Monday, 12 February 2024

জ্যোতিষশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞান - ডঃ শ্যামল চক্রবর্তী

 আমাদের যে চারটি 'বেদ' রয়েছে তার কোনটিতেই 'জ্যোতিষী'র কথা লেখা নেই। চারটে 'বেদ' বাদ দিয়ে 'বেদাঙ্গ' রয়েছে। দর্শন রয়েছে। 'ব্রাহ্মণ' ও 'সংহিতা'র কথাও আমরা জানি। এসবই খ্রিস্ট ধর্ম দু'হাজার থেকে পাঁচশো বছর আগের কথা। বেদসাহিত্যের কোথাও আপনি জ্যোতিষী, কোষ্ঠি, ঠিকুজি এসব কথা পাবেন না। সার্কুলার দাতারা বলেছেন, পুরোনো ভারত জানতে 'বৈদিক জ্যোতিষ' পড়ুন। আমরা বলছি, বেদসাহিত্যে জ্যোতিষীর ব্যাপার স্যাপার নেই বলেই ভারতীয় হিসেবে আমরা গর্বিত। আমাদের একটি বেদাঙ্গের নাম 'জ্যোতিষাম অয়নম'। পাতা খুলে দেখবেন। খ-গোলের কথা আছে। জ্যোতিষ্কদের চলাফেরার কথা আছে। খ-গোল মানে 'পৃথিবী' অনেকেই জানেন। গ্রহ, ভাগ্য, হস্তরেখা এসব কথার চিহ্নমাত্র নেই।

হ্যাঁ, ভারতীয় হিসেবে গর্ব হয় যখন দেখি চীন মিশর গ্রিস সকল সভ্যতায় 'জ্যোতিষী'র কথাবার্তা থাকলেও ভারতীয় সভ্যতায় তার ছায়া মাত্র নেই। গ্রিক সভ্যতা বাদ দিলে বাকি সব সভ্যতায় এই জ্যোতিষচর্চা রাজা রাজড়াদের বাড়ির বিষয় ছিল। সব রাজাই একজন বা একের বেশি রাজজ্যোতিষী রাখতেন। কখন যুদ্ধে যেতে পারলে জয় হবে, কখন সিংহাসনে রাজপুত্রের অভিষেক হবে, কখন রাজকন্যার বিয়ে দিলে ভালো হয় - এসব কথা রাজজ্যোতিষীদের গোনা গুনতি করে বলতে হত। সাধারণ মানুষ 'রাজাউজির'দের ব্যাপার স্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। গ্রিক সভ্যতায় এসে আমরা দেখতে পেলাম 'জ্যোতিষ' বিষয়টা একরকমের আটপৌরে চরিত্র অর্জন করেছে। সাদামাটা মানুষেরাও 'জ্যোতিষ' নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। ভালোমন্দ জানতে জ্যোতিষীদের কাছে যাচ্ছেন। নিশ্চয়ই সেই যুগে কোন কারসাজি ছিল। রাজার বাড়ির আচার বাইরে ছড়াতে পারলে ব্যবসা বাড়ে অনেক। বুদ্ধি খাটিয়ে একদল মানুষকে এই কাজ করতে হয়েছে। যেখানে মানুষের বসতি সেখানেই জ্যোতিষের আলোচনা শুরু করতে হয়েছে। বিজ্ঞানের ইতিহাস পড়লে আমরা দেখি, গ্রিস দেশের পণ্ডিতেরা একটা বিষয়ে খুব অহঙ্কার করেন। কি বিষয়? গ্রিক সভ্যতার আগে নাকি পৃথিবীর কোথাও 'বিজ্ঞান' ছিল না। কি ছিল তবে? ওঁরা বলেন, 'জ্ঞান' ছিল, 'বিজ্ঞান' ছিল না। আমরা জানি, কথা দুটোর মানে আলাদা। 'জ্ঞান' বলতে কত কি হতে পারে। 'বিজ্ঞান' বললে যা খুশি হয় না। নিয়মকানুন মেনে কথা বলতে হয়। আমরা এখানে কথাটার সত্যি-মিথ্যে যাচাই করছি না। তবে বলতে চাইছি, গ্রিক সভ্যতার শেষ দিকে ছিল ব্যাবিলন সভ্যতা। ব্যাবিলন শহরকে মাঝে রেখে গড়ে উঠেছিল। সেই সভ্যতারই একজন রাজা ছিলেন আলেকজাণ্ডার। আলেকজাণ্ডার খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ সালের কাছাকাছি আমাদের দেশ আক্রমণ করেন। তখনই ওঁদের দেশ থেকে এই দেশে 'জ্যোতিষবিদ্যা'র আমদানি ঘটে। আগে বলেছি আমরা, গ্রিক সভ্যতার আমলে জ্যোতিষচর্চা ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ে। কোষ্ঠি তৈরি শুরু হয়।

বাইরে থেকে কোন কিছু এলেই তা বেঁচে থাকে না। তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। আমরা দেখছি, প্রথম যে নামকরা মানুষ 'জ্যোতিষ' বাঁচিয়ে রাখতে উদ্যোগী হয়েছেন তিনি বরাহমিহির। ছয় শতকের চরিত্র বরাহমিহির। পণ্ডিত মানুষ। নানা বিষয়ে তাঁর বই রয়েছে। গণিত, জ্যোতিষ, ভূগোল এমনকি প্রাণিবিদ্যাতেও তাঁর খুব উঁচুমানের বই ছিল। তাঁর জীবনের কথা বলতে গেলে দুটো বইয়ের নাম করতে হয়। 'পঞ্চসিদ্ধান্তিকা' আর 'বৃহৎসংহিতা'। প্রথম বইটিতে হিন্দু জ্যোতির্বিদ্যার নানা ভাবনা চিন্তা রয়েছে। হিন্দু জ্যোতির্বিদ্যার পাঁচটি শাখা। পৌলিশা, রোমক, বশিষ্ঠ, সূর্য আর পৈতামহ। এদের এক একটিকে আমরা 'সিদ্ধান্ত' বলি। তাই একসাথে বরাহমিহির নাম দিয়েছিলেন 'পঞ্চসিদ্ধান্তিকা'। তবে একটা কথা বলা দরকার। পৌলিশা ও রোমক সিদ্ধান্তে গ্রিক ভাবনার যথেষ্ট প্রভাব দেখা যায়। এমন কথা বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাও বলেছেন। বরাহমিহির তাঁর লেখায় আমাদের দেশের আর্যভট্ট ছাড়াও লাটদের সিংহাচার্য, প্রদ্যুম্ন ও বিজয়নন্দীর কথা বলেছেন।

আমাদের দেশের বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার ১৬ই জুন ২০০১ তারিখের 'ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি' পত্রিকায় পরিষ্কার লিখেছেন, 'বৈদিক জ্যোতিষবিদ্যা 'বৈদিক' নয়, 'বিজ্ঞান'ও নয়। আমাদের বেদের কোথাও এই বিষয়ে কথা নেই। বরং বলা যায় আর্যভট্ট প্রথম (পঞ্চম শতাব্দ) থেকে শুরু করে ভাস্কর দ্বিতীয় (দ্বাদশ শতাব্দ) পর্যন্ত আমাদের জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা ঈর্ষণীয় মৌলিকত্বের সাক্ষর রেখেছে।

দ্বিতীয় যে বইটির কথা আমরা বলব, বোধ হয় বরাহমিহির সেই বই না লিখলে আরও ভালো করতেন। দুর্বলতাহীন একজন বড়ো মাপের বিজ্ঞানী হিসেবেই তাঁর নাম আলোচনা হত। যাই হোক, বইটির নাম আমরা বলেছি। 'বৃহৎসংহিতা'। ফলিত জ্যোতিষের বই। গ্রহের ফেরে মানুষের নানা রকমের ক্ষতি হয়। ক্ষতি এড়াতে গ্রহরত্ন ধারণ করতে হয়। বরাহমিহির কথাটা মানেন। তাই 'বৃহৎসংহিতা'য় নানা গ্রহরত্নের গুণাগুণের কথা ফলাও করে লিখলেন।


No comments:

Post a Comment