Thursday, 7 September 2017

মনুসংহিতা এবং নারী

মনুর চোখে শূদ্র যেমন অপূর্ণ মানব, নারীও তাই । মনুসংহিতার বহু শ্লোকে নারী ও শূদ্র একই সাথে উচ্চারিত । যা শূদ্রের জন্যে নিষেধ তা নারীর জন্যেও নিষেধ । তাদের জন্যে একই বিধি-বিধান ।

মনুর ধর্মশাস্ত্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিল কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদ । মনুর কালের আগেই কর্মবাদ বৈধতা পেয়ে গিয়েছিল । পরে তার সাথে যুক্ত করা হয় জন্মান্তরবাদের তত্ত্বকে । মনুর ধর্মশাস্ত্র এই দুই মতবাদকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে । এই জন্মে দেবতারূপ দ্বিজ ও পতির সেবায় ত্রুটি ঘটলে পরজন্মে শুভ্রও নারীকে আরও হীনপশুযোনিতে জন্ম নিতে হবে । ব্রাহ্মণ্যধর্মের কুটিল উদ্ভাবনে কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদের গোলকধাঁধা থেকে শূদ্র যেমন মুক্তি পায়নি, নারীও পায়নি ।

মনুসংহিতার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন । সেই শ্রেষ্ঠত্ব প্রায় দেবত্বের সমপর্যায়ের । কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায় । নিজেরা ভূতলস্থ দেবতার মর্যাদা গ্রহণ করেও, কেন তারা নিজেদের জননী-জায়া-ভগ্নী-কন্যা-বধূদের দেবীর মর্যাদায় ওপরে তুললেন না ? কেন তাদের নামিয়ে দিলেন দাসীর সমপর্যায়ে ? মনু ব্রাহ্মণ নারী ও শূদ্রা নারীর মধ্যে কোনও পার্থক্য রাখেননি । মনু সব বর্ণের নারীর জন্যে একই বিধান রেখে গেছেন । মনু নিজেদের পরিবারের নারীদেরও হীন অবস্থানে নামিয়ে দিয়েছিলেন অন্য বর্ণের নারীদের সাথে । এতটাই ছিল মনুর নারী বিদ্বেষ । মনু শুধু ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য নয়, পুরুষতন্ত্রও সুপ্রতিষ্ঠিত করে গেছেন । তাঁর ধর্মশাস্ত্র সেই আধিপত্যবাদের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ।

==================================================================
"মানবধর্মশাস্ত্র" মনুসংহিতা 

মনুসংহিতা সম্পূর্ণরূপে আচরণগত বিধি নির্দেশক শাস্ত্রগ্রন্থ । মনুসংহিতাকে বলা হয়েছে মানবধর্মশাস্ত্র । ভারতীয় সমাজ সংগঠনভুক্ত মানবসমষ্টির সব নরনারী জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কীভাবে চলবে, কোন পরিস্থিতিতে নর-নারীর কী করণীয় আর কী বর্জনীয়, তাদের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীরাই বা তাদের জন্যে কী করবেন, কোন স্খলন বা অপরাধের জন্যে কোন শাস্তি বা প্রায়শ্চিত্ত, সব ব্যাপারেই বিশদ বিধি-বিধান দিয়ে গেছেন মনু ।

==================================================================
মনুসংহিতা মানবীশাস্ত্র নয় 

বর্ণবাদে বিভক্ত ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় নারীর সামাজিক অবস্থান কখনও মর্যাদার ছিল না । সব ধর্মশাস্ত্র, স্মৃতি পুরাণেই নারীকে দেখানো হয়েছে হীনজন্মারূপে । নারীকে স্থান দেওয়া হয়েছে শূদ্র ও পশুর সাথে । মনুসংহিতার বহু শ্লোকে নারী ও শূদ্র একইসাথে উচ্চারিত ।

সুঙ্গযুগ থেকে গুপ্তযুগ-এর কালে রাষ্ট্রশক্তির সহায়তায় প্রাচীনতর বেদ ও বেদোত্তর অনুশাসনগুলির নতুনভাবে বিন্যাসের প্রয়োজন দেখা দেয় । এই উদ্দেশ্যেই আনুমানিক এই কালপর্বে মনুসংহিতা সংকলিত হয় । কল্যাণী বন্দোপাধ্যায় মনে করেন, "এই সময় বিভিন্ন বিধর্মী গোষ্ঠীর আগ্রাসন এবং বেদবিরোধী বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রসারের ফলে হিন্দুধর্মের এক সংকটকাল উপস্থিত হয় । তাই হিন্দুধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে রচিত হয় স্মৃতিশাস্ত্র অথবা ধর্মশাস্ত্র । যার অনুশাসন ছিল অপেক্ষাকৃত কঠোর এবং অনেক সময় নিষ্ঠুর ।"

কল্যাণী বন্দোপাধ্যায় মনে করেন মানবধর্মশাস্ত্র "মনুসংহিতার যুগেই নারীকে সামগ্রিকভাবে পুরুষের পদানত করে প্রায় পশুতে পরিণত করার কাজটি সম্পূর্ণ হয় । যদিও এর প্রেক্ষাপট আগেই কিছুটা তৈরী হয়েছিল ।"

অন্য একটি গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন, "প্রাচীনকাল থেকে হিন্দুশাস্ত্রের অনুশাসন অনুযায়ী ভারতীয় আর্থসামাজিক কাঠামোতে সর্বত্র সাধারণভাবে নারীকে শূদ্রের এবং পশুর সাথে একাসনে বসানো হয়েছে । বৈদিক যুগেও এর কোন ব্যতিক্রম ছিল না । শতপথ ব্রাহ্মণে নারীকে শুধু শূদ্র নয়, কুকুর এবং কালো পাখির (কাক) সঙ্গে তুলনা করে সবাইকে "অনৃত" বা "মিথ্যা" বলে ঘোষণা করা হয়েছে । স্মৃতিশাস্ত্রের প্রধান প্রবক্তা মনুও নারীকে "মিথ্যার মতই অপবিত্র" আখ্যা দিয়েছিলেন । ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণ নিজেই যে চাতুর্বর্ণ্য সৃষ্টি করেছেন এ কথা বলার সময় প্রসঙ্গত আরও বলেছেন যে বৈশ্য, শূদ্র এবং নারী প্রভৃতি "পাপযোনি"রা তাঁকে আশ্রয় করেই পরমগতি লাভ করে । অর্থাৎ বৈশ্য, শূদ্র এবং নারী সবাই এক স্থানীয় এবং পাপী । পরবর্তীকালে অনেক পুরাণেও প্রায় একই কথা শোনা যায় । উদাহরণস্বরূপ আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে খ্রিস্ট পরবর্তী পঞ্চম শতকের মধ্যে রচিত বায়ু পুরাণে বলা হয়েছে যে পাপী, বৈশ্য, স্ত্রী (নারী) ও শূদ্র যদি একটি "গোপন স্তব" শোনে, তবে তারা রুদ্রলোকে (স্বর্গে) যায় । অর্থাৎ  বৈশ্য, শূদ্র, নারী এবং পাপী সবাই পরস্পরের সাথে তুলনীয় এবং নিম্নস্তরের জীব (যারা সাধারণভাবে স্বর্গে যাবার অধিকারী নয়) ।

কল্যাণী বন্দোপাধ্যায় আরো দেখিয়েছেন, যে উপনিষদে শুধু দার্শনিক তত্ত্বই রয়েছে বলে মনে করা হয়, সেখানে আবার স্ত্রীর প্রতি স্বামীর সামাজিক অনুশাসন আছে যার সাথে তাত্ত্বিক দর্শনের প্রায় কোন মিল নেই । তিনি বৃহদারণ্যক উপনিষদের একটি শ্লোক তুলে ধরেছেন । "(প্রয়োজনে) স্ত্রীকে লাঠি বা হাত দিয়ে মারবে, " (৬।৪।৭) দেখা যাচ্ছে উপনিষদ শুধু দার্শনিক তত্ত্বের আকরই নয়, নারীর প্রতি অবমাননাকর বিধানও এতে আছে ।

======================

বেদ-উপনিষদে এত যে সব স্ততি নারীর, তার অবির্ভাবের, তার আত্মার, মনুসংহিতার কোথাও তার প্রভাব নেই । সেখানে নারী সম্পূর্ণরূপেই পুরুষের অধীন । তিনি পুরুষের অংশ নন । তার অবস্থান পুরুষের পদতলে । নারীকে মনুসংহিতা পাঠ করবার কিংবা শ্রবণের অধিকার পর্যন্ত দেননি মনু,

২/১৬ যার গর্ভাধান থেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পর্যন্ত বিধি মন্ত্র সহকারে উক্ত হয়েছে, এই শাস্ত্রে তার অধিকার জ্ঞাতব্য, অন্য কারও নয় ।

সুরেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় 'যার' শব্দের ব্যাখ্যা দিয়েছেন 'দ্বিজ' বলে । আর 'অধিকার' বলতে তিনি অধ্যয়ন ও শ্রবণের অধিকার বলেছেন । পঞ্চানন্দ তর্করত্নের অনুবাদেও একই কথা লা হয়েছে । ব্রাহ্মণ্য সমাজসংগঠনে তারাই শুধু দ্বিজ যাদের জন্যে উপনয়নের বিধান রয়েছে । তারা শুধু পুরুষ, নারী নন । ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় কন্যা হলেও নয় ।

==================================================================
নারীর শিক্ষার অধিকার শাস্ত্রসম্মত নয় 

মনু বেদকে অতিক্রম করেননি । মনুসংহিতায় বারংবার তা উচ্চারিত । মনু বেদমন্ত্রের রচয়িতা বেদকন্যাদের জানতেন না তা তো নয় । কিন্তু মনুসংহিতায় তিনি সেই বেদকন্যাদেরও বেদপাঠের অধিকার পর্যন্ত নেই বলে বিধান দিয়ে গেছেন ।

মনু মানবধর্মশাস্ত্রে নারীর জ্ঞানার্জন ও শিক্ষার অধিকারই তুলে দিলেন । তাদের জন্য কোনওরূপ সংস্কারের বিধান পর্যন্ত থাকল না । মনুর বিধান নারীকে সম্পূর্ণরূপে গৃহের অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে দিল । নারীর বিবাহকে করা হল বাধ্যতামূলক ।নারীর জন্যে সব ধরনের শিক্ষা-দীক্ষা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল । তাকে বাধ্য করা হল স্বামী পুত্রের সেবা করে জীবনদান করতে । মনু বিধান দিলেন,

২/৬৭ স্ত্রীলোকদের বিবাহবিধি বৈদিক সংস্কার বলে কথিত, পতিসেবা গুরুগৃহে বাস এবং গৃহকর্ম তাদের (হোমরূপ) অগ্নিপরিচর্যা ।

নারীর জন্যে বিবাহ-ই হয়ে গেল সবচেয়ে বড় সংস্কার । পতিসেবা তুলনীয় হয়ে গেল গুরুগৃহ বাসের সাথে । আর গৃহকর্ম হল হোমরূপ অগ্নিপরিচর্যা । নারীর জন্যে আর কি প্রয়োজন ? মনু কিন্তু পুরুষদের জন্যে উপনয়ন ছাড়াও অন্যান্য জাতকর্মের বিধান রেখেছেন,

২/৬৫ ব্রাহ্মণের কেশান্ত সংস্কার ষোলো বৎসর বয়সে, ক্ষত্রিয়ের বাইশ বছর বৎসরে এবং বৈশ্যের চব্বিশ বৎসরে করণীয় ।

এখানে শূদ্র পুরুষের কথা নেই । মনুর কাছে শূদ্র কখনো পূর্ণমানব ছিল না । ... মনু যাদের কথা বললেন তারা সব দ্বিজপুত্র । কিন্তু দ্বিজপুত্রদের জন্যে যে সংস্কার ছিল বৈদিক উচ্চারণে ঋদ্ধ, দ্বিজকন্যাদের জন্যে তা ছিল অমন্ত্রক ।

২/৬৬ এক সকল সংস্কার স্ত্রীলোকের শরীর সংস্কারের জন্য যথাকালে ও যথাক্রমে অমন্ত্রক করণীয় ।

======================

মনুর আগে বেদ অধ্যায়ন ছিল শিক্ষার প্রথম পাঠ । মনুর বিধানে মনুসংহিতায় বেদপাঠের অধিকার নিষিদ্ধ হয়ে যায় । মনু বললেন,

৯/১৮ স্ত্রীলোকদের মন্ত্রসহকারে (জাতকর্মাদি) সংস্কার নেই --- এই ধর্মবিহিত । এরা (ধর্মের প্রমান রূপ শ্রূতি স্মৃতিরহিতত্ব হেতু) ধর্মজ্ঞ নয়, (পাপনাশক মন্ত্র জপ রহিতত্ব হেতু) মন্ত্রহীন এবং মিথ্যার ন্যায় (অশুভ) --- এই শাস্ত্রীয় নিয়ম ।

মনু নারীকে মিথ্যার ন্যায় অশুভ এবং অধর্মজ্ঞ মন্ত্রহীন বলে চিহ্নিত করলেন । শুধু বেদপাঠ নয়, অন্যান্য সব ধর্মশাস্ত্র পাঠও নারীর জন্যে নিষিদ্ধ করে তার প্রথাগত সব শিক্ষার পথ বন্ধ করার বিধান দিলেন । তাতে নারীর মানবিক বিকাশের পথ চিরদিনের জন্যে বন্ধ হয়ে যায় । মনু চেয়েছিলেন নারীর ওপর পুরুষের নিরংকুশ আধিপত্য । সে জন্যে অনেক কঠোর বিধানও তাই যুক্ত করতে হয়েছে মনুসংহিতায়, এর সৃষ্টিকর্তাকে ।

যে নারী বেদের যুগে বেপারংগমা ব্রহ্মবাদিনী হতে পারতেন, হোমে যার ছিল সহজ অধিকার পুরুষের অনুরূপ, মনুসংহিতায় তা নিষিদ্ধ হয়ে যায় । হোমে নারীর অধিকার স্বীকার করতে চাননি মনু,

১১/৩৬ কন্যা, যুবতী, অল্পবিদ্যাসম্পন্ন ব্যক্তি, মূর্খ, রোগাদি পীড়িত ব্যক্তি ও অনুপনীত ব্যক্তি হোম করবে না ।
১১/৩৭ এই (উক্ত) ব্যক্তিরা হোম করলে তারা এবং যার জন্য করে সে নরকে পতিত হয় । সুতরাং, হোতা হবেন শ্রৌতকর্মে প্রবীণ ও বেদে পারদর্শী ।

কন্যা ও যুব-নারীকে এখানে পংক্তিভুক্ত করা হয়েছে অল্পবিদ্যাসম্পন্ন ও অসুস্থ পুরুষদের সাথে । এতে অবশ্য কোনও অসংগতি নেই । মনু তা করতেই পারেন । কন্যাদের শিক্ষাই তো শাস্ত্রসম্মত ছিল না মনুর কাছে । তাদের তো মূর্খ হয়ে থাকা ছাড়া কোনও বিকল্প ছিল না । কন্যাদের কুমারী হয়ে থাকারও কোন বিধান নেই মনুসংহিতায় । বিবাহ-ই কন্যার পরমাগতি ।

==================================================================
বিবাহ প্রসঙ্গে মনুসংহিতা

মানবধর্মশাস্ত্র মনুসংহিতায় কন্যা-শিশুর জন্য বিবাহ-ই ছিল প্রথম উল্লেখযোগ্য সংস্কার । পুত্রের উপনয়ন না হলে তার দ্বিজত্বে উত্তরণ হত না । কন্যার জন্যে উপনয়ন ছিল বিবাহ । মনু ২/৬৬ । মনুর ধর্মশাস্ত্রে নারীর জন্যে বিবাহ ছিল বাধ্যতামূলক ।

======================

বেদ রচনাকালের যুগে আমরা ব্রাহ্মবাদিনী বিশ্ববারা, অপালা, বাক, লোপামুদ্রাদের দেখেছি, তাঁরা অবিবাহিতই ছিলেন । পতিলোক নামে স্বর্গলাভের জন্যে বিবাহ নামক অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত হয়ে তাঁদের পুরুষের অধীনতাকে স্বীকার করে নিতে হয়নি । সংখ্যায় অল্প হলেও বেদের যুগে চিরকুমারীদের অস্তিত্ব ছিল । কিন্তু মানবধর্মশাস্ত্র মনুসংহিতা সেই পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল । তাই ধর্মশাস্ত্রের যুগে আমরা অপালা-বিশ্ববারা-বাককে খুঁজে পাইনি । কোনও ধর্মশাস্ত্রের সাথেই নারীর নাম যুক্ত নয় । মনু নারীর বিবাহ অত্যাবশ্যক বলেই নির্দেশ দিয়েছিলেন । মনু নারীর বিবাহের বয়স পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন,


৯/৯৪ ত্রিশ বৎসর বয়স্ক পুরুষ মনোরমা দ্বাদশবর্ষীয়া কন্যাকে বিবাহ করবে অথবা চব্বিশ বৎসর বয়স্ক পুরুষ আট বৎসর বয়স্ক কন্যাকে বিবাহ করবে । ত্বরাবান্ ব্যক্তি (অর্থাৎ যে এই বয়স সীমার কম বয়সে বিবাহ করে সে) গার্হস্থ্যধর্মে অবসাদ প্রাপ্ত হয় ।

======================

মনুর মনোগত বাসনা ছিল কন্যা ঋতুমতী হওয়ার পূর্বেই তাকে সম্প্রদান করা । কন্যা ছিল জনকের কাছে বস্তু সমতুল । যেমন ভূমি, পশু ও বস্তু দান করা যায় । কন্যা বস্তু বলেই বিবাহ নামক অনুষ্ঠানে তাকে সম্প্রদান করা হয় । বর বস্তু নয় বলেই তাকে সম্প্রদান করা চলে না । মনু কন্যার নিম্নতম বিবাহ বয়স আট বছরের কম হলেও তাকে সম্প্রদান করার বিধান দিয়ে গেছেন,

৮/৮৮ কন্যা বিবাহযোগ্যা না হলেও তাকে উৎকৃষ্ট, সুরূপ ও সবর্ণ বরের কাছে বিধি অনুসারে সম্প্রদান করবে ।

কোন কন্যাকে বিবাহ করা যাবে মনুসংহিতায় তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে,

৩/৮, ৩/৯ কপিলাবর্ণ, অধিকাঙ্গবিশিষ্টা, রোগগ্রস্তা, লোমহীনা, অধিকলোমবিশিষ্টা, বাচাল, পিঙ্গ লবর্ণা, নক্ষত্র, বৃক্ষ, নদী, পর্বত, পক্ষী, সর্প, দাস --- এইগুলির নামধারিণী এবং ভীতিজনক নামযুক্তা কন্যাকে বিবাহ করবে না ।

৩/১০ যে অঙ্গহীন নয়, যার নাম সুখে উচ্চার্য, হে হংসগতি বা গজগামিনী, যার লোম ও কেশ কোমল, দন্ত ক্ষুদ্র, অঙ্গ মৃদু , সেই স্ত্রীলোককে বিবাহ করবে ।

৩/১১ যে কন্যার ভ্রাতা নেই বা পিতা অজ্ঞাত, বিজ্ঞব্যক্তি পুত্রিকা ধর্মশঙ্কায় তাকে বিবাহ করবে না ।

======================

মনুসংহিতায় নারীর নাম কীধরণের হবে তারও নির্দেশ দেওয়া রয়েছে,

২/৩৩ স্ত্রীলোকের নাম হবে সহজে উচ্চার্য, অনিষ্ঠুরতাবাচক, অনায়াসবোধ্য, সুন্দর, শুভসূচক, অন্তে দীর্ঘবর্ণযুক্ত এবং আশীর্বাদবোধক ।

এই নির্দেশ লঙ্ঘন করলে সেই কন্যা বিবাহ করার যোগ্যা বলে বিবেচিত হবে না - এই ছিল মনুর বিধান ।

মনুসংহিতার অন্য একটি শ্লোকে "বিবাহযোগ্যা কন্যার উপযুক্ত পাত্র পাওয়া না গেলে মৃত্যপর্যন্ত পিতৃগৃহে রেখে দেওয়া উচিত" বলে বিধান দিয়েছেন মনু,

৯/৮৯ বরং কন্যা ঋতুমতী হয়েও আমরণ (পিতৃগৃহে) থাকবে, তথাপি কখনও তাকে নির্গুণ বরের হাতে দিবে না ।

======================

মনু তো কন্যার বিবাহের বয়স পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন (৯/৯৪) । এমনকি 'উৎকৃষ্ট সুরূপ ও সবর্ণ বর পেলে কন্যা বিবাহ-যোগ্যা না হলেও তাকে সম্প্রদান করতে বলেছেন (৯/৮৮) । অর্থাৎ বরের বয়স যাই হোক, 'সগুণ' হলে, আট বছরের কম হলেও কন্যাকে বিবাহ দেওয়া চলে । অন্য একটি শ্লোকে (৫/১৫৪) মনু বিধান দিয়েছেন পতি দুশ্চরিত্র, কামুক ও গুণহীন হলেও তাকে লঙ্ঘন করা যাবে না । তাকে দেবতার ন্যায় সেবা করে যেতে হবে । কোনও নারী সেই কালেও দুশ্চরিত্র কামুক গুণহীন বরকে স্বেচ্ছায় বরণ করে নিত না । তাকে তুলে দেওয়া হত তার হাতে । নির্গুণ বরের হাতে সম্প্রদান করা হলে কন্যা যাতে স্ত্রীধর্মপালনে অবাধ্য না হয়, তাই মনুর এই বিধান । নির্গুণ বরের হাতে বিবাহযোগ্যা কন্যাকে সম্প্রদান না করে তাকে আজীবন পিতৃগৃহে রেখে দেওয়ার মনু-উপদেশ তাই আমাদের বিভ্রান্ত করে ।

======================

মনুর অনিন্দনীয় বিবাহ পদ্ধতি হচ্ছে মূলত দানাত্মক বিবাহ । দানাত্মক বিবাহে কন্যা যেন প্রাণহীন বস্তু, সম্পত্তির সমতুল, অথবা পালিত পশু । তাই দানের বিষয় কন্যাদান হল শ্রেষ্ঠ দান, 'মহাদান' । দানের শাস্ত্রীয় পরিচয় হল দেয় বস্তুতে নিজের স্বত্বের অবসান ঘটিয়ে পরের স্বত্ব উৎপন্ন করা ... । তাই বিবাহে কন্যার পিতৃস্বত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায় । নারীর গোত্রান্তর হয় । 

কোনও শাস্ত্রীয় বিধানেই নারীর স্বতন্ত্র সত্বা স্বীকৃত নয় । মনুর শাস্ত্রেও সেই স্বীকৃতি নেই । শুধুমাত্র বিবাহের পর সন্তান জন্মদান করার জন্যেই নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে । সেই তার একমাত্র কাজ ।(৯/৯৬) 

==================================================================
নারীর ধর্ম : মনুর বিধান

মনু নারীকে কোনও রূপেই স্বাধীনতা দিতে চাননি । নারী সারাজীবন পুরুষের অধীনতা স্বীকার করে বেঁচে থাকবে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত । কোনও রাখ-ঢাক না করেই মনু বলেছেন,

৯/২ স্ত্রীলোকদের (স্বামী প্রভৃতি) ব্যক্তিগণ তাদের দিনরাত পরাধীন রাখবেন, (অনিষিদ্ধ) রূপাদিবিষয়াসক্ত স্ত্রীলোকদেরও নিজের বশে রাখতে হবে ।

৯/৩ স্ত্রীলোককে পিতা কুমারী জীবনে, স্বামী যৌবনে ও পুত্র বার্ধক্যে রক্ষা করে; (কখনও) স্ত্রীলোক স্বাধীনতার যোগ্য নয় ।

৯/২ এরা রূপ বিচার করে না, (যৌবনাদি) বয়সে এদের আদর নেই, রূপবান বা কুরূপ পুরুষ মাত্রেই তার সঙ্গে সম্ভোগ করে ।

৯/৩ শয়ন, উপবেশন, অলংকার, কাম, ক্রোধ, কুটিলতা, পরহিংসা, মন্দ আচরণ -- এইগুলি স্ত্রীলোকের (স্বভাবগত করে) মনু সৃষ্টি করেছিলেন ।

২/২১৩ নারীদের স্বভাবই হল পুরুষদের দূষিত করা । অতএব পন্ডিতগণ স্ত্রীলোক সম্বন্ধে অনবহিত হন না ।

২/২১৪ সংসারে কাম ও ক্রোধের বশবর্তী বিদ্বান বা অবিদ্বান ব্যক্তিকে স্ত্রীলোক বিপথে নিতে পারে ।

মনু নারীদের এতটাই অবিশ্বাস করেছেন যে, জননী, ভগ্নী ও কন্যার সাথেও একাকী নির্জনগৃহে বাস করতে নিষেধ  করে গেছেন ঠিক পরবর্তী শ্লোকে,

২/২১৫ মা, বোন বা মেয়ের সঙ্গে শূন্যগৃহাদিতে পুরুষ থাকবে না । শক্তিশালী ইন্দ্রিয়সমূহ বিদ্বান লোককেও বশীভূত করে ।







Wednesday, 2 August 2017

নোট বাতিলের পরিণতি

পুঁজিবাদই কালো টাকার লাইফ লাইন - হরিলাল নাথ 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের পর বিশ্বের দেশে দেশে মুক্তিসংগ্রাম দুর্বার হয়ে ওঠে এবং একে একে উপনিবেশগুলি স্বাধীন হতে শুরু করে । ফলে আগের মতো বিনা বাধায় অঢেল শ্রম ও সম্পদ শোষণ অসম্ভব হয়ে পড়ে । অবশিষ্ট বিশ্ব থেকে উন্নত পুঁজিবাদে শ্রম ও সম্পদের শোষণ নিয়ন্ত্রিত বা বাধাপ্রাপ্ত হবার ফলে পুঁজিবাদের বিকাশের গতি মন্থর হতে থাকে । বস্তুত ১৯৬০-র দশকের শেষ দিক থেকেই পুঁজিবাদী বিকাশের সংকট নতুন করে অনুভূত হতে থাকে ।

তখন পুঁজিবাদের ক্রমবর্ধমান সংকট থেকে মুক্তির পথ হিসেবে হাজির করা হয় নব্য উদারনীতিকে । অর্থাৎ পুঁজিকে বন্ধনহীন-বাধাহীন করতে হবে । একাজ অতীতের ঔপনিবেশিক শোষণের মাধ্যমে আর সম্ভব নয় । তাই প্রয়োগ শুরু হয় নব্য সাম্রাজ্যবাদী কৌশলে নয়া-উপনিবেশবাদের প্রয়োগ । জাতি রাষ্ট্র বা জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণাকে ভেঙে ফেলতে হবে । এক একটি দেশে খন্ড পুঁজির খন্ড শোষণ নয় । দেশের সীমান্ত তুলে দিয়ে পুঁজি-পণ্য-পরিষেবার অবাধ বিচরণের ব্যবস্থা করতে হবে সারাবিশ্বে । এভাবে 'আইনি' বা 'স্বীকৃতি' পথে পশ্চিমী পুঁজি নতুন করে বিশ্বজুড়ে দখলদারি কায়েম করতে পারবে । পশ্চিমী পুঁজি সারা বিশ্ব থেকে সস্তায় উপকরণ সংগ্রহ ও শ্রম শোষণ করে মুনাফার হার বাড়িয়ে নিতে পারবে । নব্য-উদারনীতি উন্নত পুঁজিবাদেরই সংকট মুক্তির নব্য ব্যবস্থা । বিশ্বব্যাঙ্ক, আই এম এফ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ পশ্চিমী নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির মাধ্যমে এই ব্যবস্থাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেবার প্রক্রিয়াই চলছে ।

নয়া-উদারনীতি পুঁজিবাদের ক্রমাগত ও ক্রমঘনীভূত সংকটজনিত বন্ধদশা থেকে মুক্তির নতুন দিশা । বিশ্বায়নের নাম নতুন মোড়কে শোষণের তীব্রতা ও ব্যাপ্তি বৃদ্ধির নতুন অভিমুখই উদারনীতি । এই ব্যবস্থা যথারীতি জাতি রাষ্ট্র ও কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণার পরিপন্থী । এই ব্যবস্থায় উৎপাদনে সরকারি হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণ চলে না । পুঁজি ও পুঁজিপতিদের অবাধ ও পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলে এই ব্যবস্থা । গোটা বিশ্বের সর্বত্র সব দেশে পুঁজির বন্ধনহীন প্রতিবন্ধকতাহীন অবাধ বিচরণ চায় এই ব্যবস্থা । সামাজিক নিরাপত্তা, জনকল্যাণ ইত্যাদি তুলে দিয়ে সমস্ত মানুষকে এবং গোটা সমাজকে পুঁজির সর্বগ্রাসী শোষণের মুখে ঠেলে দেওয়া হয় । জনস্বার্থে বা সমাজের স্বার্থে যেহেতু সরকারের দায়বদ্ধতা প্রত্যাহৃত হয়, তাই কর সংগ্রহের আর কোনো প্রয়োজন থাকে না । তখন কর হার কমা, কর ছাড়, কর বিধি শিথিল এই ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায় ।

মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা হয়, নব্য উদারনীতির নব্য ব্যবস্থায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আয় বৃদ্ধি এবং উন্নয়নে রাষ্ট্র বা সরকারের আর তেমন কোনো ভূমিকা নেই । সেই দায়িত্ব পালন করবে ব্যক্তিগত পুঁজি বা বেসরকারি পুঁজি । যত বেশি পরিমাণে দেশি ও বিদেশি বেসরকারি পুঁজি বিনিয়োগ হবে, ততই কাজের সুযোগ বাড়বে, মজুরি বাড়বে এবং উন্নয়ন হবে । সরকারের প্রধান কাজ হবে বেসরকারি মালিকের হাতে পুঁজির পরিমাণ বৃদ্ধিতে সব রকমের সাহায্য করা । একাজে সরকার পাঁচ রকমভাবে সাহায্য করতে পারে । (১) বিত্তবান ও কর্পোরেটের কাছ থেকে কর বাবদ আয় যথাসম্ভব কমিয়ে । মুনাফা বা আয়ের ওপর কর কমলে তাদের উদ্বৃত্ত আয়ের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে এবং সেটা ফের বিনিয়োগ করে আরও বেশি মুনাফা করতে পারবে । (২) জমি-খনিজ-বনজ ইত্যাদি জাতীয় তথা প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর জাতীয় মালিকানা পরিবর্তন করে বেসরকারি মালিকানায় রূপান্তর । এর ফলে অমূল্য জাতীয় সম্পদ লুট করে যথেচ্ছ মুনাফা বাড়ানো যায় । (৩) শ্রমিকদের নিয়োগ, ছাঁটাই, মজুরির হার ইত্যাদির দায়িত্ব পুরোপুরি মালিকদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে শ্রম আইন সংশোধন করে । একইভাবে প্রত্যাহার করে নিতে হবে যাবতীয় সামাজিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা । অর্থাৎ শ্রমিকদের কাজের ও আয়ের নিরাপত্তা যত অনিশ্চিত করা যাবে, ততই তাদের বেশি বেশি করে শোষণ করা সম্ভব হবে । (৪) সরকারের যাবতীয় সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্প গুটিয়ে ফেলতে হবে । সরকার যদি শ্রমজীবী মানুষের মৌলিক চাহিদার কিছুটা সরবারহ করে সামাজিক প্রকল্পের মাধ্যমে, তাহলে শ্রমের বাজারে চাহিদা কিছু হ্রাস পাবে । তখন  বেসরকারি পুঁজির সস্তায় শ্রম পাওয়ায় ব্যাঘাত ঘটবে । অর্থাৎ সরকারকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে, যাতে কোনো অবস্থাতেই শ্রমজীবীদের বেঁচে থাকার উপকরণ সরকারের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে না পায় । তাদের সেটা জোগাড় করতে হবে শ্রমের বাজারে প্রতিযোগিতায় নেমে । অর্থাৎ যে যত সস্তায় যত বেশি শ্রম দিতে পারবে, তারই কর্মসংস্থান হবে । পুঁজি চায় শ্রমের বিপুল মজুটবাহিনী (বেকার) যাতে যেকোনো শর্তে তাদের শ্রম নিঙড়ে নেওয়া সহজ হয় । (৫) সব দেশের সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিতে হবে, যাতে পুঁজি-পণ্য-পরিষেবা সর্বত্র বাজার দখল করতে পারে । এইভাবে জনগণের স্বার্থরক্ষার বদলে পুঁজির স্বার্থরক্ষার দিকে সরকারকে নিয়ে যেতে তবে । এটাই উদারনীতি । এ যুগের পুঁজিবাদের সংকটমোচনের একমাত্র দাওয়াই । পুঁজি ও শ্রমজীবীর স্বার্থ যেহেতু পরস্পর বিরোধী, তাই পুঁজির সঙ্কটমোচনের মানে শ্রমজীবীর সংকটবৃদ্ধি । বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বের এটাই নির্মম বাস্তবতা ।

আজ উদারনীতির নামে বিনিয়োগ বৃদ্ধির নামে, জি ডি পি বৃদ্ধির নামে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির নামে দেশে দেশে উদারনৈতিক সংস্কারের কাজ ঢালাওভাবে চলছে । তারই পরিণতিতে ধনবৈষম্য ও সম্পদ-বৈষম্য হু হু করে বাড়ছে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজতন্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে পুঁজিবাদের আধারে আবির্ভূত জাতি রাষ্ট্র ও কল্যাণকামী রাষ্ট্রের বিকাশ ধন-বৈষম্য বৃদ্ধিতে কিছুটা লাগাম টানতে সক্ষম হলেও, এখন তা ফের তীব্র গতি পেয়েছে । বিশেষ করে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপর্যয়ের পর ধন-বৈষম্য অতীতের সব রেকর্ডকে অতিক্রম করে গেছে । সত্যিই এই বৈষম্য অভূতপূর্ব ও অভাবনীয় ।

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয় ও সমাজতন্ত্রের আপৎকালীন পশ্চাদপসারণের ফলে পুঁজিবাদের সামনে সবচেয়ে বড় ও কঠিন প্রতিবন্ধকতাটি দুর্বল হয়ে পড়ে । সেই সুযোগে পুঁজিবাদ তার মানবিক মুখোশটি খুলে ফেলে নতুন করে আগ্রাসী চেহারা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে । দ্রুত ফিকে হতে থাকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক মূল্যবোধও । বুর্জোয়া গণতন্ত্রে বৃহৎ ও একচেটিয়া পুঁজির দাপট বাড়তে থাকে । স্বাভাবিকভাবেই তখন জাতি রাষ্ট্র বা জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র গুরুত্ব হারায় । সামগ্রিক উন্নয়নে বা জনকল্যাণে অথবা সম্পদের পুনর্বণ্টনে রাষ্ট্র বা সরকারের দায় ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যায় ।

আমরা জানি, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা শ্রমশোষণ ও উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ-র মাধ্যমে মুষ্টিমেয় বিত্তবানের হাতে পুঁজি ও সম্পদের কেন্দ্রীভবন ঘটায় । কিন্তু এই প্রক্রিয়া পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের আধারে জনকল্যাণকামী ও জাতি রাষ্ট্রের আইন ও বিধি মেনে চললে পুঁজির কেন্দ্রীভবনের গতি খানিকটা হলেও নিয়ন্ত্রিত হয় । পুঁজির মালিকরা এই বিলম্বিত লয়ে সম্পদ বৃদ্ধিতে তুষ্ট নয় । তাই তারা আইন ও বিধি লঙ্ঘন করে অর্থাৎ কর ফাঁকি দিয়ে সম্পদ বৃদ্ধির গতি বাড়ায় ।

আধুনিক পুঁজিবাদের এই ব্যবস্থা কর ফাঁকি দেবার পথকে ক্রমাগত সুগম ও প্রসারিত করে চলেছে । নব্য পুঁজিবাদের অনুসারী সরকারগুলিও আইনকানুন ও কর আদায় ব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্গঠিত ও শিথিল করছে, যাতে বিত্তবানদের ওপর করের বোঝা কমে, কর ফাঁকি দেওয়া সহজতর হয় এবং কর ফাঁকি দেবার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ দুর্বল হয় । বস্তুত অনেক ফাঁকফোকর রেখেই তৈরি বা সংশোধন করা হয় কর আইন ও কর আদায় ব্যবস্থা । যাতে কর ফাঁকির বিরুদ্ধে সাজা দেবার সুযোগ বিশেষ না থাকে ।

Saturday, 24 June 2017

বিবেকানন্দ ভারতীয় নব জাগরণের দার্শনিক - শ্যামল চক্রবর্তী

বিবেকানন্দের ভাবনায় সমাজভাবনা ও সমাজতন্ত্র 

স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তায় স্বদেশচেতনা এবং শ্রমিকস্বার্থবোধ একাত্মতা লাভ করেছিল । তিনি শিকাগো থেকে দেওয়ান হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লিখেছেন (নভেম্বর, ১৮৯৪), "কোথায় ইতিহাসের কোন যুগে ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়, পুরোহিত ও ধর্মধ্বজিগণ দীনদুঃখীদের জন্য চিন্তা করিয়াছে ? অথচ ইহাদের নিষ্পেষণ করাতেই তাহাদের ক্ষমতার প্রাণশক্তি । ... দরিদ্রগণের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা এত বেশী কেন ? একথা বলা মূর্খতা যে তরবারির সাহায্যে তাহাদিগকে ধর্মান্তরগ্রহণে বাধ্য করা হইয়াছিল । ... বস্তুত জমিদার ও পুরোহিতবর্গের হস্ত হইতে নিষ্কৃতিলাভের জন্যই উহারা ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছিল । আর সেইজন্য বাংলাদেশ, যেখানে জমিদারের বিশেষ সংখ্যাধিক্য, সেখানে কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানেরই সংখ্যা বেশী ।"

ভারতে অনেকরকম সাধু-সন্ন্যাসী দেখা যায় । তাঁরা সমাজ ও জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান । কিন্তু বিবেকানন্দ ছিলেন সম্পূর্ণ অন্য ধরণের মানুষ । তিনি সারা ভারত পদব্রজে পর্যটন করেন এবং ধনি-গরিব নির্বিশেষে নানাধরণের মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটে । তিনি ইউরোপ-আমেরিকা পর্যটন করে ধনতান্ত্রিক ও বিভিন্ন ধরনের সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হন । এই প্রক্রিয়ার মধ্য থেকেই সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে তার চিন্তার মিশ্রণ ঘটে । তাঁর ধর্মচেতনা মানুষকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল ।

নতুন সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল তাঁর চোখে । বিবেকানন্দের সমসাময়িক চিন্তাবিদদের সঙ্গে বিবেকানন্দের পার্থক্য ছিল এই যে, অন্য চিন্তাবিদরা শুধু সমাজ সংস্কারের কথা বলতেন । বিবেকানন্দ আমূল পরিবর্তনের কথা ভাবতেন । উগ্র জাতীয়তাবাদী ও হিন্দুত্ববাদীরা ভারতকে  পুরোনো দিনে ফিরে যাবার কথা বলতেন । কিন্তু বিবেকানন্দ তাঁদের সঙ্গে আদৌ একমত ছিলেন না । তিনি নতুন ভারতের কথা বলতেন । যে ভারতের শাসকরা হবেন সমাজের একেবারে নীচের তোলার মানুষ অর্থাৎ শূদ্র । তিনি নতুন সমাজের যে কল্পনা করেছিলেন তা হল বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামিক দেহ ।

শূদ্র জাগরণ সম্পর্কে বিবেকানন্দ বলেছিলেন : 'আর যাহাদের শারীরিক পরিশ্রমে ব্রাহ্মণের আধিপত্য, ক্ষত্রিয়ের ঐশ্বর্য, বৈশ্যের ধনধান্য সম্ভব, তাহারা কোথায়? সমাজের যাহারা সর্বাঙ্গ হইয়াও সর্ব দেশে সর্বকালে ... ভারবাহী পশু, সে শূদ্রজাতির কি গতি?' এই যে অপরিসীম বেদনাবোধের সঙ্গে তিনি শূদ্রদের সম্বন্ধে ভেবেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তিনি বুঝেছেন বৈশ্য সভ্যতাই মানুষের ইতিহাসে সবটুকু নয়, তার একটা ধারা থাকতে পারে । এ বিষয়টি স্বামীজীর চোখে ধরা পড়েছিল বলেই বৈশ্য সভ্যতার ভালো দিকটি বলবার সঙ্গে শূদ্র জাগরণের অনিবার্য ভবিষ্যতের প্রতিও ইঙ্গিত দিয়েছেন তাঁর পত্রাবলীতে ।

বিবেকানন্দ ভারত ইতিহাসে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় তথ্য তুলে ধরে আমাদের জানিয়েছেন শাসক শ্রেণী সব সময় শোষিতদের অগ্রসর অংশের প্রতিনিধিদের কিনে এবং তাদেরই ব্যবহার করে নীচেকার মানুষকে পদদলিত করবার জন্যে । তিনি উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন - 'বশিষ্ঠ, নারদ, জাবাল, সত্যকাম, ব্যাস, কৃপ, দ্রোণ এবং কর্ণ । শ্রেণী আভিজাত্যের দিক থেকে এদের প্রত্যেকেরই জন্মকাহিনী, পিতৃপরিচয় বা মাতৃপরিচয় সন্দিগ্ধ রহস্যে আবৃত ' । 'জ্ঞান ও বীরত্বের পুরস্কারস্বরূপ এঁরা কেউবা ব্রাহ্মণ সমাজে কেউবা ক্ষত্রিয় সমাজে উন্নীত হলেন ।' বিবেকানন্দ মন্তব্য করেছেন - 'এঁদের এই সামাজিক ঊর্দ্ধগতির ফলে গণিকা, দাসী, মৎস্যজীবি বা শকটচালক সম্প্রদায়ের কি যে উপকার হল তা বোঝা দুষ্কর ।

স্বামীজী বলেছেন, ভারতবর্ষের প্রকৃত শাসনক্ষমতা জনসাধারণের হাতে ছিল না । যারা ক্ষুধিত বঞ্চিত, যারা নিচুরতলার মানুষ, মার-খাওয়া মানুষ, যারা ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্তভাবে সংগ্রাম করছে, তারা কোনো সময়ে এমনভাবে দানা বাঁধতে পারেনি, যাতে ক্ষমতাটা তাদের হাতে আসতে পারে । পারস্পরিক স্বার্থের খাতিরে ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়েরা একত্র হয়েছে । কিন্তু গণশোষণের বন্যার গতিটি কোনো সময়ে স্তিমিত হয়নি, বরং ক্ষুরধার হয়েছে । স্বামীজীর বিশ্লেষণ অনুযায়ী পশ্চিমী মুসলমানেরা যখন আমাদের দেশ বিজয় করতে এলো, তাদের হাতে আমরা মার খেয়েছি, তাদের বুকের সাহস এবং বীর্যবত্তায় ভারতবর্ষ পরাভূত হয়েছে । পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গিয়েছে, Royal Power-এর হাত থেকে শূদ্র শ্রেণী কোনোদিন রক্ষা পায়নি । (অনেক পরে পৃথিবীর ইতিহাসে, ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে, প্রথম শূদ্রের বিপ্লব ঘটেছে রুশ দেশে - লেখক)।

 স্বামীজী তাঁর সন্ধানী দৃষ্টিতে নূতন সমাজের যে চেহারা দেখেছিলেন পশ্চিমী সমাজ তাতে বিস্মিত হয়, তার কারণ এই যে আসন্ন শূদ্ররাজত্ব সম্পর্কে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নিঃসংশয় । 'বর্তমান ভারত' -এ তিনি বলেছেন "সোশ্যালিজম, অ্যানার্কিজম, নিহিলিজম এবং এ-জাতীয় মতবাদগুলি আসন্ন সমাজ-বিপ্লবের অগ্রদূত ।" অ্যানার্কিজম, নিহিলিজম দিয়ে সমাজ বিপ্লব করা যাবে কিনা আমরা এ নিয়ে তর্কের ঝড় তুলতে পারি, কিন্তু এ মতবাদগুলো যে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ, একথাটা যদি আমরা বুঝতে চেষ্টা করি তা হলে স্বামীজীর বক্তব্যের মর্মবাণীর দিকে আমরা বোধ হয় দৃষ্টি ফেরাতে পারি । বিনা দ্বিধায় অবিকম্পিত স্বরে তিনি ঘোষণা করেছেন শূদ্রের আধিপত্য অবশ্যম্ভাবী, কেউ একে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না । "... Time will come when there will be the rising of the Sudra class and their Sudrahood"

তিনি আরও বলেছিলেন, "নতুন ভারত বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে, ঝোপ-জঙ্গল-পাহাড়-পর্বত থেকে" । তাঁর ভরসার স্থল ছিল সাধারণ মানুষ । কেন তাঁর ধারণা ছিল মধ্যবিত্ত এবং অভিজাতরা শরীর এবং মনে একেবারে মরে গেছে । তিনি আরও বলেছিলেন ধনীরা কারও কোন উপকার করেনি । শোষিতদের জন্য সংগঠনের অভাব তিনি খুব অনুভব করেছিলেন । শূদ্রদের আত্মশক্তি প্রয়োগের পথে ঐক্য এবং সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা তিনি দৃঢ়ভাবে অনুভব করেছিলেন ।

স্বামী বিবেকানন্দের সমকালীন সময় ছিল ভারতের নব জাগরণের যুগ । কিন্তু ইউরোপে নবজাগরণ তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল এবং পুরোনো সমাজের গর্ভে নতুন সমাজের আবির্ভাবের দার্শনিক, অর্থনৈতিক ও সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি সূচিত করেছিল । একদিকে বুর্জোয়া গণতন্ত্রে পতাকা উড়ছে, পুঁজিবাদ পোক্ত হচ্ছে । পুঁজিবাদের স্থায়িত্বের দর্শন প্রভাব বিস্তার করেছে । অপরদিকে প্রকৃতি বিজ্ঞানের বিকাশ ভাববাদী দর্শনের ভিত্তিমূলকে নাড়িয়ে দিচ্ছে । মার্কস-এঙ্গেলেসের হাত ধরে উন্নত হচ্ছে । শক্তিশালী হচ্ছে বস্তুবাদী দর্শন, সমাজতান্ত্রিক দর্শনের ভিত্তি গঠনের তত্ত্ব । ইংল্যান্ডে ছিলেন 'ওয়েল' পন্থীরা এবং ফ্রান্সে ছিলেন ফুলিয়ের অনুগামী সমর্থকরা । এরা ছাড়া ছিলেন ইউটোপিয়া সমাজতন্ত্রের পক্ষে সরব । আরও ছিলেন পুঁজি বা মুনাফার ক্ষতি হবে না অথচ সামাজিক ন্যায় বিচারও থাকবে, এমন অদ্ভুত তত্ত্বের প্রবর্তকেরা । এর বিপরীতে চুল মার্কস ও এঙ্গেলস, তাঁরা ঐ দু-ধরনের সমাজতন্ত্রীদের মতবাদের ত্রুটিগুলি ধরিয়ে দেন এবং সমাজ পরিবর্তনের গতিধারা এবং তার অন্তর্নিহিত বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া উদঘাটন করেন । এই সময় আট ঘন্টার কাজের দাবিও শুরু হয়ে যায় ।

যে মতবাদেরই হোন না কেন - সমাজতন্ত্রীরা চার্চদের ভূমিকার বিরুদ্ধে ছিলেন । তারা ধর্মের সমালোচনা করতেন এবং সমাজের ঘটতে থাকা ঘটনাগুলির মধ্যে চার্চের হস্তক্ষেপের নিন্দা করতেন । এই অংশটার সঙ্গে বিবেকানন্দের যোগাযোগ হয়েছিল । কিন্তু মার্কস-এঞ্জেলেসের ধারণার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল -- এমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি ।

ভারতে এই ভাবধারা প্রবেশ করলেও কোন তত্ত্বগত এবং সংগঠিত রূপ প্রকাশ পায়নি । স্বামী বিবেকানন্দ ছাত্র অবস্থাতেই ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে ভালোভাবেই পরিচিত হয়েছিলেন । তিনি পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন । ঐ সময় বিদেশে সম্ভবত স্বামী বিবেকানন্দ সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন । পরবর্তীকালে আমেরিকা ও ইউরোপ পর্যটনের সময় তিনি বিভিন্ন ধরনের সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন ।

বিবেকানন্দ মনে করতেন ভারতবর্ষের ইতিহাস হল - শ্রেণী শাসনের ইতিহাস (তৎকালীন সময়ে মার্কসবাদরা ছাড়া একমাত্র বিবেকানন্দই একথা ভাবতে পেরেছিলেন)। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, ইতিহাসের আদি অধ্যায় ছিল ব্রাহ্মণ শাসন, তারপর ক্ষত্রিয় শাসন, তারপরে বৈশ্য শাসন (বিবেকানন্দের কথায় তা তখনও চলছে) তার পরেই মুদির দোকানের মত জায়গাগুলো থেকে বের করে ভারতকে শূদ্র শাসনের অধীনে নিয়ে আসার কথা বলেছিলেন ।

ভারতের বৈশ্য শাসন সম্পর্কে তিনি যে মন্তব্য করেছেন তা প্রকৃতপক্ষে বৈশ্য শাসনকে পুঁজিবাদী শোষণের সমগোত্রীয় বলে চিহ্নিত করা । বৈশ্য শাসন সম্পর্কে তিনি বলেছেন এটা হচ্ছে 'রক্ত পিপাসু ক্ষমতা' । পুঁজিবাদী শাসন যে নিঃসন্দেহে শোষণ করে তা বিবেকানন্দের চিন্তাকে এড়িয়ে যেতে পারেনি । তবে বিবেকানন্দ শুধু বৈশ্য সভ্যতার সমালোচনাই করেননি, একই সঙ্গে বৈশ্য সভ্যতা যে জ্ঞান, বিজ্ঞান, কৃষি এবং প্রযুক্তির অভাবনীয় সম্পদ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে তারও তিনি সোচ্চার প্রশংসা করেছেন । বৈশ্যদের এই বিষয়ে প্রশংসা করলেও তিনি বলেছিলেন এই শূদ্রের শ্রমের ওপরেই নির্ভর করে ব্রাহ্মণের প্রভাব ক্ষত্রিয়ের ক্ষমতা এবং বৈশ্যের সম্পদ সম্ভব হয়েছে । যাদের নাম দেওয়া হয়েছে নীচু জাতি অন্ত্যজ তারাই হল আসলে সমাজের শরিক, কিন্তু তাদের ইতিহাস কোথায় ? তারা লেখাপড়া শিখলে তাদের জিভ ও মাংস উপড়ে দেওয়া হতো । বিবেকানন্দ আর-একটি কথা বলেছেন যা মার্কসবাদী হিসেবে আমাদের কাছে প্রণিধানযোগ্য । ক্ষত্রিয়ের হাত থেকে ক্ষমতা নেওয়ার সময় বৈশ্যদের এমন কোনো সদিচ্ছা ছিল না যে, ক্ষমতা শূদ্রদের হাতে গিয়ে পড়ুক । মার্কসবাদীরা মিলিয়ে নিতে পারবেন সামন্ততন্ত্রের হাত থেকে পুঁজিবাদী যখন ক্ষমতা দখল করল তারাও শ্রমিক শ্রেণীর হাত থেকে নিজেদের ক্ষমতা বাঁচাতে চাইছিল । বিবেকানন্দ বলেছিলেন, 'সোসালিজম, অ্যানার্কিজম অ্যান্ড নিহিলিজম এই জাতীয় অন্যান্য মতামতগুলি আসন্ন সমাজ বিপ্লবের অগ্রদূত' (বিবেকানন্দ মডার্ন ইন্ডিয়া) 'শূদ্রের আধিপত্য অবশ্যম্ভাবি কেউ একে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না ।'

শূদ্র শাসন কী হিংসার পথে হাঁটবে, না অহিংসার পথে হাঁটবে এ ক্ষেত্রে বিবেকানন্দের স্পষ্ট মত ছিল অহিংসার পথেই হাঁটা উচিত । কিন্তু বাস্তবে কি তা সম্ভব ? কারণ বলবানরা সবসময় দুর্বলদের ওপর অত্যাচার করে । এইজন্য তিনি শূদ্রদেড় উদ্দেশ্যে বলেছিলেন 'বিদ্রোহে তোমার চির অধিকার ।' তিনি আরো বলেছিলেন, সন্ন্যাসীদের পক্ষে অহিংসা সম্ভব কিন্তু ওটা সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভব নয় । উচ্চ-জাতির উচিত হচ্ছে নিম্ন জাতিদের ন্যায্য অধিকার পেতে সাহায্য করা, তা না করে তাদের অবনমিত করতে চাইলে তারা নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যাবে, নিজেদের সমাধি নিজেদেরই খুঁড়তে হবে । যত বিলম্ব বাড়বে তত মার খাবে । কোনো দেশে সাধারণ মানুষের যদি অধিকার না থাকে তাহলে জাতি সংগঠিত হতে পারে না ।

বিবেকানন্দ বলেছিলেন 'আমি সমাজতন্ত্রী তার মানে এই নয় যে, সমাজতন্ত্রকে আমি একটা পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ সমাজব্যবস্থা বলে মনে করি, কারণটা এই যে উপবাস করার চেয়ে আধখানা রুটি খাওয়া ভালো ।' স্বামী বিবেকানন্দের এই উক্তি থেকে বোঝা যায় সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর কিছু ধারণা হয়েছিল । যদিও তিনি ইউটোপিও সমাজব্যবস্থার কথা শুনেছিলেন সেটাই তাঁর প্রেরণার উৎস স্থল ছিল । কিন্তু তাঁর ধারণার মধ্যে কী ভুল ছিল ? ধারণার মধ্যে ভুল ছিল সেটা বলা যাবে না, আমরা যারা মার্কসবাদী তারা জানি সমাজতন্ত্র সাম্যবাদের আগের ধাপ । আবার সমাজতন্ত্রকে বহু পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করতে হয় । সমাজতন্ত্র যত অগ্রসর হয় তত প্রাচুর্য বাড়ে । একবিংশ শতাব্দীর চিন, এ বিষয়ে আমাদের কাছে একটা জ্বলন্ত উদাহরণ । স্বামী বিবেকানন্দের এই উক্তি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে তৎকালীন ভারতীয় সাধক-সন্ন্যাসীদের ও মনীষীদের মধ্যে সর্বপ্রথম শ্রেণীস্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজবিবর্তনের ধারা অনুধাবন করার মতো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয় ।

বিবেকানন্দ কেন প্রত্যক্ষভাবে সমাজ সংস্কারের পথে অগ্রসর না হয়ে ধর্ম সংস্কার ও ধর্ম প্রচারের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন ? বিবেকানন্দ ধর্মের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র ও মানবতন্ত্রের কথাই বেশি বলেছেন । ভারতে তিনিই সর্বপ্রথম সমাজতন্ত্রের আদর্শ প্রচার করেছেন, সেকথা ভুলে গিয়ে তাকে যদি শুধু ধর্ম সংস্কারক বা ধর্মের বিচারক বলে প্রচার করা হয় তবে তাঁর আদর্শকে ও জীবনের ব্রতকে বিকৃত ও খণ্ডিত করা হবে ।

বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক লেখক বিনয় ঘোষের মতে প্রত্যক্ষভাবে সমাজ সংস্কারের পথে না গিয়ে বিবেকানন্দ ধর্মসংস্কারের ওপর জোর দিয়েছেন কেন ? বিবেকানন্দের কাছে ধর্ম মানে কতকগুলি মন্ত্র বা আচার ছিল না । তাঁর কাছে ধর্ম ছিল কতকগুলি প্রত্যয়, বিশ্বাস, ধ্যানধারণা, ন্যায়-অন্যায়, নীতিবোধ ইত্যাদি । সমগ্র জাতির মানস সত্তার মূল ভিত্তিটিকে তিনি সবার আগে শক্ত করতে চেয়েছিলেন । দ্বিতীয়ত তিনি মনে করেছিলেন বৃহত্তর হিন্দু সমাজের কল্যাণের জন্য কিছু করতে হলে প্রথমেই হিন্দু ধর্মকে অপবাদ ও কুসংস্কারের পঙ্ককুন্ড থেকে উদ্ধার করা দরকার । তৃতীয়ত ব্রাহ্ম সমাজের জটিল তত্ত্ব জনসাধারণের কাছে বোধগম্য ছিল না তা ছিল উচ্চশিক্ষিত, উচ্চবিত্তদের মধ্যে আবদ্ধ ব্রাহ্মবাদীরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন । চতুর্থত, সনাতন পন্থী ও হিন্দু জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল । বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ কখনই সংকীর্ণ সনাতনপন্থী ছিলেন না । বিবেকানন্দ ধর্মের মাধ্যমে সমাজতত্ত্ব ও মানবতত্ত্বের কথা বলেছেন । আমাদের দেশে সমাজতন্ত্রের আদর্শ সম্ভবত সর্বপ্রথম বিবেকানন্দই স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন । সুতরাং তাকে শুধু ধর্মসংস্কারক বা ধর্মপ্রচারক বললে ভুল হবে । তাঁর জীবনের ব্রতকেও যথোচিত মর্যাদা দেওয়া হবে না ।

================================================================

আমাদের দেশে যদি আধুনিক রাষ্ট্র চিন্তা ও সমাজচিন্তার ইতিহাস কোনোদিন লেখা হয় তবে স্বামী বিবেকানন্দ যে সেখানে কেবল স্বাদেশিকতা ও স্বাজাত্যবোধের অন্যতম উদ্বোধক বলে স্থান পাবেন তা নয়, তার সঙ্গে সমানাধিকার ও সমাজতন্ত্রের আদর্শের প্রথম প্রবক্তার কৃতিত্বও তিনি দাবি করবেন এবং সে-দাবি ঐতিহাসিক বা সমাজবিজ্ঞানীর পক্ষে অস্বীকার করাও সম্ভব হবে না । তাঁর কালে এই আদর্শের কথা নির্ভীককণ্ঠে প্রচার করতে যে কি প্রচন্ড পৌরুষের প্রয়োজন হয়েছিল তা আজ আমরা কল্পনাও করতে পারব না । কল্পনা করুন আজ থেকে ৭০/৮০ বছর আগে - বিদেশি ব্রিটিশরাজের একচ্ছত্র রাজত্বের যুগে -- কেবল স্বদেশপ্রেমের কথা নয় -- তিনি দেশের উচ্চশ্রেণী ও উচ্চসমাজের মুখের উপর বলেছেন -- 'তোমরা শূন্যে বিলীন হও, নূতন ভারত বেরুক, বেরুক চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে, মালো, মেথরের ঝুপড়ির মধ্য থেকে ।'

সর্ব নিম্নস্তরের মানুষের কাছেও প্রাণের অভিনন্দন পাওয়া যায় - এ তিনি জানতেন । কিন্তু বৈরাগ্যের বাণী বা ধর্মতত্ত্বের কথা তিনি মানুষের কাছে প্রচার করেননি । প্রচার করেছেন ঐতিহ্যের কথা, দেশাত্মবোধের কথা এবং জাতিভেদহীন শ্রেণীভেদহীন সমাজগঠনের কথা । আজকের জাতীয় সংকটের দিনে বিশেষ করে স্বামী বিবেকানন্দের দেশাত্মবোধ ও দেশীয় ঐতিহ্যবোধের আদর্শ এবং তাঁর ভেদবৈষম্যহীন ভারতীয় সমাজগঠনের আদর্শ থেকে আমরা খানিকটা প্রেরণা পেতে পারি । 

Thursday, 15 June 2017

ভারতে সাম্প্রদায়িকতা স্বরূপ-সন্ধান ও আশুবিপদ - একটি নোট - বিজয় পাল

ধর্ম ও মৌলবাদ

বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্ম সবন্ধে বলছেন, " হিন্দু ধর্মের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হইল অন্যান্য ধর্ম ও বিশ্বাস সমূহের প্রতি সহিষ্ণুতা । ... যদি কেউ মনে করে থাকেন যে, ঐক্য আসবে কোন একটি ধর্মের জয়ের ও অন্য সব ধর্মের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে, তাকে আমি বলব : হে আমার ভাই, এটা তোমার ভ্রান্ত আশা । আমি কি চাইব যে, খ্রিস্টানরা হিন্দুধর্ম গ্রহণ করুক ? ঈশ্বর করুন, কখনই না । ... খ্রিস্টান হিন্দু বা বৌদ্ধ হবে না অথবা হিন্দুও বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান হবে না । কিন্তু প্রত্যেককেই অপরের আদর্শ থেকে তার মর্মকথা আত্মস্থ করতে হবে ।"

=========================================================

আদিম মানুষের প্রকৃতির কাছে অসহায়তা থেকে উদ্ভূত অলৌকিক ধারণা পরবর্তীকালে সমাজে আধিপত্য সৃষ্টিকারী শক্তির হাতে ধর্ম বিশ্বাসের মাধ্যমে শ্রেণি শাসনের হাতিয়ারে পরিণত হয় । শ্রেণি শাসনে গরিব মানুষের আর্থিক ও সামাজিক অসহায়তা আরও তীব্র হওয়ায় 'ধর্ম বিশ্বাসের' শেকড় আরও শক্তপোক্ত হয়ে ওঠে ।

... প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়তাজনিত অতিলৌকিক বিশ্বাসকে সমাজে প্রভুত্বকারী শ্রেণি ধর্মের মোড়কে হাজির করেছে এবং তাকে ব্যবহার করেছে, যার শেকড় রয়েছে মানুষের জীবন জীবিকার অধিকারের অপ্রাপ্তি ও অনিশ্চয়তাজনিত হতাশা ও ব্যর্থতার দীর্ঘ নিঃশ্বাসের গভীরে ।

=========================================================

ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম সাম্প্রদায়িকতা 

ধর্মনিরপেক্ষতার ঠিক বিপরীতে রয়েছে সাম্প্রদায়িকতা । আমাদের দেশের সংবিধানে ১৯৭৭ সালে প্রথম 'ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি যুক্ত করা হয় । ধর্মনিরপেক্ষতা ধারণাটি এসেছে ইউরোপের ইতিহাস থেকে । ইউরোপের উদীয়মান বুর্জোয়াদের সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে সংগ্রাম করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে হয়েছিল । সামন্ত প্রভুদের সঙ্গে গীর্জার পাদ্রীদের দৃঢ় গাঁটছড়া বাঁধা ছিল । ফলে সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে তাদের গীর্জার বিরুদ্ধেও লড়তে হয়েছে । ইতিহাসে এই যুদ্ধ 'ক্রুসেড' নামে খ্যাত । এই সংগ্রামের মাধ্যমেই বুর্জোয়ারা বুঝেছিল রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক ছেদ করতে হবে । রাষ্ট্র ধর্মের সঙ্গে যুক্তও হবে না আবার ধর্ম-বিরোধীও হবে না । প্রত্যেক নাগরিকেরই স্বাধীন ধর্মাচরণের অধিকার থাকবে । তবে কেউ কাউকে ধর্মাচরণ করতে বাধ্য করবে না, কারও ধর্মাচরণে বাধাও দেবে না । ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের এই সম্পর্ককেই ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে গণ্য করা হয় । সেজন্যই ইউরোপের বিশেষত ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে কার্যত সকলেই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও ওরা ওদের দেশকে খ্রিস্টান ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেনি ।

=========================================================

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেদ, উপনিষদের উপর ভিত্তি করেই তাঁর আন্তর্জাতিক মানবতাবাদ গড়ে তুলেছিলেন । সেই উপলব্ধি থেকে তিনি লিখলেন, "এই বহু দেব দেবী, বিচিত্র পুরাণ এবং অন্ধ লোকাচার সংকুল আধুনিক বৃহৎ বিকারের নাম হিন্দুত্ব ।" "সাহেবি অনুকরণ আমাদের পক্ষে নিষ্ফল, হিন্দুয়ানী গোঁড়ামী আমাদের পক্ষে মৃত্যু ।" (হিন্দুর ঐক্য) ।

উভয় সাম্প্রদায়িক শক্তির উগ্র প্রচারে বিরক্ত কবি লিখলেন, "একটা দিন আসিল যখন হিন্দু আপন হিন্দুত্ব লইয়া গৌরব করিতে উদ্যত হইল। তখন মুসলমান যদি হিন্দুর গৌরব মানিয়া লইয়া নিজেরা চুপচাপ পড়িয়া থাকিত তবে হিন্দু খুব খুশি হইত সন্দেহ নাই, কিন্তু যে কারণে হিন্দুর হিন্দুত্ব উগ্র হইয়া উঠিল সেই কারণেই মুসলমানের মুসলমানি মাথা তুলিয়া উঠিল। ... আমি হিন্দুর তরফ থেকেই বলছি, মুসলমানের ত্রুটি বিচারটা থাক্‌-- আমরা মুসলমানকে কাছে টানতে যদি না পেরে থাকি তবে সেজন্যে যেন লজ্জা স্বীকার করি।"

তিনি আরও বললেন, "ভারতবর্ষের অধিবাসীদের দুই মোটা ভাগ, হিন্দু ও মুসলমান। যদি ভাবি, মুসলমানদের অস্বীকার করে এক পাশে সরিয়ে দিলেই দেশের সকল মঙ্গলপ্রচেষ্টা সফল হবে, তা হলে বড়োই ভুল করব। ছাদের পাঁচটা কড়িকে মানব, বাকি তিনটে কড়িকে মানবই না, এটা বিরক্তির কথা হতে পারে, কিন্তু ছাদ-রক্ষার পক্ষে সুবুদ্ধির কথা নয়। আমাদের সবচেয়ে বড়ো অমঙ্গল বড়ো দুর্গতি ঘটে যখন মানুষ মানুষের পাশে রয়েছে অথচ পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ নেই, অথবা সে সম্বন্ধ বিকৃত।" এভাবেই উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলার মাধ্যমেই ভারতের প্রকৃত মঙ্গল হতে পারে বলে কবি দৃঢ় মত পোষণ করেন ।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীভৎসতা দেখে তিনি উপলব্ধি করে লিখলেন, "এই মোহমুগ্ধ ধর্ম বিভীষিকার চেয়ে সোজাসুজি নাস্তিকতা অনেক ভাল ।  আজ মিছে ধর্মকে পুড়িয়ে ফেলে ভারত যদি খাঁটি ধর্ম, খাঁটি নাস্তিকতা পায় তবে ভারত সত্যই নব জীবন লাভ করবে ।"

আর এস এস হিন্দু ধর্ম প্রচারের নামে 'হিন্দুত্ব' শব্দটিকে সামনে এনেছে । 'হিন্দুত্ব' শব্দটি হিন্দু ধর্মের কোথাও নেই । কোন হিন্দু ধর্ম গুরুর লেখাতে এই শব্দটি পাওয়া যায় না । হিন্দু ধর্মকে ফ্যাসিবাদের মোড়কে হাজির করার উদ্দেশ্যেই প্রথমে হিন্দু মহাসভা পরে আর এস এস নেতা সাভারকার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ১৯২৩ সালে প্রথম 'হিন্দুত্ব' শব্দটি ব্যবহার করেন । 'হিন্দুত্ব' শব্দের আড়ালে তিনি ভারতে বসবাসকারী সকলকে হিন্দুত্বের অনুসারী হওয়ার নিদান দেন । অর্থাৎ অন্য ধর্ম মতগুলির বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে ধর্মীয় বিভাজনের উদ্দেশ্যে একাজ তিনি করেন । তিনি দাবি করেন 'হিন্দুত্ব' হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট জীবন-ধারা, যার উদ্ভব ভারতেই । অতএব ভারতে থাকতে হলে হিন্দুত্বের জীবনধারা গ্রহণ করতে হবে । এর বাইরে যারা থাকবেন তাদের ভারতের নাগরিকত্ব থাকবে না অর্থাৎ তাদের ভারত ত্যাগ করতে হবে নইলে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো করে থাকতে হবে । এটা খোলাখুলি অন্য ধর্মগুলির প্রতি আক্রমণের আহবান । সোজা কথায় মুসলিম নিধনের আহবান ।

অথচ যে বিবেকানন্দকে ওরা ওদের মতের সপক্ষে বিকৃতভাবে প্রচার করে, তিনি বলছেন, "আমাদের দৃঢ় ধারণা যে, বেদান্তের মতবাদ যতই সূক্ষ্ম ও বিস্ময়কর হউক না কেন, কর্ম পরিণত ইসলাম ধর্মের সহায়তা ব্যতীত তাহা মানব সাধারণের অধিকাংশের নিকট সম্পূর্ণরূপে নিরর্থক। আমরা মানবজাতির সেই স্থানে লইয়া যাইতে চাই — যেখানে বেদও নাই, বাইবেলও নাই, কোরানও নাই , অথচ বেদ, বাইবেল ও কোরানের সমন্বয় দ্বারাই ইহা করিতে হইবে। মানবকে শিখাইতে হইবে যে, সকল ধর্ম একত্বরূপ সেই এক ধর্মেরই বিবিধ প্রকাশ মাত্র, সুতরাং যাহার যেটি সর্বাপেক্ষা উপযোগী সেইটিকেই সে বাছিয়া লইতে পারে । আমাদের মাতৃভূমির পক্ষে হিন্দু ও ইসলাম ধর্ম-রূপ এই দুই মহান মতের সমন্বয়ই বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ - একমাত্র আশা । আমি মানসচক্ষে দেখিতেছি, এই বিবাদ বিশৃঙ্খলা ভেদপূর্বক ভবিষ্যৎ পূর্ণাঙ্গ ভারত বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামিক দেহ লইয়া মহা মহিমায় ও অপরাজেয় শক্তিতে জাগিয়া উঠিতেছে।"

সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে ধিক্কার জানিয়ে তিনি লিখছেন, 'কোনও ধর্মই কখনও মানুষের উপর অত্যাচার করে নাই, কোন ধর্মই কখনও এই ধরনের অন্যায় কার্যের সমর্থন করে নাই । তবে মানুষকে এ-সকল কার্যে উত্তেজিত করিল কিসে ? রাজনীতিই মানুষকে এই সকল অন্যায় কার্য করিতে প্ররোচিত করিয়াছে, ধর্ম নয় ।"

তিনি আরও লিখছেন, "সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি ও এগুলির ভয়াবহ ফল স্বরূপ ধর্মোন্মত্ততা এই সুন্দর পৃথিবীকে বহুকাল অধিকার করিয়া রাখিয়াছে । ইহারা পৃথিবীকে হিংসায় পূর্ণ করিয়া রাখিয়াছে । ইহারা পৃথিবীকে হিংসায় পূর্ণ করিয়াছে, বারবার ইহাকে নরশোণিতে সিক্ত করিয়াছে, সভ্যতা ধ্বংস করিয়াছে এবং সমগ্র জাতিকে হতাশায় মগ্ন করিয়াছে । এই সকল ভীষণ পিশাচ যদি না থাকিত, তাহা হইলে মানব সমাজ আজ পূর্বাপেক্ষা অনেক উন্নত হইত । তবে ইহাদের মৃত্যুকাল উপস্থিত ।"

"যদি এই ভারতে যেখানে চিরদিন সকল সম্প্রদায়ই সম্মানিত হইয়া আসিয়াছেন সেই ভারতে এখনও এইসব সাম্প্রদায়িক বিবাদ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পর দ্বেষহিংসা থাকে, তবে ধিক্ তাহাদিগকে, যাহারা সেই মহিমান্বিত পূর্ব পুরুষগণের বংশধর বলিয়া নিজদের পরিচয় দেয়। ... আমরা সকলকেই আমাদের ভাবে আনিতে পারি না । আমরা যেরূপ ব্যাখ্যা করিব, সকলকেই সে ব্যাখ্যা গ্রহণ করিতে হইবে বা সকলকেই আমাদের প্রণালী অবলম্বন করিয়া চলিতে হইবে জোর করিয়া এরূপ চেষ্টা করা অত্যন্ত অন্যায় । ... অপরকে ঘৃণা করিতে থাকিলে কেহই নিজে অবনত না হইয়া থাকিতে পারে না ... সম্প্রসারণই জীবন, সঙ্কীর্ণতাই মৃত্যু, প্রেমই জীবন, দ্বেষই মৃত্যু ।"

ভাবলে শিউরে উঠতে হয় আর এস এস বিবেকানন্দকে যেভাবে তাদের স্বার্থে প্রচার করছে, বেঁচে থাকলে তিনি এদের সম্বন্ধে কী বলতেন ।

আজীবন নিষ্ঠাভরে হিন্দু ধর্মাচরণ পালন করেও গান্ধীজি আর এস এস-এর সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে স্পষ্ট করে বললেন, "কোটি কোটি ভারতবাসী যারা হিন্দু ছিল ও পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা আর ভারতীয় রইল না --- এই ধারণার বিরুদ্ধে আমি বিদ্রোহ ঘোষণা করি । ... হিন্দু ধর্ম ও ইসলাম দুটি পরস্পর বিরোধী মতবাদ ও সংস্কৃতি - এই ধারণার বিরুদ্ধেও আমার সমস্ত প্রাণ মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে ।"

কমিউনিস্টরা ধর্মাচরণ না করাকেই শ্রেয় মনে করে, কারণ তাঁরা বিশ্ব - প্রকৃতির যাবতীয় সৃষ্টি ও ঘটনা, তার উদ্ভব ও লয়ের কারণ বাইরের কোন শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে - এই ভ্রান্ত ধারণার দ্বারা পরিচালিত হয় না । তাই বলে তারা কারও ধর্মবিশ্বাসকে আঘাত করে না । তারা শুধু মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, কারও সম্পদের পাহাড়, কারও নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার জন্য ঈশ্বরকে দায়ী করা বা তাঁর ইচ্ছাতেই সব হচ্ছে এই ধারণার দ্বারা পরিচালিত না হওয়ার জন্য মানুষকে সমবেত করার চেষ্টা করে । বৈষম্যের কারণ বর্তমান বিশ্ব-ব্যবস্থা তথা আর্থিক-নীতির মধ্যেই নিহিত রয়েছে - এই সত্য তুলে ধরে তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মহাসাগরে সকলকে মেলাতে চায় ।

=========================================================





=========================================================

আমেরিকায় প্রবাসকালে বিবেকানন্দ গো মাংস ভক্ষণ করেছেন । এর বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা অভিযোগ করলে তিনি দৃঢ়ভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন এবং বলেন "ভারতবাসীরা যদি চায় আমি একমাত্র হিন্দু খাবার খাই, তারা যেন আমাকে একজন রান্নার লোক এবং তার জন্য অনেক টাকা পাঠায় ... আমি কারও আদেশে চলিনা, আমি আমার জীবনের উদ্দেশ্য জানি এবং আমার কোন সংকীর্ণতা নেই । আমি যতখানি ভারতীয় ততখানি বিশ্বমানব ।  তোমরা কি বলতে চাও যে আমি ঐ জাতিভেদে জর্জরিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন, নিষ্ঠুর, ভন্ড, নাস্তিক ও কাপুরুষ শিক্ষিত হিন্দুদের মধ্যেই জীবন কাটাবার জন্য এবং মরবার জন্য জন্মেছি ?" (আলা সিংগা নামে তাঁর এক মাদ্রাজি শিষ্যকে লন্ডন থেকে ১৮৯৫ এর ১৮ নভেম্বর লেখা পত্র সংকলনে পাওয়া যায়) । ১৯০২ সালে বিবেকানন্দের মৃত্যুর পরে অমৃতবাজার পত্রিকায় 'The Meat Eating Swami' নামে একটি সম্পাদকীয় লেখা হয়েছিল । (সূত্র - 'সহাস্য বিবেকানন্দ' - শঙ্করীপ্রসাদ বসু )।

=========================================================

Wednesday, 14 June 2017

কমিউনিজমের সামাজিক ও রাজনৈতিক মতবাদ - রজনী পাম দত্ত



সাম্যবাদের লক্ষ্য হল মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য সমাজের এবং অবশেষে একটি একীভূত অখণ্ড সত্তা হিসেবে সমগ্র বিশ্ব-সমাজের উৎপাদিকা শক্তিগুলিকে সংগঠিত করা, বিদ্যমান প্রাকৃতিক সম্পদ, বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা ও কার্যক্ষম প্রতিটি মানুষের সহযোগমূলক শ্রমকে যথাসম্ভব ভালভাবে ব্যবহার করা এবং এর সাহায্যে ত্রুটিপূর্ণ উপায়ে প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগানোর বর্তমান নির্ভরতা থেকে মানবসমাজেকে মুক্ত করা, সেইসঙ্গে বর্তমানের নানান বৈরিতা ও শ্রেণীবিভাজন থেকেও মানবসমাজের মুক্তি ঘটানো । এই পথেই বাস্তবায়িত হবে ভবিষ্যতের স্বাধীন সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা ।

==============================================

সমাজ-গঠনের উচ্চতর পর্যায় হিসেবে সাম্যবাদের সুবিধাগুলি একান্তই স্পষ্ট ।

প্রথমত, বিদ্যমান উৎপাদিকা-শক্তিগুলি, যেগুলি আজ ক্রমবর্ধিত মাত্রায় অব্যবহৃত, অপব্যবহৃত অথবা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে চলেছে, সেগুলিকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হবে ।

দ্বিতীয়ত, বাজারের বেপরোয়া অধিপত্যের নৈরাজ্য, প্রাকৃতিক ও সামাজিক সম্পদের সীমাহীন অপচয় এবং ক্রমবর্ধিত বিধ্বংসী সংকটের বদলে সুসমঞ্জসভাবে পরিকল্পিত উৎপাদন ও উন্নয়ন ।

তৃতীয়ত, ক্রমবর্ধিত চাহিদা পূরণের জন্য উৎপাদনের অবাধ ও সুসমঞ্জস বিস্তার ঘটানো সম্ভব হবে - সেক্ষেত্রে সমাজের শ্রেণীকাঠামো ও পণ উৎপাদনের অবস্থা নিজের মর্জিমাফিক কোনও বাজার-সীমা চাপিয়ে দিয়ে তাকে ব্যাহত করতে পারবে না । উৎপাদনের বিস্তার এবং কলাকৌশলের উন্নতি বিদ্যমান যাবতীয় চাহিদাকে পূরণ করতে সক্ষম হলে তার ফলস্বরূপ আর দারিদ্র্য, সংকট ও সার্বিক বেকারিত্ব দেখা দেবে না, বরং সৃষ্টি হবে বাড়তি চাহিদা পূরণ করার এবং শ্রমের ভার লাঘব করার সম্ভাবনা ।

চতুর্থত, উৎপাদনের বিশ্বব্যাপী সংগঠন - যা একমাত্র সাম্যবাদী ভিত্তিতেই গড়ে উঠতে পারে - অন্য দেশ দখল করা, কাঁচামাল ও শোষণের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে নিজেদের কব্জায় আনার জন্য সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক সংঘাতের অবসান ঘটাবে এবং তার ফলস্বরূপ অবসান ঘটবে অস্ত্রশস্ত্রের বিপুল অপচয় ও বিধ্বংসী যুদ্ধের, যা এই মুহূর্তে গ্রাস করতে চলেছে সমগ্র মানবসমাজকে ।

পঞ্চমত, উন্নত ও পশ্চাদ্পদ জাতি ও দেশগুলির মধ্যেকার, শাসক ও শোষিত দেশগুলির মধ্যেকার পার্থক্য অন্তর্হিত হবে এবং অবসান ঘটবে বর্তমানের ভারসাম্যহীন বিশ্ব-বিকাশের, যেখানে পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চল উন্নত উৎপাদন চালু করার মতো যাবতীয় সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আদিম কলাকৌশল আর শস্তা শ্রমের ঔপনিবেশিক এলাকা হিসেবে পিছিয়ে পড়ে আছে । এইসব এলাকা এবং সেখানকার বাসিন্দাদের দ্রূত উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে সর্বাধিক উন্নত দেশগুলির সমান মাত্রায় উন্নীত করার কাজে ব্যবহার করা হবে বিশ্বের সম্পদকে । সমস্ত দেশের স্বাধীনতা ও সমতার মধ্যে দিয়েই উন্মুক্ত হবে ভবিষ্যতের ঐক্যবদ্ধ মানবজাতি গঠনের পথ ।

ষষ্ঠত, শ্রেণীসমূহের অবলুপ্তির ফলে অবসান ঘটবে বর্তমান সমাজকাঠামোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত পরজীবীবৃত্তি ও অপচয়ের - অবসান ঘটবে ওপরতলার অলসতা আর লুণ্ঠনমূলক কার্যকলাপের, নীচের তোলার মানুষদের বিপথগামী শ্রম, অত্যাধিক মেহনত আর উন্নয়নহীনতার, এবং অর্থহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বিপণন-ব্যবস্থা ও অনুৎপাদিকা কার্যকলাপে সমাজের শ্রমশক্তির ক্রমবর্ধমান অপচয়ের । শ্রেণীর অবলুপ্তি ঘটলে এই সবকিছুরই অবসান ঘটবে ।

সপ্তমত, শ্রেণীগুলির অবলুপ্তি ঘটলে শ্রেণী-সংঘাতের সর্বনাশা বোঝার হাত থেকে মুক্তি পাবে সমাজ, আর তার ফলস্বরূপ অবসান ঘটবে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার এবং সার্বজনীন গঠনমূলক কর্তব্যের বদলে শ্রমশক্তির ভিন্নপথে চালিত হওয়ার (যা বর্তমানে অপরিহার্য ও প্রয়োজনীয়, সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে উৎপাদনের উপকরণসমূহের সামাজিক মালিকানা অর্জিত না-হওয়া পর্যন্ত যা টিকে থাকবে)।

অষ্টমত, বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেক হল নারীরা, যারা এখনও পরাধীন ও অনুন্নতই রয়ে গেছে । তাদের প্রকৃত মুক্তি একমাত্র তখনই সম্ভব, যখন সামাজিক উৎপাদনে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে নারীরা, যখন মাতৃত্বের দায়িত্ব সামাজিকভাবে বহন করা হবে এবং যখন অর্থনৈতিকভাবে নারীরা আর পুরুষদের ওপর নির্ভরশীল থাকবে না ।

নবমত, সংস্কৃতি আর একটিমাত্র শ্রেণীর একচেটিয়া সম্পত্তি হয়ে থাকবে না, তা পরিণত হবে সকলের সাধারণ ঐতিহ্যে । শ্রেণীগত পার্থক্যের যাবতীয় অবশেষ নিশ্চিহ্ন হওয়ার পর এবং নতুন ও পূর্ণবিকশিত সাম্যবাদী মানবতার বিবর্তন সম্পূর্ণ হওয়ার পর, মানসিক শ্রম ও কায়িক শ্রমের মধ্যেকার বৈরিতা, শহর ও গ্রামের মধ্যেকার বৈরিতা এবং বিদ্যমান শ্রমবিভাজনের উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ সম্পূর্ণভাবে অবলুপ্ত হবে ।

দশমত, শ্রেণীগত পার্থক্য সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পরবর্তী সাম্যবাদী সমাজে একটি অধীনস্থ শ্রেণীকে দমন করার এবং সামাজিক দ্বন্দ্বকে বলপ্রয়োগের সাহায্যের স্তব্ধ করার যন্ত্র হিসেবে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অবসান ঘটবে । তখন সামনে এসে দাঁড়াবে সামাজিক উৎপাদনের যৌথ পরিচালনার সার্বজনীন দায়িত্ব, যে-কাজে সকলেই অবাধে ও সচেতনভাবে অংশগ্রহণ করবে । মানবিক সম্পর্কের সমগ্র ব্যবস্থা থেকে অন্তর্হিত হবে সব ধরণের দমনপীড়ন । পরিপূর্ণভাবে বিকশিত সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার নীতি হল, 'প্রত্যেকে দেবে তার সামর্থ্য অনুযায়ী, পাবে তার প্রয়োজন অনুযায়ী ।'

সাম্যবাদের এইসব ধারণা নিছকই 'আকাশকুসুম', 'কাল্পনিক' ও 'ভাববাদী' হিসেবে প্রতিভাত হবে আজকের দিনের বাণিজ্যিক বা প্রশাসনিকভাবে প্রশিক্ষিত 'বাস্তববাদী মানুষ' বা 'সম্মানিত নাগরিক'-দের কাছে, যারা 'জানে' যে এই ধরনের কোনও সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার সামর্থ্য মানবচরিত্রের নেই, লোভ, অলসতা, দ্বন্দ্বপ্রিয়তা আর ব্যক্তিগত ক্ষমতালিপ্সাই মানবচরিত্রের সহজাত বৈশিষ্ট্য, মানবসমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে কাজ করতে ও নিজেদের ভাগ্যকে মেনে নিতে বাধ্য করানোর জন্য দমনপীড়ন ও বাহ্যিক শৃঙ্খলার চাবুক আর অনাহারের ভীতির মধ্যে রেখে দেওয়া একান্তই অপরিহার্য ।

তবে এইসব অদূরদর্শী ও সংকীর্ণমনা 'বাস্তববাদী মানুষরা', যারা একটি বিশেষ ঐতিহাসিক পর্যায়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে মানবজাতির তথাকথিত চিরন্তন ও বিশ্বজনীন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খুঁজে বেড়ায়, তারা যেমনটা ভাবে কমিউনিস্টরা তেমন বাস্তবতাবর্জিত নয় । কমিউনিস্টরা খুব ভালভাবেই জানে যে তথাকথিত অপরিবর্তনীয় - বাস্তবে নিরন্তন পরিবর্তনশীল - মানবচরিত্র হচ্ছে প্রতিটি ঐতিহাসিক পর্যায়ে সেই পর্যায়ের সামাজিক অবস্থারই ফসল । তারা এ-ও জানে যে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা অবশ্যম্ভাবীরূপে অত্যন্ত কুৎসিত ও সমাজবিরোধী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্ম দেয় এবং যারা এক নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে তাদের মধ্যে প্রথমদিকে পুরনো পুঁজিবাদী দুনিয়ার বেশ কিছু অভ্যাস ও দৃষ্টিভঙ্গি রয়ে যেতে বাধ্য, নতুন সমাজব্যবস্থা গঠনের চলমান প্রক্রিয়াই তার নির্মাণকারীদের চরিত্র ও সাংস্কৃতিক মানের উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম ।

এই কারণেই প্রকৃত সাম্যবাদী সমাজে উত্তরণ রাতারাতি বা এক বছরের মধ্যে ঘটে যেতে পারে না (এবং কল্পিত যাবতীয় সমস্যাগুলি এই ধরনের উদ্ভট অনুমান থেকেই জন্ম নেয়), বরং সেই উত্তরণ হচ্ছে বিকাশের এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ারই চূড়ান্ত ফল । সাম্যবাদী সমাজমুখী এই বিকাশ একটি নিম্নতর স্তর অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের পথ বেয়ে অগ্রসর হয়ে উন্নীত হবে উচ্চতর স্তরে অর্থাৎ সাম্যবাদে ।

==============================================

বিজ্ঞানী, বিশেষ বৃত্তিজীবী ব্যক্তি, স্থপতি ও প্রশিক্ষিত প্রশাসকদের মতো প্রকরণগত বুদ্ধিজীবীরা, সেইসঙ্গে চিকিৎসক, শিক্ষক ও অন্যান্যরা শ্রমিকশ্রেণী কর্তৃক ক্ষমতাদখল এবং তার পরবর্তী সমাজতন্ত্র নির্মাণের কাজে এক অমূল্য সহযোগীর ভূমিকা পালন  করতে পারেন । কিন্তু তাঁরা কোনও স্বাধীন ভূমিকা পালন করতে পারেন না (যেমনটা অনেক সময় বলা হয়ে থাকে) । উৎপাদনেরউপায়সমূহের স্বাধীন মালিকানা অর্জন করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয় । তাঁদের সামনে দু'টিমাত্র পথ আছে : হয় পুঁজিপতি শ্রেণীর সেবা করা, নয়তো শ্রমিকশ্রেণীর সেবা করা । এঁদের মধ্যেকার সবথেকে প্রগতিশীল ব্যক্তিরা ক্রমশই এ-সত্য উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন এবং শ্রমিকশ্রেণীর পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন ।

==============================================

শ্রমিকশ্রেণীর সচেতন অংশ অর্থাৎ অগ্রগামী কমিউনিস্টরা এই প্রক্রিয়ার বিকাশে সহায়তা করতে ও তাকে ত্বরান্বিত করতে পারে, এবং এর অবশ্যম্ভাবী ক্ষয়ক্ষতিকে কমিয়ে আনতে পারে, কিন্তু এই প্রক্রিয়াকে পরিহার করার কোনও সংক্ষিপ্ত পথ নেই --- কেননা এই প্রক্রিয়ায় শ্রমিকরা তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার সাহায্যে শিক্ষালাভ করে ।

==============================================

গুরুত্বপূর্ণ সোভিয়েতগুলিতে - পেত্রোগ্রাদ ও মস্কো সোভিয়েত, প্রাক-সংসদে ট্রেড ইউনিয়নভিত্তিক প্রতিনিধিত্বে, উত্তরাঞ্চলীয় সৈন্যবাহিনীতে, পেত্রোগ্রাদ  ও মস্কোর স্থানীয় নির্বাচন ইত্যাদিতে প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে বলশেভিক পার্টি সংখ্যাধিক্য অর্জন না-করা পর্যন্ত বলশেভিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়নি ।

==============================================

বিপ্লব অথবা একনায়কত্বকে কেউ নিশ্চয়ই গোলাপের রঙে চিত্রিত করার চেষ্টা করবেন না । কোনও বর্বর ও নির্মম শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের কঠোর বাস্তবতাকে সহ্য করতে অপারগ ভাবপ্রবণ সমর্থনের বদলে পাঠক যদি কমিউনিজমের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, তা-ও বরং ভাল । তবে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার আগে তাঁরা নিশ্চিতভাবে জেনে নিন-যে-জগতের দিকে তাঁরা মুখ ফেরাচ্ছেন সে-জগৎ হল ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ  ঔপনিবেশিক দাসত্বের জগৎ, যাদের কৃত নির্বিচার গণহত্যা ও ধ্বংসের পরিমাণ সর্বহারা বিপ্লবের সমগ্র ঘটনার তুলনায় সহস্রগুণ অধিক । 

Thursday, 1 June 2017

শহীদ স্মৃতি - শিব বর্মা


এই স্মৃতিকথা পড়ে জনৈক বন্ধু মন্তব্য করেছিল যে, এতে মন্দিরের দেবতাগুলি ভেঙে যেতে পারে । আমি তার সঙ্গে একমত হতে পারিনি । আমার বিশ্বাস যখন মহাপুরুষের পদচিহ্ন ধরে আমরা চলতে চাই না অথবা তাঁর মতো নিজে হতে চাই না তখন তাঁকে দেবতা বানিয়ে মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করি, তখন তিনি মানুষের সারি থেকে পৃথক হয়ে শুধু পূজার বস্তু হয়ে পড়েন যার গুনগান করা যায় বটে কিন্তু তাঁর মতো নিজেকে গড়ে তোলার কথা চিন্তা করা যায় না, কেন না সব মানুষ দেবতা হতে পারে না । তাছাড়া যখন আমরা কোন মানুষকে দেবতারূপে গড়ার জন্য যত্নবান হই তখন তার মানবসুলভ রূপ চাপা পড়ে যায় এবং সেখানে একটি কৃত্রিম বা মন-গড়া প্রতিমা তৈরি হয় । আদর্শ হলেও সে মূর্তি, কৃত্রিম হয়ে থাকে । আমরা তাকে সহৃদয়তা দিয়ে ভালোবাসতে পারি না । পারি না তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে আপন করে নিতে । এই স্মৃতিকথায়, আমি সাথীদের মানুষ হিসাবে যেমন পেয়েছিলাম, তেমন ভাবেই তাঁদের চিত্রিত করতে প্রয়াস পেয়েছি । রিটাচিং বা কাট-ছাঁট করে এদের দেবতা বানানো যেত । কিন্তু তাহলে এদের স্বাভাবিক আকর্ষণ মুছে যেত । তখন এই চিত্রের এই প্রতিমার সামনে মাথা নত হতো ঠিকই কিন্তু তাদের তুলে নিয়ে চুমো খাবার ইচ্ছা হয়তো হতো না । তাকে হয়তো পুষ্পার্ঘ্য নিশ্চয়ই দেওয়া হতো কিন্তু কর্মক্ষেত্রে তারা প্রেরণা যোগাতে পারতো না । - শিব বর্মা

=================================================

সর্দার ভগত সিংহ

ভগৎ সিংহের আগে বিপ্লবীদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল দেশের স্বাধীনতা । তবে এই স্বাধীনতা সম্পর্কে আমাদের কি মনোভাব, তার আগে সে-সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্বচ্ছ ছিল না । ইংরেজ বড়োলাটকে হঠিয়ে সেই জায়গায় কোন ভারতীয়কে বসিয়ে দিলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ? সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং তার ভিত্তিতে মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ অব্যাহত থাকতে আমরা কি যথার্থভাবে স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারবো ? স্বাধীনতার পর সরকার কার হবে, ভাবী সমাজের রূপরেখা কেমন হবে ইত্যাদি বিষয়ে বিপ্লবীদের মধ্যে বিশেষ অস্পষ্টতা ছিল । বিপ্লবীদের মধ্যে ভগত সিংহই প্রথম এই সব প্রশ্ন উত্থাপন করে এবং সমাজবাদকে দলের উদ্দিষ্টরূপে সামনে নিয়ে আসে । তার বক্তব্য, দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্যে লড়াই লক্ষ্যের দিকে প্রথম পদক্ষেপ মাত্র । সেখানে পৌঁছে যদি আমরা থেমে যাই তাহলে অভিযান আমাদের অর্ধ সমাপ্ত থেকেই যাবে । সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা আসলে অল্পসংখ্যক লোকের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবার স্বাধীনতাই হয়ে দাঁড়াবে । শোষণ ও বৈষম্যের মূলোৎপাটন করার ভিত্তিতে গঠিত সমাজবাদী সমাজ ও সমাজবাদী রাষ্ট্র ক্ষমতাই রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটাতে পারে ।

সে সময়টায় সমাজবাদ ছিল যুগের ডাক । বিপ্লবীদের মধ্যে ভগত সিংহই সর্বপ্রথম সেই ডাক শুনে চিনতে পারে । তার অন্যান্য সাথীদের চেয়ে এইখানটায় তার মহত্ত্ব ।

=================================================

হাইকোর্টের সামনে বিপ্লবের পরিভাষা করতে গিয়ে সে বলে : "বিপ্লব হলো জগতের নিয়ম । এটা হলো মানব প্রকৃতির রহস্য ।" কিন্তু "এতে রক্তেরাঙ্গা সংঘর্ষ অনিবার্য, তাতে না আছে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার কোন স্থান । সেটা বোমা ও পিস্তলের কোন সম্প্রদায় নয় ।"

"বিপ্লব বিরোধীরা কেবল পিস্তল, বোমা, তলোয়ার ও রক্তপাতকেই বিপ্লব বলে থাকে । কিন্তু বিপ্লব এগুলিতেই সীমাবদ্ধ নয় । এই জিনিসগুলি বিপ্লবের উপকরণ হতে পারে কিন্তু এগুলির ব্যবহারের পেছনে বিপ্লবের বাস্তবিক শক্তি জনগণের, সমাজের অর্থনীতিক ও রাজনীতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের উদ্দেশ্যের মধ্যেই নিহিত থাকে ।"

"আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিপ্লবের উদ্দেশ্য কিছু ব্যক্তির রক্তপাত করা নয় । আমাদের উদ্দেশ্য হলো মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ ব্যবস্থাকে শেষ করে এই দেশের জন্য আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রাপ্ত করা ।"

=================================================

"আপনি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কথা বলছেন । আমি জিজ্ঞেস করি, সর্বশক্তিমান হওয়া সত্ত্বেও আপনার ভগবান অন্যায়, অত্যাচার, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, শোষণ, অসাম্য, দাসত্ব, মহামারী, হিংসা ও যুদ্ধ প্রভৃতিকে শেষ করে দেয় না কেন ? এসবকে শেষ করে দেবার শক্তি থাকা সত্ত্বেও যদি সে মানবজাতিকে এই অভিশাপগুলি থেকে মুক্ত না করে তাহলে নিশ্চয়ই তাকে ভালো ভগবান বলা যায় না । আর যদি এগুলিকে শেষ করার ক্ষমতা তার না থাকে তাহলে সে সর্বশক্তিমান নয় । যদি সে এসব খানিকটা খেলা দেখাবার জন্য লীলার ছলে করে তাহলে একথাই বলতে হবে যে সে অসহায়দের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মজা দেখার এক নির্দয় ক্রূর সত্তা । জনহিতের জন্য সে যত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় ততই ভালো । মায়াবাদ, ভাগ্যবাদ, ঈশ্বরবাদ ইত্যাদিকে আমি মুষ্টিমেয় ক্ষমতালোভী শোষকদের জনসাধারণকে ভুলিয়ে রাখার জন্য আবিষ্কৃত বিষাক্ত জিনিস ছাড়া আর কিছু মনে করি না ।"

=================================================

"আমি বিশ্বাস করি যে এপর্যন্ত যে অর্থে এই শব্দের ব্যবহার হয়ে এসেছে সেই অর্থে এখন এর আর বাজার নেই । আজ পর্যন্ত প্রায় সব ধর্মই মানুষকে পরস্পরের কাছ থেকে আলাদা করেছে, নিজেদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করেছে । জগতে আজ পর্যন্ত যত রক্তপাত ধর্মের নামে ধর্মের ঠিকাদাররা করেছে অত বোধ হয় কেউ করেনি । সত্য কথা হলো এই যে এই ধরিত্রীর স্বর্গকে ধর্মের নামেই তচনচ করা হয়েছে । যে ধর্ম মানুষকে মানুষ থেকে পৃথক করে, ভালোবাসার জায়গায় পরস্পরকে ঘৃণা করতে শেখায়, অন্ধবিশ্বাসকে উৎসাহ দান করে, মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে, বুদ্ধিভ্রংশ ঘটায়, সেই ধর্ম কোনদিনই আমার ধর্ম হতে পারবে না । যা প্রতিপদে মানুষকে সুখী করতে পারে, সমতা, সমৃদ্ধি ও ভ্রাতৃত্বের পথে তাকে এক পা এগিয়ে দিতে পারে, আমার কাছে তাই হলো ধর্ম । অল্প কথায় বলতে গেলে এই পৃথিবী আর ভারতের এই পবিত্রভূমি হলো আমার স্বর্গ । এর মাটিতে বিচরণকারী প্রতিটি ব্যক্তি, প্রতিটি মানুষ আমার দেবতা, আমার ভগবান । আর ভগবানকে ভগবানের সঙ্গে লড়িয়ে আমার স্বর্গকে যে শক্তিগুলি নরক করে তুলেছে সেগুলিকে শেষ করে মানুষকে শ্রেণীহীন সমাজের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রত্যেকটি প্রচেষ্টা, প্রত্যেকটি পদক্ষেপ আমার ধর্ম ।"

=================================================

তাদের কাছ থেকে শেষবারের বিদায় নিয়ে আমরা যখন চলে যাচ্ছি তখন আমাদের মধ্যে একজন (জয়দেব কপূর) ভগত সিংহকে জিজ্ঞেস করলো, "সরদার, তুমি মরতে যাচ্ছ । আমি জানতে চাই তুমি এর জন্য আফসোস করছো না তো?"

প্রশ্নটি শুনে প্রথমে সরদার অট্টহাস্য করলো তারপর গম্ভীর হয়ে বললো, "বিপ্লবের পথে পা বাড়াবার সময় আমি ভেবেছিলুম যদি আমি আমার জীবন দিয়ে দেশের চতুর্দিকে ইনকিলাব জিন্দাবাদ-এর ধ্বনি পৌঁছে দিতে পারি তাহলে মনে করবো যে আমি আমার জীবনে মূল্য পেয়ে গিয়েছি । আজ ফাঁসির এই কুঠুরির মধ্যে গরাদের পিছনে বসেও আমি কোটি কোটি দেশবাসীর কণ্ঠ থেকে সেই ধ্বনির হুঙ্কার শুনতে পাই । আমি বিশ্বাস করি আমার এই ধ্বনি স্বাধীনতা সংগ্রামের চালক শক্তিরূপে সাম্রাজ্যবাদীদের ওপর শেষ পর্যন্ত আঘাত করতে থাকবে ।" আবার কিছুটা থেমে নিজের স্বাভাবিক স্মিতহাস্যের মধ্যে সে ধীরে বললো, "আর এত ছোট জীবনের এর চেয়ে বেশি মূল্য কিই বা হতে পারে ?"

=================================================

ফাঁসির মঞ্চে ওঠার সময় ভগত সিংহ একজন ইংরাজ ম্যাজিস্ট্রেটকে সম্বোধন করে বললো, "ম্যাজিস্ট্রেট মহাশয়, আপনি সত্যি সত্যিই বড় ভাগ্যবান, কারণ আপনি এই দৃশ্য দেখার সুযোগ পাচ্ছেন যে একজন ভারতীয় বিপ্লবী তার মহান আদর্শের জন্য কিভাবে হাসতে হাসতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে।"

=================================================

চন্দ্রশেখর 'আজাদ' 

এ কথা ঠিক যে আমরা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রবক্তা ছিলাম কিন্তু সে বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল প্রত্যেক মানুষের যাতে সুখ শান্তি হয় তার ব্যবস্থা করা । 'বসুধৈব কুটুম্বকম্' ছিল আমাদের উদ্দেশ্য । তাই প্রত্যেক মানুষের জীবনের প্রতি আমাদের ছিল গভীর মমত্ববোধ । আমরা সমকালীন ব্যবস্থার বিরোধী ছিলাম । কোন ব্যক্তি বিশেষের শত্রূ ছিলাম না । ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে আমাদের কঠোর নীতি সেই সূত্রেই আসতো যখন যে চলতি রাজনীতি ও সামাজিক অসাম্য-ব্যবস্থার প্রতিনিধিরূপে আমাদের সম্মুখীন হতো ।

=================================================

যাঁরা আজাদকে ফ্যাসিস্ত বলেছেন তাঁরা তার কতকগুলি বাহ্যিক আচার আচরণই দেখেছেন । বস্তুত আজাদের অন্তর যে সর্বদাই আদর্শবোধে সজাগ থাকতো তা এরা বুঝতে পারেননি অথবা বুঝেও না বোঝার ভান করেছেন । অহিংসা নীতিতে অবিশ্বাস, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ত্রাস নীতি, সেনাবাহিনীর প্রাধান্য হলো ফ্যাসিবাদের বাহ্যিক প্রকাশ । আজাদও অহিংসায় বিশ্বাস করতো না ঠিকই । নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে তার জন্ম এবং ছোটকাল থেকেই সে সামরিক প্রকৃতিরই ছিল । কিন্তু এটুকুর জন্য কি তাকে ফ্যাসিস্ত বলা যায় ? ফ্যাসিবাদের লক্ষ্য হলো বর্তমান বিপ্লবী আন্দোলনে বাধা সৃষ্টি করা, তাকে বিপথগামী করা, সাম্রাজ্যবাদের শক্তি বৃদ্ধি করা এবং সাধারণ মানুষকে গালভরা কথায় ভুলিয়ে ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদকে জিইয়ে রাখা । আজাদ এবং তার দল সম্পর্কে এর মধ্যে একটা কথাও প্রযোজ্য নয় । আজাদ ছিল সাম্রাজ্যবাদের ঘোরতর শত্রু । তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদের অবসান ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা স্থাপন করা ।

=================================================

শিবরাম হরি রাজগুরু

বিপ্লবী জীবনে ভগত সিংহকে তার সব চেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে গণ্য করতো রাজগুরু । জাতীয় মুক্তি অর্জনের সংগ্রামে কে এগিয়ে গিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়বে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল তার জন্য । ভগত সিংহ তার আগে যেন শহীদ না হয় এটাই ছিল তার নিয়ত চিন্তা । যখনই কোন অ্যাকশনের কথা হতো তার একমাত্র দাবি থাকতো তাকে উক্ত অ্যাকশনে আগে পাঠাতে হবে ।

=================================================

দেশ ও জাতির পুনর্বাসনের প্রকৃষ্ট পন্থা যে সাম্যবাদ অথবা সমাজতন্ত্রবাদ, এ-বিশ্বাস তার পূর্ণমাত্রায় ছিল । এর মানে এই নয় যে এই উভয় তত্ত্ব সম্পর্কে সে গভীর ও বিস্তৃত জ্ঞান অর্জন করেছিল । সমাজতন্ত্রবাদ বলতে কি বোঝায়, এর রূপায়ণের জন্য কি ও কোন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে, সমাজতান্ত্রিক সমাজের মৌল লক্ষণসমূহ কি হবে, ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর দিতে সমর্থ ছিল তাও বলছি না । মূল কথা সে যা বুঝেছিল তা হলো, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যারা বিবিধ সম্পদ তৈরি করে তারা শ্রমের বিনিময়ে যৎসামান্যই পেয়ে থাকে । সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়  এ বৈষম্য দূর করা সম্ভব হবে । সেখানে ধনী-দরিদ্র বিভেদ থাকবে না । সবাইকে শ্রম করে খেতে-পরতে হবে । কোন ব্যক্তি বিশেষ বা সম্প্রদায় বিশেষ কারো পরিশ্রমলব্ধ তৈরি সম্পদ আত্মস্বার্থে বা সম্প্রদায়-স্বার্থে ব্যবহার করতে পারবে না । সমগ্র সমাজের কল্যাণে উদ্বৃত্ত সম্পদ ব্যয়িত হবে । অপর কথায় শোষণব্যবস্থা লুপ্ত হবে । কোন দেশ তদ্দেশীয় কোন বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে অপর দেশ অধিকার করে তা লুন্ঠন করবে না । অর্থাৎ দুর্বল ও অনগ্রসর দেশ ও জাতি সমূহকে গোলামে পরিণত করবে না ।

মার্কসবাদী তত্ত্ব এবং সাম্যবাদের বুনিয়াদী মতাদর্শ সমূহ না জানলেও রাজগুরু তার নিজ জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে গভীরভাবেই বুঝেছিল দারিদ্র্যের কি দুঃসহ জ্বালা, পদে-পদে কি ভীষণ লাঞ্ছনা, অনাদর আর অবহেলা । এই অভিজ্ঞতাই, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতি তার নিষ্ঠা সঞ্চার করার ভিত্তি রচনা করেছিল; এই আদর্শে অনুপ্রাণিত করেছিল । কালক্রমে এটাই গভীর প্রত্যয় এবং প্রেরণা রূপে তার হৃদয়ে গেঁথে যায় ।

=================================================

আমি ঢাকা-ঢাকি না করে সোজাসুজিই বললাম, "মরতে ভয় পাচ্ছ ? যা কিছু করেছো তার জন্য অনুশোচনা হচ্ছে ?"

আমার কথা শুনে প্রথমে মৃদু হাসল । পরক্ষণেই গম্ভীর ও দৃঢ় কণ্ঠে বললো "তোমার কাছে এধরনের কথা শুনবো ভাবতে পারিনি । অন্তত তুমি ভালোভাবেই জান যে আমি মরতে ভয় পাই না ।  আজ তোমাকে যা বললাম তা হলো আমার অন্তরের অনুরণন । দারিদ্র্য হলো অভিশাপ । আর স্নেহ-প্রীতি-মমতার অনাস্বাদ হলো নরক । এই অনুভূতি হলো আমার বাইশ বছরের জীবন নিঙড়ানো বিশ্লেষণ । কিছু লোক আমাদের দারিদ্র্যের পঙ্কে ডুবিয়ে রাখে । স্নেহ-ভালোবাসার পরিবেশ থেকে বঞ্চিত করে তাই । এ পৃথিবী সুন্দর, মনোরম আর সুখকর । তাই এই সুন্দর পৃথিবীতে ভালোবাসা ও প্রীতির মধুর স্পর্শ আরো কিছুকাল ভোগ করতে কার না সাধ হয় । এই স্বাভাবিক মানবিক অনুভূতিকে তুমি বলবে মৃত্যুকে ভয় করা?" রাজগুরু কিছু সময়ের জন্য নীরব হয়ে গেল । আবার বলতে লাগল, "মৃত্যুর সঙ্গে গলাগলি করার জন্য প্রস্তুত হয়েই তো এই সত্যকে চিনেছি । তুমি কি ভাবছ যে সে সংগ্রামের এই অন্তিম পর্বে এসে, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলবো আমায় ছেড়ে দাও । মনে রেখো আমি যা কিছু করছি তা তোমাদের মতো প্রত্যয়দৃঢ় হয়েই করেছি । যে স্বর্গ আমরা রচনা করতে চাই তার আবরণ উন্মোচন করে যদি এতটুকু আলোও দেখাতে ওয়ারী কোটি কোটি দেশবাসীকে আমার প্রাণের বিনিময়ে তা'হলে তাই হবে অনেক । বাকি কাজ দেশের মানুষ নিজেরাই পূর্ণ করে নেবে । এমন আলোকোজ্জ্বল মহান মৃত্যুকে যে ভয় করে তাকে মূর্খ ছাড়া আর কি বলবো । একজন বিপ্লবীর নিকট এ মৃত্যু আশীর্বাদ ।"

=================================================

সুখদেব

বিপ্লবীদের উদ্দেশ্যের সাফল্যে তার বিশ্বাস কতখানি অটল ছিল তার প্রমাণ ফাঁসির কিছু পূর্বে গান্ধীকে লেখা তার চিঠি । "বিপ্লবীদের লক্ষ্য হলো এদেশে সোস্যালিস্ট গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা । এ লক্ষ্যের সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই । ... আমি মনে করি ... আপনার এই ধারণা হবে না যে বিপ্লবীরা যুক্তিহীন হয় এবং তারা নিছক ধ্বংসের কাজে আনন্দ পায় । আমরা আপনাকে জানিয়ে দিতে চাই যে, সত্য কথা এর বিপরীত । তারা প্রত্যেকটি পদক্ষেপের পূর্বে চারদিককার সম্বন্ধে বিচার করে নেয় । তারা তাদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সদা সচেতন থাকে । তারা আপন বিপ্লবী বিধানে গঠনমূলক কাজের উপযোগিতাকে মুখ্য স্থান দেয়, যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে তার ধ্বংসাত্মক দিকটাই বেশি নজর দিতে হয়েছে ।"

"... সে দিন আর বেশী দূর নেই তাদের (বিপ্লবীদের) নেতৃত্বে ও তাদের পতাকার তলে জনগণকে তাদের সমাজবাদী প্রজাতন্ত্রের উচ্চ লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে দেখা যাবে ।"

এই চিঠির এক স্থলে তার ফাঁসির সাজা সম্বন্ধে সে লিখলো, "লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার তিন জন অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ডের হুকুম হয়েছে এবং যারা ঘটনাক্রমে দেশে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেছে তারাই বিপ্লবী দলের সব কিছু নয় । বাস্তবিক পক্ষে তাদের মৃত্যুদণ্ড মকুব হলে দেশের পক্ষে ততো কল্যাণকর হবে না যতখানি হবে তাদের ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুবরণ করলে ।"

=================================================

মহাবীর সিংহ

মহাবীরের বাবার সে চিঠির অক্ষর ও শব্দ আজ বিয়াল্লিশ বছর পরও আমার হুবহু মনে পড়ছে । তিনি লিখেছিলেন :

"একথা জেনে খুবই আনন্দিত হলাম যে, তুমি দেশের কাজে নিজেকে অর্পণ করতে কৃতনিশ্চয় হয়েছ । আমার তো ধারণা হয়েছিল যে, আমাদের বংশে পূর্বপুরুষের রক্ত আর নেই । সবাই মনে-প্রাণে দাসত্ব মেনে নিয়েছে । তোমার চিঠি পড়ে আজ আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি ।"

"যেখানে তোমার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল, তাদের আজ উত্তর লিখে দিয়েছি । তুমি এ বিষয়ে নিশ্চিত থেকো যে আমি এমন কিছু করবো না যাতে তোমার সংকল্পে বাধা সৃষ্টি হয় ।"

"দেশ সেবার যে পথ তুমি বেছে নিয়েছ, মনে রেখো, তা সাধনার পথ, বড়ই দুরূহ সেই পথ । তবু তুমি যখন এই পথে পা বাড়িয়েছ তখন আর পিছনে ফফিরে তাকাবে না । সাথীদের ধোঁকা দিও না এবং তোমার বৃদ্ধ পিতার নামের খেয়াল রেখো ।"

"তুমি যেখানেই থাক না কেন আমার আশীর্বাদ তোমার সঙ্গে থাকবে ।"

- তোমার পিতা, দেবী সিংহ

=================================================

অনশন শেষ হবার পর সহকর্মী জয়দেব কাপুর মহাবীর সিংহের একটি নোট বই পেয়েছিল । কাপুরের কথায় ঐ নোট বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় পুশকিনের একটি ছোট কবিতা লেখা ছিল যা মহাবীর সিংহের উপযুক্ত । ওই কবিতা ও তার অনুবাদ নিচে দিলাম । এই কবিতার ছত্রগুলি মহাবীর সিংহের বিপ্লবী জীবন বুঝতে সাহায্য করবে ।


I know destruction awaits him,
who first rises
Against the oppressor's yoke;
My fate is sealed aand closed,
But tell me where and when
Without victims
Was ever freedom won?
For my native land I perish
I feel it and I know it
And in my heart O Holy father!
My fatal star
I bless!

=================================================

যতীন্দ্রনাথ দাশ

লাহোরে কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৬২ দিন অনশন সংগ্রাম চালানোর পর শহীদের মৃত্যুবরণ করেন ।

অবশেষে ১৩ই জুলাই, ভগত সিংহ ও দত্তের সমর্থনে আমাদের মধ্যে দু'চার জন ব্যতীত আর সবাই অনশন সংগ্রাম আরম্ভ করলো ।

আমাদের মধ্যে একমাত্র যতীন দাশ ছাড়া কারো অনশনের অভিজ্ঞতা ছিল না । ভাবাবেগে চালিত হয়ে অনশন সংগ্রামে যোগ দিতে যতীন্দ্রনাথ নিষেধ করলো সাথীদের । সে বললো, "রিভালবার পিস্তল নিয়ে লড়াই করার চেয়ে  অনেক বেশি কঠিন এক অনশন সংগ্রামে আমরা নামছি । অনশন সংগ্রামীকে তিল-তিল করে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যেতে হয় । শত্রুর সঙ্গে সম্মুখ লড়াইয়ে গুলির আঘাতে প্রাণ দেওয়া, বা ফাঁসির রশিতে জীবন দেওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ । অনশনে অংশ নিয়ে পরে পিছু হটলে বিপ্লবীদের প্রতিষ্ঠা ধুলায় লুটিয়ে পড়বে । তাই বলছি যে যোগ দিয়ে পিছিয়ে পড়ার চেয়ে প্রথম থেকেই অনশনে যোগ না দেওয়াই সমীচীন ।"

সে আরো বলে যে, সে নিজে অনশন আরম্ভ করলে যতদিন না সরকার দাবিসনদ মেনে না নেয়, ততদিন অনশন চালিয়ে যাবে । সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে বলে যে, তাড়াহুড়ো করে কিছু না করাই ভালো । আরো একদিন সময় নিক তারা । ভালো করে বুঝে-সুঝে অনশনে যোগ দিক । যারা নিজেদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবলে সন্দিহান, তাদের অনশনে যোগ না দেওয়াই বাঞ্চনীয় । সে একথাও স্পষ্ট করে বলে যে, যারা অনশন করবে না তারাও অন্যদের মতো সম্মানিত বিপ্লবী হিসাবে গণ্য হবে ।

=================================================

সেইদিন থেকে তিলে তিলে তার মৃত্যুর পথে যাত্রা শুরু হলো । শহীদের মৃত্যুবরণের পথে প্রত্যেকটি মুহূর্তে তার শান্ত ও সৌম্য চেহারায় দৃঢ় সংকল্পের রেখা আরও গভীর হয়ে ফুটে উঠলো ।

কয়েকদিনের মধ্যে তার অবস্থা খারাপ হলো । সারা দেহে বিষক্রিয়া ছড়িয়ে গেল । চোখ বন্ধ হয়ে এল । ডাক্তার ডুশ প্রয়োগ করতে চাইল । কিন্তু সে অসম্মতি জানাল । কংগ্রেসের বহু নেতা, ডিফেন্স কমিটির সদস্যবৃন্দও অনুরোধ জানালো । কিন্তু তাতে কাজ হলো না । সরকারকে কেউ জানালো যে, হয়তো সে ভগত সিংহের কথা মানবে । এই পরামর্শ পাবার পর ভগত সিংহকে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আনা হলো । ভগত সিংহ তাকে একবার অনুরোধ করাতে দাশ ডুশ নিতে রাজি হলো । জেলের জনৈক কর্তাব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেছিল যতীন্দ্রনাথকে "আপনি কারো অনুরোধ রাখেননি । কিন্তু ভগত সিংহ বলতেই রাজি হলেন কেন ?" উত্তরে সে বলে, "আপনি জানেন না ভগত সিংহ কি ধরনের বীরপুরুষ । আমি কখনো তার কথা ফেলতে পারি না ।"

আর একবার ভগত সিংহ তাকে ওষুধ খেতে অনুরোধ করে । তখন সে জবাব দেয়, "শোন ভগত সিংহ, আমি জানি যে, আমার শপথ ভঙ্গ করা উচিত নয় । কিন্তু তোমার অনুরোধও অগ্রাহ্য করতে পারি না । যাই হোক, এর পর কোন অনুরোধ আমায় করো না ।" তার অবস্থার অবনতি দেখে তাকে মেয়ো হাসপাতালে পাঠাতে চাইলো সরকার । কিন্তু যতীন্দ্রনাথ সে হাসপাতালে যেতে অস্বীকার করলে সরকার তাকে জামিনে খালাস করার সিদ্ধান্ত নিলো । জনৈক সাজানো শেঠ জামিনদার হতে রাজিও হলো । হঠাৎ ছাড়া পাবার খবর পেয়ে যতীন্দ্রনাথ সবাইকে তার পাশে ডেকে নিয়ে বসলো "এ সব ধোঁকাবাজি, সরকার জানে আমার দিন ঘনিয়ে এসেছে । আমার মৃত্যুর দায়িত্ব সে নিতে চায় না । তাই আমাকে জেলের বাইরে বার করে দিয়ে আমার থেকে রেহাই পেতে চায় । আমি এটা হতে দেব না ।" এ-কথা বলে আমাদের দিকে তাকাল । বললো, "আমি এখানে মাঝে থেকে, লড়াই করেই মরতে চাই । আমি চাই তোমরাও সাধ্যমতো বাধা দাও যাতে আমাকে এখান থেকে না সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে ।"

=================================================

Wednesday, 24 May 2017

নন্দীগ্রাম সিঙ্গুর পেরিয়ে - ডঃ সমীরকুমার মুখোপাধ্যায়

১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় আসার ঠিক পরের বছরই পঞ্চায়েত নির্বাচন করে গ্রামের মানুষকে ক্ষমতায়নের পথে এগিয়ে দেওয়ার পথে চালিত করে বাম সরকার । এতে করে একদিকে যেমন কৃষকের ক্ষমতায়ন ও তাদের মর্যাদার আইনী স্বীকৃতি ঘটেছিল অন্যদিকে তেমনি কৃষকেরা জমিদার জোতদার-মহাজনী চক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার প্রতিষ্ঠানিক হাতিয়ার পেয়েছিলেন । গ্রাম বাংলায় ক্ষমতার কাঠামোর যেমন আমূল পরিবর্তন ঘটল তেমনি কৃষির উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বাড়তে শুরু করল । ধান, গম, আলু, পাট, শস্য উৎপাদনে দেশের সামনের সারিতে উঠে আসে পশ্চিমবঙ্গ । একই সঙ্গে গ্রাম বাংলার সমাজ-অর্থনীতিতে মৌলিক রূপান্তর ঘটেছিল, অবশ্যই তা সমাজতান্ত্রিক নয়, তা ছিল কৃষিতে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে 'লাঙ্গল যার, জমি তার' নীতির আক্ষরিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে গ্রাম বাংলাকে গণতান্ত্রিক ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করা । সারা দেশে কৃষি জমির মাত্র ৩% এই রাজ্যে, অথচ বন্টিত জমির ২০% এই রাজ্যে । কলকাতার বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের আলোচনায় যাঁরা ৩৪ বছরকে এই রাজ্যের কৃষ্ণ গহ্বরে ঢুকে যাওয়ার কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেন তাঁদের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ বামেদের আপনারা তুলোধোনা করুন, ওটাই আপনাদের কাজ তবে তথ্যগুলোকে আড়াল করবেন না, জানবেন আমাদের মতন অর্ধ ও স্বল্পশিক্ষিত লোকেরা আপনাদের আলোচনা থেকে আলোকিত হতে চেষ্টা করি । প্রসঙ্গত বলি কলকাতার একটি টিভি চ্যানেলের সঞ্চালক 'ঈশ্বর পরিত্যক্ত এই রাজ্যে', 'বামেদের রক্তক্ষরণ', 'বামেদের শীতঘুম', 'জুরাসিক যুগের তত্ত্ব', 'একবার ক্ষমতা থেকে চলে গেলে বামেরা আর ক্ষমতায় ফেরে না' প্রভৃতি শব্দবন্ধের মাধ্যমে বাম্পন্থাকে হেয় করে প্রচুর আনন্দ পান, সেটা পাওয়ার অধিকার তাঁর নিশ্চয়ই আছে, তবে আমার ছোট্ট অনুরোধ সঞ্চালকের আসনে থাকাকালীন তাঁর আপাত নিরপেক্ষতাটা যেন না হারান ।


==========================================================


তাত্ত্বিকভাবে মূল লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থেকে বাস্তবোচিত নীতি গ্রহণই হল pragmatism ।

Tuesday, 11 April 2017

জাতিসমস্যায় মার্কসবাদ - সুপ্রকাশ রায়

"জাতি হইল, ইতিহাসের বিভিন্ন যুগের মধ্য দিয়া ক্রমবিকাশ-প্রাপ্ত, এক-ভাষাভাষী, নির্দিষ্ট স্থানে বসবাসকারী, একই অর্থনীতিক জীবন-সম্পন্ন এবং সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপের মধ্য দিয়া প্রকাশিত একই মানসিক গঠনযুক্ত স্থায়ী জনসমাজ ।" - J.V.Stalin : Marxism and the National and Colonial Question

=====================================

অস্ট্রালয়েড, মঙ্গোলয়েড এবং "আর্য" নামক মিশ্রিত মনোবসংখ্যাকে লইয়াই বর্তমান বাঙালী জাতি গঠিত । পণ্ডিতগণের মতে, বাঙালী জাতির মধ্যে "আর্য" রক্তের পরিমাণ শতকরা মাত্র পাঁচ ভাগ । বাকি সমস্তই "অনার্য" রক্ত । কোন সুদূর অতীতে কোল-সাঁওতাল-মুন্ডা-ওরাওঁদের পূর্বপুরুষ অর্থাৎ অস্ট্রালয়েড মানবশাখা, কোচ প্রভৃতি মঙ্গোলয়েড, "দ্রাবিড়" বলিয়া কথিত মিশ্রিত মানবগোষ্ঠী বাঙলাদেশে বন-জঙ্গল সাফ করিয়া বসতি স্থাপন করিয়াছিল । পরে "আর্য" বলিয়া কথিত মানুষ আসিয়া বাঙলাদেশে বাস করিতে থাকে । তাহার পর কালক্রমে এই জনসমষ্টি পরস্পরের সহিত মিশিয়া গিয়া এবং ইতিহাসের অর্থাৎ সমাজ-বিকাশের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করিয়া বাঙালী জাতিতে পরিণত হইয়াছে ।

=====================================

কেবলমাত্র কৃষি মানব-শাখার ঐক্য সাধনে অক্ষম । ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাই উহার শোষণ-কার্যের প্রয়োজনে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মিশ্রণ ঘটাইতে এবং উহাদের একজাতিরূপে গড়িয়া তুলিতে পারে ।

=====================================

বহু ভিন্ন ভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী বা উপজাতির মিশ্রণের ভিত্তিতেই প্রত্যেকটি আধুনিক জাতির জন্ম । এঙ্গেলস-এর কথায় :
"ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপেই কোন জাতিগোষ্ঠী বা উপজাতির মানুষ ভিতরে ও বাইরে সংহত ও ঘনিষ্ঠ হতে বাধ্য হয় । এইভাবে সর্বত্র পরস্পর-সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীও সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া বসবাসের এবং শীঘ্রই পরস্পরের সহিত মিশিয়া যাইবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে । ইহারাই অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ ঐ নিজ নিজ বাসভূমি একত্র করিয়া একটিমাত্র জাতির বাসভূমি সৃষ্টি করে ।"

F.Engels : The Origin of the Family, Private Property and the State

=====================================

আধুনিক ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মূলধনী শ্রেণীর পণ্যের বাজার সৃষ্টির তাগিদে দেশের বিভিন্ন অংশের মধ্যে এবং আদিবাসীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ গড়িয়া উঠে । জাতীয় সংহতি সৃষ্টির কার্যে ধনতন্ত্রের শক্তি অসাধারণ । ধনতন্ত্রই সামন্ততন্ত্রের বাধা চূর্ণ করিয়া জনসমষ্টিকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া তোলে । ধনতন্ত্রই বিশাল শিল্পাঞ্চলগুলিতে শ্রমিকরূপে বিপুল জনসংখ্যার সমাবেশ ঘটায় । ধনতন্ত্রই শিল্পকেন্দ্র শহরের সহিত কাঁচামালের সরবরাহ-ক্ষেত্র গ্রামাঞ্চলের সংযোগ স্থাপন করে এবং সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি করে ইহার সহিত অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধযুক্ত একটি মধ্যশ্রেণী । এই মধ্যশ্রেণীই তখন ধনতন্ত্রের মুখপাত্ররূপে জাতীয়তার ধারণা অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ প্রচার করে । ভারতবর্ষেও ধনতন্ত্রের প্রয়োজনে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় আন্দোলন গড়িয়া উঠিয়াছে । ভারতবর্ষের মূলধনীশ্রেণীও উহার অনুগত মধ্যশ্রেণীর সহায়তায় জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি করিয়াছে এবং উহাদের শোষণের প্রয়োজনে বহু জাতিতে বিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও সকল ভারতবাসীকে এক জাতি বলিয়া প্রচার করিয়াছে এবং এখনও করিতেছে ।

=====================================

"জাতি হইল সমাজের বিকাশ-ধারার বুর্জোয়াযুগের একটি অনিবার্য রূপ --- একটি অতি প্রয়োজনীয় পরিণতি ।"

Lenin : The Teachings of Karl Marx

=====================================

পশ্চিম ইউরোপে এক-একটি জাতি লইয়া এক-একটি রাষ্ট্র গঠিত হইয়াছে । এই সকল রাষ্ট্রে অন্য কোন জাতির অস্তিত্ব না থাকায়, এই সকল একজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে জাতীয় উৎপীড়নের কোন প্রশ্ন উঠে নাই । কিন্তু পূর্ব-ইউরোপে ও প্রাচ্য জগতে, যেমন ভারতবর্ষে, বহুজাতি-ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠিত হইয়াছে । এই সকল বহুজাতি-ভিত্তিক রাষ্ট্রে প্রভুত্ব করিতেছে ঐ রাষ্ট্রেরই কোন একটি বিশেষ উন্নত জাতি, আর অনগ্রসর জাতিগুলি বা জাতীয় জনশাখা বা উপজাতিগুলি প্রথমে ঐ প্রভুত্বকারী জাতিটির রাজনীতিক দাসত্বের এবং পরে অর্থনীতিক দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইয়াছে । প্রাচ্য জগতের এই বহুজাতি-ভিত্তিক রাষ্ট্রগুলিই জাতীয় উৎপীড়নের প্রধান ক্ষেত্র । এই প্রকারের জাতীয় উৎপীড়ন, অর্থাৎ একজাতির উপর অন্য জাতির উৎপীড়ন হইতেই জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ, জাতীয় আন্দোলন, জাতিগত সমস্যা প্রভৃতির সৃষ্টি হইয়াছে ।

=====================================

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বৈপ্লবিক সংগ্রামের জোয়ারে সমগ্র ভারতবর্ষের সাম্রাজ্যবাদী, সামন্ততান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক শোষণ-ব্যবস্থা ভাসিয়া যাইবার উপক্রম হয় তখন প্রত্যক্ষ শাসন আর সম্ভব নয় বুঝিয়া সাম্রাজ্যবাদীরা সমগ্র ভারতবর্ষকে ভাঙিয়া ভারত, পাকিস্তান ও ব্রহ্মদেশ এই তিনটি বহু-জাতিভিত্তিক নূতন রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে এবং এই তিনটি নূতন রাষ্ট্রের বৃহৎ বুর্জোয়া ও সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের হাতে শাসনভার ছাড়িয়া দিয়া পর্দার আড়ালে সরিয়া দাঁড়ায় ।

=====================================

যুদ্ধের সময় ঔপনিবেশিক বা আধা-ঔপনিবেশিক দেশসমূহের জনসাধারণের নিকট সাম্রাজ্যবাদীদের সাহায্যের আবেদনের ফলে উহাদের দুর্বলতা জনসাধারণের নিকট স্পষ্ট হইয়া উঠে, ঔপনিবেশিক দেশগুলির জনসাধারণের মনে আত্মশক্তিতে বিশ্বাস দেখা দেয় এবং সাম্রাজ্যবাদের শোষণ-উৎপীড়ন হইতে মুক্তিলাভের জন্য সংগ্রামের সাহস ও সংকল্প জাগিয়া উঠে । তাহার ফলেই আরাম্ভ হয় জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম । প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ভারতবর্ষেও এই সংগ্রাম চরমরূপ গ্রহণ করিয়াছিল ।

=====================================

প্রথম মহাযুদ্ধের পর আর একটি বিশেষ কারণেও জাতিগত সমস্যা ব্যাপকতর হইয়াছে, উহা বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিক সমস্যায় পরিণত হইয়াছে এবং জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের শক্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে । এই সময় জাতিগত সমস্যা প্রথমে বিচ্ছিন্ন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের আকারে এবং পরে সর্বগ্রাসী দাবাগ্নির আকারে বিশ্বব্যাপী মুক্তি-সংগ্রামরূপে দেখা দিয়াছে । এই বিশেষ কারণটি ছিল, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির দ্বারা তুরস্কের অঙ্গচ্ছেদ এবং রাষ্ট্র হিসাবে উহার অস্তিত্বের বিলোপসাধনের প্রয়াস । সে সময় তুরস্ক ছিল রাজনীতিক দিক থেকে সমগ্র মুসলিম জগতে সর্বাপেক্ষা অগ্রসর এবং অসাধারণ মানমর্যাদার অধিকারী । সাম্রাজ্যবাদীদের এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তুরস্ক উহার জাতীয় স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য সংগ্রাম আরম্ভ করে । তাহার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের পদানত দেশগুলি অর্থাৎ প্রাচ্যের ঔপনিবেশিক জগতের সমগ্র মুসলমান জনসাধারণ তুরস্কের পক্ষে দন্ডায়মান হয় এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ঔপনিবেশিক জগতের মুক্তি-সংগ্রামে যোগদান করে । ইহার ফলে ঔপনিবেশিক জগতের সংগ্রামী শক্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পায় । ভারতবর্ষে 'খিলাফত সংগ্রাম' ইহার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত । এইভাবে সংগ্রামের ক্ষেত্রে অনগ্রসর মুসলমান জনসাধারণের আবির্ভাব জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের পক্ষে একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ।

=====================================

বিশ্বব্যাপী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম দুর্বার হইয়া উঠে ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দে হইতে । বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার গর্ভ হইতে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মত দেখা দেয় 'নভেম্বর বিপ্লব' । তাহার ফলে ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দে ঔপনিবেশিক জগতের মুক্তির বাণী লইয়া আবির্ভূত হয় সমাজতন্ত্রী সোভিয়েত রাষ্ট্র । সাম্রাজ্যবাদের কবল হইতে প্রাচ্যের ঔপনিবেশিক জগতের মুক্তির বাণী ছিল ইহার পতাকায় অঙ্কিত । রুশিয়ার জার সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক দাসত্ব হইতে মুক্তিলাভ করিল বহু জাতি । এই সফলতায়  প্রাচ্যের ঔপনিবেশিক জগতের মানুষ মুক্তি-সংগ্রামের দুর্বার প্রেরণা লইয়া জাগিয়া উঠে । এইভাবে স্তালিনের ভাষায়, 'গড়িয়া উঠে আয়ার্ল্যান্ড হইতে ভারতবর্ষ পর্যন্ত এক অখণ্ড ও বিশাল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ফ্রন্ট ।"

=====================================

প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালের মত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরেও, অর্থাৎ সম্প্রতিকালেও কতকগুলি নূতন বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র আবির্ভূত হইয়াছে । এই সকল রাষ্ট্রও দীর্ঘকালের জাতীয় আন্দোলনের পরেই জন্মলাভ করিয়াছে । বুর্জোয়াশ্রেণীই ছিল এই সকল জাতীয় আন্দোলনের পরিচালক । সুতরাং এই নূতন রাষ্ট্রগুলিও বুর্জোয়া রাষ্ট্র রূপে দেখা দিয়াছে । দৃষ্টান্তস্বরূপ ভারত, পাকিস্তান এবং ব্রহ্মদেশের নাম করা যায় । বুর্জোয়া রাষ্ট্র বলিয়াই এই সকল নবজাত বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রেও বিভিন্ন জাতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হয় নাই এবং বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী বা উপজাতির উপর একটি বা কয়েকটি বৃহৎ ও উন্নততর জাতির শোষণ-উৎপীড়নেরও অবসান ঘটে নাই । ইহার মূল কারণ এই যে, এই সকল নূতন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং শ্রেণীর শোষণ-উৎপীড়নের ভিত্তির উপর, শ্রমিকশ্রেণী ও কৃষকের উপর মূলধনী ও জমিদার শ্রেণীর উপর শ্রেণীর শোষণ-উৎপীড়নের ভিত্তির উপর । সংক্ষেপে বলা যায়, এই নূতন বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রগুলি হইল শ্রেণীরাষ্ট্র এবং ইহারা শোষক-শ্রেণীগুলির শোষণ-উৎপীড়নের যন্ত্র ভিন্ন অন্য কিছু নয় । সুতরাং এই সকল রাষ্ট্র শ্রেণী শোষণ অব্যাহত রাখিবার জন্য পীড়ন-যন্ত্র অর্থাৎ শাসন-ক্ষমতা বা রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যতীত একদিনও টিকিয়া থাকিতে পারে না ।

=====================================

এই প্রকারের রাষ্ট্রই নিজ স্বার্থ রক্ষার জন্য, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ বিগ্রহ পরিচালনার জন্য শেষ পর্যন্ত আর্থিক ও সামরিক দিক হইতে শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির সাহায্যপ্রার্থী হইতে বাধ্য হয় । এই আর্থিক ও সামরিক সাহায্য লাভের শর্ত হিসাবেই এই প্রকারের রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির আজ্ঞাবহ ভৃত্যে পরিণত না হইয়া পারে না,-- যেমন হইয়াছে তথাকথিত স্বাধীন ভারতরাষ্ট্র ।

=====================================

"উৎপীড়িত জাতিসমূহের মুক্তি ও স্বাধীনতা ব্যতীত সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার কথা যেমন ভাবা যায় না, তেমনই বিভিন্ন জাতির উপর উৎপীড়ন ব্যতীত ধনতন্ত্রের অর্থাৎ বুর্জোয়া শাসনের অস্তিত্বের কথাও চিন্তা করা যায় না । যতদিন পর্যন্ত কৃষক জনসাধারণ এবং পাতিবুর্জোয়াশ্রেণী জাতীয়তাবাদের মোহে আচ্ছন্ন হইয়া থাকিবে এবং বুর্জোয়াশ্রেণীর নির্দেশে পরিচালিত হইবে, ততদিন উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ অনিবার্য । কিন্তু যখনই কৃষক জনসাধারণ শ্রমিকশ্রেণীর অনুগামী ও শ্রমিকশ্রেণীর নির্দেশে পরিচালিত হইবে তখনই বিভিন্ন জাতির মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হইবে, এক জাতির উপর হইতে অন্য জাতির শোষণ-উৎপীড়নের অবসান ঘটিবে এবং জাতিসমূহের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত হইবে ।" - স্তালিন

=====================================

মার্কস-এঙ্গেলস তাঁহাদের 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'-তে জাতি-সমস্যাটিকে কোন সংকীর্ণ জাতিগত দৃষ্টিকোণ হইতে বিচার না করিয়া শ্রমিকশ্রেণীর আন্তর্জাতিক আদর্শ দ্বারাই বিচার করিয়াছেন এবং দেখাইয়াছেন যে, কেবল শ্রমিকশ্রেণীর আন্তর্জাতিকতা দ্বারাই এই সমস্যার পূর্ণ সমাধান সম্ভব । এই শ্রমিক আন্তর্জাতিকতাই সমগ্র 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'র মূল আদর্শ । তাই 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো' ঘোষণা করিয়াছে :

"অন্যান্য শ্রমিক পার্টি ও কমিউনিস্টদের মধ্যে পার্থক্য এই যে, - (১) বিভিন্ন দেশের শ্রমিকশ্রেণীর জাতীয় সংগ্রামে কমিউনিস্টরা সমগ্র শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থকে সংকীর্ণ জাতীয়তার প্রশ্ন হইতে স্বতন্ত্রভাবে বিচার করিবে এবং সেই ভাবেই এই প্রশ্নের উপর গুরুত্ব আরোপ করিবে; (২) বুর্জোয়াশ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রাম যে সকল বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করিয়া অগ্রসর হইবে, সংগ্রামের সেই সকল স্তরে কমিউনিস্টরা সকল সময় এবং সমগ্র শ্রমিক-সংগ্রামেরই প্রতিনিধিত্ব করিবে ।"

ইহাই জাতিগত প্রশ্নে কমিউনিস্টদের বিচারের মূল ভিত্তি । শ্রমিকশ্রেণী সকল প্রকারের শোষণ-উৎপীড়নের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করে । সুতরাং তাহারা তাহাদের শ্রেণীগত আদর্শ হিসাবেই প্রত্যেকটি উৎপীড়িত জাতির স্বাধীনতা-সংগ্রামও সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে । কিন্তু তাই বলিয়া শ্রমিকশ্রেণী কখনও "ন্যায়-অন্যায় যাহাই করুক না কেন আমার জাতি, আমার দেশ" অথবা "আমার দেশ সবার ঊর্দ্ধে"-প্রভৃতি বুর্জোয়া ও পাতিবুর্জোয়া নীতি সমর্থন করে না । কোন জাতির মুক্তি-সংগ্রামের গতি প্রকৃতি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের দিকে কিনা তাহা বিচার করিয়াই শ্রমিকশ্রেণী জাতীয় সংগ্রাম সমর্থন করে ।

=====================================

মার্কসবাদীদের মতে, যে প্রতিক্রিয়াশীল শাসন ও শোষণব্যবস্থা ক্ষুদ্র-বৃহৎ সমস্ত জাতির স্বাধীন বিকাশ ও স্বাধীন অস্তিত্বের পক্ষে বাধাস্বরূপ, সেই শোষণ ও শাসন-ব্যবস্থার ধ্বংস সাধনেই প্রত্যেকটি জাতির মূলস্বার্থ রক্ষিত হইতে পারে । সুতরাং জাতীয় স্বাধীনতার জন্য যে সংগ্রাম পরিচালিত হয় তাহা নিঃসন্দেহে প্রগতিশীল । কিন্তু সেই সংগ্রাম আন্তর্জাতিক মুক্তি-সংগ্রামের সহিত কতখানি সম্পর্কযুক্ত তাহাই উহার প্রগতিশীলতার মাপকাঠি । এই জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম যে পরিমাণে বিশ্বের সমগ্র মানবজাতির পশ্চাদপদ অবস্থা ও শোষণ-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে এবং অগ্রগতির জন্য আন্তর্জাতিক সংগ্রামের সহিত সম্পর্কযুক্ত হইবে, জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম কেবল ততখানিই প্রগতিশীল বলিয়া গণ্য হইবে । আন্তর্জাতিক সংগ্রাম হইতে বিচ্ছিন্ন জাতীয়তাবাদকে শ্রমিকশ্রেণী বা মার্কসবাদ অগ্রাহ্য করে ।

=====================================

মার্কস-এঙ্গেলস উৎপীড়ক দেশের শ্রমিকশ্রেণীর কর্তব্য বিশেষভাবে নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন । যে প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা ঐ রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন জাতির শোষণ-উৎপীড়নের জন্য এবং প্রতিবেশী দেশসমূহকে গ্রাস করিবার জন্য ব্যবহৃত হয়, সেই রাষ্ট্রের শ্রমিকশ্রেণী কখনও তাহাদের তথাকথিত পিতৃভূমিকে সমর্থন করিতে পারে না । সেই রাষ্ট্র-ক্ষমতার বিরুদ্ধেই শ্রমিকশ্রেনীকে সংগ্রাম করিতে হইবে ।

=====================================

১৯৬৪ সালে আমেরিকার নিগ্রো জনসাধারণের সংগ্রাম সমর্থন করিবার জন্য সমস্ত বিশ্বের জনসাধারণকে আহবান জানাইয়া মাও সে-তুঙ লিখিয়াছিলেন :
"শেষ বিশ্লেষণে জাতীয় সংগ্রাম মূলত শ্রেণী সংগ্রাম ।"

=====================================

রাজনীতিক ও সামাজিক মুক্তি কেবল বিপ্লবের দ্বারাই সম্ভব । সুতরাং বলা যায় : 'প্রত্যেকটি শোষিত জাতি ও শ্রেণীর পক্ষে বিপ্লবই মূল প্রশ্ন ।' - মাও সে-তুং

=====================================

জাতীয় বিপ্লব জাতির জনসাধারণের - শ্রমিক কৃষকের - প্রত্যেকটি শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেণীর বিপ্লবের প্রশ্ন । কারণ, জাতির সর্বাধিক জনসংখ্যার - শ্রমিক-কৃষক ও অন্যান্য শোষিত শ্রেণীর স্বার্থই জাতীয় স্বার্থ । সুতরাং জাতীয় মুক্তির অর্থ, শোষণ-উৎপীড়ন হইতে জাতির সর্বাধিক জনসংখ্যার, বিশেষত শ্রমজীবী জনসাধারণের, শ্রমিক-কৃষকের মুক্তি ।

=====================================

ভারতের সংশোধনবাদী কমিউনিস্ট নেতৃত্ব সেদিন অর্থাৎ ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলমানের মিলন ও ঐক্যের অজুহাতে কেবল ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দুস্থান-পাকিস্তান এই দুই ভাগে ভারত ভাগের সহায়তা করিয়া মার্কসবাদকে কবরস্থ করিয়াছিল ।

ধর্ম জাতিত্বের কোন নিয়ামক উপাদান হইতে পারে না - এই মার্কসবাদী সত্যটিকে সংশোধনবাদী কমিউনিস্ট নেতৃত্ব সেদিন অস্বীকার করিয়াছিলেন । জাতি-সমস্যার সমাধান যে কেবল বিপ্লবের মধ্য দিয়াই সম্ভব - মার্কসবাদের এই মহাসত্যটিকে এড়াইবার জন্যই কমিউনিস্ট নেতৃত্বের এই বিশ্বাসঘাতকতা ।

=====================================

সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী শ্রেণী বলিয়া শ্রমিকশ্রেণীই হইবে ভারতের ঐক্যবদ্ধ বৈপ্লবিক 'ফ্রন্টের' নায়ক ও সংগঠক । শ্রমিকশ্রেণী একটি আন্তর্জাতিক বিপ্লবী শক্তি । তাই শ্রমিকশ্রেণী জাতি-বন্ধন ও দেশ-বন্ধনের ঊর্ধ্বে । এই জন্য একমাত্র শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বেই জাতি-উপজাতিসমূহের মুক্তি-সংগ্রাম, আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম, মুক্ত জাতি-উপজাতিসমূহের সমাজতন্ত্রের পথে জয়যাত্রার সংগ্রাম সফল হইতে পারে । ভূমির বন্ধনে আবদ্ধ কৃষক-সম্প্রদায়কে একমাত্র শ্রমিকশ্রেণীই পারে সামন্ততন্ত্রের বন্ধন হইতে মুক্ত করিয়া সমাজতন্ত্রের পথে চালিত করিতে । তাই ভারতের শ্রমিকশ্রেণীই হইবে ভারতের ঐক্যবদ্ধ বৈপ্লবিক 'ফ্রন্টের' জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের চালক-শক্তি ।

শ্রমিকশ্রেণী একটি অখণ্ড সর্বভারতীয় শক্তি । বাহিরের দিক হইতে জাতিগতভাবে বিভক্ত হইলেও শ্রেণীগতভাবে ইহারা এক ও অখণ্ড, শ্রেণী-চরিত্রের দিক হইতে অবিভাজ্য । ভারতের শ্রমিকশ্রেণী আজ একটি সর্বভারতীয় বিপ্লবী রাজনীতিক শক্তিরূপে আবির্ভূত, বৈপ্লবিক ভূমিকায় সুপ্রতিষ্ঠিত । তাই ভারতের বিভিন্ন জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামগুলিকে শ্রমিকশ্রেণীই জাতীয় পরিসরে সংগঠিত করিবে, ইহাদের মধ্যে ঐক্য গড়িয়া তুলিবে । ভারতের শ্রমিকশ্রেণীই শহরাঞ্চলের শোষিত মধ্যশ্রেণীর সংগ্রাম, জাতীয়-বুর্জোয়াগোষ্ঠীর সংগ্রাম গড়িয়া তুলিবে, এই সংগ্রামগুলিকে পরিচালিত করিবে এবং এক বৈপ্লবিক 'ফ্রন্টে' ঐক্যবদ্ধ করিবে ।

ভারতের শ্রমিকশ্রেণীই হইবে বিভিন্ন জাতি-উপজাতির এবং বিভিন্ন অঞ্চলের খন্ড খন্ড গণতান্ত্রিক বিপ্লবসমূহের সংগঠক, ঐক্যসাধক ও পরিচালক । শ্রমিকশ্রেণীর পরিচালনায়ই এই জাতীয় ও উপজাতীয় বিপ্লবসমূহ বিচ্ছিন্ন না থাকিয়া এক মহাজাতীয় বিপ্লবে পরিণত হইবে এবং দ্রুত গণতান্ত্রিক স্তর উত্তীর্ণ হইয়া সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে প্রবেশ করিবে ।

=====================================

"মানব-সমাজ যে বিভিন্ন রাষ্ট্রে ও জাতিতে বিভক্ত হইয়া রইয়াছে কেবল তাহার অবসান ঘটানোই সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য নয়, কেবল জাতিসমূহের বাহ্যিক মিলন ঘটানোই সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য নয় , সকল মানুষ যাহাতে মিলিয়ে মিশিয়া একাকার হইয়া যায় তাহাই সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য । ... উৎপীড়িত শ্রেণীসমূহের একনায়কত্বের পরিবর্তনশীল যুগের মধ্য দিয়া যাহাতে মানব জাতির মধ্য হইতে সকল শ্রেণীর অস্তিত্ব লোপ পায়, যাহাতে উৎপীড়িত জাতিসমূহ বিচ্ছিন্নতা ও স্বাধীনতার যুগের মধ্য দিয়া শেষ পর্যন্ত পূর্নমুক্তি লাভ করিয়া মিলিয়ে একাকার হইয়া যাইতে পারে তাহাই সমাজতন্ত্রের চরম লক্ষ্য ।" - Lenin : The Significance of Self-Determination






Thursday, 6 April 2017

শ্রীমদভগবাদগীতা ও বর্ণবৈষম্য

শমঃ,দমঃ,তপঃ শৌচম্‌ ক্ষান্তি আর্জবম্‌ এব চ ।
জ্ঞানম্‌ বিজ্ঞানম্‌ অস্তিকম্‌ ব্রহ্ম কর্ম সভাবজম্‌ ।।(১৮:৪২)
অর্থ - শম, দম, তপ, শৌচ, ক্ষান্তি, সরলতা, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও আস্তিক্য এগুলো ব্রাহ্মনদের স্বভাবজাত কর্ম।

শৌর্যম্‌ তেজঃ ধৃতিঃ দাক্ষ্যম্‌ যুদ্ধে চ অপি অপলায়নম্‌ ।
আনম্‌ ঈশ্বরম্‌ ভাবঃ চ ক্ষাত্রম্‌ কর্ম স্বভবজম্‌ ।।(১৮:৪৩)
অর্থ - শৌর্য, তেজ, ধৃতি, দক্ষ্যতা, যুদ্ধে অপরাম্মুখতা, দানশীলতা ও শাসন ক্ষমতা এইগুলি ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত কর্ম  ।

কৃষি গোরক্ষা বানিজ্যম্‌ বৈশ্য কর্ম স্বভাবজম ।
পরিচর্যা আত্মকম্‌ কর্মঃ শুদ্রস্য অপি স্বভাবজম্‌ ।।(১৮:৪৪)
অর্থ - কৃষি, গোরক্ষা ও বানিজ্য এইগুলো বৈশ্যের স্বভাবজাত কর্ম । পরিচর্যা শুদ্রের স্বভাবজাত কর্ম ।

এই পরিচর্যাত্মাক কর্মের অর্থ হলো সেবা করা।উচ্চ তিন বর্ণের মানুষদের ক্রমাগত সেবা করা । মানে যাকে বলে জন্মদাস এবং এটা নাকি আবার স্বভাবজাত । দাসগিরি করা কিভাবে একটি গোত্রের সকল মানুষের স্বভাব হয়ে গেল তা বোঝা গেল না । ঠিক একই ভাবে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা কিভাবে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদেরই স্বভাব কর্ম হয়ে গেল তাও বোঝা কঠিন । কোন শূদ্র কখনো জ্ঞান চর্চা করতে পারবে না, দেশ শাসন করতে পারবে না, কারণ তার জন্ম একটা শূদ্র পরিবারে । মোটকথা ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয় মিলে খাবে-দাবে, ভোগ করবে, দেশ শাসন করবে, বৈশ্যরা করবে গরু পালন আর চাষবাস, শূদ্ররা হবে জন্মোদাস । কি চমৎকার ভগবানের বাণী !


https://blog.mukto-mona.com/2014/02/04/39541/

Tuesday, 4 April 2017

ড. আম্বেদকর ও জাত বর্ণ শ্রেণি - শ্যামল চক্রবর্তী

ভারতে হিন্দুধর্মের হিংস্র বর্ণ-বৈষম্যের মধ্য থেকে নিম্নবর্ণে থাকা মানুষের মুক্তির জন্য এবং শিক্ষার সার্বিক প্রসারের জন্য তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে থাকেন । তাঁর অদম্য মানসিকতা এবং প্রভূত জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে শাসক ১৯৪২ সালে ২ রা জুলাই ভাইসরয়-এর এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে তাঁকে শ্রম-দপ্তরের সদস্য মনোনীত করে । ঐ পদটি ছিল কার্যত ভারতের শ্রম-মন্ত্রীর পদ । ঐ পদ গ্রহণ করে তিনি অনেক বাধা অতিক্রম করে শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণের জন্য উৎসাহ-ব্যঞ্জক নজির সৃষ্টি করেছিলেন । তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল - (১) শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা ও গৃহ নির্মাণে সাহায্য, (২) ট্রেড ইউনিয়ন করার আইনি স্বীকৃতি, (৩) মৃত শ্রমিকদের পরিবারকে এককালীন অর্থ সাহায্য, (৪) ন্যূনতম বেতন প্রদান, (৫) প্রসুতিকালীন সবেতন ছুটি ইত্যাদি । ফলে ভারতের শ্রমিকশ্রেণীর অধিকারের প্রশ্নে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল ।

=============================

আমাদের দেশে অনেক ধর্ম যেমন আছে আবার হিন্দু ধর্মের মধ্যে অনেক জাতও আছে । প্রায় সাড়ে ছয় হাজার । সেটি আরও বিভক্ত বর্ণাশ্রম জাতিভেদে, অর্থাৎ জাত ব্যবস্থায় । যতগুলি জাত ততোগুলি টুকরো । যার সংখ্যা এখন সাড়ে ছ হাজারেরও বেশি । যার প্রত্যেকটির সাথে প্রত্যেকটির 'বিরাগ' আছে । আর ড. আম্বেদকর বলেছেন 'ভারতের এই জাত ব্যবস্থা হল এমনই একটি বহুতল বাড়ি যার একটা তল থেকে আর একটা তলে যাবার সিঁড়ি নেই ।' কার্ল মার্কস যাকে বলেছেন 'বিরাগ', ড. আম্বেদকর তাকে আরও পরিষ্কার করেছেন 'graded inequality' বলে । অর্থাৎ বিরাগ বা ঘৃণার প্রকৃতিটা হলো ক্রমিক অসাম্য । এই যে হাজারটা জাত, মান মর্যাদায় তারা কিন্তু সবাই সমান নয় । প্রত্যেকটি জাত অপর একটি জাতের হয় উপরে নয়তো নিচে অবস্থান করছে, উলম্ব অবস্থান (vertical lay-out), অনুভূমিক (horizontal) নয় । এখানে কায়স্থরা মনে করে তারা মাহিষ্যদের থেকে উপরে এবং ব্রাহ্মণদের নিচে, মাহিষ্যরা মনে করে তারা সদগোপের থেকে উপরে কিন্তু কায়স্থদের থেকে নিচে, বাগদীরা মনে করে তারা সদগোপের থেকে নিচে কিন্তু ডোমেদের থেকে উপরে । নমঃশূদ্ররা মনে করে তারা পৌন্ড্রদের থেকে উপরে ।

এইভাবে ভারতবর্ষের হিন্দুদের প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের ঠোকাঠুকি । অন্য কারও থেকে উপরে আছে তাই সে সন্তুষ্ট । উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে জোট বাঁধার কথা ভাবতেই পারে না । একদিকে 'বিরাগ' আর অন্যদিকে সন্তুষ্টি, তাই মার্কসের ভাষায় সৃষ্টি হয়েছে 'স্থিতিসাম্য' (static balance) । এই static balance-এর জন্যই বর্ণ ব্যবস্থা এত দীর্ঘ সময় টিকে রয়েছে । এবং এই ব্যবস্থার সুফলটুকু অর্থাৎ ক্ষীরটুকু ব্রাহ্মণরা হিন্দু ধর্মের বড়ি খাইতে শূদ্রদের সম্মতি সাপেক্ষেই আত্মসাৎ করেছে ।

=============================

তিনি অচ্ছুতদের জন্যে জমি আর আলাদা কলোনি দাবি করেছিলেন । অবশ্য কৃষিবিপ্লব ছাড়া এ-সব করা সম্ভব নয় । তবে ভূমিদাসদের মতো অন্য সব জাতের মুখ চেয়ে বসে থাকার ব্যাপারটা থেকে বাঁচতে হলে সমস্ত অস্পৃশ্যকে জমি দেওয়ার ভাবনাচিন্তা খুবই সঠিক । কিন্তু সব ভূমিহীন মানুষের অভিন্ন সংগ্রামের ভেতর দিয়েই তো এই লক্ষ্যে পৌঁছানো যেত ।

আম্বেদকর হিন্দুসমাজের অন্যায় লোকাচারের, অন্যায় আচরণের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যে তাঁর অনুগামীদের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করতে বললেন । কিন্তু অন্যায় ভূমিগত সম্পর্কের ভিতের ওপরে গড়ে উঠেছে সমাজের যে ভয়ঙ্কর বাস্তব অবস্থাটা, তা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেই তো পালায় না । প্রেম আর সাম্যের সন্ধানে বেরিয়ে, তা যে পাওয়া গেল না, তার তো জলজ্যান্ত প্রমাণ সাম্প্রতিক নির্যাতন নিপীড়নের সব কান্ডকারখানা । পরিস্থিতিটা এমন করুন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, সবচেয়ে দলিত মথিত যে সম্প্রদায়গুলো, সেখান থেকেও উদ্ভূত বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টি সমতার সম্বন্ধে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটুকু, আরও চাকরি-বাকরি, আসন সংরক্ষণ, শিক্ষার সুযোগ সুবিধা - এইসব দাবির সঙ্কীর্ণ বেড়াটা পার হয়ে আদর্শগতভাবে আর বেশি দূরে এগুতে পারছে না । বর্তমান আর্থ-সামাজিক কাঠামোখানাকে একদম ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবার কাজটা ওঁদের চৈতন্যের বৃত্তের মধ্যে ঠাঁই পায়নি । ভূমিগত সম্পর্কগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বলতে অন্য আর সকলের সঙ্গে যুথবদ্ধ হয়ে অভিন্ন যুদ্ধ চালানোটাও যে বোঝায় - এটা কিন্তু ওঁদের নজরে পড়ল না । এইসব সম্প্রদায় থেকে যে সব বুদ্ধিজীবী উঠে এসেছেন, এঁরাও কেউ আগে, কেউ বা পরে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কাঠামোখানাকেই মেনে নিয়েছেন; জমির সঙ্গে, শিল্পের সঙ্গে বর্তমান সম্পত্তিগত সম্পর্কের ব্যাপারটা একটুও না ছুঁয়েই গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো সম্বন্ধে একটা সাধারণ ঘোষণায় তৃপ্ত হয়ে রয়েছেন ।

=============================

ভারতীয় সমাজে জাতপাত প্রথা একটি বিশেষ ধরনের বৈশিষ্ট্য । এটা একমাত্র ভারতেরই বৈশিষ্ট্য । বিশ্বের অন্য কোনো দেশে এরকম নেই । ভারতে জাতিভেদ শ্রেণিভিত্তিক ভাগাভাগির একটা লক্ষণ । কারণ জাতিভেদ বর্ণপ্রথার নামে অথবা জাতের নামে সমাজের শ্রমজীবী অংশকে দাবিয়ে রাখার জন্যই তৈরি হয়েছে । জাতিভেদ প্রথা শ্রেণি শোষণেরই একটা হাতিয়ার । উদ্বৃত্ত অংশ যত বেশি সম্ভব আত্মসাৎ করার লক্ষ্যেই জাতপাত প্রথার সৃষ্টি । উৎপাদন সম্পর্কের সাথে জাতপাত প্রথা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ।

জাতপাত প্রথার সৃষ্টি হয়েছে প্রায় তিন হাজার বছর আগে । ক্রমান্বয়ে এর পরিমাণগত পরিবর্তন হয়েছে । কিন্তু শোষণের গুণগত উপাদান প্রায় একই রয়ে গেছে । জাতিভেদ প্রথার কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ আছে এবং কিছু নির্দিষ্ট সীমাও আছে । কিন্তু জাত আর শ্রেণি শোষণ ও জাতপাতভিত্তিক শোষণ মিলে গেলে শোষণের তীব্রতা ও পরিমাণ অনেকগুণ বেড়ে যায় । যে দেশে জাত ব্যবস্থা নেই সেই দেশগুলিতে শ্রমিক বা কৃষক বা উভয়ই অর্থাৎ সব ধরনের শোষিতরা দলবদ্ধভাবে বা সুযোগ পেলে ব্যক্তিগতভাবে মালিকের সঙ্গে দর কষাকষি করতে পারে । ইচ্ছে করলে একটা বৃত্তি বা পেশা থেকে অন্য পেশায় চলে যেতে পারে । কিন্তু জাতের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব না । কারণ পেশা হচ্ছে জাতভিত্তিক । ইচ্ছে থাকলেও কোনো পেশার বাইরে অন্য কোনো কাজ করতে পারবে না । পেশাও ঠিক হবে জন্মসূত্রে । কাজেই তার জোট বাঁধারও কোনো সুযোগ নেই । নীচু জাত হবার সুবাদে সমাজে উচ্চশ্রেণির লোকেরা তাকে দাবিয়ে রাখে । তাকে সবসময় একটা ভয় বা আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয় । শারীরিকভাবেও  নিগৃহীত হতে পারে অথবা তাকে সামাজিক দিক থেকেও বয়কট করা হতে পারে বা সমাজ থেকে বের করে দেওয়া হতে পারে । সমাজ থেকে বের করে দেওয়া বা সামাজিক বয়কট তার মৃত্যুর সমান ।

এই ভারতে সামাজিক বিভাজন ঠিক কবে থেকে শুরু তা নিয়ে কিছু সমস্যা আছে । ভারতে প্রাচীনতম সভ্যতা হরপ্পা সভ্যতা (খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছর) ছিল প্রথম নগর সভ্যতা । শ্রেণি বিভাগ বা শ্রেণি শোষণ ছাড়া নগর সভ্যতা গড়ে উঠতে পারে না । কাজেই শ্রেণি শোষণ ছিল এটা নিশ্চিত । কিন্তু যতদিন পর্যন্ত হরপ্পা লিপি পড়া না যাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত জানা যাবে না যে তখন জাত ভাগ ছিল কিনা । বৈদিক সাহিত্য অনুযায়ী প্রায় খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার সাল নাগাদ প্রথম দেখা যায় বর্ণভেদ ভারতে শুরু হয়েছিল । ঋকবেদের দশম মন্ডলে বর্ণভেদের কথা আছে ।

কিন্তু বিদ্বজ্জনেরা মনে করেন বর্ণ বিভাজন প্রথমে দেখা যায় যজুর্বেদে । পরে তা ঋকবেদে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে । অনুমান করা হয় এক হাজার থেকে আটশত খ্রিস্টপূর্বের মধ্যে বর্ণ বিভাজন হয়ে যায় । সেই সময় সম্পত্তির মালিকানা তৈরি হয়েছিল । ফলে শ্রেণি বিভাজন হয় । ...

... জাত বিভাজন শুধু মাত্র শ্রম বিভাজন নয় । এটা শ্রমিকদের মধ্যেও বিভাজন । যে কোন সমাজে শ্রম বিভাজন দরকার হয় । কিন্তু ভারতে শ্রম বিভাজনটা একটা কৃত্রিম শৃঙ্খলে আবদ্ধ আছে । এখানে শ্রমিকদের মধ্যে এই বিভাজনটা স্তর বিন্যাস করে করা হয়েছে । পৃথিবীর কোন দেশেই শ্রম বিভাজনকে শ্রমিকদের স্তর বিন্যাসের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়নি ।শ্রম বিভাজন স্বতঃস্ফূর্তভাবেও হয়নি । স্বাভাবিক আগ্রহ থেকেও নয় । নিজের পেশা নিজে বেছে নিতে পারলে যে দক্ষতা অর্জন করা যায় বা নিজের জীবনের আর্থিক উন্নতি করা যায়, তা উপর থেকে চাপিয়ে দিলে হয় না ।

=============================

জাতপাত ব্যবস্থা ছিল প্রাথমিক উৎপাদকদের উদ্বৃত্ত থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে সামাজিক চেতনা তৈরি করার লক্ষ্যে একটা ধর্মীয় প্রক্রিয়া ।

=============================

আম্বেদকর একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, যার উত্তর এখনও কোনো জাতীয়তাবাদী দিতে পারেননি । প্রশ্নটার ধরণ ছিল এইরকম - দু'টো পৃথক জাতের যৌন মিলনে জন্ম দেওয়া সন্তানের রক্তের বিশুদ্ধতা নষ্ট হতে পারে এমন যুক্তি না হয় বোঝা গেল । কিন্তু এক পংক্তিতে বসে খেলেও কী রক্তের বিশুদ্ধতা নষ্ট হয়ে যায় ?

=============================

পৃথিবীর কয়েকটা দেশে বর্ণবৈষম্যবাদ এখনও নির্মূল হয়নি । এটা ছিল গায়ের রঙের বর্ণবৈষম্যবাদ । গণতান্ত্রিক পরিবেশের ক্রমশ বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তা দুর্বল হচ্ছে । ভারতে জাতপাতের বিভেদ কেবলমাত্র দু'টো সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে নয় । ভারতের একশো কোটির মানুষের মধ্যে ৮২ কোটি মানুষ হিন্দু । এই হিন্দুদের মধ্যে কত রকমের ভাগ । শুধু ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র নয়, প্রতিটা ভাগে কত উপবিভাগ । প্রতিটা বিভাগ-উপবিভাগের সঙ্গে অন্য বিভাগ-উপবিভাগের ঘৃণা, বিদ্বেষ, রক্ত, খুন মাখানো সম্পর্ক । এর শীর্ষে বসে ডান্ডা ঘোরাচ্ছে সবচেয়ে উঁচুজাতি বলে দাবি করা ব্রাহ্মণরা । প্রায় তিন হাজার বছর ধরে সেই বৈদিক যুগ থেকে মানুষের অভ্যাসের সঙ্গে জীবনচর্চার মধ্যে এই ঘৃণা বিদ্বেষ জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে । দুনিয়ার মধ্যে ভারত একটা নিকৃষ্ট ব্যতিক্রম । এমন দেশটা কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি ।

=============================

খ্রিস্ট্রপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্মের এই অগ্রগতি ও জনগণের দলে দলে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের প্রতিক্রিয়া হিসাবে ব্রাহ্মণ্যবাদে এক পুনরুত্থানবাদী ধারা শুরু হল । গৌতম বুদ্ধ সামাজিক ক্ষেত্রে বর্ণভেদের বিরোধিতা করেননি । বৌদ্ধ ধর্মের বাইরে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যে জাতিভেদের উপাদান রয়েই গেল । কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের উত্থানের ফলে ব্রাহ্মণ পুনরুত্থানবাদীরা আরও আষ্টে-পৃষ্ঠে জাতপাতকে সামাজিক আইনে বেঁধে ফেলল । রাজশক্তি নিজস্বার্থে তাতে মদত দিল । ব্রাহ্মণ পুনরুত্থানবাদ জীবনের সবক্ষেত্রে, ধর্মীয়, বুদ্ধিবৃত্তিগত, গার্হস্থ এবং সামাজিক ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই কঠোর আচরণবিধি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ব্রাহ্মণ্য সাম্রাজ্যের দুর্গ তৈরি করল । স্মৃতি বা ধর্মশাস্ত্রগুলি, মহাভারত ও রামায়ণ মহাকাব্য এবং অন্যান্য ধর্মীয় সাহিত্যে এই পুনরুত্থানবাদী ধারার প্রবাহ চলল । কয়েক শত বৎসর ধরে বহু চারণ কবি রামকে প্রতীক হিসাবে তুলে ধরলেন । এদের বলা হতো লব কুশ । এই ধারা বেয়েই রামায়ণ তৈরি হল । রামের চরিত্র সৃষ্টি ব্রাহ্মণ্যবাদকে সুসংহত করার লক্ষ্যে পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনের ফলশ্রূতি ।

=============================

ঋকবেদীয় পর্বে শ্রম বিভাজন অনেক এগিয়েছিল । অর্থব বেড পর্বের শেষদিকে অবশ্য কর্মবিভাজন (সামাজিক স্তর বিভাজন) হতে থাকে এবং জনগোষ্ঠী ও পরিবার গোষ্ঠী ক্রমে সামাজিক শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে যায় । শর্মার (আর এস শর্মা) মতে শূদ্র জনগোষ্ঠী বা আর্যদের যে অংশ দাসসুলভ কাজ করতেন, তাদের স্থান নির্ধারণ হল চতুর্থ বর্গে । পুরোহিতদের প্রভাবেই বর্ণ ব্যবস্থায় মতাদর্শের প্রভাব ঘটেছিল ।

=============================

বুদ্ধদেবের মতাদর্শে একটা অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব ছিল । তিনি হিন্দু সমাজের চতুর্বর্ণ সমাজের বিরোধিতা করেননি বরং তাকে স্বীকারই করেছিলেন । আবার তিনিই সমাজের বর্ণভেদ ভিত্তিক সামাজিক অসাম্যকে স্বীকার করেননি । তাঁর মত অনুযায়ী, মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব বা মূল্য নির্ধারিত হয় কোন জাতে সে জন্মগ্রহণ করেছে তার ফলে নয়, নির্ধারিত হয় তার আত্মিক ও নৈতিক গুণাবলী দিয়ে ।

=============================

কুরুক্ষেত্রে অর্জুন আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে না চাইলে কৃষ্ণ তাকে উজ্জীবিত করার জন্য নাকি কিছু উপদেশ দেন, এই উপদেশগুলোই হল গীতা । যদিও অনেক শাস্ত্রকার ও ঐতিহাসিক সমাজতত্ত্ববিদ মনে করেন গীতা মূল মহাভারতে ছিল না । খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে ভগবদগীতা পর্যায়ক্রমে রচিত । তারপরে মহাভারতে সংযুক্ত হয়েছিল । গীতার একটা বিখ্যাত উক্তি " স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় -পরধর্ম ভয়াবহ" এই স্বধর্ম কী ? তখন কি কোনো গ্রন্থে হিন্দু ধর্ম নাম কোন ধর্মের কথা বলা হয়েছে ? এখানে জাতপাতকেই ধর্ম বলা হয়েছে ।

=============================

ব্রাহ্মণ্য ধর্মের চরম গোঁড়ামি, জাত-পাত, অস্পৃশ্যতার নিদারুন অত্যাচার ও অবিচারের বিকল্প হিসাবে গৌতম বুদ্ধ সংঘগুলিতে সাম্যের আবহাওয়া সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন । তাই ভারতীয় জনগণের একটা বিশাল অংশ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিল । ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রেও তা একইভাবে প্রযোজ্য । ভারতে ইসলাম এক হাতে কোরান অপর হাতে তরবারি নিয়ে আসেনি । অল্প কিছু ক্ষেত্রে রাজশক্তি বা জোর করে ধর্মান্তর হলেও ইসলামের প্রভাব এখানে বেড়েছে দুটো প্রধান কারণে । সুফি ভক্তিবাদের ফলে এবং হিন্দু সমাজে জাতপাত ভেদের জন্য । নিম্নবর্ণের এবং দলিত জনগণের একাংশ উচ্চবর্ণের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে । স্বামী বিবেকানন্দ একে চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন । ভারতে দলিত মানুষ ইসলামের মধ্যে সাম্যের উপাদান দেখতে পেয়েছিল । বিবেকানন্দের মতে এই জন্য ভারতে (বিবেকানন্দের সময় অবিভক্ত ভারত - লেখক) এক পঞ্চাংশ  ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ।

=============================

হিন্দুধর্মের এবং সাধারণভাবে সমস্ত ধর্মেরই সামাজিক তথা অর্থনৈতিক ভূমিকাকে শ্রমিকশ্রেণির সামনে সঠিকভাবে তুলে না ধরলে আদর্শগত সংগ্রাম সফল হতে পারবে না । কৃষিবিপ্লব ঘটানোর জন্যে সংগ্রাম, একচেটিয়া পুঁজির দাপটচাপট আর সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অবসান ঘটানোর জন্যে সংগ্রাম সমাজতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাবে -- এমন ধরণের জনগণতন্ত্ররাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রাম--এ-সবই তো হচ্ছে আমাদের একালের প্রধান সংগ্রাম । এইসব সংগ্রাম থেকে সমাজের জাতপাতের ভেদাভেদ প্রথাটাকে দূর করে দেওয়ার প্রশ্নটাকে আলাদা করে দেখে ওটাকে খালি হিন্দু সমাজের সংস্কারের প্রশ্ন বলে মনে করা আর চলে না ।

=============================

সংরক্ষণের প্রশ্ন

ভারতের সংবিধানে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণ চালু আছে । জনসংখ্যার অনুপাত অনুযায়ী সংরক্ষণ-এর হার নির্ধারিত হবে কিন্তু কোনো সময়ই তা ৫০ শতাংশ অতিক্রম করতে পারবে না । শুধুমাত্র সরকারী চাকুরির ক্ষেত্রে সরকারি বা সরকার পোষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষেত্রে এই সংরক্ষণ প্রযোজ্য হয় । কিন্তু বেসরকারি ক্ষেত্রে সংরক্ষণ চালু করার প্রস্তাব থাকলেও তা এখনও আলোচনার স্তরে আছে । আর এস এস এবং বিজেপি-র বিভিন্ন মহল থেকে সংরক্ষণ প্রথার বিরোধিতা করা হচ্ছে এবং তা তুলে দেওয়ার জন্য সওয়াল করা হচ্ছে ।

ভারতের মত জাতপাত বিভক্ত সমাজে সংরক্ষণ থাকাটা খুবই প্রয়োজনীয় । কারণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উচ্চবর্ণের মানুষেরা সমাজ শাসন করেছেন, ধর্মের নামে বিভিন্ন বিধি বিধান দিয়েছেন তার অনিবার্য পরিণতিতে নিম্নবর্ণের মানুষদের শিক্ষা এবং সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল এবং তাদের উপরে অনেক বিধিনিষেধ জারি করা ছিল, এখনও কিছু কিছু আছে । উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ডঃ আম্বেদকরকে স্কুলে সহপাঠীদের সাথে একসাথে বসতে দেওয়া হতো না, বাইরে চাটাই পেতে বসতে হতো । পানীয় জলের পাত্রের কাছে যেতে পারতেন না । এমনকি অধ্যাপনার চাকরি পাওয়ার পরেও অধ্যাপকদের জলপানের অধিকার ছিল না । শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তারা উচ্চবর্ণের তুলনায় ক্রমশ পিছিয়ে গেছে । উচ্চবর্ণরা সংখ্যায় কম হয়েও যুগের পর যুগ ধরে সিংহভাগ চাকরিবাকরি, শিক্ষার সুযোগ -সমস্ত কিছুই দখলে রাখতেন ।

ব্রিটিশ আমলে সংরক্ষণের নীতি প্রথম চালু হয়েছিল । মূলস্রোতে আনবার জন্য সংরক্ষণই ছিল দরিদ্র নিম্নবর্ণের মানুষের কাছে একমাত্র অবলম্বন । যারা ইসলাম ধর্ম বা বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা কিন্তু এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল । এদের সংরক্ষণের আওতায় আনবার জন্য ২০১০ সালে রঘুনাথ মিত্র কমিশন রায় দিয়েছিলেন যে আর্থিক দিক থেকে ধর্ম নির্বিশেষে পিছিয়ে পড়া মানুষকে সংরক্ষণের আওতায় আনা যেতে পারে । পশ্চিমবাংলার বামফ্রন্ট সরকারি এটি প্রথম কার্যকরী করে এবং শতকরা ১৭ ভাগ সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষণের সুযোগ পায় ।

সংরক্ষণের সুযোগ নেওয়ার জন্য গ্রূপ ডি চাকরি ছাড়া অন্য পদে ন্যূনতম মাধ্যমিক পাশ করা দরকার । কিন্তু সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী তফশিলভুক্ত জাতির শতকরা ৭১.৩ ভাগ স্কুল ফাইনাল পাশ করার সুযোগ পায় (ভুল সংশোধন - তফশিলভুক্ত জাতির শতকরা ৭১.৩ ভাগ স্কুল ছুট) । ফলে সরকারের খুবই নিম্নস্তরের কাজে প্রতি ৪ জন দরিদ্রের মধ্যে ১ জন মাত্র সংরক্ষণের সুযোগ নিতে পারে । ২০০১-এর আদমসুমারি অনুযায়ী দলিতদের মধ্যে মাত্র ২.২৪% স্নাতক । এখন নয়া উদার অর্থনীতির যুগে সব কিছুর সঙ্গে শিক্ষাও বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে । ফলে সরকারি চাকরির সংখ্যা কমে যাচ্ছে । ১২০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ১ কোটি ৮০ লক্ষ মাত্র সরকারি চাকরি ।

তফশিল জাতি ও উপজাতির জন্য জাতীয় কমিশনের রিপোর্টে দেখা যায় যে কেন্দ্রীয় সরকারের এ গ্রেড অফিসারের ন্যূনতম ১৫ শতাংশ এই অংশের মানুষের হওয়া উচিত সেখানে ৮.৪ শতাংশ মাত্র চাকরি করেন । দিল্লি হাইকোর্টের ২০ জন বিচারকের মধ্যে একজনও দলিত নেই । তামিলনাড়ু সামাজিক ন্যায়ের জন্য বিখ্যাত কিন্তু সেখানেও হাইকোর্টের বিচারকের ৩৮ জনের মধ্যে মাত্র ৪ জন, কেরালায় ২৫ জনের মধ্যে ১ জন তফশিল জাতিভুক্ত ।

২০১১ আদমসুমারি অনুযায়ী ১২০ কোটির মধ্যে তফশিল জাতি ও উপজাতির সংখ্যা ৩০ কোটি । সংরক্ষণের মাধ্যমে আদিবাসিরা চাকরি পে ঝাড়ুদার বা জমাদার ইত্যাদি পদে ।

সংরক্ষণ নিয়ে দুটি প্রশ্ন যথাযথ উঠে এসেছে । তফশিল জাতিভুক্ত অনেক মানুষ আছেন যারা সংরক্ষণের সুবিধা পেয়ে অর্থনৈতিক মর্যাদা পেয়েছেন । যারা ব্যক্তিগতভাবে তফসিলী উপজাতিভুক্ত হওয়ার জন্য অর্থনৈতিক বা শিক্ষাক্ষেত্রে ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অনেক অগ্রসর হয়ে এসেছেন যেমন কলেজের অধ্যক্ষ বা অধ্যক্ষা, চিকিৎসক, সরকারি অফিসার নিম্ন আদালতের বিচারক ইত্যাদি । এইভাবে তফশিলভুক্ত উপজাতির মধ্যে একটা উচ্চতর অংশ তৈরি হয়েছে তাদের পরিবারের মানুষেরা এখন সমাজের প্রভাবশালী অংশের মধ্যে অন্যতম । তারা এখন সমাজের সংরক্ষণের সমগ্র সুবিধা ভোগ করে নিচ্ছেন । তাদের বলা হয় ক্রাম লেয়ার । আবার উচ্চবর্ণের মানুষ হলেও অর্থনৈতিক দিক থেকে খুবই পিছিয়ে পড়া প্রচুর মানুষ আছেন । কিন্তু তারা উচ্চবর্ণের মানুষ এইজন্যই কোনো সুযোগ পান না । তাদের জন্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আয়ের একটা ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া হোক এবং উচ্চবর্ণের হলেও অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদদের সংরক্ষণের সুযোগ দিতে হবে ।

=============================

ভারতে এত জাতি ধর্ম আছে যে তা পরিচিতি সত্তার উর্বর ভূমি ।

বিভিন্ন দলিত গোষ্ঠী, ওবিসি আন্দোলন, সংরক্ষণের জন্য, সম্পদের ভাগ নেবার দাবিতে এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং অন্য নানা কারণে পরস্পর বিরোধী রাজনীতিতে প্রশ্রয় দেয় । কিন্তু এই গোষ্ঠীগুলি মৌলিক সামাজিক কাঠামো এবং শ্রেণি শোষণ বদলানোর দাবিতে আন্দোলন সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যায় না । অন্যান্য নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলাতে তাদের আগ্রহ নেই ।...

...এ ধরনের পরিচিতি সত্তা নির্ভর রাজনীতি শুধুমাত্র দলিত বা পশ্চাৎপদশ্রেণির সংগঠনগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই । নির্বাচনী শক্তি ও সমর্থন ভিত্তি বাড়াতে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলিও পরিচিতি সত্তা-নির্ভর রাজনীতিকে ব্যবহার করে থাকে । উত্তরপ্রদেশে যেমন বিজেপি, এসপি এবং কংগ্রেসের মতো সব দলই জাতপাত ও সাবকাস্ট ভিত্তিক দলীয় সম্মেলনের আয়োজন করে থাকে । পরিচিতি সত্তা-নির্ভর রাজনীতিকে তারা ব্যবহার করে এবং জাতপাতভিত্তিক বিভাজন প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করে ।


=============================

ভারতীয় সমাজে শ্রেণি শোষণ এবং সামাজিক নিপীড়ন দুটোই আছে । আমাদের দেশের আর্থ সামাজিক কাঠামোয় জাতপাতভিত্তিক, জাতিগোষ্ঠীগত ও লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক নিপীড়ন একই সঙ্গে পুঁজিবাদী ও আধা সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণি শোষণের সঙ্গেই বিদ্যমান । শাসকশ্রেণিগুলি উদবৃত্ত শ্রম শোষণ করে শ্রেণি শোষণের মাধ্যমে এবং তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে তারা বিভিন্ন ধরণের সামাজিক নিপীড়নকে কাজে লাগায় । সে জন্যই শ্রেণি সংগ্রাম চালিয়ে নিয়ে যাবার গুরুত্বের উপরও জোর দেবার পাশাপাশি সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামও চালাতে হবে । বিশ্বজোড়া লগ্নিপুঁজির দাপট বাড়ার এবং সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন মাথাচাড়া দেবার পরই শাসকশ্রেণিগুলি পরিচিতি সত্তা-নির্ভর রাজনীতি ও আন্দোলনকে বড় আকারে মদত দিচ্ছে । এ ধরনের আন্দোলন নিপীড়িত শ্রেণীগুলির মধ্যে পেটি বুর্জোয়াদের একটা অংশকে ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসার সুযোগ করে দেয় ।