Tuesday, 9 February 2021

CAA ও ভারতীয় নাগরিক - গৌতম রায়

রাজীব-মোহন্ত চুক্তির ভিতর দিয়ে আসামের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে নাগরিকত্ব আইনের ৬-এ ধারা তৈরির যে পথ খুলে দেওয়া হয়েছিল, সেটিকেই পরবর্তীকালে কেন্দ্রে এন ডি এ নামক নীতিবিহীন, সুবিধাবাদী জোট সরকারের প্রধান শরিক হিসেবে বিজেপি-র নেতৃত্বাধীন অটলবিহারী সরকারের ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের ১৪-এ ধারা সংযোজনের সুযোগ করে দেয়।

**********************************************************

সাধারণ মানুষ যাতে খাদ্যের দাবিতে সোচ্চার না হয়, শিক্ষার দাবিতে সোচ্চার না হয়, বেকারত্ব নিরসনের দাবি না তোলে, স্বাস্থ্যের অধিকারের দাবি না তোলে, নারীর ক্ষমতায়নের দাবি না তোলে, সংখ্যালঘুর অধিকার ব্রিটিশের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের কালের চুক্তি অনুযায়ী, সংখ্যালঘুর অধিকারের কথা না তোলে, আদিবাসী, দলিত-তফসিলি জাতি, উপজাতিভুক্ত মানুষ, যাতে তাঁদের অধিকার, কর্মসংস্থান - ইত্যাদির প্রশ্ন না তোলে, একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কোম্পানি, কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের কাছে বেচে দেওয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে কোনো প্রশ্ন যাতে তৈরি না হতে পারে, নতুন কোনো শিল্পের সম্ভাবনা কেন ভারতবর্ষে তৈরি করতে দেশের সরকার যত্নবান নয় - এই প্রশ্ন যাতে মানুষ না করেন - সেই জন্যই কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি এন আর সি-র জুজু সাধারণ মানুষকে দেখিয়ে চলেছেন।

**********************************************************

পোশাক, বেশভূষা, সাজসজ্জার উপর নির্ভর করে যিনি মানুষের ধর্ম নিরূপণ করতে চান, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতবর্ষের সংস্কৃতি, সভ্যতা সম্পর্কে কতখানি অজ্ঞ - তা ভাবলে সত্যিই আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। পবিত্র ইসলামীয় সংস্কৃতি ভারতবর্ষের রীতিনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতিতে সেলাই করে পড়া কাপড়ের কোন প্রচলন ছিল না। দর্জির দ্বারা জামাকাপড় নির্মাণের ধারণাই পবিত্র ইসলামের ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার পর ভারতবর্ষের মানুষ জেনেছেন। তার আগে এদেশের মানুষ কখনো সেলাই করা কাপড় পরতেন না। যে ব্রাহ্মণ্যবাদী - জাতপাতভিত্তিক - বর্ণভিত্তিক সংস্কৃতিকে ভারতবর্ষের ধ্যানজ্ঞান হিসেবে বিকৃতরূপে দেখিয়ে, রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চায় হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, সন্ত্রাসী শক্তি, সেই প্রাচীন ভারতীয় ধ্যানধারণায় স্টিচ করা কোনো জামাকাপড় পরবার কোন প্রচলনই ছিল না।

**********************************************************

ধর্মবিশ্বাসে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় ব্রাহ্ম ছিলেন। প্রফুল্লচন্দ্র সেন হিন্দু ধর্মের প্রচলিত রীতিনীতির প্রতি ছিলেন আস্থাবান। কার্যত প্রফুল্লচন্দ্র সেনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে জয়রামবাটিতে শ্রীশ্রী মা সারদা দেবীর জন্মস্থানকে তাঁর পরিবারের লোকজনের নানা আপত্তিকে অতিক্রম করে সম্পূর্ণভাবে রামকৃষ্ণ মিশনের আওতায় আনা সম্ভবপর হয়েছে।

জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মত মানুষ, তাঁরা ব্যক্তিজীবনে ছিলেন নাস্তিক। তা সত্ত্বেও তাঁরা একটি বারের জন্যেও অপরের ধর্মাচরণ ঘিরে কখনো কোনোরকম বাধা সৃষ্টি করেননি। জ্যোতি বাবু তাঁর ব্যক্তিজীবনে কখনো ধর্মচর্চার ধারপাশ দিয়ে না হাঁটলেও, ইন্দিরা গান্ধীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর শিখবিরোধী দাঙ্গা প্রশমনে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষদের সব ধরনের নিরাপত্তা প্রদানের উদ্দেশ্যে যখন গুরুদ্বারে গিয়েছেন, তখন শিখ ধর্মের প্রচলিত রীতিনীতিকে মান্যতা দিয়ে মাথায় উষ্ণীষ পড়েই গুরুর দ্বারে প্রবেশ করেছেন।

জ্যোতিবাবুর ব্যক্তিজীবন চর্চাতে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের এতটুকু গুরুত্ব না থাকলেও, শিখ সম্প্রদায়ের মানুষকে বাঁচানোর স্বার্থে, প্রবল বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জ্যোতি বসু যেমন কোনরকম জেদাজেদির মধ্যে যাননি, তেমনই এই বিষয়টিকে তাঁর রাজনৈতিক প্রচারের একটু মাধ্যম হিসেবে একটি বারের জন্যও তুলে ধরেননি।

**********************************************************

 ... তথাকথিত বিশেষজ্ঞরা এটাই বলবার চেষ্টা করছিলেন যে, কেরলে যেহেতু বামপন্থীদের প্রধান শত্রু হচ্ছে কংগ্রেস, তাই কেরলের প্রেক্ষিতকে সামনে রেখে, কোনো অবস্থাতে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টভুক্ত দলগুলি কেরালাতে দলের সঙ্গে শত্রুতার সম্পর্ক যে রাজনৈতিক দলের, সেই দলের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের সংগ্রামের ক্ষেত্রে কোনো বোঝাপড়া বা গণআন্দোলনের ক্ষেত্রে কোন বোঝাপড়া করে উঠতে পারেন না।

এই অভিমতটি সম্পূর্ণভাবেই একাংশের তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের একান্ত নিজস্ব অভিমত। তা নিয়ে নতুন করে বলবার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ গোটা বিষয়টি নিয়ে আলাপ আলোচনার যে নির্যাস বামপন্থী দলগুলোর পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে কোনো অবস্থাতেই এই তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের অভিমতকে সিলমোহর দেওয়া হয়নি।

তবুও রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে, কেরলে ক্ষমতাসীন বামপন্থীদের সঙ্গে বিরোধী কংগ্রেসের রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রেক্ষিতে, জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের আনা এন আর সি, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা তারও আগের প্রেক্ষিতে - সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারা ও ৩৫এর এ ধারার অবলুপ্তি, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের জমি সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়দানের পর যে পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার প্রেক্ষিতে, গোটা দেশকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের হাত থেকে রক্ষা করতে, সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়কে সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় নিরাপত্তা দেওয়ার স্বার্থে, সমস্ত রকমের রাজনৈতিক বিরোধকে পাশে রেখে, একযোগে কেন্দ্রের ভারতবর্ষের মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত করে, ভারতবর্ষকে রাজনৈতিক হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করবার এই ভয়ঙ্কর চক্রান্তের বিরুদ্ধে, একযোগে আন্দোলন সাম্প্রতিক ভারতের গণআন্দোলনের ইতিহাসের ক্ষেত্রে এক নয়া দিগন্ত উন্মোচিত করেছে।

কেরালাতে সেখানকার শাসক ও বিরোধী দলের কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের এই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধে একযোগে লড়াইকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ এই প্রশ্নের অবতারণা করছেন যে, পরস্পর বিরোধী দুটি রাজনৈতিক দল যদি কেরালায় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে একত্রে লড়াই করতে পারে, তাহলে কেন, পশ্চিমবঙ্গে, এখানকার শাসক তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিরোধী বামপন্থীরা একযোগে লড়াই করতে পারবে না?

বস্তুত এই তত্ত্বটি অনেকদিন ধরে সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতিক, যারা বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমতাসীন করবার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ভূমিকা নিয়েছিল, তারা বাতাসে ভাসিয়ে দিতে শুরু করেছিল। সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে রুখতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বামপন্থীদের একযোগে আন্দোলনে নামা উচিত - এমন আজগুবি তত্ত্ব তারা অনেকদিন ধরে নানা পত্র-পত্রিকায় সন্দর্ভের ভিতর দিয়ে, সামাজিক গণমাধ্যমের ভিতর দিয়ে, সাধারণ আলাপচারিতার মধ্যে দিয়ে তুলে আনবার চেষ্টা করছিল।

এই প্রশ্নের প্রথম এবং প্রধান উত্তর হলো এই যে, অর্থনৈতিক প্রশ্ন এবং শ্রেণি অবস্থানের প্রশ্নে কংগ্রেস দলের সম্পর্কে যথেষ্ট প্রশ্ন এবং সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও একথা অত্যন্ত জোর দিয়ে বলতে হয় যে, কংগ্রেস দল নীতিগতভাবে কোনো অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িক নয়। আজ পর্যন্ত কি কেন্দ্রে কি কোনো রাজ্যে সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে কংগ্রেস দল বামপন্থীদের মতোই, কোনো সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী দলের সঙ্গে আঁতাত করে সরকারে থাকেনি।

অপরপক্ষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তাঁর তৃণমূল কংগ্রেস প্রকাশ্যে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করলেও, নয়ের দশকের শেষভাগ থেকে তারা বিজেপির জোটসঙ্গী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। পরবর্তীকালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এন ডি এ নামক নীতিহীন সুবিধাবাদী জোটের শরিক হয়ে একটানা সাড়ে ছয় বছর কেন্দ্রে ক্ষমতার মৌতাত উপভোগ করেছে। এই সময়কালে সর্বনাশা অর্থনৈতিক নানা ধরনের সিদ্ধান্তের পাশাপাশি গোটা দেশজুড়ে বিজেপি এবং তার সঙ্গীসাথীরা ও তাদের মূল মস্তিস্ক আর এস এস যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন চালিয়েছে, সে সম্পর্কে কিন্তু কেন্দ্রে মন্ত্রী থাকাকালীন বা তারপরেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি প্রতিবাদসূচক শব্দ আজ পর্যন্ত ব্যবহার করেননি।

এমনকি গুজরাত গণহত্যা যখন সংগঠিত হয় নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে, সেই সময়কালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শরিক থেকেছেন এন ডি এ-র। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে দেখেছেন সব কিছু। কিন্তু একটিবারের জন্য সেই গণহত্যার এতটুকুও প্রতিবাদ তাঁর কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়নি। শুধু তাই নয়, গুজরাট গণহত্যায় হাজার হাজার সংখ্যালঘু মুসলমানের রক্তে হাত লাল করে নরেন্দ্র মোদি যখন বিধানসভা নির্বাচনে আবার জিতে আসেন, তখন এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই নরেন্দ্র মোদিকে আজকের বিজেপি নেতা মুকুল রায়ের মাধ্যমে ফুল পাঠিয়ে শুভেচ্ছা পর্যন্ত জানিয়েছিলেন।

অস্ট্রেলিয়ার মিশনারী ফাদার গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টেইন্সকে দুই শিশুপুত্র সহ জিপে আগুন লাগিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে আর এস এসের সহযোগী বজরং দল। গোটা উড়িষ্যা জুড়ে সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষদের উপরে নানা ধরনের অত্যাচার চালায় আর এস এস ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো। বাজপেয়ী জমানাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় অবস্থান করে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু একটিবারও সেইসব অপকর্মের কোনরকম বিরোধিতা করেননি।

রাজনৈতিক হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে বাজপেয়ী সরকারের আমলে যেভাবে এন সি আর টি থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইতিহাস পাঠক্রমকে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক অভিধারায় বিকৃত করা শুরু হয়েছিল, সে সম্পর্কে কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটিবারের জন্য কোনো রকম প্রতিবাদ করেননি। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের ক্ষমতাচ্যুত করতে সেই সময় এ রাজ্যের বুকে বিজেপি এবং তাদের মূল মস্তিস্ক আর এস এসের বিভিন্ন ধরনের তথাকথিত সামাজিক সংগঠনগুলির শ্রীবৃদ্ধিতে সবরকমভাবে সাহায্য করেছিলেন।

বস্তুত পশ্চিমবঙ্গের বুকে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর হিন্দু সাম্প্রদায়িক, রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে সংসদীয় গণতন্ত্রের নিরিখে এবং সামাজিক অবস্থানের নিরিখে পায়ের নিচে জমি করে দেওয়ার ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে ন্যক্কারজনক ভূমিকা, তার প্রেক্ষিতে সেই ব্যক্তির বিজেপি বিরুদ্ধতার মধ্যে আদৌ সততা আছে কিনা - এই প্রশ্নটি প্রথম তোলা দরকার।

No comments:

Post a Comment