দেহগত আকৃতি-প্রকৃতি তারতম্য অনুযায়ী, অর্থাৎ চুল, চোখ, নাক, মাথার খুলি, গায়ের রং প্রভৃতির পার্থক্যের ভিত্তিতে মানুষের যে ভাগ-বিভাগ করা হয় - নৃতত্ত্ববিজ্ঞানে সেটা একটা দীর্ঘদিনের প্রচণ্ড বিতর্কমূলক বিষয়। এ বিষয়ে মূল সমস্যা প্রধানত দুটি। এক: প্রাণী-জগতের বিবর্তনের ক্রম-বিকাশে একটি জায়গায় এবং একটি মূল উৎস থেকেই মানুষের আবির্ভাব হয়েছিলো, না, এই ক্রমবিকাশের ধারায় একসঙ্গে বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন মানুষের গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়েছিলো - এ প্রশ্নের জবাবে নৃতত্ত্ববিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারেননি। দুই: উপরের ওই প্রশ্ন থেকেই আরেকটি প্রশ্ন ওঠে। সেটা হলো এই যে, জীব হিসাবে গোটা মানুষের সমাজ একই শ্রেণিভুক্ত হলেও, দৈহিক আকৃতি এবং বর্ণের দিক দিয়ে বিভিন্ন মানুষের গোষ্ঠীতে যে পার্থক্য রয়েছে, সে পার্থক্যের উৎস কি? পৃথিবীর আবির্ভাবের সময় থেকেই কি এই পার্থক্য ছিলো? এ বিষয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে নানারকম বিপরীত মত আছে। এক দলের মত হলো যে কিছু কিছু পার্থক্য নিয়েই এই পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হয়েছিলো; ফলে গোটা মানুষের সমাজে দেহগত আকৃতি ইত্যাদির দিক দিয়ে মূল কয়েকটি বিশিষ্ট আলাদা আলাদা গোষ্ঠী এখনো পর্যন্ত তাদের পৃথক স্বাতন্ত্র্য নিয়ে টিকে আছে। তাঁদের মতে গোটা মানুষের সমাজে এগুলোই হলো আদি এবং "খাঁটি" জাতি। আরেকদল পণ্ডিত ওই "আদি" ও "খাঁটি" জাতিতে বিশ্বাসী নন। তাঁরা বলেন যে শুরু থেকেই মানুষের মধ্যে ক্রমাগত এমন একটি মিশ্রণ ও সংমিশ্রণের ধারা চলে আসছে যে এই ধরনের কোনো "খাঁটি" জাতির কথা ভাবাই যায় না।
যাই হোক, সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়ানো মানুষের মধ্যে মোটামুটি কয়েকটি মূল পার্থক্য এখনো নজরে পড়ে। আগেই বলেছি, এ পার্থক্যগুলি কিন্তু শুধুই শরীরের গঠন, রং ইত্যাদির ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত। নৃতত্ত্ববিজ্ঞানীরা এই পার্থক্যগুলি অনুযায়ী মানুষকে মোটামুটি চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন : (১) ইউরোপ, ভূমধ্যসাগর অঞ্চল এবং পশ্চিম এশিয়া জুড়ে শ্বেতকায় যে মানুষের দল চোখে পড়ে, পণ্ডিতরা তাকে ককেশয়েড বলে অভিহিত করেছেন। ককেশিয়ানদের মধ্যে আবার কয়েকটি প্রধান উপশাখা আছে। একেবারে উত্তর অঞ্চলের শ্বেতকায় মানুষ বা নর্ডিক; মাঝামাঝি আরেকটি দল অর্থাৎ আলপাইন; এবং দক্ষিণ অঞ্চলের ঈষৎ ঘন বর্ণের মানুষ অর্থাৎ মেডিটারেনিয়ান বা আইবেরিয়ান। (২) পূর্বএশিয়া এবং আমেরিকা মহাদেশ জুড়ে পীতকায় যে মানুষের দল চোখে পড়ে তারা হলো মঙ্গোলয়েড। (৩) আফ্রিকার ঘন কৃষ্ণকায় মানুষের দল হলো নিগ্রয়েড, এবং (৪) অস্ট্রেলিয়া ও নিউগিনি অঞ্চলের প্রাচীনতম অধিবাসীরা - পণ্ডিতরা যাকে অস্ট্রোলয়েড বলে অভিহিত করেছেন। অবশ্য কালক্রমে এই চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্যের জাতির পরস্পরের মধ্যে প্রচুর মিশ্রণ এবং সংমিশ্রণ হবার ফলে নানারকম মিশ্র জাতির সৃষ্টি হয়েছে।
যেমন জাতিগত বৈষম্যের দিক দিয়ে, তেমনি ভাষাগত বৈষম্যের দিক দিয়েও পণ্ডিতমহলের নানারকম মতভেদ রয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীতে আমরা অসংখ্য ভাষার ব্যবহার দেখতে পাই। এগুলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করে পণ্ডিতরা মানুষের ভাষা-গোষ্ঠীকেও কয়েকটি মূল বিভাগে বিভক্ত করেছেন। (১) ইন্দো-ইউরোপীয়: এর অন্তর্ভুক্ত হলো কেলট, গ্রিক, ল্যাতিন, টিউটনিক, স্লাভ, আর্য, হিটটাইট ইত্যাদি। (২) সেমিটিক: এর অন্তর্ভুক্ত হলো প্রাচীন ব্যাবিলন ও আসীরিয়ার ভাষা, ফিনিশীয়দের ভাষা, হিব্রু, সিরিয়ান, আরব, আবিসিনিয়ান ইত্যাদি। (৩) হ্যামিটিক: প্রাচীন মিশরবাসীদের ভাষা এর অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তাছাড়া উত্তর আফ্রিকার বার্বার এবং পূর্ব-আফ্রিকার সোমালী ইত্যাদি ভাষাও এর অন্তর্ভুক্ত। (৪) তুরানিয়ান বা ফিনো-ঊগ্রীয়: ল্যাপল্যাণ্ড, সাইবেরিয়া, ফিনল্যাণ্ড, ম্যাজার, তুর্কী, মাঞ্চু, মঙ্গোল ইত্যাদি ভাষা এর অন্তর্ভুক্ত। (৫) ভোট-চীন: চীন, বর্মী, শ্যাম এবং তিব্বতী ভাষাগুলি এর অন্তর্ভুক্ত। (৬) আমেরিন্ডিয়ান: অর্থাৎ উত্তর আমেরিকার আদিম আদিবাসী রেড-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে প্রচলিত ভাষাগুলি। (৭) অস্ট্রিক: মালয় এবং পলিনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জের আদিম আদিবাসীদের ব্যবহৃত ভাষাসমূহ। আফ্রিকার বান্টুদের মধ্যে প্রচলিত ভাষাটিও একটি আলাদা বিশিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বলে পণ্ডিতরা মনে করেন। দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠী সম্পর্কেও নানারকম মতামত আছে।
এই প্রসঙ্গে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেটা হলো এই যে, এখনো পর্যন্ত মানুষের ব্যবহৃত কয়েকটি প্রাচীন ভাষার পাঠোদ্ধার হয়নি বলে সেই ভাষাগুলোর গোষ্ঠীবিভাগ সম্পর্কে সঠিকভাবে এখনো কিছু বলা যায় না। এগুলো হলো : (১) প্রাচীন সিন্ধু-উপত্যকার সভ্যতার ভাষা, (২) প্রাচীন ক্রীটের ভাষা, (৩) সুমের-এর প্রাচীনতম অধিবাসীদের ভাষা।
No comments:
Post a Comment