Wednesday, 17 January 2024

জ্যোতি বসু বিধায়ক থেকে মুখ্যমন্ত্রী - রহিত বসু

পশ্চিমবঙ্গের পুনর্গঠিত বিধানসভায় ৮৩ জন সদস্য থাকলেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্য হওয়ায় তাঁর জায়গায় সদস্য হন বিধানচন্দ্র রায়। বাংলা বিভাগের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সংখ্যাও কমে যায়। রূপনারায়ণ রায়ের নির্বাচনী কেন্দ্রটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। ফলে বিধানসভায় কমিউনিস্ট গ্রুপে রইলেন জ্যোতি বসু এবং রতনলাল ব্রাহ্মণ।

স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার প্রথম অধিবেশন শুরু হল ২১ নভেম্বর। সেই অধিবেশনের মূল কর্মসূচি ছিল স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন।

কিন্তু সেই প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই উঠে দাঁড়ালেন জ্যোতিবাবু। তখন স্পিকারের আসনে ছিলেন বর্ধমানের মহারাজা স্যার উদয়চাঁদ মহতাব। জ্যোতিবাবু বললেন - "আমি জানাতে চাই, অসংখ্য কৃষক নানা জায়গা থেকে এই সভাকে, স্বাধীন বাংলার সভাকে সংবর্ধনা জানাতে আসছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, পুলিশ হাওড়া এবং শিয়ালদার কাছে তাঁদের আটকে দিয়েছে। আমি জানি না, এটা কেন হল। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী সে কথা জানেন। তিনি আমাদের বলেছেন, তাঁরা আসতে পারেন। কিন্তু ডিসিপ্লিনড ভাবে, যাতে কোনও গণ্ডগোল না-হয়। একথা তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কারণ তাঁরা অভিনন্দন জানাতে আসছেন। আমি জানি না, পুলিশ কেন এই কাজ করল। আমি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাই। তিনি যদি বাইরে গিয়ে একটু দেখেন, তাহলে সুবিধা হয়।"

স্পিকার তখন মুখ্যমন্ত্রীকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার নির্দেশ দিলেন। প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ বললেন - "কাল ভোরবেলা কৃষ্ণবিনোদ রায় এ ব্যাপারে কথা বলতে আমার কাছে যান। তিনি আমাকে বলেন, আপনাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সব কৃষকরা পরিষদের মধ্যে উপস্থিত হবেন। আমি বলি, সভাগৃহের মধ্যে যুক্তভাবে তাদের না-আসাটাই বাঞ্ছনীয়। তবে আমি তাঁকে বলি, আপনারা যদি ওয়েলিংটন স্কোয়ার বা ময়দানে কোনও সভা করেন, সেই সভায় আমরা যেতে পারি। গিয়ে বক্তৃতা দিতেও প্রস্তুত আছি এমনকি কৃষকদের সম্বন্ধে আমাদের নীতি কি, তা বলতেও প্রস্তুত আছি। এছাড়া,অন্য কোনওরকম প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি। তখন কৃষ্ণবিনোদবাবু বলেন, আমি আপনার কথা শুনলাম কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের মতামত কি, তা পরে জানাব। তারপর রাতে টেলিফোন করে তিনি জানান, আমাদের মতের সঙ্গে তাঁদের মতবাদ ঠিক মেলে না। শিয়ালদা স্টেশন, কি হাওড়া স্টেশনে মিছিল আটকেছে কিনা, তা আমি ঠিক বলতে পারি না।" কৃষক সভার নেতাদের দিকে অভিযোগের তীর ঘুরিয়ে দিয়ে প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ বলতে থাকেন - "এখানে কৃষ্ণবিনোদবাবু এবং আর এক ভদ্রলোক এসেছেন। তাঁরা বললেন, মিছিল ধর্মতলা স্ট্রিটের মোড়ে আটকিয়েছে।"

পুলিশ এসপ্ল্যানেড ইস্টে জড়ো হওয়া প্রায় ২০ হাজার ছাত্র  কৃষকের উপর ব্যাপক লাঠি চালায় এবং কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে। বিধানসভা ভবন থেকে বার হয়ে জ্যোতিবাবু ততক্ষণে এসপ্ল্যানেড ইস্টের দিকে রওনা দিয়েছেন। সেখানে গিয়ে তিনিও দেখলেন পুলিশ লাঠি চালাচ্ছে আর কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ছে। সেই ছিল জ্যোতিবাবুর প্রথম কাঁদানে গ্যাসের অভিজ্ঞতা। সেখান থেকেই হাঁটতে হাঁটতে তিনি মহাকরণে গেলেন। সেখানে তিনি প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের কাছে জানতে চান, পুলিশ কৃষকদের শান্তিপূর্ণ জমায়েত লক্ষ্য করে কেন কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ছে? প্রফুল্লবাবু তাঁকে বোঝালেন, কীভাবে কাঁদানে গ্যাস তৈরি করা হয়।

স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা অধিবেশনের প্রথমদিনেই, পুলিশের আচরণ এবং সেই আচরণ সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাখ্যাটাই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কংগ্রেস পরিচালিত এই মন্ত্রিসভা কোন পথে চলবে। প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের মুখ্যমন্ত্রিত্বে কংগ্রেস সরকার প্রথম যে আইনটি চালু করেছিল, তার নাম ছিল 'পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ ক্ষমতা আইন।' পরে ওই আইনের নাম হয় 'পশ্চিমবঙ্গ নিরাপত্তা আইন।'
*********************************************************************
১৯৫২ সালের সাধারণ নির্বাচনের শেষ অধিবেশনে পশ্চিমবঙ্গ নিরাপত্তা (সংশোধনী) আইন নিয়ে আলোচনা হয়। কারাবাসের সময়কার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে জ্যোতিবাবু বলেন, "আমার বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হল, তুমি জনসভায় বক্তৃতা দিতে পারবে না। আমি জানতে চাই, তাহলে আমি কী করব? আমার কাজ কী হবে? আমি তো বেকার হয়ে যাব।"

বিধান রায় তাকে থামিয়ে দিয়ে তখন বলেন - "হাইকোর্টে প্র্যাক্টিস করবেন।"

জ্যোতিবাবু জবাবে বলেন - "আপনার পরামর্শ মতো চলার কোনও ইচ্ছা আমার নেই। আমি জানি, এখানে এমন অনেক মন্ত্রী আছেন, যাঁরা ব্যবসা করে অন্য পথে অনেক টাকা রোজগার করেছেন। আমি সেসব কথা বলতে চাই না। আমি একজন পেশাদার বিপ্লবী। আমার কাজ হল, এই সরকারকে উৎখাত করা, মানুষের সঙ্গে কথা বলা, আর তাঁদের সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের পথে টেনে আনা। আমাকে যদি সেই কাজ করতে না দেওয়া হয়, যদি আমার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে আমার এই জীবনের মূল্য কী?"
*********************************************************************
রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সমাজবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ - সকলেই বলে থাকেন, পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের রাজনৈতিক সাফল্য এবং একাধিপত্যের পিছনে সব থেকে বড় কারণটি হল ভূমিসংস্কার এবং গ্রামোন্নয়ন।

১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর '৭৮ সালে 'অপারেশন বর্গা'র স্লোগানের পিছনে তেভাগা আন্দোলনের ছায়া খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। স্বাধীনতার আগে থেকেই অবশ্য জ্যোতিবাবু বিধানসভায় জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের দাবিতে, রাজ-মহারাজা-নবাবদের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে তাঁর সেই সমালোচনা আরও জোরালো হয়েছে, কংগ্রেস সরকারকে তিনি বরাবরই জোতদার-জমিদারদের সরকার বলে মনে করেছেন। তাঁর সেই ধারণা ভারতীয় সমাজ, সেই সমাজের শ্রেণী ভারসাম্য, সেই ভারসাম্যে কংগ্রেসের অবস্থান দেখেই তৈরি হয়েছিল। ভূমি সংস্কার সম্পর্কে প্রধান আইনগুলি কংগ্রেস জমানাতেই তৈরি হয়েছে, একথা যেমন ঠিক, তেমনি একথাও ঠিক, সেইসব আইন কার্যকর করার বিষয় কখনই কংগ্রেস সরকারের কর্মসূচিতে গুরুত্ব পায়নি। অথচ, ভূমিসংস্কারের দাবি প্রাথমিকভাবে বুর্জোয়া শ্রেণীর দাবি-সনদেই থাকার কথা। অর্থনীতির যে কোনও ছাত্রই জানেন, শিল্প বিকাশ, পুঁজিবাদী বিকাশের প্রাথমিক শর্তই হল পুঁজির দ্রুত সঞ্চয়, কাঁচামালের বাড়তি জোগান এবং শিল্পপণ্যের বর্ধিত বাজার। আর তার জন্য অপরিহার্য শর্তই হল ভূমিসংস্কার।

সমাজবিকাশে অর্থনীতির এই অপরিহার্য শর্ত সম্পর্কে ১৯৫২ সালেই কিন্তু জ্যোতিবাবুর স্পষ্ট ধারণা ছিল। নিজস্ব ঢঙে কংগ্রেসের সমালোচনা করে প্রথমে তিনি বললেন, - "মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, এটা ভাববার সময় এসেছে যে, জমিদারি প্রথা উঠিয়ে দেওয়া হবে কি না। সে বিষয়ে গবেষণা দরকার এবং একজন গবেষণা করতে গিয়ে - 'ফ্রম দ্য ফ্রাইং প্যান টু দ্য ফায়ার' না কি একটা ইংরাজি কথা বললেন। এই সব নাকি চিন্তা করবার সময় এসেছে। কিন্তু আমরা জানি, ভারতবর্ষের জাতীয় আন্দোলন অনেক গবেষণা করার পর, অনেক হিসাব করার পর একথাটা মেনে নিয়েছে যে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করতে হবে, কৃষকদের জমির মালিক করতে হবে। সুতরাং নতুন করে গবেষণা করার কিছু নেই। তাই আজ এসব কথা শুনে আমরা একটু আতঙ্কগ্রস্ত হচ্ছি। এই নিয়ে আলোচনার সময়ে আমাদের সঙ্গে কংগ্রেস সরকার ও কংগ্রেসের চিরকাল একটা মতভেদ থাকবে। কী সেই মতভেদ? জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ বিনা খেসারতে করা হবে, না খেসারত দিয়ে করা হবে? এই কংগ্রেসি সরকার জমিদার ও জোতদারদের সরকার, সাধারণ মানুষের সরকার নয়। সেইজন্য এই সব কাজ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।"
*********************************************************************
কিছুদিন পরেই গোহত্যা বন্ধের দাবিতে আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠতে শুরু করে। অন্যান্য রাজ্যের ঘটনাবলির প্রভাব পড়তে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে। '৫৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর কলকাতার বড়বাজারে এক মিছিলের উপর পুলিশ লাঠি চালায় ও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে। বহু লোক আহত হন,একজনের মৃত্যু হয়। ইতিমধ্যে চার-পাঁচটি রাজ্য গো-হত্যা নিষিদ্ধ করে দেয়। বিধানসভায় হেমন্ত বসু বলেন - "গো-রক্ষা বিশেষ প্রয়োজন তা সে কৃষিকাজের জন্য হোক, দুধের জন্যই হোক বা শরীরের পুষ্টির জন্যই হোক। যেভাবেই হোক, বহু লোক এই আন্দোলনকে সমর্থন করছেন, তাঁরা লাঠি-গুলি খাচ্ছেন। এর পিছনে জনমত রয়েছে। গো-হত্যা সম্পূর্ণ বন্ধ করার যে নীতি, সেই নীতির দিক থেকে আমি তা সমর্থন করি। কিন্তু বাংলাদেশে বা ভারতবর্ষের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দিকে দৃষ্টি রেখে আজ কারও উপর জোর করে কোনও আইন চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়।"

এ বিষয়ে জ্যোতিবাবুর মনোভাব ছিল খুবই কড়া। এবং গো-হত্যার বন্ধের দাবিতে আন্দোলনের পিছনে যে সাম্প্রদায়িক প্রবণতা রয়েছে, তা তাঁর নজর এড়ায়নি। তাই তিনি বললেন - "এই আন্দোলন আরম্ভ হওয়ার আগে, তাঁদের নাম কী জানি না, কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত কি না জানি না, কিন্তু তাঁরা আমার কাছে এসেছিলেন। তাঁদের আমি কখনও দেখিনি, কোথাকার লোক তাও জানি না। আমি বললাম, এটা আইনকানুন অনুযায়ী যদি বন্ধ করতে চান, তাহলে করুন। কিন্তু হঠাৎ এই সত্যাগ্রহ কেন? হাজার হাজার মানুষ যখন বেকার হয়ে যাচ্ছে, শিশুরা খেতে পাচ্ছে না, ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে খাচ্ছে এই কলকাতা শহরে, চাষীরা খেতে পাচ্ছে না, জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে - তার জন্য তো আপনারা কিছু বলেন না! এইসব মানুষকে বাঁচানোর জন্য আন্দোলন করেন না। অথচ আজ আপনারা বলছেন,গো-হত্যা বন্ধ করতে হবে। কারণ এতে ধর্মের বাঁধন আছে। তা ওই ভদ্রলোক বললেন, এটা ধর্মের প্রশ্ন নয়, অর্থনৈতিক প্রশ্ন। শিশুরা দুধ খেতে পাচ্ছে না। আমি বললাম, আপনারা যদি এই গ্যারান্টি দিতে পারেন যে, আমাদের দেশে গো-রক্ষা করলে সমস্ত শিশু দুধ খেতে পাবে, তাহলে আমার পার্টি আপনাদের পাশে থাকবে।"

গো-হত্যা বন্ধের দাবিতে আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠলে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্যই যে অনেক মানুষ উন্মুখ হয়ে আছেন, তা জ্যোতিবাবুর নজর এড়ায়নি। তিনি দাঙ্গা দেখেছেন স্বাধীনতার আগে এবং পরে, তিনি জানেন দাঙ্গা কেন হয়, কারা থাকে দাঙ্গার পিছনে এবং তারপর কীভাবে সেইসব দাঙ্গায় সাধারণ মানুষকেও জড়িয়ে নেওয়া হয়। এক একটি দাঙ্গার পরে একটা সমাজ কী ভাবে এলোমেলো হয়ে যায়, অর্থনীতি কীভাবে বিধ্বস্ত হয়, তারপর সেই পারস্পরিক অবিশ্বাস দূর করতে কত বছর কেটে যায়, - তার সব কিছুই জ্যোতিবাবু জানতেন। তিনি তাই বললেন - "আমাদের রাষ্ট্রে হিন্দু-মুসলিম দুই-ই বাস করছেন। মুসলমানরা স্বভাবতই একটু ভীত হবেন, যদি এর ভিতরে ধর্মের কথা আসে। গত ১৫ অগস্ট আমি খড়গপুরে মিটিং করতে গিয়েছিলাম। যেখানে মিটিং করছিলাম, তার কাছে দেখলাম একদল সাধু বসে আছেন। সেখানে ধর্মের কথা হচ্ছে, যজ্ঞ হচ্ছে গোমাতাকে বাঁচাতে হবে - এইসব স্লোগান সেখানে দেওয়া হচ্ছে। এ থেকে যদি আর এক সম্প্রদায়ের মানুষ ভীত হন, যদি একটু শঙ্কিত হন, তাহলে কি তাঁদের দোষ দেওয়া যায়? যদি আপনারা বলেন যে, অহিংসভাবে করছি, তাতেও তো কাজ হচ্ছে না। এই সব করে শেষে আমাদের কোথায় নিয়ে যাবেন? আমি বলি, মানুষের উপরে আর কিছু নেই।"
*********************************************************************
... জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকে পণ্ডিত নেহেরু বললেন, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলাই তাঁর প্রধান পরিকল্পনা। সেই রাষ্ট্রে জনসাধারণই সমগ্র রাষ্ট্রের কল্যাণে উৎপাদন যন্ত্রের মালিক হবে। গণতান্ত্রিক এবং শান্তিপূর্ণ পথেই রাষ্ট্রে পরিবর্তন আনতে হবে। নেহরুর মতে, আধুনিক চিন্তাধারায় ব্যক্তিগত মুনাফার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমাজের কোনও স্থান নেই। অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে, তাঁরা এই ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করে দিচ্ছেন।

এই পর্যন্ত নেহরু যা বলেছেন, তাতে কমিউনিস্টদের অখুশি হওয়ার কোনও কারণ ছিল না। কিন্তু কিছুদিন পরেই কমিউনিস্টদের আক্রমণ করে তিনি যা বললেন, তাতে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠল। তিনি বললেন, দলীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য দেশের স্বার্থ বিসর্জন দেওয়া ভারতীয় কমিউনিস্টদের রীতি। ব্যাঙ্ক ধর্মঘটে উস্কানি দেওয়ার জন্য কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে নেহরু বললেন, দেশের প্রতিটি সমস্যা সম্পর্কে কমিউনিস্টদের মনোভাব দেশ ও জাতির পরিপন্থী। এই প্রসঙ্গে তিনি অবশ্য চিনা কমিউনিস্টদের প্রশংসা করলেন। নেহরুর বক্তব্য ছিল, কমিউনিস্টরা তেলেঙ্গানায় যে সশস্ত্র বিদ্রোহের নীতি গ্রহণ করেছিল, তা পরে বর্জন করলেও তাঁরা এখনও স্থানীয় বিরোধে উস্কানি দিয়ে বিশৃঙ্খলা ও অসন্তোষ জিইয়ে রাখার নীতিতে বিশ্বাসী।
*********************************************************************
পরে এই বিধান রায়ই বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যৌথভাবে বাংলা-বিহার সংযুক্তির প্রস্তাব দেন।

ওই প্রস্তাবের বিরোধিতায় ১৯৫৬ সালের ২৬ জানুয়ারি কলকাতার সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে (তৎকালীন ওয়েলিংটন স্কোয়ারে) এক জনসভা হয়। সেই সভার সভাপতি ছিলেন জ্যোতি বসু। ২ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘটে সামিল হয় ছাত্রছাত্রীরা। ৫ ফেব্রুয়ারি কমিউনিস্ট পার্টির বিহার প্রাদেশিক কমিটি বলল - "দ্বিভাষিক রাজ্য ভারতের জাতীয় ঐক্য ক্ষুন্ন করবে।" তার আগেই কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদক হিসাবে জ্যোতিবাবু বলেন - "রাজ্য পুনর্গঠন সম্পর্কে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্তের সঙ্গে নীতির কোনও সম্পর্ক নেই এবং ওই সিদ্ধান্ত সুবিধাবাদী। পশ্চিমবঙ্গের ন্যায্য দাবি অস্বীকার করতে আগেই রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের রিপোর্টে ভাষা-ভিত্তিক নীতিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। এখন কংগ্রেস নেতৃত্ব বিশেষত পুরুলিয়ার বাংলা ভাষাভাষী অধ্যুষিত বিরাট এলাকাকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত অস্বীকার করে সেই অন্যায়ের পরিমাণ আরও বাড়িয়েছে।"

কমিউনিস্ট পার্টি কেন বিরোধিতা করেছিল? তাদের যুক্তি ছিল - দু'টি রাজ্যের এই সংযুক্তিকরণের ফলে জাতীয় ঐক্য সম্প্রসারিত হবে না। বরং বিহারি-বাঙালি বিরোধ সমগ্র যুক্ত রাজ্যে ছড়িয়ে পড়বে। তাছাড়া, এর ফলে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া বিহার ভারতীয় ও বিদেশি পুঁজিপতিদের অবাধ শোষণের ক্ষেত্রে পরিণত হবে। তখনই বিহারে প্রতিক্রিয়াশীলদের শক্ত ঘাঁটিগুলোকে পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে। এরই পাশাপাশি, দ্বিভাষিক রাজ্যের শাসনব্যবস্থায় বাঙালি-বিহারি রেষারেষি বাড়বে, ফলে শাসনব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটবে। কমিউনিস্ট পার্টির আপত্তির অন্য একটি কারণটি ছিল, দেশের অন্যান্য এলাকায় ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের নীতি স্বীকৃত হওয়ার পথে সংযুক্তিকরণের এই প্রস্তাব পিছনের দিকে তাকানো ছাড়া আর কিছুই নয়।
*********************************************************************
সেই সময়ে কেরলের পালঘাটে কমিউনিস্ট  সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। কিন্তু কলকাতা উত্তর-পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন বাংলা-বিহার সংযুক্তির ইস্যুতে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যে, জ্যোতিবাবু ও প্রমোদ দাশগুপ্ত সেই পার্টি কংগ্রেসে উপস্থিত থাকতে পারেননি। 
*********************************************************************
তারপর জ্যোতিবাবু কর্মচারীদের সমস্যার কথা, তাঁদের প্রয়োজনের কথা বললেন। এবং তার সেই বক্তৃতায় সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সবরকম উপাদানই মজুত ছিল। পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি জানালেন - ১১ লক্ষ ৪৪ হাজার সরকারি কর্মচারীর মধ্যে ৯৫ হাজার কর্মচারী মাসে ১০০ টাকার কম বেতন পান। ৬৬ হাজার লোক ৭৫ টাকার কম পান এবং ১৬ হাজার কর্মচারী ৫০ টাকারও কম পান। তিনি বললেন - "এই যদি কর্মচারীদের অবস্থা হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে কর্মচারীদের দিয়ে কোনও কাজ হতে পারে? তাঁদের মধ্যে নিশ্চয়ই অসন্তোষ জমবে। এই যে মিনিয়েলস, চাপরাশি, এঁদের কথা যদি বলা হয়, তাহলে আপনারা সেই ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি অবলম্বন করে বলে দেন, তাঁদের তো আর জীবনযাত্রার মান বাড়েনি। মিডল ক্লাস লোকের তো আর জীবনযাত্রার মান বাড়েনি। তাঁদের তো আর ছেলেপিলেদের লেখাপড়া শেখাতে হয় না। তাঁরা নিজেরা লেখাপড়া শিখতে পারেননি বলে কি তাঁদের মনে ছেলেপিলেদের লেখাপড়া শেখানোর ইচ্ছে আসে না? তারপর ২৩২ জন অফিসার আছেন, যাঁদের বেসিক স্যালারি ১ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা। অথচ আপনারা বলছেন, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলবেন। এই জন্য রাইটার্স বিল্ডিংসে এবং জেলায় শতকরা ৯০ ভাগ কর্মচারী সরকারের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছেন। আজ তাঁরা আপনাদের ঘৃণা করেন। আপনাদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেন। আপনারা বলেন, কমিউনিস্ট পার্টি তাঁদের খেপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাদের তো বুদ্ধি-বিবেচনা আছে।"

এইসব সরকারি কর্মচারীই এখনও বামফ্রন্ট সরকারের মূল ভিত। জ্যোতিবাবু শাসন ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্নস্তরে সরকারি কর্মচারীদের যে হারে বেতন বেড়েছে, তা হয়তো পরবর্তী সময়ে সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। কিন্তু কর্মচারীদের সরকার-বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে তাঁকে কখনও ভাবতে হয়নি।...

... বিধান রায়ের সমালোচনা করার ফাঁকে জ্যোতিবাবু বন্ধু সিদ্ধার্থ রায়কেও ছাড়লেন না, বললেন - "এই যে এত বড় বড় গণতন্ত্রের কথা বলেন সিদ্ধার্থ রায়, একখানা লাল বই এনে, স্ট্যালিনের না কার কথা, মস্কোর ব্যাপারে এখানে পড়ে গেলেন। কিন্তু আমরা তো মস্কোর কথা বলিনি। মূর্খের কাছে মস্কোর কথা কী বলব? যারা মানুষকে খেতে দিতে পারে না, তাঁদের কাছে মস্কোর কথা বলতে পারি না।"
*********************************************************************
জ্যোতিবাবু বললেন - "মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, যার যা কোয়ালিফিকেশন আছে, যার যা প্রাপ্য, তাঁকে তা দিতে হবে। তিনি বললেন ডিভিসি-র যে ইঞ্জিনিয়ার এলেন আমেরিকা থেকে, তিনি যদি ৫ হাজার টাকা মাইনে চান তো তাঁকে ৫ হাজার টাকা মাইনে দিতে হবে। তা না হলে সে এসে আমাদের কাজ করে দেবে কেন? আমি বলি, এই দুটোকে মিশিয়ে কোনও লাভ নেই। আমরা যে-কাজ জানি না, নো-হাউ জানি না, আমাদের ছেলেরা, আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা তা শিখে নেবে। এইরকম শিখবার জন্য আমেরিকা থেকে হোক, ওয়েস্ট জার্মানি থেকে হোক, জাপান থেকে হোক, রাশিয়া থেকে হোক, যেখান থেকে হোক আমাদের লোক আনতে হবে এবং তাঁরা যে মাইনে চান, সেই মাইনে তাঁদের দিতে হবে। আমরা ৬ মাস কি ১০ বছরে তা শিখে নেব, শিখে নিয়ে তাঁদের বিদায় করে দেব। তাঁরা চলে যাবেন এবং আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা তারপর সেই টেকনিক্যাল কাজগুলো করতে পারবেন।"

অর্থাৎ পুঁজিবাদী বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং তার প্রয়োগের বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে সেই ১৯৫৭ সালেই জ্যোতিবাবুর স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়েছিল। দেশীয় প্রযুক্তিকে অক্ষুন্ন রেখে কখন কোন শিল্পে অথবা সামাজিক পরিষেবার কোন ক্ষেত্রে বিদেশি প্রযুক্তিকে স্বাগত জানাতে হবে, বিদেশি প্রযুক্তির জন্য দেশের দরজা কতটা ফাঁক করতে হবে, বলা যায় তখন থেকেই সেই ধারণার অনুশীলন করে চলেছেন জ্যোতিবাবু। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সরকারি সংস্থায় কম্পিউটার ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাঁর দল বা ট্রেড ইউনিয়নের বিরোধিতা কেন তীব্র হয়ে উঠেছিল, তা অবশ্য বোঝা যায় না।
*********************************************************************
মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের একটি মন্তব্যে উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে রাজ্য সরকারের মনোভাব স্পষ্ট হয়ে গেল। '৫৮ সালের অক্টোবর মাসে আমেরিকা সফরে রওনা হওয়ার আগে তিনি বললেন - "পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছোট ছোট পতিত জমি উদ্ধার করা ও তার উন্নয়নের ব্যবস্থা করা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে সম্ভব নয় এবং এভাবে পুনর্বাসনের চেষ্টা সফল হবে না। কারো এভাবে যেসব জমি পাওয়া যাবে, তা নিকৃষ্ট শ্রেণীর। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে উদ্বাস্তুদের সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। তৃতীয়ত, স্থানীয় বর্গাদার ও ভূমিহীন কৃষিশ্রমিক পরিবারের প্রয়োজন উপেক্ষা করার মতো নয়। তাছাড়া উদ্বাস্তুদের মধ্যে দলে দলে বিভক্ত হয়ে থাকার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। সুতরাং, শিবিরবাসী কৃষক পরিবারের প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম জমিই খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য পাওয়া যাবে।"

তার কিছুদিন পরেই ময়দানে এক জনসভায় জ্যোতিবাবু বললেন - "যারা বাংলার বাইরে যেতে চাইবেন না, তাঁদের জন্য ক্যাম্প খোলা রাখা এবং এখানে সরকারের তৎপর থাকা প্রয়োজন। দণ্ডকারণ্যের প্রশ্নে সর্বভারতীয় স্তরে ব্যবস্থা হচ্ছে। কাজেই সরকারের কর্তব্য হবে, দণ্ডকারণ্য ব্যবস্থার দিকে যেমন নজর দেওয়া, তেমনই এখানে ক্যাম্প খোলা রেখে পতিত জমি উদ্ধার এবং শিল্পায়নের মাধ্যমে এই রাজ্যেও উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।" এই সভায় জ্যোতিবাবুর বক্তব্য ছিল - "পশ্চিমবঙ্গে পতিত জমি উদ্ধার এবং শিল্প প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা হলে উদ্বাস্তুদেরই শুধু পুনর্বাসন হবে না, স্থানীয় বাসিন্দা ও ভূমিহীন কৃষকদেরও কল্যাণ সম্ভব। কেন্দ্রীয় সরকারের টাকার অভাব নেই। দণ্ডকারণ্যের জন্য অনেক কোটি টাকা খরচ করতে সরকার রাজি, অথচ এই রাজ্যে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য অর্থ ব্যয়ে তারা রাজি নয়। প্রায় তিন কোটি মানুষ যেখানে এই রাজ্যে বাস করতে পারেন, সেখানে ৩৫ হাজার উদ্বাস্তুর স্থান হবে না - এমন যুক্তি অর্থহীন ও বিভ্রান্তিকর।"
*********************************************************************
যত বড় বড় বাড়ি ও সম্পত্তি বিধানবাবু কিনছেন, অতিরিক্ত টাকা দিয়ে, আমাদের রাজ্য বাজেট থেকে টাকা লুট করে। আমি নাম করে দিচ্ছি। লালগোলার ২০০ বছরের পুরনো বাড়ি, ভ্যালুয়েশন তার আড়াই লক্ষের বেশি নয় - সেটা ৮ লক্ষ টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। অ্যাডভোকেট জেনারেল এস এম বোসের বাড়ি হুগলির কালেক্টর অ্যাসেস করেছিলেন ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ৫০ হাজারে হবে না। ৪ লক্ষ টাকা তাঁকে দিয়েছেন। মহারাজা অব ভিজানাগ্রাম বেলেঘাটায়, তার ভ্যালুয়েশন ৩ লক্ষ টাকার বেশি হবে না। কিন্তু ৬ লক্ষ টাকায় কেনা হয়েছে। এভাবে টাকা দেওয়াকে চুরি ছাড়া কিছুই বলতে পারি না। অন্য কোনও ভালো ভাষা থাকে, অন্যরা বলবেন। আমার জানা নেই।
*********************************************************************
পশ্চিমবঙ্গে সেই সময় খাদ্য সংকট এবং উদ্বাস্তু সমস্যা যেন হাত ধরাধরি করে চলছিল। সেই উদ্বাস্তু সমস্যাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং উদ্বাস্তুদের মধ্যে অনিশ্চয়তা আরও যখন বেড়ে গেল, তখন কংগ্রেস সরকার বলল, উদ্বাস্তুদের পশ্চিমবঙ্গের বাইরে না পাঠালে উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। উদ্বাস্তুদের বাইরে পাঠানোর পক্ষে প্রধানত দু'টি যুক্তি দেখানো হল। প্রথমত বলা হল, পশ্চিমবঙ্গে এত ঘনবসতি যে, পুনর্বাসনের জায়গা নেই। প্রতি বর্গমাইলে এখানে লোকসংখ্যা খুব বেশি। কিন্তু এই ঘনবসতি ছিল শহরাঞ্চলে, গ্রামাঞ্চলে নয়। ১৯৩১, ১৯৪১, ১৯৫১ সালের সেন্সাস রিপোর্ট খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে গ্রামাঞ্চলে প্রতি বর্গমাইলে লোক সংখ্যা যা বেড়েছিল, তার তুলনায় ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে প্রতি বর্গমাইলে মাত্র তিনজন করে বেড়েছিল। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ১৯৫৯ সালের সারা পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩২ লক্ষ। দ্বিতীয় যুক্তিতে বলা হত, ক্যাম্প উদ্বাস্তুদের জন্য কৃষিযোগ্য জমির প্রয়োজন এবং এই পশ্চিমবঙ্গে কৃষিযোগ্য জমির একান্ত অভাব। সেই সময়ে সরকারি পরিসংখ্যানে বলা হল, পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন ক্যাম্পে ৫১ হাজার উদ্বাস্তু বাস করেন। ওই ৫১ হাজার উদ্বাস্তুর মধ্যে ৩৩ হাজার ২০০ জন কৃষিজীবী। এই কৃষিজীবী পুনর্বাসনের জন্য ২ লক্ষ একর চাষযোগ্য জমি দরকার বলে সরকারের তরফে বলা হয়েছিল।

জ্যোতিবাবু বিধানসভায় বললেন - "এই সরকারকে আমরা দেখেছি যে, কারও সঙ্গে কোনওরকম সহযোগিতা করতে চান না। শুধু চাবুক মেরে জোর করে সব ব্যবস্থা করতে চান। বাস্তুহারাদের আজ মানুষ বলে তাঁরা জ্ঞান করেন না। আমার কথা হচ্ছে, বাস্তুহারারা যদি বলেন যে, আমরা পশ্চিমবাংলায় থাকতে চাই তাহলে এটা কি অন্যায় কিছু তাঁরা বলে ফেলবেন? নিজের পরিবেশের মধ্যে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, ভাষা সমস্ত কিছু নিয়ে তাঁরা যদি বলেন যে, আমরা এখানে থাকতে চাই, বিশেষ করে কৃষক বাস্তুহারারা, তাহলে এটা তো কিছু অন্যায় হয় না - এটাই তো স্বাভাবিক। স্বাভাবিক বলছি এইজন্য যে, আমাদের দেশে ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ গঠন, এ নিয়ে বহু আন্দোলন আমরা করেছি, এবং আজও এই আন্দোলন বিভিন্ন জায়গায় চলছে। যদি এই পরিবেশে ভাষার কোনও মূল্য না থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের ওই আন্দোলন করার কোনও প্রয়োজন ছিল না। তাহলে বলতাম, আমরা সব ভারতবাসী, যেখানেই বাস করি না, তাতে কিছু যায় আসে না। সেজন্য আজ তাঁরা বলছেন যে, আমরা পশ্চিমবাংলায় থাকতে চাই। কী অন্যায় কথা তাঁরা বলছেন? সেজন্য বলছি, এ ব্যাপারে জোরজুলুম করা উচিত নয়। আমরা তাঁদের জোর করে ট্রেনে করে ভেড়া-গরু-ছাগলের মতো বাইরে পাঠিয়ে দিলাম, এটা করা উচিত নয়। আপনারা যদি তাঁদের পেটে মারেন এবং বলেন, তোমাকে ভিখারি করে নিলাম, তুমি পথে বেরিয়ে যাও স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের হাত ধরে, তাহলে এর চেয়ে খারাপ জিনিস আর কী হতে পারে? বাস্তুহারাদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে একটা প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিকে।"

ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ ও অন্ধ্রপ্রদেশ মধ্যবর্তী দণ্ডকারণ্যে উদ্বাস্তুদের পাঠানোর জন্য রাজ্য সরকার উঠে পড়ে লাগল। সেখানে সব মিলিয়ে ছিল প্রায় ৮০ হাজার বর্গমাইল এলাকা। দণ্ডকারণ্যে উন্নয়নের জন্য সরকার প্রায় ৩০ কোটি টাকা খরচ করবে বলে ঠিক করল। জ্যোতিবাবু বললেন - "আপনারা বলেছেন - এটা নতুন বাংলা হবে। বাস্তুহারাদের জোর করে নিয়ে যেতে চাইছেন। তারপর বাজে ভাঁওতা বাস্তুহারাদের দিচ্ছেন - এই অভাগা মানুষগুলোকে। সেখানে কাছাকাছি ৩০ লক্ষ আদিবাসী রয়েছেন। তার আশেপাশে, মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যা, অন্ধ্রে ভূমিহীন কৃষক রয়েছেন, যাঁদের সংখ্যা প্রায় ২৭ ভাগ হবে। সেখানে এই কয়েকজন বাঙালি নিয়ে গিয়ে বাংলা গড়ে তুলবেন? আপনারা আন্দামানে কি নতু বাংলা গড়ে তুলতে পেরেছেন? সেখান সেই নিয়ে গোলমাল বেঁধেছে। আমি বলি, একথা তুলবেন না। এতে প্রধানত ভাঁওতা দেওয়া হয় এবং তাঁদের প্রতি অবিচার করা হয়। ২ লক্ষ মানুষ সেখানে গিয়ে নতুন করে কলোনী গড়বেন! আমি দেখেছি, ২৪ পরগনা কংগ্রেস পার্টি থেকে এইরকম একটি ইস্তাহার দেওয়া হয়েছে। তাঁরা বলছেন যে, দ্বিতীয় একটা বঙ্গদেশ গড়ে উঠবে। তাহলে আন্দামানেও একটা বঙ্গদেশ, উড়িষ্যার বহু এলাকাই বঙ্গদেশ, জামসেদপুরের কিছু অংশও একটা বঙ্গদেশ, বেনারসও একটা বঙ্গদেশ - কেননা সেখানে বহু বাঙালি আগে থেকেই আছেন। তাহলে এরকম বহু বঙ্গদেশ আছে। দণ্ডকারণ্যে নতুন বাংলা কী করে গড়ে উঠবে? সেখানে দু'টো তিনটে স্টেটের ব্যাপার। ৬০-৭০-৮০ মাইল দূরে দূরে তারা ক্যাম্প করবে। তাই আপনারা যে জোরজুলুম, প্রতারণা করছেন - তা করবেন না।"  
*********************************************************************
ইতিমধ্যে অন্য একটি ঘটনায় রাজ্য রাজনীতিতে চমকের সৃষ্টি হয়। সত্তরের দশকে যিনি ছিলেন কমিউনিস্টদের সব থেকে বড় ঘোষিত শত্রু, '৫৮ সালের আগস্ট মাসের উপনির্বাচনে সেই সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন কমিউনিস্ট এবং বামপন্থীরা। তার আগে খাদ্য দফতরে দুর্নীতির প্রতিবাদে বিধান রায়ের মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। এরপর তিনি দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর কেন্দ্রের উপনির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কংগ্রেস প্রার্থী বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি সাড়ে ১০ হাজারেরও বেশি ভোটে হারিয়ে দেন। সেই উপনির্বাচনের প্রধান ইস্যু ছিল খাদ্য সমস্যা ও খাদ্য দফতরের দুর্নীতি।
*********************************************************************
লিউ-শাও-চি চেয়ারম্যান পদে বসার কিছুদিন আগেই দলাই লামা ভারতে প্রবেশ করেন এবং তাঁকে আশ্রয় দেওয়া হয়। সেইসময় তিব্বতের ওই ধর্মগুরু ও রাষ্ট্রপ্রধানের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতে ও ভারতের বাইরে ব্যাপক উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছিল। পণ্ডিত নেহরু তখন বলেন, দলাই লামা স্বেচ্ছায় লাসা ত্যাগ করেছেন। ভারত সরকার তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা করবে। তাঁর বক্তব্য ছিল, তিব্বতের ঘটনাবলী এক জাতীয় অভ্যুত্থান। কিন্তু চিন বলল, তিব্বতের ঘটনাবলি 'প্রতিক্রিয়াশীল অভিজাত'-দের চক্রান্ত।

জাতীয় ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক অজয় ঘোষের একটি বিবৃতিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মহলে সংশয়ের সৃষ্টি হয়। তিনি সেইসময় বলেন, ভূমি সংস্কারের ব্যাপারে কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, তা যাতে কার্যকরী হতে পারে এবং কায়েমি স্বার্থ যাতে এই প্রচেষ্টা বানচাল করে দিতে না পারে তার জন্য কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেসের ও অন্য দলের গণতন্ত্রপন্থীদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে রাজি। তখন প্রশ্ন উঠেছিল - সহযোগিতার অর্থ কি সরকারি ক্ষমতার অংশীদারি? অজয় ঘোষ জানিয়ে দেন, সহযোগিতা বলতে তিনি কোয়ালিশন সরকার গঠন বোঝাচ্ছেন না। এ ব্যাপারে বেসরকারি স্তরেই তাঁরা সহযোগিতা করবেন।
*********************************************************************
এর মধ্যে '৫৯ সালের জুন মাসে কেরলের পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে সর্বভারতীয় রাজনীতি ঘোরালো হয়ে ওঠে। বিরোধীদের ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে কেরলের পরিস্থিতি তখন অশান্ত হয়ে উঠেছিল। সেইসময় কেরলের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ। কমিউনিস্ট পার্টিকে পণ্ডিত নেহরু বললেন, একমাত্র সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমেই কেরলের অশান্ত পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি নেহরুর সেই পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে বলল - "কেরলের বিরোধী দলগুলো বেআইনি পথে যে একতরফা দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করার চেষ্টা করছে, নেহরুর প্রস্তাব তারই একটা গণতান্ত্রিক ছদ্মবেশ ছাড়া আর কিছুই নয়।"

শেষ পর্যন্ত কেরলে নাম্বুদিরিপাদের নেতৃত্বে গঠিত ২৮ মাসের কমিউনিস্ট মন্ত্রিসভার অবসান হল। জ্যোতিবাবু তখন কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদের সম্পাদক। তিনি বললেন - "কেরলে কেন্দ্রীয় সরকারের এই কাজকে আমি স্বৈরাচার এবং গণতন্ত্রের প্রতি অত্যাচার বলে মনে করি।"

কেরলে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গে মিছিল বার হয়। ময়দানে এক জনসভায় জ্যোতিবাবু বলেন, পশ্চিমবঙ্গে তাঁরা কোনওরকম প্রতিশোধমূলক আন্দোলন করবেন না। তবে খাদ্যের দাবিতে তাঁরা অবশ্যই তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলবেন। জ্যোতিবাবু বললেন - "যেদিন থেকে কেরলে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেদিন থেকেই কেরলের ও সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতারা সেই সরকারকে গদিচ্যুত করার জন্য নানারকম ষড়যন্ত্র শুরু করে। প্রথমে তাঁরা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে সরকারের সমর্থক দু'-তিনজন বিধানসভার সদস্যকে দলে টানার চেষ্টা করেন।"

প্রধানমন্ত্রী নেহরুর ভূমিকারও তীব্র সমালোচনা করেন জ্যোতিবাবু। তিনি বলেন - "বাংলার মানুষ যখন তাঁদের অভিযোগ প্রতিকারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল বার করেন, তখন নেহরু দিল্লিতে বসে বলেন, কলকাতায় কারণে-অকারণেই মিছিল হয়। মহারাষ্ট্রে যখন ১০৫ জন লোককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, তখন তিনি কী করেছিলেন? মহারাষ্ট্রের আন্দোলন তো সংবিধান-বিরোধী আন্দোলন ছিল না।" বসুর প্রশ্ন ছিল - "কেরলের সরকার সংবিধানের কোন ধারার বিরোধী কাজ করেছিল? কী দোষে তাদের গদিচ্যুত করা হল? ছোট একটি রাজ্যে কমিউনিস্ট সরকারকে কংগ্রেস সহ্য করতে পারেনি। আর যদি কয়েকটি রাজ্যে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে তো কংগ্রেস পাকিস্তানের আয়ুবশাহীর মতো দেশে ডিক্টেটরি শাসন কায়েম করবে।"
*********************************************************************
তার পাঁচদিন পরেই এ আই সি সি-র অধিবেশনে কংগ্রেস সভানেত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং প্রধানমন্ত্রী নেহরু কমিউনিস্টদের কার্যকলাপ সম্পর্কে কড়া মন্তব্য করেন। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার গোলমালের কথা উল্লেখ করে নেহরু বলেন, "এইসব লোকের সঙ্গে কোনও রকম বোঝাপড়া চলতে পারে না। আমরা যদিও সবরকম গণতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করি এবং অন্যদলকে সবরকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়াই আমাদের ইচ্ছা, কিন্তু আমরা এরকম ঘটনা কখনই সহ্য করব না।" ওই অধিবেশনে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, "ভারতের সঙ্গে কোনও কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের বিরোধ দেখা দিলে ভারতের কমিউনিস্টরা সেই কমিউনিস্ট রাষ্ট্রকেই সমর্থন করেন। কিন্তু কোনও অকমিউনিস্ট দেশের সঙ্গে বিরোধ দেখা দিলে তারা ভারতের সঙ্গে থাকেন।"

তার দু'দিন পরেই বিধানসভায় মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করে জ্যোতিবাবু বললেন - "আমরা দেখলাম, পণ্ডিত নেহরু তাঁদের পার্টি মিটিঙে কংগ্রেস নেতা হিসাবে বলেছেন যে, পশ্চিমবাংলায় যা হয়েছে, পশ্চিমবাংলার আইনসভায় যা হয়েছে, তাতে পশ্চিমবাংলা কলঙ্কিত হয়েছে, ভারতবর্ষ কলঙ্কিত হয়েছে। তাঁর কন্যাও বলেছিলেন, গণতন্ত্রের বিপদ, পার্লামেন্টারি ডেমোক্র্যাসির বিপদ। আমরা ভাবলাম, কেরলে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তারপর অন্তত তিনি এখানেও গণঅভ্যুত্থান দেখতে পাবেন। এখানে দু'-দুটো জেনারেল স্ট্রাইক, রাজ্যজুড়ে সর্বাত্মক ধর্মঘট হয়ে গেল। কিন্তু কোথাও, কি তিনি গণঅভ্যুত্থান দেখতে পেলেন না? এমন শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট কি কোথাও দেখেছেন? আরও তিনি বললেন যে, অ্যাসেম্বলির ভিতর পবিত্র জায়গা। এখানে বিধানসভায় যে জুতো ছোঁড়াছুড়ি হয়েছে, সেসব কথাও তিনি বললেন। এই যে পবিত্র জায়গা, এটা কি শুধু অ্যাসেম্বলির ভিতর? মাতৃভূমির আর কোনও স্থানে কি পবিত্র জায়গা নেই? তিনি কি আর কোনও জায়গা পবিত্র বলে জানেন না? পার্লামেন্টারি ডেমোক্র্যাসি কি বাইরে থাকবে না? শুধু এর বিধানসভার ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে? এটাই কি তিনি ঠিক করেছেন? কারণ এর একটু মুশকিল আছে। কারণ বাইরে কী হচ্ছে?
*********************************************************************
জ্যোতিবাবু যে ভাষায় পণ্ডিত নেহরুকে আক্রমণ করতে পারতেন, ভারতবর্ষের তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। কমিউনিস্ট পার্টিতে তখন যে তারকার অভাব ছিল, তা নয়। বরং কমিউনিস্ট পার্টিতে সেইসময় এমন অনেক নেতা ছিলেন, মার্কসবাদী তত্ত্বের অনুশীলনের বিচারে যাঁরা বরং জ্যোতিবাবুর তুলনায় কয়েক কদম এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু জ্যোতিবাবু বরাবরই মার্কসবাদের অনুশীলন করেছেন সাধারণ মানুষের ভাষায়, তাকে এদেশের জলহাওয়া, সাধারণ মানুষের ভাবাবেগের মতো করে গড়ে নিয়ে। সংসদীয় গণতন্ত্র তাঁর কাছে এমনই একটি বিশ্বাস, যার পথ ধরে তিনি মনে করেন, কমিউনিস্ট পার্টির মূল লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। ফলে পণ্ডিত নেহরুকে তাঁর একথা বলতে বাধেনি যে - "পণ্ডিত নেহরু পার্লামেন্টারি ডেমোক্র্যাসির কথা শোনালেন, কিন্তু কেরলে কেন গণতন্ত্রকে হত্যা করলেন? কেরলে তো আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। তা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট অ্যাডভাইস করলেন যে, কেরলে এদের দরকার নেই। মেজরিটি থাক বা না-থাক, এদের পদত্যাগ করতে হবে, এদের তাড়িয়ে দিতে হবে। কেন তাড়িয়েছেন, তাও বলছেন। বলেছেন, তারা কনস্টিটিউশন মতো চলছে না। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, কনস্টিটিউশনের কোন ধারা ভায়োলেট করা হল? তা বলবেন না। সেখানে যে কোন পার্লামেন্টারি ডেমোক্র্যাসির বিপদ, পণ্ডিত নেহরু তা দেখলেন না। এ যদি সাধারণ মানুষ হত, বলতাম, হামবাগিজম অ্যান্ড হিপোক্র্যাসি। কিন্তু পণ্ডিত নেহরুকে কী বলি? তিনি এত বড় নেতা, তাঁকে কী বলি?
*********************************************************************
কংগ্রেস সম্পর্কে জ্যোতিবাবু ইদানিং এত কড়া কথা আর বলেন না। বলেন না, তাঁর কারণ, ভারতবর্ষের প্রধান রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের চেহারাটাই এখন বদলে গিয়েছে। এখন সমাজের উপরি-কাঠামোয়, রাজনৈতিক লড়াই আবর্তিত হয় সাম্প্রদায়িকতা বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার ইস্যুকে কেন্দ্র করে। এই ইস্যুতেই প্রায় সব রাজনৈতিক দল দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বামপন্থী এবং কংগ্রেসিরাও এখন শুধু সেই ইস্যুতে, অন্তত সংসদে, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে লড়াই করে। প্রধান এই রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের আড়ালে চাপা পড়ে যায়, সাধারণ মানুষের স্বার্থে আঘাত করছে এমন আর্থিক সংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই। পিছড়ে বর্গ, আদিবাসী ও তফসিলীদের সামাজিক সমস্যার সংগ্রামও নজরের আড়ালে চলে যায়। আবার এই দুটি শিবিরের বিভাজন রেখাও অস্পষ্ট হয়ে যাবে প্রধান রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। যেমন হয়েছিল কংগ্রেস কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতায় থাকার সময়। তখন কংগ্রেসই ছিল কমিউনিস্টদের প্রধান রাজনৈতিক শত্রু।
*********************************************************************
তার কিছুদিন পরেই কমিউনিস্ট পার্টির নেতা এস এ ডাঙ্গে লোকসভায় বলেন, চিন কখনও ভারত আক্রমণ করবে না। যেমন ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, ভারত কখনও চিন আক্রমণ করবে না, তেমনই তিনিও এই প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন যে, চিনও কখনও ভারত আক্রমণ করবে না। লোকসভার জনৈক সদস্য সেইসময় জানতে চান, 'ডাঙ্গে কোন অধিকারে চিনের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন?' অন্য এক সদস্য ডাঙ্গের কাছে জানতে চান - 'আপনি কি কোনও চিঠি পেয়েছেন?' ডাঙ্গে বলেন - 'প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেননের অপসারণ  তিব্বতকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যেই ভারতে কংগ্রেস সহ অন্যান্য দল আন্দোলন চালাচ্ছে। সীমান্তের কোনও সমস্যা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। কমিনিস্ট পার্টিকে বিচ্ছিন্ন করে, আগামী নির্বাচনের আগে কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করার রাজনীতি নিয়েই এই আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে।"
*********************************************************************
জ্যোতিবাবু এরপর ক্রীড়া প্রশাসনের শীর্ষে রাজনীতির লোক ও শাসক দলের পছন্দসই ব্যবসায়ীদের বসানো এবং মোহনবাগান ক্লাবের নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে বিধান রায়কে তুলোধোনা করলেন। তিনি বললেন - "আপনারা একটা কমিটি করবেন - স্পোর্টসের কথা যখন ভাববেন, তখন এমন লোককে নিয়ে ভাববেন, যাঁরা স্পোর্টস সম্বন্ধে কিছুই জানেন না। সব ব্যবসাদার, বড় বড় লোক, রাজা-মহারাজা - তাঁদের নিয়ে স্পোর্টস কমিটি করবেন। এমন ঘটনা ঘটেছে, মুখ্যমন্ত্রী মোহনবাগান ক্লাবের অ্যানুয়াল ইলেকশনে টেলিফোন করে করে বলেছেন, ওহে, অমুক দে-কে ভোট দাও, ধীরেন দে-কে ভোট দাও।"

বিধান রায় তখন উঠে দাঁড়িয়ে জ্যোতিবাবুর এই মন্তব্যের প্রতিবাদ জানালেন। বললেন - "এটা সত্য নয়। একেবারে ভিত্তিহীন।"

জ্যোতিবাবু পাল্টা বললেন - "এটা একেবারে ট্রু। আপনিও জানেন, আমরাও জানি। আপনি সত্যিই খারাপ কাজ করেছেন। কিন্তু আমি বলি, এইসব ব্যবসা-বাণিজ্য, ওষুধের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট লোকদের হেডে রাখছেন কেন? যাঁরা স্পোর্টসম্যান, যাঁদের উদ্যম আছে, তাঁদের কেন নিচ্ছেন না? অর্থাৎ, আমরা দেখছি, ব্যবসাদাররা যেমন সমাজের শীর্ষস্থানে বসে আছেন, সমস্ত কিছু কন্ট্রোল করছেন, ব্ল্যাকমার্কেট থেকে আরম্ভ করে সব কিছুই, তেমনি আমরা দেখছি, স্পোর্টিং ওয়ার্ল্ডেও তাঁদের ঢুকিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তাঁরা ঠিক করবেন, কী হবে না হবে। এইজন্য লজ্জায় আমাদের মাথা তোলা যায় না।

বিধান রায় তখন বলে ওঠেন -"কেবল ব্যারিস্টারদেরই ঢোকানো হবে?"

জ্যোতিবাবু জবাবে বললেন - "আমি সেকথা বলি না। এমন লোককে ধরুন, যাদের দিয়ে কাজ হবে। আজকে ডিসিশন নিন, কাল স্পোর্টস স্টেডিয়াম হতে পারে, অল্পদিনের মধ্যে স্টেডিয়াম হতে পারে। কিন্তু এইভাবে জিনিসটাকে আপনারা ফেলে রেখে দিয়েছেন।"
*********************************************************************
এই সভায় ভারত-চিন সীমান্ত বিরোধের ব্যাপারে কমিউনিস্টদের ভূমিকা নিয়ে কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষের অভিযোগের জবাব দিলেন তিনি। জ্যোতিবাবু সেখানে বললেন - "চিন যদি ভারতের জমি দখল করেই থাকে, তাহলে সরকার সময়মতো খবর পায়নি কেন? জমি দখল হয়ে থাকলে, সেই সরকার গদিতে থাকে কী করে?"
*********************************************************************
তারপর জ্যোতিবাবু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য যেসব কথা বললেন, তার মধ্যে কেউ কেউ প্রাদেশিকতার গন্ধ খুঁজে পেতেই পারেন।

তিনি বললেন - "এঁদের কেন জায়গা হবে না? এঁরা বাঙালি। সমস্ত অবাঙালিরা পশ্চিমবঙ্গের ফ্যাক্টরি ভরে ফেলল, ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কথা শঙ্করদাসবাবু বললেন। তবে উনি বোধহয় জানেন না - দুর্গাপুর অঞ্চলে আমরা এখনও দেখছি যে, সেখানে বলা হচ্ছে, ক্যাম্প রিফিউজিদের যেন এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম লিখতে না দেওয়া হয়। এই বাঙালি রিফিউজি, যাঁরা ক্যাম্পে আছে, তারা যদি তাদের নাম লিখতে যায়, তাহলে তাদের নাম লিখতে বারণ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ, যদি চাকরি পেয়ে তারা ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যায়! শুধু তাই নয়, বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউনিটদের বলা হচ্ছে যে, এদের কাজ দিও না। অর্থাৎ সমস্ত রকম প্রেসার দিয়ে বাধ্য করে তারপর যাতে এদের দাসপ্রথায় দণ্ডকারণ্যে পাঠানো যায়, তারই চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না যে, বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউনিটের তরফ থেকে যদি ব্যবস্থা না করা হয়, তাহলে পশ্চিমবঙ্গে এরা কোথায় চাকরি পাবে?

"হাজার হাজার উদ্বাস্তু, যারা ক্যাম্পে আছে, ভোটার লিস্ট থেকে তাদের নাম কেটে দেওয়া হয়েছে। আর তাদের বলা হচ্ছে, আগে সিটিজেনস সার্টিফিকেট জোগাড় কর। তোমাদের ভাষা থেকে বুঝছি, তোমরা পদ্মার ওপার থেকে এসেছ, তোমরা বাঙাল। এদের বলা হচ্ছে, সিটিজেনস সার্টিফিকেট নিতে হবে, তবে ভোট দিতে পারবে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তারা, জেনারেল ইলেকশনে ভোট দিয়েছে, আর তাদের নামে কেস দিচ্ছে - কেউ রাজনীতি করতে পারবে না, ভোটার হতে পারবে না। ওরা দাস। কিন্তু রোমান দাসরাও একদিন রাইজ করেছিল। চিরদিন তাদের দাবিয়ে রাখা যায়নি। একদিন যদি ওই পথ তাদের নিতে হয়, তাহলে ওরাও তা নেবে।"
*********************************************************************
চিনাদের কাজকর্মের সমালোচনা করে বিবৃতি দিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক অজয় ঘোষ। তিনি বললেন - "চিনাদের সঙ্গে বর্তমানে বিরোধ চলছে। এই অবস্থায় চিনাদের বর্তমান কার্যকলাপ উত্তেজনা বাড়াতে এবং ভারতবাসীর মনে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি না-করে পারে না। এর ফলে, দু'-দেশের মধ্যে সম্পর্কে যে আরও অবনতি ঘটবে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।"
*********************************************************************
পরদিন নেহরু বললেন, "ভারত সরকারের লক্ষ্য ও নীতি হল, ভারতভূমি থেকে চিনা আক্রমণকারীদের সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত করা এবং এর ফলে যুদ্ধের সম্ভাবনা খারিজ করা যায় না। তাহলে বাহিনী রাখার প্রয়োজন কী? সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী রাখার প্রয়োজন কী?" একই সঙ্গে অবশ্য নেহরুর বক্তব্য ছিল - ভারত ও চিনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে গোটা বিশ্বে নিদারুণ বিপর্যয় দেখা দেবে। এই যুদ্ধ বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হবে এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য এই যুদ্ধ চলতে থাকবে। চিনের পক্ষে ভারতকে পরাজিত করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনই ভারতের পক্ষেও পিকিঙে প্রবেশ করা সম্ভব নয়।

ভারত-চিন সীমান্ত সমস্যার উত্তাপ সাধারণ নির্বাচনের প্রচারেও পড়তে শুরু করেছিল। '৬২ সালের গোড়ায় ২৪ পরগনার বরাহনগরে এক জনসভায় জ্যোতিবাবু বললেন - "কংগ্রেস একটি সুবিধাবাদী পার্টি। যখন যা সুবিধা, তখন তা করে দেশকে ওরা সর্বনাশের পথে নিয়ে যাচ্ছে।"

তার আগের দিনই উত্তরবঙ্গের এক সভায় মুখ্যমন্ত্রীবিধান রায় কমিউনিস্ট পার্টির পতাকাকে 'বিদেশি পতাকা' বলে বর্ণনা করেন। সেই অভিযোগের জবাবে জ্যোতি বসু বললেন - "ডাঃ রায় জানেন না, ওই পতাকার উদ্ভব কোথা থেকে। বহুদিন আগে আমেরিকার এক শহরে ওই পতাকা নিয়েই শ্রমিকরা বিদ্রোহ করেন এবং শ্রমিকদের রক্তে রাজপথ লাল হয়ে যায়। তার পরেই শ্রমিকরা ওই লাল পতাকাকে নিজেদের পতাকা বলে গ্রহণ করেন। চিন বা রাশিয়া থেকে ওই পতাকার উদ্ভব হয়নি।" একই সঙ্গে তিনি কংগ্রেসের পতাকারও বিশ্লেষণ করলেন - "ওই পতাকা রামায়ণ বা মহাভারত থেকে আসেনি। ফরাসি বিপ্লবের পর ভারতের তৎকালীন বিপ্লবীরা ওই পতাকা গ্রহণ করেন। কংগ্রেসের এখনকার পতাকার রঙের হয়ত কিছুটা বদল হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ফরাসি বিপ্লবের পর এদেশের বিপ্লবীরা ওই দেশের বিদ্রোহী পতাকার অনুকরণ করেছিলেন।" তারপর পরিহাসের সুরে তিনি বলেন - "ডাঃ রায়ের লাল পতাকায় এত ভয় কেন? রামভক্ত হনুমানের পতাকাও তো লাল!"
*********************************************************************
দু'-একদিন আগেই কমিউনিস্ট প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষ বলেছিলেন, কমিউনিস্ট পার্টি চিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করুক। সেই চ্যালেঞ্জের জবাবে জ্যোতিবাবু বললেন - 'অতুল্যবাবু যদি চিনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে রাজি থাকেন, তাহলে আমি তাঁর পিছনে যেতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নেহরু যে ওই ব্যাপারে মীমাংসা চাইছেন।"
*********************************************************************
সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের হাত কতটা শক্ত করে ধরা যেতে পারে, তা নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে বিতর্ক চিরকালীন। কোনটি বেশি বিপজ্জনক - কংগ্রেসের আর্থিক নীতি, যার ফলে গরিব আরও গরিব হয়ে যায়, নাকি সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে ওই দলের আপস করার প্রবণতা - এই বিতর্কেও কখনও কখনও কমিউনিস্ট পার্টির মনোলিথিক গঠন চিড় দেখা গিয়েছে। কিন্তু অন্য অনেক দলের মতো কংগ্রেসও বরাবরই যে ভোটের আগে-পরে সাম্প্রদায়িক তাস বার করেছে, তা কারওরই নজর এড়ায়নি।
*********************************************************************
জ্যোতিবাবু এরপর জাতীয় সংহতি, ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বক্তৃতার কথা উল্লেখ করলেন, তারপর বিভিন্ন প্রচার-পুস্তিকা থেকে পড়ে শোনাতে শুরু করলেন - "এখানে একটা জায়গায় বলা হয়েছে - 'ধর্ম ও ঈশ্বরবিশ্বাসের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির জেহাদ।' কোনও গণতান্ত্রিক দেশে কি এই জিনিস হয়? কোনও গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনে কি ঈশ্বরের কথা আসে? অথচ এখানে লেখা হয়েছে, 'কমিউনিস্ট পার্টি কোনও ধর্মে এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়।' আমার কথা হল, এটা ঠিক হলেও এটা নির্বাচনের বিষয়বস্তু নয়। অন্য জায়গায় হতে পারে। তারপর দেখুন এখানে লেখা আছে, 'আপনি কি এই ধর্মবিরোধী মতবাদকে ভোট দিয়ে সমর্থন করবেন?' তাহলে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনের মধ্যে ধর্ম এবং ঈশ্বরকে টেনে আনা হল। অথচ এটা নির্বাচনের মধ্যে আসার কথা নয়, একথা পণ্ডিত নেহরু বরাবরই বলে আসছেন। কেরালাতে বিশপরা একটা সার্কুলার দিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে পণ্ডিত নেহরু কেরালায় গিয়ে প্রচার করে বলেছেন যে, এটা অন্যায়। কিন্তু এই বুকলেট চৌরঙ্গির কংগ্রেস ভবন থেকে বেরিয়েছে।"

সেই বছর ভোটের আগে কংগ্রেস ভবন থেকে 'কমিউনিস্ট পার্টির স্বরূপ' বলে আরও একটি ইস্তাহার প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই ইস্তাহারে 'পয়গম' নামে একটি কাগজে প্রকাশিত কমিউনিস্ট-বিরোধী প্রচারের কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হয়। জ্যোতিবাবু বললেন - "গত ১০-২-৬২ তারিখে পয়গম-এর যে সংখ্যা বেরিয়েছে, সেই সংখ্যায় কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে এবং ধর্ম সম্বন্ধে অনেক কথা লেখা হয়েছে। তার একটা জায়গায় আছে, 'খৃষ্টান এবং মুসলিমপ্রধান রাশিয়ায় মুসলমান ধর্ম লোপ পেয়েছে এবং সেখানে ৪ কোটি মুসলমান হজ, রোজা, নামাজ প্রভৃতি ছেড়ে দিয়ে শুয়োর পুষতে বাধ্য হচ্ছে।' এইরকম অনেক কথা বলে তারপর বলেছে যে, 'কমিউনিস্টদের উপর আল্লার অভিশাপ বর্ষিত হোক।' এটা যদি শুধু পয়গম-এর একটা আর্টিকল হত, আমি কিছু বলতাম না। কিন্তু এই আর্টিকলটা কংগ্রেস পার্টির এতই পছন্দ হল যে, এ থেকে একটা অংশ নিয়ে কংগ্রেস ভবন থেকে বিনয় রায় কমিটির পক্ষে এইভাবে একটা কাগজে উদ্ধৃত করে দিলেন। এই হল ধর্মের ব্যাপার। আমি বলছি যে, এই পদ্ধতি যদি থাকে, তাহলে এটা যেন না-বলা হয় যে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়েছে। ওঁরা বলুন যে, নির্বাচনে জিতবার জন্য আমরা যে কোনও পন্থা অবলম্বন করব - এটা ভাল কথা এবং সাহস করে এটা বলা উচিত। কিন্তু টাটা-বিড়লা-সিংহানিয়া প্রভৃতি কলকারখানার মালিকের টাকা নিয়ে, আর এইরকম পদ্ধতিতে নির্বাচনে জিতবেন, তারপর তাঁরা এখানে এসে বড় বড় কথা বলবেন - এ ভণ্ডামি আমাদের পছন্দ হচ্ছে না।"
*********************************************************************
কয়েকদিন পরেই, '৬২ সালের ২০ অগস্ট হায়দরাবাদে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকই ই. এম. এস. নাম্বুদিরিপাদ সাংবাদিক বৈঠক করে বললেন - ভারত-চিন সীমান্ত বিরোধের ইস্যুতে কমিউনিস্ট পার্টি মোটামুটিভাবে ভারত সরকারের বক্তব্য ও মনোভাবের সঙ্গে একমত হলেও বিশেষ বিশেষ এলাকা সম্পর্কে দুই দেশের দাবিদাওয়ার ব্যাপারে আলোচনায় যোগ দিতে চায় না। কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করে ই. এম. এস. সেদিন জানিয়ে দিলেন, কমিউনিস্ট পার্টির মতে উত্তর-পূর্বে ম্যাকমোহন লাইনই নির্ভুল সীমারেখা এবং লাদাখে পার্টি চিরকালীন সীমান্তই মেনে নিয়েছে। ই. এম. এস'এর কাছে তখন জানতে চাওয়া হয় - "লাদাখে চিরকালীন সীমান্ত মেনে নিয়ে পার্টি কি ভারত সরকারের একথা মেনে নিচ্ছে যে, চিন ভারতীয় এলাকা দখল করেছে?'  নাম্বুদিরিপাদ ওই প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়ে বললেন - "আমাদের দল আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির নীতির সঙ্গে একমত।" তখন তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয় - "কমিউনিস্ট পার্টি কি রাশিয়া বা যুগোস্লাভিয়ার মতো দেশের মধ্যস্থতা পছন্দ করে?" ই এম এস বললেন - "এই ধরণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ভারত সরকারের উপরেই ছেড়ে দেওয়া উচিত। এই ধরণের প্রশ্ন নিয়ে প্রকাশ্যে সংবাদপত্রে আলোচনা করা চলে না।" "দলের জাতীয় পরিষদের বৈঠকে ভারত সরকার ও নেহরুর মধ্যে পার্থক্য করার চেষ্টা হয়েছে কেন" এই প্রসঙ্গে ই. এম. এস. বলেন - "ভারত সরকার ও নেহরুর মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। যাই হোক না কেন, নেহরু নেহরুই।" ম্যাকমোহন লাইনই যে ভারত  চিনের মধ্যকার সীমানা - ভারত সরকারের এই যুক্তি অস্পষ্টভাবে মেনে নিয়ে অক্টোবর মাসে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি একটি প্রস্তাব পাস করল। তবে প্রস্তাব পাস করানোর আগে তা নিয়ে ভোটাভুটি করতে হয়। 
*********************************************************************
সেইদিনই কংগ্রেস নেতা অতুল্যঘোষের একটি মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি প্রচার করেন জ্যোতিবাবু। তিনি সেদিন বললেন - "আমি মনে করি, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের পর পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের নেতার কর্তব্য, দেশের সব শক্তির মধ্যে সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করা। কিন্তু তিনি তাঁর নিজস্ব প্রকৃতি অনুযায়ী এবং তাঁর দলের সংকীর্ণ স্বার্থের কথা ভেবে জনগণকে বিভক্ত করতে এবং জনগণের একাংশকে কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধের প্ররোচিত করতে উদ্যোগী হয়েছেন। যখন আমাদে সৈনিকরা চরম ত্যাগ স্বীকার করছেন, তখন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির এই চেষ্টা কমিউনিস্ট পার্টির সব সদস্য ও সৎ লোকেরা ব্যর্থ করে দেবেন বলে আমি নিশ্চিত।" সেইসময়ে কয়েকটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, সীমান্তের ঘটনা-বলিকে জ্যোতিবাবু তুচ্ছ করে দেখছেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে অতুল্য ঘোষ যে মন্তব্য করেন, জ্যোতিবাবু তারই প্রতিবাদ জানান।

ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে কমিউনিস্ট পার্টি-বিরোধী প্রচার ক্রমশ তীব্র হতে থাকায় চারদিনের মধ্যেই জ্যোতিবাবুকে আরও একটি বিবৃতি দিতে হল। এবার তিনি বললেন - "চিনপন্থী ও ভারতের প্রতিরক্ষাবিরোধী বলে ব্যক্তিগতভাবে আমার নিন্দা করে এবং আমাদের পার্টির পশ্চিমবঙ্গ শাখার বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত অপপ্রচারের অভিযান চালানো হচ্ছে। এর আগে আমি এক বিবৃতিতে জানিয়েছিলাম, আমাদের সব কমিটিই কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য। কিন্তু আমাদের পার্টির কয়েকটি শাখা বিবৃতি দিয়েছে, যদিও এর প্রয়োজন ছিল না।"

সেই সময় দিল্লিতে দলের জাতীয় পরিষদের যে বৈঠক চলছিল, জ্যোতিবাবু তাতে অনুপস্থিত ছিলেন। কয়েকজন বন্ধুর অনুরোধে তিনি বিবৃতি দিচ্ছেন বলে জানিয়ে জ্যোতিবাবু বললেন - "ভারত এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন। ভারত চিনের সঙ্গে অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে এবং ভারত সরকার আশু কর্তব্যে দেশকে প্রস্তুত করার জন্য জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। আমি এখনও বিশ্বাস করি যে, এই পরিস্থিতি সত্ত্বেও দুটি দেশ বড় বিপর্যয় ও সশস্ত্র যুদ্ধ এড়াতে পারে। এই জাতীয় যুদ্ধে, চিন বা ভারত, কারওরই স্বার্থসিদ্ধি হবে না এবং এটা স্পষ্টই বোঝা যায় যে, কোনও দেশই অপর দেশকে পদানত করতে পারবে না।"

জ্যোতিবাবুর বক্তব্য ছিল - "এই যুদ্ধে বরং সাম্রাজ্যবাদীরা আনন্দিত হবে। ভারতের জোট-বহির্ভূত থাকার নীতি বানচাল হয়ে যাবে। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ও পুঁজিপতিরা আরও বেশি করে ভারতের এই অবস্থার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে এবং আমাদের জনগণ আরও দুর্ভোগের মধ্যে পড়বেন। দুটি দেশই শান্তিপূর্ণ অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তোলার পরিবর্তে প্রয়োজনের চাপে যুদ্ধকালীন অর্থনীতি গড়ে চলবে।" জ্যোতিবাবু বললেন - "বর্তমান অবস্থায় আমরা বিশ্বাস করি যে, ভারতের পক্ষ থেকে একতরফা যুদ্ধবিরতির প্রশ্ন ওঠে না। উন্নত সশস্ত্র শক্তির কাছে আত্মসমর্পনেরও প্রশ্ন ওঠে না। ভারতের মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সবরকম দুর্বলতা দূর করতে হবে। আমরা শান্তিপূর্ণ মীমাংসার সব আশা ত্যাগ করিনি।"
*********************************************************************
শেষ পর্যন্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় পরিষদ ভারতকে আক্রমণের অভিযোগে চিনকে অভিযুক্ত করল।  নভেম্বর জাতীয় পরিষদের বৈঠকে এই মর্মে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। মাতৃভূমি রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য কমিউনিস্ট পার্টি জনগণের প্রতি আবেদন জানাল। সরাসরি চিনের নিন্দা করে কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় পরিষদ বলল, ম্যাকমোহন লাইন অতিক্রম করা হবে না বলে চিন সরকার গত তিন বছর ধরে যে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিল, সেই প্রতিশ্রুতি ভেঙে চিনা সৈন্যরা ওই আন্তর্জাতিক সীমারেখা লঙ্ঘন করেছে এবং অনেক জায়গাতেই ভারতীয় এলাকার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার আগে জাতীয় পরিষদের বৈঠকে ভোটাভুটি হয়।

তিন পৃষ্ঠাব্যাপী প্রস্তাবে জাতীয় পরিষদ বলল, "চিনের মতো একটি সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র যে অস্ত্রের জোরে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ মীমাংসায় উদ্যত হবে, তা কখনও কল্পনা করা যায়নি।" চিন তখন বলছিল, 'নেহরু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল ও প্রতিক্রিয়াশীল সম্প্রসারণবাদীদের নেতা।'
*********************************************************************
বিধানসভায় প্রবল আক্রমণের মুখে পড়ে সেকথা স্বীকার করে নিলেন কমিউনিস্ট নেতা সোমনাথ লাহিড়ী - "আমি অকপটে স্বীকার করি যে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় পরিষদে কারও কারও মনে দ্বিধা ছিল। অনেক দ্বিধার পর, অনেক দ্বিধার বিরুদ্ধে লড়াই করে তবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। কিন্তু আমি বলব, আমাদের মনে যদি দ্বিধা না-থাকত, রাতারাতি আমরা যদি ভোল পাল্টাতাম, তাহলে আমরা মানুষ বলে গণ্য হতে পারতাম না। এতদিন আমরা বিশ্বাস করে এসেছি, চিনের প্রতিশ্রুতি, চিনের আদর্শ, চিন যেকথা বলেছে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে সমস্ত আন্তর্জাতিক দুনিয়ার সঙ্গে সুর মিলিয়ে - আমরা কী করে বিশ্বাস করব যে, তারা সেই প্রতিশ্রুতি একদিন ভঙ্গ করে দেবে? তাই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে, স্বভাবতই নিজেদের ধ্যান-ধারণার সঙ্গে আমাদের সংগ্রাম করতে হয়েছে। আজ সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বলা যায়, অতীতে আমাদের কেউ কেউ যা বলেছেন বা ভেবেছেন বা লিখেছেন তার মধ্যে ভ্রান্তি কিছু থাকতে পারে, তার মধ্যে অপরিণামদর্শিতা কিছু থাকতে পারে। কিন্তু সেই যে ভ্রান্তি বা অপরিণামদর্শিতা, সেটা অতীতের বিষয়।"

সোমনাথ লাহিড়ীর মতো বিচক্ষণ নেতাকে কেন বিধানসভার অধিবেশনে বামপন্থী এবং দক্ষিনপন্থীদের প্রবল আক্রমণের মুখে দলের ভিতরকার কথা খুলে বলতে হয়েছিল, তা নিয়ে গবেষণার কোনও সুযোগ নেই। বরং বলা যায়, কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে 'চিনপন্থী' বলে চিহ্নিত নেতাদের খুঁজে বার করা যে চেষ্টা শুরু হয়েছিল, সোমনাথ লাহিড়ির সেদিনকার বক্তৃতা সেই চেষ্টাকেই সাহায্য করেছে।
*********************************************************************
জেলের ভিতরে জ্যোতিবাবুর সঙ্গে অন্য কট্টরপন্থী নেতাদের মতপার্থক্য বাড়তে থাকে। কট্টরপন্থী বলে পরিচিত নেতারা তখনই পার্টি থেকে বার হয়ে গিয়ে নতুন পার্টির গড়ার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু জ্যোতিবাবু ও তাঁর মতের সমর্থক নেতারা তখনই সেই প্রস্তাবে সায় দিতে রাজি ছিলেন না। দলের একাংশ সেই সময় জ্যোতিবাবুকে অপদস্থ করার জন্য তাঁকে ব্যক্তিগত স্তরে আক্রমণ করতে শুরু করেন। তাঁর বিরুদ্ধে এমন প্রচার শুধু হয়, যাকে কুৎসা বলা যেতে পারে। যেমন তখন জ্যোতিবাবুকে আক্রমণ করে বলা হচ্ছিল, তিনি বুর্জোয়া পরিবারের সন্তান, তিনি আরামপ্রিয়, তিনি বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছেন, কারণ তিনি দুর্বলচিত্ত। সেইসময় জ্যোতিবাবুর মতো যেসব নেতা তখনই পার্টিতে ভাঙনের বিরোধী ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই মত ছিল, যেসব অর্থনৈতিক দাবি সামনে রেখে নতুন পার্টি গঠিত হবে, তখন কমিউনিস্ট পার্টিই সেইসব দাবিতে আন্দোলন করছিল। তা সত্ত্বেও নতুন পার্টি গঠিত হলে জনসাধারণ তার রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দাবি করবেন এবং ধরে নিতে পারেন যে, নিছক চিনের স্বার্থেই পাল্টা পার্টি গড়া হচ্ছে। জনসাধারণের এই ধারণা নতুন পার্টির ভবিষ্যতের পক্ষে ক্ষতিকারক হবে বলে তাঁদের আশঙ্কা ছিল। তাঁদের সেই আশঙ্কা যে ভুল ছিল, পরবর্তীকালের ইতিহাসই তা প্রমাণ করেছে। কিন্তু সেটাও বড় কথা নয়। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল, জনসাধারণ যে ওরকম ভাবতে পারেন, সেই ধারণা যে ওইসব নেতার কী করে হল, তা কখনও স্পষ্ট করে জানা যায়নি।
*********************************************************************
কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ বিরোধ ততদিনে বিস্ফোরক হয়ে উঠেছে। দলের ঘেরাটোপ ছেড়ে তা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে প্রকাশ্যে। তারই চরম প্রকাশ দেখা গিয়েছিল দিল্লিতে এ. কে. গোপালনের বাড়িতে। সেদিন ছিল, ১৯৬৪ সালের ২৬ মার্চ। এক সাংবাদিক বৈঠকে বাসবপুন্নায়া বললেন, দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট নেতা এস. এ. ডাঙ্গে ১৯২৪ সালে তাঁর কারামুক্তির বিনিময়ে বৃটিশ সরকারকে সাহায্য করতে চেয়ে চিঠি দিয়েছিলেন।

কানপুরের বলশেভিক চক্রান্ত মামলায়, ডাঙ্গেকে ১৯২৪ সালে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাঁকে চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। বাসবপুন্নায়া বললেন, বোম্বাইয়ের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় ডাঙ্গের চিঠিপত্র প্রকাশিত হওয়ার তিনমাস আগেই তিনি সেইসব চিঠির অস্তিত্বের কথা জানতেন। এইসব চিঠির যথার্থতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য তিনি সাংসদ পি রামমূর্তিকে নিয়ে জাতীয় মহাফেজখানার অফিসে যান এবং পরে আরও দুবার সেখানে গিয়ে কয়েক ঘন্টা ধরে 'ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন' সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র দফতরের ফাইলপত্র দেখেন।
*********************************************************************
মতাদর্শের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের মধ্যে যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে, সে ব্যাপারে তাঁদের নীতি এবং কর্মসূচি কী হবে, সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই তা স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করলেন জ্যোতিবাবু। তিনি বললেন - "ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি একটি সার্বভৌম স্বাধীন দল এবং এই দল স্বাধীনভাবেই নিজের নীতি ও কৌশল ঠিক করবে।" জ্যোতিবাবু সেদিন বললেন - তিনি এখনও চান না যে, ভারতের কমিনিস্ট পার্টির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হোক। ধনিক শ্রেণী নিয়ন্ত্রিত এই সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজন আছে। কিন্তু ঐতিহাসিক ঘটনাবলির কারণে বাধ্য হয়েই তাঁরা এখনকার পথে এসেছেন। একই সঙ্গে তিনি জানিয়ে দেন, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ডাঙ্গে-পন্থীরা যে কংগ্রেস-ঘেঁষা নীতি নিয়েছেন, তাঁরা সম্পূর্ণভাবে তার বিরোধিতা করছেন। সেই সময়েই জ্যোতিবাবুর আশঙ্কা ছিল, মতাদর্শের ইস্যুতে নেতৃত্বের লড়াইয়ের ফলে পার্টির সাধারণ সদস্য ও দরদিদের মধ্যে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করতে বেশ কিছু সময় লাগবে।

অবশেষে কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চলে এল প্রকাশ্যে, একেবারে ময়দানের জনসভায়। সেটা ছিল '৬৪ সালের ৯ মে। কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদের ডাকে ময়দানের এক সভায় জ্যোতি বসু বললেন - "আমরা পার্টির সংগ্রামী ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আর ডাঙ্গেপন্থীরা তাকে মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের হাত থেকে পার্টিকে রক্ষা করার জন্যই আমরা জনসাধারণের কাছে পার্টির ভিতরকার সঙ্কটের কথা খুলে বলতে চাই, যাতে জনগণ আমাদের সাহায্য করেন। পার্টিকে এখন আর শুধু বাইরের শত্রু নয়, ভিতরের শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ডাঙ্গে নিজের জঘন্য অপরাধ ঢাকার জন্য তাঁর বিরোধীদের চিনপন্থী বলে দেখানোর চেষ্টা করছেন। নেহরুও শ্রেণীস্বার্থে যেটুকু প্রগতিশীল কথা বলেন, ডাঙ্গেপন্থীরা তাও বলেন না। ওঁরা নেহরু সরকারকে আদৌ গদিচ্যুত করতে চান না।"
*********************************************************************
তারপর শিক্ষামন্ত্রীর বক্তৃতার বিভিন্ন অংশ উদ্ধৃত করে এবং তার সমালোচনা করে জ্যোতিবাবু বললেন - "উনি অঙ্কের হিসাব দিলেন - আগে এত টাকা খরচ হত, এখন এত টাকা খরচ হচ্ছে। হিসাব দেওয়া উচিত ছিল, আমাদের প্রয়োজন কী, আমাদের আদর্শ কী, আমাদের লক্ষ্য কী, সংবিধানে কী লেখা ছিল, আমাদের কী করণীয়। ১০ বছরের মধ্যে বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা তাঁরা করতে পেরেছেন? ১৪ বছরের বালক-বালিকাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন? করতে পারেননি, এই হবে আপনাদের উত্তর। কেন পারিনি, কতটা পেরেছি, কবে বাকিটা আমরা পারব - এইভাবে বিচার করা উচিত ছিল। তা তিনি পারেননি। তিনি কতকগুলি অঙ্কের হিসাব দিয়ে মনে করলেন যে, কথা ঘুরিয়ে দিলাম। ৩০ কোটি টাকার বাজেট পেশ করে মনে করলেন যে, মাথা ঘুরিয়ে দেব।"

তখন প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষায় ইংরেজির ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে বড় ধরনের কোনও বিতর্ক না থাকলেও, সরকারের নির্দিষ্ট কোনও নীতি বা পরিকল্পনা ছিল না। ফলে কখনও কখনও ছাত্রছাত্রীদের চরম অসুবিধার মুখোমুখি পড়তে হত। তাঁর বক্তৃতায় সেই সমস্যার কথাও উল্লেখ করলেন জ্যোতিবাবু। তিনি বললেন - "স্কুলে শিক্ষা হচ্ছে মাতৃভাষায়। তারপর অনার্স নিলে ইংরেজিতে পড়তে হবে বিভিন্ন বিষয়। তাহলে কী করে সে পড়বে? সেইজন্য একাদশ ক্লাসের ছাত্রদের অসুবিধা হবে সেখানে। অনার্স কোর্স তারা পড়তে পারবে না। এগুলো বিচারের সময় কি এখনও আসেনি?"

জ্যোতিবাবুর মুখ্যমন্ত্রিত্বে এই রাজ্যে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাকে ঢালাও ভাবে অবৈতনিক করে দেওয়া হয়েছে। সরকারের নীতির ফলে, ভূমিহীন কৃষকের ছেলে এবং শিল্পপতির সন্তান একই রকমের সুযোগ পেয়ে গেল। উচ্চশিক্ষাতেও খরচ বৃদ্ধির ফলে তাল মিলিয়ে উপযুক্ত সময়ে ফি-বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ফলে বনগাঁ এবং বালিগঞ্জের ছাত্রছাত্রীকে একই আর্থিক মানদণ্ডে বিচার করা হয়েছে। ভরতুকির ক্ষেত্রে এইরকম উদার মনোভাবের ফল কী হতে পারে, রাজ্য সরকার তা বুঝতে পারল অনেক পরে।
*********************************************************************
কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে সরকারের এই আচরণকে জ্যোতিবাবু সামাজিক সমস্যা এবং সামাজিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করলেন। তিনি বললেন - "সরকার যত মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন, মানুষের যে সমস্যা তাঁরা সৃষ্টি করেছেন, তার সমাধানের পথ যত তাঁরা খুঁজে পাচ্ছেন না, ততই সরকার মরিয়া হয়ে এটাই মনে করেছেন, গদিতে টিকে থাকার জন্য একমাত্র উপায় হচ্ছে, গণতন্ত্রকে খতম করা। এমন অবস্থার মধ্যে তাঁরা এসেছেন যে, কংগ্রেস পার্টির নিরাপত্তা ও দেশের নিরাপত্তাকে তাঁরা এক কোনো দেখতে আরম্ভ করছেন। তাঁরা বলছেন, কংগ্রেস যদি না বেঁচে থাকে, কংগ্রেস যদি পর্যদুস্ত হয়, কংগ্রেস যদি নির্বাচনে কোথাও হেরে যায়, কংগ্রেস যদি গদিচ্যুত হয়, তাহলে দেশের বিপদ হবে। তাহলে দেশকে আমরা বাঁচাতে পারব না, তাহলে দেশে নিরাপত্তার অভাব হয়ে যাবে। এইভাবে তাঁরা পার্টিকে দেশের সঙ্গে মিল করে দিচ্ছেন। ঠিক যা হওয়ার কথা, তার উল্টো জিনিস তাঁরা করে দিচ্ছেন।
*********************************************************************
এর কিছুদিন আগেই বেতার ভাষণের মাধ্যমে এবং লোকসভায় বক্তৃতা করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুলজারিলাল নন্দ বামপন্থীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আক্রমণ চালিয়েছিলেন। তার জবাবে জ্যোতিবাবু বললেন - "কংগ্রেস নেতারা যা বলবেন, সেটাই হচ্ছে আইন। সেটাই আমাদের বিশ্বাস করতে হবে। কংগ্রেস নেতারা যদি বলেন যে, কেউ দেশদ্রোহী, তাহলে তিনি দেশদ্রোহী হবেন। সেটা সত্য কথা বলে ধরে নিতে হবে। এটা কী করে হতে পারে? শ্রীনন্দ বা শ্রীপ্রফুল্ল সেন একটি কথা বলবেন - ওঁরা তো কখনও আমাকে দেশপ্রেমিক বলতে পারেন না। কী করে বলবেন? আমরা তো ওঁদের বিরুদ্ধে। আমরা ওঁদের খতম করতে চাই, উৎখাত করতে চাই। ওঁরা উৎখাত না হলে, ওঁরা খতম না হলে দেশের মঙ্গল নেই বলে আমরা মনে করি। যারা এইসব কথা বলছে, তারা কী করে আমাদের দেশপ্রেমিক বলতে পারে? এটা সম্ভব নয়। আমরা যেমন ওদের দেশদ্রোহী মনে করছি, ওরাও আমাদের দেশদ্রোহী মনে করছে। কিন্তু তাতে আপনি বিনা বিচারে আটক করে রাখতে পারেন না। আমরা যদি কোনও অপরাধ করে থাকি, সরকার আছে আপনাদের হাতে, আদালত আছে, কোর্টে খাড়া করে দিন। দেখা যাক সেখানে কী হয়! জজরা তো সব কমিউনিস্ট হয়ে যাননি।"

বামপন্থী কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে গুলজারিলাল নন্দ লোকসভায় আরও কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বামপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি চিনা কমিউনিস্টদের কাছ থেকে, বিশেষ করে হংকং থেকে প্রচুর অর্থ পেয়েছে। বিধানসভায় সেই অভিযোগেরও জবাব দিলেন জ্যোতিবাবু। তিনি বললেন - "ওই যে অপদার্থ মিনিস্টার বসে আছেন এইখানে একজন, আর ওইখানে একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী - তাঁরা কী করছেন সেখানে? হংকং থেকে টাকা এসেছে আমাদের দেশের সব কিছু বানচাল করার জন্য? ওঁরা বলেন, চিন আমাদের শত্রু। সেখানে শত্রুর কাছ থেকে হংকং মারফত আমাদের কাছে টাকা আসছে। আমি জিজ্ঞাসা করি, এত বড় অপরাধ যেখানে হচ্ছে, সেখানে এই অপদার্থ লোকগুলো কী করছেন?"

"শ্রী নন্দ এবং প্রফুল্ল সেন কেন পদত্যাগ করছেন না? তাঁরা না দিচ্ছেন কোন প্রমাণ, অথচ এই কথা বলে যাচ্ছেন। যদি সত্যি কথা হয়, তাহলে এঁদের প্রথম চাকরি যাওয়া দরকার, তারপর আমাদের যা হয় হবে। ব্যাঙ্ক অফ চায়নার রিপোর্ট পাবলিশ করুন। দেখুন কার নাম আছে। যতীন চক্রবর্তী মহাশয় আপার হাউসে সেদিন তাঁদের নাম পড়ে দিয়েছেন। এঁদের বন্ধু, এঁদের পেট্রন। মিলিওনিয়ার্স, মাল্টি মিলিওনিয়ার্স, কোটিপতিদের  নাম সেখানে আছে, যারা ওভারড্রাফট পেয়ে থাকে। আমি বলছি না যে, ওভারড্রাফট পাওয়া অন্যায়। কিন্তু ওভারড্রাফট যারা পেয়েছে,এই সমস্ত লোকের নাম আছে - বলছেন যে, সিক্রেট রিপোর্ট, আমরা বার করব না।"
*********************************************************************
"সতীশ পাকড়াশির মতো লোক, যিনি ৩০ বছর জেল খেটেছেন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, তাঁকে কড়েয়া রোড থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল পুরুলিয়ায়। তাঁর উপর আর প্রতিহিংসা নিয়ে কী লাভ? অত বয়স যে মানুষের হয়েছে, তাঁর জুতোর শুকতলার যোগ্য নন আপনারা, যাঁরা তাঁকে ধরে নিয়ে গেলেন, ৩০ বছর যিনি জেল খেটেছেন ওইখানে - আমি মুখ্যমন্ত্রীকে এই বিশেষ কেসটা বলেছিলাম। কারণ আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে ফিরিয়ে এনে অন্য একটা জেলে রেখেছেন। কিন্তু এইরকম অনেকেই আছেন। এঁদের বিনা বিচারে গ্রেফতার, বিনা অজুহাতে গ্রেফতার, কোনও কারণ নেই, কোনও কারণ দর্শাতে পারছেন না, মিথ্যা কথা বলছেন তাঁদের সম্বন্ধে, একেবারে জলজ্যান্ত মিথ্যা কথা। আবার যদি জেলের ভিতরে এরকম ব্যবহার করেন, তাহলে কী মনে হয়?"
*********************************************************************
জ্যোতিবাবু তখন বললেন - "আজকে আমরা এটা বুঝতে পারলাম, কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকার একমত হয়ে বর্ডার সিল করেছেন। যাইহোক, চিফ মিনিস্টার এসব কথা বলে ভাল করেছেন। তিনি যে অজুহাত দিয়েছেন, সেই অজুহাতে তিনি বলেছেন যে, সব পঞ্চম বাহিনী ঢুকে যাবে। আমি যে সব দেখেছি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এবং যে সব বই, তাতে আছে যে, পঞ্চম বাহিনীর কাজ করার জন্য যারা আসে, তারা ট্রাভেল ডকুমেন্ট ছাড়া আসে না। আমি জানি না, আমাদের রাষ্ট্রে ওইরকম পঞ্চম বাহিনী নেই বলে কেন বলছেন। বাইরে থেকে, আমেরিকা, পাকিস্তান থেকে, এরকম বহু লোক যাঁরা আমাদের এখানে এসে সমস্ত খবর নিয়ে যায়, যা সব রাষ্ট্রে হয় যে ট্রাভেল ডকুমেন্ট ছাড়া পঞ্চম বাহিনীর লোক ঢোকে না। এটুকু যদি ১৮ বছর না শিখে থাকেন, তাহলে জানি না কবে শিখবেন। কাজেই এসব ফাঁকির কথা বলে লাভ নেই। সরকার ঠিক করেছেন যে, ওঁরা (উদ্বাস্তু) এলে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়বে, পূর্ব পাকিস্তানে নর্মাল অবস্থা হয়ে গেছে,কাজেই এখন আসার প্রয়োজন নেই।"
*********************************************************************
১৯৬৫ সালের ২ এপ্রিল উদ্বাস্তুদের বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য জ্যোতিবাবু একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তখন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন বললেন - "এই যে ৯ হাজার ফিরে এলেন, এঁরা কারা? এঁরা যদি সেখান থেকে সর্বস্বান্ত হয়ে এসে থাকেন ঘরবাড়ি ছেড়ে, জমিজমা ছেড়ে, সমস্ত কিছু পরিত্যাগ করে, তাহলে তাঁরা কেন আবার ফিরে গেলেন, একথাটা চিন্তা করতে হবে। সেখানে যদি এরকম হয় যে, তাদের সেখানে ধর্ম থাকবে না, ইজ্জত থাকবে না, কালচার থাকবে না, সেখানে বাস করা অসম্ভব - তাহলে এত লোক ফিরে যাচ্ছেন কেন? কাজেই কেন্দ্রীয় সরকারের মনে এরকম সন্দেহ হতে পারে যে, এই সমস্ত লোক যারা চলে গেল, তাদের বেলায় ভালভাবে স্ক্রুটিনি করতে হবে, চেক করতে হবে, যাকে তাকে আসতে দেওয়া চলবে না। একজন বললেন, পাকিস্তান থেকে যে সমস্ত চর আসে, তাদের আপনারা প্রশ্রয় দেন। এতবড় একটা অসত্য উক্তি আমরা কল্পনা করতে পারি না। এইরকম যাঁরা কল্পনা করেন, তাঁদের সম্বন্ধে আমাদের ধারণা অত্যন্ত নিচু - তাঁদের কথার উত্তর দেওয়া উচিত নয় এবং আমাদের কাছে তাদের কিছু দাবি করার অধিকারও নি। তাঁরা মনে করেন, আমরা খুব খারাপ লোক, আমরা দেশের শত্রু, আমরা দেশদ্রোহী।"

জ্যোতিবাবু তখন বললেন - "আমরা কতকগুলি জায়গায় দেখতে গিয়েছিলাম - বর্ডার দেখার জন্য। ওঁরা আমাদের বলেছিলেন যে, ওঁদের গোপনে চলে আসতে হয়। কারণ অসুবিধাটা হচ্ছে, জাঁকজমক করে ডকুমেন্টস নিয়ে যদি আসার ব্যবস্থা করতে হয়, তাহলে কিছু সমাজবিরোধী লোক আছে যারা বাধা দেয় এবং নানাভাবে অত্যাচার করে। এরই জন্য তাঁরা ভাবেন, ওসব দরকার নেই। কোনও দিন রাতের অন্ধকারে চলে যাব। নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন বলেই তো তাঁরা এসব করেন। এখন তাহলে এঁদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে পাকিস্তানে, তা নাহলে এখানে তাঁদের কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।"
*********************************************************************
সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অন্য রাজ্যের বিধায়কদের বেতন ও ভাতা বেশি ছিল। এমন-কি অসমের তুলনাতেও এখানে বিধায়কদের বেতন ও ভাতা কম ছিল। তা সত্ত্বেও জ্যোতিবাবু বিলের বিরোধিতা করে বললেন - "আমরা এখানে আইন রচনা করি, আমাদের কাছে মানুষ অনেক কিছু আশা করেন। এই অবস্থার মধ্যে আমরা তাঁদের কিছু করতে পারলাম না, সরকারপক্ষ থেকে কিছু করলেন না - আমরা অ্যাসেম্বলিতে আর বেশিদিন নেই, দু'বছর। এর মধ্যে আমরা এসে আমাদের ভাতাটা বাড়িয়ে নিয়ে চলে গেলাম, বাকি অন্যদের ৫ টাকা - ২ টাকা বাড়ল - আমরা ৫০ টাকা বাড়িয়ে নিয়ে চলে গেলাম, প্রয়োজন যতই হক, এটা অশোভন, অন্যায় হয়। তারপরও যদি বেতন বৃদ্ধি হয়, তাতে আমাদের কিছু সুবিধা নেই। কারণ আমাদের বাড়তি টাকাটা সমস্ত পার্টিতে আসবে - এখন হংকং থেকে যখন পাচ্ছি না, তখন সরকারের তহবিল থেকে টাকা পেলে আমাদের কাজের সুবিধা হয়। কিন্তু তথাপি ওটা আমাদের বিরোধিতা করতে হচ্ছে যে, কারণ এই প্রস্তাবটি একেবারে সময়োপযোগী হয়নি।"
*********************************************************************
'৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসেও যখন জ্যোতিবাবু অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করছেন, তখন কংগ্রেস বেঞ্চ থেকে ব্যাপক হট্টগোল শুরু হয়। সেই গোলমাল উপেক্ষা করেই তিনি বক্তৃতা শুরু করে দেন। এই সময় মুখ্যমন্ত্রী সভাকক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যান। জ্যোতিবাবু তখন বলে উঠলেন - "আমি জানতে চাই, পালের গোদাটা বেরিয়ে গেলেন কেন? ওঁকে ডেকে আনুন। এখানে কাউন্সিল অফ মিনিস্টারদের যিনি হেড, মুখ্যমন্ত্রী, তিনি এই অনাস্থা প্রস্তাবের আগেই বেরিয়ে গেলেন, এটা কী করে হবে? এগুলো তো ভালো নয়।"

জ্যোতিবাবু একই কথা বলতেই থাকলেন - "মুখ্যমন্ত্রী, যিনি এই পালের গোদা, তাঁর এখানে থাকা উচিত ছিল এই অনাস্থা প্রস্তাব আলোচনার সময়। কিন্তু তিনি পালিয়ে গেলেন। তিনি কোথায় চলে গেলেন? হি ইজ দ্য লিডার ..."

ডেপুটি স্পিকার তখন বললেন - "তিনি তাঁর ঘরে বসে শুনবেন।"

কিন্তু সেই জবাব জ্যোতিবাবুকে সন্তুষ্ট করতে পারল না। তিনি বললেন - "তিনি যদি ঘরে বসে শোনেন, তাহলে আমরা কি সব ঘরে বসে আলোচনা করব? অবশ্য এটা আমি বুঝতে পারি, যাঁদের জনগণের কাছ থেকে পালিয়ে গুণ্ডা এবং পুলিশ বাহিনীর আশ্রয়ে থাকতে হয়েছে, আমাদের এই সব বক্তব্য শুনতে তাঁদের একটু অসুবিধা হবে, এ বিষয়ে আমরা নিঃসন্দেহ। তাই পালের গোদাটি এখান থেকে চলে গেলেন।"
*********************************************************************
সংসদীয় গণতন্ত্রকে কমিউনিস্টরা তাঁদের মূল লক্ষ্যে পৌঁছানোর মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল কেন, পরিষদীয় রাজনীতির গোড়ায় জ্যোতিবাবুর বক্তৃতা থেকে তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যেত। এখন সেই লক্ষ্য হয়ত অনেকটাই অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। সংসদীয় রাজনীতির গোলকধাঁধায় শ্রেণী সংগ্রামের পথের ব্যবহারও এখন অনেকটা সংশয়াচ্ছন্ন। বিশ্বায়নের দাপটে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর পথ আরও অনেক বেশি পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু গোড়াতে তো সেরকম ছিল না। তখন বিধানসভার যে কোনও বক্তৃতাতেই জ্যোতিবাবু মানুষের রাজনৈতিক অধিকারের কথা, কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক লক্ষ্যের কথা সরবে উচ্চারণ করেছেন। যেমন অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় তিনি বললেন - "আমরা বাংলার জনসাধারণকে বলেছি গঠনমূলক কথা যে, আমূল পরিবর্তন যদি মানুষের জীবনে আনতে হয়, তাহলে এই সরকারকে নির্মূল করতে হবে - এছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। এই সব সাধারণ মানুষ, কৃষক-শ্রমিকমধ্যবিত্ত, তাঁরা ১৯ বছর ধরে আবেদন-নিবেদন এই সরকারের কাছে করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতায় এটা জেনেছেন যে, এই সরকার দেশি-বিদেশি একচেটিয়া পুঁজিপতি ও বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পদলেহন করে চলেছে। আমাদের দেশের অগণিত মানুষের এখন এমনই অবস্থা হয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, একটা যুদ্ধবিগ্রহ হলে এখানকার সেকেণ্ড ক্লাস সিটিজেনে যারা পরিণত হয়েছে, সেই মুসলমান ভাইদের বিনা বিচারে গ্রেফতার করে রাখা হয়েছে। কারণ ওঁরা বললেন, পাকিস্তানে  গ্রেফতার হয়েছেন, সেইজন্য আমাদের পশ্চিমবাংলায় মুসলমান গ্রেফতার করতে হবে।"

জ্যোতিবাবু একথা বলা মাত্রই কংগ্রেসের সদস্যরা ব্যাপক গোলমাল শুরু করলেন। কিন্তু তাতে ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি বলেই চললেন - "তারা আমাদের মতো এখানকার নাগরিক। তিন হাজার মানুষকে বিনা বিচারে কোনও প্রমাণ ছাড়া কারাবরণ করালেন। এর জবাব কে দেবে আমাদের? মুখ্যমন্ত্রী এর জবাব দেবেন না। মুসলমানরা এ জিনিস বুঝেছেন। এটা কতবড় লজ্জার কথা। ওটা পাকিস্তানে হতে পারে, কারণ পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়করা বলেন যে, ওটা মুসলিম রাষ্ট্র। কিন্তু আমাদের এখানে কী করে এ জিনিস হয়?"
*********************************************************************
ট্রাম কোম্পানি অধিগ্রহনের ঘটনা, সেই সময়ে বাম রাজনৈতিক মহলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল। কারণ এই ট্রাম কোম্পানিকে ঘিরে বাম ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের অনেক ঐতিহ্য জড়িত ছিল। ১৯২৯ সালে সাইমন্স কমিশন যখন ভারতে এসেছিল, তখন অন্য অনেকের মতো কলকাতার ট্রাম শ্রমিকরাও সেই কমিশনের বিরুদ্ধে হরতাল ডেকেছিলেন। এবং সেই হরতাল ডাকার জন্য বিলাতি ট্রাম কোম্পানি একদিনে ৫০ শ্রমিককে ছাঁটাই করে দেয়। ভারতে তখন ব্রিটিশদের শাসন বলে ট্রাম কোম্পানির সেইসব ছাঁটাই শ্রমিক অন্য কোনও কারখানায় কাজ পাননি। সেই শ্রমিকদের অনেকেই পরে অনাহারে তিলে তিলে মারা গিয়েছেন। ট্রাম শ্রমিকদের আন্দোলন কিন্তু স্তিমিত হয়নি। বিদেশী নিয়ন্ত্রণ থেকে ট্রাম কোম্পানির মুক্তির দাবিতে তাঁদের আন্দোলন বরং আরও জোরদার হয়ে উঠেছিল। তারপর চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতা কর্পোরেশনের সামনে ট্রাম কোম্পানিকে কিনে নেওয়ার একটা সুযোগ আসে। সেইসময় কলকাতা কর্পোরেশনের সব কাউন্সিলাররা মিলিত ভাবে ট্রাম কোম্পানি কিনে নেওয়ার দাবি জানান। তার জন্য সরকারের কাছে ডিবেঞ্চার ছেড়ে টাকা যোগাড় করার অনুমতি চাওয়া হয়। কিন্তু তৎকালীন মুসলিম লিগ সরকার কলকাতা কর্পোরেশনকে সেই অনুমতি দেয়নি। তার পরের ঘটনা তো ইতিহাস।  
*********************************************************************
এই নির্বাচনে আবার যুক্তফ্রন্টে সামিল হওয়ার জন্য সি পি আই (এম)-কে বামপন্থী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, যে সব দল সমাজতন্ত্রের আদর্শ বা বিপ্লবের তত্ত্বে বিশ্বাস করে না, সেইসব দলের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা করতে সি পি আই (এম) এত আগ্রহী কেন। সি পি আই (এম)-এর এই সিদ্ধান্তকে তখন অনেকে সুবিধাবাদী বলে চিহ্নিত করেছিল। সেইসব সমালোচনার জবাবে সি পি আই (এম) তখন বলল -

(১) যেসব দল কংগ্রেস শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার ব্যাপারে নূন্যতম কর্মসূচির ভিত্তিতে সি পি আই (এম)-কে সাহায্য করতে প্রস্তুত, তাদের সঙ্গেই সি পি আই (এম) নির্বাচনী সমঝোতা করবে।

(২) সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের নীতি মেনে নেওয়ার জন্য সি পি আই (এম) ওই দলের উপর চাপ দিতে চায় না। আবার বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন কোনও মাপকাঠিতেই সি পি আই (এম) ওই সব দলের গণতান্ত্রিক চরিত্র বিচার করে না।

(৩) সি পি আই (এম) দেখে - শাসক কংগ্রেস দলের নীতি সম্পর্কে ওই সব দলের মনোভাব কীরকম, সি পি আই (এম)-এর সঙ্গে মৈত্রী গড়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে তারা কতটা আগ্রহী এবং নূন্যতম কর্মসূচি কার্যকর করার ব্যাপারে তাঁদের মনোভাব কেমন।
*********************************************************************
ছাঁটাই সম্পর্কে সরকারের মনোভাব ব্যাখ্যা করে তিনি বললেন, ছাঁটাই যাতে না-হয়, সবসময় সেভাবেই তাঁরা চিন্তা করবেন। জ্যোতিবাবুর বক্তব্য ছিল - "অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার জন্য ২০ বছরের কংগ্রেস সরকারই দায়ী। আর্থিক অচলাবস্থার দায়িত্ব দেখো পুরোপুরি শ্রমিকদের কাঁধে চাপালে চলবে কেন? অথচ সেরকম চেষ্টাই চলছে। শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকার ছেড়ে দিতে হবে - এরকম অবস্থা আমরা কিছুতেই মেনে নেব না। শ্রমিকরা কখনই ধর্মঘটের অধিকার ছেড়ে দিতে পারেন না। ধর্মঘটই শ্রমিকদের শেষ হাতিয়ার। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি যাতে মেনে নেওয়া হয়, যুক্তফ্রন্ট সবসময়ই সেদিকে নজর রাখবে। কোনও দাবি ন্যায্য কিনা, তা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিতে পারে। তাহলেও আলোচনার মাধ্যমে সেই মতপার্থক্য দূর করা যায়।"
*********************************************************************
অন্যদিকে, রাজ্যপাল পদে ধর্মবীরের থাকার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সংঘাত বেড়ে চলছিল। কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়ে দিলেন, বিধানসভার অধিবেশনের আগে রাজ্যপালকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে না। জ্যোতিবাবু তখন বললেন - "যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা  রাজ্যপালের একের অপরের উপর বিশ্বাস নেই। এই বিশ্বাস না-থাকলে কাজ চলে না। তাঁকে যেতেই হবে। ধর্মবীরের চলে যেতে ১০-১৫ দিন সময় লাগলেও লাগতে পারে। তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার যে সুরে কথা বলছেন, তা ভাল নয়। এতেই প্রচণ্ড আপত্তি আছে। এতে মনে হয়, কেন্দ্রীয় সরকার সহযোগিতা চান না।" ৬ মার্চ বিধানসভার অধিবেশনে এক নতুন নজির সৃষ্টি হল। ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে সেইদিনই প্রথম একজন রাজ্যপাল মন্ত্রিসভা যে ভাষণ তৈরি করে দিয়েছিল, তার একটি প্রধান অংশ বাদ দিলেন। রাজ্যপাল সরকারের তৈরি করে দেওয়া ভাষণের ৫৩৫টি শব্দ বাদ দিলে সরকার পক্ষের বিধায়করা 'ধর্মবীর ফিরে যাও' স্লোগান দিতে থাকেন। বিধানসভায় ধন্যবাদজ্ঞাপক প্রস্তাবের পাশাপাশি রাজ্যপালের নিন্দাও করা হয়। 
*********************************************************************
জোতদার-বর্গাদারদের মধ্যে সংঘাতের আঁচ চলে এল বিধানসভায়। ভূমি-সংস্কার সংশোধনী বিল নিয়ে আলোচনায় হরেকৃষ্ণ কোঙার বললেন - "আমি একথা যুক্তফ্রন্ট সরকারের পক্ষ থেকে বলতে চাই, একদিকে জোতদার, আর একদিকে বর্গাদার - উভয়কে আমরা সমান চোখে দেখি না। আমি মনে করি, বর্গাদাররা দুর্বল, তারা গরীব। তাদের রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য, অত্যন্ত পবিত্র কর্তব্য। সেই কর্তব্য আমরা পালন করব। তাদের সেই অধিকার ও কর্তব্য করতে গিয়ে আমরা ছোটো ছোটো মালিকের ন্যায়-সঙ্গত অধিকারের কথাও নিশ্চয়ই বিবেচনা করব। কিন্তু বড় বড় জোতদারের প্রতি আমাদের কোনও দরদ নেই।"

বিল নিয়ে আলোচনার সময় বিরোধী পক্ষ বলেছিল, এই আইনের ফলে শ্রেণী সংগ্রাম বেড়ে চলবে। সরকার পক্ষ বললেন, না, এর ফলে কোনও শ্রেণীসংগ্রাম বাড়বে না। যে শ্রেণীসংগ্রাম আছে, যা সেখানে চলছে, সেই শ্রেণীসংগ্রামে কংগ্রেস সরকার এতদিন ধনীদের সাহায্য করেছেন, তাঁরা গরীব চাষীদের এতদিন পিটিয়েছেন। আমরা সেই গরীব চাষীদের হাত-পা সুদৃঢ় করতে চাই, সেই দুর্বল, গরীব চাষীদের পাশে আমরা সরকারি যন্ত্র নিয়ে দাঁড়াতে চাই।"

বিরোধীরা তখন বলেছিলেন, যা কিছুই হোক, আইনসঙ্গত ভাবে হোক। তার জবাবে হরেকৃষ্ণ কোঙার স্পষ্ট বললেন - "আইনসঙ্গত ভাবে যদি করতে যাই, তাতে অনেক অসুবিধা আছে। আইনসঙ্গত ভাবে সব কিছু করতে পারছি না, যতক্ষণ না ভূমি-সংস্কার আইন পরিপূর্ণভাবে সংশোধন করতে পারছি। তবে এও আমরা জানি, সবই আইনের মাধ্যমে সংশোধন করতে পারা যায় না। যাদের টাকা আছে, তারা কোর্টকাছারিতে গিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে পারবে, দলিল দেখাতে পারবে। আইনের পথটা কোথায়? তাঁরা যে আইন করলেন, সেই আইনের ফাঁক দিয়ে হাজার হাজার বিঘা জমি বেরিয়ে গেল। এই আইনের ফাঁক দিয়েই হাজার হাজার বিঘা জমি তারা চুরি করতে পারবে এবং হাজার হাজার টাকা ফি দিয়ে সিদ্ধার্থবাবুর মতো ব্যারিস্টার রাখতে পারবে। কী করতে পারবে গরীব চাষী, দুর্বল চাষী? তাদের সামর্থ্য কোথায়? আমরা জানি, গরীব কৃষক যদি সংগঠিত না হয়, আমাদের পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে আমরা একা গভর্নমেন্ট তাদের রক্ষা করতে পারব না। আমরা তাদের উৎসাহ দেব এবং উৎসাহ দিয়েই যাব। এতে কেউ কেউ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। আমরা এতে আতঙ্কিত নই। ওঁরা যখন গাল দেন, তখন আমরা মনে করি, আমরা সঠিক পথে চলছি। আর জোতদারদের বন্ধুরা যদি আমাদের সমর্থন করেন, তখন বুঝতে হবে, আমাদের কোনও পদস্খলন হচ্ছে।"
*********************************************************************
আরও একটি নির্বাচন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল পশ্চিমবঙ্গে। নির্বাচনের আগে রক্তাক্ত হয়ে উঠল গোটা রাজ্য। '৭১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর স্ট্রিটে আততায়ীর ছুরিকাঘাতে নিহত হলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের চেয়ারম্যান ও জননেতা হেমন্ত বসু। খুনীর আচমকা আক্রমণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় পর্যন্ত তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। অজাতশত্রু ওই নেতার মুখ থেকে অস্পষ্টভাবে শোনা গিয়েছিল - "আমায় খুন করে তোমাদের কী লাভ? কেন আমায় মারছো?"
*********************************************************************
অজয় মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন এই কোয়ালিশন সরকার অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হল না। কোয়ালিশনের শরিকদের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত তীব্র হয়ে উঠল। তাদের দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি অনুযায়ী ওই ধরনের কোয়ালিশনে ফরওয়ার্ড ব্লকের খাপ খাওয়ার কথা ছিল না। তারা কি শুধুই তীব্র সি পি আই (এম)-বিরোধিতার জন্য ওই কোয়ালিশনে যোগ দিয়েছিল, না স্পিকার পদের আকর্ষণে - তা ছিল দীর্ঘ গবেষণার বিষয়। বাজেট অধিবেশনে শাসক কোয়ালিশনের সংকট তীব্র হয়ে উঠল। কংগ্রেস নিশ্চিত হয়ে গেল যে, বাজেট অধিবেশনেই তারা গরিষ্ঠতা হারাবে। ফলে তড়িঘড়ি বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করা হল। সি পি আই (এম)-এর নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটকে সরকার গড়ার কোনও সুযোগ না দিয়ে ২৫ জুন রাতে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভেঙে দেওয়া হল। আবার  রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হল রাজ্যে। তখন রাজ্যপাল ছিলেন এস এস ধাওয়ান। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকার কেন্দ্রের শিক্ষামন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে দফতর-বিহীন মন্ত্রী হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে পাঠাল। সিদ্ধার্থবাবু অনেকদিন থেকেই এই রাজ্যের রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। এক সময় তিনি বামপন্থীদের সঙ্গেও ছিলেন। ফলে সি পি আই (এম)-এর মোকাবিলা করার জন্য ইন্দিরা গান্ধীর তাঁকেই পছন্দ হল। রাজ্যে অবশ্য খুনোখুনির রাজনীতি অব্যাহত ছিল। '৭১ সালের অগস্ট মাসে কাশিপুরে গণহত্যার ঘটে তার মধ্যে সব থেকে চাঞ্চল্যকর। রাজনৈতিক দল এবং পুলিশের মিলিত সন্ত্রাস যে কতদূর ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে, কাশীপুরের ঘটনাই ছিল তার প্রমাণ। 
*********************************************************************
অবশেষে এল ১৯৭২ সালের নির্বাচন। ১১ মার্চ পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন ঘোষিত হল। নির্বাচনের আগে সি পি আই (এম)-এর নেতৃত্বে বামপন্থীরা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে ১১ দফা দাবি সনদ পেশ করলেন। কিন্তু সন্ত্রাস অব্যাহত রইল। ভোটের দিন সকাল থেকেই কংগ্রেস কর্মী এবং পুলিশের মিলিত ব্যবস্থায় সি পি আই (এম) সহ অন্যান্য বামপন্থী দল কোণঠাসা হয়ে পড়ল। জ্যোতিবাবুর নির্বাচনী কেন্দ্র বরাহনগরে ভোট শুরু হওয়ার আগেই অর্ধেকের বেশি বুথ থেকে পোলিং এজেন্টদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ ও কংগ্রেস কর্মীদের সম্মিলিত সন্ত্রাসের মোকাবিলা করতে পারল না সি পি আই (এম)। সকাল থেকেই প্রায় সব জেলা থেকেই বুথ দখলের খবর আসতে শুরু করল। ১৩ মার্চ সন্ধ্যায় সি পি আই (এম) গণনা কেন্দ্রে কাউন্টিং এজেন্ট পাঠাবে না বলে ঠিক করল।

ভোটের ফলে সি পি আই (এম)-এর আশঙ্কাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। কংগ্রেস এককভাবে ২১৬টি আসন দখল করল। সি পি আই পেল ৩৫টি আসন, সি পি আই (এম) পেল ১৪টি। সি পি আই প্রার্থী শিবপদ ভট্টাচার্যের কাছে প্রায় ৩৯ হাজার ভোটে হেরে গেলেন জ্যোতিবাবু। ২৫ বছর ধরে যিনি ধারাবাহিকভাবে বিধানসভায় প্রভাবশালী নেতা হিসাবে নিজের স্টাইলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সেই জ্যোতিবাবুর পরাজয় ছিল সেবারের ভোটের ফলে সব থেকে চাঞ্চল্যকর ঘটনা। সি পি আই (এম) অবশ্য এই ফলে অবাক হয়নি।

১৮ মার্চ বামপন্থী ফ্রন্ট সিদ্ধান্ত নিল, তারা বিধানসভা বয়কট করবে। যৌথ বিবৃতিতে বামপন্থী নেতারা বললেন - "এই নির্বাচন ছিল পুরোপুরি জালিয়াতির উপর সাজানো। শাসকদল, প্রশাসন ও পুলিশ যে হরেকরকম জালিয়াতির শরণ নিয়েছিল, তার আরও অনেক অকাট্য প্রমাণ আমাদের হাতে এসেছে।

"এই পরিস্থিতিতে এই সাজানো আইনসভা বয়কট করে প্রতিবাদ জানানো ছাড়া আমাদের সামনে অন্য কোনও পথ নেই।"
*********************************************************************
৫ জুন ব্রিগেডের সমাবেশে অবশ্য জ্যোতিবাবু বসেছিলেন জয়প্রকাশের পাশেই। সেই সমাবেশের বক্তৃতায় জয়প্রকাশ '৭২-এর নির্বাচনের সন্ত্রাসের কথা উল্লেখ করলেন। তিনি বললেন - "এই শাসন ব্যবস্থা বদল না করে গনতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাওয়া যাবে না। ভোটের মাধ্যমেও এই অবস্থা বদলানো যাবে না। গতবার জ্যোতিবাবুর কেন্দ্রে সকাল ১০ টার মধ্যেই ভোট শেষ হয়ে গিয়েছিল। প্রফুল্লবাবু (সেন) এবং অন্য নেতারা রয়েছেন। তাঁরা তো জানেন, ভোটের নামে এখানে কী হয়েছিল! মুষ্টিমেয় লোক বোমা-পিস্তল হাতে বুথ দখল করে ভোটকে প্রহসনে পরিণত করবে - এটা সহ্য করা বাংলার যুব শক্তির পক্ষে লজ্জার কথা।" সেদিনের সভায় জয়প্রকাশই ছিলেন একমাত্র বক্তা। সভায় সেদিন কোনও দলের কোনও পতাকাই দেখা যায়নি।
*********************************************************************

Thursday, 11 January 2024

ইসলাম ও পরধর্ম - কঙ্কর সিংহ

কোরানে মোট সুরা বা পরিচ্ছেদের সংখ্যা ১১৪। মোট আয়াত বা বাক্যের সংখ্যা ৬৬৬৬।

*********************************************************

ইসলাম, কোরান এবং হাদীস

ওসমানের সংকলিত কোরানে সুরা এবং আয়াতসমূহকে অবতীর্ণ হওয়ার কালক্রম অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে সংকলিত করা হয়নি। মাওলা আলীর নিজের হাতে লেখা কোরানে নাকি এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু খেলাফতের সংকলিত কোরানে আয়াতসমূহের অবতরণের সময়কাল ধরে কেন ধারাবাহিকভাবে সংকলিত না করে সম্পাদনা করে সংকলিত করা হল তার কোনও উত্তর আমাদের জানা নেই। এই ব্যাপারে রসুল মোহাম্মদের কোনও নির্দেশ ছিল বলেও জানা যায় না। ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষকরা এই প্রশ্নের উত্তর সযত্নে এড়িয়ে গেছেন বলেই মনে হয়। তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান রাষ্ট্রীয়ভাবে কোরান সংকলনের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা সুষ্ঠু ও নির্ভুলভাবে কোরানকে রক্ষা করার জন্যে। কিন্তু তাতে এত ফাঁক কেন থেকে গেল তা নিয়েও গবেষণা কম হয়নি। শেষপর্যন্ত কোরানের রাষ্ট্রীয় সংকলনকে মুসলিম বিশ্ব মেনে নিয়েছে। সুরা আলাক থেকেই ওহীর সূচনা। অথচ প্রথম অবতীর্ণ সুরা আলাক সংকলিত কোরানের ৯৬তম সুরা। সুরা আলাক যে প্রথম ওহী তার উল্লেখ রয়েছে সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য হাদীসে। প্রথম ওহী কেন কোরানে প্রথম সুরার মর্যাদা পেল না - তাকে স্থানান্তরিত করা হল কোরানের একেবারে শেষদিকে তার কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। রসুলের মৃত্যুর নয়দিন পূর্বে শেষ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল। শেষ ওহীর অবতরণের কাল নিয়েও অবশ্য মতভেদ রয়েছে। শেষ আয়াত সংকলিত রয়েছে সুরা তাওবায়। যা সংকলিত কোরানের নবম সুরা। সুরা তাওবা শেষ সুরা কিনা তা নিয়েও ইসলামী পণ্ডিতরা একমত নন। কোরানের সংকলিত সুরা এবং আয়াতের এই যে বিন্যাস তা নিয়ে ওহীর ধারক মোহাম্মদের কোনও নির্দেশ ছিল বলে জানা যায় না।
*************************
আল্লাহ নিজেই কোরান সংরক্ষণ করবেন, সেকথাও স্পষ্টভাবে বলেছেন,

নিশ্চয়ই আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষণ করব। - সুরা হিজর, ১৫/৯

আল্লাহ যখন নিজেই কোরান সংরক্ষণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তখন তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমানের শাসনকালে কোরান সংকলন এবং সংরক্ষণ নিয়ে এতকিছু করতে হল কেন? এই সব প্রশ্ন তোলার কোনও অবকাশ নেই ইসলামে।
*************************
সহীহ হাদীস সংগ্রহ এবং সংকলনের কাজ শুরু হয়েছিল ইমাম আবু হানিফার মৃত্যুর পর (৭৬৮ খ্রি:) এবং শেষ হয়েছে আব্বাসীয় রাজবংশের খেলাফতের সময়ে, তাদের ইচ্ছা এবং অর্থপ্রদানে। এই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক টয়েনবি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'Study of History'তে মন্তব্য করেছেন,


মনমতো শাস্ত্র রচনা করিয়ে নিতে উমাইয়া বা আব্বাসীয় রাজপুরুষগণ কেউ পিছপা ছিল না। তারা এই ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিল যে, হজরতের হাদীস অনুযায়ী জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করবে। তাই মদীনা থেকে তারা শাস্ত্রকারদের নিয়ে আসে বাগদাদে। প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেদের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে ইসলামকে ব্যবহার করেছিল। আর ওই শাস্ত্রকারদের পোষও মানিয়েছিল।

খেলাফত যখন বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল, সেই রাজতান্ত্রিক পদ্ধতির কারণেই ক্ষমতাসীন খলিফা বা বাদশাহের সিংহাসনপ্রীতি প্রবল হয়ে ওঠে। সেই সিংহাসন রক্ষার জন্য বাদশাহ-খলিফাদের ধর্মকে ব্যবহার করতে হয়েছে তাদের কীর্তি ও অপকীর্তিকে সমর্থন যোগানের জন্যে। তাই এই অপকীর্তিকে জায়েজ করার জন্যে হাদীস সংকলনের সূচনা এবং একেই উদ্দেশ্য করে ধর্মীয় সাহিত্য ও পাণ্ডিত্যের অনুসরণ।

The forging of traditions soon became a legitimate literary pursuit, indeed a hallmark of piety and scholarship.

ঠিক এই অবস্থাতে ছয়জন ইমাম এগিয়ে এলেন, "to restore some semblance of order to the existing state of intellectual and moral anarchy." এই ছয় ইমাম সাহেবকে তাই হারকিউনিয়ন প্রকৃতির কাজে ব্যাপৃত হয়ে পড়তে হয় রাজনৈতিক কারণে, যার ফলশ্রুতিতে নিম্নলিখিত 'গুরুভার' ধর্মের অবলম্বন স্বরূপ প্রকাশ পেয়েছে।

১। ইমাম বোখারী (মৃ. ৮৭৫) ৬০০,০০০ লাখ হাদীস সংগ্রহ করে রাখলেন মাত্র ৭৩০০ (পুনরাবৃত্তি বাদ দিলে সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭৬২)।
২। ইমাম মুসলিম (মৃ. ৮৭৬) ৩০০,০০০ লাখ হাদীস সংগ্রহ করে রাখলেন মাত্র ৪৩৪৮।
৩।  ইমাম তিরমিজি (মৃ. ৮৯৪) ৩০০,০০০ লাখ হাদীস সংগ্রহ করে রাখলেন মাত্র ৩১১৫।
৪। ইমাম আবু দাউদ (মৃ. ৮৯০) ৫০০,০০০ লাখ হাদীস সংগ্রহ করে রাখলেন মাত্র ৪৮০০।
৫। ইমাম ইবনে মাজা (মৃ. ৮৯০) ৪০০,০০০ লাখ হাদীস সংগ্রহ করে রাখলেন মাত্র ৪০০০।
৬। ইমাম নাসাঈ (মৃ. ৯১৭) ২০০,০০০ লাখ হাদীস সংগ্রহ করে রাখলেন মাত্র ৪৩২১।

রসুল মোহাম্মদের মৃত্যুর (৮ জুন, ৬৩২ খ্রি) সুদীর্ঘকাল পরে কেন এইসব হাদীস সংকলন করতে হয়েছিল তা নিয়ে ইসলামী পণ্ডিত ও গবেষকদের মধ্যে যে বিতর্ক তা এখনো শেষ হয়নি। ৬ জন ইমাম অক্লান্ত পরিশ্রমে সংগ্রহ করেছিলেন ২৩ লক্ষ হাদীস। যার মধ্যে ৯৮% বাদ দিয়েছিলেন অসত্য বলে। ছয় ইমামের হাদীসের সংখ্যা মাত্র ২৩৩৪৬ (পুনরাবৃত্তি বাদে)। এইসব সহীহ হাদীস নিয়েও সংশয় দূর হয়নি ইসলামী চিন্তাবিদদের।
*************************
কোরান-হাদীসের ব্যাখ্যা নিয়ে ইসলামের মূল দুই ভাগ - শিয়া ও সুন্নীদের মধ্যে বিতর্ক ইসলামের প্রাথমিককাল থেকেই। এই বিতর্ক থেকেই ইসলামী বিধি-বিধান নিয়ে সাতটি মজহব বা আইনের স্কুল জন্ম নিয়েছে। তারমধ্যে চারটি হল সুন্নীদের, তিনটি শিয়াদের । সুন্নীদের মজহবগুলি হল হানাফী, মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্বেলী। 
*************************
কোরান ইসলাম ছাড়া অন্যসব ধর্মের ধর্মপুস্তকেই বাতিল বলে রায় দেয়। ইহুদী, খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্বে অনেকটাই মিল আছে। এই তিনধর্মের তিন ধর্মগ্রন্থ তৌরাত, ইঞ্জিল ও কোরানে বলা হয়েছে মানুষ একই আদি মাতা-পিতার বংশধর। কোরানে ইহুদীধর্মের প্রবর্তক হজরত মুসা এবং খিস্ট্রধর্মের প্রবর্তক হজরত ইসাকে (খ্রিস্টানরা যাঁকে বলেন যীশু) নবীর মর্যাদা দান করা হয়েছে। কোরানে অনেকবার বলা হয়েছে মুসা ও ইসা নবীর কথা। মুসা এবং ইসাকে কিতাবদান করেছিলেন আল্লাহ - তৌরাত এবং ইঞ্জিল। তৌরাত অবতীর্ণ হয়েছিল হিব্রু ভাষায় আর ইঞ্জিল গ্রীকভাষায়। এই দুটি ভাষা ছিল মুসা এবং ইসার মাতৃভাষা। একইভাবে কোরান যখন সৃষ্টি করা হল, তা অবতীর্ণ করা হল আরবি ভাষায়। মোহাম্মদের মাতৃভাষায়।

আমি তোমার (মোহাম্মদের) ভাষায় কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি যাতে মানুষ উপদেশ গ্রহণ করে। -- সুরা দোখান, ৪৪/৫৮

আরবি কোনও পবিত্র ভাষা নয়। আল্লাহর নিজস্ব ভাষাও নয়। আল্লাহর যদি নিজের কোনও সুনির্দিষ্ট ভাষা থাকত তাহলে আল্লাহ তৌরাত ও ইঞ্জিলকে সেই ভাষাতেই, অর্থাৎ আরবি ভাষাতে অবতীর্ণ করতেন।

***********************************************************

কোরান এবং আল্লাহর সার্বভৌমত্ব

ইসলাম মৌলবাদী ধর্ম। ইসলাম যুগ, কাল ও সময়ের পরিবর্তনের সাথে সংগতি রেখে ধর্মের কোনও আনুষাংকিতারও পরিবর্তন স্বীকার করে না। সেই পরিবর্তন যথাস্থানে যথাবিহিত হলেও। মূলের প্রতি শতকরা একশত ভাগ অনুগত থাকাই হল ইসলাম ধর্মের প্রথম এবং শেষ কথা। ইসলাম মনে করে এই ধর্ম ছাড়া অন্য কোনও মতে ও পথে মানুষের মুক্তি আসতে পারে না। মহান বিশ্বে সত্য রয়েছে মাত্র একটি ধর্মে। সেই ধর্ম হল ইসলাম। নিখিল বিশ্বে যা কিছু সৃষ্টি সব আল্লাহর। আল্লাই সৃষ্টি করেছেন মানুষকে এবং মানবশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদকে। আল্লাহ মর্ত্যভূমিকে দান করেছেন 'আলো' এবং 'কিতাব'। সেই আলো হল রসুল মোহাম্মদ আর কিতাব হল কোরান। মুসলমানদের একমাত্র আদর্শ হল মোহাম্মদ। আল্লাহর কোরানের বাইরে অন্য কোনও পথ নেই মানুষের সামনে। মোহাম্মদ সমগ্র কোরান তাঁর জীবনে প্রয়োগ করেছেন। তাই মোহাম্মদ এবং কোরান অভিন্ন। তাই বিনা বিতর্কে, চোখ বন্ধ করে কোরান এবং মোহাম্মদকে গ্রহণ করতে হবে সমগ্রভাবে। আল্লাহর তাই স্পষ্ট নির্দেশ :

আল্লাহ ও তাঁর রসুল কোন বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোন বিশ্বাসী পুরুষ কিংবা বিশ্বাসী নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না। কেউ আল্লাহ এবং তাঁর রসুলকে অমান্য করলে সে তো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে। - সুরা আযাব, ৩৩/৩৬

***********************************************************

কোরান, ইসলাম এবং মূর্তিপূজারী

মোহাম্মদের জন্মের কালে আরবভূমিতে যেমন ইহুদী ও খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা ছিলেন, তেমন ছিলেন মূর্তিপূজারীরা। মোহাম্মদের জন্ম মক্কার যে কোরেশ বংশে তারা ছিলেন মূর্তি উপাসক। কাবাশরীফ ছিল তাদের উপাসনালয়। পিতৃধর্ম অনুযায়ী মোহাম্মদও ছিলেন মূর্তি উপাসক। আল্লাহর ওহী লাভ করে তিনি পিতৃধর্ম ধ্বংস করেছিলেন। মোহাম্মদের প্রবর্তিত ধর্মে অহিংসার কোন স্থান ছিল না। ইসলাম ধর্মের দিক থেকে সহাবস্থান স্বীকার করে না। কোনও ধর্মের সাথেই নয়। ইসলামের ভ্রাতৃপ্রতিম অপর যে দুই ধর্ম, ইহুদী ও খ্রিস্ট তাদের সাথেও নয়। মুসলমানদের বিশ্বাস বিশ্বের সব মানুষ একদিন ইসলামের পতাকার নিচে আশ্রয় নেবে।

ইসলামের সবচেয়ে বড় বিরোধ মূর্তি উপাসনার সাথে। কোরানে আরবের মূর্তি উপাসকদের বলা হয়েছে অবিশ্বাসী। সেই অবিশ্বাসীদের ইসলামের আশ্রয়ে নিয়ে এসে পৌত্তলিকতা নির্মূল করাই হল ইসলাম-বিশ্বাসীদের পবিত্র দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পাল করার জন্যে মুসলমানরা আল্লাহর কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কোরানে বলা হয়েছে পৃথিবীর বুকে মুসলমানরা হলেন সর্বোৎকৃষ্ট জনগোষ্ঠি। মানবজাতির কল্যাণ সাধনের জন্যেই মুসলমানদের অভ্যুত্থান হয়েছে।

তোমরাই শ্র্রেষ্ঠ দল, মানবজাতির জন্য তোমাদের অভ্যুত্থান হয়েছে। - সুরা আল ইমরান, ৩/১১০

কোরানের অনেক বাংলা অনুবাদেই কোরান অমান্যকারীদের অবিশ্বাসী না বলে কাফের বলা হয়েছে। বাংলা ভাষায় প্রথম কোরান অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেনও 'কাফের' শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কোরানের অন্য একটি অনুবাদ থেকে আমরা কাফেরের সংজ্ঞা ধরতে পারি:

যারা আল্লাহর নাজেল করা আইন অনুযায়ী বিচার করে না তারাই কাফের। - সুরা মায়েদা, ৫/৪৪

কোরান অমুসলমানদের সামগ্রিকভাবে দুইভাগে বিভক্ত করেছে - কাফের ও আহল আলকিতাব (কিতাবের জনগণ, ইহুদী বা খ্রিস্টানদের এই দলে অন্তর্ভুক্ত করা যায়)। কাফের হলেন তারাই যাদের ওপর আল্লার কোনও গ্রন্থ বা কিতাব অবতীর্ণ হয়নি এবং যারা আল্লাহর কোনও প্রেরিত কিতাবের ওপর বিশ্বাসী নয়। আল্লাহর কিতাব-বিশ্বাসী নয় বলেই তারা অবিশ্বাসী। কোরানের শব্দার্থের বিশেষজ্ঞ ইমাম রাঘিবের মতে কাফের বলতে তাদেরই বোঝায়, যারা কিছু গোপন করে (কাফারা অর্থে গোপন করা)। তিনি এও জানিয়েছেন রাত্রি যেমন অন্ধকারে সবকিছু গোপন করে কাফের বলতে সেরকমও বোঝায়। তাহলে তাঁর মতে একজন কৃষককেও তো কাফের বলতে হয় মাটির তলায় বীজ গোপন করার জন্যে। কিন্তু এভাবে অর্থ করা ভুল হবে, অমুসলমানরা যে অর্থে কাফের। কোরানীয় শব্দের বিশেষজ্ঞ ইমাম রাঘবীর ভাষ্য অনুযায়ী কাফের শব্দের অর্থ হল সত্য গোপন করা, বিশেষত উদঘাটিত সত্য। কোরান অনুযায়ী কাফের শব্দের অর্থ দাঁড়ায় যিনি আল্লাহর পথ নির্দেশ এবং সত্যকে মানতে চান না। ইহুদী, খ্রিস্টান এবং সাবীয়রা কাফের নন। কোরানে এদের কথাই শুধু বলা হয়েছে, এদের বাদ দিলে বিশ্বের আর সব ধর্ম অনুসারীরাই কাফের। (সূত্র : ইসলাম ও আধুনিকতা - আসগর আলি ইঞ্জিনিয়ার)

মক্কার মূর্তি উপাসক প্রসঙ্গেই কোরানে কাফের ও অবিশ্বাসী শব্দের উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু কাফেররা শুধু আরবেই ছিলেন না। আরবভূমির বাইরে অনেক দেশেই তাদের আবাস ছিল। তাদেরও ছিল নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস। কাফেরদের জন্যে অনেক নির্দেশ কোরানে।

অবিশ্বাসী বা কাফেরদের সাথে মুসলমানরা কীভাবে আচরণ করবে তার নির্দেশ রয়েছে কোরানে। আর স্পষ্ট নির্দেশ আছে কাফেরদের বন্ধুরূপে গ্রহণ না করার জন্যে। কাফেরদের হত্যা করার কথা বলা হয়েছে বারবার। কতভাবে না কাফেরদের জাহান্নামের শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে মৃত্যুর পর কোরানে। অসংখ্য আয়াতে কাফের বা অবিশ্বাসীদের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে কোরানে। আমরা কিছু আয়াত তুলে ধরছি :

সুরা বাকারা :
আর যেখানে পাও, তাদের হত্যা কর।
আর তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাক, যতক্ষণ না (তাদের) ধর্মদ্রোহিতা দূর হয় এবং আল্লাহর দ্বীন (ধর্ম) প্রতিষ্ঠিত না হয়।
আর তোমাদের জন্যে যুদ্ধের বিধান দেওয়া হল। ২/১৯১, ১৯৩, ২১৬


সুরা ইমরান :
বিশ্বাসীগণ যেন বিশ্বাসীদের ছাড়া অবিশ্বাসীদের অভিভাবকরূপে গ্রহণ না করে, যে কেউ এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহর কোন সম্পর্ক থাকবে না।
যারা অবিশ্বাস করে তাদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করে। ৩/২৮, ১৫১

সুরা নিসা :
নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর অংশী করার অপরাধ ক্ষমা করবেন না।
যারা আমার আয়াতকে অবিশ্বাসী করে তাদের আগুনে দগ্ধ করবই।
আল্লাহ অবিশ্বাসীদের শক্তি সংযত করবেন।
আল্লাহ কখনই বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে অবিশ্বাসীদের জন্য কোন পথ রাখবেন না।
বিশ্বাসীগণের পরিবর্তে অবিশ্বাসীদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। ৪/৪৮, ৫৬, ৮৪, ১৪১, ১৪৪

সুরা মায়েদা :
যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ করে তাদের হত্যা করা হবে অথবা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে অথবা বিপরীত দিক হতে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদের দেশ হতে নির্বাসিত করা হবে। (বিপরীত দিক হতে-র অর্থ ডান হাত বাম পা অথবা বাম হাত ডান পা) ৫/৩৩

সুরা আনফাল :
যারা অবিশ্বাস করে আমি তাদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করব। সুতরাং তাদের স্কন্ধে ও সর্বাঙ্গে আঘাত কর।
তোমরা তাদের বধ করনি, আল্লাহই তাদের বধ করেছেন।
এবং তোমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাকবে যতক্ষণ অধর্ম দূর হয় এবং আল্লাহর ধর্ম সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিশ্বাসীদের সংগ্রামের জন্য উদ্বুদ্ধ কর, তোমাদের মধ্যে কুড়িজন ধৈর্যশীল থাকলে তারা দুশতজনের উপর বিজয়ী হবে এবং তোমাদের মধ্যে একশতজন থাকলে তারা একসহস্র অবিশ্বাসী উপর বিজয়ী হবে। কারণ তারা এমন এক সম্প্রদায় যার বোধশক্তি নেই। ৮/১২, ১৭, ৩৯, ৬৫

সুরা তওবা :
অতঃপর নিষিদ্ধমাস অতিবাহিত হলে অংশীবাদীদের যেখানে পাবে বধ করবে, অবরোধ করবে এবং প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের জন্য ওৎ পেতে থাকবে। ...
তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করবে। তোমাদের হাতে আল্লাহ ওদের শাস্তি দেবেন, ওদের লাঞ্ছিত করবেন।
তোমাদের পিতা ও ভাই যদি বিশ্বাস অপেক্ষা অবিশ্বাসকে শ্রেয় জ্ঞান করে তবে ওদের অভিভাবকরূপে গ্রহণ করো না ...
অংশীবাদীরা তো অপবিত্র।
অবিশ্বাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তী তাদের সাথে যুদ্ধ কর।
অবিশ্বাসী ও মুনাফিকদের (কপটদের) বিরুদ্ধে সংগ্রাম কর এবং তাদের প্রতি কঠোর হও? জাহান্নাম ওদের আবাসস্থল। ৯/৫, ১৪, ২৩, ২৮, ৭৩, ১২৩

সুরা আম্বীয়া :
তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের উপাসনা কর সেগুলি তো জাহান্নামের ইন্ধন, তোমরাই ওতে প্রবেশ করবে। ২১/৯৮

সুরা ফুরকান :
সুতরাং তুমি অবিশ্বাসীদের আনুগত্য করোনা এবং তুমি কোরআনের সাহায্যে ওদের সঙ্গে কঠোর সংগ্রাম চালিয়ে যাও। ২৫/৫২

সুরা সাফফাত :
একত্র কর সীমালংঘনকারীদের ও ওদের সহচরদের এবং যাদের ওরা উপাসনা করত। আল্লাহর পরিবর্তে এবং ওদের জাহান্নামের পথে পরিচালিত কর। ৩৭/২২ - ২৩

সুরা ফাতাহ :
যারা আল্লাহতে এবং তাঁর রসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে না আমি সেসব অবিশ্বাসীদের জন্য জ্বলন্ত অগ্নি প্রস্তুত রেখেছি। ৪৮/১৩

সুরা হাশর :
প্রকৃতপক্ষে তোমরাই (মুসলমানগণ) তাদের (অবিশ্বাসীদের) অন্তরে আল্লাহ অপেক্ষা অধিকতর ভয়ের কারণ কেননা তারা এক নির্বোধ সম্প্রদায় বলে আল্লাহকে ভয় না করে তোমাদের অধিক ভয় করে। ৫৯/১৩

কোরানে মূর্তি উপাসক অবিশ্বাসী কাফেরদের প্রসঙ্গে অসংখ্য আয়াত থেকে আমরা কিছুমাত্র তুলে ধরলাম। কোরানে প্রথম সুরা, সুরা ফাতিহাতেই শুধু অবিশ্বাসীদের সম্বন্ধে কোনও আয়াত নেই। তাছাড়া প্রায় সব সুরাতেই অবিশ্বাসীদের নিয়ে কিছু না কিছু আয়াত রয়েছে। যেখানে আমরা খুঁজে পাই অবিশ্বাসী অংশীদারীদের প্রতি চরম ঘৃণা। এমন একটি আয়াতও নেই যেখানে তাদের সাথে মানিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কোরান বিশ্বাসী মুসলমানদের কতভাবে যে উদ্বুদ্ধ করেছে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে। ক্ষমা করার কথা কোথাও বলা নেই। কোরানের বিভিন্ন তফসিরে এইসব আয়াতের অনেকরকম ব্যাখ্যা থাকতে পারে। কিন্তু সেইসব ব্যাখ্যা থেকেও কোনওভাবেই কাফেরদের প্রতি চরম বিদ্বেষকে আড়াল করা যাবে বলে আমাদের মনে হয় না। অনেকে দাবি করেন কিছু কিছু আয়াতের রূপক অর্থ রয়েছে। কোনও কোনও আয়াতকে রূপকার্থে বুঝতে চাইলেও সব আয়াতকে তো সেভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাছাড়া সাধারণভাবে অর্থ বুঝে যারা কোরান পাঠ করেন তাদের রূপকের সন্ধান পাওয়ার কথা নয়। আর যারা মনে করেন কোরানের এই অবিশ্বাসী-সহিংসাকে বিচার করতে হবে কোরান অবতীর্ণ হওয়ার সময়কাল এবং পরিস্থিতি বিবেচনা করে, তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই কোরান মানুষের সৃষ্টি নয়। কোরান আল্লাহর বাণী ও নির্দেশ। শাশ্বত ও চিরন্তন। কোরানকে তো কালসীমায় বেঁধে ব্যাখ্যা করা যায় না।

***********************************************************

ইসলাম ও জেহাদ

অবিশ্বাসী মূর্তি উপাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হল জেহাদ। জেহাদ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে তো ফরজ। এর অর্থ হল "জিহাদ ফি আবিল আল্লাহ।" - আল্লার পথে যুদ্ধ করা। "জেহাদের কোন বিকল্প নেই"। (হাদীস, বুখারী)। যারা জেহাদে অংশ নেবে আল্লাহ তাদের সব ধরণের পাপ ক্ষমা করে দেবেন। জেহাদে অংশগ্রহণকারীদের স্থান হবে জান্নাতে। (সুরা স্বাফ, ৬১/১২)

জেহাদ হল ধর্মযুদ্ধ। জেহাদ মুসলমানদের জন্যে বাধ্যতামূলক। হাদীস বুখারীতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যাদের বিরুদ্ধে জেহাদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে মুসলমানদের জন্যে তারা হলেন :

১. যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, এবং 
২. যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা করবে।

"জেহাদ হচ্ছে হজ, ওমরাহ হজ, নফল নামাজ রোজা ইত্যাদির চেয়েও মহত্তর।"

Jihad is superior to Hajj and Umra and also suprior to non-obligatory prayers and fasting. [Al-Bukhari, Volume-1]

কেয়ামত পর্যন্ত একজন মুসলমানের জন্যে জেহাদ বাধ্যতামূলক। কোনও মুসলমান জেহাদের আহ্বানকে অস্বীকার করতে পারেন না।

জেহাদ নিয়ে কোরানে অনেক আয়াত।

সুরা বাকারা:
আর যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তোমরাও আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর। ২/১৯০

সুরা নিসা:
অতএব যারা পরকালের বিনিময়ে পার্থিব জীবন বিক্রয় করে তাদের আল্লাহর পথে সংগ্রাম করা উচিত।
তোমাদের কি হয়েছে যে তোমরা আল্লাহর পথে ... সংগ্রাম করবে না?
যারা বিশ্বাসী তারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে আর যারা অবিশ্বাসী তারা তাগুতের (শয়তানের) পথে সংগ্রাম করে।
বিশ্বাসীদের মধ্যে যারা অক্ষম নয় অথচ ঘরে বসে থাকে এবং (আর) যারা আল্লাহর পথে স্বীয় ধন-প্রাণ দিয়ে জিহাদ করে তারা সমান নয়। ৪/৭৪, ৭৫, ৭৬, ৯৫

সুরা তওবা:
তোমরা অংশীবাদীদের সাথে সমবেতভাবে যুদ্ধ করবে।
তোমাদের সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম কর। ৯/৩৬, ৪১

জেহাদ প্রসঙ্গে কোরানে আরো অনেক আয়াত রয়েছে। কিছু আয়াত পূর্বেই তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহর পথে মুসলমানরা সংগ্রাম করল তাদের জন্যে রয়েছে মৃত্যুর পর বেহেশতের পুরস্কার। আল্লাহ মুসলমানদের জীবন ও সম্পত্তি কিনেছেন তাদের বেহেশতে স্থান দেওয়ার জন্য।

নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বাসীদের নিকট হতে জীবন ও সম্পদ বেহেশতের মূল্য বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন। - সুরা তওবা, ৯/১১১

আল্লাহর পথে যুদ্ধই তো জেহাদ। জেহাদে মৃত্যু হলেই মুসলমান 'শহীদ' হয়ে যান। 
জেহাদ শব্দের উৎপত্তি 'জুহদ' থেকে। আরবি ভাষায় বিশেষজ্ঞ মতে জেহাদের অর্থ হল, "to make substancial effort". ইংরেজি-আরবি অভিধানে জেহাদের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে -"to make the utmost effort to attain something beloved or to save oneself from something disliked." সরাসরি না হলেও এই সংজ্ঞার ভিতর আমরা অবিশ্বাসীদের প্রতি মুসলমানদের ঘৃণার পরিচয় পেয়ে যাই জেহাদ শব্দের মধ্যে।

ইসলামী চিন্তাবিদরা মনে করেন, কোন মুসলমান জেহাদকে অস্বীকার করতে পারেন না। সেই সুযোগ তার নেই। মুসলমান জেহাদকে অস্বীকার করলে মুসলমান থাকেন না, কাফের হয়ে যান।

Jihad is an ordained obligation and commanded by Allah. Any person wo denies Jihad is a Kafir and people who doubt the obligation of Jihad have one astray. [Iman Saraski]

...

কাফেররা যদি একমাত্র সত্যধর্ম ইসলামের পথে আসতে না চান, তাদের যে কোনওভাবে সেই সত্যের পথে আনার জন্যে সংগ্রাম করাই তো হল জেহাদ। তারা যদি সত্যধর্ম গ্রহণ অর্থে না চান তাদের হত্যা করার জন্যেই বারবার নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ, কারণ এই পৃথিবীর মালিক হলেন আল্লাহ এবং তাঁর রসুল। সেখানে কাফেরদের স্থান হতে পারে না।

ইসলামের সুন্নি শাখার চার মজহারের কথা আমরা বলেছি। ইসলামের সেই চার আইনের স্কুলের (ফিকাহ - Jurisprudence) জেহাদ সম্বন্ধে ধারণাও আমরা দেখে নিতে পারি।

Maliki - The Muslims are to fight with the Kufaar to advance Allah's religion.
Shafiee - The Meaning of Jihad in Sharaee terms is to make utmost effort in fighting in path of Allah.
Hanbali - Jihad means to fight against the unbelievers.
Hanafi - Jihad means to be in fighting in the Path of Allah by ones life, wealth and speech.

আমরা দেখলাম জেহাদের ধারণা নিয়ে চার মজহারের মধ্যে বিশেষ মতপার্থক্য নেই। কাফেরদের বিরুদ্ধে সংগ্রামই হল জেহাদ।

কেন এই জেহাদ? পৌত্তলিক মুশরিকদের কোরান বলেছে অপবিত্র। নিকৃষ্টতর জীব। অবিশ্বাসী মানুষ ইমানদার ক্রীতদাস অপেক্ষাও নীচতর।

অংশীবাদীরা তো অপবিত্র। - সুরা তওবা, ৯/২৮
অংশীবাদী পুরুষ তোমাদের চমৎকৃত করলেও ধর্মে বিশ্বাসী ক্রীতদাস তা অপেক্ষা উত্তম। - সুরা বাকারা, ২/২২১
নিশ্চয়ই, আল্লাহর নিকট নিকৃষ্ট জীব তারাই যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করে এবং অবিশ্বাস করে। - সুরা আনফল, ৮/৫৫

সত্য প্রত্যাখ্যানকারী একজনকেও অব্যাহতি না দেওয়ার পক্ষে বিধান দিয়েছে কোরান। 

পৃথিবীতে সত্য প্রত্যাখ্যানকারী কোন গৃহবাসীকে অব্যাহতি দিও না।
তুমি ওদের অব্যাহতি দিলে ওরা তোমার দাসদের বিভ্রান্ত করবে এবং জন্ম দিতে থাকবে কেবল দুস্কৃতিকারী ও সত্য প্রত্যাখ্যানকারী। - সুরা নূহ, ৭১/২৬-২৭

জেহাদ হল ধর্মপ্রতিষ্ঠা করার জন্যে যুদ্ধ। সেই ধর্ম হল ইসলাম, মোহাম্মদের প্রতিষ্ঠিত ধর্ম। পরবর্তীকালে জেহাদের যত উদার ব্যাখ্যাই দেওয়া হোক না কেন ইসলামের প্রাথমিককাল থেকেই এই যুদ্ধ ছিল আক্রমণাত্মক। যারা মনে করেন আক্রান্ত হলেই শুধু মুসলমানরা আক্রমন করেছেন, মুসলমানদের ভূমিকা ছিল সবসময় রক্ষণাত্মক এবং শান্তির সপক্ষে, ইতিহাস কিন্তু তাদের পক্ষে রায় দেয় না। রসুল নিজেই বলেছেন আল্লাহর নির্দেশেই তিনি যুদ্ধ করেছেন ইসলামকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্যে।

I have been ordered by God to fight with people till they bear testimony to the fact that there is no God but Allah and that Mohammed is his messenger, and that they establish prayer nd pay Zakat [money]. If they do it, their blood and their property are safe from me. (সহীহ বুখারী)
*************************
মোহাম্মদের জীবনে মক্কাবিজয় ছিল ইসলামের চূড়ান্ত বিজয়। রসুল মক্কা বিজয়ের পর কাবায় প্রবেশ করে কোরেশদের উপাস্য ৪৬০টি মূর্তি নিজের হাতে ভেঙ্গে ছিলেন। এর সশ্রদ্ধ উল্লেখ রয়েছে সহীহ বুখারী হাদীসে,

আবদুল্লাহ বিন মাসুদ বর্ণনা করেছেন, রসুল মক্কায় প্রবেশ করলেন এবং (সেইসময়) সেখানে, কাবার অভ্যন্তরে চতুর্দিকে ৪৬০টি মূর্তি ছিল। রসুল তাঁর হাতে যে লাঠি ছিল তা দিয়ে সেইসব মূর্তি ভেঙ্গে ফেললেন এবং আবৃত্তি করলেন 'সত্য (ইসলাম) এসেছে, মিথ্যা (অবিশ্বাস) দূর হয়েছে'।

রসুলের কণ্ঠে কোরানের সেই আয়াত:

বল সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে, নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হবে। - সুরা বনি ইসরাইল, ১৭/৮১

কিন্তু মোহাম্মদ কী ইসলামকে পৌত্তলিকতামুক্ত করতে পেরেছেন? পৌত্তলিকতার অর্থ তো শুধু মূর্তি উপাসনা নয়। এর অর্থ যে বড় ব্যাপক। যে কোনও জড় পদার্থকে শ্রদ্ধা জানানো যে আঙ্গিকেই তা হোক পৌত্তলিকতার পর্যায়ে পড়ে।

মুসলিম জাহানের পবিত্রতম তীর্থ কাবায় পরম শ্রদ্ধার সাথে সংরক্ষিত রয়েছে যে কৃষ্ণ পাথর (Black Stone) যাকে বলা হয় হজর-ই -আসওয়াদ (Hazr-E-Aswad) তা মোহাম্মদ নিজেই অধিষ্ঠিত করে গেছেন। রসুল কাবার সব মূর্তি ধ্বংস করলেও এই কৃষ্ণ পাথরের ওপর হাত দেননি। ইসলাম-পূর্ব দীর্ঘকাল থেকেই এই কৃষ্ণপাথর কাবায় সংরক্ষিত ছিল। অন্যান্য মূর্তির সাথে, ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কোরেশ এবং অন্য আরববাসীরা, এই বিমূর্ত প্রস্তরখণ্ডকে উপাসনা করত তাদের পালনীয় রীতিতে।

মুসলমানরা বিশ্বাস করেন এই কৃষ্ণপাথর আল্লাহ বেহেশত থেকে বিতাড়িত আদি মানব এবং ইসলামের প্রথম নবী হজরত আদমকে দান করেছিলেন। এই কৃষ্ণ প্রস্তর আদমের সময় থেকে কাবায় সংরক্ষিত রয়েছে এই বিশ্বাস নিয়ে তর্ক করার কোনও সুযোগ নেই। আরব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে কৃষ্ণপ্রস্তর অত্যন্ত পবিত্র। ইসলাম পূর্বকালে তাদের সব উপাসনাকালে সংরক্ষিত থাকত এই পাথর। বিমূর্ত পাথরের কোনও সুনির্দিষ্ট অবয়ব না থাকলেও তাকে মূর্তি থেকে আলাদা করা যায় না। হজরত আদমের সাথে যুক্ত করে আরবের প্রাচীন ধর্মসংস্কৃতির একটা অংশকে এইভাবে আত্তীকরণ করেছেন রসুল মোহাম্মদ। কেন ইসলামের নবী পৌত্তলিকতার এই প্রতীককে বিশেষ মর্যাদায় কাবায় অধিষ্ঠিত করেছিলেন, তা নিয়ে ইসলামী পণ্ডিত গবেষকদের অনেকরকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তাতে আমাদের মন ভরে না। রসুলের মৃত্যুর পর কাবার এই পাথর নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছিল তাঁর প্রিয় সহচরদের মধ্যে। সেই বিতর্কে যোগ দিয়েছিলেন খোলাফায়ে রাশেদীনের খলিফারাও। কিন্তু রসুল যা করে গেছেন তাকে বদলানো যায় না বলেই সব বিতর্ক থেমে গেছে একসময়। ইসলামের প্রাথমিককালে এই বিতর্ককে বাড়তে দিলে তাকে সামাল দেওয়া যেত না। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম হল হজ। সমর্থ মুসলিম কাবায় হজ করতে যাওয়ার স্বপ্ন লালন করেন জীবনভর। কাবায় হজ করতে গিয়ে সেই পবিত্র কৃষ্ণপ্রস্তর 'আসওয়াদ'কে চুম্বন করার মধ্যেই হজের পরিপূর্ণতা। এই চুম্বন আরবিয় সংস্কৃতি। তাকে ধারণ করেছে ইসলাম। 'আসওয়াদ'কে চুম্বন করা যে পৌত্তলিকতা তা স্বীকার করেন না মুসলমানরা। কিন্তু তাকে আমরা অন্যভাবে ভাবতে পারি না।

হজ ইসলামের অন্যতম মূলভিত্তি, হজের 'আরাকান' বা অবশ্য করণীয় কাজ পাঁচটি :

(১) এহরাম বাঁধা (সেলাই বিহিন নির্দিষ্ট নিয়মে বিধিসম্মত শ্বেতবস্ত্র পরিধান)
(২) তওয়াফ অর্থাৎ কাবা প্রদক্ষিণ করা 
(৩) 'ছাফা' হতে 'মারওয়া' পাহাড় পর্যন্ত নির্ধারিত নিয়মে দৌড়ানো 
(৪) আরাফার ময়দানে দণ্ডায়মান হওয়া 
(৫) মস্তক মুদ্রণ করা (হানাফী মতবাদীরা মনে করেন মস্তক মুদ্রণ হজের 'আরাকান' নয়)

তার ওপর রয়েছে মিনায় শয়তানের উদ্দেশ্যে প্রস্তর নিক্ষেপ। আরও অনেক নিয়ম পালন করতে হয় হজের সময়। বিস্তারিত বিবরণে আমরা যাব না।

শুধু কৃষ্ণপ্রস্তর 'আসওয়াদ'কে চুম্বন কেন, হজের পঞ্চ আরাকানের কোনওটিকে কী পৌত্তলিকতা বিমুক্ত বলা যায়? মিনায় অদৃশ্য শয়তানকে যেভাবে প্রস্তর নিক্ষেপ করে প্রতীকী অনুষ্ঠান পালন করা হয় তাকেও কী পৌত্তলিকতা থেকে আলাদা করে ভাবা যায়।

***********************************************************

ইসলাম, কোরান এবং ইহুদী ও খ্রিস্টান

ইহুদী ও খ্রিস্টানদের আরবভূমি থেকে বিতাড়ন করার কারণ হল তারা আল্লাহর সুসন্তান নন। তাদের অধিকার ছিল না আল্লাহর জমিতে অবস্থান করার। আল্লাহর রসুল বলতেন, "তোমাদের জানা উচিত এই পৃথিবীর মালিক আল্লাহ এবং তাঁর রসুল।" (৪৩৬৩। মুসলিম, ৩য় খণ্ড)

ইহুদী ও খ্রিস্টানদের প্রতি নির্দয় হওয়ার কারণ হিসেবে ইসলামী পণ্ডিতগণ ব্যাখ্যা দেন যে এই ধর্ম অনুসারীরা আল্লাহ এবং তাঁর নবীর (মুসা ও ইসার) অংশীদারীত্বে বিশ্বাস করেন। তারা তাদের নবীদের আল্লাহর অংশ বলে মনে করেন। তাই তাদের অপরাধ অমার্জনীয়। আল্লাহর দুনিয়ায় তাদের স্থান পাওয়া উচিত নয়।

নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর অংশী করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। - সুরা নিসা, ৪/১১৬
*************************
মদীনার ইহুদীদের শায়েস্তা করার জন্যে বনী নজীর গোত্রের মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ খেজুর গাছ কাটার নির্দেশ দিয়েছিলেন মোহাম্মদ।

আরবভূমির মানুষের কাছে খেজুর গাছ সমতুল সম্পদ আর নেই। আরবের নিয়ম অনুসারে খেজুর গাছ কাটা ছিল চরম গুনাহ, মহাপাপ। মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার পর সেখানকার অবস্থানকারী বনি নজীর গোত্রের ইহুদীরা ইসলামে আত্মসমর্পণ করেননি। মোহাম্মদ তাদের মদীনা থেকে বিতাড়িত করার লক্ষ্যে তাদের এলাকায় অধিকাংশ খেজুর গাছ কেটে ফেলার নির্দেশ দেন। সহী মুসলিম হাদীসে তার বর্ণনা পাওয়া যায়,

"4324, it is narrated on the authority of Abdullah that the Messenger of Allah (may peace be upon him) ordered the date-palms of Bani Nadir to be burnt and cut." (মুসলিম, ৩য় খণ্ড)

এই খেজুরগাছ কাটার জন্য আল্লাহর রসুলকে মদীনাবাসীর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। তখনই আল্লাহর ওহী অবতীর্ণ হয় রসুলের ওপর। আমরা কোরানে এই আয়াতটি যেভাবে পাই :

তোমরা যে কতক খেজুর গাছ কর্তন করেছ এবং কতক কর্তন না করে রেখে দিয়েছ, তা তো আল্লারই অনুমতিক্রমে। এ এজন্য যে এর দ্বারা আল্লাহ সত্যত্যাগকারীদের লাঞ্ছিত করবেন। - সুরা হাশর, ৫৯/৫

ইসলামী পণ্ডিতরা মনে করেন ইহুদী এবং খ্রিস্ট ধর্ম আল্লাহ প্রেরিত নবীদের অনুসারী হলেও তা হয়ে পড়েছিল অপবিত্র। তাতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হয়ে পড়েছিল। তাই সেমেটিক অন্য দুই ধর্মের উত্তরাধিকার বহন করে অবতীর্ণ হয়েছিল কোরান। জন্ম হয়েছিল ইসলাম ধর্মের। "Islam undoubtedly perfected and completed Christianity and Judaism."

কিন্তু যে কোরানে সবই দয়ালু এবং ক্ষমাশীল আল্লাহর বাণী এবং নির্দেশ, সেখানে এত অশান্তির ইন্ধন কেন?

***********************************************************

ইসলামে সহনশীলতা

কোরান থেকে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা বার বার যে আয়াতটি উদ্ধৃত করেন, তা হল,

ধর্মের জন্য কোন জোর জবরদস্তি নেই। - সুরা বাকারা, ২/২৫৬

এই আয়াতটি তুলে ধরে তাঁরা প্রমাণ করতে চান ইসলামের সহনশীলতা এবং নমনীয়তা। কিন্তু ইসলামী চিন্তাবিদরা মনে করেন কোরানের এই আয়াত আল্লাহ বাতিল করেছেন অন্য একটি আয়াত দিয়ে।

হে নবী। অবিশ্বাসী ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কর এবং ওদের প্রতি কঠোর হও। - সুরা তওবা, ৯/৭৩

... ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের ছাড় দেওয়া হলেও রসুল পৌত্তলিক আরবদের কোনও ছাড় দেননি, সেখানে "জোরজবরদস্তি" প্রয়োগ করা হয়েছিল। কোরানের ২।২৫৬ আয়াত কাফেরদের জন্যে প্রযোজ্য ছিল না। ইসলাম প্রাথমিক পর্যায় কাটিয়ে ওঠার পর নিজেদের অবস্থানকে সংহত করে নিয়ে তরবারির জোরে কাফেরদের ইসলাম কবুল করতে বাধ্য করা হয়েছিল। কাফেরদের পিতৃধর্ম সংরক্ষণ করার কোনও অধিকার স্বীকৃত হয়নি।

... মুসলিম ধর্মবেত্তাগণ এইভাবে 'জোরজবরদস্তি'কে জায়েজ করে দিয়েছেন। কারণ রসুল নির্দেশ দিয়েছিলেন যতক্ষণ পর্যন্ত অবিশ্বাসীরা ইসলামের ওপর বিশ্বাস স্থাপন না করে তাদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। আর রসুল নির্দেশ পেয়েছিলেন আল্লাহর কাছ থেকে। (সুরা বাকারার ১৯৩ আয়াতটি পূর্বেই উদ্ধৃত হয়েছে)।

"নাসিক-উল-মানসুক" এর রচয়িতা ইবনে হাজম-আল আন্দালুসি জানাচ্ছেন কোরানে মোট ১১৪টি আয়াতে যেভাবে সহনশীলতার কথা বলা হয়েছে তা ছিল ইসলামের প্রাথমিক কালের নির্দেশ। এরকম দুটি আয়াত এখানে তুলে ধরা হল।

তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের প্রতিপালককে ডাক। - সুরা আরাফ, ৭/৫৫
তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সকলেই বিশ্বাস করত। তবে তুমি কি বিশ্বাসী হওয়ার জন্য মানুষের উপর জবরদস্তি করবে? - সুরা ইউনুস, ১০/৯৯

আন্দালুসি মনে করেন রসুলের প্রয়াণের আগেই এইসব আয়াত বাতিল করা হয়েছে সুরা তওবার ৯/৫ আয়াত দ্বারা "Slay the idolaters wherever you find them."

সুরা তওবা মোহাম্মদের প্রতি আল্লাহর সর্বশেষ নাজেলকৃত সুরা। তাই সুরা তওবার প্রাসঙ্গিকতা অন্যসব সুরা থেকে আলাদা। এই সুরার কোনও আয়াত যদি কোরানের অন্য কোনও সুরার আয়াতের সাথে বিরোধপূর্ণ বলে মনে হয় আপাতভাবে, তাহলে সুরা তওবার আয়াত প্রাধান্য পাবে বলে মনে করেন ইসলামী পণ্ডিতরা। ৯/৫ আয়াত দ্বারা অন্য আয়াতের বাতিলকরণ নিয়ে ইসলামী পণ্ডিতদের মধ্যে ভিন্নমত অনেক দিনের।
*************************
মক্কা নগরীর কাবায় বিভিন্ন স্থান থেকে আরবরা তীর্থ করতে আসতেন। ইসলামের হজের উৎস সেই প্রাক ইসলামিক আরব ঐতিহ্য থেকে আত্তীকৃত। তীর্থ উপলক্ষে যারা কাবায় আসতেন তাদের সাথে মক্কাবাসীদের যে আর্থিক লেন-দেন হত, সেটা ছিল তাদের জন্যে একটা বড় আয়ের উৎস। যখন কাবায় অমুসলিমদের তীর্থ উপলক্ষে আসার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেন আল্লাহ (সুরা তওবা, ৯/২৮) তখন মক্কাবাসীদের সেই আয় বন্ধ হয় যায়, তাদের জন্যে আয়ের নতুন উৎস খুলে দেওয়ার জন্যে খ্রিস্টান ও ইহুদীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় অমানবিক ও অসাম্মানিক কর। সেই কর হল জিজিয়া কর বা Poll-tax । 
*************************
কবির স্বাধীনতাকে কোনও কালেই স্বীকার করেনি ইসলাম। কবি এবং কবিতার সাথে ইসলামের যেন জন্মবিরোধ। কোরানে কবিদের নিয়ে স্পষ্ট সাবধান বাণী রয়েছে :

"এবং কবিদের অনুসরণ করে তারা যারা বিভ্রান্ত" -- সুরা শোআরা, ২৬/২২৪ 
*************************
কোরানের অন্য যে আয়াতটি নিয়ে মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদরা অহংকার করেন তা হল,

তোমাদের ধর্ম তোমাদের, আমার ধর্ম আমার -- সুরা কাফেরুন, ১০৯/৬

এই আয়াতকে অবলম্বন করেই তাঁরা বলেন ইসলাম হল ধর্মনিরপেক্ষ ধর্ম। এই আয়াতের মর্মবাণী যাই হোক, কোরান এবং ইসলামের ইতিহাস থেকে তাকে আলাদা করে দেখা যায় না। সুরা কাফেরুনের এই আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল মক্কায় একেবারে ইসলামের ঊষালগ্নে। প্রথম নাজেল হওয়া ২০টি আয়াতের একটি এই আয়াত। কোরানের আয়াতসমূহকে যদি অবতীর্ণ হওয়ার ক্রমানুযায়ী বিন্যস্ত করে সংকলিত করা হত, তাহলে এই আয়াতটি হত ১৮তম আয়াত। উদারতা এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার মহৎ চেতনায় সমৃদ্ধ এই আয়াতটি যখন অবতীর্ণ হয় তখন নব দীক্ষিত মুসলমানরা অস্তিত্বের সংগ্রামে রত ছিলেন। তখনও মুসলমানরা মক্কার পৌত্তলিকদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারেননি। অনেক মুসলমানকে নির্ভর করতে হত পৌত্তলিকদের ওপর নানা কারণে। তখন তাই এই উদারতার নির্দেশ না পেলে মুসলমানদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ত। পরবর্তীকালে মক্কা ও মদীনায় কোরানের এত সব আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে যে এই আয়াত স্পষ্টতই অর্থ হারিয়ে ফেলে, তাছাড়া সুরা তওবার ৯/৫ আয়াত দ্বারা এই আয়াত বাতিল করা হয়েছে বলেই ধরে নেওয়া হয়। তুলনীয় আরো আয়াত হল, সুরা বাকারা'র ২/১৯১, ১৯২, ১৯, সুরা নিসা'র ৪/৮৪ এবং সুরা আনফল'র ৮/৬৫।

ইসলামের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে যখন নবী মোহাম্মদের অনুসারীরা সংখ্যায় খুব কম ছিলেন, তারা ছিলেন দল হিসেবে দুর্বল। তখন তাদের পৌত্তলিক মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করার অবস্থা ছিল না, তাই আল্লার সেই ওহী, "To you be your way and to be mine". Q (109/6)

মোহাম্মদ মদীনায় হিজরত করার পর পরই অন্য সব আয়াত অবতীর্ণ হয়। প্রথমে মুসলমানরা ছিলেন প্রতিরোধকারী। পরে নিজেদের অবস্থান সংহত হলে তারা আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করেন। একের পর এক অবতীর্ণ হয় নতুন নতুন আয়াত। ওহীতে উদারতার পরিবর্তে দেখা যায় কঠোরতা।
*************************
ইহুদীরা ছিলেন মুসলমানদের জাতশত্রু। খ্রিস্টানরা নন। নবদীক্ষিত মুসলমানদের প্রতি খ্রিস্টানদের সহানুভূতির অভাব ছিল না। কোরানে তার স্বীকৃতি রয়েছে,

এবং যারা বলে 'আমরা খ্রিস্টান' মানুষের মধ্যে তাদেরই তুমি বিশ্বাসীদের নিকটতর বন্ধুরূপে দেখবে। -- সুরা মায়েদা, ৫/৮২

কিন্তু রসুল আরবভূমি থেকে শুধু ইহুদীদের নয় খ্রিস্টানদের বিতাড়ন করেছিলেন। পৌত্তলিকদের বাধ্য করেছিলেন ইসলামে আত্মসমর্প করতে।

ইসলাম ধর্ম হিসেবে ইহুদী খ্রিস্টধর্মকে সাময়িকভাবে স্বীকার করে নিলেও তার বাইরেও পৃথিবীতে অনেক ধর্মের অস্তিত্ব ছিল, রয়েছে এবং আগামীকালেও থাকবে তা মানতে চায়নি। ধর্ম হিসেবে সাকার উপাসনাকে কোরান ক্ষমা করেনি বলেই মুসলমানরা মূর্তি উপাসক কোনও ধর্মবিশ্বাসের সাথে সহাবস্থান করতে চাননি কখনো। ধর্মে জবরদস্তি নেই, কিংবা তোমার ধর্ম তোমার বলে যে আয়াত খুঁজে পাওয়া যায় কোরানে তা ছিল ইসলামের জন্মলগ্নের ধারণা। বলা যায় অস্তিত্ব রক্ষার কৌশল। পরে এই ধারণার বিপরীত মেরুতে অবস্থান গ্রহণ করেন মুসলমানরা। সারা বিশ্বে পর ধর্মের যত অবমাননা করেছে হলই বা মূর্তি পূজকের ধর্ম, মুসলমানরা, অন্য কোনও ধর্মবিশ্বাসী মানুষ তা করেনি। মুসলমানরা কোরানের নির্দেশের দোহাই নিয়ে পর ধর্মের কত যে মন্দির-উপাসনালয় ভেঙ্গেছেন, তাদের উপাস্য মূর্তি গুঁড়ো করে দিয়েছেন, তাদের দেবস্থান অপবিত্র করে দিয়েছেন - ইসলামের ইতিহাসেই তার উল্লেখ রয়েছে। তার জন্যে মুসলমানদের অহংকারও কম নয়।

কাবায় রসুল মোহাম্মদ-ই প্রথম মূর্তি ভাঙ্গেননি বিধর্মী, অবিশ্বাসী, কাফেরদের। বিধর্মীর উপাস্য দেবমূর্তি ভাঙ্গার নির্দেশ আল্লাহ পূর্বতন নবীদেরও দিয়েছিলেন। কোরানে তা মোহাম্মদকে জানিয়েছেন আল্লাহ।

হযরত ইব্রাহীম ইসলামের আরেক নবী। ইহুদী ও খ্রিস্ট ধর্মগ্রন্থেও তাঁর সশ্রদ্ধ উল্লেখ রয়েছে। নবী ইব্রাহীম আল্লাহর নির্দেশে প্রিয়তম পুত্র ইসমাইলকে কোরবানী দিয়েছিলেন। আল্লাহ তাঁর ঈমানের পরীক্ষা নিয়েছিলেন। পরে তিনি পুত্রকে ফিরিয়ে দেন পিতার কাছে। নির্দেশ দেন পশু কোরবানীর। সেই ত্যাগের স্মরণে তখন থেকেই নাকি ইসলামে পশু কোরবানী দেওয়ার প্রথা প্রচলিত হয় বিশেষ মাসের বিশেষ দিনে। হজরত ইব্রাহীমের ঐতিহাসিক প্রামাণিকতা নিয়ে আমরা কোনও প্রশ্ন তুলছি না। আল্লাহ হজরত ইব্রাহিমকে যে বিধর্মীর উপাস্য দেবমূর্তি ভাঙ্গার নির্দেশ দিয়েছিলেন কোরানে তা উল্লেখ রয়েছে সুরা আম্বীয়ায়।

শপথ আল্লাহর, তোমরা চলে গেলে আমি তোমাদের মূর্তিগুলি সম্বন্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা অবলম্বন করব।
অতঃপর সে ওদের প্রধানটি ছাড়া অন্যান্য মূর্তিগুলিকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল। -- সুরা আম্বীয়া, ২১/৫৭ - ৫৮

মোহাম্মদ মক্কা বিজয়ের পর নিজ হাতে কাবায় মূর্তি ভেঙ্গেছিলেন আল্লাহর অনুমোদনে। সেই থেকেই মুসলমানদের পরধর্মের মূর্তি ভাঙ্গার পরম্পরা। এটাই ইসলামের ইতিহাস, অনেক যুগের। ইতিহাসকেও যা অতিক্রম করে যায় অনেক সময়।

আফগানিস্তান একসময় বৌদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান হয়ে ওঠেছিল ইসলাম পূর্ব যুগে। সেখানকার বামিয়ানে পাহাড় খোদাই করে পৃথিবীর দুটি সর্বোচ্চ, সুন্দরতম (১৭৫ ফুট ও ১২০ ফুট উচ্চ) বুদ্ধমূর্তি তৈরী করেছিলেন কুষাণ যুগের ভাস্কর ও শিল্পীরা। পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসে যে ভাস্কর্যের কোনও তুলনা ছিল না। আফগানিস্তানে যখন ইসলামী মৌলবাদী তালিবানরা ক্ষমতা দখল করেছিল, তাদের ভাষায় তারা কোরানের শাসন কায়েম করেছিল। কোরান যে কোনও মূর্তি ভাঙ্গার স্পষ্ট নির্দেশ দেয়। বামিয়ানের সেই বিখ্যাত মূর্তি তখন কারো উপাস্য ছিল না। শতশত বছর পূর্ব থেকেই সেখানে সেইসব মূর্তি উপাসনার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারী ছিল। সেই বুদ্ধমূর্তি ছিল ইতিহাস শিল্পের স্মারক চিহ্ন। সভ্যতার অমূল্য সম্পদ বামিয়ানের সেই মূর্তি ধ্বংস করল তালিবানরা আল্লাহর নামে। কোরানের শিক্ষার নামে। সারা বিশ্ব নিন্দায় মুখর হয়েছিল। তালিবানদের কাছে আবেদন জানিয়েছিল সেই অতুলনীয় সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতে। পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রের কর্ণধারগণও নিরস্ত করতে পারেনি তালিবানদের। কিন্তু তালিবানদের নিরস্ত করতে পারত যে মুসলিম বিশ্ব তারা সেই দায়িত্ব পালন করেনি। অনেক মুসলিম দেশ তালিবানদের বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করাকে অন্যায় বলেই মনে করেনি। খুব বেশীদিনের ঘটনা নয় এই ধ্বংসলীলা।
*************************
ইসলাম পরধর্মের কোনও নিদর্শন সংরক্ষণযোগ্য বলে মনে করে না। যা কোরান এবং রসুলের হাদীসে নেই তাকে ধ্বংস করাটাই তাদের কাছে মহান ব্রত।
*************************
"ইসলামের ভাতৃত্ব বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব নয়। এটা কেবল মুসলমানদের জন্য। ইসলামে এক প্রকার সাম্য আছে। তবে তা মুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাদের সমাজের বাইরের মানুষদের জন্য আছে ঘৃণা ও শত্রুতা।" বলেছেন ভীমরাও রামজী আম্বেদকর। ভারতের দলিত নেতা, সংবিধানের জনক। ...

আম্বেদকর যা বলেছেন তা আমরা মিলিয়ে নিতে পারি মুসলিম দেশ ও রাষ্ট্রের প্রচলিত জীবনধারা থেকে। প্রতি জুম্মায় (শুক্রবার) নামাজের পর খুতবা পাঠ করা হয়। ইমাম সেই খুতবা পাঠ করেন। নামাজীরা শোনেন। সেখানে আল্লাহর কাছে প্রার্থণায় ইসলাম ও মুসলমানদের জয় কামনা করা হয় বারবার। সাথে আরও প্রার্থনা জানানো হয় আল্লাহ যেন অবিশ্বাসী, কাফের, বেদায়াতী এবং মুশরিকদের ধ্বংস কর দেন। তাদের জিল্লতি দেন। দয়া নয়, ক্ষমা নয়। বিধর্মীদের জন্যে শুধু নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রার্থনা।

দুই ঈদের জামাতের পরও খুতবা পাঠ করা হয়। জামাতে উপস্থিত থাকেন সর্বশ্রেণীর মুসলমান। উপস্থিত থাকে দেশ  রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানগণ। সেটাই ইসলামের সাম্য। নামাজের পর মুনাজাত করা হয়। ঈদের মুনাজাতে কামনা করা হয় মুসলিম বিশ্বের সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি, ঐক্য  সংহতি। মুসলিম উম্মার কল্যাণ। সমগ্র বিশ্বের নয়, সর্ব মানবের নয়। মুসলমানরা যেন কামনাই করতে পারেন না মানবতার কল্যাণ। বিশ্বের শান্তি।
*************************
বিদায় হজের (১০ হিজরী, ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ) শেষ বাণীতেই রসুল মোহাম্মদ বলে গেছেন - "সব মুসলমান ভাই ভাই"। আরব-অনারব, সাদা-কালো কারো ওপর কারো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তিনি দেশ-জাতি-ভাষা-বর্ণের সীমারেখা তুলে দিলেন মুসলমানদের জন্যে। শুধুই মুসলমানদের জন্যে। অমুসলমানদের জন্যে তাঁর কোন আহ্বান ছিল না। মৃত্যুর মাত্র চারদিন আগেও রসুল মোহাম্মদ বলে গেছেন কোনও মুশরিক যেন আরবে থাকতে না পারে [সূত্র: মাওলানা আজাদ, মৃত্যুর দুয়ারে মানবতা, পৃ - ২০]। আরব তাদের জন্মভূমি। তাহলে তারা যাবেন কোথায়? যারা ইসলাম কবুল করবে না তাদের জন্যে আল্লাহর নবীর কোনও ভাবনা নেই। কোরানে যে স্পষ্ট আহ্বান রয়েছে কোনও অমুসলমান মুসলমানের বন্ধু কিংবা অভিভাবক হতে পারে না। বিশ্বাসযোগ্য তো নয়ই। আল্লাহর রসুল সেই নির্দেশই পালন করে গেলেন।

***********************************************************

ইসলাম ও মৌলবাদ

ইসলাম রাজনৈতিক ধর্ম। ইসলাম ক্ষমতার ধর্ম। দেশ, রাষ্ট্র, ধর্ম ইসলামে আলাদা নয়।

লাতিন ভাষায় একটা মূল্যবান কথা পাওয়া যায়, "Cojus Regio, ejus Religio" অর্থাৎ "দেশ যার ধর্ম তার"। ইসলাম ধর্মের প্রচারের সঙ্গেই যেন জড়িয়ে এই বাণী। তাই মুসলমানরা যখনই কোনও অঞ্চলের দখল পেয়েছেন প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাদের ধর্মকে। সেখানে অন্য কোন ধর্মের স্থান হয়নি ব্যতিক্রমকে না ধরলে। বিজয়ী মুসলমানরা বাধ্য করেছেন অন্য ধর্মানুসারীদের, ইসলামের ভাষায় অবিশ্বাসী পৌত্তলিক কাফেরদের, ইসলামকে বরণ করে নিতে। যারা তা অস্বীকার করেছেন তাঁদের বিতাড়িত কেছেন ইসলামের ধর্মরাজ্য থেকে। পারস্যে স্থান হয়নি জরথুস্ট্রবাদী অগ্নি উপাসকদের। পারস্য থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে তারা এখনো টিকে আছেন ভারতে।

ইসলাম তার রাষ্ট্রসীমায় অন্য যে কোনও ধর্মের প্রচার নিষিদ্ধ করে। ...

মাওলানা মওদুদী মনে করেন, ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলমানরা - অবিশ্বাসী কাফের এবং আদলে কিতাবধারী অংশীবাদী কোন ধর্মানুসারীরা তাদের নিজস্ব ধর্মমত প্রচারের সুযোগ পেতে পারে না। তাঁর ভাষায় দারুল ইসলামে কুফরীর প্রচারের সুযোগ দেওয়া সঙ্গত বলে বিবেচিত হতে পারে না। কারণ ইসলামের প্রাথমিক কালে খোলাফায়ে রাশেদীন পরবর্তী খলিফারা এই ধরনের সুযোগ দেননি।

মওদুদী মনে করেন ইসলামের মূল দৃষ্টিভঙ্গী অন্য যে কোনও ধর্মের চেয়ে আলাদা।

"ইসলাম মূলত নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গীতে মানবজাতির সামনে পথনির্দেশ উপস্থিত করে এবং পূর্ণ নিশ্চয়তার সাথে দাবী করে যে, এর নির্দেশিত পথই নিখুঁত, আর সব পথই ভ্রান্তিপূর্ণ। এতেই মানব জাতির কল্যাণ নিহিত, অন্য সব মত ও পথে তার ধ্বংস আর বিপর্যয় ছাড়া কিছুই নেই।" (প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮)

সব মানুষকে তাই ইসলামের পথে আসতে হবে অন্য সব ধর্ম পরিত্যাগ করে। এই হল মৌলবাদ। এ থেকে ইসলাম কখনো বিমুক্ত হতে পারে না। মাওলানা মওদুদী এই প্রসঙ্গে কোরানের দুটি আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়েছেন,

আর নিশ্চয়ই এ আমার সরল পথ। সুতরাং তোমরা এ-ই অনুসরণ করবে আর অন্য পথ অনুসরণ করবে না, করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। এভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন তোমরা সাবধান হও। - সুরা আনআম, ৬/১৫৩
কারণ ওরা তোমাদেরকে আগুনের দিকে ডাক দেয়। আর আল্লাহ তোমাদেরকে নিজ অনুগ্রহে জান্নাতও ক্ষমার দিকে আহ্বান করেন। - সুরা বাকারা, ২/২২১

মওদুদী মনে করেন মানব জাতিকে চিরন্তন ধ্বংসের দিকে আহ্বানকারী কুফরী মত ও পথকে ইসলাম সহ্য করতে পারে না। আগুনের যে গহীন গহ্বরের দিকে কাফের মুশরিকরা ধাবিত হচ্ছে সেদিকে অন্যদের টেনে নিয়ে যাবার খোলা লাইসেন্স অন্তত ইসলাম দিতে পারে না। তাই ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরধর্ম প্রচারের কোন বিধান থাকতে পারে না।

ক্ষমতার সাথে ইসলামের স্বাভাবিক সম্পর্ক ইসলামের জন্মলগ্ন থেকে। ইসলামে অহিংসার কোনও স্থান নেই। ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্যে সহিংস যে কোনও পথ অবলম্বন ইসলাম অনুমোদন করে। ক্ষমতা ও ইসলামের সম্পর্কের ব্যাখ্যা হল "Creed and state, faith and polity." ইসলামকে বিকশিত করতে হলে তাই সবার আগে ক্ষমতা দখল করতে হয়। ক্ষমতায় না থাকলে মুসলমানদের নিরাপত্তায় শুধু বিঘ্নিত হয় না, ইসলামও প্রসার লাভ করে না। যেখানে মুসলমানরা ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত নয় - সেখানে ইসলাম নিরাপদ নয়। এই চিন্তাধারাই হল মৌলবাদ। এ যুগের পরিভাষায় যেভাবে মৌলবাদকে ব্যাখ্যা করা হয় মুসলমানরা তা স্বীকার করে না। আধুনিক পরিভাষায় মৌলবাদ ধর্মের বিকৃতি। অপর ধর্মকে মৌলবাদ ঘৃণা করতে শেখায়। সব রকম বিদ্বেষের মন্ত্রণাদাতা মৌলবাদ। শান্তির শত্রু। মৌলবাদ হল "নারীর প্রতি কর্কশ অবজ্ঞা। নারীপুরুষের অসাম্য, রক্ষণশীল যৌন বিধানের নামে হিংস্রতা ও নারীমুক্তির বিরুদ্ধাচরণ। যুদ্ধ যেমন পরিবেশ দূষণের সহায়ক, মৌলবাদ তেমনই ঘটায় সংস্কৃতিদূষণ" - বলেছেন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী অম্লান দত্ত। (হিংসা প্রেম স্বদেশচিন্তা - অম্লান দত্ত)

অম্লান দত্ত যা বলেছেন মুসলমানরা তাই নিয়েই অহংকার করেন। পরধর্মকে ধ্বংস করতে যুদ্ধ করা ইসলামে বাধ্যতামূলক। আর সংস্কৃতি বলতে সুসভ্য মানুষ যা বোঝে - শিল্প, সংগীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য - ইসলাম তাকে মান্যতা দেয় না। কোরানে বলা হয়েছে :

"আর যারা বিভ্রান্ত তারা কবিদের অনুসরণ করে" - সুরা শোআরা, ২৬/২২৪

একটি সহিহ হদিশে আছে :
"নিশ্চয়ই ছবির শিল্পীগণ পরলোকে শাস্তি পাবে এবং তাদের বলা হবে যা তোমরা সৃষ্টি করেছ তাতে প্রাণ সঞ্চার কর"।

অন্য একটি হাদীসে দেখা যায় :
"যে গৃহে (প্রাণীর) চিত্র থাকে সে গৃহে (রহমতের) ফেরেশতা প্রবেশ করে না।" (হাদীস শরীফ, রফিকউল্লাহ, হরফ প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৭৯)

কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র, শিল্পকলা সবকিছুই ইসলামে নিষিদ্ধ। সেটাই ইসলামের মৌল বিধান। কবিতা বা চিত্রকলা ইসলামে নিষিদ্ধ হলেও কোনও সমরাস্ত্রই কিন্তু ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। তরবারি হল জেহাদের প্রতীক। তাই তা ইসলাম বিরোধী নয়।

অম্লান দত্তের যে সাহসী উচ্চারণ আমরা পাই, "ধর্মশাস্ত্রের সকল বিধান, ধর্মপুস্তকের সমস্ত বাণী সমস্তরের নয়, সমান সত্য অথবা অসত্য নয়" (সূত্র: হিংসা প্রেম স্বদেশচিন্তা), তা মেনে নিলে একজন মুসলমান আর মুসলমান থাকেন না। মুরতাদ হয়ে যান। তার বিবি তালাক হয়ে যায়।

কোরান হল আল্লাহর আইন। আর আল্লাই হলেন এই দুনিয়ার মালিক এবং শাসনকর্তা। আর ইসলাম হল আল্লাহর প্রত্যক্ষ শাসন।

ইসলামে বলা হয়েছে আল্লাহ সব ক্ষমতার অধিকারী, মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধিরূপে দুনিয়ায় এসেছে,

তিনিই পৃথিবীতে তোমাদের প্রতিনিধি করেছেন। - সুরা আনাম, ৬/১৬৫

এখানে প্রতিনিধি বলতে বুঝতে হবে শুধু মুসলমানদের, অন্য কোনও ধর্মের অনুসারীদের নয়। কাফের মুশরিক অবিশ্বাসীরা পৃথিবীতে কখনও আল্লার প্রতিনিধি হতে পারেন না। ইসলামের আবির্ভাবের পর ইহুদী-খ্রিস্টানরা আর আল্লাহর প্রতিনিধি নন, তাদের হাতে আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব থাকলেও। তাদের, পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করার গৌরব খারিজ করে দিয়েছেন আল্লাহ নিজেই। এটাই ইসলামের মৌল বিধান। ইসলামই পৃথিবীতে একমাত্র পরিপূর্ণ দ্বীন।

নিশ্চয়ই, ইসলাম আল্লাহর একমাত্র ধর্ম। - সুরা আল ইমরান, ৩/১৯

ইসলাম হল চূড়ান্ত ধর্ম। শুধু তাই নয়। ইসলাম বিজয়ীর ধর্ম। 'Islam is a religion of conquest'। ইসলামে পরাজয় বলে কিছু নেই।

এটাই মূল কথা। মূলের সাথে কোনভাবেই আপোস করা সম্ভব নয় বলেই ইসলাম মৌলবাদী ধর্ম। ইসলামের মূল 'Article of Faith' হচ্ছে আল্লাহ ও রসুলকে বিশ্বাস করা, আল্লাহর ওহী, ফেরেশতা এবং কেয়ামতে বিশ্বাস এবং আল্লাহর বিধানে বিশ্বাস ও দায়িত্ববোধ। এক চুলও বিচ্যুতি নয় এইসব মূলনীতি থেকে। এই মূলনীতির সাথে কঠিন শৃঙ্খলে আবদ্ধ যে বিশ্বাস তাই ইসলাম। একেই সাধারণভাবে মৌলবাদ বলা যায়। সেই অর্থে প্রত্যেক মুসলমানকে মৌলবাদী হতে হয়। ইসলামের এই শিক্ষা থেকেই জন্ম নিয়েছে ধর্মান্ধতা, পরধর্ম অসহিষ্ণুতা। তা থেকেই গড়ে উঠেছে ইসলামী শাসনব্যবস্থার নির্দয়তার ভিত্তি। ইসলামের দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে যার প্রতিফলন দেখা গেছে।

ইসলাম হল একমাত্র অন্তিম সত্য। Ultimate Truth এবং মুক্তির একমাত্র পথ। এই বিশ্বাসই হল মৌলবাদ। পশ্চিমবঙ্গে বিশিষ্ট মুসলিম চিন্তাবিদ হোসেনুর রহমান মনে করেন, 

এই বিশ্বাস থেকে একটি স্বতঃসিদ্ধ ধারণা জন্ম নিয়েছে : বহু সভ্যতার মধ্যে ইসলাম আর একটি সভ্যতা নয়। ইসলাম আদি ও অকৃত্রিম, যারা ইসলামি সভ্যতা ও মুসলমান মানসিকতা নিয়ে চর্চা করেছে তারা বুঝেছেন এই বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে মুসলমান বিভিন্ন সভ্যতা, সভ্যতার বিচিত্র প্রকাশ এবং মূল্যবোধ, সম্ভাবনা ও সৃজনশীলতা নিয়ে ব্যস্ত হতে পারে না। তার কাছে কোরান এবং দ্য ফাইনালিটি অব দি কোরানিক রেভেলেশন মুখ্য ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ ইসলাম আদি ও অকৃত্রিম প্রেরণা। ইসলামেই নিবদ্ধ আছে পরম, চূড়ান্ত সত্য।

এরপরেই হোসেনুর রহমান তাঁর প্রিয়তম ইসলামবিদ বিশ্ববিখ্যাত G E Von Grunebaum'র মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। আমরা তাও তুলে ধরছি -

The Muslim scene needs scrutiny with respect to its harmony with the unalterable ordinance, but not with respect to its cultural elements and the forces responsible for its birth and growth. [Islam - p. 185 সূত্র : ধর্ম দ্বন্দ্ব ও জাতীয়তাবাদ - হোসেনুর রহমান]

এইজন্যেই "কোরান ও হজরত মোহাম্মদকে নিয়ে কোন সমালোচনামূলক আলোচনা চলতে পারে না।" এই মন্তব্য হোসেনুর রহমানের। তিনি মনে করেন এজন্যেই "মুসলিম সভ্যতার কোন বৈজ্ঞানিক আলোচনা সম্ভব হয়নি। যখনই কেউ এ বিষয়ে অগ্রগামী হয়েছেন তাকে ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক কারণে বাধাপ্রাপ্ত হতে হয়েছে।"
*************************
কাজী আবদুল ওদুদ অবশ্য বলেছেন "মুক্ত বিচার-বুদ্ধির সাথে ইসলামের কিছুমাত্র বিরোধ নেই।" কিন্তু আমরা তো সেই মুক্তবিচার বুদ্ধির কথা কোথাও খুঁজে পাই না, কোরানের শিক্ষা বস্তুত কোনও মুক্ত বুদ্ধির সন্ধান দেয় না। নতমস্তকে নির্দেশ মেনে নেওয়ার বিধান দেয় শুধু।

***********************************************************

ইসলাম ও পরনারী

নারী অধিকারের ওপর কোরান নির্দেশিত ইসলামের কয়েকটি মৌলিক নীতি হল :

নারীদের উপর পুরুষের কিছু মর্যাদা আছে - সুরা বাকারা, ২/২২৮
পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ আল্লাহ এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। - সুরা নিসা, ৪/৩৪
তোমাদের মধ্যে পছন্দমত দুজন পুরুষকে সাক্ষ্য রাখবে, আর যদি দুজন পুরুষ না থাকে তবে একজন পুরুষ ও দুজন স্ত্রীকে। - সুরা বাকারা, ২/২৪২
এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান। - সুরা নিসা, ৪/১১
স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর যাদের সদুপদেশ দাও, তারপর তাদের শয্যা বর্জন কর এবং তাদের প্রহার কর। - সুরা নিসা, ৪/৩৪
তবে বিবাহ করবে (স্বাধীনা) নারীদের মধ্যে, যাকে তোমাদের ভাল লাগে, দুই, তিন অথবা চার। - সুরা নিসা, ৪/৩
তোমাদের স্ত্রী তোমাদের শষ্যক্ষেত্র (স্বরূপ)। অতএব তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা গমন করতে পার। - সুরা বাকারা, ২/২২৩

তাছাড়া অসংখ্য হাদীসে নারীর মর্যাদার অবনয়ন এবং তার সামাজিক অক্ষম অবস্থানের কথা বলা হয়েছে। নারীকে বলা হয়েছে, "আননেসাও হাবালীতিশ শায়াতীন" অর্থাৎ "নারী শয়তানের ফাঁদ"।

একটি সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে,
দোজখীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হবে। (বুখারী, ২৫৫১।২৫৫২)

সহীহ বুখারীর অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে,
"নারী শয়তানের আকৃতি ধরে নিকটে আসে এবং শয়তানের আকৃতি ফিরে যায়।"

এই হাদীস নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছে সা'দউল্লাহ। "মাতা, ভগিনী এবং কন্যা সকলেই নারী"। এরা কি কোনো পুরুষের কাছে (অর্থাৎ পুত্র, ভ্রাতা এবং পিতার কাছে) শয়তানের রূপ ধরে আসে? (সূত্র : হাদীস সাহিত্যের ইতিহাস)

আর একটি সহিহ হাদীসে রয়েছে,
"কোনও নারী অথবা কুকুর নামাজরত অবস্থায় তোমার সম্মুখ দিয়ে যায়, তাহলে তোমার এবাদত আল্লাহর কাছে পৌঁছাবে না।"

তুলনীয় আরো কয়েকটি সহিহ হাদিস:
"পুরুষের পক্ষে নারীর অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকর জিনিস আমি আমার পরে আর কিছু রেখে যাচ্ছি না,"
"নারী হল আওরাত বা আবরণীয় জিনিস। যখন সে বের হয় শয়তান তাকে চোখ তুলে দেখে।"
"অকল্যাণ রয়েছে তিন জিনিসে - নারী, বাসস্থান ও পশুতে।"

এইসব হাদীসে নারীর যে অবনমন তার কোনও তুলনা নেই। নারীকে এখানে আর মানবীরূপে চেনা যায় না। তাকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে ইতর পশুর সমপর্যায়ে। ইসলামে এই হল নারীর অবস্থান।

***********************************************************

ইসলামের অগ্রগতি : দ্বিজাতিতত্ত্বের জন্ম

কোরানে বলা হয়েছে, সেখানে কোনও অসংগতি নেই:

এ যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও হত তবে তাতে নিশ্চয়ই অনেক অসংগতির (বৈপরীত্য) কথা পেত। - সুরা নিসা, ৪/৮২

আল্লাহর কিতাবে অসংগতি থাকার কথা নয়। কোরানের প্রথম বাংলা অনুবাদকারী ভাই গিরিশচন্দ্র সেন 'ব্যাতিক্রম' শব্দটি ব্যবহার করেছেন। মাওলানা মোরাবক করীম জওহরের অনুবাদে প্রথম দিকের সংস্করণে "বৈপরীত" শব্দটি ছিল না। পরের সংস্করণে তা যুক্ত হয়েছে। ইংরেজি অনুবাদে আমরা 'Contradiction' শব্দই পাচ্ছি। 'ব্যতিক্রম', 'অসংগতি', 'বৈপরীত্য' যাই বলি কোরানে ইসলামে অবিশ্বাসীদের সাথে আচরণ নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে গ্রন্থিত যে আয়াতসমূহ পাওয়া যায়, তাতে যে পরস্পর বিরোধিতা রয়েছে তা কী আড়াল করা যায়।

তবে এই অসংগতি বা ব্যতিক্রমকে বুঝতে হবে এই আয়াত দিয়ে :

আমি যখন এক আয়াতের স্থলে অন্য এক আয়াত উপস্থিত করি তখন তারা বলে 'তুমি তো কেবল মিথ্যা উদ্ভাবনকারী'। আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেন তা তিনিই ভাল জানেন - কিন্তু ওদের অধিকাংশই জানে না। - সুরা নাহল, ১৬/১০১

কিন্তু কোন আয়াত আল্লাহ বাতিল করেছেন তা কিন্তু স্পষ্ট করে বলা নেই কোরানে। তাই বাতিল করা আয়াতের উদাহরণ যখন বার বার তুলে ধরা হয় অবিশ্বাসীদের কাছে (আয়াত ২/২৫৬ কিংবা ১০৯/৬) তাদের বিভ্রান্তি বেড়ে যায়।
*************************
দ্বি-জাতিতত্ত্বেই (Two Nation Theory) মুসলমানদের বিশ্বাস। সেটাই ওদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

মুসলমানরা ভাষা ও বর্ণের বাধা ডিঙিয়ে যেতে পারে কিন্তু ধর্মের বাধা নয়। কোরান তাদের কাছে চিরন্তন সত্য (Universal Truth)। আর মানুষ বিভক্ত দুই জাতিতে - বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী। পৃথিবীতে মুসলমানরাই একমাত্র বিশ্বাসী, অন্য সব জাতি কাফের, মুশরিক, ইহুদী, খ্রিস্টান সকলেই অবিশ্বাসীদের দলে। আল্লাহ বার বার কোরানে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন অবিশ্বাসীদের ব্যাপারে। অবিশ্বাসীরা তো কোরান বিশ্বাস করে না, তাদের সাথে মিলে কী করে এক জাতি গঠন সম্ভব।

কেবল অবিশ্বাসীরাই আমার নির্দশনাবলী অস্বীকার করে। - সুরা আনকাবুত, ২৯/৪৭
*************************
মুসলমানরা দেশে দেশে নিজেদের ছড়িয়ে দিয়েও তাদের মনোভূমিতে লালন করেছেন কোরানের ভাষা ভিত্তিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে। যে সব দেশে তারা ক্ষমতা দখল করেছেন সেখানে তারা 'দারুল ইসলাম' প্রতিষ্ঠা করলেও দেশজ সংস্কৃতিকে গ্রহণ না করে তাকে ধ্বংস করেছেন। আর যেখানে তারা শাসন ক্ষমতায় পৌঁছাতে পারেননি, সেই দেশ তাদের জন্যে হয়ে উঠেছে 'দারুণ হারব'। সেখানে তারা নিজেদের সর্বভাবেই উদ্বাস্তু করে রেখেছেন। মুসলিমরা অন্যদের সাথে মিলে কোথাও এক সাংস্কৃতিক জাতিতে (One Cultural Nation) পরিণত হননি।

ইসলাম শুধু রাজনৈতিক দ্বিজাতিতত্ত্বেই বিশ্বাসী করে তোলেনি মুসলমানদের, তাদের মনোভূমিতে সাংস্কৃতিক দ্বিজাতিতত্ত্বের বীজও বপন করে দিয়েছে।

***********************************************************

ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতা

ধর্মনিরপেক্ষতা একটি রাষ্ট্রচেতনা, রাষ্ট্রদর্শনও বলা যায়। ইংরেজির Secularism-র বাংলা অর্থ করা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা। Chamber's Dictionary-তে Secularism হল "The belief that the state morals education should be independent of religion." Oxford Dictionary বলছে, "Secularism means the doctrine that morality should be based solely on regards to the well being of the mankind in the present to the extension of all considerations drawn from belief".

অম্লান দত্ত Secularism-র অর্থ করেছে 'ইহসর্বস্বতা'। বাংলাদেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন 'ইহজাগতিকতা।' হোসেনুর রহমান বলেছেন 'লোকায়তকরণ' (Secularization)। যিনি যেভাবেই ব্যাখ্যা করুন ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে আমরা একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা বুঝতে চাই।

কিন্তু ইসলাম ধর্মনিরপেক্ষতাকে স্বীকার করে না, ইসলাম মনে করে একমাত্র আল্লাহই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের অধিকারী, মানুষ নয়। আর আল্লাহর প্রতিনিধিত্বশীল শাসন হল ইসলামী শাসন, মুসলমানের শাসন। রাষ্ট্রের শাসন কর্তৃত্ব, তার ক্ষমতা, এখতিয়ার ও অর্থসম্পদ আল্লাহ এবং মুসলমানদের আমানত, কোনও অমুসলমান কখনো মুসলমানের শাসক হতে পারে না। ইসলামে ধর্মনিরপেক্ষতার কোনও অস্তিত্ব নেই। ইসলামী মৌলবাদী চিন্তাবিদরা মনে করেন, "ধর্মনিরপেক্ষতা হল ইসলামমুক্ত শাসন। ধর্মনিরপেক্ষতা হল ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কহীনভাবে দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ইত্যাদিকে পরিচালনার মতবাদ। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হল রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি তথা সমাজে সংশ্লিষ্ট সবকিছুকে ধর্মহীন করা। ইসলামমুক্ত করা।"

মুসলমানরা তাই ধর্মনিরপেক্ষতাকে বরদাস্ত করতে পারেন না। মুসলমানদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা হল অপবিত্র শাসন, কাফেরদের (কুফরী) মতবাদ। ধর্মনিরপেক্ষতাকে স্বীকার করলে মুসলমান থাকা যায় না। তারা মনে করেন "মুমিন মুসলমান অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোনও কাফেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে পারেন না। যারা এরূপ করবে আল্লাহর সাথে তাদের কোনও সম্পর্জ থাকবে না।" তারা তুলে ধরেন কোরানের সুরা আল ইমরানের ২৮ সংখ্যক আয়াত।

মাওলানা মওদুদীর শিষ্য এবং বাংলাদেশের জামাতে ইসলামীর অবসরপ্রাপ্ত আমীর গোলাম আযম কোরানের আলোকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ব্যাখ্যা করে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, কোনও মুসলমান ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করতে পারে না। ইসলামে বিশ্বাসী কোনও মানুষের ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী থাকা স্বাভাবিক নয়। 'মুসলিম নাস্তিক' কথাটা যেমন হাস্যকর, 'ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমান' কথাটা তেমনি কৌতুকপ্রদ। তিনিও মনে করেন ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করলেই মুসলমান ইসলাম থেকে দূরে সরে যান। তিনি আর মুসলমান থাকেন না। তিনি এদের বলেছেন "বেওকুফ"।
*************************
আল্লাহ যদি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনও ধর্মকে গ্রহণ না করেন তাহলে আল্লাহর জমিনে অন্য ধর্মের অস্তিত্ব থাকাও সম্ভব নয়। তাই মুসলমানদের পবিত্র দায়িত্ব হল কাফের মুশরিকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া। মুসলমানরা মনে করেন, "ইসলাম হল সর্বমানবের জন্য সর্বকালোপযোগী সর্বাধিক কল্যাণকর একমাত্র জীবনবিধান।" এই সর্বমানবিক মমতায় সিন্গ্ধ নির্ভুল কল্যাণবার্তা।" সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া মুসলমানদের পবিত্র দায়িত্ব। এই দায়িত্ব থেকে তাদের নিষ্কৃতি নেই। অব্যাহতি গ্রহণেরও কোনও সুযোগ নেই। কারণ এটা "আল্লাহর হুকুম এবং মহানবীর উত্তরাধিকার।"

নবীর উত্তরাধিকার বহন করে, আল্লাহর নির্দেশে, মুসলমানদের আমরা এই পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি হিদ্দার যুদ্ধে, আরও কতশত যুদ্ধে। তখন মদীনা সনদের কথা কারো মনে পড়ে না। কিন্তু রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করলে এই দায়িত্বপালনের সুযোগ থাকে না। তাই কোনও মুসলমান ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করতে পারে না।

আল্লাহর সতর্কবাণী হল, মুসলমানরা যেন কোনও অবস্থাতেই কাফের, মুশরিক, ইহুদী ও নাসারাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ না করেন। ধর্মনিরপেক্ষতাকে স্বীকার করলে মানুষকে আর ধর্মপরিচয়ে দেখা যায় না। সব মানুষকে সমমর্যাদায় দেখতে হয়। একজন মোমিন মুসলমানের পক্ষে তা সম্ভব নয়। এই কারণেও এই কুফরী মতবাদ গ্রহণযোগ্য নয় মুসলমানদের কাছে। তাই ইসলামী রাষ্ট্র আল্লাহর নির্দেশ মেনে নিয়ে শুধু তাঁর মনোনীত ধর্মকেই হেফাজত করবে। অন্য কোনও ধর্ম ও মতবাদের কোনও স্থান নেই ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায়। ইসলাম ছাড়া অন্যধর্মের লালন ও সংরক্ষণও করা যাবে না ইসলামী রাষ্ট্র শাসনে। আল্লাহর রসুল এই বিধান মেনে নিয়ে আরবভূমি থেকে সব ধর্মকে উচ্ছেদ করেছেন। তাঁর উম্মতদের জন্যে সেটাই রসুলের উত্তরাধিকার।

ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী হোসেনুর রহমান মনে করেন, "সাধারণভাবে মুসলমান মানসিকতা ধর্মনিরপেক্ষতাবিমুখ।"

***********************************************************

ইসলাম ও গণতন্ত্র

রসুল মোহাম্মদের মৃত্যু ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে। তারপর খোলাফায়ে রাশেদীনের কার্যকাল,

১. হজরত আবুবকর ৬৩২ - ৩৪ খ্রি 
২. হজরত ওমর ৩৪ - ৪৪ খ্রি 
৩. হজরত ওসমান ৬৪৪ - ৫৬ খ্রি 
৪. হজরত আলী ৬৫৬ - ৬১ খ্রি 

রসুলের মৃত্যুর পর 'সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গণতান্ত্রিক; ব্যবস্থায় জনগণের সম্মতিক্রমে খলিফাদের নির্বাচন হয়েছিল বলে ইতিহাস রায় দেয় না। সহিহ মুসলিম হাদীসের এক রেওয়াতে উল্লেখ রয়েছে যে মৃত্যুর পূর্বে রসুল আবুবকরকে খলিফা মনোনীত করে ফরমান লিখে দিতে চেয়েছিলেন। [সূত্র:ল সা'দউল্লাহ : ধর্ম, রাজনীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতা, পৃ: ১৫০] কিন্তু হজরত ওমরের কারণে তা হয়ে ওঠেনি। রসুল তা করতেই পারেন। কারণ হজরত ওমরের এক প্রশ্নের উত্তরে রসুল বলেছিলেন তিনি পুরুষদের মধ্যে দুনিয়ায় আয়েশার পিতা আবুবকরকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসেন। কাজেই রসুল মৃত্যুর পর তাঁর প্রিয়তম মানুষটিকে খলিফার আসনে দেখতে চাইবেন সেটা স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু ইসলামের অপর বড় গোষ্ঠী শিয়ারা মনে করেন, নবী তাঁর মৃত্যুর পর হজরত আলীকে খলিফা হিসেবে মনোনীত করতে চেয়েছিলেন। ওমরের বিরোধিতার কারণে তা হয়নি। শিয়ারা আলী ছাড়া খোলাফায়ে রাশেদীনের অন্য তিন খলিফাকে স্বীকার করেন না। যারা করেন তারা হলেন সুন্নী। শব্দটা এসেছে সুন্না থেকে যার অর্থ হল 'রসুলের ঐতিহ্য।' 'শিয়াৎ আলী' অর্থাৎ আলীর পক্ষভুক্তরা দাবি করেন যে, 'আলী হলেন আল্লাহর বন্ধু' এবং তিনি-ই হলেন মোহাম্মদের প্রকৃত উত্তরাধিকারী। শিয়ামতে বিশ্বাসীরা কেবলমাত্র মোহাম্মদ ও বারোজন ইমামের কর্তৃত্ব স্বীকার করেন। এই বারোজন ইমামের মধ্যে আছেন আলী, ইমাম হোসেন এবং তাদের প্রত্যক্ষ বংশধরেরা। এই ইমামরা মানুষ এবং আল্লাহর মধ্যে সংযোগস্থাপন করেন বলে মনে করেন শিয়াপন্থীরা। সুন্নীরা আলীকে খলিফা বলেই মানেন, তাঁকে "আল্লাহর বন্ধু" বলে ভিন্নতর মর্যাদা দেন না। শিয়া-সুন্নী বিতর্ক রসুলের মৃত্যুর পরপর শুরু হয়।
*************************
আবুবকর কন্যা আয়েশা শুধু রসুলের পত্নী ছিলেন না, ছিলেন তাঁর প্রিয়তমা নারী, হজরত ওমরকে বলেছিলেন সে কথা মোহাম্মদ। রসুল বলেছিলেন "একমাত্র আয়েশা ছাড়া অন্য কোনও বিবির সঙ্গে অবস্থানকালে আমার প্রতি ওহী নাজিল হয়নি।" মুসলমানদের কাছ এইজন্যেই হজরত আয়েশার এত মর্যাদা।
*************************
যে 'গণতান্ত্রিক' খেলাফায়ে রাশেদীনের শাসনকাল নিয়ে এত উচ্ছ্বাস মুসলিম বিশ্বে তা গণতান্ত্রিক ছিল না। চার খলিফা ব্যক্তিমানুষ হিসেবে প্রবাদতুল্য সৎমানুষ হলেও তাঁরা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত ছিলেন না। গণতন্ত্রের ধারণাকে একবিংশ শতকে না টেনেও বলা যায় একথা।

চার খলিফাই ছিলেন রসুলের নিকটতম আত্মীয়। আবুবকর ও ওমরের কন্যার পাণিগ্রহণ করেছিলেন রসুল। ওসমান ও আলীকে করেছিলেন কন্যাদান। ওসমানকে এককন্যার মৃত্যুর পর আরেক কন্যা দিয়েছিলেন তিনি। আলী শুধু তাঁর জামাতাই নন - পিতৃব্যপুত্র ছিলেন। দুজনের একই পিতামহ। মোহাম্মদ ও আলীর ধমনীতে প্রবাহিত হত আবদুল মোত্তালেবের রক্তধারা। 
*************************
রসুল পুত্রের জনক হলে সেই পুত্র তাঁর উত্তরাধিকারী হয়ে উঠত মনে করেই নাকি আল্লাহ রসুলকে পুত্রহীন করেছিলেন। আল্লাহর যদি তাই ইচ্ছে হয় তাহলে মাত্র তিনদশক পর কী করে ইসলামের খেলাফত বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেল তার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।

রসুলের প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকার না থাকলেও তাঁর গোত্রের কর্তৃত্ব বহাল ছিল খেলাফতে। রসুল ছিলেন কোরেশ গোত্রজাত। আবুবকর-ওমর-ওসমান-আলী খলিফা চতুষ্টয়ও ছিলেন কোরেশ গোত্রের। এঁদের মধ্যে রসুল, আবুবকর -ওমর-আলী ছিলেন কোরেশ গোত্রভুক্ত হাশেম বংশের। আর ওসমান ছিলেন উমাইয়া বংশের। কোরেশরা মনে করত 'খলিফা' পদটি তারা ছাড়া অন্য গোত্রের বংশধররা অধিকার করতে পারেন না। খেলাফায়ে রাশেদীনের পর খলিফারা রাজতন্ত্র কায়েম করলেও তা কোরেশ গোত্রের বাইরে যায়নি। কোরেশ গোত্রের দুই বংশ উমাইয়া ও হাশেম বংশ ছয় শতাব্দী শাসন করেছে মুসলমানদের। কোনও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ঐতিহ্য তৈরী হয়নি খলিফাতন্ত্র থেকে।
*************************
মুসলমান যেন গণতন্ত্রে এবং সার্বজনীন মানবাধিকারে বিশ্বাস-ই স্থাপন করতে পারেন না, "The concept of human rights and democracy are alien to Islam."

***********************************************************
ইসলামী রাষ্ট্র ও অমুসলমান

ইসলামে রাজনীতি ও ধর্ম অভিন্ন। কোরানে প্রচারিত আল্লাহর নির্দেশ হল রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি - দেশের সংবিধান। আল্লাহ-ই জমিন  আশমান সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং বিশ্বচরাচরের সব সার্বভৌমত্ব আল্লাহর - মানুষের নয়। হতে পারে না। তাই সার্বভৌমত্বের সব গুণ, বৈশিষ্ট্য, সব ক্ষমতার উৎস একমাত্র আল্লাহর সত্ত্বাতেই কেন্দ্রীভূত। কোরানে হলে হয়েছে,

নিশ্চয়ই আল্লাহ যা ইচ্ছা আদেশ করেন। - সুরা মায়েদাহ, ৫/১
আল্লাহ আদেশ করেন, তাঁর আদেশ রদ করার কেউ নেই। - সুরা রাদ, ১৩/৪১

আল্লাহ কারো কাছে জবাবদিহি করেন না, মানুষকেই তাঁর কাছে জবাবদিহি করতে হয়,

তিনি যা করেন সে বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হবে না বরং ওদেরই প্রশ্ন করা হবে। - সুরা আম্বিয়া, ২১/২৩

আল্লাহ সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। তিনি যাকে মনে করেন শাস্তি দেন। যাকে ইচ্ছা মুক্তি দেন। তিনি কোনও সুপারিশ গ্রহণ করেন না।

তিনি নিজের দাসদের উপর পরাক্রমশালী, এবং তিনি প্রজ্ঞাময়, জ্ঞাতা। - সুরা আনাম, ৬/১৮

এই আল্লাহ, তাঁর কাছে সব বান্দা সমান নন। অমুসলমানদের জন্যে তাঁর আইন আলাদা।

সউদী আরবের সংবিধান হল কোরান। আলাদা কোন সংবিধান নেই ওই দেশের। আল্লাহর যে সার্বভৌমত্ব আমরা দেখলাম উল্লিখিত আয়াতসমূহে, তাতে করে স্বৈরতন্ত্রী সউদী আরবের শাসনকর্তা কী করে ইসলামের পিতৃভূমিকে শাসন করেন আমরা তা বুঝতে পারি। ইসলামী শাসকরা বল থাকেন কোরান "man made law" নয়, আল্লাহর নিজস্ব আইন। কোনও দেশের সংবিধান তার ওপরে স্থান পেতে পারে না। আল্লাহর তাঁর সংবিধানে অমুসলমানদের যে অধিকার দিয়েছেন তার বাইরে তারা কিছু পেতে পারেন না। এই মূল নীতিকে অবলম্বন করে ইসলামী রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়।

ইসলামী রাষ্ট্র নাগরিকদের দুভাগে বিভক্ত করে,
১. মুসলমান - আসল নাগরিক।
২. জিম্মি 

জিম্মিদের কথা বলতে গিয়ে মাওলানা মওদুদী তাঁর 'Islamic Law and Constitution' গ্রন্থে বলেছেন,

By Zimmis are meant all those non-Muslims who affirmed to remain loyal and obedient to the Islamic State where in they propose to live regardless of the country they were born in. For all citizens of this kind, Islam furnishes a guarantee of protection of life and limb, property and culture, faith and honour. it enforces only its law of the land on them and it gives them equal rights with Muslims in all civil matters. They are eligible for all kinds of employment except for key posts. They should be neither called upon to undertake nor can be entrusted with the responsibility of policy making. Further more, the responsibility of the defence of the state which develops exclusively and entirely on the Muslim citizens. 

মওদুদী আরো বলেছেন, 

...It is the Muslim rulers whom the Muslim have been asked to obey. Muslims alone can be the rulers in an Islamic state.

এই হল ইসলামী রাষ্ট্র শাসনব্যবস্থায় জিম্মি বা অমুসলমানদের অবস্থান; ইসলামী রাষ্ট্রের শীর্ষপদ দূরের কথা প্রশাসনের কোনও পদেই তাদের অবস্থান ইসলামসম্মত নয়। মুসলমানরা কখনো অবিশ্বাসীদের অনুগত হতে পারে না। তাদের নির্দেশ পালন তো নয়ই।

হোসেনুর রহমান তাঁর 'ধর্মসংকট' গ্রন্থে জানাচ্ছেন "বিশ্ববিখ্যাত ইসলামবিদ Gibb এবং Bowen তাঁদের প্রামাণিক গ্রন্থে Islamic Society and the West Dhimmi শীর্ষক বিরাট অধ্যায়ে বলেছেন অটোমান সাম্রাজ্যে জিম্মিদের স্বীকার করা হয় এবং "tolerated religions and ethnic minorities বলে চিহ্নিত করা হয়।"
*************************
কোনও মুসলিম দেশ জিম্মিদের নিয়ে এক জাতি (One Nation) গঠন করে না। কারণ সেটা কোরান স্বীকৃত নয়। সেটা করলে রাষ্ট্রের ইসলামী রূপ আর থাকে না। The majority (মুসলমান) and the minorities (অমুসলমান) did not fully constitute a national community. - এটাই হল মূল কথা।

ইসলামী রাষ্ট্র শাসনব্যবস্থা চলে যে আইনে তার উৎস শরীয়া। "শরীয়া সহনশীলতার কথা বলে, বলে না সহাবস্থানের কথা। বরং বিধর্মীদের হীনমানস (Inferiority) অক্ষুন্ন থাকুক এই ধারণা পোষণ করা হয়।" মন্তব্য হোসেনুর রহমানের।

শরীয়া মনে হল সহনশীলতার কথাও বলে না। ইসলামে শরীয়া আদি ও অকৃত্রিম। যার কোনও পরিবর্তন নেই। কিন্তু জিম্মিদের নিয়ে শরীয়ার ব্যাখ্যা কখনোই এক ছিল না। তাদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও সেটা মূলত ইসলামী রাষ্ট্রে তাদের গ্রহণ গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে। তাদের অধিকারের প্রশ্নে সেই মতপার্থক্য গুরুতর নয়।
*************************
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের নিজস্ব ধর্মপ্রচারের অধিকারও স্বীকৃত নয় (পূর্বেও আলোচনা করেছি আমরা)। মাওলানী মওদুদী মনে করেন।

অমুসলিমদের ধর্মপ্রচারের ব্যাপারটা অবশ্য আলাদা। এটা আমাদের ভালোভাবে বুঝে নেয়া দরকার যে, আমরা যদি একেবারে আত্মহত্যার জন্য প্রস্তুত না হই, তাহলে আমাদের দেশে অমুসলিমদের ধর্মপ্রচারের অনুমতি দিয়ে শক্তিশালী সংখ্যালঘু সম্প্রদায় গড়ে উঠতে দেওয়ার মতো নির্বুদ্ধিতার কাজ করা সংগত হবে না। (প্রাগুক্ত, পৃ:ল ৫৫-৫৬)

এখানে আর কোরান-হাদীসের কথা নেই। যা আছে তা হল হীনমন্যতা।
*************************
বিচার ব্যবস্থা

শুধু শাসনব্যবস্থায় নয় - বিচারব্যবস্থায় চরম বৈষম্য দেখা যায় ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায়, মুসলিমদের সাথে অমুসলিমদের। আরবের বিচার ব্যবস্থায় একটা মূলনীতি ছিল হত্যার বদলে মৃত্যদণ্ড। অন্য কোনও শাস্তি নয়। মোহাম্মদ এই নীতি বদলে দিলেন অমুসলিম হত্যার ক্ষেত্রে। কোনও মুসলিম যদি একজন অমুসলিমকে হত্যাও করে তাহলে সেই হত্যাকারী মুসলিমকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না। হত্যাকারী শুধু জরিমানা প্রদান করবে নিহতের পরিবার বা উত্তরাধিকারীকে। কিন্তু কোনও অমুসলিম যদি একজন মুসলিমকে হত্যা করে তাহলে তার শাস্তি অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড। অন্য কোনও শাস্তি নয়। রসুল মনে করতেন মুসলমানদের রক্তই শুধু একরকম। "Only Muslims have blood that is alike"।

বিখ্যাত ইসলামী আইনবিদ ও চিন্তাবিদ, ইবনে থিমাইয়া, ইবনে হাজম, আল শাফিঈ, ইবনে কাইয়ুম, আল জ্বাজিয়া, আল জালান, আল বুখারী - সকলেই এই নীতির সপক্ষে বলে গেছেন।

ইবনে থিমাইয়া বলেছেন,
Nothing in the law of Muhammad states that the blood for the disbeliever is equal to the blood of the Muslim because faith is necessary for equality. The people of the Covenant (Jews or Christians) do not believe in Muhammad and Islam, thus their blood and the Muslim's blood cannot be equal. These are distinctive texts which indicate that a Muslim is not to be put to death for (murdering) one of the people of the covenant or and unbeliever. But a free Muslim must be killed for a free Muslim, regardless of the race.

ইমাম আল শাফিঈ মনে করেন, 
A Muslim is not to be killed for an unbeliever.
If believer murders an unbeliever, he has to pay blood feud to the Jew or Christian which is one-third of the blood feud of the believer, though Malik says it must be one half.

নিহতের রক্তমূল্য নির্দ্ধারণে মতভেদ থাকলেও প্রতিপাদ্য হল কোনও মুসলিমকে অমুসলিম হত্যার জন্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না। "A Muslim is not to be put to death for a non-Muslim."।

কিন্তু পক্ষান্তরে কোনও মুসলিম যদি অন্য এক মুসলিমকে হত্যা করে তাহলে আরবের প্রাচীন আইনে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে। (সূত্র: "Ahkam-al Qu'ran" - The Ordinances of the Qu'ran)

ইবনে কাইয়ুম আল জ্বাজিয়া বলেছেন,
Muslim blood is alike (has tha same value). A Muslim is not to be put to death for killing an unbeliever.
(সূত্র: "Zad-al-Maad", sec III, P-124)

সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমেও অনুরূপ হাদীস দেখা যায়,
A Muslim is not to be sentenced to death for an unbeliever. (Bukhari)
A Muslim is not to be sentenced to death for one of the people of the covenant nor for a free man or a slave. (Muslim)

ইসলামে দাসত্ব প্রথা অনুমোদিত। একজন দাস যদি মুসলমানও হয় তার সাথে একজন মুক্ত মুসলমানের মর্যাদার ফারাক বিস্তর। তা অতিক্রম করা যায় না সাম্যের ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করেও। এইসব আইনের ব্যাখ্যা থেকে তা আমরা জানতে পারি।

দাস এবং আজাদ মুসলমান যে সমতুল নয় তার নির্দেশ রয়েছে কোরানেও, 
আল্লাহ একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন : একজন ক্রীতদাসের কথা ভাবো কোনও কিছুর উপরে তার কর্তৃত্ব নেই, আর ভাবো অন্য একজনের কথা যাকে আমার তরফ থেকে দেওয়া হয়েছে উৎকৃষ্ট জীবিকা, তা থেকে সে খরচ করে চলে প্রকাশ্যে এবং গোপনে - এই ডজন কি তুল্য মর্যাদার? - সুরা নাহল, ১৬/৭৫

কিন্তু হত্যাকারীর প্রশ্নে একজন দাস আবার মুসলমান হওয়ার সুবিধা পেয়ে যায়। অদ্ভুত বিধান এই বিচারব্যবস্থার। আল জালান রায় দিয়েছেন,
On the topic of punishment, whether or not a man embraces the same religion will be considered. Thus a Muslim is not to be sentenced to death, even if he is a slave and the victim was a free man, not a Muslim.

দাস এবং আজাদ মানুষের মধ্যে যত বৈষম্য থাকুক, একজন মুসলমান দাস যদি অমুসলমান কোনও আজাদ মানুষকেও হত্যা করে, তাহলে হত্যাকারী দাসের মৃত্যুদণ্ড হবে না। কারণ দাস হলেও তিনি মুসলমান।

... বিশিষ্ট ইসলামী আইনবিদ ইবনে হাজম দাবি করেছেন কোরানিক আইনের এই ব্যাখ্যা তাঁর নিজের মত নয়। রসুলের হাদীসের ওপর ভিত্তি করেই তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, একজন অমুসলমান হত্যাকারীও কীভাবে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেয়ে যায়। হত্যার মত অপরাধের পর যদি তিনি ইসলাম কবুল করেন তাহলে মৃত্যুদণ্ড তার ওপর প্রযোজ্য হবে না। আইনের এই বিধান যেন হত্যাকারীকেও আহ্বান জানাচ্ছে 'ইসলাম কবুল কর। আল্লাহ এবং রসুলকে মেনে নাও। তাহলে হত্যার মত অপরাধের শাস্তিও লঘু হয়ে যাবে।'

ইসলামী বিচারব্যবস্থার আরেক বিচিত্র দিক হল, বিচারকের আদালতে অমুসলমানদের সাক্ষ্যকে অস্বীকার করা। এই ব্যাপারেও মুসলিম আইনবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মতের খুব বেশী অমিল নেই।

মালিক ইবনে ওনস বলেছেন,
Non-Muslims testimony is not permissible at all, even against each other. of course, their testimony is not allowable against Muslims but Muslim testimony against them is acceptable.

অমুসলিম মহিলাদের সম্বন্ধে তাঁর মন্তব্য হল,
The testimony of the women of the people of the covenant is not permissible even in birth! But the testimony of the women of Muslims is acceptable provided two women testify. One woman's testimony is not acceptable.

ইমাম আল শাফীঈ মনে করেন,
The testimony of the people of the covenant is not permissible. The witness must be one who belongs to our religion and he must be a freeman not a slave. Testimony is acceptable only from our freeman who belongs to our religion.

এই মন্তব্য প্রশ্নাতীত। শুধুমাত্র একজন আজাদ মুসলমান আদালতে সাক্ষ্য দিতে পারেন, কোন দাস নয়, অমুসলমান তো নয়ই।

আল বুখারীর সহিহ হাদীসে রয়েছে,
Polytheists are not to be asked for a testimony or anything else. The testimony of the people of other religions against each other is not allowable, based on the Qur'anic saying : 'We caused enmity among them.' and because the prophet Muhammad said : 'Do not believe the people of the Book'. (Bukhari)

অমুসলিম অমুসলিমদের পক্ষে বা বিপক্ষেও সাক্ষ্য প্রদান করতে পারবেন না, কারণ, তা কোরানসম্মত নয়। রসুলের নির্দেশ তাই। কোনও অবস্থাতেই একজন অবিশ্বাসী কিংবা অংশীবাদী বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না।

... এইসব শ্রদ্ধেয় ইসলামী চিন্তাবিদদের পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য থেকে কোরান ও হাদীস সম্মত ইসলামী বিচার ব্যবস্থার যে চিত্র আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তাতে বিচার-সাম্যের কোনও চিহ্ন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় না।

***********************************************************

ইসলাম ও মানবতা

ইসলাম ধর্মানুযায়ী কোনও মুসলমান কখনো উচ্চারণ করতে পারেনা, "আমায় নইলে হে ভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে।" স্রষ্টাকে একথা বলার সাহসই নেই একজন মুসলমানের, তাকে সেই অধিকার দেওয়া হয়নি। তার জন্যে সেটা হারাম অপরাধ। ইসলামে সৃষ্টি আর স্রষ্টা অভেদ নয়। পরিপূরক নয় একে অন্যের। স্রষ্টার কোনও অংশ নয় সৃষ্টি। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন রক্ত বিন্দু থেকে (সুরা আনাক, ৯৬/২)। রসুলের প্রতি প্রথম নাজেল হয়েছিল এই ওহী, তিনি আবার অন্য একটি সুরায় বলেছেন, মাটি থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন (সুরা সাদ, ৩৮/৭৯)। আদি মানব আদমকে আল্লাহই সৃষ্টি করেছিলেন মাটি থেকে। আবার দেখা যায় আল্লাহ বলছেন মানুষের সৃষ্টি স্খলিত শুক্রবিন্দু  থেকে (সুরা নজম, ৫৩/৪৬)। পানি থেকেও মানুষকে সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে কোরানে (সুরা ফুকরান, ৫৪/২৫)। এই পানি স্খলিত শুক্রও হতে পারে। কোরানে অনেকবার বলা হয়েছে বিভিন্ন সুরার নানা আয়াতে, মানুষের সৃষ্টি জমাট রক্তবিন্দু, মাটি, স্খলিত শুক্র এবং তুচ্ছ তরল পদার্থ থেকে। মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তাঁকে উপাসনা করতে (সুরা জারিয়াত, ৫১/৫৬)। মানুষের সৃষ্টি নিয়ে কোনও তর্ক আল্লাহ পছন্দ করেন না (সুরা ইয়াসিন, ৩৬/৭৭)। এই ইসলামের মানুষ, মুসলমান। তিনি শুধু আল্লাহকে বন্দনা করতে পারেন, তাঁর প্রশংসা করতে পারে। কিন্তু তাঁকে ভালবাসা যায় না। ... কখনো পরমসখা নন। কারণ ইসলামের মৌল ধারণার তা বিরোধী। এই প্রসঙ্গে হোসেনুর রহমানের একটি মন্তব্য মনে পড়ে গেল,
"The muslim's God is all demanding, all powerful, the Almighty God."

মুসলমানের আল্লাহ কখনো "...is just like a human being, maleable, amenable, and multivoiced" হতে পারেন না।

যিনি আকাশ ও পৃথিবী ছয়দিনে সৃষ্টি করে তারপর আরশে সমাসীন হন। - সুরা আরাফ, ৭/৫৪

আল্লাহর আরশে সমাসীন নিয়ে সমগ্র কোরানে ১০টি সুরায় মোট ১৪টি আয়াত রয়েছে। 'আরশ' হল আল্লাহর সিংহাসন বা সৃষ্টি পরিচালন কেন্দ্র। (সূত্র: কোরান সূত্র - মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান)।

আল্লাহ তো "সপ্তাকাশ আর আরশের মালিক"
Lord of the seven heaven and Lord of the Glorious Throne. - সুরা মুমিনুন, ২৩/০৬

মুসলিম মানসে সর্বশক্তিমান আল্লাহ কখনো তাঁর 'আরশ' থেকে ধরার ধূলায় নেমে যাস্ট পারেন না পরমবন্ধু হয়ে।

এই যে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
"বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো
সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো।
নয়কো বনে, নয় বিজনে, নয়কো আমার আপন মনে
সবার যেথায় আপন তুমি হে প্রিয়
সেথায় আপন আমারো।

এইভাবে বিশ্বের সাথে, সর্বমানবের সাথে যুক্ত হয়ে আল্লাকে আপন করে, প্রিয়ের মত করে ভালোবাসতে পারেন না একজন মুসলমান। বিশ্ববিধাতা যে তার কাছে শুধুই একজন প্রভু, তিনি প্রিয় হবেন কী করে!

আল্লাহ শুধু মুসলমানের। তাঁর করুণা মুসলমান ছাড়া আর কারো ওপর বর্ষিত হয় না। তেমন কথা কোরানে বলা নেই। কোনও মুসলমান তাই উচ্চারণ করতে পারেন না "সবার ওপরে মানুষ সত্য"। ইসলামে যে মানবতা আছে তা খণ্ডিত। বিশ্বজনীন নয়।

***********************************************************