ধর্ম ও মৌলবাদ
বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্ম সবন্ধে বলছেন, " হিন্দু ধর্মের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হইল অন্যান্য ধর্ম ও বিশ্বাস সমূহের প্রতি সহিষ্ণুতা । ... যদি কেউ মনে করে থাকেন যে, ঐক্য আসবে কোন একটি ধর্মের জয়ের ও অন্য সব ধর্মের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে, তাকে আমি বলব : হে আমার ভাই, এটা তোমার ভ্রান্ত আশা । আমি কি চাইব যে, খ্রিস্টানরা হিন্দুধর্ম গ্রহণ করুক ? ঈশ্বর করুন, কখনই না । ... খ্রিস্টান হিন্দু বা বৌদ্ধ হবে না অথবা হিন্দুও বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান হবে না । কিন্তু প্রত্যেককেই অপরের আদর্শ থেকে তার মর্মকথা আত্মস্থ করতে হবে ।"
=========================================================
আদিম মানুষের প্রকৃতির কাছে অসহায়তা থেকে উদ্ভূত অলৌকিক ধারণা পরবর্তীকালে সমাজে আধিপত্য সৃষ্টিকারী শক্তির হাতে ধর্ম বিশ্বাসের মাধ্যমে শ্রেণি শাসনের হাতিয়ারে পরিণত হয় । শ্রেণি শাসনে গরিব মানুষের আর্থিক ও সামাজিক অসহায়তা আরও তীব্র হওয়ায় 'ধর্ম বিশ্বাসের' শেকড় আরও শক্তপোক্ত হয়ে ওঠে ।
... প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়তাজনিত অতিলৌকিক বিশ্বাসকে সমাজে প্রভুত্বকারী শ্রেণি ধর্মের মোড়কে হাজির করেছে এবং তাকে ব্যবহার করেছে, যার শেকড় রয়েছে মানুষের জীবন জীবিকার অধিকারের অপ্রাপ্তি ও অনিশ্চয়তাজনিত হতাশা ও ব্যর্থতার দীর্ঘ নিঃশ্বাসের গভীরে ।
=========================================================
ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম সাম্প্রদায়িকতা
ধর্মনিরপেক্ষতার ঠিক বিপরীতে রয়েছে সাম্প্রদায়িকতা । আমাদের দেশের সংবিধানে ১৯৭৭ সালে প্রথম 'ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি যুক্ত করা হয় । ধর্মনিরপেক্ষতা ধারণাটি এসেছে ইউরোপের ইতিহাস থেকে । ইউরোপের উদীয়মান বুর্জোয়াদের সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে সংগ্রাম করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে হয়েছিল । সামন্ত প্রভুদের সঙ্গে গীর্জার পাদ্রীদের দৃঢ় গাঁটছড়া বাঁধা ছিল । ফলে সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে তাদের গীর্জার বিরুদ্ধেও লড়তে হয়েছে । ইতিহাসে এই যুদ্ধ 'ক্রুসেড' নামে খ্যাত । এই সংগ্রামের মাধ্যমেই বুর্জোয়ারা বুঝেছিল রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক ছেদ করতে হবে । রাষ্ট্র ধর্মের সঙ্গে যুক্তও হবে না আবার ধর্ম-বিরোধীও হবে না । প্রত্যেক নাগরিকেরই স্বাধীন ধর্মাচরণের অধিকার থাকবে । তবে কেউ কাউকে ধর্মাচরণ করতে বাধ্য করবে না, কারও ধর্মাচরণে বাধাও দেবে না । ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের এই সম্পর্ককেই ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে গণ্য করা হয় । সেজন্যই ইউরোপের বিশেষত ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে কার্যত সকলেই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও ওরা ওদের দেশকে খ্রিস্টান ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেনি ।
=========================================================
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেদ, উপনিষদের উপর ভিত্তি করেই তাঁর আন্তর্জাতিক মানবতাবাদ গড়ে তুলেছিলেন । সেই উপলব্ধি থেকে তিনি লিখলেন, "এই বহু দেব দেবী, বিচিত্র পুরাণ এবং অন্ধ লোকাচার সংকুল আধুনিক বৃহৎ বিকারের নাম হিন্দুত্ব ।" "সাহেবি অনুকরণ আমাদের পক্ষে নিষ্ফল, হিন্দুয়ানী গোঁড়ামী আমাদের পক্ষে মৃত্যু ।" (হিন্দুর ঐক্য) ।
উভয় সাম্প্রদায়িক শক্তির উগ্র প্রচারে বিরক্ত কবি লিখলেন, "একটা দিন আসিল যখন হিন্দু আপন হিন্দুত্ব লইয়া গৌরব করিতে উদ্যত হইল। তখন মুসলমান যদি হিন্দুর গৌরব মানিয়া লইয়া নিজেরা চুপচাপ পড়িয়া থাকিত তবে হিন্দু খুব খুশি হইত সন্দেহ নাই, কিন্তু যে কারণে হিন্দুর হিন্দুত্ব উগ্র হইয়া উঠিল সেই কারণেই মুসলমানের মুসলমানি মাথা তুলিয়া উঠিল। ... আমি হিন্দুর তরফ থেকেই বলছি, মুসলমানের ত্রুটি বিচারটা থাক্-- আমরা মুসলমানকে কাছে টানতে যদি না পেরে থাকি তবে সেজন্যে যেন লজ্জা স্বীকার করি।"
তিনি আরও বললেন, "ভারতবর্ষের অধিবাসীদের দুই মোটা ভাগ, হিন্দু ও মুসলমান। যদি ভাবি, মুসলমানদের অস্বীকার করে এক পাশে সরিয়ে দিলেই দেশের সকল মঙ্গলপ্রচেষ্টা সফল হবে, তা হলে বড়োই ভুল করব। ছাদের পাঁচটা কড়িকে মানব, বাকি তিনটে কড়িকে মানবই না, এটা বিরক্তির কথা হতে পারে, কিন্তু ছাদ-রক্ষার পক্ষে সুবুদ্ধির কথা নয়। আমাদের সবচেয়ে বড়ো অমঙ্গল বড়ো দুর্গতি ঘটে যখন মানুষ মানুষের পাশে রয়েছে অথচ পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ নেই, অথবা সে সম্বন্ধ বিকৃত।" এভাবেই উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলার মাধ্যমেই ভারতের প্রকৃত মঙ্গল হতে পারে বলে কবি দৃঢ় মত পোষণ করেন ।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীভৎসতা দেখে তিনি উপলব্ধি করে লিখলেন, "এই মোহমুগ্ধ ধর্ম বিভীষিকার চেয়ে সোজাসুজি নাস্তিকতা অনেক ভাল । আজ মিছে ধর্মকে পুড়িয়ে ফেলে ভারত যদি খাঁটি ধর্ম, খাঁটি নাস্তিকতা পায় তবে ভারত সত্যই নব জীবন লাভ করবে ।"
আর এস এস হিন্দু ধর্ম প্রচারের নামে 'হিন্দুত্ব' শব্দটিকে সামনে এনেছে । 'হিন্দুত্ব' শব্দটি হিন্দু ধর্মের কোথাও নেই । কোন হিন্দু ধর্ম গুরুর লেখাতে এই শব্দটি পাওয়া যায় না । হিন্দু ধর্মকে ফ্যাসিবাদের মোড়কে হাজির করার উদ্দেশ্যেই প্রথমে হিন্দু মহাসভা পরে আর এস এস নেতা সাভারকার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ১৯২৩ সালে প্রথম 'হিন্দুত্ব' শব্দটি ব্যবহার করেন । 'হিন্দুত্ব' শব্দের আড়ালে তিনি ভারতে বসবাসকারী সকলকে হিন্দুত্বের অনুসারী হওয়ার নিদান দেন । অর্থাৎ অন্য ধর্ম মতগুলির বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে ধর্মীয় বিভাজনের উদ্দেশ্যে একাজ তিনি করেন । তিনি দাবি করেন 'হিন্দুত্ব' হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট জীবন-ধারা, যার উদ্ভব ভারতেই । অতএব ভারতে থাকতে হলে হিন্দুত্বের জীবনধারা গ্রহণ করতে হবে । এর বাইরে যারা থাকবেন তাদের ভারতের নাগরিকত্ব থাকবে না অর্থাৎ তাদের ভারত ত্যাগ করতে হবে নইলে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো করে থাকতে হবে । এটা খোলাখুলি অন্য ধর্মগুলির প্রতি আক্রমণের আহবান । সোজা কথায় মুসলিম নিধনের আহবান ।
অথচ যে বিবেকানন্দকে ওরা ওদের মতের সপক্ষে বিকৃতভাবে প্রচার করে, তিনি বলছেন, "আমাদের দৃঢ় ধারণা যে, বেদান্তের মতবাদ যতই সূক্ষ্ম ও বিস্ময়কর হউক না কেন, কর্ম পরিণত ইসলাম ধর্মের সহায়তা ব্যতীত তাহা মানব সাধারণের অধিকাংশের নিকট সম্পূর্ণরূপে নিরর্থক। আমরা মানবজাতির সেই স্থানে লইয়া যাইতে চাই — যেখানে বেদও নাই, বাইবেলও নাই, কোরানও নাই , অথচ বেদ, বাইবেল ও কোরানের সমন্বয় দ্বারাই ইহা করিতে হইবে। মানবকে শিখাইতে হইবে যে, সকল ধর্ম একত্বরূপ সেই এক ধর্মেরই বিবিধ প্রকাশ মাত্র, সুতরাং যাহার যেটি সর্বাপেক্ষা উপযোগী সেইটিকেই সে বাছিয়া লইতে পারে । আমাদের মাতৃভূমির পক্ষে হিন্দু ও ইসলাম ধর্ম-রূপ এই দুই মহান মতের সমন্বয়ই বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ - একমাত্র আশা । আমি মানসচক্ষে দেখিতেছি, এই বিবাদ বিশৃঙ্খলা ভেদপূর্বক ভবিষ্যৎ পূর্ণাঙ্গ ভারত বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামিক দেহ লইয়া মহা মহিমায় ও অপরাজেয় শক্তিতে জাগিয়া উঠিতেছে।"
সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে ধিক্কার জানিয়ে তিনি লিখছেন, 'কোনও ধর্মই কখনও মানুষের উপর অত্যাচার করে নাই, কোন ধর্মই কখনও এই ধরনের অন্যায় কার্যের সমর্থন করে নাই । তবে মানুষকে এ-সকল কার্যে উত্তেজিত করিল কিসে ? রাজনীতিই মানুষকে এই সকল অন্যায় কার্য করিতে প্ররোচিত করিয়াছে, ধর্ম নয় ।"
তিনি আরও লিখছেন, "সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি ও এগুলির ভয়াবহ ফল স্বরূপ ধর্মোন্মত্ততা এই সুন্দর পৃথিবীকে বহুকাল অধিকার করিয়া রাখিয়াছে । ইহারা পৃথিবীকে হিংসায় পূর্ণ করিয়া রাখিয়াছে । ইহারা পৃথিবীকে হিংসায় পূর্ণ করিয়াছে, বারবার ইহাকে নরশোণিতে সিক্ত করিয়াছে, সভ্যতা ধ্বংস করিয়াছে এবং সমগ্র জাতিকে হতাশায় মগ্ন করিয়াছে । এই সকল ভীষণ পিশাচ যদি না থাকিত, তাহা হইলে মানব সমাজ আজ পূর্বাপেক্ষা অনেক উন্নত হইত । তবে ইহাদের মৃত্যুকাল উপস্থিত ।"
"যদি এই ভারতে যেখানে চিরদিন সকল সম্প্রদায়ই সম্মানিত হইয়া আসিয়াছেন সেই ভারতে এখনও এইসব সাম্প্রদায়িক বিবাদ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পর দ্বেষহিংসা থাকে, তবে ধিক্ তাহাদিগকে, যাহারা সেই মহিমান্বিত পূর্ব পুরুষগণের বংশধর বলিয়া নিজদের পরিচয় দেয়। ... আমরা সকলকেই আমাদের ভাবে আনিতে পারি না । আমরা যেরূপ ব্যাখ্যা করিব, সকলকেই সে ব্যাখ্যা গ্রহণ করিতে হইবে বা সকলকেই আমাদের প্রণালী অবলম্বন করিয়া চলিতে হইবে জোর করিয়া এরূপ চেষ্টা করা অত্যন্ত অন্যায় । ... অপরকে ঘৃণা করিতে থাকিলে কেহই নিজে অবনত না হইয়া থাকিতে পারে না ... সম্প্রসারণই জীবন, সঙ্কীর্ণতাই মৃত্যু, প্রেমই জীবন, দ্বেষই মৃত্যু ।"
ভাবলে শিউরে উঠতে হয় আর এস এস বিবেকানন্দকে যেভাবে তাদের স্বার্থে প্রচার করছে, বেঁচে থাকলে তিনি এদের সম্বন্ধে কী বলতেন ।
আজীবন নিষ্ঠাভরে হিন্দু ধর্মাচরণ পালন করেও গান্ধীজি আর এস এস-এর সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে স্পষ্ট করে বললেন, "কোটি কোটি ভারতবাসী যারা হিন্দু ছিল ও পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা আর ভারতীয় রইল না --- এই ধারণার বিরুদ্ধে আমি বিদ্রোহ ঘোষণা করি । ... হিন্দু ধর্ম ও ইসলাম দুটি পরস্পর বিরোধী মতবাদ ও সংস্কৃতি - এই ধারণার বিরুদ্ধেও আমার সমস্ত প্রাণ মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে ।"
কমিউনিস্টরা ধর্মাচরণ না করাকেই শ্রেয় মনে করে, কারণ তাঁরা বিশ্ব - প্রকৃতির যাবতীয় সৃষ্টি ও ঘটনা, তার উদ্ভব ও লয়ের কারণ বাইরের কোন শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে - এই ভ্রান্ত ধারণার দ্বারা পরিচালিত হয় না । তাই বলে তারা কারও ধর্মবিশ্বাসকে আঘাত করে না । তারা শুধু মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, কারও সম্পদের পাহাড়, কারও নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার জন্য ঈশ্বরকে দায়ী করা বা তাঁর ইচ্ছাতেই সব হচ্ছে এই ধারণার দ্বারা পরিচালিত না হওয়ার জন্য মানুষকে সমবেত করার চেষ্টা করে । বৈষম্যের কারণ বর্তমান বিশ্ব-ব্যবস্থা তথা আর্থিক-নীতির মধ্যেই নিহিত রয়েছে - এই সত্য তুলে ধরে তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মহাসাগরে সকলকে মেলাতে চায় ।
=========================================================
=========================================================
আমেরিকায় প্রবাসকালে বিবেকানন্দ গো মাংস ভক্ষণ করেছেন । এর বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা অভিযোগ করলে তিনি দৃঢ়ভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন এবং বলেন "ভারতবাসীরা যদি চায় আমি একমাত্র হিন্দু খাবার খাই, তারা যেন আমাকে একজন রান্নার লোক এবং তার জন্য অনেক টাকা পাঠায় ... আমি কারও আদেশে চলিনা, আমি আমার জীবনের উদ্দেশ্য জানি এবং আমার কোন সংকীর্ণতা নেই । আমি যতখানি ভারতীয় ততখানি বিশ্বমানব । তোমরা কি বলতে চাও যে আমি ঐ জাতিভেদে জর্জরিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন, নিষ্ঠুর, ভন্ড, নাস্তিক ও কাপুরুষ শিক্ষিত হিন্দুদের মধ্যেই জীবন কাটাবার জন্য এবং মরবার জন্য জন্মেছি ?" (আলা সিংগা নামে তাঁর এক মাদ্রাজি শিষ্যকে লন্ডন থেকে ১৮৯৫ এর ১৮ নভেম্বর লেখা পত্র সংকলনে পাওয়া যায়) । ১৯০২ সালে বিবেকানন্দের মৃত্যুর পরে অমৃতবাজার পত্রিকায় 'The Meat Eating Swami' নামে একটি সম্পাদকীয় লেখা হয়েছিল । (সূত্র - 'সহাস্য বিবেকানন্দ' - শঙ্করীপ্রসাদ বসু )।
=========================================================
বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্ম সবন্ধে বলছেন, " হিন্দু ধর্মের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হইল অন্যান্য ধর্ম ও বিশ্বাস সমূহের প্রতি সহিষ্ণুতা । ... যদি কেউ মনে করে থাকেন যে, ঐক্য আসবে কোন একটি ধর্মের জয়ের ও অন্য সব ধর্মের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে, তাকে আমি বলব : হে আমার ভাই, এটা তোমার ভ্রান্ত আশা । আমি কি চাইব যে, খ্রিস্টানরা হিন্দুধর্ম গ্রহণ করুক ? ঈশ্বর করুন, কখনই না । ... খ্রিস্টান হিন্দু বা বৌদ্ধ হবে না অথবা হিন্দুও বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান হবে না । কিন্তু প্রত্যেককেই অপরের আদর্শ থেকে তার মর্মকথা আত্মস্থ করতে হবে ।"
=========================================================
আদিম মানুষের প্রকৃতির কাছে অসহায়তা থেকে উদ্ভূত অলৌকিক ধারণা পরবর্তীকালে সমাজে আধিপত্য সৃষ্টিকারী শক্তির হাতে ধর্ম বিশ্বাসের মাধ্যমে শ্রেণি শাসনের হাতিয়ারে পরিণত হয় । শ্রেণি শাসনে গরিব মানুষের আর্থিক ও সামাজিক অসহায়তা আরও তীব্র হওয়ায় 'ধর্ম বিশ্বাসের' শেকড় আরও শক্তপোক্ত হয়ে ওঠে ।
... প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়তাজনিত অতিলৌকিক বিশ্বাসকে সমাজে প্রভুত্বকারী শ্রেণি ধর্মের মোড়কে হাজির করেছে এবং তাকে ব্যবহার করেছে, যার শেকড় রয়েছে মানুষের জীবন জীবিকার অধিকারের অপ্রাপ্তি ও অনিশ্চয়তাজনিত হতাশা ও ব্যর্থতার দীর্ঘ নিঃশ্বাসের গভীরে ।
=========================================================
ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম সাম্প্রদায়িকতা
ধর্মনিরপেক্ষতার ঠিক বিপরীতে রয়েছে সাম্প্রদায়িকতা । আমাদের দেশের সংবিধানে ১৯৭৭ সালে প্রথম 'ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি যুক্ত করা হয় । ধর্মনিরপেক্ষতা ধারণাটি এসেছে ইউরোপের ইতিহাস থেকে । ইউরোপের উদীয়মান বুর্জোয়াদের সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে সংগ্রাম করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে হয়েছিল । সামন্ত প্রভুদের সঙ্গে গীর্জার পাদ্রীদের দৃঢ় গাঁটছড়া বাঁধা ছিল । ফলে সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে তাদের গীর্জার বিরুদ্ধেও লড়তে হয়েছে । ইতিহাসে এই যুদ্ধ 'ক্রুসেড' নামে খ্যাত । এই সংগ্রামের মাধ্যমেই বুর্জোয়ারা বুঝেছিল রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক ছেদ করতে হবে । রাষ্ট্র ধর্মের সঙ্গে যুক্তও হবে না আবার ধর্ম-বিরোধীও হবে না । প্রত্যেক নাগরিকেরই স্বাধীন ধর্মাচরণের অধিকার থাকবে । তবে কেউ কাউকে ধর্মাচরণ করতে বাধ্য করবে না, কারও ধর্মাচরণে বাধাও দেবে না । ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের এই সম্পর্ককেই ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে গণ্য করা হয় । সেজন্যই ইউরোপের বিশেষত ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে কার্যত সকলেই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও ওরা ওদের দেশকে খ্রিস্টান ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেনি ।
=========================================================
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেদ, উপনিষদের উপর ভিত্তি করেই তাঁর আন্তর্জাতিক মানবতাবাদ গড়ে তুলেছিলেন । সেই উপলব্ধি থেকে তিনি লিখলেন, "এই বহু দেব দেবী, বিচিত্র পুরাণ এবং অন্ধ লোকাচার সংকুল আধুনিক বৃহৎ বিকারের নাম হিন্দুত্ব ।" "সাহেবি অনুকরণ আমাদের পক্ষে নিষ্ফল, হিন্দুয়ানী গোঁড়ামী আমাদের পক্ষে মৃত্যু ।" (হিন্দুর ঐক্য) ।
উভয় সাম্প্রদায়িক শক্তির উগ্র প্রচারে বিরক্ত কবি লিখলেন, "একটা দিন আসিল যখন হিন্দু আপন হিন্দুত্ব লইয়া গৌরব করিতে উদ্যত হইল। তখন মুসলমান যদি হিন্দুর গৌরব মানিয়া লইয়া নিজেরা চুপচাপ পড়িয়া থাকিত তবে হিন্দু খুব খুশি হইত সন্দেহ নাই, কিন্তু যে কারণে হিন্দুর হিন্দুত্ব উগ্র হইয়া উঠিল সেই কারণেই মুসলমানের মুসলমানি মাথা তুলিয়া উঠিল। ... আমি হিন্দুর তরফ থেকেই বলছি, মুসলমানের ত্রুটি বিচারটা থাক্-- আমরা মুসলমানকে কাছে টানতে যদি না পেরে থাকি তবে সেজন্যে যেন লজ্জা স্বীকার করি।"
তিনি আরও বললেন, "ভারতবর্ষের অধিবাসীদের দুই মোটা ভাগ, হিন্দু ও মুসলমান। যদি ভাবি, মুসলমানদের অস্বীকার করে এক পাশে সরিয়ে দিলেই দেশের সকল মঙ্গলপ্রচেষ্টা সফল হবে, তা হলে বড়োই ভুল করব। ছাদের পাঁচটা কড়িকে মানব, বাকি তিনটে কড়িকে মানবই না, এটা বিরক্তির কথা হতে পারে, কিন্তু ছাদ-রক্ষার পক্ষে সুবুদ্ধির কথা নয়। আমাদের সবচেয়ে বড়ো অমঙ্গল বড়ো দুর্গতি ঘটে যখন মানুষ মানুষের পাশে রয়েছে অথচ পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ নেই, অথবা সে সম্বন্ধ বিকৃত।" এভাবেই উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলার মাধ্যমেই ভারতের প্রকৃত মঙ্গল হতে পারে বলে কবি দৃঢ় মত পোষণ করেন ।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীভৎসতা দেখে তিনি উপলব্ধি করে লিখলেন, "এই মোহমুগ্ধ ধর্ম বিভীষিকার চেয়ে সোজাসুজি নাস্তিকতা অনেক ভাল । আজ মিছে ধর্মকে পুড়িয়ে ফেলে ভারত যদি খাঁটি ধর্ম, খাঁটি নাস্তিকতা পায় তবে ভারত সত্যই নব জীবন লাভ করবে ।"
আর এস এস হিন্দু ধর্ম প্রচারের নামে 'হিন্দুত্ব' শব্দটিকে সামনে এনেছে । 'হিন্দুত্ব' শব্দটি হিন্দু ধর্মের কোথাও নেই । কোন হিন্দু ধর্ম গুরুর লেখাতে এই শব্দটি পাওয়া যায় না । হিন্দু ধর্মকে ফ্যাসিবাদের মোড়কে হাজির করার উদ্দেশ্যেই প্রথমে হিন্দু মহাসভা পরে আর এস এস নেতা সাভারকার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ১৯২৩ সালে প্রথম 'হিন্দুত্ব' শব্দটি ব্যবহার করেন । 'হিন্দুত্ব' শব্দের আড়ালে তিনি ভারতে বসবাসকারী সকলকে হিন্দুত্বের অনুসারী হওয়ার নিদান দেন । অর্থাৎ অন্য ধর্ম মতগুলির বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে ধর্মীয় বিভাজনের উদ্দেশ্যে একাজ তিনি করেন । তিনি দাবি করেন 'হিন্দুত্ব' হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট জীবন-ধারা, যার উদ্ভব ভারতেই । অতএব ভারতে থাকতে হলে হিন্দুত্বের জীবনধারা গ্রহণ করতে হবে । এর বাইরে যারা থাকবেন তাদের ভারতের নাগরিকত্ব থাকবে না অর্থাৎ তাদের ভারত ত্যাগ করতে হবে নইলে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো করে থাকতে হবে । এটা খোলাখুলি অন্য ধর্মগুলির প্রতি আক্রমণের আহবান । সোজা কথায় মুসলিম নিধনের আহবান ।
অথচ যে বিবেকানন্দকে ওরা ওদের মতের সপক্ষে বিকৃতভাবে প্রচার করে, তিনি বলছেন, "আমাদের দৃঢ় ধারণা যে, বেদান্তের মতবাদ যতই সূক্ষ্ম ও বিস্ময়কর হউক না কেন, কর্ম পরিণত ইসলাম ধর্মের সহায়তা ব্যতীত তাহা মানব সাধারণের অধিকাংশের নিকট সম্পূর্ণরূপে নিরর্থক। আমরা মানবজাতির সেই স্থানে লইয়া যাইতে চাই — যেখানে বেদও নাই, বাইবেলও নাই, কোরানও নাই , অথচ বেদ, বাইবেল ও কোরানের সমন্বয় দ্বারাই ইহা করিতে হইবে। মানবকে শিখাইতে হইবে যে, সকল ধর্ম একত্বরূপ সেই এক ধর্মেরই বিবিধ প্রকাশ মাত্র, সুতরাং যাহার যেটি সর্বাপেক্ষা উপযোগী সেইটিকেই সে বাছিয়া লইতে পারে । আমাদের মাতৃভূমির পক্ষে হিন্দু ও ইসলাম ধর্ম-রূপ এই দুই মহান মতের সমন্বয়ই বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ - একমাত্র আশা । আমি মানসচক্ষে দেখিতেছি, এই বিবাদ বিশৃঙ্খলা ভেদপূর্বক ভবিষ্যৎ পূর্ণাঙ্গ ভারত বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামিক দেহ লইয়া মহা মহিমায় ও অপরাজেয় শক্তিতে জাগিয়া উঠিতেছে।"
সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে ধিক্কার জানিয়ে তিনি লিখছেন, 'কোনও ধর্মই কখনও মানুষের উপর অত্যাচার করে নাই, কোন ধর্মই কখনও এই ধরনের অন্যায় কার্যের সমর্থন করে নাই । তবে মানুষকে এ-সকল কার্যে উত্তেজিত করিল কিসে ? রাজনীতিই মানুষকে এই সকল অন্যায় কার্য করিতে প্ররোচিত করিয়াছে, ধর্ম নয় ।"
তিনি আরও লিখছেন, "সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি ও এগুলির ভয়াবহ ফল স্বরূপ ধর্মোন্মত্ততা এই সুন্দর পৃথিবীকে বহুকাল অধিকার করিয়া রাখিয়াছে । ইহারা পৃথিবীকে হিংসায় পূর্ণ করিয়া রাখিয়াছে । ইহারা পৃথিবীকে হিংসায় পূর্ণ করিয়াছে, বারবার ইহাকে নরশোণিতে সিক্ত করিয়াছে, সভ্যতা ধ্বংস করিয়াছে এবং সমগ্র জাতিকে হতাশায় মগ্ন করিয়াছে । এই সকল ভীষণ পিশাচ যদি না থাকিত, তাহা হইলে মানব সমাজ আজ পূর্বাপেক্ষা অনেক উন্নত হইত । তবে ইহাদের মৃত্যুকাল উপস্থিত ।"
"যদি এই ভারতে যেখানে চিরদিন সকল সম্প্রদায়ই সম্মানিত হইয়া আসিয়াছেন সেই ভারতে এখনও এইসব সাম্প্রদায়িক বিবাদ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পর দ্বেষহিংসা থাকে, তবে ধিক্ তাহাদিগকে, যাহারা সেই মহিমান্বিত পূর্ব পুরুষগণের বংশধর বলিয়া নিজদের পরিচয় দেয়। ... আমরা সকলকেই আমাদের ভাবে আনিতে পারি না । আমরা যেরূপ ব্যাখ্যা করিব, সকলকেই সে ব্যাখ্যা গ্রহণ করিতে হইবে বা সকলকেই আমাদের প্রণালী অবলম্বন করিয়া চলিতে হইবে জোর করিয়া এরূপ চেষ্টা করা অত্যন্ত অন্যায় । ... অপরকে ঘৃণা করিতে থাকিলে কেহই নিজে অবনত না হইয়া থাকিতে পারে না ... সম্প্রসারণই জীবন, সঙ্কীর্ণতাই মৃত্যু, প্রেমই জীবন, দ্বেষই মৃত্যু ।"
ভাবলে শিউরে উঠতে হয় আর এস এস বিবেকানন্দকে যেভাবে তাদের স্বার্থে প্রচার করছে, বেঁচে থাকলে তিনি এদের সম্বন্ধে কী বলতেন ।
আজীবন নিষ্ঠাভরে হিন্দু ধর্মাচরণ পালন করেও গান্ধীজি আর এস এস-এর সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে স্পষ্ট করে বললেন, "কোটি কোটি ভারতবাসী যারা হিন্দু ছিল ও পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা আর ভারতীয় রইল না --- এই ধারণার বিরুদ্ধে আমি বিদ্রোহ ঘোষণা করি । ... হিন্দু ধর্ম ও ইসলাম দুটি পরস্পর বিরোধী মতবাদ ও সংস্কৃতি - এই ধারণার বিরুদ্ধেও আমার সমস্ত প্রাণ মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে ।"
কমিউনিস্টরা ধর্মাচরণ না করাকেই শ্রেয় মনে করে, কারণ তাঁরা বিশ্ব - প্রকৃতির যাবতীয় সৃষ্টি ও ঘটনা, তার উদ্ভব ও লয়ের কারণ বাইরের কোন শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে - এই ভ্রান্ত ধারণার দ্বারা পরিচালিত হয় না । তাই বলে তারা কারও ধর্মবিশ্বাসকে আঘাত করে না । তারা শুধু মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, কারও সম্পদের পাহাড়, কারও নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার জন্য ঈশ্বরকে দায়ী করা বা তাঁর ইচ্ছাতেই সব হচ্ছে এই ধারণার দ্বারা পরিচালিত না হওয়ার জন্য মানুষকে সমবেত করার চেষ্টা করে । বৈষম্যের কারণ বর্তমান বিশ্ব-ব্যবস্থা তথা আর্থিক-নীতির মধ্যেই নিহিত রয়েছে - এই সত্য তুলে ধরে তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মহাসাগরে সকলকে মেলাতে চায় ।
=========================================================
=========================================================
আমেরিকায় প্রবাসকালে বিবেকানন্দ গো মাংস ভক্ষণ করেছেন । এর বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা অভিযোগ করলে তিনি দৃঢ়ভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন এবং বলেন "ভারতবাসীরা যদি চায় আমি একমাত্র হিন্দু খাবার খাই, তারা যেন আমাকে একজন রান্নার লোক এবং তার জন্য অনেক টাকা পাঠায় ... আমি কারও আদেশে চলিনা, আমি আমার জীবনের উদ্দেশ্য জানি এবং আমার কোন সংকীর্ণতা নেই । আমি যতখানি ভারতীয় ততখানি বিশ্বমানব । তোমরা কি বলতে চাও যে আমি ঐ জাতিভেদে জর্জরিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন, নিষ্ঠুর, ভন্ড, নাস্তিক ও কাপুরুষ শিক্ষিত হিন্দুদের মধ্যেই জীবন কাটাবার জন্য এবং মরবার জন্য জন্মেছি ?" (আলা সিংগা নামে তাঁর এক মাদ্রাজি শিষ্যকে লন্ডন থেকে ১৮৯৫ এর ১৮ নভেম্বর লেখা পত্র সংকলনে পাওয়া যায়) । ১৯০২ সালে বিবেকানন্দের মৃত্যুর পরে অমৃতবাজার পত্রিকায় 'The Meat Eating Swami' নামে একটি সম্পাদকীয় লেখা হয়েছিল । (সূত্র - 'সহাস্য বিবেকানন্দ' - শঙ্করীপ্রসাদ বসু )।
=========================================================
No comments:
Post a Comment