Monday, 16 November 2020
বিবাহ প্রসঙ্গে - সুকুমারী ভট্টাচার্য
Tuesday, 11 August 2020
প্রেম, বিবাহ ও অন্যান্য - প্রবীর ঘোষ
নারীরা যতই নারী স্বাধীনতা ও পুরুষের সমান অধিকার দাবি করুন না কেন, বেকার ছেলে বিয়ে করতে তো কখনওই বিজ্ঞাপন দেন না! তবে বেকার মেয়েরা কি করে প্রত্যাশা করেন রাজপুত্তুররা তাঁদের বিয়ে করবেন? আসলে মেয়েদের চেতনার অণুতে সংস্কারের মজ্জায়-মজ্জায় ঢুকে গেছে স্বামীকে আভিজাত্যের নিদর্শন একটি বস্তু হিসেবে পরিমাপ করা, স্বামীকে নিজের চেয়ে অনেক বড় মাপের হিসেবে চাওয়া, নিজের ওপর স্বামীর স্বত্বাধিকার মেনে নেওয়া।
***********************************************************
স্ত্রীর উপর স্বামীর এমন স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণ অনেক ক্ষেত্রেই স্বামীর উপর স্ত্রীর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা। অনেক সময় সামাজিক পরিবেশগত কারণে অনেক নারী ধরেই নেন, স্বামী-পুত্র-কন্যার সেবায় জীবন উৎসর্গ করার মধ্যেই নারী জীবনের সার্থকতা। এরা অবশ্যই মধ্যবিত্ত মানসিকতার মানুষ। আপনি যখন মা হিসেবে ছেলের জামা-প্যান্ট ধোয়া, ইস্ত্রি করা, স্কুলের টিফিন তৈরি করে গুছিয়ে দেওয়া, জুতোর পালিশ ঠিক রাখা ইত্যাদি কাজগুলো করেন স্নেহময়ী জননীর মহান কর্তব্য হিসেবে, তখন একবারের জন্যেও কি ভেবেছেন আপনার এমনতর কাজ-কর্মের ফলে যৌবনে পৌঁছে আপনার ছেলে প্রত্যাশা করবে তার স্ত্রীও এমনি করে গৃহকর্ম ও শিশুপালনের কাজগুলো একা হাতেই সামলাক? সে তখন নিশ্চয়ই স্ত্রীকে গৃহকর্ম, শিশুপালন ইত্যাদি বিষয়ে পরিপূর্ণ সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসবে না। আপনার মেয়ে যৌবনে পৌঁছে আপনার প্রভাবে এটাই ধরে নেবে এসব কাজ করার একক দায়িত্ব একজন আদর্শ স্ত্রী ও মা হিসেবে তারই। এখনও আমাদের সমাজে সাধারণভাবে প্রচলিত স্ত্রী চাকুরিরতা হলেও তার উপরই বর্তায় গৃহকর্ম ও শিশুপালনের ঝক্কি। এমন এক অবস্থা সৃষ্টির জন্য দায়ভাগ পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় যেমন পুরুষের ওপর বর্তায়, তেমনই কিছুটা দায়ভাগ অবশ্যই নারীদের, যাঁরা এই ধারাকে স্থায়ী রাখার মানসিকতা সন্তানদের মধ্যে তৈরি করে চলেছেন।
***********************************************************
যৌন-মুক্তির বা যৌন স্বাধীনতার দাবি যদিও ধনতান্ত্রিক সভ্যতারই দাবি, তবু এই দাবি প্রতিষ্ঠার মধ্যেই রয়েছে ধনতন্ত্রের ধ্বংসের বীজ। কারণ, যৌন স্বাধীনতার একান্ত অনিবার্য শর্ত - সাম্য, নারী-পুরুষে সাম্য, মানুষে মানুষে সাম্য, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা। আর এই সাম্য ধনতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর ধ্বংস ছাড়া সম্ভব নয়। মুক্ত যৌন-প্রণয়ের আবশ্যিক শর্ত হওয়া উচিত অবদমনহীন, শোষণহীন, বন্ধুত্ব ও বিশ্বাস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মানবীয় সম্পর্ক।
***********************************************************
একগামী মানে অবশ্য আজীবন একজনের সঙ্গেই যৌননিষ্ঠ থাকবে - এমনটি অবশ্যই নয়। যে মানুষের জীবন বেশি গতিময়, জীবনে উত্থান-পতন বেশি, তাদের বন্ধুরাও পরিবর্তিত হতে থাকে। প্রেমিকা বা প্রেমিক একজন 'বিশেষ বন্ধু'। এই 'বিশেষ বন্ধুত্ব'ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাল্টাতে পারে। জীবনে যেমন পুরনো বন্ধুদের কেউ কেউ বিদায় নেয়, কেউ কেউ আসে -- তেমন কোনও 'বিশেষ বন্ধু' জীবনে এলে স্বাগত জানানোই উচিত।
***********************************************************
প্রেম বা দাম্পত্য জীবনের আদর্শ সম্পর্ক গড়ে ওঠার প্রাথমিক ও আবশ্যিক শর্ত যৌনতা নয়। নাহলে গণিকা ও লম্পটরাই হত সেরা প্রেমিকা ও প্রেমিকের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। .... প্রেম বা দাম্পত্য জীবনের প্রাথমিক ও আবশ্যিক শর্তই হলো বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা এবং মতাদর্শগত মিল।
***********************************************************
রাজনীতি সচেতন, আদর্শ সচেতন, মূল্যবোধ সচেতন, আত্মমর্যাদা সচেতন, স্বাধীন মানসিকতাসম্পন্ন দম্পতিদের বিচ্ছেদ তুলনামূলকভাবে অসচেতন ও স্বল্পসচেতন দম্পতিদের চেয়ে অনেক বেশি ঘটে। দু'জনেই যখন আদর্শ-সচেতন, মূল্যবোধ-সচেতন, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন, রাজনীতি ও সমাজনীতি সম্পর্কে সচেতন তখন আদর্শগত দ্বন্দ্ব দেখা দিতেই পারে - সেটা একপক্ষের আদর্শচ্যুতির জন্যে যেমন হতে পারে, তেমনই আদর্শগত মতপার্থক্য থেকেও হতে পারে। এই দ্বন্দ্ব নিয়ে 'প্রেমিক-প্রেমিকা' অথবা 'স্বামী-স্ত্রী'র সম্পর্ক অটুট রাখা অবাঞ্ছিত মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক কি?
***********************************************************
কোনটা সত্যি? হিন্দুদের ঈশ্বর-বিশ্বাস, নাকি মুসলিমদের আল্লা-বিশ্বাস? আমি যদি হিন্দু থেকে মুসলিম হয়ে যাই, তবে কি আমার ঈশ্বর সাকার থেকে নিরাকার হয়ে যাবেন? আমি ইসলাম ধর্ম ছেড়ে হিন্দু হলে আমার ঈশ্বর নিরাকার থেকে আবার বিশিষ্ট হতে বাধ্য হবে?
আমার ইচ্ছেতেই যদি আমার ঈশ্বরের রূপ সাকার বা নিরাকার হতে বাধ্য হন, তবে তো আমি আমার ঈশ্বরের চেয়েও বেশি শক্তিমান।
***********************************************************
Tuesday, 4 August 2020
পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি - ফ্রেডরিক এঙ্গেলস
Tuesday, 28 July 2020
লেনিন - সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর
Sunday, 26 July 2020
আর এস এস-বি জে পি এবং সোশ্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং - গৌতম রায়
ভারত সরকার, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের সঙ্গে আরএসএসের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং গোলওয়ালকরের মুক্তির বিষয়টি নিয়ে আপোষে আলাপ আলোচনার নেতৃত্ব এই একনাথ রাণাডেই দিয়েছিলেন। সর্দার প্যাটেলের সঙ্গে আরএসএস নেতা একনাথ রাণাডের প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল মাইসোরে বিশিষ্ট শিল্পপতি ঘনশ্যামদাস বিড়লার বাড়িতে। এর আগে থেকেই নানা স্তরে আরএসএসের সঙ্গে জিডি বিড়লার একটি সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। মূলত বৃহৎ বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি কংগ্রেসের সঙ্গে বিড়লাদের ঘনিষ্ঠতা থাকলেও আরএসএসের সঙ্গে একটা সম্পর্ক রেখে প্রথম থেকেই চলে আসছিলেন জিডি বিড়লা।
মাইসোরে জিডি বিড়লার বাড়িতে সর্দার প্যাটেলের সঙ্গে তাঁর বৈঠকটিকে একনাথ রাণাডে 'বিশৃঙ্খলা' বলে পরবর্তী সময়ে অভিহিত করেছিলেন। প্যাটেলের পক্ষ থেকে রাণাডের উপর বার বার এই বলে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল যে, গোটা দেশের আইনশৃঙ্খলার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে সঙ্ঘের দ্বারা - এমনটাই ছিল একনাথ রাণাডের অভিযোগ (১৯৬৯ সালের ২৯শে ডিসেম্বর কন্যাকুমারীতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একনাথ রাণাডে এই অভিযোগ করেছিলেন)। এই বৈঠকে সর্দার প্যাটেলের ভূমিকা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সাক্ষাৎকারে বেশ ক্ষোভই রাণাডে প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর মতে, কোন কোন ক্ষেত্রে আরএসএস আইন শৃঙ্খলার পরিবেশের অবনতি ঘটাচ্ছে - তার নাকি কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেশের গৃহমন্ত্রী সর্দার প্যাটেল দিতে পারেননি। সাক্ষাৎকারে রানাডে বলেন যে, আগে সঙ্ঘ সম্পর্কে যেসব অভিযোগ সর্দার প্যাটেল গোলওয়ালকরকে জানিয়েছিলেন, সেইসব অভিযোগ নিয়ে তিনি (রাণাডে) যখন প্যাটেলকে বিড়লার বাড়ির বৈঠকে চেপে ধরেন, তখন সেইসব বিষয়ে স্পষ্ট কোনো জবাব দেওয়া সর্দার প্যাটেলের পক্ষে সম্ভবপর হয়নি।
নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়ে সর্দার প্যাটেলের মূর্তি প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন, তার পিছনে সামগ্রিক ভাবে সঙ্ঘের কতোখানি সমর্থন রয়েছে, তা একনাথ রানাডের এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ্যে আসার পর আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। গান্ধী হত্যার পর সঙ্ঘের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং গোলওয়ালকরের মুক্তি প্রসঙ্গে দেশের তৎকালীন গৃহমন্ত্রী সর্দার প্যাটেলের অবশ্যই একটি সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তবে তাঁর সেই সক্রিয়তা কতোখানি সঙ্ঘের স্বার্থে আর কতোখানি প্যাটেলের সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে ব্যক্তি বিরোধের জেরে তা নিয়ে একটা সংশয় খোদ সঙ্ঘের ভিতরেই আছে।
সঙ্ঘের একটি অংশ মনে করেন যে, পন্ডিত নেহেরুর সঙ্গে নিজের ব্যক্তি বিরোধের জেরে প্যাটেল ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন আরএসএসকে। কংগ্রেসের সঙ্গে সঙ্ঘের মিলনের প্রশ্নে সর্দার প্যাটেলের যে প্রস্তাব ছিল, সেই প্রস্তাব সঙ্ঘ বা কংগ্রেস দলের স্বার্থে যতো না সর্দার প্যাটেল দিয়েছিলেন, তার থেকে অনেক বেশি তিনি তাঁর নিজের স্বার্থে দিয়েছিলেন বলে সঙ্ঘ নেতৃত্বের একটি অংশ আজও মনে করেন। সঙ্ঘ নেতৃত্বের এই প্রসঙ্গে অনুমান এই ছিল যে, দক্ষিণপন্থী অবস্থানের প্রশ্নে কংগ্রেস দলের ভিতরে নেহরু লবির চাপে বেশ খানিকটা কোণঠাসা ছিলেন সর্দার প্যাটেল। তাঁর এই কোণঠাসা অবস্থাটা কাটিয়ে তুলতেই তিনি কংগ্রেসের ভিতরে সঙ্ঘকে মিশিয়ে দিতে চাইছিলেন। এই ব্যক্তিস্বার্থবাহী সর্দার প্যাটেলকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েই নরেন্দ্র মোদির অতি সক্রিয়তাকে সঙ্ঘ নেতৃত্বের একটা বড়ো অংশই খুব একটা ভালো চোখে নেয়নি।
মোদির এই অতি সক্রিয়তাকে সঙ্ঘের ভিতরে এখনো যাঁরা একনাথ রানাডে প্রমুখের একান্ত অনুগামী রয়েছেন, তাঁরা নিছক গুজরাটি অস্মিতাকে উসকে দেওয়া বলেই ধরেছিলেন। তাঁদের কাছে সঙ্ঘের উপর নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সময়ে সর্দার প্যাটেলের সঙ্গে একনাথ রানাডে বিতর্কের জেরে সর্দার প্যাটেলকে সার্বিকভাবে আরএসএসের রোল মডেল হিসেবে তুলে ধরা নিয়ে বেশ কিছুটা সংশয় আছে। এই সংশয়ের নিরিখেই হয়তো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পরই সর্দার প্যাটেলকে ঘিরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যে অতিসক্রিয়তা ছিল, তাতে এখন কিছুটা ভাঁটা পড়েছে।
Monday, 23 March 2020
Should the Left Become Social Democratic?
Should the Left Become Social Democratic?
Saturday, 21 March 2020
সংকট ও বামপন্থা
=================================================================
সন্ন্যাসীসুলভ নৈতিকতা এবং রাজনীতি থেকে সরে আসাটা, মূলগতভাবে দাঁড়িয়ে আছে এই বুদ্ধিজীবীদের রাজনীতি এবং রাজনীতির নোংরা দুনিয়া - যেখানে তাদের বিশ্বাসমতো দেবদূতেরা বাস করে না - তার প্রতি তাদের অবজ্ঞার ওপর। সুতরাং, এরা যার বিরোধিতা করতে চায়, তারই প্রতিবিম্বকে নির্মাণ করে, যেমন নয়া উদারনীতির দ্বারা সূচিত 'উন্নয়নের ধর্মাচার'। মনমোহন সিং বলেন : রাজনীতি হল নোংরা, রাজনীতির ঊর্দ্ধে ওঠো, 'উন্নয়ন'কে রাজনীতি থেকে আলাদা করো। বাম বিরোধী বুদ্ধিজীবীরাও বলেন : রাজনীতি হল নোংরা, রাজনীতির ঊর্দ্ধে ওঠো, 'উন্নয়ন'-এর বিরুদ্ধে লড়াইকে রাজনীতি থেকে আলাদা করো। রাজনীতির প্রতি এই অবজ্ঞা, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি ঘৃণা, আজ ভারতবর্ষে মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা বড়ো অংশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। ...
... সন্ন্যাসীসুলভ নৈতিকতার উত্থানও একই প্রবণতার অংশ, যেটা আসলে 'রাজনীতিকে ধ্বংস' করার একটা প্রক্রিয়া ব্যতীত আর কিছুই নয়। মধ্যবিত্ত নৈতিকতা কেবল বিভিন্ন সমস্যাকে তুলে ধরে, কোনো কর্মসূচিকে নয়। তারা একটা সমস্যা থেকে আরেকটা সমস্যায় বিচরণ করে এবং তারা কোনো সুব্যবস্থিত রাজনৈতিক ঐক্যের অনুপস্থিতিকেই কামনা করে। কেউ এটাকে "উত্তর আধুনিকতাবাদী রাজনীতি" বলতে পারেন, তবে আসলে এটা রাজনীতির অস্বীকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
=================================================================
কমিউনিস্টদের সাথে বেশিরভাগ এনজিওর সবচেয়ে নিকট পার্থক্যটি, ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের সাথে যুক্ত অত্যধিক প্রগতিশীলদের ধরলেও মূলত সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কিত। ইরাক যুদ্ধের বা মার্কিন হস্তক্ষেপ সমূহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, যা অনেক প্রগতিশীল এনজিও-ই করতে পারে, তা কিন্তু কোনোভাবেই এটা বোঝায় না যে সেটা সাম্রাজ্যবাদের ধারণাকে স্বীকার করে নিতে হচ্ছে (এমনকি যখন এই জাতীয় হস্তক্ষেপ সমূহের পেছনে থাকা বস্তুগত স্বার্থকেও বোঝা যাচ্ছে) যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ এগুলিকে কোনো কাহিনিপর্বের ঘটনা হিসেবে দেখবে। কমিউনিস্টরা সাম্রাজ্যবাদকে বিভিন্ন আকস্মিক কাহিনিপর্বের সংকলন হিসাবে নয়, বরং একটা গোটা ব্যবস্থা হিসাবে দেখে যা পুঁজিবাদের চরিত্র থেকেই উদ্ভূত।
যে সংস্কার তাদের করতে হবে তা 'সাম্রাজ্যবাদ'-এর ধারণা পরিত্যাগ করে নয়, বরং তার উল্টো অর্থাৎ সেই ধারণার প্রতি আরও দৃঢ়ভাবে অনুগত থেকে। শ্রমিক, কৃষক, কৃষি শ্রমিক ইত্যাদি বুনিয়াদি শ্রেণিগুলি যাদের স্বার্থ বামপন্থীরা রক্ষা করতে চায় তারা যাতে দুর্দশার সম্মুখীন না হয়ে (সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এবং অভ্যন্তরীণ কর্পোরেট স্বার্থের কারণে) ত্রাণ পেতে পারে সেই বিষয়ে তাদের আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে। এবং তার জন্য তাদের অবশ্যই পার্টির অভ্যন্তরে বিতর্ক, আলোচনা এবং ভিন্নমতের জন্য পরিসর সুনিশ্চিত করতে হবে, যাতে এটি বৌদ্ধিক কার্যকলাপের সফল কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে, একটি একশিলীভূত সত্তার পরিবর্তে যেখানে কোনো বামশাসিত রাজ্যে আঞ্চলিক বড়োকর্তা বা আমলার আদেশে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সেই সিদ্ধান্তকে সারা দেশ জুড়ে এর সদস্যেরা সমর্থন করে এই কাজকে বিপ্লবী দায়িত্ব মনে করে।
প্রশ্ন আসতে পারে যে সমাজগণতন্ত্রী বলতে যা বোঝায় এটা কী তাই-ই নয়? উত্তর হল 'না'। কার্ল লিবনেখট-দের সঙ্গে রোজা লুক্সেমবার্গ সমাজগণতন্ত্রকে পরিত্যাগ করেছিলেন এবং একটা সমাজগণতন্ত্রী সরকারের সৈন্যদের হাতেই মারা যান; এবং তিনি একশিলীভূত সংগঠনে বিশ্বাসও করতেন না। লেনিন এতেও বিশ্বাস করতেন না। যখন তাঁর নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী সরকার অবরুদ্ধ পরিস্থিতিই ব্রেস্ত লিতভস্ক-এর চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, বুখারিন এবং অন্যান্যদের আপত্তি সত্ত্বেও, তখন তারা কমিউনিস্ট নামে একটা তাত্ত্বিক পত্রিকা প্রকাশ করে এই চুক্তিকে আক্রমণ করার জন্য, যেটা এমনকি ঐ সময়েও বলশেভিক সরকার বা পার্টি নিষিদ্ধ করেনি। পার্টির মধ্যে ভিন্ন মতের জন্য বৃহত্তর পরিসর থাকার সঙ্গে 'সমাজগণতন্ত্র' সমার্থক নয়। কমিউনিস্টদের প্রতি সমাজগণতন্ত্রীতে রূপান্তরিত হওয়ার উপদেশটি তাই, খুব সৎ অর্থে ধরলেও, ভারতীয় এলিটদের সাম্রাজ্যবাদের সাথে 'আপস' করা এবং শ্রমজীবী জনতার থেকে দূরত্ব বজায় রাখার মানসিকতারই প্রতিফলন মাত্র।
=================================================================
একটা আন্তর্জাতিকতাবাদী আন্দোলনরূপে কমিউনিজম এমন এক সময়ে বিকাশলাভ করেছিল যখন পুঁজিবাদী দেশগুলি উগ্র জাতীয়তাবাদকে মাহাত্ম্যদানকারী এক বিশ্বযুদ্ধে লিপ্ত। যুদ্ধরত দেশগুলোর শ্রমিকদের যাতে লগ্নিপুঁজির স্বার্থে যুদ্ধক্ষেত্রের ট্রেঞ্চে অপরকে খতম না করতে হয়, তাই লেনিনের তোলা 'সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত করা'র স্লোগান বা শান্তির পক্ষে ইউরোপীয় শ্রমিকদের আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য রোজা লুক্সেমবার্গ-এর স্লোগান পুঁজিবাদীদের দ্বারা পুষ্ট উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকতাবাদের পতাকা উড়িয়েছিল।
যে লগ্নিপুঁজির বিরুদ্ধে তারা শ্রমিকদের সংগঠিত করছিল তা ছিল জাতীয় লগ্নিপুঁজি, ব্রিটিশ, জার্মান অথবা ফরাসি। রুডলফ হিলফারডিং তাঁর বিখ্যাত কাজ 'ডাস ফিনাঞ্জ ক্যাপিটাল'-এ যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন বা এরিখ মারিয়া রিমার্ক তাঁর ধ্রুপদী রচনা 'অল কোয়াইট অন দ্য ওয়স্টার্ন ফ্রন্ট'-এ যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তা অনুযায়ী এই লগ্নিপুঁজির মতাদর্শ হল 'জাতীয়তার ধারণা'-কে গৌরবান্বিত করা। সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিকতাবাদ পুঁজিবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল; এবং দেশগুলিতে জাতীয় পুঁজির আধিপত্যের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে সংগঠিত করার কাজটি কমিউনিস্টদের জন্য কোনো তাত্ত্বিক সমস্যার সৃষ্টি করেনি।
সমসাময়িক বিশ্বায়নের অনিবার্য ফলস্বরূপ যা ঘটল তা হল লগ্নিপুঁজির বিশ্বায়ন যেটি আবার অন্ধ দেশপ্রেমকে নয়, বরং একটি নিজস্ব ব্রান্ডের আন্তর্জাতিকতাবাদকে মদত জোগাল। এবং সংকটের প্রেক্ষিতে বিকল্প কর্মসূচির জন্য কোনো একটি দেশের জনসাধারণকে সংগঠিত করা মানে আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা, যার অর্থ জাতীয়তাবাদেই পিছিয়ে আসা এবং সমসাময়িক লগ্নি পুঁজি কথিত আন্তর্জাতিকতাবাদের কবল থেকে একটি বিশেষ জাতি রাষ্ট্র, যেটিকে বামপন্থীরা দখল করার আশা করছে, সেটির তত্ত্বাবধানে জাতিটির বিচ্ছিন্নকরণ। এটাই বামপন্থীদের উভয় সংকটের মধ্যে ফেলছে।
=================================================================
প্রথম বাধা শহুরে মধ্যবিত্তের ভূমিকা। ভারতে কৃষকশ্রেণির সমর্থন হারাবার আশঙ্কায় শঙ্কিত পুঁজিবাদ শহুরে মধ্যবিত্তের সমর্থন নিজের দিকে টানতে সমর্থ হয়েছে। এই শহুরে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় বিশ্বায়ন ও তার নয়া উদারপন্থী নীতিতে উপকৃত। এখানকার অবস্থা লাতিন আমেরিকার মত নয় যেখানে মুক্ত অর্থনীতি বস্তুত গভীর আর্থিক সংকট তৈরি করে যারা ভুক্তভোগী কেবল শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেত মজুর নয় শহুরে মধ্যবিত্তশ্রেণিও। ভারতে নয়া-উদারপন্থার আমলে তেমন কোনো গভীর সংকট সৃষ্টি হয়নি যা শহুরে মধ্যবিত্তকে এই ব্যবস্থা সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ করতে পারে।
নয়া উদারপন্থার এই সদ্যপ্রাপ্ত সমর্থন ভিতটি ব্যাঙ্গার্থে বামপন্থী হস্তক্ষেপেরই ফল (যদিও এর অর্থ এই নয় যে বামপন্থীদের হস্তক্ষেপ ঠিক ছিল না)। মুক্ত অর্থনীতি এবং দেশি বিনিময়মূল্যে স্বাধীনভাবে বিদেশি অর্থ সম্পদে পরিণত করার প্রয়াসের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের সফল প্রতিরোধে অর্থনীতি উপকৃত হয়েছে। একমাত্র চিন ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য প্রতিটি বৃহৎ অঞ্চল যে আর্থিক সংকটে ভুক্তভোগী এর ফলে তা এড়ানো গেছে। এর দরুন এখনও পর্যন্ত উৎপাদক অর্থনীতির ঊর্দ্ধমুখী বৃদ্ধির হার বজায় রাখার সম্ভব হয়েছে। এতে শ্রমিকশ্রেণি, কৃষক, ক্ষেত মজুর, ক্ষুদ্র উৎপাদকরা লাভবান হয়নি কিন্তু বৃহৎ বুর্জোয়াশ্রেণি ছাড়া উপকৃত হয়েছে ভারতের শহর ও গ্রামের 'বিত্তবান শ্রেণি', ভূস্বামী, পর্যাপ্ত পুঁজির মালিক, শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ফলে নয়া-উদারপন্থী জামানায় এদের আগ্রহ বেড়েছে এবং এরাই বৃহৎ বুর্জোয়াদের প্রধান নয়া ভরসা এবং সাম্রাজ্যবাদের স্থানীয় সমর্থনের উৎস।
এটাই লাতিন আমেরিকার সঙ্গে ভারতের প্রধান পার্থক্য যা থেকে বুঝে নেওয়া যায় কেন লাতিন আমেরিকান বামপন্থা আজ ঊর্ধ্বমুখী অথচ ভারতীয় বামপন্থা সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। নয়া-উদারপন্থার লাভবান শহুরে মধ্যবিত্তের সমর্থন হারানো ভারতীয় বামেরা এবং এখনও অবধি কৃষকশ্রেণির সমর্থন জোগাড়ে অসমর্থ নতুন পরিস্থিতিতে যা দ্রুত প্রত্যাশিত।
শহুরে মধ্যবিত্তের গুরুত্ব কেবলমাত্র তার সংখ্যায় নয়। আসলে এটা সেই শ্রেণি যা থেকে শিক্ষিত, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি, বিদ্বজ্জন, জনমত তৈরি করা মানুষজনদের সংগ্রহ করা হয়। এই শ্রেণি যেমন সর্বহারার মাঝে বিপ্লবী তত্ত্বের বার্তাবহ উপাদান তৈরি করে তেমনই ওই সর্বহারাদের মাঝে পুঁজির দাসত্ব তত্ত্বের বাহক উপাদান তৈরির ভূমিকাও নিতে পারে। যে-কোনো সন্ধিলগ্নে শহুরে মধ্যবিত্তর এ দুই সত্তার কোনটি প্রকট হবে অন্যান্য বহু কারণের মধ্যে তা নির্ভর করে তার নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার উপর। সুতরাং ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে বামপন্থার এক অংশে প্রভাব খাটিয়ে তাকে ঐতিহাসিক লক্ষ্যচ্যুত করে পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলনের তাত্ত্বিক ক্ষতি করতে সক্ষম শহুরে মধ্যবিত্ত।
=================================================================
কেউ কেউ যুক্তি দর্শাবেন সংসদীয় রাজনীতির এটাই অবশ্যম্ভাবী ফল। সেটা কিন্তু একেবারেই অযৌক্তিক। লেনিন বরাবর এ বিষয়ে জোর দিয়েছেন যে বিপ্লবী রাজনীতি তখনই উৎকর্ষ পায় যখন বিপ্লবী শক্তিগুলি পূর্ণ স্বাধীনভাবে ক্রিয়াশীল। যে কারণে সমাজের 'বুনিয়াদি শ্রেণিদের' হয়ে সওয়াল করা দলগুলিকে সক্রিয় ভূমিকা নেবার যে স্বাধীনতা সংসদীয় গণতন্ত্র দেয় তা সংকুচিত করতে বুর্জোয়াগোষ্ঠী সদা তৎপর। সুতরাং সংসদীয় গণতন্ত্র বর্জনের পরিবর্তে বামেদের ভূমিকা হওয়া উচিত একদিকে এই সংগঠনগুলিতে অংশ নেওয়া এবং অন্যদিকে সেগুলির গণতান্ত্রিক উপাদান বর্ধিত করতে লড়াই জারি রাখা। এটি এতটাই মার্কসবাদী চেতনার সঙ্গে জড়িত যে রোজা লুক্সেমবার্গের মতো বিপ্লবীও বস্তুত চেয়েছিলেন তাঁর দোল জার্মানির সংসদীয় নির্বাচনে অংশ নিক।
Tuesday, 14 January 2020
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও দেশদ্রোহী আরএসএস
এই কথাগুলো আর কারো নয়, স্বয়ং 'গুরুজি'র লেখা!
বাইরের জগৎ তো দূরের কথা, নিজের স্বয়ংসেবকদেরকেই ঘৃণা-হতাশার পথে ঠেলে দিয়েও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ না করবার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন 'গুরুজি' গোলওয়ালকার। কিন্তু কেন?
তাঁর নিজের জবানীতেই দেখা যাক। 'গুরুজি' বলছেন, "যেই ব্যক্তিরা শহীদ হয়েছেন, তাঁরা যে বীর সন্দেহ নেই। তাঁদের আদর্শকে আমরা যথার্থভাবে পুরুষালি আদর্শ হিসেবেও মেনে নিতে পারি। সাধারণ মানুষ, যারা নেহাতই ভয়ে ভয়ে ভবিতব্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে, তাদের থেকে অনেক উপরে এনারা। কিন্তু তা সত্ত্বেও এমন মানুষদের আমরা সামাজিক আদর্শ হিসেবে মনে করতে পারি না। আমরা এ কথা বলতে পারি না যে তাঁদের শাহাদতই মানুষের জীবনের আদর্শ হওয়া উচিত। নিজেদের আদর্শ তাঁরা পরিপূর্ণ করে যেতে সক্ষম যখন হননি, অতএব আমাদের এটা মানতেই হবে যে তাঁদের মধ্যে কোনোপ্রকারের ত্রুটি নিশ্চয়ই ছিল।"
অর্থাৎ, স্বাধীনতা সংগ্রামে মৃত্যুবরণ করা অসংখ্য ভারতবাসীর মৃত্যু বেদনাদায়ক হলেও তাঁরা কেউই সামাজিক আদর্শ হিসেবে গণ্য হতে পারেন না! তাঁদের আদর্শ কোনভাবেই সঙ্ঘের আদর্শ হতে পারে না! তাঁরা হলেনই বা শহীদ, হলেনই বা বীর। তাঁদের পথের হাঁটার কোনো প্রশ্নই ওঠে না!
পূর্ণ স্বরাজের দাবীতে সারা দেশ তখন "করো অথবা মরো" ধ্বনিতে মাতোয়ারা। সেই সময় 'গুরুজি'র মুখে এরকম কথা? শহীদের আদর্শ কখনো সঙ্ঘের আদর্শ হতে পারে না? কেন?
আসলে ইংরেজ প্রভুদের প্রিয়পাত্র হতে চেয়ে হিন্দু-বনাম-মুসলমান সংঘাতের যে চিত্র সাভারকার এঁকেছিলেন, অসহযোগ-উত্তর দেশে যে সংঘাতকে হেড়গেওয়ার বেছে নিয়েছিলেন, সেই সংঘাতেরই পূর্ণ চরিত্রায়ণ করেছিলেন তাঁদের সুযোগ্য উত্তরসূরি মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার। 'বাঞ্চ অফ থটস' বলে তাঁর লেখা বইটাতে এই চরিত্রায়ণ প্রসঙ্গে কোনো রাখঢাক না করে প্রকাশ্যেই তিনি বলেছেন যে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অঞ্চল-ভিত্তিক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেন না। কেউ ভারতবর্ষের বাসিন্দা বলেই যে সে সত্যিকারের ভারতীয় হিসেবে গণ্য হবে, এ কথা তিনি মানেন না। সত্যিকারের জাতীয় সত্ত্বা কেবলমাত্র সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বন্ধনে আবদ্ধ হলেই গড়ে তোলা সম্ভব। অতএব ভারতবর্ষের সকল বাসিন্দাদের মধ্যেও সত্যিকারের ভারতীয় কেবল হিন্দুরাই, কারণ তাঁদের পূর্বপুরুষেরাই এই দেশের সংস্কৃতিকে গড়ে তুলেছিলেন।
এই বিচিত্র তত্ত্ব গড়ে তুলতে গিয়ে কখনো তিনি বলছেন আর্য-সন্তান হিন্দুরা ভারতবর্ষের আদিবাসী, কখনো বা হিটলারের জার্মানির তারিফ করছেন, কখনো আবার ইহুদিদের ইজরায়েল রাষ্ট্র গড়ার দাবিকে সমর্থন করছেন। কখনো আবার তিনি এটাও বলছেন যে "ভারতবর্ষের অহিন্দু মানুষজনকে হয় হিন্দুদের সংস্কৃতি ও ভাষা শিখতে হবে। তাঁদের হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে জানতে হবে ও হিন্দু ধর্মকে সন্মান করতে হবে ... মোট কথা, তাঁদের ভিনদেশি সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে ভারতীয় হয়ে উঠতে হবে। অথবা তাঁদের এ দেশে থাকতে হবে হিন্দু জাতির অধীনে। কোনো চাহিদা বা কোনো অধিকার ছাড়া। এমনকি নাগরিক অধিকারও দেওয়া হবে না তাঁদের।"
এ তো দর্শন নয়, এ তো সর্বনাশা ঘৃণার প্রলাপ!
আজকের দিনে 'ঘর ওয়াপসি'র নামে আমজনতাকে উত্যক্ত করে যারা, তাদের মুখের ভাষা এখান থেকেই এসেছে।
যে সময়ে ভারতবর্ষে ভিনদেশি ইংরেজ সরকার আমজনতার আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে শাসন ও শোষণ করছে, সে সময়েই বসে গোলওয়ালকার কেমন করে যেন ভিনদেশি শত্রু খুঁজে পেলেন ইংরেজদের মধ্যে নয়, ভারতীয় মুসলমান, খ্রিস্টান ও কমিউনিস্টদের মধ্যে! যে সময়ে সাধারণ মানুষের ঐক্যই স্বাধীনতার একমাত্র পথ, সে সময়ে সেই একতার স্বপ্নের মধ্যেই গোলওয়ালকার ভারত-বিরোধী 'ষড়যন্ত্র' খুঁজে পেলেন! বললেন, "ইংরেজ বিরোধিতাকে ভাবা হল দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ। এই প্রতিক্রিয়াশীল দর্শনের ভয়াবহ প্রভাব সমগ্র স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর, নেতাদের উপর, এবং আপামর দেশবাসীর উপর পড়েছিল।"
শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এটাই সত্যি।
শোনা যায় দেশের কিছু কিছু অংশে সঙ্ঘের কর্মীরা নিজেদের অন্তরাত্মার ডাককে ফেলতে না পেরে আন্দোলনের পথে নেমেছিলেন। 'গুরুজি'কে অগ্রাহ্য করে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের নিজস্ব রিপোর্টেই পরিষ্কার, ১৯৪০-এর সেই উত্তাল দশকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনো কর্মসূচীতেই অংশগ্রহণ করেনি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে ইংরেজ সরকার অতএব নিষিদ্ধ ঘোষণা করার কোনো কারণই দেখেনি। দেশের সমস্ত নেতা যখন কোনো না কোনো জেলে বন্দি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের নেতারা তখনও বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও তার পরিবারের অনুগামীরা আজকে অনেকেই ভগৎ সিংকে আপন করে নিতে উৎসুক। হয়তো তাঁরা আর মনে রাখতে চান না যে ভগৎ সিং যখন কারাবন্দি, সেই সময়ে তাঁর সহকর্মী - পরবর্তীকালে প্রখ্যাত হিন্দি লেখক - যশপাল, বিনায়কের দাদা গণেশ সাভারকারের সাথে দেখা করে তাঁদের বিপ্লবী কাজকর্ম ও ভগৎ সিং -সুখদেব-রাজগুরুদের পক্ষে আইনি লড়াইয়ের জন্য আর্থিক সহযোগিতা চান। গণেশ সাভারকার তাঁদের ৫০,০০০ টাকা দিতে রাজি ছিলেন - শুধু যদি তাঁরা মহম্মদ আলি জিন্নাহকে খুন করতে রাজি হন! চন্দ্রশেখর আজাদ সেই চাহিদা শুনে বলেছিলেন, " এই লোকটা (গণেশ সাভারকার) আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামী নয়, সুপারি নেওয়া খুনি মনে করে। ও ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়েছে। আমাদের লড়াই ইংরেজদের বিরুদ্ধে। আমরা মুসলমানদের মারবো কেন? ওকে বলে দিও ওর টাকার প্রয়োজন নেই আমাদের।"