প্রশ্ন-৫) ভারতবর্ষের সংবিধানে উল্লিখিত ৩৭০নং ধারা কি সাময়িক?
উত্তর) সংবিধানের একবিংশ অংশে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ হল ৩৭০ নং ধারা। এটা ঠিক এর শিরোনামে লেখা আছে এটা সাময়িক, পরিবর্তন সাপেক্ষ এবং বিশেষ বিধান। তাই অনেকেই ব্যাখ্যা করেন এই ধারাটি সাময়িক সময়ের জন্য রচিত হয়েছিল। জম্মু-কাশ্মীরের গণপরিষদ এবং পরবর্তীতে জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভা এই ধারার পরিবর্তন, বিলোপসাধন অথবা একই রূপে রেখে দিতে পারে। জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা এই ধারাটিকে বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, ফলে এটি সাময়িক নয়। এই নিয়ে স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে অনেক বিতর্ক দেখা যায়। ১৯৬৯ সালে সম্পৎ প্রকাশ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট এই ধারাকে সাময়িক আখ্যা দেওয়ার আবেদনকে সরাসরি নাকচ করে। দিল্লী হাইকোর্টে কুমারী বিজয়লক্ষ্মী একটি মামলায় দাবী করেন ৩৭০নং ধারা সাময়িক এবং এই ধারাটিকে বহাল রাখা আসলে সংবিধানের প্রতি জালিয়াতি। দিল্লী হাইকোর্ট এই মামলাও খারিজ করে দেয়। ২০১৮ সালের ৩রা এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট আর একটি মামলায় সরাসরি জানিয়ে দেয়, শিরোনামে সাময়িক শব্দটি লেখা থাকলেও এই ধারাটি সাময়িক নয়। বিভিন্ন সময় এই রায়গুলিতে আদালত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় এই ধারাটির শিরোনামে 'সাময়িক' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল তৎকালীন গণপরিষদকে প্রস্তাবিত ধারাটি সংশোধনী-সংযোজনী অথবা বিলোপ সাধনের অধিকার দেওয়ার জন্য। কিন্তু তৎকালীন গণপরিষদ এবং পরবর্তীতে বিধানসভা এই ধারাটি বজায় রাখার পক্ষে মত দেয়, ফলে এটি 'সাময়িক' নয়।
প্রশ্ন-৬) সংবিধানের ৩৭০নং ধারাটি কি বিলোপ করা যেতে পারে?
উত্তর) এটা ঠিক উপধারা ৩৭০(৩) অনুযায়ী ৩৭০নং ধারা বিলোপ করা যেতেই পারে রাষ্ট্রপতির আদেশের ভিত্তিতে। তবে এই আদেশের জন্য জম্মু-কাশ্মীরের গণপরিষদের সম্মতি প্রয়োজন। কিন্তু ১৯৫৭ সালের ২৬শে জানুয়ারী সেই গণপরিষদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাই সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অনেকের মত এই ধারা বিলোপ করা যায় না। আবার একাংশের ব্যাখ্যা এটি বিলোপ করতে হলে রাজ্য বিধানসভার সম্মতি প্রয়োজন। বর্তমান বিজেপি সরকার সংবিধান বিশেষজ্ঞদের এই সব মতামতের তোয়াক্কা না করে, জম্মু-কাশ্মীরের জনসাধারণকে অন্ধকারে রেখে, সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বকে কারাগারে নিক্ষেপ করে, ৭ লক্ষ ৪০ হাজার সৈনিকের বন্দুকের ডগায় সেখানকার মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে রেখে জবরদস্তি এই আইন পাশ করানোর চেষ্টা করেছে। এটা গণতন্ত্র? দেশের উন্নতির জন্য কি ৩৭০নং ধারা কোন অন্তরায় সৃষ্টি করেছে? দেশজোড়া বেকার, অসংখ্য শ্রমিক ছাঁটাই, আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি এইসব সমস্যার দিকে নজর না দিয়ে বন্দুকের ডগায় জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের কোনও মতামত না নিয়ে এই কাজ করার অর্থ কি? এটা দেশের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি সমাধানে ব্যর্থ মোদী সরকারের দৃষ্টি ঘোরানোর প্রয়াস মাত্র। দেশের বাকি ১০টি রাজ্য বিশেষ অধিকার নিয়ে চলতে পারে অথচ জম্মু-কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া হলো কেন? একাজ কি সন্ত্রাসবাদীদের আরো সাহায্য করবে না? পাকিস্তান কাশ্মীর প্রশ্নে বরাবর আন্তর্জাতিক মহল থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল প্রধানত ২টি কারণে - (ক) ভারতবর্ষ জম্মু-কাশ্মীরের মানুষকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দিয়েছিল (খ) পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদীদের জম্মু-কাশ্মীরে ব্যবহার করলেও, ভারতবর্ষ কখনও পাক অধিকৃত কাশ্মীরে কোন জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে মদত দেয়নি। ভারতবর্ষ বরাবরই শান্তিপূর্ণ-দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের পক্ষপাতী। এখন বিজেপির এই পদক্ষেপে জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাতক হিসাবে ভারতবর্ষ চিহ্নিত হবে। ৩৭০নং ধারা বিলোপ করলে ভারতবর্ষের বাকি অংশের কোন মানুষের লাভ হবে? ভারতবর্ষের বেকার যুবক কাজ পাবে? শ্রমিকের মজুরী বাড়বে? জিনিসপত্রের দাম কমবে? দেশে গরীবি কমবে? আসলে সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ মোদী সরকার ধর্মের নামে মানুষকে বিভক্ত করে রাখতে চাইছে, আর এই প্রশ্নে জম্মু-কাশ্মীর, তাঁর হাতের তুরুপের তাস। তাই ভারতবড়হ বা পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী আভ্যন্তরীন বিপদে পড়লেই, দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য জম্মু-কাশ্মীর সমস্যা পরিকল্পিতভাবে সামনে আনে।
প্রশ্ন-১২) সংবিধানের ৩৭০নং ধারা বিলোপ কি প্রয়াত শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের দাবী মেনে?
উত্তর) সংবিধানের ৩৭০নং ধারা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সময় শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন কংগ্রেস দলের সদস্য, সংসদেরও সদস্য এবং ভারতের সংবিধান রচনার জন্য তৈরী গণপরিষদেরও সদস্য। সংসদে অথবা গণপরিষদের কোনও অধিবেশনে শ্রী মুখার্জী ৩৭০নং ধারা গ্রহণ করার সময়ে আপত্তি জানাননি। সংসদে বিভিন্ন বিষয়ে তিনি অনেক বক্তৃতা করেছিলেন কিন্তু এই বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে তিনি কোন বক্তৃতা সংসদে অথবা গণপরিষদে করেননি। বরং ১৯৫৩ সালের ৯ই জানুয়ারী জওহরলাল নেহেরুকে লেখা একটি চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন - "আমাদের নিঃসঙ্কোচে শেখ আব্দুল্লার নেতৃত্বে বিশেষ সুবিধাসহ কাশ্মীর উপত্যকার অস্তিত্ব মেনে নেওয়া দরকার, যতদিন পর্যন্ত তিনি সেই বিশেষ ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন মনে করবেন"। তবে আশ্চর্যজনকভাবে নেহেরু মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের পর পুরানো অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ উল্টো পথে হেঁটে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার বিষয়টি ভারতীয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিরোধীতা শুরু করেন। দেশের শিল্পমন্ত্রী থাকাকালীন শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ৩৭০নং ধারার বিরোধিতা করেননি কারণ তিনি জানতেন আরও অনেকগুলি করদ রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ৩৭১নং ধারা যুক্ত হতে চলেছে, সংবিধানে এদের বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার জন্য। ৩৭০নং ধারার বিরুদ্ধে বিদ্বেষকে তাই ব্যবহার করা হয়েছে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করবার এবং মুসলমান বিরোধী জিগীর তোলাবার জন্য। এরা ৩৭১নং ধারার বিরোধীতা করে না কারণ এটিকে ব্যবহার করে হিন্দু-মুসলমান জনগণকে বিভক্ত করার সুযোগ নেই।
তৎকালীন কাশ্মীরে প্রবেশ করতে গেলে পারমিট নেওয়ার প্রয়োজন হত। শ্রী মুখার্জী 'এক দেশ, এক বিধান, এক নিশান, এক প্রধান' এই স্লোগানকে সামনে রেখে বিনা পারমিটে আইন ভেঙ্গে কাশ্মীর অভিযানে যান এবং গ্রেপ্তার বরণ করেন। একজন সাংসদ কি উদ্দেশ্যে বিনা পারমিটে গায়ের জোরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছিলেন! সাংসদ হিসাবে অনুমতি চাইলেই তো তিনি পারমিট নিয়েই সেখানে যেতে পারতেন। দুঃখজনকভাবে জেলবন্দী থাকা অবস্থাতেই তাঁর মৃত্যু হয়।
প্রশ্ন-১৩) ভারতীয় জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কি অবদান ছিল ভারত গঠনে?
উত্তর) ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে রাউ কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী তৎকালীন আইনমন্ত্রী শ্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল হিন্দু কোড বিল সংসদের সামনে পেশ করেন। দেশভাগ এবং স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম আইনমন্ত্রী ড. বি.আর.আম্বেদকর নেহেরুর মন্ত্রিসভার সামনে এই বিল পেশ করেন এবং তা সিলেক্ট কমিটির বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়। ১৯৪৮ সালের ১২ই আগস্ট সিলেক্ট কমিটির রিপোর্ট ড. আম্বেদকর সংসদে পেশ করেন এবং ৩১শে আগস্ট সংসদের সম্মতির জন্য উত্থাপন করেন। ১৯৪৯ সালে ২৯শে ডিসেম্বর বিলটি পেশ করার কথা থাকলেও হিন্দু মৌলবাদীদের প্রবল বিরোধীতার জন্য সেটি সংসদে পেশ করা হয় ১৯৫১ সালে ৫ই ফেব্রুয়ারী। কিন্তু শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সহ হিন্দুত্ববাদীদের প্রবল বিরোধীতায় নেহেরু সরকার কিছুটা পিছু হঠতে বাধ্য হয়।
কি ছিল এই বিলে - (ক) হিন্দু বিবাহ আইন সংশোধন, (খ) হিন্দু উত্তরাধিকার সম্পত্তি সংক্রান্ত আইন, (গ) হিন্দু নাবালক এবং অভিভাবকত্ব আইন, (ঘ) হিন্দু দত্তক গ্রহন এবং পরিচর্যা সংক্রান্ত আইন। এই আইনগুলির মাধ্যমে হিন্দুদের বহু বিবাহ রদ, হিন্দু মহিলাদের বিবাহ বিচ্ছেদ করবার অধিকার, বাল্যবিবাহ রদ, হিন্দু নারীদের সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি পরিবর্তন আনার চেষ্টা হয়েছিল। শ্রী মুখোপাধ্যায় এই আইনের বিরোধীতা করতে হয়ে সংসদে বলেন - 'কোনভাবেই মহিলাদের বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার দেওয়া যাবে না'। বহু বিবাহের অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে তার সওয়াল ছিল কেবলমাত্র হিন্দুদের থেকে এই অধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না। তাঁর সহযোগী মদনমোহন মালব্য ভিন্ন জাতের মধ্যে বিবাহের ক্ষেত্রে প্রবল বিরোধীতা করে বলেছিলেন - 'একই জাতির মধ্যে বিবাহ হওয়া উচিত কারণ একই ধরণের খাদ্যাভ্যাস এবং অন্যান্য অভ্যাস তাদের মধ্যে মেলামেশা করতে সুবিধা দেয় এবং ব্যক্তি ও জাতির স্বাস্থ্য এবং সুখ বজায় রাখে'। এই হিন্দু কোড বলের বিরোধীতা করে তাঁরা আরও বলেছিলেন - 'যেহেতু বিবাহ হিন্দু সমাজে একটি গভীর দর্শনের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে এবং এটি মৌলিক এবং পবিত্র অধিকার হিন্দুদের, তাই হিন্দু বিবাহ আইনের সংশোধন কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না'। অর্থাৎ বহু বিবাহের পক্ষে এরা সওয়াল করেছেন।
শ্রী মুখার্জী উচ্চবর্ণদের এই আইনের আওতার বাইরে রাখার পক্ষে জোরালো সওয়াল করে বলেছিলেন - '(উচ্চবর্ণের) যারা উত্তরাধিকার সূত্রে বহু বৎসর ধরে এই ধারাবাহিকতা মেনে চলছেন তারা কিছু কম দেশপ্রেমিক নন অন্যান্য (নিচু) জাতির তুলনায়। এদের উপর জবরদস্তি নতুন আইন চাপিয়ে দেবেন না'। ড. আম্বেদকরের তীব্র আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত বলেন - তাহলে সমগ্র ভারতবাসীর জন্য এই আইন প্রয়োগ করা হোক। শ্রী মুখোপাধ্যায় এই আইনের বিরোধীতা করতে গিয়ে অভিযোগ তুলেছিলেন হিন্দুদের আইনের এই পরিবর্তনে হিন্দু ধর্ম নাকি আক্রান্ত হচ্ছে। জবাবে ড. আম্বেদকর বলেছিলেন - 'আমি ওনাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই কেউ স্ত্রীকে মারধর করলে সেটা কি ধর্মীয় পরম্পরার নামে মেনে নেওয়া হবে? একটি আদালতে একজন বিচারক বলেছিলেন - হিন্দুধর্মে এটি গ্রহণযোগ্য। আমি শ্রী মুখোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করতে চাই এই ধরণের নিষ্ঠুরতা কি ধর্ম?'
শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে হিন্দু মৌলবাদী শক্তির প্রবল আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে সেদিন আম্বেদকর ক্ষোভে পদত্যাগ করেছিলেন। এদেরই উত্তরাধিকার বিজেপি আজ ড. আম্বেদকরের গলায় মালা দেন কোন অধিকারে? সেদিন যারা সব হিন্দুর জন্য এক আইনের বিরোধীতা করেছিলেন, আজ কিসের ভিত্তিতে তারা গোটা দেশের জন্য একই আইন প্রণয়নের কথা বলেন? আসলে একই আইনের নাম করে প্রগতির জন্য সমাজ সংস্কার নয়, সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ আনার জন্যই ইউনিফর্ম সিভিল কোডের কথা এরা বলছেন।
প্রশ্ন-১৪) শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কি বাংলাভাগ রুখতে চেয়েছিলেন? তিনি কি দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন?
উত্তর) শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কংগ্রেসের আহ্বানে ভারত ছাড়ো আন্দোলন সম্পর্কে ১৯৪২ সালের ২৬শে জুলাই তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্নর জন হারবার্টকে একটি চিঠিতে লেখেন - 'যে কোন ব্যক্তি যদি বর্তমান যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ) মানুষকে জাগিয়ে তুলে আন্দোলন করবার পরিকল্পনা করেন, যার ফলে আভ্যন্তরীন অস্থিরতা এবং নিরাপত্তাহীনতা তৈরী হতে পারে, সরকারের উচিত তাকে প্রতিহত করা'। তিনি আরও লেখেন - 'আপনার অনুগত একজন মন্ত্রী হিসাবে আমি সম্পূর্ণভাবে আপনার সরকারকে সহযোগীতা করতে চাই এবং আমার রাজ্য ও দেশকে এই সংকটজনক মুহূর্তে সেবা করতে চাই।' প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সেই সময় স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ না নিয়ে ফজুলল হকের নেতৃত্বে মুসলীম লীগের মন্ত্রীসভায় তিনি অর্থমন্ত্রী হিসাবে যোগদান করেছিলেন। যে সময় একদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারত ছাড়ো আন্দোলন গড়ে উঠছে এবং নেতাজী সুভাষ বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠনের কাজ চলছে তখন মুসলীম লীগের মন্ত্রীসভায় উপমুখ্যমন্ত্রী হিসাবে যোগদান করে তিনি ব্রিটিশ সরকারকে সহযোগীতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আর.এস.এস. দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প সংগঠিত করেছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নাম লেখানোর জন্য।
১৯৪৬ সালের শেষের দিকে শ্রী মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলা ভাগের দাবীতে গঠিত হয় - 'Bengal Partition League', পরবর্তীতে যা 'Bengal Provincial Conference' নামে পরিচিত হয়। ঐ বছর ফেব্রুয়ারী মাসে হিন্দু মহাসভার বাংলা শাখা হিন্দুদের জন্য পৃথক বাংলা রাজ্য গঠনের জন্য একটি কমিটি তৈরী করে এবং ২৯শে মার্চ এর বার্ষিক সাধারণ সভায় হিন্দুদের জন্য পৃথক রাজ্যের দাবীতে প্রস্তাব পাশ করে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে শ্রী মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে হুগলী জেলার তারকেশ্বরে বাঙালী হিন্দু সম্মেলন সংগঠিত হয়। এখান থেকেই শ্রী মুখোপাধ্যায় প্রস্তাব দেন 'বাঙলা ভাগই একমাত্র সমস্যা সমাধানের রাস্তা'। এই সম্মেলন থেকে গৃহীত এক প্রস্তাবে তাঁকেই দায়িত্ব দেওয়া হয় - বাঙালি হিন্দুদের জন্য পৃথক রাজ্যের দাবীতে একটি কাউন্সিল গঠন এবং গণপরিষদের কাছে বাংলা ভাগের সীমানা নির্ধারণের আবেদন করার জন্য।
এই প্রসঙ্গে জ্যোতি বসু 'যতদূর মনে পড়ে' এই আত্মকথায় উল্লেখ করেন - 'দেশভাগের প্রশ্নে আমাদের পার্টির কি নীতি ছিল, তা এখানে বলা দরকার। আগেই বলেছি, পার্টি দেশভাগের বিরোধীতা করেছিল - কিন্তু এর প্রতিরোধ করার মত শক্তি ও প্রভাব পার্টির ছিল না। ভারতে তখন আমাদের পার্টি ৩য় বৃহত্তম শক্তি হলেও কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের তুলনায় আমাদের শক্তি খুবই দুর্বল ছিল। আমাদের প্রতিবাদ ও বিরোধীতা সত্ত্বেও দেশ যখন সত্য সত্যই বিভক্ত হলো, তখন এই বাস্তবকে স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া আমাদের পার্টির সামনে আর কোন বিকল্প ছিল না'।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যখন শ্রী মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন তখন ব্রিটিশ পতাকাকে অবমাননা করবার জন্য ১ম ছাত্রকে বেত্রাঘাত করার প্রতিবাদ করে ধরিত্রী গাঙ্গুলী এবং উমাপদ মজুমদার এই দুজন ছাত্রকে বরখাস্ত করেছিলেন - এমন অভিযোগও তাঁর বিরুদ্ধে আছে। তাই ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অন্যতম প্রবক্তার স্বাধীনতা আন্দোলন, সমাজসংস্কার এবং বাংলাভাগের ক্ষেত্রে যে নেতিবাচক ভূমিকা ছিল তা সকলের জানা অত্যন্ত জরুরী।
********************************************
জম্মু-কাশ্মীরের ভারত ভুক্তির অন্যতম প্রধান ভিত্তি ৩৭০নং ধারাকে লঘু করার প্রশ্নে কমিউনিস্টরা বরাবর বিরোধীতা করেছে। ২০০১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা শ্রী জ্যোতি বসু একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন - 'কাশ্মীরীদের স্বশাসন এবং অধিক ক্ষমতা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত সরকার সঠিক নীতি গ্রহণ করেনি। তাই তারা ধীরে ধীরে ভারত থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। ঐ সময় জনসংঘ ও হিন্দুত্ববাদীদের উত্থানেরও প্রভাব পড়েছিল। বিশেষত যখন কাশ্মীরের জনগণের থেকে এই সমস্ত ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া হয়, তখন তরুণ কাশ্মীরীরা পাকিস্তানপন্থী ও ভারত বিরোধী হয়ে উঠেছিলেন। এখন অনেকগুলি গোষ্ঠী রয়েছে। শেখ আব্দুল্লার মতো কয়েকজন পাকিস্তানে যোগ দিতে চাননি, চেয়েছিলেন স্বাধীন কাশ্মীর। জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর তিনি যখন আবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, আমি ওনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম - কেন আপনি এটা চাইছেন? এই ধরণের ছোট রাজ্য নিয়ে আপনি কিভাবে চালাবেন? তিনি আমাকে যুক্তি দিয়েছিলেন - আমি স্বাধীন কাশ্মীর পেলে পাকিস্তান, আমেরিকা ও ভারত আমাকে সমর্থন দেবে। যাই হোক শেষ পর্যন্ত তিনি ভারতবর্ষের সাথেই ছিলেন। আমরা কাশ্মীরকে কখনই পাকিস্তানের হাতে তুলে দিতে পারি না। এ বিষয়টা স্পষ্ট। আমরা কাশ্মীরকে স্বাধীন রাষ্ট্রও হতে দিতে পারি না। কিন্তু আমরা সেই অবস্থানে অনড় আছি যা আগেও বলেছি। জম্মু-কাশ্মীরকে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন দেওয়া প্রয়োজন। শুধু জম্মু-কাশ্মীরে স্বায়ত্বশাসন দিলেই হবে না; কাশ্মীরের মধ্যে জম্মু অন্যান্য অংশেও স্বশাসনের ক্ষমতা দিতে হবে। এভাবেই জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের, বিশেষত মুসলমানদের বিশ্বাস আমরা ফিরে পেতে পারি। তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন; এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। একাজ করতে গেলে তাঁদের অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃত নজর দিতে হবে। এই মুহূর্তে শুধু ৩৭০নং ধারা দিয়ে তাঁদের রাজনৈতিকভাবে খুশি করা যাবে না, যেটা অবশ্য বর্তমান সরকার (বাজপেয়ী সরকার) প্রত্যাহার করতে চায়। কিন্তু এই ধারার পাশাপাশি জওহরলাল নেহেরুর আমলে যেসব ক্ষমতা তাঁদের ছিল সেগুলি ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। কিছু ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন যদি তারা নিজস্ব সুপ্রিম কোর্ট চান বা অন্য কিছু চান, প্রতিরক্ষা এবং বিদেশ নীতি ছাড়া সবকিছুই তাদের দেওয়া উচিত। কিন্তু আর্থিক সহায়তা বহন করা উচিত ভারত সরকারের। এভাবেই মানুষের আস্থা অর্জন করা সম্ভব।' - (কমিউনিস্ট স্মৃতিকথা, এ.জি.নূরানী)
No comments:
Post a Comment