ভারতে হিন্দুধর্মের হিংস্র বর্ণ-বৈষম্যের মধ্য থেকে নিম্নবর্ণে থাকা মানুষের মুক্তির জন্য এবং শিক্ষার সার্বিক প্রসারের জন্য তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে থাকেন । তাঁর অদম্য মানসিকতা এবং প্রভূত জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে শাসক ১৯৪২ সালে ২ রা জুলাই ভাইসরয়-এর এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে তাঁকে শ্রম-দপ্তরের সদস্য মনোনীত করে । ঐ পদটি ছিল কার্যত ভারতের শ্রম-মন্ত্রীর পদ । ঐ পদ গ্রহণ করে তিনি অনেক বাধা অতিক্রম করে শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণের জন্য উৎসাহ-ব্যঞ্জক নজির সৃষ্টি করেছিলেন । তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল - (১) শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা ও গৃহ নির্মাণে সাহায্য, (২) ট্রেড ইউনিয়ন করার আইনি স্বীকৃতি, (৩) মৃত শ্রমিকদের পরিবারকে এককালীন অর্থ সাহায্য, (৪) ন্যূনতম বেতন প্রদান, (৫) প্রসুতিকালীন সবেতন ছুটি ইত্যাদি । ফলে ভারতের শ্রমিকশ্রেণীর অধিকারের প্রশ্নে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল ।
=============================
আমাদের দেশে অনেক ধর্ম যেমন আছে আবার হিন্দু ধর্মের মধ্যে অনেক জাতও আছে । প্রায় সাড়ে ছয় হাজার । সেটি আরও বিভক্ত বর্ণাশ্রম জাতিভেদে, অর্থাৎ জাত ব্যবস্থায় । যতগুলি জাত ততোগুলি টুকরো । যার সংখ্যা এখন সাড়ে ছ হাজারেরও বেশি । যার প্রত্যেকটির সাথে প্রত্যেকটির 'বিরাগ' আছে । আর ড. আম্বেদকর বলেছেন 'ভারতের এই জাত ব্যবস্থা হল এমনই একটি বহুতল বাড়ি যার একটা তল থেকে আর একটা তলে যাবার সিঁড়ি নেই ।' কার্ল মার্কস যাকে বলেছেন 'বিরাগ', ড. আম্বেদকর তাকে আরও পরিষ্কার করেছেন 'graded inequality' বলে । অর্থাৎ বিরাগ বা ঘৃণার প্রকৃতিটা হলো ক্রমিক অসাম্য । এই যে হাজারটা জাত, মান মর্যাদায় তারা কিন্তু সবাই সমান নয় । প্রত্যেকটি জাত অপর একটি জাতের হয় উপরে নয়তো নিচে অবস্থান করছে, উলম্ব অবস্থান (vertical lay-out), অনুভূমিক (horizontal) নয় । এখানে কায়স্থরা মনে করে তারা মাহিষ্যদের থেকে উপরে এবং ব্রাহ্মণদের নিচে, মাহিষ্যরা মনে করে তারা সদগোপের থেকে উপরে কিন্তু কায়স্থদের থেকে নিচে, বাগদীরা মনে করে তারা সদগোপের থেকে নিচে কিন্তু ডোমেদের থেকে উপরে । নমঃশূদ্ররা মনে করে তারা পৌন্ড্রদের থেকে উপরে ।
এইভাবে ভারতবর্ষের হিন্দুদের প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের ঠোকাঠুকি । অন্য কারও থেকে উপরে আছে তাই সে সন্তুষ্ট । উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে জোট বাঁধার কথা ভাবতেই পারে না । একদিকে 'বিরাগ' আর অন্যদিকে সন্তুষ্টি, তাই মার্কসের ভাষায় সৃষ্টি হয়েছে 'স্থিতিসাম্য' (static balance) । এই static balance-এর জন্যই বর্ণ ব্যবস্থা এত দীর্ঘ সময় টিকে রয়েছে । এবং এই ব্যবস্থার সুফলটুকু অর্থাৎ ক্ষীরটুকু ব্রাহ্মণরা হিন্দু ধর্মের বড়ি খাইতে শূদ্রদের সম্মতি সাপেক্ষেই আত্মসাৎ করেছে ।
=============================
তিনি অচ্ছুতদের জন্যে জমি আর আলাদা কলোনি দাবি করেছিলেন । অবশ্য কৃষিবিপ্লব ছাড়া এ-সব করা সম্ভব নয় । তবে ভূমিদাসদের মতো অন্য সব জাতের মুখ চেয়ে বসে থাকার ব্যাপারটা থেকে বাঁচতে হলে সমস্ত অস্পৃশ্যকে জমি দেওয়ার ভাবনাচিন্তা খুবই সঠিক । কিন্তু সব ভূমিহীন মানুষের অভিন্ন সংগ্রামের ভেতর দিয়েই তো এই লক্ষ্যে পৌঁছানো যেত ।
আম্বেদকর হিন্দুসমাজের অন্যায় লোকাচারের, অন্যায় আচরণের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যে তাঁর অনুগামীদের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করতে বললেন । কিন্তু অন্যায় ভূমিগত সম্পর্কের ভিতের ওপরে গড়ে উঠেছে সমাজের যে ভয়ঙ্কর বাস্তব অবস্থাটা, তা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেই তো পালায় না । প্রেম আর সাম্যের সন্ধানে বেরিয়ে, তা যে পাওয়া গেল না, তার তো জলজ্যান্ত প্রমাণ সাম্প্রতিক নির্যাতন নিপীড়নের সব কান্ডকারখানা । পরিস্থিতিটা এমন করুন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, সবচেয়ে দলিত মথিত যে সম্প্রদায়গুলো, সেখান থেকেও উদ্ভূত বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টি সমতার সম্বন্ধে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটুকু, আরও চাকরি-বাকরি, আসন সংরক্ষণ, শিক্ষার সুযোগ সুবিধা - এইসব দাবির সঙ্কীর্ণ বেড়াটা পার হয়ে আদর্শগতভাবে আর বেশি দূরে এগুতে পারছে না । বর্তমান আর্থ-সামাজিক কাঠামোখানাকে একদম ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবার কাজটা ওঁদের চৈতন্যের বৃত্তের মধ্যে ঠাঁই পায়নি । ভূমিগত সম্পর্কগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বলতে অন্য আর সকলের সঙ্গে যুথবদ্ধ হয়ে অভিন্ন যুদ্ধ চালানোটাও যে বোঝায় - এটা কিন্তু ওঁদের নজরে পড়ল না । এইসব সম্প্রদায় থেকে যে সব বুদ্ধিজীবী উঠে এসেছেন, এঁরাও কেউ আগে, কেউ বা পরে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কাঠামোখানাকেই মেনে নিয়েছেন; জমির সঙ্গে, শিল্পের সঙ্গে বর্তমান সম্পত্তিগত সম্পর্কের ব্যাপারটা একটুও না ছুঁয়েই গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো সম্বন্ধে একটা সাধারণ ঘোষণায় তৃপ্ত হয়ে রয়েছেন ।
=============================
ভারতীয় সমাজে জাতপাত প্রথা একটি বিশেষ ধরনের বৈশিষ্ট্য । এটা একমাত্র ভারতেরই বৈশিষ্ট্য । বিশ্বের অন্য কোনো দেশে এরকম নেই । ভারতে জাতিভেদ শ্রেণিভিত্তিক ভাগাভাগির একটা লক্ষণ । কারণ জাতিভেদ বর্ণপ্রথার নামে অথবা জাতের নামে সমাজের শ্রমজীবী অংশকে দাবিয়ে রাখার জন্যই তৈরি হয়েছে । জাতিভেদ প্রথা শ্রেণি শোষণেরই একটা হাতিয়ার । উদ্বৃত্ত অংশ যত বেশি সম্ভব আত্মসাৎ করার লক্ষ্যেই জাতপাত প্রথার সৃষ্টি । উৎপাদন সম্পর্কের সাথে জাতপাত প্রথা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ।
জাতপাত প্রথার সৃষ্টি হয়েছে প্রায় তিন হাজার বছর আগে । ক্রমান্বয়ে এর পরিমাণগত পরিবর্তন হয়েছে । কিন্তু শোষণের গুণগত উপাদান প্রায় একই রয়ে গেছে । জাতিভেদ প্রথার কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ আছে এবং কিছু নির্দিষ্ট সীমাও আছে । কিন্তু জাত আর শ্রেণি শোষণ ও জাতপাতভিত্তিক শোষণ মিলে গেলে শোষণের তীব্রতা ও পরিমাণ অনেকগুণ বেড়ে যায় । যে দেশে জাত ব্যবস্থা নেই সেই দেশগুলিতে শ্রমিক বা কৃষক বা উভয়ই অর্থাৎ সব ধরনের শোষিতরা দলবদ্ধভাবে বা সুযোগ পেলে ব্যক্তিগতভাবে মালিকের সঙ্গে দর কষাকষি করতে পারে । ইচ্ছে করলে একটা বৃত্তি বা পেশা থেকে অন্য পেশায় চলে যেতে পারে । কিন্তু জাতের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব না । কারণ পেশা হচ্ছে জাতভিত্তিক । ইচ্ছে থাকলেও কোনো পেশার বাইরে অন্য কোনো কাজ করতে পারবে না । পেশাও ঠিক হবে জন্মসূত্রে । কাজেই তার জোট বাঁধারও কোনো সুযোগ নেই । নীচু জাত হবার সুবাদে সমাজে উচ্চশ্রেণির লোকেরা তাকে দাবিয়ে রাখে । তাকে সবসময় একটা ভয় বা আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয় । শারীরিকভাবেও নিগৃহীত হতে পারে অথবা তাকে সামাজিক দিক থেকেও বয়কট করা হতে পারে বা সমাজ থেকে বের করে দেওয়া হতে পারে । সমাজ থেকে বের করে দেওয়া বা সামাজিক বয়কট তার মৃত্যুর সমান ।
এই ভারতে সামাজিক বিভাজন ঠিক কবে থেকে শুরু তা নিয়ে কিছু সমস্যা আছে । ভারতে প্রাচীনতম সভ্যতা হরপ্পা সভ্যতা (খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছর) ছিল প্রথম নগর সভ্যতা । শ্রেণি বিভাগ বা শ্রেণি শোষণ ছাড়া নগর সভ্যতা গড়ে উঠতে পারে না । কাজেই শ্রেণি শোষণ ছিল এটা নিশ্চিত । কিন্তু যতদিন পর্যন্ত হরপ্পা লিপি পড়া না যাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত জানা যাবে না যে তখন জাত ভাগ ছিল কিনা । বৈদিক সাহিত্য অনুযায়ী প্রায় খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার সাল নাগাদ প্রথম দেখা যায় বর্ণভেদ ভারতে শুরু হয়েছিল । ঋকবেদের দশম মন্ডলে বর্ণভেদের কথা আছে ।
কিন্তু বিদ্বজ্জনেরা মনে করেন বর্ণ বিভাজন প্রথমে দেখা যায় যজুর্বেদে । পরে তা ঋকবেদে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে । অনুমান করা হয় এক হাজার থেকে আটশত খ্রিস্টপূর্বের মধ্যে বর্ণ বিভাজন হয়ে যায় । সেই সময় সম্পত্তির মালিকানা তৈরি হয়েছিল । ফলে শ্রেণি বিভাজন হয় । ...
... জাত বিভাজন শুধু মাত্র শ্রম বিভাজন নয় । এটা শ্রমিকদের মধ্যেও বিভাজন । যে কোন সমাজে শ্রম বিভাজন দরকার হয় । কিন্তু ভারতে শ্রম বিভাজনটা একটা কৃত্রিম শৃঙ্খলে আবদ্ধ আছে । এখানে শ্রমিকদের মধ্যে এই বিভাজনটা স্তর বিন্যাস করে করা হয়েছে । পৃথিবীর কোন দেশেই শ্রম বিভাজনকে শ্রমিকদের স্তর বিন্যাসের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়নি ।শ্রম বিভাজন স্বতঃস্ফূর্তভাবেও হয়নি । স্বাভাবিক আগ্রহ থেকেও নয় । নিজের পেশা নিজে বেছে নিতে পারলে যে দক্ষতা অর্জন করা যায় বা নিজের জীবনের আর্থিক উন্নতি করা যায়, তা উপর থেকে চাপিয়ে দিলে হয় না ।
=============================
জাতপাত ব্যবস্থা ছিল প্রাথমিক উৎপাদকদের উদ্বৃত্ত থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে সামাজিক চেতনা তৈরি করার লক্ষ্যে একটা ধর্মীয় প্রক্রিয়া ।
=============================
আম্বেদকর একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, যার উত্তর এখনও কোনো জাতীয়তাবাদী দিতে পারেননি । প্রশ্নটার ধরণ ছিল এইরকম - দু'টো পৃথক জাতের যৌন মিলনে জন্ম দেওয়া সন্তানের রক্তের বিশুদ্ধতা নষ্ট হতে পারে এমন যুক্তি না হয় বোঝা গেল । কিন্তু এক পংক্তিতে বসে খেলেও কী রক্তের বিশুদ্ধতা নষ্ট হয়ে যায় ?
=============================
পৃথিবীর কয়েকটা দেশে বর্ণবৈষম্যবাদ এখনও নির্মূল হয়নি । এটা ছিল গায়ের রঙের বর্ণবৈষম্যবাদ । গণতান্ত্রিক পরিবেশের ক্রমশ বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তা দুর্বল হচ্ছে । ভারতে জাতপাতের বিভেদ কেবলমাত্র দু'টো সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে নয় । ভারতের একশো কোটির মানুষের মধ্যে ৮২ কোটি মানুষ হিন্দু । এই হিন্দুদের মধ্যে কত রকমের ভাগ । শুধু ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র নয়, প্রতিটা ভাগে কত উপবিভাগ । প্রতিটা বিভাগ-উপবিভাগের সঙ্গে অন্য বিভাগ-উপবিভাগের ঘৃণা, বিদ্বেষ, রক্ত, খুন মাখানো সম্পর্ক । এর শীর্ষে বসে ডান্ডা ঘোরাচ্ছে সবচেয়ে উঁচুজাতি বলে দাবি করা ব্রাহ্মণরা । প্রায় তিন হাজার বছর ধরে সেই বৈদিক যুগ থেকে মানুষের অভ্যাসের সঙ্গে জীবনচর্চার মধ্যে এই ঘৃণা বিদ্বেষ জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে । দুনিয়ার মধ্যে ভারত একটা নিকৃষ্ট ব্যতিক্রম । এমন দেশটা কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি ।
=============================
খ্রিস্ট্রপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্মের এই অগ্রগতি ও জনগণের দলে দলে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের প্রতিক্রিয়া হিসাবে ব্রাহ্মণ্যবাদে এক পুনরুত্থানবাদী ধারা শুরু হল । গৌতম বুদ্ধ সামাজিক ক্ষেত্রে বর্ণভেদের বিরোধিতা করেননি । বৌদ্ধ ধর্মের বাইরে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যে জাতিভেদের উপাদান রয়েই গেল । কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের উত্থানের ফলে ব্রাহ্মণ পুনরুত্থানবাদীরা আরও আষ্টে-পৃষ্ঠে জাতপাতকে সামাজিক আইনে বেঁধে ফেলল । রাজশক্তি নিজস্বার্থে তাতে মদত দিল । ব্রাহ্মণ পুনরুত্থানবাদ জীবনের সবক্ষেত্রে, ধর্মীয়, বুদ্ধিবৃত্তিগত, গার্হস্থ এবং সামাজিক ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই কঠোর আচরণবিধি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ব্রাহ্মণ্য সাম্রাজ্যের দুর্গ তৈরি করল । স্মৃতি বা ধর্মশাস্ত্রগুলি, মহাভারত ও রামায়ণ মহাকাব্য এবং অন্যান্য ধর্মীয় সাহিত্যে এই পুনরুত্থানবাদী ধারার প্রবাহ চলল । কয়েক শত বৎসর ধরে বহু চারণ কবি রামকে প্রতীক হিসাবে তুলে ধরলেন । এদের বলা হতো লব কুশ । এই ধারা বেয়েই রামায়ণ তৈরি হল । রামের চরিত্র সৃষ্টি ব্রাহ্মণ্যবাদকে সুসংহত করার লক্ষ্যে পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনের ফলশ্রূতি ।
=============================
ঋকবেদীয় পর্বে শ্রম বিভাজন অনেক এগিয়েছিল । অর্থব বেড পর্বের শেষদিকে অবশ্য কর্মবিভাজন (সামাজিক স্তর বিভাজন) হতে থাকে এবং জনগোষ্ঠী ও পরিবার গোষ্ঠী ক্রমে সামাজিক শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে যায় । শর্মার (আর এস শর্মা) মতে শূদ্র জনগোষ্ঠী বা আর্যদের যে অংশ দাসসুলভ কাজ করতেন, তাদের স্থান নির্ধারণ হল চতুর্থ বর্গে । পুরোহিতদের প্রভাবেই বর্ণ ব্যবস্থায় মতাদর্শের প্রভাব ঘটেছিল ।
=============================
বুদ্ধদেবের মতাদর্শে একটা অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব ছিল । তিনি হিন্দু সমাজের চতুর্বর্ণ সমাজের বিরোধিতা করেননি বরং তাকে স্বীকারই করেছিলেন । আবার তিনিই সমাজের বর্ণভেদ ভিত্তিক সামাজিক অসাম্যকে স্বীকার করেননি । তাঁর মত অনুযায়ী, মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব বা মূল্য নির্ধারিত হয় কোন জাতে সে জন্মগ্রহণ করেছে তার ফলে নয়, নির্ধারিত হয় তার আত্মিক ও নৈতিক গুণাবলী দিয়ে ।
=============================
কুরুক্ষেত্রে অর্জুন আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে না চাইলে কৃষ্ণ তাকে উজ্জীবিত করার জন্য নাকি কিছু উপদেশ দেন, এই উপদেশগুলোই হল গীতা । যদিও অনেক শাস্ত্রকার ও ঐতিহাসিক সমাজতত্ত্ববিদ মনে করেন গীতা মূল মহাভারতে ছিল না । খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে ভগবদগীতা পর্যায়ক্রমে রচিত । তারপরে মহাভারতে সংযুক্ত হয়েছিল । গীতার একটা বিখ্যাত উক্তি " স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় -পরধর্ম ভয়াবহ" এই স্বধর্ম কী ? তখন কি কোনো গ্রন্থে হিন্দু ধর্ম নাম কোন ধর্মের কথা বলা হয়েছে ? এখানে জাতপাতকেই ধর্ম বলা হয়েছে ।
=============================
ব্রাহ্মণ্য ধর্মের চরম গোঁড়ামি, জাত-পাত, অস্পৃশ্যতার নিদারুন অত্যাচার ও অবিচারের বিকল্প হিসাবে গৌতম বুদ্ধ সংঘগুলিতে সাম্যের আবহাওয়া সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন । তাই ভারতীয় জনগণের একটা বিশাল অংশ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিল । ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রেও তা একইভাবে প্রযোজ্য । ভারতে ইসলাম এক হাতে কোরান অপর হাতে তরবারি নিয়ে আসেনি । অল্প কিছু ক্ষেত্রে রাজশক্তি বা জোর করে ধর্মান্তর হলেও ইসলামের প্রভাব এখানে বেড়েছে দুটো প্রধান কারণে । সুফি ভক্তিবাদের ফলে এবং হিন্দু সমাজে জাতপাত ভেদের জন্য । নিম্নবর্ণের এবং দলিত জনগণের একাংশ উচ্চবর্ণের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে । স্বামী বিবেকানন্দ একে চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন । ভারতে দলিত মানুষ ইসলামের মধ্যে সাম্যের উপাদান দেখতে পেয়েছিল । বিবেকানন্দের মতে এই জন্য ভারতে (বিবেকানন্দের সময় অবিভক্ত ভারত - লেখক) এক পঞ্চাংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ।
=============================
হিন্দুধর্মের এবং সাধারণভাবে সমস্ত ধর্মেরই সামাজিক তথা অর্থনৈতিক ভূমিকাকে শ্রমিকশ্রেণির সামনে সঠিকভাবে তুলে না ধরলে আদর্শগত সংগ্রাম সফল হতে পারবে না । কৃষিবিপ্লব ঘটানোর জন্যে সংগ্রাম, একচেটিয়া পুঁজির দাপটচাপট আর সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অবসান ঘটানোর জন্যে সংগ্রাম সমাজতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাবে -- এমন ধরণের জনগণতন্ত্ররাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রাম--এ-সবই তো হচ্ছে আমাদের একালের প্রধান সংগ্রাম । এইসব সংগ্রাম থেকে সমাজের জাতপাতের ভেদাভেদ প্রথাটাকে দূর করে দেওয়ার প্রশ্নটাকে আলাদা করে দেখে ওটাকে খালি হিন্দু সমাজের সংস্কারের প্রশ্ন বলে মনে করা আর চলে না ।
=============================
সংরক্ষণের প্রশ্ন
ভারতের সংবিধানে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণ চালু আছে । জনসংখ্যার অনুপাত অনুযায়ী সংরক্ষণ-এর হার নির্ধারিত হবে কিন্তু কোনো সময়ই তা ৫০ শতাংশ অতিক্রম করতে পারবে না । শুধুমাত্র সরকারী চাকুরির ক্ষেত্রে সরকারি বা সরকার পোষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষেত্রে এই সংরক্ষণ প্রযোজ্য হয় । কিন্তু বেসরকারি ক্ষেত্রে সংরক্ষণ চালু করার প্রস্তাব থাকলেও তা এখনও আলোচনার স্তরে আছে । আর এস এস এবং বিজেপি-র বিভিন্ন মহল থেকে সংরক্ষণ প্রথার বিরোধিতা করা হচ্ছে এবং তা তুলে দেওয়ার জন্য সওয়াল করা হচ্ছে ।
ভারতের মত জাতপাত বিভক্ত সমাজে সংরক্ষণ থাকাটা খুবই প্রয়োজনীয় । কারণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উচ্চবর্ণের মানুষেরা সমাজ শাসন করেছেন, ধর্মের নামে বিভিন্ন বিধি বিধান দিয়েছেন তার অনিবার্য পরিণতিতে নিম্নবর্ণের মানুষদের শিক্ষা এবং সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল এবং তাদের উপরে অনেক বিধিনিষেধ জারি করা ছিল, এখনও কিছু কিছু আছে । উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ডঃ আম্বেদকরকে স্কুলে সহপাঠীদের সাথে একসাথে বসতে দেওয়া হতো না, বাইরে চাটাই পেতে বসতে হতো । পানীয় জলের পাত্রের কাছে যেতে পারতেন না । এমনকি অধ্যাপনার চাকরি পাওয়ার পরেও অধ্যাপকদের জলপানের অধিকার ছিল না । শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তারা উচ্চবর্ণের তুলনায় ক্রমশ পিছিয়ে গেছে । উচ্চবর্ণরা সংখ্যায় কম হয়েও যুগের পর যুগ ধরে সিংহভাগ চাকরিবাকরি, শিক্ষার সুযোগ -সমস্ত কিছুই দখলে রাখতেন ।
ব্রিটিশ আমলে সংরক্ষণের নীতি প্রথম চালু হয়েছিল । মূলস্রোতে আনবার জন্য সংরক্ষণই ছিল দরিদ্র নিম্নবর্ণের মানুষের কাছে একমাত্র অবলম্বন । যারা ইসলাম ধর্ম বা বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা কিন্তু এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল । এদের সংরক্ষণের আওতায় আনবার জন্য ২০১০ সালে রঘুনাথ মিত্র কমিশন রায় দিয়েছিলেন যে আর্থিক দিক থেকে ধর্ম নির্বিশেষে পিছিয়ে পড়া মানুষকে সংরক্ষণের আওতায় আনা যেতে পারে । পশ্চিমবাংলার বামফ্রন্ট সরকারি এটি প্রথম কার্যকরী করে এবং শতকরা ১৭ ভাগ সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষণের সুযোগ পায় ।
সংরক্ষণের সুযোগ নেওয়ার জন্য গ্রূপ ডি চাকরি ছাড়া অন্য পদে ন্যূনতম মাধ্যমিক পাশ করা দরকার । কিন্তু সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী তফশিলভুক্ত জাতির শতকরা ৭১.৩ ভাগ স্কুল ফাইনাল পাশ করার সুযোগ পায় (ভুল সংশোধন - তফশিলভুক্ত জাতির শতকরা ৭১.৩ ভাগ স্কুল ছুট) । ফলে সরকারের খুবই নিম্নস্তরের কাজে প্রতি ৪ জন দরিদ্রের মধ্যে ১ জন মাত্র সংরক্ষণের সুযোগ নিতে পারে । ২০০১-এর আদমসুমারি অনুযায়ী দলিতদের মধ্যে মাত্র ২.২৪% স্নাতক । এখন নয়া উদার অর্থনীতির যুগে সব কিছুর সঙ্গে শিক্ষাও বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে । ফলে সরকারি চাকরির সংখ্যা কমে যাচ্ছে । ১২০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ১ কোটি ৮০ লক্ষ মাত্র সরকারি চাকরি ।
তফশিল জাতি ও উপজাতির জন্য জাতীয় কমিশনের রিপোর্টে দেখা যায় যে কেন্দ্রীয় সরকারের এ গ্রেড অফিসারের ন্যূনতম ১৫ শতাংশ এই অংশের মানুষের হওয়া উচিত সেখানে ৮.৪ শতাংশ মাত্র চাকরি করেন । দিল্লি হাইকোর্টের ২০ জন বিচারকের মধ্যে একজনও দলিত নেই । তামিলনাড়ু সামাজিক ন্যায়ের জন্য বিখ্যাত কিন্তু সেখানেও হাইকোর্টের বিচারকের ৩৮ জনের মধ্যে মাত্র ৪ জন, কেরালায় ২৫ জনের মধ্যে ১ জন তফশিল জাতিভুক্ত ।
২০১১ আদমসুমারি অনুযায়ী ১২০ কোটির মধ্যে তফশিল জাতি ও উপজাতির সংখ্যা ৩০ কোটি । সংরক্ষণের মাধ্যমে আদিবাসিরা চাকরি পে ঝাড়ুদার বা জমাদার ইত্যাদি পদে ।
সংরক্ষণ নিয়ে দুটি প্রশ্ন যথাযথ উঠে এসেছে । তফশিল জাতিভুক্ত অনেক মানুষ আছেন যারা সংরক্ষণের সুবিধা পেয়ে অর্থনৈতিক মর্যাদা পেয়েছেন । যারা ব্যক্তিগতভাবে তফসিলী উপজাতিভুক্ত হওয়ার জন্য অর্থনৈতিক বা শিক্ষাক্ষেত্রে ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অনেক অগ্রসর হয়ে এসেছেন যেমন কলেজের অধ্যক্ষ বা অধ্যক্ষা, চিকিৎসক, সরকারি অফিসার নিম্ন আদালতের বিচারক ইত্যাদি । এইভাবে তফশিলভুক্ত উপজাতির মধ্যে একটা উচ্চতর অংশ তৈরি হয়েছে তাদের পরিবারের মানুষেরা এখন সমাজের প্রভাবশালী অংশের মধ্যে অন্যতম । তারা এখন সমাজের সংরক্ষণের সমগ্র সুবিধা ভোগ করে নিচ্ছেন । তাদের বলা হয় ক্রাম লেয়ার । আবার উচ্চবর্ণের মানুষ হলেও অর্থনৈতিক দিক থেকে খুবই পিছিয়ে পড়া প্রচুর মানুষ আছেন । কিন্তু তারা উচ্চবর্ণের মানুষ এইজন্যই কোনো সুযোগ পান না । তাদের জন্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আয়ের একটা ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া হোক এবং উচ্চবর্ণের হলেও অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদদের সংরক্ষণের সুযোগ দিতে হবে ।
=============================
আমাদের দেশে অনেক ধর্ম যেমন আছে আবার হিন্দু ধর্মের মধ্যে অনেক জাতও আছে । প্রায় সাড়ে ছয় হাজার । সেটি আরও বিভক্ত বর্ণাশ্রম জাতিভেদে, অর্থাৎ জাত ব্যবস্থায় । যতগুলি জাত ততোগুলি টুকরো । যার সংখ্যা এখন সাড়ে ছ হাজারেরও বেশি । যার প্রত্যেকটির সাথে প্রত্যেকটির 'বিরাগ' আছে । আর ড. আম্বেদকর বলেছেন 'ভারতের এই জাত ব্যবস্থা হল এমনই একটি বহুতল বাড়ি যার একটা তল থেকে আর একটা তলে যাবার সিঁড়ি নেই ।' কার্ল মার্কস যাকে বলেছেন 'বিরাগ', ড. আম্বেদকর তাকে আরও পরিষ্কার করেছেন 'graded inequality' বলে । অর্থাৎ বিরাগ বা ঘৃণার প্রকৃতিটা হলো ক্রমিক অসাম্য । এই যে হাজারটা জাত, মান মর্যাদায় তারা কিন্তু সবাই সমান নয় । প্রত্যেকটি জাত অপর একটি জাতের হয় উপরে নয়তো নিচে অবস্থান করছে, উলম্ব অবস্থান (vertical lay-out), অনুভূমিক (horizontal) নয় । এখানে কায়স্থরা মনে করে তারা মাহিষ্যদের থেকে উপরে এবং ব্রাহ্মণদের নিচে, মাহিষ্যরা মনে করে তারা সদগোপের থেকে উপরে কিন্তু কায়স্থদের থেকে নিচে, বাগদীরা মনে করে তারা সদগোপের থেকে নিচে কিন্তু ডোমেদের থেকে উপরে । নমঃশূদ্ররা মনে করে তারা পৌন্ড্রদের থেকে উপরে ।
এইভাবে ভারতবর্ষের হিন্দুদের প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের ঠোকাঠুকি । অন্য কারও থেকে উপরে আছে তাই সে সন্তুষ্ট । উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে জোট বাঁধার কথা ভাবতেই পারে না । একদিকে 'বিরাগ' আর অন্যদিকে সন্তুষ্টি, তাই মার্কসের ভাষায় সৃষ্টি হয়েছে 'স্থিতিসাম্য' (static balance) । এই static balance-এর জন্যই বর্ণ ব্যবস্থা এত দীর্ঘ সময় টিকে রয়েছে । এবং এই ব্যবস্থার সুফলটুকু অর্থাৎ ক্ষীরটুকু ব্রাহ্মণরা হিন্দু ধর্মের বড়ি খাইতে শূদ্রদের সম্মতি সাপেক্ষেই আত্মসাৎ করেছে ।
=============================
তিনি অচ্ছুতদের জন্যে জমি আর আলাদা কলোনি দাবি করেছিলেন । অবশ্য কৃষিবিপ্লব ছাড়া এ-সব করা সম্ভব নয় । তবে ভূমিদাসদের মতো অন্য সব জাতের মুখ চেয়ে বসে থাকার ব্যাপারটা থেকে বাঁচতে হলে সমস্ত অস্পৃশ্যকে জমি দেওয়ার ভাবনাচিন্তা খুবই সঠিক । কিন্তু সব ভূমিহীন মানুষের অভিন্ন সংগ্রামের ভেতর দিয়েই তো এই লক্ষ্যে পৌঁছানো যেত ।
আম্বেদকর হিন্দুসমাজের অন্যায় লোকাচারের, অন্যায় আচরণের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যে তাঁর অনুগামীদের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করতে বললেন । কিন্তু অন্যায় ভূমিগত সম্পর্কের ভিতের ওপরে গড়ে উঠেছে সমাজের যে ভয়ঙ্কর বাস্তব অবস্থাটা, তা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেই তো পালায় না । প্রেম আর সাম্যের সন্ধানে বেরিয়ে, তা যে পাওয়া গেল না, তার তো জলজ্যান্ত প্রমাণ সাম্প্রতিক নির্যাতন নিপীড়নের সব কান্ডকারখানা । পরিস্থিতিটা এমন করুন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, সবচেয়ে দলিত মথিত যে সম্প্রদায়গুলো, সেখান থেকেও উদ্ভূত বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টি সমতার সম্বন্ধে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটুকু, আরও চাকরি-বাকরি, আসন সংরক্ষণ, শিক্ষার সুযোগ সুবিধা - এইসব দাবির সঙ্কীর্ণ বেড়াটা পার হয়ে আদর্শগতভাবে আর বেশি দূরে এগুতে পারছে না । বর্তমান আর্থ-সামাজিক কাঠামোখানাকে একদম ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবার কাজটা ওঁদের চৈতন্যের বৃত্তের মধ্যে ঠাঁই পায়নি । ভূমিগত সম্পর্কগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বলতে অন্য আর সকলের সঙ্গে যুথবদ্ধ হয়ে অভিন্ন যুদ্ধ চালানোটাও যে বোঝায় - এটা কিন্তু ওঁদের নজরে পড়ল না । এইসব সম্প্রদায় থেকে যে সব বুদ্ধিজীবী উঠে এসেছেন, এঁরাও কেউ আগে, কেউ বা পরে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কাঠামোখানাকেই মেনে নিয়েছেন; জমির সঙ্গে, শিল্পের সঙ্গে বর্তমান সম্পত্তিগত সম্পর্কের ব্যাপারটা একটুও না ছুঁয়েই গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো সম্বন্ধে একটা সাধারণ ঘোষণায় তৃপ্ত হয়ে রয়েছেন ।
=============================
ভারতীয় সমাজে জাতপাত প্রথা একটি বিশেষ ধরনের বৈশিষ্ট্য । এটা একমাত্র ভারতেরই বৈশিষ্ট্য । বিশ্বের অন্য কোনো দেশে এরকম নেই । ভারতে জাতিভেদ শ্রেণিভিত্তিক ভাগাভাগির একটা লক্ষণ । কারণ জাতিভেদ বর্ণপ্রথার নামে অথবা জাতের নামে সমাজের শ্রমজীবী অংশকে দাবিয়ে রাখার জন্যই তৈরি হয়েছে । জাতিভেদ প্রথা শ্রেণি শোষণেরই একটা হাতিয়ার । উদ্বৃত্ত অংশ যত বেশি সম্ভব আত্মসাৎ করার লক্ষ্যেই জাতপাত প্রথার সৃষ্টি । উৎপাদন সম্পর্কের সাথে জাতপাত প্রথা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ।
জাতপাত প্রথার সৃষ্টি হয়েছে প্রায় তিন হাজার বছর আগে । ক্রমান্বয়ে এর পরিমাণগত পরিবর্তন হয়েছে । কিন্তু শোষণের গুণগত উপাদান প্রায় একই রয়ে গেছে । জাতিভেদ প্রথার কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ আছে এবং কিছু নির্দিষ্ট সীমাও আছে । কিন্তু জাত আর শ্রেণি শোষণ ও জাতপাতভিত্তিক শোষণ মিলে গেলে শোষণের তীব্রতা ও পরিমাণ অনেকগুণ বেড়ে যায় । যে দেশে জাত ব্যবস্থা নেই সেই দেশগুলিতে শ্রমিক বা কৃষক বা উভয়ই অর্থাৎ সব ধরনের শোষিতরা দলবদ্ধভাবে বা সুযোগ পেলে ব্যক্তিগতভাবে মালিকের সঙ্গে দর কষাকষি করতে পারে । ইচ্ছে করলে একটা বৃত্তি বা পেশা থেকে অন্য পেশায় চলে যেতে পারে । কিন্তু জাতের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব না । কারণ পেশা হচ্ছে জাতভিত্তিক । ইচ্ছে থাকলেও কোনো পেশার বাইরে অন্য কোনো কাজ করতে পারবে না । পেশাও ঠিক হবে জন্মসূত্রে । কাজেই তার জোট বাঁধারও কোনো সুযোগ নেই । নীচু জাত হবার সুবাদে সমাজে উচ্চশ্রেণির লোকেরা তাকে দাবিয়ে রাখে । তাকে সবসময় একটা ভয় বা আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয় । শারীরিকভাবেও নিগৃহীত হতে পারে অথবা তাকে সামাজিক দিক থেকেও বয়কট করা হতে পারে বা সমাজ থেকে বের করে দেওয়া হতে পারে । সমাজ থেকে বের করে দেওয়া বা সামাজিক বয়কট তার মৃত্যুর সমান ।
এই ভারতে সামাজিক বিভাজন ঠিক কবে থেকে শুরু তা নিয়ে কিছু সমস্যা আছে । ভারতে প্রাচীনতম সভ্যতা হরপ্পা সভ্যতা (খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছর) ছিল প্রথম নগর সভ্যতা । শ্রেণি বিভাগ বা শ্রেণি শোষণ ছাড়া নগর সভ্যতা গড়ে উঠতে পারে না । কাজেই শ্রেণি শোষণ ছিল এটা নিশ্চিত । কিন্তু যতদিন পর্যন্ত হরপ্পা লিপি পড়া না যাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত জানা যাবে না যে তখন জাত ভাগ ছিল কিনা । বৈদিক সাহিত্য অনুযায়ী প্রায় খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার সাল নাগাদ প্রথম দেখা যায় বর্ণভেদ ভারতে শুরু হয়েছিল । ঋকবেদের দশম মন্ডলে বর্ণভেদের কথা আছে ।
কিন্তু বিদ্বজ্জনেরা মনে করেন বর্ণ বিভাজন প্রথমে দেখা যায় যজুর্বেদে । পরে তা ঋকবেদে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে । অনুমান করা হয় এক হাজার থেকে আটশত খ্রিস্টপূর্বের মধ্যে বর্ণ বিভাজন হয়ে যায় । সেই সময় সম্পত্তির মালিকানা তৈরি হয়েছিল । ফলে শ্রেণি বিভাজন হয় । ...
... জাত বিভাজন শুধু মাত্র শ্রম বিভাজন নয় । এটা শ্রমিকদের মধ্যেও বিভাজন । যে কোন সমাজে শ্রম বিভাজন দরকার হয় । কিন্তু ভারতে শ্রম বিভাজনটা একটা কৃত্রিম শৃঙ্খলে আবদ্ধ আছে । এখানে শ্রমিকদের মধ্যে এই বিভাজনটা স্তর বিন্যাস করে করা হয়েছে । পৃথিবীর কোন দেশেই শ্রম বিভাজনকে শ্রমিকদের স্তর বিন্যাসের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়নি ।শ্রম বিভাজন স্বতঃস্ফূর্তভাবেও হয়নি । স্বাভাবিক আগ্রহ থেকেও নয় । নিজের পেশা নিজে বেছে নিতে পারলে যে দক্ষতা অর্জন করা যায় বা নিজের জীবনের আর্থিক উন্নতি করা যায়, তা উপর থেকে চাপিয়ে দিলে হয় না ।
=============================
জাতপাত ব্যবস্থা ছিল প্রাথমিক উৎপাদকদের উদ্বৃত্ত থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে সামাজিক চেতনা তৈরি করার লক্ষ্যে একটা ধর্মীয় প্রক্রিয়া ।
=============================
আম্বেদকর একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, যার উত্তর এখনও কোনো জাতীয়তাবাদী দিতে পারেননি । প্রশ্নটার ধরণ ছিল এইরকম - দু'টো পৃথক জাতের যৌন মিলনে জন্ম দেওয়া সন্তানের রক্তের বিশুদ্ধতা নষ্ট হতে পারে এমন যুক্তি না হয় বোঝা গেল । কিন্তু এক পংক্তিতে বসে খেলেও কী রক্তের বিশুদ্ধতা নষ্ট হয়ে যায় ?
=============================
পৃথিবীর কয়েকটা দেশে বর্ণবৈষম্যবাদ এখনও নির্মূল হয়নি । এটা ছিল গায়ের রঙের বর্ণবৈষম্যবাদ । গণতান্ত্রিক পরিবেশের ক্রমশ বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তা দুর্বল হচ্ছে । ভারতে জাতপাতের বিভেদ কেবলমাত্র দু'টো সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে নয় । ভারতের একশো কোটির মানুষের মধ্যে ৮২ কোটি মানুষ হিন্দু । এই হিন্দুদের মধ্যে কত রকমের ভাগ । শুধু ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র নয়, প্রতিটা ভাগে কত উপবিভাগ । প্রতিটা বিভাগ-উপবিভাগের সঙ্গে অন্য বিভাগ-উপবিভাগের ঘৃণা, বিদ্বেষ, রক্ত, খুন মাখানো সম্পর্ক । এর শীর্ষে বসে ডান্ডা ঘোরাচ্ছে সবচেয়ে উঁচুজাতি বলে দাবি করা ব্রাহ্মণরা । প্রায় তিন হাজার বছর ধরে সেই বৈদিক যুগ থেকে মানুষের অভ্যাসের সঙ্গে জীবনচর্চার মধ্যে এই ঘৃণা বিদ্বেষ জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে । দুনিয়ার মধ্যে ভারত একটা নিকৃষ্ট ব্যতিক্রম । এমন দেশটা কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি ।
=============================
খ্রিস্ট্রপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্মের এই অগ্রগতি ও জনগণের দলে দলে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের প্রতিক্রিয়া হিসাবে ব্রাহ্মণ্যবাদে এক পুনরুত্থানবাদী ধারা শুরু হল । গৌতম বুদ্ধ সামাজিক ক্ষেত্রে বর্ণভেদের বিরোধিতা করেননি । বৌদ্ধ ধর্মের বাইরে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যে জাতিভেদের উপাদান রয়েই গেল । কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের উত্থানের ফলে ব্রাহ্মণ পুনরুত্থানবাদীরা আরও আষ্টে-পৃষ্ঠে জাতপাতকে সামাজিক আইনে বেঁধে ফেলল । রাজশক্তি নিজস্বার্থে তাতে মদত দিল । ব্রাহ্মণ পুনরুত্থানবাদ জীবনের সবক্ষেত্রে, ধর্মীয়, বুদ্ধিবৃত্তিগত, গার্হস্থ এবং সামাজিক ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই কঠোর আচরণবিধি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ব্রাহ্মণ্য সাম্রাজ্যের দুর্গ তৈরি করল । স্মৃতি বা ধর্মশাস্ত্রগুলি, মহাভারত ও রামায়ণ মহাকাব্য এবং অন্যান্য ধর্মীয় সাহিত্যে এই পুনরুত্থানবাদী ধারার প্রবাহ চলল । কয়েক শত বৎসর ধরে বহু চারণ কবি রামকে প্রতীক হিসাবে তুলে ধরলেন । এদের বলা হতো লব কুশ । এই ধারা বেয়েই রামায়ণ তৈরি হল । রামের চরিত্র সৃষ্টি ব্রাহ্মণ্যবাদকে সুসংহত করার লক্ষ্যে পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনের ফলশ্রূতি ।
=============================
ঋকবেদীয় পর্বে শ্রম বিভাজন অনেক এগিয়েছিল । অর্থব বেড পর্বের শেষদিকে অবশ্য কর্মবিভাজন (সামাজিক স্তর বিভাজন) হতে থাকে এবং জনগোষ্ঠী ও পরিবার গোষ্ঠী ক্রমে সামাজিক শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে যায় । শর্মার (আর এস শর্মা) মতে শূদ্র জনগোষ্ঠী বা আর্যদের যে অংশ দাসসুলভ কাজ করতেন, তাদের স্থান নির্ধারণ হল চতুর্থ বর্গে । পুরোহিতদের প্রভাবেই বর্ণ ব্যবস্থায় মতাদর্শের প্রভাব ঘটেছিল ।
=============================
বুদ্ধদেবের মতাদর্শে একটা অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব ছিল । তিনি হিন্দু সমাজের চতুর্বর্ণ সমাজের বিরোধিতা করেননি বরং তাকে স্বীকারই করেছিলেন । আবার তিনিই সমাজের বর্ণভেদ ভিত্তিক সামাজিক অসাম্যকে স্বীকার করেননি । তাঁর মত অনুযায়ী, মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব বা মূল্য নির্ধারিত হয় কোন জাতে সে জন্মগ্রহণ করেছে তার ফলে নয়, নির্ধারিত হয় তার আত্মিক ও নৈতিক গুণাবলী দিয়ে ।
=============================
কুরুক্ষেত্রে অর্জুন আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে না চাইলে কৃষ্ণ তাকে উজ্জীবিত করার জন্য নাকি কিছু উপদেশ দেন, এই উপদেশগুলোই হল গীতা । যদিও অনেক শাস্ত্রকার ও ঐতিহাসিক সমাজতত্ত্ববিদ মনে করেন গীতা মূল মহাভারতে ছিল না । খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে ভগবদগীতা পর্যায়ক্রমে রচিত । তারপরে মহাভারতে সংযুক্ত হয়েছিল । গীতার একটা বিখ্যাত উক্তি " স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় -পরধর্ম ভয়াবহ" এই স্বধর্ম কী ? তখন কি কোনো গ্রন্থে হিন্দু ধর্ম নাম কোন ধর্মের কথা বলা হয়েছে ? এখানে জাতপাতকেই ধর্ম বলা হয়েছে ।
=============================
ব্রাহ্মণ্য ধর্মের চরম গোঁড়ামি, জাত-পাত, অস্পৃশ্যতার নিদারুন অত্যাচার ও অবিচারের বিকল্প হিসাবে গৌতম বুদ্ধ সংঘগুলিতে সাম্যের আবহাওয়া সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন । তাই ভারতীয় জনগণের একটা বিশাল অংশ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিল । ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রেও তা একইভাবে প্রযোজ্য । ভারতে ইসলাম এক হাতে কোরান অপর হাতে তরবারি নিয়ে আসেনি । অল্প কিছু ক্ষেত্রে রাজশক্তি বা জোর করে ধর্মান্তর হলেও ইসলামের প্রভাব এখানে বেড়েছে দুটো প্রধান কারণে । সুফি ভক্তিবাদের ফলে এবং হিন্দু সমাজে জাতপাত ভেদের জন্য । নিম্নবর্ণের এবং দলিত জনগণের একাংশ উচ্চবর্ণের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে । স্বামী বিবেকানন্দ একে চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন । ভারতে দলিত মানুষ ইসলামের মধ্যে সাম্যের উপাদান দেখতে পেয়েছিল । বিবেকানন্দের মতে এই জন্য ভারতে (বিবেকানন্দের সময় অবিভক্ত ভারত - লেখক) এক পঞ্চাংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ।
=============================
হিন্দুধর্মের এবং সাধারণভাবে সমস্ত ধর্মেরই সামাজিক তথা অর্থনৈতিক ভূমিকাকে শ্রমিকশ্রেণির সামনে সঠিকভাবে তুলে না ধরলে আদর্শগত সংগ্রাম সফল হতে পারবে না । কৃষিবিপ্লব ঘটানোর জন্যে সংগ্রাম, একচেটিয়া পুঁজির দাপটচাপট আর সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অবসান ঘটানোর জন্যে সংগ্রাম সমাজতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাবে -- এমন ধরণের জনগণতন্ত্ররাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রাম--এ-সবই তো হচ্ছে আমাদের একালের প্রধান সংগ্রাম । এইসব সংগ্রাম থেকে সমাজের জাতপাতের ভেদাভেদ প্রথাটাকে দূর করে দেওয়ার প্রশ্নটাকে আলাদা করে দেখে ওটাকে খালি হিন্দু সমাজের সংস্কারের প্রশ্ন বলে মনে করা আর চলে না ।
=============================
সংরক্ষণের প্রশ্ন
ভারতের সংবিধানে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণ চালু আছে । জনসংখ্যার অনুপাত অনুযায়ী সংরক্ষণ-এর হার নির্ধারিত হবে কিন্তু কোনো সময়ই তা ৫০ শতাংশ অতিক্রম করতে পারবে না । শুধুমাত্র সরকারী চাকুরির ক্ষেত্রে সরকারি বা সরকার পোষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষেত্রে এই সংরক্ষণ প্রযোজ্য হয় । কিন্তু বেসরকারি ক্ষেত্রে সংরক্ষণ চালু করার প্রস্তাব থাকলেও তা এখনও আলোচনার স্তরে আছে । আর এস এস এবং বিজেপি-র বিভিন্ন মহল থেকে সংরক্ষণ প্রথার বিরোধিতা করা হচ্ছে এবং তা তুলে দেওয়ার জন্য সওয়াল করা হচ্ছে ।
ভারতের মত জাতপাত বিভক্ত সমাজে সংরক্ষণ থাকাটা খুবই প্রয়োজনীয় । কারণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উচ্চবর্ণের মানুষেরা সমাজ শাসন করেছেন, ধর্মের নামে বিভিন্ন বিধি বিধান দিয়েছেন তার অনিবার্য পরিণতিতে নিম্নবর্ণের মানুষদের শিক্ষা এবং সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল এবং তাদের উপরে অনেক বিধিনিষেধ জারি করা ছিল, এখনও কিছু কিছু আছে । উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ডঃ আম্বেদকরকে স্কুলে সহপাঠীদের সাথে একসাথে বসতে দেওয়া হতো না, বাইরে চাটাই পেতে বসতে হতো । পানীয় জলের পাত্রের কাছে যেতে পারতেন না । এমনকি অধ্যাপনার চাকরি পাওয়ার পরেও অধ্যাপকদের জলপানের অধিকার ছিল না । শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তারা উচ্চবর্ণের তুলনায় ক্রমশ পিছিয়ে গেছে । উচ্চবর্ণরা সংখ্যায় কম হয়েও যুগের পর যুগ ধরে সিংহভাগ চাকরিবাকরি, শিক্ষার সুযোগ -সমস্ত কিছুই দখলে রাখতেন ।
ব্রিটিশ আমলে সংরক্ষণের নীতি প্রথম চালু হয়েছিল । মূলস্রোতে আনবার জন্য সংরক্ষণই ছিল দরিদ্র নিম্নবর্ণের মানুষের কাছে একমাত্র অবলম্বন । যারা ইসলাম ধর্ম বা বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা কিন্তু এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল । এদের সংরক্ষণের আওতায় আনবার জন্য ২০১০ সালে রঘুনাথ মিত্র কমিশন রায় দিয়েছিলেন যে আর্থিক দিক থেকে ধর্ম নির্বিশেষে পিছিয়ে পড়া মানুষকে সংরক্ষণের আওতায় আনা যেতে পারে । পশ্চিমবাংলার বামফ্রন্ট সরকারি এটি প্রথম কার্যকরী করে এবং শতকরা ১৭ ভাগ সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষণের সুযোগ পায় ।
সংরক্ষণের সুযোগ নেওয়ার জন্য গ্রূপ ডি চাকরি ছাড়া অন্য পদে ন্যূনতম মাধ্যমিক পাশ করা দরকার । কিন্তু সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী তফশিলভুক্ত জাতির শতকরা ৭১.৩ ভাগ স্কুল ফাইনাল পাশ করার সুযোগ পায় (ভুল সংশোধন - তফশিলভুক্ত জাতির শতকরা ৭১.৩ ভাগ স্কুল ছুট) । ফলে সরকারের খুবই নিম্নস্তরের কাজে প্রতি ৪ জন দরিদ্রের মধ্যে ১ জন মাত্র সংরক্ষণের সুযোগ নিতে পারে । ২০০১-এর আদমসুমারি অনুযায়ী দলিতদের মধ্যে মাত্র ২.২৪% স্নাতক । এখন নয়া উদার অর্থনীতির যুগে সব কিছুর সঙ্গে শিক্ষাও বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে । ফলে সরকারি চাকরির সংখ্যা কমে যাচ্ছে । ১২০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ১ কোটি ৮০ লক্ষ মাত্র সরকারি চাকরি ।
তফশিল জাতি ও উপজাতির জন্য জাতীয় কমিশনের রিপোর্টে দেখা যায় যে কেন্দ্রীয় সরকারের এ গ্রেড অফিসারের ন্যূনতম ১৫ শতাংশ এই অংশের মানুষের হওয়া উচিত সেখানে ৮.৪ শতাংশ মাত্র চাকরি করেন । দিল্লি হাইকোর্টের ২০ জন বিচারকের মধ্যে একজনও দলিত নেই । তামিলনাড়ু সামাজিক ন্যায়ের জন্য বিখ্যাত কিন্তু সেখানেও হাইকোর্টের বিচারকের ৩৮ জনের মধ্যে মাত্র ৪ জন, কেরালায় ২৫ জনের মধ্যে ১ জন তফশিল জাতিভুক্ত ।
২০১১ আদমসুমারি অনুযায়ী ১২০ কোটির মধ্যে তফশিল জাতি ও উপজাতির সংখ্যা ৩০ কোটি । সংরক্ষণের মাধ্যমে আদিবাসিরা চাকরি পে ঝাড়ুদার বা জমাদার ইত্যাদি পদে ।
সংরক্ষণ নিয়ে দুটি প্রশ্ন যথাযথ উঠে এসেছে । তফশিল জাতিভুক্ত অনেক মানুষ আছেন যারা সংরক্ষণের সুবিধা পেয়ে অর্থনৈতিক মর্যাদা পেয়েছেন । যারা ব্যক্তিগতভাবে তফসিলী উপজাতিভুক্ত হওয়ার জন্য অর্থনৈতিক বা শিক্ষাক্ষেত্রে ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অনেক অগ্রসর হয়ে এসেছেন যেমন কলেজের অধ্যক্ষ বা অধ্যক্ষা, চিকিৎসক, সরকারি অফিসার নিম্ন আদালতের বিচারক ইত্যাদি । এইভাবে তফশিলভুক্ত উপজাতির মধ্যে একটা উচ্চতর অংশ তৈরি হয়েছে তাদের পরিবারের মানুষেরা এখন সমাজের প্রভাবশালী অংশের মধ্যে অন্যতম । তারা এখন সমাজের সংরক্ষণের সমগ্র সুবিধা ভোগ করে নিচ্ছেন । তাদের বলা হয় ক্রাম লেয়ার । আবার উচ্চবর্ণের মানুষ হলেও অর্থনৈতিক দিক থেকে খুবই পিছিয়ে পড়া প্রচুর মানুষ আছেন । কিন্তু তারা উচ্চবর্ণের মানুষ এইজন্যই কোনো সুযোগ পান না । তাদের জন্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আয়ের একটা ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া হোক এবং উচ্চবর্ণের হলেও অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদদের সংরক্ষণের সুযোগ দিতে হবে ।
=============================
ভারতে এত জাতি ধর্ম আছে যে তা পরিচিতি সত্তার উর্বর ভূমি ।
বিভিন্ন দলিত গোষ্ঠী, ওবিসি আন্দোলন, সংরক্ষণের জন্য, সম্পদের ভাগ নেবার দাবিতে এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং অন্য নানা কারণে পরস্পর বিরোধী রাজনীতিতে প্রশ্রয় দেয় । কিন্তু এই গোষ্ঠীগুলি মৌলিক সামাজিক কাঠামো এবং শ্রেণি শোষণ বদলানোর দাবিতে আন্দোলন সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যায় না । অন্যান্য নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলাতে তাদের আগ্রহ নেই ।...
...এ ধরনের পরিচিতি সত্তা নির্ভর রাজনীতি শুধুমাত্র দলিত বা পশ্চাৎপদশ্রেণির সংগঠনগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই । নির্বাচনী শক্তি ও সমর্থন ভিত্তি বাড়াতে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলিও পরিচিতি সত্তা-নির্ভর রাজনীতিকে ব্যবহার করে থাকে । উত্তরপ্রদেশে যেমন বিজেপি, এসপি এবং কংগ্রেসের মতো সব দলই জাতপাত ও সাবকাস্ট ভিত্তিক দলীয় সম্মেলনের আয়োজন করে থাকে । পরিচিতি সত্তা-নির্ভর রাজনীতিকে তারা ব্যবহার করে এবং জাতপাতভিত্তিক বিভাজন প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করে ।
ভারতে এত জাতি ধর্ম আছে যে তা পরিচিতি সত্তার উর্বর ভূমি ।
বিভিন্ন দলিত গোষ্ঠী, ওবিসি আন্দোলন, সংরক্ষণের জন্য, সম্পদের ভাগ নেবার দাবিতে এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং অন্য নানা কারণে পরস্পর বিরোধী রাজনীতিতে প্রশ্রয় দেয় । কিন্তু এই গোষ্ঠীগুলি মৌলিক সামাজিক কাঠামো এবং শ্রেণি শোষণ বদলানোর দাবিতে আন্দোলন সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যায় না । অন্যান্য নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলাতে তাদের আগ্রহ নেই ।...
...এ ধরনের পরিচিতি সত্তা নির্ভর রাজনীতি শুধুমাত্র দলিত বা পশ্চাৎপদশ্রেণির সংগঠনগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই । নির্বাচনী শক্তি ও সমর্থন ভিত্তি বাড়াতে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলিও পরিচিতি সত্তা-নির্ভর রাজনীতিকে ব্যবহার করে থাকে । উত্তরপ্রদেশে যেমন বিজেপি, এসপি এবং কংগ্রেসের মতো সব দলই জাতপাত ও সাবকাস্ট ভিত্তিক দলীয় সম্মেলনের আয়োজন করে থাকে । পরিচিতি সত্তা-নির্ভর রাজনীতিকে তারা ব্যবহার করে এবং জাতপাতভিত্তিক বিভাজন প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করে ।
=============================
ভারতীয় সমাজে শ্রেণি শোষণ এবং সামাজিক নিপীড়ন দুটোই আছে । আমাদের দেশের আর্থ সামাজিক কাঠামোয় জাতপাতভিত্তিক, জাতিগোষ্ঠীগত ও লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক নিপীড়ন একই সঙ্গে পুঁজিবাদী ও আধা সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণি শোষণের সঙ্গেই বিদ্যমান । শাসকশ্রেণিগুলি উদবৃত্ত শ্রম শোষণ করে শ্রেণি শোষণের মাধ্যমে এবং তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে তারা বিভিন্ন ধরণের সামাজিক নিপীড়নকে কাজে লাগায় । সে জন্যই শ্রেণি সংগ্রাম চালিয়ে নিয়ে যাবার গুরুত্বের উপরও জোর দেবার পাশাপাশি সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামও চালাতে হবে । বিশ্বজোড়া লগ্নিপুঁজির দাপট বাড়ার এবং সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন মাথাচাড়া দেবার পরই শাসকশ্রেণিগুলি পরিচিতি সত্তা-নির্ভর রাজনীতি ও আন্দোলনকে বড় আকারে মদত দিচ্ছে । এ ধরনের আন্দোলন নিপীড়িত শ্রেণীগুলির মধ্যে পেটি বুর্জোয়াদের একটা অংশকে ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসার সুযোগ করে দেয় ।
ভারতীয় সমাজে শ্রেণি শোষণ এবং সামাজিক নিপীড়ন দুটোই আছে । আমাদের দেশের আর্থ সামাজিক কাঠামোয় জাতপাতভিত্তিক, জাতিগোষ্ঠীগত ও লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক নিপীড়ন একই সঙ্গে পুঁজিবাদী ও আধা সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণি শোষণের সঙ্গেই বিদ্যমান । শাসকশ্রেণিগুলি উদবৃত্ত শ্রম শোষণ করে শ্রেণি শোষণের মাধ্যমে এবং তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে তারা বিভিন্ন ধরণের সামাজিক নিপীড়নকে কাজে লাগায় । সে জন্যই শ্রেণি সংগ্রাম চালিয়ে নিয়ে যাবার গুরুত্বের উপরও জোর দেবার পাশাপাশি সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামও চালাতে হবে । বিশ্বজোড়া লগ্নিপুঁজির দাপট বাড়ার এবং সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন মাথাচাড়া দেবার পরই শাসকশ্রেণিগুলি পরিচিতি সত্তা-নির্ভর রাজনীতি ও আন্দোলনকে বড় আকারে মদত দিচ্ছে । এ ধরনের আন্দোলন নিপীড়িত শ্রেণীগুলির মধ্যে পেটি বুর্জোয়াদের একটা অংশকে ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসার সুযোগ করে দেয় ।
No comments:
Post a Comment