প্রাগৈতিহাসিক ভারতে আধুনিক মানবের সংক্ষিপ্ত কালানুক্রমিক সূচি
~ ৩,০০,০০০ বছর : মরক্কোর সাফি শহর থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জেবেল ইরহাউদ-এর এক গুহায় প্রাপ্ত আধুনিক মানুষ হোমো স্যাপিয়েন্স-এর অদ্যাবধি আবিষ্কৃত প্রাচীনতম অবশেষে বয়স।
~ ১,৮০,০০০ বছর : আফ্রিকার বাইরে প্রাপ্ত কোন আধুনিক মানুষের জীবাশ্মের বয়স - উত্তর ইজরায়েলের মিসলিয়াতে এক পাহাড়ের গায়ে।
~ ৭০,০০০ বছর আগে : জিন বিশেষজ্ঞদের গণনামতে সবচেয়ে সফল আফ্রিকা বহির্মুখী পরিযান মোটামুটি এই সময়ের আশেপাশেই হয়েছিল। এই পরিযায়ীদের 'সফল' বলার কারণ এরা আজকের আনফ্রিকীয় জনসংখ্যার সকলেরই পূর্বসূরি। (এর আগের আফ্রিকার বাইরে যাওয়া আধুনিক মানুষরা এমন কোনও বংশ বা কুলের চিহ্ন রেখে যায়নি, যা বর্তমানে শনাক্ত করা যায়।) সম্ভবত, ৭০,০০০ বছর আগের সেইসব আফ্রিকা বহির্মুখী পরিযায়ীরা দক্ষিণের পথ ধরে এগিয়ে গিয়েছিলেন যা হয়তো তাঁদের আফ্রিকা থেকে (বিশেষত, বর্তমানের এরিত্রিয়া এবং জ্বিবৌতি) লোহিত সাগরের দক্ষিণ প্রান্তস্থিত বাব-এল-মান্দেব হয়ে এশিয়ার দিকে (আধুনিক ইয়েমেন) নিয়ে এসেছিল।
~ ৬৫,০০০ বছর আগে : আফ্রিকা বহির্মুখী পরিযায়ীরা ভারতে পৌঁছলেন, আর এসেই তাঁরা বিপুল সংখ্যক আদিম মানবের সম্মুখীন হলেন। তাঁরা সম্ভবত উপ-হিমাচল অংশ দিয়ে অন্তর্দেশীয় পথে এবং সমুদ্রতীরবর্তী পথ ধরে দুটো দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন; উপমহাদেশের অন্যান্য হোমো প্রজাতি, যারা মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল তাদের থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখার জন্যই হয়তো এমনটা করা, এবং তারও পরে সেখান থেকে তাঁরা ভারতীয় উপমহাদেশ পেরিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার দিকে চলে গিয়েছিলেন।
~ ৬০,০০০ - ৪০,০০০ বছর আগে : আফ্রিকা বহির্মুখী পরিযায়ীদের উত্তরসূরিরা মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের এই সময়কালের মধ্যে জনসংখ্যার বিস্তার ঘটায়।
~ ৪০,০০০ বছর আগে : ইউরোপের নিয়ান্ডারথালরা অবলুপ্ত হল, দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের আইবেরীয় উপদ্বীপ (আধুনিক পর্তুগাল এবং স্পেন) তাদের অন্তিম আশ্রয়স্থল হয়ে রইল।
~ ৪৫,০০০ - ২০,০০০ বছর আগে : আফ্রিকা বহির্মুখী পরিযায়ীদের উত্তরসূরি আদি ভারতীয়রা এই উপমহাদেশে মাইক্রোলিথিক প্রযুক্তির (অতিক্ষুদ্র পাথরের তৈরি যন্ত্রাদির) ব্যবহার শুরু করেন। তাঁদের জনসংখ্যা মধ্য ও পূর্ব ভারতে অবিশ্বাস্যভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। উন্নত মানবের 'সর্বাধিক সমাগম' ঘটে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে। আধুনিক মানব ক্রমে মধ্যভারত ও দাক্ষিণাত্যভূমির যে অঞ্চলটায় জড়ো এবং থিতু হতে থাকল, সেটা হয়তো বা দীর্ঘদিন ধরেই অন্যান্য হোমো প্রজাতির আশ্রয়স্থল হয়ে ছিল।
~ ১৬,০০০ বছর আগে (১৪,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) : আধুনিক মানব সাইবেরিয়া আর আলাস্কার মাঝে সংযোগকারী সেতুর মতো ভূমি বেরিঞ্জিয়া পেরোনোর পর পৌঁছল আমেরিকায়, যাকে মানুষের বাসস্থানহিসেবে অন্তিম মুখ্য মহাদেশ বলা চলে।
~ ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : বেলুচিস্তানের বোলান পাহাড়ের পাদদেশে, বর্তমানে মেহরগড় নামে পরিচিত এক গ্রামে, এক নতুন কৃষিজাত উপনিবেশের পত্তন হয় যা ক্রমেই সিন্ধু এবং ভূমধ্যসাগরের মাঝের অংশে এই সময়ের বৃহত্তম জনবসতিগুলোর অন্যতম হয়ে ওঠে।
~ ৭০০০ - ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : জাগ্রোস অঞ্চল থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় ইরানীয় কৃষকদের অভিগমনের ফলে আদি ভারতীয়দের উত্তরসূরিদের সঙ্গে তাদের মিশ্রণ ঘটে; এই সময়েরই আশেপাশে। জিনতত্ত্ববিদদের গণনামতে এই মিশ্রণ মোটামুটিভাবে ৪৭০০ থেকে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ঘটেছিল।
~ ৭০০০ - ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : মেহরগড় অঞ্চলে যব ও গম চাষ এবং সেইসঙ্গে পোষ মানানো গবাদিপশুর ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। যদিও এই ভূমি ২৬০০ থেকে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে পরিত্যক্ত হয়। ততদিনে অবশ্য কৃষিজাত উপনিবেশ উত্তর-পশ্চিম ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল - সে সিন্ধু আর ঘাগ্গর - হাকরা নদীর উপত্যকায় হোক কিংবা গুজরাতে।
~ ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : এই সময়কালেই উচ্চ গাঙ্গেয়ভূমি অঞ্চলে অধুনা উত্তরপ্রদেশের সন্ত কবীরনগর জেলার লহুরাদেওয়াতে ধান চাষের এবং স্থায়ী বসবাসের বন্দোবস্তের প্রভূত প্রমাণ মেলে। জংলা ধান থেকে কৃষিজাত ধান উৎপাদনের এই ক্রমবিকাশের পর্যায়ের কালানুক্রম অবশ্য নিশ্চিত করে বলা যায় না, কিন্তু লহুরাদেওয়ার ব্যাপারটা একটা স্থির ইঙ্গিত দেয়, বা বলা ভালো আমাদের নিঃসন্দেহ করে, সেটা হল কৃষিকার্যে এইসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা দক্ষিণ এশিয়ার বহু জায়গাতেই একইসঙ্গে হচ্ছিল এবং মেহরগড় কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না।
~ ৫৫০০ - ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : হরপ্পা যুগের আদিভাগে, এ সময়ে ভারতের কালিবঙ্গান, রাখিগঢ়ি এবং পাকিস্তানের বনওয়ালি ও রহমান ঢেরির মতো বিভিন্ন নগরে একটু একটু করে তাদের একান্ত নিজস্ব শৈলীতে প্রাথমিক কৃষিজাত উপনিবেশগুলো গড়ে উঠছিল।
~ ৩৭০০ - ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রাথমিক কৃষিকার্যের প্রমাণ পাওয়া যেতে থাকে - পূর্ব রাজস্থান, দক্ষিণ ভারত, মধ্য ভারতের বিন্ধ্য পর্বত অঞ্চল, পূর্ব ভারত এবং কাশ্মীরের সোয়াত উপত্যকা।
~ ২৬০০ - ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : পরিণত হরপ্পাযুগে নতুন করে নির্মিত ও পুনর্নির্মিত হল বহু জনপদ, আর বহু পূর্বে বিদ্যমান জনপদ পরিত্যক্ত হল। একই ধরনের / নির্দিষ্ট লিপি, শিলমোহর, চিহ্ন তথা পরিমাপক বাটখারার প্রচলন দেখা গেল সারা অঞ্চল জুড়ে উন্নততর মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে। আদি হরপ্পাযুগ থেকে পরিণত হরপ্পাযুগের রূপান্তর প্রায় চার বা পাঁচ প্রজন্মেরও বেশি সময়, বা ১০০ থেকে ১৫০ বছর ধরে ঘটেছিল।
~ ২৩০০ - ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : ব্যাক্ট্রিয়া - মর্জিয়ানা প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্রের সময়ে অক্সাস নদীর (আমু দরিয়া নামেও পরিচিত) এবং অধুনা আফগানিস্তান, দক্ষিণ উজবেকিস্তান আর পশ্চিম তাজিকিস্তান মিলিয়ে আশেপাশের সভ্যতা। ব্যাক্ট্রিয়া - মর্জিয়ানা প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্রের হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে নিবিড় বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ছিল।
~ ২১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : কাজাখ স্তেপভূমি থেকে পাস্তোরালিস্টরা মধ্য দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে দক্ষিণাভিমুখী পরিযান করে যাদের আমরা আজ তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তান বলে জানি। এই পরিযায়ীরা ব্যাক্ট্রিয়া - মর্জিয়ানা প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্রের উপর প্রভাব ফেলে, কিন্তু অধিকাংশ অন্য পথ ধরে দক্ষিণ এশিয়া যায় খ্রিস্টপূর্বাব্দে দ্বিতীয় সহস্রাব্দে, যেমন নিচে বর্ণিত হল (২০০০ - ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে)।
~ ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : দুটি মুখ্য পরিযানের ঢেউ ওঠে চিনদেশে তাদের মূল শিকড় - কৃষি বিপ্লবের পর তার ফলে ওঠা জনসংখ্যার ঢেউ - দক্ষিণপূর্ব এশিয়াকে নবরূপ দান করে। অস্ট্রো এশিয়াটিক ভাষা তৈরি হয়, নতুন উদ্ভিদ এবং নতুন প্রজাতির ধানের বৈচিত্র আসে ভারতে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পরে।
~ ২০০০ - ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : স্তেপভূমির পাস্তোরালিস্টদের (পশুপালক) নতুন পরিযানের ঢেউ ওঠে অনেক, মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে। ভারতীয় - ইউরোপীয় ভাষা এবং নতুন ধর্মীয় তথা সাংস্কৃতিক প্রথার উদ্ভব ঘটে।
~ ১৯০০ - ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : হরপ্পাযুগের অন্তিম ভাগে এই সভ্যতার ক্ষয় এবং ঘটনাচক্রে অবলুপ্তি হতে দেখা যায়। প্রাথমিকভাবে দীর্ঘকালীন খরা অনাবৃষ্টিকে দায়ী করা যায়, যা পশ্চিম এশিয়ার সভ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। এমনকী মিশর ও চীনদেশকেও ছাড়েনি।
*******************************************************************
আমাদের সঙ্গে আমাদের নিকটতম বিবর্তনশীল জ্ঞাতি ভাই হোমো ইরেক্টাস, হোমো নিয়ান্ডারথালেন্সিস, ডেনিসোভান প্রভৃতিদের দ্বারা তৈরি করা যন্ত্রপাতি, সরঞ্জামের মধ্যে প্রায়ই কোনও ভিন্নতা ছিল না এবং এমন কোনও আকস্মিক মুহূর্তও ছিল না, যখন হোমো স্যাপিয়েন্সরা দুম করে এসে পড়েছিল!
এই সব হোমো প্রজাতির বিলুপ্ত সদস্যদের (হোমো স্যাপিয়েন্স হচ্ছে বর্তমানে হোমো পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য) আমাদের মতোই বড় আকারের মস্তিস্ক ছিল।
গত দশকে তো আমরা এমনকী এও জেনেছি যে, তারা জিনগতভাবে হোমো স্যাপিয়েন্স-দের যথেষ্ট কাছাকাছি ছিল। অর্থাৎ তাদের সঙ্গে আমাদের পূর্বপুরুষরা মিলিত হয়েছে এবং পরবর্তীকালে উৎপাদনক্ষম সন্তান উৎপন্ন করেছে।
এগুলো নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি কারণ আমরা এখন জানি যে, সকল অনাফ্রিকীয় হোমো স্যাপিয়েন্স বর্তমানে তাদের ডিএনএ-তে প্রায় ২ শতাংশ নিয়ান্ডারথাল-এর জিন বহন করে। আমাদের মধ্যে কিছু যেমন - মেলানেশিয়, পাপুয়ান এবং আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ার আবার ৩ থেকে ৬ শতাংশ ডেনিসোভান (অন্তিম প্রস্তর যুগে সাইবেরিয়া থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া অব্দি বিচরণ করা প্রাচীন মানবের এক অবলুপ্ত প্রজাতি) ডিএনএ বহন করে। এই জিনগত উত্তরাধিকারের জন্য, আমরা হয়তো তাদের পূর্বপুরুষ বলতে পারি, কিন্তু যাদের সঙ্গে হোমো স্যাপিয়েন্স একসময়ে হেসেখেলে দিন কাটিয়েছে, তাদেরকে সম্ভবত আমাদের বিবর্তনশীল জ্ঞাতি ভাই হিসাবে দেখাটাই যুক্তিসঙ্গত হবে। জীববিজ্ঞানের দিক দিয়ে, আমরা শুধু একটি ক্রমাগত ঘটতে থাকা নিরবিচ্ছিন্ন বিবর্তনের অংশ, যেখানে হোমো স্যাপিয়েন্স-দের ডিএনএ'র ৯৬ শতাংশ শিম্পাঞ্জিদের দ্বারা অধিকৃত।
*******************************************************************
আচ্ছা আমরা কেন সবসময় ধরে নিই ভারতে আধুনিক মানুষকে বাইরের কোথাও থেকেই আসতে হয়েছে? কেন এখানেই তাদের উৎপত্তি হল না? মাত্র কয়েক দশক আগেও এটা বেশ একটা যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন বলে ভাবা যেত, কারণ আধুনিক মানুষ যে পৃথকভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে হোমো প্রজাতির প্রাচীন বা বিলুপ্ত সদস্যদের (যেমন হোমো ইরেক্টাস) যারা প্রায় ১৯ লক্ষ বছর আগে সমস্ত ইউরেশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল, তাদের থেকে বিবর্তিত হয়েছিল, সেই তত্ত্বটি তখনও জোরালো ছিল - যদিও চার্লস ডারউইন ১৮৭১ সাল নাগাদই আধুনিক মানুষের আফ্রিকীয় বংশোদ্ভূত হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তত্ত্বটি ছিল বিভিন্নভাবে বিবর্তিত জনগোষ্ঠী পরবর্তীকালে নিজেদের মধ্যে মিশ্রণ ঘটানোর ফলে এইভাবে একটি প্রজাতি হিসাবে আমাদের একত্র করতে পেরেছে, এভাবে বিভিন্ন মহাদেশে আমাদের বিভিন্ন প্রজাতিতে ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আটকানো গেছে।
তবে এই তত্ত্ব এখন আবর্জনাপাত্রে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কোনও সাচ্চা গবেষক একে কোনও সম্ভাবনা বলেই গণ্য করেন না (যদিও অতি সাম্প্রতিক কাল অবধিও অন্তত ধারণা ছিল, কিছু বিচ্ছিন্ন আস্তানা বিশেষ করে চীনের মতো জায়গা থেকে থাকতে পারে, যেখানে প্রাচীন মানুষ থেকে চীনা মানুষে একেবারে স্বাধীনভাবে এবং স্বতঃস্ফূর্ত বিবর্তন ঘটেছে)। কেন এই তত্ত্ব বাতিল হল তার পিছনে পুরাতাত্ত্বিক এবং জিনতত্ত্বগত উভয় কারণই দায়ী। আফ্রিকার জীবাশ্ম সংক্রান্ত নথি আমাদের নিকটতম আত্মীয়দের অবশিষ্টাংশে পরিপূর্ণ - ৭০ লক্ষ বছর আগে সাহেলানথ্রোপাস চ্যাডেন্সিস, ৪০ লক্ষ বছর আগে আরডিপিথেকাস র্যাকমিডাস, ৩৫ লক্ষ বছর আগে কেনিয়ানথ্রোপাস প্ল্যাটিওপ্স, ২৪ লক্ষ বছর আগে হোমো হ্যাবিলিস এবং ৭ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ বছর আগে হোমো হাইডেলবার্গেন্সিস - বিশ্বে আর অন্য কোনও অঞ্চল ছিল না যা আফ্রিকার সঙ্গে কোনোভাবে তুলনীয় হতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন মহাদেশে বৈচিত্র্যময় মানব উদ্ভবের বিরুদ্ধে অকাট্য যুক্তিটা আসলে ছিল জিনগত। ডিএনএ প্রমাণ আমাদের স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত করেছে যে, আফ্রিকা বহিঃস্থ সমস্ত আধুনিক মানুষ আসলে আফ্রিকা বহির্মুখী একটা মাত্র জনগোষ্ঠীর উত্তরসূরি, যারা ৭০,০০০ বছরের আশেপাশের কোনও একটা সময়ে এশিয়াতে পাড়ি জমিয়েছিল, এবং সম্ভবত এই সময়কালের মধ্যে তাদের নিকটবর্তী জিনতুতো জ্ঞাতি ভাই হোমো নিয়ান্ডারথালেন্সিস-দের সরিয়ে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছিল। সমস্ত সাম্প্রতিক গবেষণালব্ধ ফল আধুনিক মানুষের আফ্রিকীয় বংশোদ্ভূত হওয়ার স্বপক্ষেই বারবার নিশ্চয়তা দেয়। অতি সম্প্রতি এই ২০১৭ সালের জুন মাসে আমরা খবর পেলাম যে মরক্কোর সাফি শহরের থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জেবেল ইরহাউদ-এর এক গুহায় যে প্রাচীন মাথার খুলিটা পাওয়া গেছে সেটা আধুনিক মানুষ হোমো স্যাপিয়েন্সেরই, যার বয়স প্রায় ৩,০০,০০০ বছর।
যতদিন না এই জেবেল ইরহাউদের গুহা থেকে প্রাপ্ত জীবাশ্মের শ্রেণীবদ্ধকরণ এবং বয়স নির্ণয় করা হয়নি, ততদিন অবধি ইথিওপিয়ার পুরাতাত্ত্বিক স্থান ওমো কিবিশে প্রাপ্ত ১,৯৫,০০০ বছরের পুরোনো দুটো মাথার খুলিই ছিল সবচেয়ে প্রাচীন আধুনিক মানবের জীবাশ্ম। তাই জেবেল ইরহাউদের আবিষ্কার আধুনিক মানবের সূচনার ইতিহাসকে এক ঝটকায় প্রায় ১,০০,০০০ বছর পিছিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং আমরা কোথা থেকে এসেছি সেই সংশয়ের আর কিছুমাত্র অবশিষ্ট রাখেনি। যদিও জেবেল ইরহাউদের থেকে প্রাপ্ত করোটিতে আমাদের মুখাবয়বের সঙ্গে অনেক গঠনগত সাদৃশ্য আছে, তবে এর পিছনদিকটা আদিম মানবের মতো বেশ খানিকটা লম্বাটে গড়নের, তা ছাড়াও বড় বড় দাঁত রয়েছে, যা ইঙ্গিত দেয় আধুনিক মানুষ হঠাৎ করে একদিনে উৎপত্তি হয়ে পূর্ণবিকশিতরূপ পায়নি, উপরন্তু প্রায় ৩,০০,০০০ বছর ধরে একটানা চলা এক প্রক্রিয়ার ফল মাত্র।
*******************************************************************
'আফ্রিকার বাইরে' যাওয়ার সময়কাল
এখন জেনেটিক্সের গঠনতত্ত্বটা যেহেতু মোটামুটি জানা হয়ে গেছে, চলুন পরের প্রশ্নে যাওয়া যাক : জিনতত্ত্ববিদরা কেন বলেন আফ্রিকার বাইরের সকল আধুনিক মানুষ একটিই জনগোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত, যারা আফ্রিকা মহাদেশ ছেড়ে পরিজন করেছিল?
কেনই বা তারা ৭০,০০০ বছরের কিছু আগে-পরে দলবদ্ধভাবে অভিনিষ্ক্রমণ করেছিল? কারণটা সুস্পষ্ট ও সহজবোধ্য। আপনি বিশ্বব্যাপী আফ্রিকার বাইরের মানুষের এমটিডিএনএ-র দিকে লক্ষ করলে দেখবেন, তারা সবাই L3 নামক একটিই হ্যাপ্লো গোষ্ঠী থেকে এসেছে, যার সঙ্গে আফ্রিকার সম্পর্ক গভীর! একটু ভাবুন এর আসল অর্থটা কী? আফ্রিকার বাইরের সমস্ত মানুষ সেই একজন আফ্রিকান মহিলার বংশধর, যিনি L3 এমটিডিএনএ হ্যাপ্লোগোষ্ঠীর এই ধারার সূচনা করেছিলেন! আফ্রিকায় আরও প্রায় পনেরোটি সুপ্রাচীন বংশধারা রয়েছে যেমন L0, L1, L1a এবং L1c প্রভৃতি, কিন্তু তারা কেউই বাকি দুনিয়ার জনসংখ্যা বিস্তারের জন্য দায়ী দলের অংশ নয়। বর্তমানে L3-র দুটি সরাসরি বংশধর বা উপ-হ্যাপ্লোগোষ্ঠী আছে, M এবং N, N-এর আবার নিজস্ব প্রধান উপ-হ্যাপ্লোগোষ্ঠী হল R। তাই আফ্রিকার বাইরের সমগ্র বিশ্বের জনগণ M, N বা R হ্যাপ্লো গোষ্ঠীর বংশধারার বাহক। দক্ষিণ এশিয়ায় যেমন এই তিনটি হ্যাপ্লোগোষ্ঠীর সবকটিই উপস্থিত, ইউরোপে আবার মাত্র দুটি দেখা যায়, N এবং R, M সেখানে অনুপস্থিত।
Y-ক্রোমোজোমের বংশগতির ক্ষেত্রেও ছবিটা প্রায় এক। C, D এবং F, কেবল এই তিনটি আফ্ৰিকাজাত হ্যাপ্লোগোষ্ঠী গোটা পৃথিবীর বাকি অংশকে জনাকীর্ণ করে - যারা সকলেই আবার একটি জনিতৃ হ্যাপ্লোগোষ্ঠী CT থেকে উদ্ভূত। আবার, এর মানে দাঁড়াচ্ছে, আফ্রিকার বাইরের সব মানুষই Y-ক্রোমোজোমের CT হ্যাপ্লোগোষ্ঠীর সূচনাকারী নির্দিষ্ট একজন মানুষের বংশধর। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায় আফ্রিকার আধুনিক মানুষের জনসংখ্যার মাত্র একটি উপধারা বিশ্বের বাকি অংশকে জনাকীর্ণ করেছিল। দ্বিতীয়ত, সমস্ত পরিযায়ী এমটিডিএনএ হ্যাপ্লোগোষ্ঠী L3 থেকে উদ্ভূত, অন্য কোনও হ্যাপ্লোগোষ্ঠী থেকে হয়নি। যার ফলে বলা যায় পরিযানের ঘটনাটি একবারই ঘটেছিল, বারংবার নয়। কারণ একাধিকবার পরিযান ঘটলে বর্তমান জনসংখ্যায় শুধুমাত্র L3 নয়, একটি বড় সংখ্যক এমটিডিএনএ হ্যাপ্লোগোষ্ঠীর বংশধরদের পাওয়া যেত। বহুসংখ্যক পরিযানেও সবাই একই L3 হ্যাপ্লোগোষ্ঠীর বংশধর, এমন সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
অভিবাসনের ঘটনাটি যে ৭০,০০০ বছরের কিছু আগে-পরে ঘটেছিল সেটা আমরা কীভাবে স্থির করলাম? সেটাও সহজেই বোধগম্য। মিউটেশনের হার এবং এই সময়ের জিনোম সংক্রান্ত তথ্যের সাহায্যে জিনতত্ত্ববিদরা কোনও বিশেষ হ্যাপ্লোগোষ্ঠীর উত্থানের সময়কাল গণনা করতে পারেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত অনুসারে L3-র আবির্ভাব মোটামুটিভাবে প্রায় ৭০,০০০ বছর আগে ঘটেছে। একইভাবে বলা যায়, N বংশধারার সূত্রপাত আজ থেকে প্রায় ৬১,০০০ বছর আগে এবং M-এর ক্ষেত্রে প্রায় ৪৮,০০০ বছর আগে। তাই আফ্রিকা বহির্মুখী পরিযান বিগত ৬১,০০০ বছরেরও অনেক পরে হওয়ার সম্ভাবনা নেই (অন্যথা আফ্রিকায় N বংশধারার বৃদ্ধি ঘটা উচিত ছিল, যা এক্ষেত্রে হয়নি), আবার তা ৭০,০০০ বছরের অনেক আগেও হয়নি, কারণ তাহলে আফ্রিকাতে L3 হ্যাপ্লোগোষ্ঠীর কোনও বংশধরই থাকত না, এক্ষেত্রে যা অবাস্তব।
বহির্গমনের সময়কে অনেকটা নিশ্চিতরূপে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে একে অকাট্য যুক্তি মনে হতে পারে, কিন্তু এইসব অনুমান উদ্দিষ্ট সকল হ্যাপ্লোগোষ্ঠীর 'গড়' বয়সের ভিত্তিতে গঠিত। প্রতিটি গণনার প্রকৃত সময়সীমা কমবেশি কয়েক হাজার বছর হতে পারে। তাই এটা বলা আরও যুক্তিসঙ্গত হবে যে আফ্রিকা বহির্মুখী পরিযানটি মোটামুটি ৫০,০০০ বছরের পরে এবং প্রায় ৮০,০০০ বছরের আগে কিছুতেই ঘটেনি। যদি আমরা কিছু নির্দিষ্ট জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যকে জেনেটিক বৈশিষ্ট্যর উপরে অগ্রাধিকার দিই, তাহলে আমরা এই অপেক্ষাকৃত বড় সময়সীমার পরিবর্তে বিগত অনুমানিক ৫০,০০০ থেকে ৬০,০০০ বছরের মধ্যবর্তী সময়ের একটা ছোট জানলার কাছে পৌঁছতে পারব।
*******************************************************************
একক-উৎসজাত নয়, একটি বহু-উৎসজাত সভ্যতা
ভারত ও ইউরোপ উভয়তই, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষীরাই জনগণতাত্ত্বিক চিত্র পরিবর্তন করার মতো শেষ গুরুত্বপূর্ণ অভিবাসীদল। ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী থেকে ১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ আসা শক বা সিদিয়াবাসী, প্রায় ৪৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আসা হূণ, ৭১০ খ্রিস্টাব্দে আরব, ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে মুঘল এবং তারপর পর্তুগিজ, ফরাসি, ওলন্দাজ এবং ব্রিটিশরা অবধি - ভারতে একাধিক বিদেশি আক্রমণ ঘটেছে। কিন্তু তাদের কেউই আমাদের জনসংখ্যার চিত্রের উপর একটি সূক্ষ্ম এবং ছোট ছাপের চেয়ে বেশি কিছু রেখে যেতে পারেননি, যদিও আমাদের সংস্কৃতির উপর তাদের বিরাট প্রভাব রয়েছে। সাম্প্রতিক ডিএনএ এবং জেনেটিক্স বিজ্ঞানের সাহায্যে আমরা এখন নিশ্চিতভাবে এটা বলতে পারি। এবং ভবিষ্যতেও সম্ভবত কোনও অভিবাসন বা আক্রমণ আমাদের জনসংখ্যার চিত্র পরিবর্তন করতে পারবে না। তাই এই অধ্যায়ের নাম শেষ অভিবাসীগণ। একাধিক ঐতিহ্য এবং অভিজ্ঞতা থেকে উপাদান সংগ্রহ করে একটি অনন্য সংস্কৃতি সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের সাধারণ ইতিহাস গঠিত হয়েছে। আমরা একটি বহু-উৎসজাত সভ্যতা, কোনও একক উৎস থেকে আমাদের উৎপত্তি হয়নি।
২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কিছুকাল পরে যখন শেষ অভিবাসী, 'আর্যরা', ভারতে এসে পৌঁছেছিল, উপমহাদেশের ভারতীয়রা তার আগে থেকেই পৃথিবীর আধুনিক মানুষের অন্যতম বৃহৎ জনগোষ্ঠী ছিল (যদি সবচেয়ে বৃহত্তম নাও হয়); ইতিমধ্যেই তারা একটি কৃষি বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং তারপর একটি নাগরিক বিপ্লবেরও নেতৃত্ব দিয়েছি যা সে সময়ের বৃহত্তম সভ্যতার সৃষ্টি করেছিল; এবং উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম ... প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে একটি করে কৃষি রূপান্তরের নেতৃত্ব দান করেছিল। এটা বললে ভুল হবে না যে, হরপ্পা সভ্যতার আমলেই বর্তমান ভারতের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল।
হাজার বছর বা তারও বেশি যে সময় হরপ্পা সভ্যতার পতনের সাক্ষী ছিল সম্ভবত সেটাই দক্ষিণ এশিয়ায় আধুনিক মানব ইতিহাসের সবচেয়ে অশান্ত এবং আন্দোলিত সময় ছিল। কিন্ত এই বিষয়ে আমাদের কাছে খুব সামান্যই তথ্য আছে বলে এ নিয়ে জানার সুযোগও কম। যা ঘটেছে তার দিকে একবার তাকানো যাক দীর্ঘদিন ধরে চলা এক সভ্যতা, নিজের সময়ের বৃহত্তম, দীর্ঘকালীন খরার দাপটে বিধ্বস্ত, এবং তার সর্বাধিক দৃশ্যমান ক্ষমতা এবং খ্যাতির প্রতীকগুলির ধীরে ধীরে অবলুপ্তি, এমনকী নাগরিকতাবাদও নিজেই তার অস্তিত্ব বিপন্ন করেছিল; মানুষের একটি নতুন জীবন অনুসন্ধানে পূর্ব এবং দক্ষিণে স্থানান্তরিত হওয়া; উত্তর-পশ্চিম থেকে আগত অভিবাসীদের একটি নতুন ধারা, নতুন ভাষা এবং একটি ভিন্ন সংস্কৃতি নিয়ে আসা যেখানে বলিদান প্রথার মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং পশুপালনে অগ্রাধিকার এবং শহুরে বসতি স্থাপনের চেয়ে গবাদি পশুর প্রজননের উপর অধিক জোর দেওয়া হত; উত্তর-পূর্ব দিক থেকে অভিবাসীদের অন্য একটি দল এসেছিল, তারাও নতুন ভাষা, নতুন গৃহ উৎপাদিত উদ্ভিদ এবং সম্ভবত জলাভূমি চাষের কৌশল এবং ধানের একটি নতুন প্রজাতি নিয়ে আসে ... এবং এভাবেই ভারতীয় সংস্কৃতির পাত্রটি পরিপূর্ণ হয়ে ফুটতে আরম্ভ করে। চার হাজার বছর পরে, এটি এখনও ঢিমে আঁচে ফুটছে, মাঝে-মাঝেই ইহুদী থেকে সিরিয়াবাসী থেকে পার্সীদের মতো নতুন নতুন উপাদান যোগ করা হচ্ছে।
*******************************************************************
ঐতিহাসিক রোমিলা থাপারকে উদ্ধৃত করে বলা যায় :
নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মূল্যায়ন করার সময়ে আমরা প্রায়শই ভুলে যাই বা খেয়াল রাখি না যে, যুক্তিবাদিতা এবং সংশয়বাদ মূলত প্রাচীন ভারতীয় চিন্তাধারারই একটি অংশ ছিল। এটি শুধু চার্বাক বা লোকায়ত চিন্তাবিদদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। দর্শনের অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন বৌদ্ধ ও জৈন চিন্তাধারাতেও এর প্রভাব লক্ষণীয়। আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রশ্ন করার একটি সহজাত ক্ষমতা পেয়েছি, যা স্রেফ দার্শনিক চিন্তাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং জনপ্রিয় সাহিত্যেও স্পষ্টভাবে দ্রষ্টব্য। সেই ঐতিহ্যকে লালন করাই সমুচিত কাজ হবে।
*******************************************************************
ভারতীয় হিসাবে আমরা হয়তো একই ইতিহাসের অধিকারী, তবে বিভিন্ন প্রান্তের বিচারে আমাদের কিছু আলাদা অভিজ্ঞতাও হয়েছে। একদিকে দক্ষিণ এবং পূর্ব ভারত আর অন্যদিকে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের মধ্যে রাজনৈতিক এমনকী খাওয়াদাওয়ার অভ্যাসের মধ্যেও যে পার্থক্য রয়েছে, সেটাই এইসব অঞ্চলের মধ্যে ফারাকের প্রতিচ্ছবি এবং তাদের মধ্যে কিছু কিছু সুপ্রাচীন।
উদাহরণস্বরূপ, আমাদের খাদ্যাভাসকেই ধরা যাক। এটা স্পষ্ট যে উত্তর ভারতীয় এবং পশ্চিম ভারতীয়রা পূর্ব ভারতীয় বা দক্ষিণ ভারতীয়দের তুলনায় দুধ এবং দুধজাত খাবার অনেক বেশি আর মাছ মাংস অনেক কম খান। রাজনীতিবিদ এবং ধারাবিবরণকাররা প্রায়শই এই পার্থক্যগুলিকে প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক-রাজনৈতিক হিসাবে দেখেন। তবে এগুলির আরও একটি মৌলিক কারণ রয়েছে : জিন। অথবা আরও বিশদে বললে, প্রায় ৭৫০০ বছর আগে ইউরোপে উৎপন্ন 13910T নামক একটি জিনের পরিব্যক্তি (মিউটেশন)। এই জিন মানব শরীরকে শৈশব পেরিয়ে, পরিণত বয়সে দুধ হজম করতে সাহায্য করে। গোটা বিশ্বে হোমো স্যাপিয়েন্স এই ক্ষমতা অর্জনকারী একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কারণ মানুষেরা গবাদিপশু বা ছাগল পালন এবং তাদের দুধের জন্য ব্যবহার করতে শিখে নেওয়ার আগে, এ জাতীয় মিউটেশনের কোনও প্রয়োজনীয়তা ছিল না। কিন্তু একবার তারা গবাদি পশুপালন শুরু করার পর, প্রাপ্তবয়স্কদের দুধ হজম করার ক্ষমতা অর্জন ভীষণভাবে দরকারি হয়ে পড়েছিল। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খাপ খেয়ে যাওয়ার মতো একটি পরিব্যক্ত জিন বিবর্তনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছিল।
পরিণত বয়সেও দুধ হজম করার ক্ষমতা একাধিকবার অভিযোজিত হয়েছিল; বিশ্বের চারটি ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে। তবে 13910T নামক ইউরোপীয় মিউটেশনটির ব্যাপারে আমরা বিশেষ আগ্রহী। কারণ প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে দুধ খাওয়া ও হজম করার ক্ষমতাধারী অধিকাংশ ভারতীয়রা জিনের এই ইউরোপীয় সংস্করণটিরই বাহক। দেশব্যাপী সমস্ত প্রধান ভাষাগোষ্ঠী এবং প্রধান অঞ্চল থেকে ডিএনএ নমুনা বিশ্লেষণ করে ভারতে ল্যাকটেজের স্থায়িত্ব (শৈশবের পরে দুধ হজম করার ক্ষমতার জন্য প্রযুক্তিগত শব্দবন্ধ) বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে একাধিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেছে, যার মধ্যে তিনটি নিম্নরূপ প্রথমত, ভারতে এর বিন্যাসের ধরণটি উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটি স্থির অবনতির পথ ধরেছে। দ্বিতীয়ত, মিউটেশনটি ইউরোপীয়দের সঙ্গে অভিন্ন। তৃতীয়ত, প্রাপ্তবয়সে ভারতীয়দের মধ্যে মাত্র এক-পঞ্চমাংশ দুধ খেয়ে হজম করতে পারেন, তার মধ্যে পশ্চিম এবং উত্তর ভারতের লোকেরাই সর্বাধিক। পশ্চিম এবং উত্তর ভারতের অঞ্চলগুলিতে এই জিনের প্রাপ্তির হার ৪০ শতাংশের বেশি হলেও দক্ষিণ-পূর্ব ভারতে তা ১ শতাংশেরও কম।
সুতরাং এর থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পূর্ব ভারতীয় বা দক্ষিণ ভারতীয়রা কেন উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয়দের তুলনায় অনেক কম পান করেন। উদ্দিষ্ট জিনটি থাকুক বা না থাকুক, প্রাপ্তবয়সে তাদের অনেকেই দুধ হজম করতে অক্ষম। যাঁদের এই জিন আছে আর যাঁদের নেই, তাঁদের মধ্যে প্রধান ফারাকটা হল, এই জিনের অধিকারীরা সারাজীবন ধরে স্বচ্ছন্দে দুধ পান এবং হজম করে যেতে পারবেন; আর যাঁদের তা নেই, তাঁরা নিজেদের জন্মের প্রথম বছর থেকে সাবালকত্ব অর্জনের মধ্যে যে কোনও সময়ে এই ক্ষমতা হারাবেন।
এর সঙ্গে একদিকে উত্তর ও পশ্চিম এবং অন্যদিকে দক্ষিণ ও পূর্বের মধ্যে নিরামিষাশী আহার বা মাছ মাংস খাওয়ার অভ্যাসের পার্থক্যের কী সম্পর্ক? সহজভাবে বলা যায়, জিনের মিউটেশন সেই ভারতীয়দের প্রাপ্তবয়সে মাংস বা মাছের বিকল্প প্রাণীজ প্রোটিন উৎস হিসাবে দুধ হজম করার ক্ষমতা দিয়েছে। যা তাদের অনেকেই গ্রহণ করেছেন বলে মনে হয়। জাতীয় নমুনা জরিপ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবারভিত্তিক খাদ্য ব্যয়ের সমীক্ষা থেকে এই পরিসংখ্যানগুলি পাওয়া গেছে। তথ্যাদি থেকে স্পষ্টভাবে দেখা যায়, অত্যধিক দুধ সেবনকারী রাজ্যগুলি অনেক কম মাছ, মাংস, ডিম খায়। অন্যদিকে মাছ, মাংস, ডিম বেশি খাওয়া রাজ্যে দুধ খাওয়ার পরিমাণ অনেক কম।
দুধ এবং মাংস আহারের একটি বিপরীত প্রবণতাও স্পষ্টতই দৃশ্যমান, তবে সেটা সামান্য কিছু অঞ্চলে। আরও মনে রাখতে হবে, যেসব স্থানে জিন মিউটেশনের আধিক্য বেশি, সেখানেই বেশি দুধ এবং কম মাংস খাওয়ার প্রবণতা রয়েছে, এবং এর বিপরীত ক্রমটিও সত্যি।
জিনের এই কাহিনিটি আমাদের ভারতবর্ষের সমাজতাত্ত্বিক মানচিত্রের এক নির্দেশক। আমাদের সভ্যতার নিরিখে সাধারণ প্রশ্নের উত্তরগুলির মধ্যে তারতম্যের যে নিদর্শনগুলি দেখি, যেমন কী খাওয়া উচিত আর কী অনুচিত, তারও একটা যথাযোগ্য কারণ এর থেকেই মেলে। এই ধরনের পার্থক্য এবং নিদর্শনগুলো মুছে ফেলার চেষ্টা করা বা এক ধাঁচের সংস্কৃতি নির্মাণ করতে চাওয়া একটি অ-ভারতীয় উদ্যোগ হবে, যা যেমন দুর্ঘটনার ঝুঁকিপূর্ণ তেমনই ব্যর্থতার আশঙ্কাজনক।
*******************************************************************
No comments:
Post a Comment