Thursday, 9 December 2021

শহীদ-ই-আজম ভগৎ সিং

 ফাঁসি নয়, গুলি করে আমাদের হত্যা করুন 

(লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা ডিফেন্স কমিটি'র আইনবিদদের সিদ্ধান্ত ছিল ফাঁসি থেকে ভগৎ সিং এবং তাঁর দুই সহকর্মীকে বাঁচাতে ব্যাপক চেষ্টা চালাবার জন্য ফাঁসির দিনটি পিছিয়ে দেওয়া। এর একটাই পথ খোলা ছিল, গভর্ণরের কাছে দয়া ভিক্ষা করা। কিন্তু সবাই জানত ভগৎ সিংকে দিয়ে কিছুতেই তা করানো যাবে না। ১৯৩১ সালের ১৯শে মার্চ অ্যাডভোকেট প্রাণনাথ মেহেতা জেলে ওঁদের সঙ্গে দেখা করতে যান। ভগৎ সিং তাঁর কথা শুনতেন। তিনি বারবার মার্সি পিটিশন দেবার কথা বলেন এবং পিটিশনের ভাষা অপমানজনক হবে না বলে আশ্বাস দেন। অবশেষে ভগৎ সিং বলেন, "ঠিক আছে, লিখে আনুন"। পরদিন পিটিশনের খসড়া নিয়ে শ্রী মেহেতা জেলে দেখা করলে ভগৎ সিং বলেন 'মার্সি পিটিশন' তিনি নিজেই পাঠিয়ে দিয়েছেন। এটি ভগৎ সিং-এর সেই ঐতিহাসিক পত্র।)

প্রিয় মহাশয়,

সবিনয় নিবেদন এই যে, লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার শুনানির জন্য ভারতে বৃটিশ সরকারের সর্বোচ্চ আধিকারিক ভাইসরয় একটি বিশেষ অর্ডিনান্স বলে এক ট্রাইবুন্যাল গঠন করেছিলেন। এই ট্রাইবুন্যাল ১৯৩০ সালের অক্টোবর মাসে আমাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছে। আমার বিরুদ্ধে আনীত সবচেয়ে বড় অভিযোগ হল আমি সম্রাট পঞ্চম জর্জের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। ট্রাইবুন্যালের এই সিদ্ধান্ত থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রথমতঃ ইংরেজ জাতি এবং ভারতীয় জনতার মধ্যে যুদ্ধ চলছে এবং দ্বিতীয়তঃ আমি নিশ্চিতভাবে এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছি, সুতরাং আমি একজন রাজদ্রোহী যুদ্ধবন্দী। যদিও এই অভিযোগের ব্যাখ্যাকে অতিশয়োক্তির সীমায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তবুও আমি একথা না বলে পারি না যে, এর দ্বারা আমায় সম্মানিত করা হয়েছে।

প্রথম বিষয়টির ওপর আমি কিছুটা বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করতে চাই। আমার ধারণা প্রত্যক্ষভাবে কোন লড়াই এখনো শুরু হয়নি। যুদ্ধ শুরু হবার ব্যাপারে ট্রাইবুন্যালের মতামত কি, তা আমার জানা নেই। তবু আমি বিষয়টি স্বীকার করে নিচ্ছি এবং সেই সঙ্গে বিষয়টির সম্পর্কে একটি সঠিক ধারণা আমি দিতে চাই।

আমি এই কথা বলতে চাই যে, যুদ্ধ শুরু হয়েছে এবং যতদিন ভারতীয় জনগণ এবং শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার উপায়গুলির ওপর ক্ষমতাশালী ব্যক্তির একাধিপত্য কায়েম থাকবে ততদিন পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলবে, তা সেই ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ইংরেজ পুঁজিপতি, ইংরেজ শাসকই হন অথবা পুরোপুরি ভারতীয়ই হোন। যদি বিশুদ্ধ ভারতীয় পুঁজিপতিদের দ্বারাই কেবল গরীবের রক্ত শোষণ চলতে থাকে, তবুও পরিস্থিতির খুব বেশি পরিবর্তন হবে না। যদি আপনার সরকার কিছু নেতা এবং সমাজের কিছু প্রধান ব্যক্তির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে, যদি কিছু সুবিধা পাইয়ে দেয় অথবা উভয়পক্ষে একটা সমঝোতা হয়ে যায়, তাতেও পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হতে পারে না। জনগণের ওপর এসব কথার প্রভাব খুবই কম।

দেশের যুবকদের আরেকবার ঠকানো হল, একথা ভেবে আমি দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন নই। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা পথভ্রষ্ট হয়েছেন এবং ইংরেজের সঙ্গে আপোষ আলোচনার সময় সেইসব গৃহহারা, নিরাশ্রয়, নিবেদিত প্রাণ সংগ্রামীদের কথা ভুলে গিয়েছেন যাদের দুর্ভাগ্যক্রমে বিপ্লবী পার্টির সদস্য বলে তাঁরা মনে করেন। একথা ভেবেও আমি ভয় পাই না। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা বিপ্লবীদের শত্রু মনে করেন, কারণ তাঁদের বিচারে এরা হিংসায় বিশ্বাসী। আমাদের বীরাঙ্গনারা নিজেদের সব কিছুই বিসর্জন দিয়েছেন। তাঁরা নিজেদের স্বামীদের আত্মদানের বেদীমূলে প্রেরণ করেছেন। তাঁরা নিজেরাই নিজেদের নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু আপনার সরকার তাঁদের বিদ্রোহী মনে করে। আপনাদের দালালরা মিথ্যা কাহিনী তৈরী করে ওঁদের বদনাম দেয় এবং পার্টির সুনামের হানি ঘটাবার চেষ্টা করে। কিন্তু তবুও যুদ্ধ চলছে।

বিভিন্ন সময় এই যুদ্ধ ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করবে। কখনো প্রকাশ্য লড়াই চলবে, কখনো সংগ্রাম চলবে গোপনে। কখনো তা বিক্ষোভের স্তরে থাকবে আবার কখনো মরণপণ সংগ্রাম শুরু হবে। রক্তাক্ত সংগ্রাম হবে, না তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ পথে লড়াই হবে, তা নির্ভর করছে আপনি কোন পথে চলবেন তার ওপর। কাজের পথ আপনিই বেছে নিন। কিন্তু সংগ্রাম চলবেই, তুচ্ছ বিষয়গুলি অবহেলা করে, অর্থহীন নীতিবাগীশ আদর্শবাদকে উপেক্ষা করে নিরবিচ্ছিন্ন লড়াই চলবে। নবীন উদ্যম, অপরিসীম দৃঢ়তা, অপ্রতিরোধ্য সংকল্প নিয়ে সংগ্রাম চলবে যতদিন না সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যতদিন না বর্তমান সমাজব্যবস্থাকে উৎখাত করে সমাজের অবাধ সমৃদ্ধির ভিত্তিতে নতুন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা যায় এবং এই পথে সমস্ত ধরণের শোষণের অবসান ঘটানো যায়। এই পথেই মানব সভ্যতা এগিয়ে যাবে স্থায়ী শান্তির এক নতুন যুগে। অচিরেই শুরু হবে আখেরি লড়াই এবং চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে যাবে।

পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী শোষণের দিন ফুরিয়ে আসছে। এ সংগ্রাম আমরা শুরু করিনি, আমাদের জীবনাবসানের সঙ্গে সঙ্গে এ সংগ্রাম শেষ হয়ে যাবে না। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে,বর্তমান বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই সংগ্রাম অনিবার্যভাবে গড়ে উঠেছে। আমাদের মৃত্যুতে আত্মদানের পুষ্পমাল্যে আর একটি নতুন ফুল গাঁথা হবে। যতীন দাসের অতুলনীয় আত্মদান, ভগবতীচরণের হৃদয়বিদারক অথচ মহান আত্মদান এবং আমাদের প্রিয় সংগ্রামী সাথী আজাদের গৌরবময় আত্মদান ইতিমধ্যেই আত্মদানের সেই পুষ্পমাল্যটিকে বর্ণোজ্জ্বল করেছে।

আমাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে একথা বললে বোধ হয় আপনি দ্বিমত হবেন না যে, আপনি আমাকে ফাঁসি দিতে কৃতসংকল্প এবং আপনি তা করবেনই। আপনার হাতে ক্ষমতা আছে এবং আপনারা মনে করেন ক্ষমতার জোরেই কৃতকর্মের যৌক্তিকতা প্রমাণ করা যায়। আমরা জানি, 'জোর যার, মুলুক তার' - এই নীতি নিয়েই আপনি চলেন। আমাদের বিচারের প্রহসন এর জ্বলন্ত প্রমাণ।

আমরা বলতে চাই, আপনার আদালতের সিদ্ধান্ত হল আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছি অর্থাৎ আমরা যুদ্ধবন্দী। আমরা তাই যুদ্ধবন্দীসুলভ ব্যবহার চাই। আমরা বলতে চাই, ফাঁসি নয়, আমাদের গুলি করে হত্যা করা হোক। আপনার আদালতের বক্তব্যকে আপনি মূল্য দেন একথা প্রমাণের দায়িত্ব আপনার।

আমাদের অনুরোধ এবং আশা, আপনি অনুগ্রহ করে সেনাদপ্তরে আদেশ দিন, তারা যেন সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে আমাদের হত্যা করে।

নিবেদক 

ভগৎ সিং, রাজগুরু, শুকদেব

No comments:

Post a Comment