Wednesday, 28 December 2016

পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়



শুধু কেবল আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর যে-কোন দেশে, যে-কোন যুগে যে-কেউ জন্মভূমিকে তার স্বাধীন করবার চেষ্টা করেচে, তাকে আপনার নয় বলবার সাধ্য আর যার থাক আমার নেই ।

নারীর স্বাধীনতার প্রসঙ্গে  মন তাহার কোনকালেই সায় দিতে চাহিত না । ইহাতে মঙ্গল নাই, ইহা ভাল নয় --- তাহার রুচি ও আজন্ম সংস্কার এ কথা অনুক্ষণ তাহার কানে কানে বলিত । অথচ, শাস্ত্রীয় অনুশাসনগুলার মধ্যেও যে ইহাদের প্রতি গভীর অবিচার নিহিত আছে এ সত্য তাহার ন্যায়নিষ্ঠ চিত্ত কিছুতেই অস্বীকার করিতে পারিত না । ইহাতে সে দুঃখ পাইত কিন্তু পথ পাইত না ।

কোন একটা কথা কেবলমাত্র বহুদিন ধরে বহু লোকে বলতে থাকলেই তা সত্য হয়ে ওঠে না ।

ক্ষতি ত অনেক জিনিসেই হয় না অপূর্ববাবু, কিন্তু বিনা প্রয়োজনেও কোন কাজ করা আমাদের বারণ ।

যেখানে ফেলে যাওয়াই মঙ্গল, সেখানে আঁকড়ে থাকাতেই অকল্যাণ ।

এ নরককুন্ড ত এরা বানায় নি । এরা শুধু তার প্রায়শ্চিত্ত করচে ।

মানুষের প্রতি মানুষে কত অত্যাচার করচে চোখ মেলে দেখতে শিখুন । কেবল ছোঁয়াছুঁয়ি বাঁচিয়ে, নিজে সাধু হয়ে থেকে ভেবেচেন পুণ্য সঞ্চয় করে একদিন স্বর্গে যাবেন ? মনেও করবেন না ।

এই হৃদয়হীনতা নিবারণ করিবার উপায় নাই, লোকে করে না, কেহ করিতে চাহিলে সবাই তাকে পাগল বলিয়া উড়াইয়া দেয় ।

এরা কারা অপূর্ববাবু ? এরা ত আমারই । এই ছোট্ট কথাটুকু যখনি ভুলচেন, তখনি আপনার গোল বাধচে । আর ভাল ? ভাল-করা বলে যদি সংসারে কোন কথা থাকে, তার যদি কোন অর্থ থাকে সে ত এইখানে । ভাল ত ডাক্তারবাবুর করা যায় না অপূর্ববাবু ।

চিরদিন সংসারে অত্যাচারিত, পীড়িত, দুর্বল বলিয়া মানুষের সহজ অধিকার হইতে যাহারা সবলের দ্বারা প্রবঞ্চিত, নিজের উপরে বিশ্বাস করিবার কোন কারণ যাহারা দুনিয়ায় খুঁজিয়া পায় না, দেবতা ও দৈবের প্রতি তাহাদেরই বিশ্বাস সব চেয়ে বেশী ।

ভাল বক্তার কাছে জনতা যুক্তিতর্ক চাহে না, যাহা মন্দ তাহা কেন মন্দ এ খবরে তাহাদের আবশ্যক হয় না, শুধু মন্দ যে কত মন্দ অসংখ্য বিশেষণ যোগে ইহাই শুনিয়া তাহারা চরিতার্থ হইয়া যায় ।

এ যে কেবল ধনীর বিরুদ্ধে দরিদ্রের আত্মরক্ষার লড়াই । এতে দেশ নেই, জাত নেই, ধর্ম নেই, মতবাদ নেই - হিন্দু নেই, মুসলমান নেই, - জৈন, শিখ কোন কিছুই নেই, - আছে শুধু ধনোন্মত্ত মালিক আর তার অশেষ প্রবঞ্চিত অভুক্ত শ্রমিক । তোমাদের গায়ের জোরকে তারা ভয় করে, তোমাদের শিক্ষার শক্তিকে তারা অত্যন্ত সংশয়ের চোখে দেখে, তোমাদের জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষায় তাদের রক্ত শুকিয়ে যায় । অক্ষম, দুর্বল, মূর্খ, দুর্নীতিপরায়ণ তোমরাই যে তাদের বিলাস-ব্যসনের একমাত্র পাদপীঠ । তাই, মাত্র তোমাদের জীবনধারণটুকুর বেশী তিলার্ধ যে তারা স্বেচ্ছায় কোন দিন দেবে না - এই সত্য হৃদয়ঙ্গম করা কি তোমাদের এতই কঠিন ।

তোমরা অসাধু, তোমরা উচ্ছৃঙ্খল, তোমরা ইন্দ্রিয়াসক্ত - তাদের মুখ থেকে এই-সকল অপবাদই তোমরা চিরদিন শুনে এসেছ । তাই, যখনই তোমরা তোমাদের দাবী জানিয়েছ, তখনই তোমাদের সকল দুঃখকষ্টের মূলে তোমাদের অসংযত চরিত্রকেই দায়ী করে তারা তোমাদের সর্বপ্রকার উন্নতিকে নিবারিত করে এসেছে, - কেবল এই মিথ্যেই তোমাদের তারা অনুক্ষণ বুঝিয়ে এসেছে, - ভাল না হলে কারও উন্নতই কোন দিন হতে পারে না ।

আমার দেশ গেছে বলেই আমি এদের শত্রু নই । একদিন মুসলমানের হাতেও এ দেশ গিয়েছিল । কিন্তু সমস্ত মনুষ্যত্বের এতবড় পরম শত্রু জগতে আর নেই । স্বার্থের দায়ে ধীরে ধীরে মানুষকে অমানুষ করে তোলাই এদের মজ্জাগত সংস্কার । এই এদের ব্যবসা, এই এদের মূলধন ।

সময়মত স্থান ত্যাগ করা এবং একটিভিটি ত্যাগ করা এক বস্তু নয় আইয়ার ।

আরে পরাধীন দেশের সব চেয়ে বড় অভিসম্পাতই হোলো কৃতঘ্নতা । যাদের সেবা করবে তারাই তোমাকে সন্দেহের চোখে দেখবে, প্রাণ যাদের বাঁচাবে, তারাই তোমাকে বিক্রি করে দিতে চাইবে । মূঢ়তা আর অকৃতজ্ঞতা প্রতি পদক্ষেপে তোমায় ছুঁচের মত বিঁধবে । শ্রদ্ধা নেই, স্নেহ নেই, সহানুভূতি নেই, কেউ কাছে ডাকবে না, কেউ সাহায্য করতে আসবে না, বিষধর সাপের মত তোমাকে দেখে লোকে দূরে সরে যাবে । দেশকে ভালোবাসার এই আমাদের পুরস্কার, ভারতী এর বেশী দাবী করবার কিছু যদি থাকে, ত  সে শুধু পরলোকে ।

আপনাকে ভোলাবার অনেক রাস্তা আছে, ভারতী, কিন্তু সত্যে পৌঁছাবার আর দ্বিতীয় পথ নেই ।

ও কবি, ও গুণী, ওদের জাত আলাদা । ওদের ভাল-মন্দ ঠিক আমাদের সঙ্গে মেলে না । কিন্তু তাই বলে দুনিয়ার ভাল-মন্দের বাঁধা আইনে ওকে মাপ করা চলে না । ওর গুণের ফল তারা সবাই মিলে ভোগ করে, শুধু দোষের শাস্তিটুকু সহ্য করে ও নিজে ।

জন-কতক কুলি-মজুরের ভাল করার জন্যে পথের-দাবী আমি সৃষ্টি করিনি । এর ঢের বড় লক্ষ্য । এই লক্ষ্যের মুখে হয়ত একদিন এদের ভেড়া-ছাগলের মতই বলি দিতে হবে , -

এমন করে এদের ভালো করা যায় না, - এদের ভালো-করা যায় শুধু বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে ? এবং সেই বিপ্লবের পথে চালনা করার জন্যেই আমার পথের-দাবীর সৃষ্টি । বিপ্লব শান্তি নয় । হিংসার মধ্যে দিয়েই তাকে চিরদিন পা ফেলে আসতে হয়, - এই তার বর, এই তার অভিশাপ ।

মানুষের চলার পথ মানুষে কোনদিন নিরুপদ্রবে ছেড়ে দেয় না ভারতী ।

মহামানবের মুক্তি-সাগরে মানবের রক্তধারা তরঙ্গ তুলে ছুটে যাবে সেই ত আমার স্বপ্ন ।

অশান্তি ঘটিয়ে তোলার মানেই অকল্যাণ ঘটিয়ে তোলা নয় । শান্তি ! শান্তি ! শান্তি ! শুনে শুনে কান একেবারে ঝালাপালা হয়ে গেছে । কিন্তু এ অসত্য এতদিন ধরে কারা প্রচার করেছে জানো ? পরের শান্তি হরণ করে যারা পরের রাস্তা জুড়ে অট্টালিকা প্রাসাদ বানিয়ে বসে আছে তারাই এই মিথ্যামন্ত্রের ঋষি । বঞ্চিত, পীড়িত, উপদ্রুত নরনারীর কানে অবিশ্রান্ত এই মন্ত্র জপ করে করে তাদের এমন করে তুলেছে যে, আজ তারাই অশান্তির নাম চমকে উঠে, -- ভাবে এ বুঝি পাপ, এ বুঝি অমঙ্গল ! বাঁধা গরু অনাহারে দাঁড়িয়ে মরতে দেখেচ ? সে দাঁড়িয়ে মরে তবু সেই জীর্ণ দড়িটা ছিঁড়ে ফেলে মনিবের শান্তি নষ্ট করে না । তাইত হয়েছে, তাইত আজ দীন-দরিদ্রের চলার পথ একেবারে রুদ্ধ হয়ে গেছে ! তবুও তাদেরই অট্টালিকা প্রাসাদ চূর্ণ করার কাজে তাদেরি সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে যদি আমরাও আজ অশান্তি বলে কাঁদতে থাকি ত পথ পাবো কোথায় ? না ভারতী, সে হবে না ও প্রতিষ্ঠান যত প্রাচীন, যত পবিত্র, যত সনাতনই হোক, -- মানুষের চেয়ে বড় নয়, -- আজ সে-সব আমাদের ভেঙ্গে ফেলতেই হবে । ধূলো ত উড়বেই, বালি ত ঝরবেই, ইঁট-পাথর খসে মানুষের মাথাতে ত পড়বেই ভারতী, এই ত স্বাভাবিক ।

ধর্মঘট বলে একটা বস্তু আছে, কিন্তু নিরুপদ্রব-ধর্মঘট বলে কোথাও কিছু নেই । সংসারে কোন ধর্মঘটই কখনো সফল হয় না, যতক্ষণ না পিছনে তার বাহুবল থাকে ।

ধনীর আর্থিক ক্ষতি এবং দরিদ্রের অনশন এক বস্তু নয় ।

দেশের মধ্যে ছোটবড় এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা দেশের ঢের ভাল কাজ করে । আর্তের সেবা, নরনারীর পুন্যসঞ্চয়ে প্রবৃত্তি দান করা, লোকের জ্বর ও পেটের অসুখে ঔষধ যোগানো, জল-প্লাবনে সাহায্য ও সান্ত্বনা দেওয়া -- তাঁরাই তোমাকে পথ দেখিয়ে দেবেন, ভারতী, কিন্তু আমি বিপ্লবী । আমার মায়া নেই, দয়া নেই, স্নেহ নেই --পাপ-পুণ্য আমার কাছে মিথ্যা পরিহাস । ওই-সব ভাল কাজ আমার কাছে ছেলেখেলা । ভারতের স্বাধীনতাই আমার একমাত্র লক্ষ, আমার একটিমাত্র সাধনা । এই আমার ভাল, এই আমার মন্দ,-- এ ছাড়া এ জীবনে আর আমার কোথাও কিছু নাই ।

ভারতের স্বাধীনতা ছাড়া আমার নিজের আর দ্বিতীয় লক্ষ্য নেই, কিন্তু মানবজীবনে এর চেয়ে বৃহত্তর কাম্য আর নেই এমন ভুলও আমার কোন দিন হয়নি । স্বাধীনতাই স্বাধীনতার শেষ নয় । ধর্ম, শান্তি, কাব্য, আনন্দ --- এরা আরও বড় । এদের একান্ত বিকাশের জন্যই ত স্বাধীনতা, নইলে এর মূল্য ছিল কোথা ?

বিপ্লব মানেই ভারতী, কাটাকাটি রক্তারক্তি নয় । বিপ্লব মানে অত্যন্ত দ্রুত আমূল পরিবর্তন ।

যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জনপদ ভস্মসাৎ করে ফেলে, আয়তনে সে কতটুকু জানো ? শহর যখন পোড়ে সে আপনার ইন্ধন আপনি সংগ্রহ করে দগ্ধ হয় । তার ছাই হবার উপকরণ তারই মধ্যে সঞ্চিত থাকে, বিশ্ববিধানের এ নিয়ম কোন রাজশক্তিই কোনদিন ব্যত্যয় করতে পারে না ।

লজ্জাহীন উলঙ্গ স্বার্থ এবং পশু-শক্তির একান্ত প্রধান্যই এর মূলমন্ত্র । সভ্যতার নাম দিয়ে দুর্বল, অক্ষমের বিরুদ্ধে এতবড় মুষল মানুষের বুদ্ধি আর ইতিপূর্বে আবিষ্কার করেনি ।

মনে আছে আমার ছেলেবেলায় স্কুলের পড়ার বইয়ে একবার পড়েছিলাম, বিলেতে বসে আমাদের কল্যাণ ভেবে ভেবেই কেবল রাজমন্ত্রীর চোখের নিদ্রা এবং মুখের অন্ন বিস্বাদ হয়ে গেছে । এই সত্য ছেলেদের কণ্ঠস্থ করতে হয়, এবং উদরান্নের দায়ে শিক্ষকদের কণ্ঠস্থ করাতে হয় । সভ্য রাজ্যতন্ত্রের এই রাজনীতি ভারতী ।

দেশের ভালো যাঁরা করবেন তাঁরা চাঁদা তুলে দিকে দিকে অনাথ-আশ্রম, ব্রহ্মচর্যাশ্রম, বেদান্ত-আশ্রম, দরিদ্র-ভান্ডার প্রভৃতি নানা হিতকর কার্য করছেন, মহৎ লোক তাঁরা, আমি তাঁদের ভক্তি করি, - কিন্তু দেশের ভালো করার ভার আমি নিইনি, আমি স্বাধীন করার ভার নিয়েছি ।

প্রবল দুর্বলের সম্পদ কেন ছিনিয়ে নেবে না, এ কথা যে সভ্য ইয়োরোপের নৈতিক-বুদ্ধি ভাবতেই পারে না ।

ইউরোপীয় সভ্যতার অন্যায়-বোধটা অপরের ঘর-চড়াও হয়েই হয়, তাঁদের নিজেদের দেশের মধ্যে ঘটতে দেখা যায় না ।

নিরীহ চাষাভুষোর জন্যে তোমার দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নেই ভারতী, কোন দেশেই তারা স্বাধীনতার কাজে যোগ দেয় না । বরঞ্চ বাধা দেয় । তাদের উত্তেজিত করার মত পণ্ডশ্রমের সময় নেই আমার । আমার কারবার শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, ভদ্র-সন্তানদের নিয়ে । কোনদিন যদি আমার কাজে যোগ দিতে চাও ভারতী, এ কথাটা ভুলো না । আইডিয়ার জন্যে প্রাণ দিতে পারার মত প্রাণ, শান্তিপ্রিয়, নির্বিরোধী, নিরীহ কৃষকের কাছে আশা করা বৃথা । তারা স্বাধীনতা চায় না, শান্তি চায় । যে শান্তি অক্ষম, অশক্তের, ---- সেই পঙ্গুর জড়ত্বই তাদের ঢের বেশী কামনার বস্তু ।

বিপ্লব মানেই শুধু রক্তারক্তি কান্ড নয়, --- বিপ্লব মানে অত্যন্ত দ্রুত আমূল পরিবর্তন ! রাজনৈতিক বিপ্লব নয়, -- সে আমার । কবি, তুমি প্রাণ খুলে শুধু সামাজিক বিপ্লবের গান শুরু করে দাও । যা কিছু সনাতন, যা কিছু প্রাচীন, জীর্ণ, পুরাতন, --- ধর্ম, সমাজ, সংস্কার --- সমস্ত ভেঙ্গে-চুরে ধ্বংস হয়ে যাক, --- আর কিছু না পারো, শশী, কেবল এই মহাসত্যই মুক্তকণ্ঠে প্রচার করে দাও, --- এর চেয়ে ভারতরে বড় শত্রু আর নেই --- তারপরে থাক দেশের স্বাধীনতার বোঝা আমার এই মাথায় !

যত বড়ই হোক, কারও অভাবকেই যেন না আমরা সর্বনাশ বলে ভাবি, একজনের স্থান যেন জলস্রোতের মত আর একজন স্বচ্ছন্দে এবং অত্যন্ত অনায়াসেই পূর্ণ করে নিতে পারে এই শিক্ষাই ত আমাদের প্রথম এবং প্রধান শিক্ষা ভারতী ।

কারও সম্বন্ধেই কটূক্তি করা অন্যায়, কিন্তু অশ্রদ্ধেয়কে শ্রদ্ধা করাও অন্যায়, এমন কি তিনি পূর্বপিতামহ হলেও । এতে মিষ্টতা থাকতে পারে কিন্তু যুক্তি নেই ভারতী, যা কুসংস্কার তাকে পরিত্যাগ করতে শেখো ।

আমরা বিপ্লবী, পুরাতনের মোহ আমাদের জন্য নয় । আমাদের দৃষ্টি, আমাদের গতি, আমাদের লক্ষ্য শুধু সুমুখের দিকে । পুরাতনের ধ্বংস করেই ত শুধু আমাদের পথ করতে হয় । এর মধ্যে মায়া-মমতার অবকাশ কৈ ? জীর্ণ, মৃত পথ জুড়ে থাকলে আমরা পথের-দাবীর পথ পাবো কোথায় ?

পুরাতন মানেই পবিত্র নয়, ভারতী । মানুষ সত্তর বছরের প্রাচীন হয়েছে বলেই সে দশ বছরের শিশুর চেয়ে বেশী পবিত্র হয়ে ওঠে না । তোমার নিজের দিকেই চেয়ে দেখ, মানুষের অবিশ্রাম চলার পথে ভারতের বর্ণাশ্রম ধর্ম ত সকল দিকেই মিথ্যে হয়ে গেছে । ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, কেউ ত আর সে আশ্রম অবলম্বন করে নেই । থাকলে তাকে মরতে হবে । সে যুগের সে বন্ধন আজ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে । তবুও তাকেই পবিত্র মনে করে কে জানো, ভারতী ? ব্রাহ্মণ । চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকেই নিরতিশয় পবিত্র জ্ঞানে করা আঁকড়ে থাকতে চায় জানো ? জমিদার ।

সমস্ত ধর্মই মিথ্যা, --- আদিম দিনের কুসংস্কার । বিশ্বমানবতার এতবড় পরম শত্রু আর নেই ।

কল্যাণ আমার কাম্য নয়, আমার কাম্য স্বাধীনতা ।

এই পরিবর্তনশীল জগতে সত্যোপলব্ধি বলিয়া কোন নিত্যবস্তু নাই । তাহার জন্ম আছে, মৃত্যু আছে, --- যুগে যুগে কালে কালে মানবের প্রয়োজনে তাহাকে নূতন হইয়া আসিতে হয় । অতীতের সত্যকে বর্তমানে স্বীকার করিতেই হইবে এ বিশ্বাস ভ্রান্ত, এ ধারণা কুসংস্কার ।

এই ত বিপ্লবীর চরম শিক্ষা । কান্না কার তরে ? নালিশ কার কাছে ? দাদার যদি ফাঁসি হয়েছে শোনো, যেন বিদেশীর হুকুমে সে ফাঁসি তার দেশের লোকেই তার গলায় বেঁধে দিয়েছে । দেবেই ত ! কসাইখানা থেকে গরুর মাংস গরুতেই ত বয়ে নিয়ে আসে ।

দূর থেকে এসে যারা জন্মভূমি আমার অধিকার করেছে, আমার মনুষ্যত্ব, আমার ক্ষুধার অন্ন, তৃষ্ণার জল, --- সমস্ত যে কেড়ে নিলে তারই রইল আমাকে হত্যা করবার অধিকার, আর রইল না আমার ?

সাহেবের বুটের তলায় চিত হয়ে শুয়ে শান্তির বাণী আমার মুখ দিয়ে ঠিক বার হবে না, --- হয়ত আটকাবে ।

তুমি কবির শ্লোক প্রায় আবৃত্তি করে বল, গিয়াছে দেশ দুঃখ কি, আবার তোরা মানুষ হ । কিন্তু দেশ ফিরে পাবার মত মানুষ হওয়া কাকে বলে শুনি ? ভেবেচ, মানুষ হবার পথ তোমার অবারিত ? মুক্ত ? ভেবেচ, দেশের দরিদ্র নারায়ণের সেবা আর ম্যালেরিয়ার কুইনিন জুগিয়ে বেড়ানোকেই মানুষ হওয়া বলে ? বলে না । মানুষ হয়ে জন্মানোর মর্যাদা-বোধকেই মানুষ হওয়া বলে । মৃত্যুর ভয় থেকে মুক্তি পাওয়াকেই মানুষ হওয়া বলে ।

সভ্যতার যদি কোন তাৎপর্য থাকে ত সে এই যে, অক্ষম ও দুর্বলের ন্যায্য অধিকার যেন প্রবলের গায়ের জোরে পরাভূত না হয় ।

'পথেরদাবী' চাষা-হিতকারিণী প্রতিষ্ঠান নয়, এ আমার স্বাধীনতা অর্জনের অস্ত্র । শ্রমিক এবং কৃষক এক নয় ভারতী । তাই, পাবে আমাকে কুলি-মজুর-কারিকরের মাঝখানে, কারখানার ব্যারাকে, কিন্তু পাবে না খুঁজে পাড়াগাঁয়ে চাষার কুটীরে ।

সংস্কার মানে মেরামত, --- উচ্ছেদ নয় । গুরুভারে যে অপরাধ আজ মানুষের অসহ্য হয়ে উঠেছে তাকেই সুসহ করা ; যে যন্ত্র বিকল হয়ে এসেছে মেরামত করে তাকেই সুপ্রতিষ্ঠিত করার যে কৌশল বোধ হয় তারই নাম শাসন-সংস্কার ।

আইডিয়ার জন্য সর্বস্ব বিসর্জন দিতে পারে শুধু শিক্ষিত ভদ্র-সন্তান, অশিক্ষিত কৃষকে পারে না ।

সকলে কিন্তু সকল কাজের যোগ্য হয় না ।


Wednesday, 9 November 2016

কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন (পার্টি - স্তালিন)


"আমরা হইতেছি একটি শ্রেণীর পার্টি, সুতরাং প্রায় গোটা শ্রেণীই আমাদের পার্টির নেতৃত্বে কাজ করিবে এবং পার্টির সহিত যথাসম্ভব ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট থাকিবে । কিন্তু কেহ যদি মনে করে যে পুঁজিতন্ত্রের আওতায় সমগ্র শ্রেণীই তাহার অগ্রগামী বাহিনী অর্থাৎ সোসালিস্ট পার্টির চেতনা ও কার্যকলাপের সমান পর্যায়ে উঠিতে সমর্থ হইবে, তাহা হইলে তাহার সে ধারণা হইবে নিছক ম্যানিলোভবাদ ও 'লেজুড়' হইয়া থাকারই সামিল  । ট্রেড ইউনিয়ন হইতেছে শ্রমিক-সংগঠনের অপেক্ষাকৃত আদিম রূপ এবং অনুন্নত স্তরের লোকেরাও এই সংগঠনের কার্যকলাপ হৃদয়ঙ্গম করিতে পারে, কোনো বুদ্ধিমান সোসালিস্টই কখনও এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করে নাই যে, পুঁজিতন্ত্রের আওতায় ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলি সমগ্র বা প্রায় সমগ্র শ্রমিকশ্রেণীকে নিজের অন্তর্ভুক্ত করিতে পারে না । অগ্রগামী বাহিনীর প্রতি সমগ্র শ্রমিক সাধারণ ক্রমশই আকৃষ্ট হইতেছে ইহাদর সহিত অগ্রগামী বাহিনীর পার্থক্য আছে, অগ্রগামী বাহিনীর নিয়ত কর্তব্য হইতেছে শ্রমিকদের ব্যাপকতম স্তরকে চেতনার সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করিয়া তোলা, সমগ্র শ্রমিক সাধারণের সহিত অগ্রগামী বাহিনীর পার্থক্য এবং তাহার এই কর্তব্যের কথা ভুলিয়া যাওয়ার অর্থ হইতেছে আত্মপ্রবঞ্চনা করা, নিজেদের কর্তব্যের বিরাট গুরুত্ব সম্পর্কে অন্ধ থাকা ও এই কর্তব্যকে সংকীর্ণ গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ করিয়া ফেলা ।" - লেনিন
=================================


পার্টি একটি সংগঠিত সমগ্র সত্তা - আমাদের পার্টির নিয়ম-কানুনের প্রথম প্যারায় লেনিন এই ধারণাকে রূপ দিয়েছেন, ইহা সুবিদিত । উহাতে বলা হইয়াছে : পার্টি হইতেছে তাহার অন্তর্ভুক্ত সংগঠনের সমষ্টি এবং পার্টিসভ্যকে পার্টির যে কোন একটি সংগঠনের সভ্য হইতে হইবে ।

=================================


"মার্তভের দৃষ্টিভঙ্গি হইতে দেখিলে পার্টির সীমারেখা অনির্দিষ্ট থাকিয়া যায়, কেন না প্রত্যেক ধর্মঘটীই 'নিজেকে পার্টি সভ্য বলিয়া ঘোষণা' করিতে পারে । এই শিথিলতার সুবিধা কি ? একটি 'পদবী'র ব্যাপক সম্প্রসারণ এইটুকু মাত্র । কিন্তু ক্ষতি এই যে, ইহাতে শ্রেণী ও পার্টিকে এক করিয়া গুলাইয়া ফেলার এমন এক ধারণা প্রচলন করা হয়, যাহাতে সংগঠনের সর্বনাশ ঘটে ।" - লেনিন

=================================


"পূর্বে আমাদের পার্টি যথারীতি সংগঠিত একটি সমগ্র সত্তারূপে সংহত হইয়া উঠে নাই, পার্টি তখন ছিল ভিন্ন ভিন্ন উপদলের সমষ্টি মাত্র, তাই তখন এইসব উপদলের মধ্যে এক ভাবাদর্শগত প্রভাবের সম্পর্ক ছাড়া অন্য কোন সম্পর্ক সম্ভব ছিল না । এখন আমরা একটি সংগঠিত পার্টির মধ্যে সংহত হইয়াছি এবং তাহার অর্থই হইতেছে যে, পার্টির কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, ভাবাদর্শের শক্তি এখন কর্তৃত্বের শক্তিতে রূপান্তর লাভ করিয়াছে, পার্টির ঊর্ধ্বতন সংগঠনের প্রতি অধস্তন সংগঠনের আনুগত্য এখন আয়ত্ত হইয়াছে ।" - লেনিন

=================================


"এই অভিজাতসুলভ উচ্ছৃঙ্খলতা বিশেষভাবে রুশ নিহিলিস্টদের (শূন্যতাবাদীদের) নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য । ইহারা পার্টি সংগঠনকে একটি বীভৎস 'কারখানা' মনে করে; সমগ্রের নিকট অংশের, সংখ্যাগরিষ্ঠের নিকট সংখ্যালঘিষ্টের বশ্যতাকে ইহারা 'ভূমিদাস-প্রথার' সমতুল মনে করে । একটি কেন্দ্রের পরিচালনায় শ্রমবিভাগের কথা শুনিলেই ইহারা সকরুণ প্রহসনের শুরে চিৎকার করিয়া উঠে যে, ইহাতে মানুষকে 'নাটবল্টুতে' পরিণত করা হইতেছে । পার্টির সাংগঠনিক নিয়মকানুনের উল্লেখ করিলেই ইহারা ঘৃণার সহিত মুখ বিকৃত করিয়া এই অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য করে যে নিয়মকানুন একেবারে বাদ দিয়াই চলা যাইতে পারে ...।" "পরিষ্কার বুঝা যায়, বহুভাষিত আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে চিৎকার একটি ধুয়া ছাড়া আর কিছুই নয়, কেন্দ্রে যে সব লোক কাজ করিতেছে, তাহাদের প্রতি অসন্তোষকে ঐ ধুয়ার আবরণে ঢাকা দিবার চেষ্টাই শুধু করা হয় । তুমি আমলাগিরি ফলাইতেছ কারণ আমার ইচ্ছানুযায়ী তুমি নির্বাচিত হও নাই, আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তুমি কংগ্রেস কর্তৃক নির্বাচিত হইয়াছ । তুমি অন্ধভাবে বিধি অনুসরণ করিয়া চল - কারণ, তুমি আমার সম্মতির উপর নির্ভর করিয়া চল না, তুমি চল কংগ্রেসের বিধিবৎ সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করিয়া, তুমি স্থূল যন্ত্রের মতো কাজ কর - কারণ, পার্টি কংগ্রেসের যান্ত্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলেই তুমি কর্তৃত্ব লাভ করিয়াছ, এবং কমিটিতে আসন পাইবার আমারও যে ইচ্ছা আছে, তাহা তুমি বিবেচনা কর না । তুমি স্বৈরাচারী - কারণ, তুমি পুরাতন দলের হাতে ক্ষমতা ছাড়িয়া দিতে রাজি নও ।" - লেনিন

=================================


"পার্টি হইতেছে শ্রেণী সংগঠনগুলির সর্বোত্তম রূপ এবং সর্বহারাশ্রেণীর অন্য প্রকারের সংগঠনের মধ্যেও এই সংগঠনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রসার লাভ করা কর্তব্য ।" - লেনিন

এই কারণেই পার্টি-বহির্ভূত সংগঠনসমূহে 'স্বাধীনতা' ও 'নিরপেক্ষতার' সুবিধাবাদী মতবাদ লেনিনবাদের তত্ত্ব ও ব্যবহারিক প্রয়োগের সহিত একেবারেই খাপ খায় না । আইনসভার মধ্যে পার্টি হইতে বিচ্ছিন্ন সদস্য ও সংবাদপত্র জগতে স্বাধীন সাংবাদিকদের উদ্ভব হয় এই মতবাদের প্রশ্রয়েই; এই মতবাদের ফলেই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে সংকীর্ণচেতা কর্মীদের উদ্ভব হয় এবং সমবায়-সমিতি আন্দোলনে আত্মতুষ্ট ও পন্ডিতমূর্খ কর্মকর্তাদের আসর ইহার ফলেই জমিয়া উঠে ।

=================================


শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে পার্টির প্রয়োজন কেবল একাধিপত্য কায়েম করার জন্যই নয়, এই একাধিপত্যকে বজায় রাখার জন্য শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে পার্টি আরও বেশি প্রয়োজন, সমাজতন্ত্রের পূর্ণ সাফল্য আয়ত্ত করার উদ্দেশ্যে এই একাধিপত্যকে দৃঢ়তর ও সম্প্রসারিত করার জন্য শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে পার্টি প্রয়োজন । লেনিন বলিয়াছিলেন :
"এখন প্রায় প্রত্যেকেই নিশ্চয়ই উপলব্ধি করিতেছেন যে, পার্টির ভিতর কঠোরতম ও প্রকৃত পক্ষে লৌহকঠিন শৃঙ্খলা না থাকিলে এবং সমগ্র শ্রমিকশ্রেণীর পরিপূর্ণ ও অকুন্ঠ সমর্থন না পাইলে অর্থাৎ শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে যাঁহারা পশ্চাৎপদ স্তরকে সংগ্রামে টানিয়া আনিতে ও চালনা করিতে সক্ষম সেইরূপ চিন্তাশীল, সৎ, আত্মত্যাগী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পূর্ণ সমর্থন না পাইলে, এই দীর্ঘ আড়াই বছর ধরিয়া কেন, আড়াই মাসও বলশেভিকদের পক্ষে ক্ষমতা বজায় রাখা সম্ভব হইত না ।"

একাধিপত্য 'বজায় রাখা' ও 'সম্প্রসারিত করা' বলিতে কী বুঝায় - লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে শৃঙ্খলা ও সংগঠনের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করা; শ্রমিক সাধারণের সংহতির শক্তি গড়িয়া তোলা, এবং খুদে বুর্জোয়াদেড় ক্ষয়কারক প্রভাব ও অভ্যাসের সংস্পর্শ হইতে শ্রমিকশ্রেণীকে রক্ষা করিবার উপযোগী দুর্ভেদ্য শক্তি গঠন করা, পেটি-বুর্জোয়া স্তরকে নতুনভাবে শিক্ষা দিয়া নতুন সমাজজীবনের উপযোগী করিয়া তাহাদের গড়িয়া তোলার জন্য সর্বহারাদের সাংগঠনিক কাজের সম্প্রসারণ করা । শ্রেণীভেদ দূর করিতে এবং সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা সংগঠিত করার অনুকূল অবস্থা গড়িয়া তুলিতে শ্রমিকশ্রেণী যাহাতে সক্ষম হয় সেই জন্য তাহাকে উপযুক্ত শক্তি হিসাবে শিক্ষিত হইয়া উঠিতে সাহায্য করা । কিন্তু দৃঢ়তা ও শৃঙ্খলার দিক হইতে শক্তিশালী এক পার্টি ব্যতীত এইসব কাজ সুসম্পন্ন করা অসম্ভব । লেনিন বলিয়াছেন :
"সর্বহারাশ্রেণীর একাধিপত্য বলিতে বুঝায় পুরাতন সমাজের শক্তি ও রীতিনীতির বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম । এই সংগ্রাম কখনো চলে ভীষণ রক্তপাতের মধ্য দিয়ে, কখনো রক্তপাত ছাড়া, কখনো সশস্ত্র উপায়ে কখনো শান্তিপূর্ণভাবে, এই সংগ্রাম সামরিক ও অর্থনৈতিক, শিক্ষার ক্ষেত্রে ও শাসনবিভাগেও এই সংগ্রাম চলে । লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি লোকের অভ্যস্ত জীবনধারার শক্তি সাংঘাতিক । বহু সংগ্রামের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ লৌহ-দৃঢ় এক পার্টি ব্যতীত, শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে সমস্ত সৎ লোকের বিশ্বাসভাজন পার্টি ব্যতীত জনগণের মনোভাবের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া তাহাদের ঠিক পথে পরিচালিত করার উপযোগী প্রভাবশালী পার্টি ব্যতীত ঐ সংগ্রাম সাফল্যজনকভাবে পরিচালিত করা অসম্ভব । স্বকীয় একাধিপত্য বজায় রাখার জন্য সর্বহারাশ্রেণীর পক্ষে পার্টি প্রয়োজন । পার্টি সর্বহারাশ্রেণীর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার একটি হাতিয়ার ।

সুতরাং সমাজে যখন কোন শ্রেণীর অস্তিত্ব থাকিবে না এবং সর্বহারাশ্রেণীর একাধিপত্যের যখন ক্রমবিলোপ ঘটিবে, তখন পার্টিরও ক্রমবিলোপ ঘটিবে ।

=================================


"বর্তমান তীব্র অন্তর্যুদ্ধের যুগের কমিউনিস্ট পার্টি যদি খুব কেন্দ্রীভূতভাবে সুসংবদ্ধ হয় এবং পার্টির মধ্যে লৌহকঠিন শৃঙ্খলা যদি সামরিক শৃঙ্খলার পর্যায়ে উন্নীত হয়, পার্টিকেন্দ্র যদি শক্তি ও কর্তৃত্বের আধার হয়, এই কেন্দ্র যদি ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী ও পার্টি সভ্যদের বিশ্বাসভাজন হয়, - তবেই শুধু কমিউনিস্ট পার্টি বর্তমান তীব্র অন্তর্যুদ্ধের যুগে তাহার কর্তব্য সম্পাদন করিতে সক্ষম হয় ।" - লেনিন

=================================


"সর্বহারাশ্রেণীর পার্টির লৌহকঠিন শৃঙ্খলা যাহারাই বিন্দুমাত্র খর্ব করে, বিশেষত সর্বহারাশ্রেণীর একাধিপত্যের যুগে, তাহারাই শ্রমিকশ্রেণীর বিরুদ্ধে বুর্জোয়াদেরই সাহায্য করে ।" - লেনিন

=================================


...পার্টির দশম কংগ্রেসে 'পার্টি-ঐক্য' বিষয়ক প্রস্তাবে লেনিন "পার্টি ঐক্যের দিক হইতে উপদল গঠনের ক্ষতিকর ফল" সম্বন্ধে সকলকে সাবধান করিয়া দিয়াছেন, এবং "সর্বহারাশ্রেণীর একাধিপত্য সাফল্যমন্ডিত করার জন্য সর্বহারাশ্রেণীর অগ্রগামী বাহিনীর মধ্যে সম্মিলিত ইচ্ছা গড়িয়া তোলাকেই মূল শর্ত" বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন ।

এই কারণেই "পার্টির মধ্যে উপদলীয় নীতি বরবাদ করিতে এবং কোনরকম ব্যতিক্রম না দেখাইয়া পার্টির ভিতরকার সমস্ত উপদল অবিলম্বে নিশ্চিহ্ন করিতে" লেনিন দাবি জানাইয়াছেন । "যে-সব উপদল আলাদা নীতি ও কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করিতেছে তাহাদের ধ্বংসের জন্য প্রয়োজন হইলে বিনা শর্তে এখনই পার্টি হইতে তাহাদের বহিষ্কারের" জন্যও তিনি দাবি জানাইয়াছেন ।

=================================


"বুর্জোয়া-মনোভাবাপন্ন এই সব শ্রমিককে 'বাবু-শ্রমিক' বলিলেই ঠিক হয়; জীবনযাত্রার প্রণালী, উপার্জনের পরিমাণ ও দৃষ্টিভঙ্গির দিক হইতে ইহারা সম্পূর্ণরূপে পন্ডিতমূর্খদের সামিল; এই স্তরের শ্রমিকরাই দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রধান খুঁটি এবং আমাদের যুগে বুর্জোয়াশ্রেণীর প্রধান সামাজিক (সামরিক নয়) অবলম্বন ইহারাই । শ্রমিক আন্দোলনে ইহারাই বুর্জোয়াদের প্রধান দালাল; ধনিকশ্রেণীর পক্ষ হইয়া শ্রমিকদের নেতৃত্ব করে, বিপ্লবের পরিবর্তে সংস্কার ও শ্রেণীসংগ্রামের পরিবর্তে জঙ্গি জাতিদর্পের উন্মাদনা প্রচারের ইহারাই প্রধান বাহন ।" - লেনিন
=================================


"আমাদের মধ্যে সংস্কারপন্থী ও মেনশেভিকদের থাকিতে দিলে শ্রমিকবিপ্লবের জয়লাভ করা অসম্ভব, বিপ্লবের সাফল্য বজায় রাখা অসম্ভব । নীতির দিক হইতে একথা খুব স্পষ্ট এবং রাশিয়া ও হাঙ্গেরি উভয় দেশেরই অভিজ্ঞতা এই কথাই পরিষ্কার সমর্থন করিয়াছে । রাশিয়াতে অনেকবারই এমন দূরূহ অবস্থার উদ্ভব হইয়াছে যখন এই শ্রেণীর সুবিধাবাদী ও মেনশেভিকরা, সংস্কারপন্থী মধ্যবিত্ত ও গণতন্ত্রীরা আমাদের পার্টির মধ্যে থাকিলে সোভিয়েতের রাষ্ট্র নিশ্চয়ই উচ্ছন্নে যাইত । ইতালিতে ক্ষমতা দখলের জন্য বুর্জোয়াশ্রেণীর ও শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে চরম সংগ্রামের দিন ঘনাইয়া আসিয়াছে, একথা সাধারণত স্বীকার করা হইয়া থাকে । এই অবস্থায় মেনশেভিক, সংস্কারপন্থী ও তুরাতিপন্থীদের পার্টি হইতে বহিষ্কার করা একান্ত প্রয়োজন; শুধু তাই নয়; সে সব চমৎকার কমিউনিস্ট এখনো মত ও পথ ঠিক করিতে না পারিয়া অনিশ্চয়তার দোলায় দুলিতেছে এবং সংস্কারপন্থীদের হিত 'ঐক্য' স্থাপনের দিকে ঝুঁকিতেছে, তাহাদেরও দায়িত্বশীল পদ হইতে অপসারণ করা দরকার । ... বিপ্লবের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে যখন তীব্রতম সংগ্রামের ভিতর দিয়া অগ্রসর হইতে হয়, তখন পার্টির মধ্যে বিন্দুমাত্র দ্বিধাসংকোচ থাকিলে তাহার ফলে শ্রমিকশ্রেণীর হাত হইতে ক্ষমতা খসিয়া পড়িতে পারে; কারণ এই ক্ষমতা অদ্যাবধি সুদৃঢ় হইয়া উঠে নাই, ইহার বিরুদ্ধে আক্রমণ এখনো বেশ জোরালো । এই অবস্থায় অস্থিরমতি নেতারা যদি পার্টির কাজ হইতে অবসর গ্রহণ করে, তাহা হইলে পার্টি এবং শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলন ও বিপ্লবের শক্তি তাহার ফলে খর্ব তো হইবেই না, বরং বৃদ্ধিই পাইবে ।" - লেনিন



Tuesday, 25 October 2016

আমি কি বাঙালি ? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার অন্যতম কারণ যে অঙ্গ রাজ্যগুলির ওপর রুশ ভাষার জবরদস্তি, তা আমাদের কত্তারা খেয়াল করেন না ।


বামপন্থীরা কেউ বাঙালি বা ভারতীয় নয় । মার্কসবাদ তো বিশ্বমানবিক আদর্শ । প্রখ্যাত ঐতিহাসিক টয়েনবি বলেছিলেন, কমিউনিজমের প্রধান প্রতিদ্বন্ধী হবে ন্যাশনালিজম, তাতে তাঁরা কর্ণপাত করেননি । মার্কসবাদী হয়েও চিন ও রাশিয়া নিজেদের সীমানা সম্পর্কে স্পর্শকাতর, সমাজতন্ত্রী হয়েও যে হাঙ্গেরি ও রুমানিয়ার মধ্যে তিক্ত ঝগড়া লেগেই ছিল, তাও তাঁরা দেখেও দেখতে চাননি । এবং দেশের উগ্র বামপন্থীরা বাঙালির যা কিছু গর্বের বস্তু, তাকে ভাঙতে বসলেন । রামমোহন সামন্ততন্ত্রের প্রতিভূ, বিদ্যাসাগর সিপাহিবিদ্রোহ সমর্থন করেননি সুতরাং প্রতিক্রিয়াশীল, রবীন্দ্রনাথ বুর্জোয়া কবি, সুভাষ বোস ফ্যাসিস্ত ! বিবেকানন্দ উল্লেখেরও অযোগ্য । তাঁদের সভা-সমিতিতে মার্কস-লেনিন-স্তালিনের বড় বড় ছবি ঝুলছে, বাঙালি তথা ভারতীয় কেউ স্থান পাননি । এমনকি মুজাফফর আহমেদের ছবিও না । মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেসের সম্পত্তি, সুতরাং বামপন্থীদের কাছে অচ্ছুত ।


যাঁরা নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করেন, যাঁরা আন্তর্জাতিক মানসিকতার অধিকারী বলে মনে করেন নিজেদের, তারা ভুলে যান যে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে পরিপূর্ণ ভাবে অবহিত না হলে কোনও মানুষেরই মানসিক গঠন সম্পূর্ণ হয় না । যার পা দুটি গাঁথা থাকবে নিজের দেশের মাটিতে চোখ থাকবে নিজস্ব পারিপার্শ্বিকে আর চিন্তায় থাকবে সারা পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাস, সেই প্রকৃত আন্তর্জাতিক মানুষ । অ্যারিস্টটল থেকে মাও জে ডং পর্যন্ত অনেকেই এমন কথা বলে গেছেন । বাঙালির ঐতিহ্যকে অগ্রাহ্য করে প্রগতিশীল হওয়া যায় না ।

Thursday, 18 August 2016

তর্কপ্রিয় ভারতীয় - রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর ভারতবর্ষ

 রবীন্দ্রনাথ বরাবরই জোরালো ভাষায় ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনা করে এসেছেন । যত দিন গেছে তা আরও জোরালো হয়েছে । এই ব্যাপারটা প্রায়ই লোকের নজর এড়িয়ে যায় । তার কারণ, তিনি বিশেষভাবে সচেষ্ট ছিলেন, যাতে ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনার সঙ্গে ব্রিটিশ কিংবা পাশ্চাত্য দেশের মানুষ এবং সংস্কৃতির বিরূপ সমালোচনা না হয়ে যায় । ইংল্যান্ডে গাঁধীকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল, পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কে তাঁর অভিমত কী, তার জবাবে তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তিটি, ("সে বস্তুটি থাকলে তো ভালই হত") রবীন্দ্রনাথের মুখ থেকে বেরোতে পারত না । কীসের প্ররোচনায় গাঁধীর এই প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ তা বুঝতে পারতেন - সাম্রাজ্যবাদী অত্যাচারের সঙ্গে সাংস্কৃতিক আত্মম্ভরিতা যুক্ত হয়েছিল । এই সাংস্কৃতিক দম্ভের এক চমৎকার দৃষ্টান্ত ডি. এইচ. লরেন্সের মধ্যে পাই : 'যতদিন যাচ্ছে আমি দেখে আরও বিস্মিত হচ্ছি, প্রকৃতপক্ষে প্রাচ্যের অধিবাসীরা, -- ভারতীয় এবংগ পারসিকেরা - যা কোনওদিন স্বপ্নেও দেখতে পারেনি, আমাদের ইউরোপীয় সভ্যতা তার চেয়ে কত উচ্ছে অবস্থিত । ... অতি ন্যক্কারজনক তাদের প্রতি এই মিথ্যা শ্রদ্ধার ভান, এই অবাঞ্চিত রবীন্দ্রপূজা ।' কিন্তু, তামাশার ছলেও, রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য সভ্যতাকে গাঁধীর মতো খারিজ করে দিতে পারেননি ।

Sunday, 7 August 2016

আম্বেদকর একটি সমাজতাত্ত্বিক পর্যালোচনা ১

সি কে কোলে নাম একজন সমাজ সংস্কারক ১৯২৬ সালে মুম্বাই বিধি সভায় এক প্রস্তাব রেখেছিলেন এইভাবে - সমস্ত প্রকাশ্য সামাজিক লোকালয়ে দলিতদের সমাজের মূল স্রোতের মতো মুখ্য অধিকার দেওয়া হোক । সেই সর্বজনীন অধিকারবোধের তালিকার অন্তর্গত হল যথাক্রমে বিচারালয়ের সমান অধিকার, বিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকার ও পঠন, কুয়োর জল ব্যবহারের অধিকার এবং বাজার করবার সমতা দেন প্রভৃতি । দলিতদের জন্য এর প্রতিটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা যেন বাধ্যতামূলক তুলে নেওয়া হয় । ওই আনীত প্রস্তাবের ভিত্তিতেই প্রণয়ন করা হল নতুন এক আইন । নতুন আইন মোতাবেক কোলাবার প্রসিদ্ধ 'চৌদুয়ার' জলাশয় দলিতদের ব্যবহার করবার অবাধ অনুমতি করা হল ।কিন্তু ওখানকার প্রচলিত নিয়ম মেনে পুরোনোপন্থীরা দলিতদের জল ব্যবহারে অযথা বাধা সৃষ্টি করত । তাই দলিতদের আইনী দাবির পূর্ণ কার্যকারিতার লক্ষ্যে বহিষ্কৃত হিতকারিনী সভা ১৯২৭ সালে ১৯/২০ মার্চে মাহারে এক পরিষদ তৈরি করল ।  ওই পরিষদের কর্মসূচী অনুযায়ী হাজার হাজার অস্পৃশ্য মানবমানবী একত্রিত হয়েছিলেন । ওখানে বাবাসাহেব বলেন, গণজাগরণের পর্ব সমাপ্ত হয়েছে, এখন চেতনার প্রত্যক্ষ রূপায়ণের প্রয়োজন । নেওয়া হল, সত্যাগ্রহ আন্দোলনের শপথসূচী । মহারাষ্ট্রের সমস্ত প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রায় পাঁচ হাজার দলিত মাহার অভিযান সফল করলেন । ওই জনসভায় ১৫ বছরের দলিত থেকে ৭৫ বছরের অস্পৃশ্যদের জমায়েত ছিল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে । ... গোটা জনসভা চারভাগে বিভক্ত হল । পূর্ণ শৃঙ্খলিত মর্যাদায় তারা এগিয়ে চলল পুকুরের দিকে । ভারতীয় সমাজ সংস্কারের ইতিহাসে এই সত্যাগ্রহ আন্দোলনের বিশেষ মাহাত্ম্য আছে । বাবাসাহেব স্বয়ং গেলেন পুকুর পর্যন্ত । চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে জল স্পর্শ করলেন আর আঁজলা ভরে সেই জল পান করলেন । হাজার হাজার মানুষ আম্বেদকরের পদাঙ্ক অনুসরণ করলেন । ... এদিকে গোঁড়াপন্থীরা ভেবে নিল, পুকুরের জল তো অশুদ্ধ । এদিকে বিকল্প কোনো জলের ব্যবস্থাও নেই । কীভাবে তাদের তৃষ্ণার পানীয় জল পাওয়া যায় ? তখন এই পুকুর থেকে ১০৭ ঘড়া জল তুলে নিল, ওতে মিশিয়ে দিল গোমূত্র আর গোবর । এবার ওই জল পুকুরে মিশিয়ে ঘোষণা করে দিল যে পুকুরের জল বিশুদ্ধ হয়ে গেছে । কি আশ্চর্য অসঙ্গতিময়, অজ্ঞান অন্ধ বিচারক্ষমতা আর সিদ্ধান্ত দান । মানুষের স্পর্শে অশুদ্ধ জল জন্তুজানোয়ারের বর্জ্য পদার্থের সংশ্রবে শুদ্ধ হয়ে গেল । এই ছিল তৎকালীন সামাজিক সনাতনী অভিধার স্মারক কথা ।


'আমার সংঘর্ষ তত্ত্বের বিরুদ্ধে, কোনো ব্যক্তিসত্তা বা জাতিগোষ্ঠীর বিরোধিতায় নয় । পুনের একজন ব্রাহ্মণ মহিলা এই সত্যাগ্রহে যোগদানের ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন । ওঁকে আমি কীভাবে নিবারণ করব ? আমার সংঘর্ষ ব্রাহ্মণদের অন্ধ কাঠিন্যের সঙ্গে । কিন্তু প্রগতিশীল উদারনৈতিক মানবতাবাদী ব্রাহ্মণদের সহযোগিতা আমি কীভাবে এড়িয়ে যাব ?'


১৯২৭ সালের ২৫শে ডিসেম্বর সকলকে বিস্মিত করে বাবাসাহেব মনুস্মৃতির প্রসঙ্গ তুলে মাহারে ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন করলেন । 'মনুস্মৃতি' বলে বর্ণব্যবস্থা শাস্ত্রানুগ, শাস্ত্রসিদ্ধ । মনু সামাজিক বৈষম্য সমর্থন করেছেন শূদ্র জাতির নিন্দা করে । তাই তিনি প্রকাশ্যে জ্বালিয়ে দিলেন 'মনুস্মৃতি'। আত্মস্বাতন্ত্র্যবোধের পূর্ণ সন্ধান লাভ করতে গেলে এই গ্রন্থ প্রতি মুহূর্তের অন্তরায় । অস্পৃশ্যদের কাছে গ্রন্থটি অপমানজনক বলেই তিনি সেটিকে দগ্ধ করবার সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছিলেন । 'মনুস্মৃতি' দগ্ধ করে বাবাসাহেব সামাজিক পরাধীনতার বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন ।


নাসিকের কলারাম মন্দিরে প্রবেশ ঘিরে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে সবর্ণদের মানসিকতায় বিক্ষুব্ধ হয়ে দলিতরা ১৯২৮ সালে নাসিকেই এক শীর্ষ বৈঠক করেন । বৈঠকে পৌরোহিত্য করবার জন্য ভাবা হল ডঃ বাবাসাহেবের নাম । দলিত বর্ণের উদ্দেশ্য ছিল স্বতন্ত্র মন্দির নির্মাণ প্রকল্প । কিন্তু পরিষদের অধ্যক্ষপদের স্থান থেকে বাবাসাহেব এই কর্মসূচীর বিরোধিতাই করলেন ।

তিনি বললেন, নিজের সন্তের নামাঙ্কিত মন্দির নির্মাণে কোনো সফল উদেশ্য চরিতার্থ হবে না । উল্টে গোটা ঘটনাটাই তখন ওই পরিস্থিতিতে আগুনে ঘি ঢালার মতো হিতে বিপরীত ডেকে আনবে । কেননা, অস্পৃশ্যতার কলঙ্ক নিয়ে স্বতন্ত্র দেবমন্দির গঠনে সেই সামাজিক দূরত্ব আরও স্বকৃত জটিলতা সৃষ্টি করবে । তাছাড়া এই জাতীয় মন্দির নির্মাণে ব্যয়ভার বহনের দায় বর্তাবে গরিবগুর্বো দলিতদের ওপর । আর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি হল বাবাসাহেব কোনোদিনই মানুষের চাইতে দেবতার মূর্তি পুজোয় সায় দেননি ।


১৯২৮-এ মুম্বাই-এ দেড় লক্ষ মজুর নিজেদের অধিকারের দাবী তুলে হরতাল করেছিলেন । ওই হরতালে দলিতদের ভূমিকায় ছিল উল্লেখযোগ্য প্রাধান্য আর বৈচিত্র্য । হরতাল শেষ না হলে দলিতদের আত্মহত্যা করা ছাড়া বিকল্প পথ খোলা ছিল না । তাই ওই হরতালের প্রতি সমর্থন নয় বিরোধিতা করেছিলেন বাবাসাহেব । উনি আরও সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করেছিলেন যে সবর্ণেরা নেতৃত্বের দিক থেকে দলিত মজুরদের শ্রমিক মজুর রূপে না দেখে শুধু দলিত রূপেই দেখে । ভেতরে ভেতরে দলিতদের জন্য দূরত্বময় ঘৃণা আর উপেক্ষাই তাদের লক্ষ্য । এমনকি দলিতদের অপমানজনক, সম্মানহানির কাজগুলোই করতে হত । তাই আম্বেদকর ভেবে নিলেন, শিক্ষা ব্যতীত দলিত-সামাজিক-জীবনের কোনো পরিবর্তিত পরিস্থিতি তৈরি হবে না ।


জাতিপ্রথার অসহনীয় রক্ষণশীলতা ভেঙে ফেলবার জন্য অসবর্ণ অন্তর্বিবাহকেই মাধ্যম হিসেবে মনে মনে স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন বাবাসাহেব ।


বাবাসাহেব বললেন যে, কংগ্রেসীদের মতামত স্ববিরোধী । মুখে তাঁরা বলছেন, জাতপাতের ঊর্ধ্বে মনুষ্যত্বের ওপর বিশ্বাস তৈরি বাঞ্চনীয় । কিন্তু কার্যত শ্লোগান দেবার কর্মসূচীতে অন্যরকম বক্তব্য । এখানে হিন্দু সমাজ মনে করে, কেবল হিন্দু-মুসলমানেরই সমস্যা বর্তমান । কিন্তু দলিতদের কোনো সমস্যার অস্তিত্ব সম্বন্ধে তারা উদাসীন । এমনকি কোনো সমস্যা শোনবার মতো তাদের ধৈর্যও নেই । তাই ভবিষ্যতে এ দেশের গঠিত সংবিধানে দলিতদের অধিকার বোধের আর সুরক্ষা সম্পর্কে নিরাপত্তা থাকা দরকার । তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে এদেশের অস্পৃশ্যদের অধিকার ফিরিয়ে দেবেনই, এমনকি রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে তাদের হৃত সম্মানবোধ প্রতিষ্ঠা করে যাবেন । তিনি স্পষ্টই জানিয়ে দেন যে ভবিষ্যতে শুধুমাত্র হিন্দুদের একচেটিয়া সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ঔদ্ধত্য মেনে নেবেন না কোনো মূল্যেই ।


বাবাসাহেব বলেছিলেন, 'মহাত্মাজী আমার কোনো মাতৃভূমি নেই ।' গান্ধীজী উত্তর দিয়েছিলেন, 'আপনার মাতৃভূমি আছে, এটিই আপনার জন্মস্থান ।' বাবাসাহেব পুনরায় বললেন, 'আবার বলছি আমার কোনো মাতৃভূমি নেই ।' গান্ধীজী অবাক-দৃষ্টিতে সপ্রশ্ন হলেন । আম্বেদকর বলেছিলেন যে কুকুরের থেকেও নিম্নমানের জীবনধারণ প্রক্রিয়ায় কেউ জন্মস্থানকে মাতৃভূমি বলে চিহ্নিত করতে পারে না ।


তৃতীয় গোলমেজ অধিবেশনে যোগদানের আগে পুনেতে আহূত এক সভায় তিনি বলেছিলেন যে 'দেশদ্রোহী', 'রাষ্ট্রদ্রোহী', 'হিন্দুধর্ম-বিধ্বংসী' বলে আখ্যাত ব্যক্তিত্বটি তিনি নিজেই । কারণ এই সমাজে জন্ম নিয়ে এই সমাজেই তাঁর মৃত্যু অনিবার্য । হিন্দুদের মন বলে কিছু নেই । ওঁরা নির্জীব । ওঁদের মন পাথর আর ইঁটের দেওয়ালের মতো দুর্লঙ্ঘনীয় । ওই দেয়ালে মাথা ঠোকাই সার হবে । ওতে মাথা চৌচির হলেও হিন্দুদের মনের কোনো পরিবর্তন হবে না ।


দলিত সমাজের পতন এবং কমজোরী আন্দোলনের জন্য দায়ী হিন্দু সমাজ । সমাজে সমান প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য, ব্যক্তিগত সমান অধিকারে, মানবতায় দীক্ষিত হওয়ার তাগিদে দ্বিতীয় কোনো ধর্মে দীক্ষিত হতে পারা যায় না কি ? অর্থাৎ সমান্তরাল ধর্মচিন্তার কথায় তখন তিনি আন্দোলিত । ওই একটি বিন্দুতে যুক্তিদানের দক্ষ উচ্চারণ স্পষ্ট হল ওঁর কণ্ঠে । 'তথাকথিত হিন্দুধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করো, স্বাভিমান আর শান্তির লক্ষে অন্যত্র যাও । কিন্তু স্মরণে রাখবে, তোমার নির্বাচিত ধর্মবোধে যেন সমান অধিকারবোধ, সম আচরণ ক্ষেত্র আর সমস্তর চেতনার স্পন্দন থাকে ।' বক্তৃতার অন্তিম অংশটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর - 'আমি অস্পৃশ্য জাতিতে জন্ম নিয়েছি, এতে কোনো অপরাধ ছিল না, কিন্তু মৃত্যুর সময় আমি হিন্দুরূপে থাকব না ।'


১৯৩৫ সালে আইনমাফিক অনেক প্রদেশে নির্বাচন ঘোষণা করা হয় । দলিতদের লড়াইকে অধিক গতিময় করে তোলবার তাগিদেই তিনি 'স্বতন্ত্র মজদুর পার্টি' স্থাপন করেন । ১৯৩৬-এর ১৫ই আগস্ট 'টাইমস অফ ইন্ডিয়া'-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বাবাসাহেব বলেছিলেন দেশ শাসনে অপ্রত্যক্ষ বা প্রত্যক্ষ রীতিতে ভাগনির্ভর করে নিজের আনুকূল্য না তৈরি করে দলিত আর শোষিত বর্গের দুঃখ দূরীভূত করা যাবেই না ।অন্য কেউ দলিত বা শোষিত বর্গের কাজ করবে না । সে আশাও দুরাবহ । তাই মজুর পার্টির স্বাতন্ত্র্য আবশ্যিক । লক্ষ্য করবার বিষয় হল যে, বাবাসাহেব এখানে দলিত শব্দের স্থানে 'মজুর' শব্দের সচেতন প্রয়োগ করলেন । .... মজুরদের প্রকাশ্য সভায় বলতেন দুনিয়ায় দুই বর্গ বর্তমান - (১) বড়লোক, (২) গরীবলোক । শোষক আর শোষিত । তৃতীয়স্থানে মধ্যমবর্গ । ওদের বর্গ অত্যন্ত ক্ষুদ্র । তাই কৃষক আর মজুর নিজের অবস্থান চিহ্নিত করে নিক । জাতি ধর্ম বর্ণ নিরপেক্ষতায় মজুর সংগঠনের আবশ্যিকতা রয়ে গেছে । ডঃ আম্বেদকরজীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈপ্লবিক কর্মবিন্যাসের অন্তর্গত হল, ভারতীয় মজুরদের স্বতন্ত্র ধারণাবোধ ।


কংগ্রেসের ঐতিহাসিক 'ভারতছাড়ো' আন্দোলনের সূচনা পর্ব ঘোষিত হয় । বাবাসাহেব উল্টে বলেছিলেন - 'ছাড়ো ভারতের চেয়ে আমি নতুন ভারতের প্রতীক্ষায় থাকব ।'


'৪৭ সালের ১৪ই জুলাই ব্রিটিশ সংসদে ভারতের স্বাধীনতার প্রস্তাব আনীত হয় এবং সংবিধানসভার হাতে পূর্ণ অধিকার দেওয়া হয় । সংবিধান সমিতির সিদ্ধান্তে বাবাসাহেব বাংলা বিধানসভা থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন । কিন্তু বঙ্গভঙ্গের কারণে ওঁর সদস্যপদ আপনাআপনি রুদ্ধ হয়ে যায় । সংবিধান সভায় বাবাসাহেবের মতো বড় মাপের পন্ডিতের উপস্থিতি সর্বজনস্বীকৃত । সংবিধান সভায় ওঁর প্রতিনিধিত্বের দাবীতে ডঃ জয়কর ত্যাগপত্র পেশ করলেন । মুম্বাই বিধিমন্ডলের কংগ্রেস পার্টি আম্বেদকরজীকে নির্বাচিত করেন ।


সমস্ত বিশ্বের গণতান্ত্রিক সংবিধানের রূপরেখার সতর্ক অধ্যয়নে ভারতের সংবিধানকে দিতে চেয়েছিলেন স্বতন্ত্র মাত্রা । এমন এক নিরপেক্ষ রূপকার হতে চাইলেন এই কর্মী বিপ্লবী মানুষটি, যেখানে মানুষের বর্ণ, বর্গ, ভাষা বা লিঙ্গবৈষম্য কোনোভাবেই মানবতাকে আঘাত না করে । প্রতিটি মানুষের সুযোগ্য অধিকারবোধের সচেতন প্রয়োগকুশলতাকে তিনি গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন ।


সংবিধানের গুরুত্ব সম্বন্ধে মতামত দিতে গিয়ে বাবাসাহেব বলেন যে ভারতীয় সংবিধানে সম্বন্বিত তত্ত্ব ওই শতাব্দীর ব্যক্তিত্বচিহ্নিত স্বতন্ত্র চেতনামাত্র । সভাগৃহের মূল বক্তব্য আর সিদ্ধান্ত সংবিধানে ব্যক্ত হয়েছে । সংবিধানের ভালো-মন্দ নির্ভর করে শাসনকর্তার প্রয়োগদক্ষতার ওপর । সংবিধান সভায় ভাষণ দেবার সময় ভারতীয় জনগণের উদ্দেশ্যে তিনি সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন । বলেছিলেন, রাজনৈতিক পার্টিগুলো রাষ্ট্রহিতের পরিবর্তে নিজেদের ক্ষুদ্র অস্তিত্ববোধের স্বার্থ দেখলে ভারতের স্বাধীনতা বিপন্ন হবে । এছাড়াও তিনি আঙ্গুলি সংকেত করেছিলেন দ্বিতীয় এক অশনি নির্দেশের প্রতি । সেটি হল ব্যক্তিপূজার ধারণা । যে কোনো পরিস্থিতিতেই জনগণ ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ থেকে যেন বিচ্যুত না হয়ে যায় । আত্মমর্যাদাবোধ সমর্পন করে কোনো ব্যাক্তিমানুষকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া অনুচিত । সেই ব্যক্তিমানুষ যত বড়ই হোক না কেন, সমগ্র জাতীয়তাবোধের ঊর্ধ্বে তার গুরুত্ব নেই । নির্বোধ অন্ধ আনুগত্যময় ব্যক্তিপুজো দেশের স্বাধীন চেতনাকে আঘাত করতে পারে । বাবাসাহেব আরও স্পষ্ট করে জানিয়েছেন যে সামাজিক আর অর্থনৈতিক উন্নতিপ্রকল্পে জনগণের সাংবিধানিক পথকেই মর্যাদা দেওয়া কর্তব্য । অসংবিধানিকতার পদাঙ্ক অনুসরণের নাম অরাজকতার পৃষ্ঠপোষকতা । এছাড়া তিনি দেশের জনগণকে শুধু রাজনৈতিক স্বার্থবোধে লালিত হতে নিষেধ করলেন । কেননা সামাজিক অসাম্যতায় কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার অর্থ হল স্বল্পসংখ্যক মানুষের বহুসংখ্যক মানুষের ওপর কর্তৃত্বের কায়েম করতে দেওয়া । অর্থাৎ ক্ষমতায়ণ চিহ্নিত হয়েই রইবে মুষ্টিমেয় মানুষের কুক্ষিগত স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর । 

Thursday, 28 July 2016

আম্বেদকর একটি সমাজতাত্ত্বিক পর্যালোচনা

ধর্ম সংস্কারক, সমাজ সংস্কারক, ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী, হিন্দু ধর্ম বিরোধী, অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক নেতা, সংবিধানের মুখ্য স্থপতি, শিক্ষাবিদ - এই বিশেষণগুলির সবকটিই সত্য, কিন্তু এর কোনো একটিকে নিয়ে তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনের রূপকে ধরা সম্ভব নয় ।


“Lost sights are never regained by begging and by appeals to the conscience of the usurpers but by relentless struggle’. তিনি মনে করেছিলেন ভারতের স্বাধীনতা মানেই ভারতের জনগণের স্বাধীনতা নয় । প্রথমটা যে দ্বিতীয়টাকে সুনিশ্চিত করবে এমন কোন কথা নেই । আর আম্বেদকর জনগণের স্বাধীনতার স্বাধীনতার ধারণাতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন ।

রাজনৈতিক সংস্কার ও সামাজিক সংস্কারের মধ্যে আম্বেদকর সামাজিক সংস্কারের ধারণাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন । প্রকৃত সংস্কার কখনই কার্যকরী হবে না যদি না সামাজিক বিষয়টা অবহেলিত থাকে । তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে অধিকার আইনের দ্বারা রক্ষিত হয় না - অধিকার রক্ষা হয় প্রধানত 'সামাজিক ও নৈতিক বিবেক' দ্বারা ।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী কালো মানুষদের কাছে মৌলিক অধিকারের কি গুরুত্ব আছে ? জার্মানীতে ইহুদি দমন হয়েছিল আইনী অধিকার সে দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও । ভারতে নীচু জাতিগুলির কাছেও তেমনি সংবিধান, মৌলিক অধিকার - এগুলি অর্থহীন কারণ রাজনৈতিক গণতন্ত্র সত্ত্বেও সামাজিক স্বৈরাচার চালু থাকতে পারে । তাই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র যদি সামাজিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রে দ্বারা পরিপূরিত না হয় তা হলে 'রাজনৈতিক গণতন্ত্র' ধারণাটিই অর্থহীন হয়ে পড়ে ।


"We must make our political democracy a social democracy as well. Political democracy cannot last unless there lies at the base of it social democracy. What does social democracy mean? It means a way of life which recognizes liberty, equality and fraternity as the principles of life.”


আম্বেদকর বলেছিলেন, "On 26.1.1950, we are going to enter a life of contradictions.”


দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার আলো প্রবেশ করাতে হবে এবং আন্দোলনের জন্য তাদের সংগঠিত করতে হবে, যে তিনটি slogan তিনি দিয়েছিলেন তা হল 'educate, agitate and organize.' দলিত সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা প্রতিনিধিত্বের কথা তিনি বলেছিলেন এবং কংগ্রেসের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও এর সপক্ষে ব্রিটিশদের সওয়াল করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত ১৯৩২ সালে গান্ধী এবং আম্বেদকরের মধ্যে Poona Pact সম্পাদিত হয় যার মাধ্যমে কংগ্রেস দলিতদের জন্য আরও বেশি প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে মেনে নিয়েছিল এবং যা ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের মধ্যে স্বীকৃতি পায় । আম্বেদকর বলেছিলেন, "My criterion of my work is the welfare of my community. I have no other ambition. For that only, I cooperated with the Congress.” তিনি বলেছিলেন, “Whatever I have achieved, is entirely due to the strength of my community. I am proud to be born a Harijan.”


তাঁর মতে, হিন্দুরা টিঁকে রয়েছে সমস্যাগুলিকে এড়িয়ে গিয়ে - তার মুখোমুখি হয়ে সমাধান করে নয় । হিন্দু সমাজের প্রগতিশীলতার ধারণাকে তিনি তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন, কারণ তিনি মনে করেছিলেন যে সমাজ জাতি-ব্যবস্থা ও অসাম্যের ওপর নির্ভরশীল, তা কখনও সামাজিক ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না - সেই সমাজ কখনও প্রগতিশীল বলে পরিগণিত হতে পারে না ।


তিনি বলেছিলেন যে, হিন্দু সমাজ শূদ্রদের যে চোখে দেখে, নারীদেরও সেই একইভাবে দেখে - উভয়ের ক্ষেত্রেই সমাজ তাদের কোনো অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়নি । হিন্দু বিবাহের নিয়ম হচ্ছে - 'polygamy for the man and perpetual slavery for the woman' । তাই নারীর অধিকারের প্রশ্নটি হচ্ছে দাসত্ব না স্বাধীনতা-এর কোনটি প্রাধান্য পাবে সেই প্রশ্ন ! বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার নিয়ে সেই সময়ে যে বিতর্ক চলেছিল সেখানে আম্বেদকর এক পরিস্কার stand নিয়েছিলেন । তিনি বলেছিলেন, যে বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয়টি হিন্দু সমাজে প্রচলিতই রয়েছে । 'Shudras forming 90 p.c. of the population had customary divorce. Are we for 90 p.c. or for 10 p.c. of the high caste people?' আম্বেদকর বলেছিলেন, "হিন্দুসমাজের বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা কেবলমাত্র পুরুষদের জন্য নারীর বর্ণাশ্রম নেই, কেন ? তারা কি মানব সমাজের বাইরে ? তারা কি গুণহীন ? হিন্দু শাস্ত্রকারদের মতে নারীমাত্রই শূদ্রাণী এবং তার কোন স্বাধীন সত্তা নেই । নারী সমাজের প্রতি এত বড় অসম্মান আর কোনো ধর্ম করেনি ।"


========================================================================

আর্যদের ভারতে পদসঞ্চারের সময় কোনো জাতিবিভেদজনিত প্রথা ছিল না । কিন্তু ব্যবসার ওপর বর্গীকরণ করবার প্রবণতা ছিল । ভারতীয় সাহিত্যে প্রথমে 'বর্ণ' শব্দের উল্লেখ ছিল, 'জাতি' শব্দের প্রয়োগ ঘটেছে অনেক পরে । 'বর্ণ' শব্দের প্রয়োগ মূলত গায়ের রঙ নির্ভর । ধর্মশাস্ত্রতে জাতি ও বর্ণের প্রয়োগ সমার্থক । এইখানেই ডঃ আম্বেদকরের আগমনের প্রস্তুতি ক্ষেত্রের বীজ নিহিত রয়েছে । বৈদিকযুগে আর্যসমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যদের মধ্যে বর্গীকরণ ছিল না । ঋকবেদের যুগে শূদ্ররা তিরস্কৃতও ছিল না । আদতে ঋকবেদে ছিল তিনটি বর্ণ - ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য । উপনিষদের সময় থেকে চতুর্থ বর্গ তথা শূদ্র সম্প্রদায়ের নির্মিতি করা হয়েছে । উপনিষদের কালসীমা প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৬০০ পর্যন্ত । স্পষ্টত উল্লেখ্য, বর্ণ আর জাতি বিভাজনের নাম মানুষের অবনমন এবং সর্বাত্মক ক্ষেত্রে অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার প্রবণতা খুবই প্রাচীনকালজাত । গুনকেন্দ্রিক বর্ণব্যবস্থার রূপান্তরীকরণ এবং জন্মগ্রহণ কবে, কিভাবে কোন সালে হয়েছে, তার নিশ্চিত প্রমাণ সঠিকভাবে প্রত্যক্ষ নয় । আসলে এই প্রক্রিয়া হয়েছে অত্যন্ত ধীরে ধীরে । প্রকৃত জ্ঞান আর তর্কচেতনাকে বহিষ্কার করে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি লাভকেন্দ্রিক অনুভবের প্রহর থেকেই জন্মসূত্রকেন্দ্রিক জাতিব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে । সমাজশোধনকারী 'মনুস্মৃতি' থেকে নবীন সমাজ ব্যবস্থায়  জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত । সামাজিক বর্গীকরণ পুরোপুরি জন্মভিত্তিক ।  বর্গীকরণের জন্মসূত্রকেন্দ্রিকতায় শূদ্র আর অচ্ছুতের মানবিক অধিকারবোধ সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত । ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে তাদের অস্তিত্ব সুস্থ-মানবিকতা । কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, মনুর পূর্বেই শূদ্র আর অচ্ছুতের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে । সমাজের তথাকথিত প্রচলিত নিয়মাবলি মনু ক্রমানুসারে শাস্ত্রবন্দী করে গেছেন । বিদগ্ধদের অনুমান, মনুর সময়সীমা খ্রিস্টপূর্ব ২০০ । সূচনাপর্ব থেকে 'মনুস্মৃতি' অনেক স্তরে বিন্যস্ত । গ্রন্থটির পূর্ণাঙ্গ রচনাকাল একটি নির্দিষ্ট সময়বন্দী না হয়ে খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে খ্রিস্টীয় ২০ পর্যন্ত বিস্তৃত । গৌতমবুদ্ধের জন্মকালীন সময়সীমা হল খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০'র মধ্যে । তথাকথিত যজ্ঞব্যবস্থা বা বর্ণবিভাজনের তীব্র বিরোধিতা করে মানবতাবোধের আদর্শে নিজের দর্শন তৈরি করেছিলেন বুদ্ধদেব । এখানে একটা কথা স্পষ্ট যে, কিছু মানুষের স্বার্থকেন্দ্রিক ক্রুরতার প্রভাবে তামাম পদদলিত মানুষ প্রায় তিন হাজার বছর থেকেই ক্রন্দনরত । বর্ণব্যবস্থার ভিন্নতর নির্বাচনী সূত্র ধরে বুদ্ধদেব 'সমতাবাদী ব্যবস্থা' স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন । কিন্তু এর স্থিতিশীলতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি । কেননা, বর্ণব্যবস্থায় এ যাবৎকাল প্রচলিত একদল মানুষের উদ্দেশ্যবোধ আর তথাকথিত নিরাপত্তা যে এক্ষেত্রে বিঘ্নিত হল; তাই ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির প্রশ্নে বৌদ্ধধর্মকে স্বীকার করতে তারা দ্বিধাগ্রস্ত হল । আবার বৌদ্ধধর্ম এত তর্কশুদ্ধ আর মানবিক ছিল যে, তার বিরোধিতাও প্রায় অসম্ভব ছিল । তাই শ্রেষ্ঠ মূল্যবোধকে স্বীকার করে নিয়ে বৌদ্ধধর্মকে আত্মপক্ষের আনুকূল্যে প্রযুক্ত করা হয়েছিল । এখানেও যখন সম্ভব-অসম্ভবের প্রশ্ন এল, তখন হিন্দুধর্মকেই বৌদ্ধধর্মের অনুকূল করবার চেষ্টা করা হল । এই কারণেই 'শঙ্করাচার্য' 'প্রচ্ছন্ন বুদ্ধ' নাম খ্যাত ।


উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণকে ক্ষুদ্র মনে করত আর নিম্নবর্ণও হীনম্মন্যতায় ভুগত । বর্ণব্যবস্থায় প্রান্তিক শূদ্র এবং তার নিম্নে অবস্থানকারী শূদ্র সর্বদাই উপেক্ষিত, অপাংক্তেয় আর অপমানিত হত । ধর্মের ধুয়ো তুলে সমাজের সর্বক্ষেত্রেই তারা  অপাংক্তেয় ছিল । পৃথিবীর কোনো দেশে ধর্ম বা সর্বশক্তিমানের এদেশের নির্ভরতায় একটি সম্পূর্ণ বর্ণের এত ঘোরতর উপেক্ষা হয়নি । ভারতবর্ষেই এটি ঘটেছে । কোনো গোষ্ঠীকে বর্ণ বা জাতির নাম দিয়ে সমাজব্যবস্থার মূল ছাঁচ থেকে ক্রম-বহিষ্কারে স্বাভাবিক মানবিক অধিকারের বঞ্চনায় তৈরি করে নেওয়া হয় পূর্ণ গোলামিতে । ওই গোষ্ঠী নিরুপায় হয়ে গোলামির পরাধীনতায় সমর্পিত হয় । মানুষের সংবেদনশীলতা একমাত্র নির্ণীত হয় জ্ঞানের কারণে । শিক্ষাকেন্দ্রিক জ্ঞানের অভাবেই তাদের সংবেদনশীল সচেতনতা জন্ম নেয়নি ।


শ্রী জ্যোতিরাও গোবিন্দরাও ফুলে (১৮২৭ - ১৮৯০)  ব্যাক্তিত্ব, যিনি উপেক্ষিত ভারতীয় কৃষকসমাজের প্রতি ইংরেজ শাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন । তাঁর স্থির ধারণা ছিল যে, ভারতীয় চাষীদের দুর্দশা-গ্রস্ততার অন্যতম কারণত্রয়ী হল, অজ্ঞানতা, অন্ধ-অনুগত্য এবং ধর্মান্ধতা ।


ভারতীয় সমাজসংস্কারের তিনটি সূত্র বাবাসাহেবের চিন্তাশীলতায় গৃহীত । সূত্র তিনটি হল - 'পড়ো', 'সংগঠিত হয়ে যাও' এবং 'সংঘর্ষ করো' ।

========================================================================




  

Wednesday, 25 May 2016

বাল্মীকির রাম ফিরে দেখা - সুকুমারী ভট্টাচার্য

রাম উপাখ্যানে কতগুলো প্রশ্ন জাগে । প্রথমত, বালী বধ বিষয়ে । স্পষ্টতই ক্ষত্রিয় বীরের পক্ষে কাজটা গর্হিত, এক বানররাজাকে আড়ালে লুকিয়ে থেকে হত্যা করা, এটা কোনো নীতিতেই সমর্থন করা যায় না । উত্তরে যদি বলি, সীতাকে খুঁজে পাবার জন্যে সুগ্রীবের সাহায্য অত্যাবশ্যক ছিল, তাহলেও প্রশ্ন ওঠে যে এতে রামের বীরত্ব সম্বন্ধে জাগে । সম্মুখ-সমরে তাহলে বালীকে হারাবার শক্তি বা সে শক্তি সম্বন্ধে আত্মবিশ্বাস রামের ছিল না । এটা এক যশস্বী ক্ষত্রিয়বীরের পক্ষে গ্লানিকর । কাজটা কাপুরুষোচিত, সম্পূর্ণ স্বার্থ প্রনেদিত । এবং আরও কলঙ্ককর হলো, বালীকে নিজের প্রজা বলে শাসন করেছেন বলা, বানর মাংস অভক্ষ্য তবুও বালী হত্যাকে মৃগয়া বলা এবং আনুষঙ্গিক বিস্তর কুযুক্তির অবতারণা করা।

গুহকের আতিথ্য গ্রহণ না করার মধ্যেও বর্ণ-বৈষম্যের প্রশ্ন ওঠে । ফলাহারী ঋষিরাও অন্যের দেওয়া ফল খেতে পারেন, বনবাসকালে রাম কয়েকবার মুনিঋষির আতিথ্য নিয়েওছেন । গুহক চন্ডাল, তাই তার কাছে শুধু পশুর খাদ্যই গ্রহণ করলেন।

অন্ধমুনি বৈশ্য, তাঁর স্ত্রী শূদ্রা (২/৫৭/৬৩) । তিনি নিজেকে 'বানপ্রস্থী' বলছেন কী করে ? তাহলে 'শম্বুকের সাধনাও তো অশাস্ত্রীয় হয় না ? এই শম্বুককে রাম বধ করেছেন এবং ব্রাহ্মণের অকাল মৃত পুত্রকে বাঁচাতে । তাহলে প্রাণের মূল্য রাম রাজত্বে বর্ণগতভাবে আপেক্ষিক, ব্রাহ্মণ-পুত্রের প্রাণ শূদ্রের প্রাণের চেয়ে দামি ? এটা মেনে নেওয়া হয়েছে সমস্ত প্রক্ষিপ্ত অংশে । রামরাজ্যে চন্ডালের সঙ্গে বন্ধুত্ব শুধু কথায় ?যে ফল জল ব্রাহ্মণদের কাছে নেওয়া যায় তা চন্ডাল বন্ধুর কাছে নেওয়া যায় না ? শূদ্র শম্বুক তপস্বী, কৃচ্ছসাধনে রত কিন্তু সাধারণ এক ব্রাহ্মণ বালকের তুলনায় তার প্রাণের মূল্য কিছু নেই ।

বালীকে বধ করা, শম্বুককে হত্যা করা ছাড়াও যেটি আমাদের বেশি ভাবায় তা হলো সীতা প্রত্যাখ্যান । সুন্দরকান্ডে সীতাহরণের পরে রামের যে বিলাপ তার ভাব সম্পূর্ণতই বিরহার্ত প্রেমিকের, কিন্তু সে কি শুধু অলঙ্কারিক বিরহ ? শুধু সীতাসম্ভোগ-বঞ্চিতের বিলাপ ? নতুবা দীর্ঘ অদর্শনের পরে রামের 'হৃদয়ান্তর্গতভাব' এমন হলো কেন যে সীতাকে দেখা মাত্রই তাঁর দুই চক্ষু পীড়িত বোধ করল এবং রাজনন্দিনী রাজকুলবধু সীতাকে শিবিকা থেকে নেমে হেঁটে আসবার হুকুম দিলেন, সীতা আসামাত্রই বললেন, 'গচ্ছ বৈদেহি' তোমার জন্য যুদ্ধ করিনি, করেছি ইক্ষবাকু বংশের গৌরব রক্ষার জন্য ? কোথায় ছিল সে ইক্ষবাকু কুলের গর্ব যখন লঙ্কায় প্রকাশ্য সভায় অপ্রমাণিত, অসত্য আশংকায় রাজকুলবধূকে কটু কথা বলেছিলেন ? কোথায় ছিল সে কুলগর্ব যখন দেবতাদের সাক্ষ্য, ঋষি বাল্মীকির শপথ সব অগ্রাহ্য করে পুত্রদের, প্রজাদের, অতিথিদের সামনে ইক্ষবাকু কুলবধূ সীতাকে আবার অগ্নিপরীক্ষা দিতে বললেন ? কোথায় রইল সে গর্ব যখন দেবী বসুমতী বারংবার সন্দেহে পীড়িত, লাঞ্ছিত, অপমানিত কন্যাকে কোলে নিয়ে অন্তর্ধান করলেন ? কে অপরাধী প্রমাণিত হলো ? অকারণ সন্দেহ এবং তার বশে দণ্ডদানের অপরাধে কলঙ্কিত হলেন না, ইক্ষবাকু-কুলতিলক রামচন্দ্র ? সীতা লক্ষ্মণকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছিলেন। 'রামকে বোলো, আমাকে চিরদিনই সম্পূর্ণ নির্দোষ জেনে, রামের হিতব্রতিনী জেনে, শুধু লোকাপবাদের আতঙ্কে ভয় পেয়ে ত্যাগ করলেন তিনি ।' এতে কি ইক্ষবাকু কুলের গৌরব বাড়ল ? গৌরব বাড়ল অন্যায় দণ্ডদাতা রাজার ? এ-ই রাম রাজ্যের নমুনা ?

========================================================================


কলিতে শূদ্র দ্বিজাতির প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠবে একথা রামায়ণ মহাভারত উভয় মহাকাব্যের ভার্গব প্রক্ষেপে অত্যন্ত স্পষ্ট । কাজেই এমন আদর্শ রাজার আকল্প নির্মান করতে হবে যিনি কঠোর হাতে প্রতিস্পর্ধী শূদ্রকে দমন করেন, বিনা দ্বিধায়, বিনা চিন্তায় । সেই আদর্শ রাজা রামচন্দ্র, যিনি শম্বুককে হত্যা করলেও দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করে বলেন - তুমি দেবতাদের কাজ করেছ । বর্ণগুলোর ক্রম যাতে নষ্ট না হয় সেটা দেখা রাজার কর্তব্য । রাম সেই আদর্শ রাজা, যাঁর এক খড়গাঘাতে প্রতিস্পর্ধী শূদ্র মরল এবং বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণের অকালমৃত পুত্রও বাঁচল । কলির আসন্ন সংক্রমণ থেকে যিনি প্রজাকুলকে বাঁচালেন, সমাজকে আশ্বস্ত এবং সুস্থির করলেন ।

পিতৃভক্ত, বন্ধু-বৎসল, প্রজাহিতৈষী, ভ্রাতৃ-বৎসল দেবদ্বিজে ভক্তিমান, সুবিচারক, যজ্ঞকারী - অতএব আদর্শ যুগোচিত নায়ক । শূদ্র যদি ত্রিবর্ণের সেবা ছাড়া অন্য কিছুর আকাঙ্ক্ষা করে তবে বর্ণ-ধর্মরক্ষাকারী রাজা তো তাকে মেরে ফেলবেনই । স্ত্রী যদি অনিচ্ছাতেও পর-পুরুষের দ্বারা স্পৃষ্ট বা অপহৃত হয় - তবে যতই সচ্চরিত্রা হোন না তিনি, অগ্নিপরীক্ষা, নির্বাসন, পুনর্বার পরীক্ষা এইসব অবমাননা তাঁকে নির্বিকার চিত্তে মেনে নিতেই হবে । সমাজ কখনোই নারীকে ব্যক্তি বল স্বীকার করেনি, ভোগ্যবস্তু পণ্যদ্রব্য এইসব আখ্যা দিয়েছে । .... সীতার সচ্চরিত্রা নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হবার পরও তাঁর গর্ভজাত সন্তানদের ইক্ষবাকু কুলের রাজসিংহাসনে অধিকার দেওয়া গেল না । প্রজারা নিশ্চয়ই পুলকিত হলো, আদর্শ রাজা রাজকুল-মর্যাদায় এতটুকু কলুষের বা তার সন্দেহেরও স্পর্শ লাগতে দিলেন না ।

এই যে নতুন আদর্শের প্রজাপালক রাজার নির্মাণ হলো, ইনি কিন্তু মহাকাব্যের নায়ক নন । সে নায়ক ক্ষত্রিয় যোদ্ধা বীর, আদর্শ রাজা হওয়া তাঁর কাছে প্রতীক্ষিত ছিল না । ক্ষত্রিয় নায়কের অঙ্গীকার ও কর্তব্য শেষ হয়েছে যুদ্ধ-জয়ে রাবণ-বধে । তারপর শুরু হলো মহাকাব্যটি ঢেলে সাজানো, আদিকান্ডে প্রথমার্ধে ও উত্তরাকান্ডে এঁর নবকলেবর রূপায়ণ ঘটল । এখন ইনি বর্ণধর্মের পরিপালক রাজা । শূদ্র ও নারীর কোনোরকম স্বাধীনতা, স্পর্ধা বা অধিকার স্বীকার করলে পাছে কলির স্পর্শদোষ ঘটে রাজ্যে, তাই ইনি সমাজের স্থিতবস্থা রক্ষা করেছেন অতন্দ্রভাবে । এর কিছু মূল্য দিতে হয়েছে তাঁকে, এক-পত্নীক রাজা সীতাকে হারালেন । সমাজে নারীর সতীত্ব শুচিতা নিয়ে যে নতুন নিরিখ তৈরি হয়েছে তার কাছে বলি দিতে হলো আপন দাম্পত্য-সুখ । কিন্তু এর মূল্য দিতে তাঁর বিশেষ বাজেনি, কারণ সীতাকে যখন তিনি প্রথম কঠিন কথাগুলো বলেন লঙ্কায়, তখন তা তাঁর হৃদয়ান্তর্গত ভাব । অর্থাৎ, সমাজের নির্মম নির্দেশ তিনি নিজ অন্তরে স্বীকার করে নিয়েছিলেন বলেই পারলেন ওই কথাগুলি বলতে । এইখানে মহাকাব্যের পরাজয় ঘটল শাস্ত্রকারদের কাছে ।

আজ যখন 'রামরাজ্য' সম্বন্ধে একটা স্বপ্নকে পুনর্বার কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করার একটা উগ্র চেষ্টা হচ্ছে এ দেশের লোকমানসে, তখন যেন আমরা নিজেদের প্রশ্ন করি : নারী শূদ্রের ওপর অত্যাচার যে তন্ত্রে অপরিহার্যভাবে গৃহীত, যেখানে ধর্মাকাঙ্ক্ষী শূদ্র ব্রাহ্মণ-পুত্রের জন্য প্রাণ দিতে বাধ্য হয়, নিষ্পাপ অন্তঃসত্ত্বা নারী অকারণে যেতে বাধ্য হয় নির্বাসনে, দেওরালা-আড়ওয়ালের পরও আমরা কি সেই রাজতন্ত্রই চাই ? এরই নায়ক কি 'মর্যাদা পুরুষোত্তম' ? অর্থাৎ পুরুষের সর্বোত্তম আদর্শ অসহায়কে বিপন্নকে ও নারীকে রক্ষা করাই তো এতদিন আদর্শ পুরুষদের অবশ্য করণীয় ছিল, তাকে বর্জন করে যে রাজতন্ত্র, তা কি সাধারণ মানুষের পক্ষে চূড়ান্ত অভিশাপ হয়ে উঠবে না ? তাকে ঠেকানোই কি আজ আমাদের প্রধান কর্তব্য নয় ?

Sunday, 15 May 2016

বামফ্রন্ট সরকার ৩৪ বছরের ইতিহাস সংকলন

বামফ্রন্ট সাফল্যকে অনুধাবন করতে ব্যাপক তথ্যাবলীর চেয়ে জীবনের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু কোন মানুষই জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে কখনো বিচরণ করতে পারেন না, তাই কেবলমাত্র ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে ব্যাপকতম সত্যকে স্পর্শ করা সম্ভব নয় । তবে সমাজজীবনের বৃহত্তর অংশগুলির জন্য কোন ইতিবাচক কাজ হলে তার পরোক্ষ প্রভাব সমাজের সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে । পশ্চিমবাংলায় সে অনুভব এত প্রত্যক্ষ ও স্পষ্ট যে, অজস্র মিথ্যা প্রচারেও সেগুলিকে নিষ্প্রভ করা যায়নি । কেননা এখানে উন্নয়নের সুফলে উপকৃত সর্বজনীন মানুষ । তবে ভিন্ন একটু মাধ্যম ও মাত্রা রয়েছে যার নিরিখে অনেক সময়ই সত্যকে চিন্হিত করা যায় । তা হলো বিবেচ্য বিষয় প্রসঙ্গে তৃতীয় কোন নিরপেক্ষ অভিজ্ঞতা ও অভিমত । তৃতীয় পক্ষ অর্থে তেমন অংশের মানুষ বা প্রতিষ্ঠান যে বা যারা ঘটনাবলীর দাতা ও গ্রহীতা না, দূরের অবলোকনকারী বা সমীক্ষক । পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্য উপলব্ধিতে সংক্ষেপে এমন নিরিখ কিছুটা লক্ষ্য করা যাক ----

১) সাধারণ মানুষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও রাজ্যের সাফল্য সমগ্র দেশ তথা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে । বিশেষ করে দারিদ্র দূরীকরণে এ রাজ্যের অভাবনীয় সাফল্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে বহুল আলোচিত বিষয় । রাষ্ট্রসংঘের দারিদ্রতা সম্পর্কিত প্রতিবেদনে পশ্চিমবঙ্গের সাফল্য প্রশংসিত হয়েছে । রাষ্ট্রসংঘ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রশংসা করেই ক্ষান্ত হয়নি অন্যদের অনুরূপ পথে চলার পরামর্শ দিয়েছে ।

২) ২০০০ সালের ৩১শে জানুয়ারি প্রকাশিত বিশ্বব্যাঙ্কের "ভারত : দারিদ্র্য দূরীকরণ, উন্নয়ন, উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণ" রিপোর্টে ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে দ্রুততার সঙ্গে দারিদ্র প্রমশনের ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর কারণও চিন্হিত করা হয়েছে । বলা হয়েছে পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে এই সময়ে ভূমিসংস্কার ও উচ্চহারে কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । এরই পাশাপাশি রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্পর্কে রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়, "বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা রাষ্ট্রায়ত্ত স্বাস্থ্য পরিষেবার বিশ্বাসযোগ্যতা কয়েকটি রাজ্যে বাড়িয়েছে - উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা" ।

৩) একদা ভারতের যোজনা কমিশনের অন্যতম সদস্য মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়া ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাপ্লায়েড ইকনেমিক রিসার্চের সুবর্ণজয়ন্তী বক্তৃতায় দেশের প্রধান ১৪ টি রাজ্যের (যেখানে ৯৫ শতাংশ মানুষ বাস করেন) উন্নয়নের তুলনামূলক ব্যাখ্যা করেন । সেখানে তুলে ধরা হয়েছে "১৯৮০-৮১ সাল থেকে ১৯৯০-৯১ সাল (৮০-র দশক) এবং ১৯৯০-৯১ সাল থেকে ১৯৯৭-৯৮ সালের (৯০-এর দশক) মধ্যে ১৪ টি রাজ্যের উন্নয়নমূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে । ঐ রিপোর্ট থেকে দেখা গেছে ৮০-র দশকে মোট আভ্যন্তরীণ উত্পাদন বৃদ্ধির হারের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল দশম । ৯০-এর দশকে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, কর্নাটক, তামিলনাডু, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ এবং রাজস্থানকে অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গ তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে । মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের পরই পশ্চিমবঙ্গের স্থান । মাথাপিছু রাজ্যের মোট আভ্যন্তরীণ উত্পাদন বৃদ্ধির দিক থেকে ৮০-এর দশকে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল একাদশ । ৯০-এর দশকে উঠে এসেছে তৃতীয় স্থানে, মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের পরেই ।

৪) হল্যান্ডের আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জি কে লিটেন এক দীর্ঘ গবেষণামূলক প্রবন্ধে লিখেছেন "অনেক পর্যবেক্ষকের কাছে এটা বিস্ময়কর যে, পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট প্রধান বামফ্রন্ট সরকার এখন প্রায় দুই দশক হলো ক্ষমতায় রয়েছে । এই সরকার অনেকগুলি জাতীয়, প্রাদেশিক ও স্থানীয় স্তরের নির্বাচনের পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে । ভারতীয় রাজনীতির ক্রমবর্ধমান ঘূর্ণাবর্তের মধ্যেও তা অবিচল রয়েছে । অবজ্ঞামূলক অস্বীকৃতি এবং নিঃশর্ত প্রশস্তি, এই দুই চরমাবস্থা কাটিয়ে একজন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক সরাসরি স্বীকার করে নিতে পারেন যে, পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ভালই কাজ করেছে এবং সেটাই হলো তার সাফল্যের উত্সস্বরূপ"।

৫) দেশের অন্যতম বনিকসভা - অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার অব কমার্স বিভিন্ন রাজ্যের উত্পাদন বৃদ্ধির হার সম্পর্কে একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে । তাতে ৮০-র দশক এবং ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যে বিভিন্ন রাজ্যের অভ্যন্তরীণ উত্পাদন বৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে তুলে ধরা হয়েছে । তাতে দেখা গেছে আলোচ্য সময়ে গড় উত্পাদন বৃদ্ধির হার বিহারে ১.৭৯ শতাংশ, পাঞ্জাবে ০.৬৯ শতাংশ, রাজস্থানে ০.৬ শতাংশ কমেছে । এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ । ৮০-র দশকের তুলনায় ৯০-র দশকে (১৯৯১-১৯৯৮) পশ্চিমবঙ্গে উত্পাদন বৃদ্ধির হার ৪.৭১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৬.৯১ শতাংশ হয়েছে ।

৬) রাষ্ট্রসংঘের অ্যাটাকিং পর্ভাটি রিপোর্ট (২০০০-০১) পশ্চিমবঙ্গের বর্গা অপারেশন-এর প্রশংসা করা হয়েছে ।

৭) পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সারা দেশের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে । শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা পরিচালিত বিকেন্দ্রীকৃত ব্যবস্থার প্রসারের এবং কর্মসূচির সুষ্ঠ রূপায়ণের ফলে কমেছে গ্রামীণ দারিদ্রতা । বিশ্বব্যাঙ্ক পশ্চিমবঙ্গের ভূমিকাকে প্রশংসা করে পশ্চিমবঙ্গকে অভিহিত করেছিল "leader state" হিসাবে ।

৮) কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ শৌরী কর্তিক প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে, ১৯৯৩-৯৪ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক বিকাশের হার পশ্চিমবঙ্গে সর্বাধিক । আলোচ্য সময়ে অর্থনৈতিক বিকাশের হার কমেছে অন্ধ্রপ্রদেশে ৮৩ শতাংশ, দিল্লিতে ৪০.২ শতাংশ, পাঞ্জাবে ৩৫ শতাংশ এবং উত্তর প্রদেশে ৪ শতাংশ । আর বেড়েছে ওড়িশায় ১.০২ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৫.৫৮ শতাংশ,বিহারে ১৮ শতাংশ, মহারাষ্ট্রে ২২ শতাংশ, রাজস্থানে ৫০ শতাংশ, কর্নাটকে ৮৫ শতাংশ, তামিলনাড়ুতে ৮৮ শতাংশ, ত্রিপুরায় ১০১ শতাংশ, গুজরাটে ১২১ শতাংশ এবং কেরালায় ১৪০ শতাংশ বেড়েছে । পশ্চিমবঙ্গে বেড়েছে সর্বাধিক হারে ১৮০ শতাংশ ।

৯) পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সাফল্য প্রসঙ্গে ভূয়শী প্রশংসা করেছেন বিশ্ববিখ্যাত পন্ডিত, বিশেষজ্ঞ, গবেষক নোয়াম চমস্কি ।

১০) পশ্চিমবঙ্গের সাক্ষরতার কর্মসূচীর বিপুল সাফল্যের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসাবে ইউনেস্কো পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে পুরস্কৃত করেছে ।

১১) ১৯৮৯ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত পূর্বাঞ্চল ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের সমস্ত রাজ্যগুলির পঞ্চায়েতরাজ সম্মেলনের উদ্বোধন করতে এসে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত রাজীব গান্ধী বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এবং বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগকে প্রশংসা করে তাকে সমগ্র দেশের 'মডেল' হিসাবেই চিন্হিত করেছিলেন ।

১২) সামাজিক বনসৃজনের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করে বনরক্ষার সাফল্যের জন্য বামফ্রন্ট সরকার অর্জন করে আন্তর্জাতিক সন্মান 'পল গেটি পদক' ।

১৩) পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসঙ্গে প্রতীচী ট্রাস্ট ২০১০ সালে একটি সমীক্ষা করে । ঐ সমীক্ষার ভিত্তিতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন যে মন্তব্য করেছেন তাহা এখানে উল্লেখ করা হলো : প্রথমত --- "শুধু ছাত্র ভর্তির সংখ্যাই বেশী নয়, ছাত্রদের উপস্থিতির গড়ও উল্লেখযোগ্য । (প্রাথমিক স্কুলে ও শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে যথাক্রমে ৫৮ শতাংশ এবং ৬৪ শতাংশ থেকে বেড়ে উভয় ক্ষেত্রেই ৭৫ শতাংশ হয়েছে)" । দ্বিতীয়ত --- "শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অবদান সম্পর্কে অবদান সম্পর্কে পিতামাতাদের সন্তুষ্টির মাত্রা বেড়েছে । (প্রাথমিক স্কুলের ক্ষেত্রে ৫২ শতাংশ থেকে ৬৪ শতাংশ এবং শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের ক্ষেত্রে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ) । যদিও সামগ্রিক সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এখনও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে । সন্তানদের উন্নতির ক্ষেত্রেও পিতামাতারা আগের থেকে অনেক বেশী সন্তুষ্ট । (প্রাথমিক স্কুলে ৪২ শতাংশ থেকে ৭১ শতাংশ, শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের ক্ষেত্রে ৪৯ শতাংশ থেকে ৭৩ শতাংশ)" । তৃতীয়ত --- "২০০১-০২ সালে ছাত্ররা কে কতটা শিখেছে, তার উপর সমীক্ষা চালাতে গিয়ে আমরা প্রতিটি ছাত্রের আলাদা আলাদা করে পরীক্ষা নিয়েছিলাম । আমরা দেখেছিলাম এমনকি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রদের ৩০ শতাংশ নিজের নাম লিখতে পারে না ।এতে আমরা খুবই আশাহত হয়েছিলাম । কিন্তু এখন এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে । বর্তমানে এই সংখ্যা ৩০ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৫ শতাংশ । (যদিও সংখ্যাটি শূন্য হওয়াটাই কাম্য, কিন্তু এই সংখ্যাটি হ্রাস পাওয়াও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়)" । চতুর্থত --- "এখন বেশিরভাগ প্রাথমিক স্কুল ও শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে মিড ডে মিল দেওয়া হয় । স্কুলগুলিতে শিক্ষা ও ছাত্রদের পুষ্টি বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা-ও স্পষ্ট । স্কুলে মিল দেওয়ার জন্য অবশ্যই ছাত্রদের উপস্থিতির হার বৃদ্ধি পেয়েছে । আবার শিক্ষকদের সংগঠনগুলিও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনুপস্থিতি কমাতে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে । এই উদ্যোগের ফলেও বহু অঞ্চলে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে" । পঞ্চমত ---"শিক্ষকদের সঙ্গে বাবা-মায়েদের সাক্ষাত এখন অনেক বেশী বাস্তবায়িত হচ্ছে । বিশেষ করে মা ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়ে কমিটি তৈরী হচ্ছে । তা সত্ত্বেও এঁদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতির ব্যাপারে আমাদের নির্দিষ্ট কিছু পরামর্শ আছে" । "স্কুল শিক্ষার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে " ।

১৪) প্রবীণ চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন বলেছেন - "প্রায় ৩৫ বছর ধরে আমি এই বামফ্রন্টকে দেখছি, দেখে আসছি ১৯৭৭ সাল থেকে কিভাবে এই দলটি নিয়মিত পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে নিজেদের গড়ে তুলেছে । প্রত্যাবর্তন কিন্তু পরিবর্তনের ভিতর দিয়েই হয় । সহজ স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দ জীবন পেয়েছে সাধারণ মানুষ এই বামফ্রন্টের আমলেই । নতুন রাস্তাঘাট, ব্রিজ থেকে ছোট-বড় অনেক কাজই করেছে এই সরকার । সেই সঙ্গে আমি তো অবশ্যই বলব যে, শিল্পী-সাহিত্যিকতা সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছেন এই বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই । সিনেমার কর্মী হিসাবে আমি যেমন নন্দন-এর কথা উল্লেখ না করে পারছি না । আমার বিদেশী বন্ধুবান্ধবের যাঁরাই এসে দেখেছেন, বলেছেন, আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা কমপ্লেক্স । রক্ষনাবেক্ষণ নিয়ে সমস্যা তো থাকতেই পারে । নন্দন তৈরি হয়েছিল জ্যোতি বসুর আমলে, তারপর বিশেষ করে বুদ্ধদেব যথেষ্ট মাথা ঘামিয়েছেন নন্দন-এর সূত্রে সিনেমার উন্নত সংস্কৃতি এ-রাজ্যে তৈরি করতে । সব পরিকল্পনা হয়তো বাস্তবে রূপায়িত হয়নি । তা নিয়ে আমার একটু অস্বস্তি ছিল, বেশ ছিল । বলে রাখা ভাল, আমি কিন্তু কোন বামপন্থী দলের সভ্য নই । কমিউনিস্ট পার্টি যখন অবিভক্ত চিলম তখনও আমি তাদের মেম্বার বা কার্ডহোল্ডার --- কিছুই ছিলাম না । তাছাড়া এই বামফ্রন্টের দলীয় মত কোন ভাবেই আমার উপর বিস্তার করে না । আরও স্পষ্ট করে বলা ভাল, আমার ভাবনাচিন্তা কাজকর্মের ব্যাপারে আমি কখনই তাদের মতামতের অপেক্ষায় থাকি না " ।

Thursday, 12 May 2016

সিঙ্গুর - না বলা কথা ।

আজ ১২ই মে ২০১৬ "এই সময়" পত্রিকায় "সিপিএম-কে বামপন্থার পাঠ দিল সুপ্রিম কোর্ট" শীর্ষক খবরটা পড়তে পড়তে বহুদিনের না বলা কিছু কথা বলতে ইচ্ছে হলো । ইতিমধ্যেই ইচ্ছুক অনিচ্ছুক নিয়ে রাজ্য রাজনীতি তোলপাড় - ৩৫ বছর দীর্ঘ সময়কালব্যাপী বামফ্রন্ট সরকার পতন -  বামফ্রন্টের নিজস্ব মূল্যায়নেও সিঙ্গুর আন্দোলন সরকার পতনের একটা প্রধান কারণ হিসাবে উঠে এসেছে - তত্কালীন বিরোধী দল সরকারে এসেই সিঙ্গুর সমস্যার সমাধান করবে বলে কথা দিয়েও কথা রাখেনি - সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ সমস্যা নিয়ে টাটা ও বর্তমান সরকার সুপ্রিম কোর্টে - এসবই আমাদের জানা । "এই সময়" পত্রিকা বলছে  তত্কালীন বিরোধী নেত্রী এটা বলেছিলেন, ওটা বলেছিলেন - উনি কি বলেছিলেন বা কি করতে চেয়েছিলেন এটা নিয়ে এখন আর কোনো প্রশ্ন থাকারই কথা নয় - তত্কালীন বিরোধী নেত্রী ও তার দলের অবস্থান নিয়ে কোনো আলোচনা করতেও চাই না - তাদের ঐকান্তিক কৃষক প্রীতি এই ৫ বছরে আমাদের বারবার দৃষ্টিগোচর হয়েছে ।

আমার প্রশ্নটা অন্য জায়গাতে - গণতন্ত্রে একটা মানুষের অধিকার নিয়ে - টাটা একটা নির্দিষ্ট জায়গাতে কারখানা বানাতে চেয়েছিল - কিন্তু কিছু কৃষক বা ক্ষুদ্র জমির মালিক তাদের স্বল্প চাষের জমি বিক্রি করতে চাননি - জমির পরিমান ৪০০ একর নাকি ৪০ একর - সেটাও প্রশ্ন নয় । প্রশ্নটা হলো - গণতন্ত্রে কোটিপতি ব্যবসায়ী হিসাবে টাটার যেমন একটা চাহিদা আছে - মালিকপক্ষ হিসাবে তার যেমন মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, তেমনই ৫০০০ টাকার জমিতে লাঙ্গল টানা একজন প্রান্তিক কৃষকেরও তার নিজস্ব মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে - গণতান্ত্রিক কাঠামোতে সেটাও ফেলনা নয় । অনিচ্ছুক কৃষকদের সাথে বসে আলোচনার মাধ্যমে অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াটার জটিলতাটাকে কাটিয়ে ওঠা যেত না কি ? মানছি, বিরোধী দল রাজ্যের উন্নয়নের প্রশ্নটাকে সরিয়ে কতিপয় অনিচ্ছুক জমির মালিক্গুলোকে সামনে রেখে শুধুই রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন - কিন্তু বামফ্রন্ট শাসিত রাজ্যে প্রান্তিক কৃষকদের অধিকার ক্ষুন্ন হওয়া কি কোনোভাবেই সমর্থন যোগ্য ?

আমি নিজে একজন কৃষক পরিবারের সদস্য হয়ে মনে করি - আমার ছোট জমিতে আমি চাষ করবো, আমি আমার জমি কোনো কারখানার মালিককে বিক্রি করবো না - আমি আমার জমি বিক্রি করে, জীবিকার সন্ধানে একটা বেসরকারী কারখানায় দারোয়ানের কাজ করবো না - আমাদের দেশের গণতন্ত্র আমাকে আমার নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয় । আর সিঙ্গুর কোনো জনস্বার্থে অধিগ্রহণ নয় - সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ করে কোনো নতুন রাস্তা হতো না, কোনো নতুন রেলপথ গড়ে উঠত না, কোনো নতুন সামরিক বাহিনীর কেন্দ্রও গড়ে উঠত না - কোন দিক থেকে একটা কারখানার মালিকের জন্য জমি অধিগ্রহণকে জনস্বার্থে অধিগ্রহণ বলা যায় ? আমিও জানি রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থে, ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থে কল কারখানা দরকার - কল কারখানার জন্য জমিও চাই - কিন্তু কোনভাবেই কি বহুফসলি জমি অধিগ্রহণ এড়ানো যেত না ?

বর্তমান সরকারের জমি অধিগ্রহণ নীতি অনুযায়ী সরকার শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করে দেবে না - মালিকপক্ষকে নিজের জমির ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হবে । একটা এলাকাতে ২০০০ জনের জমি থাকলে, মালিকপক্ষকে ২০০০ মানুষের সাথে দরাদরি করতে হবে - এটা অবাস্তব -  প্রধানত এই জমি অধিগ্রহণ নীতির কারণেই বিগত ৫ বছরে পশ্চিমবঙ্গ একটাও বড় শিল্পের মুখ দেখেনি । যদি মালিকপক্ষ এই জমি অধিগ্রহণ নীতি মেনেও নেন - তাহলে শিল্পপতি আর ক্ষুদ্র জমির মালিকের মধ্যে ঢুকবে জমির মাফিয়া, সিন্ডিকেট - আখেরে প্রতারিত হবেন প্রান্তিক কৃষকেরা । তাই প্রান্তিক কৃষকদের স্বার্থরক্ষার প্রশ্নে রাজ্য সরকারেরই মধ্যস্থতা বাঞ্চনীয় । তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জমি অধিগ্রহণ পদ্ধতিতে ভুল থাকতে পারে - কিন্তু তাঁর ও বামফ্রন্ট সরকারের সদিচ্ছা সংশয়াতীত - কিন্তু কোথাও যেন একটা ভুল হয়ে গেল - যার মাসুল আজও দিতে হচ্ছে আমাদের সবাইকে । পড়াশোনা শেষ করেই অন্য রাজ্যে পাড়ি দাও - বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে এক নিঃসঙ্গ জীবনকে নিয়ে চলতে হচ্ছে আমাদের যুবসমাজকে - সেটা অবশ্যই কাম্য নয়  । সিঙ্গুর প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পশ্চিমবঙ্গ শিল্পায়নে একটা জোয়ার আসতো - যা সকলের মত আমারও স্বপ্ন । পশ্চিমবঙ্গের মত কৃষিনির্ভরশীল রাজ্যে যেখানে ক্ষুদ্র জমির মালিকানা বেশি - সেখানে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াটা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেকাংশেই জটিল । কিন্তু বামপন্থী শাসিত একটি রাজ্যে সামান্য একটি কৃষকেরও স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়াটা কি বাঞ্চনীয় ?

প্রক্রিয়াগতভাবে অবশ্যই ভুল হয়েছে কিন্তু সমস্যা সমাধানে বামফ্রন্ট সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল - কিছু বাধাকে সেসময় প্রতিহত করা যায়নি  - কিন্তু থেমে যাওয়া যাবে না - এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই ভবিষ্যতের দিকে এগোতে হবে । ২০১৬ বিধানসভা ভোটে জয়ী হলে বামফ্রন্ট ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক জোট অবশ্যই শিল্পের প্রতি মনোযোগী হবে - বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে এটাই জনগনের প্রত্যাশা । আশা রাখি - নতুন সরকার জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে অনেক বেশি সংবেদনশীল হবে, কোনভাবেই কৃষকের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে না আর সিঙ্গুরবাসীও  আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানে উত্সাহী হবেন ।


ধীমান 

Tuesday, 29 March 2016

গর্ভঘাতী গুজরাত

"একতরফা এই হত্যালীলাকে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া । গোধরার কামরায় ৫৮ জন করসেবক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের পুড়িয়ে মারার জন্যেই সংখ্যালঘুদের আক্রান্ত হতে হয়েছে, মোদীর এই ঘোষণার সঙ্গে গলা মেলান কেন্দ্রের জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) । মোদীর বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয় না । ঘটনার প্রায় এক মাস পরে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী গুজরাত এসে মোদীকে রাজধর্ম পালন করার নির্দেশ দেন । তারপরেই কিন্তু গোয়াই দলীয় সম্মেলনে তিনি বলেন মুসলিমদেরও অন্যদের সঙ্গে মানিয়ে চলার অভ্যাস করতে হবে । গোটা দুনিয়ায় যেখানেই মুসলিমরা বাস করে তারা কোথাও অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে বনিয়ে থাকতে পারে না ।"

"সরকারের একজন শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রী হরেন পান্ডিয়া তাঁর নির্বাচনের প্রাক্কালে অঙ্গীকার করেছিলেন যে তাঁর এলাকাকে তিনি মুসলমান শূন্য করবেন ।"

"সংঘের মতাদর্শে, রাজনৈতিক লেখা ও ভাষণে, শাখার সব "সাংস্কৃতিক" কার্যকলাপে দুটি ব্যাপারের ওপর সর্বদা জোর দেওয়া হয়েছে - এক হল মুসলমানদের ভারতে আগমনের প্রথম দিন থেকে হিন্দুনারীদের উপর অত্যাচারের বিচিত্র কাল্পনিক বা অতিরঞ্জিত উপাখ্যান । অন্যটি হল মুসলমান জনসংখ্যার প্রবর্ধমান হারের তেমনই অতিরঞ্জিত কাল্পনিক পরিসংখ্যান, ভারতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সম্ভাবনা । এই দুই আখ্যানকে ভিত্তি করে গড়ে তোলা হয়েছে এক আকাশচুম্বী প্রতিশোধমূলক মনোভাব, এক সর্বাত্মক হিংসাধর্মী আশঙ্কা  ।

এর পরিনাম আমরা গুজরাতে দেখেছি । 'প্রতিশোধের' পিপাসায় মুসলমান মেয়েদের প্রবীণা থেকে তিন বছরের শিশু পর্যন্ত বেধড়ক পেটানো হয়েছে, তাদের গণধর্ষণ ও বহু ধর্ষণ করা হয়েছে, তাদের কোলের শিশুদের ছিনিয়ে নিয়ে চোখের সামনে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে । অথবা শিশুদের পেট্রল খাইয়ে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে মায়ের সামনে । তারপর মাকে ধর্ষণ করে পেট চিরে গর্ভস্থ অজাত শিশুকে বার করে ছিন্নভিন্ন করে অগ্নিদগ্ধ করা হয়েছে । ধর্ষিত, মৃত মহিলাদের জরায়ু নষ্ট করা হয়েছে তারপর প্রজনন স্থানে অত্যাচার করা হয়েছে, রাস্তায় রাস্তায় নগ্ন করে হাঁটানো হয়েছে । সবশেষে তাঁদের আগুনে ফেলে ভস্মীভূত করা হয়েছে যাতে ধ্বংসের কোন চিহ্ন না থাকে । আর যাতে মুসলমানদের অন্তিম ধর্মানুষ্ঠান - কাফন-কবর- পালন না করে হিন্দুমতে শবদাহ করা যায় ।

এ অত্যাচার সাময়িক পাগলামি নয়, এর বিশেষ উদ্দেশ্য আছে । নারীদেহ ভবিষ্যত প্রজন্মের আধার, সেই আধার অত্যাচার করে নষ্ট করে মুসলমানদের ভবিষ্যতকেই ভস্মীভূত করা হচ্ছে - শুধু প্রতীকিভাবে নয়, আক্ষরিক অর্থে । লক্ষ্যণীয় যে, বিশেষ করে শরীরের প্রজননস্থানের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে । আরও লক্ষ্যণীয় যে মায়ের সামনে শিশুকে হত্যা করা হয়েছে ব্যাপকভাবে । অর্থাৎ, এই প্রজন্ম থেকে শুরু করে ভ্রুণ পর্যন্ত, জীবিত বা অজাত সমস্ত মুসলমানের জীবন ও জীবনের সম্ভাবনা পর্যন্ত নষ্ট করা হয়েছে । জাতিবিলোপের উপাখ্যানে এধরনের ব্যাপক পরিকল্পনার নজির বিরল । ...

.... ফ্যাসিবাদের একটা সুবিধা হল যে তা এতই ভয়ঙ্কর এক সত্য যে তাকে সময় থাকতে বিশ্বাস করতে কেউ চায় না । যখন সে সত্য সকলের কাছে একেবারেই প্রকট হয়ে ওঠে তখন তার হাতে আর সময় থাকে না ।"


"১৯৮৪-এর দিল্লি ও ভারতের অন্যান্য শিখ নিধন পর্বও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দলের পাশে ম্লান । কেন ? সে দাঙ্গায় পূর্ব পরিকল্পিত ছক ছিল না । কংগ্রেসের কিছু সাংসদ (বলরাম ভগত) ও বিধায়ক ললিত মাকেনের বিরুদ্ধে দাঙ্গায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ থাকলেও, প্রশাসনের বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও কোন মতেই বলা যাবে না শিখ নিধন পর্ব প্রচ্ছন্ন সরকারি মদতে হয়েছে । যেমনটি হয়েছে গুজরাতে ।

"বম্বের প্রাক্তন পুলিশ প্রধান গুজরাতের অনুসন্ধানী দলের সদস্য হিসেবে তদন্ত করে যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন তা প্রশাসনিক ষড়যন্ত্রকারীদের সহায়ক ভূমিকা স্পষ্ট করে দেয় । টাইমস অফ ইন্ডিয়ার বিশেষ নিবন্ধে (২৪.৪.০২) তিনি লিখেছেন - "রাজ্য সরকার হত্যালীলার নীরব দর্শকই শুধু ছিল না তারা এই ঘটনা ঘটতে দিয়েছে । তারা দাঙ্গাকারীদের প্ররোচিত করেছে, উত্সাহ দিয়েছে এবং ধ্বংসলীলায় অংশ নিয়েছে । পুলিশ তাদের চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে ।"

এর পরে তিনি লিখেছেন "একজন মন্ত্রী আমেদাবাদ শহরের পুলিশ কমিশনারের কন্ট্রোলরুমে বসে থেকে হুকুম দিতে থাকেন । আর এক মন্ত্রী রাজ্য পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেলের কন্ট্রোলরুমে ঢোকেন । এবং পুলিশ তাদের নির্দেশ মত কাজ করতে থাকে । পুলিশের এই সার্বিক আত্মসমর্পণ গোটা আই পি এস শ্রেণীর পক্ষে এক কলঙ্ক হয়ে রইল । যার দাগ সহজে মুছবে না । গুজরাত নিঃসন্দেহে পুলিশ বাহিনীর রাজনৈতিক দলের ক্রীড়নক হওয়ার নিকৃষ্ট উদাহরণ ।" ....

.... গোধরার ঘটনাকে সামনে শিখন্ডী করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দোল যে বর্বর সাম্প্রদায়িক আক্রমণ চালিয়েছে তা হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিশোধ নয় । বেশ কিছুদিন ধরেই সংঘ পরিবার সগর্বে বলে আসছে গুজরাত হল হিন্দুত্ব নির্মাণের পরীক্ষাগার । ... "

"দেখা যাক আর এস এস-এর দ্বিতীয় সরসঞ্চালক, এম এস গোলওয়ালকর কি বলেন । we or our nationhood defined গ্রন্থে (১৯৩৯) তিনি লেখেন, হিন্দুস্তানে, বিদেশী জাতিদের বসবাস করতে গেলে হয় তাদের হিন্দু সংস্কৃতি, ভাষা এবং ধর্মকে জানতে হবে, শ্রদ্ধা করতে হবে ... এককথায় হয় নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে চিন্হিত করে হিন্দু জাতির মধ্যে মিশে যেতে হবে, নয় হিন্দু জাতির অধীনে অবদমিত হয়ে থাকতে হবে । তারা কোনো বিশেষ সুযোগ সুবিধা ... এমনকী নাগরিক অধিকার দাবী করতে বা আশা করতে পারবে না ।"

"দেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন সংঘই তাঁর আত্মা । দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রে (গান্ধীনগর, আহমেদাবাদ) নারকীয় হত্যাকান্ডের পরও তিনি গুজরাতের আইন-শৃঙ্খলার প্রশংসা করেছেন । দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কবুল করেছেন সংখ্যালঘু হত্যা ও ধর্ষণ তো হয়েই থাকে । বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল তথা সংঘ পরিবারের বড়, মেজ, সেজ নানা শাখার প্রতিনিধিদের ঠাঁই মিলেছে লোকসভায়, গুজরাত বিধানসভায়, কেন্দ্রীয় বা রাজ্য ক্যাবিনেটে । প্রশাসনের বা আমলাতন্ত্রের প্রতিটি স্তরে হয় সংঘপন্থীদের প্রাধান্য নয়তো সংঘের নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে । অন্যদিকে কংগ্রেস বা যুক্তফ্রন্ট আমলে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা কখনই এরকম ক্ষমতা হাতে পায়নি ।"

"সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত কংগ্রেসের নেতারা ১৯৮৪-র জন্য শিখদের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন । ধরে নিলাম সেটা ভোটের জন্য ভন্ডামি, কিন্তু সংঘের নেতারা  সেটুকু ভন্ডামি করার দরকার বোধ করছেন না  । উত্তরপ্রদেশে ভোটের আগে বাজপেয়ী দৃপ্তকন্ঠে বলেছিলেন, আমাদের মুসলিম ভোট চাই না । গোয়াতে গলার স্বর আরেকটু ওপরে তুলে সমস্ত হিংসার জন্য মুসলমানদের দায়ী করেছিলেন । "

Sunday, 28 February 2016

ফিরে দেখা - বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

"স্বাধীন দেশে গণতন্ত্রের ইতিহাসে পশ্চিমবাংলায় সার্বিক বন্দিমুক্তির (General Amnesty) এই কৃতিত্ব বামপন্থীদেরই ।"

"....নতুন পঞ্চায়েতের কঠিন প্রচেষ্টার অন্যতম রূপকার সত্যব্রত সেন মন্তব্য করেছিলেন --- 'এমন ধারালো অস্ত্র হবে এটি যে ঠিকমত ধরতে না পারলে নিজেদের হাতই কেটে যাবে ।'"

"দক্ষিনপন্থী ও ফ্যাসিবাদের হাতে সংস্কৃতির ও লেখক শিল্পীদের অবমাননা, অত্যাচার, হত্যা --- ইতিহাসে সুপরিচিত । অন্যদিকে দেশ-বিদেশের ইতিহাসে সংস্কৃতির জগতে বামপন্থীদের বিপুল সাফল্য যেমন আমাদের গর্ববোধ, তেমনি হঠকারিতার অসাফল্য ও নির্বুদ্ধিতায় আমরা কম ম্রিয়মান নই ।
সোভিয়েত ইউনিয়নে সাহিত্যে 'সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার' ফতোয়া জারি কি সঠিক ছিল ? কেন ডস্টয়েভস্কি কোনো দিনও প্রাপ্য সন্মান পেলেন না, পাস্টেরন্যাক নির্বাসিত হলেন নিজ স্বদেশভূমিতে ?
বলশয় থিয়েটারের মতন অনেক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাফল্যের পাশাপাশি এই দুর্বুদ্ধি কেন ? শক্তিধর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা তখন কেন কীভাবে ভীত সন্ত্রস্ত রুগণ হয়ে পড়ল ?
চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দীর্ঘসময় দাঙ্গা-হাঙ্গামা নৈরাজ্যের মধ্যে 'রেড ল্যানটার্ন'-সহ তিনটি অপেরা ছাড়া আর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড সব কিছুই বাতিল হলো । এটা কোন শুভবুদ্ধির প্রকাশ ?"

"বৃহৎ বাজারি সংবাদপত্রের মালিকপক্ষ স্বাভাবিক কারণেই তা সত্ত্বেও কোনোদিনও বামফ্রন্ট সরকারের রাজনৈতিক দর্শনকে সমর্থন করে না । ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা হয়েছে আমাদের হেয় ও অপদস্থ করার । সংবাদপত্রের সমালোচনা অধিকার আমরা কখনোই বিরোধিতা করিনি, শুধু আশা করেছি ন্যায়সংগত ও যুক্তিসংগত ব্যবহার । এটা ঠিক, তাদের পরামর্শে আমরা চলিনি, কারণ আমাদের মৌলিক আনুগত্য ছিল সাধারণ মানুষের কাছে ।"

"বহুত্ববাদকে মেনে নিয়ে শত পুষ্প বিকশিত হোক এই ছিল আমাদের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মূল দর্শন । আমরা কোনো ফতোয়া জারি করিনি । কারণ আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করেছি - শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে ?"

"এই সময়কালে ত্রিস্তর নির্বাচনের মাধ্যমে পঞ্চায়েত রাজ প্রতিষ্ঠা, ভূমি সংস্কার ও গ্রামোন্নয়ন কর্মসূচি নতুন মাত্র যোগ করে । পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ভূমি বন্টনের স্থায়ী কমিটি একটি বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করেছে । যেমন করেছে বর্গা রেকর্ডের কর্মসূচি ।
শিক্ষায়তনে গণ-টোকাটুকি একটি সামাজিক ব্যাধির জন্ম হয়েছিল কংগ্রেস আমলে, তাকে পরাস্ত করা সম্ভব হয় এই সময়ে । বিদ্যালয় স্তরে শিক্ষাকে দু-কিস্তিতে অবৈতনিক ঘোষণা ও রূপায়িত হয় । শুধু ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক নয়, সামাজিক আলোড়ন সৃষ্টি করে এই সিদ্ধান্ত । প্রাথমিক স্তরে বাংলা ভাষাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয় পঠন-পাঠনের মাধ্যম হিসেবে । যে নীতি বিতর্কের সৃষ্টি করে এবং পরবর্তীকালে সংশোধিত হয় ।
রাজ্যে ট্রেড ইউনিয়ন ও সামাজিক  অধিকার সর্বত্র স্বীকৃত হয় ।জনজীবনের সর্বত্র গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয় । সংস্কৃতি জগতে স্বাধীন শিল্পচর্চার খোলামেলা পরিবেশ তৈরি হয় । কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে সম্পর্কে নতুন দাবিসনদ তৈরি করে ও জাতীয় স্তরে তাকে আলোচ্য বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় ।"

Wednesday, 10 February 2016

ফরাসি পণ্ডিত ভলতেয়ার

"আমি তোমার মত মানি না, কিন্তু তুমি যাহাতে তোমার মত অবাধে বলিতে পারো, তাহার জন্য আমি নিজের প্রাণ অবধি বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। " -  ফরাসি পণ্ডিত ভলতেয়ার

" I might disagree vehemently with what you say,but I will defend your right to say it. " ------ Voltaire

Friday, 29 January 2016

এই হিন্দু রাষ্ট্রের স্লোগান আসলে কী ? - ইয়েচুরি

"আর এস এসকে সে রকম বীর বা ত্রাতার বেশে হাজির করতে হলে, একটা মিথ্যা চেতনা সৃষ্টির প্রয়োজন ছিলো যে, হিন্দুরা বঞ্চিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে । সেই সঙ্গে জরুরি ছিলো , এর জন্য দায়ী বলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা জন্মানো (হিটলারের প্রচন্ড ইহুদি বিরোধিতার খেই ধরে) ।

গৈরিক বাহিনীর আজকের ক্রিয়াকলাপ ও প্রচার-কার্য গোলওয়ালকরের কাছে পাওয়া এই দুই নির্দিষ্ট তাত্ত্বিক ইন্ধনের ভিত্তিতেই চলে । অভিষ্ট পূরণে তারা গোয়েবলসীয় কৌশলকে আরও উন্নত ও শানিততর (গোয়েবলস হিটলারের প্রচারমন্ত্রী ছিলেন) করেছে, অর্থাৎ মিথ্যা বলো - পর্বতপ্রমাণ মিথ্যা, যার ফলে মিথ্যাই সত্যরূপে প্রতীয়মান হবে ।"

" "বিদেশি অংশের সামনে দুটি পথ খোলা আছে । হয় দেশ ও জাতির সঙ্গে একাত্ম হও অথবা যতক্ষণ তারা থাকতে দেয় অথবা এ দেশ ছাড়তে হুকুম না দেয়, ততদিন তাদের দয়ায় থাকো ... ।" ... যে ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মকে রাজনীতি ও রাষ্ট্র থেকে পৃথক করে ব্যক্তিগত বিষয়রূপে গণ্য করে, গোলওয়ালকর তাকে খারিজ করলেন । ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রায় ঈশ্বরদ্রোহিতার পর্যায়ে ফেলে তিনি বিতর্ক জুড়ে দেন এই বলে যে,

"ধর্মকে ব্যক্তিগত প্রশ্নরূপে গণ্য করার এবং রাষ্ট্রীয় ও জনজীবনে পরিহারের পক্ষে একটা সাধারণ প্রবণতা দেখা যায় । ধর্মকে ভুল বোঝা এই ঝোঁকের কারণ এবং যাদের গোষ্ঠীতে ধর্ম বলার মতো কিছু নেই তারাই এই ঝোঁকের মূলে" (গোলওয়ালকর, ১৯৩৯, পৃ. ২৩) রয়েছেন ।"

========================================================================

"।। ফ্যাসিবাদের অনুপ্রেরণা ।।

সেই 'প্রাচীন জাতিদের' আচরণ কেমন হবে ? ফ্যাসিস্ত জার্মানির এর চেয়ে রাখঢাকহীন তোষামোদ আর হয় না ।

"প্রাচীন বর্ণাভিমান, যার বলে জার্মান উপজাতিরা সারা ইউরোপ ছেয়ে ফেলেছিলো, এ যুগের জার্মানিতে সে আবার মাথা তুলেছে, ফলে জাতিকে তার লুন্ঠনকারী পূর্বপুরুষ দ্বারা নির্ধারিত লক্ষ্যপূরণের পথ অনুসরণ করতেই হচ্ছে । আমাদের ক্ষেত্রেও একই হবে; বর্ণাভিমান আবার জেগে উঠেছে । এই দেশ যে আধ্যাত্মিক মহাপুরুষকুলের জন্ম দিয়েছে, তাঁরা আজ সৌম্য মহিমায় দৃপ্ত পদভারে মেদিনী কাঁপাচ্ছেন, তাঁরাই এর সাক্ষ্য বহন করছেন ।"
আরও বলেছেন

"জাতির বিশুদ্ধতা ও তার সংস্কৃতিকে অক্ষুণ্ন রাখতে, জার্মানি সেমিটিক জাতির ইহুদিদের বহিষ্কার করে সারা পৃথিবীকে চমকে দিয়েছিলো । এখানে জাত্যাভিমান তার তীব্রতমরূপে প্রকট । জার্মানি দেখিয়ে দিয়েছে যে মূলেই যারা পৃথক, সেই জাতি, সংস্কৃতিকে অভিন্ন সত্তায় সমন্বিত করা প্রায় অসম্ভব । হিন্দুস্তানে আমরা, আমাদের হিতার্থে এ থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিতে পারি" (গোলওয়ালকর, ১৯৩৯, পৃ. ৩৫) ।

এইভাবে হিটলার হয়ে দাঁড়ালেন 'গুরুজির গুরু'। আর এস এসের রাজনৈতিক কর্মসূচির দানবীয় প্রকৃতির এটাই বাস্তব রূপ । হিন্দু ধর্ম ও প্রাচীন সবকিছুর ধ্বজাধারীর বেশে, আদ্যোপান্ত আধুনিক ও পাশ্চাত্য ফ্যাসিবাদী ধারণা আমদানি করতে, তার কোনো বিবেক দংশন নেই । ফ্যাসিবাদ ছাড়া, বাকি সব পাশ্চাত্য ধারণা ও সভ্যতার প্রগতি এদের কাছে 'বিজাতীয়' বলে নিন্দিত ।

ফ্যাসিবাদী ছদ্ম-হিন্দুত্বের কোনো কোনো প্রবক্তা ফ্যাসিবাদের এই নগ্ন স্তাবকতার সপক্ষে উদ্ভূত কুযুক্তি নিয়ে এগিয়ে আসেন ।

"১৯৩৯ সালে ইহুদিদের প্রতি হিটলারের আচরণের বিশেষ কিছু খবর না থাকায়, তার একটি মাত্র উল্লেখ উপেক্ষা করাই উচিত অথবা মানুষটিকে সন্দেহের হাত থেকে ছাড় দেওয়াই সঙ্গত" (মোদক, ১৯৯৩, পৃ. ১১)।

যদি তাই হয়, তবে ১৯৪৭ সালের সংস্করণেও এই অনুচ্ছেদটি অপরিবর্তিত রয়ে গেল কেন ?  ১৯৪৭ সালে হিটলারের অপরাধগুলি সাধারণ মানুষের গোচরে এসেছিলো, যেমন এর আগে ১৯৩৯-এও এসেছিলো । পরবর্তী সংস্করণে গোলওয়ালকর ওই অংশটি বাদ দিলেন না কেন ? তথ্য পাওয়া যায়নি বলে নয়, কারণ হলো গোলওয়ালকর ও আজকের গৈরিক বাহিনী হিটলারের পদ্ধতিকে পাল্লা দিতে চায় ।

জ্বলন্ত অসঙ্গতিও গোলওয়ালকরকে বিচলিত করে না । যদি, তাঁর মতে, হিন্দুরাই আর্য ছিলো, তাহলে হিটলার আবার কোন আর্যদের ত্রাতার ভূমিকা নিয়েছিলেন ? সেগুলোও যদি আর্য হয়, তবে তারা কি ভারত থেকে জার্মানিতে দেশান্তরী হয়েছিলো নাকি উল্টোটা ? তাঁর তত্ত্ব মানলে, ভারত ও জার্মানি উভয়েই একটি অভিন্ন জাতির অংশ !

অনুশীলনটি পুরোপুরিই ফ্যাসিবাদী ঝোঁকের হিন্দুরাষ্ট্রের মতাদর্শগত ভিত্তি জুগিয়েছে, যা গৈরিক বাহিনীর আজকের ব্রতের সারমর্ম ।"

=======================================================================

"হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা আর মুসলিম মৌলবাদ একে অপরকে পুষ্টি যোগায় ।"

"গোলওয়ালকারের বইটি (we or our nationhood defined by guruji) প্রকাশ হওয়ার দু'বছর বাদে, জামাত-এ-ইসলামি গঠিত হয় । ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে, মওলানা আবুল আলা মওদুদির নেতৃত্বে পাঠানকোটে তার প্রতিষ্ঠা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । আর এস এসের কাছে যেমন গোলওয়ালকার, জামাতের ক্ষেত্রে তেমনি মওদুদি । তাঁদের রাজনৈতিক প্রকল্প ও ভূমিকার সাদৃশ্য বাস্তবিকই চমকপ্রদ । হিটলার যেমন গোলওয়ালকারের নায়ক, ঠিক তেমনি মওদুদির কাছেও । গোলওয়ালকার যেমন মানব সভ্যতার আধুনিক সব কিছুকেই - স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং সংসদীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ - বিজাতীয় ধারণা বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, মওদুদির এবং মুসলিম মৌলবাদী দর্শনের ভূমিকাও ছিলো অনুরূপ ।

১৯৪৭ সালের মে মাসে, দেশবিভাগ যখন আসন্ন, মওদুদি হিন্দু শাস্ত্র ও বিধান মেনে রাষ্ট্র ও সমাজ গড়তে ভারতীয়দের আহ্বান জানান, যেমন পাকিস্তানকে তাঁরা গড়বেন 'আল্লা'র বিধান মেনে ।পাকিস্তানে কুআদিআনি-বিরোধী দাঙ্গার অনুসন্ধানে নিযুক্ত এক সদস্য কমিশনের বিচারক মহম্মদ মুনিবের কিছু প্রশ্নের উত্তরে মওদুদি বলেন :

"যদি হিন্দু বিধানের ওপর ভর করে কোনো হিন্দু সরকার ভারতে আসে এবং মনুর বিধান আইনরূপে গৃহীত হয়, এবং যার ফলে মুসলিমরা অস্পৃশ্য বলে বিবেচিত হয়, সরকারে তাদের অংশগ্রহণ করতে না দেওয়া হয় - শুধু তাই নয়, তারা নাগরিক অধিকার থেকে পর্যন্ত বঞ্চিত হয়, তবে আমার আপত্তি নেই" (জেড এ নিজামি, ১৯৭৫)

হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা আর মুসলিম মৌলবাদ একে অপরকে পুষ্টি জোগায় । এও প্রক্রিয়ায়, উভয়েই সাম্প্রদায়িক বিষ গভীর থেকে গভীরে ছড়িয়ে দেয়, আমাদের দেশের ঐক্য ও সংহতির বিন্যাস বিপন্ন করে । উভয়েই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের  --- যাদের প্রতিনিধিরূপে তারা নিজেদের দাবি করে --- স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে । আজ ভারত ধর্মনিরপেক্ষ, কারণ হিন্দু ও মুসলিমদের বৃহত্তর অংশ তাদের এই রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করেছে ।"

পুরাণ ও ইতিহাস - ইয়েচুরি

"বিজেপিকে ভারতের রাজনীতির কেন্দ্রীয় মঞ্চে নিয়ে আসা এই সমগ্র প্রচারকার্যে বেপরোয়াভাবে পুরাণ এবং ইতিহাসের পার্থক্য মুছে দেওয়া হয়েছে, দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের ফারাক ঘুচিয়ে দেওয়া হয়েছে । ধার্মিকতার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোন সম্পর্ক নেই তবুও মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যাপকভাবে অপব্যবহার করে সাম্প্রদায়িকতা এগিয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে ।"

Monday, 25 January 2016

মার্কসবাদ ও ধর্ম - ইয়েচুরি

"ধর্মীয় দুঃখ-কষ্ট একাধারে বাস্তব দুঃখ-কষ্টের প্রকাশ ও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ । ধর্ম নিপীড়িত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন পৃথিবীর সহৃদয়তার কাহিনী, যেন ভৌতিক জীবনের আত্মা, মানুষের জীবনে ধর্ম হচ্ছে আফিম ।"

" ... কোপারনিকাস অথবা একলব্যকে যে নিগ্রহ করা হয়েছিল, মার্কসবাদ তার জন্য ধর্মকেই দায়ী করে না । তার কারণ তৎকালীন সামাজিক শক্তি ও গতিবিধি ধর্মের ভাষাতেই প্রতিফলিত হয়েছিল, কারণ লিপিবদ্ধ ইতিহাসের গোটাটাতেই ধর্মই ছিল প্রধান মতাদর্শ । ধর্ম যতদিন প্রধান মতাদর্শ হয়ে থাকে, ততদিন প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল আদর্শ, শাসকশ্রেণীর কায়েমী স্বার্থ ও শোষিত শ্রেণীর দাবি সমানভাবে ধর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের মনে নিজেদের উপস্থিত করে । তাই মার্কসবাদ ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের প্রগতিশীল উপাদানকেও স্বীকার করে, যেমন সুফি বা ভক্তি আন্দোলন, কিন্তু একইসঙ্গে তাদের সীমাবদ্ধতাকেও দেখিয়ে দেয়, কারণ কেবলমাত্র ধর্মীয় ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে তারা সমাজের কাঙ্খিত পরিবর্তন আনতে পারবে না ।"

একটি নির্দিষ্ট সময়ে যখন সুনির্দিষ্ট শ্রেণী সংগ্রাম ধর্মের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়, তখন অন্য সকল শাসকশ্রেণীর মত সেই ধর্মই শোষক শ্রেণীর হাতিয়ার ও যুক্তিতে পরিণত হয় । যেমন লেনিন বলেছেন, "ধর্ম হলো এক ধরণের আত্মিক শোষণ যা সর্বত্র ব্যাপকতম জনসাধারণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, যারা অন্যের সুবিধার জন্য শুধু খেটেই মরে এবং দারিদ্র্য ও বিচ্ছিন্নতায় নিষ্পেষিত হয় । শোষকদের বিরুদ্ধে শোষিতদের লড়াই করার অক্ষমতা থেকে তৈরি হয় কবরের পর এক উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষা, ঠিক যেমন প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে বর্বরেরা ভগবান, শয়তান, জাদু ইত্যাদির উপর আস্থা রেখেছিল । যে মানুষ সারা জীবন ধরে পরিশ্রম করছে আর কষ্ট করছে ধর্ম তাকে শেখাচ্ছে এই মর্ত্যে যেন সে নম্র হয়, ধৈর্যশীল হয় যাতে সে পরবর্তীকালে স্বর্গে যাবার পুরস্কার পায় এবং যারা অন্যের শ্রমের উপর বেঁচে থাকে, ধর্ম তাদেরকে শেখায় এই মর্ত্যে তুমি দয়া দেখাও, ফলে শোষক হিসাবে টিকে থাকার সস্তা যুক্তি যোগায় এবং স্বর্গীয় যুগের জন্য ঠিকঠাক দামের টিকিট বিক্রি করে ।"

"মার্কসবাদ ধর্মকেই আক্রমণ করে না । মার্কসবাদ আক্রমণ করে সেই পরিস্থিতিকে যা ধর্মের উত্থানে সাহায্য করে এবং সেই অবস্থাকে যা জনগণের উপর ধর্মের আধিপত্যকে বজায় রাখতে সাহায্য করে ।যেহেতু ধর্ম নিজে কোন বস্তু নয়, মার্কসবাদ সেই বস্তুর আমূল বদল চায়, যা ধর্মকে শ্রেণী শোষণের স্থায়ী হাতিয়ারে পরিণত করে ।"

Sunday, 24 January 2016

হিন্দুদের মুসলমান বিরোধ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

হিন্দুমুসলমান (সাময়িক সারসংগ্রহ)

"আমাদের একটা মস্ত কাজ আছে হিন্দু-মুসলমানে সখ্যবন্ধন দৃঢ় করা। অন্য-দেশের কথা জানি না কিন্তু বাংলাদেশে যে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সৌহার্দ্য ছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। বাংলায় হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানের সংখ্যা বেশি এবং হিন্দু-মুসলমানে প্রতিবেশিসম্বন্ধ খুব ঘনিষ্ঠ। কিন্তু আজকাল এই সমন্ধ ক্রমশ শিথিল হইতে আরম্ভ করিয়াছে। একজন সম্ভ্রান্ত বাঙালি মুসলমান বলিতেছিলেন বাল্যকালে তাঁহারা তাঁহাদের প্রতিবেশী ব্রাহ্মণ পরিবারদের সহিত নিতান্ত আত্মীয়ভাবে মেশামেশি করিতেন। তাঁহাদের মা-মাসিগণ ঠাকুরানীদের কোলে পিঠে মানুষ হইয়াছেন। কিন্তু আজকাল শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে নূতন হিন্দুয়ানি অকস্মাৎ নারদের ঢেঁকি অবলম্বন করিয়া অবতীর্ণ হইয়াছে। তাঁহারা নবোপার্জিত আর্য অভিমানকে সজারুর শলাকার মতো আপনাদের চারি দিকে কণ্টকিত করিয়া রাখিয়াছেন; কাহারো কাছে ঘেঁসিবার জো নাই। হঠাৎবাবুর বাবুয়ানার মতো তাঁহাদের হঠাৎ হিঁদুয়ানি অত্যন্ত অস্বাভাবিক উগ্রভাবে প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে। উপন্যাসে নাটকে কাগজে পত্রে অকারণে বিধর্মীদের প্রতি কটাক্ষপাত করা হইয়া থাকে। আজকাল অনেক মুসলমানও বাংলা শিখিতেছেন এবং বাংলা লিখিতেছেন-- সুতরাং স্বভাবতই এক পক্ষ হইতে ইঁট এবং অপরপক্ষ হইতে পাটকেল্ বর্ষণ আরম্ভ হইয়াছে। কোথায় তুর্কীর সুলতান তিনশত পাচক রাখিয়াছেন ইহাই লইয়া ম্লেচ্ছদিগকে তিরস্কার ও হিঁদুয়ানির বড়াই করিয়া আপন পাড়ার প্রতিবেশীদের সহিত বিরোধের সূত্রপাত করিলে তাহাতে হিন্দুদের, মাহাত্ম্য নহে, পরন্তু ক্ষুদ্রতারই পরিচয় দেওয়া হয়। যদি আমাদের ধর্মের এমন কোনো গুণ থাকে যাহাতে আমাদের পুরাতন পাড়ার লোককেও আপন করিয়া লইতে বাধা দেয় তবে সে ধর্মের জন্য অহংকার করিবার কারণ কিছুই দেখি না।"

লোকহিত (কালান্তর)

"অল্পদিন হইল এ-সম্বন্ধে আমাদের একটা শিক্ষা হইয়া গেছে। যে কারণেই হউক যেদিন স্বদেশী নিমকের প্রতি হঠাৎ আমাদের অত্যন্ত একটা টান হইয়াছিল সেদিন আমরা দেশের মুসলমানদের কিছু অস্বাভাবিক উচ্চস্বরেই আত্মীয় বলিয়া ভাই বলিয়া ডাকাডাকি শুরু করিয়াছিলাম।

সেই স্নেহের ডাকে যখন তাহারা অশ্রুগদগদ কণ্ঠে সাড়া দিল না তখন আমরা তাহাদের উপর ভারি রাগ করিয়াছিলাম। ভাবিয়াছিলাম এটা নিতান্তই ওদের শয়তানি। একদিনের জন্যও ভাবি নাই আমাদের ডাকের মধ্যে গরজ ছিল কিন্তু সত্য ছিল না। মানুষের সঙ্গে মানুষের যে একটা সাধারণ সামাজিকতা আছে, যে সামাজিকতার টানে আমরা সহজ প্রীতির বশে মানুষকে ঘরে ডাকিয়া আনি, তাহার সঙ্গে বসিয়া খাই, যদি-বা তাহার সঙ্গে আমাদের পার্থক্য থাকে সেটাকে অত্যন্ত স্পষ্ট করিয়া দেখিতে দিই না-- সেই নিতান্ত সাধারণ সামাজিকতার ক্ষেত্রে যাহাকে আমরা ভাই বলিয়া আপন বলিয়া মানিতে না পারি দায়ে পড়িয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ভাই বলিয়া যথোচিত সতর্কতার সহিত তাহাকে বুকে টানিবার নাট্যভঙ্গী করিলে সেটা কখনোই সফল হইতে পারে না।

এক মানুষের সঙ্গে আর-এক মানুষের, এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আর-এক সম্প্রদায়ের তো পার্থক্য থাকেই, কিন্তু সাধারণ সামাজিকতার কাজই এই-- সেই পার্থক্যটাকে রূঢ়ভাবে প্রত্যক্ষগোচর না করা। ধনী-দরিদ্রে পার্থক্য আছে, কিন্তু দরিদ্র তাহার ঘরে আসিলে ধনী যদি সেই পার্থক্যটাকে চাপা না দিয়া সেইটেকেই অত্যুগ্র করিয়া তোলে তবে আর যাই হউক দায়ে ঠেকিলে সেই দরিদ্রের বুকের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িয়া অশ্রুবর্ষণ করিতে যাওয়া ধনীর পক্ষে না হয় সত্য, না-হয় শোভন।

হিন্দুমুসলমানের পার্থক্যটাকে আমাদের সমাজে আমরা এতই কুশ্রীভাবে বেআব্রু করিয়া রাখিয়াছি যে, কিছুকাল পূর্বে স্বদেশী অভিযানের দিনে একজন হিন্দু স্বদেশী-প্রচারক এক গ্লাস জল খাইবেন বলিয়া তাঁহার মুসলমান সহযোগীকে দাওয়া হইতে নামিয়া যাইতে বলিতে কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করেন নাই। কাজের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার বশে মানুষ মানুষকে ঠেলিয়া রাখে, অপমানও করে-- তাহাতে বিশেষ ক্ষতি হয় না। কুস্তির সময়ে কুস্তিগিরদের গায়ে পরস্পরের পা ঠেকে তাহার হিসাব কেহ জমাইয়া রাখে না, কিন্তু সামাজিকতার স্থলে কথায় কথায় কাহারও গায়ে পা ঠেকাইতে থাকিলে তাহা ভোলা শক্ত হয়। আমরা বিদ্যালয়ে ও আপিসে প্রতিযোগিতার ভিড়ে মুসলমানকে জোরের সঙ্গে ঠেলা দিয়াছি; সেটা সম্পূর্ণ প্রীতিকর নহে তাহা মানি; তবু সেখানকার ঠেলাঠেলিটা গায়ে লাগিতে পারে, হৃদয়ে লাগে না। কিন্তু সমাজের অপমানটা গায়ে লাগে না, হৃদয়ে লাগে। কারণ, সমাজের উদ্দেশ্যই এই যে, পরস্পরের পার্থক্যের উপর সুশোভন সামঞ্জস্যের আস্তরণ বিছাইয়া দেওয়া।

বঙ্গবিচ্ছেদ-ব্যাপারটা আমাদের অন্নবস্ত্রে হাত দেয় নাই, আমাদের হৃদয়ে আঘাত করিয়াছিল। সেই হৃদয়টা যতদূর পর্যন্ত অখণ্ড ততদূর পর্যন্ত তাহার বেদনা অপরিচ্ছিন্ন ছিল। বাংলার মুসলমান যে এই বেদনায় আমাদের সঙ্গে এক হয় নাই তাহার কারণ তাহাদের সঙ্গে আমরা কোনোদিন হৃদয়কে এক হইতে দিই নাই।

সংস্কৃত ভাষায় একটা কথা আছে, ঘরে যখন আগুন লাগিয়াছে তখন কূপ খুঁড়িতে যাওয়ার আয়োজন বৃথা। বঙ্গবিচ্ছেদের দিনে হঠাৎ যখন মুসলমানকে আমাদের দলে টানিবার প্রয়োজন হইল তখন আমরা সেই কূপ-খননেরও চেষ্টা করি নাই-- আমরা মনে করিয়াছিলাম, মাটির উপরে ঘটি ঠুকিলেই জল আপনি উঠিবে। জল যখন উঠিল না কেবল ধুলাই উড়িল তখন আমাদের বিস্ময়ের সীমাপরিসীমা রহিল না। আজ পর্যন্ত সেই কূপখননের কথা ভুলিয়া আছি। আরও বার বার মাটিতে ঘটি ঠুকিতে হইবে, সেই সঙ্গে সে-ঘটি আপনার কপালে ঠুকিব।"

হিন্দুমুসলমান (কালান্তর)

“পৃথিবীতে দুটি ধর্মসম্প্রদায় আছে অন্য সমস্ত ধর্মমতের সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধতা অত্যুগ্র-- সে হচ্ছে খৃস্টান আর মুসলমান-ধর্ম। তারা নিজের ধর্মকে পালন করেই সন্তুষ্ট নয়, অন্য ধর্মকে প্রতিহত করতে উদ্যত। এইজন্যে তাদের ধর্ম গ্রহণ করা ছাড়া তাদের সঙ্গে মেলবার অন্য কোনো উপায় নেই। খৃস্টানধর্মাবলম্বীদের সম্বন্ধে একটি সুবিধার কথা এই যে, তারা আধুনিক যুগের বাহন; তাদের মন মধ্যযুগের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ নয়। ধর্মমত একান্তভাবে তাদের সমস্ত জীবনকে পরিবেষ্টিত করে নেই। এইজন্যে অপরধর্মাবলম্বীদেরকে তারা ধর্মের বেড়ার দ্বারা সম্পূর্ণ বাধা দেয় না। য়ুরোপীয় আর খৃস্টান এই দুটো শব্দ একার্থক নয়। "য়ুরোপীয় বৌদ্ধ' বা "য়ুরোপীয় মুসলমান' শব্দের মধ্যে স্বতোবিরুদ্ধতা নেই। কিন্তু ধর্মের নামে যে-জাতির নামকরণ ধর্মমতেই তাদের মুখ্য পরিচয়। "মুসলমান বৌদ্ধ' বা "মুসলমান খৃস্টান' শব্দ স্বতই অসম্ভব। অপর পক্ষে হিন্দুজাতিও এক হিসাবে মুসলমানদেরই মতো। অর্থাৎ, তারা ধর্মের প্রাকারে সম্পূর্ণ পরিবেষ্টিত। বাহ্য প্রভেদটা হচ্ছে এই যে, অন্য ধর্মের বিরুদ্ধতা তাদের পক্ষে সকর্মক নয়-- অহিন্দু সমস্ত ধর্মের সঙ্গে তাদের শষশ-ৎভষরনশঢ় শষশ-দষ-ষসনক্ষতঢ়ভষশ। হিন্দুর ধর্ম মুখ্যভাবে জন্মগত ও আচারমূলক হওয়াতে তার বেড়া আরও কঠিন। মুসলমানধর্ম স্বীকার ক'রে মুসলমানের সঙ্গে সমানভাবে মেলা যায়, হিন্দুর সে পথও অতিশয় সংকীর্ণ। আহারে ব্যবহারে মুসলমান অপর সম্প্রদায়কে নিষেধের দ্বারা প্রত্যাখ্যান করে না, হিন্দু সেখানেও সতর্ক। তাই খিলাফৎ উপলক্ষ্যে মুসলমান নিজের মসজিদে এবং অন্যত্র হিন্দুকে যত কাছে টেনেছে হিন্দু মুসলমানকে তত কাছে টানতে পারে নি। আচার হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধের সেতু, সেইখানেই পদে পদে হিন্দু নিজের বেড়া তুলে রেখেছে। আমি যখন প্রথম আমার জমিদারি কাজে প্রবৃত্ত হয়েছিলুম তখন দেখেছিলুম, কাছারিতে মুসলমান প্রজাকে বসতে দিতে হলে জাজিমের এক প্রান্ত তুলে দিয়ে সেইখানে তাকে স্থান দেওয়া হত। অন্য-আচার-অবলম্বীদের অশুচি ব'লে গণ্য করার মতো মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের এমন ভীষণ বাধা আর কিছু নেই। ভারতবর্ষের এমনি কপাল যে, এখানে হিন্দু-মুসলমানের মতো দুই জাত একত্র হয়েছে; ধর্মমতে হিন্দুর বাধা প্রবল নয়, আচারে প্রবল; আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয়, ধর্মমতে প্রবল। এক পক্ষের যে দিকে দ্বার খোলা, অন্য পক্ষের সে দিকে দ্বার রুদ্ধ। এরা কী করে মিলবে। এক সময়ে ভারতবর্ষে গ্রীক পারসিক শক নানা জাতির অবাধ সমাগম ও সম্মিলন ছিল। কিন্তু মনে রেখো, সে "হিন্দু'-যুগের পূর্ববর্তী কালে। হিন্দুযুগ হচ্ছে একটা প্রতিক্রিয়ার যুগ-- এই যুগে ব্রাহ্মণ্যধর্মকে সচেষ্টভাবে পাকা ক'রে গাঁথা হয়েছিল। দুর্লঙ্ঘ্য আচারের প্রাকার তুলে এ'কে দুষ্প্রবেশ্য ক'রে তোলা হয়েছিল। একটা কথা মনে ছিল না, কোনো প্রাণবান জিনিসকে একেবারে আটঘাট বন্ধ ক'রে সামলাতে গেলে তাকে মেরে ফেলা হয়। যাই হোক, মোট কথা হচ্ছে, বিশেষ এক সময়ে বৌদ্ধযুগের পরে রাজপুত প্রভৃতি বিদেশীয় জাতিকে দলে টেনে বিশেষ অধ্যবসায়ে নিজেদেরকে পরকীয় সংস্রব ও প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ রক্ষা করবার জন্যেই আধুনিক হিন্দুধর্মকে ভারতবাসী প্রকাণ্ড একটা বেড়ার মতো করেই গড়ে তুলেছিল-- এর প্রকৃতিই হচ্ছে নিষেধ এবং প্রত্যাখ্যান। সকলপ্রকার মিলনের পক্ষে এমন সুনিপুণ কৌশলে রচিত বাধা জগতে আর কোথাও সৃষ্টি হয় নি। এই বাধা কেবল হিন্দু-মুসলমানে তা নয়। তোমার আমার মতো মানুষ যারা আচারে স্বাধীনতা রক্ষা করতে চাই, আমরাও পৃথক, বাধাগ্রস্ত। সমস্যা তো এই, কিন্তু সমাধান কোথায়। মনের পরিবর্তনে, যুগের পরিবর্তনে। য়ুরোপ সত্যসাধনা ও জ্ঞানের ব্যাপ্তির ভিতর দিয়ে যেমন ক'রে মধ্যযুগের ভিতর দিয়ে আধুনিক যুগে এসে পৌঁচেছে হিন্দুকে মুসলমানকেও তেমনি গণ্ডির বাইরে যাত্রা করতে হবে। ধর্মকে কবরের মতো তৈরি করে তারই মধ্যে সমগ্র জাতিকে ভূতকালের মধ্যে সর্বতোভাবে নিহিত করে রাখলে উন্নতির পথে চলবার উপায় নেই, কারো সঙ্গে কারো মেলবার উপায় নেই। আমাদের মানসপ্রকৃতির মধ্যে যে-অবরোধ রয়েছে তাকে ঘোচাতে না পারলে আমরা কোনোরকমের স্বাধীনতাই পাব না। শিক্ষার দ্বারা, সাধনার দ্বারা সেই মূলের পরিবর্তন ঘটাতে হবে-- ডানার চেয়ে খাঁচা বড়ো এই সংস্কারটাকেই বদলে ফেলতে হবে-- তার পরে আমাদের কল্যাণ হতে পারবে। হিন্দু-মুসলমানের মিলন যুগপরিবর্তনের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু এ কথা শুনে ভয় পাবার কারণ নেই; কারণ অন্য দেশে মানুষ সাধনার দ্বারা যুগপরিবর্তন ঘটিয়েছে, গুটির যুগ থেকে ডানা-মেলার যুগে বেরিয়ে এসেছে। আমরাও মানসিক অবরোধ কেটে বেরিয়ে আসব; যদি না আসি তবে, নান্যঃপন্থা বিদ্যতে অয়নায়।”

আত্মপরিচয়

“সকল মানুষেরই "আমার ধর্ম' বলে একটা বিশেষ জিনিস আছে। কিন্তু সেইটিকেই সে স্পষ্ট করে জানে না। সে জানে আমি খৃস্টান, আমি মুসলমান, আমি বৈষ্ণব, আমি শাক্ত ইত্যাদি। কিন্তু সে নিজেকে যে ধর্মাবলম্বী বলে জন্মকাল থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত নিশ্চিন্ত আছে সে হয়তো সত্য তা নয়। নাম গ্রহণেই এমন একটা আড়াল তৈরি করে দেয় যাতে নিজের ভিতরকার ধর্মটা তার নিজের চোখেও পড়ে না।

কোন্ ধর্মটি তার? যে ধর্ম মনের ভিতরে গোপনে থেকে তাকে সৃষ্টি করে তুলছে। জীবজন্তুকে গড়ে তোলে তার অন্তর্নিহিত প্রাণধর্ম। সেই প্রাণধর্মটির কোনো খবর রাখা জন্তুর পক্ষে দরকারই নেই। মানুষের আর-একটি প্রাণ আছে, সেটা শারীর-প্রাণের চেয়ে বড়ো--সেইটে তার মনুষ্যত্ব। এই প্রাণের ভিতরকার সৃজনীশক্তিই হচ্ছে তার ধর্ম। এইজন্যে আমাদের ভাষায় "ধর্ম' শব্দ খুব একটা অর্থপূর্ণ শব্দ। জলের জলত্বই হচ্ছে জলের ধর্ম, আগুনের আগুনত্বই হচ্ছে আগুনের ধর্ম। তেমনি মানুষের ধর্মটিই হচ্ছে তার অন্তরতম সত্য।”


Saturday, 23 January 2016

ভারত উন্নয়ন ও বঞ্চনা - অমর্ত্য সেন জঁ দ্রেজ

"দুনিয়ার অন্য নানা দেশের মতোই ভারতেও গণতন্ত্র তার সম্পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি: 'জনগণের, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য' শাসনের লক্ষ্য পূরণে ঘাটতি ভারতেও থেকে গিয়েছে । "

"ষাট বছরের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ভারত গণতান্ত্রিক দেশগুলির মধ্যে অগ্রণী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে । দক্ষিণ এশিয়া সহ দুনিয়ার অনেক দেশেই যেমন সামরিক বাহিনী এসে নির্বাচিত সরকারকে গদিচ্যুত করে ক্ষমতার দখল নিয়েছে, ভারতে তা হয়নি । বহু ভাষা, ধর্ম  এবং জাতিগোষ্ঠী সমন্বিত একটি দেশে গণতন্ত্র কী ভাবে বিকশিত হতে পারে, ভারত তা প্রত্যয়ের সঙ্গে দেখিয়ে দিয়েছে । "

বি আর আম্বেডকর বলেছিলেন, 'শিক্ষিত করা, বিক্ষুব্ধ করা এবং সংগঠিত করা'র শক্তি সম্পর্কে হতাশ হওয়ার কোনও কারণ নেই, বরং সেই সম্ভাবনাগুলি চরিতার্থ করতে আমাদের যথেষ্ট তৎপর হওয়ার কারণ আছে ।"

"ভারতে সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা প্রথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, এটা গর্ব করার ব্যাপার । রেডিয় এবং টেলিভিশনেও বহু স্টেশন ও চ্যানেল কাজ করছে, বিশেষ করে বহু টিভি চ্যানেলে চব্বিশ ঘন্টা সংবাদ পরিবেশন করা হয়, বিভিন্ন মতের বিতর্কের মধ্য দিয়ে সংবাদের পর্যালোচনা করা হয় । একটা স্তরে এটা অবশ্যই গণতান্ত্রিক পরিসরের বিরাট সাফল্য এবং অবাধ বহুদলীয় নির্বাচনের মতো অন্য বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের উপরেও এর একটা সুপ্রভাব থাকে ।
সংবাদমাধ্যমের  ব্যর্থতার দিকটাও মনে রাখা দরকার । নাগরিকদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক জীবনে যে সব অন্যায় এবং অকুশলতা আছে, সংবাদমাধ্যমে সেগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব পায় না । সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনযাত্রার সংকট এবং সমস্যাগুলি দূর করার কাজে একটা কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে, এ-রকম গভীর এবং উৎকৃষ্ট সাংবাদিকতার নমুনা কমই দেখা যায়; সংবাদমাধ্যম সাধারণত সমাজের সৌভাগ্যবান এবং সফল অংশের উজ্জ্বল ছবি দেখাতেই ব্যস্ত থাকে । কিছু প্রশংসনীয় ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তা ব্যতিক্রমমাত্র ।"

"আয়বৃদ্ধির সামাজিক সুফল এখনও অত্যন্ত সীমিত । সমস্যাটা শুধু এই নয় যে, সাম্প্রতিক কালে আয়ের বৈষম্য রীতিমত বেড়েছে; চিনে যখন প্রকৃত মজুরি দ্রুত বেড়েছে এবং তার ফলে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানে রীতিমত উন্নতি হয়েছে, ভারতে তখন মজুরি কার্যত একই জায়গায় আটকে আছে । পাশাপাশি, আয়বৃদ্ধির ফলে সরকারি রাজস্ব বাড়লেও সেই বাড়তি সম্পদ সামাজিক এবং বস্তুগত পরিকাঠামোর উন্নয়নে যথেষ্ট কাজে লাগানো হয়নি, এ ব্যাপারেও চিনের তুলনায় ভারত অনেক পিছিয়ে ।শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিচর্যা, পানীয় জল বা নিকাশী ব্যবস্থার মতো অপরিহার্য সামাজিক পরিষেবাগুলির সরবারহেও বিপুল ঘাটতি আছে, বহু মানুষ এখনও এই সব পরিষেবা থেকে সম্পূর্ণত বা বহুলাংশে বঞ্চিত ।"

"কুড়ি বছর আগে দক্ষিন এশিয়ার ছ'টি দেশের (ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান) মধ্যে সামাজিক সূচকগুলির তালিকায় ভারত সাধারণত দু'নম্বর জায়গাটিতে থাকত, এখন তার স্থান বেশিরভাগ ব্যাপারেই নীচের দিক থেকে দ্বিতীয় - একমাত্র পাকিস্তানের ওপরে । ভারত মাথাপিছু আয়ের সিঁড়িটিতে ক্রমশ উপরে উঠছে, আর সামাজিক অর্জনের সিঁড়িটিতে ক্রমশ নীচে নামছে । "

"স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় সেই সংগ্রামের নায়করা বলেছিলেন, স্বাধীন ভারতের লক্ষ্য হবে উন্নয়ন ও সমতা । সেই পরিপ্রেক্ষিতে, মানতেই হবে, স্বাধীন ভারতের ব্যর্থতা বিরাট । ব্যর্থতা শুধু এই নয় যে, আয়বৃদ্ধির সুফল বন্টনে বিরাট বৈষম্য ঘটেছে; উন্নয়নের ফলে অর্জিত সম্পদ সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের বিপুল সামাজিক বঞ্চনা দূর করার কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রেও রীতিমত ব্যর্থতা দেখা গেছে ।"

"স্বাধীনতার সময় ভারতে 'রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক গণতন্ত্র' প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়েছিল । কিছুটা অতিসরলিকরণের ঝুঁকি নিয়ে বলা যায়, দুটি ক্ষেত্রে ভারত এই লক্ষ্য পূরণে বিশেষ ভাবে ব্যর্থ : (১) যাঁরা সুবিধাভোগী, তাঁদের সঙ্গে অবশিষ্ট মানুষের অবস্থায় এখনও বিপুল বৈষম্য এবং (২) ভারতীয় অর্থনীতি ও সমাজ যে ভাবে সংগঠিত, তাতে দক্ষতা ও দায়বদ্ধতা এখন অত্যন্ত কম ।"



"সাম্প্রতিক দশকগুলিতে, বিশেষত গত বছর দশেকে ভারতের দ্রুত আয়বৃদ্ধি নিয়ে সঙ্গত কারণেই একটা উচ্ছ্বাস তৈরী হয়েছে । 'মধ্যবিত্ত শ্রেণি'র (প্রচলিত অর্থে, আয়ের দিক থেকে উপরের দিকের কুড়ি শতাংশ মানুষ) জীবন-মানের যতটা উন্নতি হয়েছে, সেটা আগের দশকগুলিতে ভাবা যায়নি । কিন্তু অন্য অনেক ধরনের মানুষের - যেমন রিকশা-চালক, বাড়ির কাজের লোক বা ইটভাটার শ্রমিকের - ক্ষেত্রে গল্পটা অনেক জটিল । এ ধরনের বা এর চেয়েও কম সুবিধাভোগী মানুষের জীবনে আর্থিক সংস্কারের পর্বটিতে উচ্ছ্বসিত হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি । তাঁদের অবস্থায় কোনও উন্নতি হয়নি এমন নয়, কিন্তু পরিবর্তন হয়েছে অত্যন্ত ধীরগতিতে এবং তার ফলে তাঁদের চরম দুর্দশা বিশেষ পাল্টায়নি ।"

"অশোক কোতোয়াল, ভরত রামস্বামী এবং ইউলিমা ওয়াধবা (২০১১) প্রণীত এক সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে এই বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে । ১৯৮৩ এবং ২০০৪-০৫, এই দুটি বছরের এনএসএস সমীক্ষার পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তাঁরা এই গবেষণাটি করেছেন । তাঁদের হিসেবে, এই সময়ের মধ্যে গ্রাম প শহর মিলিয়ে দারিদ্রের মাথা-গুনতি অনুপাত ৪৫ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২৮ শতাংশ । তাঁরা দেখিয়েছেন, দারিদ্র রেখার অঙ্কটি যদি দ্বিগুন করা হয় (তারপরেও কিন্তু অঙ্কটি কমই থাকবে), তা হলে ১৯৮৩ সালে দারিদ্রের অনুপাত ছিল ৮৬ শতাংশ এবং ২০০৪-০৫ সালে ৮০ শতাংশ । কুড়ি বছরে এই উন্নতি অকিঞ্চিৎকর, বিশেষ করে দারিদ্র হ্রাসের সরকারি পরিসংখ্যানের তুলনায় । আরও সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে যে, গত দুই দশকে সামগ্রিকভাবে উন্নতশীল দেশগুলির তুলনায় ভারতে দারিদ্রের মাত্রা হ্রাসের গতি অনেক কম ছিল - ভারতে আয়বৃদ্ধির গতি উন্নতিশীল দুনিয়ার গড় আয়বৃদ্ধির চেয়ে অনেকটা বেশি হওয়া সত্ত্বেও ।"

Tuesday, 19 January 2016

সক্রেটিস

" জাহাজ তৈরী করতে বিশেষজ্ঞের পরামর্শের দরকার হয়, দুর্গ বানাতেও বিশেষজ্ঞ লাগে। .. শুধু জাতীয় নীতির অতি গুরুত্বপূর্ণ ন্যায়-অন্যায় স্থির করার প্রশ্নে যে-খুশি উঠে দাঁড়িয়ে গেল আর কথা বলতে শুরু করল, সঙ্গে সঙ্গে সে হয়ে গেল বিজ্ঞ বিচারক ..."

Sunday, 17 January 2016

ফ্রান্সে শ্রেণী-সংগ্রাম ১৮৪৮ থেকে ১৮৫০ - কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস

"সব থেকে শক্তিশালী, সবচেয়ে সুশৃঙ্খল ও দ্রুততম হারে বিকাশমান সমাজতন্ত্রী দল হিসাবে শুধু বর্তমান থেকেই জার্মান শ্রমিকেরা তাদের আদর্শের জন্য যে কাজ সম্পন্ন করেছিল, সেই প্রথম কাজটি বাদেও তারা আর একটি মস্ত কাজ করেছে । সর্বজনীন ভোটাধিকার কী ভাবে প্রয়োগ করতে হয় - তা দেখিয়ে দিয়ে তারা তাদের সব দেশের কমরেডদের নতুন ও সব থেকে তীক্ষ্ণ একটি হাতিয়ার জোগায় ।"

"যেখানে জনসাধারণ এখন পর্যন্ত আমাদের থেকে দূরে সরে আছে, সেখানে নির্বাচনী প্রচারের মারফত তাদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের, এবং আমাদের আক্রমণের মুখে অন্য সব পার্টিকে সমগ্র জনসাধারণের দরবারে নিজেদের মতামত ও কার্যকলাপের ব্যাখ্যা করতে বাধ্য করার এক অদ্বিতীয় হাতিয়ার আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে এই ভোটাধিকার ।"

"প্রলেতারিয়েতের একটি মাত্র জবরদখল বুর্জোয়ারা মেনে নিতে প্রস্তুত - লড়বার জবরদস্তি ।"

Saturday, 9 January 2016

ধর্ম - মার্ক্সবাদ

দার্শনিক মনীষী কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) ইউরোপের ভাববাদী দার্শনিক হেগেলের (১৭৭০-১৮৩১) আইনের দর্শনের পর্যালোচনার ভূমিকাতে বলেন “ধর্ম হল নিপীড়িত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয় ঠিক যেমন সেটা হল আত্মবিহীন পরিবেশের আত্মা। ধর্ম হল জনগণের জন্য আফিম। মানুষের মায়াময় সুখ হিসেবে ধর্মকে লোপ করাটা হল মানষের প্রকৃত সুখের দাবি করা। বিদ্যমান হালচাল সম্বন্ধে মোহ পরিত্যাগ করার দাবিটা হল যে-হালচালে মোহ আবশ্যক, সেটাকে পরিত্যাগ করার দাবি। তাই ধর্মের সমালোচনা হল ধর্ম যার জ্যোতির্মণ্ডল সেই অশ্রু উপত্যকার (এই পার্থিব জীবনের) সমালোচনার সূত্রপাত।”