Thursday, 12 May 2016

সিঙ্গুর - না বলা কথা ।

আজ ১২ই মে ২০১৬ "এই সময়" পত্রিকায় "সিপিএম-কে বামপন্থার পাঠ দিল সুপ্রিম কোর্ট" শীর্ষক খবরটা পড়তে পড়তে বহুদিনের না বলা কিছু কথা বলতে ইচ্ছে হলো । ইতিমধ্যেই ইচ্ছুক অনিচ্ছুক নিয়ে রাজ্য রাজনীতি তোলপাড় - ৩৫ বছর দীর্ঘ সময়কালব্যাপী বামফ্রন্ট সরকার পতন -  বামফ্রন্টের নিজস্ব মূল্যায়নেও সিঙ্গুর আন্দোলন সরকার পতনের একটা প্রধান কারণ হিসাবে উঠে এসেছে - তত্কালীন বিরোধী দল সরকারে এসেই সিঙ্গুর সমস্যার সমাধান করবে বলে কথা দিয়েও কথা রাখেনি - সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ সমস্যা নিয়ে টাটা ও বর্তমান সরকার সুপ্রিম কোর্টে - এসবই আমাদের জানা । "এই সময়" পত্রিকা বলছে  তত্কালীন বিরোধী নেত্রী এটা বলেছিলেন, ওটা বলেছিলেন - উনি কি বলেছিলেন বা কি করতে চেয়েছিলেন এটা নিয়ে এখন আর কোনো প্রশ্ন থাকারই কথা নয় - তত্কালীন বিরোধী নেত্রী ও তার দলের অবস্থান নিয়ে কোনো আলোচনা করতেও চাই না - তাদের ঐকান্তিক কৃষক প্রীতি এই ৫ বছরে আমাদের বারবার দৃষ্টিগোচর হয়েছে ।

আমার প্রশ্নটা অন্য জায়গাতে - গণতন্ত্রে একটা মানুষের অধিকার নিয়ে - টাটা একটা নির্দিষ্ট জায়গাতে কারখানা বানাতে চেয়েছিল - কিন্তু কিছু কৃষক বা ক্ষুদ্র জমির মালিক তাদের স্বল্প চাষের জমি বিক্রি করতে চাননি - জমির পরিমান ৪০০ একর নাকি ৪০ একর - সেটাও প্রশ্ন নয় । প্রশ্নটা হলো - গণতন্ত্রে কোটিপতি ব্যবসায়ী হিসাবে টাটার যেমন একটা চাহিদা আছে - মালিকপক্ষ হিসাবে তার যেমন মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, তেমনই ৫০০০ টাকার জমিতে লাঙ্গল টানা একজন প্রান্তিক কৃষকেরও তার নিজস্ব মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে - গণতান্ত্রিক কাঠামোতে সেটাও ফেলনা নয় । অনিচ্ছুক কৃষকদের সাথে বসে আলোচনার মাধ্যমে অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াটার জটিলতাটাকে কাটিয়ে ওঠা যেত না কি ? মানছি, বিরোধী দল রাজ্যের উন্নয়নের প্রশ্নটাকে সরিয়ে কতিপয় অনিচ্ছুক জমির মালিক্গুলোকে সামনে রেখে শুধুই রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন - কিন্তু বামফ্রন্ট শাসিত রাজ্যে প্রান্তিক কৃষকদের অধিকার ক্ষুন্ন হওয়া কি কোনোভাবেই সমর্থন যোগ্য ?

আমি নিজে একজন কৃষক পরিবারের সদস্য হয়ে মনে করি - আমার ছোট জমিতে আমি চাষ করবো, আমি আমার জমি কোনো কারখানার মালিককে বিক্রি করবো না - আমি আমার জমি বিক্রি করে, জীবিকার সন্ধানে একটা বেসরকারী কারখানায় দারোয়ানের কাজ করবো না - আমাদের দেশের গণতন্ত্র আমাকে আমার নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয় । আর সিঙ্গুর কোনো জনস্বার্থে অধিগ্রহণ নয় - সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ করে কোনো নতুন রাস্তা হতো না, কোনো নতুন রেলপথ গড়ে উঠত না, কোনো নতুন সামরিক বাহিনীর কেন্দ্রও গড়ে উঠত না - কোন দিক থেকে একটা কারখানার মালিকের জন্য জমি অধিগ্রহণকে জনস্বার্থে অধিগ্রহণ বলা যায় ? আমিও জানি রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থে, ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থে কল কারখানা দরকার - কল কারখানার জন্য জমিও চাই - কিন্তু কোনভাবেই কি বহুফসলি জমি অধিগ্রহণ এড়ানো যেত না ?

বর্তমান সরকারের জমি অধিগ্রহণ নীতি অনুযায়ী সরকার শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করে দেবে না - মালিকপক্ষকে নিজের জমির ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হবে । একটা এলাকাতে ২০০০ জনের জমি থাকলে, মালিকপক্ষকে ২০০০ মানুষের সাথে দরাদরি করতে হবে - এটা অবাস্তব -  প্রধানত এই জমি অধিগ্রহণ নীতির কারণেই বিগত ৫ বছরে পশ্চিমবঙ্গ একটাও বড় শিল্পের মুখ দেখেনি । যদি মালিকপক্ষ এই জমি অধিগ্রহণ নীতি মেনেও নেন - তাহলে শিল্পপতি আর ক্ষুদ্র জমির মালিকের মধ্যে ঢুকবে জমির মাফিয়া, সিন্ডিকেট - আখেরে প্রতারিত হবেন প্রান্তিক কৃষকেরা । তাই প্রান্তিক কৃষকদের স্বার্থরক্ষার প্রশ্নে রাজ্য সরকারেরই মধ্যস্থতা বাঞ্চনীয় । তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জমি অধিগ্রহণ পদ্ধতিতে ভুল থাকতে পারে - কিন্তু তাঁর ও বামফ্রন্ট সরকারের সদিচ্ছা সংশয়াতীত - কিন্তু কোথাও যেন একটা ভুল হয়ে গেল - যার মাসুল আজও দিতে হচ্ছে আমাদের সবাইকে । পড়াশোনা শেষ করেই অন্য রাজ্যে পাড়ি দাও - বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে এক নিঃসঙ্গ জীবনকে নিয়ে চলতে হচ্ছে আমাদের যুবসমাজকে - সেটা অবশ্যই কাম্য নয়  । সিঙ্গুর প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পশ্চিমবঙ্গ শিল্পায়নে একটা জোয়ার আসতো - যা সকলের মত আমারও স্বপ্ন । পশ্চিমবঙ্গের মত কৃষিনির্ভরশীল রাজ্যে যেখানে ক্ষুদ্র জমির মালিকানা বেশি - সেখানে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াটা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেকাংশেই জটিল । কিন্তু বামপন্থী শাসিত একটি রাজ্যে সামান্য একটি কৃষকেরও স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়াটা কি বাঞ্চনীয় ?

প্রক্রিয়াগতভাবে অবশ্যই ভুল হয়েছে কিন্তু সমস্যা সমাধানে বামফ্রন্ট সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল - কিছু বাধাকে সেসময় প্রতিহত করা যায়নি  - কিন্তু থেমে যাওয়া যাবে না - এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই ভবিষ্যতের দিকে এগোতে হবে । ২০১৬ বিধানসভা ভোটে জয়ী হলে বামফ্রন্ট ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক জোট অবশ্যই শিল্পের প্রতি মনোযোগী হবে - বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে এটাই জনগনের প্রত্যাশা । আশা রাখি - নতুন সরকার জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে অনেক বেশি সংবেদনশীল হবে, কোনভাবেই কৃষকের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে না আর সিঙ্গুরবাসীও  আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানে উত্সাহী হবেন ।


ধীমান 

No comments:

Post a Comment