"তাঁদের বয়স একুশ-বাইশ । তাঁরা কেবল বামফ্রন্ট সরকারের দুর্বলতাগুলিই প্রত্যক্ষ করেছেন । কংগ্রেস (আই) শাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতা তাঁদের নেই । তাঁরা কংগ্রেস (আই)-র আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসও প্রত্যক্ষ করেননি । .... ১৯৮২ সাল থেকে মধ্যবিত্তদের একটা অংশ ও গ্রামাঞ্চলের একটা অংশের মধ্যে আমাদের রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস পাচ্ছে । কংগ্রেস (আই)-র কর্মী ও ছেলেমেয়েরা তখন থেকেই খুবই সক্রিয় । তারা সবাই গুন্ডা বা সমাজবিরোধী নয় । তারা জনগনের মধ্যে যাচ্ছে । সরকারী কাজকর্মে এবং পার্টি ও বামফ্রন্টের কাজকর্মে আমাদের দুর্বলতা, ব্যর্থতা রয়েছে । আমাদের আচরণ, ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহার, দুর্নীতির (যদিও খুব সামান্য ক্ষেত্রে) ঘটনার প্রশ্নটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে । কমিউনিস্টরা যে কংগ্রেস থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের - সেটাই জনগণ আমাদের কাছে প্রত্যাশা করেন ।"
"আমাদের অসাফল্য ও ব্যর্থতার কারণগুলি অর্থাৎ আর্থিক ও সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার কথাগুলি সুনির্দিষ্টভাবে ও পরিষ্কারভাবে জনগণকে বোঝানো - এটাই জরুরি রাজনৈতিক কর্তব্য ।"
"প্রধান বিষয় হলো : জনসাধারণের মধ্যে দৈনন্দিন লাগাতার কর্মতৎপরতার স্লোগান কার্যকর করো, তাঁদের রাজনৈতিক চেতনার মান উন্নত করার জন্য নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস চালিয়ে যাও এবং পার্টির ভিতরে শুদ্ধিকরণের অভিযান অব্যাহত রাখো । যেন প্রতিটি ক্ষেত্রে -- সরকারী কাজকর্মে, আমাদের আচরণে, আমাদের জীবন যাপনের ধারা (লাইফ স্টাইল) ইত্যাদিতে জনগণ যে আমাদের ও কংগ্রেস (আই)-র মধ্যেকার পার্থক্য বুঝতে পারেন। ... । আমাদের নিজেদের চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে এসে বিভিন্ন মাধ্যমের সাহায্যে (ক্লাব, পাঠাগার, খেলা-ধুলা, সাংস্কৃতিক সংগঠন) ব্যাপক অভিযানের পরিকল্পনা নিতে হবে । যে জনগণ মনস্থির করেননি, তাঁদের কাছে বেশি করে পৌঁছাতে হবে । ধৈর্যশীল মনোভাব নিয়ে তাঁদের বোঝাতে হবে ।"
"১৯৮৪ - ৮৫ সালে বাজেট ঘাটতি প্রথমে দেখানো হয়েছিল ১৯০০ কোটি টাকা । যদিও বাস্তবে প্রায় ছ'মাসেই তা দিয়ে দাঁড়িয়েছিল পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি । ঐ বাজেটে প্রথমে রাজীব সরকারও কত সব নয়ানীতির কথা তুলেছিল । একুশ শতকের কথা রাজীব গান্ধী একটু বেশি বলতেন । সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নয়া অর্থনৈতিক নীতির কথা । উন্নত কারিগরি বিদ্যা ও দ্রুত শিল্পায়নের ধুয়ো তুলে রাজীব সরকার যে নয়া নীতির কথা বলেছিল, তার মূল শর্তগুলি ছিল একরকম - বেসরকারি ক্ষেত্রকে আরো 'স্বাধীনতা' দেওয়া, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে খাটো করা ও ক্রমশ তুলে দেওয়া, এবং বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির কচি ভারতের বাজার উন্মুক্ত করা ।"
"বিরোধী ঐক্য গড়তে গিয়ে আমাদের পার্টি মূলত দেখছে, তারা যেন সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির সঙ্গে আপস রফার পথ বর্জন করে এবং সমস্ত সাম্প্রদায়িক ও বিভেদপন্থী শক্তিগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বামপন্থী শক্তিগুলির সঙ্গে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে । কিন্তু এসব পার্টির অনেকেই নির্বাচনী লাভের জন্য বিজেপি-র সঙ্গে সমঝোতার পক্ষপাতী । সেই সঙ্গে তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তি ও শক্তি আছে যারা বামপন্থীদের সঙ্গে একই অবস্থান নিতে চায় এবং সেহেতু প্রতিক্রিয়াশীল পার্টিগুলির সঙ্গে সমস্ত বোঝাপড়া বর্জন করতে চায় ।"
" রাজীব সরকার একদিকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং আর এস এস-কে বিতর্কিত জমিতে রাম জন্মভূমি মন্দির নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে, আবার একই সঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বাবরি মসজিদ ভাঙা হবে না বলে এবং তাদের আইনগত অধিকার সুরক্ষিত থাকবে বলে আশ্বাস দিয়েছে ।"
"আইনের চৌহদ্দির মধ্যে নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাস বা সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ড চালাবার অধিকার যে কোনো সংগঠন বা গোষ্ঠীর যেমন আছে, তেমনই তাদের এসব বিশ্বাস বা কাজকর্মের জন্য অন্য সংগঠন বা গোষ্ঠীর স্বার্থহানি ঘটতে পারে, তেমন কোনো কিছু রাজ্য সরকার করতে দিতে পারে না । "
"প্রতিক্রিয়ার শক্তিকে আঘাত হানার ঐতিহাসিক দায়িত্ব আমাদের । তাই পৌঁছতে হবে সেই মানুষদের কাছে, যাঁদের ভুল বোঝাতে ওরা সক্ষম হয়েছে । একদিকে অব্যাহত রাখতে হবে উন্নয়নমূলক কাজের ধারা, অন্যদিকে আরো নমনীয় হতে হবে আমাদের । বারবার যেতে হবে মানুষের কাছে । জবাব দিতে হবে হবে সমস্ত প্রশ্নের । মানুষের চেতনার মান উন্নত করতে হবে ।"
"আমরা সংরক্ষণের বিরোধী নই । অনগ্রসরদের উন্নতি ঘটানোর জন্য সংরক্ষণ দরকার । অন্তত বর্তমান অবস্থায় । কিন্তু সংরক্ষণই একমাত্র সমাধান নয় । এছাড়া সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক মানদন্ডই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । অর্থনৈতিক মানদন্ডকে বাদ দিয়ে, জাতপাত ভিত্তিক বিভেদকামীরা মাথা চাড়া দেবে এবং এতে প্রতিক্রিয়ার হাতই শক্ত হবে ।"
"২৫ জুন আমি চতুর্থবারের জন্য মুখ্যমন্ত্রীপদে শপথ নিলাম । শপথ নিলেন অন্যান্য মন্ত্রীরা । শপথ নেবার পর অনেকেই, বিশেষত সাংবাদিকরা সব রেকর্ডের কথা বলছিলেন । টানা চতুর্থবার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে রেকর্ড হয়েছিল কি না জানি না, তারপর তো পঞ্চমবারও আমরা জিতেছি । এ তো ব্যক্তিগতভাবে আমার সাফল্য ছিল না । আমি পার্টির দেওয়া দায়িত্ব করি । জনগণ আমাদের পার্টির উপর, বামফ্রন্টের উপর আস্থা রেখেছেন, এটাই বড় কথা । এতে যে দায়িত্ব কত বেড়ে গিয়েছিল, কত বেড়ে যায় একথাই আমি বারবার বলি । আরো দায়িত্ব পালনের যোগ্য হয়ে উঠতে হবে আমাদের ।"
"পি ভি নরসিমা রাওয়ের নতুন সরকার তার অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের হাত দিয়ে যে নয়া অর্থনীতি হাজির করল, তা বলা যেতে পারে নতুন সরকারের প্রথম জনবিরোধী সিদ্ধান্ত । রাজীব গান্ধীর আমলের উদারনীতিবাদ আমাদের জাতীয় অর্থনীতির গোড়ায় আঘাত করেছিল । এখন অর্থনীতির বেসরকারিকরণ, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে আস্তে আস্তে তুলে দেওয়া, বিদেশী পুঁজির নাম করে দেশের বাজার খুলে দেওয়ার জন্য এবং আমাদের দেশের একচেটিয়া পুঁজি যাতে বাড়ে তার জন্য সমস্ত বাধানিষেধ তুলে দেবার জন্য চাপ আসছিল । নয়া অর্থনীতি সেই চাপেরই ফসল । আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারের কাছে আরো ঋণ পাওয়ার জন্য তাদের শর্ত মানতে গিয়ে আমাদের দেশ ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে এবং দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিচ্ছে । কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার মাত্র চার সপ্তাহের মধ্যে নরসিমা রাও সরকারের গৃহীত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলি দেশের বুকে এক নয়া সর্বশক্তি হাজির করল । "
"২৮তম কংগ্রেস সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের প্রক্রিয়াকে আরো এগিয়ে নিয়ে এল । কংগ্রেসের গৃহীত প্রস্তাবে 'মানবিক ও গণতান্ত্রিক
সমাজতন্ত্রের' কথা বলে, শ্রেণী মূল্যবোধের বদলে তথাকতিত 'বিশ্বজনীন মানবিক মূল্যবোধের' স্থান দেওয়া হলো । দলিলে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে কোনো সংঘাতের কথা বাতিল করে, তাদের সাহায্যেই তথাকতিত 'নিরাপদ ও সভ্য বিশ্বব্যবস্থা' গড়ে তোলার কথা বলা হলো ।
শুধু তাই নয়, সি পি এস ইউ নেতৃত্ব ত্রুটি সংশোধনের বদলে ২৯তম কংগ্রেসের জন্য তৈরি খসড়া কর্মসূচিতে পরিষ্কার ভাবে বলে দিল যে, আজকের সমাজে কোনো শ্রেণী-বিভাজন নেই, শ্রম ও পুঁজির মধ্যে বৈরিতা নেই এবং সাম্রাজ্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের
মধ্যে কোনো বৈরিতা নেই, কোনো সংঘাত নেই । ভাবতেও অবাক লাগে যে, এসব কথা ওঁরা কীভাবে বললেন । সারা বিশ্বের প্রকৃত অবস্থার থেকে এ-যেন মুখ ফিরিয়ে নেওয়া । এসব কথা সাম্রাজ্যবাদীদের উল্লসিত করে তুলল । প্রতিবিপ্লব
সুযোগ পেয়ে গেল ।"
"আমরা মার্কসবাদীরা একথাই বলি যে, মানুষের কাছে যাও, সেখান থেকে শিক্ষিত হও ।"
"এই কঠিন মতাদর্শগত আক্রমণের চাপ সহ্য করতে না পেরে বহু দেশেই কমিউনিস্ট পার্টি নিজেই মার্কসবাদ-লেনিনবাদ পরিত্যাগ করে আকঁড়ে ধরছে সোস্যাল ডেমোক্র্যাসি । চতুর্দশ কংগ্রেস সঠিকভাবে বলেছিল যে, চিরকালই সোস্যাল ডেমোক্র্যাসি হচ্ছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে সংস্কারের মতাদর্শ । এটি হলো শ্রেণীসংগ্রামের বদলে শ্রেণী সমঝোতার লাইন । তাই এটা বিপদ এবং এই মতাদর্শগত আক্রমণকে সরাসরি মোকাবিলার জন্য আমরা বলেছিলাম যে, এ অবস্থায় গণ-আন্দোলনের বিকাশ, মতাদর্শগত শুদ্ধতার প্রতি বিশ্বস্ততা রক্ষা করার ওপরই নির্ভর করছে, সাম্রাজ্যবাদের বর্ধিত বিপদকে কতটা মোকাবিলা করা যাবে ।"
"৬ ডিসেম্বর বর্বরেরা ভেঙে দিল বাবরি মসজিদ । গোটা বিশ্বের কাছে মাথা হেঁট করে দিল আমাদের ।"
"১৯৯৫ সাল
শেকসপিয়ার বার্থপ্লেস ট্রাস্টের ডিরেক্টরকে আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি আবক্ষ মূর্তি উপহার দিই । ভারতের হাইকমিশনার ড. এস এম সিংভি এ ব্যাপারে অনেক আগে থেকে উদ্যোগী হয়েছিলেন । রবীন্দ্রনাথের মূর্তিটি শেকসপিয়ারের জন্মস্থানের বাগানে রাখা হবে । খুব সুন্দর সময় কেটেছিল । যদিও বেশিক্ষণ থাকা হয়নি । সেবার লন্ডনের নেহেরু সেন্টারেও রবীন্দ্রনাথের একটি মূর্তি উপহার দিয়েছিলাম । এই মূর্তি বিখ্যাত ভাস্কর সোমনাথ হোড়ের তৈরি ।"
"জাতীয় রাজনীতিতে আমাদের মর্যাদা বেড়েছে । সেই অনুপাতে সাংগঠনিক ক্ষমতা বাড়েনি । সুষম বিকাশ হয়নি । এটা কাটিয়ে উঠতে হবে, যত দ্রুত সম্ভব ।"
"পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট পঞ্চমবার মন্ত্রিসভা গঠন করলেও আগামী দিনে আত্মসন্তুষ্টি বা শৈথিল্যের কোনো স্থান নেই । আমাদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে । জনগণ আমাদের কাছে অনেক বেশি প্রত্যাশা করেন । গোটা দেশ তো বটেই বিদেশের মানুষও আজ ভারতের বামপন্থীদের দিকে তাকিয়ে আছেন । খেটে খাওয়া মানুষের অনেক আশা আমাদের উপর । জনগনকে রিলিফ দেবার জন্য যথাসাধ্য করতে যেমন হবে, তেমনই তাঁদের রাজনৈতিক চেতনার মান বাড়াতে হবে । এ কাজ কমিউনিস্টরাই পারে । কারণ, শুধু সরকার গঠনের মধ্যে আমাদের লক্ষ্য পূরণ হয়ে যায় না । সামাজিক রূপান্তরের পথ অনেক জটিল । অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে সেই পথ অতিক্রম করতে হয় । এর কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই ।"
No comments:
Post a Comment