শুধু কেবল আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর যে-কোন দেশে, যে-কোন যুগে যে-কেউ জন্মভূমিকে তার স্বাধীন করবার চেষ্টা করেচে, তাকে আপনার নয় বলবার সাধ্য আর যার থাক আমার নেই ।
নারীর স্বাধীনতার প্রসঙ্গে মন তাহার কোনকালেই সায় দিতে চাহিত না । ইহাতে মঙ্গল নাই, ইহা ভাল নয় --- তাহার রুচি ও আজন্ম সংস্কার এ কথা অনুক্ষণ তাহার কানে কানে বলিত । অথচ, শাস্ত্রীয় অনুশাসনগুলার মধ্যেও যে ইহাদের প্রতি গভীর অবিচার নিহিত আছে এ সত্য তাহার ন্যায়নিষ্ঠ চিত্ত কিছুতেই অস্বীকার করিতে পারিত না । ইহাতে সে দুঃখ পাইত কিন্তু পথ পাইত না ।
কোন একটা কথা কেবলমাত্র বহুদিন ধরে বহু লোকে বলতে থাকলেই তা সত্য হয়ে ওঠে না ।
ক্ষতি ত অনেক জিনিসেই হয় না অপূর্ববাবু, কিন্তু বিনা প্রয়োজনেও কোন কাজ করা আমাদের বারণ ।
যেখানে ফেলে যাওয়াই মঙ্গল, সেখানে আঁকড়ে থাকাতেই অকল্যাণ ।
এ নরককুন্ড ত এরা বানায় নি । এরা শুধু তার প্রায়শ্চিত্ত করচে ।
মানুষের প্রতি মানুষে কত অত্যাচার করচে চোখ মেলে দেখতে শিখুন । কেবল ছোঁয়াছুঁয়ি বাঁচিয়ে, নিজে সাধু হয়ে থেকে ভেবেচেন পুণ্য সঞ্চয় করে একদিন স্বর্গে যাবেন ? মনেও করবেন না ।
এই হৃদয়হীনতা নিবারণ করিবার উপায় নাই, লোকে করে না, কেহ করিতে চাহিলে সবাই তাকে পাগল বলিয়া উড়াইয়া দেয় ।
এরা কারা অপূর্ববাবু ? এরা ত আমারই । এই ছোট্ট কথাটুকু যখনি ভুলচেন, তখনি আপনার গোল বাধচে । আর ভাল ? ভাল-করা বলে যদি সংসারে কোন কথা থাকে, তার যদি কোন অর্থ থাকে সে ত এইখানে । ভাল ত ডাক্তারবাবুর করা যায় না অপূর্ববাবু ।
চিরদিন সংসারে অত্যাচারিত, পীড়িত, দুর্বল বলিয়া মানুষের সহজ অধিকার হইতে যাহারা সবলের দ্বারা প্রবঞ্চিত, নিজের উপরে বিশ্বাস করিবার কোন কারণ যাহারা দুনিয়ায় খুঁজিয়া পায় না, দেবতা ও দৈবের প্রতি তাহাদেরই বিশ্বাস সব চেয়ে বেশী ।
ভাল বক্তার কাছে জনতা যুক্তিতর্ক চাহে না, যাহা মন্দ তাহা কেন মন্দ এ খবরে তাহাদের আবশ্যক হয় না, শুধু মন্দ যে কত মন্দ অসংখ্য বিশেষণ যোগে ইহাই শুনিয়া তাহারা চরিতার্থ হইয়া যায় ।
এ যে কেবল ধনীর বিরুদ্ধে দরিদ্রের আত্মরক্ষার লড়াই । এতে দেশ নেই, জাত নেই, ধর্ম নেই, মতবাদ নেই - হিন্দু নেই, মুসলমান নেই, - জৈন, শিখ কোন কিছুই নেই, - আছে শুধু ধনোন্মত্ত মালিক আর তার অশেষ প্রবঞ্চিত অভুক্ত শ্রমিক । তোমাদের গায়ের জোরকে তারা ভয় করে, তোমাদের শিক্ষার শক্তিকে তারা অত্যন্ত সংশয়ের চোখে দেখে, তোমাদের জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষায় তাদের রক্ত শুকিয়ে যায় । অক্ষম, দুর্বল, মূর্খ, দুর্নীতিপরায়ণ তোমরাই যে তাদের বিলাস-ব্যসনের একমাত্র পাদপীঠ । তাই, মাত্র তোমাদের জীবনধারণটুকুর বেশী তিলার্ধ যে তারা স্বেচ্ছায় কোন দিন দেবে না - এই সত্য হৃদয়ঙ্গম করা কি তোমাদের এতই কঠিন ।
তোমরা অসাধু, তোমরা উচ্ছৃঙ্খল, তোমরা ইন্দ্রিয়াসক্ত - তাদের মুখ থেকে এই-সকল অপবাদই তোমরা চিরদিন শুনে এসেছ । তাই, যখনই তোমরা তোমাদের দাবী জানিয়েছ, তখনই তোমাদের সকল দুঃখকষ্টের মূলে তোমাদের অসংযত চরিত্রকেই দায়ী করে তারা তোমাদের সর্বপ্রকার উন্নতিকে নিবারিত করে এসেছে, - কেবল এই মিথ্যেই তোমাদের তারা অনুক্ষণ বুঝিয়ে এসেছে, - ভাল না হলে কারও উন্নতই কোন দিন হতে পারে না ।
আমার দেশ গেছে বলেই আমি এদের শত্রু নই । একদিন মুসলমানের হাতেও এ দেশ গিয়েছিল । কিন্তু সমস্ত মনুষ্যত্বের এতবড় পরম শত্রু জগতে আর নেই । স্বার্থের দায়ে ধীরে ধীরে মানুষকে অমানুষ করে তোলাই এদের মজ্জাগত সংস্কার । এই এদের ব্যবসা, এই এদের মূলধন ।
সময়মত স্থান ত্যাগ করা এবং একটিভিটি ত্যাগ করা এক বস্তু নয় আইয়ার ।
আরে পরাধীন দেশের সব চেয়ে বড় অভিসম্পাতই হোলো কৃতঘ্নতা । যাদের সেবা করবে তারাই তোমাকে সন্দেহের চোখে দেখবে, প্রাণ যাদের বাঁচাবে, তারাই তোমাকে বিক্রি করে দিতে চাইবে । মূঢ়তা আর অকৃতজ্ঞতা প্রতি পদক্ষেপে তোমায় ছুঁচের মত বিঁধবে । শ্রদ্ধা নেই, স্নেহ নেই, সহানুভূতি নেই, কেউ কাছে ডাকবে না, কেউ সাহায্য করতে আসবে না, বিষধর সাপের মত তোমাকে দেখে লোকে দূরে সরে যাবে । দেশকে ভালোবাসার এই আমাদের পুরস্কার, ভারতী এর বেশী দাবী করবার কিছু যদি থাকে, ত সে শুধু পরলোকে ।
আপনাকে ভোলাবার অনেক রাস্তা আছে, ভারতী, কিন্তু সত্যে পৌঁছাবার আর দ্বিতীয় পথ নেই ।
ও কবি, ও গুণী, ওদের জাত আলাদা । ওদের ভাল-মন্দ ঠিক আমাদের সঙ্গে মেলে না । কিন্তু তাই বলে দুনিয়ার ভাল-মন্দের বাঁধা আইনে ওকে মাপ করা চলে না । ওর গুণের ফল তারা সবাই মিলে ভোগ করে, শুধু দোষের শাস্তিটুকু সহ্য করে ও নিজে ।
জন-কতক কুলি-মজুরের ভাল করার জন্যে পথের-দাবী আমি সৃষ্টি করিনি । এর ঢের বড় লক্ষ্য । এই লক্ষ্যের মুখে হয়ত একদিন এদের ভেড়া-ছাগলের মতই বলি দিতে হবে , -
এমন করে এদের ভালো করা যায় না, - এদের ভালো-করা যায় শুধু বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে ? এবং সেই বিপ্লবের পথে চালনা করার জন্যেই আমার পথের-দাবীর সৃষ্টি । বিপ্লব শান্তি নয় । হিংসার মধ্যে দিয়েই তাকে চিরদিন পা ফেলে আসতে হয়, - এই তার বর, এই তার অভিশাপ ।
মানুষের চলার পথ মানুষে কোনদিন নিরুপদ্রবে ছেড়ে দেয় না ভারতী ।
মহামানবের মুক্তি-সাগরে মানবের রক্তধারা তরঙ্গ তুলে ছুটে যাবে সেই ত আমার স্বপ্ন ।
অশান্তি ঘটিয়ে তোলার মানেই অকল্যাণ ঘটিয়ে তোলা নয় । শান্তি ! শান্তি ! শান্তি ! শুনে শুনে কান একেবারে ঝালাপালা হয়ে গেছে । কিন্তু এ অসত্য এতদিন ধরে কারা প্রচার করেছে জানো ? পরের শান্তি হরণ করে যারা পরের রাস্তা জুড়ে অট্টালিকা প্রাসাদ বানিয়ে বসে আছে তারাই এই মিথ্যামন্ত্রের ঋষি । বঞ্চিত, পীড়িত, উপদ্রুত নরনারীর কানে অবিশ্রান্ত এই মন্ত্র জপ করে করে তাদের এমন করে তুলেছে যে, আজ তারাই অশান্তির নাম চমকে উঠে, -- ভাবে এ বুঝি পাপ, এ বুঝি অমঙ্গল ! বাঁধা গরু অনাহারে দাঁড়িয়ে মরতে দেখেচ ? সে দাঁড়িয়ে মরে তবু সেই জীর্ণ দড়িটা ছিঁড়ে ফেলে মনিবের শান্তি নষ্ট করে না । তাইত হয়েছে, তাইত আজ দীন-দরিদ্রের চলার পথ একেবারে রুদ্ধ হয়ে গেছে ! তবুও তাদেরই অট্টালিকা প্রাসাদ চূর্ণ করার কাজে তাদেরি সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে যদি আমরাও আজ অশান্তি বলে কাঁদতে থাকি ত পথ পাবো কোথায় ? না ভারতী, সে হবে না ও প্রতিষ্ঠান যত প্রাচীন, যত পবিত্র, যত সনাতনই হোক, -- মানুষের চেয়ে বড় নয়, -- আজ সে-সব আমাদের ভেঙ্গে ফেলতেই হবে । ধূলো ত উড়বেই, বালি ত ঝরবেই, ইঁট-পাথর খসে মানুষের মাথাতে ত পড়বেই ভারতী, এই ত স্বাভাবিক ।
ধর্মঘট বলে একটা বস্তু আছে, কিন্তু নিরুপদ্রব-ধর্মঘট বলে কোথাও কিছু নেই । সংসারে কোন ধর্মঘটই কখনো সফল হয় না, যতক্ষণ না পিছনে তার বাহুবল থাকে ।
ধনীর আর্থিক ক্ষতি এবং দরিদ্রের অনশন এক বস্তু নয় ।
দেশের মধ্যে ছোটবড় এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা দেশের ঢের ভাল কাজ করে । আর্তের সেবা, নরনারীর পুন্যসঞ্চয়ে প্রবৃত্তি দান করা, লোকের জ্বর ও পেটের অসুখে ঔষধ যোগানো, জল-প্লাবনে সাহায্য ও সান্ত্বনা দেওয়া -- তাঁরাই তোমাকে পথ দেখিয়ে দেবেন, ভারতী, কিন্তু আমি বিপ্লবী । আমার মায়া নেই, দয়া নেই, স্নেহ নেই --পাপ-পুণ্য আমার কাছে মিথ্যা পরিহাস । ওই-সব ভাল কাজ আমার কাছে ছেলেখেলা । ভারতের স্বাধীনতাই আমার একমাত্র লক্ষ, আমার একটিমাত্র সাধনা । এই আমার ভাল, এই আমার মন্দ,-- এ ছাড়া এ জীবনে আর আমার কোথাও কিছু নাই ।
ভারতের স্বাধীনতা ছাড়া আমার নিজের আর দ্বিতীয় লক্ষ্য নেই, কিন্তু মানবজীবনে এর চেয়ে বৃহত্তর কাম্য আর নেই এমন ভুলও আমার কোন দিন হয়নি । স্বাধীনতাই স্বাধীনতার শেষ নয় । ধর্ম, শান্তি, কাব্য, আনন্দ --- এরা আরও বড় । এদের একান্ত বিকাশের জন্যই ত স্বাধীনতা, নইলে এর মূল্য ছিল কোথা ?
বিপ্লব মানেই ভারতী, কাটাকাটি রক্তারক্তি নয় । বিপ্লব মানে অত্যন্ত দ্রুত আমূল পরিবর্তন ।
যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জনপদ ভস্মসাৎ করে ফেলে, আয়তনে সে কতটুকু জানো ? শহর যখন পোড়ে সে আপনার ইন্ধন আপনি সংগ্রহ করে দগ্ধ হয় । তার ছাই হবার উপকরণ তারই মধ্যে সঞ্চিত থাকে, বিশ্ববিধানের এ নিয়ম কোন রাজশক্তিই কোনদিন ব্যত্যয় করতে পারে না ।
লজ্জাহীন উলঙ্গ স্বার্থ এবং পশু-শক্তির একান্ত প্রধান্যই এর মূলমন্ত্র । সভ্যতার নাম দিয়ে দুর্বল, অক্ষমের বিরুদ্ধে এতবড় মুষল মানুষের বুদ্ধি আর ইতিপূর্বে আবিষ্কার করেনি ।
মনে আছে আমার ছেলেবেলায় স্কুলের পড়ার বইয়ে একবার পড়েছিলাম, বিলেতে বসে আমাদের কল্যাণ ভেবে ভেবেই কেবল রাজমন্ত্রীর চোখের নিদ্রা এবং মুখের অন্ন বিস্বাদ হয়ে গেছে । এই সত্য ছেলেদের কণ্ঠস্থ করতে হয়, এবং উদরান্নের দায়ে শিক্ষকদের কণ্ঠস্থ করাতে হয় । সভ্য রাজ্যতন্ত্রের এই রাজনীতি ভারতী ।
দেশের ভালো যাঁরা করবেন তাঁরা চাঁদা তুলে দিকে দিকে অনাথ-আশ্রম, ব্রহ্মচর্যাশ্রম, বেদান্ত-আশ্রম, দরিদ্র-ভান্ডার প্রভৃতি নানা হিতকর কার্য করছেন, মহৎ লোক তাঁরা, আমি তাঁদের ভক্তি করি, - কিন্তু দেশের ভালো করার ভার আমি নিইনি, আমি স্বাধীন করার ভার নিয়েছি ।
প্রবল দুর্বলের সম্পদ কেন ছিনিয়ে নেবে না, এ কথা যে সভ্য ইয়োরোপের নৈতিক-বুদ্ধি ভাবতেই পারে না ।
ইউরোপীয় সভ্যতার অন্যায়-বোধটা অপরের ঘর-চড়াও হয়েই হয়, তাঁদের নিজেদের দেশের মধ্যে ঘটতে দেখা যায় না ।
নিরীহ চাষাভুষোর জন্যে তোমার দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নেই ভারতী, কোন দেশেই তারা স্বাধীনতার কাজে যোগ দেয় না । বরঞ্চ বাধা দেয় । তাদের উত্তেজিত করার মত পণ্ডশ্রমের সময় নেই আমার । আমার কারবার শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, ভদ্র-সন্তানদের নিয়ে । কোনদিন যদি আমার কাজে যোগ দিতে চাও ভারতী, এ কথাটা ভুলো না । আইডিয়ার জন্যে প্রাণ দিতে পারার মত প্রাণ, শান্তিপ্রিয়, নির্বিরোধী, নিরীহ কৃষকের কাছে আশা করা বৃথা । তারা স্বাধীনতা চায় না, শান্তি চায় । যে শান্তি অক্ষম, অশক্তের, ---- সেই পঙ্গুর জড়ত্বই তাদের ঢের বেশী কামনার বস্তু ।
বিপ্লব মানেই শুধু রক্তারক্তি কান্ড নয়, --- বিপ্লব মানে অত্যন্ত দ্রুত আমূল পরিবর্তন ! রাজনৈতিক বিপ্লব নয়, -- সে আমার । কবি, তুমি প্রাণ খুলে শুধু সামাজিক বিপ্লবের গান শুরু করে দাও । যা কিছু সনাতন, যা কিছু প্রাচীন, জীর্ণ, পুরাতন, --- ধর্ম, সমাজ, সংস্কার --- সমস্ত ভেঙ্গে-চুরে ধ্বংস হয়ে যাক, --- আর কিছু না পারো, শশী, কেবল এই মহাসত্যই মুক্তকণ্ঠে প্রচার করে দাও, --- এর চেয়ে ভারতরে বড় শত্রু আর নেই --- তারপরে থাক দেশের স্বাধীনতার বোঝা আমার এই মাথায় !
যত বড়ই হোক, কারও অভাবকেই যেন না আমরা সর্বনাশ বলে ভাবি, একজনের স্থান যেন জলস্রোতের মত আর একজন স্বচ্ছন্দে এবং অত্যন্ত অনায়াসেই পূর্ণ করে নিতে পারে এই শিক্ষাই ত আমাদের প্রথম এবং প্রধান শিক্ষা ভারতী ।
কারও সম্বন্ধেই কটূক্তি করা অন্যায়, কিন্তু অশ্রদ্ধেয়কে শ্রদ্ধা করাও অন্যায়, এমন কি তিনি পূর্বপিতামহ হলেও । এতে মিষ্টতা থাকতে পারে কিন্তু যুক্তি নেই ভারতী, যা কুসংস্কার তাকে পরিত্যাগ করতে শেখো ।
আমরা বিপ্লবী, পুরাতনের মোহ আমাদের জন্য নয় । আমাদের দৃষ্টি, আমাদের গতি, আমাদের লক্ষ্য শুধু সুমুখের দিকে । পুরাতনের ধ্বংস করেই ত শুধু আমাদের পথ করতে হয় । এর মধ্যে মায়া-মমতার অবকাশ কৈ ? জীর্ণ, মৃত পথ জুড়ে থাকলে আমরা পথের-দাবীর পথ পাবো কোথায় ?
পুরাতন মানেই পবিত্র নয়, ভারতী । মানুষ সত্তর বছরের প্রাচীন হয়েছে বলেই সে দশ বছরের শিশুর চেয়ে বেশী পবিত্র হয়ে ওঠে না । তোমার নিজের দিকেই চেয়ে দেখ, মানুষের অবিশ্রাম চলার পথে ভারতের বর্ণাশ্রম ধর্ম ত সকল দিকেই মিথ্যে হয়ে গেছে । ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, কেউ ত আর সে আশ্রম অবলম্বন করে নেই । থাকলে তাকে মরতে হবে । সে যুগের সে বন্ধন আজ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে । তবুও তাকেই পবিত্র মনে করে কে জানো, ভারতী ? ব্রাহ্মণ । চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকেই নিরতিশয় পবিত্র জ্ঞানে করা আঁকড়ে থাকতে চায় জানো ? জমিদার ।
সমস্ত ধর্মই মিথ্যা, --- আদিম দিনের কুসংস্কার । বিশ্বমানবতার এতবড় পরম শত্রু আর নেই ।
কল্যাণ আমার কাম্য নয়, আমার কাম্য স্বাধীনতা ।
এই পরিবর্তনশীল জগতে সত্যোপলব্ধি বলিয়া কোন নিত্যবস্তু নাই । তাহার জন্ম আছে, মৃত্যু আছে, --- যুগে যুগে কালে কালে মানবের প্রয়োজনে তাহাকে নূতন হইয়া আসিতে হয় । অতীতের সত্যকে বর্তমানে স্বীকার করিতেই হইবে এ বিশ্বাস ভ্রান্ত, এ ধারণা কুসংস্কার ।
এই ত বিপ্লবীর চরম শিক্ষা । কান্না কার তরে ? নালিশ কার কাছে ? দাদার যদি ফাঁসি হয়েছে শোনো, যেন বিদেশীর হুকুমে সে ফাঁসি তার দেশের লোকেই তার গলায় বেঁধে দিয়েছে । দেবেই ত ! কসাইখানা থেকে গরুর মাংস গরুতেই ত বয়ে নিয়ে আসে ।
দূর থেকে এসে যারা জন্মভূমি আমার অধিকার করেছে, আমার মনুষ্যত্ব, আমার ক্ষুধার অন্ন, তৃষ্ণার জল, --- সমস্ত যে কেড়ে নিলে তারই রইল আমাকে হত্যা করবার অধিকার, আর রইল না আমার ?
সাহেবের বুটের তলায় চিত হয়ে শুয়ে শান্তির বাণী আমার মুখ দিয়ে ঠিক বার হবে না, --- হয়ত আটকাবে ।
তুমি কবির শ্লোক প্রায় আবৃত্তি করে বল, গিয়াছে দেশ দুঃখ কি, আবার তোরা মানুষ হ । কিন্তু দেশ ফিরে পাবার মত মানুষ হওয়া কাকে বলে শুনি ? ভেবেচ, মানুষ হবার পথ তোমার অবারিত ? মুক্ত ? ভেবেচ, দেশের দরিদ্র নারায়ণের সেবা আর ম্যালেরিয়ার কুইনিন জুগিয়ে বেড়ানোকেই মানুষ হওয়া বলে ? বলে না । মানুষ হয়ে জন্মানোর মর্যাদা-বোধকেই মানুষ হওয়া বলে । মৃত্যুর ভয় থেকে মুক্তি পাওয়াকেই মানুষ হওয়া বলে ।
সভ্যতার যদি কোন তাৎপর্য থাকে ত সে এই যে, অক্ষম ও দুর্বলের ন্যায্য অধিকার যেন প্রবলের গায়ের জোরে পরাভূত না হয় ।
'পথেরদাবী' চাষা-হিতকারিণী প্রতিষ্ঠান নয়, এ আমার স্বাধীনতা অর্জনের অস্ত্র । শ্রমিক এবং কৃষক এক নয় ভারতী । তাই, পাবে আমাকে কুলি-মজুর-কারিকরের মাঝখানে, কারখানার ব্যারাকে, কিন্তু পাবে না খুঁজে পাড়াগাঁয়ে চাষার কুটীরে ।
সংস্কার মানে মেরামত, --- উচ্ছেদ নয় । গুরুভারে যে অপরাধ আজ মানুষের অসহ্য হয়ে উঠেছে তাকেই সুসহ করা ; যে যন্ত্র বিকল হয়ে এসেছে মেরামত করে তাকেই সুপ্রতিষ্ঠিত করার যে কৌশল বোধ হয় তারই নাম শাসন-সংস্কার ।
আইডিয়ার জন্য সর্বস্ব বিসর্জন দিতে পারে শুধু শিক্ষিত ভদ্র-সন্তান, অশিক্ষিত কৃষকে পারে না ।
সকলে কিন্তু সকল কাজের যোগ্য হয় না ।