Tuesday, 15 December 2015

যত দূর মনে পড়ে - জ্যোতি বসু (১)

"আমার মনে আছে, আমরা লন্ডন থেকে চলে আসার আগে রজনী পাম দত্ত, হ্যারি পলিট, বেন ব্র্যাডলে প্রমুখ সি পি জি বি- নেতারা আমাদের বলেছিলেন, ভারতে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী যুক্তফ্রন্টের কৌশলই হলো সঠিক কৌশল

"তখন তেলেঙ্গানার সংগ্রাম প্রত্যাহৃত, কিন্তু বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়নি ....শ্রীমতী মৃদুলা সারাভাই-এর সাহায্যে নেহেরুর সঙ্গে আমার সাক্ষাত্কারের ব্যবস্থা হলো নেহেরুকে আমি তেলেঙ্গানায় বন্দিদের মুক্তি দেবার কথা বললাম নেহেরু সব শুনেটুনে বললেন, খোঁজ নিচ্ছি

নেহেরু আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁর পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে আমাদের পার্টির ধারণা কী ? আমি বললাম,'মোটামুটি ঠিকই আছে তবে কাশ্মীর-সমস্যা ভারতের আভ্যন্তরীণ সমস্যা, এখানে একজন বিদেশী (মার্কিন) নাগরিক পর্যবেক্ষক হিসাবে আছেন কেন, এটাই প্রশ্ন ' উত্তরে নেহেরু একটু চটে গিয়ে বললেন, 'আমি কমিউনিস্ট নই, --- সকলের সঙ্গে আমাকে যোগাযোগ সম্পর্ক রাখতে হবে', ইত্যাদি আমি নিয়ে আর কোনো যুক্তিতর্কের মধ্যে গেলাম না, কারণ আমি পার্টির প্রতিনিধি হিসাবে গিয়েছিলাম তেলেঙ্গানার রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির জন্য দরবার করতে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে "


"নিঃসন্দেহে বামপন্থী হঠকারিতার নীতি ঠিক ছিল না এই নীতি পার্টির অনেক ক্ষতিও করেছে কিন্তু পার্টির নীতিগুলি কার্যকর করার জন্য পার্টির ক্যাডাররা নিষ্ঠার বীরত্বের সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন, শহিদ হয়েছেন অনেক কমরেড জমির জন্য কৃষক-সংগ্রাম হয়েছে শ্রমিকরা তাঁদের দাবি আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছেন এই ইতিবাচক দিকগুলির কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না আমরা এই সময়ও জনগণকে পরিত্যাগ করিনি, জনগণের সঙ্গেই ছিলাম জনগনও আমাদের বর্জন করেননি ১৯৫২ সালের সাধারণ নির্বাচনে তার প্রমাণ পাওয়া গেল কংগ্রেস সরকার যখন ধরে নিয়েছে যে, কমিউনিস্ট পার্টিকে তারা খতম করে দিয়েছে, তখন আমাদের পার্টিকে তাৎপর্যপূর্ণ শক্তি নিয়ে বিধানসভায় প্রবেশ করতে দেখা গেল "

"
প্রখ্যাত সাংবাদিক সত্যেন মজুমদার সম্পাদকীয়তে পুলিস সম্পর্কে লেখেন, 'এরা জননীর জঠরের লজ্জা।'"

"
১৯৬৭ সালে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের শাসনকালের ট্রাম কোম্পানিকে সরকারি পরিচালনায় আনা হয় "

""
তিস্তা নদীর জলস্ফীতির দরুন উত্তরবঙ্গে বারে বারে বন্যা হয়েছে পূর্বতন কংগ্রেসি সরকারগুলি তিস্তা প্রকল্প রূপায়ণের কোনো চেষ্টা করেনি বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই প্রকল্পটি অগ্রাধিকার পায় "

"
আমাদের পার্টির নেতৃত্বে নিবর্তনমূলক আটক আইনের বিরুদ্ধে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক আন্দোলন চলেছিল ১৯৬৭ সালে কংগ্রেসের নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার আইনটির প্রয়োগ বন্ধ করে "

"
দার্জিলিঙের নেপালি এলাকায় পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দেবার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক এটাই পার্টির নীতি এই নীতির ভিত্তিতেই আমি আমার বক্তব্য পেশ করি বলাই বাহুল্য, কেন্দ্রের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার আমাদের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিল সে সময় আমাদের এই দাবিকে 'জাতি-বিরোধী' আখ্যা দেওয়া হয়েছিল চার দশকের লাগাতার আন্দোলন অভিযান কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারকে অবশেষে নতি স্বীকারে বাধ্য করেছে এর পেছনে ছিল পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের লাগাতার প্রয়াস "

"
বামপন্থী দলগুলির ঐক্যকে নেহরু 'সুবিধাবাদী ঐক্য' বলে পরিহাস করেছিলেন কিন্তু আমরা সে সভায় ঘোষণা করলাম, 'আমরা একটি কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি বামপন্থী দলগুলির ঐক্য শুধু আসন ভাগাভাগির ঐক্য নয় গত কয়েক বছরে বিভিন্ন আন্দোলন রক্তপাতের মধ্য নিয়ে এই সংগ্রামী ঐক্য গড়ে উঠেছে এই ঐক্য সাধারণ মানুষেরই সংগ্রামী ঐক্যের ফল '"

"
দেশীয় জমিদার বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে ভারতের মুক্তিসংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল তাই বিদেশী পুঁজির শোষণ বন্ধ করা ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম স্লোগান বাস্তবে কিন্তু তা কার্যকরী হলো না স্বাধীনতার পরও নিজেদের পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার জন্য নতুন করে দেশীয় বুর্জোয়ারা বিদেশী পুঁজিকে আমন্ত্রণ  শুরু করল "

"
আমাদের রাজনৈতিক প্রচার-আন্দোলনের ধারাকে আরো উন্নত করতে হবে, দেশ পুনর্গঠনের বিকল্প কর্মসূচি নিয়মিতভাবে নির্দিষ্টভাবে জনগনের বিভিন্ন অংশের নিকট প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে, আরো তীব্র ব্যাপক গণ-সংগ্রামের জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে, পার্টির মধ্যে যে-কোনো আত্মসন্তুষ্টির মনোভাব, স্বতস্ফূর্ততা নিস্ক্রিয়তা দূর করতে হবে, জনসাধারণের দুর্দশা, আশা-আকাঙ্খা উপলব্ধি করতে হবে তাঁদের সমস্যা সঠিকভাবে  আমাদের জন-সংযোগ আরো ব্যাপক গভীরতর করতে হবে, বামপন্থী ঐক্যকে সংহত আরো ব্যাপক করার জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে, বুর্জোয়া প্রভাব থেকে শ্রমিকশ্রেনীকে বিশেষত হিন্দি ভাষাভাষী শ্রমিকদের মুক্ত করার জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রচার শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, কৃষকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য এবং যাদের জমি আছে, এমন কৃষকদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির নীতি সম্বন্ধে ভীতি সৃষ্টি করার জন্য কংগ্রেস গ্রামের কায়েমি স্বার্থ যে অপপ্রচার চালাচ্ছে, সে বিষয়ে কৃষকদের সচেতন করতে হবে আমাদের পাল্টা প্রচার চালাতে হবে ...

"
দুর্দশাগ্রস্ত জনগণ কংগ্রেসি কুশাসনের পরিবর্তন চেয়েছিলেন, কিন্তু কাকে তাঁরা পছন্দ করবেন -বিষয়ে সঠিক অবস্থান নিতে হলে বর্তমান সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর মৌল পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাঁদের উপলব্ধি থাকা দরকার সে উপলব্ধিও জাগিয়ে তুলতে হবে, সেটাই আমাদের রাজনৈতিক সাংগঠনিক কাজ এটা অল্প সময়ের কাজ নয় জনগনের কংগ্রেসবিরোধী মনোভাবকে আমরা কমিউনিস্টদের সপক্ষে ঝোঁক বলে দেখার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু জনগনের স্বত:স্ফূর্ত মনোভাবকে রাজনৈতিক চেতনার, সমাজতন্ত্রী স্তরে উন্নীত না করলে তাঁরা বুর্জোয়া মতাদর্শের প্রভাবাধীনেই থেকে যান, একথাটি সকলে মনে রাখেননি "

"
সরকারগুলিতে আমাদের পার্টির অংশগ্রহণ হলো জনগনতন্ত্রের জন্য সর্বহারাশ্রেণী এবং তার মিত্রদের পক্ষে জনসাধারণকে বেশি বেশি সংখ্যায় টেনে আনার জন্য সংগ্রামের এক সুনির্দিষ্ট রূপ "

"
গণতান্ত্রিক পার্টিগুলির সঙ্গে আমাদের মৈত্রীবন্ধন একটা সুনির্দিষ্ট নীতির ওপরেই প্রতিষ্ঠিত এর ফলে কোনো শরিকেরই মতাদর্শগত, রাজনৈতিক সাংগঠনিক স্বাধীনতা বর্জন করা বোঝায় না এতে বোঝায় যে, মতাদর্শগত, রাজনৈতিক তত্ত্বগত অবস্থান বিভিন্ন রকমের হলেও জনবিরোধী একচেটিয়া কংগ্রেসি-শাসনের বিকল্প হিসেবে একটি সর্বসম্মত সর্বনিম্ন কর্মসূচি নিয়ে জনগণের স্বার্থে কাজ করা সম্ভব "

"
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে প্যারিসের পুলিশ ফ্রান্সের সমাজতন্ত্রীদের ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসবাদীদের সংগঠিত করেছিল সন্ত্রাসবাদীরা প্রথম দিকে কাজটা ঠিকভাবেই শুরু করেছিল কিন্তু শেষের দিকে যে শাসকশ্রেণী সন্ত্রাসবাদীদের সংগঠিত করেছিল, তাদেরই প্রতিনিধিদেরই হত্যা করার চেষ্টা করে তাই এতে বিস্ময়ের কিছু নেই, যে ছুরি এবং রিভালবার আমাদের কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল, তা আজ আপনাদের কিছু কর্মী নেতাদের বিরুদ্ধেও ব্যবহৃত হচ্ছে "

"
আমাদের ধারণা ছিল, নির্বাচনের আগে আমাদের বিরুদ্ধে যত হিংস্র আক্রমনই করুক না কেন, নির্বাচনের দিন  ভোট দিতে বেরুবেন, তখন অন্তত তারা নিজেদের সংযত করবে, তখন অন্তত প্রশাসন একটা বাহ্যিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে কিন্তু আমাদের সমস্ত কল্পনার বাইরে সিদ্ধার্থ রায় এবং তার ভৈরববাহিনী আপামর সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই যুদ্ধ ঘোষণা করল নিজেদের গণতন্ত্রের মুখোশকে নিজেরাই ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে দেখাল যে, ক্ষমতার লোভে কত বর্বর নৃশংস স্বৈরতন্ত্রী রূপ তারা ধারণ  করতে পারে আরেকবার, এই বাংলার মাটিতে প্রমাণিত হলো দুনিয়ার ইতিহাসের নির্ভুল সত্য --- আক্রমণ প্রথমে নেমে আসে কমিউনিস্টদের ওপর, তারপরে তা ছড়ায় সাধারণ মানুষের মাঝে "

"
আক্রমণ ক্ষুব্ধ হয়ে হঠকারিতা করা ভুল হবে, কিন্তু আক্রমণের মুখে আত্মসমর্পণ, মাথা ঠান্ডা রেখে সাহস দৃঢ়তার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চালাতে হবে "

"
আগের তুলনায় বেশি ত্যাগ নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে এগুতে হবে এটা সহজ নয়, কিন্তু কংগ্রেসি শাসকরা তাদের গুন্ডাবাহিনী এই অবস্থার মধ্যেই জনগণকে ঠেলে দিচ্ছে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকশ্রেণী, মেহনতি কৃষক, কর্মচারী, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র যুব সমস্ত গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের কাছে আমাদের আবেদন --- ঐক্যবদ্ধভাবে শাসক শ্রেণীর আক্রমনের মোকাবিলা করুন সংখ্যালঘু ভাইদের পাশে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে তাঁদের সাহায্য করুন ফ্যাসিবাদী জল্লাদরাজ্যের বিরুদ্ধে এক হয়ে রুখে দাঁড়ান যে কোনো বিপদই আসুক না কেন আমাদের পার্টি জনগণের পাশে থাকবে, বামপন্থী ঐক্যকে চোখের মণির মতো রক্ষা করবে ফ্যাসিবাদী বিপদের বিরুদ্ধে আরো ব্যাপকতর ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করবে

সমস্ত বামপন্থী পার্টির বিরুদ্ধেই আক্রমণ চলেছে, কিন্তু আমাদের পার্টির বিরুদ্ধে আক্রমণ  বেশি কেন্দ্রীভূত হয়েছে হাজার হাজার কর্মী দরদি আজ কঠিন বিপদের মুখে দাঁড়িয়েছে কিন্তু আমরা কমিউনিস্টরা এক বিশেষ জাতের মানুষ রক্ত ঝরিয়েও কেউ আমাদের সংগ্রামের পথ হতে বিচ্যুত করতে পারেনি এবং পারবে না হিংস্র শত্রুর আক্রমণে জনদের রক্ত ঝরেছে, যাঁরা নির্যাতিত হচ্ছেন, যাঁদের জীবিকা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, যাঁরা পরিবার-পরিজনসহ এলাকা হতে বিতাড়িত হচ্ছেন, যাঁরা  বছরের পর বছর কারাগারে বন্দি, তাঁদের সহজ সান্ত্বনা দিয়ে আমরা অপমানিত করতে পারি না, তাঁদের সহযোদ্ধার অভিবাদন জানাই "

"
জরুরি অবস্থার সময় সংবাদপত্রের ওপর নেমে এসেছিল মারাত্মক আক্রমণ প্রেস সেন্সরশিপ চালু করা হলো সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ করতে বোধহয় ইংরেজ আমলেও এরকম হয়নি ১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলনের সময় কিছু দিনের জন্য ব্রিটিশ সরকার প্রেস সেন্সরশিপ চালু করেছিল, কিন্তু তাতে শুধু সম্পাদকীয় আলোচনা সেন্সর করা হতো সংবাদ প্রকাশের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা ইংরেজ শাসকেরাও জারি করেনি সেই সময় নেতাদের গ্রেপ্তারের সংবাদ, পুলিশের লাঠিচার্জ, মিলিটারির গুলিচালনা, বিক্ষোভ-আন্দোলন-মিটিং ইত্যাদির খবর পেতে মানুষের কোনো অসুবিধা হয়নি সংবাদ জানার জন্য মানুষের নূন্যতম অধিকারকে সেদিন যতটুকু স্বীকৃতি ইংরেজরা দিয়েছিল, ইন্দিরা গান্ধী সেটুকুও কেড়ে নিলেন নির্মমভাবে রবীন্দ্রনাথও বাদ গেলেন না, তাঁর উদ্ধৃতি, গান পর্যন্ত সেন্সর করা হলো মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিনের কোনো রচনাবলি থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া নিষিদ্ধ হয়ে গেল ইন্দিরা গান্ধী তাঁর পরিবারের স্তাবকতা করে লেখা তৈরি করতে হতো বড় বড় কাগজের সাংবাদিকদের বিচারব্যবস্থার ক্ষমতা খর্ব করার জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা প্রকাশ্যেই প্রচার চালাতে থাকেন কুখ্যাত ৮২ তম সংবিধান সংশোধনটি সময় করা হয় "

"
প্রথম বামফ্রন্ট সরকার
২১ জুন রাজভবনে ঠিক সাড়ে দশটায় ফ্রন্ট মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করেছিল এদিন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আমি এবং মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন সি পি আই (এম)-এর  কমরেড কৃষ্ণপদ ঘোষ . অশোক মিত্র, আর এস পি- যতীন চক্রবর্তী এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের কানাইলাল ভট্টাচার্য ২৩ জুন আরো ১৬ জন মন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন পরে আরো জন মন্ত্রিসভায় যুক্ত হন শপথগ্রহনের পর মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় এছাড়া রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল হিসাবে নিযুক্ত হন স্নেহাংশু আচার্য দপ্তর বন্টনের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় শ্রমমন্ত্রী হন কৃষ্ণপদ ঘোষ অর্থ, পরিকল্পনা দপ্তরের ভার . অশোক মিত্রকে দেওয়া হয় ভূমি ভূমি রাজস্ব দপ্তর বিনয় চৌধুরীকে শিল্প বানিজ্য দপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয় কানাইলাল ভট্টাচার্যকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পঞ্চায়েত দপ্তরের সঙ্গে কারাবিভাগের দায়িত্ব পান আর এস পি দলের দেবব্রত বন্দোপাধ্যায় খাদ্য সরবারহ মন্ত্রী হন সুধীন কুমার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য হন তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রী

...
সরকার তো গঠিত হলো আগেই প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছিল, এবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, সরকারকে পরামর্শদানের জন্য ফ্রন্টের দলগুলির কয়েকজনকে নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হবে ২৫ জুন বামফ্রন্টের নেতৃবৃন্দের বৈঠক থেকে 'পশ্চিমবঙ্গ বামফ্রন্ট কমিটি' নামে এই কমিটি গঠিত হলো কমরেড সরোজ মুখার্জি প্রস্তাব করলেন, এবার আর কনভেনার নয়, ফ্রন্টের একজন চেয়ারম্যান থাকবেন এর আগে যুক্তফ্রন্টের সময় একবার সুধীন কুমার, আরেকবার নিরঞ্জন সেনগুপ্তকে কনভেনার করেই ফ্রন্টের কাজ চালানো হয়েছিল প্রমোদ দাশগুপ্তকে চেয়ারম্যান করার প্রস্তাব দিলে তিনি প্রথমে কিছুতেই রাজি হননি পরে অন্য দলগুলির অনুরোধে তিনি চেয়ারম্যান হতে রাজি হন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান হিসাবে তাঁর সুযোগ্য ভূমিকার কথা এরাজ্যের মানুষ চিরকাল মনে রাখবেন

সরকার গড়ার পরে এক কঠিন দায়িত্ব আমাদের উপর এসে পড়ল একটি বুর্জোয়া-জমিদার রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে অঙ্গরাজ্যে সরকার গঠন করে সাধারণ মানুষের স্বার্থে তাকে পরিচালনা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ কারণ, সংবিধান, আইন, প্রশাসন,আমলাতন্ত্র সবই কায়েমিস্বার্থের সুবিধার জন্য তৈরি রাজ্য সরকারগুলির হাতে আইনগত এবং আর্থিক ক্ষমতা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ আবার এই সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যেও কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ এসে পড়ে এই অবস্থায় সরকারে এসে ঘোষিত ৩৬ দফা কর্মসূচিকে রূপায়নের উপর আমরা জোর দিলাম আমাদের প্রথম কাজই ছিল সাধারণ মানুষের লুন্ঠিত গণতান্ত্রিক অধিকারকে ফিরিয়ে আনা মানুষের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করা

আমরা একথা উপলব্ধি করেছিলাম যে, বামফ্রন্ট সরকারকে আগের দুটি যুক্তফ্রন্ট সরকারের মতো সহজে ভেঙে দেওয়া যাবে না কারণ, আগের দুটি যুক্তফ্রন্ট সরকারের থেকে এই সরকারের শক্তি এবং জনসমর্থন ছিল অনেক বেশি তাছাড়া বামদলগুলিও অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ ছিল মানুষের এই সমর্থনকে মর্যাদা দিয়ে তাদের হাতে ক্ষমতাকে পৌঁছে দেওয়ার কাজ আমরা শুরু করলাম একারণেই সে সময় আমি বলেছিলাম, 'আমরা শুধু রাইটার্স বিল্ডিং থেকে সরকার চালাব না'

প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ঘোষিত ৩৬ দফা কর্মসূচির মধ্যে ২১ দফার পূর্ণ রূপায়ণ সম্ভব হয়েছিল বাকি ১৫ দফা কর্মসূচি রূপায়ণ করা গিয়েছিল আংশিকভাবে গ্রামাঞ্চলে গরিব মানুষের সামাজিক অর্থনৈতিক অধিকার অর্জনের পথকে সুনিশ্চিত করার জন্য ভূমিসংস্কারের কাজ অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে করা হয়েছিল একই সঙ্গে, ভাগচাষীদের উচ্ছেদ রোধের জন্য 'অপারেশন বর্গা' চালু করা, খেতমজুরদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, গ্রামে মহাজনি প্রথা অবসানের উদ্দেশ্যে কর ঋণভারের সুরাহা করার কাজ শুরু হলো

আগেই বলেছি, শপথ গ্রহণের পর প্রথম বৈঠকেই বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভা রাজনৈতিক আনুগত্য নির্বিশেষে সমস্ত বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কংগ্রেসি আমলে অপহৃত গণতন্ত্র নাগরিক স্বাধীনতার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল এই মুক্তি পাওয়া বন্দিদের মধ্যে ১৭০০ জন ছিলেন কংগ্রেস এবং বিভিন্ন নকশালপন্থী গোষ্ঠীর নেতা কর্মী কংগ্রেস সহ সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় দশ হাজার ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো সরকারি কর্মচারীদের ওপর যেসব দমনমূলক নির্দেশাবলি ছিল, সেগুলিও প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো বিনা বিচারে এতক, বিচারাধীন মামলা - সংবিধানের ৩১১ () () ধারায় যে সব সরকারি কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়েছিল, তাঁদের প্রাপ্য সমস্ত সুযোগ-সুবিধাসহ চাকরিতে পুনর্বহাল করা হলো রাজনৈতিক কারণে বরখাস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ফিরিয়ে আনা হলো এছাড়া। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শিল্পসংস্থার কর্তৃপক্ষের কাছেও সরকার আবেদন জানাল, যাতে তারাও রাজনৈতিক কারণে বরখাস্ত শ্রমিক-কর্মচারীকে পুনর্বহাল করে

গণতান্ত্রিক অধিকারকে শুধু পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করাই নয়, বামফ্রন্ট সরকার এই অধিকারকে সম্প্রসারিত করেছে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারকে এই সরকার প্রতিষ্ঠিত করে সংগঠন গড়ার অধিকার দেওয়া হয় পুলিশ কর্মীদের শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত দাবির ভিত্তিতে আন্দোলন বা ধর্মঘট ভাঙার জন্য সরকার পুলিশ পাঠাবে না, আমরা ঘোষণা করলাম রাজ্যে পঞ্চায়েত এবং পৌরসভাগুলিকে সক্রিয় করে তলার উদ্যোগ নেওয়া হলো দীর্ঘদিন ধরে এইসব স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলির নির্বাচন করা হয়নি এগুলির ক্ষমতাও ছিল অত্যন্ত সীমিত পঞ্চায়েত আইনকে সংশোধন করে ত্রিস্তর-পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা চালু করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটিয়ে মানুষের হাতে তা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলো নতুন এই পঞ্চায়েতের ভূমিকা কর্মধারা নিরুপণে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং আমাদের পার্টির নেতা সত্যব্রত সেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন "

"
১৯৭৯ সাল

এই সময় পশ্চিমবঙ্গ কেরালায় গো-হত্যা বন্ধের দাবিতে হঠাৎই আচার্য বিনোবা ভাবে পাটনার আশ্রমে অনশন শুরু করে দিলেন এর ফলে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল আমরা মানুষকে এই প্রশ্নে আমাদের নীতি খোলাখুলিভাবে বললাম গো-হত্যা নিষিদ্ধ করে কোনোমতেই আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠের খাদ্যাভ্যাসে সংখ্যালঘিষ্ঠের উপরে চাপিয়ে দিতে পারি না এতে খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের যে মৌলিক অধিকার রয়েছে, তাকেই লঙ্ঘন করা হবে ভাবেজিকে অনশন থেকে বিরত থাকতে জনতা পার্টির নেতা চন্দ্রশেখর, কেরালার মুখ্যমন্ত্রী নায়নারসহ আমরা অনেকেই আবেদন জানালাম অবশ্য কংগ্রেস (আই) এবং আর এস এস এবিষয়টি নিয়ে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাকে উশকানি দেওয়ার চেষ্টা করেছিল এসময় একদিন আমি নিজেই পাটনার আশ্রমে গিয়ে বিনোবা ভাবের সঙ্গে দেখা করি মনে আছে, ব্যাপারে স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দর কথাও তাঁকে বলেছিলাম তাঁকে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাইকেও অনুরোধ করি, এবিষয়ে তাঁকে হস্তক্ষেপ করতে অবশেষে, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিশ্রুতিতে বিনোবাজি অনশন প্রত্যাহার করে নেন "

No comments:

Post a Comment