সাম্যবাদের লক্ষ্য হল মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য সমাজের এবং অবশেষে একটি একীভূত অখণ্ড সত্তা হিসেবে সমগ্র বিশ্ব-সমাজের উৎপাদিকা শক্তিগুলিকে সংগঠিত করা, বিদ্যমান প্রাকৃতিক সম্পদ, বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা ও কার্যক্ষম প্রতিটি মানুষের সহযোগমূলক শ্রমকে যথাসম্ভব ভালভাবে ব্যবহার করা এবং এর সাহায্যে ত্রুটিপূর্ণ উপায়ে প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগানোর বর্তমান নির্ভরতা থেকে মানবসমাজেকে মুক্ত করা, সেইসঙ্গে বর্তমানের নানান বৈরিতা ও শ্রেণীবিভাজন থেকেও মানবসমাজের মুক্তি ঘটানো । এই পথেই বাস্তবায়িত হবে ভবিষ্যতের স্বাধীন সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা ।
==============================================
সমাজ-গঠনের উচ্চতর পর্যায় হিসেবে সাম্যবাদের সুবিধাগুলি একান্তই স্পষ্ট ।
প্রথমত, বিদ্যমান উৎপাদিকা-শক্তিগুলি, যেগুলি আজ ক্রমবর্ধিত মাত্রায় অব্যবহৃত, অপব্যবহৃত অথবা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে চলেছে, সেগুলিকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হবে ।
দ্বিতীয়ত, বাজারের বেপরোয়া অধিপত্যের নৈরাজ্য, প্রাকৃতিক ও সামাজিক সম্পদের সীমাহীন অপচয় এবং ক্রমবর্ধিত বিধ্বংসী সংকটের বদলে সুসমঞ্জসভাবে পরিকল্পিত উৎপাদন ও উন্নয়ন ।
তৃতীয়ত, ক্রমবর্ধিত চাহিদা পূরণের জন্য উৎপাদনের অবাধ ও সুসমঞ্জস বিস্তার ঘটানো সম্ভব হবে - সেক্ষেত্রে সমাজের শ্রেণীকাঠামো ও পণ উৎপাদনের অবস্থা নিজের মর্জিমাফিক কোনও বাজার-সীমা চাপিয়ে দিয়ে তাকে ব্যাহত করতে পারবে না । উৎপাদনের বিস্তার এবং কলাকৌশলের উন্নতি বিদ্যমান যাবতীয় চাহিদাকে পূরণ করতে সক্ষম হলে তার ফলস্বরূপ আর দারিদ্র্য, সংকট ও সার্বিক বেকারিত্ব দেখা দেবে না, বরং সৃষ্টি হবে বাড়তি চাহিদা পূরণ করার এবং শ্রমের ভার লাঘব করার সম্ভাবনা ।
চতুর্থত, উৎপাদনের বিশ্বব্যাপী সংগঠন - যা একমাত্র সাম্যবাদী ভিত্তিতেই গড়ে উঠতে পারে - অন্য দেশ দখল করা, কাঁচামাল ও শোষণের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে নিজেদের কব্জায় আনার জন্য সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক সংঘাতের অবসান ঘটাবে এবং তার ফলস্বরূপ অবসান ঘটবে অস্ত্রশস্ত্রের বিপুল অপচয় ও বিধ্বংসী যুদ্ধের, যা এই মুহূর্তে গ্রাস করতে চলেছে সমগ্র মানবসমাজকে ।
পঞ্চমত, উন্নত ও পশ্চাদ্পদ জাতি ও দেশগুলির মধ্যেকার, শাসক ও শোষিত দেশগুলির মধ্যেকার পার্থক্য অন্তর্হিত হবে এবং অবসান ঘটবে বর্তমানের ভারসাম্যহীন বিশ্ব-বিকাশের, যেখানে পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চল উন্নত উৎপাদন চালু করার মতো যাবতীয় সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আদিম কলাকৌশল আর শস্তা শ্রমের ঔপনিবেশিক এলাকা হিসেবে পিছিয়ে পড়ে আছে । এইসব এলাকা এবং সেখানকার বাসিন্দাদের দ্রূত উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে সর্বাধিক উন্নত দেশগুলির সমান মাত্রায় উন্নীত করার কাজে ব্যবহার করা হবে বিশ্বের সম্পদকে । সমস্ত দেশের স্বাধীনতা ও সমতার মধ্যে দিয়েই উন্মুক্ত হবে ভবিষ্যতের ঐক্যবদ্ধ মানবজাতি গঠনের পথ ।
ষষ্ঠত, শ্রেণীসমূহের অবলুপ্তির ফলে অবসান ঘটবে বর্তমান সমাজকাঠামোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত পরজীবীবৃত্তি ও অপচয়ের - অবসান ঘটবে ওপরতলার অলসতা আর লুণ্ঠনমূলক কার্যকলাপের, নীচের তোলার মানুষদের বিপথগামী শ্রম, অত্যাধিক মেহনত আর উন্নয়নহীনতার, এবং অর্থহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বিপণন-ব্যবস্থা ও অনুৎপাদিকা কার্যকলাপে সমাজের শ্রমশক্তির ক্রমবর্ধমান অপচয়ের । শ্রেণীর অবলুপ্তি ঘটলে এই সবকিছুরই অবসান ঘটবে ।
সপ্তমত, শ্রেণীগুলির অবলুপ্তি ঘটলে শ্রেণী-সংঘাতের সর্বনাশা বোঝার হাত থেকে মুক্তি পাবে সমাজ, আর তার ফলস্বরূপ অবসান ঘটবে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার এবং সার্বজনীন গঠনমূলক কর্তব্যের বদলে শ্রমশক্তির ভিন্নপথে চালিত হওয়ার (যা বর্তমানে অপরিহার্য ও প্রয়োজনীয়, সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে উৎপাদনের উপকরণসমূহের সামাজিক মালিকানা অর্জিত না-হওয়া পর্যন্ত যা টিকে থাকবে)।
অষ্টমত, বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেক হল নারীরা, যারা এখনও পরাধীন ও অনুন্নতই রয়ে গেছে । তাদের প্রকৃত মুক্তি একমাত্র তখনই সম্ভব, যখন সামাজিক উৎপাদনে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে নারীরা, যখন মাতৃত্বের দায়িত্ব সামাজিকভাবে বহন করা হবে এবং যখন অর্থনৈতিকভাবে নারীরা আর পুরুষদের ওপর নির্ভরশীল থাকবে না ।
নবমত, সংস্কৃতি আর একটিমাত্র শ্রেণীর একচেটিয়া সম্পত্তি হয়ে থাকবে না, তা পরিণত হবে সকলের সাধারণ ঐতিহ্যে । শ্রেণীগত পার্থক্যের যাবতীয় অবশেষ নিশ্চিহ্ন হওয়ার পর এবং নতুন ও পূর্ণবিকশিত সাম্যবাদী মানবতার বিবর্তন সম্পূর্ণ হওয়ার পর, মানসিক শ্রম ও কায়িক শ্রমের মধ্যেকার বৈরিতা, শহর ও গ্রামের মধ্যেকার বৈরিতা এবং বিদ্যমান শ্রমবিভাজনের উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ সম্পূর্ণভাবে অবলুপ্ত হবে ।
দশমত, শ্রেণীগত পার্থক্য সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পরবর্তী সাম্যবাদী সমাজে একটি অধীনস্থ শ্রেণীকে দমন করার এবং সামাজিক দ্বন্দ্বকে বলপ্রয়োগের সাহায্যের স্তব্ধ করার যন্ত্র হিসেবে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অবসান ঘটবে । তখন সামনে এসে দাঁড়াবে সামাজিক উৎপাদনের যৌথ পরিচালনার সার্বজনীন দায়িত্ব, যে-কাজে সকলেই অবাধে ও সচেতনভাবে অংশগ্রহণ করবে । মানবিক সম্পর্কের সমগ্র ব্যবস্থা থেকে অন্তর্হিত হবে সব ধরণের দমনপীড়ন । পরিপূর্ণভাবে বিকশিত সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার নীতি হল, 'প্রত্যেকে দেবে তার সামর্থ্য অনুযায়ী, পাবে তার প্রয়োজন অনুযায়ী ।'
সাম্যবাদের এইসব ধারণা নিছকই 'আকাশকুসুম', 'কাল্পনিক' ও 'ভাববাদী' হিসেবে প্রতিভাত হবে আজকের দিনের বাণিজ্যিক বা প্রশাসনিকভাবে প্রশিক্ষিত 'বাস্তববাদী মানুষ' বা 'সম্মানিত নাগরিক'-দের কাছে, যারা 'জানে' যে এই ধরনের কোনও সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার সামর্থ্য মানবচরিত্রের নেই, লোভ, অলসতা, দ্বন্দ্বপ্রিয়তা আর ব্যক্তিগত ক্ষমতালিপ্সাই মানবচরিত্রের সহজাত বৈশিষ্ট্য, মানবসমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে কাজ করতে ও নিজেদের ভাগ্যকে মেনে নিতে বাধ্য করানোর জন্য দমনপীড়ন ও বাহ্যিক শৃঙ্খলার চাবুক আর অনাহারের ভীতির মধ্যে রেখে দেওয়া একান্তই অপরিহার্য ।
তবে এইসব অদূরদর্শী ও সংকীর্ণমনা 'বাস্তববাদী মানুষরা', যারা একটি বিশেষ ঐতিহাসিক পর্যায়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে মানবজাতির তথাকথিত চিরন্তন ও বিশ্বজনীন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খুঁজে বেড়ায়, তারা যেমনটা ভাবে কমিউনিস্টরা তেমন বাস্তবতাবর্জিত নয় । কমিউনিস্টরা খুব ভালভাবেই জানে যে তথাকথিত অপরিবর্তনীয় - বাস্তবে নিরন্তন পরিবর্তনশীল - মানবচরিত্র হচ্ছে প্রতিটি ঐতিহাসিক পর্যায়ে সেই পর্যায়ের সামাজিক অবস্থারই ফসল । তারা এ-ও জানে যে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা অবশ্যম্ভাবীরূপে অত্যন্ত কুৎসিত ও সমাজবিরোধী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্ম দেয় এবং যারা এক নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে তাদের মধ্যে প্রথমদিকে পুরনো পুঁজিবাদী দুনিয়ার বেশ কিছু অভ্যাস ও দৃষ্টিভঙ্গি রয়ে যেতে বাধ্য, নতুন সমাজব্যবস্থা গঠনের চলমান প্রক্রিয়াই তার নির্মাণকারীদের চরিত্র ও সাংস্কৃতিক মানের উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম ।
এই কারণেই প্রকৃত সাম্যবাদী সমাজে উত্তরণ রাতারাতি বা এক বছরের মধ্যে ঘটে যেতে পারে না (এবং কল্পিত যাবতীয় সমস্যাগুলি এই ধরনের উদ্ভট অনুমান থেকেই জন্ম নেয়), বরং সেই উত্তরণ হচ্ছে বিকাশের এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ারই চূড়ান্ত ফল । সাম্যবাদী সমাজমুখী এই বিকাশ একটি নিম্নতর স্তর অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের পথ বেয়ে অগ্রসর হয়ে উন্নীত হবে উচ্চতর স্তরে অর্থাৎ সাম্যবাদে ।
==============================================
বিজ্ঞানী, বিশেষ বৃত্তিজীবী ব্যক্তি, স্থপতি ও প্রশিক্ষিত প্রশাসকদের মতো প্রকরণগত বুদ্ধিজীবীরা, সেইসঙ্গে চিকিৎসক, শিক্ষক ও অন্যান্যরা শ্রমিকশ্রেণী কর্তৃক ক্ষমতাদখল এবং তার পরবর্তী সমাজতন্ত্র নির্মাণের কাজে এক অমূল্য সহযোগীর ভূমিকা পালন করতে পারেন । কিন্তু তাঁরা কোনও স্বাধীন ভূমিকা পালন করতে পারেন না (যেমনটা অনেক সময় বলা হয়ে থাকে) । উৎপাদনেরউপায়সমূহের স্বাধীন মালিকানা অর্জন করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয় । তাঁদের সামনে দু'টিমাত্র পথ আছে : হয় পুঁজিপতি শ্রেণীর সেবা করা, নয়তো শ্রমিকশ্রেণীর সেবা করা । এঁদের মধ্যেকার সবথেকে প্রগতিশীল ব্যক্তিরা ক্রমশই এ-সত্য উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন এবং শ্রমিকশ্রেণীর পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন ।
==============================================
শ্রমিকশ্রেণীর সচেতন অংশ অর্থাৎ অগ্রগামী কমিউনিস্টরা এই প্রক্রিয়ার বিকাশে সহায়তা করতে ও তাকে ত্বরান্বিত করতে পারে, এবং এর অবশ্যম্ভাবী ক্ষয়ক্ষতিকে কমিয়ে আনতে পারে, কিন্তু এই প্রক্রিয়াকে পরিহার করার কোনও সংক্ষিপ্ত পথ নেই --- কেননা এই প্রক্রিয়ায় শ্রমিকরা তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার সাহায্যে শিক্ষালাভ করে ।
==============================================
গুরুত্বপূর্ণ সোভিয়েতগুলিতে - পেত্রোগ্রাদ ও মস্কো সোভিয়েত, প্রাক-সংসদে ট্রেড ইউনিয়নভিত্তিক প্রতিনিধিত্বে, উত্তরাঞ্চলীয় সৈন্যবাহিনীতে, পেত্রোগ্রাদ ও মস্কোর স্থানীয় নির্বাচন ইত্যাদিতে প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে বলশেভিক পার্টি সংখ্যাধিক্য অর্জন না-করা পর্যন্ত বলশেভিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়নি ।
==============================================
বিপ্লব অথবা একনায়কত্বকে কেউ নিশ্চয়ই গোলাপের রঙে চিত্রিত করার চেষ্টা করবেন না । কোনও বর্বর ও নির্মম শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের কঠোর বাস্তবতাকে সহ্য করতে অপারগ ভাবপ্রবণ সমর্থনের বদলে পাঠক যদি কমিউনিজমের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, তা-ও বরং ভাল । তবে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার আগে তাঁরা নিশ্চিতভাবে জেনে নিন-যে-জগতের দিকে তাঁরা মুখ ফেরাচ্ছেন সে-জগৎ হল ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ঔপনিবেশিক দাসত্বের জগৎ, যাদের কৃত নির্বিচার গণহত্যা ও ধ্বংসের পরিমাণ সর্বহারা বিপ্লবের সমগ্র ঘটনার তুলনায় সহস্রগুণ অধিক ।
No comments:
Post a Comment