মধ্যপ্রাচ্যের তিন সেমেটিক ধর্ম - ইহুদী, খ্রিস্টান ও ইসলাম। তিন ধর্মেই নারী সৃষ্টির একটি সাধারণ কাহিনী রয়েছে। খ্রিস্টানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ইঞ্জিল, যার উল্লেখ বারবার দেখা যায় কোরানে। সেখানে বিধাতাপুরুষের নারী সৃষ্টির বর্ণনা রয়েছে, "সদাপ্রভু ঈশ্বর আদি মানব আদমকে নিদ্রায় মগ্ন করলে তিনি নিদ্রিত হলেন, ঈশ্বর তখন আদমের পাঁজরের একটা হাড় নিয়ে তা মাংস দিয়ে পূরণ করেন। সদাপ্রভু আদম হতে গৃহীত সে পঞ্জরে এক স্ত্রী নির্মাণ করে আদমের কাছে নিয়ে আসেন, তখন আদম বলেন এই স্ত্রী তাঁর অস্থির অস্থি। এঁর নাম হবে নারী। কেননা তিনি নর হতে তৈরী হয়েছেন।" এই কাহিনীটি দেখা যায় কোরানেও। আদম কোনও নারী সন্তান নয়, তাঁর কোনও জননী নেই, স্বয়ং বিধাতা তাঁকে সৃষ্টি করেছেন মাটি হতে। মানবের আদি পিতার জন্ম মৃত্তিকা হতে। সেমেটিক ধর্মসমূহের স্রষ্টা তা বারবার ঘোষণা করেছেন ধর্মপুস্তকে। তৌরাত, ইঞ্জিল, কোরানে। ইহুদী-খ্রিস্টান-ইসলাম - তিন ধর্মেই অস্বীকার করা হয়েছে মানুষের স্বাভাবিক জন্মপ্রক্রিয়া। শুধু তাই নয়। নারীকে করে তুলেছে তার সৃষ্টির জন্যে পুরুষের দেহের কাছে ঋণী। পুরুষের পঞ্জর না হলে নারী সৃষ্টি হত না। পুরুষ তার অন্য বিধাতা। ঈশ্বরের ধর্মগ্রন্থে নর নারীর জন্মদাতা। যে অস্থিপঞ্জর থেকে নারীকে সৃষ্টি করা হল সেই পঞ্জরও আবার সহজসরল নয় - বক্র। বক্র হাড় থেকে জন্ম বলে নারীর স্বভাবও বক্র। তাকে নিন্দা করেই এরপর ধরনীর ধূলায় নেমেছেন ঈশ্বরের প্রেরিত দূত - নবী রসুলরা, বিধাতাপুরুষের সাথে তাঁরাও কণ্ঠ মিলিয়েছেন নারী নিন্দায়। যে নারীনিন্দা তাঁদের অনুগামী পুরুষদের কাছে হয়ে উঠেছে পবিত্র ধর্মপুস্তক, কখনও তা ঈশ্বরের ঐশীবাণী, কখনও তা প্রেরিত পুরুষের জীবন বিধান ও কর্মনির্দেশ। যাকে অবনত মস্তকে শুধু মেনে নিতে হয়। অবহেলা কিংবা অস্বীকার করা যায় না। করলেই ধর্মচ্যুতি। যার জন্যে রয়েছে চরম জাগতিক শাস্তির বিধান। এইসব ধর্মপুস্তক, বিধি-বিধান হয়ে উঠেছে সব সামাজিক জাগতিক আইনের উৎসব। যা ক্রমাগতভাবে পুরুষকে তৈরী করে দিয়েছে নারীর বিধাতারূপে। তাকে আষ্টে-পৃষ্টে করেছে শৃঙ্খলিত। নারী সেই শৃঙ্খল খুলতে পারেনি। কারণ আইন হল বিধাতার। নির্দেশও তাঁর প্রেরিত পুরুষ দ্বিতীয় বিধাতার।
Saturday, 25 November 2023
ইসলাম ও নারী - কঙ্কর সিংহ
*********************************************************
ইসলাম পৃথিবীর স্বীকৃত ধর্মগুলির মধ্যে কনিষ্ঠতম ধর্ম। হজরত মোহাম্মদ এই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। যদিও ইসলাম ধর্মানুসারীদের বিশ্বাস সৃষ্টির আদি পিতা আদম হতে ইসলামের উদ্ভব। আদম ইসলামের প্রথম নবী।
*************************
মোহাম্মদ কোরানকে ধারণ করেছিলেন, অনেক সুরা ও আয়াত লিখেও রেখেছিলেন। বেশীটাই ছিল হাফেজ (কোরান মুখস্ত যাদের আছে) দের কণ্ঠে। কিন্তু কোনও সংকলিত রূপ দিয়ে যাননি বা যেতে পারেননি। কোরান পূর্ণাঙ্গরূপে সংকলিত হয় মোহাম্মদের মৃত্যুর দুই দশক পরে ইসলামের ৩য় খলিফা হজরত ওসমানের হাতে। খলিফা ওসমানকে তাই বলা হয় 'জামেউল কোরান' বা কোরান সংকলক।
*************************
মক্কার কাছে হেরা পর্বতে প্রথম যে ওহী অবতীর্ণ হয়েছিল মোহাম্মদের ওপর তা সুরা আলাক।
পাঠ কর তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্তপিন্ড হতে। - সুরা আলাক, ৯৬/১-২
*************************
বর্তমানে কোরানকে যেভাবে পাওয়া যায় তাতে নারী'র প্রথম দর্শন দেখা যায় - সুরা বাকারায়। মদীনায় এই সুরাটি অবতীর্ণ হয়েছিল। এই সুরার আত্মপ্রকাশ তাই মোহাম্মদের নবুয়ত লাভের অনেক পরের দিকে।
সুরা বাকারার সেই বিখ্যাত আয়াতটি তুলে ধরছি -
তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের শস্যক্ষেত্র, অতএব তোমরা
তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা যেতে পার। - সুরা বাকারা, ২/২২৩
কোরানের এই আয়াত নারীকে একেবারে পৌঁছে দিয়েছে পৃথিবীর আদিমতম সমাজে। নবীন ধর্ম ইসলামের অনুগত মুসলমানদের জন্যে এই আয়াতের 'নির্দেশ' নারীর জন্যে চরম অবমাননার। এখানে নারীর অবনমন চূড়ান্ত। প্রাচীন বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই মনে করা হত যে নারীর সাথে উর্বরা প্রকৃতির কোনোও প্রভেদ নেই। প্রকৃতির ক্ষেত্রকে কর্ষণ করলে যেমন শস্য পাওয়া যায়, নারীকে মৈথুন করলেও তেমনি সন্তানের জন্ম হয়। সন্তান জন্মে নারীর কোনও ভূমিকা নেই। যেমন নেই শস্যক্ষেত্রের। কর্ষণ করে বীজ বপন করলে শস্য আর মৈথুনের বীজ থেকে সন্তান। এই আয়াত নারীকে শুধু পদানতই করেনি, তাকে পরিণত করেছে পুরোপুরি যৌন কর্ষণের ক্ষেত্ররূপে। নবীনতম ধর্ম ইসলাম দাবি করে, এই ধর্ম নারীকে যত অধিকার দিয়েছে বিশ্বের অন্য কোনও ধর্ম তা দেয়নি। দিতে পারেনি। ইসলাম নারীকে অন্ধকার জগ থেকে তুলে এনে নতুন মহিমায় গরিয়সী করেছে। ইসলাম নারীকে কোনও ভাবেই মহিয়সী করেনি। নারীকে উর্বরা শস্যক্ষেত্রের সাথে উপমা তাকে আদিম থেকে আদিমতর স্তরে অবনমিত করে। সুরা বাকারার ২/২২৩ আয়াত সেটাই বুঝিয়ে দেয় আমাদের।
*************************
রোজার রাত্রিতে তোমাদের জন্য স্ত্রী সহবাস বৈধ করা হয়েছে। - সুরা বাকারা, ২/১৮৭
রমজান মাস মুসলমানদের জন্যে সংযমের মাস, রিপুকে দমনের মাস। সেই পবিত্র মাসেও মুসলমানদের জন্যে স্ত্রী-সহবাস হালাল করে দিলেন আল্লাহ এই আয়াতে। ... রসুল মোহাম্মদ নিজেও রোজার মাসে স্ত্রীসম্ভোগ করতেন। হাদীসে তার উল্লেখ রয়েছে।
মোহাম্মদের পত্নী আয়েশা এবং উস্মে সালমা উভয়েই বলেছেন যে কোনও কোনও সময় রসুল স্ত্রীর সাথে সঙ্গমের পর 'জানাবত' অবস্থায় সোবেহ সাদেক (রাত্রি শেষে প্রত্যুষের আলো ফোটার আগের মুহূর্ত) হয়ে যেত। তখন তিনি স্নান করতেন এবং রোজা রাখতেন। (৯৯৫ / বোখারী শরীফ, মাওলানা আজিজুল হক অনুদিত)
*************************
মূর্তিপূজারী কাফের রমণীকে ধর্মান্তরিত না করে বিয়ে করা যায় না। কোরানের নির্দেশ তাই।
আর অংশীবাদী রমণী যে-পর্যন্ত না বিশ্বাস করে তোমরা তাকে বিয়ে কোরো না। অবিশ্বাসী নারী তোমাদের চমৎকৃত করলেও নিশ্চয় ধর্মে বিশ্বাসী ক্রীতদাসী তার চেয়ে ভালো। - সুরা বাকার, ২/২২১
*************************
কোরানেও রজঃস্বলা নারীকে দেখা হয়েছে নিষিদ্ধ ও দূষিত প্রাণী রূপে। এখানে ইসলামের বিধান পুরুষতান্ত্রিক অন্যসব ধর্মের চেয়ে আলাদা নয়। ইসলাম এখানে কোনও আধুনিকতা পরিচয় দিতে পারেনি। রজঃস্রাব চলাকালীন নারী অশুচি হয় না। তবে তার প্রয়োজন হয় বিশ্রামের, বিশেষ করে যৌনসংগম থেকে।
লোকে তোমাকে রজঃস্রাব সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। তুমি বলো, 'তা অশুচি', তাই রজঃস্রাবকালে স্ত্রীসঙ্গ বর্জন করবে। - সুরা বাকারা, ২/২২২
ঋতুমতী নারীর রজঃ অশুচি। এই বার্তা কোরানে বলা হলেও রসুল মোহাম্মদ কামুক পুরুষদের জন্যে স্ত্রী সংসর্গ পুরোপুরি বন্ধ করেননি। তিনি ইচ্ছে করেই যেন কোরানকে অতিক্রম করেছিলেন। তিনি অবশ্য কিছু শাস্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। একটি হাদীসে বলা হয়েছে -
রজঃস্বলা স্ত্রীর সাথে কোনও পুরুষ সংগত হলে তাকে এই কাজের জন্যে এক দিরহাম সদকা দিতে হবে। রক্তের রং কিছুটা হলদেটে হলে সদকার পরিমাণ হবে অর্দ্ধ দিনার আর সম্পূর্ণ লাল হলে এক দিনার। (মিশকাত - ৫৫৩,৫৫৪)
কোরান যা নিষিদ্ধ করেছে তা থেকেও রেহাই পাওয়া যায় কিছু সদকা দিলে যদি তা স্ত্রী সংসর্গ জনিত হয়। সমর্থ পুরুষের জন্যে এই সদকা সংগ্রহ করা খুব কঠিন নয়। যৌন-সংযম বলে কিছু যেন থাকতে নেই ইসলামে। ইসলাম নারীকে দেখেছে মূর্তিমতী কাম বলে, যে নারী একদিন তাকে করেছিল স্বর্গভ্রষ্ট, লিপ্ত করেছিল 'পাপকাজে'। সে নারীকে ইসলাম ক্ষমা করেনি।
*************************
ইসলাম দাবি করে নারীকে সম্পত্তির ওপর অধিকার প্রদান এর আগে কোনও ধর্ম-সমাজ দেয়নি, এটা এক বৈপ্লবিক উদাহরণ। ইসলাম পুরুষের সাথে নারীকেও সম্পত্তির অধিকারী করেছে। ইসলাম নারীকে সম্পত্তির অধিকার দিলেও সমান অধিকার দেয়নি, সব স্থানেই নারী পুরুষের অর্দ্ধেক। অর্থাৎ একজন পুরুষের সমান দুজন নারী। পিতা-মাতা-ভ্রাতা-স্বামী-পুত্র--সবার সম্পত্তিতেই নারীর উত্তরাধিকার স্বীকৃত হলেও তা নিরংকুশ নয়। সেখানেও লিঙ্গ-বৈষম্য তাকে পূর্ণ মানব না করে অর্দ্ধমানবী করে রেখে দিয়েছে।
সুরা নিসার ৭, ১১ এবং ১২ নং আয়াতেও বলা হয়েছে -
পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে। আর পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছে, তা অল্পই হোক অথবা বেশিই হোক, এক নির্ধারিত অংশ।
আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন তোমাদের সন্তানসন্ততি সম্পর্কে: এক ছেলে পাবে দুই মেয়ের অংশের সমান; যদি দুই মেয়ের বেশি থাকে তবে তারা পাবে যা সে রেখে গেছে তার দুই-তৃতীয়াংশ, আর যদি এক মেয়ে থাকে তবে সে পাবে অর্ধেক, আর তার যদি সন্তান থাকে তবে তার পিতামাতা প্রত্যেকে পাবে তার ছয় ভাগের এক ভাগ, কিন্তু যদি তার সন্তান না থাকে, শুধু পিতামাতা তার উত্তরাধিকারী হয় তবে তার মা পাবে তিন ভাগের এক ভাগ; কিন্তু যদি তা ভাইয়েরা থাকে তবে তার মা পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ।
তোমাদের স্ত্রী যা রেখে যায় তার অর্ধেক তোমরা পাবে। যদি তাদের একটি সন্তান থাকে তবে তোমরা পাবে তাদের রেখে-যাওয়া সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ, তাদের অসিয়তের দাবি বা ঋণ পরিশোধের পরে। আর তারা পাবে তোমরা যা রেখে যাও তার চার ভাগের এক ভাগ যদি তোমাদের সন্তান না থাকে, কিন্তু যদি একটি সন্তান থাকে তবে যা রেখে যায় তার আট ভাগের এক ভাগ তারা পাবে, তোমাদের অসিয়তের দাবি বা ঋণ পরিশোধের পরে। আর যদি কোনো পুরুষ বা স্ত্রীলোক সম্পত্তি রেখে যায় তার আছে এক ভাই বা এক বোন তবে তাদের প্রত্যেকে পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ। - সুরা নিসা, ৪/৭, ১১, ১২
ইসলাম নারীকে সম্পত্তির অধিকার দিয়ে কিছুটা আর্থিক সুবিধা দিলেও কেড়ে দিয়েছে অনেক কিছু। নারীকে এই সুবিধা দানের জন্যে অহংকারও কম নেই ইসলামের। কিন্তু ইসলামের আইনে নারী পিতা ও স্বামীর যে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়েছে তাতে তার অংশ খুবই কম, সব ক্ষেত্রেই তা পুরুষের অর্দ্ধেক। মুসলমানরা দাবি করেন নারী যেভাবে পিতৃকুল ও পতির কুলে সম্পত্তি পায় তা যোগ করলে পুরুষের অংশকে ছাড়িয়ে যাবে, কিন্তু তা সত্যি নয়। সব রকম হিসেব-নিকেশ করে দেখা গেছে একই অবস্থানে নারী কোনও ভাবেই পুরুষের অংশ ছাড়িয়ে যায় না।
সুরা নিসায় কোরানের স্রষ্টা আবার পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেছেন -
পুরুষ নারীর রক্ষাকর্তা, কারণ আল্লাহ তাদের এককে অপরের ওপর বিশিষ্টতা দান করেছেন, আর এজন্য যে, পুরুষরা তাদের ধনসম্পদ থেকে ব্যয় করে। - সুরা নিসা, ৪/৩৪
এই বিষয়ে সতর্কবাণীও রয়েছে আল্লাহর -
যা দিয়ে আল্লাহ তোমাদের কাউকে কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন তোমরা তার লালসা কোরোনা। পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য, আর নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য। - সুরা নিসা, ৪/৩২
আল্লাহ পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে এ নারী। এটা আল্লাহর বিধান। এই বিধান থেকেই গড়ে উঠেছে ইসলামের সব আইনকানুন যা নারীকে করেছে শৃঙ্খলিত। যা থেকে ইসলামের বিশ্ব নারীকে আর মুক্তি দেয়নি। মুসলমানরা বলেন ইসলাম নারীকে যত সন্মান দিয়েছে অন্য কেউ তা দেয়নি। এখানে কোথায় সেই সন্মান। কোথায় বা পরিপূর্ণ সামাজিক অধিকার। একজনকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করলে অন্যজনের অধিকার সংকুচিত করে নিতে হয়। তার সমান অধিকারের দাবি তুলে নিতে হয়। কোরান নারীকে সেই কথাই শিখিয়েছে।
*********************************************************
ইসলামে বিয়ে কোনও ঐশী ধর্মানুষ্ঠান নয়। বিয়ে একটা চুক্তি। রসকষহীন, কর্কশ। বলেছেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদরা। এই চুক্তি দুটি সমমানুষের মধ্যে নয়, অসম মানুষের মধ্যে, যেখানে একজনের শ্রেষ্ঠত্ব অপরের ওপরে আরোপিত। ইসলামে বিয়ে এক অসম চুক্তি।
*************************
ইসলাম পুরুষকে করেছে বহুভোগ্যা। সুরা নিসার প্রথমেই আল্লাহ বলে দিয়েছেন -
তবে বিয়ে করবে (স্বাধীন) নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভালো লাগে, দুই, তিন বা চার জনকে। আর যদি আশঙ্কা কর যে সুবিচার করতে পারবে না তবে একজনকে বা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকে। এভাবেই তোমাদের পক্ষপাতিত্ব না করার সম্ভাবনা বেশি। সুরা নিসা, ৪/৩
*************************
পতি-পত্নীর দাম্পত্য জীবন তো শুধু অশন-বসনে সীমাবদ্ধ নয়। কিন্তু তার বাইরে যদি নিয়ে যাওয়া হয় সেই 'সুবিচার'কে তাহলে কার্যত তা কোনও মানব-সন্তানের পক্ষে সম্ভব নয়। বিশ্বের সর্বকালের 'শ্রেষ্ঠ মানব' যাঁকে বলা হয়, সেই রসুল মোহাম্মদও তা পারেননি। ... আল্লাহ নিজেও জানতেন তাঁর কোনও বান্দার পক্ষে তা সম্ভব নয়, তাই সুরা নিসার অন্য একটি আয়াতে তিনি বললেন -
আর তোমরা যতই ইচ্ছা কর না কেন তোমাদের স্ত্রীদের সাথে কখনোই সমান ব্যবহার করতে পারবে না। তবে তোমরা কোনো-একজনের দিকে সম্পূর্ণ রূপে ঝুঁকে পড়ো না ও অপরকে ঝুলিয়ে রেখো না। - সুরা নিসা, ৪/১২৯
*************************
ইসলামে কোনো বৈরাগ্য নেই। পুরুষের জন্যে তা হারাম। নারীর তো কোনও স্বাধীন সত্ত্বাই নেই। নারীকে তো সৃষ্টি করা হয়েছে পুরুষের অবাধ গমনের শস্যক্ষেত্র রূপেই। রসুলের একটি হাদিসে বলা হয়েছে "যখন কোনও ব্যক্তি বিয়ে করে তার অর্ধেক ইবাদত (প্রার্থনা) পূর্ণ হয়ে যায়। বাকী অর্ধেকের জন্য যেন সে আল্লাহকে ভয় করে।" অন্য একটি হাদিসে রয়েছে "বিয়ে করা আমার সুন্নত। যে আমার সুন্নত হতে বিরত থাকবে সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য নহে।" বিবাহ ইসলামের জীবনবিধানে এমন একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য যা না করলে রসুলের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়। তার সরল অর্থ সে ব্যক্তি আর মুসলমান থাকে না। বিবাহ সম্বন্ধে আর একটি হাদীস হল, "বিবাহিত পুরুষের এক রাকাত (নামাজের এক অংশ) নামাজ অবিবাহিত পুরুষের সত্তর রাকাত নামাজ হতেও উত্তম।" এই হাদীসে বিবাহ পেয়ে গেছে নামাজের মর্যাদা। তাকে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে আল্লাহর ইবাদতের সাথে। এর পর কোনও মুসলমান পুরুষ অবিবাহিত থাকার জীবন বেছে নিতে পারে। বিয়ে করা তার কাছে পূণ্য অর্জনের পথে পা বাড়ানো।
*************************
ইসলামী বিবাহ প্রথায় 'দেনমোহর' গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিয়ের চুক্তির ফলে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে পায় দেনমোহর। কিছু অর্থ, অলংকার বা সম্পত্তির লিখিত প্রতিশ্রুতি। যার বিনিময়ে স্বামী নামে পুরুষটি লাভ করে স্ত্রী নামে নারীটির দেহের ওপর একচ্ছত্র অধিকার। তখন স্ত্রী পরিণত হয়ে যায় অনুগতা বৈধ যৌনদাসীতে। সেখানে যখন খুশী গমন করে কর্ষণ করা যায়। দেনমোহর শুধু কাবিনে লেখা থাকে। স্ত্রী সাধারণত তা নগদে পায় না। এমন কী বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও তা সাধারণত আদায় হয় না। দেনমোহর পরিমাণে খুব বেশী হয় না। ইসলামের আইনী মজহাব হানাফী আইনে বলা হয়েছে দেনমোহর হবে কম পক্ষে ১০ দিরহাম। অন্য মজহাব মালিকি আইনে কমপক্ষে ৩ দিরহাম। আর হাদিস অনুসারে কমপক্ষে ১টি লোহার আংটি। রসুল মোহাম্মদ বলেছেন "নিশ্চয়ই এই ধরনের বিবাহে বরকত বেশী হয় যে বিবাহের মোহর কম থাকে।" তিনি আরও বলেছেন "ঐ স্ত্রীলোক অতি উত্তম যে দেখিতে সুন্দরী এবং যাহার মোহর অতি নগন্য।" হজরত মোহাম্মদ অসুন্দরী নারীদের পছন্দ করতেন না। বিয়েতে দেনমোহরের পরিমাণ নিয়ে কনে ও বরপক্ষের মধ্যে দরকষাকষি চলে দুই পক্ষের অভিভাবকের মধ্যে। এটা স্বীকৃত প্রথা। সেখানে কনের কোনও ভূমিকা থাকে না। কিন্তু তার শরীর নিয়েই চলে হাটের দরাদরি।
নারীদের দেনমোহর খুশি মনে দিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছে কোরান। সেই সাথে স্ত্রীদেরও উপদেশ দেওয়া হয়েছে তারা যেন খুশি মনে দেনমোহরের কিছু অংশ ছেড়ে দেয়।
আর তোমরা নারীদেরকে তাদের দেনমোহর খুশি মনে দিয়ে দাও। যদি তারা খুশি মনে তার কিছু ছেড়ে দেয় তোমরা তা স্বচ্ছন্দে ভোগ করো। - সুরা নিসা, ৪/৪
কোরান পুরুষকে শুধু নারীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব এবং কর্তৃত্বই দান করেনি, অবাধ্য স্ত্রীকে প্রহার করার নির্দেশ পর্যন্ত দিয়েছে।
স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের ভাল করে উপদেশ দাও, তারপর তাদের বিছানায় যেওনা ও তাদেরকে প্রহার করো। যদি তারা তোমাদের অনুগত হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পথ খুঁজবে না। - সুরা নিসা, ৪/৩৪
কোরানে পুরুষ কোন কোন নারীকে বিয়ে করতে পারবে না তার তালিকা রয়েছে (সুরা নিসা, ৪/২২ - ২৩)। সেই তালিকায় উল্লিখিত সম্পর্ক ছাড়া সব নারীকে মুসলমানরা বিয়ে করতে পারেন শুধু সধবা (যার স্বামী বর্তমান) নারী ছাড়া (সুরা নিসা, ৪/২৪)। এই সধবা শুধু মুসলিম নারীদের বেলা প্রযোজ্য। কাফের বা অংশীবাদী নারী হলে এই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য নয়। ... পরধর্মের কোনও সধবা নারী যদি ইসলাম গ্রহণ করে কিংবা মুসলমানদের অধিকারভুক্ত হয় যুদ্ধবন্দীরূপে বা অন্যভাবে, তাহলে তার পূর্ববর্তী বিবাহ বাতিল হয়ে যায় তিনি না চাইলেও। তার স্বামী তখন পরপুরুষ হয়ে যান তার কাছে, সেই সধবা নারী তখন আর সধবা থাকেন না ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে। তখন যে কোনও মুসলমান পুরুষের সাথে তার বিবাহ হতে পারে। তার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে তাকে অধিকার করে নিয়ে। খুব সহজ আইন ইসলামের।
একজন মুসলমান পুরুষ চারটি বৈধ স্ত্রী রাখার পরও যত খুশী 'ডান হাতের অধিকারভুক্ত' দাসীকে সম্ভোগ করতে পারে, কোনও বাধা নেই ইসলামী আইনে বা নৈতিকতায়। দাসী সম্ভোগ ইসলামে বৈধ। ডান হাতের অধিকারভুক্ত দাসীদের বেলায় কোনও সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি কোরানে।
আমি তোমার জন্য তোমাদের স্ত্রীদেরকে বৈধ করেছি যাদেরকে তুমি দেনমোহর দিয়েছ ও বৈধ করেছি তোমার ডানহাতের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকে। - সুরা আহজাব, ৩৩/৫০
*************************
কোরান তালাক সম্বন্ধে কী বলে আমরা দেখে নিতে পারি। সুরা বাকারায় আছে -
আর যদি তারা তালাক দিতে সংকল্প করে তবে তো আল্লাহ সব শোনেন, সব জানেন।
তালাকপ্রাপ্ত নারীগণ তিন রজঃস্রাব কাল প্রতীক্ষায় থাকবে।
এ তালাক দুবার, তারপর হয় ভালভাবে রাখবে বা সদয়ভাবে বিদায় দেবে। - সুরা বাকারা, ২/২২৭ - ২২৯
বিয়ে হয়ে গেছে, কিন্তু স্ত্রীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি কিংবা দেনমোহর ধার্য হয়নি তেমন স্ত্রীকে অবাধে তালাক দেওয়া যায়। যদি দেনমোহর ধার্য হয় তা হলে তার পরিমান হবে অর্দ্ধেক। তবে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী মাফ করে দিলে সেই দেনমোহরও দিতে হবে না।
স্ত্রীকে স্পর্শ করার বা দেনমোহর ধার্য করার পূর্বে যদি তাদেরকে তালাক দাও, তবে কোনো পাপ হবে না, আর তোমরা যদি স্পর্শ করার পূর্বে স্ত্রীদের তালাক দাও, অথচ দেনমোহর পূর্বেই ধার্য করে থাক - তা হলে নির্দিষ্ট দেনমোহরের অর্দ্ধেক তোমাদেরকে আদায় করতে হবে। - সুরা বাকারা, ২/২৩৬ - ২৩৭
তালাকপ্রাপ্ত নারীকে ভরণপোষণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে - তবে তা বাধ্যতামূলক নয়, তা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে মুসলমান পুরুষের সদিচ্ছা ও সামর্থের ওপর। নারী তালাক দিতে পারে এমন কথা কোরানে বলা নেই। কোরানের তফসিরকাররা এ বিষয়ে বিভিন্ন মত পোষণ করলেও একটা বিষয়ে বোধহয় ভিন্নমত নেই যে স্ত্রী শুধু তালাক চাইতে পারে যদি তার স্বামী নামে প্রভুটি তা অনুমোদন করে। সেক্ষেত্রে নারীকে তার দেনমোহরের দাবি পরিত্যাগ করতে হয়। স্বামীর কোনও রকম সম্পত্তির ওপরও তার অধিকার থাকে না।
ইসলামে বিয়ে নামে যে চুক্তি তা স্বেচ্ছাচারী স্বামী যে কোনও মুহূর্তে ভেঙ্গে দিতে পারে। "ইসলামে বিবাহ-বিচ্ছেদ বা তালাক গেলাস থেকে জল ঢালা থেকেও সহজ স্বামীর জন্যে, আর স্ত্রীর জন্য ফাঁসির রজ্জু খোলার থেকেও তা কঠিন।" অনেক পণ্ডিত প্রবর মনে করেন কোরানে এক সাথে তিন তালাক দেওয়ার বিধান নেই। দুই তালাক দেওয়ার পর ইচ্ছা করলে তালাক ফিরিয়ে নেওয়ার কথাও সেখানে রয়েছে। ৩য় তালাকের খড়্গ সেখানে ঝুলিয়ে রাখা হলেও পরে তা গ্রহণ করা হয়নি। ইসলামের শ্রেষ্ঠ খলিফা বলা হয় হজরত ওমরকে। তিনি কোরানকে অতিক্রম করেছেন একথা ভাবা যায় না। তিন তালাক নিয়ে কোরানের ভাষ্যকাররা যে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছিলেন খলিফা ওমরের খেলাফতের কালে তাতে তিন তালাক একসাথে দিতে পারার বৈধতা পায়। সেই থেকে মুসলমান সমাজে তিন তালাক নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। ইসলামের ইতিহাস এই বলে। ...
... এই ওমরের খেলাফতেই তিন তালাক নিয়ে সব বিতর্কের অবসান হয়। কিন্তু ওমরের কথা বলা হলেও, ইসলামের শ্রেষ্ঠ ইমামগণ - ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেরী, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল - সকলেই একমত যে আলাদা আলাদা বা এক সাথে যেভাবেই তিন তালাক দেওয়া হোক, তালাক কার্যকর হয়ে যাবে। ...
... কোরানের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে ইসলামের শরীয়া আইন। সেই আইনে একসাথে তিন তালাক দেওয়া বৈধ। তালাক সম্বন্ধে আরো কিছু কথা -
তালাক (শব্দটা উচ্চারণ বা অন্য যে কোন ভাবে তিনবার একসাথে বা আলাদাভাবে প্রকাশ করা।, লেয়ান (প্রমাণ করতে পারুক বা না-ই পারুক স্ত্রীর ওপর ব্যাভিচারের অপবাদ আনলেই বিয়ে ভেঙ্গে যায়), এই দুই পদ্ধতিতে স্বামী এক মিনিটেই বিয়ে বাতিল করতে পারে। আর যিহার (স্ত্রীর শরীরের কোন অংশের সাথে স্বামী তার মায়ের শরীরের ওই অংশের তুলনা করলে বিয়ে ভেঙ্গে যায় - আরব বেদুঈনদের প্রাচীন সংস্কৃতি) এই তিন পদ্ধতিতে স্বামী এক তালাক দিতে পারে। শারিয়ায় তালাকের একচ্ছত্র অধিকার আছে শুধুমাত্র স্বামীর হাতে, স্ত্রীর হাতে নয়। পৃথিবীর কোন সংগঠন বা ব্যক্তির অধিকার নেই স্বামীকে তালাক থেকে বিরত রাখতে পারে বা তালাকের কারণ জিজ্ঞেস করতে পারে। লেয়ান আর যিহার আজকাল আর দেখা যায় না কিন্তু তাৎক্ষণিক তালাকের বজ্র স্ত্রীদের মাথায় নেমে আসে মুসলিম সমাজে। আরও লক্ষণীয় যে দাসী-স্ত্রীদের বেলায় তিনবার নয়, তালাক হয়ে যায় দু'বারেই। এবং তালাকের পরে সাধারণ স্ত্রীরা তিন এবং দাসী-স্ত্রীরা দুই ইদ্দতের পরে বিয়ে করতে পারে।
লক্ষণীয় যে শারিয়া-আইনে মাদক বা মদের ঘোরে, অত্যাচারের চাপে, রাসায়নিক প্রভাবে, হাসিঠাট্টার ছলে বা চাপের মুখে তালাক উচ্চারণ করলেও তাৎক্ষণিক ভাবে তালাক পুরো হয়ে যায়। কারণ, স্বামী নাকি বিভিন্ন সম্ভাবনার মধ্যে "সর্বশ্রেষ্ঠ" সিদ্ধান্ত নেয় তালাক দেবার, যে অধিকার তাকে নাকি আল্লাহই দিয়েছেন।"
*************************
মৃত স্বামী বা তালাক দেওয়া স্বামীর জন্যে নারীর ইদ্দত পালন বাধ্যতামূলক। কিন্তু স্ত্রী মারা গেলে স্বামীকে মাত্র তিনদিন অপেক্ষা করতে হয়, বেশী নয়। আর এক স্ত্রীকে তালাক দিয়ে সাথে সাথে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করা যায়, এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে হয় না স্বামী নামে পুরুষটিকে।
যেখানেই তালাক সেখানেই তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে পুনর্বিবাহ করার প্রশ্নটা চলে আসে। কারণ অনেক সময় ভুলবশতও তালাক দেওয়া হয় স্ত্রীকে। কোরানে তালাক দেওয়া স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করার বিধান রয়েছে,
তারপর ঐ স্ত্রীকে যদি সে তালাক দেয় তবে যে-পর্যন্ত না ঐ স্ত্রী অন্য স্বামীকে বিবাহ করছে তার পক্ষে সে বৈধ হবে না। তারপর যদি সে (দ্বিতীয় স্বামী) তাকে তালাক দেয় তবে তাদের মিলনে কোনো দোষ নেই। - সুরা বাকারা, ২/২৩
... কোরানের তফসিরকাররা বলে থাকেন তালাককে নিরুৎসাহ করার জন্যেই এত কঠিন বিধি। কিন্তু যে পুরুষ ভুল করে তাকে তো কিছুই হারাতে হয় না, সব মূল্য দিতে হয় নারীকে। সুরা বাকারার এই আয়াত নারীর জন্যে যে চরম অসম্মানের তা ভেবে দেখেন না কোরান বিশেষজ্ঞরা। ... রসুল বলে গেছেন মুহাল্লিলের সাথে বিয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত বৈধ নয় যতক্ষণ পর্যন্ত দুজনের মধ্যে যৌন-মিলন ঘটে (বোখারী হাদিস - ২০৭৮, ২০৭৯)। আসলে ইসলামে কোনও বিয়েই যৌন মিলন ছাড়া বৈধতা পায় না।
*************************
ইসলামের প্রথম যুগে আরও এক প্রকার বিবাহ-বিধি প্রচলিত ছিল। যাকে বলা হয়েছে চুক্তি বিবাহ। ইসলামের পরিভাষায় যার নাম মুতা-বিবাহ। ইসলামের গরিষ্ঠ অংশ সুন্নীদের মধ্যে মুতা বিবাহ আর চালু না থাকলেও শিয়াদের মধ্যে এখনো এই বিবাহ প্রথা মান্যতা পায়।
"শিয়া মুসলিমদের একটি অংশ অস্থায়ী বিবাহকে আইনসঙ্গত মনে করেন।" (সৈয়দ আমীর আলী - 'দ্য স্পিরিট অব ইসলাম')
*************************
ইসলামে নারীকে বলা হয় 'ফিৎনা'। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী।
*********************************************************
আরব নারীরা অবরোধবাসিনী ছিলেন না। ইসলাম তাদের মুক্ত পৃথিবী থেকে অবরোধে ঢুকিয়েছে। ইসলাম-পূর্ব আরব সমাজে নারীদের যে অধিকার ও স্বাধীনতা ছিল, ইসলাম তা হরণ করে। নবীপত্নীদের দিয়ে তার সূচনা।
হে নবীপত্নীগণ! তোমরা তো অন্য নারীদের মত নও, যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পরপুরুষের সঙ্গে কোমল কণ্ঠে কথা বলবে না যাতে অন্তরে যার ব্যাধি আছে সে প্রলুব্ধ হয়। তোমরা ভালভাবে কথাবার্তা বলবে। আর তোমরা ঘরে থাকবে, জাহেলিয়া (প্রাগইসলামি) যুগের মতো নিজেদেরকে দেখিয়ে বেড়িয়ো না। - সুরা আহজাব, ৩৩/৩২, ৩৩
পত্নীদের অবরোধবাসিনী করতে চেয়েছিলেন রসুল মোহাম্মদ। আল্লাহ অনুমোদন তিনি পেয়েছিলেন। তিনি যা কামনা করেন আল্লাহ তা দান করেন। আল্লাহ তো অন্তর্যামী। সুরা আহজাব মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছিল। নবীপত্নীদের জন্যে সাবধানবাণীও রয়েছে এই সুরায়।
হে নবি! তুমি তোমার স্ত্রীদের বলো, তোমরা যদি পার্থিব জীবনের ভোগ ও বিলাসিতা কামনা কর, তবে এসো, আমি তোমাদের ভোগবিলাসের ব্যবস্থা করে দিই আর তোমাদেরকে ভদ্রতার সাথে বিদায় দিই।
হে নবীপত্নীগণ! যে কাজ স্পষ্টত অশ্লীল তোমাদের মধ্যে কেউ তা করলে তাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেওয়া হবে। - সুরা আজহার, ৩৩/২৮ - ৩০
... নবীপত্নী ছাড়া অন্যদের জন্যে অবতীর্ণ হয়েছিল সুরা নূরের এই আয়াত।
বিশ্বাসী নারীদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে ও তাদের যৌন অঙ্গকে হেফাজত করে। যা সাধারণত প্রকাশমান তা ছাড়া তারা যেন তাদের সৌন্দর্য (বা অলংকার) প্রদর্শন না করে। তাদের ঘাড় ও বুক যেন মাথার কাপড় দ্বারা ঢাকা থাকে। তারা যেন নিজের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, নিজেদের মেয়েছেলে, তাদের অধিকার ভুক্ত দাস-দাসী, যৌনকামনারিক্ত পুরুষ আর সেইসব ছেলে যাদের নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে জ্ঞান হয়নি তাদের ছাড়া কারও কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তারা যেন তাদের গোপন সৌন্দর্য (বা অলংকার) প্রকাশের জন্য সজোরে পা ফেলে না চলে। - সুরা নূর, ২৪/৩১
*************************
প্রাক-ইসলামী যুগে আরবে নারীরা সংগীত চর্চা করতেন। তাদের খ্যাতি ছিল। সে জন্যেই কী ইসলামে নারীদের কলা-সংস্কৃতি ও সঙ্গীত সাধনা একরকম নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল। 'অন্ধকার যুগে'র নারীদের সংগীত প্রতিভার কথা এখন ইসলামের ইতিহাসবিদরাও স্বীকার করেন।
অনেক নামী মহিলা কবি ছিল তখন আরবে। তাদেরও খ্যাতি ছিল। অস্বীকার করাও যেত না তাদের। নবীর বিরুদ্ধে ব্যঙ্গাত্মক কবিতা রচনা করার অপরাধে ইহুদী কবি, বনি গোত্রের আসমা বিনতে মারোয়ান নামে এক নারীকে হত্যা কেন জনৈক মুসলমান। এই হত্যাকাণ্ড রসুল অনুমোদন করেছিলেন এবং খুশী হয়েছিল। কবি আসমা বিনতে মারোয়ানের সামাজিক প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ না হলে তাঁকে হত্যা করা হত না।
ইসলাম কবির স্বাধীনতাকে স্বীকার করে না। কবি ও কবিতার সাথে যেন ইসলামের জন্মবিরোধ। এই সেই সাবধান বাণী,
এবং কবিদের অনুসরণ করে তারা যারা বিভ্রান্ত। - সুরা শোআরা, ২৬/২২৪
হাদীসে আছে -
কাহারও অভ্যন্তর কবিতায় পরিপূর্ণ হওয়া অপেক্ষা পুঁজে পরিপূর্ণ হওয়া উত্তম। - বোখারী শরীফ, ২৩৫০
*********************************************************
আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক, পরম করুণাময়, পরম দয়াময়। তিনি বিচারদিনের মালিক (সুরা ফাতিহা, ১/১ - ৩)। কিন্তু আল্লাহ পুরুষ। পিতৃতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা। উজ্জ্বল তাঁর প্রতিষ্ঠা। তিনি নারী পুরুষের যুগ্ম অস্তিত্ব নন। সেজন্যেই তাঁর পক্ষপাতিত্ব পুরুষতন্ত্রের প্রতি। আল্লাহ যে পুরুষ সে কথা তিনি ঘোষণা করেছেন কোরানে। কোনও দ্বিধা নেই তাতে। সুরা আনআমে বলা হয়েছে,
তিনি আকাশ পৃথিবীর স্রষ্টা, তাঁর সন্তান হবে কেমন করে? তাঁর তো কোনো স্ত্রী নেই, তিনিই তো সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন। - সুরা আনআম, ৬/১০১
*************************
আল্লাহ কোনো সন্তান গ্রহণ করেননি। - সুরা মুমিনুন, ২৩/৯১
*************************
আকাশ ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব তাঁরই। তিনি কোনো সন্তান গ্রহণ করেননি। - সুরা ফুরকান, ২৫/২
*************************
আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করতে চাইলে তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করতে পারতেন। - সুরা জুমার, ৩৯/৪
*************************
আর আমরা এ-ও বিশ্বাস করেছি যে, আমাদের প্রতিপালকের মর্যাদা অনেক ওপরে। তিনি কোনো স্ত্রী নেননি ও তাঁর কোনো সন্তানও নেই। - সুরা জিন, ৭২/৩
*************************
তিনি কাউকে জন্ম দেননি ও তাকেও কেউ জন্ম দেয়নি। - সুরা ইখলাস, ১১২/৩
*********************************************************
পুরুষের স্খলিত, বেগবান শুক্রকে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে কোরানে। কিন্তু নারীর নারীত্ব সেখানে উপেক্ষিত। কোনও স্বীকৃতি নেই, সব পুরুষকেই তার জন্মের জন্য ঋণী থাকতে হয় নারীর কাছে। সেই ঋণ শুধু নারী জঠরে সন্তান ধারণ করে বলেই নয়। উন্নত চিকিৎসাবিজ্ঞান নারীকে অন্যের সন্তান গর্ভে গ্রহণ করার ক্ষমতাও দিয়েছে, কিন্তু সেখানেও আরও একজন নারী তার ডিম্বানু দান করেছিল বলেই ভ্রুণ সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। শুধু পুরুষ দ্বারা সৃষ্টি প্রস্ফুটিত হয় না। কোনও কালেই হয়নি। আল্লাহর কোরানে তার বিন্দুমাত্র উল্লেখ নেই বলে আমাদের তা ব্যথিত করে। অথচ ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর একমাত্র ধর্ম -
নিশ্চয় ইসলাম আল্লাহর একমাত্র ধর্ম। - সূরা আল-ই-ইমরান, ৩/১৯
আর মুসলমান হচ্ছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবদল। তোমরাই শ্রেষ্ঠ দল। মানবজাতির জন্য তোমাদের অভ্যুত্থান হয়েছে।
তোমরাই হবে শ্ৰেষ্ঠ, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও। - সুরা-আল-ই, ইমরান, ৩/১১০, ১৩৯
আল্লাহর এই ইসলামে নারীকে সৃষ্টিধাত্রী রূপে পূর্ণ স্বীকৃতি নেই। নারীকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন পুরুষের দেহ থেকে। তার নর্ম সংগিনীরূপে। নতুন সৃষ্টির জন্যে নয়, নারী তার জন্মের জন্যে পুরুষের কাছে ঋণী, পুরুষ তার জন্মের জন্যে ঋণী নয় নারীর কাছে।
*********************************************************
বিবি খদিজার নামে আমি এই পদ্যটি লিখি;
বিসমিল্লাহ কহিবনা, শুধু খদিজার নাম নেবো।
প্রভু, অনুমতি দাও। গোস্বা করিওনা, একবার
শুধু তাঁর নামে এই পদ্যখানি লিখিব মা'বুদ।
নবীজীর নাম? উঁহু, তাঁর নামও নেবোনা মালিক
শুধু খদিজার নাম - অপরূপ খদিজার নামে
একবার দুনিয়ায় আমি সব নাম ভুলে যাবো
তোমাকেও ভুলে যাবো ভুলে যাবো নবীকে আমার।
একমাত্র তিনি, প্রভু, একমাত্র তাঁর চাকুরিতে
উট ও ব্যবসা লয়ে ছিল মোর নবীজী বহাল।
তুমি ডাঁট মারিওনা - নবী ছিল তোমার হাবীব
কিন্তু খদিজার ছিল বেতনের বাঁধা কর্মচারী -
সব নারী জানে তুমি খাটো হয়ে আছো এইখানে
তোমার খাতিরে তবু তা প্রকাশ্যে জাহির করেনা।
(ফরহাদ মজহার, 'বিবি খদিজা', এবাদত নামা: ৩৬)
*************************
ইবনে হাজম আরো বলেছেন যতক্ষণ পর্যন্ত কন্যা অক্ষতা কুমারী থাকে ততক্ষণ সে পিতা বা অভিভাবকের সম্পত্তি। বিয়েতে তার মত গ্রহণের কোনও প্রয়োজন নেই। কন্যার একবার বিয়ে হয়ে গেলে তার কুমারীত্ব মুছে যায়। শুধু তখনি তার নিজের ওপর অধিকার জন্মে। স্বামী মারা গেলে বা তালাক দিলে পুনর্বিবাহেই শুধু সে মত দিতে পারে। কুমারী অবস্থায় একটি মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে এই হল ইসলামের অধিকার।
*************************
এক পর্যায়ে আল্লাহ মোহাম্মদকে বিয়ের ব্যাপারে ইতি টানতে বলেছিলেন (সুরা আজহাব, ৩২/৫২)। তবে তিনি মোহাম্মদের জন্যে পত্নীদের তালাক দেওয়া নিষিদ্ধ করেছিলেন তা বোধ হয় ঠিক নয় (সুরা তাহরিম, ৬৬/৫)।
*************************
এই যে প্রিয়তমা পত্নী কিশোরী আয়েশা তাঁকেও ভুল বুঝেছিলেন রসুল। সাফওয়ান-ইবনে মোয়াত্তাল নামে একজন সাহাবাকে জড়িয়ে আয়েশাকে নিয়ে একটি অপবাদ রটেছিল। রসুল সেই অপবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এক পর্যায়ে আয়েশাকে তালাক পর্যন্ত দিতে চেয়েছিলেন তিনি। হজরত আলীর বক্তব্য থেকে এর ইঙ্গিত পাওয়া যায় হাদীসে (বোখারী শরীফ, ১৮৫৯-৬১)। কোরানেও এর ইঙ্গিত রয়েছে।
যারা মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে তারা তো আমাদেরই একটি দল। এই অপবাদকে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্ঠকর মনে কোরো না, বরং এ তো তোমাদের জন্য কল্যাণকর। ওদের প্রত্যেকের জন্য আছে ওদের কৃত পাপকর্মের ফল আর ওদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে তার জন্য আছে কঠিন শাস্তি।
যারা সাধ্বী, নিরীহ ও বিশ্বাসী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে তারা ইহলোকে ও পরলোকে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। - সুরা নূর, ২৪/১১, ২৩
*************************
হজরত মোহাম্মদের জীবনে সবচেয়ে বিতর্কিত বিয়ে ছিল জয়নবের সাথে বিয়ে। জয়নব ছিলেন হজরতের ফুফাতো (পিসতুতো) বোন। জায়েদ বিন হারিস ছিলেন দক্ষিণ সিরিয়ার বনি কাম নামে এক খ্রিস্টান গোত্রের ছেলে। শৈশবে তাঁকে দস্যুরা হরণ করে মক্কায় বিক্রি করে দেয়। বিবি খাদিজা তাঁকে ক্রয় করে মোহাম্মদকে উপহার দেন। মোহাম্মদ জায়েদকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। জায়েদকে মুক্ত করে দেন তিনি। খবর পেয়ে জায়েদের পিতা ও ভ্রাতা তাঁকে ফিরিয়ে নিতে আসলে তিনি যেতে অস্বীকৃত হন। প্রথম যে কজন পুরুষ ইসলাম গ্রহণ করেন জায়েদ তাঁদের একজন। মোহাম্মদ জায়েদকে পালিতপুত্র রূপে গ্রহণ করেন এবং নিজের নাম জায়েদের সাথে যুক্ত করে দেন। সেই থেকে জায়েদ পরিচিত হন জায়েদ বিন মোহাম্মদ বলে। মোহাম্মদ ঘোষণা করেন জায়েদ তাঁর পুত্র। তিনি জায়েদের উত্তরাধিকার গ্রহণ করবেন এবং জায়েদ করবেন তাঁর (W. Muir - 'The life of Mohammad', p-35)। জয়নাবকে মোহাম্মদ পছন্দ করেন জায়েদের বধূরূপে। উচ্চ হাশেমী বংশের কন্যা জয়নাবের এই বিয়েতে প্রথমে আপত্তি থাকলেও মেনে নেন রসুলের নির্দেশে। আল্লাহ এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন।
আল্লাহ ও রসুল কোনো বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোনো বিশ্বাসী পুরুষ বা নারীর সে-বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না। - সুরা আহজাব, ৩৩/৩৬
বিয়ের পর জায়েদকে মেনে নিতে পারছিলেন না জয়নব। তিনি মোহম্মদের অন্যতমা পত্নী হতে চাইলেন। শেষ পর্যন্ত জায়েদ জয়নবকে তালাক দেন। এই ব্যাপারেও রসুলের নির্দেশ ছিল বলে ইতিহাসবিদরা মনে করেন। পরে জয়নবকে মোহাম্মদ তাঁর অন্যতম পত্নী রূপে গ্রহণ করেন। পালিত পুত্রের বধূকে বিয়ে করা যায় কিনা তা নিয়ে মোহাম্মদ বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাঁকে উদ্ধার করেন, অবতীর্ণ হয় ওহী।
তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন করেছিলে আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেন। তুমি লোক ভয় করেছিলে, অথচ আল্লাহকে ভয় করা তোমার পক্ষে অধিকতর সংগত ছিল। তারপর জায়েদ যখন (জয়নবের সাথে) বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করল তখন আমি তাকে তোমার সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করলাম যাতে বিশ্বাসীদের পোষ্যপুত্ররা নিজ স্ত্রীর সাথে বিবাহ সূত্র ছিন্ন করলে সেসব রমনীকে বিয়ে করতে বিশ্বাসীদের কোনো বাধা না হয়।
আল্লাহ নবির জন্য যা বিধিসম্মত করেছেন তা করতে তার জন্য কোনো বাধা নেই। - সুরা আজহাব, ৩৮/৩৭ - ৩৮
জয়নবের সাথে মোহাম্মদের বিয়ের খবর শুনে বিবি আয়েশা মন্তব্য করেছিলেন, "রসুল যা কামনা করেন আল্লাহ সাথে সাথে তা অনুমোদন করেন"। এই উক্তি অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। ইসলামের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে আয়েশার এই মন্তব্য।
সেই থেকে ইসলামে দত্তক বা পালিত সন্তান গ্রহণ নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
আর পোষ্যপুত্র যাদেরকে তোমরা পুত্র বল, আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের পুত্র করেননি। তোমরা ওদেরকে ডাকো ওদের পিতৃপরিচয়ে। - সুরা আজহাব, ৩৩/৪ - ৫
*************************
রসুল বলেছেন আল্লাহ সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করেন তালাককে। কিন্তু দেখা যায় তিনিও বারবার তালাক নামে অস্ত্র ব্যবহার করতে চেয়েছেন পত্নীদের ওপর। আল্লাহর রসুলের পত্নীদের প্রতি যদি সহনশীলতা এই পর্যায়ে থাকে তাহলে সাধারণ মুসলমানদের অবস্থা সেই যুগেও কী ছিল আমরা তা ভেবে নিতে পারি।
তবে রসুল কোনও স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেনি শেষ পর্যন্ত সেকথাও সত্যি নয়। রসুলের এক বিবাহিতা পত্নী ছিলেন আসমা (নোমান কিন্দির কন্যা)। তিনি নিজেই নাকি মুক্তি চেয়েছিলেন। তাই রসুল তাঁকে তালাক দিয়েছিলেন। রসুলের কোনও কোনও জীবনীকার উল্লেখ করেছেন যে, মোহাম্মদের সাথে আসমার কোনরকম যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি অর্থাৎ বিয়ে কনজুমেট করেনি (সা'দ উল্লাহ - 'ইসলাম ও নারী', দৈনিক জনকণ্ঠ, ঢাকা, ২২ আগস্ট, ১৯৯৭)। আমরা ধরে নিতে পারি এই বিয়ে ধরে রাখতে চাননি আসমা।
*************************
রসুল অনেক বিধবা নারীকে বিয়ে করে তাঁদের উদ্ধার করেছিলেন বলে দাবি করা হয়। কিন্তু রসুলের মৃত্যুর পর তাঁর বিধবাদের পুনর্বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়। তাদের বলা হয় উম্মুল মুমেনীন, মুসলমানদের জননীস্বরূপা। কোরানে আল্লাহ নির্দেশ পাঠান রসুলের উম্মতদের প্রতি।
নবি বিশ্বাসীদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়েও কাছের, আর তার স্ত্রীরা তাদের মায়ের মতো। তোমাদের কারও পক্ষে আল্লাহর রসুলকে কষ্ট দেওয়া বা তার মৃত্যুর পর তাদের স্ত্রীদেরকে বিবাহ করা সংগত হবে না। - সুরা আহজাব, ৩৩/৬, ৫৩
মোহাম্মদ যখন মারা যান তখন আয়েশার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। দীর্ঘজীবন লাভ করেছিলেন তিনি। ভোগ করেছিলেন দীর্ঘ বৈধব্য-যন্ত্রণা। তাঁর কোনও সন্তান ছিল না।
*************************
মোহাম্মদ মুসলমান ছাড়াও ইহুদী ও খ্রিস্টান রমণীকে বিয়ে করেছিলেন। এই দুই ধর্মানুসারীদের ইসলাম কিতাবের অধিকারী বলে মনে করে। ইহুদীদের তৌরাত ও খ্রিস্টানদের ইঞ্জিল কোরানেও মান্যতা পায়। তাই পূর্বে ধর্মান্তরিত না করেও এই দুই ধর্মের নারীকে বিয়ে করতে ইসলাম কোনও বাধা নিষেধ আরোপ করে না। পরে ধর্মান্তরিত হলেও চলে। কিন্তু পৌত্তলিকদের বেলায় ইসলামে ধর্মান্তরিত এ হলে কোন ভাবেই নয়। ইসলামে ধর্মান্তরিত হলে অবশ্য ভিন্ন কথা। কিন্তু যেখানে সুযোগ নেই সেখানেও ইসলাম কোনও ছাড় দেয় না।
নারী তো শুধু পত্নী নয়, জননীও। হাদীসে বলা হয়েছে, "জননীর পায়ের নীচে বেহেশত।" এখানে যোগ করা উচিত ছিল সেই জননীকে হতে হবে বিশ্বাসী নারী। না হলে তো আর বেহেশত থাকবে না। মোহাম্মদের মা আমিনা তাঁর শৈশবেই মারা যান। তখনো ধর্ম হিসাবে ইসলামের উন্মেষ হয়নি। আমিনানন্দন মোহাম্মদের নবুয়ত লাভ তো অনেক অনেক পরের ঘটনা। স্বাভাবিক কারণেই মোহাম্মদজননী আমিনা ইসলাম-বিশ্বাসী নারী ছিলেন না। সেই জন্যে মোহাম্মদ গর্ভধারিনীকেও মর্যাদা দিতে পারেননি। জননীর কবর তিনি কোনওদিন জিয়ারত (ইসলামী অনুযায়ী পরলোকগত আত্মার শান্তি কামনা করে প্রার্থনা) করতে চাননি, তিনি পৌত্তলিক ছিলেন বলে। জননীর প্রতি শ্রদ্ধাকে এখানে ছাড়িয়ে গেছে ধর্মবিশ্বাস। ইসলামে সব কিছুই যেন খণ্ডিত। মহত্তর মানবিক চেতনায় উদ্ভাসিত নয়। মোহাম্মদ জননীর বেলায়ও সেই গণ্ডী অতিক্রম করতে পারেননি।
*********************************************************
রসুল হজরত মোহাম্মদের শাসনকালে নারীরা মসজিদে যেতেন। মৃত্যুর পর মৃতের জানাজায়ও অংশ নিতেন। রসুলের একটি হাদীস রয়েছে, যাতে বলা হয়েছে "আল্লাহর বান্দীগণকে আল্লাহর মসজিদে যাইতে নিষেধ করিও না।" (বোখারী শরীফ - ৪১২)। রসুলের জানাজায়ও নারীরা অংশ নিয়েছিলেন। হজরত ওমর এসব পছন্দ করতেন না। তিনি অসিয়ত করে যান যে তাঁর জানাজায় যেন কোনও নারী অংশগ্রহণ না করে। হজরত ওমরের খেলাফত থেকেই নারীদের মসজিদে যাওয়া এবং জানাজায় অংশগ্রহণ করা নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
তালাক আইনও সংশোধন করে যান খলিফা ওমর। আগে তিন তালাক একসাথে দেওয়া যেত না। ওমরের সময় একসাথে তিন তালাক দেওয়ার নিয়ম চালু হয়ে যায়।
*************************
একেবারে হাল আমলের ঘটনা, বিংশ শতাব্দীর। ইসলামের দুই পবিত্র ও পূণ্য নগরী মক্কা মোয়াজ্জেমা ও মদীনা মনোয়ারা। তার হেফাজতকারী এখন সৌদি আরবের রাজকীয় সরকার। যে রাজকীয় শাসনব্যবস্থা ইসলাম অনুমোদন করে না বলেই দাবি করা হয়। সৌদি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা আমীর মোহম্মদ ইবনে সউদের বংশধর বাদশাহ (Absolute King) আবদুল আজিজ ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন সউদি আরব নামে রাষ্ট্রটি। বাদশাহ আবদুল আজিজ বিয়ে করেছিলেন ৩০০-র বেশি নারীকে। তাঁর একসময়ের বিবাহিত পত্নীরা তালাকপ্রাপ্ত হয়ে উপপত্নীরূপে ঢুকে যেত বাদশাহের হারেমে। বাদশাহ আবদুল আজিজের ছিল ৪৪টি পুত্র এবং অসংখ্য কন্যা সন্তান। অন্তত দুই হাজার রাজকুমার এখন বাদশাহ আজিজ ইবনে সউদের বংশধর।
ইসলামের খলিফা, শাহেনশা, বাদশাহ, নবাবরা নাকি কোরানকে অতিক্রম করেননি।
আর যদি তোমরা এক স্ত্রীর জায়গায় অন্য স্ত্রী নেওয়া ঠিক কর আর তাদের একজনকে প্রচুর অর্থ দিয়ে থাক তবুও তার থেকে কিছুই নেবে না। - সুরা নিসা, ৪/২০
ইসলামে পুরুষদের বহু বিবাহের এই উত্তরাধিকার তাদের ধর্মীয় অধিকার।
*********************************************************
আরবভূমির ঊষর মরু অঞ্চলে মোহাম্মদের জন্ম ও জীবনকাল। তাঁর কর্মভূমি। যে দুটি নগরী মক্কা ও মদীনাকে কেন্দ্র করে তিনি আবর্তিত হয়েছেন সেখানে জলের বড় অভাব। বেগবতী কোনও স্রোতস্বিনী নেই। ছোট নদীও নয়। আছে শুধু কিছু মরুদ্যান নগর থেকে বাইরে গেলে ধূ ধূ প্রান্তরের মধ্যে। কিন্তু নদীর কথা আরববাসীরা শুনেছেন। যদি যেন তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। তাই এই জীবনে যা দেখা হল না পরলোকে গিয়ে যদি তার দেখা মেলে। আল্লাহ মুসলমানদের সেই নদীর দেশ জান্নাতে নিয়ে যেতে চান। নদী আছে আরব মরুবাসীর স্বপ্নে। সেই নদীর দেশে যাওয়ার জন্যে আল্লাহ তাদের প্রলুব্ধ করেন। আল্লাহ তাই কোরানের অনেক সুরায় বারংবার বলেছেন সেই কথা, "জান্নাতের নিচে নদী বইবে।" কোরানের দ্বিতীয় সুরা, সুরা বাকারায় আমরা প্রথম জন্নত ও নদীকে একসাথে খুঁজে পাই।
যারা বিশ্বাস করে তাদেরকে সুখবর দাও যে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত যার নিচে নদী বইবে। - সুরা বাকারা, ২/২৫
কোরানের একেবারে শুরুতেই আমরা জান্নাতের দর্শন পেলাম। পেয়ে গেলাম নদীকেও। যে নদী জান্নাতের নিচে বহমান। এরপর এই নদীকে আমরা বহমান দেখেছি সুরা থেকে সুরায়। আয়াত থেকে আয়াতে। কোরানে অন্তত ২৩টি আয়াতে বলা হয়েছে জান্নাতের নিচে নদী বইবে।
*************************
জান্নাতের প্রতিশ্রুতি ও বর্ণনা কোরানের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে। কোরানের মোট আয়াতের সংখ্যা ৬৬৬৬ এবং সুরার সংখ্যা ১১৪। বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রাক্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান মুহম্মদ হাবিবুর রহমান বিশিষ্ট কোরান বিশেষজ্ঞ। তাঁর 'কোরান সূত্র' কোরানের বিষয়ভিত্তিক বিন্যাস, অসামান্য একটি গ্রন্থ। ... তিনি দেখিয়েছেন কোরানের ১১৪টি সুরার মধ্যে ৫২টিতে জান্নাতের কথা রয়েছে। আর জান্নাত সংক্রান্ত আয়াতের সংখ্যা ২৮৯।
*************************
জান্নাত হল মুসলমান পুরুষদের জন্যে প্রলোভন। জান্নাত অর্থ অনন্ত কামনা। জান্নাত অর্থ চূড়ান্ত ভোগ। যা মর্ত্যবাসীর কল্পনাতে আসবে না। জান্নাতে মিলবে সুস্বাদু ফল-মূল-দ্রাক্ষা, খেজুর, ডালিম, কলা ও কণ্টকবিহীন বদরি (যা আরববাসীর প্রিয়), ছায়া (আরবে কোথায় আর সেই ছায়া) দুধের আর মধুর নহর। যা চাওয়া হবে তাই পাওয়া যাবে কামনার সব কিছু। মদিরা আর শরাব। পবিত্র সুরা (জান্নাতের সুরাও পবিত্র)। কনক থালায় পরিবেশিত হবে খাদ্য। উজ্জ্বল একখানি পাত্রে শরাব। যত খুশি খাওয়া যাবে। জান্নাতে মাতাল হবে না কেউ। সেখানে তাদের স্বর্ণনির্মিত ও মুক্তাখচিত কঙ্কন দিয়ে অলংকৃত করা হবে, সেখানে তাদের পোশাক পরিচ্ছদ হবে রেশমের। এই দুনিয়াতে এইসব তাদের পরতে দেওয়া হয়নি। তাই আখেরেতে সেই সুযোগ করে দেওয়া। চাওয়ার আগেই তারা পেয়ে যাবে সবুজ মিহি মখমল ও রেশমের সব আবরণ। সবুজ রং আল্লাহর বড় প্রিয়। তাই জান্নাতের পোশাকের রংয়ের এই নির্বাচন। জান্নাতে মিলবে নারী আর নারী। এক-দুই-তিন-চার নয়, প্রতিটি পুরুষের জন্যে ৭২টি হুর (সংখ্যাটা কোরানে নেই। রয়েছে রসুলের হাদীস তিরমিজি শরীফে)। জান্নাতে যে আসন মিলবে তার যে কত বর্ণনা। সেখানে মুখোমুখি হেলান দিয়ে বসা যাবে। হুররা সব চিরকুমারী, আয়তনয়না, সমবয়স্কা। প্রেমময়ী সুরক্ষিত ডিমের মত উজ্জ্বল। তারা সব পবিত্র সঙ্গিনী। যাদের এর আগে কোনও মানুষ বা জিন স্পর্শ করেনি, অক্ষত যোনী সব তারা, মুক্তা, প্রবাল ও পদ্মরাগমণির মত। আয়তলোচনা হুরের সাথে শুধু মিলন আর মিলন। এই সব বর্ণনা কোরানের বিভিন্ন আয়াতের। সব কিছু ছাড়িয়ে কোরানের জান্নাত হল শরাব আর হুর। যৌনতার মানসভূমি। বাধাবন্ধনহীন উদ্দাম সেই যৌনতা, তাই পারস্যের কবি হাফিজ এই দুনিয়াতেই তা পেতে চাইলেন। বেহেশতে যা পাওয়া যায় এই দুনিয়াতে তা চাওয়ার মধ্যে কোনও অপরাধ দেখেননি তিনি।
কোরান হাদীস সবাই বলে
পবিত্র সেই বেহেশত নাকি
সেথায় গেলে মিলবে শরাব
তন্বী হুরী ডাগর আঁখি।
শরাব এবং প্রিয়ায় মিলে
দিন কাটে মোর দোষ কী তাতে?
বেহেশত যা হারাম নহে
মর্ত্যে হবে হারাম তা কি!
ইরানের কবি এখানে যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন তার উত্তর আমরা দিতে পারব না।
*************************
জান্নাতের কত বর্ণনা যে হাদীসে রয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। রসুল মোহাম্মদ বলেছেন 'জান্নাতের মাটি হবে মেশাক জাফরানের। আল্লাহ কনক ও রজতের ইঁট দিয়ে তা নির্মাণ করেছেন। জান্নাতের সুখ ও সৌন্দর্য বর্ণনা করা কোনও মানবসন্তানের পক্ষে সম্ভব নয়, মর্তের মুসলমানরা সেখানে ৩০ বছরের যুবক হয়ে প্রবেশ করবে আর মুসলমান নারীরা রূপান্তরিত হবে ১৬ বছরের পূর্ণ যুবতীতে। হুররাও সকলেই ১৬ বছরের পূর্ণ যুবতী সমতুল হবে। জান্নাতে হুর, নারী, পুরুষ কারো বয়স বৃদ্ধি পাবে না। তারা চিরযৌবন লাভ করবে সেখানে।'
*************************
হাদীসে আরো বলা হয়েছে - 'আল্লাহ হুরদের এত সৌন্দর্য দান করেছেন যে তা কোনও মানুষ বর্ণনা করতে পারবে না। তাদের মুখের থুথু এত সুগন্ধপূর্ণ হবে যে তার এক ফোঁটা জলে পড়লে সমস্ত জল দুধের মত শুভ্র ও আতরের মত সুগন্ধময় হয়ে যাবে। যদি কোনও হুর রজনীর দিকে তাকান তবে সেই রজনী দিবসে রূপান্তরিত হয়। জান্নাতের এই হুররা হবে জান্নাতবাসী মুসলমানদের দাসী।'
*************************
জান্নাতের পরিকল্পনা এবং মানসসৃষ্টি সম্পূর্ণরূপে মর্ত্যের মুসলমান পুরুষদের জন্যে। এখানে যে প্রলোভন দেওয়া হয়েছে তা কাম উত্তেজনার, যৌনতার, প্রমোদের। এই জান্নাত মুসলমান রমনীদের জন্যে নয়। সতী-সাধ্বী মুসলমান স্ত্রীর জন্যেও নয়। আল্লাহর দুনিয়ায় তাদের অবস্থান অবরোধে, পুরুষের মনোরঞ্জনে আর সন্তান উৎপাদন। কল্পিত জান্নাতে তাদের জায়গা দেওয়া হয়নি। তারা সেখানে উপেক্ষিতা। অত হুরের মধ্যে সেখানে তারা কাকে খুঁজবে, করবেই বা কী? কোরানে পুরুষদের জান্নাতে প্রবেশের কথা কতবার কতভাবে বলা হয়েছে। নারীদের ক্ষেত্রে তার কিছুই বলা হয়নি। জান্নাতের ওপর কোরানে ২৮৯টি আয়াত আছে। তার মধ্যে মাত্র ৫টি আয়াতে নারীকে খুঁজে পাওয়া যায়।
আল্লাহ বিশ্বাসী নর ও নারীকে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যার নিচে নদী বইবে - সেখানে তারা থাকবে চিরকাল - প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্থায়ী জান্নাতে উত্তম বাসস্থানের। - সুরা তওবা, ৯/৭২
তোমরা ও তোমাদের স্ত্রীরা সানন্দে জান্নাতে প্রবেশ করো। - সুরা জুখরফ, ৪৩/৭০
(তিনি জিহাদের নির্দেশ দিয়েছেন) এজন্য যে তিনি বিশ্বাসী পুরুষ ও বিশ্বাসী নারীদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার নিচে নদী বইবে - যেখানে তারা স্থায়ী হবে। - সুরা ফাতাহ, ৪৮/৫
সেদিন তুমি দেখবে বিশ্বাসী পুরুষ বিশ্বাসী নারীদেরকে। তাদের সামনে ও ডানপাশে তাদের জ্যোতি বিচ্ছুরিত হবে। বলা হবে, আজ তোমাদের জন্য সুখবর জান্নাতের, যার নিচে নদী বইবে।
স্থায়ী জান্নাত। সেখানে তারা প্রবেশ করবে আর তাদের পিতামাতা, পতিপত্নী ও সন্তান সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে তারাও। - সুরা রা'দ, ১৩/২৩
জান্নাত নিয়ে এত আয়াতের মধ্যে মাত্র ৫টি আয়াতে আমরা নারীকে দেখতে পাই। জান্নাতে নারীরা তাদের মর্তের স্বামীকে খুঁজে পাবে কিনা সে কথা কোথাও বলা নেই। যদি দেখাও মেলে স্বামী নামে সেই পুরুষটি মর্তের পুণ্যের ফলে ৭২ জন আয়তলোচনা চিরযৌবনময়ী হুর নিয়ে 'নয় জীবন' যাপন করবে। মর্তের স্ত্রীদের জান্নাতে তো তার প্রয়োজন নেই। জান্নাতে সেইসব স্ত্রীদের চিনে নিয়েই বা কী হবে। এই হল ইহলোকে পতিব্রতা নারীদের জান্নাতের পুরস্কার। অবশ্য নারীরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারলে 'উত্তম বাসস্থান' পাবেন। সেই প্রতিশ্রুতি তাদের দেওয়া হয়েছে। তবে উত্তম বাসস্থানে কীভাবে তারা দিন কাটাবেন তা কোথাও বলা নেই। মনে হয় সেখানেও তাদের অবরোধে থাকতে হবে। আল্লার তাই ইচ্ছা। তাদের দেহ তো আলো থেকে সৃষ্ট নয়। তারা তো জান্নাতের হুর নয়, তাদের জান্নাতের জীবন যেন আরও কষ্টের। ইহলোকে চতুর্থাংশ স্বামী হলেও বরাদ্দ ছিল তাদের জন্যে। জান্নাতে তেমন প্রতিশ্রতি নেই।
যে ৫টি আয়াতে জান্নাতে নারীর প্রবেশের কথা বলা আছে তার মধ্যে একটি হল জেহাদ-সংক্রান্ত (৪৮/৫)। জেহাদ অর্থ ধর্মযুদ্ধ। ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে যুদ্ধ। রসুলের আমলে একটাই অর্থ ছিল জেহাদের। ইসলাম মুসলমান পুরুষের জন্যে জেহাদকে বাধ্যতামূলক করেছে। নারীর জন্যে নয়। কোরানের পরের যুগের ভাষ্যকাররা (তফসিরকার) জেহাদকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁরা জেহাদকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। একটি হল আল-জেহাদ আল আকবর। অন্যটি আল-জেহাদ আল-আসগর। এদের মধ্যে প্রথমটিকে বলা যেতে পারে অন্তৰ্জেহাদ। রসুলের যুগে অন্তৰ্জেহাদের সুযোগ ছিল না। যারা জেহাদী তারাই শুধু জান্নাতের অধিকার পাবে। সুরা ফাতাহতে তাই বুঝি বলা হয়েসে। কিন্তু নারী তো এই আয়াতের অধিকার নিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না? এই প্রশ্নের সরল উত্তর কোরানে নেই। কিন্তু হাদীসে আছে। "নারীর জন্য জেহাদ হল হজ", একটি হাদীসে বলা হয়েছে। অন্য একটি হাদীসে এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে পতি সেবাকে। ইহলোকে পতিব্রতা নারীর আখেরেতে জান্নাত লাভ। পতির সেবা এমন-ই মহৎ কর্ম। এর পর আর বিতর্ক চলে না। সুরা রা'দের ১৩/২৩ আয়াতে নারীর কথা আলাদা করে বলা হয়নি। মাতা-পিতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে নারী আছে। যার যার পুণ্যে সে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কিন্তু জান্নাতে প্রবেশ করে পিতামহ-পিতা-পুত্র-পৌত্র সকলেই তো নতুন জীবন লাভ করে যৌবন ফিরে পাবে। তাদের একই বয়স হবে। নতুন ভুবনে তারা ব্যস্ত থাকবেন হরিণনয়না হুরদের সেবা নিয়ে, ইহলোকের পরমাত্মীয়দের জান্নাতে খুঁজে তো লাভ নেই কোনও। প্রমোদে টান পড়া শুধু। মাতা-জায়া-কন্যারা জান্নাতে গেলে তাদের চলে যেতে হবে সুন্দর বাসস্থানে, যার নিচে নদী বইবে। তাদের আর যেন কোনও চাওয়া থাকতে নেই। জান্নাতে নারীর জন্যে কোনও প্রলোভন নেই। সেখানে শুধু পুরুষের সহস্র পাওয়া। জান্নাতে নারীরা অবশ্য যৌবনবতী হয়েই প্রবেশ করবেন। কারণ সেখানে শুধু জয়গান যৌবনের। যুবতী হয়েই সেখানে প্রবেশ করতে হবে - এটাই জান্নাতের শর্ত। সে কথা রসুল বলে গেছেন তাঁর হাদীসে। কিন্তু তিনি আবার এও বলে গেছেন জান্নাতে নারীরা কম সংখ্যায় প্রবেশ করবে, দোজখীদের মধ্যে নারীরা হবে সখ্যাগরিষ্ঠ। ...
... দুনিয়ার সতী-সাধ্বী এরই বেহেশতে গিয়ে অনন্ত-যৌবনা হবে সে কথা স্পষ্ট করে বলা নেই। পুরুষের বেলায় আছে। এই নারী বেহেশতে গিয়ে আদৌ তার স্বামীর সাথে অত হুরদের ডিঙিয়ে মিলতে পারবে কিনা তাও বলা নেই। জান্নাতে মর্ত্যের পতিকে না হয় নাই পেল সাধ্বী পত্নীরা। কিন্তু তাদের জন্যে অন্য ব্যবস্থা কোথায়? কোরানে কোনও ইঙ্গিত পর্যন্ত নেই। তাহলে বেহেশতে অনন্তযৌবন নিয়ে তারা কী করবে। পুরুষের বাহাত্তর হুর আর সহস্র দাসের বিপরীতে নারীর প্রাপ্তি শুধু উত্তম বাসস্থান। যার যোগফল শূন্য। নারীর জন্যে এই কোরানের জান্নাত। বেহেশতের মেওয়া।
শুধু হুর নয়। আল্লাহ পুরুষের জন্যে অন্য ব্যবস্থাও করে রেখেছেন জান্নাতে। পুরুষদের যে সমকামিতা এই দুনিয়ায় নিন্দনীয় জান্নাতে যেন তা বৈধ করে দিয়েছেন আল্লাহ। কোরানে নিষিদ্ধ সমকামিতার কথা বলা হয়েছে মাত্র দুটি আয়াতে -
আর তোমাদের পুরুষদের মধ্যে যে-দুজন এ (ব্যাভিচার) করবে তাদেরকে শাস্তি দেবে। তবে তারা যদি তওবা করে ও শুদ্ধ হয় তবে তাদের রেহাই দেবে। - সুরা নিসা, ৪/১৬
তোমরা কি যৌন তৃপ্তির জন্য নারীকে ছেড়ে পুরুষের কাছে যাবে? - সুরা নামল, ২৭/৫৫
দুটি আয়াতেই পুরুষের সমকামিতাকে খুব জোরের সাথে নিন্দা করা হয়নি। তওবা করে শুদ্ধ সমকামী দুই পুরুষকে ক্ষমা করে দিতে বলা হয়েছে। সুরা নিসার সংলগ্ন আয়াতেই (৪/১৫) অবৈধ যৌনাচারের জন্যে নারীকে যেখানে মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেওয়া হয়েছে, সেখানে এই শাস্তি তুচ্ছ মনে হয়। এর কারণ হয়তো তৎকালীন আরব সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষিত। ইসলাম পূর্ব আমলে আরব দেশে পুরুষদের মধ্যে সমকামিতার প্রচলন ছিল। মোহাম্মদ তাকে নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই ব্যাপারে তাঁর মন এক জায়গায় আবদ্ধ ছিল না। তিনি মনে করেছিলেন দুনিয়ায় এই যৌনসংগম নিষিদ্ধ করলে জান্নাতে তার সুযোগ এবং প্রলোভন থাকা উচিত। আরববাসীর মনের খবর তিনি রাখতেন। প্রাক ইসলামী যুগে আরবের এক বিখ্যাত কবি ছিলেন আবু-নুয়াস। সমকামি প্রেমকে উৎসাহিত করে তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতার কটি লাইন :
A lad whom all can see girt with sword and belt
not like your whore who has to go veiled
Make for smooth-faced boys and do your very best
to mount them, for women are the mounts of the devils. (Perfumed devils)
জান্নাতে পাওয়া যাবে গিলমানদের। তাদের বাংলা অনুবাদে বলা হয়েছে 'চির কিশোর', তারা জান্নাতী পুরুষদের সেবা করবে। সেটা কোন সেবা? এত হুর থাকতে আবার গিলমানদের প্রয়োজন হল কেন? ভিন্ন রুচির পুরুষদের জন্যে? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা পাইনি কোরানে-হাদীসে। জান্নাতের পুরুষরা যা কামনা করবে তাই তো পাবে। আল্লাহ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি তো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। জান্নাতে গিলমানরা রয়েছে ৪টি আয়াতে -
তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকবে গিলমান (কিশোরেরা), যারা সংরক্ষিত মুক্তোর মতো। - সুরা তুর, ৫২/২৪
তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকবে চিরকিশোরেরা।
পানপাত্র, কুঁজো ও ঝরনাঝরা সুরায় ভরা পেয়ালা নিয়ে। - সুরা ওয়াকিয়া, ৫৬/১৭-১৮
তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকবে চিরকিশোরেরা, যাদের দেখে মনে হবে ওরা যেন বিক্ষিপ্ত মুক্তো। - সুরা দাহর, ৭৬/১৯
সংরক্ষিত মুক্তো বা বিক্ষিপ্ত মুক্তোর মত এই গিলমান বা চিরকিশোরেরা শুধু কী জান্নাতী পুরুষদের হাতে তুলে দেবে সোনার পানপাত্র? তার জন্যে চিরকিশোরদের কী প্রয়োজন ছিল? সেই কাজ তো আলোর হুর-রাই করছিল। এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই।
*************************
সৈয়দ আমীর আলী আরো বলেছেন কোরানের জান্নাতে হুরদের ধারণা জরথুস্ট্রদের কাছ থেকে প্রাপ্ত। জান্নাতের ধারণাও।
*********************************************************
কোরান ইসলামের একমাত্র ধর্মগ্রন্থ, পবিত্রতম। ইসলাম ধর্ম অনুসারী মুসলমানদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হয় কোরান দ্বারা। ইসলামের সব আইনের ভিত্তি হল কোরান।
এরপরেই হাদীসের স্থান। হাদীসকে বলা হয় কোরানের ব্যাখ্যা (Interpretation)। কোরান ইসলামের মূল সংবিধান, হাদীস শব্দের শাব্দিক অর্থ কথাবার্তা। নতুন কিছু যা পূর্বে ছিল না। আর শব্দের পরিভাষা হল নবী মোহাম্মদের কথাবার্তা, ক্রিয়াকলাপ এবং প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মৌল সম্মতি। মোহাম্মদ যা বলেছেন, যা করেছেন এবং যে বিষয়ের প্রতি তাঁর সমর্থন পাওয়া গেছে তাই হল হাদীস। কোরান প্রকাশ্য আর হাদীস গোপনীয় ওহী। এর অর্থ নবী মোহাম্মদ নিজে থেকে কখনও কিছু বলেননি। যা বলেছেন আল্লাহর কাছ থেকে প্রত্যাদেশ পেয়েই বলেছেন, সেই অর্থে কোরান ও হাদীসের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। পার্থক্য যে-টুকু তা হল কোরানের অর্থ ও ভাষা (text) উভয়ই অক্ষরে অক্ষরে আল্লাহর ওহী দ্বারা অবতীর্ণ। কোরান হল 'ওহী মতলু' বা আল্লাহর কালাম। কিন্তু হাদীসের অর্থ ও বিষয়বস্তু আল্লাহর ওহী দ্বারা প্রাপ্ত বটে। কিন্তু ইহার শব্দ ও বাক্য রসুলের রচিত। কোরান হাদীসের আসল উৎস একই। তাই মুসলমানদের কাছে হাদীসের মর্যাদা কোরানের পরেই।
*************************
প্রথমে আমরা হাদীস-সম্রাট ইমাম বোখারীর সহীহ হাদীস থেকে কয়েকটি নির্বাচিত হাদীস তুলে ধরব। ...
• পুরুষের পরে নারী অপেক্ষা ক্ষতিকর বিপদের জিনিস আমি আমার পরে আর কিছু রেখে যাচ্ছি না।
• যদি বিবি হাওয়া না হতেন তবে কখনো কোনও নারী স্বামীর ক্ষতি করত না।
• তোমরা দুনিয়া সম্পর্কে সতর্ক হও। সতর্ক হও নারী জাতি সম্পর্কে। কেননা বনি ইস্রাইলের প্রতি প্রথম যে বিপদ এসেছিল তা নারী জাতির ভিতর দিয়েই।
• পুরুষ নারীর বাধ্য হলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
নারীকে বিশ্বাস না করার জন্য কত সতর্কবাণী। নারী এখানে আর মানবীসত্ত্বায় নেই। হয়ে উঠেছে দানবী। তাকে বিশ্বাস করলে তার ওপর নির্ভর করলে অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। নারীকে বিশ্বাস করে আদিপিতা আদম বিপথে চালিত হয়ে আল্লার রোষানলে পড়ে জান্নাতভ্রষ্ট হন। বাইবেলে (কোরান-হাদীসেও এই কাহিনী রয়েছে) বর্ণিত স্বর্গ হতে পতনের সে কাহিনী নারীকে করে তুলেছে চির-অপরাধী। তাকে তুলে ধরেছে পুরুষের কীর্তি-সুখ-শান্তি ধ্বংসকারী রূপে। অথচ নারী না হলেতো সৃষ্টির রহস্যই উন্মোচিত হত না। নারী তো সৃষ্টির ধাত্রী।
বোখারী শরীফ থেকে আরো কিছু হাদীস -
• হযরত নবী (দঃ) বলিয়াছেন, আমার পরে দ্বীন-বিনষ্টকারী এবং মানুষকে বিপথগামী করার বহু সূত্রই সৃষ্টি হইবে। কিন্তু এই শ্রেণীর ক্ষতিসাধনকারী বস্তুসমূহের মধ্যে পুরুষদের জন্য নারীগণই হইবে সর্বাধিক ক্ষতিকারিনী - পুরুষের জন্য নারীদের সমতুল্য পথভ্রষ্টকারী ক্ষতিকারক আর কোন কিছু হইবে না।
• নারী (জাতির মূল অর্থাৎ সর্বপ্রথম নারী - আদি-মাতা হাওয়া) পাঁজরের (ঊর্দ্ধতম) হাড় হইতে সৃষ্ট। পাঁজরের হাড়সমূহের মধ্যে ঊর্দ্ধতম হাড়খানাই সর্বাধিক বাঁকা।
• দোজখীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হইবে।
• স্বামী যদি স্ত্রীকে স্বীয় বিছানায় প্রতি ডাকে এবং স্ত্রী তাহাতে অসম্মতি প্রকাশ করে যদ্দরুণ স্বামী অসন্তুষ্টির সহিত রাত্রিযাপন করিয়াছেন, তবে সেই স্ত্রীর রাত্রি এই অবস্থায় অতিবাহিত হয় যে, ফেরেশতাগণ ভোর পর্যন্ত সারারাত্র তাহার প্রতি লানৎ (বা অভিশাপ) বর্ষণ করিয়া থাকেন।
• অকল্যাণ তিন জিনিসে - নারী, বাসস্থান ও পশুতে।
ইসলামে, রসুলের হাদীসে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আনুগত্য প্রশ্নাতীত। সেখানে কোনও শর্ত নেই। কিন্তু স্বামী স্ত্রী বা স্ত্রীদের প্রতি অনুগত হবে এমন কোনও হাদীস নেই, স্ত্রীকে যখন ডাক দেবে স্বামী শয্যায় তাকে আসতেই হবে যৌনমিলনের জন্যে। সেখানে স্ত্রী নামে বস্তুটির ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনও মূল্য নেই। স্বামী স্ত্রী বা স্ত্রীদের ঘরে রেখে কোনও উপপত্নীতে উপগত হলেও স্বামীর ওপর কোনও লানত বর্ষণ হবে না। তেমন কোনও হাদীস আমাদের চোখে পড়েনি।
মহানবী মোহাম্মদকে দোজখ বা জাহান্নম দেখানো হয়েছিল। সেখানে তিনি দেখেছেন দোজখীদের অধিকাংশ নারী। রোজ কিয়ামতের পূর্বে কাদের বিচার করা হল। আল্লাহ কেন নারীদের দিয়ে দোজখ পূর্ণ করলেন তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা হাদীসে নেই। ... রসুল মোহাম্মদকে প্রশ্ন করা হয়েছিল নারীরা কেন এত বেশী সংখ্যায় দোজখে যাবে। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন নারীরা যে 'কুফরী' বেশী করে থাকে তা হল স্বামীর কুফরী (নাশোকরী ও নেমকহারামী)। নারীর স্বভাবই হল এই কুফরী করা। এখানেও সেই স্বামী নামে প্রভুর আনুগত্যের প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে। (সূত্র: বোখারী শরীফ, অনুবাদ - মাওলানা আজিজুল হক)
বোখারী শরীফ থেকে আরো কিছু নির্বাচিত হাদীস -
• নারী জাতি আড়ালে থাকার বস্তু। আড়াল থেকে নারী বের হলেই শয়তান তাদের প্রতি উঁকি মারে। এই জন্যেই নারীর নাম হল আওরত বা আবরণীয় জিনিস।
• নারী শয়তানের ফাঁদ।
• নারী শয়তানের আকৃতিতে সামনে আসে এবং শয়তানের আকৃতিতে চলে যায়।
নারী তো শুধু দয়িতা নয়। মাতা-কন্যা-ভগ্নীও, তারাও কী পুত্র-পিতা ও ভ্রাতার কাছে শয়তানের রূপ ধরে আসে? এই প্রশ্নের উত্তর কোথায় খুঁজি। এই সব হাদীসে নারীর প্রতি অসম্মান চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে। নারী বেগানা পুরুষের সামনে আসলেই শয়তান তার ওপর ভর করে এবং শয়তানের আকৃতি পেয়ে যায় সেই নারী, এরপর যদি সেই নারী আড়ালেও চলে যায়, শয়তানের আকৃতির রেখাপাত রেখে দেয় সেই পুরুষের হৃদয় পটে। তাই সব দিকে আবড়িত করে ঘরে বন্দী করে রাখতেই হয় নারীকে। সেটাই উত্তম কাজ। নারীকে শয়তানের দৃষ্টি থেকে রক্ষা করার এ ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। এটাও এক ব্যাখ্যা হাদীসের। অনুরূপ বোখারী হাদীসে রসুল বলেছেন -
• স্বামীর অনুপস্থিতিতে নারীদের কাছে যেও না। কারণ শয়তান তোমাদের প্রত্যেকের রক্ত চলাচলের পথে চলতে সক্ষম।
• একাকী কোনও নারীর সঙ্গে দেখা হলেই শয়তান তাদের তৃতীয় জন হয়।
শয়তান কী শুধু নারীকেই দেখে? পুরুষকে দেখে না। দেখার কথা নয়। কারণ শয়তানও আল্লাহর সৃষ্টি আরেক পুরুষ, তারও প্রয়োজন নারীর। নারীর সাথে তার জন্মবিরোধ। সেটাই হয়তো আরেক ব্যাখ্যা নারী ও শয়তানের সম্পর্কের।
*************************
আর একটি হাদীস -
• কোনও নারী অথবা কুকুর যদি নামাজরত অবস্থায় সম্মুখ দিয়ে যায় তাহলে তার এবাদত আল্লাহর কাছে পৌঁছাবে না। (বোখারী শরীফ - ৩১৬)
*************************
পর্দার বা অবরোধের বিধায় যে যে অঙ্গ নারীকে ঢেকে রাখতে হবে তার একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে বোখারী শরীফে। তাকে বলা হচ্ছে 'ছতর' বা 'সতর'। নারীদের দেহ ঢেকে রাখা সম্পর্কে দুটি নির্দেশ রয়েছে। প্রথম হল সতর। অন্যটি হেজাব বা পর্দা। সতরের পরে হেজাব। সতরের অঙ্গ ও সীমা কেউ না দেখলেও আবৃত রাখতে হবে। তাছাড়া সতরের সীমা ও অঙ্গ সমূহ আবৃত রাখা নামাজের একটি অন্যতম ফরজ নারীর জন্যে। যা অবশ্য পালনীয়। পক্ষান্তরে পর্দা বা হেজাবের অঙ্গ শুধুমাত্র দর্শক হতে আবৃত রাখা আবশ্যক। অর্থাৎ ঘরের ভেতর অবরোধে থাকাকালীন হেজাব না পরলেও চলতে পারে।
*********************************************************
ইসলামের বিচারালয়ে নারীকে কখনো পূর্ণ মানুষ রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। নারীকে বিবেচনা করা হয় পুরুষের অর্দ্ধেক বলে। দুজন নারী মিলে একজন পুরুষের সমকক্ষ হওয়া যায়। কোনও বিচারে সাক্ষ্য দিতে হলে যেখানে একজন পুরুষ হলে চলতে পারে সেখানে প্রয়োজন হবে দুজন নারীর। এ থেকেই ইসলামের বিচারব্যবস্থায় নারীর অবস্থা ও অবস্থান দুটোই বুঝে নেওয়া যায়।
আর তোমাদের পছন্দমতো দুইজন পুরুষকে সাক্ষী রাখবে। আর যদি দুজন পুরুষ না থাকে, তবে একজন পুরুষ ও দুইজন স্ত্রীলোক। - সুরা বাকারা, ২/২৮২
বোখারী শরীফে রয়েছে -
তোমাদের পুরুষদের মধ্য হতে দুজন সাক্ষী সংগ্রহ করতে হবে। যদি দুজন পুরুষ না থাকে একজন পুরুষ ও দুজন নারী হলে হবে।
কোরানের প্রতিধ্বনি হাদীসে। কোরানের এই আয়াত ও এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে নারীর রয়েছে সৃষ্টিগত দুর্বলতা। তাই আল্লাহ নারীর ওপর পুরুষকে শ্ৰেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আর কোনও ব্যাখ্যা আমরা খুঁজে পাইনি। এই শ্রেষ্ঠত্ব থেকেই নারীর উত্তরাধিকার পুরুষের অর্দ্ধেক। সে সম্পত্তির অধিকার পেলেও পিতা, স্বামী, ভাই, পুত্র কারো সম্পত্তিতেই পুরুষের সমান অধিকার পায় না। পায় পুরুষের অর্ধাংশ।
*************************
শরিয়তী আইনে 'জেনা'র জন্যে চরম শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ব্যাভিচার, বিবাহ-বহির্ভূত যৌনমিলন, ধর্ষণ ও পতিতাবৃত্তিকে জেনা বলা হয়েছে। অর্থাৎ পরস্পরের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কের কোনও চুক্তি নেই এমন দুজন নরনারীর যৌনমিলন হল জেনা। শরিয়তী আইনে জেনা বা ব্যাভিচারের জন্যে চরম শাস্তির বিধান রাখা হলেও নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে শাস্তি দুরকম। জেনার জন্যে অবিবাহিত পুরুষের ক্ষেত্রে তা ১০০ ঘা বেত্রদণ্ড বিবাহিত পুরুষের ক্ষেত্রে ৮০ ঘা বেত্রদণ্ড। কিন্তু নারীর বেলায় এই শাস্তি প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড। অপরাধ প্রমাণ করতে চারজন পুরুষ সাক্ষীর প্রয়োজন হয়। কোনও ভাবেই নারীর সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হয় না। এই প্রসঙ্গে কোরানের এই আয়াতটি স্মরণীয় -
তোমাদের নারীদের মধ্যে যারা ব্যাভিচার করে তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের মধ্য থেকে চারজন সাক্ষী নেবে। যদি তারা সাক্ষ্য দেয়, তবে তাদেরকে ঘরে আটক করবে। যে পর্যন্ত না তাদের মৃত্যু হয় বা আল্লাহ তাদের জন্য ওই কোনো ব্যবস্থা করেন। - সুরা নিসা, ৪/১৫
পুরুষ ব্যাভিচার করলে তাকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘরে আটক রাখার নির্দেশ কোরানের কোনও আয়াতে নেই। পুরুষ যেন ব্যাভিচার করতেই পারে না যদি না নারী তাকে প্রলুব্ধ করে। কারণ হাদীসের ভাষায় শয়তানের পাতা ফাঁদে পা দেয় নারী পুরুষ নয়।
*************************
শরীয়া আইনে নারী তো কোনদিন বিচারক হতে পারেন না।
*********************************************************
শতবর্ষ পূর্বে বাংলার এক মুসলমান নারী মহিয়সী বেগম রোকেয়া ঘোষণা করেছিলেন -
"আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ এই ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।" পিতৃতন্ত্রের দীর্ঘ ইতিহাসে এই প্রথম কোনো নারী সরাসরি বাতিল করে দেন কোনো বিশেষ একটি ধর্মগ্রন্থকে নয়। সমস্ত ধর্মগ্রন্থকে; ধর্মগ্রন্থের পেছনের সত্যকে প্রকাশ করেন অকপটে। (রোকেয়া রচনাবলী, সম্পাদকের নিবেদন)
আমাদের যথাসম্ভব অধঃপতন হওয়ার পর দাসত্বের বিরুদ্ধে কখনও মাথা তুলিতে পারি নাই; ...যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। ... আমরা প্রথমতঃ যাহা সহজে মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি। এখন ত অবস্থা এই যে, ভূমিষ্ঠ হওয়ামাত্রই শুনিতে পাস: 'প্যাট! তুই জন্মেছিস গোলাম, থাকবি গোলাম!' সুতরাং আমাদের আত্মা পর্যন্ত গোলাম হইয়া যায়। ...
আমরা যখনই উন্নত মস্তকে অতীত ও বর্তমানের প্রতি দৃষ্টিপাত করি, অমনই সমাজ বলে: 'ঘুমাও, ঘুমাও, ঐ দেখ নরক।' মনে বিশ্বাস না হইলেও অন্ততঃ আমরা মুখে কিছু না বলিয়া নীরব থাকি। ...
আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। ...
এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ-রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। মুণিদের বিধানে যে-কথা শুনিতে পান, কোন স্ত্রী মুণির বিধান হয়ত তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন। যাহা হউক, ধর্মগ্রন্থসমূহ ঈশ্বর প্রেরিত কি না, তাহা কেহই নিশ্চয় বলিতে পারে না। যদি ঈশ্বর কোন দূত রমণী-শাসনের নিমিত্ত প্রেরণ করিতেন, তবে সে দদূত বোধ হয় কেবল এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিতেন না। ... এখন আমাদের আর ধর্মের নামে নত মস্তকে নরের অযথা প্রভুত্ব সহা উচিত নহে। আরো দেখ, যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ়, সেখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক। ...
ধর্ম শেষে আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছে, ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন। ...
(রোকেয়া রচনাবলী)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment