Wednesday, 13 January 2021

বিপন্ন কৃষি ও কৃষক

 তিনটি আইন আলাদা আলাদাভাবে বলবৎ হলেও তিনটি আইন অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। এই তিনটি আইন কৃষকের স্বার্থে নয়। এমনকী, কৃষি উৎপাদনের যাঁরা চূড়ান্ত ভোক্তা, তাঁদের স্বার্থেও নয়। আইনগুলি খোলা মনে পর্যালোচনা করলেই ধরা পড়ে এই সত্য। তিনটি আইনের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি -

১। কৃষকের জন্য নূন্যতম সহায়ক মূল্যের প্রতিশ্রুতি কোথাও নেই।

২। মজুতদারি আর বেআইনি বলে গণ্য হবে না।

৩। চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, তৈলবীজ, খাদ্যযোগ্য তেল ইত্যাদি পণ্যগুলির মজুতদারি ও দামে সরকারি তরফে নিয়ন্ত্রণ হবে কেবলমাত্র যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অন্যান্য সাধারণ দাম বৃদ্ধি এবং মারাত্মক দুর্যোগ ইত্যাদি অনন্য সাধারণ পরিস্থিতিতে।

৪। সেক্ষেত্রেও সবজি ও ফল ইত্যাদির ক্ষেত্রে ১০০% ও অপচনশীল কৃষিজ পণ্য অর্থাৎ তেল, চা, চিনি ইত্যাদির ক্ষেত্রে ৫০% দাম বৃদ্ধি ঘটলে তবেই সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

৫। সেক্ষেত্রেও মূল্য সংযোগশৃঙ্খলে উৎপাদনের মধ্যবর্তী স্তরে কোনো কারবার বা কারবারির উপর সেই নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্ত হবে না। উদাহরণ, কোনো আলুভাজা প্রস্তুতকারক সংস্থা বাজারে আলুর দাম আগুন হলেও যথেচ্ছ আলু মজুত রাখতে পারবে কিংবা, চিনির দর আকাশ ছুঁলেও চিনি কল আখ মজুত করে চলবে।

৬। রাজ্যের হাত থেকে কৃষি ব্যবস্থা পুরোপুরি কেন্দ্রের অধিকারে চলে যাবে।

৭। রাজ্যের হাতে মান্ডির বাইরে কৃষি থেকে আয়ের কোনো উপায় থাকবে না।

৮। কৃষি পণ্যের কারবারিরা নিজেদের স্বার্থে মান্ডির কমিশন এজেন্ট বা ফড়েদের মাধ্যমে কৃষকের পণ্য মাঠ থেকে সরাসরি হাতিয়ে নেবার উদ্যোগ নেবেন।

৯। এমএসপি নির্ধারিত দাম মান্ডির বাইরে আদায় হওয়ার বাধ্যবাধকতা না থাকায় জবরদস্তি করার সুযোগ থাকবে।

১০। অত্যাবশ্যক নিত্য প্রয়োজনীয় চাল, ডাল, তৈলবীজ, পেঁয়াজ আর আলু অত্যাবশ্যক থাকবে না। রাজ্যের হাতেও বাজারের দাম নিয়ন্ত্রকের কোনো অধিকার থাকবে না। ফলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সঙ্কটের সম্মুখীন হতে বাধ্য।

১১। বর্তমানে নানান আইন সত্ত্বেও ছোটো কৃষকেরা ফড়েদের হাতের শিকার। যেটুকু আইনি ব্যবস্থা ছিল কৃষক স্বার্থ রক্ষায় তাও তুলে নেওয়া হবে নতুন ব্যবস্থায়। কৃষি পণ্য লেনদেনে কৃষক স্বার্থ দেখার খাতাকলমের ব্যবস্থাটুকুও তুলে নেওয়া হবে এই নতুন ব্যবস্থায়।

১২। তৈরি হবে তিন ধরনের বাজার। মান্ডি, চুক্তি চাষ, মান্ডির বাইরের বাজার। মান্ডি তৈরি হয়েছিল ফড়েরা যাতে কৃষকদের জমি থেকে পণ্য তুলে তাদের অত্যাচার না করতে পারে। নতুন ব্যবস্থায় কৃষকের বাড়ি পর্যন্ত ফড়েদের যাওয়ার রাস্তা আরও প্রশস্ত হবে।

১৩। চুক্তি চাষ হবে। চুক্তি হবে কৃষক ও বাণিজ্য সংস্থার মধ্যে। চুক্তিতে ফসলের পরিমাণ, গুনগত মান, দাম ইত্যাদি সমস্তই আগাম নির্ধারিত থাকবে।

১৪। চুক্তিভঙ্গে সরকার সাধারন কৃষকের পাশে কীভাবে থাকবে অথবা থাকবে কিনা তা অনুচ্চারিত।

১৫। এই চুক্তি সম্পাদিত হবে মহকুমাশাসকের কর্তৃত্বের এক্তিয়ারে।

১৬। এই চুক্তির উপর রাজ্যের নিজস্ব আইন বা আদেশের কোনো প্রভাব থাকবে না।

১৭। চুক্তি খেলাপ করার অভিযোগ উঠলে, তার বিচার দেশের দেওয়ানি আদালতে হবে না।

১৮। চুক্তি সংক্রান্ত যাবতীয় বিবাদের বিচার করবেন মহকুমা শাসক। তাঁর বিচারে সন্তুষ্ট না হলে আপিল করতে হবে জেলা শাসক বা অতিরিক্ত জেলা শাসকের অধীন উত্তর-বিচার কর্তৃপক্ষের কাছে। এক্ষেত্রে মহকুমাশাসক, জেলা শাসক তথা উত্তর-বিচার কর্তৃপক্ষের রায় দেশের দেওয়ানি আদালতের রায়ের সমান মান্যতা পাবে।

১৯। সরকারি তরফে কৃষির বাজার ও বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষেত্র সমস্তটাই কুক্ষিগত থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। রাজ্যের আইন এক্ষেত্রে প্রশ্ন তুলতে পারবে না। দেশের আদালত তথা মূল বিচার ব্যবস্থার কোনও ভূমিকাই নেই। কেন্দ্রের সঙ্গে সরাসরি প্রশাসনিক যোগাযোগ থাকবে জেলা শাসক ও মহকুমা শাসকের। রাজ্য প্রশাসন থাকবে নীরব দর্শক। আসলে এই তিনটি কৃষি আইন ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, স্বেচ্ছাচার, একনায়কতন্ত্র ও কর্পোরেট আনুগত্যের দলিল।

এক দেশ, এক বাজার শ্লোগানকে সামনে রেখে অবাধ বাণিজ্যের বিষয়টিকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। কৃষকের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে কর্পোরেটরা এর ফলে সুবিধা ভোগ করবে। সহায়ক মূল্য ও মূল্য স্হিতিশীল রাখার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় কৃষক সমাজকে সার্বিকভাবেই কৃষি ব্যবসার কর্পোরেটদের দয়া দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করতে হবে। এই তিনটি আইন আগ্রাসী নয়া উদারবাদী ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে। অনাহার, দুর্দশা, অসহায় অবস্থার মধ্যে থাকা কৃষক সমাজ ও গ্রামের গরিব মানুষের উপর তীব্র অর্থনৈতিক আক্রমণ নেমে আসবে।

No comments:

Post a Comment