Thursday, 11 February 2021

ভগৎ সিং শহিদ-এ-আজম - তীর্থঙ্কর চট্টোপাধ্যায়

আসফাকউল্লা ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। বস্তুবাদী নন, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী তো কোনোভাবেই না। অথচ তিনি ভবিষ্যতের স্বাধীন ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে তাঁর ধারণাকে এই ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন: "বিদেশি শাসনকে কদর্য মনে করি এবং একই সঙ্গে ঘৃণা করি এমন কোনো ভারতীয় গণতান্ত্রিক শাসনকে, যা দরিদ্র ও দুর্বলের অধিকারকে অস্বীকার করবে, অথবা যদি তা ধনী ও জমিদারদের তৈরি ওই, অথবা যদি তাতে কৃষক ও শ্রমিকের সমান অংশগ্রহণ না থাকে, অথবা যদি সরকারের আইন অসাম্য ও পার্থক্যের ভিত্তিতে রচিত হয়। যদি ভারত স্বাধীন হয় এবং যদি শ্বেতকায় প্রভুদের হাত থেকে দেশ শাসনের বলগা আমার দেশের ভাইরা কেড়ে নেবার পরেও ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অসমতা, জমিদার-রায়তের মধ্যে অসমতা রয়ে যায়, তবে আমি আল্লাহ-র কাছে প্রার্থনা করি, যতদিন তাঁর সৃষ্টিতে সাম্য না প্রতিষ্ঠিত হয়, ততদিন আমি স্বাধীনতা চাই না। যদি এই সব ধারণার জন্য লোকে আমায় কমিউনিস্ট বলে তো বলুক। আমার থোড়াই এসে যায়।"

কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলার আর একজন অভিযুক্ত মহাবীর সিং-এর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়েছিল। তিনি তাঁর বাবাকে আন্দামান-যাত্রার ঠিক আগে একটি চিঠি লেখেন। তাতে লিখেছিলেন: "সমাজ বলতে আমি আর্য সমাজ বা অন্য কোনো সংকীর্ণ সমিতি বুঝি না, আমি বুঝি সমস্ত সাধারণ মানুষের সমাজ। তার কারণ, এই ধর্মীয় সমিতিগুলি এত অদূরদর্শী যে আমার কাছে তারা অর্থহীন। উপরন্তু আমি সব ধর্ম থেকেই দূরে  থাকতে চাই, কারণ তারা সংকীর্ণ, আত্মকেন্দ্রিক, অবিচারভিত্তিক। আমি চাই, অন্যেরাও তা থেকে দূরে থাকুক। মানুষ ও সমাজের পক্ষে যা সবচেয়ে মূল্যবান বলে আমি মনে করি, তা হল নিম্নলিখিত আদর্শ। জাতি, গাত্রবর্ণ, ধর্ম বা অর্থের ওপর ভিত্তি করে কোনো মানবিক সম্পর্ক গড়া উচিত নয়।" 

*************************************************

নিম্ন আদালতে ভগৎ সিং-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, 'বিপ্লব' বলতে তিনি কী বোঝেন? তাঁর উকিল আসফ আলি এই প্রশ্নে আপত্তি করলে আদালত প্রশ্ন নাকচ করে। কিন্তু দায়রা আদালতে নিজের মতাদর্শ ঘোষণার সুযোগ হিসেবে স্বেচ্ছায় ভগৎ সিং প্রশ্নটির উত্তর দেন। "বিপ্লব সর্বদা রক্তাক্ত সংঘাতে জড়িত নয় এবং তার মধ্যে ব্যক্তিগত প্রতিশোধেরও স্থান নেই। বিপ্লব মানে বোমা-পিস্তলের পূজা নয়। বিপ্লব বলতে আমরা বুঝি যে, বর্তমান ব্যবস্থা যা স্পষ্টতই অন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তাকে পাল্টাতে হবে। যদিও যারা স্পষ্টতই উৎপাদক বা শ্রমিক, তারাই সমাজের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান, তবু তারা তাদের শ্রমের ফল থেকে শোষকদের দ্বারা বঞ্চিত, তাদের মৌলিক অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। ... অতএব একটা মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন এবং যারা এ কথা উপলব্ধি করেছে তাদেরই দায়িত্ব সমাজকে সমাজতান্ত্রিক ভিত্তির ওপরে পুনর্গঠিত করা। এই কাজ সমাধা না হলে এবং মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ এবং এক দেশ দ্বারা অপর দেশের শোষণ, যা সাম্রাজ্যবাদের মুখোশ পরে আছে, বন্ধ না হলে, সমাজের সামনে আজ যে কষ্টভোগ ও হত্যালীলার  বিপদ, তাকে রোখা যাবে না এবং যুদ্ধের অবসান ও বিশ্বশান্তির যুগ উদ্বোধনের সব কথাই ছদ্মবেশহীন কপটতা বলে বোঝা যাবে। বিপ্লব বলতে আমরা বুঝি শেষ পর্যন্ত এমন একটা সমাজব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা যা এই রকম ধ্বংসের ভয়ে ত্রস্ত নয়, যেখানে সর্বহারার সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত যার ফলে আসবে এমন একটা বিশ্ব-ফেডারেশন যা বিশ্বমানবকে উদ্ধার করবে পুঁজিবাদের দাসত্ব থেকে ও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের দৈন্য থেকে।" পরিশেষে তাঁরা সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর সংগ্রামের কথা বলেছেন এবং বিবৃতি শেষ করছেন 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' লিখে।

*************************************************

১৩ সেপ্টেম্বর সকালে ৬২ দিন অনশনের পর যতীন দাস শহীদের মৃত্যু বরণ করলেন। শেষ অবধি তাঁর মনোবল অটুট ছিল। প্রায় অচৈতন্য অবস্থাতেও তিনি খাদ্য প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সারা দেশ আগের সাত দিন উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করছিল। চরম মুহূর্তের পর সারা দেশে ক্ষোভ ও শোকের বন্যা বয়ে গেল। তখনকার দিনে টেলিভিশন ছিল না, খুব কম বাড়িতেই রেডিয়ো ছিল, টেলিফোন ব্যবস্থাও দুর্বল ছিল। তবু খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে দুপুরের মধ্যে।

এই মৃত্যুসংবাদ শান্তিনিকেতনে পৌঁছাল সন্ধ্যা নাগাদ। ভাদ্রের শেষ; আসন্ন পুজোর ছুটির ঠিক আগে 'তপতী' নাটকের অভিনয় হবে। রবীন্দ্রনাথ ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নাটকের মহলা দিচ্ছিলেন। যতীন দাসের খবর আসতে রিহার্সাল বন্ধ হয়ে গেল। যে যার ঘরে ফিরে গেলেন। সেই রাতে রবীন্দ্রনাথ একটি গান লিখলেন। পরের দিন রিহার্সালে এসে বললেন, এই নতুন গানটি সকলকে শিখে নিতে হবে। ওই কোরাস দিয়েই 'তপতী' শুরু হবে।


সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ

হে ভৈরব, শক্তি দাও, ভক্ত-পানে চাহো।

দূর করো মহারুদ্র   যাহা মুগ্ধ, যাহা ক্ষুদ্র

মৃত্যুরে করিবে তুচ্ছ প্রাণের উৎসাহ।

দুঃখের মন্থনবেগে উঠিবে অমৃত,

শঙ্কা হতে রক্ষা পাবে যারা মৃত্যুভীত।

তব দীপ্ত রৌদ্র তেজে   নির্ঝরিয়া গলিবে যে

প্রস্তরশৃঙ্খলোন্মুক্ত ত্যাগের প্রবাহ।

*************************************************

দ্বিতীয় পাঞ্জাব ছাত্র সম্মেলনের মুক্ত অধিবেশন হয়েছিল ১৯ অক্টোবর ১৯২৯। সভাপতিত্ব করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। এই সভায় পড়া হয়েছিল ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত-র বার্তা, জেল থেকে পাঠানো।

কমরেডগণ,
আজ আমরা যুবসমাজকে পিস্তল-বোমা হাতে তুলে নিতে বলতে পারি না। আজ ছাত্রদের সামনে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। আগামী লাহোর অধিবেশনে কংগ্রেস দেশের স্বাধীনতার জন্য কঠোর সংগ্রামের ডাক দেবে। জাতীয় ইতিহাসের এই সংকটকালে যুবসমাজকে এক বিশাল দায়িত্ব নিতে হবে। ... তাদের দায়িত্ব শিল্প এলাকার কোটি কোটি বস্তিবাসী ও কোটি কোটি জীর্ণ কুটিরবাসী গ্রামীণ মানুষকে জাগিয়ে তোলা, যাতে আমরা স্বাধীন হতে পারি, যাতে মানুষের হাতে মানুষের শোষণ হয়ে ওঠে অসম্ভব। ...শহীদ যতীন্দ্রনাথ দাসের কাছ থেকে প্রেরণা নিয়ে, এবং দেশের প্রতি অশেষ ভক্তি নিয়ে, তাদের প্রমাণ করতে হবে যে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা অনড় পণ নিয়ে লড়তে সক্ষম।

সভাস্থলে এই বার্তা পরে দেবার পরে সমবেত কণ্ঠে ধ্বনি ওঠে, "ভগৎ সিং জিন্দাবাদ" - সেই সঙ্গে ঘন ঘন হাততালি।

*************************************************

আজ একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে পৌঁছে ভারতে এমনই এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে হিন্দুত্ববাদীদের দাপটে ইতিহাস থেকে আরম্ভ করে গৃহস্থের খাদ্যতালিকা পর্যন্ত পাল্টে দিচ্ছে নয়া-সন্ত্রাসের অঙ্গুলিনির্দেশ। ইতিহাসকে বলা হচ্ছে কল্পনা আর কাল্পনিক কাহিনিকে বলা হচ্ছে ইতিহাস। চেষ্টা চলছে ভগৎ সিং-কে হিন্দু বীর হিসেবে প্রতিপন্ন করার এবং তাঁর আত্মদানকে হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার ভিত্তিরূপে স্থাপনের। সযত্নে চাপা দেওয়া হচ্ছে তাঁর লেখা 'কেন আমি নাস্তিক' প্রবন্ধ। অনুল্লিখিত থাকছে আরও দুটি লেখা: "ধর্ম এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম" এবং "সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও তার প্রতিকার"।

শেষোক্ত প্রবন্ধটি ১৯২৮ সালের জুন মাসে 'কীর্তি' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধে ভগৎ সিং লক্ষ্য করেছেন, ১৯২০-২১ সালের অসহযোগ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ার পর একের পর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটছে। তাঁর লেখার অব্যবহিত আগের ঘটনা হল কোহাট শহরের ভয়াবহ দাঙ্গা। তিনি লক্ষ্য করেছেন, বর্ণনায় প্রাধান্য পাচ্ছে মুসলমান নৃশংসতা হিন্দুদের ওপর বা শিখদের ওপর, কিংবা মুসলমানের ওপর অন্যদের অত্যাচার। কিন্তু মূল কারণটা সকলেই বাদ দিয়ে যায়। মূল কারণ অর্থনৈতিক। দারিদ্র এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে চার আনা পয়সার জন্যেও অন্যায় কাজে নাম্বার জন্য বহু মানুষ, কী হিন্দু কী শিখ কী মুসলমান প্রস্তুত। এরই সুযোগ পুঁজিবাদীরা নেয়, যাতে সব গরিব মানুষের আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তু তারা না হয়। ভগৎ সিং লিখছেন, "দাঙ্গা সর্বদাই হতাশাজনক খবরে ভর্তি, কিন্তু কলকাতার দাঙ্গায় একটা ভালো জিনিসও ঘটেছিল। শ্রমিকরা দাঙ্গায় অংশ নেয়নি, এমনকি ট্রেড ইউনিয়নগুলি চেষ্টা করেছিল মারমুখো জনতাকে শান্ত করতে। এই সব লোক শ্রেণিসচেতন হয়ে উঠেছিল এবং নিজেদের শ্রেণিস্বার্থ খুঁজতে শিখেছিল। শ্রেণিচেতনাই প্রধান হাতিয়ার যা সহায় হতে পারে দাঙ্গা রুখতে।" উপসংহারে বলছেন, "ধর্মকে যদি রাজনীতি থেকে পৃথক করা যায়, তাহলে আমরা সকলে যৌথভাবে সামিল হতে পারি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়, ধর্মীয় বিষয়ে যতই তফাত থাকুক না কেন। আমরা অনুভব করছি যে ভারতের প্রকৃত হিতৈষীরা এই নীতিগুলো অনুসরণ করে ভারতকে বাঁচাবেন সেই আত্মহননের পথ থেকে যে পথে আজ সে চলছে।" এর প্রত্যেকটি কথা আজকের ভারতেও প্রযোজ্য। ধর্ম আর রাজনীতির পৃথকীকরণ, যা ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞার্থ, আজকের ভারতে যতটা প্রয়োজন, ততখানি স্বাধীনতার পরে আর কখনও ছিল না।

একই মাসে (জুন ১৯২৮) প্রকাশিত হয়েছিল "অস্পৃশ্যতার সমস্যা"। সেখানেও তথাকথিত অস্পৃশ্যদের আহ্বান করা হয়েছিল নিজের শ্রেণিসত্তাকে উপলব্ধি করে শ্রেণিসংগ্রামে অংশ নিতে। তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, "তোমরাই আসল শ্রমিক শ্রেণি।" ঠিক পরের লাইনে উদ্ধৃত করেছিলেন মার্কস-এঙ্গেলসের অমর পঙক্তি: "দুনিয়ার মজদুর এক হও, শৃঙ্খল ছাড়া আর কিছু তোমাদের হারাবার নেই।" ভগৎ সিং তার সঙ্গে যোগ করেছিলেন, "সামাজিক আন্দোলন থেকে বিপ্লব শুরু করো।" আজকের জাতপাতের উৎপাতে ক্লিষ্ট ভারতে প্রত্যেকটি কথা গুরুত্বপূর্ণ।

ভগৎ সিং আজও যুগোপযোগী। 


No comments:

Post a Comment