বামফ্রন্ট সাফল্যকে অনুধাবন করতে ব্যাপক তথ্যাবলীর চেয়ে জীবনের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু কোন মানুষই জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে কখনো বিচরণ করতে পারেন না, তাই কেবলমাত্র ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে ব্যাপকতম সত্যকে স্পর্শ করা সম্ভব নয় । তবে সমাজজীবনের বৃহত্তর অংশগুলির জন্য কোন ইতিবাচক কাজ হলে তার পরোক্ষ প্রভাব সমাজের সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে । পশ্চিমবাংলায় সে অনুভব এত প্রত্যক্ষ ও স্পষ্ট যে, অজস্র মিথ্যা প্রচারেও সেগুলিকে নিষ্প্রভ করা যায়নি । কেননা এখানে উন্নয়নের সুফলে উপকৃত সর্বজনীন মানুষ । তবে ভিন্ন একটু মাধ্যম ও মাত্রা রয়েছে যার নিরিখে অনেক সময়ই সত্যকে চিন্হিত করা যায় । তা হলো বিবেচ্য বিষয় প্রসঙ্গে তৃতীয় কোন নিরপেক্ষ অভিজ্ঞতা ও অভিমত । তৃতীয় পক্ষ অর্থে তেমন অংশের মানুষ বা প্রতিষ্ঠান যে বা যারা ঘটনাবলীর দাতা ও গ্রহীতা না, দূরের অবলোকনকারী বা সমীক্ষক । পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্য উপলব্ধিতে সংক্ষেপে এমন নিরিখ কিছুটা লক্ষ্য করা যাক ----
১) সাধারণ মানুষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও রাজ্যের সাফল্য সমগ্র দেশ তথা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে । বিশেষ করে দারিদ্র দূরীকরণে এ রাজ্যের অভাবনীয় সাফল্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে বহুল আলোচিত বিষয় । রাষ্ট্রসংঘের দারিদ্রতা সম্পর্কিত প্রতিবেদনে পশ্চিমবঙ্গের সাফল্য প্রশংসিত হয়েছে । রাষ্ট্রসংঘ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রশংসা করেই ক্ষান্ত হয়নি অন্যদের অনুরূপ পথে চলার পরামর্শ দিয়েছে ।
২) ২০০০ সালের ৩১শে জানুয়ারি প্রকাশিত বিশ্বব্যাঙ্কের "ভারত : দারিদ্র্য দূরীকরণ, উন্নয়ন, উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণ" রিপোর্টে ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে দ্রুততার সঙ্গে দারিদ্র প্রমশনের ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর কারণও চিন্হিত করা হয়েছে । বলা হয়েছে পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে এই সময়ে ভূমিসংস্কার ও উচ্চহারে কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । এরই পাশাপাশি রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্পর্কে রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়, "বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা রাষ্ট্রায়ত্ত স্বাস্থ্য পরিষেবার বিশ্বাসযোগ্যতা কয়েকটি রাজ্যে বাড়িয়েছে - উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা" ।
৩) একদা ভারতের যোজনা কমিশনের অন্যতম সদস্য মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়া ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাপ্লায়েড ইকনেমিক রিসার্চের সুবর্ণজয়ন্তী বক্তৃতায় দেশের প্রধান ১৪ টি রাজ্যের (যেখানে ৯৫ শতাংশ মানুষ বাস করেন) উন্নয়নের তুলনামূলক ব্যাখ্যা করেন । সেখানে তুলে ধরা হয়েছে "১৯৮০-৮১ সাল থেকে ১৯৯০-৯১ সাল (৮০-র দশক) এবং ১৯৯০-৯১ সাল থেকে ১৯৯৭-৯৮ সালের (৯০-এর দশক) মধ্যে ১৪ টি রাজ্যের উন্নয়নমূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে । ঐ রিপোর্ট থেকে দেখা গেছে ৮০-র দশকে মোট আভ্যন্তরীণ উত্পাদন বৃদ্ধির হারের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল দশম । ৯০-এর দশকে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, কর্নাটক, তামিলনাডু, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ এবং রাজস্থানকে অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গ তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে । মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের পরই পশ্চিমবঙ্গের স্থান । মাথাপিছু রাজ্যের মোট আভ্যন্তরীণ উত্পাদন বৃদ্ধির দিক থেকে ৮০-এর দশকে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল একাদশ । ৯০-এর দশকে উঠে এসেছে তৃতীয় স্থানে, মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের পরেই ।
৪) হল্যান্ডের আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জি কে লিটেন এক দীর্ঘ গবেষণামূলক প্রবন্ধে লিখেছেন "অনেক পর্যবেক্ষকের কাছে এটা বিস্ময়কর যে, পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট প্রধান বামফ্রন্ট সরকার এখন প্রায় দুই দশক হলো ক্ষমতায় রয়েছে । এই সরকার অনেকগুলি জাতীয়, প্রাদেশিক ও স্থানীয় স্তরের নির্বাচনের পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে । ভারতীয় রাজনীতির ক্রমবর্ধমান ঘূর্ণাবর্তের মধ্যেও তা অবিচল রয়েছে । অবজ্ঞামূলক অস্বীকৃতি এবং নিঃশর্ত প্রশস্তি, এই দুই চরমাবস্থা কাটিয়ে একজন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক সরাসরি স্বীকার করে নিতে পারেন যে, পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ভালই কাজ করেছে এবং সেটাই হলো তার সাফল্যের উত্সস্বরূপ"।
৫) দেশের অন্যতম বনিকসভা - অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার অব কমার্স বিভিন্ন রাজ্যের উত্পাদন বৃদ্ধির হার সম্পর্কে একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে । তাতে ৮০-র দশক এবং ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যে বিভিন্ন রাজ্যের অভ্যন্তরীণ উত্পাদন বৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে তুলে ধরা হয়েছে । তাতে দেখা গেছে আলোচ্য সময়ে গড় উত্পাদন বৃদ্ধির হার বিহারে ১.৭৯ শতাংশ, পাঞ্জাবে ০.৬৯ শতাংশ, রাজস্থানে ০.৬ শতাংশ কমেছে । এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ । ৮০-র দশকের তুলনায় ৯০-র দশকে (১৯৯১-১৯৯৮) পশ্চিমবঙ্গে উত্পাদন বৃদ্ধির হার ৪.৭১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৬.৯১ শতাংশ হয়েছে ।
৬) রাষ্ট্রসংঘের অ্যাটাকিং পর্ভাটি রিপোর্ট (২০০০-০১) পশ্চিমবঙ্গের বর্গা অপারেশন-এর প্রশংসা করা হয়েছে ।
৭) পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সারা দেশের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে । শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা পরিচালিত বিকেন্দ্রীকৃত ব্যবস্থার প্রসারের এবং কর্মসূচির সুষ্ঠ রূপায়ণের ফলে কমেছে গ্রামীণ দারিদ্রতা । বিশ্বব্যাঙ্ক পশ্চিমবঙ্গের ভূমিকাকে প্রশংসা করে পশ্চিমবঙ্গকে অভিহিত করেছিল "leader state" হিসাবে ।
৮) কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ শৌরী কর্তিক প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে, ১৯৯৩-৯৪ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক বিকাশের হার পশ্চিমবঙ্গে সর্বাধিক । আলোচ্য সময়ে অর্থনৈতিক বিকাশের হার কমেছে অন্ধ্রপ্রদেশে ৮৩ শতাংশ, দিল্লিতে ৪০.২ শতাংশ, পাঞ্জাবে ৩৫ শতাংশ এবং উত্তর প্রদেশে ৪ শতাংশ । আর বেড়েছে ওড়িশায় ১.০২ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৫.৫৮ শতাংশ,বিহারে ১৮ শতাংশ, মহারাষ্ট্রে ২২ শতাংশ, রাজস্থানে ৫০ শতাংশ, কর্নাটকে ৮৫ শতাংশ, তামিলনাড়ুতে ৮৮ শতাংশ, ত্রিপুরায় ১০১ শতাংশ, গুজরাটে ১২১ শতাংশ এবং কেরালায় ১৪০ শতাংশ বেড়েছে । পশ্চিমবঙ্গে বেড়েছে সর্বাধিক হারে ১৮০ শতাংশ ।
৯) পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সাফল্য প্রসঙ্গে ভূয়শী প্রশংসা করেছেন বিশ্ববিখ্যাত পন্ডিত, বিশেষজ্ঞ, গবেষক নোয়াম চমস্কি ।
১০) পশ্চিমবঙ্গের সাক্ষরতার কর্মসূচীর বিপুল সাফল্যের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসাবে ইউনেস্কো পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে পুরস্কৃত করেছে ।
১১) ১৯৮৯ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত পূর্বাঞ্চল ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের সমস্ত রাজ্যগুলির পঞ্চায়েতরাজ সম্মেলনের উদ্বোধন করতে এসে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত রাজীব গান্ধী বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এবং বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগকে প্রশংসা করে তাকে সমগ্র দেশের 'মডেল' হিসাবেই চিন্হিত করেছিলেন ।
১২) সামাজিক বনসৃজনের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করে বনরক্ষার সাফল্যের জন্য বামফ্রন্ট সরকার অর্জন করে আন্তর্জাতিক সন্মান 'পল গেটি পদক' ।
১৩) পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসঙ্গে প্রতীচী ট্রাস্ট ২০১০ সালে একটি সমীক্ষা করে । ঐ সমীক্ষার ভিত্তিতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন যে মন্তব্য করেছেন তাহা এখানে উল্লেখ করা হলো : প্রথমত --- "শুধু ছাত্র ভর্তির সংখ্যাই বেশী নয়, ছাত্রদের উপস্থিতির গড়ও উল্লেখযোগ্য । (প্রাথমিক স্কুলে ও শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে যথাক্রমে ৫৮ শতাংশ এবং ৬৪ শতাংশ থেকে বেড়ে উভয় ক্ষেত্রেই ৭৫ শতাংশ হয়েছে)" । দ্বিতীয়ত --- "শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অবদান সম্পর্কে অবদান সম্পর্কে পিতামাতাদের সন্তুষ্টির মাত্রা বেড়েছে । (প্রাথমিক স্কুলের ক্ষেত্রে ৫২ শতাংশ থেকে ৬৪ শতাংশ এবং শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের ক্ষেত্রে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ) । যদিও সামগ্রিক সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এখনও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে । সন্তানদের উন্নতির ক্ষেত্রেও পিতামাতারা আগের থেকে অনেক বেশী সন্তুষ্ট । (প্রাথমিক স্কুলে ৪২ শতাংশ থেকে ৭১ শতাংশ, শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের ক্ষেত্রে ৪৯ শতাংশ থেকে ৭৩ শতাংশ)" । তৃতীয়ত --- "২০০১-০২ সালে ছাত্ররা কে কতটা শিখেছে, তার উপর সমীক্ষা চালাতে গিয়ে আমরা প্রতিটি ছাত্রের আলাদা আলাদা করে পরীক্ষা নিয়েছিলাম । আমরা দেখেছিলাম এমনকি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রদের ৩০ শতাংশ নিজের নাম লিখতে পারে না ।এতে আমরা খুবই আশাহত হয়েছিলাম । কিন্তু এখন এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে । বর্তমানে এই সংখ্যা ৩০ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৫ শতাংশ । (যদিও সংখ্যাটি শূন্য হওয়াটাই কাম্য, কিন্তু এই সংখ্যাটি হ্রাস পাওয়াও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়)" । চতুর্থত --- "এখন বেশিরভাগ প্রাথমিক স্কুল ও শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে মিড ডে মিল দেওয়া হয় । স্কুলগুলিতে শিক্ষা ও ছাত্রদের পুষ্টি বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা-ও স্পষ্ট । স্কুলে মিল দেওয়ার জন্য অবশ্যই ছাত্রদের উপস্থিতির হার বৃদ্ধি পেয়েছে । আবার শিক্ষকদের সংগঠনগুলিও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনুপস্থিতি কমাতে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে । এই উদ্যোগের ফলেও বহু অঞ্চলে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে" । পঞ্চমত ---"শিক্ষকদের সঙ্গে বাবা-মায়েদের সাক্ষাত এখন অনেক বেশী বাস্তবায়িত হচ্ছে । বিশেষ করে মা ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়ে কমিটি তৈরী হচ্ছে । তা সত্ত্বেও এঁদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতির ব্যাপারে আমাদের নির্দিষ্ট কিছু পরামর্শ আছে" । "স্কুল শিক্ষার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে " ।
১৪) প্রবীণ চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন বলেছেন - "প্রায় ৩৫ বছর ধরে আমি এই বামফ্রন্টকে দেখছি, দেখে আসছি ১৯৭৭ সাল থেকে কিভাবে এই দলটি নিয়মিত পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে নিজেদের গড়ে তুলেছে । প্রত্যাবর্তন কিন্তু পরিবর্তনের ভিতর দিয়েই হয় । সহজ স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দ জীবন পেয়েছে সাধারণ মানুষ এই বামফ্রন্টের আমলেই । নতুন রাস্তাঘাট, ব্রিজ থেকে ছোট-বড় অনেক কাজই করেছে এই সরকার । সেই সঙ্গে আমি তো অবশ্যই বলব যে, শিল্পী-সাহিত্যিকতা সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছেন এই বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই । সিনেমার কর্মী হিসাবে আমি যেমন নন্দন-এর কথা উল্লেখ না করে পারছি না । আমার বিদেশী বন্ধুবান্ধবের যাঁরাই এসে দেখেছেন, বলেছেন, আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা কমপ্লেক্স । রক্ষনাবেক্ষণ নিয়ে সমস্যা তো থাকতেই পারে । নন্দন তৈরি হয়েছিল জ্যোতি বসুর আমলে, তারপর বিশেষ করে বুদ্ধদেব যথেষ্ট মাথা ঘামিয়েছেন নন্দন-এর সূত্রে সিনেমার উন্নত সংস্কৃতি এ-রাজ্যে তৈরি করতে । সব পরিকল্পনা হয়তো বাস্তবে রূপায়িত হয়নি । তা নিয়ে আমার একটু অস্বস্তি ছিল, বেশ ছিল । বলে রাখা ভাল, আমি কিন্তু কোন বামপন্থী দলের সভ্য নই । কমিউনিস্ট পার্টি যখন অবিভক্ত চিলম তখনও আমি তাদের মেম্বার বা কার্ডহোল্ডার --- কিছুই ছিলাম না । তাছাড়া এই বামফ্রন্টের দলীয় মত কোন ভাবেই আমার উপর বিস্তার করে না । আরও স্পষ্ট করে বলা ভাল, আমার ভাবনাচিন্তা কাজকর্মের ব্যাপারে আমি কখনই তাদের মতামতের অপেক্ষায় থাকি না " ।
১) সাধারণ মানুষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও রাজ্যের সাফল্য সমগ্র দেশ তথা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে । বিশেষ করে দারিদ্র দূরীকরণে এ রাজ্যের অভাবনীয় সাফল্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে বহুল আলোচিত বিষয় । রাষ্ট্রসংঘের দারিদ্রতা সম্পর্কিত প্রতিবেদনে পশ্চিমবঙ্গের সাফল্য প্রশংসিত হয়েছে । রাষ্ট্রসংঘ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রশংসা করেই ক্ষান্ত হয়নি অন্যদের অনুরূপ পথে চলার পরামর্শ দিয়েছে ।
২) ২০০০ সালের ৩১শে জানুয়ারি প্রকাশিত বিশ্বব্যাঙ্কের "ভারত : দারিদ্র্য দূরীকরণ, উন্নয়ন, উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণ" রিপোর্টে ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে দ্রুততার সঙ্গে দারিদ্র প্রমশনের ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর কারণও চিন্হিত করা হয়েছে । বলা হয়েছে পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে এই সময়ে ভূমিসংস্কার ও উচ্চহারে কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । এরই পাশাপাশি রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্পর্কে রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়, "বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা রাষ্ট্রায়ত্ত স্বাস্থ্য পরিষেবার বিশ্বাসযোগ্যতা কয়েকটি রাজ্যে বাড়িয়েছে - উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা" ।
৩) একদা ভারতের যোজনা কমিশনের অন্যতম সদস্য মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়া ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাপ্লায়েড ইকনেমিক রিসার্চের সুবর্ণজয়ন্তী বক্তৃতায় দেশের প্রধান ১৪ টি রাজ্যের (যেখানে ৯৫ শতাংশ মানুষ বাস করেন) উন্নয়নের তুলনামূলক ব্যাখ্যা করেন । সেখানে তুলে ধরা হয়েছে "১৯৮০-৮১ সাল থেকে ১৯৯০-৯১ সাল (৮০-র দশক) এবং ১৯৯০-৯১ সাল থেকে ১৯৯৭-৯৮ সালের (৯০-এর দশক) মধ্যে ১৪ টি রাজ্যের উন্নয়নমূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে । ঐ রিপোর্ট থেকে দেখা গেছে ৮০-র দশকে মোট আভ্যন্তরীণ উত্পাদন বৃদ্ধির হারের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল দশম । ৯০-এর দশকে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, কর্নাটক, তামিলনাডু, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ এবং রাজস্থানকে অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গ তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে । মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের পরই পশ্চিমবঙ্গের স্থান । মাথাপিছু রাজ্যের মোট আভ্যন্তরীণ উত্পাদন বৃদ্ধির দিক থেকে ৮০-এর দশকে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল একাদশ । ৯০-এর দশকে উঠে এসেছে তৃতীয় স্থানে, মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের পরেই ।
৪) হল্যান্ডের আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জি কে লিটেন এক দীর্ঘ গবেষণামূলক প্রবন্ধে লিখেছেন "অনেক পর্যবেক্ষকের কাছে এটা বিস্ময়কর যে, পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট প্রধান বামফ্রন্ট সরকার এখন প্রায় দুই দশক হলো ক্ষমতায় রয়েছে । এই সরকার অনেকগুলি জাতীয়, প্রাদেশিক ও স্থানীয় স্তরের নির্বাচনের পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে । ভারতীয় রাজনীতির ক্রমবর্ধমান ঘূর্ণাবর্তের মধ্যেও তা অবিচল রয়েছে । অবজ্ঞামূলক অস্বীকৃতি এবং নিঃশর্ত প্রশস্তি, এই দুই চরমাবস্থা কাটিয়ে একজন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক সরাসরি স্বীকার করে নিতে পারেন যে, পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ভালই কাজ করেছে এবং সেটাই হলো তার সাফল্যের উত্সস্বরূপ"।
৫) দেশের অন্যতম বনিকসভা - অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার অব কমার্স বিভিন্ন রাজ্যের উত্পাদন বৃদ্ধির হার সম্পর্কে একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে । তাতে ৮০-র দশক এবং ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যে বিভিন্ন রাজ্যের অভ্যন্তরীণ উত্পাদন বৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে তুলে ধরা হয়েছে । তাতে দেখা গেছে আলোচ্য সময়ে গড় উত্পাদন বৃদ্ধির হার বিহারে ১.৭৯ শতাংশ, পাঞ্জাবে ০.৬৯ শতাংশ, রাজস্থানে ০.৬ শতাংশ কমেছে । এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ । ৮০-র দশকের তুলনায় ৯০-র দশকে (১৯৯১-১৯৯৮) পশ্চিমবঙ্গে উত্পাদন বৃদ্ধির হার ৪.৭১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৬.৯১ শতাংশ হয়েছে ।
৬) রাষ্ট্রসংঘের অ্যাটাকিং পর্ভাটি রিপোর্ট (২০০০-০১) পশ্চিমবঙ্গের বর্গা অপারেশন-এর প্রশংসা করা হয়েছে ।
৭) পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সারা দেশের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে । শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা পরিচালিত বিকেন্দ্রীকৃত ব্যবস্থার প্রসারের এবং কর্মসূচির সুষ্ঠ রূপায়ণের ফলে কমেছে গ্রামীণ দারিদ্রতা । বিশ্বব্যাঙ্ক পশ্চিমবঙ্গের ভূমিকাকে প্রশংসা করে পশ্চিমবঙ্গকে অভিহিত করেছিল "leader state" হিসাবে ।
৮) কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ শৌরী কর্তিক প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে, ১৯৯৩-৯৪ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক বিকাশের হার পশ্চিমবঙ্গে সর্বাধিক । আলোচ্য সময়ে অর্থনৈতিক বিকাশের হার কমেছে অন্ধ্রপ্রদেশে ৮৩ শতাংশ, দিল্লিতে ৪০.২ শতাংশ, পাঞ্জাবে ৩৫ শতাংশ এবং উত্তর প্রদেশে ৪ শতাংশ । আর বেড়েছে ওড়িশায় ১.০২ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৫.৫৮ শতাংশ,বিহারে ১৮ শতাংশ, মহারাষ্ট্রে ২২ শতাংশ, রাজস্থানে ৫০ শতাংশ, কর্নাটকে ৮৫ শতাংশ, তামিলনাড়ুতে ৮৮ শতাংশ, ত্রিপুরায় ১০১ শতাংশ, গুজরাটে ১২১ শতাংশ এবং কেরালায় ১৪০ শতাংশ বেড়েছে । পশ্চিমবঙ্গে বেড়েছে সর্বাধিক হারে ১৮০ শতাংশ ।
৯) পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সাফল্য প্রসঙ্গে ভূয়শী প্রশংসা করেছেন বিশ্ববিখ্যাত পন্ডিত, বিশেষজ্ঞ, গবেষক নোয়াম চমস্কি ।
১০) পশ্চিমবঙ্গের সাক্ষরতার কর্মসূচীর বিপুল সাফল্যের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসাবে ইউনেস্কো পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে পুরস্কৃত করেছে ।
১১) ১৯৮৯ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত পূর্বাঞ্চল ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের সমস্ত রাজ্যগুলির পঞ্চায়েতরাজ সম্মেলনের উদ্বোধন করতে এসে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত রাজীব গান্ধী বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এবং বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগকে প্রশংসা করে তাকে সমগ্র দেশের 'মডেল' হিসাবেই চিন্হিত করেছিলেন ।
১২) সামাজিক বনসৃজনের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করে বনরক্ষার সাফল্যের জন্য বামফ্রন্ট সরকার অর্জন করে আন্তর্জাতিক সন্মান 'পল গেটি পদক' ।
১৩) পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসঙ্গে প্রতীচী ট্রাস্ট ২০১০ সালে একটি সমীক্ষা করে । ঐ সমীক্ষার ভিত্তিতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন যে মন্তব্য করেছেন তাহা এখানে উল্লেখ করা হলো : প্রথমত --- "শুধু ছাত্র ভর্তির সংখ্যাই বেশী নয়, ছাত্রদের উপস্থিতির গড়ও উল্লেখযোগ্য । (প্রাথমিক স্কুলে ও শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে যথাক্রমে ৫৮ শতাংশ এবং ৬৪ শতাংশ থেকে বেড়ে উভয় ক্ষেত্রেই ৭৫ শতাংশ হয়েছে)" । দ্বিতীয়ত --- "শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অবদান সম্পর্কে অবদান সম্পর্কে পিতামাতাদের সন্তুষ্টির মাত্রা বেড়েছে । (প্রাথমিক স্কুলের ক্ষেত্রে ৫২ শতাংশ থেকে ৬৪ শতাংশ এবং শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের ক্ষেত্রে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ) । যদিও সামগ্রিক সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এখনও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে । সন্তানদের উন্নতির ক্ষেত্রেও পিতামাতারা আগের থেকে অনেক বেশী সন্তুষ্ট । (প্রাথমিক স্কুলে ৪২ শতাংশ থেকে ৭১ শতাংশ, শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের ক্ষেত্রে ৪৯ শতাংশ থেকে ৭৩ শতাংশ)" । তৃতীয়ত --- "২০০১-০২ সালে ছাত্ররা কে কতটা শিখেছে, তার উপর সমীক্ষা চালাতে গিয়ে আমরা প্রতিটি ছাত্রের আলাদা আলাদা করে পরীক্ষা নিয়েছিলাম । আমরা দেখেছিলাম এমনকি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রদের ৩০ শতাংশ নিজের নাম লিখতে পারে না ।এতে আমরা খুবই আশাহত হয়েছিলাম । কিন্তু এখন এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে । বর্তমানে এই সংখ্যা ৩০ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৫ শতাংশ । (যদিও সংখ্যাটি শূন্য হওয়াটাই কাম্য, কিন্তু এই সংখ্যাটি হ্রাস পাওয়াও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়)" । চতুর্থত --- "এখন বেশিরভাগ প্রাথমিক স্কুল ও শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে মিড ডে মিল দেওয়া হয় । স্কুলগুলিতে শিক্ষা ও ছাত্রদের পুষ্টি বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা-ও স্পষ্ট । স্কুলে মিল দেওয়ার জন্য অবশ্যই ছাত্রদের উপস্থিতির হার বৃদ্ধি পেয়েছে । আবার শিক্ষকদের সংগঠনগুলিও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনুপস্থিতি কমাতে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে । এই উদ্যোগের ফলেও বহু অঞ্চলে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে" । পঞ্চমত ---"শিক্ষকদের সঙ্গে বাবা-মায়েদের সাক্ষাত এখন অনেক বেশী বাস্তবায়িত হচ্ছে । বিশেষ করে মা ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়ে কমিটি তৈরী হচ্ছে । তা সত্ত্বেও এঁদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতির ব্যাপারে আমাদের নির্দিষ্ট কিছু পরামর্শ আছে" । "স্কুল শিক্ষার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে " ।
১৪) প্রবীণ চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন বলেছেন - "প্রায় ৩৫ বছর ধরে আমি এই বামফ্রন্টকে দেখছি, দেখে আসছি ১৯৭৭ সাল থেকে কিভাবে এই দলটি নিয়মিত পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে নিজেদের গড়ে তুলেছে । প্রত্যাবর্তন কিন্তু পরিবর্তনের ভিতর দিয়েই হয় । সহজ স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দ জীবন পেয়েছে সাধারণ মানুষ এই বামফ্রন্টের আমলেই । নতুন রাস্তাঘাট, ব্রিজ থেকে ছোট-বড় অনেক কাজই করেছে এই সরকার । সেই সঙ্গে আমি তো অবশ্যই বলব যে, শিল্পী-সাহিত্যিকতা সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছেন এই বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই । সিনেমার কর্মী হিসাবে আমি যেমন নন্দন-এর কথা উল্লেখ না করে পারছি না । আমার বিদেশী বন্ধুবান্ধবের যাঁরাই এসে দেখেছেন, বলেছেন, আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা কমপ্লেক্স । রক্ষনাবেক্ষণ নিয়ে সমস্যা তো থাকতেই পারে । নন্দন তৈরি হয়েছিল জ্যোতি বসুর আমলে, তারপর বিশেষ করে বুদ্ধদেব যথেষ্ট মাথা ঘামিয়েছেন নন্দন-এর সূত্রে সিনেমার উন্নত সংস্কৃতি এ-রাজ্যে তৈরি করতে । সব পরিকল্পনা হয়তো বাস্তবে রূপায়িত হয়নি । তা নিয়ে আমার একটু অস্বস্তি ছিল, বেশ ছিল । বলে রাখা ভাল, আমি কিন্তু কোন বামপন্থী দলের সভ্য নই । কমিউনিস্ট পার্টি যখন অবিভক্ত চিলম তখনও আমি তাদের মেম্বার বা কার্ডহোল্ডার --- কিছুই ছিলাম না । তাছাড়া এই বামফ্রন্টের দলীয় মত কোন ভাবেই আমার উপর বিস্তার করে না । আরও স্পষ্ট করে বলা ভাল, আমার ভাবনাচিন্তা কাজকর্মের ব্যাপারে আমি কখনই তাদের মতামতের অপেক্ষায় থাকি না " ।
No comments:
Post a Comment