গান্ধীজি বোম্বাইতে একটি সভায় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আসবার খবর তিনি জানতে পারলেন। তিনি বেশ কিছু পূর্বেই সভাস্থলে উপস্থিত হলেন। সভাস্থলের সামনে কয়েক হাজার শ্রোতা অপেক্ষা করছিল। গান্ধীজি মঞ্চে উঠামাত্রই রণদিভে মঞ্চে চিৎকার করে গান্ধীজিকে বললেন, "আপনি আমাদের সাথে বেইমানী করেছেন কারণ আপনি ভগৎ সিংহের ফাঁসিকে সমর্থন করেছেন আর মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করে অন্তরীন রাখাটাও সমর্থন করেছেন।" এই কথা বলে রণদিভে মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন। গান্ধীজি কোন কথা বললেন না। সভাস্থলে একটা নিস্তব্ধতার মধ্যে হাজার হাজার শ্রোতা এটা লক্ষ করলেন।
*************************************
ইতিমধ্যে অনেকটা আপোষের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হল। দেশ ভাগও হল। নেহেরু সরকার শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী মানুষের ন্যায্য দাবীতে লড়াই সংগ্রামের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনল। পার্টি লড়াই সংগ্রামকে জারী রাখার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু পার্টির সাধারণ সম্পাদক যোশীর বক্তব্য সময় জঙ্গী আন্দোলন করলে সরকারী আক্রমণ আরও তীব্র হবে। অতএব এটা না করে নেহেরু সরকারকে কাজ করতে দেওয়া উচিৎ। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নেহেরু এবং তাঁর অনুগামীদের অপসারিত করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও দাঙ্গার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের অনুগামী সরকার গঠন করতে তৎপর। অতএব এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় হচ্ছে সংযুক্ত গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করা যেটা শুধু বামপন্থীদের দ্বারা গঠিত না করে গান্ধী থেকে নেহেরু, সমস্ত সোস্যালিস্ট শক্তি, কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য বামপন্থীদের নিয়ে গঠন করা এবং কাজ করা। যোশীর বক্তব্য নিয়ে পার্টির মধ্যে আলোড়ন শুরু হল। কেন্দ্রীয় কমিটি অবশ্য যোশীর বক্তব্য খারিজ করে দিল। এদিকে রণদিভে এবং ভবানী সেন ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভুল ব্যাখ্যা করে বললেন ভারতের স্বাধীনতা একটা প্রহসন। তাঁরা বললেন যে ভারতের জাতীয় বুর্জোয়ারা সাম্রাজ্যবাদী-জমিদার ও বুর্জোয়া ঐক্যের ছোট শরিক। এঁদের এই ব্যাখ্যা পার্টির মধ্যে আর এক সংকট সৃষ্টি করল।
*************************************
তিনি ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের পরামর্শ দিতেন যে ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা, জাত-পাতের কোন প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। সকলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। তিনি আরও বলতেন যে ট্রেড ইউনিয়নে অথনৈতিক দাবী অবশ্যই স্থান পাবে কিন্তু সেটা যেন একমাত্র দাবী না হয়। ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের সমাজের সকলের স্বার্থে কর্মকান্ড চালাতে হবে। কৃষকদের স্বার্থে কাজ করতে হবে।
*************************************
দেশ স্বাধীন হওয়ার একদিন পূর্বে ১৪ই আগষ্ট, ১৯৪৭ এ নাম্বুদ্রিপাদ সহ অনেক কমিউনিস্টকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তিপ্রাপ্তদের তালিকায় গোপালনের নাম থাকা সত্ত্বেও তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয় না। গোপালন একটি জাতীয় পতাকা নিয়ে আরও কয়েকজনের সাথে কারাগারের মধ্যে ১৫ই আগষ্ট প্রাতঃকালে পতাকা উত্তোলন করেন।
*************************************
১৯২৯ সালে পুলিশ 'মেছুয়া বাজার মামলায়" নিরঞ্জন সেন, সতীশ পাকড়াশী, পান্নালাল দাসগুপ্ত, সুধাংশু দাসগুপ্ত এবং আরও অনেককে গ্রেফতার করে। প্রমোদ দাসগুপ্ত গ্রেফতার হননি। এইসব বিপ্লবীদের আর্থিক অবস্থা খুবই সঙ্গীন ছিল। মামলার ব্যয় বহন করা কষ্টসাধ্য হচ্ছিল। বাইরে থেকে প্রমোদ দাসগুপ্ত এ ব্যাপারে যথাসাধ্য করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি আর্থিক সাহায্যের জন্য তৎকালীন খ্যাতনামা কংগ্রেস নেতা সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন কিন্তু বসু আর্থিক সাহায্যের ব্যাপারে সরাসরি আপত্তি জানান কারণ তিনি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলেন।
*************************************
১৯২৭ সালে ভারতে সাইমন কমিশনের প্রতিনিধিরা আগমন করেন। কংগ্রেস সাইমন কমিশনের বিরোধিতা করে। সর্বত্র বিক্ষোভ শুরু হয়। কমিশন বেনারস পৌঁছালে রামমূর্ত্তি অন্যান্য ছাত্রদের সাথে নিয়ে এই কমিশনের বিরোধিতা করে আওয়াজ উঠান "সাইমন কমিশন গো ব্যাক"। রামমূর্ত্তি ভগত সিংয়ের প্রতিষ্ঠিত 'নওজোয়ান ভারত সভাতে' যোগদান করেন এবং তিনি এই সংগঠনে সক্রিয়তার সাথে কর্মকান্ড চালাতে থাকেন। তিনি 'জাতপাত তোড়ো মন্ডলের' সদস্য হন।
*************************************
১৯২০ সালের শেষে লাহোরে কংগ্রেস পার্টির সম্মেলনে রামমূর্ত্তি একজন দর্শক হিসেবে যোগদান করেন। এই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় যে প্রতিবছর ২৬শে জানুয়ারী ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করা হবে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রামমূর্ত্তি ও অন্যান্য ছাত্ররা বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কর্মসূচী নির্দিষ্ট দিনে পালন করেন।
*************************************
রামমূর্ত্তি শেষ ট্রেড ইউনিয়ন সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কোয়েম্বাটুরে। ১৯৮৭ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর গুরুতর অসুস্থ হয়ে সরকারী জেনারেল হাসপাতালে ভর্ত্তি হন এবং আইসিইউতে রাখা হয়। ৪০ দিন ব্যাপী চিকিৎসার পর একটু সুস্থ হয়ে গৃহে প্রত্যাবর্ত্তন করেন। আবার একই হাসপাতালে ২৪শে নভেম্বর ভর্ত্তি হন। রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাঁকে নিয়মিত দেখতে যেতেন। রাষ্ট্রপতি বেঙ্কটরমন তাঁর সুস্থতা কামনা করে পুষ্পস্তবক প্রেরণ করেন। এই সময় কেন্দ্রীয় সরকার হঠাৎ দেশের মহান স্বাধীনতা যোদ্ধা হিসেবে ৯০ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করে। যার মধ্যে নাম ছিল নাম্বুদ্রিপাদ, হরকিষেণ সিং সুরজিৎ, রামমূর্ত্তি, বি টি রণদিভে, সমর মুখার্জী, রাষ্ট্রপতি ভেঙ্কটরমন ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জৈল সিং। সরকারী অফিসাররা যখন স্বাধীনতা সংগ্রামী পেনশনের কথা হাসপাতালে রামমূর্ত্তিকে জানাতে যান, অফিসারদের পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয় যে পার্টি ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে পার্টির কেউ স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে সরকার থেকে কোন পেনশন গ্রহণ করবে না। অফিসাররা বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যান।
*************************************
সুরজিৎ বিপ্লবী ভগৎ সিং প্রতিষ্ঠিত 'নওজোয়ান ভারত সভা'র সদস্য হন।
*************************************
পূর্ব ইউরোপ এবং সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর কিউবাতে খাদ্য সংকট দেখা দিল। সুরজিৎ পার্টির মধ্যে একটি প্রস্তাব দিলেন যে সিপিআই(এম) কিউবাতে ভাতৃপ্রতিম সাহায্য হিসাবে গম প্রেরণ করবে। পার্টির মধ্যে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন যে এত গম কি করে সংগ্রহ করা যাবে। পার্টি ১০ হাজার টন গম সংগ্রহ করল যাতে সুরজিতের অবদান বিশাল। মোট ৫ কোটি টাকা মূল্যের খাদ্যসামগ্রী নিয়ে জাহাজে করে সুরজিৎ কিউবাতে গেলেন এবং ফিদেল কাস্ত্রো নিজে জাহাজঘাটে উপস্থিত হয়ে সুরজিতের কাছ থেকে খাদ্যসামগ্রী গ্রহণ করলেন।
*************************************
শোকজ্ঞাপন পুস্তকে দেশের রাষ্ট্রপতি কে.আর.নারায়ণন লেখেন - "ই এম এস বিংশ শতাব্দীর এক বিশাল ব্যক্তিত্ব এবং একজন সংগ্রামী জাতীয়তাবাদী যিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে বিপ্লবী ধারাকে যুক্ত করেন। তিনি একজন সমৃদ্ধ চিন্তাবিদ যিনি সঠিক রণনীতি এবং কৌশল প্রয়োগ করে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে অগ্রগতির পথে নিয়ে গেছেন। তাঁর নাম ভারতীয় জনগণ চিরকাল স্মরণে রাখবে।"
*************************************
১৯৪৩ সালে বাংলায় এক ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ হয়। প্রায় ৪৫ লক্ষ মানুষের এতে মৃত্যু হয়। কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েকশত খিচুড়ী রান্নাঘর চালু করা হয় এবং সাধ্যমত মানুষকে এই খাদ্য সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও Bengal Medical Relief Co-ordination Committee গঠিত হয় যার সভাপতি হন ডাঃ বিধান রায় এবং সম্পাদক হন জ্যোতি বসু।