Tuesday, 2 April 2024

যে গল্পের শেষ নেই - দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

পৃথিবীকে অনেক বেশি করে, অনেক ভালো করে, জয় করতে পারা। কী আশ্চর্য এই কীর্তি। ভাবতে গেলে স্তম্ভিত হতে হয়! গোয়ালে গরু, মরাইয়ে ধান - মানুষ আর ভোঁতা হাতিয়ার হাতে খাবার জোগাড়ের আশায় বনে বনে হন্যে হয়ে ঘুরতে বাধ্য নয়। ওই সুদূর অতীতে পৃথিবীকে ওইভাবে জয় করতে শুরু করেছিলো বলেই মানুষ আজ সভ্যতার কোন আশ্চর্য শিখরে উঠে আসতে পারলো! ওইভাবে উঠে আসবার গল্পই হলো মানুষের আসল গল্প।

তবু সে-গল্প শোনাবার সময় ভুলে গেলে চলবে না যে সুদূর অতীতে ওই অসহ্য দারিদ্র্যের জীবন ছেড়ে আসবার সময়, অভাবের অন্ধকার থেকে প্রাচুর্যের আঙিনায় এগিয়ে আসবার জন্যে, মানুষকে মূল্যও দিতে হয়েছে অনেকখানি। আগেকার দিনে সমানে-সমান সম্পর্কটাও গিয়েছে খোয়া। এ-কথায় কোনো সন্দেহই নেই যে ওই রকমের একটা দারুণ মূল্য চোকাতে না পারলে মানুষ আজ এমন বড়ো হতে পারতো না। তাই, তখনকার যুগে সমানে-সমান সম্পর্কটা হারাতে হয়েছিলো বলে চোখের জল ফেলবারও সত্যিই মানে হয় না। কিন্তু সেই সঙ্গেই মনে রাখতে হবে, আজকের দিনে অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েও মানুষ দেখছে মানুষে-মানুষ সম্পর্কটাকে আবার যদি সমানে-সমান করে নেওয়া না হয় তাহলে শান্তি নেই, সুখ নেই। আজকের দিনে তাই আবার ভালো করে ভেবে দেখা দরকার আদিম যুগের সমানে-সমান সম্পর্কটা খোয়া যাবার কথা। এই সম্পর্কটা হারানোর অনেকগুলো দিক আছে। সেই দিকগুলোর কথাই একে একে বলি।

যেমন ধরো, সিপাই-শান্ত্রী। যেমন ধরো, পাণ্ডা-পুরুত। এরা কারা? এরা এলোই বা কোথা থেকে?

মানুষ যতোদিন পর্যন্ত দল বেঁধে সমানে-সমান হয়ে থাকতো ততোদিন পর্যন্ত মানুষকে শাসন করবার জন্যে কোনো ব্যবস্থার দরকার পড়েনি। দলের কাজ চালাতো দলের মোড়ল আর সর্দার, আর এই মোড়ল আর সর্দার চলতো দলের সবাইকার মত মেনে। কিন্তু মানুষের দল দুভাগে ভাগ হয়ে যাবার পর দরকার পড়লো শাসন করবার ব্যবস্থা। কেননা, তখন থেকে আর সবাই সমানে-সমান নয়, সবাই স্বাধীন নয়। মানুষে-মানুষে ভাই-ভাই ভাব গেছে ভেঙে, দেখা দিয়েছে লোভ, লুঠতরাজ, মানুষের সঙ্গে মানুষের লড়াই। কিন্তু সবাই যদি লুঠতরাজ করতে যায়, সবাই যদি মারামারি আর কাটাকাটি নিয়ে মেতে ওঠে, তাহলে মানুষের দল একেবারে চুরমার হয়ে ভেঙে যাবার ভয়। তাই দরকার পড়লো কতকগুলো আইনকানুনের। আইন-কানুনগুলো সবাইকে মানতেই হবে, না মানলে শাস্তির ব্যবস্থা। শাস্তির ভয়ে আইন-কানুন মানা এমনতরো ব্যাপার এর আগে দরকার পড়েনি। কেননা, মানুষ তখন জানের দায়ে পৃথিবীর সঙ্গে লড়াই করছে, হাতিয়ার উন্নত হয় না বলেই দল বেঁধে একসঙ্গে মিলে লড়াই করছে, প্রাণপণে পৃথিবীর সঙ্গে লড়াই করে যতোটুকু জিনিস পাওয়া যায় ততোটুকু দিয়ে কোনোমতে সবাইকার প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। তাই সবাই গরিব, তবু সবাই সমান। সবাই মিলে যে-কাজটা করে সে-কাজটা সম্বন্ধে উচিত-অনুচিতের কথা, আইন-বেআইনের কথা ওঠে না। কিন্তু তারপর থেকে অন্য কথা - মানুষে মানুষে মারামারি আর কাটাকাটি। এই অবস্থায় কতকগুলো আইন-কানুন যদি না থাকে তাহলে মানুষের দলটা টিকবে কেমন করে?

কিন্তু শুধু কতকগুলো আইন-কানুন তৈরি করলেই তো হলো না, সবাই যাতে সেগুলো মানতে বাধ্য হয় সেই ব্যবস্থাও করা দরকার। সেই ব্যবস্থারই নাম হলো শাসন করবার ব্যবস্থা। আইন-কানুনগুলো সবাই ঠিকমতো মানছে কিনা তারই তদারক করার লোক চাই। আইনগুলো কে মানলো আর কে মানলো না তারই বিচার। তাছাড়া সিপাই চাই, শান্ত্রী চাই, জল্লাদ চাই, কোটাল চাই। যারা আইন মানবে না তাদের তাঁবে রাখার জন্যে। আস্তে আস্তে মানুষের দলের মধ্যে দেখা দিলো কাজির-উজির, জল্লাদ-কোটাল, সিপাই-শান্ত্রী। এরা শাসন করবে মানুষের দলকে, হিসেব করে দেখবে কে আইন মানলো আর কে আইন মানলো না; যে মানলো না তাকে ধরে আনতে হবে, তাকে শাস্তি দিতে হবে। শাসন বলে ব্যবস্থা না থাকলে তখন মানুষের দল টিকতে পারে না, তাই যাদের ওপর শাসনের ভার তাদের খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখবার দায়টা পড়লো বাকি সবাইকার ঘাড়ে। পৃথিবীর সঙ্গে লড়াই করে যে যা-কিছু জোগাড় করবে তার একটা করে অংশ যাবে এই শাসকদের পেট ভরাবার জন্যে। সেই অংশটারই নাম হলো খাজনা। 

প্রথমটায় মনে হতে পারে, খাসা ব্যবস্থা। কেউ যাতে অন্যায় করতে না পারে তাই জন্যে আইন-কানুন। আইন-কানুনগুলো যাতে কেউ না উড়িয়ে দিতে পারে তাই জন্যে শাসনব্যবস্থা। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলেই বুঝতে পারবে এই ব্যবস্থার মধ্যে ফাঁকিটা ঠিক কোথায়। আইন-কানুনগুলো শুরু হবার সময় থেকে আজ পর্যন্ত কোনোকালেই ওগুলোর উদ্দেশ্য নয় সমস্ত মানুষের যাতে ভালো হয় সেই ব্যবস্থা করা। সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বেশির ভাগ আইনের আদত কথাটা ঠিক কী? একদল মানুষ মুখ বুজে খাটবে, আর তাদের খাটুনি দিয়ে তৈরি জিনিস লুঠ করবে আর একদল মানুষ। যারা মুখ বুজে খাটবে তারা যদি মুখ বুঝে থাকতে রাজি না হয়? যদি রাজি না হয় নিজেদের মেহনত দিয়ে গড়া জিনিস অপরের ভাঁড়ারে তুলে দিতে? তাহলে শাস্তি, শাসন। তাই আইন। ঘাড় গুঁজে কুঁজো হয়ে রাজাকে মানতে হবে, না মানলে দারুণ শাস্তি। বড়োলোককে মানতে হবে, বড়োলোকের ভাঁড়ার থেকে কানাকড়ি সরানো চলবে না। সরাতে গেলে শাস্তি, দারুণ শাস্তি। বেশিরভাগ আইন-কানুনই হলো এই ধরনের আইন-কানুন। শোষণের খাতিরেই শাসন। যদিও অনেক রকম রঙচঙে আর মিষ্টি মিষ্টি কথা দিয়ে এই সত্যি কথাটুকুকে ঢেকে রাখবার চেষ্টা করা হয়েছে, তবুও ভালো করে ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে আইন-কানুন আর সিপাই-শান্ত্রী সব কিছুর পেছনে একটি হিসেব যাতে মেহনতকারীর দল হঠাৎ না বেঁকে দাঁড়ায়, হঠাৎ না রুখে ওঠে। তারই জন্যে এই সব ব্যবস্থা : আইন-কানুন, রাজা-উজির, হরেক রকমের।

কিন্তু শুধু ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা রাখাও কঠিন। কেননা, মেহনতকারীদের যে দল সেটাই হলো আসলে প্রকাণ্ড বড়ো দল। রাজা-উজিরই বলো আর বড়োলোকই বলো, গুনে দেখলে দেখা যায় বাকি মানুষদের চেয়ে যারা খেটে মরছে তাদের চেয়ে - দলে ওরা নেহাতই নগণ্য। তাই, শুধু সিপাই-শান্ত্রী আর জল্লাদ-কোটাল দিয়ে চিরকালের মতো এদের দাবিয়ে রাখা যায় না। বনের বাঘকে খাঁচায় পুরে রাখলেও নিশ্চিন্তি নেই, দরকার পড়ে নিয়ম করে বাঘকে আফিম খাওয়াবার। আফিম খেলে বাঘ ঝিমিয়ে থাকবে, মাথা তুলতে পারবে না, তাই কোনোদিন সে-খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে পড়তে পারে এ-হেন দুশ্চিন্তার আর কারণ থাকবে না। বাঘের বেলায় যে-রকম ব্যবস্থা, মেহনতকারী মানুষদের বেলাতেও খানিকটা সেই ধরণেরই ব্যবস্থা গড়ে উঠলো। এই ব্যবস্থাটার নাম ধর্ম। ধর্ম বলে ব্যাপারটা অবশ্য নেহাতই জটিল; তাই নিয়ে অনেক কিছু ভাববার আর বোঝবার আছে। তবু আমাদের গল্পের এখানে যেটা বিশেষ করে বোঝা দরকার শুধু সেটুকুই বলবো। যাতে মেহনতকারী মানুষেরা মাথা তুলতে না পারে, যাতে তারা ঝিমিয়ে থাকতে বাধ্য হয়, তারই একটা বড়ো উপায় বলতে ধর্ম। 

সিপাই-শান্ত্রীর সহায় হিসেবে দেখা দিলো পাণ্ডা-পুরুতের দল। মেহনতকারী মানুষ যাতে মাথা তুলতে না পারে, যাতে ঝিমিয়ে থাকতে বাধ্য হয়, সেই জন্যে পাণ্ডা আর পুরুত। সিপাই-শান্ত্রীর হাতে তীর-ধনুক আর বল্লম-বর্শা, পাণ্ডা-পুরুতের ঝুলিতে ধর্মের আফিম। তারা মানুষকে বুঝিয়ে বেড়াতে লাগলো পৃথিবীর সুখ-দুঃখ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। মানুষের এই নশ্বর জীবনে যদি সুখ না জোটে, যদি দুঃখ ভোগ করতে হয়, তাহলেও তাই নিয়ে মন-মেজাজ গরম করবার কোনো মানে হয় না। কেননা, করুণাময় ভগবান সৃষ্টি করেছেন এই পৃথিবী, এখানে যা কিছু ঘটছে তা সবই সেই মঙ্গলময়ের ইচ্ছায়। তিনি সব মানুষকেই সমান ভালোবাসেন। তাহলে কারুর কপালে অতো সুখ আর কারুর কপালে অতো দুঃখ কেন? বিশেষ করে আমাদের দেশে যারা ধর্মের প্রচারক তারা বললে : ঐ তো মজা! আসলে যে-লোক আগের জন্মে ভালো কাজ করেছে এ-জন্মে সে সুখভোগ করছে, যে-লোক আগের জন্মে খারাপ কাজ করেছে এ-জন্মে সে দুঃখভোগ করছে। এই হলো ভগবানের নিয়ম। তাই এ-জন্মে সুখ পাচ্ছো, না, দুঃখ পাচ্ছো তাই নিয়ে মাথা ঘামিও না। মুখ বুজে ভগবানের আদেশ হলো রাজাকে ভক্তি করবার আদেশ, পাণ্ডা আর পুরোহিতের কথা মানবার আদেশ। যদি মুখ বুজে এই সব আদেশ পালন করতে পারো তাহলে পরজন্মে বা পরকালে তোমার কপালেও অনেক সুখ জুটবে। এ-জন্মে শাকান্ন পাচ্ছো না বলে ভগবানে ভক্তি হারিও না। আসলে ভগবান তোমাকে দুঃখ দিয়ে পরখ করে নিচ্ছেন। ইহকালে শাকান্নের অভাবটা যদি হাসিমুখে মানতে পারো তাহলে পরকালে তোমার পরমান্ন একেবারে সুনিশ্চিত। জীবনে যে-আনন্দ তুমি পেলে না সে-আনন্দ পাবার আশায় নিজে নিজে কিছু করে বসাটা একেবারে মূর্খতা; মঙ্গলময়ের পায়ে মাথা কোটো, তাঁর মনে করুণার উদ্রেক করো, তিনি তোমার মনস্কামনা পূরণ করবেন। তাঁর ইচ্ছে অনুসারেই পৃথিবী চলে, তাই তাঁর কাছে করুণা ভিক্ষে করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

অবশ্যই, মেহনতকারী মানুষরা যদি ভগবানের পায়ে শুধু মাথাই কোটে তাহলে পাণ্ডা-পুরুতদের সংসারই বা চলে কেমন করে? তাই ওরা প্রচার করতে শুরু করলো, শুধু কথায় ভগবানের মন ভেজে না। তার পায়ে মাথা কুটতে হবে, কিন্তু সেই সঙ্গেই তাকে চালকলার নৈবেদ্য খাওয়াতে হবে, আর এই ভগবানের সঙ্গে যেহেতু পাণ্ডা-পুরুতদের খুব ভাবসাব সেই হেতু এদের জন্যে কিছু নগদ দক্ষিণা না আনলেই বা চলবে কেন?

প্রার্থনার মাহাত্ম্য। করুণা চাওয়া, ভিক্ষে চাওয়া, মাথা কোটা। মনে রাখতে হবে, মানুষ যতোদিন ছেলেমানুষ ছিলো, ছিলো দল বেঁধে মিলে মিশে সমানে-সমান হয়ে, ততদিন মানুষের মাথায় এই করুণা-চাওয়া, ভিক্ষে চাওয়া প্রার্থনা করবার কথা আসেনি। ততোদিন ছিল ইন্দ্রজাল। ইন্দ্রজালের মধ্যে কল্পনার আর আজগুবি ধারণার দিকটা যতোখানিই থাকুক না কেন, এর আসল ঝোঁক হলো পৃথিবীটাকে জয় করবার দিকে। কিন্তু আগেকার সেই সমানে-সমান জীবন ভেঙে যাবার পর থেকে নষ্ট হলো জয় করবার দিকে ঝোঁকটাও। মানুষ শিখলো মাথা কুটতে, মানুষ ভাবলো বিধাতার কথা। যারা শোষক, পরের মেহনত লুঠ করে বড়োলোক হয়, তারা বাকি সবাইকে শেখাতে লাগলো এই বিধাতার কথাটা : সবই ঘটছে বিধাতার কৃপায়, বড়োলোকদের ওপরে রাগ করে লাভ নেই, লাভ শুধু বিধাতার পায়ে মাথা কুটে।

***************************************************

আরো একটুখানি তলিয়ে দেখা যাক, দেখা যাক ঠিক কোন ধরনের কথাগুলো শাসকদের মনের মতো কথা। খুব মোটামুটি বললে বলতে হবে, এই ধরনের কথা আছে দুটো। এক হলো, এই যে দুনিয়া এটা আসলে সত্যি জিনিস নয়। আর দু-নম্বরের কথা হলো, এই দুনিয়াতে আসলে কোনো অদলবদল নেই, যা সত্য তা চিরকাল একই রকম, তা বদলায় না। কথা দুটোকে ভালো করে বোঝবার দরকার আছে।

প্রথমত, দুনিয়াটাকে আমরা যেভাবে দেখি সেইভাবে দেখাটা ঠিক দেখা নয়। আমরা দেখি, এই দুনিয়ায় মাটি আছে, মাটির বুকে ফসল ফলায় মানুষ আর সেই ফসল খেয়ে পেট ভরে মানুষের। শাসকদের মনের কথা হলো, এই সবই ভুল দেখা। যেমন, ভুল করে মানুষ অনেক সময় দড়িতে সাপ দেখে সেইরকম। আসলে ওখানে আছে দড়ি, সাপ নয়। তবু অন্ধকার আর অজ্ঞানের ঘোরে ভুল করে কেউবা ভাবলো সাপই। এও তেমনি। আছে অন্য রকমের জিনিস, সাধারণ মানুষ ভুল করে দেখছে মাটির পৃথিবী, রক্তমাংসে গড়া মানুষ, এই রকম কতোই না!

কিন্তু এই ধরনের কথাটাই শাসকদের মনের কথা কেন? কেননা, সাধারণ মানুষকে যদি কোনোমতে বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে এই মাটির পৃথিবীটা সত্যি নয়, রক্ত-মাংস দিয়ে গড়া মানুষগুলোও সত্যি নয়, সত্যি নয় মানুষের পেটের জ্বালা, সত্যি নয় অন্ন-বস্ত্র যা দিয়ে পেটের জ্বালা মেটানো যায়, শীতের হাত থেকে শরীরকে বাঁচানো যায় - তাহলে সাধারণ মানুষের মনটা অন্য দিকে যাবে, মাটির পৃথিবীর কাছ থেকে আদায় করা জিনিসপত্তরগুলোকে আর তারা অতো দামী মনে করবে না। আর সাধারণ মানুষের মন যদি সত্যিই অন্যদিকে যায় তাহলে শোষকরা তো দিব্বি নিশ্চিন্তি।

ভেবে দেখো একবার। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাটির বুকে ফসল ফলায় তারা যদি বলতে শুরু করে: 'ওই ফসলটা হলো সত্যি, ওই ফসল দিয়ে পেট ভরানোটাই হলো সত্যি; আমি চাই ওই ফসল, যতোটা আমার মেহনত দিয়ে তৈরি ততোটারই ওপর দখল শুধু আমার, আর কারুর নয়' তাহলে? যদি সমস্ত মেহনতকারী মানুষ মাটির পৃথিবীটাকে এইভাবে সত্যি বলে চিনতে শুরু করে, তাহলে শাসকদের মন ভয়ে কেঁপে উঠবে না কি? তাই শাসকদের মনের কথাটা উলটো ধরনের কথা। মাটির পৃথিবীটা সত্যি জিনিস নয়, এর পেছনে অন্য কিছু আছে, যা সত্যি, যা বাস্তব।

আর অদল-বদল। পৃথিবীটা কি সত্যিই বদলে যায়? আজ তার চেহারাটা যে-রকম আগামীকাল কি সেই রকম আর থাকবে না? বদলে গিয়ে অন্য রকম হয়ে যাবে? শাসকের দল নিশ্চয়ই আর্তনাদ করে বলবে : না না, তা কিছুতেই নয়, তা কখনো হতেই পারে না। আজকের দিনে পরের মেহনত দিয়ে গড়া জিনিস লুঠ করে যে-রকম মজায় দিন কাটছে বরাবরই যেন সেইরকম ভাবে দিন কাটে। পৃথিবী বদলে গিয়ে অন্যরকম হয়ে গেলে চলবে কেন? আসলে, পৃথিবীতে অদল-বদল বলে আমরা যা কিছু দেখি তার সবটুকুই হলো দেখার ভুল। বদল আসলে নেই, ভুল করে মনে করছি বদল দেখছি বুঝি। এও ওই দড়িতে সাপ দেখার মতো। শোষকের দল এই কথাটাও সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করাতে চায়। বলতে চায়, পৃথিবীটা চিরন্তন, অদল-বদল বলে বাস্তবিকই কিছু নেই পৃথিবীতে।

মোটামুটি এই দুটো কথাই হলো শাসকদের মনের মতো কথা। এই দুটো কথা যদি সাধারণ মানুষের মনে খুব গভীরভাবে গেঁথে দেওয়া যায় তাহলে তার মন একেবারে চিরকালের মতো পঙ্গু হয়ে থাকবে, শোষণের বিরুদ্ধে, শাসনের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, এই মন কোনোদিন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। আর মন যদি না ওঠে তাহলে হাতও উঠবে না। হাত না উঠলে নিশ্চিন্তি।

তাই ধর্ম ছাড়াও শাসকদের তরফ থেকে অন্য রকম ব্যবস্থার বন্দোবস্ত আছে। মস্ত বড় বড় পণ্ডিতদের মুখ দিয়ে এই কথাগুলো প্রচার করানো। তারা সব এমনটাই ডাকসাইটে পণ্ডিত যে তর্ক করে দিনকে রাত বলে প্রমাণ দিতে পারেন। তুমি হয়তো স্পষ্টই বুঝছো যে তোমার দারুণ খিদে পেয়েছে, এক দলা ভাত গিললেই তোমার পেটের জ্বালা জুড়োবে। কিন্তু ওই সব বড়ো বড়ো পণ্ডিতেরা এমন সব তর্কের মারপ্যাঁচ শুরু করবে যে তোমার কাছে সব কিছু গোলমাল হয়ে যাবে, আর তুমি শেষ পর্যন্ত মানতে বাধ্য হবে যে তোমার কথাটাই ভুল, ওদের কথাটাই সত্যি। মেহনত করবার সময়, গতর খাটাবার সময়, মানুষ স্পষ্টই দেখছে যে তার হাতের কোদালটা সত্যিকারের কোদাল, যে-ফসলটা ফলছে সেটাও নেহাতই সত্যিকারের ফসল। কিন্তু মেহনতের কথাটা, গতর খাটাবার কথাটা আলাদা কথা। যখন থেকে মানুষের সমাজ চিড় খেয়ে দু-ভাগে ভেঙে গিয়েছে তখন থেকেই গতর খাটানো আর মাথা খাটানোর মধ্যে মুখ দেখাদেখি নেই, গতর খাটাবার সময় যে-কথাটাকে স্পষ্ট আর সত্যি বলে মনে হয় মাথা খাটিয়ে সেই কথাটাকেই একেবারে ভুল আর বাজে কথা বলে প্রমাণ করে দেওয়া।

যতো দিন কেটেছে ততোই ধারালো হয়েছে, শাণিত হয়েছে শাসকদলের পণ্ডিতদের এই সব যুক্তি-তর্কগুলো। দিনের পর দিন ধরে তারা দিনকে রাত করে চলেছে, আর সবাই মুগ্ধ হয়ে বলেছে : কী অসাধারণ পণ্ডিত! কী বিদ্যা! কী বুদ্ধি! শোষকরা খাতির করে সভায় ডেকে এনেছে এই সব পণ্ডিতদের।

এমন কি আজকের পৃথিবীতেও এই ধরণের ব্যাপারে শেষ নেই। তার কারণ আজকের পৃথিবীতেও একদিকে শোষক আর একদিকে মেহনতকারী মানুষ, যাদের ভুল বোঝানো দরকার। তারা হয়তো ক্ষেপে উঠবে, বলবে : 'পৃথিবীকে বদল করবো আমরা! শেষ হবে শোষণ, পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী আসবে।'

No comments:

Post a Comment