আচ্ছা আমরা কেন সবসময় ধরে নিই ভারতে আধুনিক মানুষকে বাইরের কোথাও থেকেই আসতে হয়েছে? কেন এখানেই তাদের উৎপত্তি হল না? মাত্র কয়েক দশক আগেও এটা বেশ একটা যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন বলে ভাবা যেত, কারণ আধুনিক মানুষ যে পৃথকভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে হোমো প্রজাতির প্রাচীন বা বিলুপ্ত সদস্যদের (যেমন হোমো ইরেক্টাস) যারা প্রায় ১৯ লক্ষ বছর আগে সমস্ত ইউরেশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল, তাদের থেকে বিবর্তিত হয়েছিল, সেই তত্ত্বটি তখনও জোরালো ছিল - যদিও চার্লস ডারউইন ১৮৭১ সাল নাগাদই আধুনিক মানুষের আফ্রিকীয় বংশোদ্ভূত হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তত্ত্বটি ছিল বিভিন্নভাবে বিবর্তিত জনগোষ্ঠী পরবর্তীকালে নিজেদের মধ্যে মিশ্রণ ঘটানোর ফলে এইভাবে একটি প্রজাতি হিসাবে আমাদের একত্র করতে পেরেছে, এভাবে বিভিন্ন মহাদেশে আমাদের বিভিন্ন প্রজাতিতে ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আটকানো গেছে।
Friday, 26 April 2024
আদি ভারতীয় - টনি জোসেফ
আচ্ছা আমরা কেন সবসময় ধরে নিই ভারতে আধুনিক মানুষকে বাইরের কোথাও থেকেই আসতে হয়েছে? কেন এখানেই তাদের উৎপত্তি হল না? মাত্র কয়েক দশক আগেও এটা বেশ একটা যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন বলে ভাবা যেত, কারণ আধুনিক মানুষ যে পৃথকভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে হোমো প্রজাতির প্রাচীন বা বিলুপ্ত সদস্যদের (যেমন হোমো ইরেক্টাস) যারা প্রায় ১৯ লক্ষ বছর আগে সমস্ত ইউরেশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল, তাদের থেকে বিবর্তিত হয়েছিল, সেই তত্ত্বটি তখনও জোরালো ছিল - যদিও চার্লস ডারউইন ১৮৭১ সাল নাগাদই আধুনিক মানুষের আফ্রিকীয় বংশোদ্ভূত হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তত্ত্বটি ছিল বিভিন্নভাবে বিবর্তিত জনগোষ্ঠী পরবর্তীকালে নিজেদের মধ্যে মিশ্রণ ঘটানোর ফলে এইভাবে একটি প্রজাতি হিসাবে আমাদের একত্র করতে পেরেছে, এভাবে বিভিন্ন মহাদেশে আমাদের বিভিন্ন প্রজাতিতে ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আটকানো গেছে।
Tuesday, 16 April 2024
পৃথিবীর ইতিহাস - দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, রমাকৃষ্ণ মৈত্র
দেহগত আকৃতি-প্রকৃতি তারতম্য অনুযায়ী, অর্থাৎ চুল, চোখ, নাক, মাথার খুলি, গায়ের রং প্রভৃতির পার্থক্যের ভিত্তিতে মানুষের যে ভাগ-বিভাগ করা হয় - নৃতত্ত্ববিজ্ঞানে সেটা একটা দীর্ঘদিনের প্রচণ্ড বিতর্কমূলক বিষয়। এ বিষয়ে মূল সমস্যা প্রধানত দুটি। এক: প্রাণী-জগতের বিবর্তনের ক্রম-বিকাশে একটি জায়গায় এবং একটি মূল উৎস থেকেই মানুষের আবির্ভাব হয়েছিলো, না, এই ক্রমবিকাশের ধারায় একসঙ্গে বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন মানুষের গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়েছিলো - এ প্রশ্নের জবাবে নৃতত্ত্ববিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারেননি। দুই: উপরের ওই প্রশ্ন থেকেই আরেকটি প্রশ্ন ওঠে। সেটা হলো এই যে, জীব হিসাবে গোটা মানুষের সমাজ একই শ্রেণিভুক্ত হলেও, দৈহিক আকৃতি এবং বর্ণের দিক দিয়ে বিভিন্ন মানুষের গোষ্ঠীতে যে পার্থক্য রয়েছে, সে পার্থক্যের উৎস কি? পৃথিবীর আবির্ভাবের সময় থেকেই কি এই পার্থক্য ছিলো? এ বিষয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে নানারকম বিপরীত মত আছে। এক দলের মত হলো যে কিছু কিছু পার্থক্য নিয়েই এই পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হয়েছিলো; ফলে গোটা মানুষের সমাজে দেহগত আকৃতি ইত্যাদির দিক দিয়ে মূল কয়েকটি বিশিষ্ট আলাদা আলাদা গোষ্ঠী এখনো পর্যন্ত তাদের পৃথক স্বাতন্ত্র্য নিয়ে টিকে আছে। তাঁদের মতে গোটা মানুষের সমাজে এগুলোই হলো আদি এবং "খাঁটি" জাতি। আরেকদল পণ্ডিত ওই "আদি" ও "খাঁটি" জাতিতে বিশ্বাসী নন। তাঁরা বলেন যে শুরু থেকেই মানুষের মধ্যে ক্রমাগত এমন একটি মিশ্রণ ও সংমিশ্রণের ধারা চলে আসছে যে এই ধরনের কোনো "খাঁটি" জাতির কথা ভাবাই যায় না।
যাই হোক, সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়ানো মানুষের মধ্যে মোটামুটি কয়েকটি মূল পার্থক্য এখনো নজরে পড়ে। আগেই বলেছি, এ পার্থক্যগুলি কিন্তু শুধুই শরীরের গঠন, রং ইত্যাদির ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত। নৃতত্ত্ববিজ্ঞানীরা এই পার্থক্যগুলি অনুযায়ী মানুষকে মোটামুটি চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন : (১) ইউরোপ, ভূমধ্যসাগর অঞ্চল এবং পশ্চিম এশিয়া জুড়ে শ্বেতকায় যে মানুষের দল চোখে পড়ে, পণ্ডিতরা তাকে ককেশয়েড বলে অভিহিত করেছেন। ককেশিয়ানদের মধ্যে আবার কয়েকটি প্রধান উপশাখা আছে। একেবারে উত্তর অঞ্চলের শ্বেতকায় মানুষ বা নর্ডিক; মাঝামাঝি আরেকটি দল অর্থাৎ আলপাইন; এবং দক্ষিণ অঞ্চলের ঈষৎ ঘন বর্ণের মানুষ অর্থাৎ মেডিটারেনিয়ান বা আইবেরিয়ান। (২) পূর্বএশিয়া এবং আমেরিকা মহাদেশ জুড়ে পীতকায় যে মানুষের দল চোখে পড়ে তারা হলো মঙ্গোলয়েড। (৩) আফ্রিকার ঘন কৃষ্ণকায় মানুষের দল হলো নিগ্রয়েড, এবং (৪) অস্ট্রেলিয়া ও নিউগিনি অঞ্চলের প্রাচীনতম অধিবাসীরা - পণ্ডিতরা যাকে অস্ট্রোলয়েড বলে অভিহিত করেছেন। অবশ্য কালক্রমে এই চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্যের জাতির পরস্পরের মধ্যে প্রচুর মিশ্রণ এবং সংমিশ্রণ হবার ফলে নানারকম মিশ্র জাতির সৃষ্টি হয়েছে।
যেমন জাতিগত বৈষম্যের দিক দিয়ে, তেমনি ভাষাগত বৈষম্যের দিক দিয়েও পণ্ডিতমহলের নানারকম মতভেদ রয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীতে আমরা অসংখ্য ভাষার ব্যবহার দেখতে পাই। এগুলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করে পণ্ডিতরা মানুষের ভাষা-গোষ্ঠীকেও কয়েকটি মূল বিভাগে বিভক্ত করেছেন। (১) ইন্দো-ইউরোপীয়: এর অন্তর্ভুক্ত হলো কেলট, গ্রিক, ল্যাতিন, টিউটনিক, স্লাভ, আর্য, হিটটাইট ইত্যাদি। (২) সেমিটিক: এর অন্তর্ভুক্ত হলো প্রাচীন ব্যাবিলন ও আসীরিয়ার ভাষা, ফিনিশীয়দের ভাষা, হিব্রু, সিরিয়ান, আরব, আবিসিনিয়ান ইত্যাদি। (৩) হ্যামিটিক: প্রাচীন মিশরবাসীদের ভাষা এর অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তাছাড়া উত্তর আফ্রিকার বার্বার এবং পূর্ব-আফ্রিকার সোমালী ইত্যাদি ভাষাও এর অন্তর্ভুক্ত। (৪) তুরানিয়ান বা ফিনো-ঊগ্রীয়: ল্যাপল্যাণ্ড, সাইবেরিয়া, ফিনল্যাণ্ড, ম্যাজার, তুর্কী, মাঞ্চু, মঙ্গোল ইত্যাদি ভাষা এর অন্তর্ভুক্ত। (৫) ভোট-চীন: চীন, বর্মী, শ্যাম এবং তিব্বতী ভাষাগুলি এর অন্তর্ভুক্ত। (৬) আমেরিন্ডিয়ান: অর্থাৎ উত্তর আমেরিকার আদিম আদিবাসী রেড-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে প্রচলিত ভাষাগুলি। (৭) অস্ট্রিক: মালয় এবং পলিনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জের আদিম আদিবাসীদের ব্যবহৃত ভাষাসমূহ। আফ্রিকার বান্টুদের মধ্যে প্রচলিত ভাষাটিও একটি আলাদা বিশিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বলে পণ্ডিতরা মনে করেন। দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠী সম্পর্কেও নানারকম মতামত আছে।
এই প্রসঙ্গে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেটা হলো এই যে, এখনো পর্যন্ত মানুষের ব্যবহৃত কয়েকটি প্রাচীন ভাষার পাঠোদ্ধার হয়নি বলে সেই ভাষাগুলোর গোষ্ঠীবিভাগ সম্পর্কে সঠিকভাবে এখনো কিছু বলা যায় না। এগুলো হলো : (১) প্রাচীন সিন্ধু-উপত্যকার সভ্যতার ভাষা, (২) প্রাচীন ক্রীটের ভাষা, (৩) সুমের-এর প্রাচীনতম অধিবাসীদের ভাষা।
Tuesday, 2 April 2024
যে গল্পের শেষ নেই - দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
তবু সে-গল্প শোনাবার সময় ভুলে গেলে চলবে না যে সুদূর অতীতে ওই অসহ্য দারিদ্র্যের জীবন ছেড়ে আসবার সময়, অভাবের অন্ধকার থেকে প্রাচুর্যের আঙিনায় এগিয়ে আসবার জন্যে, মানুষকে মূল্যও দিতে হয়েছে অনেকখানি। আগেকার দিনে সমানে-সমান সম্পর্কটাও গিয়েছে খোয়া। এ-কথায় কোনো সন্দেহই নেই যে ওই রকমের একটা দারুণ মূল্য চোকাতে না পারলে মানুষ আজ এমন বড়ো হতে পারতো না। তাই, তখনকার যুগে সমানে-সমান সম্পর্কটা হারাতে হয়েছিলো বলে চোখের জল ফেলবারও সত্যিই মানে হয় না। কিন্তু সেই সঙ্গেই মনে রাখতে হবে, আজকের দিনে অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েও মানুষ দেখছে মানুষে-মানুষ সম্পর্কটাকে আবার যদি সমানে-সমান করে নেওয়া না হয় তাহলে শান্তি নেই, সুখ নেই। আজকের দিনে তাই আবার ভালো করে ভেবে দেখা দরকার আদিম যুগের সমানে-সমান সম্পর্কটা খোয়া যাবার কথা। এই সম্পর্কটা হারানোর অনেকগুলো দিক আছে। সেই দিকগুলোর কথাই একে একে বলি।
যেমন ধরো, সিপাই-শান্ত্রী। যেমন ধরো, পাণ্ডা-পুরুত। এরা কারা? এরা এলোই বা কোথা থেকে?
মানুষ যতোদিন পর্যন্ত দল বেঁধে সমানে-সমান হয়ে থাকতো ততোদিন পর্যন্ত মানুষকে শাসন করবার জন্যে কোনো ব্যবস্থার দরকার পড়েনি। দলের কাজ চালাতো দলের মোড়ল আর সর্দার, আর এই মোড়ল আর সর্দার চলতো দলের সবাইকার মত মেনে। কিন্তু মানুষের দল দুভাগে ভাগ হয়ে যাবার পর দরকার পড়লো শাসন করবার ব্যবস্থা। কেননা, তখন থেকে আর সবাই সমানে-সমান নয়, সবাই স্বাধীন নয়। মানুষে-মানুষে ভাই-ভাই ভাব গেছে ভেঙে, দেখা দিয়েছে লোভ, লুঠতরাজ, মানুষের সঙ্গে মানুষের লড়াই। কিন্তু সবাই যদি লুঠতরাজ করতে যায়, সবাই যদি মারামারি আর কাটাকাটি নিয়ে মেতে ওঠে, তাহলে মানুষের দল একেবারে চুরমার হয়ে ভেঙে যাবার ভয়। তাই দরকার পড়লো কতকগুলো আইনকানুনের। আইন-কানুনগুলো সবাইকে মানতেই হবে, না মানলে শাস্তির ব্যবস্থা। শাস্তির ভয়ে আইন-কানুন মানা এমনতরো ব্যাপার এর আগে দরকার পড়েনি। কেননা, মানুষ তখন জানের দায়ে পৃথিবীর সঙ্গে লড়াই করছে, হাতিয়ার উন্নত হয় না বলেই দল বেঁধে একসঙ্গে মিলে লড়াই করছে, প্রাণপণে পৃথিবীর সঙ্গে লড়াই করে যতোটুকু জিনিস পাওয়া যায় ততোটুকু দিয়ে কোনোমতে সবাইকার প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। তাই সবাই গরিব, তবু সবাই সমান। সবাই মিলে যে-কাজটা করে সে-কাজটা সম্বন্ধে উচিত-অনুচিতের কথা, আইন-বেআইনের কথা ওঠে না। কিন্তু তারপর থেকে অন্য কথা - মানুষে মানুষে মারামারি আর কাটাকাটি। এই অবস্থায় কতকগুলো আইন-কানুন যদি না থাকে তাহলে মানুষের দলটা টিকবে কেমন করে?
কিন্তু শুধু কতকগুলো আইন-কানুন তৈরি করলেই তো হলো না, সবাই যাতে সেগুলো মানতে বাধ্য হয় সেই ব্যবস্থাও করা দরকার। সেই ব্যবস্থারই নাম হলো শাসন করবার ব্যবস্থা। আইন-কানুনগুলো সবাই ঠিকমতো মানছে কিনা তারই তদারক করার লোক চাই। আইনগুলো কে মানলো আর কে মানলো না তারই বিচার। তাছাড়া সিপাই চাই, শান্ত্রী চাই, জল্লাদ চাই, কোটাল চাই। যারা আইন মানবে না তাদের তাঁবে রাখার জন্যে। আস্তে আস্তে মানুষের দলের মধ্যে দেখা দিলো কাজির-উজির, জল্লাদ-কোটাল, সিপাই-শান্ত্রী। এরা শাসন করবে মানুষের দলকে, হিসেব করে দেখবে কে আইন মানলো আর কে আইন মানলো না; যে মানলো না তাকে ধরে আনতে হবে, তাকে শাস্তি দিতে হবে। শাসন বলে ব্যবস্থা না থাকলে তখন মানুষের দল টিকতে পারে না, তাই যাদের ওপর শাসনের ভার তাদের খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখবার দায়টা পড়লো বাকি সবাইকার ঘাড়ে। পৃথিবীর সঙ্গে লড়াই করে যে যা-কিছু জোগাড় করবে তার একটা করে অংশ যাবে এই শাসকদের পেট ভরাবার জন্যে। সেই অংশটারই নাম হলো খাজনা।
প্রথমটায় মনে হতে পারে, খাসা ব্যবস্থা। কেউ যাতে অন্যায় করতে না পারে তাই জন্যে আইন-কানুন। আইন-কানুনগুলো যাতে কেউ না উড়িয়ে দিতে পারে তাই জন্যে শাসনব্যবস্থা। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলেই বুঝতে পারবে এই ব্যবস্থার মধ্যে ফাঁকিটা ঠিক কোথায়। আইন-কানুনগুলো শুরু হবার সময় থেকে আজ পর্যন্ত কোনোকালেই ওগুলোর উদ্দেশ্য নয় সমস্ত মানুষের যাতে ভালো হয় সেই ব্যবস্থা করা। সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বেশির ভাগ আইনের আদত কথাটা ঠিক কী? একদল মানুষ মুখ বুজে খাটবে, আর তাদের খাটুনি দিয়ে তৈরি জিনিস লুঠ করবে আর একদল মানুষ। যারা মুখ বুজে খাটবে তারা যদি মুখ বুঝে থাকতে রাজি না হয়? যদি রাজি না হয় নিজেদের মেহনত দিয়ে গড়া জিনিস অপরের ভাঁড়ারে তুলে দিতে? তাহলে শাস্তি, শাসন। তাই আইন। ঘাড় গুঁজে কুঁজো হয়ে রাজাকে মানতে হবে, না মানলে দারুণ শাস্তি। বড়োলোককে মানতে হবে, বড়োলোকের ভাঁড়ার থেকে কানাকড়ি সরানো চলবে না। সরাতে গেলে শাস্তি, দারুণ শাস্তি। বেশিরভাগ আইন-কানুনই হলো এই ধরনের আইন-কানুন। শোষণের খাতিরেই শাসন। যদিও অনেক রকম রঙচঙে আর মিষ্টি মিষ্টি কথা দিয়ে এই সত্যি কথাটুকুকে ঢেকে রাখবার চেষ্টা করা হয়েছে, তবুও ভালো করে ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে আইন-কানুন আর সিপাই-শান্ত্রী সব কিছুর পেছনে একটি হিসেব যাতে মেহনতকারীর দল হঠাৎ না বেঁকে দাঁড়ায়, হঠাৎ না রুখে ওঠে। তারই জন্যে এই সব ব্যবস্থা : আইন-কানুন, রাজা-উজির, হরেক রকমের।
কিন্তু শুধু ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা রাখাও কঠিন। কেননা, মেহনতকারীদের যে দল সেটাই হলো আসলে প্রকাণ্ড বড়ো দল। রাজা-উজিরই বলো আর বড়োলোকই বলো, গুনে দেখলে দেখা যায় বাকি মানুষদের চেয়ে যারা খেটে মরছে তাদের চেয়ে - দলে ওরা নেহাতই নগণ্য। তাই, শুধু সিপাই-শান্ত্রী আর জল্লাদ-কোটাল দিয়ে চিরকালের মতো এদের দাবিয়ে রাখা যায় না। বনের বাঘকে খাঁচায় পুরে রাখলেও নিশ্চিন্তি নেই, দরকার পড়ে নিয়ম করে বাঘকে আফিম খাওয়াবার। আফিম খেলে বাঘ ঝিমিয়ে থাকবে, মাথা তুলতে পারবে না, তাই কোনোদিন সে-খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে পড়তে পারে এ-হেন দুশ্চিন্তার আর কারণ থাকবে না। বাঘের বেলায় যে-রকম ব্যবস্থা, মেহনতকারী মানুষদের বেলাতেও খানিকটা সেই ধরণেরই ব্যবস্থা গড়ে উঠলো। এই ব্যবস্থাটার নাম ধর্ম। ধর্ম বলে ব্যাপারটা অবশ্য নেহাতই জটিল; তাই নিয়ে অনেক কিছু ভাববার আর বোঝবার আছে। তবু আমাদের গল্পের এখানে যেটা বিশেষ করে বোঝা দরকার শুধু সেটুকুই বলবো। যাতে মেহনতকারী মানুষেরা মাথা তুলতে না পারে, যাতে তারা ঝিমিয়ে থাকতে বাধ্য হয়, তারই একটা বড়ো উপায় বলতে ধর্ম।
সিপাই-শান্ত্রীর সহায় হিসেবে দেখা দিলো পাণ্ডা-পুরুতের দল। মেহনতকারী মানুষ যাতে মাথা তুলতে না পারে, যাতে ঝিমিয়ে থাকতে বাধ্য হয়, সেই জন্যে পাণ্ডা আর পুরুত। সিপাই-শান্ত্রীর হাতে তীর-ধনুক আর বল্লম-বর্শা, পাণ্ডা-পুরুতের ঝুলিতে ধর্মের আফিম। তারা মানুষকে বুঝিয়ে বেড়াতে লাগলো পৃথিবীর সুখ-দুঃখ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। মানুষের এই নশ্বর জীবনে যদি সুখ না জোটে, যদি দুঃখ ভোগ করতে হয়, তাহলেও তাই নিয়ে মন-মেজাজ গরম করবার কোনো মানে হয় না। কেননা, করুণাময় ভগবান সৃষ্টি করেছেন এই পৃথিবী, এখানে যা কিছু ঘটছে তা সবই সেই মঙ্গলময়ের ইচ্ছায়। তিনি সব মানুষকেই সমান ভালোবাসেন। তাহলে কারুর কপালে অতো সুখ আর কারুর কপালে অতো দুঃখ কেন? বিশেষ করে আমাদের দেশে যারা ধর্মের প্রচারক তারা বললে : ঐ তো মজা! আসলে যে-লোক আগের জন্মে ভালো কাজ করেছে এ-জন্মে সে সুখভোগ করছে, যে-লোক আগের জন্মে খারাপ কাজ করেছে এ-জন্মে সে দুঃখভোগ করছে। এই হলো ভগবানের নিয়ম। তাই এ-জন্মে সুখ পাচ্ছো, না, দুঃখ পাচ্ছো তাই নিয়ে মাথা ঘামিও না। মুখ বুজে ভগবানের আদেশ হলো রাজাকে ভক্তি করবার আদেশ, পাণ্ডা আর পুরোহিতের কথা মানবার আদেশ। যদি মুখ বুজে এই সব আদেশ পালন করতে পারো তাহলে পরজন্মে বা পরকালে তোমার কপালেও অনেক সুখ জুটবে। এ-জন্মে শাকান্ন পাচ্ছো না বলে ভগবানে ভক্তি হারিও না। আসলে ভগবান তোমাকে দুঃখ দিয়ে পরখ করে নিচ্ছেন। ইহকালে শাকান্নের অভাবটা যদি হাসিমুখে মানতে পারো তাহলে পরকালে তোমার পরমান্ন একেবারে সুনিশ্চিত। জীবনে যে-আনন্দ তুমি পেলে না সে-আনন্দ পাবার আশায় নিজে নিজে কিছু করে বসাটা একেবারে মূর্খতা; মঙ্গলময়ের পায়ে মাথা কোটো, তাঁর মনে করুণার উদ্রেক করো, তিনি তোমার মনস্কামনা পূরণ করবেন। তাঁর ইচ্ছে অনুসারেই পৃথিবী চলে, তাই তাঁর কাছে করুণা ভিক্ষে করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
অবশ্যই, মেহনতকারী মানুষরা যদি ভগবানের পায়ে শুধু মাথাই কোটে তাহলে পাণ্ডা-পুরুতদের সংসারই বা চলে কেমন করে? তাই ওরা প্রচার করতে শুরু করলো, শুধু কথায় ভগবানের মন ভেজে না। তার পায়ে মাথা কুটতে হবে, কিন্তু সেই সঙ্গেই তাকে চালকলার নৈবেদ্য খাওয়াতে হবে, আর এই ভগবানের সঙ্গে যেহেতু পাণ্ডা-পুরুতদের খুব ভাবসাব সেই হেতু এদের জন্যে কিছু নগদ দক্ষিণা না আনলেই বা চলবে কেন?
প্রার্থনার মাহাত্ম্য। করুণা চাওয়া, ভিক্ষে চাওয়া, মাথা কোটা। মনে রাখতে হবে, মানুষ যতোদিন ছেলেমানুষ ছিলো, ছিলো দল বেঁধে মিলে মিশে সমানে-সমান হয়ে, ততদিন মানুষের মাথায় এই করুণা-চাওয়া, ভিক্ষে চাওয়া প্রার্থনা করবার কথা আসেনি। ততোদিন ছিল ইন্দ্রজাল। ইন্দ্রজালের মধ্যে কল্পনার আর আজগুবি ধারণার দিকটা যতোখানিই থাকুক না কেন, এর আসল ঝোঁক হলো পৃথিবীটাকে জয় করবার দিকে। কিন্তু আগেকার সেই সমানে-সমান জীবন ভেঙে যাবার পর থেকে নষ্ট হলো জয় করবার দিকে ঝোঁকটাও। মানুষ শিখলো মাথা কুটতে, মানুষ ভাবলো বিধাতার কথা। যারা শোষক, পরের মেহনত লুঠ করে বড়োলোক হয়, তারা বাকি সবাইকে শেখাতে লাগলো এই বিধাতার কথাটা : সবই ঘটছে বিধাতার কৃপায়, বড়োলোকদের ওপরে রাগ করে লাভ নেই, লাভ শুধু বিধাতার পায়ে মাথা কুটে।