হিন্দু রাষ্ট্রের মৌলিক ভাবনায় নাগরিকত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। হিন্দু রাষ্ট্রের নাগরিকদের দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে। ১৯২১ সালে সাভারকার যে হিন্দুত্ববাদের সূচনা করেছেন তাতে এই দুই শর্তের স্পষ্ট ব্যাখ্যা আছে। একটি পিতৃভূমি। কোনো ব্যক্তির পিতৃপুরুষ যে ভৌগোলিক অঞ্চলে জন্মেছেন সেটাই তাঁর পিতৃভূমি। দ্বিতীয়টি দেবভূমি। কোনো ব্যক্তি যে ধর্মের অনুসারি সেই ধর্মের উৎসভূমি হল দেবভূমি। এই সূত্র অনুযায়ী বৈদিকবাদ, সনাতনবাদ, জৈন, বৌদ্ধ, লিঙ্গায়েত, শিখ, আর্য সমাজ, ব্রহ্ম সমাজ, দেব সমাজ, প্রার্থনা সমাজ-সহ অনুরূপ ধর্মমতগুলির উৎস 'হিন্দুস্থান' এবং এগুলি সবই হিন্দু ধর্মের শাখা বা অংশ। এই ধর্মাবলম্বীদের সকলেরই পিতৃভূমি ভারত। কিন্তু ভারতীয় মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, পার্সিদের পিতৃভূমি ভারত হলেও তাদের 'হিন্দুস্থানি' বলে গণ্য করা হবে না। কারণ তাদের দেবভূমি অর্থাৎ ধর্মের উৎসভূমি 'হিন্দুস্থান' নয়। একইভাবে জাপানি চীনা-সহ অন্য অনেক দেশের মানুষ যাদের দেবভূমি ভারত হলেও (বৌদ্ধ ধর্মের সূত্রে) পিতৃভূমি ভারত নয়।
========================================================
এনআরসি-কে কেন্দ্র করে অনেকগুলি গুরুতর প্রশ্ন সামনে এসেছে। তার কোনো সদুত্তর মিলছে না।
১। ১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তি অনুযায়ী আসামে এনআরসি হচ্ছে। সেই চুক্তিতে সারা দেশে এনআরসি-র কোনো কথা নেই। তাহলে সারা দেশে এনআরসি-র প্রসঙ্গ উঠছে কেন? তা ছাড়া আসামে প্রথম এনআরসি হয় ১৯৫১ সালে। পরবর্তীকালে নির্দিষ্ট সময় অন্তর তা আপডেট বা সময়োপযোগী করার কথা। অর্থাৎ এখন যে এনআরসি হচ্ছে সেটা আসলে আপডেট হবার কথা।
২। এনআরসি আবেদন ভিত্তিক ব্যবস্থা। দেশের সব অধিবাসীকেই নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে। তার মানে বর্তমানে দেশে একজনও নাগরিক নেই। নাগরিক হবার জন্য তাদের সকলকে আবেদন জানাতে হবে। তবে কি স্বাধীনতার পর ৭০ বছর ধরে ভারত নামক দেশে একজনও নাগরিক ছিল না? নাগরিকহীনভাবেই ৭০ বছর ধরে একটা দেশ চলেছে। যদি এতদিন নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হত তাহলে নতুন করে নাগরিকত্ব প্রমাণের প্রশ্ন থাকে না। সকলকে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য আবেদন করতে বলার অর্থ তাঁরা নাগরিক নন। তবে কি এতদিন অনাগরিকরাই ভোট দিয়ে সরকার গঠন করত, সরকারি সুযোগ সুবিধা ও অধিকার ভোগ করত? এমন আজব কাণ্ড সম্ভবত ভারতেই সম্ভব।
৩। আসামে ১৯ লক্ষ বাংলাদেশি চিহ্নিত। পশ্চিমবঙ্গে নাকি ২ কোটি বাংলাদেশি আছে। সারা দেশে আরও বেশ কয়েক লক্ষ হবে। এঁদের নাকি তাড়ানো হবে। কোথায় তাড়ানো হবে? বাংলাদেশ নেবে না। তাহলে যাবে কোথায়? তাদের ভবিষ্যৎ কি? উত্তর নেই।
৪। আসামে ডিটেনশন কেন্দ্রে আপাতত ৯ হাজার জনের থাকার ব্যবস্থা। বাকি ১৮ লক্ষ ৯৭ হাজারকে কোথায় রাখা হবে? এদিকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ কাউকে ৩ বছরের বেশি আটক রাখা যাবে না। ছেড়ে দিতে হবে। তাহলে কিভাবে ছাড়া হবে? ছাড়ার পর তাঁরা কি করবেন? চিহ্নিত বিদেশিদের জমিজমা, বাড়িঘর, অর্থ-সম্পদ কারা ভোগ করবে?
৫। প্রথমে ট্রাইবুনাল, তারপর হাইকোর্ট, শেষে সুপ্রিম কোর্ট। বিচার পর্ব শেষ করতে কত বছর সময় লাগবে কেউ জানে না। ততদিন বাতিলদের অবস্থান কি হবে? যে গতিতে ভারতে মামলার নিষ্পত্তি হয় এবং যে বিপুল সংখ্যক মামলা বকেয়া আছে তাতে শুধু আসামের বিদেশি নিশ্চিত করতে এক দশক সময় লেগে যেতে পারে। এরপর পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা দেশে এনআরসি হলে তার ধাক্কা সামলাতে আরও কয়েক দশক কেটে যাবে।
৬। সারা দেশে দাবি অনুযায়ী দু কোটি বাংলাদেশি চিহ্নিত হয় তাহলে তাদের ডিটেনশন সেন্টারে রেখে নূন্যতম প্রয়োজনের যোগান দিতে সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। অর্থ সঙ্কটের সময় এই বাড়তি দায় বহন করা সরকারের পক্ষে কতটা সম্ভব?
এমন উত্তরহীন প্রশ্ন আরও অনেক আছে। বোঝা যাচ্ছে সরকার চলছে বিভ্রান্তি আর উদ্বেগের ঘোলা জলে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে।
No comments:
Post a Comment