১৯৯৪ সাল
ভূমি সংস্কারের ফলে কৃষির সাফল্যের
উপর দাঁড়িয়ে শিল্পায়নকে বামফ্রন্ট সরকার প্রথম থেকেই
গুরুত্ব দিয়ে এসেছে ।
কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাড়তি উদ্যোগ ও
উদ্যম প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল ।
এ জন্য রাজ্য সরকারের
বাণিজ্য এবং শিল্প দপ্তরকে
শক্তিশালী করা হয় ।
পশ্চিমবঙ্গ শিল্প উন্নয়ন নিগমের
কাজকর্মকেও চাঙ্গা করার সিদ্ধান্ত
নেওয়া হয় । সেপ্টেম্বর
মাসের মাঝামাঝি আমাদের পার্টির বিশিষ্ট
সাংসদ সোমনাথ চ্যাটার্জিকে শিল্প
উন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান পদে
দায়িত্ব দেওয়া হয় ।...
...সেপ্টেম্বরের
১৩ তারিখে রাজ্যের শিল্পোন্নয়নের
রূপরেখা সংক্রান্ত একটি নীতি-বিবৃতি
আমি বিধানসভায় পেশ করেছিলাম ।
একটা কথা স্পষ্ট করেই
মনে রাখার দরকার যে,
এটিকে 'নীতি-বিবৃতি' হিসাবে
চিহ্নিত করা হয়েছে ।
একথা বলার কারণ হচ্ছে
বড় ও মাঝারি শিল্পের
ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার কখনো
একাই স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ নীতি
ঘোষণা করতে পারে না
। সংবিধান অনুযায়ী
এই বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের
আওতার মধ্যে । তাই
কোন প্রেক্ষাপটে এই দলিলটি আমরা
পেশ করেছিলাম, তা এর গোড়াতেই
বলে দেওয়া আছে ।...
...আমি
লক্ষ করেছি, বামফ্রন্ট-বিরোধী
মহল থেকে আমাদের বিরুদ্ধে
প্রধানত দুটি বিষয় তোলা
হয়েছে । এক
: নির্বাচন বৈতরণী পার হওয়ার
জন্য বামফ্রন্ট শিল্পায়নের হওয়া তুলেছে ।
এক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা নেই । দুই
: বামফ্রন্ট যখন কেন্দ্রীয় সরকারের
নতুন আর্তিক নীতি ও
শিল্পনীতির বিরোধিতা করছে, তখন কার্যত
সেই নীতিই বামফ্রন্ট সরকার
কার্যকর করছে পশ্চিমবঙ্গে ।
তখন, এমনকি প্রধানমন্ত্রী রাও
ও তাঁর অর্থমন্ত্রী দেশে-বিদেশে এসব কথা
বলেছেন । বামফ্রন্ট
বিরোধী সংবাদপত্র মহল এখনো বলে
চলেছে ।
বলা বাহুল্য, এসব দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য
যাঁরা করছেন তাঁরা একটি
সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই এটা করেছেন
। একথা সকলেরই
জানা, কেন্দ্রে কংগ্রেস থাকা কালে ধারাবাহিক
ও সীমাহীন বঞ্চনার ফলেই পশ্চিমবঙ্গ ও
পূর্ব ভারত বড় ও
মাঝারি শিল্পক্ষেত্রে গত তিনদশক উল্লেখযোগ্য
কোনো অগ্রগতি করতে পারেনি ।
এর জন্য দায়ী কেন্দ্রীয়
সরকার । পশ্চিমবঙ্গের
অগ্রগতিকে বাধা দেবার উদ্দেশ্যে
কেন্দ্রীয় সরকার কার্যত অর্থনৈতিক
অবরোধ তৈরী করেছিল ।
এর ফলে রাজ্যের বিপুল
ক্ষতি হয়েছে । আমি
আগেও বহুবার বলেছি, এখনো
বলেছি যে প্রধানত চারটি
বিষয়কে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় সরকার
আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অবরোধ সৃষ্টি করেছিল
:
১ । মাসুল
সমীকরণ নীতি
২ । শিল্প-অনুমোদন প্রথা
৩ । কেন্দ্রীয়
বিনিয়োগ এবং বরাত সংক্রান্ত
নানা নির্দেশ
৪ । আর্থিক
প্রতিষ্ঠান গুলির বিরূপ আচরণ
... ভৌগোলিক
ও প্রাকৃতিক কারণে পশ্চিমবঙ্গের এই
সুবিধাজনক অবস্থান জবরদস্তি কেড়ে নেওয়া হয়েছিল
। লৌহ ও
ইস্পাতশিল্পের ক্ষেত্রে এই নীতি ১৯৫৬
সাল থেকে ১৯৯২ সালের
১৫ জানুয়ারী পর্যন্ত কার্যকর ছিল । সারা
দেশে সুষম শিল্পবিকাশের দোহাই গুরুত্বপূর্ণ
কাঁচামালের ক্ষেত্রে এই নীতি চালু
করা হয়েছিল । ... সংসদে ও বাইরে গণ-আন্দোলনের চাপে কেন্দ্রীয় সরকার
বি ডি পান্ডের নেতৃত্বে
একটু কমিটি গঠন করে
এই নীতিটি পর্যালোচনা করার
সুপারিশ করার জন্য ।
পান্ডে কমিটি পর্যায়ক্রমে এই
আইন প্রত্যাহার করার সুপারিশ করে
১৯৮২ সালে । তারপরও
কেন্দ্রীয় সরকার দীর্ঘ দশ
বছর এটা চালু রাখে
। ১৯৯২ সালের
১৬ জানুয়ারী থেকে এটা আংশিক
প্রত্যাহৃত হয় । এরই
সঙ্গে লৌহ ও ইস্পাতের
ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার এমন কতগুলি
সিদ্ধান্ত গঘোষণা করে, যাতে
পশ্চিমবঙ্গ আপেক্ষিক-সুবিধা থেকে বঞ্চিত
হয় ।
মাসুল
সমীকরণ নীতি প্রত্যাহার করার
পর দেখা যায়, পরবর্তী
৪৪ মাসে ১০০ টিরও
বেশি লৌহ এবং ইস্পাত-ভিত্তিক শিল্প স্থাপনের প্রস্তাব
আমাদের কাছে এসেছিল ।
মাসুল সমীকরণ নীতি ছিল
কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক অবরোধের প্রথম স্তম্ভ ।
কেন্দ্রীয়
সরকারের অর্থনৈতিক অবরোধের দ্বিতীয় স্তম্ভ ছিল শিল্প
অনুমোদন প্রথা । ১৯৫১
সকে শিল্প লাইসেন্স নীতি
অনুযায়ী প্রথম পঞ্চবার্ষিকী যোজনা
শুরু থেকেই প্রধান প্রধান
শিল্পক্ষেত্রে এই প্রথা চালু
হয় । এটি
চালু ছিল ১৯৯১-র
মে মাস পর্যন্ত ।এই নীতি ধারাবাহিকভাবে
বেশির ভাগ রাজ্যের ক্ষেত্রে,
বিশেষত, পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্বাঞ্চলের ক্ষেত্রে
বিনিয়োগের প্রধান বাধা হিসেবে
কার্যকর হয় । তবে এটাও ঠিক যে উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি । কিন্তু তা দরকার দেশের অর্থনীতির সুষম বিকাশের স্বার্থে । আর কার্যক্ষেত্রে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার নিয়ন্ত্রণ-প্রথাকে বৈষম্যের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে । তাই, ভিন্ন কারণে ১৯৯১ সালে এই নীতি বাতিল করা হলেও, আমরা তাকে স্বাগত জানাই । নরসিমা রাও সরকার আমাদের উপকার করতে এই প্রথা বাতিল করেনি । কিন্তু এর ফলে আমাদের কাছে বাড়তি সুযোগ এসেছে ।
পশ্চিমবঙ্গের
প্রতি কেন্দ্রের অবিচারের তৃতীয় হাতিয়ার হিসেবে
দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে
কেন্দ্রীয় বিনিয়োগের ভূমিকা । পরিকল্পিত
অর্থনীতিতে উন্নয়নশীল দেশে কেন্দ্রীয় বিনিয়োগ
একটি ভূমিকা পালন করে
। কেন্দ্রীয় সরকারি
সংস্থাগুলির প্রযুক্তি উন্নয়ন, আধুনিকীকরণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয়
খাতে বরাদ্দ করা ছাড়াও
পরিকাঠামোর উন্নয়নে কেন্দ্রীয় বিনিয়োগের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ
। এই ক্ষেত্রেও
পশ্চিমবঙ্গের প্রতি বিরাট অবিচার
করা হয়েছে । স্বাধীনতার
পর থেকে এই রাজ্য
বিরাটভাবে বঞ্চিত হয়েছে ।
রেল, বিমানবন্দর, পোস্ট অফিস ইত্যাদি
ক্রমাগতুন্নয়ন আধুনিকীকরণ ও বিকাশ শিল্প
স্থাপনে অন্যতম প্রধান শর্ত
। স্বাধীনতার
পর থেকে রেল, প্রতিরক্ষা,
যোগাযোগ ব্যবস্থা, নদী ও বন্দর
উন্নয়নে বিশেষ কোনো বিনিয়োগ
হয়নি । যখন
এই রাজ্যকে হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসের জন্য
প্রাথমিক অনুমোদন চেয়ে ১১ বছর
অপেক্ষা করতে হয়েছে, তখন
কেন্দ্রীয় সরকার গুজরাটে শতকরা
একশো ভাগ অর্থ ব্যয়
করে আধুনিক পেট্রোকেমিক্যাল কারখানা
স্থাপন করেছে ।
পশ্চিমবঙ্গে
মেট্রো রেল, দুর্গাপুর ইস্পাত
ও কলকাতা বিমানবন্দরে আংশিক
আধুনিকীকরণ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো
কেন্দ্রীয় বিনিয়োগ হয়নি ।
পশ্চিমবঙ্গে
যেখানে বিনিয়োগের ভাগ ছিল ১৯৮১
সালে ৮.২%, সেখানে
এটা ১৯৯১ সালে নেমে
দাঁড়িয়েছে ৭%-এ ।
তুলনীয় রাজ্য মহারাষ্ট্র ১৯৮১
সালে কেন্দ্রীয় বিনিয়োগ ৮.৬% (প্রায়
পশ্চিমবঙ্গের সমান) ১৯৯১ সালে
বেড়ে হয়েছে ১৬.৩%
।
এছাড়া
কেন্দ্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে আমাদের
বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে ।
আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী
শিল্প ও অন্যান্য ক্ষেত্রে
পুঁজি বিনিয়োগে কেন্দ্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির ও
ব্যাঙ্কের ভূমিকা বিরাট ।
ক্ষুদ্রশিল্প থেকে বড় শিল্প
প্রতি ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য ।
এ ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গের প্রতি বড় রকমের
অবিচার করা হয়েছে ও
হচ্ছে । এখনকার
নিয়ম অনুযায়ী, কোনো বিনিয়োগকারী যদি
কোনো প্রকল্পে একশো কোটি টাকা
বিনিয়োগ করতে চান, তা
হলে তাঁকে আনতে হবে
২৫-৩০ শতাংশ টাকা
। বাকি অর্থ
তিনি পাবেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান
ও বাজার থেকে ।
এই অবস্থায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির বিরূপতা
কতটা ক্ষতিকর হতে পারে বোঝা
যায় ।
পশ্চিমবঙ্গ
থেকে বছরে ২৫-৩০
হাজার কোটি জমা পড়ে
। জমা ঋণের
সর্বভারতীয় গড় অনুপাত যেখানে
৬২ শতাংশ, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ
পেয়েছে ১৯৯৪ সালে মার্চে
৪৩.৭ শতাংশ ।
এটা পাঁচ বছর আগের
চাইতেও কম । সর্বভারতীয়
গড়ের চাইতে অনেক বেশি
কয়েকটি রাজ্য পায় কেন্দ্রীয়
সরকারের বদান্যতার জন্য । সর্বভারতীয়
গড়ের চেয়ে শতকরা ২০
ভাগ কম পাওয়ার ফলে
পশ্চিমবঙ্গে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের
সম্ভাবনা প্রতি বছর ছিটকে
যাচ্ছে । ক্রমাগত
প্রতিবাদের ফলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক
একটি সমীক্ষা চালিয়ে আমাদের বক্তব্য
সমর্থন করেছে । এ
ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের
ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কের ভূমিকা ও বি
আই এফ আর অনুমোদিত
রিহ্যাবিলিটেশন প্যাকেজকে বানচাল করার ক্ষেত্রে
আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাঙ্কের ভূমিকা
সুবিদিত । এই
বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের
অর্থনৈতিক অবরোধের আর একটি স্তম্ভ
।
উপরোক্ত
বিষয়গুলিকে হাতিয়ার করেই কেন্দ্রীয় কংগ্রেস
(আই) সরকার রাজ্যের অগ্রগতি
স্তব্ধ করার চক্রান্ত করেছে
। এরই ফলে
আমাদের রাজ্য শিল্পায়ন ক্ষেত্রে
ক্রমশ পিছিয়ে পড়ে ।
সাতাত্তর
সালে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার পর
এতসব বৈষম্য এবং বঞ্চনা
সত্ত্বেও আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা
করে চলেছি পরিস্থিতির উন্নতি
ঘটাতে । আমাদের
হাতে যতটুকু ক্ষমতা ছিল,
তার সদব্যবহার করে ক্ষুদ্র শিল্পকে
আমরা দেশের মধ্যে শীর্ষস্থানে
নিয়ে গেছি । কৃষিতেও
আমরা অনুসরণযোগ্য সাফল্য দেখাতে সক্ষম
হয়েছি । এই
সাফল্যের উপর দাঁড়িয়েই আমরা
শিল্পায়নে বাড়তি জোর দিয়েছি
পশ্চিমবঙ্গের হৃতগৌরব আমরা ফিরিয়ে আনতে
চাই । বামফ্রন্ট
সরকারের গ্রামোন্নয়ন ও ভূমিসংস্কার মূলক
কর্মসূচি রূপায়নের ফলে এরাজ্যে শিল্পায়ন
প্রক্রিয়ার একটা শক্তিশালী বুনিয়াদ
তৈরি করা গেছে ।
মানুষের চাহিদা বেড়েছে ।
ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে । আমরা
মনে করি, শিল্পায়ন প্রচেষ্টাও
একটা সংগ্রাম । সেই
সংগ্রামে আমরা জিতব ।
আমাদের
বিরুদ্ধে যতই অপপ্রচার চালানো
হোক, শিল্পায়ন প্রচেষ্টাতেও কেন্দ্রীয় শিল্পনীতির সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য
রক্ষা করেই আমরা এগিয়ে
যেতে পারব । আমাদের
শিল্পায়ন প্রচেষ্টা উপরতলার ১০-১৫ শতাংশ
মানুষের জন্য নয় ।
সমগ্র জনগণের অর্থনৈতিক সামাজিক
অগ্রগতির লক্ষ্যে আমাদের নীতি ।
স্বনির্ভরতার লক্ষ্যকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে
একটি ভারসাম্যমূল অএথনৈতিক অবস্থান আয়ত্ত করাই আমাদের
উদ্দেশ্য । তাই
একদিকে রাজনৈতিকভাবে আমরা নরসিমা সরকার
গৃহীত নয়া অর্থনৈতিক নীতির
অর্থনৈতিক নীতির বিরোধিতা করে
যাব । পাশাপাশি
বামফ্রন্ট সরকার মানুষের কল্যাণে
যতটা সুযোগ পাওয়া যায়
ততটাই কাজে লাগবে ।
শিল্পক্ষেত্রে ব্যাপক বেসরকারিকরণের ভ্রান্ত
নীতির বিপদ মোকাবিলায়, রাজ্যে
শ্রমিক-কর্মচারীদের ন্যায়সঙ্গত অবলম্বনকে কোনোভাবে ক্ষুন্ন না করে এবং
সকলের সহযোগিতা নিয়েই আমরা এগিয়ে
যাব । বহু
সংগ্রামে রক্ত ঝরিয়ে শ্রমজীবী
মানুষ যে অধিকারগুলি অর্জন
করেছেন, তা খর্ব করার
জন্য যে কোনো প্রচেষ্টাকে
বামফ্রন্ট সরকার সর্বশক্তি দিয়ে
রুখবে ।
No comments:
Post a Comment