Wednesday, 17 January 2024

জ্যোতি বসু বিধায়ক থেকে মুখ্যমন্ত্রী - রহিত বসু

পশ্চিমবঙ্গের পুনর্গঠিত বিধানসভায় ৮৩ জন সদস্য থাকলেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্য হওয়ায় তাঁর জায়গায় সদস্য হন বিধানচন্দ্র রায়। বাংলা বিভাগের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সংখ্যাও কমে যায়। রূপনারায়ণ রায়ের নির্বাচনী কেন্দ্রটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। ফলে বিধানসভায় কমিউনিস্ট গ্রুপে রইলেন জ্যোতি বসু এবং রতনলাল ব্রাহ্মণ।

স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার প্রথম অধিবেশন শুরু হল ২১ নভেম্বর। সেই অধিবেশনের মূল কর্মসূচি ছিল স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন।

কিন্তু সেই প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই উঠে দাঁড়ালেন জ্যোতিবাবু। তখন স্পিকারের আসনে ছিলেন বর্ধমানের মহারাজা স্যার উদয়চাঁদ মহতাব। জ্যোতিবাবু বললেন - "আমি জানাতে চাই, অসংখ্য কৃষক নানা জায়গা থেকে এই সভাকে, স্বাধীন বাংলার সভাকে সংবর্ধনা জানাতে আসছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, পুলিশ হাওড়া এবং শিয়ালদার কাছে তাঁদের আটকে দিয়েছে। আমি জানি না, এটা কেন হল। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী সে কথা জানেন। তিনি আমাদের বলেছেন, তাঁরা আসতে পারেন। কিন্তু ডিসিপ্লিনড ভাবে, যাতে কোনও গণ্ডগোল না-হয়। একথা তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কারণ তাঁরা অভিনন্দন জানাতে আসছেন। আমি জানি না, পুলিশ কেন এই কাজ করল। আমি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাই। তিনি যদি বাইরে গিয়ে একটু দেখেন, তাহলে সুবিধা হয়।"

স্পিকার তখন মুখ্যমন্ত্রীকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার নির্দেশ দিলেন। প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ বললেন - "কাল ভোরবেলা কৃষ্ণবিনোদ রায় এ ব্যাপারে কথা বলতে আমার কাছে যান। তিনি আমাকে বলেন, আপনাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সব কৃষকরা পরিষদের মধ্যে উপস্থিত হবেন। আমি বলি, সভাগৃহের মধ্যে যুক্তভাবে তাদের না-আসাটাই বাঞ্ছনীয়। তবে আমি তাঁকে বলি, আপনারা যদি ওয়েলিংটন স্কোয়ার বা ময়দানে কোনও সভা করেন, সেই সভায় আমরা যেতে পারি। গিয়ে বক্তৃতা দিতেও প্রস্তুত আছি এমনকি কৃষকদের সম্বন্ধে আমাদের নীতি কি, তা বলতেও প্রস্তুত আছি। এছাড়া,অন্য কোনওরকম প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি। তখন কৃষ্ণবিনোদবাবু বলেন, আমি আপনার কথা শুনলাম কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের মতামত কি, তা পরে জানাব। তারপর রাতে টেলিফোন করে তিনি জানান, আমাদের মতের সঙ্গে তাঁদের মতবাদ ঠিক মেলে না। শিয়ালদা স্টেশন, কি হাওড়া স্টেশনে মিছিল আটকেছে কিনা, তা আমি ঠিক বলতে পারি না।" কৃষক সভার নেতাদের দিকে অভিযোগের তীর ঘুরিয়ে দিয়ে প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ বলতে থাকেন - "এখানে কৃষ্ণবিনোদবাবু এবং আর এক ভদ্রলোক এসেছেন। তাঁরা বললেন, মিছিল ধর্মতলা স্ট্রিটের মোড়ে আটকিয়েছে।"

পুলিশ এসপ্ল্যানেড ইস্টে জড়ো হওয়া প্রায় ২০ হাজার ছাত্র  কৃষকের উপর ব্যাপক লাঠি চালায় এবং কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে। বিধানসভা ভবন থেকে বার হয়ে জ্যোতিবাবু ততক্ষণে এসপ্ল্যানেড ইস্টের দিকে রওনা দিয়েছেন। সেখানে গিয়ে তিনিও দেখলেন পুলিশ লাঠি চালাচ্ছে আর কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ছে। সেই ছিল জ্যোতিবাবুর প্রথম কাঁদানে গ্যাসের অভিজ্ঞতা। সেখান থেকেই হাঁটতে হাঁটতে তিনি মহাকরণে গেলেন। সেখানে তিনি প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের কাছে জানতে চান, পুলিশ কৃষকদের শান্তিপূর্ণ জমায়েত লক্ষ্য করে কেন কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ছে? প্রফুল্লবাবু তাঁকে বোঝালেন, কীভাবে কাঁদানে গ্যাস তৈরি করা হয়।

স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা অধিবেশনের প্রথমদিনেই, পুলিশের আচরণ এবং সেই আচরণ সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাখ্যাটাই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কংগ্রেস পরিচালিত এই মন্ত্রিসভা কোন পথে চলবে। প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের মুখ্যমন্ত্রিত্বে কংগ্রেস সরকার প্রথম যে আইনটি চালু করেছিল, তার নাম ছিল 'পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ ক্ষমতা আইন।' পরে ওই আইনের নাম হয় 'পশ্চিমবঙ্গ নিরাপত্তা আইন।'
*********************************************************************
১৯৫২ সালের সাধারণ নির্বাচনের শেষ অধিবেশনে পশ্চিমবঙ্গ নিরাপত্তা (সংশোধনী) আইন নিয়ে আলোচনা হয়। কারাবাসের সময়কার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে জ্যোতিবাবু বলেন, "আমার বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হল, তুমি জনসভায় বক্তৃতা দিতে পারবে না। আমি জানতে চাই, তাহলে আমি কী করব? আমার কাজ কী হবে? আমি তো বেকার হয়ে যাব।"

বিধান রায় তাকে থামিয়ে দিয়ে তখন বলেন - "হাইকোর্টে প্র্যাক্টিস করবেন।"

জ্যোতিবাবু জবাবে বলেন - "আপনার পরামর্শ মতো চলার কোনও ইচ্ছা আমার নেই। আমি জানি, এখানে এমন অনেক মন্ত্রী আছেন, যাঁরা ব্যবসা করে অন্য পথে অনেক টাকা রোজগার করেছেন। আমি সেসব কথা বলতে চাই না। আমি একজন পেশাদার বিপ্লবী। আমার কাজ হল, এই সরকারকে উৎখাত করা, মানুষের সঙ্গে কথা বলা, আর তাঁদের সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের পথে টেনে আনা। আমাকে যদি সেই কাজ করতে না দেওয়া হয়, যদি আমার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে আমার এই জীবনের মূল্য কী?"
*********************************************************************
রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সমাজবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ - সকলেই বলে থাকেন, পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের রাজনৈতিক সাফল্য এবং একাধিপত্যের পিছনে সব থেকে বড় কারণটি হল ভূমিসংস্কার এবং গ্রামোন্নয়ন।

১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর '৭৮ সালে 'অপারেশন বর্গা'র স্লোগানের পিছনে তেভাগা আন্দোলনের ছায়া খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। স্বাধীনতার আগে থেকেই অবশ্য জ্যোতিবাবু বিধানসভায় জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের দাবিতে, রাজ-মহারাজা-নবাবদের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে তাঁর সেই সমালোচনা আরও জোরালো হয়েছে, কংগ্রেস সরকারকে তিনি বরাবরই জোতদার-জমিদারদের সরকার বলে মনে করেছেন। তাঁর সেই ধারণা ভারতীয় সমাজ, সেই সমাজের শ্রেণী ভারসাম্য, সেই ভারসাম্যে কংগ্রেসের অবস্থান দেখেই তৈরি হয়েছিল। ভূমি সংস্কার সম্পর্কে প্রধান আইনগুলি কংগ্রেস জমানাতেই তৈরি হয়েছে, একথা যেমন ঠিক, তেমনি একথাও ঠিক, সেইসব আইন কার্যকর করার বিষয় কখনই কংগ্রেস সরকারের কর্মসূচিতে গুরুত্ব পায়নি। অথচ, ভূমিসংস্কারের দাবি প্রাথমিকভাবে বুর্জোয়া শ্রেণীর দাবি-সনদেই থাকার কথা। অর্থনীতির যে কোনও ছাত্রই জানেন, শিল্প বিকাশ, পুঁজিবাদী বিকাশের প্রাথমিক শর্তই হল পুঁজির দ্রুত সঞ্চয়, কাঁচামালের বাড়তি জোগান এবং শিল্পপণ্যের বর্ধিত বাজার। আর তার জন্য অপরিহার্য শর্তই হল ভূমিসংস্কার।

সমাজবিকাশে অর্থনীতির এই অপরিহার্য শর্ত সম্পর্কে ১৯৫২ সালেই কিন্তু জ্যোতিবাবুর স্পষ্ট ধারণা ছিল। নিজস্ব ঢঙে কংগ্রেসের সমালোচনা করে প্রথমে তিনি বললেন, - "মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, এটা ভাববার সময় এসেছে যে, জমিদারি প্রথা উঠিয়ে দেওয়া হবে কি না। সে বিষয়ে গবেষণা দরকার এবং একজন গবেষণা করতে গিয়ে - 'ফ্রম দ্য ফ্রাইং প্যান টু দ্য ফায়ার' না কি একটা ইংরাজি কথা বললেন। এই সব নাকি চিন্তা করবার সময় এসেছে। কিন্তু আমরা জানি, ভারতবর্ষের জাতীয় আন্দোলন অনেক গবেষণা করার পর, অনেক হিসাব করার পর একথাটা মেনে নিয়েছে যে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করতে হবে, কৃষকদের জমির মালিক করতে হবে। সুতরাং নতুন করে গবেষণা করার কিছু নেই। তাই আজ এসব কথা শুনে আমরা একটু আতঙ্কগ্রস্ত হচ্ছি। এই নিয়ে আলোচনার সময়ে আমাদের সঙ্গে কংগ্রেস সরকার ও কংগ্রেসের চিরকাল একটা মতভেদ থাকবে। কী সেই মতভেদ? জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ বিনা খেসারতে করা হবে, না খেসারত দিয়ে করা হবে? এই কংগ্রেসি সরকার জমিদার ও জোতদারদের সরকার, সাধারণ মানুষের সরকার নয়। সেইজন্য এই সব কাজ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।"
*********************************************************************
কিছুদিন পরেই গোহত্যা বন্ধের দাবিতে আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠতে শুরু করে। অন্যান্য রাজ্যের ঘটনাবলির প্রভাব পড়তে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে। '৫৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর কলকাতার বড়বাজারে এক মিছিলের উপর পুলিশ লাঠি চালায় ও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে। বহু লোক আহত হন,একজনের মৃত্যু হয়। ইতিমধ্যে চার-পাঁচটি রাজ্য গো-হত্যা নিষিদ্ধ করে দেয়। বিধানসভায় হেমন্ত বসু বলেন - "গো-রক্ষা বিশেষ প্রয়োজন তা সে কৃষিকাজের জন্য হোক, দুধের জন্যই হোক বা শরীরের পুষ্টির জন্যই হোক। যেভাবেই হোক, বহু লোক এই আন্দোলনকে সমর্থন করছেন, তাঁরা লাঠি-গুলি খাচ্ছেন। এর পিছনে জনমত রয়েছে। গো-হত্যা সম্পূর্ণ বন্ধ করার যে নীতি, সেই নীতির দিক থেকে আমি তা সমর্থন করি। কিন্তু বাংলাদেশে বা ভারতবর্ষের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দিকে দৃষ্টি রেখে আজ কারও উপর জোর করে কোনও আইন চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়।"

এ বিষয়ে জ্যোতিবাবুর মনোভাব ছিল খুবই কড়া। এবং গো-হত্যার বন্ধের দাবিতে আন্দোলনের পিছনে যে সাম্প্রদায়িক প্রবণতা রয়েছে, তা তাঁর নজর এড়ায়নি। তাই তিনি বললেন - "এই আন্দোলন আরম্ভ হওয়ার আগে, তাঁদের নাম কী জানি না, কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত কি না জানি না, কিন্তু তাঁরা আমার কাছে এসেছিলেন। তাঁদের আমি কখনও দেখিনি, কোথাকার লোক তাও জানি না। আমি বললাম, এটা আইনকানুন অনুযায়ী যদি বন্ধ করতে চান, তাহলে করুন। কিন্তু হঠাৎ এই সত্যাগ্রহ কেন? হাজার হাজার মানুষ যখন বেকার হয়ে যাচ্ছে, শিশুরা খেতে পাচ্ছে না, ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে খাচ্ছে এই কলকাতা শহরে, চাষীরা খেতে পাচ্ছে না, জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে - তার জন্য তো আপনারা কিছু বলেন না! এইসব মানুষকে বাঁচানোর জন্য আন্দোলন করেন না। অথচ আজ আপনারা বলছেন,গো-হত্যা বন্ধ করতে হবে। কারণ এতে ধর্মের বাঁধন আছে। তা ওই ভদ্রলোক বললেন, এটা ধর্মের প্রশ্ন নয়, অর্থনৈতিক প্রশ্ন। শিশুরা দুধ খেতে পাচ্ছে না। আমি বললাম, আপনারা যদি এই গ্যারান্টি দিতে পারেন যে, আমাদের দেশে গো-রক্ষা করলে সমস্ত শিশু দুধ খেতে পাবে, তাহলে আমার পার্টি আপনাদের পাশে থাকবে।"

গো-হত্যা বন্ধের দাবিতে আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠলে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্যই যে অনেক মানুষ উন্মুখ হয়ে আছেন, তা জ্যোতিবাবুর নজর এড়ায়নি। তিনি দাঙ্গা দেখেছেন স্বাধীনতার আগে এবং পরে, তিনি জানেন দাঙ্গা কেন হয়, কারা থাকে দাঙ্গার পিছনে এবং তারপর কীভাবে সেইসব দাঙ্গায় সাধারণ মানুষকেও জড়িয়ে নেওয়া হয়। এক একটি দাঙ্গার পরে একটা সমাজ কী ভাবে এলোমেলো হয়ে যায়, অর্থনীতি কীভাবে বিধ্বস্ত হয়, তারপর সেই পারস্পরিক অবিশ্বাস দূর করতে কত বছর কেটে যায়, - তার সব কিছুই জ্যোতিবাবু জানতেন। তিনি তাই বললেন - "আমাদের রাষ্ট্রে হিন্দু-মুসলিম দুই-ই বাস করছেন। মুসলমানরা স্বভাবতই একটু ভীত হবেন, যদি এর ভিতরে ধর্মের কথা আসে। গত ১৫ অগস্ট আমি খড়গপুরে মিটিং করতে গিয়েছিলাম। যেখানে মিটিং করছিলাম, তার কাছে দেখলাম একদল সাধু বসে আছেন। সেখানে ধর্মের কথা হচ্ছে, যজ্ঞ হচ্ছে গোমাতাকে বাঁচাতে হবে - এইসব স্লোগান সেখানে দেওয়া হচ্ছে। এ থেকে যদি আর এক সম্প্রদায়ের মানুষ ভীত হন, যদি একটু শঙ্কিত হন, তাহলে কি তাঁদের দোষ দেওয়া যায়? যদি আপনারা বলেন যে, অহিংসভাবে করছি, তাতেও তো কাজ হচ্ছে না। এই সব করে শেষে আমাদের কোথায় নিয়ে যাবেন? আমি বলি, মানুষের উপরে আর কিছু নেই।"
*********************************************************************
... জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকে পণ্ডিত নেহেরু বললেন, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলাই তাঁর প্রধান পরিকল্পনা। সেই রাষ্ট্রে জনসাধারণই সমগ্র রাষ্ট্রের কল্যাণে উৎপাদন যন্ত্রের মালিক হবে। গণতান্ত্রিক এবং শান্তিপূর্ণ পথেই রাষ্ট্রে পরিবর্তন আনতে হবে। নেহরুর মতে, আধুনিক চিন্তাধারায় ব্যক্তিগত মুনাফার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমাজের কোনও স্থান নেই। অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে, তাঁরা এই ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করে দিচ্ছেন।

এই পর্যন্ত নেহরু যা বলেছেন, তাতে কমিউনিস্টদের অখুশি হওয়ার কোনও কারণ ছিল না। কিন্তু কিছুদিন পরেই কমিউনিস্টদের আক্রমণ করে তিনি যা বললেন, তাতে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠল। তিনি বললেন, দলীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য দেশের স্বার্থ বিসর্জন দেওয়া ভারতীয় কমিউনিস্টদের রীতি। ব্যাঙ্ক ধর্মঘটে উস্কানি দেওয়ার জন্য কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে নেহরু বললেন, দেশের প্রতিটি সমস্যা সম্পর্কে কমিউনিস্টদের মনোভাব দেশ ও জাতির পরিপন্থী। এই প্রসঙ্গে তিনি অবশ্য চিনা কমিউনিস্টদের প্রশংসা করলেন। নেহরুর বক্তব্য ছিল, কমিউনিস্টরা তেলেঙ্গানায় যে সশস্ত্র বিদ্রোহের নীতি গ্রহণ করেছিল, তা পরে বর্জন করলেও তাঁরা এখনও স্থানীয় বিরোধে উস্কানি দিয়ে বিশৃঙ্খলা ও অসন্তোষ জিইয়ে রাখার নীতিতে বিশ্বাসী।
*********************************************************************
পরে এই বিধান রায়ই বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যৌথভাবে বাংলা-বিহার সংযুক্তির প্রস্তাব দেন।

ওই প্রস্তাবের বিরোধিতায় ১৯৫৬ সালের ২৬ জানুয়ারি কলকাতার সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে (তৎকালীন ওয়েলিংটন স্কোয়ারে) এক জনসভা হয়। সেই সভার সভাপতি ছিলেন জ্যোতি বসু। ২ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘটে সামিল হয় ছাত্রছাত্রীরা। ৫ ফেব্রুয়ারি কমিউনিস্ট পার্টির বিহার প্রাদেশিক কমিটি বলল - "দ্বিভাষিক রাজ্য ভারতের জাতীয় ঐক্য ক্ষুন্ন করবে।" তার আগেই কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদক হিসাবে জ্যোতিবাবু বলেন - "রাজ্য পুনর্গঠন সম্পর্কে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্তের সঙ্গে নীতির কোনও সম্পর্ক নেই এবং ওই সিদ্ধান্ত সুবিধাবাদী। পশ্চিমবঙ্গের ন্যায্য দাবি অস্বীকার করতে আগেই রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের রিপোর্টে ভাষা-ভিত্তিক নীতিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। এখন কংগ্রেস নেতৃত্ব বিশেষত পুরুলিয়ার বাংলা ভাষাভাষী অধ্যুষিত বিরাট এলাকাকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত অস্বীকার করে সেই অন্যায়ের পরিমাণ আরও বাড়িয়েছে।"

কমিউনিস্ট পার্টি কেন বিরোধিতা করেছিল? তাদের যুক্তি ছিল - দু'টি রাজ্যের এই সংযুক্তিকরণের ফলে জাতীয় ঐক্য সম্প্রসারিত হবে না। বরং বিহারি-বাঙালি বিরোধ সমগ্র যুক্ত রাজ্যে ছড়িয়ে পড়বে। তাছাড়া, এর ফলে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া বিহার ভারতীয় ও বিদেশি পুঁজিপতিদের অবাধ শোষণের ক্ষেত্রে পরিণত হবে। তখনই বিহারে প্রতিক্রিয়াশীলদের শক্ত ঘাঁটিগুলোকে পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে। এরই পাশাপাশি, দ্বিভাষিক রাজ্যের শাসনব্যবস্থায় বাঙালি-বিহারি রেষারেষি বাড়বে, ফলে শাসনব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটবে। কমিউনিস্ট পার্টির আপত্তির অন্য একটি কারণটি ছিল, দেশের অন্যান্য এলাকায় ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের নীতি স্বীকৃত হওয়ার পথে সংযুক্তিকরণের এই প্রস্তাব পিছনের দিকে তাকানো ছাড়া আর কিছুই নয়।
*********************************************************************
সেই সময়ে কেরলের পালঘাটে কমিউনিস্ট  সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। কিন্তু কলকাতা উত্তর-পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন বাংলা-বিহার সংযুক্তির ইস্যুতে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যে, জ্যোতিবাবু ও প্রমোদ দাশগুপ্ত সেই পার্টি কংগ্রেসে উপস্থিত থাকতে পারেননি। 
*********************************************************************
তারপর জ্যোতিবাবু কর্মচারীদের সমস্যার কথা, তাঁদের প্রয়োজনের কথা বললেন। এবং তার সেই বক্তৃতায় সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সবরকম উপাদানই মজুত ছিল। পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি জানালেন - ১১ লক্ষ ৪৪ হাজার সরকারি কর্মচারীর মধ্যে ৯৫ হাজার কর্মচারী মাসে ১০০ টাকার কম বেতন পান। ৬৬ হাজার লোক ৭৫ টাকার কম পান এবং ১৬ হাজার কর্মচারী ৫০ টাকারও কম পান। তিনি বললেন - "এই যদি কর্মচারীদের অবস্থা হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে কর্মচারীদের দিয়ে কোনও কাজ হতে পারে? তাঁদের মধ্যে নিশ্চয়ই অসন্তোষ জমবে। এই যে মিনিয়েলস, চাপরাশি, এঁদের কথা যদি বলা হয়, তাহলে আপনারা সেই ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি অবলম্বন করে বলে দেন, তাঁদের তো আর জীবনযাত্রার মান বাড়েনি। মিডল ক্লাস লোকের তো আর জীবনযাত্রার মান বাড়েনি। তাঁদের তো আর ছেলেপিলেদের লেখাপড়া শেখাতে হয় না। তাঁরা নিজেরা লেখাপড়া শিখতে পারেননি বলে কি তাঁদের মনে ছেলেপিলেদের লেখাপড়া শেখানোর ইচ্ছে আসে না? তারপর ২৩২ জন অফিসার আছেন, যাঁদের বেসিক স্যালারি ১ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা। অথচ আপনারা বলছেন, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলবেন। এই জন্য রাইটার্স বিল্ডিংসে এবং জেলায় শতকরা ৯০ ভাগ কর্মচারী সরকারের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছেন। আজ তাঁরা আপনাদের ঘৃণা করেন। আপনাদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেন। আপনারা বলেন, কমিউনিস্ট পার্টি তাঁদের খেপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাদের তো বুদ্ধি-বিবেচনা আছে।"

এইসব সরকারি কর্মচারীই এখনও বামফ্রন্ট সরকারের মূল ভিত। জ্যোতিবাবু শাসন ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্নস্তরে সরকারি কর্মচারীদের যে হারে বেতন বেড়েছে, তা হয়তো পরবর্তী সময়ে সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। কিন্তু কর্মচারীদের সরকার-বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে তাঁকে কখনও ভাবতে হয়নি।...

... বিধান রায়ের সমালোচনা করার ফাঁকে জ্যোতিবাবু বন্ধু সিদ্ধার্থ রায়কেও ছাড়লেন না, বললেন - "এই যে এত বড় বড় গণতন্ত্রের কথা বলেন সিদ্ধার্থ রায়, একখানা লাল বই এনে, স্ট্যালিনের না কার কথা, মস্কোর ব্যাপারে এখানে পড়ে গেলেন। কিন্তু আমরা তো মস্কোর কথা বলিনি। মূর্খের কাছে মস্কোর কথা কী বলব? যারা মানুষকে খেতে দিতে পারে না, তাঁদের কাছে মস্কোর কথা বলতে পারি না।"
*********************************************************************
জ্যোতিবাবু বললেন - "মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, যার যা কোয়ালিফিকেশন আছে, যার যা প্রাপ্য, তাঁকে তা দিতে হবে। তিনি বললেন ডিভিসি-র যে ইঞ্জিনিয়ার এলেন আমেরিকা থেকে, তিনি যদি ৫ হাজার টাকা মাইনে চান তো তাঁকে ৫ হাজার টাকা মাইনে দিতে হবে। তা না হলে সে এসে আমাদের কাজ করে দেবে কেন? আমি বলি, এই দুটোকে মিশিয়ে কোনও লাভ নেই। আমরা যে-কাজ জানি না, নো-হাউ জানি না, আমাদের ছেলেরা, আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা তা শিখে নেবে। এইরকম শিখবার জন্য আমেরিকা থেকে হোক, ওয়েস্ট জার্মানি থেকে হোক, জাপান থেকে হোক, রাশিয়া থেকে হোক, যেখান থেকে হোক আমাদের লোক আনতে হবে এবং তাঁরা যে মাইনে চান, সেই মাইনে তাঁদের দিতে হবে। আমরা ৬ মাস কি ১০ বছরে তা শিখে নেব, শিখে নিয়ে তাঁদের বিদায় করে দেব। তাঁরা চলে যাবেন এবং আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা তারপর সেই টেকনিক্যাল কাজগুলো করতে পারবেন।"

অর্থাৎ পুঁজিবাদী বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং তার প্রয়োগের বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে সেই ১৯৫৭ সালেই জ্যোতিবাবুর স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়েছিল। দেশীয় প্রযুক্তিকে অক্ষুন্ন রেখে কখন কোন শিল্পে অথবা সামাজিক পরিষেবার কোন ক্ষেত্রে বিদেশি প্রযুক্তিকে স্বাগত জানাতে হবে, বিদেশি প্রযুক্তির জন্য দেশের দরজা কতটা ফাঁক করতে হবে, বলা যায় তখন থেকেই সেই ধারণার অনুশীলন করে চলেছেন জ্যোতিবাবু। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সরকারি সংস্থায় কম্পিউটার ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাঁর দল বা ট্রেড ইউনিয়নের বিরোধিতা কেন তীব্র হয়ে উঠেছিল, তা অবশ্য বোঝা যায় না।
*********************************************************************
মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের একটি মন্তব্যে উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে রাজ্য সরকারের মনোভাব স্পষ্ট হয়ে গেল। '৫৮ সালের অক্টোবর মাসে আমেরিকা সফরে রওনা হওয়ার আগে তিনি বললেন - "পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছোট ছোট পতিত জমি উদ্ধার করা ও তার উন্নয়নের ব্যবস্থা করা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে সম্ভব নয় এবং এভাবে পুনর্বাসনের চেষ্টা সফল হবে না। কারো এভাবে যেসব জমি পাওয়া যাবে, তা নিকৃষ্ট শ্রেণীর। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে উদ্বাস্তুদের সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। তৃতীয়ত, স্থানীয় বর্গাদার ও ভূমিহীন কৃষিশ্রমিক পরিবারের প্রয়োজন উপেক্ষা করার মতো নয়। তাছাড়া উদ্বাস্তুদের মধ্যে দলে দলে বিভক্ত হয়ে থাকার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। সুতরাং, শিবিরবাসী কৃষক পরিবারের প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম জমিই খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য পাওয়া যাবে।"

তার কিছুদিন পরেই ময়দানে এক জনসভায় জ্যোতিবাবু বললেন - "যারা বাংলার বাইরে যেতে চাইবেন না, তাঁদের জন্য ক্যাম্প খোলা রাখা এবং এখানে সরকারের তৎপর থাকা প্রয়োজন। দণ্ডকারণ্যের প্রশ্নে সর্বভারতীয় স্তরে ব্যবস্থা হচ্ছে। কাজেই সরকারের কর্তব্য হবে, দণ্ডকারণ্য ব্যবস্থার দিকে যেমন নজর দেওয়া, তেমনই এখানে ক্যাম্প খোলা রেখে পতিত জমি উদ্ধার এবং শিল্পায়নের মাধ্যমে এই রাজ্যেও উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।" এই সভায় জ্যোতিবাবুর বক্তব্য ছিল - "পশ্চিমবঙ্গে পতিত জমি উদ্ধার এবং শিল্প প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা হলে উদ্বাস্তুদেরই শুধু পুনর্বাসন হবে না, স্থানীয় বাসিন্দা ও ভূমিহীন কৃষকদেরও কল্যাণ সম্ভব। কেন্দ্রীয় সরকারের টাকার অভাব নেই। দণ্ডকারণ্যের জন্য অনেক কোটি টাকা খরচ করতে সরকার রাজি, অথচ এই রাজ্যে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য অর্থ ব্যয়ে তারা রাজি নয়। প্রায় তিন কোটি মানুষ যেখানে এই রাজ্যে বাস করতে পারেন, সেখানে ৩৫ হাজার উদ্বাস্তুর স্থান হবে না - এমন যুক্তি অর্থহীন ও বিভ্রান্তিকর।"
*********************************************************************
যত বড় বড় বাড়ি ও সম্পত্তি বিধানবাবু কিনছেন, অতিরিক্ত টাকা দিয়ে, আমাদের রাজ্য বাজেট থেকে টাকা লুট করে। আমি নাম করে দিচ্ছি। লালগোলার ২০০ বছরের পুরনো বাড়ি, ভ্যালুয়েশন তার আড়াই লক্ষের বেশি নয় - সেটা ৮ লক্ষ টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। অ্যাডভোকেট জেনারেল এস এম বোসের বাড়ি হুগলির কালেক্টর অ্যাসেস করেছিলেন ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ৫০ হাজারে হবে না। ৪ লক্ষ টাকা তাঁকে দিয়েছেন। মহারাজা অব ভিজানাগ্রাম বেলেঘাটায়, তার ভ্যালুয়েশন ৩ লক্ষ টাকার বেশি হবে না। কিন্তু ৬ লক্ষ টাকায় কেনা হয়েছে। এভাবে টাকা দেওয়াকে চুরি ছাড়া কিছুই বলতে পারি না। অন্য কোনও ভালো ভাষা থাকে, অন্যরা বলবেন। আমার জানা নেই।
*********************************************************************
পশ্চিমবঙ্গে সেই সময় খাদ্য সংকট এবং উদ্বাস্তু সমস্যা যেন হাত ধরাধরি করে চলছিল। সেই উদ্বাস্তু সমস্যাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং উদ্বাস্তুদের মধ্যে অনিশ্চয়তা আরও যখন বেড়ে গেল, তখন কংগ্রেস সরকার বলল, উদ্বাস্তুদের পশ্চিমবঙ্গের বাইরে না পাঠালে উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। উদ্বাস্তুদের বাইরে পাঠানোর পক্ষে প্রধানত দু'টি যুক্তি দেখানো হল। প্রথমত বলা হল, পশ্চিমবঙ্গে এত ঘনবসতি যে, পুনর্বাসনের জায়গা নেই। প্রতি বর্গমাইলে এখানে লোকসংখ্যা খুব বেশি। কিন্তু এই ঘনবসতি ছিল শহরাঞ্চলে, গ্রামাঞ্চলে নয়। ১৯৩১, ১৯৪১, ১৯৫১ সালের সেন্সাস রিপোর্ট খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে গ্রামাঞ্চলে প্রতি বর্গমাইলে লোক সংখ্যা যা বেড়েছিল, তার তুলনায় ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে প্রতি বর্গমাইলে মাত্র তিনজন করে বেড়েছিল। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ১৯৫৯ সালের সারা পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩২ লক্ষ। দ্বিতীয় যুক্তিতে বলা হত, ক্যাম্প উদ্বাস্তুদের জন্য কৃষিযোগ্য জমির প্রয়োজন এবং এই পশ্চিমবঙ্গে কৃষিযোগ্য জমির একান্ত অভাব। সেই সময়ে সরকারি পরিসংখ্যানে বলা হল, পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন ক্যাম্পে ৫১ হাজার উদ্বাস্তু বাস করেন। ওই ৫১ হাজার উদ্বাস্তুর মধ্যে ৩৩ হাজার ২০০ জন কৃষিজীবী। এই কৃষিজীবী পুনর্বাসনের জন্য ২ লক্ষ একর চাষযোগ্য জমি দরকার বলে সরকারের তরফে বলা হয়েছিল।

জ্যোতিবাবু বিধানসভায় বললেন - "এই সরকারকে আমরা দেখেছি যে, কারও সঙ্গে কোনওরকম সহযোগিতা করতে চান না। শুধু চাবুক মেরে জোর করে সব ব্যবস্থা করতে চান। বাস্তুহারাদের আজ মানুষ বলে তাঁরা জ্ঞান করেন না। আমার কথা হচ্ছে, বাস্তুহারারা যদি বলেন যে, আমরা পশ্চিমবাংলায় থাকতে চাই তাহলে এটা কি অন্যায় কিছু তাঁরা বলে ফেলবেন? নিজের পরিবেশের মধ্যে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, ভাষা সমস্ত কিছু নিয়ে তাঁরা যদি বলেন যে, আমরা এখানে থাকতে চাই, বিশেষ করে কৃষক বাস্তুহারারা, তাহলে এটা তো কিছু অন্যায় হয় না - এটাই তো স্বাভাবিক। স্বাভাবিক বলছি এইজন্য যে, আমাদের দেশে ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ গঠন, এ নিয়ে বহু আন্দোলন আমরা করেছি, এবং আজও এই আন্দোলন বিভিন্ন জায়গায় চলছে। যদি এই পরিবেশে ভাষার কোনও মূল্য না থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের ওই আন্দোলন করার কোনও প্রয়োজন ছিল না। তাহলে বলতাম, আমরা সব ভারতবাসী, যেখানেই বাস করি না, তাতে কিছু যায় আসে না। সেজন্য আজ তাঁরা বলছেন যে, আমরা পশ্চিমবাংলায় থাকতে চাই। কী অন্যায় কথা তাঁরা বলছেন? সেজন্য বলছি, এ ব্যাপারে জোরজুলুম করা উচিত নয়। আমরা তাঁদের জোর করে ট্রেনে করে ভেড়া-গরু-ছাগলের মতো বাইরে পাঠিয়ে দিলাম, এটা করা উচিত নয়। আপনারা যদি তাঁদের পেটে মারেন এবং বলেন, তোমাকে ভিখারি করে নিলাম, তুমি পথে বেরিয়ে যাও স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের হাত ধরে, তাহলে এর চেয়ে খারাপ জিনিস আর কী হতে পারে? বাস্তুহারাদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে একটা প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিকে।"

ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ ও অন্ধ্রপ্রদেশ মধ্যবর্তী দণ্ডকারণ্যে উদ্বাস্তুদের পাঠানোর জন্য রাজ্য সরকার উঠে পড়ে লাগল। সেখানে সব মিলিয়ে ছিল প্রায় ৮০ হাজার বর্গমাইল এলাকা। দণ্ডকারণ্যে উন্নয়নের জন্য সরকার প্রায় ৩০ কোটি টাকা খরচ করবে বলে ঠিক করল। জ্যোতিবাবু বললেন - "আপনারা বলেছেন - এটা নতুন বাংলা হবে। বাস্তুহারাদের জোর করে নিয়ে যেতে চাইছেন। তারপর বাজে ভাঁওতা বাস্তুহারাদের দিচ্ছেন - এই অভাগা মানুষগুলোকে। সেখানে কাছাকাছি ৩০ লক্ষ আদিবাসী রয়েছেন। তার আশেপাশে, মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যা, অন্ধ্রে ভূমিহীন কৃষক রয়েছেন, যাঁদের সংখ্যা প্রায় ২৭ ভাগ হবে। সেখানে এই কয়েকজন বাঙালি নিয়ে গিয়ে বাংলা গড়ে তুলবেন? আপনারা আন্দামানে কি নতু বাংলা গড়ে তুলতে পেরেছেন? সেখান সেই নিয়ে গোলমাল বেঁধেছে। আমি বলি, একথা তুলবেন না। এতে প্রধানত ভাঁওতা দেওয়া হয় এবং তাঁদের প্রতি অবিচার করা হয়। ২ লক্ষ মানুষ সেখানে গিয়ে নতুন করে কলোনী গড়বেন! আমি দেখেছি, ২৪ পরগনা কংগ্রেস পার্টি থেকে এইরকম একটি ইস্তাহার দেওয়া হয়েছে। তাঁরা বলছেন যে, দ্বিতীয় একটা বঙ্গদেশ গড়ে উঠবে। তাহলে আন্দামানেও একটা বঙ্গদেশ, উড়িষ্যার বহু এলাকাই বঙ্গদেশ, জামসেদপুরের কিছু অংশও একটা বঙ্গদেশ, বেনারসও একটা বঙ্গদেশ - কেননা সেখানে বহু বাঙালি আগে থেকেই আছেন। তাহলে এরকম বহু বঙ্গদেশ আছে। দণ্ডকারণ্যে নতুন বাংলা কী করে গড়ে উঠবে? সেখানে দু'টো তিনটে স্টেটের ব্যাপার। ৬০-৭০-৮০ মাইল দূরে দূরে তারা ক্যাম্প করবে। তাই আপনারা যে জোরজুলুম, প্রতারণা করছেন - তা করবেন না।"  
*********************************************************************
ইতিমধ্যে অন্য একটি ঘটনায় রাজ্য রাজনীতিতে চমকের সৃষ্টি হয়। সত্তরের দশকে যিনি ছিলেন কমিউনিস্টদের সব থেকে বড় ঘোষিত শত্রু, '৫৮ সালের আগস্ট মাসের উপনির্বাচনে সেই সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন কমিউনিস্ট এবং বামপন্থীরা। তার আগে খাদ্য দফতরে দুর্নীতির প্রতিবাদে বিধান রায়ের মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। এরপর তিনি দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর কেন্দ্রের উপনির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কংগ্রেস প্রার্থী বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি সাড়ে ১০ হাজারেরও বেশি ভোটে হারিয়ে দেন। সেই উপনির্বাচনের প্রধান ইস্যু ছিল খাদ্য সমস্যা ও খাদ্য দফতরের দুর্নীতি।
*********************************************************************
লিউ-শাও-চি চেয়ারম্যান পদে বসার কিছুদিন আগেই দলাই লামা ভারতে প্রবেশ করেন এবং তাঁকে আশ্রয় দেওয়া হয়। সেইসময় তিব্বতের ওই ধর্মগুরু ও রাষ্ট্রপ্রধানের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতে ও ভারতের বাইরে ব্যাপক উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছিল। পণ্ডিত নেহরু তখন বলেন, দলাই লামা স্বেচ্ছায় লাসা ত্যাগ করেছেন। ভারত সরকার তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা করবে। তাঁর বক্তব্য ছিল, তিব্বতের ঘটনাবলী এক জাতীয় অভ্যুত্থান। কিন্তু চিন বলল, তিব্বতের ঘটনাবলি 'প্রতিক্রিয়াশীল অভিজাত'-দের চক্রান্ত।

জাতীয় ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক অজয় ঘোষের একটি বিবৃতিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মহলে সংশয়ের সৃষ্টি হয়। তিনি সেইসময় বলেন, ভূমি সংস্কারের ব্যাপারে কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, তা যাতে কার্যকরী হতে পারে এবং কায়েমি স্বার্থ যাতে এই প্রচেষ্টা বানচাল করে দিতে না পারে তার জন্য কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেসের ও অন্য দলের গণতন্ত্রপন্থীদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে রাজি। তখন প্রশ্ন উঠেছিল - সহযোগিতার অর্থ কি সরকারি ক্ষমতার অংশীদারি? অজয় ঘোষ জানিয়ে দেন, সহযোগিতা বলতে তিনি কোয়ালিশন সরকার গঠন বোঝাচ্ছেন না। এ ব্যাপারে বেসরকারি স্তরেই তাঁরা সহযোগিতা করবেন।
*********************************************************************
এর মধ্যে '৫৯ সালের জুন মাসে কেরলের পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে সর্বভারতীয় রাজনীতি ঘোরালো হয়ে ওঠে। বিরোধীদের ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে কেরলের পরিস্থিতি তখন অশান্ত হয়ে উঠেছিল। সেইসময় কেরলের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ। কমিউনিস্ট পার্টিকে পণ্ডিত নেহরু বললেন, একমাত্র সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমেই কেরলের অশান্ত পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি নেহরুর সেই পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে বলল - "কেরলের বিরোধী দলগুলো বেআইনি পথে যে একতরফা দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করার চেষ্টা করছে, নেহরুর প্রস্তাব তারই একটা গণতান্ত্রিক ছদ্মবেশ ছাড়া আর কিছুই নয়।"

শেষ পর্যন্ত কেরলে নাম্বুদিরিপাদের নেতৃত্বে গঠিত ২৮ মাসের কমিউনিস্ট মন্ত্রিসভার অবসান হল। জ্যোতিবাবু তখন কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদের সম্পাদক। তিনি বললেন - "কেরলে কেন্দ্রীয় সরকারের এই কাজকে আমি স্বৈরাচার এবং গণতন্ত্রের প্রতি অত্যাচার বলে মনে করি।"

কেরলে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গে মিছিল বার হয়। ময়দানে এক জনসভায় জ্যোতিবাবু বলেন, পশ্চিমবঙ্গে তাঁরা কোনওরকম প্রতিশোধমূলক আন্দোলন করবেন না। তবে খাদ্যের দাবিতে তাঁরা অবশ্যই তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলবেন। জ্যোতিবাবু বললেন - "যেদিন থেকে কেরলে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেদিন থেকেই কেরলের ও সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতারা সেই সরকারকে গদিচ্যুত করার জন্য নানারকম ষড়যন্ত্র শুরু করে। প্রথমে তাঁরা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে সরকারের সমর্থক দু'-তিনজন বিধানসভার সদস্যকে দলে টানার চেষ্টা করেন।"

প্রধানমন্ত্রী নেহরুর ভূমিকারও তীব্র সমালোচনা করেন জ্যোতিবাবু। তিনি বলেন - "বাংলার মানুষ যখন তাঁদের অভিযোগ প্রতিকারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল বার করেন, তখন নেহরু দিল্লিতে বসে বলেন, কলকাতায় কারণে-অকারণেই মিছিল হয়। মহারাষ্ট্রে যখন ১০৫ জন লোককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, তখন তিনি কী করেছিলেন? মহারাষ্ট্রের আন্দোলন তো সংবিধান-বিরোধী আন্দোলন ছিল না।" বসুর প্রশ্ন ছিল - "কেরলের সরকার সংবিধানের কোন ধারার বিরোধী কাজ করেছিল? কী দোষে তাদের গদিচ্যুত করা হল? ছোট একটি রাজ্যে কমিউনিস্ট সরকারকে কংগ্রেস সহ্য করতে পারেনি। আর যদি কয়েকটি রাজ্যে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে তো কংগ্রেস পাকিস্তানের আয়ুবশাহীর মতো দেশে ডিক্টেটরি শাসন কায়েম করবে।"
*********************************************************************
তার পাঁচদিন পরেই এ আই সি সি-র অধিবেশনে কংগ্রেস সভানেত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং প্রধানমন্ত্রী নেহরু কমিউনিস্টদের কার্যকলাপ সম্পর্কে কড়া মন্তব্য করেন। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার গোলমালের কথা উল্লেখ করে নেহরু বলেন, "এইসব লোকের সঙ্গে কোনও রকম বোঝাপড়া চলতে পারে না। আমরা যদিও সবরকম গণতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করি এবং অন্যদলকে সবরকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়াই আমাদের ইচ্ছা, কিন্তু আমরা এরকম ঘটনা কখনই সহ্য করব না।" ওই অধিবেশনে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, "ভারতের সঙ্গে কোনও কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের বিরোধ দেখা দিলে ভারতের কমিউনিস্টরা সেই কমিউনিস্ট রাষ্ট্রকেই সমর্থন করেন। কিন্তু কোনও অকমিউনিস্ট দেশের সঙ্গে বিরোধ দেখা দিলে তারা ভারতের সঙ্গে থাকেন।"

তার দু'দিন পরেই বিধানসভায় মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করে জ্যোতিবাবু বললেন - "আমরা দেখলাম, পণ্ডিত নেহরু তাঁদের পার্টি মিটিঙে কংগ্রেস নেতা হিসাবে বলেছেন যে, পশ্চিমবাংলায় যা হয়েছে, পশ্চিমবাংলার আইনসভায় যা হয়েছে, তাতে পশ্চিমবাংলা কলঙ্কিত হয়েছে, ভারতবর্ষ কলঙ্কিত হয়েছে। তাঁর কন্যাও বলেছিলেন, গণতন্ত্রের বিপদ, পার্লামেন্টারি ডেমোক্র্যাসির বিপদ। আমরা ভাবলাম, কেরলে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তারপর অন্তত তিনি এখানেও গণঅভ্যুত্থান দেখতে পাবেন। এখানে দু'-দুটো জেনারেল স্ট্রাইক, রাজ্যজুড়ে সর্বাত্মক ধর্মঘট হয়ে গেল। কিন্তু কোথাও, কি তিনি গণঅভ্যুত্থান দেখতে পেলেন না? এমন শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট কি কোথাও দেখেছেন? আরও তিনি বললেন যে, অ্যাসেম্বলির ভিতর পবিত্র জায়গা। এখানে বিধানসভায় যে জুতো ছোঁড়াছুড়ি হয়েছে, সেসব কথাও তিনি বললেন। এই যে পবিত্র জায়গা, এটা কি শুধু অ্যাসেম্বলির ভিতর? মাতৃভূমির আর কোনও স্থানে কি পবিত্র জায়গা নেই? তিনি কি আর কোনও জায়গা পবিত্র বলে জানেন না? পার্লামেন্টারি ডেমোক্র্যাসি কি বাইরে থাকবে না? শুধু এর বিধানসভার ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে? এটাই কি তিনি ঠিক করেছেন? কারণ এর একটু মুশকিল আছে। কারণ বাইরে কী হচ্ছে?
*********************************************************************
জ্যোতিবাবু যে ভাষায় পণ্ডিত নেহরুকে আক্রমণ করতে পারতেন, ভারতবর্ষের তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। কমিউনিস্ট পার্টিতে তখন যে তারকার অভাব ছিল, তা নয়। বরং কমিউনিস্ট পার্টিতে সেইসময় এমন অনেক নেতা ছিলেন, মার্কসবাদী তত্ত্বের অনুশীলনের বিচারে যাঁরা বরং জ্যোতিবাবুর তুলনায় কয়েক কদম এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু জ্যোতিবাবু বরাবরই মার্কসবাদের অনুশীলন করেছেন সাধারণ মানুষের ভাষায়, তাকে এদেশের জলহাওয়া, সাধারণ মানুষের ভাবাবেগের মতো করে গড়ে নিয়ে। সংসদীয় গণতন্ত্র তাঁর কাছে এমনই একটি বিশ্বাস, যার পথ ধরে তিনি মনে করেন, কমিউনিস্ট পার্টির মূল লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। ফলে পণ্ডিত নেহরুকে তাঁর একথা বলতে বাধেনি যে - "পণ্ডিত নেহরু পার্লামেন্টারি ডেমোক্র্যাসির কথা শোনালেন, কিন্তু কেরলে কেন গণতন্ত্রকে হত্যা করলেন? কেরলে তো আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। তা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট অ্যাডভাইস করলেন যে, কেরলে এদের দরকার নেই। মেজরিটি থাক বা না-থাক, এদের পদত্যাগ করতে হবে, এদের তাড়িয়ে দিতে হবে। কেন তাড়িয়েছেন, তাও বলছেন। বলেছেন, তারা কনস্টিটিউশন মতো চলছে না। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, কনস্টিটিউশনের কোন ধারা ভায়োলেট করা হল? তা বলবেন না। সেখানে যে কোন পার্লামেন্টারি ডেমোক্র্যাসির বিপদ, পণ্ডিত নেহরু তা দেখলেন না। এ যদি সাধারণ মানুষ হত, বলতাম, হামবাগিজম অ্যান্ড হিপোক্র্যাসি। কিন্তু পণ্ডিত নেহরুকে কী বলি? তিনি এত বড় নেতা, তাঁকে কী বলি?
*********************************************************************
কংগ্রেস সম্পর্কে জ্যোতিবাবু ইদানিং এত কড়া কথা আর বলেন না। বলেন না, তাঁর কারণ, ভারতবর্ষের প্রধান রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের চেহারাটাই এখন বদলে গিয়েছে। এখন সমাজের উপরি-কাঠামোয়, রাজনৈতিক লড়াই আবর্তিত হয় সাম্প্রদায়িকতা বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার ইস্যুকে কেন্দ্র করে। এই ইস্যুতেই প্রায় সব রাজনৈতিক দল দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বামপন্থী এবং কংগ্রেসিরাও এখন শুধু সেই ইস্যুতে, অন্তত সংসদে, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে লড়াই করে। প্রধান এই রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের আড়ালে চাপা পড়ে যায়, সাধারণ মানুষের স্বার্থে আঘাত করছে এমন আর্থিক সংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই। পিছড়ে বর্গ, আদিবাসী ও তফসিলীদের সামাজিক সমস্যার সংগ্রামও নজরের আড়ালে চলে যায়। আবার এই দুটি শিবিরের বিভাজন রেখাও অস্পষ্ট হয়ে যাবে প্রধান রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। যেমন হয়েছিল কংগ্রেস কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতায় থাকার সময়। তখন কংগ্রেসই ছিল কমিউনিস্টদের প্রধান রাজনৈতিক শত্রু।
*********************************************************************
তার কিছুদিন পরেই কমিউনিস্ট পার্টির নেতা এস এ ডাঙ্গে লোকসভায় বলেন, চিন কখনও ভারত আক্রমণ করবে না। যেমন ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, ভারত কখনও চিন আক্রমণ করবে না, তেমনই তিনিও এই প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন যে, চিনও কখনও ভারত আক্রমণ করবে না। লোকসভার জনৈক সদস্য সেইসময় জানতে চান, 'ডাঙ্গে কোন অধিকারে চিনের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন?' অন্য এক সদস্য ডাঙ্গের কাছে জানতে চান - 'আপনি কি কোনও চিঠি পেয়েছেন?' ডাঙ্গে বলেন - 'প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেননের অপসারণ  তিব্বতকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যেই ভারতে কংগ্রেস সহ অন্যান্য দল আন্দোলন চালাচ্ছে। সীমান্তের কোনও সমস্যা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। কমিনিস্ট পার্টিকে বিচ্ছিন্ন করে, আগামী নির্বাচনের আগে কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করার রাজনীতি নিয়েই এই আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে।"
*********************************************************************
জ্যোতিবাবু এরপর ক্রীড়া প্রশাসনের শীর্ষে রাজনীতির লোক ও শাসক দলের পছন্দসই ব্যবসায়ীদের বসানো এবং মোহনবাগান ক্লাবের নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে বিধান রায়কে তুলোধোনা করলেন। তিনি বললেন - "আপনারা একটা কমিটি করবেন - স্পোর্টসের কথা যখন ভাববেন, তখন এমন লোককে নিয়ে ভাববেন, যাঁরা স্পোর্টস সম্বন্ধে কিছুই জানেন না। সব ব্যবসাদার, বড় বড় লোক, রাজা-মহারাজা - তাঁদের নিয়ে স্পোর্টস কমিটি করবেন। এমন ঘটনা ঘটেছে, মুখ্যমন্ত্রী মোহনবাগান ক্লাবের অ্যানুয়াল ইলেকশনে টেলিফোন করে করে বলেছেন, ওহে, অমুক দে-কে ভোট দাও, ধীরেন দে-কে ভোট দাও।"

বিধান রায় তখন উঠে দাঁড়িয়ে জ্যোতিবাবুর এই মন্তব্যের প্রতিবাদ জানালেন। বললেন - "এটা সত্য নয়। একেবারে ভিত্তিহীন।"

জ্যোতিবাবু পাল্টা বললেন - "এটা একেবারে ট্রু। আপনিও জানেন, আমরাও জানি। আপনি সত্যিই খারাপ কাজ করেছেন। কিন্তু আমি বলি, এইসব ব্যবসা-বাণিজ্য, ওষুধের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট লোকদের হেডে রাখছেন কেন? যাঁরা স্পোর্টসম্যান, যাঁদের উদ্যম আছে, তাঁদের কেন নিচ্ছেন না? অর্থাৎ, আমরা দেখছি, ব্যবসাদাররা যেমন সমাজের শীর্ষস্থানে বসে আছেন, সমস্ত কিছু কন্ট্রোল করছেন, ব্ল্যাকমার্কেট থেকে আরম্ভ করে সব কিছুই, তেমনি আমরা দেখছি, স্পোর্টিং ওয়ার্ল্ডেও তাঁদের ঢুকিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তাঁরা ঠিক করবেন, কী হবে না হবে। এইজন্য লজ্জায় আমাদের মাথা তোলা যায় না।

বিধান রায় তখন বলে ওঠেন -"কেবল ব্যারিস্টারদেরই ঢোকানো হবে?"

জ্যোতিবাবু জবাবে বললেন - "আমি সেকথা বলি না। এমন লোককে ধরুন, যাদের দিয়ে কাজ হবে। আজকে ডিসিশন নিন, কাল স্পোর্টস স্টেডিয়াম হতে পারে, অল্পদিনের মধ্যে স্টেডিয়াম হতে পারে। কিন্তু এইভাবে জিনিসটাকে আপনারা ফেলে রেখে দিয়েছেন।"
*********************************************************************
এই সভায় ভারত-চিন সীমান্ত বিরোধের ব্যাপারে কমিউনিস্টদের ভূমিকা নিয়ে কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষের অভিযোগের জবাব দিলেন তিনি। জ্যোতিবাবু সেখানে বললেন - "চিন যদি ভারতের জমি দখল করেই থাকে, তাহলে সরকার সময়মতো খবর পায়নি কেন? জমি দখল হয়ে থাকলে, সেই সরকার গদিতে থাকে কী করে?"
*********************************************************************
তারপর জ্যোতিবাবু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য যেসব কথা বললেন, তার মধ্যে কেউ কেউ প্রাদেশিকতার গন্ধ খুঁজে পেতেই পারেন।

তিনি বললেন - "এঁদের কেন জায়গা হবে না? এঁরা বাঙালি। সমস্ত অবাঙালিরা পশ্চিমবঙ্গের ফ্যাক্টরি ভরে ফেলল, ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কথা শঙ্করদাসবাবু বললেন। তবে উনি বোধহয় জানেন না - দুর্গাপুর অঞ্চলে আমরা এখনও দেখছি যে, সেখানে বলা হচ্ছে, ক্যাম্প রিফিউজিদের যেন এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম লিখতে না দেওয়া হয়। এই বাঙালি রিফিউজি, যাঁরা ক্যাম্পে আছে, তারা যদি তাদের নাম লিখতে যায়, তাহলে তাদের নাম লিখতে বারণ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ, যদি চাকরি পেয়ে তারা ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যায়! শুধু তাই নয়, বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউনিটদের বলা হচ্ছে যে, এদের কাজ দিও না। অর্থাৎ সমস্ত রকম প্রেসার দিয়ে বাধ্য করে তারপর যাতে এদের দাসপ্রথায় দণ্ডকারণ্যে পাঠানো যায়, তারই চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না যে, বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউনিটের তরফ থেকে যদি ব্যবস্থা না করা হয়, তাহলে পশ্চিমবঙ্গে এরা কোথায় চাকরি পাবে?

"হাজার হাজার উদ্বাস্তু, যারা ক্যাম্পে আছে, ভোটার লিস্ট থেকে তাদের নাম কেটে দেওয়া হয়েছে। আর তাদের বলা হচ্ছে, আগে সিটিজেনস সার্টিফিকেট জোগাড় কর। তোমাদের ভাষা থেকে বুঝছি, তোমরা পদ্মার ওপার থেকে এসেছ, তোমরা বাঙাল। এদের বলা হচ্ছে, সিটিজেনস সার্টিফিকেট নিতে হবে, তবে ভোট দিতে পারবে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তারা, জেনারেল ইলেকশনে ভোট দিয়েছে, আর তাদের নামে কেস দিচ্ছে - কেউ রাজনীতি করতে পারবে না, ভোটার হতে পারবে না। ওরা দাস। কিন্তু রোমান দাসরাও একদিন রাইজ করেছিল। চিরদিন তাদের দাবিয়ে রাখা যায়নি। একদিন যদি ওই পথ তাদের নিতে হয়, তাহলে ওরাও তা নেবে।"
*********************************************************************
চিনাদের কাজকর্মের সমালোচনা করে বিবৃতি দিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক অজয় ঘোষ। তিনি বললেন - "চিনাদের সঙ্গে বর্তমানে বিরোধ চলছে। এই অবস্থায় চিনাদের বর্তমান কার্যকলাপ উত্তেজনা বাড়াতে এবং ভারতবাসীর মনে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি না-করে পারে না। এর ফলে, দু'-দেশের মধ্যে সম্পর্কে যে আরও অবনতি ঘটবে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।"
*********************************************************************
পরদিন নেহরু বললেন, "ভারত সরকারের লক্ষ্য ও নীতি হল, ভারতভূমি থেকে চিনা আক্রমণকারীদের সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত করা এবং এর ফলে যুদ্ধের সম্ভাবনা খারিজ করা যায় না। তাহলে বাহিনী রাখার প্রয়োজন কী? সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী রাখার প্রয়োজন কী?" একই সঙ্গে অবশ্য নেহরুর বক্তব্য ছিল - ভারত ও চিনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে গোটা বিশ্বে নিদারুণ বিপর্যয় দেখা দেবে। এই যুদ্ধ বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হবে এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য এই যুদ্ধ চলতে থাকবে। চিনের পক্ষে ভারতকে পরাজিত করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনই ভারতের পক্ষেও পিকিঙে প্রবেশ করা সম্ভব নয়।

ভারত-চিন সীমান্ত সমস্যার উত্তাপ সাধারণ নির্বাচনের প্রচারেও পড়তে শুরু করেছিল। '৬২ সালের গোড়ায় ২৪ পরগনার বরাহনগরে এক জনসভায় জ্যোতিবাবু বললেন - "কংগ্রেস একটি সুবিধাবাদী পার্টি। যখন যা সুবিধা, তখন তা করে দেশকে ওরা সর্বনাশের পথে নিয়ে যাচ্ছে।"

তার আগের দিনই উত্তরবঙ্গের এক সভায় মুখ্যমন্ত্রীবিধান রায় কমিউনিস্ট পার্টির পতাকাকে 'বিদেশি পতাকা' বলে বর্ণনা করেন। সেই অভিযোগের জবাবে জ্যোতি বসু বললেন - "ডাঃ রায় জানেন না, ওই পতাকার উদ্ভব কোথা থেকে। বহুদিন আগে আমেরিকার এক শহরে ওই পতাকা নিয়েই শ্রমিকরা বিদ্রোহ করেন এবং শ্রমিকদের রক্তে রাজপথ লাল হয়ে যায়। তার পরেই শ্রমিকরা ওই লাল পতাকাকে নিজেদের পতাকা বলে গ্রহণ করেন। চিন বা রাশিয়া থেকে ওই পতাকার উদ্ভব হয়নি।" একই সঙ্গে তিনি কংগ্রেসের পতাকারও বিশ্লেষণ করলেন - "ওই পতাকা রামায়ণ বা মহাভারত থেকে আসেনি। ফরাসি বিপ্লবের পর ভারতের তৎকালীন বিপ্লবীরা ওই পতাকা গ্রহণ করেন। কংগ্রেসের এখনকার পতাকার রঙের হয়ত কিছুটা বদল হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ফরাসি বিপ্লবের পর এদেশের বিপ্লবীরা ওই দেশের বিদ্রোহী পতাকার অনুকরণ করেছিলেন।" তারপর পরিহাসের সুরে তিনি বলেন - "ডাঃ রায়ের লাল পতাকায় এত ভয় কেন? রামভক্ত হনুমানের পতাকাও তো লাল!"
*********************************************************************
দু'-একদিন আগেই কমিউনিস্ট প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষ বলেছিলেন, কমিউনিস্ট পার্টি চিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করুক। সেই চ্যালেঞ্জের জবাবে জ্যোতিবাবু বললেন - 'অতুল্যবাবু যদি চিনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে রাজি থাকেন, তাহলে আমি তাঁর পিছনে যেতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নেহরু যে ওই ব্যাপারে মীমাংসা চাইছেন।"
*********************************************************************
সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের হাত কতটা শক্ত করে ধরা যেতে পারে, তা নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে বিতর্ক চিরকালীন। কোনটি বেশি বিপজ্জনক - কংগ্রেসের আর্থিক নীতি, যার ফলে গরিব আরও গরিব হয়ে যায়, নাকি সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে ওই দলের আপস করার প্রবণতা - এই বিতর্কেও কখনও কখনও কমিউনিস্ট পার্টির মনোলিথিক গঠন চিড় দেখা গিয়েছে। কিন্তু অন্য অনেক দলের মতো কংগ্রেসও বরাবরই যে ভোটের আগে-পরে সাম্প্রদায়িক তাস বার করেছে, তা কারওরই নজর এড়ায়নি।
*********************************************************************
জ্যোতিবাবু এরপর জাতীয় সংহতি, ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বক্তৃতার কথা উল্লেখ করলেন, তারপর বিভিন্ন প্রচার-পুস্তিকা থেকে পড়ে শোনাতে শুরু করলেন - "এখানে একটা জায়গায় বলা হয়েছে - 'ধর্ম ও ঈশ্বরবিশ্বাসের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির জেহাদ।' কোনও গণতান্ত্রিক দেশে কি এই জিনিস হয়? কোনও গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনে কি ঈশ্বরের কথা আসে? অথচ এখানে লেখা হয়েছে, 'কমিউনিস্ট পার্টি কোনও ধর্মে এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়।' আমার কথা হল, এটা ঠিক হলেও এটা নির্বাচনের বিষয়বস্তু নয়। অন্য জায়গায় হতে পারে। তারপর দেখুন এখানে লেখা আছে, 'আপনি কি এই ধর্মবিরোধী মতবাদকে ভোট দিয়ে সমর্থন করবেন?' তাহলে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনের মধ্যে ধর্ম এবং ঈশ্বরকে টেনে আনা হল। অথচ এটা নির্বাচনের মধ্যে আসার কথা নয়, একথা পণ্ডিত নেহরু বরাবরই বলে আসছেন। কেরালাতে বিশপরা একটা সার্কুলার দিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে পণ্ডিত নেহরু কেরালায় গিয়ে প্রচার করে বলেছেন যে, এটা অন্যায়। কিন্তু এই বুকলেট চৌরঙ্গির কংগ্রেস ভবন থেকে বেরিয়েছে।"

সেই বছর ভোটের আগে কংগ্রেস ভবন থেকে 'কমিউনিস্ট পার্টির স্বরূপ' বলে আরও একটি ইস্তাহার প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই ইস্তাহারে 'পয়গম' নামে একটি কাগজে প্রকাশিত কমিউনিস্ট-বিরোধী প্রচারের কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হয়। জ্যোতিবাবু বললেন - "গত ১০-২-৬২ তারিখে পয়গম-এর যে সংখ্যা বেরিয়েছে, সেই সংখ্যায় কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে এবং ধর্ম সম্বন্ধে অনেক কথা লেখা হয়েছে। তার একটা জায়গায় আছে, 'খৃষ্টান এবং মুসলিমপ্রধান রাশিয়ায় মুসলমান ধর্ম লোপ পেয়েছে এবং সেখানে ৪ কোটি মুসলমান হজ, রোজা, নামাজ প্রভৃতি ছেড়ে দিয়ে শুয়োর পুষতে বাধ্য হচ্ছে।' এইরকম অনেক কথা বলে তারপর বলেছে যে, 'কমিউনিস্টদের উপর আল্লার অভিশাপ বর্ষিত হোক।' এটা যদি শুধু পয়গম-এর একটা আর্টিকল হত, আমি কিছু বলতাম না। কিন্তু এই আর্টিকলটা কংগ্রেস পার্টির এতই পছন্দ হল যে, এ থেকে একটা অংশ নিয়ে কংগ্রেস ভবন থেকে বিনয় রায় কমিটির পক্ষে এইভাবে একটা কাগজে উদ্ধৃত করে দিলেন। এই হল ধর্মের ব্যাপার। আমি বলছি যে, এই পদ্ধতি যদি থাকে, তাহলে এটা যেন না-বলা হয় যে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়েছে। ওঁরা বলুন যে, নির্বাচনে জিতবার জন্য আমরা যে কোনও পন্থা অবলম্বন করব - এটা ভাল কথা এবং সাহস করে এটা বলা উচিত। কিন্তু টাটা-বিড়লা-সিংহানিয়া প্রভৃতি কলকারখানার মালিকের টাকা নিয়ে, আর এইরকম পদ্ধতিতে নির্বাচনে জিতবেন, তারপর তাঁরা এখানে এসে বড় বড় কথা বলবেন - এ ভণ্ডামি আমাদের পছন্দ হচ্ছে না।"
*********************************************************************
কয়েকদিন পরেই, '৬২ সালের ২০ অগস্ট হায়দরাবাদে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকই ই. এম. এস. নাম্বুদিরিপাদ সাংবাদিক বৈঠক করে বললেন - ভারত-চিন সীমান্ত বিরোধের ইস্যুতে কমিউনিস্ট পার্টি মোটামুটিভাবে ভারত সরকারের বক্তব্য ও মনোভাবের সঙ্গে একমত হলেও বিশেষ বিশেষ এলাকা সম্পর্কে দুই দেশের দাবিদাওয়ার ব্যাপারে আলোচনায় যোগ দিতে চায় না। কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করে ই. এম. এস. সেদিন জানিয়ে দিলেন, কমিউনিস্ট পার্টির মতে উত্তর-পূর্বে ম্যাকমোহন লাইনই নির্ভুল সীমারেখা এবং লাদাখে পার্টি চিরকালীন সীমান্তই মেনে নিয়েছে। ই. এম. এস'এর কাছে তখন জানতে চাওয়া হয় - "লাদাখে চিরকালীন সীমান্ত মেনে নিয়ে পার্টি কি ভারত সরকারের একথা মেনে নিচ্ছে যে, চিন ভারতীয় এলাকা দখল করেছে?'  নাম্বুদিরিপাদ ওই প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়ে বললেন - "আমাদের দল আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির নীতির সঙ্গে একমত।" তখন তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয় - "কমিউনিস্ট পার্টি কি রাশিয়া বা যুগোস্লাভিয়ার মতো দেশের মধ্যস্থতা পছন্দ করে?" ই এম এস বললেন - "এই ধরণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ভারত সরকারের উপরেই ছেড়ে দেওয়া উচিত। এই ধরণের প্রশ্ন নিয়ে প্রকাশ্যে সংবাদপত্রে আলোচনা করা চলে না।" "দলের জাতীয় পরিষদের বৈঠকে ভারত সরকার ও নেহরুর মধ্যে পার্থক্য করার চেষ্টা হয়েছে কেন" এই প্রসঙ্গে ই. এম. এস. বলেন - "ভারত সরকার ও নেহরুর মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। যাই হোক না কেন, নেহরু নেহরুই।" ম্যাকমোহন লাইনই যে ভারত  চিনের মধ্যকার সীমানা - ভারত সরকারের এই যুক্তি অস্পষ্টভাবে মেনে নিয়ে অক্টোবর মাসে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি একটি প্রস্তাব পাস করল। তবে প্রস্তাব পাস করানোর আগে তা নিয়ে ভোটাভুটি করতে হয়। 
*********************************************************************
সেইদিনই কংগ্রেস নেতা অতুল্যঘোষের একটি মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি প্রচার করেন জ্যোতিবাবু। তিনি সেদিন বললেন - "আমি মনে করি, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের পর পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের নেতার কর্তব্য, দেশের সব শক্তির মধ্যে সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করা। কিন্তু তিনি তাঁর নিজস্ব প্রকৃতি অনুযায়ী এবং তাঁর দলের সংকীর্ণ স্বার্থের কথা ভেবে জনগণকে বিভক্ত করতে এবং জনগণের একাংশকে কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধের প্ররোচিত করতে উদ্যোগী হয়েছেন। যখন আমাদে সৈনিকরা চরম ত্যাগ স্বীকার করছেন, তখন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির এই চেষ্টা কমিউনিস্ট পার্টির সব সদস্য ও সৎ লোকেরা ব্যর্থ করে দেবেন বলে আমি নিশ্চিত।" সেইসময়ে কয়েকটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, সীমান্তের ঘটনা-বলিকে জ্যোতিবাবু তুচ্ছ করে দেখছেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে অতুল্য ঘোষ যে মন্তব্য করেন, জ্যোতিবাবু তারই প্রতিবাদ জানান।

ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে কমিউনিস্ট পার্টি-বিরোধী প্রচার ক্রমশ তীব্র হতে থাকায় চারদিনের মধ্যেই জ্যোতিবাবুকে আরও একটি বিবৃতি দিতে হল। এবার তিনি বললেন - "চিনপন্থী ও ভারতের প্রতিরক্ষাবিরোধী বলে ব্যক্তিগতভাবে আমার নিন্দা করে এবং আমাদের পার্টির পশ্চিমবঙ্গ শাখার বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত অপপ্রচারের অভিযান চালানো হচ্ছে। এর আগে আমি এক বিবৃতিতে জানিয়েছিলাম, আমাদের সব কমিটিই কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য। কিন্তু আমাদের পার্টির কয়েকটি শাখা বিবৃতি দিয়েছে, যদিও এর প্রয়োজন ছিল না।"

সেই সময় দিল্লিতে দলের জাতীয় পরিষদের যে বৈঠক চলছিল, জ্যোতিবাবু তাতে অনুপস্থিত ছিলেন। কয়েকজন বন্ধুর অনুরোধে তিনি বিবৃতি দিচ্ছেন বলে জানিয়ে জ্যোতিবাবু বললেন - "ভারত এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন। ভারত চিনের সঙ্গে অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে এবং ভারত সরকার আশু কর্তব্যে দেশকে প্রস্তুত করার জন্য জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। আমি এখনও বিশ্বাস করি যে, এই পরিস্থিতি সত্ত্বেও দুটি দেশ বড় বিপর্যয় ও সশস্ত্র যুদ্ধ এড়াতে পারে। এই জাতীয় যুদ্ধে, চিন বা ভারত, কারওরই স্বার্থসিদ্ধি হবে না এবং এটা স্পষ্টই বোঝা যায় যে, কোনও দেশই অপর দেশকে পদানত করতে পারবে না।"

জ্যোতিবাবুর বক্তব্য ছিল - "এই যুদ্ধে বরং সাম্রাজ্যবাদীরা আনন্দিত হবে। ভারতের জোট-বহির্ভূত থাকার নীতি বানচাল হয়ে যাবে। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ও পুঁজিপতিরা আরও বেশি করে ভারতের এই অবস্থার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে এবং আমাদের জনগণ আরও দুর্ভোগের মধ্যে পড়বেন। দুটি দেশই শান্তিপূর্ণ অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তোলার পরিবর্তে প্রয়োজনের চাপে যুদ্ধকালীন অর্থনীতি গড়ে চলবে।" জ্যোতিবাবু বললেন - "বর্তমান অবস্থায় আমরা বিশ্বাস করি যে, ভারতের পক্ষ থেকে একতরফা যুদ্ধবিরতির প্রশ্ন ওঠে না। উন্নত সশস্ত্র শক্তির কাছে আত্মসমর্পনেরও প্রশ্ন ওঠে না। ভারতের মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সবরকম দুর্বলতা দূর করতে হবে। আমরা শান্তিপূর্ণ মীমাংসার সব আশা ত্যাগ করিনি।"
*********************************************************************
শেষ পর্যন্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় পরিষদ ভারতকে আক্রমণের অভিযোগে চিনকে অভিযুক্ত করল।  নভেম্বর জাতীয় পরিষদের বৈঠকে এই মর্মে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। মাতৃভূমি রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য কমিউনিস্ট পার্টি জনগণের প্রতি আবেদন জানাল। সরাসরি চিনের নিন্দা করে কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় পরিষদ বলল, ম্যাকমোহন লাইন অতিক্রম করা হবে না বলে চিন সরকার গত তিন বছর ধরে যে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিল, সেই প্রতিশ্রুতি ভেঙে চিনা সৈন্যরা ওই আন্তর্জাতিক সীমারেখা লঙ্ঘন করেছে এবং অনেক জায়গাতেই ভারতীয় এলাকার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার আগে জাতীয় পরিষদের বৈঠকে ভোটাভুটি হয়।

তিন পৃষ্ঠাব্যাপী প্রস্তাবে জাতীয় পরিষদ বলল, "চিনের মতো একটি সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র যে অস্ত্রের জোরে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ মীমাংসায় উদ্যত হবে, তা কখনও কল্পনা করা যায়নি।" চিন তখন বলছিল, 'নেহরু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল ও প্রতিক্রিয়াশীল সম্প্রসারণবাদীদের নেতা।'
*********************************************************************
বিধানসভায় প্রবল আক্রমণের মুখে পড়ে সেকথা স্বীকার করে নিলেন কমিউনিস্ট নেতা সোমনাথ লাহিড়ী - "আমি অকপটে স্বীকার করি যে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় পরিষদে কারও কারও মনে দ্বিধা ছিল। অনেক দ্বিধার পর, অনেক দ্বিধার বিরুদ্ধে লড়াই করে তবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। কিন্তু আমি বলব, আমাদের মনে যদি দ্বিধা না-থাকত, রাতারাতি আমরা যদি ভোল পাল্টাতাম, তাহলে আমরা মানুষ বলে গণ্য হতে পারতাম না। এতদিন আমরা বিশ্বাস করে এসেছি, চিনের প্রতিশ্রুতি, চিনের আদর্শ, চিন যেকথা বলেছে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে সমস্ত আন্তর্জাতিক দুনিয়ার সঙ্গে সুর মিলিয়ে - আমরা কী করে বিশ্বাস করব যে, তারা সেই প্রতিশ্রুতি একদিন ভঙ্গ করে দেবে? তাই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে, স্বভাবতই নিজেদের ধ্যান-ধারণার সঙ্গে আমাদের সংগ্রাম করতে হয়েছে। আজ সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বলা যায়, অতীতে আমাদের কেউ কেউ যা বলেছেন বা ভেবেছেন বা লিখেছেন তার মধ্যে ভ্রান্তি কিছু থাকতে পারে, তার মধ্যে অপরিণামদর্শিতা কিছু থাকতে পারে। কিন্তু সেই যে ভ্রান্তি বা অপরিণামদর্শিতা, সেটা অতীতের বিষয়।"

সোমনাথ লাহিড়ীর মতো বিচক্ষণ নেতাকে কেন বিধানসভার অধিবেশনে বামপন্থী এবং দক্ষিনপন্থীদের প্রবল আক্রমণের মুখে দলের ভিতরকার কথা খুলে বলতে হয়েছিল, তা নিয়ে গবেষণার কোনও সুযোগ নেই। বরং বলা যায়, কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে 'চিনপন্থী' বলে চিহ্নিত নেতাদের খুঁজে বার করা যে চেষ্টা শুরু হয়েছিল, সোমনাথ লাহিড়ির সেদিনকার বক্তৃতা সেই চেষ্টাকেই সাহায্য করেছে।
*********************************************************************
জেলের ভিতরে জ্যোতিবাবুর সঙ্গে অন্য কট্টরপন্থী নেতাদের মতপার্থক্য বাড়তে থাকে। কট্টরপন্থী বলে পরিচিত নেতারা তখনই পার্টি থেকে বার হয়ে গিয়ে নতুন পার্টির গড়ার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু জ্যোতিবাবু ও তাঁর মতের সমর্থক নেতারা তখনই সেই প্রস্তাবে সায় দিতে রাজি ছিলেন না। দলের একাংশ সেই সময় জ্যোতিবাবুকে অপদস্থ করার জন্য তাঁকে ব্যক্তিগত স্তরে আক্রমণ করতে শুরু করেন। তাঁর বিরুদ্ধে এমন প্রচার শুধু হয়, যাকে কুৎসা বলা যেতে পারে। যেমন তখন জ্যোতিবাবুকে আক্রমণ করে বলা হচ্ছিল, তিনি বুর্জোয়া পরিবারের সন্তান, তিনি আরামপ্রিয়, তিনি বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছেন, কারণ তিনি দুর্বলচিত্ত। সেইসময় জ্যোতিবাবুর মতো যেসব নেতা তখনই পার্টিতে ভাঙনের বিরোধী ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই মত ছিল, যেসব অর্থনৈতিক দাবি সামনে রেখে নতুন পার্টি গঠিত হবে, তখন কমিউনিস্ট পার্টিই সেইসব দাবিতে আন্দোলন করছিল। তা সত্ত্বেও নতুন পার্টি গঠিত হলে জনসাধারণ তার রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দাবি করবেন এবং ধরে নিতে পারেন যে, নিছক চিনের স্বার্থেই পাল্টা পার্টি গড়া হচ্ছে। জনসাধারণের এই ধারণা নতুন পার্টির ভবিষ্যতের পক্ষে ক্ষতিকারক হবে বলে তাঁদের আশঙ্কা ছিল। তাঁদের সেই আশঙ্কা যে ভুল ছিল, পরবর্তীকালের ইতিহাসই তা প্রমাণ করেছে। কিন্তু সেটাও বড় কথা নয়। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল, জনসাধারণ যে ওরকম ভাবতে পারেন, সেই ধারণা যে ওইসব নেতার কী করে হল, তা কখনও স্পষ্ট করে জানা যায়নি।
*********************************************************************
কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ বিরোধ ততদিনে বিস্ফোরক হয়ে উঠেছে। দলের ঘেরাটোপ ছেড়ে তা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে প্রকাশ্যে। তারই চরম প্রকাশ দেখা গিয়েছিল দিল্লিতে এ. কে. গোপালনের বাড়িতে। সেদিন ছিল, ১৯৬৪ সালের ২৬ মার্চ। এক সাংবাদিক বৈঠকে বাসবপুন্নায়া বললেন, দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট নেতা এস. এ. ডাঙ্গে ১৯২৪ সালে তাঁর কারামুক্তির বিনিময়ে বৃটিশ সরকারকে সাহায্য করতে চেয়ে চিঠি দিয়েছিলেন।

কানপুরের বলশেভিক চক্রান্ত মামলায়, ডাঙ্গেকে ১৯২৪ সালে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাঁকে চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। বাসবপুন্নায়া বললেন, বোম্বাইয়ের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় ডাঙ্গের চিঠিপত্র প্রকাশিত হওয়ার তিনমাস আগেই তিনি সেইসব চিঠির অস্তিত্বের কথা জানতেন। এইসব চিঠির যথার্থতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য তিনি সাংসদ পি রামমূর্তিকে নিয়ে জাতীয় মহাফেজখানার অফিসে যান এবং পরে আরও দুবার সেখানে গিয়ে কয়েক ঘন্টা ধরে 'ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন' সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র দফতরের ফাইলপত্র দেখেন।
*********************************************************************
মতাদর্শের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের মধ্যে যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে, সে ব্যাপারে তাঁদের নীতি এবং কর্মসূচি কী হবে, সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই তা স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করলেন জ্যোতিবাবু। তিনি বললেন - "ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি একটি সার্বভৌম স্বাধীন দল এবং এই দল স্বাধীনভাবেই নিজের নীতি ও কৌশল ঠিক করবে।" জ্যোতিবাবু সেদিন বললেন - তিনি এখনও চান না যে, ভারতের কমিনিস্ট পার্টির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হোক। ধনিক শ্রেণী নিয়ন্ত্রিত এই সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজন আছে। কিন্তু ঐতিহাসিক ঘটনাবলির কারণে বাধ্য হয়েই তাঁরা এখনকার পথে এসেছেন। একই সঙ্গে তিনি জানিয়ে দেন, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ডাঙ্গে-পন্থীরা যে কংগ্রেস-ঘেঁষা নীতি নিয়েছেন, তাঁরা সম্পূর্ণভাবে তার বিরোধিতা করছেন। সেই সময়েই জ্যোতিবাবুর আশঙ্কা ছিল, মতাদর্শের ইস্যুতে নেতৃত্বের লড়াইয়ের ফলে পার্টির সাধারণ সদস্য ও দরদিদের মধ্যে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করতে বেশ কিছু সময় লাগবে।

অবশেষে কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চলে এল প্রকাশ্যে, একেবারে ময়দানের জনসভায়। সেটা ছিল '৬৪ সালের ৯ মে। কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদের ডাকে ময়দানের এক সভায় জ্যোতি বসু বললেন - "আমরা পার্টির সংগ্রামী ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আর ডাঙ্গেপন্থীরা তাকে মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের হাত থেকে পার্টিকে রক্ষা করার জন্যই আমরা জনসাধারণের কাছে পার্টির ভিতরকার সঙ্কটের কথা খুলে বলতে চাই, যাতে জনগণ আমাদের সাহায্য করেন। পার্টিকে এখন আর শুধু বাইরের শত্রু নয়, ভিতরের শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ডাঙ্গে নিজের জঘন্য অপরাধ ঢাকার জন্য তাঁর বিরোধীদের চিনপন্থী বলে দেখানোর চেষ্টা করছেন। নেহরুও শ্রেণীস্বার্থে যেটুকু প্রগতিশীল কথা বলেন, ডাঙ্গেপন্থীরা তাও বলেন না। ওঁরা নেহরু সরকারকে আদৌ গদিচ্যুত করতে চান না।"
*********************************************************************
তারপর শিক্ষামন্ত্রীর বক্তৃতার বিভিন্ন অংশ উদ্ধৃত করে এবং তার সমালোচনা করে জ্যোতিবাবু বললেন - "উনি অঙ্কের হিসাব দিলেন - আগে এত টাকা খরচ হত, এখন এত টাকা খরচ হচ্ছে। হিসাব দেওয়া উচিত ছিল, আমাদের প্রয়োজন কী, আমাদের আদর্শ কী, আমাদের লক্ষ্য কী, সংবিধানে কী লেখা ছিল, আমাদের কী করণীয়। ১০ বছরের মধ্যে বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা তাঁরা করতে পেরেছেন? ১৪ বছরের বালক-বালিকাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন? করতে পারেননি, এই হবে আপনাদের উত্তর। কেন পারিনি, কতটা পেরেছি, কবে বাকিটা আমরা পারব - এইভাবে বিচার করা উচিত ছিল। তা তিনি পারেননি। তিনি কতকগুলি অঙ্কের হিসাব দিয়ে মনে করলেন যে, কথা ঘুরিয়ে দিলাম। ৩০ কোটি টাকার বাজেট পেশ করে মনে করলেন যে, মাথা ঘুরিয়ে দেব।"

তখন প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষায় ইংরেজির ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে বড় ধরনের কোনও বিতর্ক না থাকলেও, সরকারের নির্দিষ্ট কোনও নীতি বা পরিকল্পনা ছিল না। ফলে কখনও কখনও ছাত্রছাত্রীদের চরম অসুবিধার মুখোমুখি পড়তে হত। তাঁর বক্তৃতায় সেই সমস্যার কথাও উল্লেখ করলেন জ্যোতিবাবু। তিনি বললেন - "স্কুলে শিক্ষা হচ্ছে মাতৃভাষায়। তারপর অনার্স নিলে ইংরেজিতে পড়তে হবে বিভিন্ন বিষয়। তাহলে কী করে সে পড়বে? সেইজন্য একাদশ ক্লাসের ছাত্রদের অসুবিধা হবে সেখানে। অনার্স কোর্স তারা পড়তে পারবে না। এগুলো বিচারের সময় কি এখনও আসেনি?"

জ্যোতিবাবুর মুখ্যমন্ত্রিত্বে এই রাজ্যে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাকে ঢালাও ভাবে অবৈতনিক করে দেওয়া হয়েছে। সরকারের নীতির ফলে, ভূমিহীন কৃষকের ছেলে এবং শিল্পপতির সন্তান একই রকমের সুযোগ পেয়ে গেল। উচ্চশিক্ষাতেও খরচ বৃদ্ধির ফলে তাল মিলিয়ে উপযুক্ত সময়ে ফি-বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ফলে বনগাঁ এবং বালিগঞ্জের ছাত্রছাত্রীকে একই আর্থিক মানদণ্ডে বিচার করা হয়েছে। ভরতুকির ক্ষেত্রে এইরকম উদার মনোভাবের ফল কী হতে পারে, রাজ্য সরকার তা বুঝতে পারল অনেক পরে।
*********************************************************************
কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে সরকারের এই আচরণকে জ্যোতিবাবু সামাজিক সমস্যা এবং সামাজিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করলেন। তিনি বললেন - "সরকার যত মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন, মানুষের যে সমস্যা তাঁরা সৃষ্টি করেছেন, তার সমাধানের পথ যত তাঁরা খুঁজে পাচ্ছেন না, ততই সরকার মরিয়া হয়ে এটাই মনে করেছেন, গদিতে টিকে থাকার জন্য একমাত্র উপায় হচ্ছে, গণতন্ত্রকে খতম করা। এমন অবস্থার মধ্যে তাঁরা এসেছেন যে, কংগ্রেস পার্টির নিরাপত্তা ও দেশের নিরাপত্তাকে তাঁরা এক কোনো দেখতে আরম্ভ করছেন। তাঁরা বলছেন, কংগ্রেস যদি না বেঁচে থাকে, কংগ্রেস যদি পর্যদুস্ত হয়, কংগ্রেস যদি নির্বাচনে কোথাও হেরে যায়, কংগ্রেস যদি গদিচ্যুত হয়, তাহলে দেশের বিপদ হবে। তাহলে দেশকে আমরা বাঁচাতে পারব না, তাহলে দেশে নিরাপত্তার অভাব হয়ে যাবে। এইভাবে তাঁরা পার্টিকে দেশের সঙ্গে মিল করে দিচ্ছেন। ঠিক যা হওয়ার কথা, তার উল্টো জিনিস তাঁরা করে দিচ্ছেন।
*********************************************************************
এর কিছুদিন আগেই বেতার ভাষণের মাধ্যমে এবং লোকসভায় বক্তৃতা করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুলজারিলাল নন্দ বামপন্থীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আক্রমণ চালিয়েছিলেন। তার জবাবে জ্যোতিবাবু বললেন - "কংগ্রেস নেতারা যা বলবেন, সেটাই হচ্ছে আইন। সেটাই আমাদের বিশ্বাস করতে হবে। কংগ্রেস নেতারা যদি বলেন যে, কেউ দেশদ্রোহী, তাহলে তিনি দেশদ্রোহী হবেন। সেটা সত্য কথা বলে ধরে নিতে হবে। এটা কী করে হতে পারে? শ্রীনন্দ বা শ্রীপ্রফুল্ল সেন একটি কথা বলবেন - ওঁরা তো কখনও আমাকে দেশপ্রেমিক বলতে পারেন না। কী করে বলবেন? আমরা তো ওঁদের বিরুদ্ধে। আমরা ওঁদের খতম করতে চাই, উৎখাত করতে চাই। ওঁরা উৎখাত না হলে, ওঁরা খতম না হলে দেশের মঙ্গল নেই বলে আমরা মনে করি। যারা এইসব কথা বলছে, তারা কী করে আমাদের দেশপ্রেমিক বলতে পারে? এটা সম্ভব নয়। আমরা যেমন ওদের দেশদ্রোহী মনে করছি, ওরাও আমাদের দেশদ্রোহী মনে করছে। কিন্তু তাতে আপনি বিনা বিচারে আটক করে রাখতে পারেন না। আমরা যদি কোনও অপরাধ করে থাকি, সরকার আছে আপনাদের হাতে, আদালত আছে, কোর্টে খাড়া করে দিন। দেখা যাক সেখানে কী হয়! জজরা তো সব কমিউনিস্ট হয়ে যাননি।"

বামপন্থী কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে গুলজারিলাল নন্দ লোকসভায় আরও কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বামপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি চিনা কমিউনিস্টদের কাছ থেকে, বিশেষ করে হংকং থেকে প্রচুর অর্থ পেয়েছে। বিধানসভায় সেই অভিযোগেরও জবাব দিলেন জ্যোতিবাবু। তিনি বললেন - "ওই যে অপদার্থ মিনিস্টার বসে আছেন এইখানে একজন, আর ওইখানে একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী - তাঁরা কী করছেন সেখানে? হংকং থেকে টাকা এসেছে আমাদের দেশের সব কিছু বানচাল করার জন্য? ওঁরা বলেন, চিন আমাদের শত্রু। সেখানে শত্রুর কাছ থেকে হংকং মারফত আমাদের কাছে টাকা আসছে। আমি জিজ্ঞাসা করি, এত বড় অপরাধ যেখানে হচ্ছে, সেখানে এই অপদার্থ লোকগুলো কী করছেন?"

"শ্রী নন্দ এবং প্রফুল্ল সেন কেন পদত্যাগ করছেন না? তাঁরা না দিচ্ছেন কোন প্রমাণ, অথচ এই কথা বলে যাচ্ছেন। যদি সত্যি কথা হয়, তাহলে এঁদের প্রথম চাকরি যাওয়া দরকার, তারপর আমাদের যা হয় হবে। ব্যাঙ্ক অফ চায়নার রিপোর্ট পাবলিশ করুন। দেখুন কার নাম আছে। যতীন চক্রবর্তী মহাশয় আপার হাউসে সেদিন তাঁদের নাম পড়ে দিয়েছেন। এঁদের বন্ধু, এঁদের পেট্রন। মিলিওনিয়ার্স, মাল্টি মিলিওনিয়ার্স, কোটিপতিদের  নাম সেখানে আছে, যারা ওভারড্রাফট পেয়ে থাকে। আমি বলছি না যে, ওভারড্রাফট পাওয়া অন্যায়। কিন্তু ওভারড্রাফট যারা পেয়েছে,এই সমস্ত লোকের নাম আছে - বলছেন যে, সিক্রেট রিপোর্ট, আমরা বার করব না।"
*********************************************************************
"সতীশ পাকড়াশির মতো লোক, যিনি ৩০ বছর জেল খেটেছেন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, তাঁকে কড়েয়া রোড থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল পুরুলিয়ায়। তাঁর উপর আর প্রতিহিংসা নিয়ে কী লাভ? অত বয়স যে মানুষের হয়েছে, তাঁর জুতোর শুকতলার যোগ্য নন আপনারা, যাঁরা তাঁকে ধরে নিয়ে গেলেন, ৩০ বছর যিনি জেল খেটেছেন ওইখানে - আমি মুখ্যমন্ত্রীকে এই বিশেষ কেসটা বলেছিলাম। কারণ আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে ফিরিয়ে এনে অন্য একটা জেলে রেখেছেন। কিন্তু এইরকম অনেকেই আছেন। এঁদের বিনা বিচারে গ্রেফতার, বিনা অজুহাতে গ্রেফতার, কোনও কারণ নেই, কোনও কারণ দর্শাতে পারছেন না, মিথ্যা কথা বলছেন তাঁদের সম্বন্ধে, একেবারে জলজ্যান্ত মিথ্যা কথা। আবার যদি জেলের ভিতরে এরকম ব্যবহার করেন, তাহলে কী মনে হয়?"
*********************************************************************
জ্যোতিবাবু তখন বললেন - "আজকে আমরা এটা বুঝতে পারলাম, কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকার একমত হয়ে বর্ডার সিল করেছেন। যাইহোক, চিফ মিনিস্টার এসব কথা বলে ভাল করেছেন। তিনি যে অজুহাত দিয়েছেন, সেই অজুহাতে তিনি বলেছেন যে, সব পঞ্চম বাহিনী ঢুকে যাবে। আমি যে সব দেখেছি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এবং যে সব বই, তাতে আছে যে, পঞ্চম বাহিনীর কাজ করার জন্য যারা আসে, তারা ট্রাভেল ডকুমেন্ট ছাড়া আসে না। আমি জানি না, আমাদের রাষ্ট্রে ওইরকম পঞ্চম বাহিনী নেই বলে কেন বলছেন। বাইরে থেকে, আমেরিকা, পাকিস্তান থেকে, এরকম বহু লোক যাঁরা আমাদের এখানে এসে সমস্ত খবর নিয়ে যায়, যা সব রাষ্ট্রে হয় যে ট্রাভেল ডকুমেন্ট ছাড়া পঞ্চম বাহিনীর লোক ঢোকে না। এটুকু যদি ১৮ বছর না শিখে থাকেন, তাহলে জানি না কবে শিখবেন। কাজেই এসব ফাঁকির কথা বলে লাভ নেই। সরকার ঠিক করেছেন যে, ওঁরা (উদ্বাস্তু) এলে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়বে, পূর্ব পাকিস্তানে নর্মাল অবস্থা হয়ে গেছে,কাজেই এখন আসার প্রয়োজন নেই।"
*********************************************************************
১৯৬৫ সালের ২ এপ্রিল উদ্বাস্তুদের বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য জ্যোতিবাবু একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তখন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন বললেন - "এই যে ৯ হাজার ফিরে এলেন, এঁরা কারা? এঁরা যদি সেখান থেকে সর্বস্বান্ত হয়ে এসে থাকেন ঘরবাড়ি ছেড়ে, জমিজমা ছেড়ে, সমস্ত কিছু পরিত্যাগ করে, তাহলে তাঁরা কেন আবার ফিরে গেলেন, একথাটা চিন্তা করতে হবে। সেখানে যদি এরকম হয় যে, তাদের সেখানে ধর্ম থাকবে না, ইজ্জত থাকবে না, কালচার থাকবে না, সেখানে বাস করা অসম্ভব - তাহলে এত লোক ফিরে যাচ্ছেন কেন? কাজেই কেন্দ্রীয় সরকারের মনে এরকম সন্দেহ হতে পারে যে, এই সমস্ত লোক যারা চলে গেল, তাদের বেলায় ভালভাবে স্ক্রুটিনি করতে হবে, চেক করতে হবে, যাকে তাকে আসতে দেওয়া চলবে না। একজন বললেন, পাকিস্তান থেকে যে সমস্ত চর আসে, তাদের আপনারা প্রশ্রয় দেন। এতবড় একটা অসত্য উক্তি আমরা কল্পনা করতে পারি না। এইরকম যাঁরা কল্পনা করেন, তাঁদের সম্বন্ধে আমাদের ধারণা অত্যন্ত নিচু - তাঁদের কথার উত্তর দেওয়া উচিত নয় এবং আমাদের কাছে তাদের কিছু দাবি করার অধিকারও নি। তাঁরা মনে করেন, আমরা খুব খারাপ লোক, আমরা দেশের শত্রু, আমরা দেশদ্রোহী।"

জ্যোতিবাবু তখন বললেন - "আমরা কতকগুলি জায়গায় দেখতে গিয়েছিলাম - বর্ডার দেখার জন্য। ওঁরা আমাদের বলেছিলেন যে, ওঁদের গোপনে চলে আসতে হয়। কারণ অসুবিধাটা হচ্ছে, জাঁকজমক করে ডকুমেন্টস নিয়ে যদি আসার ব্যবস্থা করতে হয়, তাহলে কিছু সমাজবিরোধী লোক আছে যারা বাধা দেয় এবং নানাভাবে অত্যাচার করে। এরই জন্য তাঁরা ভাবেন, ওসব দরকার নেই। কোনও দিন রাতের অন্ধকারে চলে যাব। নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন বলেই তো তাঁরা এসব করেন। এখন তাহলে এঁদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে পাকিস্তানে, তা নাহলে এখানে তাঁদের কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।"
*********************************************************************
সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অন্য রাজ্যের বিধায়কদের বেতন ও ভাতা বেশি ছিল। এমন-কি অসমের তুলনাতেও এখানে বিধায়কদের বেতন ও ভাতা কম ছিল। তা সত্ত্বেও জ্যোতিবাবু বিলের বিরোধিতা করে বললেন - "আমরা এখানে আইন রচনা করি, আমাদের কাছে মানুষ অনেক কিছু আশা করেন। এই অবস্থার মধ্যে আমরা তাঁদের কিছু করতে পারলাম না, সরকারপক্ষ থেকে কিছু করলেন না - আমরা অ্যাসেম্বলিতে আর বেশিদিন নেই, দু'বছর। এর মধ্যে আমরা এসে আমাদের ভাতাটা বাড়িয়ে নিয়ে চলে গেলাম, বাকি অন্যদের ৫ টাকা - ২ টাকা বাড়ল - আমরা ৫০ টাকা বাড়িয়ে নিয়ে চলে গেলাম, প্রয়োজন যতই হক, এটা অশোভন, অন্যায় হয়। তারপরও যদি বেতন বৃদ্ধি হয়, তাতে আমাদের কিছু সুবিধা নেই। কারণ আমাদের বাড়তি টাকাটা সমস্ত পার্টিতে আসবে - এখন হংকং থেকে যখন পাচ্ছি না, তখন সরকারের তহবিল থেকে টাকা পেলে আমাদের কাজের সুবিধা হয়। কিন্তু তথাপি ওটা আমাদের বিরোধিতা করতে হচ্ছে যে, কারণ এই প্রস্তাবটি একেবারে সময়োপযোগী হয়নি।"
*********************************************************************
'৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসেও যখন জ্যোতিবাবু অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করছেন, তখন কংগ্রেস বেঞ্চ থেকে ব্যাপক হট্টগোল শুরু হয়। সেই গোলমাল উপেক্ষা করেই তিনি বক্তৃতা শুরু করে দেন। এই সময় মুখ্যমন্ত্রী সভাকক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যান। জ্যোতিবাবু তখন বলে উঠলেন - "আমি জানতে চাই, পালের গোদাটা বেরিয়ে গেলেন কেন? ওঁকে ডেকে আনুন। এখানে কাউন্সিল অফ মিনিস্টারদের যিনি হেড, মুখ্যমন্ত্রী, তিনি এই অনাস্থা প্রস্তাবের আগেই বেরিয়ে গেলেন, এটা কী করে হবে? এগুলো তো ভালো নয়।"

জ্যোতিবাবু একই কথা বলতেই থাকলেন - "মুখ্যমন্ত্রী, যিনি এই পালের গোদা, তাঁর এখানে থাকা উচিত ছিল এই অনাস্থা প্রস্তাব আলোচনার সময়। কিন্তু তিনি পালিয়ে গেলেন। তিনি কোথায় চলে গেলেন? হি ইজ দ্য লিডার ..."

ডেপুটি স্পিকার তখন বললেন - "তিনি তাঁর ঘরে বসে শুনবেন।"

কিন্তু সেই জবাব জ্যোতিবাবুকে সন্তুষ্ট করতে পারল না। তিনি বললেন - "তিনি যদি ঘরে বসে শোনেন, তাহলে আমরা কি সব ঘরে বসে আলোচনা করব? অবশ্য এটা আমি বুঝতে পারি, যাঁদের জনগণের কাছ থেকে পালিয়ে গুণ্ডা এবং পুলিশ বাহিনীর আশ্রয়ে থাকতে হয়েছে, আমাদের এই সব বক্তব্য শুনতে তাঁদের একটু অসুবিধা হবে, এ বিষয়ে আমরা নিঃসন্দেহ। তাই পালের গোদাটি এখান থেকে চলে গেলেন।"
*********************************************************************
সংসদীয় গণতন্ত্রকে কমিউনিস্টরা তাঁদের মূল লক্ষ্যে পৌঁছানোর মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল কেন, পরিষদীয় রাজনীতির গোড়ায় জ্যোতিবাবুর বক্তৃতা থেকে তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যেত। এখন সেই লক্ষ্য হয়ত অনেকটাই অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। সংসদীয় রাজনীতির গোলকধাঁধায় শ্রেণী সংগ্রামের পথের ব্যবহারও এখন অনেকটা সংশয়াচ্ছন্ন। বিশ্বায়নের দাপটে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর পথ আরও অনেক বেশি পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু গোড়াতে তো সেরকম ছিল না। তখন বিধানসভার যে কোনও বক্তৃতাতেই জ্যোতিবাবু মানুষের রাজনৈতিক অধিকারের কথা, কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক লক্ষ্যের কথা সরবে উচ্চারণ করেছেন। যেমন অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় তিনি বললেন - "আমরা বাংলার জনসাধারণকে বলেছি গঠনমূলক কথা যে, আমূল পরিবর্তন যদি মানুষের জীবনে আনতে হয়, তাহলে এই সরকারকে নির্মূল করতে হবে - এছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। এই সব সাধারণ মানুষ, কৃষক-শ্রমিকমধ্যবিত্ত, তাঁরা ১৯ বছর ধরে আবেদন-নিবেদন এই সরকারের কাছে করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতায় এটা জেনেছেন যে, এই সরকার দেশি-বিদেশি একচেটিয়া পুঁজিপতি ও বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পদলেহন করে চলেছে। আমাদের দেশের অগণিত মানুষের এখন এমনই অবস্থা হয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, একটা যুদ্ধবিগ্রহ হলে এখানকার সেকেণ্ড ক্লাস সিটিজেনে যারা পরিণত হয়েছে, সেই মুসলমান ভাইদের বিনা বিচারে গ্রেফতার করে রাখা হয়েছে। কারণ ওঁরা বললেন, পাকিস্তানে  গ্রেফতার হয়েছেন, সেইজন্য আমাদের পশ্চিমবাংলায় মুসলমান গ্রেফতার করতে হবে।"

জ্যোতিবাবু একথা বলা মাত্রই কংগ্রেসের সদস্যরা ব্যাপক গোলমাল শুরু করলেন। কিন্তু তাতে ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি বলেই চললেন - "তারা আমাদের মতো এখানকার নাগরিক। তিন হাজার মানুষকে বিনা বিচারে কোনও প্রমাণ ছাড়া কারাবরণ করালেন। এর জবাব কে দেবে আমাদের? মুখ্যমন্ত্রী এর জবাব দেবেন না। মুসলমানরা এ জিনিস বুঝেছেন। এটা কতবড় লজ্জার কথা। ওটা পাকিস্তানে হতে পারে, কারণ পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়করা বলেন যে, ওটা মুসলিম রাষ্ট্র। কিন্তু আমাদের এখানে কী করে এ জিনিস হয়?"
*********************************************************************
ট্রাম কোম্পানি অধিগ্রহনের ঘটনা, সেই সময়ে বাম রাজনৈতিক মহলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল। কারণ এই ট্রাম কোম্পানিকে ঘিরে বাম ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের অনেক ঐতিহ্য জড়িত ছিল। ১৯২৯ সালে সাইমন্স কমিশন যখন ভারতে এসেছিল, তখন অন্য অনেকের মতো কলকাতার ট্রাম শ্রমিকরাও সেই কমিশনের বিরুদ্ধে হরতাল ডেকেছিলেন। এবং সেই হরতাল ডাকার জন্য বিলাতি ট্রাম কোম্পানি একদিনে ৫০ শ্রমিককে ছাঁটাই করে দেয়। ভারতে তখন ব্রিটিশদের শাসন বলে ট্রাম কোম্পানির সেইসব ছাঁটাই শ্রমিক অন্য কোনও কারখানায় কাজ পাননি। সেই শ্রমিকদের অনেকেই পরে অনাহারে তিলে তিলে মারা গিয়েছেন। ট্রাম শ্রমিকদের আন্দোলন কিন্তু স্তিমিত হয়নি। বিদেশী নিয়ন্ত্রণ থেকে ট্রাম কোম্পানির মুক্তির দাবিতে তাঁদের আন্দোলন বরং আরও জোরদার হয়ে উঠেছিল। তারপর চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতা কর্পোরেশনের সামনে ট্রাম কোম্পানিকে কিনে নেওয়ার একটা সুযোগ আসে। সেইসময় কলকাতা কর্পোরেশনের সব কাউন্সিলাররা মিলিত ভাবে ট্রাম কোম্পানি কিনে নেওয়ার দাবি জানান। তার জন্য সরকারের কাছে ডিবেঞ্চার ছেড়ে টাকা যোগাড় করার অনুমতি চাওয়া হয়। কিন্তু তৎকালীন মুসলিম লিগ সরকার কলকাতা কর্পোরেশনকে সেই অনুমতি দেয়নি। তার পরের ঘটনা তো ইতিহাস।  
*********************************************************************
এই নির্বাচনে আবার যুক্তফ্রন্টে সামিল হওয়ার জন্য সি পি আই (এম)-কে বামপন্থী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, যে সব দল সমাজতন্ত্রের আদর্শ বা বিপ্লবের তত্ত্বে বিশ্বাস করে না, সেইসব দলের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা করতে সি পি আই (এম) এত আগ্রহী কেন। সি পি আই (এম)-এর এই সিদ্ধান্তকে তখন অনেকে সুবিধাবাদী বলে চিহ্নিত করেছিল। সেইসব সমালোচনার জবাবে সি পি আই (এম) তখন বলল -

(১) যেসব দল কংগ্রেস শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার ব্যাপারে নূন্যতম কর্মসূচির ভিত্তিতে সি পি আই (এম)-কে সাহায্য করতে প্রস্তুত, তাদের সঙ্গেই সি পি আই (এম) নির্বাচনী সমঝোতা করবে।

(২) সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের নীতি মেনে নেওয়ার জন্য সি পি আই (এম) ওই দলের উপর চাপ দিতে চায় না। আবার বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন কোনও মাপকাঠিতেই সি পি আই (এম) ওই সব দলের গণতান্ত্রিক চরিত্র বিচার করে না।

(৩) সি পি আই (এম) দেখে - শাসক কংগ্রেস দলের নীতি সম্পর্কে ওই সব দলের মনোভাব কীরকম, সি পি আই (এম)-এর সঙ্গে মৈত্রী গড়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে তারা কতটা আগ্রহী এবং নূন্যতম কর্মসূচি কার্যকর করার ব্যাপারে তাঁদের মনোভাব কেমন।
*********************************************************************
ছাঁটাই সম্পর্কে সরকারের মনোভাব ব্যাখ্যা করে তিনি বললেন, ছাঁটাই যাতে না-হয়, সবসময় সেভাবেই তাঁরা চিন্তা করবেন। জ্যোতিবাবুর বক্তব্য ছিল - "অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার জন্য ২০ বছরের কংগ্রেস সরকারই দায়ী। আর্থিক অচলাবস্থার দায়িত্ব দেখো পুরোপুরি শ্রমিকদের কাঁধে চাপালে চলবে কেন? অথচ সেরকম চেষ্টাই চলছে। শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকার ছেড়ে দিতে হবে - এরকম অবস্থা আমরা কিছুতেই মেনে নেব না। শ্রমিকরা কখনই ধর্মঘটের অধিকার ছেড়ে দিতে পারেন না। ধর্মঘটই শ্রমিকদের শেষ হাতিয়ার। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি যাতে মেনে নেওয়া হয়, যুক্তফ্রন্ট সবসময়ই সেদিকে নজর রাখবে। কোনও দাবি ন্যায্য কিনা, তা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিতে পারে। তাহলেও আলোচনার মাধ্যমে সেই মতপার্থক্য দূর করা যায়।"
*********************************************************************
অন্যদিকে, রাজ্যপাল পদে ধর্মবীরের থাকার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সংঘাত বেড়ে চলছিল। কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়ে দিলেন, বিধানসভার অধিবেশনের আগে রাজ্যপালকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে না। জ্যোতিবাবু তখন বললেন - "যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা  রাজ্যপালের একের অপরের উপর বিশ্বাস নেই। এই বিশ্বাস না-থাকলে কাজ চলে না। তাঁকে যেতেই হবে। ধর্মবীরের চলে যেতে ১০-১৫ দিন সময় লাগলেও লাগতে পারে। তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার যে সুরে কথা বলছেন, তা ভাল নয়। এতেই প্রচণ্ড আপত্তি আছে। এতে মনে হয়, কেন্দ্রীয় সরকার সহযোগিতা চান না।" ৬ মার্চ বিধানসভার অধিবেশনে এক নতুন নজির সৃষ্টি হল। ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে সেইদিনই প্রথম একজন রাজ্যপাল মন্ত্রিসভা যে ভাষণ তৈরি করে দিয়েছিল, তার একটি প্রধান অংশ বাদ দিলেন। রাজ্যপাল সরকারের তৈরি করে দেওয়া ভাষণের ৫৩৫টি শব্দ বাদ দিলে সরকার পক্ষের বিধায়করা 'ধর্মবীর ফিরে যাও' স্লোগান দিতে থাকেন। বিধানসভায় ধন্যবাদজ্ঞাপক প্রস্তাবের পাশাপাশি রাজ্যপালের নিন্দাও করা হয়। 
*********************************************************************
জোতদার-বর্গাদারদের মধ্যে সংঘাতের আঁচ চলে এল বিধানসভায়। ভূমি-সংস্কার সংশোধনী বিল নিয়ে আলোচনায় হরেকৃষ্ণ কোঙার বললেন - "আমি একথা যুক্তফ্রন্ট সরকারের পক্ষ থেকে বলতে চাই, একদিকে জোতদার, আর একদিকে বর্গাদার - উভয়কে আমরা সমান চোখে দেখি না। আমি মনে করি, বর্গাদাররা দুর্বল, তারা গরীব। তাদের রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য, অত্যন্ত পবিত্র কর্তব্য। সেই কর্তব্য আমরা পালন করব। তাদের সেই অধিকার ও কর্তব্য করতে গিয়ে আমরা ছোটো ছোটো মালিকের ন্যায়-সঙ্গত অধিকারের কথাও নিশ্চয়ই বিবেচনা করব। কিন্তু বড় বড় জোতদারের প্রতি আমাদের কোনও দরদ নেই।"

বিল নিয়ে আলোচনার সময় বিরোধী পক্ষ বলেছিল, এই আইনের ফলে শ্রেণী সংগ্রাম বেড়ে চলবে। সরকার পক্ষ বললেন, না, এর ফলে কোনও শ্রেণীসংগ্রাম বাড়বে না। যে শ্রেণীসংগ্রাম আছে, যা সেখানে চলছে, সেই শ্রেণীসংগ্রামে কংগ্রেস সরকার এতদিন ধনীদের সাহায্য করেছেন, তাঁরা গরীব চাষীদের এতদিন পিটিয়েছেন। আমরা সেই গরীব চাষীদের হাত-পা সুদৃঢ় করতে চাই, সেই দুর্বল, গরীব চাষীদের পাশে আমরা সরকারি যন্ত্র নিয়ে দাঁড়াতে চাই।"

বিরোধীরা তখন বলেছিলেন, যা কিছুই হোক, আইনসঙ্গত ভাবে হোক। তার জবাবে হরেকৃষ্ণ কোঙার স্পষ্ট বললেন - "আইনসঙ্গত ভাবে যদি করতে যাই, তাতে অনেক অসুবিধা আছে। আইনসঙ্গত ভাবে সব কিছু করতে পারছি না, যতক্ষণ না ভূমি-সংস্কার আইন পরিপূর্ণভাবে সংশোধন করতে পারছি। তবে এও আমরা জানি, সবই আইনের মাধ্যমে সংশোধন করতে পারা যায় না। যাদের টাকা আছে, তারা কোর্টকাছারিতে গিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে পারবে, দলিল দেখাতে পারবে। আইনের পথটা কোথায়? তাঁরা যে আইন করলেন, সেই আইনের ফাঁক দিয়ে হাজার হাজার বিঘা জমি বেরিয়ে গেল। এই আইনের ফাঁক দিয়েই হাজার হাজার বিঘা জমি তারা চুরি করতে পারবে এবং হাজার হাজার টাকা ফি দিয়ে সিদ্ধার্থবাবুর মতো ব্যারিস্টার রাখতে পারবে। কী করতে পারবে গরীব চাষী, দুর্বল চাষী? তাদের সামর্থ্য কোথায়? আমরা জানি, গরীব কৃষক যদি সংগঠিত না হয়, আমাদের পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে আমরা একা গভর্নমেন্ট তাদের রক্ষা করতে পারব না। আমরা তাদের উৎসাহ দেব এবং উৎসাহ দিয়েই যাব। এতে কেউ কেউ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। আমরা এতে আতঙ্কিত নই। ওঁরা যখন গাল দেন, তখন আমরা মনে করি, আমরা সঠিক পথে চলছি। আর জোতদারদের বন্ধুরা যদি আমাদের সমর্থন করেন, তখন বুঝতে হবে, আমাদের কোনও পদস্খলন হচ্ছে।"
*********************************************************************
আরও একটি নির্বাচন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল পশ্চিমবঙ্গে। নির্বাচনের আগে রক্তাক্ত হয়ে উঠল গোটা রাজ্য। '৭১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর স্ট্রিটে আততায়ীর ছুরিকাঘাতে নিহত হলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের চেয়ারম্যান ও জননেতা হেমন্ত বসু। খুনীর আচমকা আক্রমণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় পর্যন্ত তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। অজাতশত্রু ওই নেতার মুখ থেকে অস্পষ্টভাবে শোনা গিয়েছিল - "আমায় খুন করে তোমাদের কী লাভ? কেন আমায় মারছো?"
*********************************************************************
অজয় মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন এই কোয়ালিশন সরকার অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হল না। কোয়ালিশনের শরিকদের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত তীব্র হয়ে উঠল। তাদের দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি অনুযায়ী ওই ধরনের কোয়ালিশনে ফরওয়ার্ড ব্লকের খাপ খাওয়ার কথা ছিল না। তারা কি শুধুই তীব্র সি পি আই (এম)-বিরোধিতার জন্য ওই কোয়ালিশনে যোগ দিয়েছিল, না স্পিকার পদের আকর্ষণে - তা ছিল দীর্ঘ গবেষণার বিষয়। বাজেট অধিবেশনে শাসক কোয়ালিশনের সংকট তীব্র হয়ে উঠল। কংগ্রেস নিশ্চিত হয়ে গেল যে, বাজেট অধিবেশনেই তারা গরিষ্ঠতা হারাবে। ফলে তড়িঘড়ি বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করা হল। সি পি আই (এম)-এর নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটকে সরকার গড়ার কোনও সুযোগ না দিয়ে ২৫ জুন রাতে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভেঙে দেওয়া হল। আবার  রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হল রাজ্যে। তখন রাজ্যপাল ছিলেন এস এস ধাওয়ান। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকার কেন্দ্রের শিক্ষামন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে দফতর-বিহীন মন্ত্রী হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে পাঠাল। সিদ্ধার্থবাবু অনেকদিন থেকেই এই রাজ্যের রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। এক সময় তিনি বামপন্থীদের সঙ্গেও ছিলেন। ফলে সি পি আই (এম)-এর মোকাবিলা করার জন্য ইন্দিরা গান্ধীর তাঁকেই পছন্দ হল। রাজ্যে অবশ্য খুনোখুনির রাজনীতি অব্যাহত ছিল। '৭১ সালের অগস্ট মাসে কাশিপুরে গণহত্যার ঘটে তার মধ্যে সব থেকে চাঞ্চল্যকর। রাজনৈতিক দল এবং পুলিশের মিলিত সন্ত্রাস যে কতদূর ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে, কাশীপুরের ঘটনাই ছিল তার প্রমাণ। 
*********************************************************************
অবশেষে এল ১৯৭২ সালের নির্বাচন। ১১ মার্চ পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন ঘোষিত হল। নির্বাচনের আগে সি পি আই (এম)-এর নেতৃত্বে বামপন্থীরা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে ১১ দফা দাবি সনদ পেশ করলেন। কিন্তু সন্ত্রাস অব্যাহত রইল। ভোটের দিন সকাল থেকেই কংগ্রেস কর্মী এবং পুলিশের মিলিত ব্যবস্থায় সি পি আই (এম) সহ অন্যান্য বামপন্থী দল কোণঠাসা হয়ে পড়ল। জ্যোতিবাবুর নির্বাচনী কেন্দ্র বরাহনগরে ভোট শুরু হওয়ার আগেই অর্ধেকের বেশি বুথ থেকে পোলিং এজেন্টদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ ও কংগ্রেস কর্মীদের সম্মিলিত সন্ত্রাসের মোকাবিলা করতে পারল না সি পি আই (এম)। সকাল থেকেই প্রায় সব জেলা থেকেই বুথ দখলের খবর আসতে শুরু করল। ১৩ মার্চ সন্ধ্যায় সি পি আই (এম) গণনা কেন্দ্রে কাউন্টিং এজেন্ট পাঠাবে না বলে ঠিক করল।

ভোটের ফলে সি পি আই (এম)-এর আশঙ্কাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। কংগ্রেস এককভাবে ২১৬টি আসন দখল করল। সি পি আই পেল ৩৫টি আসন, সি পি আই (এম) পেল ১৪টি। সি পি আই প্রার্থী শিবপদ ভট্টাচার্যের কাছে প্রায় ৩৯ হাজার ভোটে হেরে গেলেন জ্যোতিবাবু। ২৫ বছর ধরে যিনি ধারাবাহিকভাবে বিধানসভায় প্রভাবশালী নেতা হিসাবে নিজের স্টাইলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সেই জ্যোতিবাবুর পরাজয় ছিল সেবারের ভোটের ফলে সব থেকে চাঞ্চল্যকর ঘটনা। সি পি আই (এম) অবশ্য এই ফলে অবাক হয়নি।

১৮ মার্চ বামপন্থী ফ্রন্ট সিদ্ধান্ত নিল, তারা বিধানসভা বয়কট করবে। যৌথ বিবৃতিতে বামপন্থী নেতারা বললেন - "এই নির্বাচন ছিল পুরোপুরি জালিয়াতির উপর সাজানো। শাসকদল, প্রশাসন ও পুলিশ যে হরেকরকম জালিয়াতির শরণ নিয়েছিল, তার আরও অনেক অকাট্য প্রমাণ আমাদের হাতে এসেছে।

"এই পরিস্থিতিতে এই সাজানো আইনসভা বয়কট করে প্রতিবাদ জানানো ছাড়া আমাদের সামনে অন্য কোনও পথ নেই।"
*********************************************************************
৫ জুন ব্রিগেডের সমাবেশে অবশ্য জ্যোতিবাবু বসেছিলেন জয়প্রকাশের পাশেই। সেই সমাবেশের বক্তৃতায় জয়প্রকাশ '৭২-এর নির্বাচনের সন্ত্রাসের কথা উল্লেখ করলেন। তিনি বললেন - "এই শাসন ব্যবস্থা বদল না করে গনতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাওয়া যাবে না। ভোটের মাধ্যমেও এই অবস্থা বদলানো যাবে না। গতবার জ্যোতিবাবুর কেন্দ্রে সকাল ১০ টার মধ্যেই ভোট শেষ হয়ে গিয়েছিল। প্রফুল্লবাবু (সেন) এবং অন্য নেতারা রয়েছেন। তাঁরা তো জানেন, ভোটের নামে এখানে কী হয়েছিল! মুষ্টিমেয় লোক বোমা-পিস্তল হাতে বুথ দখল করে ভোটকে প্রহসনে পরিণত করবে - এটা সহ্য করা বাংলার যুব শক্তির পক্ষে লজ্জার কথা।" সেদিনের সভায় জয়প্রকাশই ছিলেন একমাত্র বক্তা। সভায় সেদিন কোনও দলের কোনও পতাকাই দেখা যায়নি।
*********************************************************************

No comments:

Post a Comment