Thursday, 9 December 2021

নবরত্ন - এস.কে.ব্রহ্ম

গান্ধীজি বোম্বাইতে একটি সভায় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আসবার খবর তিনি জানতে পারলেন। তিনি বেশ কিছু পূর্বেই সভাস্থলে উপস্থিত হলেন। সভাস্থলের সামনে কয়েক হাজার শ্রোতা অপেক্ষা করছিল। গান্ধীজি মঞ্চে উঠামাত্রই রণদিভে মঞ্চে চিৎকার করে গান্ধীজিকে বললেন, "আপনি আমাদের সাথে বেইমানী করেছেন কারণ আপনি ভগৎ সিংহের ফাঁসিকে সমর্থন করেছেন আর মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করে অন্তরীন রাখাটাও সমর্থন করেছেন।" এই কথা বলে রণদিভে মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন। গান্ধীজি কোন কথা বললেন না। সভাস্থলে একটা নিস্তব্ধতার মধ্যে হাজার হাজার শ্রোতা এটা লক্ষ করলেন।  

*************************************

ইতিমধ্যে অনেকটা আপোষের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হল। দেশ ভাগও হল। নেহেরু সরকার শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী মানুষের ন্যায্য দাবীতে লড়াই সংগ্রামের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনল। পার্টি লড়াই সংগ্রামকে জারী রাখার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু পার্টির সাধারণ সম্পাদক যোশীর বক্তব্য  সময় জঙ্গী আন্দোলন করলে সরকারী আক্রমণ আরও তীব্র হবে। অতএব এটা না করে নেহেরু সরকারকে কাজ করতে দেওয়া উচিৎ। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নেহেরু এবং তাঁর অনুগামীদের অপসারিত করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও দাঙ্গার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের অনুগামী সরকার গঠন করতে তৎপর। অতএব এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় হচ্ছে সংযুক্ত গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করা যেটা শুধু বামপন্থীদের দ্বারা গঠিত না করে গান্ধী থেকে নেহেরু, সমস্ত সোস্যালিস্ট শক্তি, কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য বামপন্থীদের নিয়ে গঠন করা এবং কাজ করা। যোশীর বক্তব্য নিয়ে পার্টির মধ্যে আলোড়ন শুরু হল। কেন্দ্রীয় কমিটি অবশ্য যোশীর বক্তব্য খারিজ করে দিল। এদিকে রণদিভে এবং ভবানী সেন ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভুল ব্যাখ্যা করে বললেন ভারতের স্বাধীনতা একটা প্রহসন। তাঁরা বললেন যে ভারতের জাতীয় বুর্জোয়ারা সাম্রাজ্যবাদী-জমিদার ও বুর্জোয়া ঐক্যের ছোট শরিক। এঁদের এই ব্যাখ্যা পার্টির মধ্যে আর এক সংকট সৃষ্টি করল।

*************************************    

তিনি ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের পরামর্শ দিতেন যে ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা, জাত-পাতের কোন প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। সকলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। তিনি আরও বলতেন যে ট্রেড ইউনিয়নে অথনৈতিক দাবী অবশ্যই স্থান পাবে কিন্তু সেটা যেন একমাত্র দাবী না হয়। ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের সমাজের সকলের স্বার্থে কর্মকান্ড চালাতে হবে। কৃষকদের স্বার্থে কাজ করতে হবে।  

*************************************    

দেশ স্বাধীন হওয়ার একদিন পূর্বে ১৪ই আগষ্ট, ১৯৪৭ এ নাম্বুদ্রিপাদ সহ অনেক কমিউনিস্টকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তিপ্রাপ্তদের তালিকায় গোপালনের নাম থাকা সত্ত্বেও তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয় না। গোপালন একটি জাতীয় পতাকা নিয়ে আরও কয়েকজনের সাথে কারাগারের মধ্যে ১৫ই আগষ্ট প্রাতঃকালে পতাকা উত্তোলন করেন। 

*************************************

১৯২৯ সালে পুলিশ 'মেছুয়া বাজার মামলায়" নিরঞ্জন সেন, সতীশ পাকড়াশী, পান্নালাল দাসগুপ্ত, সুধাংশু দাসগুপ্ত এবং আরও অনেককে গ্রেফতার করে। প্রমোদ দাসগুপ্ত গ্রেফতার হননি। এইসব বিপ্লবীদের আর্থিক অবস্থা খুবই সঙ্গীন ছিল। মামলার ব্যয় বহন করা কষ্টসাধ্য হচ্ছিল। বাইরে থেকে প্রমোদ দাসগুপ্ত এ ব্যাপারে যথাসাধ্য করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি আর্থিক সাহায্যের জন্য তৎকালীন খ্যাতনামা কংগ্রেস নেতা সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন কিন্তু বসু আর্থিক সাহায্যের ব্যাপারে সরাসরি আপত্তি জানান কারণ তিনি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলেন। 

*************************************

১৯২৭ সালে ভারতে সাইমন কমিশনের প্রতিনিধিরা আগমন করেন। কংগ্রেস সাইমন কমিশনের বিরোধিতা করে। সর্বত্র বিক্ষোভ শুরু হয়। কমিশন বেনারস পৌঁছালে রামমূর্ত্তি অন্যান্য ছাত্রদের সাথে নিয়ে এই কমিশনের বিরোধিতা করে আওয়াজ উঠান "সাইমন কমিশন গো ব্যাক"। রামমূর্ত্তি ভগত সিংয়ের প্রতিষ্ঠিত 'নওজোয়ান ভারত সভাতে' যোগদান করেন এবং তিনি এই সংগঠনে সক্রিয়তার সাথে কর্মকান্ড চালাতে থাকেন। তিনি 'জাতপাত তোড়ো মন্ডলের' সদস্য হন।

*************************************

১৯২০ সালের শেষে লাহোরে কংগ্রেস পার্টির সম্মেলনে রামমূর্ত্তি একজন দর্শক হিসেবে যোগদান করেন। এই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় যে প্রতিবছর ২৬শে জানুয়ারী ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করা হবে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রামমূর্ত্তি ও অন্যান্য ছাত্ররা বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কর্মসূচী নির্দিষ্ট দিনে পালন করেন।        

*************************************

রামমূর্ত্তি শেষ ট্রেড ইউনিয়ন সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কোয়েম্বাটুরে। ১৯৮৭ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর গুরুতর অসুস্থ হয়ে সরকারী জেনারেল হাসপাতালে ভর্ত্তি হন এবং আইসিইউতে রাখা হয়। ৪০ দিন ব্যাপী চিকিৎসার পর একটু সুস্থ হয়ে গৃহে প্রত্যাবর্ত্তন করেন। আবার একই হাসপাতালে ২৪শে নভেম্বর ভর্ত্তি হন। রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাঁকে নিয়মিত দেখতে যেতেন। রাষ্ট্রপতি বেঙ্কটরমন তাঁর সুস্থতা কামনা করে পুষ্পস্তবক প্রেরণ করেন। এই সময় কেন্দ্রীয় সরকার হঠাৎ দেশের মহান স্বাধীনতা যোদ্ধা হিসেবে ৯০ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করে। যার মধ্যে নাম ছিল নাম্বুদ্রিপাদ, হরকিষেণ সিং সুরজিৎ, রামমূর্ত্তি, বি টি রণদিভে, সমর মুখার্জী, রাষ্ট্রপতি ভেঙ্কটরমন ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জৈল সিং। সরকারী অফিসাররা যখন স্বাধীনতা সংগ্রামী পেনশনের কথা হাসপাতালে রামমূর্ত্তিকে জানাতে যান, অফিসারদের পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয় যে পার্টি ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে পার্টির কেউ স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে সরকার থেকে কোন পেনশন গ্রহণ করবে না। অফিসাররা বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যান।

*************************************

সুরজিৎ বিপ্লবী ভগৎ সিং প্রতিষ্ঠিত 'নওজোয়ান ভারত সভা'র সদস্য হন।

*************************************

পূর্ব ইউরোপ এবং সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর কিউবাতে খাদ্য সংকট দেখা দিল। সুরজিৎ পার্টির মধ্যে একটি প্রস্তাব দিলেন যে সিপিআই(এম) কিউবাতে ভাতৃপ্রতিম সাহায্য হিসাবে গম প্রেরণ করবে। পার্টির মধ্যে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন যে এত গম কি করে সংগ্রহ করা যাবে। পার্টি ১০ হাজার টন গম সংগ্রহ করল যাতে সুরজিতের অবদান বিশাল। মোট ৫ কোটি টাকা মূল্যের খাদ্যসামগ্রী নিয়ে জাহাজে করে সুরজিৎ কিউবাতে গেলেন এবং ফিদেল কাস্ত্রো নিজে জাহাজঘাটে উপস্থিত হয়ে সুরজিতের কাছ থেকে খাদ্যসামগ্রী গ্রহণ করলেন।

*************************************

শোকজ্ঞাপন পুস্তকে দেশের রাষ্ট্রপতি কে.আর.নারায়ণন লেখেন - "ই এম এস বিংশ শতাব্দীর এক বিশাল ব্যক্তিত্ব এবং একজন সংগ্রামী জাতীয়তাবাদী যিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে বিপ্লবী ধারাকে যুক্ত করেন। তিনি একজন সমৃদ্ধ চিন্তাবিদ যিনি সঠিক রণনীতি এবং কৌশল প্রয়োগ করে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে অগ্রগতির পথে নিয়ে গেছেন। তাঁর নাম ভারতীয় জনগণ চিরকাল স্মরণে রাখবে।"

*************************************

১৯৪৩ সালে বাংলায় এক ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ হয়। প্রায় ৪৫ লক্ষ মানুষের এতে মৃত্যু হয়। কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েকশত খিচুড়ী রান্নাঘর চালু করা হয় এবং সাধ্যমত মানুষকে এই খাদ্য সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও Bengal Medical Relief Co-ordination Committee গঠিত হয় যার সভাপতি হন ডাঃ বিধান রায় এবং সম্পাদক হন জ্যোতি বসু।

শহীদ-ই-আজম ভগৎ সিং

 ফাঁসি নয়, গুলি করে আমাদের হত্যা করুন 

(লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা ডিফেন্স কমিটি'র আইনবিদদের সিদ্ধান্ত ছিল ফাঁসি থেকে ভগৎ সিং এবং তাঁর দুই সহকর্মীকে বাঁচাতে ব্যাপক চেষ্টা চালাবার জন্য ফাঁসির দিনটি পিছিয়ে দেওয়া। এর একটাই পথ খোলা ছিল, গভর্ণরের কাছে দয়া ভিক্ষা করা। কিন্তু সবাই জানত ভগৎ সিংকে দিয়ে কিছুতেই তা করানো যাবে না। ১৯৩১ সালের ১৯শে মার্চ অ্যাডভোকেট প্রাণনাথ মেহেতা জেলে ওঁদের সঙ্গে দেখা করতে যান। ভগৎ সিং তাঁর কথা শুনতেন। তিনি বারবার মার্সি পিটিশন দেবার কথা বলেন এবং পিটিশনের ভাষা অপমানজনক হবে না বলে আশ্বাস দেন। অবশেষে ভগৎ সিং বলেন, "ঠিক আছে, লিখে আনুন"। পরদিন পিটিশনের খসড়া নিয়ে শ্রী মেহেতা জেলে দেখা করলে ভগৎ সিং বলেন 'মার্সি পিটিশন' তিনি নিজেই পাঠিয়ে দিয়েছেন। এটি ভগৎ সিং-এর সেই ঐতিহাসিক পত্র।)

প্রিয় মহাশয়,

সবিনয় নিবেদন এই যে, লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার শুনানির জন্য ভারতে বৃটিশ সরকারের সর্বোচ্চ আধিকারিক ভাইসরয় একটি বিশেষ অর্ডিনান্স বলে এক ট্রাইবুন্যাল গঠন করেছিলেন। এই ট্রাইবুন্যাল ১৯৩০ সালের অক্টোবর মাসে আমাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছে। আমার বিরুদ্ধে আনীত সবচেয়ে বড় অভিযোগ হল আমি সম্রাট পঞ্চম জর্জের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। ট্রাইবুন্যালের এই সিদ্ধান্ত থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রথমতঃ ইংরেজ জাতি এবং ভারতীয় জনতার মধ্যে যুদ্ধ চলছে এবং দ্বিতীয়তঃ আমি নিশ্চিতভাবে এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছি, সুতরাং আমি একজন রাজদ্রোহী যুদ্ধবন্দী। যদিও এই অভিযোগের ব্যাখ্যাকে অতিশয়োক্তির সীমায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তবুও আমি একথা না বলে পারি না যে, এর দ্বারা আমায় সম্মানিত করা হয়েছে।

প্রথম বিষয়টির ওপর আমি কিছুটা বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করতে চাই। আমার ধারণা প্রত্যক্ষভাবে কোন লড়াই এখনো শুরু হয়নি। যুদ্ধ শুরু হবার ব্যাপারে ট্রাইবুন্যালের মতামত কি, তা আমার জানা নেই। তবু আমি বিষয়টি স্বীকার করে নিচ্ছি এবং সেই সঙ্গে বিষয়টির সম্পর্কে একটি সঠিক ধারণা আমি দিতে চাই।

আমি এই কথা বলতে চাই যে, যুদ্ধ শুরু হয়েছে এবং যতদিন ভারতীয় জনগণ এবং শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার উপায়গুলির ওপর ক্ষমতাশালী ব্যক্তির একাধিপত্য কায়েম থাকবে ততদিন পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলবে, তা সেই ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ইংরেজ পুঁজিপতি, ইংরেজ শাসকই হন অথবা পুরোপুরি ভারতীয়ই হোন। যদি বিশুদ্ধ ভারতীয় পুঁজিপতিদের দ্বারাই কেবল গরীবের রক্ত শোষণ চলতে থাকে, তবুও পরিস্থিতির খুব বেশি পরিবর্তন হবে না। যদি আপনার সরকার কিছু নেতা এবং সমাজের কিছু প্রধান ব্যক্তির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে, যদি কিছু সুবিধা পাইয়ে দেয় অথবা উভয়পক্ষে একটা সমঝোতা হয়ে যায়, তাতেও পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হতে পারে না। জনগণের ওপর এসব কথার প্রভাব খুবই কম।

দেশের যুবকদের আরেকবার ঠকানো হল, একথা ভেবে আমি দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন নই। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা পথভ্রষ্ট হয়েছেন এবং ইংরেজের সঙ্গে আপোষ আলোচনার সময় সেইসব গৃহহারা, নিরাশ্রয়, নিবেদিত প্রাণ সংগ্রামীদের কথা ভুলে গিয়েছেন যাদের দুর্ভাগ্যক্রমে বিপ্লবী পার্টির সদস্য বলে তাঁরা মনে করেন। একথা ভেবেও আমি ভয় পাই না। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা বিপ্লবীদের শত্রু মনে করেন, কারণ তাঁদের বিচারে এরা হিংসায় বিশ্বাসী। আমাদের বীরাঙ্গনারা নিজেদের সব কিছুই বিসর্জন দিয়েছেন। তাঁরা নিজেদের স্বামীদের আত্মদানের বেদীমূলে প্রেরণ করেছেন। তাঁরা নিজেরাই নিজেদের নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু আপনার সরকার তাঁদের বিদ্রোহী মনে করে। আপনাদের দালালরা মিথ্যা কাহিনী তৈরী করে ওঁদের বদনাম দেয় এবং পার্টির সুনামের হানি ঘটাবার চেষ্টা করে। কিন্তু তবুও যুদ্ধ চলছে।

বিভিন্ন সময় এই যুদ্ধ ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করবে। কখনো প্রকাশ্য লড়াই চলবে, কখনো সংগ্রাম চলবে গোপনে। কখনো তা বিক্ষোভের স্তরে থাকবে আবার কখনো মরণপণ সংগ্রাম শুরু হবে। রক্তাক্ত সংগ্রাম হবে, না তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ পথে লড়াই হবে, তা নির্ভর করছে আপনি কোন পথে চলবেন তার ওপর। কাজের পথ আপনিই বেছে নিন। কিন্তু সংগ্রাম চলবেই, তুচ্ছ বিষয়গুলি অবহেলা করে, অর্থহীন নীতিবাগীশ আদর্শবাদকে উপেক্ষা করে নিরবিচ্ছিন্ন লড়াই চলবে। নবীন উদ্যম, অপরিসীম দৃঢ়তা, অপ্রতিরোধ্য সংকল্প নিয়ে সংগ্রাম চলবে যতদিন না সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যতদিন না বর্তমান সমাজব্যবস্থাকে উৎখাত করে সমাজের অবাধ সমৃদ্ধির ভিত্তিতে নতুন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা যায় এবং এই পথে সমস্ত ধরণের শোষণের অবসান ঘটানো যায়। এই পথেই মানব সভ্যতা এগিয়ে যাবে স্থায়ী শান্তির এক নতুন যুগে। অচিরেই শুরু হবে আখেরি লড়াই এবং চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে যাবে।

পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী শোষণের দিন ফুরিয়ে আসছে। এ সংগ্রাম আমরা শুরু করিনি, আমাদের জীবনাবসানের সঙ্গে সঙ্গে এ সংগ্রাম শেষ হয়ে যাবে না। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে,বর্তমান বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই সংগ্রাম অনিবার্যভাবে গড়ে উঠেছে। আমাদের মৃত্যুতে আত্মদানের পুষ্পমাল্যে আর একটি নতুন ফুল গাঁথা হবে। যতীন দাসের অতুলনীয় আত্মদান, ভগবতীচরণের হৃদয়বিদারক অথচ মহান আত্মদান এবং আমাদের প্রিয় সংগ্রামী সাথী আজাদের গৌরবময় আত্মদান ইতিমধ্যেই আত্মদানের সেই পুষ্পমাল্যটিকে বর্ণোজ্জ্বল করেছে।

আমাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে একথা বললে বোধ হয় আপনি দ্বিমত হবেন না যে, আপনি আমাকে ফাঁসি দিতে কৃতসংকল্প এবং আপনি তা করবেনই। আপনার হাতে ক্ষমতা আছে এবং আপনারা মনে করেন ক্ষমতার জোরেই কৃতকর্মের যৌক্তিকতা প্রমাণ করা যায়। আমরা জানি, 'জোর যার, মুলুক তার' - এই নীতি নিয়েই আপনি চলেন। আমাদের বিচারের প্রহসন এর জ্বলন্ত প্রমাণ।

আমরা বলতে চাই, আপনার আদালতের সিদ্ধান্ত হল আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছি অর্থাৎ আমরা যুদ্ধবন্দী। আমরা তাই যুদ্ধবন্দীসুলভ ব্যবহার চাই। আমরা বলতে চাই, ফাঁসি নয়, আমাদের গুলি করে হত্যা করা হোক। আপনার আদালতের বক্তব্যকে আপনি মূল্য দেন একথা প্রমাণের দায়িত্ব আপনার।

আমাদের অনুরোধ এবং আশা, আপনি অনুগ্রহ করে সেনাদপ্তরে আদেশ দিন, তারা যেন সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে আমাদের হত্যা করে।

নিবেদক 

ভগৎ সিং, রাজগুরু, শুকদেব

কীভাবে পশ্চিমবঙ্গে এই পরিবর্তন হলো - দীপক নাগ

গত শতকের ষাটের দশক থেকেই পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র চলছে। বামপন্থীরা যাতে নির্বাচনের মাধ্যমেও ক্ষমতার কাছাকাছি না আসতে পারে তার জন্য মার্কিনিরা দেদার টাকা খরচ করা সহ সমস্ত রকম চেষ্টা চালিয়েছে। ভারতে নিযুক্ত আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ডেনিয়াল প্যাট্রিক ময়নিহান ১৯৭৮ সালে 'এ ডেঞ্জারাস প্লেস' নাম একটি বই প্রকাশ করেন। বইটিতে তিনি বলেন, 'আমরা দুবার - মাত্র দুবার, ভারতের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছি। এজন্য আমরা একটা রাজনৈতিক দলকে টাকা দিয়েছিলাম। দুবারই রাজ্য (বিধানসভা) নির্বাচনের আগে কমিউনিস্টদের সম্ভাব্য বিজয় ঠেকানোর জন্যই আমরা এটা করেছিলাম। একবার কেরালা আর একবার পশ্চিমবঙ্গে - যেখানে কলকাতা অবস্থিত - আমরা টাকা দিয়েছিলাম" (পৃ: ৪১)। ১৯৫৭ সালে কেরালা বিধানসভা নির্বাচনে যাতে বামপন্থীরা সরকার গঠন করতে না পারে, তার জন্যই ময়নিহান টাকা দিয়েছিলেন। আর ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের সম্ভাব্য বিজয় ঠেকানোর জন্যই আমেরিকা টাকা ঢেলেছিল। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধি ১৯৫৭ সালে ছিলেন কংগ্রেসের সভানেত্রী, আর ১৯৬৭ সালে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। বহুল প্রচারিত ময়নিহানের এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে কংগ্রেস কিন্তু কোনো আপত্তি জানায়নি। স্বাধীনতার পর থেকেই কমিউনিস্টরা যাতে ভারতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা না নিতে পারে, তার জন্য প্রত্যেক নির্বাচনের আগে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে। দিব্যি কেটে ময়নিহান দুবার ভারতের নির্বাচনে আমেরিকার হস্তক্ষেপের কথা বললেও ব্যাপারটা যে সেখানেই থেমে থাকেনি, পরবর্তী অনেক ঘটনাতেই তার প্রমাণ মেলে।

ইন্দিরা গান্ধি হত্যার পর ১৯৮৫ সালে ভারতে মধ্যবর্তী নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনেই তখন পর্যন্ত রাজ্য রাজনীতিতে সম্পূর্ণ অপরিচিত মমতা ব্যানার্জি বামপন্থীদের দুর্গ বলে পরিচিত যাদবপুর কেন্দ্র থেকে সবাইকে অবাক করে দিয়ে জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনের আগে কী ঘটেছিলো রুস্তেম গ্যালুইলিন-এর ' দ্য সি আই এ ইন এশিয়া' (১৯৮৮) থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি উল্লেখ করেন : "অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপ-সেনাপ্রধান এস কে সিং পশ্চিমবঙ্গে সিবিআই-র কাছে এক বিবৃতি দেন। সিং স্বীকার করেন যে, আমেরিকার রাষ্ট্রদূত জর্জ শেরম্যান একজন মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির ছদ্মবেশে তাঁর কাছে এক প্রস্তাব নিয়ে কলকাতায় আসেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাঁকে ১৯৮৫ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি সাধারণ নির্বাচনের আগে নিজস্ব কর্মসূচি অনুযায়ী একটা আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার কথা বলেন। রাজনৈতিক দলটি মার্কিন দূতাবাসের ছত্রছায়ায় কাজ করবে। এই দলটিকে সমস্ত বামপন্থী রাজনৈতিক দলের এবং ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিপক্ষ শক্তি হিসেবে কাজ করতে হবে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেনারেলকে জানান, দল গড়ার জন্য সমস্ত টাকা তিনিই খরচ করবেন। এই ঘটনার কথা উল্লেখ করে 'দ্য হিন্দুস্তান টাইমস' পত্রিকা বিষয়টিকে রাজনৈতিক উপায়ে হোয়াইট হাউসের নির্দেশ জারির চেষ্টা বলে উল্লেখ করে"। এর আগে ১৯৮০ সালের ১৮ ডিসেম্বর 'পিপলস ডেমোক্রেসি' পত্রিকায় ভারতের রাজনীতিতে সিআইএ-র হস্তক্ষেপ সম্বন্ধে একটা বেশ বড় প্রবন্ধ ছাপা হয়। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত কার মাধ্যমে এবং কীভাবে কার্যকর করা হয়, তা নিয়ে নানা কথা বাজারে চালু আছে। তবে মার্কিন দূতাবাসের তরফ থেকে যে বিভিন্ন সময়ে মেদিনীপুর, বীরভূম, দার্জিলিঙ, কলকাতা, নন্দীগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে মাওবাদী-তৃণমূলসহ বিভিন্ন মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে একাধিক সভা করা হয়েছে তা নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছে। মার্কিনিরা পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে যে কতখানি উৎসাহী উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্য থেকেই তা স্পষ্ট হয়। রাজ্যের নির্বাচনের মাসখানেক আগেই 'দ্য হিন্দু' পত্রিকায় ২১ এপ্রিল, ২০১১ প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে, ২০০৯ সালের মে মাসে লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের কিছু আসন বেড়ে যাওয়ার পর ২০ অক্টোবর কেবল ২৩০৩৫৩ মারফত আমেরিকার কনসাল জেনারেল বেথ এ পেইন তাঁর সরকারকে পশ্চিমবঙ্গের আগামী বিধানসভা নির্বাচনে আমেরিকার করণীয় কাজ সম্বন্ধে কিছু পরামর্শ দেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি কতখানি সফল হবেন, তা নিয়ে সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও পেইন জানান, "মমতা ব্যানার্জি বর্তমানে রেল দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে এখনও আমেরিকা সফরে না গেলেও মার্কিন সরকারের উচিত পশ্চিমবাংলার "ভাবী মুখ্যমন্ত্রী" হিসেবে তাঁকে মদত দেওয়া চালিয়ে যাওয়া। তাঁর দল তৃণমূল কনফারেস প্রকাশ্যে কখনও আমেরিকার বিরোধিতা করেনি। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে যে, ব্যানার্জি পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ সরকার বর্তমান সিপিআই(এম) পরিচালিত সরকারের চাইতে আমেরিকার প্রতি বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ হবে।" পশ্চিমবাংলা বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে ২০১১ সালের মে মাসে আর ২০০৯ সালেই কলকাতার মার্কিন কনসাল জেনারেল মমতা ব্যানার্জিকে রাজ্যের "ভাবী মুখ্যমন্ত্রী" হিসেবে চিহ্নিত করে আমেরিকায় বার্তা পাঠাচ্ছেন এবং মদত চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন। ব্যাপারটা কী আমাদের একটুও ভাবায় না? তারপর মার্কিন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিন্টন ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের নজিরবিহীনভাবে ভারতের কোন একটা রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎকার কী নিছকই একটা সহজ-সরল ব্যাপার?

আচ্ছা, কোন বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রী যদি জাল 'ডক্টরেট' ডিগ্রিধারী হতেন কিংবা সংবিধান হাতে 'বাপের জমিদারি' বলে চিৎকার করে কোনো বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাম এমএলএ-রা যদি অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করতে করতে বিধানসভা ভাঙচুর করতেন - তাহলে বাংলার কথা বাদ দিন, সারা দুনিয়াতেই বামপন্থীদের কী বলে ডাকা হতো? তাছাড়া গত আড়াই বছরে রাজ্যে যা ঘটেছে যেমন, পার্ক স্ট্রিট, রায়গঞ্জ, ভাঙড়, কামদুনি, ফেসবুক, সারদা, মগরাহাট, কালীঘাট থানা, প্রেসিডেন্সি কলেজ, স্কুল, সার্ভিস কমিশন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগ, ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, পঞ্চায়েত নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচনে ছাপ্পা ভোট, স্কুল-কলেজের নির্বাচনে দুষ্কৃতী হামলা, পুলিস হেপাজতে সুদীপ্ত গুপ্তের হত্যা, ১৪২ জনের মতো বামপন্থী কর্মী হত্যা, হাজার হাজার কর্মী-নেতার ঘরবাড়ি ছাড়া, মিথ্যে মামলা ইত্যাদি - এর দশ ভাগের এক ভাগ ঘটনাও যদি বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রীর আমলে ঘটতো - তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াতো, একবার কেউ কল্পনা করতে পারেন? কী হতো তাহলে সংবাদ মাধ্যমগুলোর ভূমিকা? এখন প্রতিদিন গণতন্ত্র-জবাই চলছে। বামপন্থীদের প্রতিবাদ, আন্দোলন - কোন কিছুকেই দাগ কাটতে দেওয়া হচ্ছে না। একটা ঘটনাকে অন্য ঘটনা দিয়ে চাপা দেওয়া হচ্ছে। বিধানসভা তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। তথাকথিত গণতন্ত্রপ্রেমীরা নীরব। কিন্তু কেন? বুর্জোয়া গণতন্ত্রে সরকারের পৰিৱৰ্তন কোন বড় ঘটনা নয়। এর আগেও দুবার বামপন্থীদের সরকার থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর একবার সরকার গঠন করতেই দেওয়া হয়নি। কিন্তু যে প্রশ্নটা সামনে আসছে তা হলো, কীভাবে এই পরিবতন হলো? ২০০৬ সালে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে মোট ১৯৪৫৬৭৭৬ বৈধ ভোটের মধ্যে বামফ্রন্ট পায় ১৯৮০০৪২৫ ভোট। শতকরা ৫০.১৮ জন ভোটার বামফ্রন্টের কাজে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তৃণমূল-বিজেপি জোট পায় শতকরা মাত্র ২৮.৭৭ ভোট। এই নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক মানুষের সমর্থনে বামফ্রন্ট জয়লাভ করার ঠিক পরেই রাজ্যে কী এমন ঘটলো? ২০০৬ - ২০১১ সালের মধ্যে বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যের লক্ষ লক্ষ বেকারের কাজের ব্যবস্থার জন্য সিঙ্গুর, শালবনী, নয়াচর প্রভৃতি জায়গায় মৌলিক শিল্প গড়ে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করে সফলতার দোরগোড়ায় প্রায় পৌঁছে যায়। এটা যদি কোনো 'ভুল' বা 'অন্যায়' হয়, তা হলে অবশ্য আলাদা কথা। সমস্ত ক্ষেত্রেই বাধা দিয়ে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে লক্ষ লক্ষ মানুষের পেটের ভাত কেড়ে নেবার ব্যবস্থা করা হলো। বাংলার মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা এবং যুব সমাজের চরম সর্বনাশ করেও তৃণমূল ২০০৬-এর চাইতে ৮০ লক্ষের কিছু বেশি ভোট বাড়িয়ে ফেললো। কিন্তু কীভাবে? বিশেষ কোনো শক্তির মদত বা বিশেষ কোনো কৌশল গ্রহণ না করে যে একাজ করা সম্ভব নয়, পৃথিবীর সব চাইতে বোকা মানুষটিও তা বুঝতে পারে।

*****************************************************

এনজিও বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর প্রকৃত উদ্দেশ্য ও ভূমিকা নিয়ে সারা পৃথিবীতে বরাবরই একটা সন্দেহ রয়ে গেছে। সমাজবদ্ধ প্রাণী হিসেবে মানুষ মানুষের জন্য ভাববে বা সমাজটাকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে সাহায্য করবে - এটাই তো স্বাভাবিক। কারণ এই শ্রেণিবিভক্ত সমাজব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় কয়েকজন মানুষ সমাজের প্রায় সমস্ত সম্পত্তির মালিক। আর সম্পত্তি বলতে যা বোঝায়, বেশিরভাগ মানুষেরই তা নেই। তাই ব্যবস্থার পরিবর্তন চাই। ১৮৪৫ সালে সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্কস তাঁর বিখ্যাত রচনা 'থিসিস অন ফয়েরবাখ'-এ প্রথম উল্লেখ করেন : 'দার্শনিকেরা কেবল নানাভাবে জগৎকে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু আসল কথা হলো সেটাকে পরিবর্তন করা'। কমিউনিস্টরাই প্রথম সমাজ পরিবর্তনের কথা বলে এবং তা করে দেখায়। জন্মলগ্ন থেকেই পুঁজিপতিরা মুনাফার জন্য মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ তৈরি করার চেষ্টা করে চলেছে। তারা সঙ্ঘবদ্ধ শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষের ওপর নানা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। এনজিও-দের টাকার মূল উৎস সাম্রাজ্যবাদী তহবিল। সাম্রাজ্যবাদীরা অন্য দেশের শ্রমিক কৃষক ও সাধারণ গরিব মানুষের মঙ্গলের কথা ভাববে, তা কুমীরের মার পুত্রশোকের মতোই অবিশ্বাস্য। আশির দশক থেকেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এই 'ভাড়াটে সমাজসেবার ব্যবসার' রমরমা বাজার হলেও এর সূচনা কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই। ঐ বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই লেনিন 'সাম্রাজ্যবাদ - পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর' নামক তাঁর বিখ্যাত বইটি প্রকাশ করেন। মহাজনী পুঁজি বৃদ্ধি ও পুঁজি রপ্তানি - এই দুটো হলো সাম্রাজ্যবাদের মূল বিষয়। পুঁজি রপ্তানি বা বাজার দখলের জন্য অন্য দেশের সরকার এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী দেশের একটা সুন্দর ভাবমূর্তি তৈরি করা প্রয়োজন। কমিউনিস্টরা সাম্রাজ্যবাদের শত্রু। তারা শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষের সুখে দুঃখে সবসময়ই পাশে থাকে। কমিউনিস্টরাই এই শোষণমূলক সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে সাধারণ মানুষকে নতুন সমাজ গোড়ার স্বপ্ন দেখায়। বিপ্লবের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র গঠিত হওয়ার পর থেকেই পুঁজিবাদ প্রমাদ গুণতে শুরু করে।

কমিউনিস্টদের পালের হাওয়া কেড়ে নেওয়ার জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা নতুন কৌশল নেয়। মার্কিনি তেল সাম্রাজ্যের অন্যতম কর্ণধার জন রকফেলার এবং ইস্পাত শিল্পের একচেটিয়া কারবারি অ্যান্ডু কার্নেগি কমিউনিস্টদের বিকল্প হিসাবে জনসেবামূলক কাজের জন্য যথাক্রমে রকফেলার ফাউন্ডেশন এবং কার্নেগি ফাউন্ডেশন তৈরি করেন। উদ্দেশ্য : সমাজসেবার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মন থেকে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ঘৃণা কমিয়ে দিয়ে কমিউনিস্ট-বিরোধী ঘৃণা জাগিয়ে তোলা। তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই কয়েকশো ফাউন্ডেশন গড়ে ওঠে। ১৯৩৬ সালে আমেরিকার বিখ্যাত ফোর্ড মোটর কোম্পানির উদ্যোগে গড়ে ওঠে ফোর্ড ফাউন্ডেশন। একইভাবে কেলগ ফাউন্ডেশন, গ্রান্ট ফাউন্ডেশন, ফ্রিডম রিসার্চ ফাউন্ডেশন, ব্রাদার্স ব্রাদার ফাউন্ডেশন, আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন, এশিয়া ফাউন্ডেশন ইত্যাদি তৈরি করা হয়। ভারতসহ তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে 'ফেলোশিপের' নামে সম্ভাবনাময় শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী প্রভৃতি বুদ্ধিজীবীদের মগজ ধোলাইয়ের জন্য আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া ছিল এইসব ফাউন্ডেশনের অন্যতম কাজ। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিলাভ করে। ফলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আশঙ্কিত হয়ে পড়ে। শুরু হয় কমিউনিস্ট বিরোধী নানা ষড়যন্ত্র। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোকে বাঁচাতে আমেরিকার স্বরাষ্ট্রসচিব জর্জ মার্শাল এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এটাই মার্শাল প্ল্যান নামে পরিচিত। এরই অঙ্গ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় 'কেয়ার' বা কো-অপারেটিভ ফর আমেরিকান রিলিফ এভরিহোয়ার। এই সংস্থার মাধ্যমেই আমেরিকা তার উদ্বৃত্ত গম বা খাদ্যদ্রব্য সারা পৃথিবীতে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে পাঠাতে শুরু করে। পি এল ৪৮০-র কথা এখনও অনেকের মনে আছে। ভারতসহ ভূখা-মানুষের দেশগুলোতে এই সাহায্য টোপ হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। কমিউনিস্ট মতাদর্শের অগ্রগতি রোধ করে তার মূল লক্ষ্য।

*****************************************************

ভিয়েতনাম যুদ্ধের খলনায়ক মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব রবার্ট ম্যাকনামারা বিশ্বব্যাঙ্কের সভাপতির দায়িত্ব নেবার পর থেকেই ভারতসহ তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দান বা সেবার মাধ্যমে 'স্বেচ্ছামূলক সেবা প্রতিষ্ঠানগুলির আন্দোলন' গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন।

*****************************************************

বিশিষ্ট মার্কিন-রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাইনর উইনার বিভিন্ন দেশের বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠীর মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মার্কিন অনুচর নিয়োগ করার দায়িত্ব পালন করেন। এইসব বুদ্ধিজীবীদের কাজের সুবিধার জন্য 'পার্টিবিহীন রাজনৈতিক সংগঠন' বা 'পার্টিবিহীন রাজনৈতিক আন্দোলন' গড়ে রোলার কথা বলা হলো।

*****************************************************
ম্যাকনামারা বা মাইরন উইনারের অ্যাকশন গ্রুপের তত্ত্বকে ভারতের মাটিতে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ভারতীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রজনী কোঠারী বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন।
*****************************************************
পরমাণু চুক্তি নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তীব্ৰ বিরোধিতা করার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হচ্ছে। আদিবাসীদের স্বার্থ দেখার নাম করে গরিব, নিরপরাধ আদিবাসীদের খুন করা হচ্ছে। আর সবই হচ্ছে মাওবাদীদের নাম করে। এ এক অদ্ভুত সমীকরণ। লালঝাণ্ডাকে যারা ঘৃণা করে, লালঝাণ্ডায় যাদের এলার্জি আছে, তাদের সঙ্গে তথাকথিত মার্কসবাদীদের আঁতাত। ম্যাকানমারা, মাইরন উইনার ও রজনী কোঠারীর সেই বিখ্যাত তত্ত্ব - হতাশাগ্রস্ত কমিউনিস্টদের সঙ্গে নিয়েই কমিউনিস্টদের ওপর আক্রমণ সংগঠিত করতে হবে। বামপন্থীদের স্লোগানসহ রাজ্যের বর্তমান বিরোধীদের প্রায় সব কিছুই ধার করা। তৃণমূল নামটাও ম্যাকানমারার 'গ্রাসরুট'-এর বাংলা অনুবাদ। পরিবর্তন-এর স্লোগানটিও তাঁর। আশ্চর্যজনকভাবে উগ্রবামপন্থী ও উগ্রদক্ষিনপন্থী সবাই এসে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে জড়ো হলেন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-লালগড় ষড়যন্ত্রের অংশীদার হিসাবে।
*****************************************************
তথাকথিত মাওবাদী সংগঠনের জন্মও কিন্তু আমেরিকায়। ১৯৭৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান দেঙ জিয়াও পিঙ আমেরিকা সফরে এলে তাঁর বিরুদ্ধে মাওবাদীদের নেতা বব অ্যাডকিয়ান হোয়াইট হাউসের সামনে বিক্ষোভ দেখান। শোনা যায় তাঁকে গ্রেফতার করে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকে দীর্ঘ ২৫ বছর তাঁর কোন হদিস পাওয়া যায়নি। তাঁর বিদেশে আত্মগোপন করার কথা শোনা যায়। কিছুদিন আগে তাঁর বক্তৃতার চার-ডিস্কের এক সিডি-র হদিশ মিলেছে। মাওবাদীদের উদ্যোগেই 'রেভোলিউশনারি ইন্টারন্যাশনাল মুভমেন্ট (রিম) গঠিত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গোরিলা বাহিনী তৈরি করে সশস্ত্র অভ্যুত্থান করাই এর উদ্দেশ্য বলে জানানো হয়েছে। ভারতের মাওবাদীরাও সেই অর্থে আমেরিকার মাওবাদীদের মতোই মাও-জে দঙ-এর নামে তাঁর চিন্তাধারার বিরোধী কাজকর্ম চালাচ্ছে। বিপ্লবের নামে প্রতিবিপ্লবীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলছে সর্বহারাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ।
*****************************************************

Wednesday, 8 December 2021

কাশ্মীর যুক্তি তর্ক সত্য - শমীক লাহিড়ী

প্রশ্ন-৫) ভারতবর্ষের সংবিধানে উল্লিখিত ৩৭০নং ধারা কি সাময়িক?

উত্তর) সংবিধানের একবিংশ অংশে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ হল ৩৭০ নং ধারা। এটা ঠিক এর শিরোনামে লেখা আছে এটা সাময়িক, পরিবর্তন সাপেক্ষ এবং বিশেষ বিধান। তাই অনেকেই ব্যাখ্যা করেন এই ধারাটি সাময়িক সময়ের জন্য রচিত হয়েছিল। জম্মু-কাশ্মীরের গণপরিষদ এবং পরবর্তীতে জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভা এই ধারার পরিবর্তন, বিলোপসাধন অথবা একই রূপে রেখে দিতে পারে। জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা এই ধারাটিকে বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, ফলে এটি সাময়িক নয়। এই নিয়ে স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে অনেক বিতর্ক দেখা যায়। ১৯৬৯ সালে সম্পৎ প্রকাশ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট এই ধারাকে সাময়িক আখ্যা দেওয়ার আবেদনকে সরাসরি নাকচ করে। দিল্লী হাইকোর্টে কুমারী বিজয়লক্ষ্মী একটি মামলায় দাবী করেন ৩৭০নং ধারা সাময়িক এবং এই ধারাটিকে বহাল রাখা আসলে সংবিধানের প্রতি জালিয়াতি। দিল্লী হাইকোর্ট এই মামলাও খারিজ করে দেয়। ২০১৮ সালের ৩রা এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট আর একটি মামলায় সরাসরি জানিয়ে দেয়, শিরোনামে সাময়িক শব্দটি লেখা থাকলেও এই ধারাটি সাময়িক নয়। বিভিন্ন সময় এই রায়গুলিতে আদালত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় এই ধারাটির শিরোনামে 'সাময়িক' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল তৎকালীন গণপরিষদকে প্রস্তাবিত ধারাটি সংশোধনী-সংযোজনী অথবা বিলোপ সাধনের অধিকার দেওয়ার জন্য। কিন্তু তৎকালীন গণপরিষদ এবং পরবর্তীতে বিধানসভা এই ধারাটি বজায় রাখার পক্ষে মত দেয়, ফলে এটি 'সাময়িক' নয়।


প্রশ্ন-৬) সংবিধানের ৩৭০নং ধারাটি কি বিলোপ করা যেতে পারে?

উত্তর) এটা ঠিক উপধারা ৩৭০(৩) অনুযায়ী ৩৭০নং ধারা বিলোপ করা যেতেই পারে রাষ্ট্রপতির আদেশের ভিত্তিতে। তবে এই আদেশের জন্য জম্মু-কাশ্মীরের গণপরিষদের সম্মতি প্রয়োজন। কিন্তু ১৯৫৭ সালের ২৬শে জানুয়ারী সেই গণপরিষদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাই সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অনেকের মত এই ধারা বিলোপ করা যায় না। আবার একাংশের ব্যাখ্যা এটি বিলোপ করতে হলে রাজ্য বিধানসভার সম্মতি প্রয়োজন। বর্তমান বিজেপি সরকার সংবিধান বিশেষজ্ঞদের এই সব মতামতের তোয়াক্কা না করে, জম্মু-কাশ্মীরের জনসাধারণকে অন্ধকারে রেখে, সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বকে কারাগারে নিক্ষেপ করে, ৭ লক্ষ ৪০ হাজার সৈনিকের বন্দুকের ডগায় সেখানকার মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে রেখে জবরদস্তি এই আইন পাশ করানোর চেষ্টা করেছে। এটা গণতন্ত্র? দেশের উন্নতির জন্য কি ৩৭০নং ধারা কোন অন্তরায় সৃষ্টি করেছে? দেশজোড়া বেকার, অসংখ্য শ্রমিক ছাঁটাই, আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি এইসব সমস্যার দিকে নজর না দিয়ে বন্দুকের ডগায় জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের কোনও মতামত না নিয়ে এই কাজ করার অর্থ কি? এটা দেশের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি সমাধানে ব্যর্থ মোদী সরকারের দৃষ্টি ঘোরানোর প্রয়াস মাত্র। দেশের বাকি ১০টি রাজ্য বিশেষ অধিকার নিয়ে চলতে পারে অথচ জম্মু-কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া হলো কেন? একাজ কি সন্ত্রাসবাদীদের আরো সাহায্য করবে না? পাকিস্তান কাশ্মীর প্রশ্নে বরাবর আন্তর্জাতিক মহল থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল প্রধানত ২টি কারণে - (ক) ভারতবর্ষ জম্মু-কাশ্মীরের মানুষকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দিয়েছিল (খ) পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদীদের জম্মু-কাশ্মীরে ব্যবহার করলেও, ভারতবর্ষ কখনও পাক অধিকৃত কাশ্মীরে কোন জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে মদত দেয়নি। ভারতবর্ষ বরাবরই শান্তিপূর্ণ-দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের পক্ষপাতী। এখন বিজেপির এই পদক্ষেপে জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাতক হিসাবে ভারতবর্ষ চিহ্নিত হবে। ৩৭০নং ধারা বিলোপ করলে ভারতবর্ষের বাকি অংশের কোন মানুষের লাভ হবে? ভারতবর্ষের বেকার যুবক কাজ পাবে? শ্রমিকের মজুরী বাড়বে? জিনিসপত্রের দাম কমবে? দেশে গরীবি কমবে? আসলে সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ মোদী সরকার ধর্মের নামে মানুষকে বিভক্ত করে রাখতে চাইছে, আর এই প্রশ্নে জম্মু-কাশ্মীর, তাঁর হাতের তুরুপের তাস। তাই ভারতবড়হ বা পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী আভ্যন্তরীন বিপদে পড়লেই, দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য জম্মু-কাশ্মীর সমস্যা পরিকল্পিতভাবে সামনে আনে।

প্রশ্ন-১২) সংবিধানের ৩৭০নং ধারা বিলোপ কি প্রয়াত শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের দাবী মেনে?

উত্তর) সংবিধানের ৩৭০নং ধারা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সময় শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন কংগ্রেস দলের সদস্য, সংসদেরও সদস্য এবং ভারতের সংবিধান রচনার জন্য তৈরী গণপরিষদেরও সদস্য। সংসদে অথবা গণপরিষদের কোনও অধিবেশনে শ্রী মুখার্জী ৩৭০নং ধারা গ্রহণ করার সময়ে আপত্তি জানাননি। সংসদে বিভিন্ন বিষয়ে তিনি অনেক বক্তৃতা করেছিলেন কিন্তু এই বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে তিনি কোন বক্তৃতা সংসদে অথবা গণপরিষদে করেননি। বরং ১৯৫৩ সালের ৯ই জানুয়ারী জওহরলাল নেহেরুকে লেখা একটি চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন - "আমাদের নিঃসঙ্কোচে শেখ আব্দুল্লার নেতৃত্বে বিশেষ সুবিধাসহ কাশ্মীর উপত্যকার অস্তিত্ব মেনে নেওয়া দরকার, যতদিন পর্যন্ত তিনি সেই বিশেষ ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন মনে করবেন"। তবে আশ্চর্যজনকভাবে নেহেরু মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের পর পুরানো অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ উল্টো পথে হেঁটে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার বিষয়টি ভারতীয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিরোধীতা শুরু করেন। দেশের শিল্পমন্ত্রী থাকাকালীন শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ৩৭০নং ধারার বিরোধিতা করেননি কারণ তিনি জানতেন আরও অনেকগুলি করদ রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ৩৭১নং ধারা যুক্ত হতে চলেছে, সংবিধানে এদের বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার জন্য। ৩৭০নং ধারার বিরুদ্ধে বিদ্বেষকে তাই ব্যবহার করা হয়েছে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করবার এবং মুসলমান বিরোধী জিগীর তোলাবার জন্য। এরা ৩৭১নং ধারার বিরোধীতা করে না কারণ এটিকে ব্যবহার করে হিন্দু-মুসলমান জনগণকে বিভক্ত করার সুযোগ নেই।

তৎকালীন কাশ্মীরে প্রবেশ করতে গেলে পারমিট নেওয়ার প্রয়োজন হত। শ্রী মুখার্জী 'এক দেশ, এক বিধান, এক নিশান, এক প্রধান' এই স্লোগানকে সামনে রেখে বিনা পারমিটে আইন ভেঙ্গে কাশ্মীর অভিযানে যান এবং গ্রেপ্তার বরণ করেন। একজন সাংসদ কি উদ্দেশ্যে বিনা পারমিটে গায়ের জোরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছিলেন! সাংসদ হিসাবে অনুমতি চাইলেই তো তিনি পারমিট নিয়েই সেখানে যেতে পারতেন। দুঃখজনকভাবে জেলবন্দী থাকা অবস্থাতেই তাঁর মৃত্যু হয়।

প্রশ্ন-১৩) ভারতীয় জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কি অবদান ছিল ভারত গঠনে?

উত্তর) ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে রাউ কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী তৎকালীন আইনমন্ত্রী শ্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল হিন্দু কোড বিল সংসদের সামনে পেশ করেন। দেশভাগ এবং স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম আইনমন্ত্রী ড. বি.আর.আম্বেদকর নেহেরুর মন্ত্রিসভার সামনে এই বিল পেশ করেন এবং তা সিলেক্ট কমিটির বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়। ১৯৪৮ সালের ১২ই আগস্ট সিলেক্ট কমিটির রিপোর্ট ড. আম্বেদকর সংসদে পেশ করেন এবং ৩১শে আগস্ট সংসদের সম্মতির জন্য উত্থাপন করেন। ১৯৪৯ সালে ২৯শে ডিসেম্বর বিলটি পেশ করার কথা থাকলেও হিন্দু মৌলবাদীদের প্রবল বিরোধীতার জন্য সেটি সংসদে পেশ করা হয় ১৯৫১ সালে ৫ই ফেব্রুয়ারী। কিন্তু শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সহ হিন্দুত্ববাদীদের প্রবল বিরোধীতায় নেহেরু সরকার কিছুটা পিছু হঠতে বাধ্য হয়।

কি ছিল এই বিলে - (ক) হিন্দু বিবাহ আইন সংশোধন, (খ) হিন্দু উত্তরাধিকার সম্পত্তি সংক্রান্ত আইন, (গ) হিন্দু নাবালক এবং অভিভাবকত্ব আইন, (ঘ) হিন্দু দত্তক গ্রহন এবং পরিচর্যা সংক্রান্ত আইন। এই আইনগুলির মাধ্যমে হিন্দুদের বহু বিবাহ রদ, হিন্দু মহিলাদের বিবাহ বিচ্ছেদ করবার অধিকার, বাল্যবিবাহ রদ, হিন্দু নারীদের সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি পরিবর্তন আনার চেষ্টা হয়েছিল। শ্রী মুখোপাধ্যায় এই আইনের বিরোধীতা করতে হয়ে সংসদে বলেন - 'কোনভাবেই মহিলাদের বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার দেওয়া যাবে না'। বহু বিবাহের অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে তার সওয়াল ছিল কেবলমাত্র হিন্দুদের থেকে এই অধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না। তাঁর সহযোগী মদনমোহন মালব্য ভিন্ন জাতের মধ্যে বিবাহের ক্ষেত্রে প্রবল বিরোধীতা করে বলেছিলেন - 'একই জাতির মধ্যে বিবাহ হওয়া উচিত কারণ একই ধরণের খাদ্যাভ্যাস এবং অন্যান্য অভ্যাস তাদের মধ্যে মেলামেশা করতে সুবিধা দেয় এবং ব্যক্তি ও জাতির স্বাস্থ্য এবং সুখ বজায় রাখে'। এই হিন্দু কোড বলের বিরোধীতা করে তাঁরা আরও বলেছিলেন - 'যেহেতু বিবাহ হিন্দু সমাজে একটি গভীর দর্শনের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে এবং এটি মৌলিক এবং পবিত্র অধিকার হিন্দুদের, তাই হিন্দু বিবাহ আইনের সংশোধন কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না'। অর্থাৎ বহু বিবাহের পক্ষে এরা সওয়াল করেছেন।

শ্রী মুখার্জী উচ্চবর্ণদের এই আইনের আওতার বাইরে রাখার পক্ষে জোরালো সওয়াল করে বলেছিলেন - '(উচ্চবর্ণের) যারা উত্তরাধিকার সূত্রে বহু বৎসর ধরে এই ধারাবাহিকতা মেনে চলছেন তারা কিছু কম দেশপ্রেমিক নন অন্যান্য (নিচু) জাতির তুলনায়। এদের উপর জবরদস্তি নতুন আইন চাপিয়ে দেবেন না'। ড. আম্বেদকরের তীব্র আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত বলেন - তাহলে সমগ্র ভারতবাসীর জন্য এই আইন প্রয়োগ করা হোক। শ্রী মুখোপাধ্যায় এই আইনের বিরোধীতা করতে গিয়ে অভিযোগ তুলেছিলেন হিন্দুদের আইনের এই পরিবর্তনে হিন্দু ধর্ম নাকি আক্রান্ত হচ্ছে। জবাবে ড. আম্বেদকর বলেছিলেন - 'আমি ওনাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই কেউ স্ত্রীকে মারধর করলে সেটা কি ধর্মীয় পরম্পরার নামে মেনে নেওয়া হবে? একটি আদালতে একজন বিচারক বলেছিলেন - হিন্দুধর্মে এটি গ্রহণযোগ্য। আমি শ্রী মুখোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করতে চাই এই ধরণের নিষ্ঠুরতা কি ধর্ম?'

শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে হিন্দু মৌলবাদী শক্তির প্রবল আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে সেদিন আম্বেদকর ক্ষোভে পদত্যাগ করেছিলেন। এদেরই উত্তরাধিকার বিজেপি আজ ড. আম্বেদকরের গলায় মালা দেন কোন অধিকারে? সেদিন যারা সব হিন্দুর জন্য এক আইনের বিরোধীতা করেছিলেন, আজ কিসের ভিত্তিতে তারা গোটা দেশের জন্য একই আইন প্রণয়নের কথা বলেন? আসলে একই আইনের নাম করে প্রগতির জন্য সমাজ সংস্কার নয়, সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ আনার জন্যই ইউনিফর্ম সিভিল কোডের কথা এরা বলছেন।

প্রশ্ন-১৪) শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কি বাংলাভাগ রুখতে চেয়েছিলেন? তিনি কি দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন?

উত্তর) শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কংগ্রেসের আহ্বানে ভারত ছাড়ো আন্দোলন সম্পর্কে ১৯৪২ সালের ২৬শে জুলাই তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্নর জন হারবার্টকে একটি চিঠিতে লেখেন - 'যে কোন ব্যক্তি যদি বর্তমান যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ) মানুষকে জাগিয়ে তুলে আন্দোলন করবার পরিকল্পনা করেন, যার ফলে আভ্যন্তরীন অস্থিরতা এবং নিরাপত্তাহীনতা তৈরী হতে পারে, সরকারের উচিত তাকে প্রতিহত করা'। তিনি আরও লেখেন - 'আপনার অনুগত একজন মন্ত্রী হিসাবে আমি সম্পূর্ণভাবে আপনার সরকারকে সহযোগীতা করতে চাই এবং আমার রাজ্য ও দেশকে এই সংকটজনক মুহূর্তে সেবা করতে চাই।' প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সেই সময় স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ না নিয়ে ফজুলল হকের নেতৃত্বে মুসলীম লীগের মন্ত্রীসভায় তিনি অর্থমন্ত্রী হিসাবে যোগদান করেছিলেন। যে সময় একদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারত ছাড়ো আন্দোলন গড়ে উঠছে এবং নেতাজী সুভাষ বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠনের কাজ চলছে তখন মুসলীম লীগের মন্ত্রীসভায় উপমুখ্যমন্ত্রী হিসাবে যোগদান করে তিনি ব্রিটিশ সরকারকে সহযোগীতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আর.এস.এস. দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প সংগঠিত করেছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নাম লেখানোর জন্য।

১৯৪৬ সালের শেষের দিকে শ্রী মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলা ভাগের দাবীতে গঠিত হয় - 'Bengal Partition League', পরবর্তীতে যা 'Bengal Provincial Conference' নামে পরিচিত হয়। ঐ বছর ফেব্রুয়ারী মাসে হিন্দু মহাসভার বাংলা শাখা হিন্দুদের জন্য পৃথক বাংলা রাজ্য গঠনের জন্য একটি কমিটি তৈরী করে এবং ২৯শে মার্চ এর বার্ষিক সাধারণ সভায় হিন্দুদের জন্য পৃথক রাজ্যের দাবীতে প্রস্তাব পাশ করে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে শ্রী মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে হুগলী জেলার তারকেশ্বরে বাঙালী হিন্দু সম্মেলন সংগঠিত হয়। এখান থেকেই শ্রী মুখোপাধ্যায় প্রস্তাব দেন 'বাঙলা ভাগই একমাত্র সমস্যা সমাধানের রাস্তা'। এই সম্মেলন থেকে গৃহীত এক প্রস্তাবে তাঁকেই দায়িত্ব দেওয়া হয় - বাঙালি হিন্দুদের জন্য পৃথক রাজ্যের দাবীতে একটি কাউন্সিল গঠন এবং গণপরিষদের কাছে বাংলা ভাগের সীমানা নির্ধারণের আবেদন করার জন্য।

এই প্রসঙ্গে জ্যোতি বসু 'যতদূর মনে পড়ে' এই আত্মকথায় উল্লেখ করেন - 'দেশভাগের প্রশ্নে আমাদের পার্টির কি নীতি ছিল, তা এখানে বলা দরকার। আগেই বলেছি, পার্টি দেশভাগের বিরোধীতা করেছিল - কিন্তু এর প্রতিরোধ করার মত শক্তি ও প্রভাব পার্টির ছিল না। ভারতে তখন আমাদের পার্টি ৩য় বৃহত্তম শক্তি হলেও কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের তুলনায় আমাদের শক্তি খুবই দুর্বল ছিল। আমাদের প্রতিবাদ ও বিরোধীতা সত্ত্বেও দেশ যখন সত্য সত্যই বিভক্ত হলো, তখন এই বাস্তবকে স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া আমাদের পার্টির সামনে আর কোন বিকল্প ছিল না'।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যখন শ্রী মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন তখন ব্রিটিশ পতাকাকে অবমাননা করবার জন্য ১ম ছাত্রকে বেত্রাঘাত করার প্রতিবাদ করে ধরিত্রী গাঙ্গুলী এবং উমাপদ মজুমদার এই দুজন ছাত্রকে বরখাস্ত করেছিলেন - এমন অভিযোগও তাঁর বিরুদ্ধে আছে। তাই ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অন্যতম প্রবক্তার স্বাধীনতা আন্দোলন, সমাজসংস্কার এবং বাংলাভাগের ক্ষেত্রে যে নেতিবাচক ভূমিকা ছিল তা সকলের জানা অত্যন্ত জরুরী।

********************************************

জম্মু-কাশ্মীরের ভারত ভুক্তির অন্যতম প্রধান ভিত্তি ৩৭০নং ধারাকে লঘু করার প্রশ্নে কমিউনিস্টরা বরাবর বিরোধীতা করেছে। ২০০১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা শ্রী জ্যোতি বসু একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন - 'কাশ্মীরীদের স্বশাসন এবং অধিক ক্ষমতা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত সরকার সঠিক নীতি গ্রহণ করেনি। তাই তারা ধীরে ধীরে ভারত থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। ঐ সময় জনসংঘ ও হিন্দুত্ববাদীদের উত্থানেরও প্রভাব পড়েছিল। বিশেষত যখন কাশ্মীরের জনগণের থেকে এই সমস্ত ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া হয়, তখন তরুণ কাশ্মীরীরা পাকিস্তানপন্থী ও ভারত বিরোধী হয়ে উঠেছিলেন। এখন অনেকগুলি গোষ্ঠী রয়েছে। শেখ আব্দুল্লার মতো কয়েকজন পাকিস্তানে যোগ দিতে চাননি, চেয়েছিলেন স্বাধীন কাশ্মীর। জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর তিনি যখন আবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, আমি ওনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম - কেন আপনি এটা চাইছেন? এই ধরণের ছোট রাজ্য নিয়ে আপনি কিভাবে চালাবেন? তিনি আমাকে যুক্তি দিয়েছিলেন - আমি স্বাধীন কাশ্মীর পেলে পাকিস্তান, আমেরিকা ও ভারত আমাকে সমর্থন দেবে। যাই হোক শেষ পর্যন্ত তিনি ভারতবর্ষের সাথেই ছিলেন। আমরা কাশ্মীরকে কখনই পাকিস্তানের হাতে তুলে দিতে পারি না। এ বিষয়টা স্পষ্ট। আমরা কাশ্মীরকে স্বাধীন রাষ্ট্রও হতে দিতে পারি না। কিন্তু আমরা সেই অবস্থানে অনড় আছি যা আগেও বলেছি। জম্মু-কাশ্মীরকে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন দেওয়া প্রয়োজন। শুধু জম্মু-কাশ্মীরে স্বায়ত্বশাসন দিলেই হবে না; কাশ্মীরের মধ্যে জম্মু অন্যান্য অংশেও স্বশাসনের ক্ষমতা দিতে হবে। এভাবেই জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের, বিশেষত মুসলমানদের বিশ্বাস আমরা ফিরে পেতে পারি। তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন; এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। একাজ করতে গেলে তাঁদের অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃত নজর দিতে হবে। এই মুহূর্তে শুধু ৩৭০নং ধারা দিয়ে তাঁদের রাজনৈতিকভাবে খুশি করা যাবে না, যেটা অবশ্য বর্তমান সরকার (বাজপেয়ী সরকার) প্রত্যাহার করতে চায়। কিন্তু এই ধারার পাশাপাশি জওহরলাল নেহেরুর আমলে যেসব ক্ষমতা তাঁদের ছিল সেগুলি ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। কিছু ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন যদি তারা নিজস্ব সুপ্রিম কোর্ট চান বা অন্য কিছু চান, প্রতিরক্ষা এবং বিদেশ নীতি ছাড়া সবকিছুই তাদের দেওয়া উচিত। কিন্তু আর্থিক সহায়তা বহন করা উচিত ভারত সরকারের। এভাবেই মানুষের আস্থা অর্জন করা সম্ভব।' - (কমিউনিস্ট স্মৃতিকথা, এ.জি.নূরানী)

Thursday, 18 November 2021

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণীর ভূমিকা - সুকোমল সেন

আলোচ্য বৎসরগুলিতে শ্রমিকশ্রেণীকে মার্কস-লেনিনের বিপ্লবী শিক্ষায় শিক্ষিত করবার জন্য কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে শ্রমিক-সংগঠনগুলির প্রচেষ্টা চলেছিল নিরন্তনভাবে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যে মীরাট মামলা সাজিয়ে কমিউনিস্টদের কঠোর সাজা দেওয়ার ব্যবস্থা করে সাম্রাজ্যবাদী সরকার ভারতের শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রভাব সমূলে উৎপাটন করবার যে চেষ্টা করেছিল কারাগারের বাইরে অবস্থিত তরুণ কমিউনিস্টরা তাঁদের একনিষ্ঠ ও সাহসী কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সরকারের সেই উদ্দেশ্যকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ করে দেয়। জেলের মধ্য থেকে কমিউনিস্ট মতবাদকে শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী দর্শনকে ভারতের নিপীড়িত জনগণের সামনে বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেন। তেমনি কারাগারের বাইরেও বয়সের দিক থেকে অত্যন্ত তরুণ, অনভিজ্ঞ অথচ বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ কমিউনিস্টরা শ্রমিকশ্রেণীকে সরাসরি জঙ্গী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পরিচালিত করে এবং মার্কস-লেনিনের মতাদর্শের বিপ্লবী তাৎপর্যগুলিকে বিশ্লেষণ করে শ্রমিকদের মধ্যে বিপ্লবী শ্রেণী-চেতনা বিকাশে অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেক কমিউনিস্ট কর্মীও এই সময়ে মার্কসীয় দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন। সন্ত্রাসবাদী কর্মীদের একটা বিরাট অংশ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। ১৯৩৫ সালের মে দিবসে আন্দামান জেলে ভগত সিং-এর সহকর্মীগণ ৩১ জন সন্ত্রাসবাদী কর্মী কমিউনিস্ট কো-অর্ডিনেশন গঠন করেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের নেতৃবৃন্দ মার্কসীয় দর্শন গ্রহণ করেন। ফলে এই সময়ে মার্কসীয় দর্শনের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ব্যাপ্তির দিক থেকে আলোচ্য সময়ে বিভিন্ন কারণে শ্রমিক আন্দোলনের যথেষ্ট ঘাটতি থাকলেও শ্রমিকশ্রেণীর শ্রেণী-চেতনার বিকাশে এই সময়ের অবদান বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।


Monday, 15 November 2021

সহজ আলোচনায় পার্টি কর্মসূচী - দীপক নাগ

 "...আমাদের শিক্ষা কোনো আপ্তবাক্য নয়, কর্মক্ষেত্রে পথনির্দেশক।" মার্কস ও এঙ্গেলস সবসময়ই একথা বলতেন। যারা কয়েকটি "সূত্র" মুখস্থ করে বারবার আওড়াতো, তাদের তাঁরা বিদ্রুপ করতেন। এই সূত্রগুলি সম্বন্ধে এ পর্যন্ত বলা যায় যে, সেগুলি কেবল সাধারণভাবে কাজের মোটামুটি একটা রূপরেখা দিতে সক্ষম; ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার প্রত্যেকটি পর্যায়ের বাস্তব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনিবার্যভাবেই এই কাজের পরিবর্তন ঘটায়। ... এই প্রশ্নাতীত সত্য উপলব্ধি করা একান্ত প্রয়োজন যে, মার্কসবাদীকে বাস্তব জীবনের, প্রকৃত তথ্যের অনুশীলন করতে হবে, পুরোনো মতবাদকে আঁকড়ে থাকলে চলবে না।" - লেনিন (লেটার্স অন ট্যাকটিকস; কালেক্টেড ওয়ার্কস)

=============================================================

আজ থেকে প্রায় একশ সত্তর বছর আগে কমিউনিস্ট লিগের কর্মসূচি বা কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহারে মার্কস-এঙ্গেলস স্পষ্ট কথায় বলেন : "কমিউনিস্টরা নিজেদের মতামত ও লক্ষ্য গোপন করতে ঘৃণা বোধ করে। খোলাখুলিভাবে তাঁরা বলেন যে, তাঁরা যা চান তা পাওয়া যেতে পারে কেবলমাত্র এখনকার সমস্ত সামাজিক অবস্থাকে জোর করে পাল্টে ফেলার মাধ্যমেই।" দুনিয়ায় হাজার হাজার রাজনৈতিক দল বা পার্টি থাকলেও শুধুমাত্র কমিউনিস্ট পার্টিই তার উদ্দেশ্য লিখিতভাবে ঘোষণা করে। বুর্জোয়াদলগুলোর প্রায় কোনোটারই কোনো লিখিত কর্মসূচি নেই। কারণ চলতি সমাজে যে শোষণ, অত্যাচার, অনাহার, বেকারি চলছে তা টিকিয়ে রেখে ধনীদের সেবা করাই তাদের একমাত্র কর্মসূচি।


মার্কসবাদীরা মনে করে বর্তমান সমাজ পরস্পর বিরোধী দুটো শ্রেণিতে বিভক্ত। অল্প কয়েকজন মানুষ সমাজের শতকরা নব্বুইভাগেরও বেশি সম্পত্তির মালিক। তাঁদের সবকিছু আছে। তাঁরা শোষক বা বুর্জোয়া। আর সমাজের নব্বুই ভাগেরও বেশি মানুষের হাতে কোনো সম্পদ নেই। তাঁরা শোষিত বা সর্বহারা। তাই তাঁরা নেই-রাজ্যের বাসিন্দা। মার্কসবাদীরা এই অসম ব্যবস্থার বদল চায়। তারা চায় শ্রেণিহীন সমাজ বা সাম্যবাদ। এই ব্যবস্থায় কোনো শোষক থাকবে না। তাই থাকবে না না-খেতে পাওয়ার ভয়। প্রত্যেকে তার প্রয়োজনমতো পায় বলেই অযথা সম্পদ জমিয়ে রাখার ইচ্ছে থাকে না। কারণ দরকার পড়ে না। অনেকটা মৌমাছির ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করার মতো। কাউকে আঘাত না দিয়ে তার যতখানি প্রয়োজন ততখানিই নেবে। তার বেশি নয়। কিন্তু সাম্যবাদ বা কমিউনিজমের স্তরে আসতে গেলে সমাজকে কয়েকটা স্তর পেরিয়ে আসতে হয়। সামন্ততান্ত্রিক স্তর পেরিয়ে পুঁজিবাদী স্তর তারপর সমাজতান্ত্রিক স্তর আর অবশেষে সাম্যবাদী স্তর। এইসব স্তর পেরোনোর জন্য চাই বিপ্লবী মতবাদ এবং একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল বা কমিউনিস্ট পার্টি। যার নেতৃত্বে থাকবে শ্রমিক শ্রেণি। কারণ মার্কসবাদীদের মতে সমাজে শ্রমিকশ্রেণিই একমাত্র বিপ্লবী শ্রেণি। লেনিনের মতে, "বিপ্লবী মতবাদ না থাকলে বিপ্লবী আন্দোলন সম্ভব নয়। ... যে পার্টি সব চাইতে এগিয়ে থাকা মতবাদ দ্বারা পরিচালিত, কেবলমাত্র সেই পার্টিই পারে অগ্রণী সংগ্রামী বাহিনীর ভূমিকা পূরণ করতে।"


কমিউনিস্ট পার্টি বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজের আমূল পরিবর্তন ঘটাতে চায়। তারা বিশ্বাস করে শুধুমাত্র ওপর ওপর পরিবর্তন বা এদিক ওদিক সামান্য সংস্কার করেই মানুষের ওপর শোষণ ও মানুষের দুঃখ দূর করা যায় না। বিপ্লব আকাশ থেকে পড়ে না। আবার স্বতঃস্ফূর্ততার দ্বারাও বিপ্লব সম্ভব নয়। এর জন্য চাই একটা পাকাপোক্ত ও সুশৃঙ্খল সংগঠন। আবার বাস্তব পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে একটা সঠিক কর্মসূচি ছাড়া সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়।

=============================================================

ফিনান্স পুঁজিকে লগ্নি পুঁজি বা মহাজনি পুঁজি বলা যেতে পারে। লেনিনের মতে, "উৎপাদন কেন্দ্রীয়ভাবে বা একসঙ্গে জড়ো হওয়া; তা থেকে একচেটিয়া কারবারের আবির্ভাব; ব্যাঙ্কের সঙ্গে শিল্পের মিশে যাওয়া বা মিলন ঘটা - এই হলো মহাজনি পুঁজি তৈরি হওয়ার ইতিহাস এবং কথাটার সারমর্ম।"

=============================================================

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব বেড়ে চলেছে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের ফলে এখন চারটি দ্বন্দ্ব বা বিরোধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই দ্বন্দ্বগুলো হলো :


(ক) সমাজতন্ত্র বনাম সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব;

(খ) সাম্রাজ্যবাদ ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব;

(গ) সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব;

(ঘ) পুঁজি ও শ্রমের দ্বন্দ্ব।

=============================================================

ভারতে বুর্জোয়া ও জমিদার জোটের নেতৃত্বে রয়েছে বড় বড় বুর্জোয়ারা। ধনতন্ত্রের বিকাশ ঘটানোই এদের লক্ষ্য। এই শ্রেণি জমিদারদের রাষ্ট্রক্ষমতায় রেখেই বা সামন্ততন্ত্রকে ধ্বংস না করেই ধনতান্ত্রিক পথে বিকাশ ঘটাতে চাইছে। এরা বিদেশি মহাজনি পুঁজির সাহায্য নিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে বা দর কষাকষি করে নিজেদের লাভের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে। ভারতীয় বুর্জোয়ারা এক্ষেত্রেও দুমুখো নীতি নিয়ে চলে। তাই ভারত জাতীয় বুর্জোয়াদের রাষ্ট্র নয়। কারণ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে তাদের বোঝাপড়া আছে। সি পি আই ভারতকে জাতীয় বুর্জোয়াদের রাষ্ট্র বলে মনে করে। তারা মনে করে ভারতীয় বুর্জোয়ারা পুরোপুরি স্বাধীন। আবার ভারতীয় বুর্জোয়ারা মুৎসুদ্দি বা সাম্রাজ্যবাদের দালাল - নকশালপন্থীদের মতো একথাও আমরা মনে করি না। এখানেই আমাদের সঙ্গে সি পি আই বা নকশালপন্থীদের কর্মসূচির অন্যতম প্রধান ফারাক।  

=============================================================

বর্তমানে বিপ্লবের দুটি স্তরের কথা আমরা বলতে পারি। প্রথমটা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং আর তারপর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। আগে বুর্জোয়ারাই নিজেদের স্বার্থে সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে বুর্জোয়া গণতন্ত্র স্থাপন করতো। কিন্তু বুর্জোয়ারা এখন আর এই ভূমিকা পালন করে না। সর্বহারা শ্রেণিকেই এখন এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। এই বিপ্লবকে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর বলা যায়। আমরা এখন এই স্তরে আছি। 


আমাদের দেশের বাস্তব পরিস্থিতিতে বিপ্লবের স্তর হিসেবে যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বন্দ্ব বা বিরোধের কথা উল্লেখ করতেই হয়, তা হলো:

(ক) পুঁজির সাথে শ্রমের দ্বন্দ্ব;

(খ) জমিদার ও কৃষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব;

(গ) সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ভারতীয় জনসমাজের দ্বন্দ্ব।

============================================================= 

কৃষি বিপ্লব হলো জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল কথা। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল শত্রু হলো:

(ক) বড় ধরনের বুর্জোয়া গোষ্ঠী,

(খ) জমিদার বা ধনী কৃষক এবং 

(গ) সাম্রাজ্যবাদ

বড় বড় পুঁজিপতিরা বিদেশি মহাজনি পুঁজির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে মুনাফা করার চেষ্টা করে। কাজেই বিদেশি লগ্নিপুঁজি বা মহাজনি পুঁজি অন্যতম প্রধান শত্রু। তাই মোটামুটিভাবে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব হচ্ছে :

 - সামন্ততন্ত্র বিরোধী,

- সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী,

- একচেটিয়া বিরোধী ও 

- গণতান্ত্রিক। 

=============================================================  

জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্টের নেতা হলো শ্রমিকশ্রেণি; দৃঢ় মিত্র হলো কৃষক সমাজ; মধ্যবিত্তশ্রেণি হলো সাধারণ মিত্র; আর দোদুল্যমান ও অস্থিতিশীল মিত্র হলো মাঝারি ও ছোট বুর্জোয়ারা।

============================================================= 

মার্কসবাদীরা পার্লামেন্টারি ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে নয়। তারা পার্লামেন্ট-সর্বস্বতার বিরুদ্ধে। অর্থাৎ পার্লামেন্টই সব বা পার্লামেন্টের মাধ্যমেই সব সমস্যার সমাধান করা বা এই সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন করা সম্ভব - আমরা তা বিশ্বাস করি না। লেনিনের কথায়, "শ্রমিকশ্রেণির পার্টিগুলি পার্লামেন্টারি সংগ্রামকে ব্যবহার করার, পার্লামেন্টে অংশগ্রহণ করারই পক্ষে। কিন্তু তারা 'পার্লামেন্টারি ক্রেটিনিজম'-এর অর্থাৎ পার্লামেন্টারি সংগ্রামই হচ্ছে রাজনৈতিক সংগ্রামের একমাত্র বা সবসময়ই প্রধান রূপ - এই বিশ্বাসের স্বরূপ নির্মমভাবে প্রকাশ করে দেয়।" 

=============================================================

সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতি অতি-নির্ভরতা আমাদের মধ্যে সংশোধনবাদী বিচ্যুতি নিয়ে আসতে পারে। আবার বুর্জোয়া সংসদীয় ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করলে তা আমাদেরকে সংকীর্ণতাবাদী বা হঠকারী বিচ্যুতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।

=============================================================

পার্টি গড়ার কাজে সমস্তরকম অ-মার্কসীয় চিন্তাধারা, কুসংস্কার, ধর্মীয় কূপমুন্ডুকতা, সাম্প্রদায়িকতা, জাতপাত, বুর্জোয়া সংস্কৃতি ও আচারআচরণ, বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে সচেতন সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।

=============================================================


Wednesday, 10 March 2021

ধর্ম এই সময়ে - সুকুমারী ভট্টাচার্য

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে যে তথ্যচিত্রটি তোলা হয় তাতে মসজিদ ধ্বংসের পরে তথ্যচিত্রী ক্যামেরা নিয়ে এক বুড়ি হিন্দু মহিলাকে জিজ্ঞেস করেন, 'মাতাজি, আজ এই এতক্ষণ ধরে যা ঘটল তাতে আপনার কি মনে হল? বৃদ্ধা সাশ্রুনেত্রে বক্ষে করাঘাত করে বললেন, 'হায় রাম, তোমার শেষে এই দশা হল যে, অন্যের বাড়ি ভেঙে তোমায় বাস করতে হয়?' ওই বৃদ্ধা বিশ্বাসী হিন্দু, তাঁর কাছে তাঁর ইষ্টদেবতা রামের মান গেল ওই সাম্প্রদায়িক বর্বরতায়।

*************************************

যে ধর্ম অসাম্প্রদায়িক, যে ধর্ম মূলত মানবিক তা সত্যকার মানব-অকল্যাণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে, যেন করত লিবারেশন থিওলজিস্টরা, প্রধানত দক্ষিণ আমেরিকায়, তবে অন্য বহু দেশেও এঁরা সক্রিয়। এঁরা বামপন্থী খ্রিস্টান, সামাজিক অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে এঁরা নিয়ত সংগ্রাম করেন। 

*************************************

আপনজনকে দূরে ঠেলে দিয়ে পর করে দেওয়া আমরা কম করিনি। এখন বোধ হয় সময় এসেছে যারা নিজেদের মার্কসবাদী বলে এবং কাজে, সাম্যবাদী সংগঠনে, আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে; তাদের শুধুমাত্র ধর্মে বিশ্বাসী বলেই ঠেলে দূরে না সরাবার। মার্কসের পরে মার্কসবাদ অপরিবর্তিত থাকেনি। ওইসব মত অবলম্বন করে দেশে দেশে বিপ্লবও সংঘটিত হয়েছে, কাজেই মার্কসবাদের মূল তত্ত্বটিকে অবিকৃত রেখে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তা যদি আন্দোলনের দ্বারা বিপ্লবের পথে এগোয়, তাহলে বোধহয় ওই পর্যন্ত ধর্মকে সহ্য করে তেমন মানুষদের সহযোদ্ধা বলে স্বীকার করলে সংগঠনের লাভ ছাড়া ক্ষতি হয় না।

ধর্ম যখন শ্রেণিসংগ্রামকে বাধা দেয়, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে তখনই তাকে সহ্য করা অন্যায়। কিন্তু আজকের ভারতবর্ষে ধর্মবিশ্বাসী মাত্রেই শ্রেণিশত্রু বা সংগ্রামের শত্রু নয়। বহু লোকের কাছে ধর্ম একান্ত ব্যক্তিগত কিছু বিশ্বাস ও আচরণ, যার দ্বারা তারা কারও কোনো ক্ষতি করার কথা কল্পনাও করে না। এদের পর করে কী লাভ? এরা নিজেদের ধর্মবিশ্বাসকে যুক্তিবিচারের আওতার বাইরে রাখে ঠিকই, রাখুক না? যদি সে বিশ্বাস অন্য কোনো সম্প্রদায়ের মানুষকে আঘাত না করে, গণসংগ্রামকে ব্যাহত না করে, বরং সংগ্রামীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে এগোয়, তাহলে নাস্তিক মার্কসবাদীর কি সেই সহিষ্ণুতাটুকু থাকবে না তার ওই গোপন ঠাকুরঘরটুকুকে আঘাত না করার? যুক্তিবিচার দিয়ে ধর্মবিশ্বাসকে যাচাই করে না বলেই অনেকসময় নিজের অভিজ্ঞতাই তাদের বিশ্বাসে আঘাত হানে। আর নাও যদি হানে তো, সাম্যবাদী চেতনায় সে আর যাই হোক সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠবে না কখনও এবং এই কারণেই আমাদের সহযোদ্ধা থাকবে।

*************************************

সব ধর্মের আদিপর্বে দেখি কোনো সম্প্রদায় ছিল না; কিছু পরে দলীয় স্বার্থ ও প্রাধান্যের লোভে কোনো কোনো ব্যক্তি পৃথক সম্প্রদায় গঠন করে ক্ষমতার জগতে উন্নতি করে নেয়, নিজের ও দলের ... । ইসলাম বাইরের জগতে সৃষ্ট হয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে ভিন্নমতাবলম্বী একটি দল হিসাবে। তার আগের ভারতবর্ষ মুখ্যত হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, আজীবক --- এদের বিভিন্ন শাখা এবং অগণ্য আদিবাসীর দেশ ছিল। ইসলাম এখানে তেমনই একটি সম্প্রদায় হয়ে পাশাপাশি শান্তিতে থাকতে পারত। ছিলও। সিন্ধুপ্রদেশে আসার পর থেকে পাঠান রাজত্বকাল পর্যন্ত। মোগল রাজত্বকালে বিধর্মী হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের স্বতন্ত্র সম্প্রদায়চেতনা কতকটা উগ্র হয়ে ওঠে। তখন অন্য সব পরিচয় ছাপিয়ে শুধু সাম্প্রদায়িক পরিচয়ই মুখ্য হয়ে ওঠে। 

*************************************

১. সাম্প্রদায়িক চেতনা ধর্মকে পুষ্ট করে না,
২. ধর্ম থেকে উদ্ভূতও নয়,
৩. মুখ্যত এর যোগ রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে এবং 
৪. সেটি করায়ত্ত করার জন্যই এ চেতনা দায়বদ্ধ।

*************************************


Wednesday, 24 February 2021

রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বাঁচাও ভারত বাঁচাও - ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)

গত তিন বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখাগুলির ধারাবাহিকভাবে হ্রাস এবং বেসরকারি খাতের শাখাগুলির দ্রুত বৃদ্ধি ঘটেছে।

সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে তার শেয়ার হোল্ডিং কমিয়ে ৫২ শতাংশ করার অনুমোদন দিয়েছে। ব্যাঙ্কস বোর্ড ব্যুরো গঠন এবং পরবর্তীকালে একটি হোল্ডিং সংস্থা গঠনের জন্য যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যেটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে সরকারি বিনিয়োগের বিলিব্যবস্থা করবে। এগুলিই বেসরকারিকরণের দিকে প্রথম পদক্ষেপ।

পি জে নায়েক কমিটির অংশীদারিত্বকে হ্রাস করে ৪০ শতাংশ করার সুপারিশ সরকার গ্রহণ করেছে। অতীতে সরকারগুলি আইসিআইসিআই-কে বেসরকারিকরণ করে বেসরকারি ব্যাঙ্ক করেছিল, যদিও আইসিআইসিআই শিল্প নির্মাণে উৎসাহ দেবার জন্যে শুরু হয়েছিল। ইউটিআইকে ইউটিআই ব্যাঙ্কে এবং তারপরে অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক হিসাবে রূপান্তরিত করে বেসরকারিকরণ করা হয়েছিল। এইচডিএফসি, যা আবাসন ক্ষেত্রকে উন্নীত করার জন্য চালু করা হয়েছিল তা বেসরকারি সেক্টরে এইচডিএফসি ব্যাঙ্কে পরিণত হয়েছে। এখন সরকার ঘোষণা করেছে আইডিবিআই ব্যাঙ্কের সরকারি অংশীদারিত্ব হ্রাস করে ৪৫ শতাংশে নামিয়ে আনবে।

মেক ইন ইন্ডিয়া, স্বচ্ছ ভারত, ডিজিটাল ইন্ডিয়া পেনশন যোজনা এবং স্টার্ট আপগুলিকে সফল করতে হলে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলিকে এদের তহবিল সরবারহ করতে হবে। বেসরকারি ক্ষেত্র কখনই এই প্রকল্পগুলিকে তহবিল দেয় না কারণ এগুলি তাৎক্ষণিক মুনাফা অর্জন করবে না এবং ব্যর্থও হতে পারে। কৃষকদের যদি কৃষি ঋণ পেতে হয়, যদি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলিকে পর্যাপ্ত ঋণ পেতে হয়, আমাদের সন্তানদের যদি শিক্ষা ঋণ নিতে হয় এবং স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে ঋণ পেতে হয়, আমাদের সন্তানদের যদি শিক্ষা ঋণ নিতে হয় এবং স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে ঋণ পেতে হয়, তবে কেবলমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি তা সরবারহ করতে পারে। সুতরাং আসুন রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলিকে সমর্থন করি। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলি বাঁচান এবং তাদের সুরক্ষার জন্যে এগিয়ে আসুন। উন্নয়ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের দাবি করুন।

**********************************************

এখন এনডিএ সরকারের দ্বিতীয় অবতার সবকিছুই বেসরকারি করতে চায়, কৃষকদের বীজ বিক্রি করতে বাধ্য করা বা মঙ্গলসূত্র বিক্রি করতে কোনও ভদ্রমহিলাকে বাধ্য করার মতোই সব তারা জ্বলাঞ্জলি দেবে প্রাইভেটের সেবায়। 

দেশের সম্পদ, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র সব তুলে দিতে চায় দেশ এবং বিদেশের বৃহদাকার কর্পোরেটদের হাতে। এদের মদতেই এনডিএ ক্ষমতায়।

কয়েকটি সাম্প্রতিক সংবাদ প্রতিবেদনের দিকে তাকান :

* রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বিমান জ্বালানি বিক্রির জন্য ভারত পেট্রোলিয়ামের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করছে।

* এনটিপিসি বেসরকারি হতে চলেছে।

* সরকারের বিলগ্নিকরণের তাড়ায় তালিকায় ফিরে এল এলআইসি'র নাম।

* ৪০০০০ ঘর নির্মাণের ভার এনবিসিসি'র কাছে হস্তান্তর করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের রায় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বিশাল অবদানের স্বীকৃতি।

* শীঘ্রই আসছে। দ্য গ্রেট সরকারি সেল - পাওয়ার গ্রিড, গেইল, বিএসএনএল এবং এমটিএনএল, সাথে জমিও পাওয়া যাবে।

* সরকার সম্পূর্ণভাবে এয়ার ইন্ডিয়া থেকে হাত গুটিয়ে নেবার পরিকল্পনা করছে।

* কৃষ্ণপট্টম বন্দরের ৭০ শতাংশ শেয়ার কিনতে প্রস্তুত হয়ে আছে আদানি।

* রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সেবায় এলআইসি'র ১৭০০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। 

* ভারতীয় নৌসেনার ৪৫০০০ কোটি টাকার সাবমেরিন প্রকল্পের শেষ মুহূর্তের পরীক্ষার জন্যে আদানি গ্রুপের প্রস্তুতি।

* পাবলিক সেক্টর ইউনিটগুলিতে শেয়ারের হোল্ডিং ৫০%-এর নিচে হ্রাস করার পরিকল্পনা নিচ্ছে সরকার।

গোটা দেশটাই কর্পোরেট, ভারতীয় ও বহুজাতিক সংস্থাগুলির কাছে বিক্রি হওয়ার মুখে। এর সাথে সংরক্ষণ নীতিও খতম হবে।

**********************************************

বামপন্থীদের দাবি 
* রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ বন্ধ করো। প্রতিরক্ষা ও কয়লা ক্ষেত্রে ১০০ ভাগ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহার করো। বিএসএনএল, অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি, ভারতীয় রেল, এয়ার ইন্ডিয়া ইত্যাদি বৃহদাকায় বেসরকারিকরণ বন্ধ করো।
* কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে চাই বর্ধিত সরকারি বিনিয়োগ। তা না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারকে বেকার যুবকদের ভাতা দিতে হবে।
* প্রতি মাসে ২১ হাজার টাকা নূন্যতম মজুরি সুনিশ্চিত করতে হবে।
* যে বিরাট সংখ্যক শ্রমিকরা কর্মচ্যূত হয়েছেন তাঁদের জীবনমান রক্ষার মতো মাসিক মজুরি সরকারকে সুনিশ্চিত করতে হবে।
* পুরনো বকেয়া মেটানো, নির্দিষ্ট নূন্যতম মজুরিতে নূন্যতম ২০০ দিনের কাজ দেওয়া সুনিশ্চিত করতে 'রেগা'য় বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
* কৃষি সঙ্কটের মোকাবিলায়, ক্রমবর্ধমান কৃষক আত্মহত্যা রুখতে এবং ফসলের উৎপাদন খরচের দেড় গুণেরও বেশি নূন্যতম সহায়ক মূল্য কার্যকর করতে কৃষকদের জন্য একেবারেই ঋণ মকুবের ব্যবস্থা করতে হবে।
* নূন্যতম মাসিক বার্ধক্য ও বিধবা পেনশন ৩ হাজার টাকা করতে হবে।

Thursday, 11 February 2021

ভগৎ সিং শহিদ-এ-আজম - তীর্থঙ্কর চট্টোপাধ্যায়

আসফাকউল্লা ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। বস্তুবাদী নন, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী তো কোনোভাবেই না। অথচ তিনি ভবিষ্যতের স্বাধীন ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে তাঁর ধারণাকে এই ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন: "বিদেশি শাসনকে কদর্য মনে করি এবং একই সঙ্গে ঘৃণা করি এমন কোনো ভারতীয় গণতান্ত্রিক শাসনকে, যা দরিদ্র ও দুর্বলের অধিকারকে অস্বীকার করবে, অথবা যদি তা ধনী ও জমিদারদের তৈরি ওই, অথবা যদি তাতে কৃষক ও শ্রমিকের সমান অংশগ্রহণ না থাকে, অথবা যদি সরকারের আইন অসাম্য ও পার্থক্যের ভিত্তিতে রচিত হয়। যদি ভারত স্বাধীন হয় এবং যদি শ্বেতকায় প্রভুদের হাত থেকে দেশ শাসনের বলগা আমার দেশের ভাইরা কেড়ে নেবার পরেও ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অসমতা, জমিদার-রায়তের মধ্যে অসমতা রয়ে যায়, তবে আমি আল্লাহ-র কাছে প্রার্থনা করি, যতদিন তাঁর সৃষ্টিতে সাম্য না প্রতিষ্ঠিত হয়, ততদিন আমি স্বাধীনতা চাই না। যদি এই সব ধারণার জন্য লোকে আমায় কমিউনিস্ট বলে তো বলুক। আমার থোড়াই এসে যায়।"

কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলার আর একজন অভিযুক্ত মহাবীর সিং-এর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়েছিল। তিনি তাঁর বাবাকে আন্দামান-যাত্রার ঠিক আগে একটি চিঠি লেখেন। তাতে লিখেছিলেন: "সমাজ বলতে আমি আর্য সমাজ বা অন্য কোনো সংকীর্ণ সমিতি বুঝি না, আমি বুঝি সমস্ত সাধারণ মানুষের সমাজ। তার কারণ, এই ধর্মীয় সমিতিগুলি এত অদূরদর্শী যে আমার কাছে তারা অর্থহীন। উপরন্তু আমি সব ধর্ম থেকেই দূরে  থাকতে চাই, কারণ তারা সংকীর্ণ, আত্মকেন্দ্রিক, অবিচারভিত্তিক। আমি চাই, অন্যেরাও তা থেকে দূরে থাকুক। মানুষ ও সমাজের পক্ষে যা সবচেয়ে মূল্যবান বলে আমি মনে করি, তা হল নিম্নলিখিত আদর্শ। জাতি, গাত্রবর্ণ, ধর্ম বা অর্থের ওপর ভিত্তি করে কোনো মানবিক সম্পর্ক গড়া উচিত নয়।" 

*************************************************

নিম্ন আদালতে ভগৎ সিং-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, 'বিপ্লব' বলতে তিনি কী বোঝেন? তাঁর উকিল আসফ আলি এই প্রশ্নে আপত্তি করলে আদালত প্রশ্ন নাকচ করে। কিন্তু দায়রা আদালতে নিজের মতাদর্শ ঘোষণার সুযোগ হিসেবে স্বেচ্ছায় ভগৎ সিং প্রশ্নটির উত্তর দেন। "বিপ্লব সর্বদা রক্তাক্ত সংঘাতে জড়িত নয় এবং তার মধ্যে ব্যক্তিগত প্রতিশোধেরও স্থান নেই। বিপ্লব মানে বোমা-পিস্তলের পূজা নয়। বিপ্লব বলতে আমরা বুঝি যে, বর্তমান ব্যবস্থা যা স্পষ্টতই অন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তাকে পাল্টাতে হবে। যদিও যারা স্পষ্টতই উৎপাদক বা শ্রমিক, তারাই সমাজের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান, তবু তারা তাদের শ্রমের ফল থেকে শোষকদের দ্বারা বঞ্চিত, তাদের মৌলিক অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। ... অতএব একটা মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন এবং যারা এ কথা উপলব্ধি করেছে তাদেরই দায়িত্ব সমাজকে সমাজতান্ত্রিক ভিত্তির ওপরে পুনর্গঠিত করা। এই কাজ সমাধা না হলে এবং মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ এবং এক দেশ দ্বারা অপর দেশের শোষণ, যা সাম্রাজ্যবাদের মুখোশ পরে আছে, বন্ধ না হলে, সমাজের সামনে আজ যে কষ্টভোগ ও হত্যালীলার  বিপদ, তাকে রোখা যাবে না এবং যুদ্ধের অবসান ও বিশ্বশান্তির যুগ উদ্বোধনের সব কথাই ছদ্মবেশহীন কপটতা বলে বোঝা যাবে। বিপ্লব বলতে আমরা বুঝি শেষ পর্যন্ত এমন একটা সমাজব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা যা এই রকম ধ্বংসের ভয়ে ত্রস্ত নয়, যেখানে সর্বহারার সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত যার ফলে আসবে এমন একটা বিশ্ব-ফেডারেশন যা বিশ্বমানবকে উদ্ধার করবে পুঁজিবাদের দাসত্ব থেকে ও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের দৈন্য থেকে।" পরিশেষে তাঁরা সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর সংগ্রামের কথা বলেছেন এবং বিবৃতি শেষ করছেন 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' লিখে।

*************************************************

১৩ সেপ্টেম্বর সকালে ৬২ দিন অনশনের পর যতীন দাস শহীদের মৃত্যু বরণ করলেন। শেষ অবধি তাঁর মনোবল অটুট ছিল। প্রায় অচৈতন্য অবস্থাতেও তিনি খাদ্য প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সারা দেশ আগের সাত দিন উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করছিল। চরম মুহূর্তের পর সারা দেশে ক্ষোভ ও শোকের বন্যা বয়ে গেল। তখনকার দিনে টেলিভিশন ছিল না, খুব কম বাড়িতেই রেডিয়ো ছিল, টেলিফোন ব্যবস্থাও দুর্বল ছিল। তবু খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে দুপুরের মধ্যে।

এই মৃত্যুসংবাদ শান্তিনিকেতনে পৌঁছাল সন্ধ্যা নাগাদ। ভাদ্রের শেষ; আসন্ন পুজোর ছুটির ঠিক আগে 'তপতী' নাটকের অভিনয় হবে। রবীন্দ্রনাথ ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নাটকের মহলা দিচ্ছিলেন। যতীন দাসের খবর আসতে রিহার্সাল বন্ধ হয়ে গেল। যে যার ঘরে ফিরে গেলেন। সেই রাতে রবীন্দ্রনাথ একটি গান লিখলেন। পরের দিন রিহার্সালে এসে বললেন, এই নতুন গানটি সকলকে শিখে নিতে হবে। ওই কোরাস দিয়েই 'তপতী' শুরু হবে।


সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ

হে ভৈরব, শক্তি দাও, ভক্ত-পানে চাহো।

দূর করো মহারুদ্র   যাহা মুগ্ধ, যাহা ক্ষুদ্র

মৃত্যুরে করিবে তুচ্ছ প্রাণের উৎসাহ।

দুঃখের মন্থনবেগে উঠিবে অমৃত,

শঙ্কা হতে রক্ষা পাবে যারা মৃত্যুভীত।

তব দীপ্ত রৌদ্র তেজে   নির্ঝরিয়া গলিবে যে

প্রস্তরশৃঙ্খলোন্মুক্ত ত্যাগের প্রবাহ।

*************************************************

দ্বিতীয় পাঞ্জাব ছাত্র সম্মেলনের মুক্ত অধিবেশন হয়েছিল ১৯ অক্টোবর ১৯২৯। সভাপতিত্ব করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। এই সভায় পড়া হয়েছিল ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত-র বার্তা, জেল থেকে পাঠানো।

কমরেডগণ,
আজ আমরা যুবসমাজকে পিস্তল-বোমা হাতে তুলে নিতে বলতে পারি না। আজ ছাত্রদের সামনে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। আগামী লাহোর অধিবেশনে কংগ্রেস দেশের স্বাধীনতার জন্য কঠোর সংগ্রামের ডাক দেবে। জাতীয় ইতিহাসের এই সংকটকালে যুবসমাজকে এক বিশাল দায়িত্ব নিতে হবে। ... তাদের দায়িত্ব শিল্প এলাকার কোটি কোটি বস্তিবাসী ও কোটি কোটি জীর্ণ কুটিরবাসী গ্রামীণ মানুষকে জাগিয়ে তোলা, যাতে আমরা স্বাধীন হতে পারি, যাতে মানুষের হাতে মানুষের শোষণ হয়ে ওঠে অসম্ভব। ...শহীদ যতীন্দ্রনাথ দাসের কাছ থেকে প্রেরণা নিয়ে, এবং দেশের প্রতি অশেষ ভক্তি নিয়ে, তাদের প্রমাণ করতে হবে যে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা অনড় পণ নিয়ে লড়তে সক্ষম।

সভাস্থলে এই বার্তা পরে দেবার পরে সমবেত কণ্ঠে ধ্বনি ওঠে, "ভগৎ সিং জিন্দাবাদ" - সেই সঙ্গে ঘন ঘন হাততালি।

*************************************************

আজ একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে পৌঁছে ভারতে এমনই এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে হিন্দুত্ববাদীদের দাপটে ইতিহাস থেকে আরম্ভ করে গৃহস্থের খাদ্যতালিকা পর্যন্ত পাল্টে দিচ্ছে নয়া-সন্ত্রাসের অঙ্গুলিনির্দেশ। ইতিহাসকে বলা হচ্ছে কল্পনা আর কাল্পনিক কাহিনিকে বলা হচ্ছে ইতিহাস। চেষ্টা চলছে ভগৎ সিং-কে হিন্দু বীর হিসেবে প্রতিপন্ন করার এবং তাঁর আত্মদানকে হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার ভিত্তিরূপে স্থাপনের। সযত্নে চাপা দেওয়া হচ্ছে তাঁর লেখা 'কেন আমি নাস্তিক' প্রবন্ধ। অনুল্লিখিত থাকছে আরও দুটি লেখা: "ধর্ম এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম" এবং "সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও তার প্রতিকার"।

শেষোক্ত প্রবন্ধটি ১৯২৮ সালের জুন মাসে 'কীর্তি' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধে ভগৎ সিং লক্ষ্য করেছেন, ১৯২০-২১ সালের অসহযোগ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ার পর একের পর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটছে। তাঁর লেখার অব্যবহিত আগের ঘটনা হল কোহাট শহরের ভয়াবহ দাঙ্গা। তিনি লক্ষ্য করেছেন, বর্ণনায় প্রাধান্য পাচ্ছে মুসলমান নৃশংসতা হিন্দুদের ওপর বা শিখদের ওপর, কিংবা মুসলমানের ওপর অন্যদের অত্যাচার। কিন্তু মূল কারণটা সকলেই বাদ দিয়ে যায়। মূল কারণ অর্থনৈতিক। দারিদ্র এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে চার আনা পয়সার জন্যেও অন্যায় কাজে নাম্বার জন্য বহু মানুষ, কী হিন্দু কী শিখ কী মুসলমান প্রস্তুত। এরই সুযোগ পুঁজিবাদীরা নেয়, যাতে সব গরিব মানুষের আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তু তারা না হয়। ভগৎ সিং লিখছেন, "দাঙ্গা সর্বদাই হতাশাজনক খবরে ভর্তি, কিন্তু কলকাতার দাঙ্গায় একটা ভালো জিনিসও ঘটেছিল। শ্রমিকরা দাঙ্গায় অংশ নেয়নি, এমনকি ট্রেড ইউনিয়নগুলি চেষ্টা করেছিল মারমুখো জনতাকে শান্ত করতে। এই সব লোক শ্রেণিসচেতন হয়ে উঠেছিল এবং নিজেদের শ্রেণিস্বার্থ খুঁজতে শিখেছিল। শ্রেণিচেতনাই প্রধান হাতিয়ার যা সহায় হতে পারে দাঙ্গা রুখতে।" উপসংহারে বলছেন, "ধর্মকে যদি রাজনীতি থেকে পৃথক করা যায়, তাহলে আমরা সকলে যৌথভাবে সামিল হতে পারি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়, ধর্মীয় বিষয়ে যতই তফাত থাকুক না কেন। আমরা অনুভব করছি যে ভারতের প্রকৃত হিতৈষীরা এই নীতিগুলো অনুসরণ করে ভারতকে বাঁচাবেন সেই আত্মহননের পথ থেকে যে পথে আজ সে চলছে।" এর প্রত্যেকটি কথা আজকের ভারতেও প্রযোজ্য। ধর্ম আর রাজনীতির পৃথকীকরণ, যা ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞার্থ, আজকের ভারতে যতটা প্রয়োজন, ততখানি স্বাধীনতার পরে আর কখনও ছিল না।

একই মাসে (জুন ১৯২৮) প্রকাশিত হয়েছিল "অস্পৃশ্যতার সমস্যা"। সেখানেও তথাকথিত অস্পৃশ্যদের আহ্বান করা হয়েছিল নিজের শ্রেণিসত্তাকে উপলব্ধি করে শ্রেণিসংগ্রামে অংশ নিতে। তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, "তোমরাই আসল শ্রমিক শ্রেণি।" ঠিক পরের লাইনে উদ্ধৃত করেছিলেন মার্কস-এঙ্গেলসের অমর পঙক্তি: "দুনিয়ার মজদুর এক হও, শৃঙ্খল ছাড়া আর কিছু তোমাদের হারাবার নেই।" ভগৎ সিং তার সঙ্গে যোগ করেছিলেন, "সামাজিক আন্দোলন থেকে বিপ্লব শুরু করো।" আজকের জাতপাতের উৎপাতে ক্লিষ্ট ভারতে প্রত্যেকটি কথা গুরুত্বপূর্ণ।

ভগৎ সিং আজও যুগোপযোগী। 


Tuesday, 9 February 2021

CAA ও ভারতীয় নাগরিক - গৌতম রায়

রাজীব-মোহন্ত চুক্তির ভিতর দিয়ে আসামের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে নাগরিকত্ব আইনের ৬-এ ধারা তৈরির যে পথ খুলে দেওয়া হয়েছিল, সেটিকেই পরবর্তীকালে কেন্দ্রে এন ডি এ নামক নীতিবিহীন, সুবিধাবাদী জোট সরকারের প্রধান শরিক হিসেবে বিজেপি-র নেতৃত্বাধীন অটলবিহারী সরকারের ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের ১৪-এ ধারা সংযোজনের সুযোগ করে দেয়।

**********************************************************

সাধারণ মানুষ যাতে খাদ্যের দাবিতে সোচ্চার না হয়, শিক্ষার দাবিতে সোচ্চার না হয়, বেকারত্ব নিরসনের দাবি না তোলে, স্বাস্থ্যের অধিকারের দাবি না তোলে, নারীর ক্ষমতায়নের দাবি না তোলে, সংখ্যালঘুর অধিকার ব্রিটিশের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের কালের চুক্তি অনুযায়ী, সংখ্যালঘুর অধিকারের কথা না তোলে, আদিবাসী, দলিত-তফসিলি জাতি, উপজাতিভুক্ত মানুষ, যাতে তাঁদের অধিকার, কর্মসংস্থান - ইত্যাদির প্রশ্ন না তোলে, একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কোম্পানি, কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের কাছে বেচে দেওয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে কোনো প্রশ্ন যাতে তৈরি না হতে পারে, নতুন কোনো শিল্পের সম্ভাবনা কেন ভারতবর্ষে তৈরি করতে দেশের সরকার যত্নবান নয় - এই প্রশ্ন যাতে মানুষ না করেন - সেই জন্যই কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি এন আর সি-র জুজু সাধারণ মানুষকে দেখিয়ে চলেছেন।

**********************************************************

পোশাক, বেশভূষা, সাজসজ্জার উপর নির্ভর করে যিনি মানুষের ধর্ম নিরূপণ করতে চান, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতবর্ষের সংস্কৃতি, সভ্যতা সম্পর্কে কতখানি অজ্ঞ - তা ভাবলে সত্যিই আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। পবিত্র ইসলামীয় সংস্কৃতি ভারতবর্ষের রীতিনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতিতে সেলাই করে পড়া কাপড়ের কোন প্রচলন ছিল না। দর্জির দ্বারা জামাকাপড় নির্মাণের ধারণাই পবিত্র ইসলামের ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার পর ভারতবর্ষের মানুষ জেনেছেন। তার আগে এদেশের মানুষ কখনো সেলাই করা কাপড় পরতেন না। যে ব্রাহ্মণ্যবাদী - জাতপাতভিত্তিক - বর্ণভিত্তিক সংস্কৃতিকে ভারতবর্ষের ধ্যানজ্ঞান হিসেবে বিকৃতরূপে দেখিয়ে, রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চায় হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, সন্ত্রাসী শক্তি, সেই প্রাচীন ভারতীয় ধ্যানধারণায় স্টিচ করা কোনো জামাকাপড় পরবার কোন প্রচলনই ছিল না।

**********************************************************

ধর্মবিশ্বাসে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় ব্রাহ্ম ছিলেন। প্রফুল্লচন্দ্র সেন হিন্দু ধর্মের প্রচলিত রীতিনীতির প্রতি ছিলেন আস্থাবান। কার্যত প্রফুল্লচন্দ্র সেনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে জয়রামবাটিতে শ্রীশ্রী মা সারদা দেবীর জন্মস্থানকে তাঁর পরিবারের লোকজনের নানা আপত্তিকে অতিক্রম করে সম্পূর্ণভাবে রামকৃষ্ণ মিশনের আওতায় আনা সম্ভবপর হয়েছে।

জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মত মানুষ, তাঁরা ব্যক্তিজীবনে ছিলেন নাস্তিক। তা সত্ত্বেও তাঁরা একটি বারের জন্যেও অপরের ধর্মাচরণ ঘিরে কখনো কোনোরকম বাধা সৃষ্টি করেননি। জ্যোতি বাবু তাঁর ব্যক্তিজীবনে কখনো ধর্মচর্চার ধারপাশ দিয়ে না হাঁটলেও, ইন্দিরা গান্ধীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর শিখবিরোধী দাঙ্গা প্রশমনে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষদের সব ধরনের নিরাপত্তা প্রদানের উদ্দেশ্যে যখন গুরুদ্বারে গিয়েছেন, তখন শিখ ধর্মের প্রচলিত রীতিনীতিকে মান্যতা দিয়ে মাথায় উষ্ণীষ পড়েই গুরুর দ্বারে প্রবেশ করেছেন।

জ্যোতিবাবুর ব্যক্তিজীবন চর্চাতে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের এতটুকু গুরুত্ব না থাকলেও, শিখ সম্প্রদায়ের মানুষকে বাঁচানোর স্বার্থে, প্রবল বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জ্যোতি বসু যেমন কোনরকম জেদাজেদির মধ্যে যাননি, তেমনই এই বিষয়টিকে তাঁর রাজনৈতিক প্রচারের একটু মাধ্যম হিসেবে একটি বারের জন্যও তুলে ধরেননি।

**********************************************************

 ... তথাকথিত বিশেষজ্ঞরা এটাই বলবার চেষ্টা করছিলেন যে, কেরলে যেহেতু বামপন্থীদের প্রধান শত্রু হচ্ছে কংগ্রেস, তাই কেরলের প্রেক্ষিতকে সামনে রেখে, কোনো অবস্থাতে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টভুক্ত দলগুলি কেরালাতে দলের সঙ্গে শত্রুতার সম্পর্ক যে রাজনৈতিক দলের, সেই দলের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের সংগ্রামের ক্ষেত্রে কোনো বোঝাপড়া বা গণআন্দোলনের ক্ষেত্রে কোন বোঝাপড়া করে উঠতে পারেন না।

এই অভিমতটি সম্পূর্ণভাবেই একাংশের তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের একান্ত নিজস্ব অভিমত। তা নিয়ে নতুন করে বলবার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ গোটা বিষয়টি নিয়ে আলাপ আলোচনার যে নির্যাস বামপন্থী দলগুলোর পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে কোনো অবস্থাতেই এই তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের অভিমতকে সিলমোহর দেওয়া হয়নি।

তবুও রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে, কেরলে ক্ষমতাসীন বামপন্থীদের সঙ্গে বিরোধী কংগ্রেসের রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রেক্ষিতে, জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের আনা এন আর সি, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা তারও আগের প্রেক্ষিতে - সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারা ও ৩৫এর এ ধারার অবলুপ্তি, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের জমি সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়দানের পর যে পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার প্রেক্ষিতে, গোটা দেশকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের হাত থেকে রক্ষা করতে, সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়কে সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় নিরাপত্তা দেওয়ার স্বার্থে, সমস্ত রকমের রাজনৈতিক বিরোধকে পাশে রেখে, একযোগে কেন্দ্রের ভারতবর্ষের মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত করে, ভারতবর্ষকে রাজনৈতিক হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করবার এই ভয়ঙ্কর চক্রান্তের বিরুদ্ধে, একযোগে আন্দোলন সাম্প্রতিক ভারতের গণআন্দোলনের ইতিহাসের ক্ষেত্রে এক নয়া দিগন্ত উন্মোচিত করেছে।

কেরালাতে সেখানকার শাসক ও বিরোধী দলের কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের এই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধে একযোগে লড়াইকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ এই প্রশ্নের অবতারণা করছেন যে, পরস্পর বিরোধী দুটি রাজনৈতিক দল যদি কেরালায় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে একত্রে লড়াই করতে পারে, তাহলে কেন, পশ্চিমবঙ্গে, এখানকার শাসক তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিরোধী বামপন্থীরা একযোগে লড়াই করতে পারবে না?

বস্তুত এই তত্ত্বটি অনেকদিন ধরে সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতিক, যারা বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমতাসীন করবার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ভূমিকা নিয়েছিল, তারা বাতাসে ভাসিয়ে দিতে শুরু করেছিল। সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে রুখতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বামপন্থীদের একযোগে আন্দোলনে নামা উচিত - এমন আজগুবি তত্ত্ব তারা অনেকদিন ধরে নানা পত্র-পত্রিকায় সন্দর্ভের ভিতর দিয়ে, সামাজিক গণমাধ্যমের ভিতর দিয়ে, সাধারণ আলাপচারিতার মধ্যে দিয়ে তুলে আনবার চেষ্টা করছিল।

এই প্রশ্নের প্রথম এবং প্রধান উত্তর হলো এই যে, অর্থনৈতিক প্রশ্ন এবং শ্রেণি অবস্থানের প্রশ্নে কংগ্রেস দলের সম্পর্কে যথেষ্ট প্রশ্ন এবং সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও একথা অত্যন্ত জোর দিয়ে বলতে হয় যে, কংগ্রেস দল নীতিগতভাবে কোনো অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িক নয়। আজ পর্যন্ত কি কেন্দ্রে কি কোনো রাজ্যে সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে কংগ্রেস দল বামপন্থীদের মতোই, কোনো সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী দলের সঙ্গে আঁতাত করে সরকারে থাকেনি।

অপরপক্ষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তাঁর তৃণমূল কংগ্রেস প্রকাশ্যে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করলেও, নয়ের দশকের শেষভাগ থেকে তারা বিজেপির জোটসঙ্গী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। পরবর্তীকালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এন ডি এ নামক নীতিহীন সুবিধাবাদী জোটের শরিক হয়ে একটানা সাড়ে ছয় বছর কেন্দ্রে ক্ষমতার মৌতাত উপভোগ করেছে। এই সময়কালে সর্বনাশা অর্থনৈতিক নানা ধরনের সিদ্ধান্তের পাশাপাশি গোটা দেশজুড়ে বিজেপি এবং তার সঙ্গীসাথীরা ও তাদের মূল মস্তিস্ক আর এস এস যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন চালিয়েছে, সে সম্পর্কে কিন্তু কেন্দ্রে মন্ত্রী থাকাকালীন বা তারপরেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি প্রতিবাদসূচক শব্দ আজ পর্যন্ত ব্যবহার করেননি।

এমনকি গুজরাত গণহত্যা যখন সংগঠিত হয় নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে, সেই সময়কালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শরিক থেকেছেন এন ডি এ-র। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে দেখেছেন সব কিছু। কিন্তু একটিবারের জন্য সেই গণহত্যার এতটুকুও প্রতিবাদ তাঁর কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়নি। শুধু তাই নয়, গুজরাট গণহত্যায় হাজার হাজার সংখ্যালঘু মুসলমানের রক্তে হাত লাল করে নরেন্দ্র মোদি যখন বিধানসভা নির্বাচনে আবার জিতে আসেন, তখন এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই নরেন্দ্র মোদিকে আজকের বিজেপি নেতা মুকুল রায়ের মাধ্যমে ফুল পাঠিয়ে শুভেচ্ছা পর্যন্ত জানিয়েছিলেন।

অস্ট্রেলিয়ার মিশনারী ফাদার গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টেইন্সকে দুই শিশুপুত্র সহ জিপে আগুন লাগিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে আর এস এসের সহযোগী বজরং দল। গোটা উড়িষ্যা জুড়ে সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষদের উপরে নানা ধরনের অত্যাচার চালায় আর এস এস ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো। বাজপেয়ী জমানাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় অবস্থান করে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু একটিবারও সেইসব অপকর্মের কোনরকম বিরোধিতা করেননি।

রাজনৈতিক হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে বাজপেয়ী সরকারের আমলে যেভাবে এন সি আর টি থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইতিহাস পাঠক্রমকে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক অভিধারায় বিকৃত করা শুরু হয়েছিল, সে সম্পর্কে কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটিবারের জন্য কোনো রকম প্রতিবাদ করেননি। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের ক্ষমতাচ্যুত করতে সেই সময় এ রাজ্যের বুকে বিজেপি এবং তাদের মূল মস্তিস্ক আর এস এসের বিভিন্ন ধরনের তথাকথিত সামাজিক সংগঠনগুলির শ্রীবৃদ্ধিতে সবরকমভাবে সাহায্য করেছিলেন।

বস্তুত পশ্চিমবঙ্গের বুকে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর হিন্দু সাম্প্রদায়িক, রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে সংসদীয় গণতন্ত্রের নিরিখে এবং সামাজিক অবস্থানের নিরিখে পায়ের নিচে জমি করে দেওয়ার ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে ন্যক্কারজনক ভূমিকা, তার প্রেক্ষিতে সেই ব্যক্তির বিজেপি বিরুদ্ধতার মধ্যে আদৌ সততা আছে কিনা - এই প্রশ্নটি প্রথম তোলা দরকার।

Monday, 18 January 2021

আসামে নাগরিকপঞ্জির সাতকাহন - দেবর্ষি দাস

উপনিবেশি আসামে শ্রমজীবীদের প্রব্রজন অনবরত হয়ে চলেছে। মোটের ওপর তিনটে ভাগে ফেলা যায়।

১। সরকার চালানোর জন্য চাই অফিসের বড়বাবু, মেজবাবু, ছোটবাবু, কেরানি, পিওন, আর্দালিদের দঙ্গল। বৃটিশ ফৌজের সাথে আছে নানা স্তরের কলমচি, ছোট সরকারি চাকুরে। বিচারব্যবস্থার সাথে যুক্ত পেশাদারেরা - বিচারক, উকিল, মোক্তার, কেরানি। আছে রসদ যোগানদারেরা, মানে সাপ্লায়ার ও ব্যবসায়ীরা। কলমচি ও ব্যবসায়ীর দল বৃটিশদের পেছন পেছন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বসতি পত্তন করে। এর মধ্যে বাঙালি, মারোয়াড়ি বা অন্য ভাষাভাষিরা পড়বেন। বাঙালি বলতে হিন্দু বাঙালি। ইংরেজদের চালু করা শিক্ষা বাকিদের তুলনায় হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে বেশি ছড়িয়েছিল। রাজস্বের খাতিরে ১৮৭৪ সালে সিলেট জেলাকে পূর্ববঙ্গ থেকে কেটে আসামের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়। লেখাপড়া জানা হিন্দু বাঙালির ঠাটবাট বাড়ে। 

২। দুই নম্বর প্রব্রজন শুরু হয় চা বাগানগুলো ফুলেফেঁপে ওঠার পর। ১৮৩০-এর দশকে প্রথম চা বাগান পত্তন হয়। প্রথম দিকে চা শ্রমিকদের চীন থেকে আনা হত। চা চাষ, চা পাতা থেকে পানীয়যোগ্য চা তৈরি করার কৌশল চীনারাই জানত সে যুগে। উৎপাদন বাড়ার সাথে সাথে শ্রমিকের প্রয়োজন বাড়ে, স্থানীয় শ্রমিকদের নিয়োগ চালু হয়। বোড়ো কসারি জনজাতিদের দিয়ে কাজ করানো হত। কিন্তু বাগান মালিকেরা অচিরেই ফাঁপরে পড়লেন। জনজাতি মানুষেরা স্থায়ী বসবাসে অভ্যস্ত হননি, তাঁদের এক জায়গায় বেশিদিন থাকার অভ্যাস নেই। তার ওপরে জনজাতি মানুষদের জনসংখ্যা অপ্রতুল। বিকল্পের সন্ধান চলল। অবশেষে শ্রমিক আমদানি করা শুরু হল। ১৮৫০-এর দশক থেকে ভিন রাজ্য থেকে ব্যাপক মাত্রায় চুক্তি শ্রমিক আমদানি আরম্ভ হল। ভারত ভূখন্ডের সবচেয়ে গরিব অঞ্চলগুলো থেকে আড়কাঠি লাগিয়ে, ঠকিয়ে, লোভ দেখিয়ে, আগাম ধার দিয়ে, চা-শ্রমিকদের আনা হত। ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল থেকে সাঁওতাল, ওঁরাও, গোন্ডদের স্রোত বিশ শতক পর্যন্ত চলেছে।

"চল মিনি আসাম যাব, দেসে বড় দুখ রে..."

কাজের লোভে, রোজগারপাতির প্রতিশ্রুতিতে বহু মিনি-র দরিদ্র প্রেমিক অচেনা 'আসাম দেসের' দিকে পা বাড়িয়েছিল। তারপর কী হল গানে নেই। আছে অন্য এক বাগানিয়া গানে। ১৯৭০-এর দশকে বেরোনো 'চামেলি মেমসাহেব' সিনেমা দেখেছেন? অসমিয়া ও বাংলা দুই ভাষাতে 'চামেলি মেমসাব' বা 'চামেলি মেমসাহেব' বেরিয়েছিল। লোকগানের সুরে ভূপেন হাজরিকা সাজিয়েছিলেন মজদুর চামেলির সাথে বাগানের সাহেবের অসম ভালবাসার গল্প।

"সর্দার বলে কাম কাম 

বাবু বলে ধরি আন

সাহেব বলে লিব পিঠের চাম 

... ফাঁকি দিয়া আনিল আসাম।"

সর্দার জনজাতি। সাহেব, মানে বাগানের মালিক বা ম্যানেজার, গোরা ইউরোপীয়। আর বাবুরা প্রায়ই বাঙালি বা অসমিয়া ভদ্রলোক হত। শোষণের তিন পরতের চাপ একদম নিচের মহলের চা মজদুরেরা পিঠে সইত আর বইত।

অজানা দেশে জঞ্জল কেটে চা বাগানের পত্তন করে, ম্যালেরিয়া কালাজ্বরের সাথে পাঞ্জা লড়ে, মালিকের চাবুক খেয়ে দিন গুজরান সহজ নয়। অনেক শ্রমিক পালিয়ে যেত। বলা ভাল পালানোর চেষ্টা করত, কেননা বিদেশ বিভুঁইয়ে পালিয়ে বেশিদূর যাওয়া শক্ত। ধরা পড়লে কপালে জুটত কড়া সাজা। দ্বিতীয় স্রোতের অভিবাসীদের নাম হালে দেওয়া হয়েছে চা-জনজাতি গোষ্ঠী।

৩। ওপরের দুই ধরণের প্রব্রজনের ঠেলায় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার জনবিন্যাস বদলে যায়। ১৮৯১ সালের জনগণনাতে দেখা যাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চারজনের মধ্যে একজন বহিরাগত। তাদের পূর্বপুরুষ বা তারা বাইরে থেকে এসেছে। প্রব্রজনের তিন নম্বর ঢেউ পূর্ববঙ্গ থেকে আসে। চা শ্রমিকদের আনা হয়েছিল চা কোম্পানির মুনাফার স্বার্থে, পূর্ববঙ্গের চাষি প্রব্রজনের পেছনে ছিল সরকারের কর তোলার খাঁই।

প্রথমত, আসামে জমির অভাব ছিল না। অভাব ছিল মানুষের, যারা জমিকে চাষের আওতায় এনে সরকারকে খাজনা দেবে। 'ওয়েস্টল্যান্ড' বা অনাবাদি জমি নিয়ে সরকারের দুশ্চিন্তা প্রথম থেকেই ছিল। জমি এমনি খালি পড়ে আছে, বসতি নেই, সরকারকে খাজনা দেওয়ার লোক নেই, এই ঘটনাটাই বরদাস্ত করা যাচ্ছিল না।

দ্বিতীয়ত, জমির জন্য চাহিদা ছিল। বিশ শতকের শুরুতে বাংলায় দুটো ঘটনা ঘটে যা জমির চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। (ক) কলকাতার আশেপাশে চটকল গড়ে ওঠে। আগে বাংলা থেকে, বিশেষত পূর্ববাংলা থেকে, কাঁচা পাট রপ্তানি হত সাগরের ওই পারে বৃটেনের চটকলে। উনিশ শতকের শেষ দিকে ভারতের মাটিতেই চটকল তৈরি হতে থাকে। হুগলী নদীর দুই পারে চটকলগুলো গজিয়ে ওঠে। খালি ইউরোপীয় মালিকানায় নয়, দেশীয় পুঁজিপতিরাও, মারোয়াড়িরা, চটকল স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা নেয়। ভারত থেকে পাটসামগ্রীর রপ্তানি বাড়তে থাকে, ফলে আরো চটকল গড়ে ওঠে, কাঁচামালের চাহিদা তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকে। (খ) বিশ শতকের শুরুতে পূর্ববঙ্গের পাট উৎপাদনের জমি শেষ হয়ে আসে। পূর্ববঙ্গ এমনিতেই জনবহুল কৃষিপ্রধান অঞ্চল। এই জমি চটকলগুলোর খিদে মেটাচ্ছিল। জমি শেষ হয়ে আসার ফলে উপনিবেশি প্রভুরা নতুন জমির সন্ধান করতে থাকেন।

আসামের নদী অববাহিকার নিচু, পলিমাটি পাটচাষের জন্য উপযুক্ত। তাই দেখা গেল আসামে অনাবাদি জমির যোগান ও তার জন্য চাহিদা দুটোই ছিল। জমিনের সাথে দরকার ছিল মানবের। এই ঘাটতি পূরণের জন্য পূর্ববঙ্গীয় চাষিদের দিয়ে বসতি পত্তন শুরু হয়। প্রব্রজনকারীরা ছিলেন আর্থিক দিক দিয়ে গরিব, পেশায় ভূমিহীন বা প্রান্তিক চাষি, ধর্মে মুসলমান।

পথ দেখান গোয়ালপাড়ার জমিদারেরা। ব্রহ্মপুত্রের চর ও নদের পাশের নিচু অঞ্চলগুলোকে অসমিয়াতে 'চর-চাপরি' বলে। সাধারণত কেউ সেখানে বসবাস করত না। পূর্ববঙ্গের চাষিদের দিয়ে জমি আবাদ করানোয় গোয়ালপাড়ার জমিদারেরা উৎসাহ দিচ্ছিলেন। বৃটিশ সরকারের আগ্রহে প্রব্রজনের স্রোত উপত্যকার পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে এগোতে থাকে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হয়, পূর্ববঙ্গকে কেটে আসামের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়। ফলে পূর্ববঙ্গ থেকে প্রব্রজনের ঢেউ আরো জোরদার হয়ে ওঠে। ১৯৩০-৪০-এ একাধিক মুসলিম লীগ সরকার আসামে চলার সময়ে প্রব্রজনের স্রোত বেড়েছিল বলে অনুমান। স্বাধীনতার পর কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানে অস্থির রাজনৈতিক অবস্থা চলছিল। অর্থনীতির হালও বলার মত নয়। দরিদ্র শ্রমজীবীদের প্রব্রজন দেশভাগের পরও চলতে থাকে। প্রব্রজনকারীদের প্রধানভাগ মুসলমান, ফলে আসামের জনসংখ্যায় মুসলমান ভাগ বাড়তে থাকে। ১৮৭৪ সালে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মাত্র ৫.৯% জনসংখ্যা মুসলমান ছিল। ১৯৪১ সালে বেড়ে হয় ২৩%। ২০১১ সালের জনগণনা বলছে আসামের জনসংখ্যার ৩৪% মুসলমান।

১৯০১ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ফি দশকে আসামের জনসংখ্যার গতি ভারতের থেকে বেশি। শুধু বেশি না, অনেকটাই বেশি। আন্দাজ করা যায়, আসামে ওই সাত দশক জুড়ে প্রব্রজন হয়ে চলেছে। ১৯৭১-এর পর অবশ্য দেখা যায় আসামের জনসংখ্যার গতি কমে গেছে, ভারতের থেকে ঢিমে তালে বেড়েছে।

এখানে দু'টো কথা মনে রাখা ভাল। এক, প্রব্রজন শুধু পূর্ববঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে হয়েছে এমন নয়। ভারতের অন্য রাজ্য থেকে প্রব্রজন হলেও আসামের জনসংখ্যা ভারতের থেকে বেশি হারে বাড়বে। দুই, পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে যত প্রব্রজন হয়েছে, তার পুরোটা মুসলমান নয়। দেশভাগের সময় হিন্দু উদ্বাস্তুদের স্রোত আসামে এসেছে। দেশভাগের পরে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের ফলে দফায় দফায় মানুষের ঢেউ এপারে এসেছে। পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধের সময়ে প্রায় এক কোটি উদ্বাস্তু ভারতে আশ্রয় নেন। ভারতের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়ার কাগজেকলমে কারণ উদ্বাস্তু প্রবেশ। বাংলাদেশের জন্মের পর সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার থেমে যায়নি। 'শত্রু সম্পত্তি' বাজেয়াপ্ত করার আইন বাংলাদেশে আছে। হিন্দুদের সম্পত্তি কতখানি সুরক্ষিত তার ওপর প্রশ্নচিহ্ন আছে। সাথে আছে ছুটকো-ছাটকা দাঙ্গা। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দাঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সীমানা পেরোনোর সময় দাঙ্গার চরিত্র মুসলমান-বিরোধী থেকে বদলে হিন্দু-বিরোধী হয়ে যায়।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, এক, সাহেবরা আসার আগে আসাম (বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা) মূল ভূখন্ডের থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন ছিল। আহোম রাজারা বিদেশি মানুষ ও পণ্যের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। দুই, উপনিবেশি শাসনের সাথে প্রব্রজনের সম্পর্ক রয়েছে। তিন, বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অভিবাসী মানুষ আসামে এসেছেন। এই স্রোত বহুদিন ধরে চলছে।

======================================================

ভূমিপুত্ররক্ষার রাজনীতিকে আসাম আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই রাজনীতিই কালে কালে বেড়ে অসমিয়া জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করে দিয়েছে। এটা দুই ভাবে হয়েছে। একটা নিচ থেকে। বোড়ো, কার্বি ও অন্য জনজাতিগোষ্ঠীরা অসমিয়া জাতীয়তাবাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। জনজাতিরা নিজেদের আলাদা স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল চালাচ্ছে। অন্য রাজ্যের দাবি উঠেছে। দ্বিতীয়টা ওপর থেকে। গত তিরিশ বছরে ভারতীয় রাজনীতিতে ভারতীয় জনতা পার্টি উঠে এসেছে। তিরিশ বছর আগে কে ভাবতে পেরেছিল অগপ বিজেপি-র ছোট শরিক হয়ে আসামে সরকার চালাবে? হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিও এক ধরণের ভূমিপুত্র রাজনীতি। তবে এরা অসমিয়া জাতীয়তাবাদের থেকে অনেক বড় মাঠে খেলাধুলো করে। সর্বভারতীয় বিজেপি-র পেছনে তাবৎ বড় পুঁজির মালিকরা আছেন। সংঘের রাজনীতির উচ্চাকাঙ্খা অসমিয়া জাতীয়তাবাদীদের তুলনায় অনেক বেশি এবং সহিষ্ণুতা কম।

কিন্তু আসাম চুক্তির কী হল? কতজনকে শনাক্ত বা বহিষ্কার করা হল? ২০১২ সালের হিসেব বলছে ২,৪৪২ জন মানুষকে বহিষ্কার করা হয়েছে, আর ৫৪,০০০ মানুষকে বাংলাদেশি হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। অথচ কথা তো হচ্ছিল ৪০ লক্ষ বিদেশির। আসলে বিদেশি ক'জন আছেন আসামে? এই নিয়ে ভাল গবেষণা নেই। লোকে ৪০ লক্ষ, ৫০ লক্ষ যা হোক একটা বলে দিচ্ছে। গত ১০০ বছরের জনসংখ্যা দেখলে বোঝা যায় ১৯৭১ সালের আগে পর্যন্ত আসামের জনসংখ্যা ভারতের থেকে বেশি হারে বেড়েছে। এর জন্য সম্ভবত পূর্ববঙ্গ থেকে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রব্রজন দায়ী। ১৯৭১-এর পরে ছবিটা পাল্টে যায়। দেখা যাচ্ছে ভারতের থেকে আসামের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম। প্রব্রজনের স্রোত একেবারে গায়েব না হলেও নগণ্য হয়েছে অনুমান করা ভুল হবে না।

তাতে অবশ্য রাজনীতির ব্যাপারীদের কিছু এসে যায় না। "কম লোককে বিদেশি শনাক্ত করা হল, এটা কি আসাম চুক্তির বিফলতা নয়? ৮৫৫ শহিদের বলিদান কি জলে যাবে?" জাতীয়তাবাদীরা এই বলে মানুষকে তাতাচ্ছে। তবে জাতীয়তাবাদীদের আজকে অত ক্ষমতা নেই যে ফের রাজ্যজুড়ে আন্দোলন তৈরি করবে। তারা আইনি পথে ঝুঁকে পড়েছে। নাগরিকপঞ্জি এক মরিয়া চেষ্টা। বিদেশিদের বহিষ্কারের দাবি জানিয়ে সুপ্রীম কোর্টে মামলা হয়েছে। কোর্ট ২০১৪ সালে এনআরসি বা নাগরিকপঞ্জি নবীকরণের নির্দেশ দিয়েছে। গোটা রাজ্যের বাসিন্দাদের বৈধ নাগরিক হওয়ার প্রমাণ দিতে হবে। বংশবৃক্ষ দাখিল করে ১৯৫১ সালের নাগরিকপঞ্জিতে অন্তর্ভুক্ত লোকেদের সাথে বা ১৯৭১ সালের আগের ভোটার লিস্টের লোকেদের সাথে নিজের রক্তসম্পর্ক প্রমাণ করতে হবে।

কথা হল, রাজ্যে অবৈধ বিদেশি থাকলে প্রশাসন-পুলিশ-বিচার ব্যবস্থা তাদের ধরুক। নির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে মামলা করুক। সরকারের অপদার্থতার বোঝা সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে কেন? এরকম প্রশ্ন অনেকের মনেই উঠছে। এ যেন মাছ ধরার জন্য গোটা পুকুরের জল ছেঁচে ফেলার মত হঠকারিতা। রাজ্যে ক'জন বিদেশি বসবাসকারী আছেন তার কোনও বিশ্বাসযোগ্য হিসেব নেই। অন্তত এই কাজটা যদি গত ৩০ বছরে পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগের সাহায্যে মনোযোগ দিয়ে করা হত তাহলে বাংলাদেশি খেদানোর রাজনীতির দোকান এতদিনে বন্ধ হয়ে যেত। যেহেতু প্রামাণ্য তথ্য নেই, নেতারা আজব সব কথা বলে লোক খেপাচ্ছেন। আসামের বিজেপি-র এক সাংসদ বলেছেন গোটা দেশে পাঁচ কোটি বাংলাদেশি আছে, যা আদতে বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ! বিজেপি-র নেতারা গোটা দেশে এনআরসি-র দাবি করেছেন।

NRC - শমীক লাহিড়ী

আসামে নাগরিকপঞ্জী প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে ১৯ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১২ লক্ষ মানুষই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। সেই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের সময় বিজেপি প্রচার করেছিল নাগরিকপঞ্জী হলে কোন হিন্দুর নাম বাদ যাবে না। এমনকি এই ধরণের ঘৃণ্য-বিভেদকামী-জঘন্য প্রচার করেছিল, নাগরিকপঞ্জী তৈরী করে সব মুসলমানকে তাড়ানো হবে এবং সেই মুসলমানদের সম্পত্তি হিন্দুরা দখল করতে পারবে। দুঃখের হলেও এক বিরাট অংশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ প্রলুব্ধ হয়ে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল এবং এর ফলে বিজেপি সরকার গঠন করতে পেরেছিল। কিন্তু নাগরিকপঞ্জীর ফল প্রকাশের পর উল্টো চিত্রই দেখা যাচ্ছে। এখন নিজেদের পিঠ বাঁচানোর জন্য বিজেপি দুটো প্রচার করা শুরু করেছে। (১) সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে নাগরিকপঞ্জী  হচ্ছে, এক্ষেত্রে বিজেপির কোন হাত নেই। (২) ২০১৬ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী বিল (CAB) পাশ করিয়ে হিন্দুদের এদেশে শরণার্থী হিসাবে রেখে দেওয়া হবে, তাই হিন্দুদের দেশ ছাড়া হওয়ার কোন ভয় নেই।

এই দুটি কথাই সর্বৈব অসত্য। প্রথমত - বর্তমানে আসাম বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা করেন এবং তাঁর আবেদনের ভিত্তিতেই সুপ্রিম কোর্ট ২০০৫ সালের ১২ই জুলাই IMDT (Illegal Migrants Determination by Tribunal Act.) আইনের সেই ধারাটি বাতিল বলে ঘোষণা করে, যে আইনে কারোর বিরুদ্ধে বিদেশী অভিযোগ আনলে অভিযোগকারীকে প্রমাণ করতে হবে অভিযোগের সত্যতা। সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশে এখন যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাকেই প্রমাণ করতে হবে যে অভিযোগ অসত্য। মানুষকে বিপদে ফেলার কাজ কে শুরু করেছিল এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত - আসাম চুক্তি অনুযায়ী নাগরিকপঞ্জী তৈরীর কাজ হচ্ছে না এই অভিযোগ জানিয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্র ও আসাম রাজ্যে সরকারের মতামত জানতে চায়। বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার দুজনেই সম্মতি দেয় দ্রুত নাগরিকপঞ্জী তৈরীর কাজকে শেষ করার পক্ষে। তাদের মতামতের ভিত্তিতেই আসামে এই নাগরিকপঞ্জী গঠনের নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। এই সত্য বেমালুম গোপন করার চেষ্টা করছে বিজেপি।

তৃতীয়ত - ২০১৬ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল যা লোকসভায় পাশ হলেও রাজ্যসভায় পাশ হয়নি সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে, সেই আইন পাশ হলেও বিদেশী হিসাবে চিহ্নিত হিন্দুধর্মাবলম্বীরা কেবলমাত্র শরণার্থী রূপেই চিহ্নিত হবেন। ৬ বছর এদেশের থাকার সুযোগ পেলেও কোন সরকারী সুযোগ-সুবিধা, ব্যাঙ্ক একাউন্ট খোলা, রেশনকার্ড, সরকারী ভাতা, সরকারী-বেসরকারী চাকুরী, ভোটার তালিকায় নাম তোলা সহ অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক সুবিধার থেকে বঞ্চিত থাকবেন। ৬ বছর বাদে তারা নাগরিক হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারেন, কিন্তু নাগরিক হতে পারবেন কিনা এমন নিশ্চয়তা প্রস্তাবিত আইনে দেওয়া নেই। তাই ৬ বছর বসবাস করবার পরে এদের ভবিষ্যত কি, এই প্রশ্নের উত্তর নেই।

১০টি মিথ্যা - ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)

 মিথ্যা নং ৩ : নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন অর্থাৎ সিএএ-র জাতীয় নাগরিক নিবন্ধক (এনআরসি)-র সাথে কোনও সম্পর্ক নেই। এটি সম্পূর্ণ পৃথক এবং বিরোধীরা মিথ্যাভাবে দুটিকে যুক্ত করার চেষ্টা করছে।

সত্য : সিএএ এবং এনআরসি একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বিজেপি'র পরিকল্পনা প্রথমে সিএএ বাস্তবায়ন, যা আফগানিস্তান, বাংলাদেশ বা পাকিস্তান এই তিনটি দেশ থেকে আসা সমস্ত অমুসলিমকে নাগরিকত্বের অধিকার দেবে। তারপরে এনআরসি দিয়ে "অনুপ্রবেশকারী" সনাক্ত করবে। অনুপ্রবেশকারী এবং শরণার্থীদের মধ্যে পার্থক্য কী? কেবলমাত্র মুসলমানরা সিএএ-তে শরণার্থী হিসাবে যোগ্যতা অর্জন করে না এবং তাই তারা অনুপ্রবেশকারী। নিম্নলিখিত উদাহরণগুলিতে দেখা যায় যে দুটোর মধ্যে মারাত্মক সংযোগ বিজেপি নিজেই স্পষ্ট করে দিয়েছে :

এপ্রিল ২০১৯-এ অমিত শাহ বলেছিলেন, "প্রথমে সিএবি আসবে। সমস্ত শরণার্থী নাগরিকত্ব পাবেন। তারপরেই এনআরসি আসবে। এ জন্যে শরণার্থীদের দুশ্চিন্তা করা উচিত নয়, অর্থাৎ দুশ্চিন্তার বিষয় কেবল অনুপ্রবেশকারীদের। কালানুক্রম বুঝুন - সিএবি আসবে এবং তারপরে এনআরসি। এনআরসি কেবল বাংলার জন্য নয়, এটি পুরো দেশের জন্য" (বিজেপি'র অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ভিডিও)।

৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ : অমিত শাহ সংসদে বলেছিলেন যে সিএএ পাসের পর একটি দেশব্যাপী এনআরসি হবে। লোকসভায় সিএএ নিয়ে বিতর্ক চলাকালীন তিনি বলেছিলেন, "আমরা দেশজুড়ে এনআরসি নিয়ে আসব। একজনও অনুপ্রবেশকারীকে রেহাই দেওয়া হবে না।"

১৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ : বিজেপি'র কার্যনির্বাহী সভাপতি জে পি নাড্ডা জানিয়েছিলেন যে সিএএ বাস্তবায়িত হবে এবং "এগিয়ে গিয়ে এনআরসিও আনা হবে।" তিনি আরও বলেছিলেন, "প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে চলেছে এবং চলবে। নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন কার্যকর করা হবে, ভবিষ্যতে এনআরসিও হবে।"

না, বিরোধী দলগুলো সিএএ এবং এনআরসি'কে সংযুক্ত করেনি, বিজেপি'র কলঙ্কিত পরিকল্পনাই এই দুটির যোগসূত্র।

এন আর সি বিভাজনের রাজনীতি - হরিলাল নাথ

হিন্দু রাষ্ট্রের মৌলিক ভাবনায় নাগরিকত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। হিন্দু রাষ্ট্রের নাগরিকদের দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে। ১৯২১ সালে সাভারকার যে হিন্দুত্ববাদের সূচনা করেছেন তাতে এই দুই শর্তের স্পষ্ট ব্যাখ্যা আছে। একটি পিতৃভূমি। কোনো ব্যক্তির পিতৃপুরুষ যে ভৌগোলিক অঞ্চলে জন্মেছেন সেটাই তাঁর পিতৃভূমি। দ্বিতীয়টি দেবভূমি। কোনো ব্যক্তি যে ধর্মের অনুসারি সেই ধর্মের উৎসভূমি হল দেবভূমি। এই সূত্র অনুযায়ী বৈদিকবাদ, সনাতনবাদ, জৈন, বৌদ্ধ, লিঙ্গায়েত, শিখ, আর্য সমাজ, ব্রহ্ম সমাজ, দেব সমাজ, প্রার্থনা সমাজ-সহ অনুরূপ ধর্মমতগুলির উৎস 'হিন্দুস্থান' এবং এগুলি সবই হিন্দু ধর্মের শাখা বা অংশ। এই ধর্মাবলম্বীদের সকলেরই পিতৃভূমি ভারত। কিন্তু ভারতীয় মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, পার্সিদের পিতৃভূমি ভারত হলেও তাদের 'হিন্দুস্থানি' বলে গণ্য করা হবে না। কারণ তাদের দেবভূমি অর্থাৎ ধর্মের উৎসভূমি 'হিন্দুস্থান' নয়। একইভাবে জাপানি চীনা-সহ অন্য অনেক দেশের মানুষ যাদের দেবভূমি ভারত হলেও (বৌদ্ধ ধর্মের সূত্রে) পিতৃভূমি ভারত নয়।

========================================================

এনআরসি-কে কেন্দ্র করে অনেকগুলি গুরুতর প্রশ্ন সামনে এসেছে। তার কোনো সদুত্তর মিলছে না।

১। ১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তি অনুযায়ী আসামে এনআরসি হচ্ছে। সেই চুক্তিতে সারা দেশে এনআরসি-র কোনো কথা নেই। তাহলে সারা দেশে এনআরসি-র প্রসঙ্গ উঠছে কেন? তা ছাড়া আসামে প্রথম এনআরসি হয় ১৯৫১ সালে। পরবর্তীকালে নির্দিষ্ট সময় অন্তর তা আপডেট বা সময়োপযোগী করার কথা। অর্থাৎ এখন যে এনআরসি হচ্ছে সেটা আসলে আপডেট হবার কথা।

২। এনআরসি আবেদন ভিত্তিক ব্যবস্থা। দেশের সব অধিবাসীকেই নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে। তার মানে বর্তমানে দেশে একজনও নাগরিক নেই। নাগরিক হবার জন্য তাদের সকলকে আবেদন জানাতে হবে। তবে কি স্বাধীনতার পর ৭০ বছর ধরে ভারত নামক দেশে একজনও নাগরিক ছিল না? নাগরিকহীনভাবেই ৭০ বছর ধরে একটা দেশ চলেছে। যদি এতদিন নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হত তাহলে নতুন করে নাগরিকত্ব প্রমাণের প্রশ্ন থাকে না। সকলকে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য আবেদন করতে বলার অর্থ তাঁরা নাগরিক নন। তবে কি এতদিন অনাগরিকরাই ভোট দিয়ে সরকার গঠন করত, সরকারি সুযোগ সুবিধা ও অধিকার ভোগ করত? এমন আজব কাণ্ড সম্ভবত ভারতেই সম্ভব।

৩। আসামে ১৯ লক্ষ বাংলাদেশি চিহ্নিত। পশ্চিমবঙ্গে নাকি ২ কোটি বাংলাদেশি আছে। সারা দেশে আরও বেশ কয়েক লক্ষ হবে। এঁদের নাকি তাড়ানো হবে। কোথায় তাড়ানো হবে? বাংলাদেশ নেবে না। তাহলে যাবে কোথায়? তাদের ভবিষ্যৎ কি? উত্তর নেই।

৪। আসামে ডিটেনশন কেন্দ্রে আপাতত ৯ হাজার জনের থাকার ব্যবস্থা। বাকি ১৮ লক্ষ ৯৭ হাজারকে কোথায় রাখা হবে? এদিকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ কাউকে ৩ বছরের বেশি আটক রাখা যাবে না। ছেড়ে দিতে হবে। তাহলে কিভাবে ছাড়া হবে? ছাড়ার পর তাঁরা কি করবেন? চিহ্নিত বিদেশিদের জমিজমা, বাড়িঘর, অর্থ-সম্পদ কারা ভোগ করবে?

৫। প্রথমে ট্রাইবুনাল, তারপর হাইকোর্ট, শেষে সুপ্রিম কোর্ট। বিচার পর্ব শেষ করতে কত বছর সময় লাগবে কেউ জানে না। ততদিন বাতিলদের অবস্থান কি হবে? যে গতিতে ভারতে মামলার নিষ্পত্তি হয় এবং যে বিপুল সংখ্যক মামলা বকেয়া আছে তাতে শুধু আসামের বিদেশি নিশ্চিত করতে এক দশক সময় লেগে যেতে পারে। এরপর পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা দেশে এনআরসি হলে তার ধাক্কা সামলাতে আরও কয়েক দশক কেটে যাবে।

৬। সারা দেশে দাবি অনুযায়ী দু কোটি বাংলাদেশি চিহ্নিত হয় তাহলে তাদের ডিটেনশন সেন্টারে রেখে নূন্যতম প্রয়োজনের যোগান দিতে সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। অর্থ সঙ্কটের সময় এই বাড়তি দায় বহন করা সরকারের পক্ষে কতটা সম্ভব?

এমন উত্তরহীন প্রশ্ন আরও অনেক আছে। বোঝা যাচ্ছে সরকার চলছে বিভ্রান্তি আর উদ্বেগের ঘোলা জলে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে।

Wednesday, 13 January 2021

বিপন্ন কৃষি ও কৃষক

 তিনটি আইন আলাদা আলাদাভাবে বলবৎ হলেও তিনটি আইন অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। এই তিনটি আইন কৃষকের স্বার্থে নয়। এমনকী, কৃষি উৎপাদনের যাঁরা চূড়ান্ত ভোক্তা, তাঁদের স্বার্থেও নয়। আইনগুলি খোলা মনে পর্যালোচনা করলেই ধরা পড়ে এই সত্য। তিনটি আইনের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি -

১। কৃষকের জন্য নূন্যতম সহায়ক মূল্যের প্রতিশ্রুতি কোথাও নেই।

২। মজুতদারি আর বেআইনি বলে গণ্য হবে না।

৩। চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, তৈলবীজ, খাদ্যযোগ্য তেল ইত্যাদি পণ্যগুলির মজুতদারি ও দামে সরকারি তরফে নিয়ন্ত্রণ হবে কেবলমাত্র যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অন্যান্য সাধারণ দাম বৃদ্ধি এবং মারাত্মক দুর্যোগ ইত্যাদি অনন্য সাধারণ পরিস্থিতিতে।

৪। সেক্ষেত্রেও সবজি ও ফল ইত্যাদির ক্ষেত্রে ১০০% ও অপচনশীল কৃষিজ পণ্য অর্থাৎ তেল, চা, চিনি ইত্যাদির ক্ষেত্রে ৫০% দাম বৃদ্ধি ঘটলে তবেই সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

৫। সেক্ষেত্রেও মূল্য সংযোগশৃঙ্খলে উৎপাদনের মধ্যবর্তী স্তরে কোনো কারবার বা কারবারির উপর সেই নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্ত হবে না। উদাহরণ, কোনো আলুভাজা প্রস্তুতকারক সংস্থা বাজারে আলুর দাম আগুন হলেও যথেচ্ছ আলু মজুত রাখতে পারবে কিংবা, চিনির দর আকাশ ছুঁলেও চিনি কল আখ মজুত করে চলবে।

৬। রাজ্যের হাত থেকে কৃষি ব্যবস্থা পুরোপুরি কেন্দ্রের অধিকারে চলে যাবে।

৭। রাজ্যের হাতে মান্ডির বাইরে কৃষি থেকে আয়ের কোনো উপায় থাকবে না।

৮। কৃষি পণ্যের কারবারিরা নিজেদের স্বার্থে মান্ডির কমিশন এজেন্ট বা ফড়েদের মাধ্যমে কৃষকের পণ্য মাঠ থেকে সরাসরি হাতিয়ে নেবার উদ্যোগ নেবেন।

৯। এমএসপি নির্ধারিত দাম মান্ডির বাইরে আদায় হওয়ার বাধ্যবাধকতা না থাকায় জবরদস্তি করার সুযোগ থাকবে।

১০। অত্যাবশ্যক নিত্য প্রয়োজনীয় চাল, ডাল, তৈলবীজ, পেঁয়াজ আর আলু অত্যাবশ্যক থাকবে না। রাজ্যের হাতেও বাজারের দাম নিয়ন্ত্রকের কোনো অধিকার থাকবে না। ফলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সঙ্কটের সম্মুখীন হতে বাধ্য।

১১। বর্তমানে নানান আইন সত্ত্বেও ছোটো কৃষকেরা ফড়েদের হাতের শিকার। যেটুকু আইনি ব্যবস্থা ছিল কৃষক স্বার্থ রক্ষায় তাও তুলে নেওয়া হবে নতুন ব্যবস্থায়। কৃষি পণ্য লেনদেনে কৃষক স্বার্থ দেখার খাতাকলমের ব্যবস্থাটুকুও তুলে নেওয়া হবে এই নতুন ব্যবস্থায়।

১২। তৈরি হবে তিন ধরনের বাজার। মান্ডি, চুক্তি চাষ, মান্ডির বাইরের বাজার। মান্ডি তৈরি হয়েছিল ফড়েরা যাতে কৃষকদের জমি থেকে পণ্য তুলে তাদের অত্যাচার না করতে পারে। নতুন ব্যবস্থায় কৃষকের বাড়ি পর্যন্ত ফড়েদের যাওয়ার রাস্তা আরও প্রশস্ত হবে।

১৩। চুক্তি চাষ হবে। চুক্তি হবে কৃষক ও বাণিজ্য সংস্থার মধ্যে। চুক্তিতে ফসলের পরিমাণ, গুনগত মান, দাম ইত্যাদি সমস্তই আগাম নির্ধারিত থাকবে।

১৪। চুক্তিভঙ্গে সরকার সাধারন কৃষকের পাশে কীভাবে থাকবে অথবা থাকবে কিনা তা অনুচ্চারিত।

১৫। এই চুক্তি সম্পাদিত হবে মহকুমাশাসকের কর্তৃত্বের এক্তিয়ারে।

১৬। এই চুক্তির উপর রাজ্যের নিজস্ব আইন বা আদেশের কোনো প্রভাব থাকবে না।

১৭। চুক্তি খেলাপ করার অভিযোগ উঠলে, তার বিচার দেশের দেওয়ানি আদালতে হবে না।

১৮। চুক্তি সংক্রান্ত যাবতীয় বিবাদের বিচার করবেন মহকুমা শাসক। তাঁর বিচারে সন্তুষ্ট না হলে আপিল করতে হবে জেলা শাসক বা অতিরিক্ত জেলা শাসকের অধীন উত্তর-বিচার কর্তৃপক্ষের কাছে। এক্ষেত্রে মহকুমাশাসক, জেলা শাসক তথা উত্তর-বিচার কর্তৃপক্ষের রায় দেশের দেওয়ানি আদালতের রায়ের সমান মান্যতা পাবে।

১৯। সরকারি তরফে কৃষির বাজার ও বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষেত্র সমস্তটাই কুক্ষিগত থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। রাজ্যের আইন এক্ষেত্রে প্রশ্ন তুলতে পারবে না। দেশের আদালত তথা মূল বিচার ব্যবস্থার কোনও ভূমিকাই নেই। কেন্দ্রের সঙ্গে সরাসরি প্রশাসনিক যোগাযোগ থাকবে জেলা শাসক ও মহকুমা শাসকের। রাজ্য প্রশাসন থাকবে নীরব দর্শক। আসলে এই তিনটি কৃষি আইন ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, স্বেচ্ছাচার, একনায়কতন্ত্র ও কর্পোরেট আনুগত্যের দলিল।

এক দেশ, এক বাজার শ্লোগানকে সামনে রেখে অবাধ বাণিজ্যের বিষয়টিকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। কৃষকের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে কর্পোরেটরা এর ফলে সুবিধা ভোগ করবে। সহায়ক মূল্য ও মূল্য স্হিতিশীল রাখার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় কৃষক সমাজকে সার্বিকভাবেই কৃষি ব্যবসার কর্পোরেটদের দয়া দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করতে হবে। এই তিনটি আইন আগ্রাসী নয়া উদারবাদী ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে। অনাহার, দুর্দশা, অসহায় অবস্থার মধ্যে থাকা কৃষক সমাজ ও গ্রামের গরিব মানুষের উপর তীব্র অর্থনৈতিক আক্রমণ নেমে আসবে।