"জাতি হইল, ইতিহাসের বিভিন্ন যুগের মধ্য দিয়া ক্রমবিকাশ-প্রাপ্ত, এক-ভাষাভাষী, নির্দিষ্ট স্থানে বসবাসকারী, একই অর্থনীতিক জীবন-সম্পন্ন এবং সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপের মধ্য দিয়া প্রকাশিত একই মানসিক গঠনযুক্ত স্থায়ী জনসমাজ ।" - J.V.Stalin : Marxism and the National and Colonial Question
=====================================
অস্ট্রালয়েড, মঙ্গোলয়েড এবং "আর্য" নামক মিশ্রিত মনোবসংখ্যাকে লইয়াই বর্তমান বাঙালী জাতি গঠিত । পণ্ডিতগণের মতে, বাঙালী জাতির মধ্যে "আর্য" রক্তের পরিমাণ শতকরা মাত্র পাঁচ ভাগ । বাকি সমস্তই "অনার্য" রক্ত । কোন সুদূর অতীতে কোল-সাঁওতাল-মুন্ডা-ওরাওঁদের পূর্বপুরুষ অর্থাৎ অস্ট্রালয়েড মানবশাখা, কোচ প্রভৃতি মঙ্গোলয়েড, "দ্রাবিড়" বলিয়া কথিত মিশ্রিত মানবগোষ্ঠী বাঙলাদেশে বন-জঙ্গল সাফ করিয়া বসতি স্থাপন করিয়াছিল । পরে "আর্য" বলিয়া কথিত মানুষ আসিয়া বাঙলাদেশে বাস করিতে থাকে । তাহার পর কালক্রমে এই জনসমষ্টি পরস্পরের সহিত মিশিয়া গিয়া এবং ইতিহাসের অর্থাৎ সমাজ-বিকাশের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করিয়া বাঙালী জাতিতে পরিণত হইয়াছে ।
=====================================
কেবলমাত্র কৃষি মানব-শাখার ঐক্য সাধনে অক্ষম । ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাই উহার শোষণ-কার্যের প্রয়োজনে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মিশ্রণ ঘটাইতে এবং উহাদের একজাতিরূপে গড়িয়া তুলিতে পারে ।
=====================================
বহু ভিন্ন ভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী বা উপজাতির মিশ্রণের ভিত্তিতেই প্রত্যেকটি আধুনিক জাতির জন্ম । এঙ্গেলস-এর কথায় :
"ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপেই কোন জাতিগোষ্ঠী বা উপজাতির মানুষ ভিতরে ও বাইরে সংহত ও ঘনিষ্ঠ হতে বাধ্য হয় । এইভাবে সর্বত্র পরস্পর-সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীও সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া বসবাসের এবং শীঘ্রই পরস্পরের সহিত মিশিয়া যাইবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে । ইহারাই অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ ঐ নিজ নিজ বাসভূমি একত্র করিয়া একটিমাত্র জাতির বাসভূমি সৃষ্টি করে ।"
F.Engels : The Origin of the Family, Private Property and the State
=====================================
আধুনিক ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মূলধনী শ্রেণীর পণ্যের বাজার সৃষ্টির তাগিদে দেশের বিভিন্ন অংশের মধ্যে এবং আদিবাসীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ গড়িয়া উঠে । জাতীয় সংহতি সৃষ্টির কার্যে ধনতন্ত্রের শক্তি অসাধারণ । ধনতন্ত্রই সামন্ততন্ত্রের বাধা চূর্ণ করিয়া জনসমষ্টিকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া তোলে । ধনতন্ত্রই বিশাল শিল্পাঞ্চলগুলিতে শ্রমিকরূপে বিপুল জনসংখ্যার সমাবেশ ঘটায় । ধনতন্ত্রই শিল্পকেন্দ্র শহরের সহিত কাঁচামালের সরবরাহ-ক্ষেত্র গ্রামাঞ্চলের সংযোগ স্থাপন করে এবং সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি করে ইহার সহিত অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধযুক্ত একটি মধ্যশ্রেণী । এই মধ্যশ্রেণীই তখন ধনতন্ত্রের মুখপাত্ররূপে জাতীয়তার ধারণা অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ প্রচার করে । ভারতবর্ষেও ধনতন্ত্রের প্রয়োজনে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় আন্দোলন গড়িয়া উঠিয়াছে । ভারতবর্ষের মূলধনীশ্রেণীও উহার অনুগত মধ্যশ্রেণীর সহায়তায় জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি করিয়াছে এবং উহাদের শোষণের প্রয়োজনে বহু জাতিতে বিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও সকল ভারতবাসীকে এক জাতি বলিয়া প্রচার করিয়াছে এবং এখনও করিতেছে ।
=====================================
"জাতি হইল সমাজের বিকাশ-ধারার বুর্জোয়াযুগের একটি অনিবার্য রূপ --- একটি অতি প্রয়োজনীয় পরিণতি ।"
Lenin : The Teachings of Karl Marx
=====================================
পশ্চিম ইউরোপে এক-একটি জাতি লইয়া এক-একটি রাষ্ট্র গঠিত হইয়াছে । এই সকল রাষ্ট্রে অন্য কোন জাতির অস্তিত্ব না থাকায়, এই সকল একজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে জাতীয় উৎপীড়নের কোন প্রশ্ন উঠে নাই । কিন্তু পূর্ব-ইউরোপে ও প্রাচ্য জগতে, যেমন ভারতবর্ষে, বহুজাতি-ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠিত হইয়াছে । এই সকল বহুজাতি-ভিত্তিক রাষ্ট্রে প্রভুত্ব করিতেছে ঐ রাষ্ট্রেরই কোন একটি বিশেষ উন্নত জাতি, আর অনগ্রসর জাতিগুলি বা জাতীয় জনশাখা বা উপজাতিগুলি প্রথমে ঐ প্রভুত্বকারী জাতিটির রাজনীতিক দাসত্বের এবং পরে অর্থনীতিক দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইয়াছে । প্রাচ্য জগতের এই বহুজাতি-ভিত্তিক রাষ্ট্রগুলিই জাতীয় উৎপীড়নের প্রধান ক্ষেত্র । এই প্রকারের জাতীয় উৎপীড়ন, অর্থাৎ একজাতির উপর অন্য জাতির উৎপীড়ন হইতেই জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ, জাতীয় আন্দোলন, জাতিগত সমস্যা প্রভৃতির সৃষ্টি হইয়াছে ।
=====================================
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বৈপ্লবিক সংগ্রামের জোয়ারে সমগ্র ভারতবর্ষের সাম্রাজ্যবাদী, সামন্ততান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক শোষণ-ব্যবস্থা ভাসিয়া যাইবার উপক্রম হয় তখন প্রত্যক্ষ শাসন আর সম্ভব নয় বুঝিয়া সাম্রাজ্যবাদীরা সমগ্র ভারতবর্ষকে ভাঙিয়া ভারত, পাকিস্তান ও ব্রহ্মদেশ এই তিনটি বহু-জাতিভিত্তিক নূতন রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে এবং এই তিনটি নূতন রাষ্ট্রের বৃহৎ বুর্জোয়া ও সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের হাতে শাসনভার ছাড়িয়া দিয়া পর্দার আড়ালে সরিয়া দাঁড়ায় ।
=====================================
যুদ্ধের সময় ঔপনিবেশিক বা আধা-ঔপনিবেশিক দেশসমূহের জনসাধারণের নিকট সাম্রাজ্যবাদীদের সাহায্যের আবেদনের ফলে উহাদের দুর্বলতা জনসাধারণের নিকট স্পষ্ট হইয়া উঠে, ঔপনিবেশিক দেশগুলির জনসাধারণের মনে আত্মশক্তিতে বিশ্বাস দেখা দেয় এবং সাম্রাজ্যবাদের শোষণ-উৎপীড়ন হইতে মুক্তিলাভের জন্য সংগ্রামের সাহস ও সংকল্প জাগিয়া উঠে । তাহার ফলেই আরাম্ভ হয় জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম । প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ভারতবর্ষেও এই সংগ্রাম চরমরূপ গ্রহণ করিয়াছিল ।
=====================================
প্রথম মহাযুদ্ধের পর আর একটি বিশেষ কারণেও জাতিগত সমস্যা ব্যাপকতর হইয়াছে, উহা বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিক সমস্যায় পরিণত হইয়াছে এবং জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের শক্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে । এই সময় জাতিগত সমস্যা প্রথমে বিচ্ছিন্ন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের আকারে এবং পরে সর্বগ্রাসী দাবাগ্নির আকারে বিশ্বব্যাপী মুক্তি-সংগ্রামরূপে দেখা দিয়াছে । এই বিশেষ কারণটি ছিল, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির দ্বারা তুরস্কের অঙ্গচ্ছেদ এবং রাষ্ট্র হিসাবে উহার অস্তিত্বের বিলোপসাধনের প্রয়াস । সে সময় তুরস্ক ছিল রাজনীতিক দিক থেকে সমগ্র মুসলিম জগতে সর্বাপেক্ষা অগ্রসর এবং অসাধারণ মানমর্যাদার অধিকারী । সাম্রাজ্যবাদীদের এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তুরস্ক উহার জাতীয় স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য সংগ্রাম আরম্ভ করে । তাহার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের পদানত দেশগুলি অর্থাৎ প্রাচ্যের ঔপনিবেশিক জগতের সমগ্র মুসলমান জনসাধারণ তুরস্কের পক্ষে দন্ডায়মান হয় এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ঔপনিবেশিক জগতের মুক্তি-সংগ্রামে যোগদান করে । ইহার ফলে ঔপনিবেশিক জগতের সংগ্রামী শক্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পায় । ভারতবর্ষে 'খিলাফত সংগ্রাম' ইহার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত । এইভাবে সংগ্রামের ক্ষেত্রে অনগ্রসর মুসলমান জনসাধারণের আবির্ভাব জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের পক্ষে একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ।
=====================================
বিশ্বব্যাপী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম দুর্বার হইয়া উঠে ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দে হইতে । বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার গর্ভ হইতে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মত দেখা দেয় 'নভেম্বর বিপ্লব' । তাহার ফলে ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দে ঔপনিবেশিক জগতের মুক্তির বাণী লইয়া আবির্ভূত হয় সমাজতন্ত্রী সোভিয়েত রাষ্ট্র । সাম্রাজ্যবাদের কবল হইতে প্রাচ্যের ঔপনিবেশিক জগতের মুক্তির বাণী ছিল ইহার পতাকায় অঙ্কিত । রুশিয়ার জার সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক দাসত্ব হইতে মুক্তিলাভ করিল বহু জাতি । এই সফলতায় প্রাচ্যের ঔপনিবেশিক জগতের মানুষ মুক্তি-সংগ্রামের দুর্বার প্রেরণা লইয়া জাগিয়া উঠে । এইভাবে স্তালিনের ভাষায়, 'গড়িয়া উঠে আয়ার্ল্যান্ড হইতে ভারতবর্ষ পর্যন্ত এক অখণ্ড ও বিশাল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ফ্রন্ট ।"
=====================================
প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালের মত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরেও, অর্থাৎ সম্প্রতিকালেও কতকগুলি নূতন বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র আবির্ভূত হইয়াছে । এই সকল রাষ্ট্রও দীর্ঘকালের জাতীয় আন্দোলনের পরেই জন্মলাভ করিয়াছে । বুর্জোয়াশ্রেণীই ছিল এই সকল জাতীয় আন্দোলনের পরিচালক । সুতরাং এই নূতন রাষ্ট্রগুলিও বুর্জোয়া রাষ্ট্র রূপে দেখা দিয়াছে । দৃষ্টান্তস্বরূপ ভারত, পাকিস্তান এবং ব্রহ্মদেশের নাম করা যায় । বুর্জোয়া রাষ্ট্র বলিয়াই এই সকল নবজাত বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রেও বিভিন্ন জাতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হয় নাই এবং বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী বা উপজাতির উপর একটি বা কয়েকটি বৃহৎ ও উন্নততর জাতির শোষণ-উৎপীড়নেরও অবসান ঘটে নাই । ইহার মূল কারণ এই যে, এই সকল নূতন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং শ্রেণীর শোষণ-উৎপীড়নের ভিত্তির উপর, শ্রমিকশ্রেণী ও কৃষকের উপর মূলধনী ও জমিদার শ্রেণীর উপর শ্রেণীর শোষণ-উৎপীড়নের ভিত্তির উপর । সংক্ষেপে বলা যায়, এই নূতন বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রগুলি হইল শ্রেণীরাষ্ট্র এবং ইহারা শোষক-শ্রেণীগুলির শোষণ-উৎপীড়নের যন্ত্র ভিন্ন অন্য কিছু নয় । সুতরাং এই সকল রাষ্ট্র শ্রেণী শোষণ অব্যাহত রাখিবার জন্য পীড়ন-যন্ত্র অর্থাৎ শাসন-ক্ষমতা বা রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যতীত একদিনও টিকিয়া থাকিতে পারে না ।
=====================================
এই প্রকারের রাষ্ট্রই নিজ স্বার্থ রক্ষার জন্য, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ বিগ্রহ পরিচালনার জন্য শেষ পর্যন্ত আর্থিক ও সামরিক দিক হইতে শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির সাহায্যপ্রার্থী হইতে বাধ্য হয় । এই আর্থিক ও সামরিক সাহায্য লাভের শর্ত হিসাবেই এই প্রকারের রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির আজ্ঞাবহ ভৃত্যে পরিণত না হইয়া পারে না,-- যেমন হইয়াছে তথাকথিত স্বাধীন ভারতরাষ্ট্র ।
=====================================
"উৎপীড়িত জাতিসমূহের মুক্তি ও স্বাধীনতা ব্যতীত সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার কথা যেমন ভাবা যায় না, তেমনই বিভিন্ন জাতির উপর উৎপীড়ন ব্যতীত ধনতন্ত্রের অর্থাৎ বুর্জোয়া শাসনের অস্তিত্বের কথাও চিন্তা করা যায় না । যতদিন পর্যন্ত কৃষক জনসাধারণ এবং পাতিবুর্জোয়াশ্রেণী জাতীয়তাবাদের মোহে আচ্ছন্ন হইয়া থাকিবে এবং বুর্জোয়াশ্রেণীর নির্দেশে পরিচালিত হইবে, ততদিন উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ অনিবার্য । কিন্তু যখনই কৃষক জনসাধারণ শ্রমিকশ্রেণীর অনুগামী ও শ্রমিকশ্রেণীর নির্দেশে পরিচালিত হইবে তখনই বিভিন্ন জাতির মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হইবে, এক জাতির উপর হইতে অন্য জাতির শোষণ-উৎপীড়নের অবসান ঘটিবে এবং জাতিসমূহের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত হইবে ।" - স্তালিন
=====================================
মার্কস-এঙ্গেলস তাঁহাদের 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'-তে জাতি-সমস্যাটিকে কোন সংকীর্ণ জাতিগত দৃষ্টিকোণ হইতে বিচার না করিয়া শ্রমিকশ্রেণীর আন্তর্জাতিক আদর্শ দ্বারাই বিচার করিয়াছেন এবং দেখাইয়াছেন যে, কেবল শ্রমিকশ্রেণীর আন্তর্জাতিকতা দ্বারাই এই সমস্যার পূর্ণ সমাধান সম্ভব । এই শ্রমিক আন্তর্জাতিকতাই সমগ্র 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'র মূল আদর্শ । তাই 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো' ঘোষণা করিয়াছে :
"অন্যান্য শ্রমিক পার্টি ও কমিউনিস্টদের মধ্যে পার্থক্য এই যে, - (১) বিভিন্ন দেশের শ্রমিকশ্রেণীর জাতীয় সংগ্রামে কমিউনিস্টরা সমগ্র শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থকে সংকীর্ণ জাতীয়তার প্রশ্ন হইতে স্বতন্ত্রভাবে বিচার করিবে এবং সেই ভাবেই এই প্রশ্নের উপর গুরুত্ব আরোপ করিবে; (২) বুর্জোয়াশ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রাম যে সকল বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করিয়া অগ্রসর হইবে, সংগ্রামের সেই সকল স্তরে কমিউনিস্টরা সকল সময় এবং সমগ্র শ্রমিক-সংগ্রামেরই প্রতিনিধিত্ব করিবে ।"
ইহাই জাতিগত প্রশ্নে কমিউনিস্টদের বিচারের মূল ভিত্তি । শ্রমিকশ্রেণী সকল প্রকারের শোষণ-উৎপীড়নের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করে । সুতরাং তাহারা তাহাদের শ্রেণীগত আদর্শ হিসাবেই প্রত্যেকটি উৎপীড়িত জাতির স্বাধীনতা-সংগ্রামও সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে । কিন্তু তাই বলিয়া শ্রমিকশ্রেণী কখনও "ন্যায়-অন্যায় যাহাই করুক না কেন আমার জাতি, আমার দেশ" অথবা "আমার দেশ সবার ঊর্দ্ধে"-প্রভৃতি বুর্জোয়া ও পাতিবুর্জোয়া নীতি সমর্থন করে না । কোন জাতির মুক্তি-সংগ্রামের গতি প্রকৃতি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের দিকে কিনা তাহা বিচার করিয়াই শ্রমিকশ্রেণী জাতীয় সংগ্রাম সমর্থন করে ।
=====================================
মার্কসবাদীদের মতে, যে প্রতিক্রিয়াশীল শাসন ও শোষণব্যবস্থা ক্ষুদ্র-বৃহৎ সমস্ত জাতির স্বাধীন বিকাশ ও স্বাধীন অস্তিত্বের পক্ষে বাধাস্বরূপ, সেই শোষণ ও শাসন-ব্যবস্থার ধ্বংস সাধনেই প্রত্যেকটি জাতির মূলস্বার্থ রক্ষিত হইতে পারে । সুতরাং জাতীয় স্বাধীনতার জন্য যে সংগ্রাম পরিচালিত হয় তাহা নিঃসন্দেহে প্রগতিশীল । কিন্তু সেই সংগ্রাম আন্তর্জাতিক মুক্তি-সংগ্রামের সহিত কতখানি সম্পর্কযুক্ত তাহাই উহার প্রগতিশীলতার মাপকাঠি । এই জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম যে পরিমাণে বিশ্বের সমগ্র মানবজাতির পশ্চাদপদ অবস্থা ও শোষণ-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে এবং অগ্রগতির জন্য আন্তর্জাতিক সংগ্রামের সহিত সম্পর্কযুক্ত হইবে, জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম কেবল ততখানিই প্রগতিশীল বলিয়া গণ্য হইবে । আন্তর্জাতিক সংগ্রাম হইতে বিচ্ছিন্ন জাতীয়তাবাদকে শ্রমিকশ্রেণী বা মার্কসবাদ অগ্রাহ্য করে ।
=====================================
মার্কস-এঙ্গেলস উৎপীড়ক দেশের শ্রমিকশ্রেণীর কর্তব্য বিশেষভাবে নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন । যে প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা ঐ রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন জাতির শোষণ-উৎপীড়নের জন্য এবং প্রতিবেশী দেশসমূহকে গ্রাস করিবার জন্য ব্যবহৃত হয়, সেই রাষ্ট্রের শ্রমিকশ্রেণী কখনও তাহাদের তথাকথিত পিতৃভূমিকে সমর্থন করিতে পারে না । সেই রাষ্ট্র-ক্ষমতার বিরুদ্ধেই শ্রমিকশ্রেনীকে সংগ্রাম করিতে হইবে ।
=====================================
১৯৬৪ সালে আমেরিকার নিগ্রো জনসাধারণের সংগ্রাম সমর্থন করিবার জন্য সমস্ত বিশ্বের জনসাধারণকে আহবান জানাইয়া মাও সে-তুঙ লিখিয়াছিলেন :
"শেষ বিশ্লেষণে জাতীয় সংগ্রাম মূলত শ্রেণী সংগ্রাম ।"
=====================================
রাজনীতিক ও সামাজিক মুক্তি কেবল বিপ্লবের দ্বারাই সম্ভব । সুতরাং বলা যায় : 'প্রত্যেকটি শোষিত জাতি ও শ্রেণীর পক্ষে বিপ্লবই মূল প্রশ্ন ।' - মাও সে-তুং
=====================================
জাতীয় বিপ্লব জাতির জনসাধারণের - শ্রমিক কৃষকের - প্রত্যেকটি শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেণীর বিপ্লবের প্রশ্ন । কারণ, জাতির সর্বাধিক জনসংখ্যার - শ্রমিক-কৃষক ও অন্যান্য শোষিত শ্রেণীর স্বার্থই জাতীয় স্বার্থ । সুতরাং জাতীয় মুক্তির অর্থ, শোষণ-উৎপীড়ন হইতে জাতির সর্বাধিক জনসংখ্যার, বিশেষত শ্রমজীবী জনসাধারণের, শ্রমিক-কৃষকের মুক্তি ।
=====================================
ভারতের সংশোধনবাদী কমিউনিস্ট নেতৃত্ব সেদিন অর্থাৎ ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলমানের মিলন ও ঐক্যের অজুহাতে কেবল ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দুস্থান-পাকিস্তান এই দুই ভাগে ভারত ভাগের সহায়তা করিয়া মার্কসবাদকে কবরস্থ করিয়াছিল ।
ধর্ম জাতিত্বের কোন নিয়ামক উপাদান হইতে পারে না - এই মার্কসবাদী সত্যটিকে সংশোধনবাদী কমিউনিস্ট নেতৃত্ব সেদিন অস্বীকার করিয়াছিলেন । জাতি-সমস্যার সমাধান যে কেবল বিপ্লবের মধ্য দিয়াই সম্ভব - মার্কসবাদের এই মহাসত্যটিকে এড়াইবার জন্যই কমিউনিস্ট নেতৃত্বের এই বিশ্বাসঘাতকতা ।
=====================================
সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী শ্রেণী বলিয়া শ্রমিকশ্রেণীই হইবে ভারতের ঐক্যবদ্ধ বৈপ্লবিক 'ফ্রন্টের' নায়ক ও সংগঠক । শ্রমিকশ্রেণী একটি আন্তর্জাতিক বিপ্লবী শক্তি । তাই শ্রমিকশ্রেণী জাতি-বন্ধন ও দেশ-বন্ধনের ঊর্ধ্বে । এই জন্য একমাত্র শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বেই জাতি-উপজাতিসমূহের মুক্তি-সংগ্রাম, আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম, মুক্ত জাতি-উপজাতিসমূহের সমাজতন্ত্রের পথে জয়যাত্রার সংগ্রাম সফল হইতে পারে । ভূমির বন্ধনে আবদ্ধ কৃষক-সম্প্রদায়কে একমাত্র শ্রমিকশ্রেণীই পারে সামন্ততন্ত্রের বন্ধন হইতে মুক্ত করিয়া সমাজতন্ত্রের পথে চালিত করিতে । তাই ভারতের শ্রমিকশ্রেণীই হইবে ভারতের ঐক্যবদ্ধ বৈপ্লবিক 'ফ্রন্টের' জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের চালক-শক্তি ।
শ্রমিকশ্রেণী একটি অখণ্ড সর্বভারতীয় শক্তি । বাহিরের দিক হইতে জাতিগতভাবে বিভক্ত হইলেও শ্রেণীগতভাবে ইহারা এক ও অখণ্ড, শ্রেণী-চরিত্রের দিক হইতে অবিভাজ্য । ভারতের শ্রমিকশ্রেণী আজ একটি সর্বভারতীয় বিপ্লবী রাজনীতিক শক্তিরূপে আবির্ভূত, বৈপ্লবিক ভূমিকায় সুপ্রতিষ্ঠিত । তাই ভারতের বিভিন্ন জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামগুলিকে শ্রমিকশ্রেণীই জাতীয় পরিসরে সংগঠিত করিবে, ইহাদের মধ্যে ঐক্য গড়িয়া তুলিবে । ভারতের শ্রমিকশ্রেণীই শহরাঞ্চলের শোষিত মধ্যশ্রেণীর সংগ্রাম, জাতীয়-বুর্জোয়াগোষ্ঠীর সংগ্রাম গড়িয়া তুলিবে, এই সংগ্রামগুলিকে পরিচালিত করিবে এবং এক বৈপ্লবিক 'ফ্রন্টে' ঐক্যবদ্ধ করিবে ।
ভারতের শ্রমিকশ্রেণীই হইবে বিভিন্ন জাতি-উপজাতির এবং বিভিন্ন অঞ্চলের খন্ড খন্ড গণতান্ত্রিক বিপ্লবসমূহের সংগঠক, ঐক্যসাধক ও পরিচালক । শ্রমিকশ্রেণীর পরিচালনায়ই এই জাতীয় ও উপজাতীয় বিপ্লবসমূহ বিচ্ছিন্ন না থাকিয়া এক মহাজাতীয় বিপ্লবে পরিণত হইবে এবং দ্রুত গণতান্ত্রিক স্তর উত্তীর্ণ হইয়া সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে প্রবেশ করিবে ।
=====================================
"মানব-সমাজ যে বিভিন্ন রাষ্ট্রে ও জাতিতে বিভক্ত হইয়া রইয়াছে কেবল তাহার অবসান ঘটানোই সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য নয়, কেবল জাতিসমূহের বাহ্যিক মিলন ঘটানোই সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য নয় , সকল মানুষ যাহাতে মিলিয়ে মিশিয়া একাকার হইয়া যায় তাহাই সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য । ... উৎপীড়িত শ্রেণীসমূহের একনায়কত্বের পরিবর্তনশীল যুগের মধ্য দিয়া যাহাতে মানব জাতির মধ্য হইতে সকল শ্রেণীর অস্তিত্ব লোপ পায়, যাহাতে উৎপীড়িত জাতিসমূহ বিচ্ছিন্নতা ও স্বাধীনতার যুগের মধ্য দিয়া শেষ পর্যন্ত পূর্নমুক্তি লাভ করিয়া মিলিয়ে একাকার হইয়া যাইতে পারে তাহাই সমাজতন্ত্রের চরম লক্ষ্য ।" - Lenin : The Significance of Self-Determination
=====================================
অস্ট্রালয়েড, মঙ্গোলয়েড এবং "আর্য" নামক মিশ্রিত মনোবসংখ্যাকে লইয়াই বর্তমান বাঙালী জাতি গঠিত । পণ্ডিতগণের মতে, বাঙালী জাতির মধ্যে "আর্য" রক্তের পরিমাণ শতকরা মাত্র পাঁচ ভাগ । বাকি সমস্তই "অনার্য" রক্ত । কোন সুদূর অতীতে কোল-সাঁওতাল-মুন্ডা-ওরাওঁদের পূর্বপুরুষ অর্থাৎ অস্ট্রালয়েড মানবশাখা, কোচ প্রভৃতি মঙ্গোলয়েড, "দ্রাবিড়" বলিয়া কথিত মিশ্রিত মানবগোষ্ঠী বাঙলাদেশে বন-জঙ্গল সাফ করিয়া বসতি স্থাপন করিয়াছিল । পরে "আর্য" বলিয়া কথিত মানুষ আসিয়া বাঙলাদেশে বাস করিতে থাকে । তাহার পর কালক্রমে এই জনসমষ্টি পরস্পরের সহিত মিশিয়া গিয়া এবং ইতিহাসের অর্থাৎ সমাজ-বিকাশের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করিয়া বাঙালী জাতিতে পরিণত হইয়াছে ।
=====================================
কেবলমাত্র কৃষি মানব-শাখার ঐক্য সাধনে অক্ষম । ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাই উহার শোষণ-কার্যের প্রয়োজনে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মিশ্রণ ঘটাইতে এবং উহাদের একজাতিরূপে গড়িয়া তুলিতে পারে ।
=====================================
বহু ভিন্ন ভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী বা উপজাতির মিশ্রণের ভিত্তিতেই প্রত্যেকটি আধুনিক জাতির জন্ম । এঙ্গেলস-এর কথায় :
"ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপেই কোন জাতিগোষ্ঠী বা উপজাতির মানুষ ভিতরে ও বাইরে সংহত ও ঘনিষ্ঠ হতে বাধ্য হয় । এইভাবে সর্বত্র পরস্পর-সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীও সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া বসবাসের এবং শীঘ্রই পরস্পরের সহিত মিশিয়া যাইবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে । ইহারাই অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ ঐ নিজ নিজ বাসভূমি একত্র করিয়া একটিমাত্র জাতির বাসভূমি সৃষ্টি করে ।"
F.Engels : The Origin of the Family, Private Property and the State
=====================================
আধুনিক ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মূলধনী শ্রেণীর পণ্যের বাজার সৃষ্টির তাগিদে দেশের বিভিন্ন অংশের মধ্যে এবং আদিবাসীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ গড়িয়া উঠে । জাতীয় সংহতি সৃষ্টির কার্যে ধনতন্ত্রের শক্তি অসাধারণ । ধনতন্ত্রই সামন্ততন্ত্রের বাধা চূর্ণ করিয়া জনসমষ্টিকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া তোলে । ধনতন্ত্রই বিশাল শিল্পাঞ্চলগুলিতে শ্রমিকরূপে বিপুল জনসংখ্যার সমাবেশ ঘটায় । ধনতন্ত্রই শিল্পকেন্দ্র শহরের সহিত কাঁচামালের সরবরাহ-ক্ষেত্র গ্রামাঞ্চলের সংযোগ স্থাপন করে এবং সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি করে ইহার সহিত অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধযুক্ত একটি মধ্যশ্রেণী । এই মধ্যশ্রেণীই তখন ধনতন্ত্রের মুখপাত্ররূপে জাতীয়তার ধারণা অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ প্রচার করে । ভারতবর্ষেও ধনতন্ত্রের প্রয়োজনে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় আন্দোলন গড়িয়া উঠিয়াছে । ভারতবর্ষের মূলধনীশ্রেণীও উহার অনুগত মধ্যশ্রেণীর সহায়তায় জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি করিয়াছে এবং উহাদের শোষণের প্রয়োজনে বহু জাতিতে বিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও সকল ভারতবাসীকে এক জাতি বলিয়া প্রচার করিয়াছে এবং এখনও করিতেছে ।
=====================================
"জাতি হইল সমাজের বিকাশ-ধারার বুর্জোয়াযুগের একটি অনিবার্য রূপ --- একটি অতি প্রয়োজনীয় পরিণতি ।"
Lenin : The Teachings of Karl Marx
=====================================
পশ্চিম ইউরোপে এক-একটি জাতি লইয়া এক-একটি রাষ্ট্র গঠিত হইয়াছে । এই সকল রাষ্ট্রে অন্য কোন জাতির অস্তিত্ব না থাকায়, এই সকল একজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে জাতীয় উৎপীড়নের কোন প্রশ্ন উঠে নাই । কিন্তু পূর্ব-ইউরোপে ও প্রাচ্য জগতে, যেমন ভারতবর্ষে, বহুজাতি-ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠিত হইয়াছে । এই সকল বহুজাতি-ভিত্তিক রাষ্ট্রে প্রভুত্ব করিতেছে ঐ রাষ্ট্রেরই কোন একটি বিশেষ উন্নত জাতি, আর অনগ্রসর জাতিগুলি বা জাতীয় জনশাখা বা উপজাতিগুলি প্রথমে ঐ প্রভুত্বকারী জাতিটির রাজনীতিক দাসত্বের এবং পরে অর্থনীতিক দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইয়াছে । প্রাচ্য জগতের এই বহুজাতি-ভিত্তিক রাষ্ট্রগুলিই জাতীয় উৎপীড়নের প্রধান ক্ষেত্র । এই প্রকারের জাতীয় উৎপীড়ন, অর্থাৎ একজাতির উপর অন্য জাতির উৎপীড়ন হইতেই জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ, জাতীয় আন্দোলন, জাতিগত সমস্যা প্রভৃতির সৃষ্টি হইয়াছে ।
=====================================
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বৈপ্লবিক সংগ্রামের জোয়ারে সমগ্র ভারতবর্ষের সাম্রাজ্যবাদী, সামন্ততান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক শোষণ-ব্যবস্থা ভাসিয়া যাইবার উপক্রম হয় তখন প্রত্যক্ষ শাসন আর সম্ভব নয় বুঝিয়া সাম্রাজ্যবাদীরা সমগ্র ভারতবর্ষকে ভাঙিয়া ভারত, পাকিস্তান ও ব্রহ্মদেশ এই তিনটি বহু-জাতিভিত্তিক নূতন রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে এবং এই তিনটি নূতন রাষ্ট্রের বৃহৎ বুর্জোয়া ও সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের হাতে শাসনভার ছাড়িয়া দিয়া পর্দার আড়ালে সরিয়া দাঁড়ায় ।
=====================================
যুদ্ধের সময় ঔপনিবেশিক বা আধা-ঔপনিবেশিক দেশসমূহের জনসাধারণের নিকট সাম্রাজ্যবাদীদের সাহায্যের আবেদনের ফলে উহাদের দুর্বলতা জনসাধারণের নিকট স্পষ্ট হইয়া উঠে, ঔপনিবেশিক দেশগুলির জনসাধারণের মনে আত্মশক্তিতে বিশ্বাস দেখা দেয় এবং সাম্রাজ্যবাদের শোষণ-উৎপীড়ন হইতে মুক্তিলাভের জন্য সংগ্রামের সাহস ও সংকল্প জাগিয়া উঠে । তাহার ফলেই আরাম্ভ হয় জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম । প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ভারতবর্ষেও এই সংগ্রাম চরমরূপ গ্রহণ করিয়াছিল ।
=====================================
প্রথম মহাযুদ্ধের পর আর একটি বিশেষ কারণেও জাতিগত সমস্যা ব্যাপকতর হইয়াছে, উহা বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিক সমস্যায় পরিণত হইয়াছে এবং জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের শক্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে । এই সময় জাতিগত সমস্যা প্রথমে বিচ্ছিন্ন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের আকারে এবং পরে সর্বগ্রাসী দাবাগ্নির আকারে বিশ্বব্যাপী মুক্তি-সংগ্রামরূপে দেখা দিয়াছে । এই বিশেষ কারণটি ছিল, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির দ্বারা তুরস্কের অঙ্গচ্ছেদ এবং রাষ্ট্র হিসাবে উহার অস্তিত্বের বিলোপসাধনের প্রয়াস । সে সময় তুরস্ক ছিল রাজনীতিক দিক থেকে সমগ্র মুসলিম জগতে সর্বাপেক্ষা অগ্রসর এবং অসাধারণ মানমর্যাদার অধিকারী । সাম্রাজ্যবাদীদের এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তুরস্ক উহার জাতীয় স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য সংগ্রাম আরম্ভ করে । তাহার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের পদানত দেশগুলি অর্থাৎ প্রাচ্যের ঔপনিবেশিক জগতের সমগ্র মুসলমান জনসাধারণ তুরস্কের পক্ষে দন্ডায়মান হয় এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ঔপনিবেশিক জগতের মুক্তি-সংগ্রামে যোগদান করে । ইহার ফলে ঔপনিবেশিক জগতের সংগ্রামী শক্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পায় । ভারতবর্ষে 'খিলাফত সংগ্রাম' ইহার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত । এইভাবে সংগ্রামের ক্ষেত্রে অনগ্রসর মুসলমান জনসাধারণের আবির্ভাব জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের পক্ষে একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ।
=====================================
বিশ্বব্যাপী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম দুর্বার হইয়া উঠে ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দে হইতে । বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার গর্ভ হইতে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মত দেখা দেয় 'নভেম্বর বিপ্লব' । তাহার ফলে ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দে ঔপনিবেশিক জগতের মুক্তির বাণী লইয়া আবির্ভূত হয় সমাজতন্ত্রী সোভিয়েত রাষ্ট্র । সাম্রাজ্যবাদের কবল হইতে প্রাচ্যের ঔপনিবেশিক জগতের মুক্তির বাণী ছিল ইহার পতাকায় অঙ্কিত । রুশিয়ার জার সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক দাসত্ব হইতে মুক্তিলাভ করিল বহু জাতি । এই সফলতায় প্রাচ্যের ঔপনিবেশিক জগতের মানুষ মুক্তি-সংগ্রামের দুর্বার প্রেরণা লইয়া জাগিয়া উঠে । এইভাবে স্তালিনের ভাষায়, 'গড়িয়া উঠে আয়ার্ল্যান্ড হইতে ভারতবর্ষ পর্যন্ত এক অখণ্ড ও বিশাল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ফ্রন্ট ।"
=====================================
প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালের মত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরেও, অর্থাৎ সম্প্রতিকালেও কতকগুলি নূতন বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র আবির্ভূত হইয়াছে । এই সকল রাষ্ট্রও দীর্ঘকালের জাতীয় আন্দোলনের পরেই জন্মলাভ করিয়াছে । বুর্জোয়াশ্রেণীই ছিল এই সকল জাতীয় আন্দোলনের পরিচালক । সুতরাং এই নূতন রাষ্ট্রগুলিও বুর্জোয়া রাষ্ট্র রূপে দেখা দিয়াছে । দৃষ্টান্তস্বরূপ ভারত, পাকিস্তান এবং ব্রহ্মদেশের নাম করা যায় । বুর্জোয়া রাষ্ট্র বলিয়াই এই সকল নবজাত বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রেও বিভিন্ন জাতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হয় নাই এবং বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী বা উপজাতির উপর একটি বা কয়েকটি বৃহৎ ও উন্নততর জাতির শোষণ-উৎপীড়নেরও অবসান ঘটে নাই । ইহার মূল কারণ এই যে, এই সকল নূতন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং শ্রেণীর শোষণ-উৎপীড়নের ভিত্তির উপর, শ্রমিকশ্রেণী ও কৃষকের উপর মূলধনী ও জমিদার শ্রেণীর উপর শ্রেণীর শোষণ-উৎপীড়নের ভিত্তির উপর । সংক্ষেপে বলা যায়, এই নূতন বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রগুলি হইল শ্রেণীরাষ্ট্র এবং ইহারা শোষক-শ্রেণীগুলির শোষণ-উৎপীড়নের যন্ত্র ভিন্ন অন্য কিছু নয় । সুতরাং এই সকল রাষ্ট্র শ্রেণী শোষণ অব্যাহত রাখিবার জন্য পীড়ন-যন্ত্র অর্থাৎ শাসন-ক্ষমতা বা রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যতীত একদিনও টিকিয়া থাকিতে পারে না ।
=====================================
এই প্রকারের রাষ্ট্রই নিজ স্বার্থ রক্ষার জন্য, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ বিগ্রহ পরিচালনার জন্য শেষ পর্যন্ত আর্থিক ও সামরিক দিক হইতে শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির সাহায্যপ্রার্থী হইতে বাধ্য হয় । এই আর্থিক ও সামরিক সাহায্য লাভের শর্ত হিসাবেই এই প্রকারের রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির আজ্ঞাবহ ভৃত্যে পরিণত না হইয়া পারে না,-- যেমন হইয়াছে তথাকথিত স্বাধীন ভারতরাষ্ট্র ।
=====================================
"উৎপীড়িত জাতিসমূহের মুক্তি ও স্বাধীনতা ব্যতীত সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার কথা যেমন ভাবা যায় না, তেমনই বিভিন্ন জাতির উপর উৎপীড়ন ব্যতীত ধনতন্ত্রের অর্থাৎ বুর্জোয়া শাসনের অস্তিত্বের কথাও চিন্তা করা যায় না । যতদিন পর্যন্ত কৃষক জনসাধারণ এবং পাতিবুর্জোয়াশ্রেণী জাতীয়তাবাদের মোহে আচ্ছন্ন হইয়া থাকিবে এবং বুর্জোয়াশ্রেণীর নির্দেশে পরিচালিত হইবে, ততদিন উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ অনিবার্য । কিন্তু যখনই কৃষক জনসাধারণ শ্রমিকশ্রেণীর অনুগামী ও শ্রমিকশ্রেণীর নির্দেশে পরিচালিত হইবে তখনই বিভিন্ন জাতির মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হইবে, এক জাতির উপর হইতে অন্য জাতির শোষণ-উৎপীড়নের অবসান ঘটিবে এবং জাতিসমূহের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত হইবে ।" - স্তালিন
=====================================
মার্কস-এঙ্গেলস তাঁহাদের 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'-তে জাতি-সমস্যাটিকে কোন সংকীর্ণ জাতিগত দৃষ্টিকোণ হইতে বিচার না করিয়া শ্রমিকশ্রেণীর আন্তর্জাতিক আদর্শ দ্বারাই বিচার করিয়াছেন এবং দেখাইয়াছেন যে, কেবল শ্রমিকশ্রেণীর আন্তর্জাতিকতা দ্বারাই এই সমস্যার পূর্ণ সমাধান সম্ভব । এই শ্রমিক আন্তর্জাতিকতাই সমগ্র 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'র মূল আদর্শ । তাই 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো' ঘোষণা করিয়াছে :
"অন্যান্য শ্রমিক পার্টি ও কমিউনিস্টদের মধ্যে পার্থক্য এই যে, - (১) বিভিন্ন দেশের শ্রমিকশ্রেণীর জাতীয় সংগ্রামে কমিউনিস্টরা সমগ্র শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থকে সংকীর্ণ জাতীয়তার প্রশ্ন হইতে স্বতন্ত্রভাবে বিচার করিবে এবং সেই ভাবেই এই প্রশ্নের উপর গুরুত্ব আরোপ করিবে; (২) বুর্জোয়াশ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রাম যে সকল বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করিয়া অগ্রসর হইবে, সংগ্রামের সেই সকল স্তরে কমিউনিস্টরা সকল সময় এবং সমগ্র শ্রমিক-সংগ্রামেরই প্রতিনিধিত্ব করিবে ।"
ইহাই জাতিগত প্রশ্নে কমিউনিস্টদের বিচারের মূল ভিত্তি । শ্রমিকশ্রেণী সকল প্রকারের শোষণ-উৎপীড়নের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করে । সুতরাং তাহারা তাহাদের শ্রেণীগত আদর্শ হিসাবেই প্রত্যেকটি উৎপীড়িত জাতির স্বাধীনতা-সংগ্রামও সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে । কিন্তু তাই বলিয়া শ্রমিকশ্রেণী কখনও "ন্যায়-অন্যায় যাহাই করুক না কেন আমার জাতি, আমার দেশ" অথবা "আমার দেশ সবার ঊর্দ্ধে"-প্রভৃতি বুর্জোয়া ও পাতিবুর্জোয়া নীতি সমর্থন করে না । কোন জাতির মুক্তি-সংগ্রামের গতি প্রকৃতি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের দিকে কিনা তাহা বিচার করিয়াই শ্রমিকশ্রেণী জাতীয় সংগ্রাম সমর্থন করে ।
=====================================
মার্কসবাদীদের মতে, যে প্রতিক্রিয়াশীল শাসন ও শোষণব্যবস্থা ক্ষুদ্র-বৃহৎ সমস্ত জাতির স্বাধীন বিকাশ ও স্বাধীন অস্তিত্বের পক্ষে বাধাস্বরূপ, সেই শোষণ ও শাসন-ব্যবস্থার ধ্বংস সাধনেই প্রত্যেকটি জাতির মূলস্বার্থ রক্ষিত হইতে পারে । সুতরাং জাতীয় স্বাধীনতার জন্য যে সংগ্রাম পরিচালিত হয় তাহা নিঃসন্দেহে প্রগতিশীল । কিন্তু সেই সংগ্রাম আন্তর্জাতিক মুক্তি-সংগ্রামের সহিত কতখানি সম্পর্কযুক্ত তাহাই উহার প্রগতিশীলতার মাপকাঠি । এই জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম যে পরিমাণে বিশ্বের সমগ্র মানবজাতির পশ্চাদপদ অবস্থা ও শোষণ-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে এবং অগ্রগতির জন্য আন্তর্জাতিক সংগ্রামের সহিত সম্পর্কযুক্ত হইবে, জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম কেবল ততখানিই প্রগতিশীল বলিয়া গণ্য হইবে । আন্তর্জাতিক সংগ্রাম হইতে বিচ্ছিন্ন জাতীয়তাবাদকে শ্রমিকশ্রেণী বা মার্কসবাদ অগ্রাহ্য করে ।
=====================================
মার্কস-এঙ্গেলস উৎপীড়ক দেশের শ্রমিকশ্রেণীর কর্তব্য বিশেষভাবে নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন । যে প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা ঐ রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন জাতির শোষণ-উৎপীড়নের জন্য এবং প্রতিবেশী দেশসমূহকে গ্রাস করিবার জন্য ব্যবহৃত হয়, সেই রাষ্ট্রের শ্রমিকশ্রেণী কখনও তাহাদের তথাকথিত পিতৃভূমিকে সমর্থন করিতে পারে না । সেই রাষ্ট্র-ক্ষমতার বিরুদ্ধেই শ্রমিকশ্রেনীকে সংগ্রাম করিতে হইবে ।
=====================================
১৯৬৪ সালে আমেরিকার নিগ্রো জনসাধারণের সংগ্রাম সমর্থন করিবার জন্য সমস্ত বিশ্বের জনসাধারণকে আহবান জানাইয়া মাও সে-তুঙ লিখিয়াছিলেন :
"শেষ বিশ্লেষণে জাতীয় সংগ্রাম মূলত শ্রেণী সংগ্রাম ।"
=====================================
রাজনীতিক ও সামাজিক মুক্তি কেবল বিপ্লবের দ্বারাই সম্ভব । সুতরাং বলা যায় : 'প্রত্যেকটি শোষিত জাতি ও শ্রেণীর পক্ষে বিপ্লবই মূল প্রশ্ন ।' - মাও সে-তুং
=====================================
জাতীয় বিপ্লব জাতির জনসাধারণের - শ্রমিক কৃষকের - প্রত্যেকটি শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেণীর বিপ্লবের প্রশ্ন । কারণ, জাতির সর্বাধিক জনসংখ্যার - শ্রমিক-কৃষক ও অন্যান্য শোষিত শ্রেণীর স্বার্থই জাতীয় স্বার্থ । সুতরাং জাতীয় মুক্তির অর্থ, শোষণ-উৎপীড়ন হইতে জাতির সর্বাধিক জনসংখ্যার, বিশেষত শ্রমজীবী জনসাধারণের, শ্রমিক-কৃষকের মুক্তি ।
=====================================
ভারতের সংশোধনবাদী কমিউনিস্ট নেতৃত্ব সেদিন অর্থাৎ ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলমানের মিলন ও ঐক্যের অজুহাতে কেবল ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দুস্থান-পাকিস্তান এই দুই ভাগে ভারত ভাগের সহায়তা করিয়া মার্কসবাদকে কবরস্থ করিয়াছিল ।
ধর্ম জাতিত্বের কোন নিয়ামক উপাদান হইতে পারে না - এই মার্কসবাদী সত্যটিকে সংশোধনবাদী কমিউনিস্ট নেতৃত্ব সেদিন অস্বীকার করিয়াছিলেন । জাতি-সমস্যার সমাধান যে কেবল বিপ্লবের মধ্য দিয়াই সম্ভব - মার্কসবাদের এই মহাসত্যটিকে এড়াইবার জন্যই কমিউনিস্ট নেতৃত্বের এই বিশ্বাসঘাতকতা ।
=====================================
সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী শ্রেণী বলিয়া শ্রমিকশ্রেণীই হইবে ভারতের ঐক্যবদ্ধ বৈপ্লবিক 'ফ্রন্টের' নায়ক ও সংগঠক । শ্রমিকশ্রেণী একটি আন্তর্জাতিক বিপ্লবী শক্তি । তাই শ্রমিকশ্রেণী জাতি-বন্ধন ও দেশ-বন্ধনের ঊর্ধ্বে । এই জন্য একমাত্র শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বেই জাতি-উপজাতিসমূহের মুক্তি-সংগ্রাম, আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম, মুক্ত জাতি-উপজাতিসমূহের সমাজতন্ত্রের পথে জয়যাত্রার সংগ্রাম সফল হইতে পারে । ভূমির বন্ধনে আবদ্ধ কৃষক-সম্প্রদায়কে একমাত্র শ্রমিকশ্রেণীই পারে সামন্ততন্ত্রের বন্ধন হইতে মুক্ত করিয়া সমাজতন্ত্রের পথে চালিত করিতে । তাই ভারতের শ্রমিকশ্রেণীই হইবে ভারতের ঐক্যবদ্ধ বৈপ্লবিক 'ফ্রন্টের' জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের চালক-শক্তি ।
শ্রমিকশ্রেণী একটি অখণ্ড সর্বভারতীয় শক্তি । বাহিরের দিক হইতে জাতিগতভাবে বিভক্ত হইলেও শ্রেণীগতভাবে ইহারা এক ও অখণ্ড, শ্রেণী-চরিত্রের দিক হইতে অবিভাজ্য । ভারতের শ্রমিকশ্রেণী আজ একটি সর্বভারতীয় বিপ্লবী রাজনীতিক শক্তিরূপে আবির্ভূত, বৈপ্লবিক ভূমিকায় সুপ্রতিষ্ঠিত । তাই ভারতের বিভিন্ন জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামগুলিকে শ্রমিকশ্রেণীই জাতীয় পরিসরে সংগঠিত করিবে, ইহাদের মধ্যে ঐক্য গড়িয়া তুলিবে । ভারতের শ্রমিকশ্রেণীই শহরাঞ্চলের শোষিত মধ্যশ্রেণীর সংগ্রাম, জাতীয়-বুর্জোয়াগোষ্ঠীর সংগ্রাম গড়িয়া তুলিবে, এই সংগ্রামগুলিকে পরিচালিত করিবে এবং এক বৈপ্লবিক 'ফ্রন্টে' ঐক্যবদ্ধ করিবে ।
ভারতের শ্রমিকশ্রেণীই হইবে বিভিন্ন জাতি-উপজাতির এবং বিভিন্ন অঞ্চলের খন্ড খন্ড গণতান্ত্রিক বিপ্লবসমূহের সংগঠক, ঐক্যসাধক ও পরিচালক । শ্রমিকশ্রেণীর পরিচালনায়ই এই জাতীয় ও উপজাতীয় বিপ্লবসমূহ বিচ্ছিন্ন না থাকিয়া এক মহাজাতীয় বিপ্লবে পরিণত হইবে এবং দ্রুত গণতান্ত্রিক স্তর উত্তীর্ণ হইয়া সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে প্রবেশ করিবে ।
=====================================
"মানব-সমাজ যে বিভিন্ন রাষ্ট্রে ও জাতিতে বিভক্ত হইয়া রইয়াছে কেবল তাহার অবসান ঘটানোই সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য নয়, কেবল জাতিসমূহের বাহ্যিক মিলন ঘটানোই সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য নয় , সকল মানুষ যাহাতে মিলিয়ে মিশিয়া একাকার হইয়া যায় তাহাই সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য । ... উৎপীড়িত শ্রেণীসমূহের একনায়কত্বের পরিবর্তনশীল যুগের মধ্য দিয়া যাহাতে মানব জাতির মধ্য হইতে সকল শ্রেণীর অস্তিত্ব লোপ পায়, যাহাতে উৎপীড়িত জাতিসমূহ বিচ্ছিন্নতা ও স্বাধীনতার যুগের মধ্য দিয়া শেষ পর্যন্ত পূর্নমুক্তি লাভ করিয়া মিলিয়ে একাকার হইয়া যাইতে পারে তাহাই সমাজতন্ত্রের চরম লক্ষ্য ।" - Lenin : The Significance of Self-Determination
No comments:
Post a Comment