Thursday, 1 June 2017

শহীদ স্মৃতি - শিব বর্মা


এই স্মৃতিকথা পড়ে জনৈক বন্ধু মন্তব্য করেছিল যে, এতে মন্দিরের দেবতাগুলি ভেঙে যেতে পারে । আমি তার সঙ্গে একমত হতে পারিনি । আমার বিশ্বাস যখন মহাপুরুষের পদচিহ্ন ধরে আমরা চলতে চাই না অথবা তাঁর মতো নিজে হতে চাই না তখন তাঁকে দেবতা বানিয়ে মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করি, তখন তিনি মানুষের সারি থেকে পৃথক হয়ে শুধু পূজার বস্তু হয়ে পড়েন যার গুনগান করা যায় বটে কিন্তু তাঁর মতো নিজেকে গড়ে তোলার কথা চিন্তা করা যায় না, কেন না সব মানুষ দেবতা হতে পারে না । তাছাড়া যখন আমরা কোন মানুষকে দেবতারূপে গড়ার জন্য যত্নবান হই তখন তার মানবসুলভ রূপ চাপা পড়ে যায় এবং সেখানে একটি কৃত্রিম বা মন-গড়া প্রতিমা তৈরি হয় । আদর্শ হলেও সে মূর্তি, কৃত্রিম হয়ে থাকে । আমরা তাকে সহৃদয়তা দিয়ে ভালোবাসতে পারি না । পারি না তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে আপন করে নিতে । এই স্মৃতিকথায়, আমি সাথীদের মানুষ হিসাবে যেমন পেয়েছিলাম, তেমন ভাবেই তাঁদের চিত্রিত করতে প্রয়াস পেয়েছি । রিটাচিং বা কাট-ছাঁট করে এদের দেবতা বানানো যেত । কিন্তু তাহলে এদের স্বাভাবিক আকর্ষণ মুছে যেত । তখন এই চিত্রের এই প্রতিমার সামনে মাথা নত হতো ঠিকই কিন্তু তাদের তুলে নিয়ে চুমো খাবার ইচ্ছা হয়তো হতো না । তাকে হয়তো পুষ্পার্ঘ্য নিশ্চয়ই দেওয়া হতো কিন্তু কর্মক্ষেত্রে তারা প্রেরণা যোগাতে পারতো না । - শিব বর্মা

=================================================

সর্দার ভগত সিংহ

ভগৎ সিংহের আগে বিপ্লবীদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল দেশের স্বাধীনতা । তবে এই স্বাধীনতা সম্পর্কে আমাদের কি মনোভাব, তার আগে সে-সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্বচ্ছ ছিল না । ইংরেজ বড়োলাটকে হঠিয়ে সেই জায়গায় কোন ভারতীয়কে বসিয়ে দিলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ? সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং তার ভিত্তিতে মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ অব্যাহত থাকতে আমরা কি যথার্থভাবে স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারবো ? স্বাধীনতার পর সরকার কার হবে, ভাবী সমাজের রূপরেখা কেমন হবে ইত্যাদি বিষয়ে বিপ্লবীদের মধ্যে বিশেষ অস্পষ্টতা ছিল । বিপ্লবীদের মধ্যে ভগত সিংহই প্রথম এই সব প্রশ্ন উত্থাপন করে এবং সমাজবাদকে দলের উদ্দিষ্টরূপে সামনে নিয়ে আসে । তার বক্তব্য, দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্যে লড়াই লক্ষ্যের দিকে প্রথম পদক্ষেপ মাত্র । সেখানে পৌঁছে যদি আমরা থেমে যাই তাহলে অভিযান আমাদের অর্ধ সমাপ্ত থেকেই যাবে । সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা আসলে অল্পসংখ্যক লোকের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবার স্বাধীনতাই হয়ে দাঁড়াবে । শোষণ ও বৈষম্যের মূলোৎপাটন করার ভিত্তিতে গঠিত সমাজবাদী সমাজ ও সমাজবাদী রাষ্ট্র ক্ষমতাই রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটাতে পারে ।

সে সময়টায় সমাজবাদ ছিল যুগের ডাক । বিপ্লবীদের মধ্যে ভগত সিংহই সর্বপ্রথম সেই ডাক শুনে চিনতে পারে । তার অন্যান্য সাথীদের চেয়ে এইখানটায় তার মহত্ত্ব ।

=================================================

হাইকোর্টের সামনে বিপ্লবের পরিভাষা করতে গিয়ে সে বলে : "বিপ্লব হলো জগতের নিয়ম । এটা হলো মানব প্রকৃতির রহস্য ।" কিন্তু "এতে রক্তেরাঙ্গা সংঘর্ষ অনিবার্য, তাতে না আছে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার কোন স্থান । সেটা বোমা ও পিস্তলের কোন সম্প্রদায় নয় ।"

"বিপ্লব বিরোধীরা কেবল পিস্তল, বোমা, তলোয়ার ও রক্তপাতকেই বিপ্লব বলে থাকে । কিন্তু বিপ্লব এগুলিতেই সীমাবদ্ধ নয় । এই জিনিসগুলি বিপ্লবের উপকরণ হতে পারে কিন্তু এগুলির ব্যবহারের পেছনে বিপ্লবের বাস্তবিক শক্তি জনগণের, সমাজের অর্থনীতিক ও রাজনীতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের উদ্দেশ্যের মধ্যেই নিহিত থাকে ।"

"আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিপ্লবের উদ্দেশ্য কিছু ব্যক্তির রক্তপাত করা নয় । আমাদের উদ্দেশ্য হলো মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ ব্যবস্থাকে শেষ করে এই দেশের জন্য আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রাপ্ত করা ।"

=================================================

"আপনি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কথা বলছেন । আমি জিজ্ঞেস করি, সর্বশক্তিমান হওয়া সত্ত্বেও আপনার ভগবান অন্যায়, অত্যাচার, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, শোষণ, অসাম্য, দাসত্ব, মহামারী, হিংসা ও যুদ্ধ প্রভৃতিকে শেষ করে দেয় না কেন ? এসবকে শেষ করে দেবার শক্তি থাকা সত্ত্বেও যদি সে মানবজাতিকে এই অভিশাপগুলি থেকে মুক্ত না করে তাহলে নিশ্চয়ই তাকে ভালো ভগবান বলা যায় না । আর যদি এগুলিকে শেষ করার ক্ষমতা তার না থাকে তাহলে সে সর্বশক্তিমান নয় । যদি সে এসব খানিকটা খেলা দেখাবার জন্য লীলার ছলে করে তাহলে একথাই বলতে হবে যে সে অসহায়দের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মজা দেখার এক নির্দয় ক্রূর সত্তা । জনহিতের জন্য সে যত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় ততই ভালো । মায়াবাদ, ভাগ্যবাদ, ঈশ্বরবাদ ইত্যাদিকে আমি মুষ্টিমেয় ক্ষমতালোভী শোষকদের জনসাধারণকে ভুলিয়ে রাখার জন্য আবিষ্কৃত বিষাক্ত জিনিস ছাড়া আর কিছু মনে করি না ।"

=================================================

"আমি বিশ্বাস করি যে এপর্যন্ত যে অর্থে এই শব্দের ব্যবহার হয়ে এসেছে সেই অর্থে এখন এর আর বাজার নেই । আজ পর্যন্ত প্রায় সব ধর্মই মানুষকে পরস্পরের কাছ থেকে আলাদা করেছে, নিজেদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করেছে । জগতে আজ পর্যন্ত যত রক্তপাত ধর্মের নামে ধর্মের ঠিকাদাররা করেছে অত বোধ হয় কেউ করেনি । সত্য কথা হলো এই যে এই ধরিত্রীর স্বর্গকে ধর্মের নামেই তচনচ করা হয়েছে । যে ধর্ম মানুষকে মানুষ থেকে পৃথক করে, ভালোবাসার জায়গায় পরস্পরকে ঘৃণা করতে শেখায়, অন্ধবিশ্বাসকে উৎসাহ দান করে, মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে, বুদ্ধিভ্রংশ ঘটায়, সেই ধর্ম কোনদিনই আমার ধর্ম হতে পারবে না । যা প্রতিপদে মানুষকে সুখী করতে পারে, সমতা, সমৃদ্ধি ও ভ্রাতৃত্বের পথে তাকে এক পা এগিয়ে দিতে পারে, আমার কাছে তাই হলো ধর্ম । অল্প কথায় বলতে গেলে এই পৃথিবী আর ভারতের এই পবিত্রভূমি হলো আমার স্বর্গ । এর মাটিতে বিচরণকারী প্রতিটি ব্যক্তি, প্রতিটি মানুষ আমার দেবতা, আমার ভগবান । আর ভগবানকে ভগবানের সঙ্গে লড়িয়ে আমার স্বর্গকে যে শক্তিগুলি নরক করে তুলেছে সেগুলিকে শেষ করে মানুষকে শ্রেণীহীন সমাজের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রত্যেকটি প্রচেষ্টা, প্রত্যেকটি পদক্ষেপ আমার ধর্ম ।"

=================================================

তাদের কাছ থেকে শেষবারের বিদায় নিয়ে আমরা যখন চলে যাচ্ছি তখন আমাদের মধ্যে একজন (জয়দেব কপূর) ভগত সিংহকে জিজ্ঞেস করলো, "সরদার, তুমি মরতে যাচ্ছ । আমি জানতে চাই তুমি এর জন্য আফসোস করছো না তো?"

প্রশ্নটি শুনে প্রথমে সরদার অট্টহাস্য করলো তারপর গম্ভীর হয়ে বললো, "বিপ্লবের পথে পা বাড়াবার সময় আমি ভেবেছিলুম যদি আমি আমার জীবন দিয়ে দেশের চতুর্দিকে ইনকিলাব জিন্দাবাদ-এর ধ্বনি পৌঁছে দিতে পারি তাহলে মনে করবো যে আমি আমার জীবনে মূল্য পেয়ে গিয়েছি । আজ ফাঁসির এই কুঠুরির মধ্যে গরাদের পিছনে বসেও আমি কোটি কোটি দেশবাসীর কণ্ঠ থেকে সেই ধ্বনির হুঙ্কার শুনতে পাই । আমি বিশ্বাস করি আমার এই ধ্বনি স্বাধীনতা সংগ্রামের চালক শক্তিরূপে সাম্রাজ্যবাদীদের ওপর শেষ পর্যন্ত আঘাত করতে থাকবে ।" আবার কিছুটা থেমে নিজের স্বাভাবিক স্মিতহাস্যের মধ্যে সে ধীরে বললো, "আর এত ছোট জীবনের এর চেয়ে বেশি মূল্য কিই বা হতে পারে ?"

=================================================

ফাঁসির মঞ্চে ওঠার সময় ভগত সিংহ একজন ইংরাজ ম্যাজিস্ট্রেটকে সম্বোধন করে বললো, "ম্যাজিস্ট্রেট মহাশয়, আপনি সত্যি সত্যিই বড় ভাগ্যবান, কারণ আপনি এই দৃশ্য দেখার সুযোগ পাচ্ছেন যে একজন ভারতীয় বিপ্লবী তার মহান আদর্শের জন্য কিভাবে হাসতে হাসতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে।"

=================================================

চন্দ্রশেখর 'আজাদ' 

এ কথা ঠিক যে আমরা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রবক্তা ছিলাম কিন্তু সে বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল প্রত্যেক মানুষের যাতে সুখ শান্তি হয় তার ব্যবস্থা করা । 'বসুধৈব কুটুম্বকম্' ছিল আমাদের উদ্দেশ্য । তাই প্রত্যেক মানুষের জীবনের প্রতি আমাদের ছিল গভীর মমত্ববোধ । আমরা সমকালীন ব্যবস্থার বিরোধী ছিলাম । কোন ব্যক্তি বিশেষের শত্রূ ছিলাম না । ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে আমাদের কঠোর নীতি সেই সূত্রেই আসতো যখন যে চলতি রাজনীতি ও সামাজিক অসাম্য-ব্যবস্থার প্রতিনিধিরূপে আমাদের সম্মুখীন হতো ।

=================================================

যাঁরা আজাদকে ফ্যাসিস্ত বলেছেন তাঁরা তার কতকগুলি বাহ্যিক আচার আচরণই দেখেছেন । বস্তুত আজাদের অন্তর যে সর্বদাই আদর্শবোধে সজাগ থাকতো তা এরা বুঝতে পারেননি অথবা বুঝেও না বোঝার ভান করেছেন । অহিংসা নীতিতে অবিশ্বাস, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ত্রাস নীতি, সেনাবাহিনীর প্রাধান্য হলো ফ্যাসিবাদের বাহ্যিক প্রকাশ । আজাদও অহিংসায় বিশ্বাস করতো না ঠিকই । নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে তার জন্ম এবং ছোটকাল থেকেই সে সামরিক প্রকৃতিরই ছিল । কিন্তু এটুকুর জন্য কি তাকে ফ্যাসিস্ত বলা যায় ? ফ্যাসিবাদের লক্ষ্য হলো বর্তমান বিপ্লবী আন্দোলনে বাধা সৃষ্টি করা, তাকে বিপথগামী করা, সাম্রাজ্যবাদের শক্তি বৃদ্ধি করা এবং সাধারণ মানুষকে গালভরা কথায় ভুলিয়ে ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদকে জিইয়ে রাখা । আজাদ এবং তার দল সম্পর্কে এর মধ্যে একটা কথাও প্রযোজ্য নয় । আজাদ ছিল সাম্রাজ্যবাদের ঘোরতর শত্রু । তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদের অবসান ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা স্থাপন করা ।

=================================================

শিবরাম হরি রাজগুরু

বিপ্লবী জীবনে ভগত সিংহকে তার সব চেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে গণ্য করতো রাজগুরু । জাতীয় মুক্তি অর্জনের সংগ্রামে কে এগিয়ে গিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়বে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল তার জন্য । ভগত সিংহ তার আগে যেন শহীদ না হয় এটাই ছিল তার নিয়ত চিন্তা । যখনই কোন অ্যাকশনের কথা হতো তার একমাত্র দাবি থাকতো তাকে উক্ত অ্যাকশনে আগে পাঠাতে হবে ।

=================================================

দেশ ও জাতির পুনর্বাসনের প্রকৃষ্ট পন্থা যে সাম্যবাদ অথবা সমাজতন্ত্রবাদ, এ-বিশ্বাস তার পূর্ণমাত্রায় ছিল । এর মানে এই নয় যে এই উভয় তত্ত্ব সম্পর্কে সে গভীর ও বিস্তৃত জ্ঞান অর্জন করেছিল । সমাজতন্ত্রবাদ বলতে কি বোঝায়, এর রূপায়ণের জন্য কি ও কোন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে, সমাজতান্ত্রিক সমাজের মৌল লক্ষণসমূহ কি হবে, ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর দিতে সমর্থ ছিল তাও বলছি না । মূল কথা সে যা বুঝেছিল তা হলো, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যারা বিবিধ সম্পদ তৈরি করে তারা শ্রমের বিনিময়ে যৎসামান্যই পেয়ে থাকে । সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়  এ বৈষম্য দূর করা সম্ভব হবে । সেখানে ধনী-দরিদ্র বিভেদ থাকবে না । সবাইকে শ্রম করে খেতে-পরতে হবে । কোন ব্যক্তি বিশেষ বা সম্প্রদায় বিশেষ কারো পরিশ্রমলব্ধ তৈরি সম্পদ আত্মস্বার্থে বা সম্প্রদায়-স্বার্থে ব্যবহার করতে পারবে না । সমগ্র সমাজের কল্যাণে উদ্বৃত্ত সম্পদ ব্যয়িত হবে । অপর কথায় শোষণব্যবস্থা লুপ্ত হবে । কোন দেশ তদ্দেশীয় কোন বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে অপর দেশ অধিকার করে তা লুন্ঠন করবে না । অর্থাৎ দুর্বল ও অনগ্রসর দেশ ও জাতি সমূহকে গোলামে পরিণত করবে না ।

মার্কসবাদী তত্ত্ব এবং সাম্যবাদের বুনিয়াদী মতাদর্শ সমূহ না জানলেও রাজগুরু তার নিজ জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে গভীরভাবেই বুঝেছিল দারিদ্র্যের কি দুঃসহ জ্বালা, পদে-পদে কি ভীষণ লাঞ্ছনা, অনাদর আর অবহেলা । এই অভিজ্ঞতাই, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতি তার নিষ্ঠা সঞ্চার করার ভিত্তি রচনা করেছিল; এই আদর্শে অনুপ্রাণিত করেছিল । কালক্রমে এটাই গভীর প্রত্যয় এবং প্রেরণা রূপে তার হৃদয়ে গেঁথে যায় ।

=================================================

আমি ঢাকা-ঢাকি না করে সোজাসুজিই বললাম, "মরতে ভয় পাচ্ছ ? যা কিছু করেছো তার জন্য অনুশোচনা হচ্ছে ?"

আমার কথা শুনে প্রথমে মৃদু হাসল । পরক্ষণেই গম্ভীর ও দৃঢ় কণ্ঠে বললো "তোমার কাছে এধরনের কথা শুনবো ভাবতে পারিনি । অন্তত তুমি ভালোভাবেই জান যে আমি মরতে ভয় পাই না ।  আজ তোমাকে যা বললাম তা হলো আমার অন্তরের অনুরণন । দারিদ্র্য হলো অভিশাপ । আর স্নেহ-প্রীতি-মমতার অনাস্বাদ হলো নরক । এই অনুভূতি হলো আমার বাইশ বছরের জীবন নিঙড়ানো বিশ্লেষণ । কিছু লোক আমাদের দারিদ্র্যের পঙ্কে ডুবিয়ে রাখে । স্নেহ-ভালোবাসার পরিবেশ থেকে বঞ্চিত করে তাই । এ পৃথিবী সুন্দর, মনোরম আর সুখকর । তাই এই সুন্দর পৃথিবীতে ভালোবাসা ও প্রীতির মধুর স্পর্শ আরো কিছুকাল ভোগ করতে কার না সাধ হয় । এই স্বাভাবিক মানবিক অনুভূতিকে তুমি বলবে মৃত্যুকে ভয় করা?" রাজগুরু কিছু সময়ের জন্য নীরব হয়ে গেল । আবার বলতে লাগল, "মৃত্যুর সঙ্গে গলাগলি করার জন্য প্রস্তুত হয়েই তো এই সত্যকে চিনেছি । তুমি কি ভাবছ যে সে সংগ্রামের এই অন্তিম পর্বে এসে, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলবো আমায় ছেড়ে দাও । মনে রেখো আমি যা কিছু করছি তা তোমাদের মতো প্রত্যয়দৃঢ় হয়েই করেছি । যে স্বর্গ আমরা রচনা করতে চাই তার আবরণ উন্মোচন করে যদি এতটুকু আলোও দেখাতে ওয়ারী কোটি কোটি দেশবাসীকে আমার প্রাণের বিনিময়ে তা'হলে তাই হবে অনেক । বাকি কাজ দেশের মানুষ নিজেরাই পূর্ণ করে নেবে । এমন আলোকোজ্জ্বল মহান মৃত্যুকে যে ভয় করে তাকে মূর্খ ছাড়া আর কি বলবো । একজন বিপ্লবীর নিকট এ মৃত্যু আশীর্বাদ ।"

=================================================

সুখদেব

বিপ্লবীদের উদ্দেশ্যের সাফল্যে তার বিশ্বাস কতখানি অটল ছিল তার প্রমাণ ফাঁসির কিছু পূর্বে গান্ধীকে লেখা তার চিঠি । "বিপ্লবীদের লক্ষ্য হলো এদেশে সোস্যালিস্ট গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা । এ লক্ষ্যের সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই । ... আমি মনে করি ... আপনার এই ধারণা হবে না যে বিপ্লবীরা যুক্তিহীন হয় এবং তারা নিছক ধ্বংসের কাজে আনন্দ পায় । আমরা আপনাকে জানিয়ে দিতে চাই যে, সত্য কথা এর বিপরীত । তারা প্রত্যেকটি পদক্ষেপের পূর্বে চারদিককার সম্বন্ধে বিচার করে নেয় । তারা তাদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সদা সচেতন থাকে । তারা আপন বিপ্লবী বিধানে গঠনমূলক কাজের উপযোগিতাকে মুখ্য স্থান দেয়, যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে তার ধ্বংসাত্মক দিকটাই বেশি নজর দিতে হয়েছে ।"

"... সে দিন আর বেশী দূর নেই তাদের (বিপ্লবীদের) নেতৃত্বে ও তাদের পতাকার তলে জনগণকে তাদের সমাজবাদী প্রজাতন্ত্রের উচ্চ লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে দেখা যাবে ।"

এই চিঠির এক স্থলে তার ফাঁসির সাজা সম্বন্ধে সে লিখলো, "লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার তিন জন অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ডের হুকুম হয়েছে এবং যারা ঘটনাক্রমে দেশে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেছে তারাই বিপ্লবী দলের সব কিছু নয় । বাস্তবিক পক্ষে তাদের মৃত্যুদণ্ড মকুব হলে দেশের পক্ষে ততো কল্যাণকর হবে না যতখানি হবে তাদের ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুবরণ করলে ।"

=================================================

মহাবীর সিংহ

মহাবীরের বাবার সে চিঠির অক্ষর ও শব্দ আজ বিয়াল্লিশ বছর পরও আমার হুবহু মনে পড়ছে । তিনি লিখেছিলেন :

"একথা জেনে খুবই আনন্দিত হলাম যে, তুমি দেশের কাজে নিজেকে অর্পণ করতে কৃতনিশ্চয় হয়েছ । আমার তো ধারণা হয়েছিল যে, আমাদের বংশে পূর্বপুরুষের রক্ত আর নেই । সবাই মনে-প্রাণে দাসত্ব মেনে নিয়েছে । তোমার চিঠি পড়ে আজ আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি ।"

"যেখানে তোমার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল, তাদের আজ উত্তর লিখে দিয়েছি । তুমি এ বিষয়ে নিশ্চিত থেকো যে আমি এমন কিছু করবো না যাতে তোমার সংকল্পে বাধা সৃষ্টি হয় ।"

"দেশ সেবার যে পথ তুমি বেছে নিয়েছ, মনে রেখো, তা সাধনার পথ, বড়ই দুরূহ সেই পথ । তবু তুমি যখন এই পথে পা বাড়িয়েছ তখন আর পিছনে ফফিরে তাকাবে না । সাথীদের ধোঁকা দিও না এবং তোমার বৃদ্ধ পিতার নামের খেয়াল রেখো ।"

"তুমি যেখানেই থাক না কেন আমার আশীর্বাদ তোমার সঙ্গে থাকবে ।"

- তোমার পিতা, দেবী সিংহ

=================================================

অনশন শেষ হবার পর সহকর্মী জয়দেব কাপুর মহাবীর সিংহের একটি নোট বই পেয়েছিল । কাপুরের কথায় ঐ নোট বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় পুশকিনের একটি ছোট কবিতা লেখা ছিল যা মহাবীর সিংহের উপযুক্ত । ওই কবিতা ও তার অনুবাদ নিচে দিলাম । এই কবিতার ছত্রগুলি মহাবীর সিংহের বিপ্লবী জীবন বুঝতে সাহায্য করবে ।


I know destruction awaits him,
who first rises
Against the oppressor's yoke;
My fate is sealed aand closed,
But tell me where and when
Without victims
Was ever freedom won?
For my native land I perish
I feel it and I know it
And in my heart O Holy father!
My fatal star
I bless!

=================================================

যতীন্দ্রনাথ দাশ

লাহোরে কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৬২ দিন অনশন সংগ্রাম চালানোর পর শহীদের মৃত্যুবরণ করেন ।

অবশেষে ১৩ই জুলাই, ভগত সিংহ ও দত্তের সমর্থনে আমাদের মধ্যে দু'চার জন ব্যতীত আর সবাই অনশন সংগ্রাম আরম্ভ করলো ।

আমাদের মধ্যে একমাত্র যতীন দাশ ছাড়া কারো অনশনের অভিজ্ঞতা ছিল না । ভাবাবেগে চালিত হয়ে অনশন সংগ্রামে যোগ দিতে যতীন্দ্রনাথ নিষেধ করলো সাথীদের । সে বললো, "রিভালবার পিস্তল নিয়ে লড়াই করার চেয়ে  অনেক বেশি কঠিন এক অনশন সংগ্রামে আমরা নামছি । অনশন সংগ্রামীকে তিল-তিল করে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যেতে হয় । শত্রুর সঙ্গে সম্মুখ লড়াইয়ে গুলির আঘাতে প্রাণ দেওয়া, বা ফাঁসির রশিতে জীবন দেওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ । অনশনে অংশ নিয়ে পরে পিছু হটলে বিপ্লবীদের প্রতিষ্ঠা ধুলায় লুটিয়ে পড়বে । তাই বলছি যে যোগ দিয়ে পিছিয়ে পড়ার চেয়ে প্রথম থেকেই অনশনে যোগ না দেওয়াই সমীচীন ।"

সে আরো বলে যে, সে নিজে অনশন আরম্ভ করলে যতদিন না সরকার দাবিসনদ মেনে না নেয়, ততদিন অনশন চালিয়ে যাবে । সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে বলে যে, তাড়াহুড়ো করে কিছু না করাই ভালো । আরো একদিন সময় নিক তারা । ভালো করে বুঝে-সুঝে অনশনে যোগ দিক । যারা নিজেদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবলে সন্দিহান, তাদের অনশনে যোগ না দেওয়াই বাঞ্চনীয় । সে একথাও স্পষ্ট করে বলে যে, যারা অনশন করবে না তারাও অন্যদের মতো সম্মানিত বিপ্লবী হিসাবে গণ্য হবে ।

=================================================

সেইদিন থেকে তিলে তিলে তার মৃত্যুর পথে যাত্রা শুরু হলো । শহীদের মৃত্যুবরণের পথে প্রত্যেকটি মুহূর্তে তার শান্ত ও সৌম্য চেহারায় দৃঢ় সংকল্পের রেখা আরও গভীর হয়ে ফুটে উঠলো ।

কয়েকদিনের মধ্যে তার অবস্থা খারাপ হলো । সারা দেহে বিষক্রিয়া ছড়িয়ে গেল । চোখ বন্ধ হয়ে এল । ডাক্তার ডুশ প্রয়োগ করতে চাইল । কিন্তু সে অসম্মতি জানাল । কংগ্রেসের বহু নেতা, ডিফেন্স কমিটির সদস্যবৃন্দও অনুরোধ জানালো । কিন্তু তাতে কাজ হলো না । সরকারকে কেউ জানালো যে, হয়তো সে ভগত সিংহের কথা মানবে । এই পরামর্শ পাবার পর ভগত সিংহকে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আনা হলো । ভগত সিংহ তাকে একবার অনুরোধ করাতে দাশ ডুশ নিতে রাজি হলো । জেলের জনৈক কর্তাব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেছিল যতীন্দ্রনাথকে "আপনি কারো অনুরোধ রাখেননি । কিন্তু ভগত সিংহ বলতেই রাজি হলেন কেন ?" উত্তরে সে বলে, "আপনি জানেন না ভগত সিংহ কি ধরনের বীরপুরুষ । আমি কখনো তার কথা ফেলতে পারি না ।"

আর একবার ভগত সিংহ তাকে ওষুধ খেতে অনুরোধ করে । তখন সে জবাব দেয়, "শোন ভগত সিংহ, আমি জানি যে, আমার শপথ ভঙ্গ করা উচিত নয় । কিন্তু তোমার অনুরোধও অগ্রাহ্য করতে পারি না । যাই হোক, এর পর কোন অনুরোধ আমায় করো না ।" তার অবস্থার অবনতি দেখে তাকে মেয়ো হাসপাতালে পাঠাতে চাইলো সরকার । কিন্তু যতীন্দ্রনাথ সে হাসপাতালে যেতে অস্বীকার করলে সরকার তাকে জামিনে খালাস করার সিদ্ধান্ত নিলো । জনৈক সাজানো শেঠ জামিনদার হতে রাজিও হলো । হঠাৎ ছাড়া পাবার খবর পেয়ে যতীন্দ্রনাথ সবাইকে তার পাশে ডেকে নিয়ে বসলো "এ সব ধোঁকাবাজি, সরকার জানে আমার দিন ঘনিয়ে এসেছে । আমার মৃত্যুর দায়িত্ব সে নিতে চায় না । তাই আমাকে জেলের বাইরে বার করে দিয়ে আমার থেকে রেহাই পেতে চায় । আমি এটা হতে দেব না ।" এ-কথা বলে আমাদের দিকে তাকাল । বললো, "আমি এখানে মাঝে থেকে, লড়াই করেই মরতে চাই । আমি চাই তোমরাও সাধ্যমতো বাধা দাও যাতে আমাকে এখান থেকে না সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে ।"

=================================================

No comments:

Post a Comment