Friday, 5 January 2024

আমার জীবন : কিছু কথা - কান্তি বিশ্বাস

 "এই বিদ্যালয়ে আমি যখন কাজ করছি তখন পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যালয় ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক। এই রাজ্যের কিছু সংখ্যক বিদ্যালয়ে ছিল একাদশ শ্রেণী যুক্ত উচ্চ মাধ্যমিক। একাদশ শ্রেণীর পরে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীৰ্ণ ছাত্র-ছাত্রীগণ কলেজে ডিগ্রী শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারত। অধিকাংশ বিদ্যালয় ছিল মাধ্যমিক। সেখানে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীরা দশমশ্রেণীর শেষে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হত। যারা সফল হত তারা কলেজে এক বছরের জন্য পি.ইউ কোর্সে ভর্তি হত। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে কলেজে ডিগ্রী ক্লাশে ভর্তি হতে পারত।

এই রাজ্যে অধিকাংশ মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল সরকারের ঘাটতি ভিত্তিক আর্থিক সহায়তার অন্তর্ভুক্ত। এই সব বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের বেতন ও অন্যান্য খরচ বাবদ সারা বছরে বিদ্যালয়ের যে ব্যয় হত তার থেকে ওই বিদ্যালয়ে পাঠরত ছাত্র-ছাত্রীদের বেতন বাবদ যে টাকা আদায় হওয়ার কথা, তা হোক বা না হোক, সেই অর্থ হিসেবের মধ্যে ধরে বিদ্যালয়ের মোট খরচ থেকে বিয়োগ করে অবশিষ্ট অর্থ সরকারের শিক্ষা বিভাগ থেকে দেওয়া হতো এবং দেওয়া হতো বছরে একবার। আর্থিক বছরের শেষ মাস অর্থাৎ মার্চ মাসের অন্তিম লগ্নে সেই অর্থ বিদ্যালয়কে দেওয়া হতো। রাজ্যের অবশিষ্ট মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলি ছিল সরকারের 'থোক সাহায্য' এর প্রকল্পের অধীনে। এই সব বিদ্যালয়ে সরকার থেকে বছর শেষে একটা থোক আর্থিক সাহায্য পেত। বিদ্যালয়ের সার্বিক ব্যয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কত অর্থ আদায় হল তা সরকার বিবেচনা করত না। এই থোক আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ হত অত্যন্ত নগন্য। আর বাকি স্কুলগুলি সরকার থেকে কোনো অর্থিক সাহায্যই পেত না। এর ফলে স্বাধীন ভারতে একটি রাজ্যে শিক্ষার যে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি তার ধারে কাছেও যেতে পারত না।

রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত এই রাজ্যে শিক্ষার এই দৈন্যদশার বিরুদ্ধে শিক্ষাপ্রিয় মানুষ এবং বিদ্যালয় শিক্ষকদের একমাত্র সংগঠন নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতি নিয়মিতভাবে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে এই দৈন্যদশার বিরুদ্ধে সরকারের কাছে দাবি জানাল। শিক্ষকগণ বিদ্যালয়ের প্রথম ঘন্টায় যে যে শ্রেণীতে যাবেন তাঁদের বলা হতো সেই সেই শ্রেণীর 'শ্রেণী শিক্ষক'। শ্রেণী শিক্ষকের দায়িত্ব থাকত প্রতিদিন প্রথম ঘন্টায় যখন শ্রেণীকক্ষের মধ্যে যাবেন তখন ছাত্র-ছাত্রীকে কাছ থেকে বেতন আদায়ের খাতা এবং বেতন দেওয়ার পরে ছাত্র-ছাত্রীদের যে রসিদ দেওয়া হতো সেই রসিদ বই হাতে করে শ্রেণীকক্ষে হাজির হওয়া। শিক্ষার্থীদের হাজিরা নথিভুক্ত করার পরে শ্রেণী শিক্ষকের কাজ হতো জমিদারী সেরেস্তার তহশীলদারের কাজ। কে কে বেতন এনেছে তাদের ডেকে একে একে দাঁড়াতে বলতেন এবং বেতন নিয়ে খাতায় নথিভুক্ত করে রসিদ কেটে শিক্ষার্থীদের দিয়ে দিতেন। মূলতঃ বিদ্যালয়ের প্রথম ঘন্টা এইভাবেই অতিবাহিত হত। যেহেতু বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের বেতন ওই ছাত্র-ছাত্রীদের বেতন থেকে দেওয়া হত সেইজন্য প্রতি শনিবার ছুটির পর শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীগণ বিদ্যালয়ের অফিস ঘরে হাজির হতেন। সপ্তাহে যে অর্থ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় হত তার মধ্যে থেকে ভাগের ভাগ কোন শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী কত পাবেন তা নেওয়ার জন্য।

শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের বেতন বেদনাদায়কভাবে সরকার নির্ধারিত করেছিল অত্যন্ত কম। আমার মনে আছে এবং পশ্চিমবঙ্গের দৈনিক সংবাদপত্রেও খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তখন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতির সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা সত্যপ্রিয় রায়ের কাছে নেতৃত্বে কলকাতার মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে শিক্ষকদের দৈন্যদশা উপস্থিত করে তা প্রশমনের জন্য একদিন দেখা করতে যান। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁরা সবিস্তারে তাঁদের বেতন-ভাতার পরিমাণ কত কম এবং তা কত অনিয়মিতভাবে দেওয়া হয় তা বিবেচনা করে শিক্ষক সমাজকে এই বৃত্তিগত দুর্দশা থেকে মুক্তি দেওয়ার জয় আবেদন জানিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে নেতা সত্যপ্রিয় রায় বলেছিলেন, 'আমরা একজন অর্থ বিজ্ঞানীকে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের আর্থিক অব্যবস্থা সম্পর্কে সমীক্ষা চালিয়েছে।' এই সমীক্ষার প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের মাসিক বেতন রাজ্যের একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর থেকেও কম। এই বেদনার আমরা অবসান চাই।'

মুখ্যমন্ত্রীর পাশেই বসেছিলেন রাজ্যের মুখ্য সচিব, তিনি এই কথাগুলি শুনে মন্তব্য করেছিলেন 'রাজ্য সরকারের চতুর্থশ্রেণীর কর্মচারীদের শূন্যপদ পূরণ করার জন্য যখন বিজ্ঞাপন বেরুবে শিক্ষকগণ যদি ওই পদের জন্য আবেদন করেন সরকার তা সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করবে।' শিক্ষক সমাজের প্রতি ওই অসম্মানজনক কুৎসিত মন্তব্যর বিরুদ্ধে শিক্ষক প্রতিনিধিগণ প্রচণ্ড প্রতিবাদ করেন এবং মুখ্যমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, 'মুখ্য সচিব যদি তার এই মার্জনাহীন মন্তব্য প্রত্যাহার না করেন তাহলে এখনই এই কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে যাব।'

মুখ্যমন্ত্রী মুচকি হেসে নীরব রইলেন। এই ঘটনার প্রতিবাদে অপমানিত হয়ে শিক্ষক নেতৃবৃন্দ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। এইরকমই ছিল সেই সময়কার বিদ্যালয় শিক্ষকদের বেদনা ভারাক্রান্ত জীবন কাহিনী।**********************************************
আমি বনগাঁয় এসে উদ্বাস্তুদের বিষয়টি সম্পর্কে পার্টির নেতাদের সাথে আলোচনা করি। তাদের কাছ থেকে জানতে পারলাম এই বঙ্গের বামপন্থী দলগুলির সম্মিলিত প্রয়াসে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের জন্য আন্দোল সংগঠিত করতে তৈরি হয়েছে একটি সংস্থা যার নাম 'সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদ' সংক্ষেপে UCRC. বনগাঁ মহকুমায় পরে 'সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদের' শাখা তৈরি হল। পার্টির সিদ্ধান্ত অনুসারে আমাকে সভাপতি করা হল। সম্পাদক হয়েছিলেন শচীন ঘোষ। একই সাথে আমি ভারতের যুব জীবনের সমস্যাকে দূর করে তাদের জীবনকে অর্থবহ করার জন্য যোগদান করলাম 'গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন'-এ। আমি উক্ত আন্দোলনের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়ি। ১৯৬৭ সালে কলকাতার ত্যাগরাজ হলে গঠিত হল গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের নির্বাচিত কমিটি। সভাপতি নির্বাচিত হলেন অমিতাভ বসু। অন্যতম সহঃ সভাপতি নির্বাচিত হলাম আমি। সম্পাদক নির্বাচিত হলেন অশোক দাশগুপ্ত। ওই সম্মেলনের পরে পাঞ্জাবের জলন্ধরে আয়োজিত হল যুব সম্মেলন। ওই সম্মেলনের সভাপতিমণ্ডলীতে আমি ছিলাম এবং সভাপতিমণ্ডলীর সভাপতি হিসাবে আমাকে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হয়েছিল। ওই সম্মেলন থেকে তৈরি হল সর্বভারতীয় যুব সংগঠন 'ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন' বা Democratic Youth Federation of India (DYFI)। এই সংগঠনের নিয়ম আছে ৪০ বছর বয়স অতিক্রম করার পরে আর কেউ এই সংগঠনের সদস্য থাকতে পারবে না। আমার বয়সের কারণে আমি পরে এই সংগঠনের কাজ থেকে অব্যাহতি পেলাম। অনেক পরে ১৯৭৭ সালে যখন আমি যুব কল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী হয়েছিলাম তখন পার্টির রাজ্য সম্পাদক শ্রদ্ধেয় কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি তো যুব কল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী, আমি যুব ফেডারেশনের সদস্য আছি কি না? আমি বললাম, 'ওই সংগঠনের সাথে আমার কি সম্পর্ক ছিল তা আপনাকে বোঝাতে পারব না, কিন্তু বয়সজনিত কারণে এখন আমি আর সদস্য নেই।' শ্রদ্ধেয় কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত আমাকে ধমক দিয়ে ভারী একটা মজার কথা বলেছিলেন, বলেছিলেন 'কমিউনিস্ট পার্টিতে সবসময় জন্ম তারিখ দিয়ে বয়স ঠিক হয় না, বয়স ঠিক করে পার্টি। আপনি এখনও যুবক। সেই জন্য ওই সগঠনের মধ্যে থেকে আপনি কাজকর্ম করবেন।' আমি যখন ওই বিভাগের মন্ত্রী তখন যুব সংগঠনের সাথে আমার সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ করি এবং পাঁচ বছর ওই দপ্তরের মন্ত্রী ছিলাম সেখানে বছরে তিনটি করে সভা নিয়মিতভাবে করতাম বিশেষ কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে। তাদের মধ্যে নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন অশোক দাশগুপ্ত সহ সি. পি. আই পার্টির যুব সংগঠনের নেতা মঞ্জু কুমার মজুমদার, আর. এস. পি. পার্টির যুব সংগঠনের নেতা ক্ষিতি গোস্বামী এবং ফরোয়ার্ড ব্লক পার্টির যুব সংগঠনের নেতা মহম্মদ ইয়াকুব। এরই সাথে সাথে আমি কৃষক সভার কর্মী হিসাবে যুক্ত হই। কৃষক আন্দোলনের সম্ভাব্য রূপরেখা তৈরি করতে সাধ্যানুসারে আমি ভূমিকা পালন করি।  
**********************************************
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার পরেই নভেম্বর মাসে পার্টির রাজ্য দপ্তরে রাজ্য সম্পাদক কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত এবং কমরেড জ্যোতি বসু আমাদের পার্টির মন্ত্রীদের এক সভায় ডেকে পাঠালেন। আমরা সকলেই সেখানে হাজির হলাম। সেখানে কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত কয়েকটি মূল্যবান কথা আমাদের বলেছিলেন। তাঁর সেই বক্তব্যের রাজনৈতিক গুরুত্ব যে অপরিসীম তা আমরা সকলেই মনে মনে উপলব্ধি করেছিলাম। তিনি অনেক কথার মধ্যে শেষের দিকে যে কথাগুলি বলেছিলেন তা আমার মনে চিরভাস্বর হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন, 'ভারতের সংবিধানে রাজ্য সরকারের ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত, তদুপরি কেন্দ্রে রয়েছে আমাদের অত্যন্ত বিরোধী সরকার। এই অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপক মানুষের সমর্থনপুষ্ট হয়ে আমরা এখানে বামফ্রন্ট সরকার গড়েছি। কাজের সুযোগ যতই কম হোক না কেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বাধা যত তীব্রই হোক না কেন রাজ্যবাসীর প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সুস্পষ্ট উদ্যোগ আমাদের গ্রহণ করতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে নতুন উদাহরণ। তার দ্বারা সমগ্র ভারতবাসীর সামনে আমরা উপস্থিত করতে পারবো এক উৎসাহব্যঞ্জক দৃষ্টান্ত যা বামপন্থী রাজনীতির প্রতি সমগ্র দেশবাসীকে আকৃষ্ট করবে। সর্বদা মনে রাখতে হবে জনকল্যাণে আমাদের এই রাজ্য সরকারের ক্ষমতা যত সীমিতই হোক না কেন, আমাদের কমরেডদের পথভ্রষ্ট, দুর্নীতিগ্রস্ত করতে তা যথেষ্ট শক্তিশালী। সেই জন্য পার্টির নেতা থেকে কর্মী সকলকে এই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের কমরেডদের আচার-আচরণ দিয়ে মানুষ আমাদের পার্টিকে বিচার করবে। সুস্পষ্ট বর্ধিত উপার্জন ব্যতীত আমাদের কমরেডদের জীবনযাত্রার মান যেন উন্নত না হয়। যে কমরেডদের বাড়িতে তেলাপিয়া মাছ যায় সেখানে যেন ওই শর্তব্যতীত রুই মাছ না যায়। যে কমরেড বিড়ি খান তার হাতে যেন ওই একই কারণ ব্যতীত সিগারেট না ওঠে। যিনি চারমিনার সিগারেট খান তার হাতে যেন উইলিস সিগারেট না দেখি। এক কঠিন কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততার সাথে আমাদের আদর্শবোধের পরিচয় দিতে হবে।'  
**********************************************
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার পরেই নভেম্বর মাসে পার্টির রাজ্য দপ্তরে রাজ্য সম্পাদক কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত এবং কমরেড জ্যোতি বসু আমাদের পার্টির মন্ত্রীদের এক সভায় ডেকে পাঠালেন। আমরা সকলেই সেখানে হাজির হলাম। সেখানে কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত কয়েকটি মূল্যবান কথা আমাদের বলেছিলেন। তাঁর সেই বক্তব্যের রাজনৈতিক গুরুত্ব যে অপরিসীম তা আমরা সকলেই মনে মনে উপলব্ধি করেছিলাম। তিনি অনেক কথার মধ্যে শেষের দিকে যে কথাগুলি বলেছিলেন তা আমার মনে চিরভাস্বর হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন, 'ভারতের সংবিধানে রাজ্য সরকারের ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত, তদুপরি কেন্দ্রে রয়েছে আমাদের অত্যন্ত বিরোধী সরকার। এই অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপক মানুষের সমর্থনপুষ্ট হয়ে আমরা এখানে বামফ্রন্ট সরকার গড়েছি। কাজের সুযোগ যতই কম হোক না কেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বাধা যত তীব্রই হোক না কেন রাজ্যবাসীর প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সুস্পষ্ট উদ্যোগ আমাদের গ্রহণ করতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে নতুন উদাহরণ। তার দ্বারা সমগ্র ভারতবাসীর সামনে আমরা উপস্থিত করতে পারবো এক উৎসাহব্যঞ্জক দৃষ্টান্ত যা বামপন্থী রাজনীতির প্রতি সমগ্র দেশবাসীকে আকৃষ্ট করবে। সর্বদা মনে রাখতে হবে জনকল্যাণে আমাদের এই রাজ্য সরকারের ক্ষমতা যত সীমিতই হোক না কেন, আমাদের কমরেডদের পথভ্রষ্ট, দুর্নীতিগ্রস্ত করতে তা যথেষ্ট শক্তিশালী। সেই জন্য পার্টির নেতা থেকে কর্মী সকলকে এই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের কমরেডদের আচার-আচরণ দিয়ে মানুষ আমাদের পার্টিকে বিচার করবে। সুস্পষ্ট বর্ধিত উপার্জন ব্যতীত আমাদের কমরেডদের জীবনযাত্রার মান যেন উন্নত না হয়। যে কমরেডদের বাড়িতে তেলাপিয়া মাছ যায় সেখানে যেন ওই শর্তব্যতীত রুই মাছ না যায়। যে কমরেড বিড়ি খান তার হাতে যেন ওই একই কারণ ব্যতীত সিগারেট না ওঠে। যিনি চারমিনার সিগারেট খান তার হাতে যেন উইলিস সিগারেট না দেখি। এক কঠিন কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততার সাথে আমাদের আদর্শবোধের পরিচয় দিতে হবে।'  
**********************************************
কেন্দ্রে তখন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) পরিচালিত অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রীত্বে মন্ত্রীসভা গঠিত হয়েছে। তখন তার শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন মুরলী মনোহর যোশী। ২০০০ সালে একটি দলিল কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা দপ্তর থেকে প্রকাশ করা হয়। নামছিল 'ন্যাশনাল কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক'। কেন্দ্রে ভারতের শিক্ষামন্ত্রীদের সম্মেলনে তাই নিয়ে একাধিকবার বিতর্ক হয়। একবার ওই সম্মেলনে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে বিজেপি, কংগ্রেস সহ একাধিক রাজনৈতিক দলের শিক্ষামন্ত্রীরা বিভিন্ন কথা বলে কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকে। তার মধ্যে অনেক পরস্পর বিরোধিতাও ছিল। আমি চুপ করেই ছিলাম। তখন হৈ হট্টগোলের মধ্যে বিজেপি এবং কংগ্রেস উভয় দলের কয়েকজন শিক্ষামন্ত্রী উঠে দাঁড়িয়ে মুরলী মনোহর যোশীকে বললেন - এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী কান্তি বিশ্বাসের মতামতটা বলতে দিন। আমরা ওনার অভিমতটা শুনতে চাই। মুরলী মনোহর যোশী আমাকে বলতে নির্দেশ দিলেন।

আমি ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় দেশে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার কয়েকটি দিক উল্লেখ করলাম, উল্লেখ করলাম প্রাক বৃটিশ এবং বৃটিশ যুগে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার কথাও, বললাম আধুনিক যুগে শিক্ষার গুরুত্ব এবং আমাদের সকলের কর্তব্যের কথা এবং দলীয় ব্যবধানের উপরে উঠে দেশের সার্বিক কল্যাণে আমাদের সকলের পক্ষ থেকে শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা মতৈক্য আনা দরকার। আমি আমার নাতিদীর্ঘ বক্তব্য শেষ করার পর উপস্থিত সকল রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীরা বললেন, 'আমরা সন্তুষ্ট হয়েছি আর কোনো বিতর্ক নেই, কান্তি বিশ্বাস যা বলেছেন আমরা সকলেই তা গ্রহণ করছি' - তখন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী মুরলী মনোহর যোশী একটি অদ্ভুত কথা বলেছেন।

তিনি বললেন, 'আমি পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী কান্তি বিশ্বাসকে যথেষ্ট সম্মান করি। শিক্ষা সম্পর্কে এত জ্ঞান কারুর মধ্যে আছে, এমন মন্ত্রী এর আগে আমি দেখিনি, সেইজন্য আমি তাঁকে সম্মান করি। কিন্তু একই সাথে আমি তাকে ঘৃণা করি, কেননা উনি মিথ্যাবাদী।'

উপস্থিত সকল মন্ত্রীরা আমার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি উঠে দাঁড়িয়ে তীব্র প্রতিবাদ করে বললাম 'কেন আমাকে মিথ্যাবাদী বলছেন?'

উনি উত্তরে বললেন, 'আমি জানি কান্তি বিশ্বাস পশ্চিমবঙ্গের একজন ব্রাহ্মণ সন্তান। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর সংখ্যক তপশিলী জাতির বাস, সেই নিম্নবর্ণের তপশিলী জাতিভুক্ত লোকের ভোট, নির্বাচনে ওঁর পার্টির পক্ষ থেকে আদায় করার জন্য উনি মিথ্যা করে এটা বলেন যে উনি নীচুজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত, যদিও ওনার জন্ম ব্রাহ্মণ কুলে।

আমি দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড প্রতিবাদ করে বললাম 'আমার দুটো কথা আছে। প্রথম কথা 'কোন যুক্তিতে বললেন যে নীচুকুলে জন্মগ্রহণ করলে তার পান্ডিত্য থাকে না এবং কোন যুক্তিতে বললেন যে, ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়েরই একচেটিয়া মেধা আছে, দ্বিতীয়ত আমি আবার বলছি আমি ব্রাহ্মণ সন্তান নই, আমি তপশিলীভুক্ত কুলে জন্মগ্রহণ করেছি। মানুষের মেধার উন্নয়নের ক্ষেত্রে আপনি যে বর্ণবাদের কথা বললেন আমি তার তীব্র প্রতিবাদ করছি এবং আমার সম্পর্কে আপনি যে ভুল তথ্য দিলেন তার তীব্র নিন্দা করছি।'

উনি আমাকে বললেন 'মানুষের মেধার বিকাশের ব্যাপারে আমার জ্ঞান আপনার থেকে অনেক বেশি। আপনি একটা স্কুলের প্রধান শিক্ষক, আমি এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান। অতএব আপনার থেকে আমার জ্ঞান অনেক বেশি' - এটা বলে তিনি অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন।**********************************************
প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর সাথে একবার দূরভাষ যোগে আমার এক অদ্ভুত বাক্য বিনিময় হয়। সালটি সম্ভবত ১৯৯৯ সাল। প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারি অনুষ্ঠানে কলকাতায় এসেছিলেন। তাঁর অনেকগুলি কর্মসূচির সাথে একটি ছিল কলকাতার রবীন্দ্রসদনে বুদ্ধিজীবী সমাবেশে একটি বক্তৃতা। তিনি তাঁর বক্তৃতার যবনিকা টেনেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ রচিত 'ভারততীর্থ' কবিতার তিনটি ছত্র উল্লেখ করে। ঐ ছত্র তিনটি ছিল -

'পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার, সেথা হতে সবে আনে উপহার, দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে, এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।'

পরের দিন স্থানীয় দৈনিক সংবাদ পত্রগুলিকে প্রধানমন্ত্রীর ঐ বক্তৃতা বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ রচিত কবিতার ঐ উদ্ধৃতি সপ্রশংসভাবে প্রকাশিত হয়। আমি তার পরের দিন প্রধানমন্ত্রীকে সম্মান নিবেদন করে একটি পত্র লিখেছিলাম। আমি আমার ঐ পত্রে লিখেছিলাম, 'আপনি রবীন্দ্রনাথ-রচিত "ভারততীর্থ" কবিতার যে ছত্র তিনটি উচ্চারণ করে আপনার বক্তৃতা শেষ করেছিলেন, ঐ ছত্র তিনটির কেবলই উপরে আছে আরও দুটি ছত্র যথা --

'হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড়, চীন -
শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।'   

বিশ্বকবি তাঁর ঐ কবিতায় এই ছত্র দুটির মাধ্যমে যে অনুভূতি ও আবেগ প্রকাশ করেছেন, আপনি তার সাথেও সহমত পোষণ করেন কি না?' বেশ কয়েকদিন পরে বিকাশভবনে আমি দপ্তরে ব্যস্ত আছি, এর মধ্যে নয়া দিল্লি থেকে দূরভাষ যোগে আমাকে জানানো হলো, প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী আমার সাথে কথা বলবেন। আমি তো অবাক। একটু পরেই উনি বললেন, 'তুমি খুব দুষ্ট আদমী আছ।' হিন্দিতে আর যে কথাগুলি বললেন, তা হলো, 'আমি আমার শিক্ষামন্ত্রী মুরলী মনোহর যোশীর কাছে শুনেছি, তুমি তাকে সব থেকে বেশি জ্বালাতন করো, তুমি প্রত্যেকটি শিক্ষামন্ত্রী সম্মেলনে তাকে বিব্রত করো। আজ তোমার চিঠি পড়ে বুঝলাম তুমি আসলেই কত দুষ্ট। আমি তোমার চিঠির জবাব দেব না, তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঐ কবিতার যে ছত্র-দুটির উল্লেখ তুমি তোমার চিঠিতে করেছ, তা যদি আমি জানতাম,তা হলে ঐ কবিতার যে ছত্র তিনটি আমি আমার বক্তৃতার শেষ-লগ্নে ব্যবহার করেছিলাম, তা আদৌ করতাম না।' আমি বিনীত ভাবে বললাম, 'আপনি এতবড়ো দেশের প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ পদে বৃত আছেন, তার মধ্যে থেকেও আমি একটি রাজ্যের মন্ত্রী, তার প্রেরিত পত্র পড়ে আপনি উত্তর দেবেন, এতটা আশা করিনি, আমি আপনাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।'
**********************************************
তখন কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনার ছিলেন টি.এন.শেষন। আর ইতিমধ্যেই উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সন্দেশখালি বিধানসভা থেকে নির্বাচিত বিধায়ক ধীরেন মন্ডলের মৃত্যু হয়। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে টি.এন.শেষনের কাছে ওই কেন্দ্রে উপনির্বাচনের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে বিব্রত করার জন্য টি.এন.শেষন রাজি হন না। এইভাবে বিধায়ক না থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রীসভায় ছয় মাস যখন শেষ হতে চলেছে তখন মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী কমরেড জ্যোতি বসু আমাকে ডেকে বললেন 'খামখেয়ালী কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনার টি.এন.শেষন সন্দেশখালি বিধাসভার আসনে উপনির্বাচন করার অনুমতি দিচ্ছে না। সেইজন্য আপনি আগামীকাল আমার কাছে পদত্যাগপত্র পেশ করবেন এবং দুদিন পরে আবার আপনি শপথ নিয়ে তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের মন্ত্রী হিসাবে আবার কাজকর্ম করবেন।' আমি কোনো উচ্চবাচ্য না করে সেই অনুসারে ১৯৯৪ সালের ৩রা মার্চ পদত্যাগপত্র পেশ করলাম এবং ৫ই মার্চ আবার মন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করে ওই দপ্তরের কাজ শুরু করলাম। মার্চ মাসেই একদিন টি.এন.শেষন মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সাথে দেখা করতে এলেন। মুখ্যমন্ত্রী আমাকে ডাকলেন। আমি সেখানে যাওয়ার পরে আমাকে দেখিয়ে মুখ্যমন্ত্রী টি.এন.শেষনকে বললেন 'উনি বিধায়ক না হওয়া সত্ত্বেও মন্ত্রী হিসাবে কাজ করছেন, সেই জন্য সন্দেশখালি বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচিত বিধায়কের মৃত্যুতে সেখানে উপনির্বাচন করে ওনাকে জয়ী করে আনার পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু আপনি একগুঁয়েমি করে তাতে বাধা দিয়েছেন। সেই জন্য ওঁকে আমি পদত্যাগ করিয়ে আবার মন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করিয়েছি। আপনি যতদিন উপনির্বাচন করার অনুমতি না দেবেন আমি ততবার একই পদ্ধতি অবলম্বন করব। দেখি আপনি কি করতে পারেন। আপনার পাগলামির জন্য আমাকে এই ঝামেলা করতে হবে দেখছি।'

টি.এন.শেষন বললেন 'আপনাদের সরকারের বিরুদ্ধে আমার কোনো ক্ষোভ নেই, কিন্তু আমার একটু মেগালোমেনিয়ার দোষ আছে সেই জন্য আমি এরকম মাঝে মাঝে পাগলামি করে থাকি। আমি এখনই ওই উপনির্বাচনের আদেশ দিয়ে দিচ্ছি।'
**********************************************




No comments:

Post a Comment