Tuesday, 14 January 2020

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও দেশদ্রোহী আরএসএস

১২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ যখন গোলওয়ালকার গান্ধীর সাথে দেখা করতে গেলেন, তখনো তাঁর উদ্দেশ্য ছিল দ্বিচারিতা। তাঁদের বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগের কথা তুলে গোলওয়ালকার জানালেন যে তাঁদের সংগঠন মোটেই মুসলান হত্যার সংগঠন নয়। কেবলই হিন্দুদের সুরক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি একটি সংগঠন মাত্র। তাঁরা শান্তির পক্ষে। তাঁরা কারো বিরোধী নন। প্যারেলাল লিখছেন স্বভাবসিদ্ধ ব্যঙ্গের সাথে, "এটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল।"
গান্ধী তখন তাঁকে বলেন, তাই যদি সত্যি হয় তাহলে সঙ্ঘের মুসলমান হত্যার বিরোধিতায় জোরালো আওয়াজ তোলা উচিত।
ধূর্ত গোলওয়ালকার! তিনি গান্ধীকে অনুরোধ করেন, সঙ্ঘের হয়ে তিনিই না হয় সেই কথা বলে দিন!
নোয়াখালির দাঙ্গা থামাতে একলা হেঁটেছিলেন যে মানুষটি, তাঁর মুখ থেকে এই কথা শুনলে দেশের মানুষ সঙ্ঘের সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তন করবেন, এই নিয়ে সন্দেহ কি?
গান্ধী তাও বললেন, যদি তাঁরা অন্তর থেকে এই কথা অনুভব করে থাকেন, তাহলে তাঁদের মুখ থেকেই এ কথা জনগণের কাছে পৌঁছলে ভালো হয়। তিনি রাজি হলেন সঙ্ঘের ১৬ই সেপ্টেম্বরের জনসভায় আসতে। সেই জনসভায় গান্ধী সঙ্ঘের কর্মীদের বলেন, "হিন্দুরা যদি বিশ্বাস করেন যে ভারতবর্ষে অহিন্দুদের সম্মানের ও সমানাধিকারের সাথে বাঁচবার অধিকার নেই, যদি তাঁরা বিশ্বাস করেন যে মুসলমানদের ভারতবর্ষে থাকতে হলে হীন হয়েই থাকতে হবে, অথবা যদি মুসলমানরা মনে করেন যে পাকিস্তানে হিন্দুদের কেবলমাত্র মুসলমান প্রভুদের দাস হয়েই থাকতে হবে, তাহলে হিন্দু এবং ইসলাম, দুই ধর্মেই সূর্যগ্রহণের মতো অন্ধকার নেমে আসবে।"
সেদিন গোলওয়ালকার গান্ধীকে মহান হিন্দু বলে সম্মানিত করেন। অথচ তার মাত্র তিন মাস পরে, রোহতক রোডের বিশাল জনসভায়, সুর পালটে ফেললেন গোলওয়ালকার!
সুর যে তিনি পাল্টাবেন, এটা প্রত্যাশিতই ছিল। এর অনেক পরে, যখন 'বাঞ্চ অফ থটস' বইটা প্রকাশ হয়, সেখানে গোলওয়ালকার পরিষ্কার ভাষায় লেখেন, "যারা বলেছিল হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ছাড়া স্বরাজ সম্ভব নয়, তারা আমাদের সমাজের সাথে সব থেকে বেশি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।"
এই স্লোগান কার স্লোগান? অবশ্যই মহাত্মা গান্ধীর!
রোহতক রোডের এই জনসভা সম্পর্কে সিআইডি আগেই সরকারকে সতর্ক করেছিল। মথুরা থেকে একটি রিপোর্ট আসে যে ৮ই ডিসেম্বরের জনসভায় সারা ভারত থেকে সঙ্ঘের ডেলিগেটরা আসবেন। সেখানে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি তৈরি করা হবে। কী সেই কর্মসূচি? উপস্থিত ২,৫০০ স্বয়ংসেবকের সামনে গোলওয়ালকার ঘোষণা করেন যে শিবাজির অনুকরণে গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার সময় এসেছে। যে দল পরাধীন ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি, তারা করবে গেরিলা যুদ্ধ। তাও স্বাধীন ভারতে? কেন? কার বিরুদ্ধে?
গোলওয়ালকার দাবি করেন যে "পাকিস্তানকে শেষ না করা পর্যন্ত সঙ্ঘ বিশ্রাম নেবে না। কেউ যদি পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়, তাকেও শেষ করে দিতে হবে। সে নেহেরু সরকার হোক বা অন্য কোন সরকার। সঙ্ঘকে হার মানানো যাবে না। সঙ্ঘ সঙ্ঘের কাজ করে যাবে।"
সঙ্ঘ শেষ করবে পাকিস্তানকে? সেটা কেমন করে সম্ভব? পাঠক ভুল বুঝবেন না। এর মানে এই নয় যে সঙ্ঘ-নির্মিত কোন সেনাবাহিনী সদ্যোজাত পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিল সেই সময়ে! যে বৃহৎ সংখ্যক মুসলমান দেশভাগের পরেও তাঁদের মাতৃভূমি ভারতবর্ষের নাগরিক হয়ে এদেশেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাঁদের উদ্দেশ্যেই এই হুঁশিয়ারি। এই জনসভাতেই গোলওয়ালকার বলেন, "পৃথিবীর কোনো শক্তি মুসলমানদের ভারতবর্ষে সুরক্ষিত রাখতে পারবে না। দেশ ওদের ছাড়তেই হবে।"
এর পরেও কারো মনে কোনো দ্বিধা থাকতে পারে কি?
তিন মাস আগে যে ব্যক্তিকে তিনি মহান হিন্দু সন্তান বলেছিলেন, যাঁকে সামনে রেখে ভেবেছিলেন সামাজিক স্বীকৃতি পাওয়া যাবে, সেই গান্ধীকেই গোলওয়ালকার চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ করলেন সেইদিন। বললেন, "গান্ধী এ দেশে মুসলমানদের রাখতে চেয়েছিলেন কারণ তাহলে কংগ্রেস মুসলমানদের ভোট পেয়ে ভোটে জিততে পারে। কিন্তু ভোটের সময় আসা পর্যন্ত এ দেশে একজনও মুসলমান পড়ে থাকবে না। যদি তাদের জোর করে এখানে রাখা হয়, তার দায়িত্ব সরকারের। হিন্দু সমাজের কোনো দায় নেই। গান্ধী আরএসএস-কে ভুল পথ দেখিয়ে বিভ্রান্ত করতে পারবেন না।"
এই বক্তব্যের শেষটুকু শুনলে শিউরে উঠতে হয়। গোলওয়ালকার বলেন, "এরকম লোকেদের চুপ করানোর অনেক উপায় আছে আমাদের। কিন্তু এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া, যার দ্বারা হিন্দু সমাজের ক্ষতি হতে পারে, আমাদের ঐতিহ্যের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু আমাদের যদি জোর করা হয় আমরা সেই পথ নিতেও পিছপা হব না।"
ইঙ্গিত খুব পরিষ্কার।
এর দু'মাস পরে গান্ধী নিহত হন। আততায়ীর নাম নাথুরাম গডসে। পরিচয়? হিন্দু মহাসভার কর্মী ও সঙ্ঘের স্বয়ংসেবক।


==============================================================================


"সঙ্ঘের দৈনন্দিন কাজ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়েও নিয়মমাফিক চলেছিল। সঙ্ঘ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে (ভারত ছাড়ো-তে) সরাসরি অংশগ্রহণ করা হবে না। তবে সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকদের মনে উথাল-পাথাল চলছিল তো বটেই। "সঙ্ঘ একেবারেই নিষ্ক্রিয় ব্যক্তিদের সংগঠন। ওদের কথাবার্তার কোন মূল্য নেই।" শুধু বাইরের লোকজন নয়, আমাদের স্বয়ংসেবকরাও অনেকে এরকম কথাবার্তাই বলতো। তারাও অনেকে খুবই বিরক্ত হয়েছিল।"

এই কথাগুলো আর কারো নয়, স্বয়ং 'গুরুজি'র লেখা!

বাইরের জগৎ তো দূরের কথা, নিজের স্বয়ংসেবকদেরকেই ঘৃণা-হতাশার পথে ঠেলে দিয়েও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ না করবার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন 'গুরুজি' গোলওয়ালকার। কিন্তু কেন?

তাঁর নিজের জবানীতেই দেখা যাক। 'গুরুজি' বলছেন, "যেই ব্যক্তিরা শহীদ হয়েছেন, তাঁরা যে বীর সন্দেহ নেই। তাঁদের আদর্শকে আমরা যথার্থভাবে পুরুষালি আদর্শ হিসেবেও মেনে নিতে পারি। সাধারণ মানুষ, যারা নেহাতই ভয়ে ভয়ে ভবিতব্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে, তাদের থেকে অনেক উপরে এনারা। কিন্তু তা সত্ত্বেও এমন মানুষদের আমরা সামাজিক আদর্শ হিসেবে মনে করতে পারি না। আমরা এ কথা বলতে পারি না যে তাঁদের শাহাদতই মানুষের জীবনের আদর্শ হওয়া উচিত। নিজেদের আদর্শ তাঁরা পরিপূর্ণ করে যেতে সক্ষম যখন হননি, অতএব আমাদের এটা মানতেই হবে যে তাঁদের মধ্যে কোনোপ্রকারের ত্রুটি নিশ্চয়ই ছিল।"

অর্থাৎ, স্বাধীনতা সংগ্রামে মৃত্যুবরণ করা অসংখ্য ভারতবাসীর মৃত্যু বেদনাদায়ক হলেও তাঁরা কেউই সামাজিক আদর্শ হিসেবে গণ্য হতে পারেন না! তাঁদের আদর্শ কোনভাবেই সঙ্ঘের আদর্শ হতে পারে না! তাঁরা হলেনই বা শহীদ, হলেনই বা বীর। তাঁদের পথের হাঁটার কোনো প্রশ্নই ওঠে না!

পূর্ণ স্বরাজের দাবীতে সারা দেশ তখন "করো অথবা মরো" ধ্বনিতে মাতোয়ারা। সেই সময় 'গুরুজি'র মুখে এরকম কথা? শহীদের আদর্শ কখনো সঙ্ঘের আদর্শ হতে পারে না? কেন?

আসলে ইংরেজ প্রভুদের প্রিয়পাত্র হতে চেয়ে হিন্দু-বনাম-মুসলমান সংঘাতের যে চিত্র সাভারকার এঁকেছিলেন, অসহযোগ-উত্তর দেশে যে সংঘাতকে হেড়গেওয়ার বেছে নিয়েছিলেন, সেই সংঘাতেরই পূর্ণ চরিত্রায়ণ করেছিলেন তাঁদের সুযোগ্য উত্তরসূরি মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার। 'বাঞ্চ অফ থটস' বলে তাঁর লেখা বইটাতে এই চরিত্রায়ণ প্রসঙ্গে কোনো রাখঢাক না করে প্রকাশ্যেই তিনি বলেছেন যে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অঞ্চল-ভিত্তিক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেন না। কেউ ভারতবর্ষের বাসিন্দা বলেই যে সে সত্যিকারের ভারতীয় হিসেবে গণ্য হবে, এ কথা তিনি মানেন না। সত্যিকারের জাতীয় সত্ত্বা কেবলমাত্র সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বন্ধনে আবদ্ধ হলেই গড়ে তোলা সম্ভব। অতএব ভারতবর্ষের সকল বাসিন্দাদের মধ্যেও সত্যিকারের ভারতীয় কেবল হিন্দুরাই, কারণ তাঁদের পূর্বপুরুষেরাই এই দেশের সংস্কৃতিকে গড়ে তুলেছিলেন।

এই বিচিত্র তত্ত্ব গড়ে তুলতে গিয়ে কখনো তিনি বলছেন আর্য-সন্তান হিন্দুরা ভারতবর্ষের আদিবাসী, কখনো বা হিটলারের জার্মানির তারিফ করছেন, কখনো আবার ইহুদিদের ইজরায়েল রাষ্ট্র গড়ার দাবিকে সমর্থন করছেন। কখনো আবার তিনি এটাও বলছেন যে "ভারতবর্ষের অহিন্দু মানুষজনকে হয় হিন্দুদের সংস্কৃতি ও ভাষা শিখতে হবে। তাঁদের হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে জানতে হবে ও হিন্দু ধর্মকে সন্মান করতে হবে ... মোট কথা, তাঁদের ভিনদেশি সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে ভারতীয় হয়ে উঠতে হবে। অথবা তাঁদের এ দেশে থাকতে হবে হিন্দু জাতির অধীনে। কোনো চাহিদা বা কোনো অধিকার ছাড়া। এমনকি নাগরিক অধিকারও দেওয়া হবে না তাঁদের।"

এ তো দর্শন নয়, এ তো সর্বনাশা ঘৃণার প্রলাপ!

আজকের দিনে 'ঘর ওয়াপসি'র নামে আমজনতাকে উত্যক্ত করে যারা, তাদের মুখের ভাষা এখান থেকেই এসেছে।

যে সময়ে ভারতবর্ষে ভিনদেশি ইংরেজ সরকার আমজনতার আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে শাসন ও শোষণ করছে, সে সময়েই বসে গোলওয়ালকার কেমন করে যেন ভিনদেশি শত্রু খুঁজে পেলেন ইংরেজদের মধ্যে নয়, ভারতীয় মুসলমান, খ্রিস্টান ও কমিউনিস্টদের মধ্যে! যে সময়ে সাধারণ মানুষের ঐক্যই স্বাধীনতার একমাত্র পথ, সে সময়ে সেই একতার স্বপ্নের মধ্যেই গোলওয়ালকার ভারত-বিরোধী 'ষড়যন্ত্র' খুঁজে পেলেন! বললেন, "ইংরেজ বিরোধিতাকে ভাবা হল দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ। এই প্রতিক্রিয়াশীল দর্শনের ভয়াবহ প্রভাব সমগ্র স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর, নেতাদের উপর, এবং আপামর দেশবাসীর উপর পড়েছিল।"

শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এটাই সত্যি।

শোনা যায় দেশের কিছু কিছু অংশে সঙ্ঘের কর্মীরা নিজেদের অন্তরাত্মার ডাককে ফেলতে না পেরে আন্দোলনের পথে নেমেছিলেন। 'গুরুজি'কে অগ্রাহ্য করে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের নিজস্ব রিপোর্টেই পরিষ্কার, ১৯৪০-এর সেই উত্তাল দশকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনো কর্মসূচীতেই অংশগ্রহণ করেনি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে ইংরেজ সরকার অতএব নিষিদ্ধ ঘোষণা করার কোনো কারণই দেখেনি। দেশের সমস্ত নেতা যখন কোনো না কোনো জেলে বন্দি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের নেতারা তখনও বহাল তবিয়তে রয়েছেন।



==============================================================================



রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও তার পরিবারের অনুগামীরা আজকে অনেকেই ভগৎ সিংকে আপন করে নিতে উৎসুক। হয়তো তাঁরা আর মনে রাখতে চান না যে ভগৎ সিং যখন কারাবন্দি, সেই সময়ে তাঁর সহকর্মী - পরবর্তীকালে প্রখ্যাত হিন্দি লেখক - যশপাল, বিনায়কের দাদা গণেশ সাভারকারের সাথে দেখা করে তাঁদের বিপ্লবী কাজকর্ম ও ভগৎ সিং -সুখদেব-রাজগুরুদের পক্ষে আইনি লড়াইয়ের জন্য আর্থিক সহযোগিতা চান। গণেশ সাভারকার তাঁদের ৫০,০০০ টাকা দিতে রাজি ছিলেন - শুধু যদি তাঁরা মহম্মদ আলি জিন্নাহকে খুন করতে রাজি হন! চন্দ্রশেখর আজাদ সেই চাহিদা শুনে বলেছিলেন, " এই লোকটা (গণেশ সাভারকার) আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামী নয়, সুপারি নেওয়া খুনি মনে করে। ও ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়েছে। আমাদের লড়াই ইংরেজদের বিরুদ্ধে। আমরা মুসলমানদের মারবো কেন? ওকে বলে দিও ওর টাকার প্রয়োজন নেই আমাদের।"

No comments:

Post a Comment