Monday, 16 November 2020

বিবাহ প্রসঙ্গে - সুকুমারী ভট্টাচার্য

'দেখ, বিয়ের পর আশীর্বাদ করবার সময়ে বলি, 'সাবিত্রীসমানা ভব' অর্থাৎ স্বামীকে যমের হাত থেকে ছিনিয়ে এনো। বেমালুম ভুলে যাই, যে ঐ সাবিত্রীই কিন্তু বিয়ের আগে প্রকাশ্যে রাজসভায় নারদের সামনে বাবার সঙ্গে প্রবল তর্ক করেছিল, তার পছন্দের মানুষকে সে বিয়ে করবেই। একবছর পর বিধবা হবে জেনেও তর্ক করেছিল। এবং জিতেছিল। আশীর্বাদ করবার সময়ে সেই সাবিত্রীই সমান হতে বলি কি? নিজের পছন্দের মানুষকে পেয়ে তার প্রাণ ভরে গিয়েছিল, সেই জোরেই না সে যমের সঙ্গে অতক্ষণ লড়াই করেছিল। এবং জিতেছিল। এরা দুই সাবিত্রী নয়রে, একটিই মেয়ে, আশীর্বাদ করতে হলে এই মেয়ের দুটো দিক ভেবেই আশীর্বাদ করতে হবে।'

========================================================================

... আমরা শাস্ত্রের দোহাই পাড়ি তখনই, যখন সে শাস্ত্র আমাদের অভীষ্টের অনুকূল। প্রতিকূল হলে বেমালুম চেপে যাই সে শাস্ত্র।

========================================================================

প্রাচীন শাস্ত্রে বৈধ বিবাহ আটরকমের ছিল (আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১/৬ অংশে এগুলির বিবরণ আছে, অন্যান্য গৃহ্যসূত্রেও আছে): ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রজাপত্য, গান্ধর্ব, রাক্ষস, আসুর ও পৈশাচ। 'ব্রাহ্ম' বিবাহে সবস্ত্রা সালংকারা কন্যাকে পিতা উপযুক্ত পাত্রে দান করতেন। 'দৈব' বিবাহে যজ্ঞ কর্মে রত পুরোহিতকে যজ্ঞকালেই কন্যাদান করতেন কন্যার পিতা। 'আর্য' বিবাহে একটি বলদ ও একটি গাভী কন্যার পিতা দান করতেন বরকে। 'প্রজাপত্য' বিবাহে কন্যার পিতা বর ও কন্যাকে 'উভয়ে একত্রে ধর্মাচরণ কর' এই বলে আশীর্বাদ করে কন্যা দান করতেন। 'আসুর' বিবাহে কন্যার পিতাকে অর্থদানে তুষ্ট করে বর কন্যাকে বিবাহ করতে পারত। 'রাক্ষস' বিবাহে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে থেকে রোরুদ্যমানা কন্যাকে বলপূর্বক হরণ করত বর ও তার বন্ধুরা। 'পৈশাচ' বিবাহে ঘুমন্ত অথবা মদমত্ত কন্যাপক্ষীয়দের মধ্যে থেকে ঘুমন্ত কন্যাকে ধর্ষণ করে নিয়ে যেত বর।   

লক্ষ করলে দেখি, আসুর বিবাহে কন্যাপণ চলিত ছিল। মনে হয়, অনেক আগে কন্যাপণই প্রচলিত ছিল। বিবাহের এ নামকরণগুলি পরবর্তী কালে খ্রীষ্ট্রীয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকের। ততদিনে সমাজে কন্যাপণ উঠে গেছে, বরপণ চলিত হয়েছে। 'আর্য' বিবাহে কন্যার পিতা নিঃসম্বল জামাতাকে তখনকার কালে সংসার পাততে যা অত্যাবশ্যক সেই গাভী-বলদ দিতেন বরকে; পণ হিসাবে ততটা নয়, যতটা সংসারযাত্রায় রওনা করিয়ে দেবার জন্য। 'আসুর' বিবাহে কন্যাপণ স্পষ্টভাবেই অনুষ্ঠিত হত। অনুমান করা যেতে পারে, এটি অন্যান্য বিবাহের সঙ্গেও যুক্ত ছিল। সেই কন্যাপণেরই স্মৃতি আর্য বিবাহে, যেখানে গাভী ও বলদ কন্যার পিতা বরকে দিতেন। (কন্যাপণের কথা পাই ঋগ্বেদে ১/১০৯/২; অথর্ববেদ ১৪/১৩২/৩৩ এবং পরবর্তীকালে কাত্যায়ন গৃহ্যসূত্রে ২/৪/২ এবং আরও অন্য বহু শাস্ত্রাংশে। গোভিল গৃহ্যসূত্রে পড়ি, বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষ উভয়ই উভয়কে স্বর্ণদান করত, তবে বরপক্ষ অনেক বেশী সোনা দিত। ২/৩/৪; কাত্যায়ন গৃহ্যসূত্র ২/৪/২ - এতেও কন্যাপণের কথা আছে। এছাড়া পরবর্তী সাহিত্যে বেশ কিছু দৃষ্টান্ত আছে কন্যাপণের) রোমানদের মধ্যেও অর্থ দিয়ে কন্যা বিয়ে করার পদ্ধতি চালু ছিল। পরবর্তীকালে যখন ধীরে ধীরে নারীর সামাজিক অবনমন ঘটে, তখন কন্যাপণও ক্রমে অচলিত হয়ে যায় এবং প্রচুর অর্থের বিনিময়ে বধু লাভ করাটা অসম্মানজনক হয়ে ওঠে বরের পক্ষে। তাই সেদিনের কন্যাপণবিশিষ্ট বিবাহের সংজ্ঞা হল 'আসুর' অর্থাৎ আর্যরীতি-বহির্ভূত। এর সমর্থনে বলা যায়, পরবর্তী কালের বহু পুরানে অনুমাত্র কন্যাপণ গ্রহণ করে যে পিতা, তাঁকে ধিক্কার দিয়ে বলা হয়েছে সে 'কন্যাবিক্রয়ী'। মনে হয় 'কন্যাবিক্রয়ী' সমাজে অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে উঠেছিল। ততদিন বরপণ সমাজে চালু, কিন্তু কোনো শাস্ত্রেই পুত্রের বিবাহে পণ গ্রহণ করেন যে - পিতা, তাঁকে পুত্রবিক্রয়ী বলা হয়নি। যদিও ছেলের বিয়েতে পণ নেওয়া মানেই বাপ ছেলেকে বিক্ৰী করছে, কারণ 'পণ' কথাটির একটাই মানে - দাম। তাই পণ নিয়ে ছেলের বিয়ে দেওয়ার অর্থই হল মেয়ের বাপের কাছে ছেলেটিকে বেচে দিচ্ছে তার বাবা। কিন্তু ততদিনে পুরুষতন্ত্র এত প্রবলভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত যে, এ অর্থ এবং এর অন্তর্নিহিত অপমান কোনো ছেলের বাপ ভেবেই দেখেনা, কারণ পুরুষমাত্রই ততদিনে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত; নারী ঊনমানব।   

========================================================================

পণ ছাড়াও নানারকমভাবে টাকা ও ধনরত্ন জড়িত ছিল বিয়ের সঙ্গে। মেয়েটিকে তার বাপের বাড়ির আত্মীয়বন্ধুরা ভালবেসে যা উপহার দিত তা 'স্ত্রীধন'। বরবধূ একসঙ্গে বসে (তাদের তখনকার সংজ্ঞা হল 'যুতক') দুবাড়ির কাছে যা পেত তা হল 'যৌতক' বা 'যৌতুক'। মেয়ের বাবা যে দামে জামাই কেনে তা হল 'পণ'। শ্বশুরবাড়িতে ভালবেসে লোকে বরবধূকে যা দেয় তা হল 'সৌদায়িক'। এর মধ্যে শাস্ত্রমতে স্ত্রীধন হল বধূর একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি, যার ওপরে শ্বশুরবাড়ির কোনো অধিকার ছিল না; মেয়েটি তার ইচ্ছামত স্ত্রীধন খরচ ও দান করতে পারত। 

========================================================================

খ্রীস্টপূর্ব সপ্তম খ্রীষ্টাব্দ থেকে প্রায় দেড় বছর পরে পর্যন্ত যেসব শাস্ত্র রচিত হয়েছিল, তাতে নারীকে নিজের দেহের বা সম্পত্তির ওপরে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। (বারবার বলা হয়েছে, শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী, বার্ধক্যে পুত্ররা নারী রক্ষাকর্তা, নারী স্বাধীনতার যোগ্য নয়; 'ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি'।

========================================================================

বৃহদারণ্যক উপনিষৎ, খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের কাছাকাছি রচনা বলে অনুমান করা হয়। সেখানে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য দাম্পত্য ব্যাপারে স্বামীকে পরামর্শ দিচ্ছেন: 'স্ত্রী যদি স্বামীর কামনা পূরণ করতে অস্বীকার করে তাহলে প্রথমে তাকে মধুর বাক্যে বশীভূত করবার চেষ্টা করবে। সেটা নিষ্ফল হলে তাকে 'কিনে নেবে'। (অবক্রীণীয়াৎ - অর্থাৎ আভরণ ইত্যাদি দেবার লোভ দেখাবে বা দেবে।) তাতেও যদি সে না রাজি হয় তাহলে লাঠি দিয়ে বা হাত দিয়ে মেরে স্ববশে আনবে।' (আক্ষরিক অনুবাদ। বৃহদারণ্যক উপনিষৎ ৬/৪/৭) এ হল ঋষিবাক্য, এর ভিত্তি আরও দু'শ বছর আগেকার প্রাচীন সংহিতা ও ব্রাহ্মণ সাহিত্যের বচন: ধন বা নিজ দেহের ওপরে নারীর কোনো অধিকার নেই (মৈত্রায়ণী সংহিতা ৩/৬/১; ৪/৬/৭; ৪/৭/৪; ১০/১০/১১। তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬/৫/৮/২ ও শতপথ ব্রাহ্মণ ৪/৪/২/১৩ ইত্যাদি_ এ ধরণের শাস্ত্রবাক্যের উদ্দেশ্য বধূর যৌনজীবনের সব স্বাধীনতা হরণ করা; স্বামীই তার যৌনজীবনের নিয়ন্তা হয়ে থাকবে। ... যাজ্ঞবল্ক্য থেকে আজ পর্যন্ত এই অত্যাচার অব্যাহত আছে। নারীর এই অসহায়তার একটা হেতু তার অর্থনৈতিক পরতন্ত্রতা। আর্থিকভাবে ভরণপোষণের জন্যে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির ওপরে নির্ভরশীল হওয়ার ফলে নিজের শরীরের ওপরেও নারীর কর্তৃত্ব থাকে না। যেসব বিধি বিধান যৌনতার প্রকাশ, বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলির সাফল্য নারীটির আর্থিক অবস্থারই প্রতিবিম্বন। সংবিধান, তত্ত্ব ও প্রয়োগের মধ্যে বিস্তর অসামঞ্জস্য থাকে; নারীর অধিকার খণ্ডিত হতে পারে সংবিধানবহির্ভূত পক্ষপাতিত্বে। অর্থনৈতিক পরাধীনতা থেকে সার্বিক অধীনতা তাকে মেনে নিতে হয়। আর ঐ পরাধীনতার অন্তরাল থেকে বিবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্রশক্তি, প্রাচীনকালে শাস্ত্রের মাধ্যমে, পরে আইনের দ্বারা।   

========================================================================

বিবাহ নারীর জীবনের একটা অবস্থামাত্রই নয়। পুরুষের কাছে তা-ই, কিন্তু নারীর কাছে যৌবনোত্তর জীবনের লক্ষ্যই হল বিবাহ। জীবনের পথ নয়, গন্তব্যস্থল। 

========================================================================

স্থিতি-প্রতিস্থিতি-সমন্বয়ের (thesis, antithesis, synthesis) যে নিয়মে সংসার আবর্তিত ও বিবর্তিত হচ্ছে ... 

========================================================================

রাধা ও সরস্বতী বাদে দেবীমূর্তিগুলি সবই মাতৃমূর্তি, এ-যেন মাতৃত্ব সম্বন্ধে এই আতিশয্যেরই এক প্রকাশ। দৈনন্দিন জীবনে নারীর ঊনমানব অবস্থানের প্রায়শ্চিত্ত করবার জন্যই যেমন পূজার কদিন মাটির প্রতিমাকে মাতৃসম্বোধন করে রক্তমাংসের নারীর প্রতি সারাবছরের আচরণের পাপক্ষালন ও ক্ষতিপূরণ করা হয়, এ-ও তারই এক প্রকাশ। শুধু তাই নয়, শাস্ত্রে, পরিবারে সমাজে বরাবর শুনি, নারীর জীবন মাতৃত্বে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়; কখনো কেউ বলে না পুরুষ পিতৃত্বে পূর্ণ হয়। মাতৃত্বের বহু দায় আছে, পিতৃত্ব শুধুই আনন্দের; তাই এই অসম দৃষ্টি। মাতৃত্বে নারী অবশ্যই গৌরবান্বিত হয়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পিতৃত্বকেও সন্মান করে' দুটি অবস্থারই দায়িত্ব এবং অধিকার সমানভাবে ভাগ করে নেবার একটা লক্ষ্য থাকা উচিত। কোনো দেবতাই পিতৃত্বের জন্যে মহীয়ান নয়, কিন্তু সর্বদেশে মাতৃদেবী মহীয়সী। ঐ মহিমা বর্তায় মর্তনারীতে, এবং নারীকে কেবলমাত্র মাতৃত্বে আবদ্ধ করে রাখলে তার যৌনতা সম্পর্কে আতঙ্ক থেকে অব্যাহতি পায় পুরুষ সমাজ। তাই বেদ থেকে পুরানে বারবার নারী সম্বন্ধে কামনা ও আশীর্বাদ উচ্চারিত হয়েছে সে যেন 'অশূন্যপস্থা হয়, অর্থাৎ তার কোল যেন কখনো খালি না থাকে, ক্রমান্বয়ে সন্তানজন্ম দিয়ে যেন সে তার নারীজন্ম সার্থক করে। ...

... পুরুষতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদন -- সে শস্যই হোক, শিল্পই হোক, সন্তানই হোক -- ঘটবে পুরুষের ইচ্ছায়। এর পিছনে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও প্রবর্তন প্রচ্ছন্ন থাকে। সন্তান উৎপাদনের সফলতার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য এবং সমকালীন অর্থনীতির বিধানের কাছে এই উৎপাদনব্যবস্থা সমর্পন করবার জন্য নারীর নিজদেহের ওপরে তার (রাষ্ট্রের) নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত করতে রাষ্ট্র বাধ্য হয়েছে। কাজেই নারী নিজদেহের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। নারীকে 'মহাভাগা পূজার্হা গৃহদীপ্তি' বলেছেন মনু কিন্তু তার ঠিক আগে এসব বিশেষণের হেতুটিও উল্লেখ করেছেন: 'প্রজনার্থা'; সন্তানের জন্ম দেয় বলেই সে মহনীয়া পূজনীয়া এবং গৃহের দীপ্তিস্বরূপিণী। (মনু ৯/২৬)   

========================================================================

বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে একটা অদ্ভুত জগাখিচুড়ি আছে। কিছু কিছু বৈদিক অনুষ্ঠান -- বৈদিক যুগের শেষাংশের  -- রয়ে গেছে, সঙ্গে কিছু বৈদিক মন্ত্রও। কিন্তু তার সঙ্গে এসে জুড়েছে বিস্তর লৌকিক অনুষ্ঠান, শুধু স্ত্রী-আচারে নয়, বিয়ের অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবেও এগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব পায়! যুগে যুগে বিকশিত হয়ে পরিবর্ধিত আকারে এখন যা দাঁড়িয়েছে তার মধ্যে আছে বরকে আসনে বসিয়ে সবস্ত্রা সালংকারা কন্যা দান করা হয়। হোম হয়, আবার বহু পরবর্তী যুগের সংযোজন শালগ্রাম শিলা বিষ্ণুর প্রতীক হয়ে সাক্ষী থাকে, অগ্নির মত। বৈদিক যুগের মত পাণিগ্রহণ ও সপ্তপদী গমন হয়। যোক্তবন্ধন অর্থাৎ বরকনের কাপড়ের শেষ প্রান্তে গিঁট বাঁধা হয়। মালাবদল অর্বাচীন কালের সংযোজন। পুরানো কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত আকারে রয়ে গেছে, যেমন অশ্বারোহন। এটি বৈদিক; বর একখণ্ড পাথর বধূর সামনে রাখলে সে তার ওপরে দাঁড়ায়, তখন বর বলে, ঐ পাথরের মত স্থির হয়ো (এহি অশ্মানমতিষ্ঠ অশ্বেব ত্বং স্থিরা ভব -- কৌশিকসূত্র ১০/৭৭)। তেমনই বহু প্রাচীনকালের রীতি অনুসারে ধ্রুবনক্ষত্র ও অরুন্ধতী দর্শনের স্মৃতিমাত্রই অবশিষ্ঠ আছে, সত্যিকার নক্ষত্রদুটিকে এখন বেশি কেউ চেনেও না। দেখেও না। কিন্তু মন্ত্রটি জরুরি, সেটি বর বলে: আকাশ ধ্রুব, পৃথিবী ধ্রুবা, এই জগৎ ধ্রুব, ধ্রুব এই পর্বতরা, এই স্ত্রী পতিকূলে ধ্রুবা (আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১/৭/২২)। লক্ষণীয়, ধ্রুবত্ব, স্থিরত্ব শুধু বধূটির কাছেই অপেক্ষিত। সে-ই প্রতিজ্ঞা করবে আমি পতিকূলে ধ্রুবা হব, অরুন্ধতীর দ্বারা আমি অবরুদ্ধ। অর্থাৎ প্রাচীন পতিব্রতা ঋষিপত্নী আমাকে পতিকূলে স্থির থাকবার জন্যে অবরুদ্ধ করেছেন। পাণিগ্রহণের পরে বধূর শুদ্ধির জন্যে বর কিছু মন্ত্র পড়ত -- ছটি আহুতি দিত বিনা মন্ত্রে এবং বলে যেত, 'এই নারীর চোখের পাতার চুল, মাথার চুল, চরিত্র, কথা, হাসি, দেহ ও বস্ত্রের রন্ধ্র থেকে নিঃসৃত রশ্মিকণা (আরোক), দন্ত, হস্ত, পদ, ঊরু, উপস্থ, জঙ্ঘাসন্ধিতে, যা কিছু ঘোর ও অশুচি আছে তার সর্বাঙ্গে, তা শুদ্ধ হোক, আপনিই মনে আসে, পুরুষ কি স্বতই শুচি, আর যত অশুচিতা তা শুধু নারীর দেহে মনে আচরণে? তা শোধন করার দায় বা অধিকার কোথা থেকে পায় পুরুষ? আসলে তার চাই একটা শুচি কুমারী কন্যা এবং সম্ভাব্য অশুচিতার প্রতিকার করার স্পর্ধা শাস্ত্র জুগিয়েছে পুরুষকে। পুরুষের অশুচিতার সম্ভাবনা পর্যন্ত শাস্ত্রে স্বীকৃত নয়। এই বৈষম্যের ভিত্তিতেই শাস্ত্রে নিষ্পন্ন হয় বিবাহ এবং অনুষ্ঠানের পদে পদে এই বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে। কন্যার পিতা ভাবী জামাতাকে আসন দিয়ে অভ্যর্থনা করে বলেন 'আপনাকে অর্চনা করছি' [অর্চয়িষ্যামো ভবন্তম্] এবং জামাতা অনুমতি দেয় 'হ্যাঁ, অর্চনা করুন' [ওম্ অৰ্চয়]। সম্প্রদানের মধ্যেও কন্যা ব্যক্তি থেকে বস্তু হয়ে ওঠে: যে বস্তুর তৎকালীন মালিক পিতা ভাবী জামাতার কাছে কন্যারূপ বস্তুটিকে দান করেন। সবস্ত্রা, সালংকারা এবং পণযৌতুক সহ। এর মধ্যেও প্রচ্ছন্ন থাকে বধূটির সামাজিক সত্তার অবমাননা, তাকে বস্তু রূপে হস্তান্তরিত হয়। বিয়ের প্রায় প্রতি পর্বে এই ধরনের অবমাননা অন্তর্নিহিত ছিল। একটিমাত্র মন্ত্রে কন্যার দীর্ঘ আয়ু কামনা করে বলা হয়েছে, তুমি সম্পদ্ ধারণ কোরো। বলাবাহুল্য, এ সম্পদ তার পতিকূলেরই, কোনো সম্পত্তিতে কন্যার তো স্বতন্ত্র কোনো অধিকার ছিল না। একটি অনুষ্ঠানে কন্যা মাদুরে পা রাখবে, তখন উচ্চারিত হবে 'পতি দেবতা' এবং 'পতিযান কামনীয়' অর্থাৎ কন্যা কামনা করছে যেন সে পতিলোকে যেতে পারে। যেটা লক্ষণীয়, তা হল শাস্ত্রে অন্য দুটি যান আছে 'দেবযান' ও 'পিতৃযাণ' অর্থাৎ দেবলোক থেকে মোক্ষ ও পিতৃলোক থেকে পুনর্জন্মের পথ। দেবতা ও পিতৃগণের মত উচ্চ আসন সৃষ্টি হল পতির এবং পত্নীর কামনা হল: যেন সে পতিলোকে ঠাঁই পায়। লাজহোম (আগুনে খই দিয়ে হোম) অনুষ্ঠানে পতির দীর্ঘায়ু, শতবর্ষ পরমায়ু কামনা করে বধূ, আর বলে, তার শ্বশুরবাড়ির সকলের যেন শ্রীবৃদ্ধি হয়। [দীর্ঘায়ুরস্তু মে পতিঃ শতং বর্ষাণি জীবত্বেধন্তাং জ্ঞাতয়ো মম] সপ্তপদীগমনের মন্ত্রগুলিতে উভয়ের মিলিত জীবনের শ্রীবৃদ্ধির কামনা আছে। পাণিগ্রহণের মন্ত্রে বর বধূকে বলে: 'আমার ব্রতে তুমি তোমার হৃদয় ধারণ কর, তোমার চিত্ত আমার চিত্তের অনুগামী হোক। বৃহস্পতি তোমাকে আমার জন্য নিযুক্ত করুন।' [... - মানব গৃহ্যসূত্র ১/১০/১৩] লক্ষণীয়, বধূটিরও যে চিত্ত আছে, আগামী বিবাহিত জীবন সম্বন্ধে যে তারও কিছু স্বপ্ন, কিছু কামনা থাকতে পারে সে বিষয়ে শাস্ত্র ও সমাজ সম্পূর্ণ উদাসীন। এক সময়ে বর বধূ সম্বন্ধে প্রার্থনা করে, এর যে পতিঘাতিকা তনু তাকে ধ্বংস কর, এর যে পুত্রহীনা তনু, পশুহীনা তনু তা দূর হোক।' [...]

এই অনুষ্ঠান ও মন্ত্রগুলির মধ্যে নারীর, বিশেষত বধূর সম্বন্ধে যে মনোভাব বিবৃত আছে তা হল: প্রথমত প্রকৃতির সৃষ্টি যে নারী যে স্বভাবত অশুচি, অকল্যানী, পুরুষপরতন্ত্র, হীন এবং কতকটা যেন ঊনমানব। বিয়ের অনুষ্ঠানের ও মন্ত্রের মধ্যে দিয়ে তার শুচিতা সম্পাদন করে' বর তাকে নিজের, পরিবারের ও সমাজের জীবনে গ্রহনযোগ্য করে তোলে। নইলে সে সংসার ও সমাজে অকল্যাণ আনবে; স্বামীকে হত্যা করবে, পুত্রদের হারাবে ও পশুর বিনাশের কারণ হবে। দ্বিতীয়ত, তার স্বতন্ত্র চিত্ত বলে কিছুই নেই বা থাকলেও না থাকাই বাঞ্চনীয়, তার সে স্বতন্ত্র চিত্তের অবনমন ঘটিয়ে সম্পূর্ণ স্বামীর চিত্তের অনুগামী, স্বামীর ব্রতের অনুব্রতা হওয়াই তার চূড়ান্ত কর্তব্য। তৃতীয়ত, স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির কল্যাণসাধনে সে আত্মনিয়োগ করবে। এতে দোষের কিছু থাকত না যদি তার আপন বাপের বাড়ির প্রতি কোনো কর্তব্য করবার কোনো সুযোগ বা অধিকার তাকে দেওয়া হত, অথবা তার স্বামীও তার শ্বশুরবাড়ি, অর্থাৎ বধূটির বাপের বাড়ির সম্বন্ধে কোনো কর্তব্য সাধনের কোনো দায়িত্ব বোধ করত। বিবাহ অনুষ্ঠানে বধূর গোত্রান্তর এমনই আমূল এবং সর্বাত্মক, এমনই আত্যন্তিক যে তার পূর্বসত্তার প্রায় পূর্ণ বিলোপ ঘটিয়ে তাকে -- শুধু তাকেই -- তার শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে একাত্ম হতে হত। চতুর্থত, স্বামীর জীবনে সে ধ্রুবা হবে। যেমন ধ্রুবা অরুন্ধতী, পাথরের ওপরে দাঁড়িয়ে, বধূ প্রতিজ্ঞা করবে স্বামীর জীবনে এবং শ্বশুরকুলে সে থাকবে পাথরের মত স্থির অটল। লক্ষণীয়, অনুরূপ কোনো প্রত্যাশা বরের সম্বন্ধে কোনো অনুষ্ঠানেই উচ্চারিত হয়নি। [এ পর্যন্ত বিয়ের যে মন্ত্র ও অনুষ্ঠানগুলির উদ্ধৃতি দেওয়া হল সেগুলি দশকর্মের জন্য নির্দিষ্ট বাঙালির, ধর্মজীবনে সুপ্রচলিত 'পুরোহিতদর্পন' গ্রন্থ থেকে উৎকলিত। ঈষৎ পরিবর্তিত ক্রম ও আকারে এগুলিই ভারতীয় হিন্দু বিবাহের বিভিন্ন পর্যায়ে ও অনুষ্ঠানে আচরিত হয়।] 

.... নারীর এই হীনতার বোধ যেহেতু সমাজে বহুকাল ধরে পরিব্যাপ্ত সেইজন্যেই বিবাহের অনুষ্ঠানে ও মন্ত্রে এই প্রতিফলন। অতএব দুটি অসম মানুষের মধ্যে বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়: উৎকর্ষ পুরুষের, ন্যূনতা নারীর। দাম্পত্যেও এর দীর্ঘ ছায়া পড়ে। লোকাচারেও এরই প্রতিবিম্ব। বিয়ে করতে যাবার আগে বর ও তার মায়ের মধ্যে একটি সংলাপ প্রচলিত। বরসাজে সজ্জিত, যাত্রায় উদ্যত ছেলেকে মায়ের প্রশ্ন: 'কোথায় যাচ্ছ বাবা?' বর: 'মা, তোমার দাসী আনতে যাচ্ছি।' তিনবার এই নাট্যাংশ অভিনীত হয়। শুধু যে বর, তার মা ও বাড়ির লোকেরা এটা বিশ্বাস করে তা-ই নয়, বধূ ও তার বাড়ির লোকেরাও এটা বিশ্বাস করে অর্থাৎ বধূটি যে শ্বশুরবাড়ির দাসী এবিশ্বাস বিবাহ অনুষ্ঠানের একটি দৃঢ়ভিত্তি। আগেই বলেছি, অন্নবস্ত্রের জন্যে বধূ স্বামীর ওপরে নির্ভরশীল তাই দাসী-ভৃত্যের মতই সে ভরণীয়া ভার্যা, তাকে খাওয়াতে হবে। [মধ্যযুগ পর্যন্ত ইংল্যাণ্ডে স্ত্রী স্বামীকে 'লর্ড' বলে সম্বোধন করত, এবং ভৃত্যও প্রভুকে ঐ সম্বোধনই করত। এই 'লর্ড' শব্দটির বুৎপত্তি হল, half-ward; half অর্থাৎ loaf বা রুটির জন্যে যে নির্ভরশীল। স্ত্রী এবং ভৃত্য ও ব্যাপারে একই পর্যায়ে পড়ে। সংস্কৃতেও 'ভৃত্য' শব্দ নিষ্পন্ন 'ভৃ' ধাতুর উত্তরে 'ক্যপ' প্রত্যয় দিয়ে, 'ভার্যা' হয় ভৃধাতুতে 'ন্যৎ' প্রত্যয় দিয়ে। অর্থ একই, ভরণীয়]

বধূটির কন্যা অবস্থায় এই অন্নঋণ ছিল পিতার কাছে, ঋণী ব্যক্তি বন্ধকরাখা বস্তুর মতই স্বাধীন নয়; তাকে দান করা যায় না। তাই বিয়ের আগে বাপের সঙ্গে মেয়েকে কনকাঞ্জলি নামে একটি নির্মম নাট্যাংশ অভিনয় করতে হয়। একমুঠো ধুলো বাপের হাতে দিয়ে মেয়ে বলে: 'সোনামুঠি নিয়েছিলাম, ধুলোমুঠি দিয়ে শোধ করলাম।' এ অনুষ্ঠান রূপকাশ্রিত, কারণ পিতার কাছে কন্যা ঋণমুক্ত না হলে তাকে সম্প্রদান করা যাবে না, তাই পিতৃকুলের ঋণ সে প্রতীকী ভাবে শোধ করে এমন মর্মান্তিক উচ্চারণে। এর মধ্যে নিহিত থাকে পিতৃকুল সম্বন্ধে তার সব দায়িত্বের অস্বীকৃতি। তিনদিন অশৌচ মেনে, চতুর্থীশ্রাদ্ধ করেই পাত্রান্তরিত বধূটি মৃত পিতা বা মাতার সম্বন্ধে সব কর্তব্য সমাধা করে। 

========================================================================

বিবাহ মানে এখন আমরা বুঝি ঐক্যদাম্পত্য (monogamy) এক স্বামী, এক স্ত্রী। কিন্তু বহুপতিকতা আঞ্চলিকভাবে এখনো আছে, প্রাচীন কালেও ছিল। আর বহুপত্নীকতা তো সেদিন অবধি বেশ জমাট ভাবেই ছিল, আইন করে বন্ধ করা হল। প্রাচীনকালে বিত্তবান ব্যক্তির বিজ্ঞাপন ছিল পশুসম্পদ আর পত্নীসংখ্যা। শাস্ত্রে যখন বলে, সেই ব্যক্তিই ভাগ্যবান যার পশুর সংখ্যা তার স্ত্রীর সংখ্যার চেয়ে বেশী। [সমৃদ্ধং যস্য কনীয়াংসো ভার্যা আসন ভূয়াংসঃ পশবঃ --- শতপথব্রাহ্মণ ২/৩/২/৮] তখন সহজেই বোঝা যায় স্ত্রীর সংখ্যা কত ছিল। সাম্প্রদায়িকতার ঝাঁঝে আজ বলা হয়ে থাকে মুসলমানের দুর্নীতির একটা প্রমান হল, সে চারটে বিয়ে করতে পারবে, যদিও বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখি, খুব কম মুসলমানই চারটি স্ত্রীর স্বামী। এই সাম্প্রদায়িকতা-দুষ্ট উক্তি শুনল প্রথমেই মনে হয়: আর কুলীন ব্রাহ্মণের তো চার স্ত্রীতে কুলোতই না। বাঁধানো খাতা তল্পিবাহকের হাতে দিয়ে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে ভিন্ন ভিন্ন স্ত্রীর বাড়িতে একরাত্রির অতিথি হয়ে শ্বশুরবাড়ির আতিথ্য, স্ত্রী-সম্ভোগ এবং যথাসম্ভব দক্ষিণা আদায় করে পরবর্তী স্ত্রীর ঠিকানা খুঁজে সেখানে হাজির হওয়া -- এই ছিল কুলীন ব্রাহ্মণের জীবিকা। এ সমাজের মানুষের মুসলমানের বহুপত্নীকতা নিয়ে বক্রোক্তি করবার কোনো অধিকার নেই। আইনের বলে এবং আর্থিক কারণে ঐক্যদাম্পত্যই এখন সমাজে বিবাহের একমাত্র রূপ।

গোষ্ঠী ও কৌম ভেঙে এল 'কুল' অর্থাৎ বৃহৎ যৌথ পরিবার, যেখানে একটি বিস্তৃত গৃহে বেশ কয়েক পুরুষ একত্র বাস করত, মনে হয় তখনই ঐক্যবিবাহ প্রবর্তিত হয়। তার বহু আগে বহু পুরুষ ও বহু নারী একত্র বাস করত, দাম্পত্য ছিল ক্ষণস্থায়ী সকল পুরুষেরই অধিকার ছিল কৌমের সকল নারীতে। পিতৃপরিচয় নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না; এমনকি প্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক যুগে যৌনমিলনের সঙ্গে সন্তান-জন্মের বৈজ্ঞানিক সম্পর্কটাই জানা ছিল না। এরই একটা রেশ থেকে গেছে মাতৃ-ধারায় প্রবাহিত পরিবারের গঠনতন্ত্রে, যেখানে সন্তান মাতৃপরিচয়ে অভিহিত হত, যেমন মহাভারতের যুগেও দেখি কৌন্তেয়, মাদ্রেয়, গাঙ্গেয়, রাধেয় ইত্যাদির মধ্যে। মানুষ যখন সন্তান-উৎপত্তির বৈজ্ঞানিক কারণটা জানত না তখন যেটা চোখে দেখতে পেত সেটা হল মায়ের গর্ভ থেকেই সন্তান আসে। কাজেই পিতৃপরিচয় তখন ছিল অনুমানসাপেক্ষ, মাতৃপরিচয় একেবারেই স্পষ্ট, তাই মাতার পরিচয়ে পুত্রের অভিহিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল। তার অনেক পরে, সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি দেখা দিল, মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে কৃষিবাণিজ্যজাত সম্পত্তি সঞ্চিত হতে লাগল। তখন সম্পত্তিমান পিতার পরিচয়ে পুত্রের পক্ষে অন্য একটি তাৎপর্য বহন করতে শুরু করল।

ঐতিহাসিকভাবে আদিম সমাজে নারী-পুরুষ সম্পর্ক ছিল যৌথ: একটি প্রজন্মের সব নারী ও পুরুষেরই অধিকার ছিল সেই প্রজন্মের সব নারীর ও পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে সম্পৃক্ত হবার। পরের ধাপে বাদ যায় ভাই বোনের যৌন মিলন। [সম্ভবত ঋগ্বেদের যম-যমী সংলাপের মধ্যে এই নিষেধের একটি ইঙ্গিত বিধৃত আছে -- ঋগ্বেদ ১০/১০] তার পরে, অনেক পরে এল ঐক্যদাম্পত্য; অন্য স্তরগুলির মত এই স্তরেও সম্পর্কের নির্ণায়ক ছিল অর্থনীতি। সাধারণ যৌথ গোষ্ঠী কৌমের সমবেত পশুধনে গোষ্ঠী এবং/বা কৌমের সাধারণ অধিকারের স্তরে এক প্রজন্মের নারী পুরুষের সাধারণ সম্পর্কে ছিল। পরে ভ্রাতা ভগিনীর যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ হয়। তারপরে যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি দেখা দিল সমাজে, তখন ধীরে ধীরে 'কুল' ভেঙে ঐক্যদাম্পত্য দেখা দেয়। এক স্বামী ও এক বা বহু স্ত্রীর সংসার। এর পেছনে ক্রীতদাস বা দাসদের ভূমিকাও সক্রিয়। শ্রমসাধ্য কাজের ভার নারীর বদলে এসে পড়ল দাসের ওপরে। এতে নারী উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে সরে এসে পরিবারে ক্রীতদাসীর ভূমিকা নিতে বাধ্য হল। মিল্ বলেন 'কোনো ক্রীতদাসই ততদূর পর্যন্ত এবং সম্পূর্ণভাবে ঠিক সেই ভাবে ক্রীতদাস নয় যেমনটা স্ত্রী'। অন্যত্রও এমন কথা পাই; একশো বছরেরও বেশি আগে এঙ্গেলস বলেছিলেন 'সমবেত উৎপাদন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিতাড়িত হয়ে স্ত্রী প্রথমে গৃহদাসীতে পরিণত হল। গার্হস্থ্য প্রকাশ্যে বা ছদ্মভাবে নারীকে দাসীতে পরিণত করার ওপরেই বর্তমান ক্ষুদ্র পরিবার প্রতিষ্ঠিত'।

ব্যক্তিগত সম্পত্তির আবির্ভাবের পরে সমাজে যে সব গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটতে লাগল তার মধ্যে একটা হল যে, সম্পত্তিমানের নতুন একটা শিরঃপীড়া দেখা দিল; তার সঞ্চিত সম্পত্তি সে তার বৈধ উত্তরাধিকারীর জন্যে রেখে যাবে। বৈধ মানে ঔরস পুত্র। অবস্থার বিপাকে অন্য নানারকম পুত্রও সম্পত্তিতে কমবেশী অধিকার অবশ্য পেত। [মহাভারত ১/১১১/২৮-২৯] দেখি পুত্র নানারকম হতে পারে: প্রধানত শুনি ঔরস, পিতার বীর্যে মাতার গর্ভে জাত। 'কানীন', কন্যাটির প্রাকবিবাহ জীবনের সন্তান, যেমন কর্ণ। 'সহোঢ়', যে সন্তানকে গর্ভে নিয়ে কন্যার বিবাহ হল। 'গৃঢ়োৎপন্ন' বিবাহের পরে গোপনে অন্যপুরুষের দ্বারা সঞ্জাত সন্তান। 'পুত্রিকাপুত্র' অপুত্রক পিতা এই শর্তে কন্যার বিবাহ দিতেন যে প্রথম পুত্রটিকে কন্যার পিতা আপন পুত্র বলে গ্রহণ করবেন। 'ক্রীত', অর্থ দিয়ে অন্যের যে সন্তানকে ক্রয় করা হয়েছে। 'দত্তক', অন্যের সন্তানকে তার অনুমতিক্রমে আপন সন্তানের পরিচয়ে তার স্থলাভিষিক্ত করা। 'স্বয়মুপাগত' যে বালক নিজেকে অন্যের কাছে বিক্রয় করে। 'পৌনর্ভব' হল নিয়োগের দ্বারা জাত বিধবার বা নিষ্প্রজ স্বামীর স্ত্রীর সন্তান -- এত রকমের সন্তানকে সমাজ স্বীকার করেছিল কারণ সমাজ চাক বা না চাক, এ সব সন্তান ছিল।       

========================================================================

দাম্পত্য জীবন যদি যৌথ পরিবারে কাটাতে হয় তাহলে পরিবারে দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি ও শ্বশুরবাড়ির লোকেদের মন্তব্য নিয়ে অশান্তি দাম্পত্য সুখশান্তি নষ্ট করে। যদি শ্বশুরবাড়িতে বধূটি মানবিক ব্যবহার পায়, তাহলে, দম্পতিটির পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক ভাল থাকলে, শান্তি থাকে। কিন্তু প্রতিবেশীদের প্রতিক্রিয়া বিরূপ হলে তার প্রভাবও দম্পতির জীবনে প্রতিঘাত সৃষ্টি করে। প্রতিবেশীদের মারফতে সামাজিক প্রতিক্রিয়াও এসে পৌঁছয় এবং তার প্রতিকূল হলে শান্তি নষ্ট হয়। প্রতিবেশীরা সমাজের প্রতীক, যে সমাজ অদৃশ্য থেকে অন্তরাল থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র বিত্তকৌলীন্য, পুরুষতন্ত্র, বর্ণবৈষম্যের মূল্য বোধে নির্মিত; এবং এইসব যেন কায়েম থাকে সে ব্যবস্থা নেপথ্য থেকে আইন, সাহিত্য, গণমাধ্যম সব দিয়েই প্রতিষ্ঠা করে।

========================================================================

সমস্যার মৌলিক উৎপত্তিস্থল দম্পতির একান্ত ব্যক্তিগত মানসিক সম্পর্কে। দুজনের শিক্ষাদীক্ষার মান -- প্রাতিষ্ঠানিক নয় -- যথার্থ শিক্ষার মানে যদি দুস্তর ব্যবধান থাকে তবে তা মানসিক সাহচর্যের পথে অন্তরায় হতে পারে। তেমনি অথবা হয়ত তার চেয়েও বেশি দুরতিক্রম্য হল রুচির ব্যবধান। ... কার্পণ্য ও উদারতার সংঘাত খুবই মর্মান্তিক। ... এছাড়াও আছে আদর্শগত ব্যবধান।  একজন হয়ত কোনো রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী, অন্যজন তার বিপরীত পন্থার অনুগামী, কিংবা দেশ বা সমাজে কল্যাণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। এ অবস্থার একের ঔদাসীন্য অপরকে তার সত্তার খুব গভীর স্তরেই আঘাত করে, কিংবা দুই বিরুদ্ধ রাজনৈতিক মতবাদের সংঘাত দুজনকেই করে। এ ধরনের বৈষম্য উপেক্ষণীয় নয়, বিশেষত যদি দুজনের বা একজনেরও আদর্শে বিশ্বস্ত আন্তরিক হয় তার জীবনের তাৎপর্যবোধের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী হয়ে জড়িয়ে থাকে। এগুলো বেশিরভাগই ঘটে সম্বন্ধ করা বিয়েতে। ...

বেশ বেশি সংখ্যায় বিয়ে ভাঙে আর্থিক কারণে। অভাবে। অথবা প্রত্যাশিত সচ্ছলতার অভাবে। আজকের দিনে আয় সে অনুপাতে বাড়ছে না এবং সন্তানসন্ততি এলে প্রত্যাশিত ভাবে পারিবারিক ব্যয়ভার দুর্বহ বোধ হচ্ছে, তখন দেখা দেয় পরস্পরকে দোষ দেওয়ার প্রবণতা। প্রথমে আয় বাড়াবার চেষ্টা, তা ব্যর্থ হলে ব্যয়সংকোচের প্রয়াস এবং বর্তমান পৃথিবীতে যেহেতু সমস্ত গণমাধ্যমই ব্যয়সংকোচের পথটা বাৎলে চলেছে, তাই অচিরেই দুপক্ষই যেন দেখতে পায় ব্যয়সংকোচের পথটা একটা কানাগলিতে গিয়ে ঠেকেছে। এর ওপরে আছে, প্রতিবেশী ও পরিচিত পরিবারগুলির জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে, চেতনে অথবা অবচেতনে, নিজেদের অবস্থার একটা তুলনার প্রয়াস যা প্রায়শই নিজেদের জীবনযাত্রার মান, অত্যন্ত উচ্চবিত্ত বাদে আর সকলের ক্ষেত্রেই যে ক্রমাগতই নেমে যাবে এই বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াটিকে স্বরূপে বোঝবার মত মুক্ত দৃষ্টি বেশিজনের থাকে না। ... আদর্শগত কোনো স্থৈর্য বা স্বল্পে সন্তুষ্ট হবার সহজাত, বা সাধনায় আয়ত্ত-করা ক্ষমতা যার নেই, এই পরিবেশে তার মর্মপীড়া বাড়বেই।

========================================================================

উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত সমাজে নারী সম্পদ উৎপাদন ব্যবস্থার শ্রম থেকে অব্যাহতি পেয়েছে। এখন তার ওপর বর্তেছে সম্পদের উত্তরাধিকারী ভোক্তা উৎপাদন করার দায়িত্বটি।

========================================================================

১৭৯২ সালে মেরি হ্বলস্টনক্রাফট লিখেছিলেন 'আমি বিশ্বাস করি যে, পুরুষের একচ্ছত্র অধিকারের দাপট থেকেই নারীর স্বভাবে বহু ভ্রমপ্রমাদ জন্ম নেয়। ... স্বাধীনতা পেলে তার চরিত্র অনেক বেশি পরিপূর্ণতা পাবে।' এ অবজ্ঞা নানা প্রসঙ্গে বিয়ে করে, এবং দুঃখের বিষয়, নারী নিজেও এই বোধবিশ্বাসের পরিবেশেই লালিত হয়। বারেবারে শোনা যায় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উচ্চারিত 'মেয়েমানুষ' এবং গর্ব ও দম্ভের সঙ্গে উচ্চারিত 'পুরুষ'। ... কাজেই শুধুমাত্র অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্য নারীকে এই বোধ দিতে পারছে না যে সে সংসারে পুরুষের সমকক্ষ। এর জন্যে চাই চেতনার মুক্তি। ... মহাভারতের বনপর্বে দ্রৌপদী সত্যভামাকে বলেছিলেন যে প্রত্যূষে উঠেই সারাদিন তিনি অবিশ্রাম গৃহকর্ম করে চলেন; তাঁর মধ্যরাতের বিশ্রাম পর্যন্ত দায়িত্বের যে ফিরিস্তি তিনি দেন, তার সঙ্গে মেলে তাবৎ ধর্মশাস্ত্রে গৃহিণীর দিনচর্যার নির্দেশ। এমন কথাও আছে যে নারী সর্বদাই গৃহকর্মে ব্যাপৃত থাকলে সে অন্যায়কর্ম থেকে নিরস্ত থাকে। তবে এমন ফিরিস্তি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে ও ইসমালিক শাস্ত্রেও ঠিক একই রকমের। এর মুলে সব প্রাচীন সমাজেই বিশ্বাস ছিল, যে নিরন্তন কাজের মধ্যে না থাকলে নারী দুশ্চরিত্র হয়ে যাবে, তাকে সে সুযোগ না দেওয়া তার চরিত্র-রক্ষারই একটা উপায়। কিন্তু দাম্পত্যে কাজের ভারের এই অসম বন্টন নারীকে শরীরে মনে পীড়িত করে এবং এর ফলে যে অশান্তির সৃষ্টি হয় তার কোনো প্রতিকার থেকে না। আরও ক্ষতি হয়: পুত্রকন্যারা বুঝে যায় গৃহকর্ম নারীরই এলাকা, অর্থাৎ ঐ অসাম্যের বিষয়টা সঞ্চারিত হয় পরবর্তী প্রজন্মেও।    

========================================================================

একটা বিকল্প হচ্ছে, শিশুটি যাতে বেড়ে ওঠার পথে মোটামুটি অনুকূল একটা পরিবেশ পায় তার ব্যবস্থা করে দুজনের বিচ্ছিন্ন হওয়া। এখানে অন্য একটি প্রশ্নও থাকে ঐ দুটি নরনারী প্রথম বিবাহে সুখ পায়নি, যে কোনো কারণেই হোক বিয়েটা ভেতর থেকে যখন ভেঙে গেছে তখন কৃত্ৰিম অভিনয়ে সেটাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা না করে সরাসরি প্রকাশ্যে ভেঙে দেওয়া এবং দুজনে সম্ভব হলে অন্য সঙ্গী বেছে নিয়ে দ্বিতীয়বার সুখ পাবার চেষ্টা করা। এখনো সমাজ একে ঐ দুটি মানুষের স্বার্থপরতার প্রমাণ হিসেবেই দেখে। সে দেখাটা ভুল। যখন বিধবাবিবাহ আন্দোলন হয় তখন তাঁর মূল মানবিক প্রেরণার উত্স কী ছিল? একটি নিরপরাধ নারীর জীবন যাতে পুনর্বার সুখের সন্ধান পায় তা-ই ত? সে নারীর বয়স চোদ্দ না চব্বিশ না চল্লিশ তা তো আলোচ্য ছিল না। সে সন্তানবতী না নিঃসন্তান তা-ও ত ভাবা হয়নি? তার জীবনটা যেন অকালে শুকিয়ে না যায় সে যেন দাম্পত্যসুখের সন্ধান পায় এই ছিল সে আন্দোলনের মূল প্রেরণা। অপরপক্ষে, কোনো বিপত্নীকের দ্বিতীয়বার বিবাহ করা নিয়ে সমাজ কখনোই কোনো মন্তব্য করেনি; বরং একথা বলেছে, স্ত্রীর মৃত্যুর পরদিনই তার কথা প্রশস্ত এবং বিধেয়। লোকে পোষা কুকুর বেড়ালের মৃত্যুতেও কয়েকদিন মুষড়ে থাকে, এ সমাজে স্ত্রীর স্থান গৃহপালিত জন্তুরও নীচে! কাজেই একবার নির্বাচনে ভুল হলে পুনর্বার নির্বাচন করার অধিকার থাকাই উচিত, প্রথমত এখনো অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথমবার সঙ্গীকে নির্বাচন করে দেয় পরিবার, সেখানে পাত্র পাত্রীর, বিশেষত কন্যার মত প্রায় উপেক্ষিত। ফলে অন্তত মেয়েদের জন্যে ঐ দ্বিতীয়বার সুখের সন্ধান করার পথটা খোলা রাখা বিশেষ প্রয়োজন। মেয়েদের জন্যে বিশেষ করে বলছি এই কারণে যে, পুরুষের পক্ষে সে পথ বরাবরই খোলা থেকেছে। বিধিমতে বিবাহিত স্ত্রী সীতাকে রামচন্দ্র বলেছিলেন 'তোমাকে আমার আর প্রয়োজন নেই, তুমি যাও'। এখনো বাড়িবাড়ি বহু মেয়ে বাসন মাজতে আসে কারণ 'স্বামী নেয়না'। স্বামী না নেবার অধিকারটি পেয়েছে আমাদের 'মর্যাদা পুরুষোত্তম' রামের কাছেই। কারণ বলাই আছে, রামের মত আচরণ করবে, রাবণের মত নয়। [রামাদিবৎ প্রবর্তিতব্যং ন রাবণাদিবৎ] কাজেই স্বামীরা নিরপরাধ স্ত্রীকে মিথ্যে সন্দেহে ত্যাগ করার পরোয়ানা পেয়েছে খোদ রামচন্দ্রের কাছে; এবং অন্তত এব্যাপারে অসংখ্য পুরুষ রামের মতই আচরণ করে। এই পরিত্যক্তা স্ত্রীর দ্বিতীয়বার নতুন জীবনে সুখী হবার মৌলিক অধিকার আছে। বিশেষত, পুরুষ যেখানে হামেশা এক বউ ছেড়ে আবার বিয়ে কিংবা বিয়ে না করেই সংসার পাতে।

প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে, বিয়ে ভেঙে যদি দ্বিতীয় সংসারেও সুখ না আসে তাহলে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম এইভাবেই কি চলবে? এর উত্তরে বলা যায় আইন যখন বিচ্ছেদের পরে পুনর্বার বিয়ের অধিকার দিয়েছে এবং ক'বার বিয়ে করা চলবে তার কোন সংখ্যা নির্দেশ করেনি, তখনই তো বারেবারে সুখের সন্ধান করার অধিকার কায়েম হয়েছে। মুশকিল হল, এমন বহু নজির আছে যেখানে দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুরবারে সঙ্গী নির্বাচনটি পাকাপাকি সুখের সন্ধান দিয়েছে এবং তার পরের যুগ্মজীবন তিরিশ চল্লিশ বছর অব্যাহত সুখে কেটেছে। এই নির্বাচনের মূল অধিকারটি সংখ্যাসীমা দিয়ে বাঁধতে গেলে এটা সম্ভব হত না। কেউ কেউ বলেন, আরও অনেক নজির আছে যারা বারেবারে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেও কোথাও স্থিতিলাভ করেনি। তেমন অনেক নারী বহু পরীক্ষা নিরীক্ষায় ক্লান্ত হয়ে শেষ জীবনে কখনো বিষণ্ণ, কখনো প্রসন্ন মনে একক জীবনকেই মেনে নিয়েছে। এদের সমাজের বিরুদ্ধে কোনো নালিশ নেই, কারণ নিজের জীবন নিজের মত পরিচালনা করার স্বাধীনতা এরা সমাজের কাছে পেয়েছিল। সে পরিচালনায় সুখ হয়ত আসেনি, কিন্তু ঐ স্বাধীনতাটা ছিল তার মৌলিক অধিকার। 

========================================================================

... ইদানীং বহু সংসারে দাম্পত্য কলহ বাড়ছে, সেটা হল সংসারে গৃহকর্ম একা মেয়েটিকেই সামলাতে হয়। উচ্চবিত্ত পরিবারের পক্ষে অত্যধিক পারিশ্রমিক দিয়ে লোক নিযুক্ত করে এবং গৃহকর্ম নির্বাহ করা সম্ভব। নিম্নবিত্ত পরিবারে ধরে নেওয়াই হয় যে বাইরে কাজ করলেও আর্থিক অসঙ্গতির জন্যে গৃহকর্মে বাইরের লোকের সাহায্য পাওয়া সম্ভব নয়; তাই সমস্ত চাপই বধূটির এবং একটু বড় ছেলেমেয়ের ওপরে পড়ে। ইদানীং বাড়িতে কাজের লোক পাওয়া প্রায় অসম্ভব। মধ্যবিত্ত যে টাকা দিতে পারে তাতে তো বটেই। অথচ মধ্যবিত্ত মানসিকতা ভৃত্যনির্ভর, কাজেই এখন বাইরে চাকরি করে যে বধূটি সে জানে বাড়ি ফিরে অধিকাংশ গৃহকর্ম তাকেই সমাধা করতে হবে। ... যত্রতত্র ভুল ইংরিজি বলে, বুঝে না বুঝে ইংরিজি ছবি দেখে, 'মামি ড্যাডি'র বকুনিতে বিগলিত যে অপসংস্কৃতিতে পুষ্ট আজকের মধ্যবিত্ত মানস, তার মধ্যে পাশ্চাত্য প্রভাবের সুস্থ দিকগুলি এখনো পৌঁছল না।

========================================================================

বিবাহ যদিও দুটি মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, তবুও রাষ্ট্রও এতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। বিবাহ হল পরিবার সৃষ্টির সুস্পষ্ট উদ্দেশ্যে নারী ও পুরুষের মধ্যে একটি সংবিধান-সম্মত মিলন। এই কারণেই রাষ্ট্র এই মিলনে উৎসাহী এবং এটিকে নিয়ন্ত্রণ করার কর্তব্য নিজে স্বীকার করে নেয়। .... বিবাহ অর্থাৎ রাষ্ট্রসমর্থিত নারীপুরুষের মিলন থেকে সন্তান এলে একটি পরিবারের সূচনা হয়, যা ধীরে ধীরে পল্লবিত হয়ে বৃদ্ধিলাভ করে। অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক একক সেই পরিবার; কাজেই তা যেন সমাজের নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে প্রবর্তিত হয় সে স্বার্থ সমাজ তথা রাষ্ট্রেরই। বিবাহ রাষ্ট্রের পক্ষে প্রয়োজনীয়। 

========================================================================

ফরাসী বিপ্লবের পরে যে সংবিধান রচিত হয় তার সম্বন্ধে এমন কথাও বলা হয়েছে যে সংবিধান কিছু ব্যক্তিকে অন্যদের চেয়ে বেশি অধিকার দিয়েছে, কিন্তু নারীকে কিছুই দেয়নি। .... এই ধরণের বৈষম্য পৃথিবীর সকল দেশে বহু জগ ধরে চলিত আছে অথচ রাষ্ট্র-সঙ্ঘের সমীক্ষা বলে 'পৃথিবীর জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, এরা পৃথিবীর মোট শ্রম-প্রহরের দুই তৃতীয়াংশ পরিশ্রম সে-ই করে থাকে, পৃথিবীর উপার্জনের এক দশমাংশ ভোগ করে এবং পৃথিবীর সম্পত্তির এক শতাংশেরও কমের অধিকারিণী।'

========================================================================

সিমোন দ বোভোয়া এই প্রসঙ্গে চূড়ান্ত অত্যুক্তি করেছেন এই বলে যে, 'বলা হয় বিবাহ পুরুষকে খর্ব করে। এ কথা প্রায়শই সত্য, কিন্তু প্রায় সর্বদাই বিবাহ নারীকে ধ্বংস করে।'

========================================================================

... বহু বিকৃতিতে, স্বার্থসংকীর্ণ, অহমিকানিষ্ঠ সংঘাতে যুগে যুগে দাম্পত্য থেকে প্রেম অন্তর্নিহিত হয়েছে। পড়ে থেকেছে শুধু বন্ধনটি। যে হতে পারতো সহচর বা সহচরী সে হয়ে ওঠে কারা-প্রহরী।

========================================================================

... সমস্ত দাম্পত্যে নিষ্ঠা একনিষ্ঠতা ও দৃঢ়তার দায়টা দেওয়া হত বধূটির ওপরে, তার পাতিব্রত্য ছিল অপরিহার্য। তাকে সতী বধূ হতে হবে অথচ ঐ সতীর কোনো পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দই নেই।

========================================================================

শরীর ও মন সমান প্রাধান্য পেলে তবেই দাম্পত্য সত্যিকার একটি দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, এবং এ ভিত্তির কোনো বিকল্প নেই।

========================================================================

অতিভোগ যে দাম্পত্যকে বিপথে নিয়ে যায়, সুখের বদলে দেয় সম্ভোগ, এ আজ ঘরে ঘরেই দেখা যাচ্ছে। প্রায়ই শোনা যায় জীবন যখন একটাই, তখন যতটা ভোগ করে নেওয়া যায় তার চেষ্টা করতে দোষ কী? দোষ প্রথমত, ঐ নগ্ন অতিলুব্ধতা মানুষের কুৎসিত একটি রিপু, যা অশুভ ও অশুচি। দ্বিতীয়ত, এই লোভের ভোগের আতিশয্যে মানুষ সেই সব কিছুকে হারাতে বসেছে যা জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলে। প্রেম, আদর্শ, মানবিক মূল্যবোধ, সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য তৎপরতা, নতুন সুন্দর এক পৃথিবী রচনার স্বপ্ন। কুবেরের সাধনা শ্রীকে পরাহত করছে, অতিভোগের লালসা দাম্পত্যকে কলুষিত করছে। 

========================================================================




  

Tuesday, 11 August 2020

প্রেম, বিবাহ ও অন্যান্য - প্রবীর ঘোষ

নারীরা যতই নারী স্বাধীনতা ও পুরুষের সমান অধিকার দাবি করুন না কেন, বেকার ছেলে বিয়ে করতে তো কখনওই বিজ্ঞাপন দেন না! তবে বেকার মেয়েরা কি করে প্রত্যাশা করেন রাজপুত্তুররা তাঁদের বিয়ে করবেন? আসলে মেয়েদের চেতনার অণুতে সংস্কারের মজ্জায়-মজ্জায় ঢুকে গেছে স্বামীকে আভিজাত্যের নিদর্শন একটি বস্তু হিসেবে পরিমাপ করা, স্বামীকে নিজের চেয়ে অনেক বড় মাপের হিসেবে চাওয়া, নিজের ওপর স্বামীর স্বত্বাধিকার মেনে নেওয়া।

***********************************************************

স্ত্রীর উপর স্বামীর এমন স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণ অনেক ক্ষেত্রেই স্বামীর উপর স্ত্রীর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা। অনেক সময় সামাজিক পরিবেশগত কারণে অনেক নারী ধরেই নেন, স্বামী-পুত্র-কন্যার সেবায় জীবন উৎসর্গ করার মধ্যেই নারী জীবনের সার্থকতা। এরা অবশ্যই মধ্যবিত্ত মানসিকতার মানুষ। আপনি যখন মা হিসেবে ছেলের জামা-প্যান্ট ধোয়া, ইস্ত্রি করা, স্কুলের টিফিন তৈরি করে গুছিয়ে দেওয়া, জুতোর পালিশ ঠিক রাখা ইত্যাদি কাজগুলো করেন স্নেহময়ী জননীর মহান কর্তব্য হিসেবে, তখন একবারের জন্যেও কি ভেবেছেন আপনার এমনতর কাজ-কর্মের ফলে যৌবনে পৌঁছে আপনার ছেলে প্রত্যাশা করবে তার স্ত্রীও এমনি করে গৃহকর্ম ও শিশুপালনের কাজগুলো একা হাতেই সামলাক? সে তখন নিশ্চয়ই স্ত্রীকে গৃহকর্ম, শিশুপালন ইত্যাদি বিষয়ে পরিপূর্ণ সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসবে না। আপনার মেয়ে যৌবনে পৌঁছে আপনার প্রভাবে এটাই ধরে নেবে এসব কাজ করার একক দায়িত্ব একজন আদর্শ স্ত্রী ও মা হিসেবে তারই। এখনও আমাদের সমাজে সাধারণভাবে প্রচলিত স্ত্রী চাকুরিরতা হলেও তার উপরই বর্তায় গৃহকর্ম ও শিশুপালনের ঝক্কি। এমন এক অবস্থা সৃষ্টির জন্য দায়ভাগ পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় যেমন পুরুষের ওপর বর্তায়, তেমনই কিছুটা দায়ভাগ অবশ্যই নারীদের, যাঁরা এই ধারাকে স্থায়ী রাখার মানসিকতা সন্তানদের মধ্যে তৈরি করে চলেছেন।

***********************************************************

যৌন-মুক্তির বা যৌন স্বাধীনতার দাবি যদিও ধনতান্ত্রিক সভ্যতারই দাবি, তবু এই দাবি প্রতিষ্ঠার মধ্যেই রয়েছে ধনতন্ত্রের ধ্বংসের বীজ। কারণ, যৌন স্বাধীনতার একান্ত অনিবার্য শর্ত - সাম্য, নারী-পুরুষে সাম্য, মানুষে মানুষে সাম্য, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা। আর এই সাম্য ধনতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর ধ্বংস ছাড়া সম্ভব নয়। মুক্ত যৌন-প্রণয়ের আবশ্যিক শর্ত হওয়া উচিত অবদমনহীন, শোষণহীন, বন্ধুত্ব ও বিশ্বাস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মানবীয় সম্পর্ক।

***********************************************************

একগামী মানে অবশ্য আজীবন একজনের সঙ্গেই যৌননিষ্ঠ থাকবে - এমনটি অবশ্যই নয়। যে মানুষের জীবন বেশি গতিময়, জীবনে উত্থান-পতন বেশি, তাদের বন্ধুরাও পরিবর্তিত হতে থাকে। প্রেমিকা বা প্রেমিক একজন 'বিশেষ বন্ধু'। এই 'বিশেষ বন্ধুত্ব'ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাল্টাতে পারে। জীবনে যেমন পুরনো বন্ধুদের কেউ কেউ বিদায় নেয়, কেউ কেউ আসে -- তেমন কোনও 'বিশেষ বন্ধু' জীবনে এলে স্বাগত জানানোই উচিত।

***********************************************************

প্রেম বা দাম্পত্য জীবনের আদর্শ সম্পর্ক গড়ে ওঠার প্রাথমিক ও আবশ্যিক শর্ত যৌনতা নয়। নাহলে গণিকা ও লম্পটরাই হত সেরা প্রেমিকা ও প্রেমিকের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। .... প্রেম বা দাম্পত্য জীবনের প্রাথমিক ও আবশ্যিক শর্তই হলো বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা এবং মতাদর্শগত মিল।

***********************************************************

রাজনীতি সচেতন, আদর্শ সচেতন, মূল্যবোধ সচেতন, আত্মমর্যাদা সচেতন, স্বাধীন মানসিকতাসম্পন্ন দম্পতিদের বিচ্ছেদ তুলনামূলকভাবে অসচেতন ও স্বল্পসচেতন দম্পতিদের চেয়ে অনেক বেশি ঘটে। দু'জনেই যখন আদর্শ-সচেতন, মূল্যবোধ-সচেতন, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন, রাজনীতি ও সমাজনীতি সম্পর্কে সচেতন তখন আদর্শগত দ্বন্দ্ব দেখা দিতেই পারে - সেটা একপক্ষের আদর্শচ্যুতির জন্যে যেমন হতে পারে, তেমনই আদর্শগত মতপার্থক্য থেকেও হতে পারে। এই দ্বন্দ্ব নিয়ে 'প্রেমিক-প্রেমিকা' অথবা 'স্বামী-স্ত্রী'র সম্পর্ক অটুট রাখা অবাঞ্ছিত মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক কি?

***********************************************************

কোনটা সত্যি? হিন্দুদের ঈশ্বর-বিশ্বাস, নাকি মুসলিমদের আল্লা-বিশ্বাস? আমি যদি হিন্দু থেকে মুসলিম হয়ে যাই, তবে কি আমার ঈশ্বর সাকার থেকে নিরাকার হয়ে যাবেন? আমি ইসলাম ধর্ম ছেড়ে হিন্দু হলে আমার ঈশ্বর নিরাকার থেকে আবার বিশিষ্ট হতে বাধ্য হবে?

আমার ইচ্ছেতেই যদি আমার ঈশ্বরের রূপ সাকার বা নিরাকার হতে বাধ্য হন, তবে তো আমি আমার ঈশ্বরের চেয়েও বেশি শক্তিমান।

***********************************************************

কেউ কেউ মনে করেন, ঈশ্বর জগতের স্রষ্টা, যেমন কুম্ভকার মৃৎপাত্রের স্রষ্টা। ঈশ্বর সর্বব্যাপী। ঈশ্বর স্রষ্টা হলে তিনি কুম্ভকারের মত মাটি ও মৃৎপাত্র হতে পৃথক। ঈশ্বর যদি তাঁর সৃষ্টি থেকে পৃথক হন, তবে সর্বব্যাপ্ত হতে পারেন না।
ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান হন, তাঁর ইচ্ছাতেই যদি মানুষের কাজ-কর্ম নির্ধারিত হয়, তবে অসৎ কাজের জন্য মানুষ কেন দায়ী হবে?
মনুষ্য জগতের বাইরের অন্যান্য প্রাণী, যাদের ভাল-মন্দ বিচার-বোধ নেই, তাদের কাজ-কর্মের জন্য ঈশ্বর কী ভাবে তাদের দায়ী করবে?
পৃথিবীতে সুখের চেয়ে দুঃখের পরিমাণ বেশি। তবে কি ঈশ্বর যতটা দয়ালু, তারচেয়ে বেশি নিষ্ঠুর?

***********************************************************

Tuesday, 4 August 2020

পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি - ফ্রেডরিক এঙ্গেলস

আমাদের যুগে বুর্জোয়া বিবাহ প্রথা হচ্ছে দু-রকমের। ক্যাথলিক দেশসমূহে আগের মতোই মাতাপিতা তরুণ বুর্জোয়া সন্তানের জন্য উপযোগী পাত্রী জোগাড় করে দেন এবং এর ফলে স্বভাবতঃই একপতিপত্নী প্রথার আত্মবিরোধ পূর্ণভাবেই ফুটে ওঠে - স্বামীর দিক থেকে ঢালাও হেটায়ারিজম এবং স্ত্রীর দিক থেকে ঢালাও ব্যভিচার। ক্যাথলিক গির্জা থেকে বিবাহবিচ্ছেদ নিশ্চয়ই এইজন্য নিষিদ্ধ করা হয় যে, তাঁরা বুঝেছিলেন যে মৃত্যর মতোই ব্যভিচারের কোন চিকিৎসা নেই। অপরপক্ষে প্রটেস্টান্ট দেশগুলিতে সাধারণতঃ বুর্জোয়া ঘরের ছেলেকে স্বশ্রেণী থেকে কমবেশি স্বাধীনভাবে স্ত্রী নির্বাচন করতে দেওয়া হয়। ফলে বিবাহের ভিত্তিতে কিছুটা ভালোবাসা থাকতে পারে এবং শালীনতার জন্য প্রটেস্টান্টসুলভ ভণ্ডামিবশে সে ভালোবাসা আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এইক্ষেত্রে পুরুষের দিক থেকে হেটায়ারিজম অনেক কম এবং স্ত্রীলোকদের পক্ষ থেকে ব্যাভিচারও ততোটা সাধারণ নয়। কিন্তু যেহেতু প্রত্যেক ধরণের বিবাহেই স্ত্রীপুরুষ বিবাহের আগে যেমন ছিল পরে তেমনই থাকে এবং যেহেতু প্রটেস্টান্ট দেশসমূহের বুর্জোয়ারা বেশির ভাগই কূপমণ্ডুক তাই প্রটেস্টান্টদের একপতিপত্নী বিবাহের উত্তম দৃষ্টান্তগুলির গড়পড়তা ধরলেও তা পরিণত হয় এক নিরেট একঘেঁয়েমির দাম্পত্য-জীবনে, যাকেই বলা হয় দাম্পত্য সুখ। এই দুধরনের বিবাহের প্রকৃষ্ট দর্পণ হচ্ছে উপন্যাস; ফরাসী উপন্যাসে ক্যাথলিক ধরনের বিবাহের সাক্ষাৎ মেলে এবং জার্মান উপন্যাসে প্রটেস্টান্ট ধরনের। উভয়ক্ষেত্রে পুরুষই 'পায়' : জার্মান নভেলের তরুণ যুবক পায় একটি তরুণী, ফরাসী নভেলে স্বামী পায় তার প্রবঞ্চনার হেনস্থা। কার দুর্ভোগ যে বেশি সব ক্ষেত্রে বলা শক্ত, কেননা জার্মান নভেলের নীরসতা ফরাসী বুর্জোয়ার মনে যতখানি ভীতি জাগায়, ফরাসী নভেলের 'দুর্নীতি' জার্মান কূপমণ্ডুকের মনে ঠিক ততখানি ভীতি উদ্রেক করে। তবু সম্প্রতি 'বার্লিন মহানগরীতে পরিণত হওয়ায়' যে হেটায়ারিজম ও ব্যাভিচার এখানে বহুদিন থেকেই বর্তমান বলে জানা, তা নিয়ে জার্মান উপন্যাসে কিছুটা কম ভীতি দেখা দিচ্ছে।

কিন্তু উভয়ক্ষেত্রে বিবাহ নির্ভর করে পাত্রপাত্রীদের শ্রেণীর উপর এবং সেই হিসাবে এগুলি সুবিধার বিবাহই থেকে যায়। উভয়ক্ষেত্রেই এই সুবিধার বিবাহ প্রায়ই অত্যন্ত সথূল বেশ্যাবৃত্তিতে পরিণত হয় - কখনো দুপক্ষের কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্ত্রীর বেলায়; স্ত্রীর সঙ্গে সাধারণ পতিতার পার্থক্য এইটুকু যে, সে ফুরনের মজুরের মতো নিজের দেহ ভাড়া খাটায় না, পরন্তু সে দেহটা বিক্রি করে চিরকালের মতো দাসত্বে। সমস্ত সুবিধামাফিক বিবাহ সম্পর্কে ফুরিয়ের এই মন্তব্য প্রযোজ্য : 'ব্যাকরণে যেমন দুটি নেতিবাচক শব্দে একটি ইতিবাচক শব্দ হয়, তেমনই বিবাহের নীতিশাস্ত্রে দুটি বেশ্যাবৃত্তি মিলে পুণ্যকর্ম হয়ে ওঠে।' কেবলমাত্র শোষিত শ্রেণীগুলির মধ্যে অর্থাৎ বর্তমানে প্রলেতারীয়দের মধ্যে স্ত্রী সম্পর্কে যৌন প্রেম সাধারণ ব্যাপার হতে পারে ও হয়ে থাকে, সরকারীভাবে এই সম্পর্ককে স্বীকার হোক বা না হোক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে চিরায়ত একপতিপত্নী প্রথার সমস্ত পুরনো বুনিয়াদই আর থাকছে না। যে সম্পত্তির সংরক্ষণ ও উত্তরাধিকারের জন্য একপতিপত্নী প্রথা ও পুরুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেরকম সব সম্পত্তিই এখানে অনুপস্থিত। অতএব এখানে পুরুষের আধিপত্য খাটাবার কোন প্রেরণা নেই। উপরন্তু তার উপায়ও নেই : এই আধিপত্য রক্ষা করে যে নাগরিক আইন তার অস্তিত্ব শুধু বিত্তবান শ্রেণীগুলির জন্য এবং প্রলেতারীয়দের সঙ্গে তাদের কারবারের জন্য। এতে টাকাকড়ি লাগে এবং সেইজন্যই শ্রমিকের দারিদ্র্যের জন্য স্ত্রীর সঙ্গে তার আচরণের ব্যাপারে এর কোন কার্যকারিতা নেই। এখানে সম্পূর্ণ বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত আর সামাজিক সম্বন্ধই হচ্ছে নির্ধারক ব্যাপার। উপরন্তু, যখন থেকে বৃহৎ শিল্প স্ত্রী লোককে ঘর থেকে শ্রমবাজার ও কারখানায় পাঠাল এবং প্রায়ই তাকে পরিবার পালনে রোজগার করতে হলো তখন থেকে প্রলেতারীয় সংসারে পুরুষের আধিপত্যের যা কিছু ভিত্তি ছিল সবই লোপ পেল -- একপতিপত্নী বিবাহের প্রতিষ্ঠা থেকে স্ত্রীলোকের প্রতি যে রূঢ়তা দৃঢ়মূল হয়ে গিয়েছিল সম্ভবত তার কিছু কিছু ছাড়া। এইভাবে প্রলেতারীয় পরিবার সঠিক অর্থে আর একপতিপত্নী নয়; এমনকি যেখানে নিবিড় প্রেম ও উভয় পক্ষের পরিপূর্ণ বিশ্বস্ততা বর্তমান সেখানেও, এবং আধ্যাত্মিক ও পার্থিব সমস্ত রকমে মন্ত্রপূত হয়েও। একপতিপত্নী প্রথার দুটি চিরন্তন সঙ্গী হেটায়ারিজম ও ব্যভিচারের ভূমিকা তাই এখানে নগন্য। বস্তুতঃ স্ত্রীলোক বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার ফিরে পেয়েছে এবং বনিবনাও না হলে স্বামী স্ত্রী ছাড়াছাড়ি হতেই পছন্দ করে। সংক্ষেপে, প্রলেতারীয় বিবাহ ব্যুৎপত্তিগত অর্থে একপতিপত্নী হলেও ঐতিহাসিক অর্থে মোটেই নয়।

আমাদের আইনজ্ঞরা অবশ্য বলে থাকেন যে, আইন প্রণয়নে প্রগতির মধ্যে দিয়ে ক্রমেই বেশি বেশি পরিমাণে স্ত্রীলোকের অভিযোগের কারণগুলি দূর হচ্ছে। আধুনিক সভ্য দেশের আইনবিধি ক্রমশঃই এই জিনিসটা মেনে নিচ্ছে যে, প্রথমত, কার্যকরী হতে গেলে বিবাহকে দুই পক্ষ থেকে স্বেচ্ছামূলক চুক্তির ভিত্তিতে হতে হবে; এবং দ্বিতীয়ত, বিবাহিত অবস্থায় অধিকার ও দায়িত্বের দিক দিয়ে উভয়পক্ষের সমতা থাকবে। যদি এই দুটি দাবি যথাযথভাবে কার্যকরী হয় তাহলে মেয়েদের চাওয়ার আর কিছু থাকে না।  

এই টিপিকাল উকিলী যুক্তি হচ্ছে ঠিক সেইরকম যা দিয়ে রেডিক্যাল বুর্জোয়া-প্রজাতন্ত্রী প্রলেতারীয়কে ফেরায়। কাজের চুক্তিকে মালিক-শ্রমিক উভয়পক্ষের স্বেচ্ছামূলক মনে করা হয়। কিন্তু কাগজে কলমে আইন উভয়পক্ষকে একই ভিত্তিতে দাঁড় করিয়ে দেয় বলে ধরা হয় চুক্তিটি স্বেচ্ছামূলক। ভিন্ন শ্রেণী অবস্থানের জন্য প্রাপ্ত একটি পক্ষের ক্ষমতা, অপরপক্ষের ওপর তার চাপ, উভয়ের বাস্তব অর্থনৈতিক অবস্থা -- এসব নিয়ে আইন মাথা ঘামায় না। এবং কাজের চুক্তি বলবৎ থাকার সময় উভয়পক্ষকেই সমান অধিকারভোগী মনে করা হয়, যতক্ষণ না কোন এক পক্ষ সুস্পষ্টভাবে এই অধিকার ছেড়ে দিচ্ছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে শ্রমিক যে তার সমান অধিকারের সামান্যতম আভাসটুকুও ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, এই বিষয়ে আইনের কিছু করবার নেই।  

বিবাহের ব্যাপারে খুব প্রগতিশীল আইনও এইটুকুতেই সন্তুষ্ট যে, উভয়পক্ষ বিবাহে সরকারীভাবে নিজেদের সম্মতি জানিয়েছে। আইনের যবনিকার আড়ালে যেখানে বাস্তব জীবন চলে সেখানে কী ঘটছে, কীভাবে এই স্বেচ্ছামূলক চুক্তিতে পৌঁছান হচ্ছে, তা নিয়ে আইন এবং আইনজ্ঞ মাথা ঘামায় না। অথচ বিভিন্ন দেশের আইনের মামুলি তুলনা থেকেও আইনজ্ঞ বুঝতে পারবেন যে, এই স্বেচ্ছামূলক চুক্তি আসলে কী দাঁড়ায়। জার্মানিতে, ফরাসী আইনের অধীন সব দেশ ও অন্যান্য দেশগুলিতে যেখানে সন্তানসন্ততিরা বাধ্যতামূলকভাবে পিতামাতার সম্পত্তির ভাগ আইনত পায়, তাদের উত্তরাধিকারচ্যুত করা যায় না, সেখানে বিবাহের প্রশ্নে সন্তানসন্ততিদের মাতাপিতার সম্মতি নিতেই হয়। যেসব দেশে ইংরেজী আইন খাটে, যেখানে বিবাহে মাতাপিতার উইলের নিরঙ্কুশ অধিকার আছে এবং তারা যদি ইচ্ছে করে তাহলে সন্তানসন্ততিদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে পারে। অতএব এটা স্পষ্ট যে, এ সত্ত্বেও কিংবা বলা উচিত এইজন্যই যেসব শ্রেণীর মধ্যে উত্তরাধিকারের মতো সম্পত্তি আছে, ইংল্যান্ডে বা আমেরিকায় তাদের মধ্যে বিবাহের স্বাধীনতা ফ্রান্স বা জার্মানির চেয়ে একছিটে বেশি নয়। 

বিবাহে স্ত্রী পুরুষের আইনী সমাধিকারের ক্ষেত্রেও অবস্থা এর চেয়ে ভাল নয়। পূর্বতন সামাজিক অবস্থার উত্তরদায়িত্ব হিসাবে প্রাপ্ত উভয়ের আইনগত অসম অধিকার, এটি স্ত্রীলোকের ওপর অর্থনৈতিক পীড়নের কারণ নয়, ফল। পুরনো সাম্যতন্ত্রী গৃহস্থালীতে যেখানে বহু দম্পতি ও তাদের ছেলেমেয়েরা থাকত সেখানে গৃহস্থালীর ব্যবস্থা স্ত্রীলোকদের উপর ন্যস্ত ছিল, -- এই কাজটি পুরুষের খাদ্য আহরণের মতোই একটা সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় বৃত্তি বলে গণ্য হতো। পিতৃপ্রধান পরিবার আসার সঙ্গে অবস্থা বদলে গেল এবং আরও বেশি বদলাল একপতিপত্নী স্বতন্ত্র পরিবার আসার ফলে। গৃহস্থালীর কাজকর্মের সামাজিক বৈশিষ্ট্য চলে গেল। এটি আর সমাজের দেখবার বিষয় রইল না, এটি হয়ে দাঁড়াল ব্যক্তিগত সেবা। সামাজিক উৎপাদনের ক্ষেত্র থেকে বহিষ্কৃত হয়ে স্ত্রী-ই হলো প্রথম ঘরোয়া ঝি। কেবলমাত্র আধুনিক বৃহৎ শিল্পই আবার তাদের সামনে সামাজিক উৎপাদনে প্রবেশের দরজা খুলে দিয়েছে, অবশ্য কেবলমাত্র প্রলেতারীয় স্ত্রীলোকদের জন্যই। কিন্তু সেটা করেছে এরকমভাবে যে, যখন সে নিজের পরিবারের ব্যক্তিগত সেবার কর্তব্য পালন করে তখন সে সামাজিক উৎপাদনের বাইরে পড়ে যায় এবং কোন কিছু উপার্জন করে না; এবং যখন সে সামাজিক পরিশ্রমে অংশ নিয়ে স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করতে চায় তখন আর সে পারিবারিক কর্তব্য পালন করতে পারে না। কারখানার স্ত্রীলোকের পক্ষে যা প্রযোজ্য তা অন্য সব পেশা এমনকি চিকিৎসা ও আইনের পেশাতেও প্রযোজ্য। আধুনিক ব্যক্তিগত পরিবার স্ত্রীলোকের প্রকাশ্য অথবা গোপন গার্হস্থ্য দাসত্বের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে এবং বর্তমান সমাজ হচ্ছে এইসব ব্যক্তিগত পরিবারের অণুর সমষ্টি। বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্ততপক্ষে বিত্তবান শ্রেণীগুলির মধ্যে পুরুষই হচ্ছে উপার্জনকারী, পরিবারের ভরণপোষণের কর্তা এবং এইজন্যই তার আধিপত্য দেখা দেয়, যার জন্য কোন বিশেষ আইনগত সুবিধা দরকার পড়ে না। পরিবারের মধ্যে সে হচ্ছে বুর্জোয়া; স্ত্রী হচ্ছে প্রলেতারিয়েত। কিন্তু শিল্পজগতে যে অর্থনৈতিক শোষণ প্রলেতারিয়েতকে পিষে ধরে তার বিশেষ প্রকৃতি সমগ্র তীক্ষ্ণতায় তখনই ফুটে ওঠে যখন পুঁজিপতি শ্রেণীর আইনগত সমস্ত বিশেষ সুবিধা দূর হয়েছে এবং আইনের চক্ষে উভয় শ্রেণীর সম্পূর্ণ সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র উভয় শ্রেণীর বিরোধ লোপ করে না; পরন্তু সে বিরোধ লড়ে শেষ করার ক্ষেত্র যোগায়। ঠিক একইভাবে আধুনিক পরিবারের মধ্যে স্ত্রীলোকের ওপর স্বামীর আধিপত্যের বিশেষ চরিত্রে এবং উভয়ের মধ্যে সত্যিকার সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ও পদ্ধতি তখনই পুরো ফুটে উঠবে যখন আইনের চক্ষে উভয়ের অধিকার সমান বলে স্বীকৃত হচ্ছে। তখন একথা স্পষ্ট হবে যে, সামাজিক উৎপাদনের মধ্যে গোটা স্ত্রীজাতিকে আবার নিয়ে আসাই হচ্ছে তাদের মুক্তির প্রথম শর্ত; এবং এর জন্যই আবার দরকার হচ্ছে সমাজের অর্থনীতির একক হিসাবে ব্যক্তিগত পরিবারের যে গুণটি রয়েছে তার বিলোপ।

*************************************************************************

আমরা এমন একটি সমাজ বিপ্লবের দিকে এগোচ্ছি যখন বর্তমানের একপতিপত্নী প্রথার অর্থনৈতিক ভিত্তি তেমন নিশ্চিতই লোপ পাবে, যেমন লোপ পাবে তার অনুপূরণ পতিতাবৃত্তির অর্থনৈতিক ভিত্তি। একই ব্যক্তির, মানে এক পুরুষের অধিকারে প্রচুর সম্পত্তি কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে এবং অপর কাউকে নয়, কেবলমাত্র সে পুরুষের নিজের সন্তানসন্ততিকেই সম্পত্তির উত্তরাধিকার দিয়ে যাবার ইচ্ছা থেকেই এই একপতিপত্নী প্রথা আসে। এইজন্যই নারীর পক্ষেই একপতিত্বে পুরুষদের গোপন বা প্রকাশ্য বহুপত্নীত্ব বাধেনি। উত্তরাধিকারযোগ্য স্থায়ী সম্পদের অন্ততপক্ষে বেশির ভাগ অংশকে --- উৎপাদনের উপায়কে -- সামাজিক সম্পত্তিতে পরিণত করে আসন্ন সমাজ-বিপ্লব কিন্তু উত্তরাধিকারের এইসব দুশ্চিন্তাকে সর্বনিম্নে নামিয়ে আনবে। যেহেতু একপতিপত্নী প্রথা অর্থনৈতিক কারণ থেকে জন্মেছে, তাই সেসব কারণ চলে গেলে কি এটিও লোপ পাবে?

এর উত্তরে যৌক্তিকতার সঙ্গেই বলা চলে : এই প্রথা লোপ না পেয়ে পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হবেই। কারণ উৎপাদনের উপায়গুলি সমাজের সম্পত্তি হওয়ার ফলে মজুরিশ্রম, প্রলেতারিয়েত লোপ পায় এবং সেই সঙ্গে সমাজের কিছু সংখ্যক স্ত্রীলোকের (সংখ্যাগতভাবে যা গণনাযোগ্য) পক্ষে অর্থের জন্য আত্মদানের আবশ্যকতাও লোপ পাবে। পতিতাবৃত্তি লোপ পাবে এবং একপতিপত্নী প্রথা ক্ষয় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত বাস্তব হবে --- সেটা পুরুষদের পক্ষেও।

মোটের উপর, পুরুষদের অবস্থা এইভাবে যথেষ্ট পরিমাণে বদলে যাবে। কিন্তু নারীর ক্ষেত্রেও, সমস্ত নারীর ক্ষেত্রেও অবস্থার গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটবে। উৎপাদনের উপায় সমাজের সম্পত্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যক্তিগত পরিবারগুলি আর সমাজের একক (Unit) থাকবে না। ব্যক্তিগত গৃহস্থালী পরিণত হবে সামাজিক শিল্পে। শিশুর পরিচর্যা ও শিক্ষা হয়ে উঠবে সামাজিক ব্যাপার, বিবাহবন্ধনের মারফত অথবা বাইরে, শিশু যেভাবেই জন্মাক না কেন, সমাজ তাদের সকলের সমান দায়িত্ব নেবে। এইজন্যই 'ভবিষ্যৎ ফলাফলের' দুশ্চিন্তা নীতিগত ও অর্থনৈতিক উভয়দিক থেকে যেটি আজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কারণ - যেজন্য একটি মেয়ে যাকে ভালোবাসে সেই পুরুষের কাছে অবাধে আত্মসমর্পণ করতে পারে না --- সে কারণ আর থাকবে না। এটা কি অধিকতর অবাধ যৌন সঙ্গমের ক্রমিক উদ্ভব ঘটাবার মতো এবং সেই সঙ্গে কৌমার্যের মর্যাদা ও স্ত্রীলোকের লজ্জাশরম সম্বন্ধে আরো শিথিল একটা জনমত উদ্ভবের মতো কারণ ঘটাবে না কি? এবং সর্বশেষে বর্তমান জগতে একপতিপত্নী প্রথা ও পতিতাবৃত্তি সম্পূর্ণ বিপরীত হলেও তারা পরস্পর অবিচ্ছেদ্য বিপরীত, একই সামাজিক অবস্থার দুটি মেরু -- এটা কি আমরা দেখিনি? তাই একপতিপত্নী প্রথাকেও বিলুপ্ত না করে কি গণিকাবৃত্তি লোপ পেতে পারে?

এখানে একটি নতুন জিনিস কার্যকরী হতে থাকবেম, এমন একটি জিনিস যা একপতিপত্নী প্রথার সূচনার সময় বড়জোর ভ্রুণ আকারে ছিল, যথা, ব্যক্তিগত যৌন প্রেম।

*************************************************************************

বিবাহের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা সাধারণভাবে তখনই কার্যকরী হতে পারে, যখন পুঁজিবাদী উৎপাদন এবং তারই সৃষ্টি করা মালিকানা সম্পর্ক বিলুপ্ত হয়ে সেইসব গৌণ অর্থনৈতিক হিসাবকে হটিয়ে দেয়, যেগুলি বিবাহের সঙ্গী নির্বাচনের উপর এত প্রভাব বিস্তার করে। তখন পরস্পর আকর্ষণ ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য থাকবে না।

যেহেতু যৌন প্রেম প্রকৃতিগতভাবেই একবদ্ধ --- যদিও বর্তমানে কেবল স্ত্রীলোকের বেলাতেই এই একবদ্ধতা পূর্ণমাত্রায় রূপায়িত হয় -- সেইজন্য যৌন প্রেমের ভিত্তিতে বিবাহ হচ্ছে প্রকৃতিগতভাবেই একপতিপত্নী প্রথা। আমরা আগেই দেখেছি যে, বাখোফেন যখন সমষ্টি-বিবাহ থেকে একবিবাহে অগ্রগতিকে স্ত্রী লোকদের কীর্তি বলেছিলেন তখন তিনি কত সঠিক ছিলেন; জোড়বাঁধা বিবাহ থেকে একপতিপত্নী প্রথায় অগ্রগতিকেই কেবল পুরুষের কাজ বলা যায় এবং ঐতিহাসিকভাবে এতে বস্তুতঃ স্ত্রীলোকের অবস্থার ক্রমাবনতি ঘটেছে এবং পুরুষের ক্ষেত্রে বিশ্বাসহানির সুযোগ বেড়েছে। তাই যে সমস্ত অর্থনৈতিক কারণের জন্য স্ত্রীলোকেরা পুরুষের নিত্যকার বিশ্বাসহানি সহ্য করতে বাধ্য হতো, --- নিজেদের জীবনযাত্রা নিয়ে এবং তার চেয়ে বেশি সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ -- তার বিলোপের সঙ্গে সঙ্গেই স্ত্রীলোকের যে সমতা অর্জিত হবে তার ফলে অতীত সমস্ত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, স্ত্রীলোক বহুগামিনী না হয়ে বরং পুরুষই আরও কার্যকরীভাবে সত্যই একপত্নীব্রতই হবে।

কিন্তু একপতিপত্নী প্রথা থেকে যা নিশ্চিতই চলে যাবে তা হচ্ছে পুরানো মালিকানা প্রথা থেকে এ বিবাহ উদ্ভূত হওয়ায় তার ওপর যেসব বৈশিষ্ট্য মুদ্রিত হয়ে গিয়েছিল সেগুলি যথা, প্রথমত, পুরুষের আধিপত্য এবং দ্বিতীয়ত, বিবাহ বন্ধনের অচ্ছেদ্য বিবাহের ক্ষেত্রে পুরুষের আধিপত্য হচ্ছে তার আর্থিক আধিপত্যের প্রত্যক্ষ ফল এবং এ আর্থিক আধিপত্য লোপের সঙ্গে সঙ্গে আপনা আপনি তা লোপ পাবে। বিবাহবন্ধনের অচ্ছেদ্যতা অংশত এসেছে সেই অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে যার মধ্যে একপতিপত্নী প্রথার উদ্ভব এবং অংশত এমন একটি যুগের রীতি থেকে যখন এইসব অর্থনৈতিক অবস্থা ও একপতিপত্নী প্রথার যোগাযোগ সঠিক হৃদয়ঙ্গম করা যায়নি এবং ধর্মে তা অতিরঞ্জিত হয়ে উঠত। বর্তমানেও বিবাহবন্ধনে হাজারো গুণ লঙ্ঘিত। যদি কেবলমাত্র প্রেমের ভিত্তিতে বিবাহই নীতিসিদ্ধ হয়, তাহলে বিবাহ তখনই নীতিসিদ্ধ যতক্ষণ প্রেম থাকে। ব্যক্তিগত যৌন প্রেমের অনুভূতির স্থায়িত্ব কিন্তু ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, বিশেষতঃ পুরুষদের মধ্যে খুবই বিভিন্ন হয়; তাই যখন একটি প্রেম একেবারে চলে যায় অথবা অপর একটি নতুন প্রেমাবেগ তার জায়গা নেয়, তখন স্বামী স্ত্রী উভয়ের পক্ষে এবং সমাজের পক্ষেও বিচ্ছেদ একটি আশীর্বাদ। বিবাহবিচ্ছেদ মামলার নিষ্প্রয়োজন কাদা মাড়িয়ে যাবার অভিজ্ঞতাটা শুধু আর সইতে হবে না।

*************************************************************************

আমরা বীর যুগের গ্রীকদের সংবিধানে দেখি যে, প্রাচীন গোত্র-সংগঠন তখনও পূর্ণ উদ্যমে চলছে; কিন্তু আমরা তার বিলুপ্তির সূত্রপাতও দেখতে পাই; পিতৃ অধিকার এবং সন্তানসন্ততি কর্তৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকার, যার ফলে পরিবারের মধ্যে সম্পদ সঞ্চয়ে সাহায্য হলো এবং গোত্রের বিরুদ্ধে পরিবারকে শক্তি যোগাল; ধনের অসমতা, বংশানুক্রমিক অভিজাতকুল ও রাজতন্ত্রের প্রাথমিক ভ্রুণ সৃষ্টি করে যা সামাজিক ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করল; দাসপ্রথা, যা প্রথমে যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু ইতিমধ্যেই উপজাতির অন্যান্য ব্যক্তি, এমনকি গোত্রের সদস্যদেরও দাসত্ববন্ধনের পথ করেছিল, আন্তঃউপজাতি যুদ্ধ থেকে গবাদি পশু, দাস ও সম্পদ লুট করে নিয়মিত জীবিকানির্বাহের উপায় হিসাবে স্থলে জলে নিয়মিত হানায় অধঃপতন; সংক্ষেপে --- ধনের প্রশস্তি শুরু হলো ও তাকেই শ্রেষ্ঠ কল্যাণ বলে সন্মান করা হলো এবং গোত্রের সাবেকী বিধি বিধানকে বিকৃত করা হলো বলপূর্বক ধন লুন্ঠন সমর্থনের জন্য। কেবলমাত্র একটি জিনিসের তখনও অভাব ছিল : একটি প্রতিষ্ঠান যা নবলব্ধ ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে গোত্র-ব্যবস্থার সাম্যতন্ত্রী ঐতিহ্য থেকে শুধু যে বাঁচাবে তাই নয়, এতদিন যাকে হেয় জ্ঞান করা হতো সেই ব্যক্তিগত মালিকানাকে পবিত্র করবে, সেই পবিত্রকরণকে মানব সমাজের শ্রেষ্ঠ লক্ষ্য বলে ঘোষণা করবে শুধু তাই নয়, অধিকন্তু সম্পত্তি আহরণের ক্রমবিকাশমান নতুন রূপগুলির উপর এবং ধনবৃদ্ধি ত্বরান্বয়ণের উপর সাধারণ সামাজিক অনুমোদনের ছাপ দিয়ে দেবে; এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার বলে সমাজের উদীয়মান শ্রেণী বিভাগ শুধু নয়, পরন্তু বিত্তশালী শ্রেণী কর্তৃক বিত্তহীন শ্রেণীগুলিকে শোষণ করার অধিকার, বিত্তহীনদের উপর বিত্তবানদের শাসনও চিরস্থায়ী করবে।

এবং সে প্রতিষ্ঠান এল। উদ্ভাবিত হলো রাষ্ট্র।

*************************************************************************



Tuesday, 28 July 2020

লেনিন - সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর

এই বর্তমান যুগ হচ্ছে কমিউনিজমের যুগ অর্থাৎ কিনা ক্যাপিটালিজমের ধ্বংস করে শ্রেণীভেদলুপ্ত মানব-সমাজের প্রতিষ্ঠা করবার যুগ। ক্যাপিটালিজমের ধ্বংসসাধন ও শ্রেণীভেদলুপ্ত সমাজের প্রতিষ্ঠাকরণ ব্যক্তিবিশেষের খেয়ালপ্রসূত রোমান্টিক মতবাদ নহে, এই মতবাদ হচ্ছে মানব-সমাজের ইতিহাসের বিভিন্ন অভিব্যক্তির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও বিচারের ফলস্বরূপ। এই বৈজ্ঞানিক মতবাদের স্রষ্টা হচ্ছেন কার্ল মার্কস। কার্ল মার্কস ক্যাপিটালিস্ট সমাজের সমগ্র কাঠামোটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, এই সমাজের কাঠামোটি ক্যাপিটালিস্ট সমাজের উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে সমাজের ক্যাপিটালিস্ট উৎপাদন প্রণালীর অবশ্যম্ভাবী মূলগত বিরোধের ফলে ভেঙে যেতে বাধ্য। অবশ্য এই ভেঙে যাওয়াটা আপনা-আপনি ঘটে উঠবে না কিম্বা ভগবানের মর্জিমতো ঘটবে না। এই ভাঙ্গনের কাজ ক্যাপিটালিস্ট সমাজের একটি শ্রেণীকে সম্পূর্ণ চেতন হয়ে আপনার ব্রত করতে হবে। সে শ্রেণী হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণী, যাকে মার্কস 'ক্যাপিটালিজমের কবর খননকারী' বলে অভিহিত করেছেন। মার্কসের মতে যে - উপায়ে শ্রমিক শ্রেণী ক্যাপিটালিজমের ধ্বংসসাধন করবে, সেই উপায় হচ্ছে 'বিপ্লব'। নান্য পন্থা বিদ্যতে অয়নায়। মার্কসের জীবিত অবস্থায় ক্যাপিটালিজমের শেষ পরিণত অবস্থা - ইম্পিরিয়ালিজমে'র সূত্রপাত ঘটেনি। তাই এই ইম্পিরিয়ালিস্ট যুগের নির্দেশ করা ছাড়া, মার্কসের পক্ষে ইম্পিরিয়ালিস্ট যুগের প্রধান লক্ষণগুলি বিশ্লেষণ করে দেখানো সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে মার্কসের অসাধারণ সংযম তাঁর প্রত্যেক গ্রন্থে আমরা লক্ষ করি। তাঁর সমস্ত 'মতবাদ' ঐতিহাসিক বাস্তবতার উপর প্রতিষ্ঠিত। বিজ্ঞানের সঙ্গে খামখেয়াল মিশিয়ে তিনি মতবাদের সৃষ্টি করেননি। এই অসাধারণ সংযম, সামাজিক মতবাদকে বাস্তবতার সামাজিক জীবনের উপর প্রতিষ্ঠা করবার ও তাকে বার বার এই বাস্তবতার দ্বারা যাচাই করে দেখবার অনন্যসাধারণ শক্তি পরবর্তী যুগে আমরা একমাত্র লেনিনের মধ্যে দেখতে পাই। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অস্তিত্বের অভাবে মার্কস যেখানে থামতে বাধ্য হন, লেনিন ঠিক সেইখান থেকে শুরু করে পরবর্তী যুগে ইম্পিরিয়ালিজমের সমস্ত লক্ষণের বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। মার্কস যখন ক্যাপিটালিস্ট সমাজের বিশ্লেষণ করে বিপ্লবের অনিবার্যতা প্রমাণ করেছিলেন, তখন বিপ্লবের থিয়োরিটিকাল যথার্থতা নিঃসন্দেহে প্রমান হলেও বিপ্লবের সমস্ত প্রণালীর বিচারের উপায় ছিল না। ক্যাপিটালিস্ট সমাজকে যে-বিপ্লব ধ্বংস করবে, সে বিপ্লব শুধু ইম্পিরিয়ালিস্ট যুগে অর্থাৎ কিনা ক্যাপিটালিজমের শেষ পরিণতির যুগে বাস্তব সমস্যা হয়ে ওঠে। সেই কারণে, তাঁর জীবিত অবস্থায় ইম্পিরিয়ালিজমের অস্তিত্বের অভাবে, মার্কসের পক্ষে সম্ভব হয়নি বিপ্লবের প্রণালী ও বিপ্লবের পরবর্তী কালে প্রলেতারিয়ান ডিকটেটরশিপ সম্বন্ধে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করার। প্যারিস কমিউনের অভিজ্ঞতা থেকে বিপ্লব প্রণালীর যত দূর শিক্ষালাভ করা যায় মার্কস তা দেখতে কসুর করেননি, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিত নয় এমন কোনো মতবাদ তিনি প্রচার করেননি। এই ক্ষেত্রেও লেনিন মার্কসের আরব্ধ ব্রতকে সম্পন্ন করেছেন। লেনিনের জীবন আলোচনা করবার সময় আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, রাশিয়ার প্রলেতারিয়ান বিপ্লবের ও বিশ্বব্যাপী প্রলেতারিয়ান বিপ্লবের নীতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে ও সংগঠনের ক্ষেত্রে লেনিন সম্পূর্ণ ভাবে মার্কসের বৈজ্ঞানিক মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। 

লেনিনের জীবন আলোচনা করার মানে হচ্ছে, রাশিয়ার প্রলেতারিয়ান বিপ্লব-আন্দোলনের ইতিহাস ও বিপ্লবের পরবর্তী কালের ইতিহাসের আলোচনা করা। লেনিন ও রুশীয় বিপ্লব অভেদ্য যোগসূত্রে বদ্ধ। এদের পরস্পরকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব। 

=========================================================================

১৯১৮ সালে মিনস্ক শহরে রাশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক দলের পত্তন করা হয়। ১৯০৩ সালে দলের দ্বিতীয় কনফারেন্সের অধিবেশন হয়। অধিবেশন শুরু হয় ব্রুসেলসে, কিন্তু নানা কারণে কনফারেন্স অসমাপ্ত অবস্থায় থাকে। পরে লন্ডনে কনফারেন্সের অধিবেশন শেষ করা হয়। এই লন্ডনের কনফারেন্সেই মতের বিভিন্নতার দরুণ রুশীয় সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দল 'বলশেভিক' ও 'মেনশেভিক', এই দুই দলে বিভক্ত হয়ে যায়। মতের বিভিন্নতা যে-বিষয় নিয়ে ঘটে সেই বিষয়টি হচ্ছে এই - লন্ডনের কনফারেন্সে লেনিন প্রস্তাব আনেন যে, দলের প্রত্যেক সভ্যকে আইন-বিরুদ্ধ গুপ্ত আন্দোলনের কাজ করতে হবে। যারা এই আইন-বিরুদ্ধ কাজ করতে সক্ষম নয়, তারা লেনিনের মতে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দলের সভ্য হবার অধিকারী নয়। অ্যাক্সেলরড প্রভৃতি এক দল সোশ্যাল ডেমোক্রেট যারা পরে মেনশেভিক বলে খ্যাত হয়, তারা লেনিনের এই প্রস্তাবের ঘোরতর বিরুদ্ধতা করল। এদের মতে প্রফেসর, কলেজের ছাত্র, বিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইন ব্যবসায়ী প্রভৃতি সকলকে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দলে প্রবেশ করবার সুযোগ দেওয়া উচিত। ঠিক এই মতবাদকে নাকচ করে দেবার জন্যেই লেনিন তাঁর প্রস্তাব এনেছিলেন। বিপ্লবমূলক শ্রমিক সংঘকে এই সব সুবিধাবাদী শিক্ষিতদের সংস্পর্শ থেকে রক্ষা করে ছিল লেনিনের উদ্দেশ্য। ১৯০৫ সালের বিপ্লবের আগে পর্যন্ত এই শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অনেকেই মার্কসের বই থেকে উদ্ধৃত করে বুলি আওড়াত এবং নিজেদের সোশ্যাল ডেমোক্রেট বলে প্রচার করত। আসলে কিন্তু এরা বুর্জোয়া শ্রেণীর উদারনৈতিক (liberal) দলের লোক ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এরা নিজেদের গা বাঁচিয়ে যতদিন কথার চাল দিয়ে চলত ততদিন নিজেদের সোশ্যাল ডেমোক্রেট বলে জাহির করতে কসুর করত না, কিন্তু যে-আইনী গুপ্ত বিপ্লবমূলক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে নিজেদের বিপদাপন্ন করবার মত মুরদ এদের কারো ছিল না। এই বিপ্লবের বুলি আওড়াতে মজবুত, অথচ আসল কাজের বেলা পশ্চাৎপদ এই ধাপ্পাবাজ শিক্ষিত সম্প্রদায়ের লোকেদের অতি অনিষ্টকর বুর্জোয়া প্রভাব থেকে শ্রমিক আন্দোলনকে বাঁচাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন লেনিন। যাঁরা লেনিনের যুক্তির যথার্থতাকে সমর্থন করে লেনিনের দলে রইলেন তাঁরা 'বলশেভিক' নামে খ্যাত হলেন, আর যারা দলের মধ্যে হরেক রকমের লোকের আমদানী করে শ্রমিক সংঘের বিপ্লবমূলক উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে দেবার উদ্যোগ করল তারা 'মেনশেভিক' নামে খ্যাত হল। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে এমন একটা তুচ্ছ কারণ নিয়ে দলকে বিভক্ত করবার এমনই বা কী প্রয়োজন ছিল? পরবর্তী কালে দলের ইতিহাস লেনিনের অসামান্য দূরদর্শিতার ভূরি ভূরি প্রমাণ দিয়েছে। শুধু রুশীয় মেনশেভিক দল নয়, অন্য দেশের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দলগুলিও এই শিক্ষিত সম্প্রদায়ের লোকেদের মধ্যে প্রবেশের পথ সহজ করে দিয়ে দলগুলিকে ক্রমশই বুর্জোয়া ভাবাপন্ন করে তুলেছে। অবশ্য এই সব দল যে কোন বিচার না করে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সুবিধাবাদী লোকেদের মধ্যে প্রবেশ করতে দিয়েছে, তার কারণ অতি সুস্পষ্ট। তার কারণ হচ্ছে এই যে, দলগুলির নেতৃত্ব ছিল যাদের হাতে তারা নিজেরাই ছিল সুবিধাবাদী লোক। যতদিন বিপ্লবের সম্ভাবনা দূরে ছিল ততদিন এরা 'বিপ্লবী' ছিল - বিপ্লবের সম্ভাবনা যতই আসন্ন হয়ে এল তখন দেখা গেল পৃথিবীর সমস্ত দেশের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক নেতার দল আসলে হচ্ছে বিপ্লবের ঘোরতর শত্রু। এই নেতারা হচ্ছে আসলে বুর্জোয়া সম্প্রদায়ভুক্ত, উদারনৈতিক দলভুক্ত লোক। এদের শ্রমিক আন্দোলনে প্রবেশের উদ্দেশ্যই হচ্ছে শ্রমিক আন্দোলনে বুর্জোয়া মতবাদের ভেজাল মিশিয়ে বিপ্লবকে প্রতিহত করা। পৃথিবীর সব দেশের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দল যখন ১৯১৪ সালের ইম্পিরিয়ালিস্ট যুদ্ধের সময় থেকে একেবারে পুরোপুরি ভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করে শ্রমিকদের স্বার্থ ইম্পিরিয়ালিস্টদের পায়ে বিকিয়ে দিল, তখন একমাত্র বলশেভিক দল যে রুশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ বজায় রাখবার জন্যে সংগ্রাম করেছে - তার অন্যতম কারণ হচ্ছে যে, এই দল লেনিনের মতো নেতা পাবার সৌভাগ্যলাভ করেছিল, যে-নেতা বুর্জোয়া শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সুবিধাবাদী লোকদের শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে প্রবেশ করাবার পথে, বিপ্লবমূলক সংগঠনের অস্তিত্বের পক্ষে অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনীয় কঠোর পরীক্ষার ব্যবস্থা রেখেছিলেন। 

Sunday, 26 July 2020

আর এস এস-বি জে পি এবং সোশ্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং - গৌতম রায়

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ নামক সংগঠনটির সবথেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো, তাঁরা ভারতীয়ত্বের কথা, জপমন্ত্রের মতো বললেও চিরন্তন ভারতবর্ষকে তাঁরা একদিনের জন্যেও স্বীকার করে না। সমন্বয়ী চেতনা, যা চিরন্তন ভারতবর্ষের প্রাণ ভ্রমরা, তাকেই তাঁরা স্বীকার করে না। তাই গান্ধীজী হত্যার দায়ে যখন ভারত সরকার এই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তখন সরকারী রোষানল থেকে বাঁচতে নানা কৌশল এঁরা অবলম্বন করলেও কোনো অবস্থাতেই সমন্বয়ী ভারতের চেতনাকে আরএসএস স্বীকার করেনি একটি মুহূর্তের জন্যে। নিষেধাজ্ঞার পর্বে ভারত সরকারের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে আপোষে সব কিছু মিটিয়ে নেওয়ার উদ্দেশে একনাথ রাণাডে আলাপ আলোচনা চালাতে শুরু করেন।

ভারত সরকার, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের সঙ্গে আরএসএসের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং গোলওয়ালকরের মুক্তির বিষয়টি নিয়ে আপোষে আলাপ আলোচনার নেতৃত্ব এই একনাথ রাণাডেই দিয়েছিলেন। সর্দার প্যাটেলের সঙ্গে আরএসএস নেতা একনাথ রাণাডের প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল মাইসোরে বিশিষ্ট শিল্পপতি ঘনশ্যামদাস বিড়লার বাড়িতে। এর আগে থেকেই নানা স্তরে আরএসএসের সঙ্গে জিডি বিড়লার একটি সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। মূলত বৃহৎ বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি কংগ্রেসের সঙ্গে বিড়লাদের ঘনিষ্ঠতা থাকলেও আরএসএসের সঙ্গে একটা সম্পর্ক রেখে প্রথম থেকেই চলে আসছিলেন জিডি বিড়লা।

মাইসোরে জিডি বিড়লার বাড়িতে সর্দার প্যাটেলের সঙ্গে তাঁর বৈঠকটিকে একনাথ রাণাডে 'বিশৃঙ্খলা' বলে পরবর্তী সময়ে অভিহিত করেছিলেন। প্যাটেলের পক্ষ থেকে রাণাডের উপর বার বার এই বলে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল যে, গোটা দেশের আইনশৃঙ্খলার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে সঙ্ঘের দ্বারা - এমনটাই ছিল একনাথ রাণাডের অভিযোগ (১৯৬৯ সালের ২৯শে ডিসেম্বর কন্যাকুমারীতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একনাথ রাণাডে এই অভিযোগ করেছিলেন)। এই বৈঠকে সর্দার প্যাটেলের ভূমিকা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সাক্ষাৎকারে বেশ ক্ষোভই রাণাডে প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর মতে, কোন কোন ক্ষেত্রে আরএসএস আইন শৃঙ্খলার পরিবেশের অবনতি ঘটাচ্ছে - তার নাকি কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেশের গৃহমন্ত্রী সর্দার প্যাটেল দিতে পারেননি। সাক্ষাৎকারে রানাডে বলেন যে, আগে সঙ্ঘ সম্পর্কে যেসব অভিযোগ সর্দার প্যাটেল গোলওয়ালকরকে জানিয়েছিলেন, সেইসব অভিযোগ নিয়ে তিনি (রাণাডে) যখন প্যাটেলকে বিড়লার বাড়ির বৈঠকে চেপে ধরেন, তখন সেইসব বিষয়ে স্পষ্ট কোনো জবাব দেওয়া সর্দার প্যাটেলের পক্ষে সম্ভবপর হয়নি।

নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়ে সর্দার প্যাটেলের মূর্তি প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন, তার পিছনে সামগ্রিক ভাবে সঙ্ঘের কতোখানি সমর্থন রয়েছে, তা একনাথ রানাডের এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ্যে আসার পর আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। গান্ধী হত্যার পর সঙ্ঘের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং গোলওয়ালকরের মুক্তি প্রসঙ্গে দেশের তৎকালীন গৃহমন্ত্রী সর্দার প্যাটেলের অবশ্যই একটি সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তবে তাঁর সেই সক্রিয়তা কতোখানি সঙ্ঘের স্বার্থে আর কতোখানি প্যাটেলের সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে ব্যক্তি বিরোধের জেরে তা নিয়ে একটা সংশয় খোদ সঙ্ঘের ভিতরেই আছে।

সঙ্ঘের একটি অংশ মনে করেন যে, পন্ডিত নেহেরুর সঙ্গে নিজের ব্যক্তি বিরোধের জেরে প্যাটেল ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন আরএসএসকে। কংগ্রেসের সঙ্গে সঙ্ঘের মিলনের প্রশ্নে সর্দার প্যাটেলের যে প্রস্তাব ছিল, সেই প্রস্তাব সঙ্ঘ বা কংগ্রেস দলের স্বার্থে যতো না সর্দার প্যাটেল দিয়েছিলেন, তার থেকে অনেক বেশি তিনি তাঁর নিজের স্বার্থে দিয়েছিলেন বলে সঙ্ঘ নেতৃত্বের একটি অংশ আজও মনে করেন। সঙ্ঘ নেতৃত্বের এই প্রসঙ্গে অনুমান এই ছিল যে, দক্ষিণপন্থী অবস্থানের প্রশ্নে কংগ্রেস দলের ভিতরে নেহরু লবির চাপে বেশ খানিকটা কোণঠাসা ছিলেন সর্দার প্যাটেল। তাঁর এই কোণঠাসা অবস্থাটা কাটিয়ে তুলতেই তিনি কংগ্রেসের ভিতরে সঙ্ঘকে মিশিয়ে দিতে চাইছিলেন। এই ব্যক্তিস্বার্থবাহী সর্দার প্যাটেলকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েই নরেন্দ্র মোদির অতি সক্রিয়তাকে সঙ্ঘ নেতৃত্বের একটা বড়ো অংশই খুব একটা ভালো চোখে নেয়নি।

মোদির এই অতি সক্রিয়তাকে সঙ্ঘের ভিতরে এখনো যাঁরা একনাথ রানাডে প্রমুখের একান্ত অনুগামী রয়েছেন, তাঁরা নিছক গুজরাটি অস্মিতাকে উসকে দেওয়া বলেই ধরেছিলেন। তাঁদের কাছে সঙ্ঘের উপর নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সময়ে সর্দার প্যাটেলের সঙ্গে একনাথ রানাডে বিতর্কের জেরে সর্দার প্যাটেলকে সার্বিকভাবে আরএসএসের রোল মডেল হিসেবে তুলে ধরা নিয়ে বেশ কিছুটা সংশয় আছে। এই সংশয়ের নিরিখেই হয়তো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পরই সর্দার প্যাটেলকে ঘিরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যে অতিসক্রিয়তা ছিল, তাতে এখন কিছুটা ভাঁটা পড়েছে।

Monday, 23 March 2020

Should the Left Become Social Democratic?


Should the Left Become Social Democratic?



On a television channel on counting day, the panellists discussing the assembly election results were asked to offer advice to the Left, which had lost both the large states it ruled, one of them quite massively, on how it should reform itself for a future resurrection.  The overwhelming opinion among them was that it should forget Lenin, and, as the anchor explicated, become ‘social democratic’.  The Left I suppose should be obliged to the panellists for being so concerned about its future; the question is: should it follow their advice and become ‘social democratic’?
The central difference between social democracy and communism is the latter’s acceptance of the category of imperialism; other differences derive from it.  Indeed, the basic split in the Second International on the attitude to the First World War arose from a difference in perspectives on imperialism.  On one side were those social democrats who supported their respective countries’ war efforts since they did not see it as an ‘imperialist war’; on the other side were those who not only were unwilling to do so, as they saw the war as an ‘imperialist war’ through which ‘their’ respective monopoly bourgeoisies were trying to grab more ‘economic territory’, but wanted the ‘imperialist war’ to be turned into a ‘civil war’ for the overthrow of the monopoly capitalist order, which made workers of one country fight fellow workers of another across the trenches.  (A third position between these two, which tried to reconcile these irreconcilable positions, gradually lost relevance.)
The second group of social democrats split from the parent parties to form communist parties, and they included not only Lenin but also Rosa Luxemburg, who, notwithstanding her many differences with Lenin, attended the founding congress of the German communist party a fortnight before her murder.  This underscores the centrality of the question of imperialism to the communist position vis-à-vis the social democrats.  And bound up with this question is the case for system-transcendence: if capitalism can be made into a peaceful, non-imperialist, non-aggressive system, as the social democrats believed it could, then it can also be made ‘humane’, and any pressing need for its transcendence by socialism disappears.
Advising the communists to become social democrats amounts, therefore, to asking them to abandon not only their basic objective of socialism, but also their persistent opposition to imperialism; indeed, one panellist on the aforementioned TV show explicitly asked the communists to forget about ‘imperialism’.
The proximate difference between the communists and the bulk of the NGOs, including some highly progressive ones which are associated with the World Social Forum, relates precisely to imperialism.  Opposition to the Iraq war or to American interventions, which many progressive NGOs would express, does not necessarily mean accepting the concept of imperialism (even when the material interests underlying such interventions are recognized), since one can still see these as episodic events.  The communists see imperialism not as a set of episodes, but as an entire order that springs from the nature of capitalism itself.
Even those who see only episodes of imperialism have missed, alas, certain glaring recent episodes, such as the killing of Osama bin Laden which violated all norms of international conduct.  One country sent in troops to attack a target in another sovereign nation, without so much as a ‘by your leave’; murdered an unarmed man, who was offering no resistance, in front of his family; took his body away; and dumped it into the sea.  Osama may have been a villain, but what is at issue here is, first, the act of aggression against a sovereign country; and second, the ethical and legal questionability of the act of killing a person without a trial, which even the Nazi mass murderers were not denied.  And yet, while Fidel Castro and Noam Chomsky have raised their voices on these questions, there has been a virtual silence over them in our country, as indeed there has been over the Nato bombing of Libya, which is in violation of international law (no matter how dictatorial Muammar Gaddafi may be).
There are no doubt fewer takers for the concept of imperialism today than was the case in the colonial era, when the imperial order was palpable.  In particular, the much-hyped gross domestic product growth rates of China and India give the impression today that the earlier asymmetry between a first and a third world, implicit in the concept of imperialism, is disappearing, and that the latter is emerging as a replica of the former.  This supposed replication, however, is obviously untrue: despite high growth, the working population in India and China continues to consist predominantly of peasants (including the landless) and petty producers, pushed even deeper into distress by such growth.  Besides, this so-called levelling of differences across nations has strengthened, and not weakened, the position of first world capital.  Much of China’s export growth, for instance, which sustains its high growth, is accounted for by American corporations locating plants in China to export back to their home economy.  The capitals of these and other ’emerging economies’ too have grown stronger, but only by integrating themselves with metropolitan capital to the detriment of their own people.  Hence, the concept of imperialism has not lost importance either in its sociological aspect (capitalism encroaching upon pre-capitalist producers) or in its spatial aspect (capital from the metropolis imposing an order where it expropriates for itself resources and primary commodities from all over the world).
But isn’t obtaining resources from outside in lieu of one’s own products what ‘trade’ is all about?  Why should ‘trade’ be called ‘expropriation’?  This is because underlying what appears as normal ‘trade’ is a complex mechanism which deliberately compresses demand by the working people of the third world to ‘release’ exhaustible resources, and commodities producible only by the limited tropical land-mass, for the use of metropolitan capital.  In colonial times, such compression was through taxation by the colonial regime, and the ‘draining away’ without any quid pro quo of the commodity counterpart of such tax revenue.  Nowadays, such compression is through a variety of neo-liberal measures, all of which restrict purchasing power in the hands of the working people.
Such compression, the essence of imperialism, arises in turn from an asymmetry: these resources and commodities are either not producible at all or cannot be produced in sufficient quantities within the metropolitan countries, but the goods and services produced in the metropolis can, given time and appropriate arrangements, always be produced in third-world economies.
Communist practice must derive from theory, whose only test is correctness and not vote-catching capacity.  Their forgetting ‘imperialism’, as the panellists advised them to do, will not only make them indistinguishable from others and hence historically irrelevant, but also leave the resistance to imperialism, which is bound to occur anyway, to terrorists, religious fundamentalists, and the Osama bin Ladens.
The reform they must undertake is not to abandon the concept of ‘imperialism’, but the very opposite, that is, to be even more firm in adhering to it.  They must be even more vigilant that the basic classes whose interests they seek to defend — namely the workers, the peasants, the agricultural labourers — are provided relief rather than distress (through encroachments by imperialism and domestic corporate interests).  And for this they must ensure space within the party for debate, discussion and dissent, so that it becomes a thriving hub of intellectual activity, rather than a monolithic entity where a decision taken at the behest of some local satrap or bureaucrat in a Left-ruled state is defended, as revolutionary duty, by its members and sympathizers all over the country.
It may be asked: isn’t this what being ‘social democratic’ means?  The answer is ‘no’.  Rosa Luxemburg rejected social democracy and, along with Karl Liebknecht, was murdered by troops under a social democratic government; and she believed in no monoliths.  Nor did Lenin.  When the besieged and beleaguered revolutionary government under him signed the Treaty of Brest-Litovsk, over the objections of Bukharin and others, they brought out a theoretical journal, Kommunist, to attack the treaty, which the Bolshevik government or the party did not proscribe even in those times.  Greater space for dissent within the party is not synonymous with ‘social democracy’.  The advice to communists to become social democrats, therefore, though well-meant, reflects only the Indian elite’s own ‘adjustment’ with imperialism and distance from the working people.

Saturday, 21 March 2020

সংকট ও বামপন্থা

আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল ধারাবাহিকতার সাথে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার প্রতি তার অঙ্গীকারবদ্ধ থাকা, যা তাকে বাস্তবিকভাবেই একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রদান করে। 'সাম্রাজ্য'-এর চাইতে সাম্রাজ্যবাদ আরও বড়ো ব্যাপার, এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা কেবল বুশ বিরোধিতা, অথবা প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলের সৈন্য সমাবেশ বা ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন সেনানিবেশ-এর বিরোধিতা করার চেয়ে অনেক বড়ো ব্যাপার, সংক্ষেপে, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা কেবল সাম্প্রতিককালে আধিপত্যকামী শক্তির নেওয়া বিভিন্ন অবস্থানের বিরোধিতা করা নয়, এটা হল রাজনীতির প্রতি একটা সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিগত অবস্থান যা কিনা সমসময়ের প্রতিটি বিষয়কে বিশ্বজোড়া আধিপত্যকামী শ্রেণি সম্পর্কের জায়গা থেকে দেখে, এবং সিপিআই(এম) ও সাধারণভাবে বামপন্থীরাই ভারতবর্ষে একমাত্র শক্তি যারা কাজটি ধারাবাহিকভাবে করে চলেছে। এরা ভারত মার্কিন পরমাণু চুক্তিকে কেবলমাত্র একটি 'পরমাণু চুক্তি' হিসেবে দেখে না, বরং সর্বোপরি একে একটি 'ভারত-মার্কিন' চুক্তি হিসাবে দেখে। এরা এই চুক্তিকে কেবল খরচ ও লাভের নিরিখে নয় (যদিও চুক্তিটি এমনকি এই দিক থেকেও আপত্তিজনক) বরং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি কোন আগামীর ইঙ্গিত বহন করছে তার নিরিখেই মূল্যায়ন করে।

=================================================================

সন্ন্যাসীসুলভ নৈতিকতা এবং রাজনীতি থেকে সরে আসাটা, মূলগতভাবে দাঁড়িয়ে আছে এই বুদ্ধিজীবীদের রাজনীতি এবং রাজনীতির নোংরা দুনিয়া - যেখানে তাদের বিশ্বাসমতো দেবদূতেরা বাস করে না - তার প্রতি তাদের অবজ্ঞার ওপর। সুতরাং, এরা যার বিরোধিতা করতে চায়, তারই প্রতিবিম্বকে নির্মাণ করে, যেমন নয়া উদারনীতির দ্বারা সূচিত 'উন্নয়নের ধর্মাচার'। মনমোহন সিং বলেন : রাজনীতি হল নোংরা, রাজনীতির ঊর্দ্ধে ওঠো, 'উন্নয়ন'কে রাজনীতি থেকে আলাদা করো। বাম বিরোধী বুদ্ধিজীবীরাও বলেন : রাজনীতি হল নোংরা, রাজনীতির ঊর্দ্ধে ওঠো, 'উন্নয়ন'-এর বিরুদ্ধে লড়াইকে রাজনীতি থেকে আলাদা করো। রাজনীতির প্রতি এই অবজ্ঞা, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি ঘৃণা, আজ ভারতবর্ষে মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা বড়ো অংশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। ...

... সন্ন্যাসীসুলভ নৈতিকতার উত্থানও একই প্রবণতার অংশ, যেটা আসলে 'রাজনীতিকে ধ্বংস' করার একটা প্রক্রিয়া ব্যতীত আর কিছুই নয়। মধ্যবিত্ত নৈতিকতা কেবল বিভিন্ন সমস্যাকে তুলে ধরে, কোনো কর্মসূচিকে নয়। তারা একটা সমস্যা থেকে আরেকটা সমস্যায় বিচরণ করে এবং তারা কোনো সুব্যবস্থিত রাজনৈতিক ঐক্যের অনুপস্থিতিকেই কামনা করে। কেউ এটাকে "উত্তর আধুনিকতাবাদী রাজনীতি" বলতে পারেন, তবে আসলে এটা রাজনীতির অস্বীকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়।

=================================================================

কমিউনিস্টদের সাথে বেশিরভাগ এনজিওর সবচেয়ে নিকট পার্থক্যটি, ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের সাথে যুক্ত অত্যধিক প্রগতিশীলদের ধরলেও মূলত সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কিত। ইরাক যুদ্ধের বা মার্কিন হস্তক্ষেপ সমূহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, যা অনেক প্রগতিশীল এনজিও-ই করতে পারে, তা কিন্তু কোনোভাবেই এটা বোঝায় না যে সেটা সাম্রাজ্যবাদের ধারণাকে স্বীকার করে নিতে হচ্ছে (এমনকি যখন এই জাতীয় হস্তক্ষেপ সমূহের পেছনে থাকা বস্তুগত স্বার্থকেও বোঝা যাচ্ছে) যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ এগুলিকে কোনো কাহিনিপর্বের ঘটনা হিসেবে দেখবে। কমিউনিস্টরা সাম্রাজ্যবাদকে বিভিন্ন আকস্মিক কাহিনিপর্বের সংকলন হিসাবে নয়, বরং একটা গোটা ব্যবস্থা হিসাবে দেখে যা পুঁজিবাদের চরিত্র থেকেই উদ্ভূত।

=================================================================

কমিউনিস্ট প্রয়োগকে অবশ্যই তত্ত্ব থেকে আহরিত হতে হয়, যার একমাত্র পরীক্ষা হল সঠিকতা এবং কখনোই ভোট কুড়ানোর ক্ষমতা নয়। প্যানেলের সদস্যদের উপদেশ অনুযায়ী বামপন্থীরা 'সাম্রাজ্যবাদ'কে ভুলে গেলে তাদের সাথে অন্যদের কোনো পার্থক্য থাকবে না। তাই ব্যাপারটা ঐতিহাসিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক। তবে শুধু তাই নয়, তারা সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিরোধ করা ছেড়ে দিলেও সেই প্রতিরোধ কিন্তু কোনো না কোনোভাবে চলবেই, এবং সেটা সন্ত্রাসবাদী, ধর্মীয় মৌলবাদ এবং ওসামা বিন লাদেনের দ্বারা সংঘটিত হবে।


যে সংস্কার তাদের করতে হবে তা 'সাম্রাজ্যবাদ'-এর ধারণা পরিত্যাগ করে নয়, বরং তার উল্টো অর্থাৎ সেই ধারণার প্রতি আরও দৃঢ়ভাবে অনুগত থেকে। শ্রমিক, কৃষক, কৃষি শ্রমিক ইত্যাদি বুনিয়াদি শ্রেণিগুলি যাদের স্বার্থ বামপন্থীরা রক্ষা করতে চায় তারা যাতে দুর্দশার সম্মুখীন না হয়ে (সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এবং অভ্যন্তরীণ কর্পোরেট স্বার্থের কারণে) ত্রাণ পেতে পারে সেই বিষয়ে তাদের আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে। এবং তার জন্য তাদের অবশ্যই পার্টির অভ্যন্তরে বিতর্ক, আলোচনা এবং ভিন্নমতের জন্য পরিসর সুনিশ্চিত করতে হবে, যাতে এটি বৌদ্ধিক কার্যকলাপের সফল কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে, একটি একশিলীভূত সত্তার পরিবর্তে যেখানে কোনো বামশাসিত রাজ্যে আঞ্চলিক বড়োকর্তা বা আমলার আদেশে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সেই সিদ্ধান্তকে সারা দেশ জুড়ে এর সদস্যেরা সমর্থন করে এই কাজকে বিপ্লবী দায়িত্ব মনে করে। 

প্রশ্ন আসতে পারে যে সমাজগণতন্ত্রী বলতে যা বোঝায় এটা কী তাই-ই নয়? উত্তর হল 'না'। কার্ল লিবনেখট-দের সঙ্গে রোজা লুক্সেমবার্গ সমাজগণতন্ত্রকে পরিত্যাগ করেছিলেন এবং একটা সমাজগণতন্ত্রী সরকারের সৈন্যদের হাতেই মারা যান; এবং তিনি একশিলীভূত সংগঠনে বিশ্বাসও করতেন না। লেনিন এতেও বিশ্বাস করতেন না। যখন তাঁর নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী সরকার অবরুদ্ধ পরিস্থিতিই ব্রেস্ত লিতভস্ক-এর চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, বুখারিন এবং অন্যান্যদের আপত্তি সত্ত্বেও, তখন তারা কমিউনিস্ট নামে একটা তাত্ত্বিক পত্রিকা প্রকাশ করে এই চুক্তিকে আক্রমণ করার জন্য, যেটা এমনকি ঐ সময়েও বলশেভিক সরকার বা পার্টি নিষিদ্ধ করেনি। পার্টির মধ্যে ভিন্ন মতের জন্য বৃহত্তর পরিসর থাকার সঙ্গে 'সমাজগণতন্ত্র' সমার্থক নয়। কমিউনিস্টদের প্রতি সমাজগণতন্ত্রীতে রূপান্তরিত হওয়ার উপদেশটি তাই, খুব সৎ অর্থে ধরলেও, ভারতীয় এলিটদের সাম্রাজ্যবাদের সাথে 'আপস' করা এবং শ্রমজীবী জনতার থেকে দূরত্ব বজায় রাখার মানসিকতারই প্রতিফলন মাত্র।

=================================================================

একটা আন্তর্জাতিকতাবাদী আন্দোলনরূপে কমিউনিজম এমন এক সময়ে বিকাশলাভ করেছিল যখন পুঁজিবাদী দেশগুলি উগ্র জাতীয়তাবাদকে মাহাত্ম্যদানকারী এক বিশ্বযুদ্ধে লিপ্ত। যুদ্ধরত দেশগুলোর শ্রমিকদের যাতে লগ্নিপুঁজির স্বার্থে যুদ্ধক্ষেত্রের ট্রেঞ্চে অপরকে খতম না করতে হয়, তাই লেনিনের তোলা 'সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত করা'র স্লোগান বা শান্তির পক্ষে ইউরোপীয় শ্রমিকদের আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য রোজা লুক্সেমবার্গ-এর স্লোগান পুঁজিবাদীদের দ্বারা পুষ্ট উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকতাবাদের পতাকা উড়িয়েছিল।

যে লগ্নিপুঁজির বিরুদ্ধে তারা শ্রমিকদের সংগঠিত করছিল তা ছিল জাতীয় লগ্নিপুঁজি, ব্রিটিশ, জার্মান অথবা ফরাসি। রুডলফ হিলফারডিং তাঁর বিখ্যাত কাজ 'ডাস ফিনাঞ্জ ক্যাপিটাল'-এ যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন বা এরিখ মারিয়া রিমার্ক তাঁর ধ্রুপদী রচনা 'অল কোয়াইট অন দ্য ওয়স্টার্ন ফ্রন্ট'-এ যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তা অনুযায়ী এই লগ্নিপুঁজির মতাদর্শ হল 'জাতীয়তার ধারণা'-কে গৌরবান্বিত করা। সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিকতাবাদ পুঁজিবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল; এবং দেশগুলিতে জাতীয় পুঁজির আধিপত্যের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে সংগঠিত করার কাজটি কমিউনিস্টদের জন্য কোনো তাত্ত্বিক সমস্যার সৃষ্টি করেনি।


সমসাময়িক বিশ্বায়নের অনিবার্য ফলস্বরূপ যা ঘটল তা হল লগ্নিপুঁজির বিশ্বায়ন যেটি আবার অন্ধ দেশপ্রেমকে নয়, বরং একটি নিজস্ব ব্রান্ডের আন্তর্জাতিকতাবাদকে মদত জোগাল। এবং সংকটের প্রেক্ষিতে বিকল্প কর্মসূচির জন্য কোনো একটি দেশের জনসাধারণকে সংগঠিত করা মানে আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা, যার অর্থ জাতীয়তাবাদেই পিছিয়ে আসা এবং সমসাময়িক লগ্নি পুঁজি কথিত আন্তর্জাতিকতাবাদের কবল থেকে একটি বিশেষ জাতি রাষ্ট্র, যেটিকে বামপন্থীরা দখল করার আশা করছে, সেটির তত্ত্বাবধানে জাতিটির বিচ্ছিন্নকরণ। এটাই বামপন্থীদের উভয় সংকটের মধ্যে ফেলছে।

=================================================================


প্রথম বাধা শহুরে মধ্যবিত্তের ভূমিকা। ভারতে কৃষকশ্রেণির সমর্থন হারাবার আশঙ্কায় শঙ্কিত পুঁজিবাদ শহুরে মধ্যবিত্তের সমর্থন নিজের দিকে টানতে সমর্থ হয়েছে। এই শহুরে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় বিশ্বায়ন ও তার নয়া উদারপন্থী নীতিতে উপকৃত। এখানকার অবস্থা লাতিন আমেরিকার মত নয় যেখানে মুক্ত অর্থনীতি বস্তুত গভীর আর্থিক সংকট তৈরি করে যারা ভুক্তভোগী কেবল শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেত মজুর নয় শহুরে মধ্যবিত্তশ্রেণিও। ভারতে নয়া-উদারপন্থার আমলে তেমন কোনো গভীর সংকট সৃষ্টি হয়নি যা শহুরে মধ্যবিত্তকে এই ব্যবস্থা সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ করতে পারে।

নয়া উদারপন্থার এই সদ্যপ্রাপ্ত সমর্থন ভিতটি ব্যাঙ্গার্থে বামপন্থী হস্তক্ষেপেরই  ফল (যদিও এর অর্থ এই নয় যে বামপন্থীদের হস্তক্ষেপ ঠিক ছিল না)। মুক্ত অর্থনীতি এবং দেশি বিনিময়মূল্যে স্বাধীনভাবে বিদেশি অর্থ সম্পদে পরিণত করার প্রয়াসের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের সফল প্রতিরোধে অর্থনীতি উপকৃত হয়েছে। একমাত্র চিন ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য প্রতিটি বৃহৎ অঞ্চল যে আর্থিক সংকটে ভুক্তভোগী এর ফলে তা এড়ানো গেছে। এর দরুন এখনও পর্যন্ত উৎপাদক অর্থনীতির ঊর্দ্ধমুখী বৃদ্ধির হার বজায় রাখার সম্ভব হয়েছে। এতে শ্রমিকশ্রেণি, কৃষক, ক্ষেত মজুর, ক্ষুদ্র উৎপাদকরা লাভবান হয়নি কিন্তু বৃহৎ বুর্জোয়াশ্রেণি ছাড়া উপকৃত হয়েছে ভারতের শহর ও গ্রামের 'বিত্তবান শ্রেণি', ভূস্বামী, পর্যাপ্ত পুঁজির মালিক, শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ফলে নয়া-উদারপন্থী জামানায় এদের আগ্রহ বেড়েছে এবং এরাই বৃহৎ বুর্জোয়াদের প্রধান নয়া ভরসা এবং সাম্রাজ্যবাদের স্থানীয় সমর্থনের উৎস।

এটাই লাতিন আমেরিকার সঙ্গে ভারতের প্রধান পার্থক্য যা থেকে বুঝে নেওয়া যায় কেন লাতিন আমেরিকান বামপন্থা আজ ঊর্ধ্বমুখী অথচ ভারতীয় বামপন্থা সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। নয়া-উদারপন্থার লাভবান শহুরে মধ্যবিত্তের সমর্থন হারানো ভারতীয় বামেরা এবং এখনও অবধি কৃষকশ্রেণির সমর্থন জোগাড়ে অসমর্থ নতুন পরিস্থিতিতে যা দ্রুত প্রত্যাশিত।


শহুরে মধ্যবিত্তের গুরুত্ব কেবলমাত্র তার সংখ্যায় নয়। আসলে এটা সেই শ্রেণি যা থেকে শিক্ষিত, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি, বিদ্বজ্জন, জনমত তৈরি করা মানুষজনদের সংগ্রহ করা হয়। এই শ্রেণি যেমন সর্বহারার মাঝে বিপ্লবী তত্ত্বের বার্তাবহ উপাদান তৈরি করে তেমনই ওই সর্বহারাদের মাঝে পুঁজির দাসত্ব তত্ত্বের বাহক উপাদান তৈরির ভূমিকাও নিতে পারে। যে-কোনো সন্ধিলগ্নে শহুরে মধ্যবিত্তর এ দুই সত্তার কোনটি প্রকট হবে অন্যান্য বহু কারণের মধ্যে তা নির্ভর করে তার নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার উপর। সুতরাং ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে বামপন্থার এক অংশে প্রভাব খাটিয়ে তাকে ঐতিহাসিক লক্ষ্যচ্যুত করে পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলনের তাত্ত্বিক ক্ষতি করতে সক্ষম শহুরে মধ্যবিত্ত।

=================================================================

কেউ কেউ যুক্তি দর্শাবেন সংসদীয় রাজনীতির এটাই অবশ্যম্ভাবী ফল। সেটা কিন্তু একেবারেই অযৌক্তিক। লেনিন বরাবর এ বিষয়ে জোর দিয়েছেন যে বিপ্লবী রাজনীতি তখনই উৎকর্ষ পায় যখন বিপ্লবী শক্তিগুলি পূর্ণ স্বাধীনভাবে ক্রিয়াশীল। যে কারণে সমাজের 'বুনিয়াদি শ্রেণিদের' হয়ে সওয়াল করা দলগুলিকে সক্রিয় ভূমিকা নেবার যে স্বাধীনতা সংসদীয় গণতন্ত্র দেয় তা সংকুচিত করতে বুর্জোয়াগোষ্ঠী সদা তৎপর। সুতরাং সংসদীয় গণতন্ত্র বর্জনের পরিবর্তে বামেদের ভূমিকা হওয়া উচিত একদিকে এই সংগঠনগুলিতে অংশ নেওয়া এবং অন্যদিকে সেগুলির গণতান্ত্রিক উপাদান বর্ধিত করতে লড়াই জারি রাখা। এটি এতটাই মার্কসবাদী চেতনার সঙ্গে জড়িত যে রোজা লুক্সেমবার্গের মতো বিপ্লবীও বস্তুত চেয়েছিলেন তাঁর দোল জার্মানির সংসদীয় নির্বাচনে অংশ নিক।

Tuesday, 14 January 2020

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও দেশদ্রোহী আরএসএস

১২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ যখন গোলওয়ালকার গান্ধীর সাথে দেখা করতে গেলেন, তখনো তাঁর উদ্দেশ্য ছিল দ্বিচারিতা। তাঁদের বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগের কথা তুলে গোলওয়ালকার জানালেন যে তাঁদের সংগঠন মোটেই মুসলান হত্যার সংগঠন নয়। কেবলই হিন্দুদের সুরক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি একটি সংগঠন মাত্র। তাঁরা শান্তির পক্ষে। তাঁরা কারো বিরোধী নন। প্যারেলাল লিখছেন স্বভাবসিদ্ধ ব্যঙ্গের সাথে, "এটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল।"
গান্ধী তখন তাঁকে বলেন, তাই যদি সত্যি হয় তাহলে সঙ্ঘের মুসলমান হত্যার বিরোধিতায় জোরালো আওয়াজ তোলা উচিত।
ধূর্ত গোলওয়ালকার! তিনি গান্ধীকে অনুরোধ করেন, সঙ্ঘের হয়ে তিনিই না হয় সেই কথা বলে দিন!
নোয়াখালির দাঙ্গা থামাতে একলা হেঁটেছিলেন যে মানুষটি, তাঁর মুখ থেকে এই কথা শুনলে দেশের মানুষ সঙ্ঘের সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তন করবেন, এই নিয়ে সন্দেহ কি?
গান্ধী তাও বললেন, যদি তাঁরা অন্তর থেকে এই কথা অনুভব করে থাকেন, তাহলে তাঁদের মুখ থেকেই এ কথা জনগণের কাছে পৌঁছলে ভালো হয়। তিনি রাজি হলেন সঙ্ঘের ১৬ই সেপ্টেম্বরের জনসভায় আসতে। সেই জনসভায় গান্ধী সঙ্ঘের কর্মীদের বলেন, "হিন্দুরা যদি বিশ্বাস করেন যে ভারতবর্ষে অহিন্দুদের সম্মানের ও সমানাধিকারের সাথে বাঁচবার অধিকার নেই, যদি তাঁরা বিশ্বাস করেন যে মুসলমানদের ভারতবর্ষে থাকতে হলে হীন হয়েই থাকতে হবে, অথবা যদি মুসলমানরা মনে করেন যে পাকিস্তানে হিন্দুদের কেবলমাত্র মুসলমান প্রভুদের দাস হয়েই থাকতে হবে, তাহলে হিন্দু এবং ইসলাম, দুই ধর্মেই সূর্যগ্রহণের মতো অন্ধকার নেমে আসবে।"
সেদিন গোলওয়ালকার গান্ধীকে মহান হিন্দু বলে সম্মানিত করেন। অথচ তার মাত্র তিন মাস পরে, রোহতক রোডের বিশাল জনসভায়, সুর পালটে ফেললেন গোলওয়ালকার!
সুর যে তিনি পাল্টাবেন, এটা প্রত্যাশিতই ছিল। এর অনেক পরে, যখন 'বাঞ্চ অফ থটস' বইটা প্রকাশ হয়, সেখানে গোলওয়ালকার পরিষ্কার ভাষায় লেখেন, "যারা বলেছিল হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ছাড়া স্বরাজ সম্ভব নয়, তারা আমাদের সমাজের সাথে সব থেকে বেশি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।"
এই স্লোগান কার স্লোগান? অবশ্যই মহাত্মা গান্ধীর!
রোহতক রোডের এই জনসভা সম্পর্কে সিআইডি আগেই সরকারকে সতর্ক করেছিল। মথুরা থেকে একটি রিপোর্ট আসে যে ৮ই ডিসেম্বরের জনসভায় সারা ভারত থেকে সঙ্ঘের ডেলিগেটরা আসবেন। সেখানে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি তৈরি করা হবে। কী সেই কর্মসূচি? উপস্থিত ২,৫০০ স্বয়ংসেবকের সামনে গোলওয়ালকার ঘোষণা করেন যে শিবাজির অনুকরণে গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার সময় এসেছে। যে দল পরাধীন ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি, তারা করবে গেরিলা যুদ্ধ। তাও স্বাধীন ভারতে? কেন? কার বিরুদ্ধে?
গোলওয়ালকার দাবি করেন যে "পাকিস্তানকে শেষ না করা পর্যন্ত সঙ্ঘ বিশ্রাম নেবে না। কেউ যদি পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়, তাকেও শেষ করে দিতে হবে। সে নেহেরু সরকার হোক বা অন্য কোন সরকার। সঙ্ঘকে হার মানানো যাবে না। সঙ্ঘ সঙ্ঘের কাজ করে যাবে।"
সঙ্ঘ শেষ করবে পাকিস্তানকে? সেটা কেমন করে সম্ভব? পাঠক ভুল বুঝবেন না। এর মানে এই নয় যে সঙ্ঘ-নির্মিত কোন সেনাবাহিনী সদ্যোজাত পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিল সেই সময়ে! যে বৃহৎ সংখ্যক মুসলমান দেশভাগের পরেও তাঁদের মাতৃভূমি ভারতবর্ষের নাগরিক হয়ে এদেশেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাঁদের উদ্দেশ্যেই এই হুঁশিয়ারি। এই জনসভাতেই গোলওয়ালকার বলেন, "পৃথিবীর কোনো শক্তি মুসলমানদের ভারতবর্ষে সুরক্ষিত রাখতে পারবে না। দেশ ওদের ছাড়তেই হবে।"
এর পরেও কারো মনে কোনো দ্বিধা থাকতে পারে কি?
তিন মাস আগে যে ব্যক্তিকে তিনি মহান হিন্দু সন্তান বলেছিলেন, যাঁকে সামনে রেখে ভেবেছিলেন সামাজিক স্বীকৃতি পাওয়া যাবে, সেই গান্ধীকেই গোলওয়ালকার চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ করলেন সেইদিন। বললেন, "গান্ধী এ দেশে মুসলমানদের রাখতে চেয়েছিলেন কারণ তাহলে কংগ্রেস মুসলমানদের ভোট পেয়ে ভোটে জিততে পারে। কিন্তু ভোটের সময় আসা পর্যন্ত এ দেশে একজনও মুসলমান পড়ে থাকবে না। যদি তাদের জোর করে এখানে রাখা হয়, তার দায়িত্ব সরকারের। হিন্দু সমাজের কোনো দায় নেই। গান্ধী আরএসএস-কে ভুল পথ দেখিয়ে বিভ্রান্ত করতে পারবেন না।"
এই বক্তব্যের শেষটুকু শুনলে শিউরে উঠতে হয়। গোলওয়ালকার বলেন, "এরকম লোকেদের চুপ করানোর অনেক উপায় আছে আমাদের। কিন্তু এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া, যার দ্বারা হিন্দু সমাজের ক্ষতি হতে পারে, আমাদের ঐতিহ্যের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু আমাদের যদি জোর করা হয় আমরা সেই পথ নিতেও পিছপা হব না।"
ইঙ্গিত খুব পরিষ্কার।
এর দু'মাস পরে গান্ধী নিহত হন। আততায়ীর নাম নাথুরাম গডসে। পরিচয়? হিন্দু মহাসভার কর্মী ও সঙ্ঘের স্বয়ংসেবক।


==============================================================================


"সঙ্ঘের দৈনন্দিন কাজ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়েও নিয়মমাফিক চলেছিল। সঙ্ঘ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে (ভারত ছাড়ো-তে) সরাসরি অংশগ্রহণ করা হবে না। তবে সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকদের মনে উথাল-পাথাল চলছিল তো বটেই। "সঙ্ঘ একেবারেই নিষ্ক্রিয় ব্যক্তিদের সংগঠন। ওদের কথাবার্তার কোন মূল্য নেই।" শুধু বাইরের লোকজন নয়, আমাদের স্বয়ংসেবকরাও অনেকে এরকম কথাবার্তাই বলতো। তারাও অনেকে খুবই বিরক্ত হয়েছিল।"

এই কথাগুলো আর কারো নয়, স্বয়ং 'গুরুজি'র লেখা!

বাইরের জগৎ তো দূরের কথা, নিজের স্বয়ংসেবকদেরকেই ঘৃণা-হতাশার পথে ঠেলে দিয়েও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ না করবার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন 'গুরুজি' গোলওয়ালকার। কিন্তু কেন?

তাঁর নিজের জবানীতেই দেখা যাক। 'গুরুজি' বলছেন, "যেই ব্যক্তিরা শহীদ হয়েছেন, তাঁরা যে বীর সন্দেহ নেই। তাঁদের আদর্শকে আমরা যথার্থভাবে পুরুষালি আদর্শ হিসেবেও মেনে নিতে পারি। সাধারণ মানুষ, যারা নেহাতই ভয়ে ভয়ে ভবিতব্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে, তাদের থেকে অনেক উপরে এনারা। কিন্তু তা সত্ত্বেও এমন মানুষদের আমরা সামাজিক আদর্শ হিসেবে মনে করতে পারি না। আমরা এ কথা বলতে পারি না যে তাঁদের শাহাদতই মানুষের জীবনের আদর্শ হওয়া উচিত। নিজেদের আদর্শ তাঁরা পরিপূর্ণ করে যেতে সক্ষম যখন হননি, অতএব আমাদের এটা মানতেই হবে যে তাঁদের মধ্যে কোনোপ্রকারের ত্রুটি নিশ্চয়ই ছিল।"

অর্থাৎ, স্বাধীনতা সংগ্রামে মৃত্যুবরণ করা অসংখ্য ভারতবাসীর মৃত্যু বেদনাদায়ক হলেও তাঁরা কেউই সামাজিক আদর্শ হিসেবে গণ্য হতে পারেন না! তাঁদের আদর্শ কোনভাবেই সঙ্ঘের আদর্শ হতে পারে না! তাঁরা হলেনই বা শহীদ, হলেনই বা বীর। তাঁদের পথের হাঁটার কোনো প্রশ্নই ওঠে না!

পূর্ণ স্বরাজের দাবীতে সারা দেশ তখন "করো অথবা মরো" ধ্বনিতে মাতোয়ারা। সেই সময় 'গুরুজি'র মুখে এরকম কথা? শহীদের আদর্শ কখনো সঙ্ঘের আদর্শ হতে পারে না? কেন?

আসলে ইংরেজ প্রভুদের প্রিয়পাত্র হতে চেয়ে হিন্দু-বনাম-মুসলমান সংঘাতের যে চিত্র সাভারকার এঁকেছিলেন, অসহযোগ-উত্তর দেশে যে সংঘাতকে হেড়গেওয়ার বেছে নিয়েছিলেন, সেই সংঘাতেরই পূর্ণ চরিত্রায়ণ করেছিলেন তাঁদের সুযোগ্য উত্তরসূরি মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার। 'বাঞ্চ অফ থটস' বলে তাঁর লেখা বইটাতে এই চরিত্রায়ণ প্রসঙ্গে কোনো রাখঢাক না করে প্রকাশ্যেই তিনি বলেছেন যে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অঞ্চল-ভিত্তিক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেন না। কেউ ভারতবর্ষের বাসিন্দা বলেই যে সে সত্যিকারের ভারতীয় হিসেবে গণ্য হবে, এ কথা তিনি মানেন না। সত্যিকারের জাতীয় সত্ত্বা কেবলমাত্র সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বন্ধনে আবদ্ধ হলেই গড়ে তোলা সম্ভব। অতএব ভারতবর্ষের সকল বাসিন্দাদের মধ্যেও সত্যিকারের ভারতীয় কেবল হিন্দুরাই, কারণ তাঁদের পূর্বপুরুষেরাই এই দেশের সংস্কৃতিকে গড়ে তুলেছিলেন।

এই বিচিত্র তত্ত্ব গড়ে তুলতে গিয়ে কখনো তিনি বলছেন আর্য-সন্তান হিন্দুরা ভারতবর্ষের আদিবাসী, কখনো বা হিটলারের জার্মানির তারিফ করছেন, কখনো আবার ইহুদিদের ইজরায়েল রাষ্ট্র গড়ার দাবিকে সমর্থন করছেন। কখনো আবার তিনি এটাও বলছেন যে "ভারতবর্ষের অহিন্দু মানুষজনকে হয় হিন্দুদের সংস্কৃতি ও ভাষা শিখতে হবে। তাঁদের হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে জানতে হবে ও হিন্দু ধর্মকে সন্মান করতে হবে ... মোট কথা, তাঁদের ভিনদেশি সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে ভারতীয় হয়ে উঠতে হবে। অথবা তাঁদের এ দেশে থাকতে হবে হিন্দু জাতির অধীনে। কোনো চাহিদা বা কোনো অধিকার ছাড়া। এমনকি নাগরিক অধিকারও দেওয়া হবে না তাঁদের।"

এ তো দর্শন নয়, এ তো সর্বনাশা ঘৃণার প্রলাপ!

আজকের দিনে 'ঘর ওয়াপসি'র নামে আমজনতাকে উত্যক্ত করে যারা, তাদের মুখের ভাষা এখান থেকেই এসেছে।

যে সময়ে ভারতবর্ষে ভিনদেশি ইংরেজ সরকার আমজনতার আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে শাসন ও শোষণ করছে, সে সময়েই বসে গোলওয়ালকার কেমন করে যেন ভিনদেশি শত্রু খুঁজে পেলেন ইংরেজদের মধ্যে নয়, ভারতীয় মুসলমান, খ্রিস্টান ও কমিউনিস্টদের মধ্যে! যে সময়ে সাধারণ মানুষের ঐক্যই স্বাধীনতার একমাত্র পথ, সে সময়ে সেই একতার স্বপ্নের মধ্যেই গোলওয়ালকার ভারত-বিরোধী 'ষড়যন্ত্র' খুঁজে পেলেন! বললেন, "ইংরেজ বিরোধিতাকে ভাবা হল দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ। এই প্রতিক্রিয়াশীল দর্শনের ভয়াবহ প্রভাব সমগ্র স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর, নেতাদের উপর, এবং আপামর দেশবাসীর উপর পড়েছিল।"

শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এটাই সত্যি।

শোনা যায় দেশের কিছু কিছু অংশে সঙ্ঘের কর্মীরা নিজেদের অন্তরাত্মার ডাককে ফেলতে না পেরে আন্দোলনের পথে নেমেছিলেন। 'গুরুজি'কে অগ্রাহ্য করে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের নিজস্ব রিপোর্টেই পরিষ্কার, ১৯৪০-এর সেই উত্তাল দশকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনো কর্মসূচীতেই অংশগ্রহণ করেনি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে ইংরেজ সরকার অতএব নিষিদ্ধ ঘোষণা করার কোনো কারণই দেখেনি। দেশের সমস্ত নেতা যখন কোনো না কোনো জেলে বন্দি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের নেতারা তখনও বহাল তবিয়তে রয়েছেন।



==============================================================================



রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও তার পরিবারের অনুগামীরা আজকে অনেকেই ভগৎ সিংকে আপন করে নিতে উৎসুক। হয়তো তাঁরা আর মনে রাখতে চান না যে ভগৎ সিং যখন কারাবন্দি, সেই সময়ে তাঁর সহকর্মী - পরবর্তীকালে প্রখ্যাত হিন্দি লেখক - যশপাল, বিনায়কের দাদা গণেশ সাভারকারের সাথে দেখা করে তাঁদের বিপ্লবী কাজকর্ম ও ভগৎ সিং -সুখদেব-রাজগুরুদের পক্ষে আইনি লড়াইয়ের জন্য আর্থিক সহযোগিতা চান। গণেশ সাভারকার তাঁদের ৫০,০০০ টাকা দিতে রাজি ছিলেন - শুধু যদি তাঁরা মহম্মদ আলি জিন্নাহকে খুন করতে রাজি হন! চন্দ্রশেখর আজাদ সেই চাহিদা শুনে বলেছিলেন, " এই লোকটা (গণেশ সাভারকার) আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামী নয়, সুপারি নেওয়া খুনি মনে করে। ও ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়েছে। আমাদের লড়াই ইংরেজদের বিরুদ্ধে। আমরা মুসলমানদের মারবো কেন? ওকে বলে দিও ওর টাকার প্রয়োজন নেই আমাদের।"