Wednesday, 15 May 2024

অরিজিন অফ স্পিসিস - চার্লস ডারউইন

প্রত্যেক জীব স্বাভাবিকভাবে এত দ্রুতহারে বৃদ্ধি পায় যে যদি না তারা ধ্বংপ্রাপ্ত হয়, তাহলে পৃথিবী এক জোড়া বংশধর দ্বারা শীঘ্রই পূর্ণ হবে। এমনকি মন্থরভাবে প্রজননক্ষম মানুষ পঁচিশ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে, এবং এক হাজার বছরের কম সময়ের মধ্যে আক্ষরিক অর্থে এই হারে এদের বংশধরদের দাঁড়াবার কোন জায়গা থাকবে না। লিনিয়াস গণনা করেছেন যে একটি একবর্ষজীবী উদ্ভিদ যদি কেবলমাত্র দুটি বীজ উৎপাদন করে - এভাবে এত অনুর্বর উদ্ভিদ যদি না থাকে - এবং যদি এদের চারাগাছগুলি পরের বছর দুটি উৎপাদন করে এবং যদি এইভাবে চলে, তবে কুড়ি বছরে দশ লক্ষ উদ্ভিদ জন্মাবে। সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে হাতি হচ্ছে সবচেয়ে কম প্রজননক্ষম, এবং এদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির সম্ভবপর সর্বনিম্ন হার আমি কষ্ট করে হিসেব করেছি। মোটামুটিভাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে হাতিরা ত্রিশ বছরের হলে সন্তান উৎপাদনক্ষম হয় এবং নব্বই বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে ৭৪০ থেকে ৭৫০ বছর পরে প্রায় এক শত নব্বই লক্ষ হাতি বেঁচে থাকবে, যারা প্রথম জোড়ার বংশধর।***********************************************************


Friday, 10 May 2024

প্রাগিতিহাস - মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

 ১৯৭৪ সালে কেনিয়ার উত্তরে ইথিওপিয়ায় পাওয়া গিয়েছিল একটি জীবাশ্ম যার নাম দেওয়া হয়েছিল লুসি। আমেরিকান নৃতত্ত্ববিদ ডোনাল্ড জোহানসন তখন উত্তর-পূর্ব ইথিওপিয়ার আওয়াস উপত্যকায় হাদার প্রত্নস্থলে কাজ করছিলেন। তিনি সেই সময়ে একটি বাহুর হাড়ের টুকরো পেয়েছিলেন। জোহানসন পরে বলেছিলেন, তখন তার নাড়ির স্পন্দন দ্রুত হয়ে গিয়েছিল, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এটি বানর নয়, একটি হোমানিন-এর হাড়। ওই প্রজাতির নামকরণ করা হয় 'অস্ট্রালোপিথেকাস আফারেন্সিস'। এরা হল প্রারম্ভিক হোমিনিন প্রজাতিগুলির মধ্যে একটি। 

সে সময়ে বীটলস-এর বিখ্যাত গান 'লুসি ইন টু দ্য স্কাই উইথ ডায়ামন্ডস'-এর অনুসরণে ওই জীবাশ্মের নাম দেওয়া হয় লুসি। লুসির কঙ্কাল প্রায় ৪০% সম্পূর্ণ অবস্থায় পাওয়া গেছে।

আজ থেকে প্রায় বত্রিশ লক্ষ বছর আগে লুসি মারা গেছে; তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। ও ছিল ছোট্টখাট্ট পূর্ণ নারী। শিম্পাঞ্জির মত মুখ ও দেহকাণ্ড, কিন্তু মানবের মত কোমর থেকে নিচের অংশ। ওদের মধ্যে এপ এবং মানব, উভয় বৈশিষ্ট্যই বর্তমান ছিল। ওরা দুটি পায়ে দাঁড়াতে এবং হাঁটতে পারত। আটত্রিশ থেকে ঊনত্রিশ লক্ষ বছর আগে পর্যন্ত ওরা পৃথিবীতে ছিল। পূর্ব আফ্রিকার ইথিওপিয়া, কেনিয়া, তানজানিয়াতে ওদের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। এই প্রজাতির সদস্যদের নাক ছিল চ্যাপ্টা, নিম্ন চোয়াল দৃঢ়ভাবে বেরিয়ে আসা এবং মস্তিস্ক ছিল ক্ষুদ্র। ওদের মস্তিষ্কের আয়তন ছিল ৫০০ কিউবিক সেন্টিমিটারের (সিসি) কম। ওরা খেত নরম খাবার যেমন পাতা, উদ্ভিদ, ফল।

কীভাবে লুসি মারা গেছে? ওর দেহের কিছু আঘাত দেখে অনুমান করা হয়, হয়তো বেচারি গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিল। অথবা হয়তো ওকে দ'লে মাড়িয়ে চলে গিয়েছিল শত শত পশু।
***************************************************************
মানব প্রজাতিগুলি তখন উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে পারছে, হাত দিয়ে ছোট ছোট পাথরের অস্ত্র বানাচ্ছে। তৈরি করতে শিখেছে পাথরের কুঠার। দাঁত হয়েছে ক্ষুদ্রতর। তার মগজের আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধীরে ধীরে তাদের একটি প্রজাতির দেহের গঠন হল অনেকটা আধুনিক মানুষের মত। এমনই এক মানব প্রজাতি হল 'হোমো ইরেক্টাস'। ওদের হাত ও পা ছিল আগের প্রজাতিগুলির তুলনায় আনুমানিকভাবে দীর্ঘ, অনেকটা আজকের মানুষের মত।

ওরা সেই সময়ে রীতিমত শিকার করতে শুরু করে ও খাদ্যতালিকায় আসে মাংস। নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেন যে, মানব প্রজাতিসমূহের খাদ্যাভ্যাসে মাংস আসার ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। মানব দেহের একটি অত্যন্ত মহার্ঘ অঙ্গ হল মস্তিক। এটি মানুষের দেহের ওজনের মাত্র ২% দখল করে কিন্তু একে পোষণের জন্য মোট প্রয়োজনীয় ক্যালোরির ২৫% পর্যন্ত আবশ্যক হয়। মস্তিষ্কের পর্যাপ্ত পুষ্টি পেতে মাংসের প্রয়োজনীয়তা ছিল।
***************************************************************
আফ্রিকান জন্মদাত্রী 

আফ্রিকার বাইরে পৃথিবীর বিভিন্ন গোষ্ঠীর 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ' হ্যাপ্লোগ্রুপ অনুসন্ধান করে দেখা যাচ্ছে সমস্ত মানুষের শিকড় আছে L3 হ্যাপ্লোগ্রুপে। L3 হ্যাপ্লোগ্রুপের উৎস আফ্রিকা। এই হ্যাপ্লোগ্রুপ থেকে পরিব্যক্তি অনুযায়ী বিভিন্ন শাখাপ্রশাখা বেরিয়েছে। আফ্রিকা থেকে যে মহাপরিযানের দলটি বেরিয়েছিল তাদের ছিল L3 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ' হ্যাপ্লোগ্রুপ। তাই পৃথিবীতে যে কোন মানুষের 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ' হ্যাপ্লোগ্রুপের পরিব্যক্তি ধরে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেই হ্যাপ্লোগ্রুপ একসময়ে উদ্ভূত হয়েছে L3 হ্যাপ্লোগ্রুপ থেকে। আফ্রিকায় অনেক পুরনো, যেমন L1, L2 ইত্যাদি হ্যাপ্লোগ্রুপ রয়েছে। এদের পৃথিবীর অন্য স্থানে দেখা যায় না। L3 হ্যাপ্লোগ্রুপ-এর কিছু নারী আফ্রিকা থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল বাকি বিশ্বে, আর কিছু L3 নারী আফ্রিকাতেই থেকে গিয়েছিল। শেষ দলের নারীরা গোটা বিশ্বে শেষ মহাপরিযানের অংশীদার ছিল না।

আদি হ্যাপ্লোগ্রুপ L3 থেকে প্রায় সমান্তরালভাবে M এবং N উদ্ভূত ও বিকশিত হয়েছে। আর N থেকে সরকারি উদ্ভূত হয়েছে R হ্যাপ্লোগ্রুপ। আফ্রিকার বাইরে সমস্ত আধুনিক মানুষের বংশগতির শুরু ওই M, N ও R হ্যাপ্লোগ্রুপ থেকে। দক্ষিণ এশিয়াতে ওই তিনটি হ্যাপ্লোগ্রুপই পাওয়া যায়। ইউরোপে আছে শুধু N ও R।

পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের পুরুষের ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ-র পরিব্যক্তির শৃঙ্খল ধরে মূলে যেতে গিয়ে দেখা গেছে যে, আফ্রিকার বাইরের সমস্ত পুরুষের উদ্ভব হয়েছে C, D ও F এই তিনটি হ্যাপ্লোগ্রুপ থেকে। এই তিনটি হ্যাপ্লোগ্রুপ আবার উদ্ভূত হয়েছে আফ্রিকার CT হ্যাপ্লোগ্রুপ থেকে।

বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানীরা মনে করেন যে কজন L3 হ্যাপ্লোগ্রুপযুক্ত নারী সেই সময়ে আফ্রিকা ছেড়েছিল, আফ্রিকার বাইরের সমগ্র মনুষ্য সমাজের আদি মাতা তারাই। আধুনিক গণনা অনুযায়ী L3 হ্যাপ্লোগ্রুপ উদ্ভূত হয়েছে সত্তর হাজার বছর বা তার কিছু আগে। আর M ও N হ্যাপ্লোগ্রুপ দুটি তার পরবর্তী দশ হাজার বছরের মধ্যে উদ্ভূত হয়েছে। বিজ্ঞানের যত অগ্রগতি হচ্ছে এই সময় গণনা ক্রমাগত নিখুঁত করার চেষ্টা চলছে। যেহেতু আফ্রিকার বাইরের সমস্ত মাতৃক্রমের উদ্ভব একটিমাত্র 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ' হ্যাপ্লোগ্রুপ থেকে, সেহেতু এই সফল মহাপরিযান হয়েছে মাত্র একবার। অর্থাৎ আফ্রিকার বাইরে সেই মহাপরিযানের বংশধরেরা আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন জাতিতে ভাগ হয়ে টিকে আছে। আগে যে সব পরিযান হয়েছে, সেগুলির আর কোন উত্তরসূরী নেই। কারণ আলাদা আলাদা সফল পরিযান হলে, আমরা আজকের মাতৃক্রম ধরে পিছন দিকে গেলে একাধিক হ্যাপ্লোগ্রুপের সন্ধান পেতাম। সেটা কিন্তু পাওয়া যায়নি। আবার পিতৃক্রম ধরে পিছনে গিয়েও সেই রকম একটা হ্যাপ্লোগ্রুপেরই সন্ধান পাই।
***************************************************************
আদি ভারতীয়দের জিনগত পরিচয় 

ভারত ছিল আফ্রিকা থেকে প্রাচীন মানুষের পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার পথের এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। পঁয়তাল্লিশ থেকে কুড়ি হাজার বছর আগে প্রাগৈতিহাসিক দক্ষিণ এশিয়াতে বিশ্ব জনসংখ্যার অর্ধেক বাস করত। মানুষের সেই অতি গুরুত্বপূর্ণ পরিযান সম্পর্কে জরুরি তথ্য পাওয়া সম্ভব ভারতের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ডিএনএ সিকোয়েন্স থেকে।

এই শতকের প্রথম থেকেই ভারত ও পৃথিবীর বহু জিনবিদ উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষের ডিএনএ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে তার ফলাফল প্রকাশ করছেন।

এই সমস্ত গবেষণাপত্রে দেখা যায় যে, সমগ্র ভারতীয়দের মূল 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ' হ্যাপ্লোগ্রুপ হল M ও N। N থেকে বিভিন্ন সময়ে উদ্ভূত হয়েছে R ও U হ্যাপ্লোগ্রুপ। ভারতীয়দের মধ্যে এই দুই হ্যাপ্লোগ্রুপও দেখা যায়। মাতৃক্রমের বিচারে অন্ততপক্ষে ৬০% ভারতীয় M 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ' হ্যাপ্লোগ্রুপের বিভিন্ন শাখা হ্যাপ্লোগ্রুপগুলি বহন করছে। শতাংশে কিছু বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায় দেশের অঞ্চল, জাতি, বর্ণ ইত্যাদির ওপরে। ভারতবর্ষে পরবর্তীকালে যে পরিযানগুলি হয়েছে, বাদবাকিদের মাতৃক্রমের উৎস আছে তাদের মধ্যে।

হায়দ্রাবাদের সেলুলার এবং মলিক্যুলার বায়লোজি কেন্দ্রের বিশিষ্ট জিনবিদ কুমারস্বামী থঙ্গরাজ দীর্ঘদিন ধরে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের উপজাতিদের জিনোম বিশ্লেষণের কাজে রত। থঙ্গরাজ ও তাঁর সহযোগীরা গ্রেটার আন্দামানিজ ও ওঙ্গেদের 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ', 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ' ও সার্বিক 'অটোজোমাল ডিএনএ' বিশ্লেষণ করেন। তারা ওদের মধ্যে দুই অভিনব 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ' হ্যাপ্লোগ্রুপ M31 ও M32-কে চিহ্নিত করেছেন। এই হ্যাপ্লোগ্রুপের উৎস দক্ষিণ এশিয়াতে, সম্ভবত ভারতে বলে অনুমান করা হয়েছে। প্রাচীন ওই দুই হ্যাপ্লোগ্রুপ থেকে ভারতে মহাপরিযানের সময়কালের একটা আভাস পাওয়া যায়।

আজ থেকে কমবেশি সত্তর হাজার বছর আগে একটি মাত্র তরঙ্গে, অল্প সময়ের মধ্যে, অতি দ্রুত আধুনিক মানুষ উপকূল বরাবর দক্ষিণ এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে শ্লথ পরিযান হলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৃথক নতুন হ্যাপ্লোগ্রুপ দেখা যেত। তা কিন্তু হয়নি।

২০০৭ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির জেনোগ্রাফিক প্রজেক্ট দ্বারা পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, দক্ষিণ ভারতে মাদুরাইয়ের কাছাকাছি জোথিমনিকাম গ্রামে বসবাসকারী কিছু পুরুষ C হ্যাপ্লোগ্রুপের এক বিরল জেনেটিক মার্কার M130 বহন করে। জেনেটিক মার্কার হল বিপুল ডিএনএ সিকোয়েন্সের মধ্যে একটি ঠিকানা। উল্লেখ করার মতো বিষয় হল, অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীদের মধ্যেও M130 মার্কার পাওয়া গেছে। পুরুষের 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ' হ্যাপ্লোগ্রুপের নির্দিষ্ট মার্কার থেকে তিনটি মহাদেশের মধ্যে একটি অতি প্রাচীন যোগাযোগের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এই তথ্য একইসঙ্গে ভারতীয়দের প্রাচীনতা ও ওই মহাপরিযানের সম্ভাব্য পথেরও ইঙ্গিত দেয়। সম্ভবত মাদুরাই অঞ্চল থেকে কিছু মানুষ অস্ট্রেলিয়ায় পরিযান করেছিল। তারা আদিতে এসেছিল আফ্রিকা থেকে। সম্ভবত তারা ছিল মহাপরিযান দলের সদস্য বা তার নিকট বংশধর।

পুরুষদের 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ' হ্যাপ্লোগ্রুপ ধরে বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ভারতে পিতৃক্রম অনুযায়ী সরাসরি আফ্রিকা থেকে আগত হ্যাপ্লোগ্রুপের প্রভাব তুলনায় কম, ৪০ থেকে ১০ শতাংশের বেশি নয়। এই তথ্য প্রাথমিকভাবে বিভ্রান্তিকর ঠেকে। মাতৃক্রমের দিক দিয়ে অধিকাংশ মানুষ আফ্রিকা থেকে সরাসরি আগত নারীর বংশধর, কিন্তু পিতৃক্রমের দিক দিয়ে পুরুষরা নয় কেন?

আসলে আফ্রিকা থেকে প্রথম যে মানুষ এদেশে এসেছিল ভারতে ইতিহাস সেখানেই থেমে নেই। পরে আরও পরিযান হয়েছে, হয়েছে মানুষের মিশ্রণ। সেই পরিযানগুলি হয়েছে তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক অতীতে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে। এরাও আদিতে সেই মহাপরিযান গোষ্ঠীর বংশধর। তবে এরা চলে গিয়েছিল পৃথিবীর অন্য প্রান্তে, সেখানে পরিব্যক্তির জন্য তাদের হ্যাপ্লোগ্রুপ হয়ে গেছে ভিন্ন। আবহাওয়া ও খাদ্যের জন্য দেহের আকার, বর্ণ হয়েছে আলাদা। তারা পরবর্তী পরিযানে ভারতবর্ষে আসে। ভারতবর্ষে আগমনকারী সেই পরিযানগুলিতে পুরুষ ছিল নারীদের তুলনায় অনেক বেশি। তারা ভারতে এসে এখানকার নারীদের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে নিজেদের 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ' রেখে গেছে পুরুষানুক্রমে ভারতীয় পুরুষের মধ্যে। যে কোনও কারণেই হোক সরাসরি আফ্রিকা থেকে আগত আদি ভারতীয় পুরুষেরা নবাগতদের তুলনায় কম বংশধর রাখতে সক্ষম হয়েছে - হয়তো তাদের নারীদের কোনোভাবে দখল করেছে নবাগত পুরুষদের দল। ...

সত্তর হাজার বছর আগে আধুনিক মানুষের ছোট এক দল সুদূর আফ্রিকা থেকে আরব দেশ ছাড়িয়ে সিন্ধুনদের তীরে ভারতবর্ষে প্রথম পা রেখেছিল। তারাই হল প্রাচীন ভারতের আদি অধিবাসী। জিনবিদরা সেই প্রাচীন জনগোষ্ঠীর নাম দেন 'আদি প্রাচীন দক্ষিণ ভারতের অধিবাসী শিকারী-সংগ্রাহক' বা 'Ancient Ancestral South Indian Population'। এই গ্রন্থে ওদের বলা হয়েছে 'আন্দামানি শিকারী-সংগ্রাহক', কারণ আজকের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের আদি অধিবাসী ওঙ্গে, সেন্টিনেলিজ, জারোয়ারা ওই প্রাচীন জনগোষ্ঠীর নিকটতম জেনেটিক প্রতিনিধি।
***************************************************************
জিনবিদ্যা ও আমাদের সংস্কার 

আধুনিক মানুষের উৎস আফ্রিকা। এক সময়ে শ্বেত-আধিপত্যবাদীদের এই সত্য গলাধঃকরণ করতে কষ্ট হয়েছে। তখন প্রচার করা হয়েছিল 'নিয়ান্ডারথাল'দের থেকে ইউরোপীয়দের উৎপত্তি। অর্থাৎ ওরা অন্যদের থেকে ভিন্ন। জিনবিদ্যার গবেষণায় এ দাবি ধোপে টেঁকেনি। কেননা শুধু ইউরোপে নয়, আফ্রিকার বাইরে সকল মানুষের মধ্যেই সামান্য 'নিয়েন্ডারথাল' জিন উপস্থিত আছে।

এমনকি ইংল্যাণ্ডে মিথ্যা জীবাশ্ম তৈরি করে প্রমাণের চেষ্টা হয়েছে ইংল্যাণ্ডেই ওদের উৎস। এ প্রসঙ্গে পিল্টডাউন ম্যানের কথা স্মর্তব্য। ১৯১২ সালে শখের নৃতত্ত্ববিদ চার্লস ডসন দাবি করেছিলেন তিনি এপ ও মানুষের মধ্যেকার 'মিসিং লিংক' আবিষ্কার করেছেন। জিওলজিক্যাল সোসাইটির সভাতেও ঘোষণা করা হয়েছিল যে, ওই করোটি জীবাশ্ম পাঁচ লক্ষ বছর আগের। ওই ঘোষণার মূল প্রতিপাদ্য হল - ইংরেজরা আফ্রিকা থেকে উদ্ভূত নয়, ওরা পৃথিবীর অন্য মানুষদের থেকে পৃথকভাবে ওদের দেশেই উদ্ভূত হয়েছে। তবে ১৯৫৩ সালে ধরা পড়ে যায় তার এই জালিয়াতি।

বিজ্ঞানভিত্তিক নতুন চিন্তা অনেকে সহজভাবে নিতে পারে না, তারা সত্যকে দেখতে পায় না। অথবা হয়তো দেখতে চায় না। ১৮৫৯-এ চার্লস ডারউইনের 'অন দ্য অরিজন অফ স্পিসিস' প্রকাশিত হবার পরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এসেছিল। এই সম্পর্কিত একটা বিখ্যাত ঘটনার উল্লেখ করছি, আজকে হয়তো তা অকল্পনীয় মনে হবে।

১৯২৫ সালে আমেরিকা হিলসবরোতে এক তরুণ জীববিদ্যার শিক্ষক স্কুলে ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়ান। সেই অপরাধে যুবকটির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। আবার সেই ঘটনা নিয়ে ১৯৫৫ সালে আমেরিকাতে বিখ্যাত নাটক 'ইনহেরিট দ্য উইণ্ড' মঞ্চস্থ হয়।

স্কুলশিক্ষক ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়ালে কি দেশের আইন ভঙ্গ হয়? পৃথিবীর সৃষ্টি কি মাত্র ৬,০০০ বছর আগে? বিবর্তনবাদ কি নাস্তিক্য ধর্ম? ইউরোপ, আমেরিকায় কিছুদিন আগেও এই সব প্রশ্ন ছিল। পরবর্তীকালে 'ডারউইনিজম' এক আন্দোলনের জন্ম দেয়। সৃষ্টির ধারণা বিকাশের ক্ষেত্রে তা নেয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। দেহবর্ণ ও জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানুষের চিন্তাধারাকে করে তোলে আধুনিক। 

যা কিছুতে আমরা অভ্যস্ত, তা ব্যত্যয় আমরা সহজে গ্রহণ করতে পারি না। আফ্রিকার মানুষের সঙ্গে আমরা সম্পর্কিত, এই কথা অনেক সাধারণ মানুষও মানতে চান না। তাদের প্রশ্ন আসে, আমার দেহের রঙ তো অত গাঢ় নয়? আমি কেন আফ্রিকার মানুষের উত্তরপুরুষ হব?

দেহের ও চুলের রঙ নিয়ে এক সংস্কার দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের মধ্যে আছে।

মনে পড়ে হার্পার লির যুগান্তকারী গ্রন্থ 'টু কিল এ মকিং বার্ড' বইটির কথা! আফ্রিকার কালো মানুষদের জন্য এই সেদিনও আমেরিকাতে আলাদা গির্জা রাখা হত। আমাদের পরিচ্ছন্ন আদিবাসীদের সম্পর্কে স্তেপভূমি থেকে আগত শ্বেতকায়দের দৃষ্টিভঙ্গী সুকুমারী ভট্টাচার্যের 'বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য' গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গী স্বাক্ষরিত আছে আমাদের বর্ণভেদ প্রথায়।

অথচ জিনবিদ্যার সাহায্যে বোঝা যায়, হাজার দশেক বছর আগেও আমরা সবাই কালো ছিলাম। জিনোম বিজ্ঞানের গবেষণায় দশ হাজার বছর আগের এক ব্রিটিশের মুখের প্রতিচ্ছবি নির্মাণ করা হয়েছে। তার ছিল ঘন কালো দেহবর্ণ, চুল কৃষ্ণবর্ণ, চোখ সবুজ। ওই প্রাচীন ব্রিটিশের নাম দেওয়া হয়েছে 'ছেডার ম্যান'।

ডিএনএ বিশ্লেষণ করে একটা মানুষের লিঙ্গ, চুলের রঙ, ত্বকের রঙ, বয়স, সে কোন রোগে আক্রান্ত ছিল কিনা কিংবা কোন অঞ্চল থেকে সে উদ্ভূত এবং আরও অনেক তথ্য জানা যায়। আজ থেকে মাত্র ৫,৭০০ বছর আগের ডেনমার্কের একটি মেয়ের মুখের ছবি তৈরি করা হয়েছে। মেয়েটির দেহবর্ণ ছিল কালো, চুল খয়েরি। চোখ নীল। তখনও ইউরোপের কিছু অংশের মানুষের দেহবর্ণ ছিল কালো। বেশ কয়েক হাজার বছর ধরে ধীরে ধীরে ওদের দেহবর্ণের অভিযোজন হয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।

ও থাকত বাল্টিক সাগরের তীরে এক গাঁয়ে। সেই মেয়ে ছিল ইউরোপীয় শিকারী-সংগ্রাহক গোষ্ঠীর সদস্য। মাছ ধরার কাজে সেই সময়ে ওরা বার্চ গাছের আঠা ব্যবহার করত। এই মেয়ে সেই বার্চ গাছের আঠা চিবিয়েছিল। যেখানে মেয়েটি আঠার টুকরো ফেলেছিল সেখানে বালির স্তরের নিচে সেটি আটকে সিল হয়ে গিয়েছিল। সেই আঠাতে রয়ে গেছে ওর দাঁতের দাগ আর তার সঙ্গে রয়ে গেছে ওর ডিএনএ।

সে সময়ে ওরা আঠা ব্যবহার করত জলের মধ্যে ছোট বেড়া তৈরি করতে। সেই বেড়াতে আটকে পড়া মাছ শিকার করত। আশ্চর্যজনকভাবে ওখানে কোন মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া না গেলেও আঠাতে লেগে থাকা দাঁতের দাগ থেকে বিজ্ঞানীরা সেই নারীর সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্সিং করতে পেরেছেন। আর সেই জিনোম সিকোয়েন্সিং থেকে ওই নারীর চেহারা সম্পর্কে আজকে একটা আন্দাজ করা সম্ভব হচ্ছে।

পৃথিবীতে সামগ্রিকভাবে বিজ্ঞানের, বিশেষ করে জিনবিদ্যার বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। প্রতিদিন যুগান্তকারী আবিষ্কারের কথা প্রকাশিত হচ্ছে, যা আমাদের পুরনো ধ্যানধারণাকে পাল্টে দিতে সাহায্য করে।

শীতের দেশের মানুষের রঙ হালকা হওয়ার মূল কারণ ত্বকের এক ধরনের অভিযোজন। এক সময়ে সকলের রঙ ছিল গাঢ়। তবে শীতের দেশে সূর্যের আলো কম। মানুষের ত্বক ভিটামিন-ডি সংশ্লেষ করে সূর্যালোকের সাহায্যে। কালো ত্বক সূর্যালোককে চামড়ার গভীরে ঢুকে ভিটামিন-ডি তৈরি করার পথে বাধা দেয়। যেখানে সূর্যের তেজ যথেষ্ট, সেখানে ত্বকের কালো রঙ সূর্যালোকের ক্ষতিকর ও অনাবশ্যক প্রবেশ আটকায়। কিন্তু শীতের দেশে কালো রঙ হলে মুশকিল, বিশেষ করে যদি খাদ্যে ভিটামিন-ডি কম থাকে। মনে করা হয়, যখন সবাই শিকারী-সংগ্রাহক ছিল তখন খাদ্যে ভিটামিন-ডি পরিমাণে ছিল অনেক বেশি। ওরা বিভিন্ন ধরনের মাছ, ডিম খেত। সেই সময়ে কালো চামড়া জৈবিকভাবে অসুবিধাজনক হয়নি। কিন্তু কৃষি খানিকটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পরে খাদ্যাভাস পাল্টে যায় আর তখন শীতের দেশের মানুষের চামড়ার রঙ ফ্যাকাশে হওয়া বেঁচে থাকার পূর্বশর্ত হয়ে দাঁড়ায়।

অল্প কিছুদিন আগেও, ইউরোপ ছিল কালো মানুষের দেশ। শুধু ব্রিটেন বা ডেনমার্ক নয়, অন্য দেশেও মানুষ কালো ছিল। স্পেনে সাত হাজার বছর আগের মানুষের পুনর্নির্মিত মুখ কালো রঙ ফুটিয়ে তুলেছে। গ্রিসেও তাই। সারা ইউরোপের মানুষের ফর্সা হতে কয়েক হাজার বছর লেগেছে। বর্ণের পরিবর্তন এক প্রকার অভিযোজন।
***************************************************************
আধুনিক মানুষের অনুমিত উদ্ভবকাল হল তিন লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার বছর আগে। আর কৃষিকাজ শুরু হয়েছে এগারো-বারো হাজার বছর আগে। ভাবতে অবাক লাগে, মানুষের মেয়াদকালের ৯৭% সময় সে কৃষিকাজ না করে কাটিয়েছে। দীর্ঘকাল তাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় শস্যজাত খাদ্য ছিল না।
***************************************************************
ভারতবর্ষে মানুষের মিশ্রণের প্রাথমিক ইতিহাস 

হলোসিন যুগের শুরু থেকে পূর্ব ইরানের অভিবাসীরা সিন্ধুনদের অববাহিকার দিকে চলে আসতে থাকে। তখন সারা ভারতে ছিল অবিমিশ্র 'আন্দামানি শিকারী-সংগ্রাহক'রা। ওই অঞ্চলের আদি 'আন্দামানি শিকারী-সংগ্রাহক'দের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে ইরানের অভিবাসীরা বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বসতি স্থাপন করে। এই মিশ্রণে 'প্রাচীন ইরান-সম্পর্কিত শিকারী-সংগ্রাহক 'দের পরিমাণ ছিল অনেকটা বেশি। হয়তো ওরা দেশের আদি 'আন্দামানি শিকারী-সংগ্রাহক'দের ঠেলে দিয়েছিল প্রত্যন্তে। যাহোক, সেই 'সিন্ধু নদের মিশ্র মানুষ' গড়ে তোলে তৎকালীন ভারত উপমহাদেশের প্রথম নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা - হরপ্পীয় সভ্যতা।

পরবর্তীকালে হরপ্পীয় সভ্যতা বিস্তৃত হতে লাগল উত্তর ও পশ্চিম ভারতে। সিন্ধু অঞ্চলের মিশ্র মানুষ হরপ্পীয় সভ্যতার ক্ষয়ের সময় থেকে, অথবা হয়তো আরও আগে, ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতে, দেশের পূর্ব ও দক্ষিণ প্রান্তে। দক্ষিণ ভারতে এসে ওরা সেখানকার 'আন্দামানি শিকারী-সংগ্রাহক'দের সঙ্গে আরও একবার মিশ্রিত হয়। দক্ষিণাঞ্চলে তৈরি হয় 'প্রাচীন দক্ষিণ ভারতের মিশ্র জাতি'। আজও দক্ষিণ ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যেও 'সিন্ধু নদের মিশ্র মানুষ'র প্রোফাইল পাওয়া যায়।

ডেভিড রাইখ ও তার সহকর্মীদের মডেল অনুযায়ী প্রায় ২,০০০ - ১,০০০ সাধারণ পূর্বাব্দের মধ্যে রাশিয়া/মধ্য-এশিয়ার স্তেপ অঞ্চল থেকে পশুপালকরা আসে উত্তর ভারতে। সেই দলে নারীর সংখ্যা ছিল কম। 'সিন্ধু নদের মিশ্র মানুষ' এর সঙ্গে এই নতুন অভিবাসীদের মিশ্রণে সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে তৈরি হয় 'প্রাচীন উত্তর ভারতের মিশ্র' জাতি। ওই মিশ্রণ ছিল মূলতঃ 'সিন্ধু নদের মিশ্র মানুষ' ও ইন্দো-ইউরোপীয় পশুপালকের মিশ্রণ।

তবে এখন আর 'বিশুদ্ধ' এই দুই পৃথক গোষ্ঠীর মানুষ পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ পরবর্তী সময়ে এদের নিজেদের মধ্যে আবার মিশ্রণ হয়েছে। এই দুই প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মিশ্রণে আজকের বিভিন্ন ভারতীয় জাতিগোষ্ঠীর সৃষ্টি। এছাড়াও অঞ্চল বিশেষে সংমিশ্রণ হয়েছে পরবর্তীকালে আগত বিভিন্ন আগন্তুকদের সঙ্গেও। এই মিশ্রণের অনুপাত দেশের বিভিন্ন অঞ্চল, জাতি ও বর্ণের ক্ষেত্রে ভিন্ন।

ভারতীয়দের ডিএনএ বিশ্লেষণের মূল কথা এরকম। আগের অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে যে, আমাদের 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ' আসে মায়ের দিক থেকে। সেগুলো অধিকাংশই আফ্রিকা থেকে পঁয়ষট্টি হাজার বছর আগে ভারতে আদি আগমনকারী মানুষের 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ'-এর সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত। সেই আগমনকারীদের দলে নারী ছিল, এবং তাদের উত্তরসূরী এখনও ভারতে যথেষ্ট পরিমাণে আছে। অন্যদিকে, 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ' আসে কেবল বাবার দিক থেকে। এই ডিএনএ কেবল পুরুষদের থাকে। তাদের মধ্যে আদি আগমনকারীদের 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ' পাওয়া যায় তুলনায় অনেক কম। তার মানে পরে-আসা জনগোষ্ঠীগুলির পুরুষরা পূর্বতনদের চাইতে বেশি বংশধর রেখে গেছে। কেমন করে এটা সম্ভব হল? পরে-আসা গোষ্ঠীগুলিতে পুরুষের সংখ্যা ছিল বেশি, নারী ছিল কম। পুরুষরা মাইগ্রেট করেছে আর নারীরা থেকে গেছে একই অঞ্চলে। নতুন আসা পুরুষরা কোনভাবে ভারতবর্ষের আগে-আসা গোষ্ঠীর নারীদের ওপর নিজেদের অধিকার স্থাপন করতে পেরেছে। হয়তো পুরনো গোষ্ঠীর পুরুষরা লড়াইতে হেরে পালিয়ে গেছে, বা খাদ্যাভাব হওয়ায় তাদের নারীরা নতুন 'ক্ষমতাশালী' গোষ্ঠীর পুরুষদের কাছে এসেছে।

ভারতবর্ষে পিতৃধারায় 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ'-র মূল হ্যাপ্লোগ্ৰুপগুলি হল R, H, L ও J। প্রায় ৭৭% ভারতীয় পুরুষ এই চারটি হ্যাপ্লোগ্ৰুপের অন্তর্গত। এর মধ্যে R-এর উৎস স্তেপ অঞ্চলে। আর H ও L হ্যাপ্লোগ্ৰুপের উৎস মধ্য এশিয়ার দিকে, J-এর উৎস ফার্টাইল ক্রিসেন্ট। শাহর-ই-শোকতা ও ব্যাকট্রিয়া-মার্জিয়ানা আর্কিওলজিক্যাল কমপ্লেক্সে প্রাপ্ত ২টি দেহাবশেষের 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ' বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে H1 হ্যাপ্লোগ্ৰুপ।    

এককথায়, ইরান বা পরে স্তেপ থেকে আসা দলে পুরুষ ছিল বেশি, নারী তুলনায় কম। সেই পুরুষেরা ভারতে এসে এখানকার আদি নারীদের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে পুরুষানুক্রমে নিজেদের ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ রেখে গেছে এই দেশের পুরুষদের মধ্যে।
***************************************************************
প্রায় পৌনে চার হাজার বছর আগে ওই সভ্যতা বিনষ্ট হয়েছে, কিন্তু তাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, অর্জিত জ্ঞান সবই কি নষ্ট হয়ে গেছে? 

একথা সত্য, কিছু প্রযুক্তিগত বিদ্যার ধারাবাহিকতা আর ছিল না। নগরের সেই নির্মাণ শৈলী, পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য, বন্দরনগরী, অথবা লিখিত সিল হারিয়ে গিয়েছে। এমনকি পরিকল্পিত শহর, সমকোণে মিলিত হওয়া শহুরে রাস্তাঘাট, জনস্বাস্থ্য সচেতনতা কয়েক হাজার বছরে ফিরে আসেনি। তবে গ্রামীণ যে সভ্যতা ওখানে ছিল - চাষের কাজে বলদের ব্যবহার, বিভিন্ন ধরনের গহনা, দাবা ও পাশা খেলা, মূর্তিপূজা, জীবনে গাছ ও পশুর গুরুত্ব, বলদে টানা যানবাহন, মৃৎশিল্প ও চাকার ব্যবহার, ধাতুশিল্প, নাচের মুদ্রা, সঙ্গীতের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের বাজনা ইত্যাদির ধারাবাহিকতা সম্ভবত চলেছে আজও। হরপ্পীয় সভ্যতার নাগরিক নিদর্শন আমরা উদ্ধার করেছি বটে, কিন্তু যুক্তিসঙ্গতভাবে মনে হয় নগরকে উদ্বৃত্ত খাদ্য জোগাত বিরাট গ্রামাঞ্চল। তার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নষ্ট হয়ে গেছে, কিন্তু সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা হয়তো বজায় থেকেছে বহুকাল। 

আজকে ডিএনএ তথ্য বলছে ওরা পরবর্তীকালে প্রায় সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল।

সাড়ে তিন হাজার বছর আগে নাগাদ ইউরেশিয়দের আগমনের ফলে এদেশে আসে বৈদিক সভ্যতা। এই বৈদিক সভ্যতা দিয়েছে নতুন ভাষা, তৈরি হয়েছে গ্রামভিত্তিক অর্থনীতি। কিছু ধর্মীয় জীবনচর্যা যেমন শবদাহ ও অন্যান্য অগ্নিসংস্কার এদের থেকেই এসেছে। ইতিহাসে বৈদিক সভ্যতার অবদান যতটা চর্চা করা হয়, সিন্ধু সভ্যতার কথা সেভাবে আলোচিত হয় না। যে দেশে একসময়ে এত লিখিত সিলের ব্যবহার হত, সেখানেই পরবর্তীকালে কয়েক হাজার বছর ধরে জোর দেওয়া হয় শ্রুতিতে, শোনা কথায়।
***************************************************************
ইউরোপীয় দেহাবশেষ থেকে প্রাচীন ডিএনএ বিশ্লেষণ করে গবেষকরা কতগুলি ফলাফল লিপিবদ্ধ করেন:

* রাশিয়ার নব্যপ্রস্তর যুগ ও ব্রোঞ্জ যুগের পুরুষদের দেহাবশেষে R1a বা R1b হ্যাপ্লোগ্রুপকে ১০০% জিনে চিহ্নিত করা গেছে। এদের মধ্যে য়াম্নায়া পুরুষরা R1b হ্যাপ্লোগ্রুপ বহন করেছে। এই সময়কাল হল আজ থেকে সাড়ে ন'হাজার থেকে চার হাজার সাতশো বছর আগে পর্যন্ত।

* তবে রাশিয়ার বাইরে নব্যপ্রস্তর যুগে R1b ডিএনএ-বিশিষ্ট প্রাচীন দেহাবশেষ পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ য়াম্নায়ারা আসার আগে ইউরোপে ওই বিশেষ হ্যাপ্লোগ্রুপের কোন অস্তিত্ব ছিল না। এই হ্যাপ্লোগ্রুপ রাশিয়ান স্তেপ অঞ্চলের, আর তা বাকি ইউরোপে বহন করে এনেছে য়াম্নায়ারা।

* R1a ও R1b হ্যাপ্লোগ্রুপ রাশিয়া থেকে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে পাঁচ হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার বছর আগে। এই দুটি হ্যাপ্লোগ্রুপ আজকের রাশিয়া সহ সারা ইউরোপের পুরুষদের মধ্যে সবচাইতে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়।

সহজ কথায় বললে, হ্যাপ্লোগ্রুপ R ও তার উপশাখাগুলি নব্যপ্রস্তর যুগের প্রাচীন ইউরোপে পাওয়া যায়নি। এই হ্যাপ্লোগ্রুপ ও তার শাখা য়াম্নায়াদের ইউরোপ অভিযানের পরে ওই অঞ্চলে প্রাচীন দেহাবশেষে পাওয়া যায়। অপরদিকে য়াম্নায়াদের সবাই এই জিন বহন করেছে; এর কোনও ব্যতিক্রম পাওয়া যায়নি। ওরা আসার আগে ইউরোপে এক স্থিতিশীল কৃষিভিত্তিক সমাজ ছিল। য়াম্নায়ারা ইউরোপের সেই স্থিতিশীল সমাজকে ভেঙে দিয়ে, কৃষকদের প্রতিস্থাপিত করে নিজেদের সম্প্রসারিত করেছিল। ...

... ইউরোপে বর্তমান অধিবাসীদের জিনপুলের মধ্যে অন্তত ১২% থেকে ৮৫% মানুষ প্রাচীন সেই যাযাবর পশুপালকের R1b1b2 মার্কার বহন করছে। শতাংশের বিভিন্নতা নির্ভর করছে অঞ্চলের ওপরে। তুরস্কের পূর্ব দিকে এই জিন সমাহার সবচাইতে কম, আর পশ্চিমে আয়ারল্যাণ্ডে সবচাইতে বেশী। এই নতি তৈরি হয়েছে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে।
***************************************************************
আজকের উত্তর ইউরোপীয়দের মত অতটা না হলেও য়াম্নায়াদের দেহবর্ণ ছিল বেশ হাল্কা। এটি একটি জেনেটিক রূপান্তরের (SLC24A5) ফলে হয়েছে। মজার কথা হল, নির্দিষ্ট জিনের এই রূপান্তর ইউরোপীয় ও দক্ষিণ এশীয়দের একটা অংশের মধ্যে দেখা যায়। এই রূপান্তর পাওয়া যায় উত্তর ভারত, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়াতে। তবে দক্ষিণ ভারতীয়দের মধ্যে কিন্তু রূপান্তরটি পাওয়া যায় না। পূর্ব এশীয়, অর্থাৎ চীন জাপান ইত্যাদি দেশের মানুষের বর্ণও হালকা। তবে তাদের হালকা বর্ণ কিন্তু অন্য একটি জেনেটিক রূপান্তরের ফল।
***************************************************************
ওয়াই-ক্রোমোজোমে R1a1a-Z93 ডিএনএ ভারতের উচ্চবর্ণের মধ্যে দেখা যায়। বিশেষ করে উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণদের মধ্যে এই ডিএনএ বা তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডিএনএ-র প্রাধান্য অবিসংবাদিত। মধ্য এশিয়াতেও এই ডিএনএ যথেষ্ট পাওয়া যায়। বিভিন্ন আনুষঙ্গিক তথ্যের ওপরে ভিত্তি করে বলা যায় যে, সম্ভবত আজ থেকে চার হাজার থেকে তিন হাজার আটশ বছর আগের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে R1a1a-Z93 প্রবেশ করেছে। আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়ার ব্রোঞ্জ যুগের জনগোষ্ঠী ইউরেশিয়ার পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে সম্প্রসারিত হয়েছিল।   
***************************************************************
ইন্দো-ইউরোপীয়রা ভারতে একবারে আসেনি। দলে দলে এসেছে। তাদের মধ্যে একটি দল হয়তো বেদের একটা অংশ বহন করে এনেছে। অধ্যাপিকা সুকুমারী ভট্টাচার্য মনে করেন, তারাই শেষ বৃহৎ দল।

অধ্যাপক রামশরণ শর্মা মনে করেন, ঋগ্বেদে উল্লিখিত দাস ও দস্যু হয়তো এক গোষ্ঠী নয়। দস্যুরা হরপ্পীয় সভ্যতার উত্তরসূরী। দাস হয়তো অগ্রগামী ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর অধস্তন পুরুষ। ঋগ্বেদের প্রথম দিকে দাস হত্যার কথা বিশেষ নেই, ওদের সঙ্গে আগন্তুকদের আচরণ ছিল কিছুটা সংযত। কিন্তু দস্যুদের ক্ষেত্রে তা নয়। ইন্দ্রও দাসেদের থেকে দস্যুদেরই বেশি আক্রমণ ও হত্যা করেছে। যারা যাগযজ্ঞ করে না তাদের মেরে ফেলে সেই ধনসম্পদ সকলকে বিলিয়ে দেওয়া হবে, এইরকমই আশা সকলে পোষণ করত। অনেক সময়ে তাদের পরাজিত করা হয়েছে ও গৃহকর্মে নিযুক্ত করা হয়েছে। এদের অপমানজনক অভিধায় ভূষিত করা হয়েছে, যেমন অনাস, বৃষশিপ্র, রাক্ষস, দাস, দস্যু। বৃষের মতো মোটা ঠোঁট বলে তাদের ওরা বলেছে বৃষশিপ্র।
***************************************************************
ভারতের মুসলমান সমাজ 

ভারতীয় মুসলমানরা এদেশীয় নাকি তারা দেশের বাইরে থেকে এসেছেন - এ নিয়ে বিতর্ক চলেছে বহুদিন।

২০০৭ সালে মারিয়া সি টেরেরোস ও তার সহকর্মীরা জিনবিদ্যার প্রাথমিক গবেষণায় দাবি করেন যে, ভারতীয় শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে পশ্চিম-এশিয়ার 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ'-র সুস্পষ্ট অনুপস্থিতি প্রমাণ করে তারা দেশের বাইরে থেকে আসেনি। ডিএনএ নমুনা নেওয়া হয়েছিল মূলতঃ উত্তরপ্রদেশের শিয়া ও সুন্নি গোষ্ঠীগুলি থেকে। সেই ডিএনএ বিশ্লেষণ করে মধ্য এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার হ্যাপ্লোগ্রুপের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এরপরে তারা সিদ্ধান্তে আসেন যে, ভারতীয় মুসলিমরা মাতৃক্রমের দিক দিয়ে দেশের বাইরের লোকেদের সঙ্গে নয় বরং অন্যান্য ভারতীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে তুলনীয়। তারা মাতৃক্রমে ভারতীয় বংশোদ্ভূত।

পুরুষদের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী বিভিন্ন ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ ডেটা থেকে উনি সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, ভারতীয় মুসলমানরা আঞ্চলিক প্রতিবেশী হিন্দুদের থেকে ধর্মান্তরিত। তবে ভারতীয় শিয়াদের মধ্যে আফ্রিকান ও মধ্য প্রাচ্যের 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ'-র YAP মিউটেশনের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি আছে। শিয়াদের এই মার্কার প্রমাণ করে, সম্ভবত একটা জিন প্রবাহ হয়েছিল মধ্য এশিয়া থেকে ভারতবর্ষে। এটি কিন্তু সুন্নিদের মধ্যে অনুপস্থিত।

২০১০ সালে মুথুকৃষ্ণ ঈশ্বরকণ্ঠ, জ্ঞানেশ্বর চৌবে, ক্রিস টাইলার স্মিথ, কুমারস্বামী থঙ্গরাজনদের গবেষণাতে দেখা যায় যে, মুসলিমদের জিনোমিক প্রোফাইল ভৌগোলিকভাবে পার্শ্ববর্তী অমুসলিমদের সঙ্গেই মেলে। তবে সামান্য পরিমাণে আফ্রিকা, আরব ও পশ্চিম এশিয়া থেকেও জিন এসেছে। এইগুলি হল L0a2a2 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ' এবং E1b1b1a ও J 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ'। শেষ পর্যন্ত ওরাও মারিয়া সি টোরোসাস-এর মত একই সিদ্ধান্তে এসেছেন। ভারতবর্ষে ইসলাম কোন ব্যাপক বহিরাগত জিন প্রবাহ নিয়ে প্রবেশ করেনি।

প্রায় একই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে জোনমিং ঝাও ও তার সহকর্মীদের গবেষণায়। ওরা দেশীয় শিয়াদের মধ্যে সনাক্ত করেন এক বিশেষ হ্যাপ্লোগ্রুপ E1b1b1। এটি সুন্নিদের মধ্যে পাওয়া যায় না। শিয়াদের মধ্যে এই হ্যাপ্লোগ্রুপের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, মুসলিমদের দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে জিনগত পার্থক্য আছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতীয় মুসলমানরা যদিও হিন্দু বর্ণপ্রথা অনুসরণ করে না তবে তারাও নিজস্ব সম্প্রদায়ের মধ্যেই বিবাহ সীমাবদ্ধ রাখে। অর্থাৎ সুন্নি এবং শিয়ারা নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যেই বিবাহ করতে পছন্দ করে। দেশজুড়ে মুসলমানদের নিয়ে একাধিক গবেষণায় জিনোম সিকোয়েন্সিং করে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, ভারতে ইসলামের বিস্তার মূলতঃ একটি সাংস্কৃতিক সংশ্লেষ, মুসলিম বিশ্ব থেকে জিন প্রবাহের প্রমাণ তেমন পাওয়া যায় না। ভারতীয় মুসলমানরা ক্ষত্রী, কুর্মী, ব্রাহ্মণ এবং ঠাকুরদের মতোই ভারতীয়।
***************************************************************
ডেভিড মহল প্রমুখ ২০১৮ সালে কিছু মূল জনগোষ্ঠীর ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ হ্যাপ্লোগ্রুপগুলি বিশ্লেষণ করে জেনেটিক মার্কারের সাহায্যে তাদের ভৌগোলিক উৎসকে সনাক্ত করার চেষ্টা করেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশের ৫০টি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর থেকে মোট ২৫০৪টি নমুনা সংগ্রহ করে 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ' ও 'অটোমোজাল ডিএনএ' বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ফলাফলগুলি থেকে সামগ্রিকভাবে ভারতে পিতৃক্রমের দিক দিয়ে মোট ১৪টি বিভিন্ন হ্যাপ্লোগ্রুপকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এই হ্যাপ্লোগ্রুপগুলি আবার পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মিউটেট করেছে। এইসব তথ্য বিশ্লেষণ করে ওরা কতগুলি সিদ্ধান্তে আসেন।

ভারতবর্ষে ওদের পরীক্ষিত প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর একাধিক হ্যাপ্লোগ্রুপের প্রতিনিধিত্ব আছে। এর থেকে বোঝা যায় যে, একটি সম্প্রদায়ের মধ্যেও একাধিক ভৌগোলিক উৎস থেকে আগত মানুষ আছে। যদিও মোট তথ্যভাণ্ডারে ১৪টি হ্যাপ্লোগ্রুপের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে, তবে দেশের প্রায় ৯০% মানুষই পিতৃক্রমের দিক দিয়ে মাত্র ৭টি হ্যাপ্লোগ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। এই গ্রুপগুলি হল: F, G, H, J, L, O এবং R। এদের মধ্যে আবার প্রায় ৭৭% মানুষ ৪টি বৃহত্তম হ্যাপ্লোগ্রুপের অন্তর্ভুক্ত: R, H, L এবং J।

হ্যাপ্লোগ্রুপ R - এটি ভারত ও পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান হ্যাপ্লোগ্রুপ। ৩৮.৫% মানুষ এই হ্যাপ্লোগ্রুপ বহন করে। এটি উদ্ভূত হয়েছে প্রায় ২৭ হাজার বছর আগে উত্তর এশিয়ায়। ইউরোপেরও অন্যতম প্রধান এই হ্যাপ্লোগ্রুপ। এই হ্যাপ্লোগ্রুপের উত্তরসূরীদের অধিকাংশ বিভিন্ন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় কথা বলেন। ভারতে হ্যাপ্লোগ্রুপ R আসে য়াম্নায়াদের সঙ্গে সম্পর্কিত বৈদিক সংস্কৃতভাষী ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর স্তেপভূমি থেকে আগমনের সঙ্গে।

হ্যাপ্লোগ্রুপ H - প্রায় ১৬.১% মানুষ এই হ্যাপ্লোগ্রুপের অধিকারী। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের একটি প্রাচীন হ্যাপ্লোগ্রুপ। একে ভারতীয় হ্যাপ্লোগ্রুপ হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। মূলতঃ মধ্য প্রাচ্য বা দক্ষিণ মধ্য এশিয়া থেকে প্রায় তিরিশ হাজার বছর আগে এর উৎপত্তি। এরা সম্ভবত আফ্রিকা থেকে আগত জনগোষ্ঠী, তবে ভারতে পরে প্রবেশ করে। উল্লেখ্য, প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগের শাহর-ই-শোকতা  ব্যাকট্রিয়া-মার্জিয়ানা আর্কিওলজিক্যাল কমপ্লেক্সে প্রাপ্ত ১১টি দেহাবশেষের মধ্যে ২টি ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ বিশ্লেষণ করে পাওয়া গিয়েছিল H1a1d2 হ্যাপ্লোগ্রুপ।

হ্যাপ্লোগ্রুপ L - প্রায় ১১.২% মানুষ এই হ্যাপ্লোগ্রুপের অধিকারী। এরাই হল হরপ্পীয় সভ্যতা তৈরির অন্যতম কারিগর।

হ্যাপ্লোগ্রুপ J - ১১.১% মানুষ এই হ্যাপ্লোগ্রুপের অধিকারী। প্রায় পনের হাজার বছর আগে ফার্টাইল ক্রিসেন্টে এই হ্যাপ্লোগ্রুপের সৃষ্টি।

হ্যাপ্লোগ্রুপ O - এই হ্যাপ্লোগ্রুপ মূলতঃ দেশের পূর্ব দিকে প্রবেশ করা অস্ট্রো-এশিয়াটিক ও তিব্বতি-বর্মীভাষীদের মধ্যে দেখা যায়।
***************************************************************
বাংলা ও ঝাড়খণ্ডের রাজমহল পাহাড়ে মালতো বা 'মালপাহাড়ি' ভাষা দ্রাবিড় ভাষাপরিবারের। ওরাওঁ, মালপাহাড়ি ইত্যাদিরা দ্ৰাবিড় ভাষায় কথা বলেন। এর থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, পূর্ব ভারতেও একসময় দ্রাবিড় ভাষা প্রচলিত ছিল।
***************************************************************
আধুনিক মানুষের মস্তিস্ক দশকের পর দশকের তথ্য সঞ্চয় করে রাখতে পারে, প্রয়োজন মত সেই তথ্য গোপন গহ্বর থেকে নিয়ে এসে মুহূর্তে প্রক্রিয়াকরণ করতে পারে, সেই প্রক্রিয়াজাত তথ্য বর্তমান সময়ে প্রাপ্ত কোন তথ্যের সাথে তুলনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে প্রক্রিয়াকরণ করতে পারে মূর্ত বা বিমূর্ত ভাবনা, হাইপোথিসিস, চিত্র, উপন্যাস, বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ নিগূঢ় নিয়ম।

তবে এই বিশাল মস্তিষ্কের জন্য (যার ওজন দেহ ওজনের মাত্র ২%) আমাদের মোট অক্সিজেনের ২০% দিতে হয়। আর দেহের ২০% রক্ত সঞ্চালন হয় ওই মস্তিষ্কে। দ্বিপদী প্রাণী হবার ফলে (সেই সময়ে মানবের পেলভিস ও জননপথ ছোট হয়ে গেছে), শরীর দীর্ঘ হবার ফলে এবং মস্তিষ্কের আয়তন বৃদ্ধি পাবার ফলে সবচাইতে যন্ত্রণা পায় মানুষ মা। বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে সে মারাও যেতে পারে। কারণ সরু জননপথ দিয়ে বড় মাথাওয়ালা হোমো স্যাপিয়েন্স শিশু জন্মায়। সন্দেহ নেই এই অসুবিধে সত্ত্বেও টিকে থাকার লড়াইতে বৃহৎ মস্তিস্ক মানুষকে সব অসুবিধা ছাপিয়ে অতিরিক্ত সুবিধা দিতে পেরেছিল।
***************************************************************
ইন্দো-ইউরোপীয়দের উদ্ভব ও তাদের দীর্ঘ পরিযানের পথ নিয়ে কিছু গবেষণা ইতিমধ্যেই হয়েছে। প্রাচীন ডিএনএ থেকে বিশ্লেষিত তথ্য এই গবেষণায় সাহায্য করেছে। স্তেপভূমির পোল্ট্যাভকাতে ২৭১০ সাধারণ পূর্বাব্দের এই পুরুষের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। ওই পুরুষটি ওয়াই-ক্রোমোজোম হ্যাপ্লোগ্রুপ R1a-এর এক উপশাখা R1a-Z93 বহন করেছে। এই বিশেষ হ্যাপ্লোগ্রুপটি মিউটেট করবার সামান্য পরেই পুরুষটি তা বহন করেছে। আবার R1a-Z93 হ্যাপ্লোগ্রুপ আজকে উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পাওয়া যায়। দক্ষিণ এশিয়ার ব্রোঞ্জ যুগের ফসিলে কিন্তু R1a হ্যাপ্লোগ্রুপ অনুপস্থিত ছিল। এই সব তথ্য একত্রিত করলে বোঝা যায় স্তেপভূমি থেকে R1a হ্যাপ্লোগ্রুপ বহনকারী এক গোষ্ঠীর পরিযান হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে।

আবার বিগত কয়েক বছর ধরে পূর্ব ইউরোপে ব্রোঞ্জ যুগের যে সব জীবাশ্ম পাওয়া গেছে সেখানেও ওয়াই-ক্রোমোজোম হ্যাপ্লোগ্রুপ R1a-এর উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। খেয়াল রাখতে হবে, রাশিয়ার স্তেপভূমি বা পূর্ব ইউরোপের মানুষের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাপ্ত 'আন্দামানি শিকারী-সংগ্রাহক' অথবা 'প্রাচীন ইরান-সম্পর্কিত শিকারী-সংগ্রাহক'-এর জিনোমিক প্রোফাইল পাওয়া যায় না। তাই ভারতবর্ষ থেকে পূর্ব ইউরোপে ইন্দো-ইউরোপীয়দের পরিযান হয়েছে এমন কথা বলার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

স্তেপভূমি থেকে একদিকে পূর্ব ইউরোপ অভিমুখে, অন্যদিকে এশিয়ার দক্ষিণ দিকে ইন্দো-ইউরোপীয়রা পরিযান করেছে, আর এই দক্ষিণমুখী পরিযান তাদের নিয়ে এসেছে ভারতবর্ষে। যুক্তির তীর ভারতে ইন্দো-ইউরোপীয়দের পরিযানের একটাই পথ দেখাচ্ছে। আজ থেকে চার থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে রাশিয়া থেকে ওরা এসেছে উত্তর ভারতে।

আর খেয়াল রাখতে হবে এই বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে বৈদিক সাহিত্য সাযুজ্যপূর্ণ। বিভিন্ন ভাষাতত্ত্ববিদ ও শব্দতাত্ত্বিক যে কথা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, সেই কথাই দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় আজকের জিনবিদ্যার আলোকে।     
***************************************************************
১৩৩ কোটি মানুষের এই দেশ। এই দেশের বিভিন্নতার সঙ্গে অন্য কোন দেশের তুলনা হয় না। ভারত সরকারের 'এনথ্রোপোলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া'-র 'পিপল অফ ইন্ডিয়া' প্রজেক্ট দেশের ৮৬৩৫ জনগোষ্ঠীর মধ্যে গবেষণা করে বিভিন্ন ধর্ম, সম্প্রদায়, গোত্র, বংশনাম নিয়ে এক তালিকা প্রস্তুত করে। ভারতে হিন্দু ধর্মে ৩৫৩৯টি সম্প্রদায় আছে, মুসলিমদের মধ্যে আছে ৫৮৪টি সম্প্রদায়, খৃস্টানদের মধ্যে ৩৩৯টি, শিখদের মধ্যে ১৩০, জৈন ১০০, বৌদ্ধ ৯৩। পার্সি, ইহুদি এবং আরও ৪১১টি ট্রাইবাল সম্প্রদায় আছে যারা ওপরের কোন ধর্মের সঙ্গে নিজেদের সনাক্ত করতে পারেনি। এই প্রসঙ্গে বলি,ভারতবর্ষে আছে ২২টি মূল ভাষা, আর ছোট বড় মিলিয়ে ১৯৫০০টি ভাষায় মানুষ কথা বলে।
***************************************************************

Friday, 26 April 2024

আদি ভারতীয় - টনি জোসেফ

প্রাগৈতিহাসিক ভারতে আধুনিক মানবের সংক্ষিপ্ত কালানুক্রমিক সূচি 

~ ৩,০০,০০০ বছর : মরক্কোর সাফি শহর থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জেবেল ইরহাউদ-এর এক গুহায় প্রাপ্ত আধুনিক মানুষ হোমো স্যাপিয়েন্স-এর অদ্যাবধি আবিষ্কৃত প্রাচীনতম অবশেষে বয়স।

~ ১,৮০,০০০ বছর : আফ্রিকার বাইরে প্রাপ্ত কোন আধুনিক মানুষের জীবাশ্মের বয়স - উত্তর ইজরায়েলের মিসলিয়াতে এক পাহাড়ের গায়ে।

~ ৭০,০০০ বছর আগে : জিন বিশেষজ্ঞদের গণনামতে সবচেয়ে সফল আফ্রিকা বহির্মুখী পরিযান মোটামুটি এই সময়ের আশেপাশেই হয়েছিল। এই পরিযায়ীদের 'সফল' বলার কারণ এরা আজকের আনফ্রিকীয় জনসংখ্যার সকলেরই পূর্বসূরি। (এর আগের আফ্রিকার বাইরে যাওয়া আধুনিক মানুষরা এমন কোনও বংশ বা কুলের চিহ্ন রেখে যায়নি, যা বর্তমানে শনাক্ত করা যায়।) সম্ভবত, ৭০,০০০ বছর আগের সেইসব আফ্রিকা বহির্মুখী পরিযায়ীরা দক্ষিণের পথ ধরে এগিয়ে গিয়েছিলেন যা হয়তো তাঁদের আফ্রিকা থেকে (বিশেষত, বর্তমানের এরিত্রিয়া এবং জ্বিবৌতি) লোহিত সাগরের দক্ষিণ প্রান্তস্থিত বাব-এল-মান্দেব হয়ে এশিয়ার দিকে (আধুনিক ইয়েমেন) নিয়ে এসেছিল।

~ ৬৫,০০০ বছর আগে : আফ্রিকা বহির্মুখী পরিযায়ীরা ভারতে পৌঁছলেন, আর এসেই তাঁরা বিপুল সংখ্যক আদিম মানবের সম্মুখীন হলেন। তাঁরা সম্ভবত উপ-হিমাচল অংশ দিয়ে অন্তর্দেশীয় পথে এবং সমুদ্রতীরবর্তী পথ ধরে দুটো দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন; উপমহাদেশের অন্যান্য হোমো প্রজাতি, যারা মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল তাদের থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখার জন্যই হয়তো এমনটা করা, এবং তারও পরে সেখান থেকে তাঁরা ভারতীয় উপমহাদেশ পেরিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার দিকে চলে গিয়েছিলেন।

~ ৬০,০০০ - ৪০,০০০ বছর আগে :  আফ্রিকা বহির্মুখী পরিযায়ীদের উত্তরসূরিরা মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের এই সময়কালের মধ্যে জনসংখ্যার বিস্তার ঘটায়।

~ ৪০,০০০ বছর আগে : ইউরোপের নিয়ান্ডারথালরা অবলুপ্ত হল, দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের আইবেরীয় উপদ্বীপ (আধুনিক পর্তুগাল এবং স্পেন) তাদের অন্তিম আশ্রয়স্থল হয়ে রইল।

~ ৪৫,০০০ - ২০,০০০ বছর আগে : আফ্রিকা বহির্মুখী পরিযায়ীদের উত্তরসূরি আদি ভারতীয়রা এই উপমহাদেশে মাইক্রোলিথিক প্রযুক্তির (অতিক্ষুদ্র পাথরের তৈরি যন্ত্রাদির) ব্যবহার শুরু করেন। তাঁদের জনসংখ্যা মধ্য ও পূর্ব ভারতে অবিশ্বাস্যভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। উন্নত মানবের 'সর্বাধিক সমাগম' ঘটে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে। আধুনিক মানব ক্রমে মধ্যভারত ও দাক্ষিণাত্যভূমির যে অঞ্চলটায় জড়ো এবং থিতু হতে থাকল, সেটা হয়তো বা দীর্ঘদিন ধরেই অন্যান্য হোমো প্রজাতির আশ্রয়স্থল হয়ে ছিল।

~ ১৬,০০০ বছর আগে (১৪,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) : আধুনিক মানব সাইবেরিয়া আর আলাস্কার মাঝে সংযোগকারী সেতুর মতো ভূমি বেরিঞ্জিয়া পেরোনোর পর পৌঁছল আমেরিকায়, যাকে মানুষের বাসস্থানহিসেবে অন্তিম মুখ্য মহাদেশ বলা চলে। 

~ ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : বেলুচিস্তানের বোলান পাহাড়ের পাদদেশে, বর্তমানে মেহরগড় নামে পরিচিত এক গ্রামে, এক নতুন কৃষিজাত উপনিবেশের পত্তন হয় যা ক্রমেই সিন্ধু এবং ভূমধ্যসাগরের মাঝের অংশে এই সময়ের বৃহত্তম জনবসতিগুলোর অন্যতম হয়ে ওঠে।

~ ৭০০০ - ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : জাগ্রোস অঞ্চল থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় ইরানীয় কৃষকদের অভিগমনের ফলে আদি ভারতীয়দের উত্তরসূরিদের সঙ্গে তাদের মিশ্রণ ঘটে; এই সময়েরই আশেপাশে। জিনতত্ত্ববিদদের গণনামতে এই মিশ্রণ মোটামুটিভাবে ৪৭০০ থেকে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ঘটেছিল।

~ ৭০০০ - ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : মেহরগড় অঞ্চলে যব ও গম চাষ এবং সেইসঙ্গে পোষ মানানো গবাদিপশুর ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। যদিও এই ভূমি ২৬০০ থেকে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে পরিত্যক্ত হয়। ততদিনে অবশ্য কৃষিজাত উপনিবেশ উত্তর-পশ্চিম ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল - সে সিন্ধু আর ঘাগ্গর - হাকরা নদীর উপত্যকায় হোক কিংবা গুজরাতে।

~ ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : এই সময়কালেই উচ্চ গাঙ্গেয়ভূমি অঞ্চলে অধুনা উত্তরপ্রদেশের সন্ত কবীরনগর জেলার লহুরাদেওয়াতে ধান চাষের এবং স্থায়ী বসবাসের বন্দোবস্তের প্রভূত প্রমাণ মেলে। জংলা ধান থেকে কৃষিজাত ধান উৎপাদনের এই ক্রমবিকাশের পর্যায়ের কালানুক্রম অবশ্য নিশ্চিত করে বলা যায় না, কিন্তু লহুরাদেওয়ার ব্যাপারটা একটা স্থির ইঙ্গিত দেয়, বা বলা ভালো আমাদের নিঃসন্দেহ করে, সেটা হল কৃষিকার্যে এইসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা দক্ষিণ এশিয়ার বহু জায়গাতেই একইসঙ্গে হচ্ছিল এবং মেহরগড় কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না।

~ ৫৫০০ - ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : হরপ্পা যুগের আদিভাগে, এ সময়ে ভারতের কালিবঙ্গান, রাখিগঢ়ি এবং পাকিস্তানের বনওয়ালি ও রহমান ঢেরির মতো বিভিন্ন নগরে একটু একটু করে তাদের একান্ত নিজস্ব শৈলীতে প্রাথমিক কৃষিজাত উপনিবেশগুলো গড়ে উঠছিল।

~ ৩৭০০ - ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রাথমিক কৃষিকার্যের প্রমাণ পাওয়া যেতে থাকে - পূর্ব রাজস্থান, দক্ষিণ ভারত, মধ্য ভারতের বিন্ধ্য পর্বত অঞ্চল, পূর্ব ভারত এবং কাশ্মীরের সোয়াত উপত্যকা।

~ ২৬০০ - ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : পরিণত হরপ্পাযুগে নতুন করে নির্মিত ও পুনর্নির্মিত হল বহু জনপদ, আর বহু পূর্বে বিদ্যমান জনপদ পরিত্যক্ত হল। একই ধরনের / নির্দিষ্ট লিপি, শিলমোহর, চিহ্ন তথা পরিমাপক বাটখারার প্রচলন দেখা গেল সারা অঞ্চল জুড়ে উন্নততর মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে। আদি হরপ্পাযুগ থেকে পরিণত হরপ্পাযুগের রূপান্তর প্রায় চার বা পাঁচ প্রজন্মেরও বেশি সময়, বা ১০০ থেকে ১৫০ বছর ধরে ঘটেছিল।

~ ২৩০০ - ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : ব্যাক্ট্রিয়া - মর্জিয়ানা প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্রের সময়ে অক্সাস নদীর (আমু দরিয়া নামেও পরিচিত) এবং অধুনা আফগানিস্তান, দক্ষিণ উজবেকিস্তান আর পশ্চিম তাজিকিস্তান মিলিয়ে আশেপাশের সভ্যতা। ব্যাক্ট্রিয়া - মর্জিয়ানা প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্রের হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে নিবিড় বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ছিল।

~ ২১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : কাজাখ স্তেপভূমি থেকে পাস্তোরালিস্টরা মধ্য দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে দক্ষিণাভিমুখী পরিযান করে যাদের আমরা আজ তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তান বলে জানি। এই পরিযায়ীরা  ব্যাক্ট্রিয়া - মর্জিয়ানা প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্রের উপর প্রভাব ফেলে, কিন্তু অধিকাংশ অন্য পথ ধরে দক্ষিণ এশিয়া যায় খ্রিস্টপূর্বাব্দে দ্বিতীয় সহস্রাব্দে, যেমন নিচে বর্ণিত হল (২০০০ - ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে)।

~ ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : দুটি মুখ্য পরিযানের ঢেউ ওঠে চিনদেশে তাদের মূল শিকড় - কৃষি বিপ্লবের পর তার ফলে ওঠা জনসংখ্যার ঢেউ - দক্ষিণপূর্ব এশিয়াকে নবরূপ দান করে। অস্ট্রো এশিয়াটিক ভাষা তৈরি হয়, নতুন উদ্ভিদ এবং নতুন প্রজাতির ধানের বৈচিত্র আসে ভারতে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পরে।

~ ২০০০ - ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : স্তেপভূমির পাস্তোরালিস্টদের (পশুপালক) নতুন পরিযানের ঢেউ ওঠে অনেক, মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে। ভারতীয় - ইউরোপীয় ভাষা এবং নতুন ধর্মীয় তথা সাংস্কৃতিক প্রথার উদ্ভব ঘটে।

~ ১৯০০ - ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে : হরপ্পাযুগের অন্তিম ভাগে এই সভ্যতার ক্ষয় এবং ঘটনাচক্রে অবলুপ্তি হতে দেখা যায়। প্রাথমিকভাবে দীর্ঘকালীন খরা অনাবৃষ্টিকে দায়ী করা যায়, যা পশ্চিম এশিয়ার সভ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। এমনকী মিশর ও চীনদেশকেও ছাড়েনি।
*******************************************************************
আমাদের সঙ্গে আমাদের নিকটতম বিবর্তনশীল জ্ঞাতি ভাই হোমো ইরেক্টাস, হোমো নিয়ান্ডারথালেন্সিস, ডেনিসোভান প্রভৃতিদের দ্বারা তৈরি করা যন্ত্রপাতি, সরঞ্জামের মধ্যে প্রায়ই কোনও ভিন্নতা ছিল না এবং এমন কোনও আকস্মিক মুহূর্তও ছিল না, যখন হোমো স্যাপিয়েন্সরা দুম করে এসে পড়েছিল!

এই সব হোমো প্রজাতির বিলুপ্ত সদস্যদের (হোমো স্যাপিয়েন্স হচ্ছে বর্তমানে হোমো পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য) আমাদের মতোই বড় আকারের মস্তিস্ক ছিল।

গত দশকে তো আমরা এমনকী এও জেনেছি যে, তারা জিনগতভাবে হোমো স্যাপিয়েন্স-দের যথেষ্ট কাছাকাছি ছিল। অর্থাৎ তাদের সঙ্গে আমাদের পূর্বপুরুষরা মিলিত হয়েছে এবং পরবর্তীকালে উৎপাদনক্ষম সন্তান উৎপন্ন করেছে।

এগুলো নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি কারণ আমরা এখন জানি যে, সকল অনাফ্রিকীয় হোমো স্যাপিয়েন্স বর্তমানে তাদের ডিএনএ-তে প্রায় ২ শতাংশ নিয়ান্ডারথাল-এর জিন বহন করে। আমাদের মধ্যে কিছু যেমন - মেলানেশিয়, পাপুয়ান এবং আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ার আবার ৩ থেকে ৬ শতাংশ ডেনিসোভান (অন্তিম প্রস্তর যুগে সাইবেরিয়া থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া অব্দি বিচরণ করা প্রাচীন মানবের এক অবলুপ্ত প্রজাতি) ডিএনএ বহন করে। এই জিনগত উত্তরাধিকারের জন্য, আমরা হয়তো তাদের পূর্বপুরুষ বলতে পারি, কিন্তু যাদের সঙ্গে হোমো স্যাপিয়েন্স একসময়ে হেসেখেলে দিন কাটিয়েছে, তাদেরকে সম্ভবত আমাদের বিবর্তনশীল জ্ঞাতি ভাই হিসাবে দেখাটাই যুক্তিসঙ্গত হবে। জীববিজ্ঞানের দিক দিয়ে, আমরা শুধু একটি ক্রমাগত ঘটতে থাকা নিরবিচ্ছিন্ন বিবর্তনের অংশ, যেখানে হোমো স্যাপিয়েন্স-দের ডিএনএ'র ৯৬ শতাংশ শিম্পাঞ্জিদের দ্বারা অধিকৃত।
*******************************************************************

আমাদের কি আদপেই বাইরের কোনও জায়গা থেকে আসার দরকার ছিল?

আচ্ছা আমরা কেন সবসময় ধরে নিই ভারতে আধুনিক মানুষকে বাইরের কোথাও থেকেই আসতে হয়েছে? কেন এখানেই তাদের উৎপত্তি হল না? মাত্র কয়েক দশক আগেও এটা বেশ একটা যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন বলে ভাবা যেত, কারণ আধুনিক মানুষ যে পৃথকভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে হোমো প্রজাতির প্রাচীন বা বিলুপ্ত সদস্যদের (যেমন হোমো ইরেক্টাস) যারা প্রায় ১৯ লক্ষ বছর আগে সমস্ত ইউরেশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল, তাদের থেকে বিবর্তিত হয়েছিল, সেই তত্ত্বটি তখনও জোরালো ছিল - যদিও চার্লস ডারউইন ১৮৭১ সাল নাগাদই আধুনিক মানুষের আফ্রিকীয় বংশোদ্ভূত হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তত্ত্বটি ছিল বিভিন্নভাবে বিবর্তিত জনগোষ্ঠী পরবর্তীকালে নিজেদের মধ্যে মিশ্রণ ঘটানোর ফলে এইভাবে একটি প্রজাতি হিসাবে আমাদের একত্র করতে পেরেছে, এভাবে বিভিন্ন মহাদেশে আমাদের বিভিন্ন প্রজাতিতে ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আটকানো গেছে।

তবে এই তত্ত্ব এখন আবর্জনাপাত্রে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কোনও সাচ্চা গবেষক একে কোনও সম্ভাবনা বলেই গণ্য করেন না (যদিও অতি সাম্প্রতিক কাল অবধিও অন্তত ধারণা ছিল, কিছু বিচ্ছিন্ন আস্তানা বিশেষ করে চীনের মতো জায়গা থেকে থাকতে পারে, যেখানে প্রাচীন মানুষ থেকে চীনা মানুষে একেবারে স্বাধীনভাবে এবং স্বতঃস্ফূর্ত বিবর্তন ঘটেছে)। কেন এই তত্ত্ব বাতিল হল তার পিছনে পুরাতাত্ত্বিক এবং জিনতত্ত্বগত উভয় কারণই দায়ী। আফ্রিকার জীবাশ্ম সংক্রান্ত নথি আমাদের নিকটতম আত্মীয়দের অবশিষ্টাংশে পরিপূর্ণ - ৭০ লক্ষ বছর আগে সাহেলানথ্রোপাস চ্যাডেন্সিস, ৪০ লক্ষ বছর আগে আরডিপিথেকাস র‍্যাকমিডাস, ৩৫ লক্ষ বছর আগে কেনিয়ানথ্রোপাস প্ল্যাটিওপ্স, ২৪ লক্ষ বছর আগে হোমো হ্যাবিলিস এবং ৭ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ বছর আগে হোমো হাইডেলবার্গেন্সিস - বিশ্বে আর অন্য কোনও অঞ্চল ছিল না যা আফ্রিকার সঙ্গে কোনোভাবে তুলনীয় হতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন মহাদেশে বৈচিত্র্যময় মানব উদ্ভবের বিরুদ্ধে অকাট্য যুক্তিটা আসলে ছিল জিনগত। ডিএনএ প্রমাণ আমাদের স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত করেছে যে, আফ্রিকা বহিঃস্থ সমস্ত আধুনিক মানুষ আসলে আফ্রিকা বহির্মুখী একটা মাত্র জনগোষ্ঠীর উত্তরসূরি, যারা ৭০,০০০ বছরের আশেপাশের কোনও একটা সময়ে এশিয়াতে পাড়ি জমিয়েছিল, এবং সম্ভবত এই সময়কালের মধ্যে তাদের নিকটবর্তী জিনতুতো জ্ঞাতি ভাই হোমো নিয়ান্ডারথালেন্সিস-দের সরিয়ে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছিল। সমস্ত সাম্প্রতিক গবেষণালব্ধ ফল আধুনিক মানুষের আফ্রিকীয় বংশোদ্ভূত হওয়ার স্বপক্ষেই বারবার নিশ্চয়তা দেয়। অতি সম্প্রতি এই ২০১৭ সালের জুন মাসে আমরা খবর পেলাম যে মরক্কোর সাফি শহরের থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জেবেল ইরহাউদ-এর এক গুহায় যে প্রাচীন মাথার খুলিটা পাওয়া গেছে সেটা আধুনিক মানুষ হোমো স্যাপিয়েন্সেরই, যার বয়স প্রায় ৩,০০,০০০ বছর।

যতদিন না এই জেবেল ইরহাউদের গুহা থেকে প্রাপ্ত জীবাশ্মের শ্রেণীবদ্ধকরণ এবং বয়স নির্ণয় করা হয়নি, ততদিন অবধি ইথিওপিয়ার পুরাতাত্ত্বিক স্থান ওমো কিবিশে প্রাপ্ত ১,৯৫,০০০ বছরের পুরোনো দুটো মাথার খুলিই ছিল সবচেয়ে প্রাচীন আধুনিক মানবের জীবাশ্ম। তাই জেবেল ইরহাউদের আবিষ্কার আধুনিক মানবের সূচনার ইতিহাসকে এক ঝটকায় প্রায় ১,০০,০০০ বছর পিছিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং আমরা কোথা থেকে এসেছি সেই সংশয়ের আর কিছুমাত্র অবশিষ্ট রাখেনি। যদিও জেবেল ইরহাউদের থেকে প্রাপ্ত করোটিতে আমাদের মুখাবয়বের সঙ্গে অনেক গঠনগত সাদৃশ্য আছে, তবে এর পিছনদিকটা আদিম মানবের মতো বেশ খানিকটা লম্বাটে গড়নের, তা ছাড়াও বড় বড় দাঁত রয়েছে, যা ইঙ্গিত দেয় আধুনিক মানুষ হঠাৎ করে একদিনে উৎপত্তি হয়ে পূর্ণবিকশিতরূপ পায়নি, উপরন্তু প্রায় ৩,০০,০০০ বছর ধরে একটানা চলা এক প্রক্রিয়ার ফল মাত্র।
*******************************************************************
'আফ্রিকার বাইরে' যাওয়ার সময়কাল 

এখন জেনেটিক্সের গঠনতত্ত্বটা যেহেতু মোটামুটি জানা হয়ে গেছে, চলুন পরের প্রশ্নে যাওয়া যাক : জিনতত্ত্ববিদরা কেন বলেন আফ্রিকার বাইরের সকল আধুনিক মানুষ একটিই জনগোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত, যারা আফ্রিকা মহাদেশ ছেড়ে পরিজন করেছিল?

কেনই বা তারা ৭০,০০০ বছরের কিছু আগে-পরে দলবদ্ধভাবে অভিনিষ্ক্রমণ করেছিল? কারণটা সুস্পষ্ট ও সহজবোধ্য। আপনি বিশ্বব্যাপী আফ্রিকার বাইরের মানুষের এমটিডিএনএ-র দিকে লক্ষ করলে দেখবেন, তারা সবাই L3 নামক একটিই হ্যাপ্লো গোষ্ঠী থেকে এসেছে, যার সঙ্গে আফ্রিকার সম্পর্ক গভীর! একটু ভাবুন এর আসল অর্থটা কী? আফ্রিকার বাইরের সমস্ত মানুষ সেই একজন আফ্রিকান মহিলার বংশধর, যিনি L3 এমটিডিএনএ হ্যাপ্লোগোষ্ঠীর এই ধারার সূচনা করেছিলেন! আফ্রিকায় আরও প্রায় পনেরোটি সুপ্রাচীন বংশধারা রয়েছে যেমন L0, L1, L1a এবং L1c প্রভৃতি, কিন্তু তারা কেউই বাকি দুনিয়ার জনসংখ্যা বিস্তারের জন্য দায়ী দলের অংশ নয়। বর্তমানে L3-র দুটি সরাসরি বংশধর বা উপ-হ্যাপ্লোগোষ্ঠী আছে, M এবং N, N-এর আবার নিজস্ব প্রধান উপ-হ্যাপ্লোগোষ্ঠী হল R। তাই আফ্রিকার বাইরের সমগ্র বিশ্বের জনগণ M, N বা R হ্যাপ্লো গোষ্ঠীর বংশধারার বাহক। দক্ষিণ এশিয়ায় যেমন এই তিনটি হ্যাপ্লোগোষ্ঠীর সবকটিই উপস্থিত, ইউরোপে আবার মাত্র দুটি দেখা যায়, N এবং R, M সেখানে অনুপস্থিত।

Y-ক্রোমোজোমের বংশগতির ক্ষেত্রেও ছবিটা প্রায় এক। C, D এবং F, কেবল এই তিনটি আফ্ৰিকাজাত হ্যাপ্লোগোষ্ঠী গোটা পৃথিবীর বাকি অংশকে জনাকীর্ণ করে - যারা সকলেই আবার একটি জনিতৃ হ্যাপ্লোগোষ্ঠী CT থেকে উদ্ভূত। আবার, এর মানে দাঁড়াচ্ছে, আফ্রিকার বাইরের সব মানুষই Y-ক্রোমোজোমের CT হ্যাপ্লোগোষ্ঠীর সূচনাকারী নির্দিষ্ট একজন মানুষের বংশধর। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায় আফ্রিকার আধুনিক মানুষের জনসংখ্যার মাত্র একটি উপধারা বিশ্বের বাকি অংশকে জনাকীর্ণ করেছিল। দ্বিতীয়ত, সমস্ত পরিযায়ী এমটিডিএনএ হ্যাপ্লোগোষ্ঠী L3 থেকে উদ্ভূত, অন্য কোনও হ্যাপ্লোগোষ্ঠী থেকে হয়নি। যার ফলে বলা যায় পরিযানের ঘটনাটি একবারই ঘটেছিল, বারংবার নয়। কারণ একাধিকবার পরিযান ঘটলে বর্তমান জনসংখ্যায় শুধুমাত্র L3 নয়, একটি বড় সংখ্যক এমটিডিএনএ হ্যাপ্লোগোষ্ঠীর বংশধরদের পাওয়া যেত। বহুসংখ্যক পরিযানেও সবাই একই L3 হ্যাপ্লোগোষ্ঠীর বংশধর, এমন সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

অভিবাসনের ঘটনাটি যে ৭০,০০০ বছরের কিছু আগে-পরে ঘটেছিল সেটা আমরা কীভাবে স্থির করলাম? সেটাও সহজেই বোধগম্য। মিউটেশনের হার এবং এই সময়ের জিনোম সংক্রান্ত তথ্যের সাহায্যে জিনতত্ত্ববিদরা কোনও বিশেষ হ্যাপ্লোগোষ্ঠীর উত্থানের সময়কাল গণনা করতে পারেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত অনুসারে L3-র আবির্ভাব মোটামুটিভাবে প্রায় ৭০,০০০ বছর আগে ঘটেছে। একইভাবে বলা যায়, N বংশধারার সূত্রপাত আজ থেকে প্রায় ৬১,০০০ বছর আগে এবং M-এর ক্ষেত্রে প্রায় ৪৮,০০০ বছর আগে। তাই আফ্রিকা বহির্মুখী পরিযান বিগত ৬১,০০০ বছরেরও অনেক পরে হওয়ার সম্ভাবনা নেই (অন্যথা আফ্রিকায় N বংশধারার বৃদ্ধি ঘটা উচিত ছিল, যা এক্ষেত্রে হয়নি), আবার তা ৭০,০০০ বছরের অনেক আগেও হয়নি, কারণ তাহলে আফ্রিকাতে L3 হ্যাপ্লোগোষ্ঠীর কোনও বংশধরই থাকত না, এক্ষেত্রে যা অবাস্তব।

বহির্গমনের সময়কে অনেকটা নিশ্চিতরূপে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে একে অকাট্য যুক্তি মনে হতে পারে, কিন্তু এইসব অনুমান উদ্দিষ্ট সকল হ্যাপ্লোগোষ্ঠীর 'গড়' বয়সের ভিত্তিতে গঠিত। প্রতিটি গণনার প্রকৃত সময়সীমা কমবেশি কয়েক হাজার বছর হতে পারে। তাই এটা বলা আরও যুক্তিসঙ্গত হবে যে আফ্রিকা বহির্মুখী পরিযানটি মোটামুটি ৫০,০০০ বছরের পরে এবং প্রায় ৮০,০০০ বছরের আগে কিছুতেই ঘটেনি। যদি আমরা কিছু নির্দিষ্ট জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যকে জেনেটিক বৈশিষ্ট্যর উপরে অগ্রাধিকার দিই, তাহলে আমরা এই অপেক্ষাকৃত বড় সময়সীমার পরিবর্তে বিগত অনুমানিক ৫০,০০০ থেকে ৬০,০০০ বছরের মধ্যবর্তী সময়ের একটা ছোট জানলার কাছে পৌঁছতে পারব।
*******************************************************************
একক-উৎসজাত নয়, একটি বহু-উৎসজাত সভ্যতা 

ভারত ও ইউরোপ উভয়তই, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষীরাই জনগণতাত্ত্বিক চিত্র পরিবর্তন করার মতো শেষ গুরুত্বপূর্ণ অভিবাসীদল। ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী থেকে ১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ আসা শক বা সিদিয়াবাসী, প্রায় ৪৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আসা হূণ, ৭১০ খ্রিস্টাব্দে আরব, ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে মুঘল এবং তারপর পর্তুগিজ, ফরাসি, ওলন্দাজ এবং ব্রিটিশরা অবধি - ভারতে একাধিক বিদেশি আক্রমণ ঘটেছে। কিন্তু তাদের কেউই আমাদের জনসংখ্যার চিত্রের উপর একটি সূক্ষ্ম এবং ছোট ছাপের চেয়ে বেশি কিছু রেখে যেতে পারেননি, যদিও আমাদের সংস্কৃতির উপর তাদের বিরাট প্রভাব রয়েছে। সাম্প্রতিক ডিএনএ এবং জেনেটিক্স বিজ্ঞানের সাহায্যে আমরা এখন নিশ্চিতভাবে এটা বলতে পারি। এবং ভবিষ্যতেও সম্ভবত কোনও অভিবাসন বা আক্রমণ আমাদের জনসংখ্যার চিত্র পরিবর্তন করতে পারবে না। তাই এই অধ্যায়ের নাম শেষ অভিবাসীগণ। একাধিক ঐতিহ্য এবং অভিজ্ঞতা থেকে উপাদান সংগ্রহ করে একটি অনন্য সংস্কৃতি সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের সাধারণ ইতিহাস গঠিত হয়েছে। আমরা একটি বহু-উৎসজাত সভ্যতা, কোনও একক উৎস থেকে আমাদের উৎপত্তি হয়নি।

২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কিছুকাল পরে যখন শেষ অভিবাসী, 'আর্যরা', ভারতে এসে পৌঁছেছিল, উপমহাদেশের ভারতীয়রা তার আগে থেকেই পৃথিবীর আধুনিক মানুষের অন্যতম বৃহৎ জনগোষ্ঠী ছিল (যদি সবচেয়ে বৃহত্তম নাও হয়); ইতিমধ্যেই তারা একটি কৃষি বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং তারপর একটি নাগরিক বিপ্লবেরও নেতৃত্ব দিয়েছি যা সে সময়ের বৃহত্তম সভ্যতার সৃষ্টি করেছিল; এবং উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম ... প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে একটি করে কৃষি রূপান্তরের নেতৃত্ব দান করেছিল। এটা বললে ভুল হবে না যে, হরপ্পা সভ্যতার আমলেই বর্তমান ভারতের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল।

হাজার বছর বা তারও বেশি যে সময় হরপ্পা সভ্যতার পতনের সাক্ষী ছিল সম্ভবত সেটাই দক্ষিণ এশিয়ায় আধুনিক মানব ইতিহাসের সবচেয়ে অশান্ত এবং আন্দোলিত সময় ছিল। কিন্ত এই বিষয়ে আমাদের কাছে খুব সামান্যই তথ্য আছে বলে এ নিয়ে জানার সুযোগও কম। যা ঘটেছে তার দিকে একবার তাকানো যাক দীর্ঘদিন ধরে চলা এক সভ্যতা, নিজের সময়ের বৃহত্তম, দীর্ঘকালীন খরার দাপটে বিধ্বস্ত, এবং তার সর্বাধিক দৃশ্যমান ক্ষমতা এবং খ্যাতির প্রতীকগুলির ধীরে ধীরে অবলুপ্তি, এমনকী নাগরিকতাবাদও নিজেই তার অস্তিত্ব বিপন্ন করেছিল; মানুষের একটি নতুন জীবন অনুসন্ধানে পূর্ব এবং দক্ষিণে স্থানান্তরিত হওয়া; উত্তর-পশ্চিম থেকে আগত অভিবাসীদের একটি নতুন ধারা, নতুন ভাষা এবং একটি ভিন্ন সংস্কৃতি নিয়ে আসা যেখানে বলিদান প্রথার মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং পশুপালনে অগ্রাধিকার এবং শহুরে বসতি স্থাপনের চেয়ে গবাদি পশুর প্রজননের উপর অধিক জোর দেওয়া হত; উত্তর-পূর্ব দিক থেকে অভিবাসীদের অন্য একটি দল এসেছিল, তারাও নতুন ভাষা, নতুন গৃহ উৎপাদিত উদ্ভিদ এবং সম্ভবত জলাভূমি চাষের কৌশল এবং ধানের একটি নতুন প্রজাতি নিয়ে আসে ... এবং এভাবেই ভারতীয় সংস্কৃতির পাত্রটি পরিপূর্ণ হয়ে ফুটতে আরম্ভ করে। চার হাজার বছর পরে, এটি এখনও ঢিমে আঁচে ফুটছে, মাঝে-মাঝেই ইহুদী থেকে সিরিয়াবাসী থেকে পার্সীদের মতো নতুন নতুন উপাদান যোগ করা হচ্ছে।
*******************************************************************
ঐতিহাসিক রোমিলা থাপারকে উদ্ধৃত করে বলা যায় :

নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মূল্যায়ন করার সময়ে আমরা প্রায়শই ভুলে যাই বা খেয়াল রাখি না যে, যুক্তিবাদিতা এবং সংশয়বাদ মূলত প্রাচীন ভারতীয় চিন্তাধারারই একটি অংশ ছিল। এটি শুধু চার্বাক বা লোকায়ত চিন্তাবিদদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। দর্শনের অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন বৌদ্ধ ও জৈন চিন্তাধারাতেও এর প্রভাব লক্ষণীয়। আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রশ্ন করার একটি সহজাত ক্ষমতা পেয়েছি, যা স্রেফ দার্শনিক চিন্তাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং জনপ্রিয় সাহিত্যেও স্পষ্টভাবে দ্রষ্টব্য। সেই ঐতিহ্যকে লালন করাই সমুচিত কাজ হবে।
*******************************************************************
ভারতীয় হিসাবে আমরা হয়তো একই ইতিহাসের অধিকারী, তবে বিভিন্ন প্রান্তের বিচারে আমাদের কিছু আলাদা অভিজ্ঞতাও হয়েছে। একদিকে দক্ষিণ এবং পূর্ব ভারত আর অন্যদিকে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের মধ্যে রাজনৈতিক এমনকী খাওয়াদাওয়ার অভ্যাসের মধ্যেও যে পার্থক্য রয়েছে, সেটাই এইসব অঞ্চলের মধ্যে ফারাকের প্রতিচ্ছবি এবং তাদের মধ্যে কিছু কিছু সুপ্রাচীন।

উদাহরণস্বরূপ, আমাদের খাদ্যাভাসকেই ধরা যাক। এটা স্পষ্ট যে উত্তর ভারতীয় এবং পশ্চিম ভারতীয়রা পূর্ব ভারতীয় বা দক্ষিণ ভারতীয়দের তুলনায় দুধ এবং দুধজাত খাবার অনেক বেশি আর মাছ মাংস অনেক কম খান। রাজনীতিবিদ এবং ধারাবিবরণকাররা প্রায়শই এই পার্থক্যগুলিকে প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক-রাজনৈতিক হিসাবে দেখেন। তবে এগুলির আরও একটি মৌলিক কারণ রয়েছে : জিন। অথবা আরও বিশদে বললে, প্রায় ৭৫০০ বছর আগে ইউরোপে উৎপন্ন 13910T নামক একটি জিনের পরিব্যক্তি (মিউটেশন)। এই জিন মানব শরীরকে শৈশব পেরিয়ে, পরিণত বয়সে দুধ হজম করতে সাহায্য করে। গোটা বিশ্বে হোমো স্যাপিয়েন্স এই ক্ষমতা অর্জনকারী একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কারণ মানুষেরা গবাদিপশু বা ছাগল পালন এবং তাদের দুধের জন্য ব্যবহার করতে শিখে নেওয়ার আগে, এ জাতীয় মিউটেশনের কোনও প্রয়োজনীয়তা ছিল না। কিন্তু একবার তারা গবাদি পশুপালন শুরু করার পর, প্রাপ্তবয়স্কদের দুধ হজম করার ক্ষমতা অর্জন ভীষণভাবে দরকারি হয়ে পড়েছিল। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খাপ খেয়ে যাওয়ার মতো একটি পরিব্যক্ত জিন বিবর্তনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছিল।

পরিণত বয়সেও দুধ হজম করার ক্ষমতা একাধিকবার অভিযোজিত হয়েছিল; বিশ্বের চারটি ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে। তবে 13910T নামক ইউরোপীয় মিউটেশনটির ব্যাপারে আমরা বিশেষ আগ্রহী। কারণ প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে দুধ খাওয়া ও হজম করার ক্ষমতাধারী অধিকাংশ ভারতীয়রা জিনের এই ইউরোপীয় সংস্করণটিরই বাহক। দেশব্যাপী সমস্ত প্রধান ভাষাগোষ্ঠী এবং প্রধান অঞ্চল থেকে ডিএনএ নমুনা বিশ্লেষণ করে ভারতে ল্যাকটেজের স্থায়িত্ব (শৈশবের পরে দুধ হজম করার ক্ষমতার জন্য প্রযুক্তিগত শব্দবন্ধ) বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে একাধিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেছে, যার মধ্যে তিনটি নিম্নরূপ প্রথমত, ভারতে এর বিন্যাসের ধরণটি উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটি স্থির অবনতির পথ ধরেছে। দ্বিতীয়ত, মিউটেশনটি ইউরোপীয়দের সঙ্গে অভিন্ন। তৃতীয়ত, প্রাপ্তবয়সে ভারতীয়দের মধ্যে মাত্র এক-পঞ্চমাংশ দুধ খেয়ে হজম করতে পারেন, তার মধ্যে পশ্চিম এবং উত্তর ভারতের লোকেরাই সর্বাধিক। পশ্চিম এবং উত্তর ভারতের অঞ্চলগুলিতে এই জিনের প্রাপ্তির হার ৪০ শতাংশের বেশি হলেও দক্ষিণ-পূর্ব ভারতে তা ১ শতাংশেরও কম।

সুতরাং এর থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পূর্ব ভারতীয় বা দক্ষিণ ভারতীয়রা কেন উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয়দের তুলনায় অনেক কম পান করেন। উদ্দিষ্ট জিনটি থাকুক বা না থাকুক, প্রাপ্তবয়সে তাদের অনেকেই দুধ হজম করতে অক্ষম। যাঁদের এই জিন আছে আর যাঁদের নেই, তাঁদের মধ্যে প্রধান ফারাকটা হল, এই জিনের অধিকারীরা সারাজীবন ধরে স্বচ্ছন্দে দুধ পান এবং হজম করে যেতে পারবেন; আর যাঁদের তা নেই, তাঁরা নিজেদের জন্মের প্রথম বছর থেকে সাবালকত্ব অর্জনের মধ্যে যে কোনও সময়ে এই ক্ষমতা হারাবেন।

এর সঙ্গে একদিকে উত্তর ও পশ্চিম এবং অন্যদিকে দক্ষিণ ও পূর্বের মধ্যে নিরামিষাশী আহার বা মাছ মাংস খাওয়ার অভ্যাসের পার্থক্যের কী সম্পর্ক? সহজভাবে বলা যায়, জিনের মিউটেশন সেই ভারতীয়দের প্রাপ্তবয়সে মাংস বা মাছের বিকল্প প্রাণীজ প্রোটিন উৎস হিসাবে দুধ হজম করার ক্ষমতা দিয়েছে। যা তাদের অনেকেই গ্রহণ করেছেন বলে মনে হয়। জাতীয় নমুনা জরিপ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবারভিত্তিক খাদ্য ব্যয়ের সমীক্ষা থেকে এই পরিসংখ্যানগুলি পাওয়া গেছে। তথ্যাদি থেকে স্পষ্টভাবে দেখা যায়, অত্যধিক দুধ সেবনকারী রাজ্যগুলি অনেক কম মাছ, মাংস, ডিম খায়। অন্যদিকে মাছ, মাংস, ডিম বেশি খাওয়া রাজ্যে দুধ খাওয়ার পরিমাণ অনেক কম।

দুধ এবং মাংস আহারের একটি বিপরীত প্রবণতাও স্পষ্টতই দৃশ্যমান, তবে সেটা সামান্য কিছু অঞ্চলে। আরও মনে রাখতে হবে, যেসব স্থানে জিন মিউটেশনের আধিক্য বেশি, সেখানেই বেশি দুধ এবং কম মাংস খাওয়ার প্রবণতা রয়েছে, এবং এর বিপরীত ক্রমটিও সত্যি।

জিনের এই কাহিনিটি আমাদের ভারতবর্ষের সমাজতাত্ত্বিক মানচিত্রের এক নির্দেশক। আমাদের সভ্যতার নিরিখে সাধারণ প্রশ্নের উত্তরগুলির মধ্যে তারতম্যের যে নিদর্শনগুলি দেখি, যেমন কী খাওয়া উচিত আর কী অনুচিত, তারও একটা যথাযোগ্য কারণ এর থেকেই মেলে। এই ধরনের পার্থক্য এবং নিদর্শনগুলো মুছে ফেলার চেষ্টা করা বা এক ধাঁচের সংস্কৃতি নির্মাণ করতে চাওয়া একটি অ-ভারতীয় উদ্যোগ হবে, যা যেমন দুর্ঘটনার ঝুঁকিপূর্ণ তেমনই ব্যর্থতার আশঙ্কাজনক।
*******************************************************************


Tuesday, 16 April 2024

পৃথিবীর ইতিহাস - দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, রমাকৃষ্ণ মৈত্র

দেহগত আকৃতি-প্রকৃতি তারতম্য অনুযায়ী, অর্থাৎ চুল, চোখ, নাক, মাথার খুলি, গায়ের রং প্রভৃতির পার্থক্যের ভিত্তিতে মানুষের যে ভাগ-বিভাগ করা হয় - নৃতত্ত্ববিজ্ঞানে সেটা একটা দীর্ঘদিনের প্রচণ্ড বিতর্কমূলক বিষয়। এ বিষয়ে মূল সমস্যা প্রধানত দুটি। এক: প্রাণী-জগতের বিবর্তনের ক্রম-বিকাশে একটি জায়গায় এবং একটি মূল উৎস থেকেই মানুষের আবির্ভাব হয়েছিলো, না, এই ক্রমবিকাশের ধারায় একসঙ্গে বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন মানুষের গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়েছিলো - এ প্রশ্নের জবাবে নৃতত্ত্ববিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারেননি। দুই: উপরের ওই প্রশ্ন থেকেই আরেকটি প্রশ্ন ওঠে। সেটা হলো এই যে, জীব হিসাবে গোটা মানুষের সমাজ একই শ্রেণিভুক্ত হলেও, দৈহিক আকৃতি এবং বর্ণের দিক দিয়ে বিভিন্ন মানুষের গোষ্ঠীতে যে পার্থক্য রয়েছে, সে পার্থক্যের উৎস কি? পৃথিবীর আবির্ভাবের সময় থেকেই কি এই পার্থক্য ছিলো? এ বিষয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে নানারকম বিপরীত মত আছে। এক দলের মত হলো যে কিছু কিছু পার্থক্য নিয়েই এই পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হয়েছিলো; ফলে গোটা মানুষের সমাজে দেহগত আকৃতি ইত্যাদির দিক দিয়ে মূল কয়েকটি বিশিষ্ট আলাদা আলাদা গোষ্ঠী এখনো পর্যন্ত তাদের পৃথক স্বাতন্ত্র্য নিয়ে টিকে আছে। তাঁদের মতে গোটা মানুষের সমাজে এগুলোই হলো আদি এবং "খাঁটি" জাতি। আরেকদল পণ্ডিত ওই "আদি" ও "খাঁটি" জাতিতে বিশ্বাসী নন। তাঁরা বলেন যে শুরু থেকেই মানুষের মধ্যে ক্রমাগত এমন একটি মিশ্রণ ও সংমিশ্রণের ধারা চলে আসছে যে এই ধরনের কোনো "খাঁটি" জাতির কথা ভাবাই যায় না।

যাই হোক, সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়ানো মানুষের মধ্যে মোটামুটি কয়েকটি মূল পার্থক্য এখনো নজরে পড়ে। আগেই বলেছি, এ পার্থক্যগুলি কিন্তু শুধুই শরীরের গঠন, রং ইত্যাদির ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত। নৃতত্ত্ববিজ্ঞানীরা এই পার্থক্যগুলি অনুযায়ী মানুষকে মোটামুটি চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন : (১) ইউরোপ, ভূমধ্যসাগর অঞ্চল এবং পশ্চিম এশিয়া জুড়ে শ্বেতকায় যে মানুষের দল চোখে পড়ে, পণ্ডিতরা তাকে ককেশয়েড বলে অভিহিত করেছেন। ককেশিয়ানদের মধ্যে আবার কয়েকটি প্রধান উপশাখা আছে। একেবারে উত্তর অঞ্চলের শ্বেতকায় মানুষ বা নর্ডিক; মাঝামাঝি আরেকটি দল অর্থাৎ আলপাইন; এবং দক্ষিণ অঞ্চলের ঈষৎ ঘন বর্ণের মানুষ অর্থাৎ মেডিটারেনিয়ান বা আইবেরিয়ান। (২) পূর্বএশিয়া এবং আমেরিকা মহাদেশ জুড়ে পীতকায় যে মানুষের দল চোখে পড়ে তারা হলো মঙ্গোলয়েড। (৩) আফ্রিকার ঘন কৃষ্ণকায় মানুষের দল হলো নিগ্রয়েড, এবং (৪) অস্ট্রেলিয়া ও নিউগিনি অঞ্চলের প্রাচীনতম অধিবাসীরা - পণ্ডিতরা যাকে অস্ট্রোলয়েড বলে অভিহিত করেছেন। অবশ্য কালক্রমে এই চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্যের জাতির পরস্পরের মধ্যে প্রচুর মিশ্রণ এবং সংমিশ্রণ হবার ফলে নানারকম মিশ্র জাতির সৃষ্টি হয়েছে।

যেমন জাতিগত বৈষম্যের দিক দিয়ে, তেমনি ভাষাগত বৈষম্যের দিক দিয়েও পণ্ডিতমহলের নানারকম মতভেদ রয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীতে আমরা অসংখ্য ভাষার ব্যবহার দেখতে পাই। এগুলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করে পণ্ডিতরা মানুষের ভাষা-গোষ্ঠীকেও কয়েকটি মূল বিভাগে বিভক্ত করেছেন। (১) ইন্দো-ইউরোপীয়: এর অন্তর্ভুক্ত হলো কেলট, গ্রিক, ল্যাতিন, টিউটনিক, স্লাভ, আর্য, হিটটাইট ইত্যাদি। (২) সেমিটিক: এর অন্তর্ভুক্ত হলো প্রাচীন ব্যাবিলন ও আসীরিয়ার ভাষা, ফিনিশীয়দের ভাষা, হিব্রু, সিরিয়ান, আরব, আবিসিনিয়ান ইত্যাদি। (৩) হ্যামিটিক: প্রাচীন মিশরবাসীদের ভাষা এর অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তাছাড়া উত্তর আফ্রিকার বার্বার এবং পূর্ব-আফ্রিকার সোমালী ইত্যাদি ভাষাও এর অন্তর্ভুক্ত। (৪) তুরানিয়ান বা ফিনো-ঊগ্রীয়: ল্যাপল্যাণ্ড, সাইবেরিয়া, ফিনল্যাণ্ড, ম্যাজার, তুর্কী, মাঞ্চু, মঙ্গোল ইত্যাদি ভাষা এর অন্তর্ভুক্ত। (৫) ভোট-চীন: চীন, বর্মী, শ্যাম এবং তিব্বতী ভাষাগুলি এর অন্তর্ভুক্ত। (৬) আমেরিন্ডিয়ান: অর্থাৎ উত্তর আমেরিকার আদিম আদিবাসী রেড-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে প্রচলিত ভাষাগুলি। (৭) অস্ট্রিক: মালয় এবং পলিনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জের আদিম আদিবাসীদের ব্যবহৃত ভাষাসমূহ। আফ্রিকার বান্টুদের মধ্যে প্রচলিত ভাষাটিও একটি আলাদা বিশিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বলে পণ্ডিতরা মনে করেন। দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠী সম্পর্কেও নানারকম মতামত আছে।

এই প্রসঙ্গে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেটা হলো এই যে, এখনো পর্যন্ত মানুষের ব্যবহৃত কয়েকটি প্রাচীন ভাষার পাঠোদ্ধার হয়নি বলে সেই ভাষাগুলোর গোষ্ঠীবিভাগ সম্পর্কে সঠিকভাবে এখনো কিছু বলা যায় না। এগুলো হলো : (১) প্রাচীন সিন্ধু-উপত্যকার সভ্যতার ভাষা, (২) প্রাচীন ক্রীটের ভাষা, (৩) সুমের-এর প্রাচীনতম অধিবাসীদের ভাষা।


Tuesday, 2 April 2024

যে গল্পের শেষ নেই - দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

পৃথিবীকে অনেক বেশি করে, অনেক ভালো করে, জয় করতে পারা। কী আশ্চর্য এই কীর্তি। ভাবতে গেলে স্তম্ভিত হতে হয়! গোয়ালে গরু, মরাইয়ে ধান - মানুষ আর ভোঁতা হাতিয়ার হাতে খাবার জোগাড়ের আশায় বনে বনে হন্যে হয়ে ঘুরতে বাধ্য নয়। ওই সুদূর অতীতে পৃথিবীকে ওইভাবে জয় করতে শুরু করেছিলো বলেই মানুষ আজ সভ্যতার কোন আশ্চর্য শিখরে উঠে আসতে পারলো! ওইভাবে উঠে আসবার গল্পই হলো মানুষের আসল গল্প।

তবু সে-গল্প শোনাবার সময় ভুলে গেলে চলবে না যে সুদূর অতীতে ওই অসহ্য দারিদ্র্যের জীবন ছেড়ে আসবার সময়, অভাবের অন্ধকার থেকে প্রাচুর্যের আঙিনায় এগিয়ে আসবার জন্যে, মানুষকে মূল্যও দিতে হয়েছে অনেকখানি। আগেকার দিনে সমানে-সমান সম্পর্কটাও গিয়েছে খোয়া। এ-কথায় কোনো সন্দেহই নেই যে ওই রকমের একটা দারুণ মূল্য চোকাতে না পারলে মানুষ আজ এমন বড়ো হতে পারতো না। তাই, তখনকার যুগে সমানে-সমান সম্পর্কটা হারাতে হয়েছিলো বলে চোখের জল ফেলবারও সত্যিই মানে হয় না। কিন্তু সেই সঙ্গেই মনে রাখতে হবে, আজকের দিনে অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েও মানুষ দেখছে মানুষে-মানুষ সম্পর্কটাকে আবার যদি সমানে-সমান করে নেওয়া না হয় তাহলে শান্তি নেই, সুখ নেই। আজকের দিনে তাই আবার ভালো করে ভেবে দেখা দরকার আদিম যুগের সমানে-সমান সম্পর্কটা খোয়া যাবার কথা। এই সম্পর্কটা হারানোর অনেকগুলো দিক আছে। সেই দিকগুলোর কথাই একে একে বলি।

যেমন ধরো, সিপাই-শান্ত্রী। যেমন ধরো, পাণ্ডা-পুরুত। এরা কারা? এরা এলোই বা কোথা থেকে?

মানুষ যতোদিন পর্যন্ত দল বেঁধে সমানে-সমান হয়ে থাকতো ততোদিন পর্যন্ত মানুষকে শাসন করবার জন্যে কোনো ব্যবস্থার দরকার পড়েনি। দলের কাজ চালাতো দলের মোড়ল আর সর্দার, আর এই মোড়ল আর সর্দার চলতো দলের সবাইকার মত মেনে। কিন্তু মানুষের দল দুভাগে ভাগ হয়ে যাবার পর দরকার পড়লো শাসন করবার ব্যবস্থা। কেননা, তখন থেকে আর সবাই সমানে-সমান নয়, সবাই স্বাধীন নয়। মানুষে-মানুষে ভাই-ভাই ভাব গেছে ভেঙে, দেখা দিয়েছে লোভ, লুঠতরাজ, মানুষের সঙ্গে মানুষের লড়াই। কিন্তু সবাই যদি লুঠতরাজ করতে যায়, সবাই যদি মারামারি আর কাটাকাটি নিয়ে মেতে ওঠে, তাহলে মানুষের দল একেবারে চুরমার হয়ে ভেঙে যাবার ভয়। তাই দরকার পড়লো কতকগুলো আইনকানুনের। আইন-কানুনগুলো সবাইকে মানতেই হবে, না মানলে শাস্তির ব্যবস্থা। শাস্তির ভয়ে আইন-কানুন মানা এমনতরো ব্যাপার এর আগে দরকার পড়েনি। কেননা, মানুষ তখন জানের দায়ে পৃথিবীর সঙ্গে লড়াই করছে, হাতিয়ার উন্নত হয় না বলেই দল বেঁধে একসঙ্গে মিলে লড়াই করছে, প্রাণপণে পৃথিবীর সঙ্গে লড়াই করে যতোটুকু জিনিস পাওয়া যায় ততোটুকু দিয়ে কোনোমতে সবাইকার প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। তাই সবাই গরিব, তবু সবাই সমান। সবাই মিলে যে-কাজটা করে সে-কাজটা সম্বন্ধে উচিত-অনুচিতের কথা, আইন-বেআইনের কথা ওঠে না। কিন্তু তারপর থেকে অন্য কথা - মানুষে মানুষে মারামারি আর কাটাকাটি। এই অবস্থায় কতকগুলো আইন-কানুন যদি না থাকে তাহলে মানুষের দলটা টিকবে কেমন করে?

কিন্তু শুধু কতকগুলো আইন-কানুন তৈরি করলেই তো হলো না, সবাই যাতে সেগুলো মানতে বাধ্য হয় সেই ব্যবস্থাও করা দরকার। সেই ব্যবস্থারই নাম হলো শাসন করবার ব্যবস্থা। আইন-কানুনগুলো সবাই ঠিকমতো মানছে কিনা তারই তদারক করার লোক চাই। আইনগুলো কে মানলো আর কে মানলো না তারই বিচার। তাছাড়া সিপাই চাই, শান্ত্রী চাই, জল্লাদ চাই, কোটাল চাই। যারা আইন মানবে না তাদের তাঁবে রাখার জন্যে। আস্তে আস্তে মানুষের দলের মধ্যে দেখা দিলো কাজির-উজির, জল্লাদ-কোটাল, সিপাই-শান্ত্রী। এরা শাসন করবে মানুষের দলকে, হিসেব করে দেখবে কে আইন মানলো আর কে আইন মানলো না; যে মানলো না তাকে ধরে আনতে হবে, তাকে শাস্তি দিতে হবে। শাসন বলে ব্যবস্থা না থাকলে তখন মানুষের দল টিকতে পারে না, তাই যাদের ওপর শাসনের ভার তাদের খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখবার দায়টা পড়লো বাকি সবাইকার ঘাড়ে। পৃথিবীর সঙ্গে লড়াই করে যে যা-কিছু জোগাড় করবে তার একটা করে অংশ যাবে এই শাসকদের পেট ভরাবার জন্যে। সেই অংশটারই নাম হলো খাজনা। 

প্রথমটায় মনে হতে পারে, খাসা ব্যবস্থা। কেউ যাতে অন্যায় করতে না পারে তাই জন্যে আইন-কানুন। আইন-কানুনগুলো যাতে কেউ না উড়িয়ে দিতে পারে তাই জন্যে শাসনব্যবস্থা। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলেই বুঝতে পারবে এই ব্যবস্থার মধ্যে ফাঁকিটা ঠিক কোথায়। আইন-কানুনগুলো শুরু হবার সময় থেকে আজ পর্যন্ত কোনোকালেই ওগুলোর উদ্দেশ্য নয় সমস্ত মানুষের যাতে ভালো হয় সেই ব্যবস্থা করা। সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বেশির ভাগ আইনের আদত কথাটা ঠিক কী? একদল মানুষ মুখ বুজে খাটবে, আর তাদের খাটুনি দিয়ে তৈরি জিনিস লুঠ করবে আর একদল মানুষ। যারা মুখ বুজে খাটবে তারা যদি মুখ বুঝে থাকতে রাজি না হয়? যদি রাজি না হয় নিজেদের মেহনত দিয়ে গড়া জিনিস অপরের ভাঁড়ারে তুলে দিতে? তাহলে শাস্তি, শাসন। তাই আইন। ঘাড় গুঁজে কুঁজো হয়ে রাজাকে মানতে হবে, না মানলে দারুণ শাস্তি। বড়োলোককে মানতে হবে, বড়োলোকের ভাঁড়ার থেকে কানাকড়ি সরানো চলবে না। সরাতে গেলে শাস্তি, দারুণ শাস্তি। বেশিরভাগ আইন-কানুনই হলো এই ধরনের আইন-কানুন। শোষণের খাতিরেই শাসন। যদিও অনেক রকম রঙচঙে আর মিষ্টি মিষ্টি কথা দিয়ে এই সত্যি কথাটুকুকে ঢেকে রাখবার চেষ্টা করা হয়েছে, তবুও ভালো করে ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে আইন-কানুন আর সিপাই-শান্ত্রী সব কিছুর পেছনে একটি হিসেব যাতে মেহনতকারীর দল হঠাৎ না বেঁকে দাঁড়ায়, হঠাৎ না রুখে ওঠে। তারই জন্যে এই সব ব্যবস্থা : আইন-কানুন, রাজা-উজির, হরেক রকমের।

কিন্তু শুধু ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা রাখাও কঠিন। কেননা, মেহনতকারীদের যে দল সেটাই হলো আসলে প্রকাণ্ড বড়ো দল। রাজা-উজিরই বলো আর বড়োলোকই বলো, গুনে দেখলে দেখা যায় বাকি মানুষদের চেয়ে যারা খেটে মরছে তাদের চেয়ে - দলে ওরা নেহাতই নগণ্য। তাই, শুধু সিপাই-শান্ত্রী আর জল্লাদ-কোটাল দিয়ে চিরকালের মতো এদের দাবিয়ে রাখা যায় না। বনের বাঘকে খাঁচায় পুরে রাখলেও নিশ্চিন্তি নেই, দরকার পড়ে নিয়ম করে বাঘকে আফিম খাওয়াবার। আফিম খেলে বাঘ ঝিমিয়ে থাকবে, মাথা তুলতে পারবে না, তাই কোনোদিন সে-খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে পড়তে পারে এ-হেন দুশ্চিন্তার আর কারণ থাকবে না। বাঘের বেলায় যে-রকম ব্যবস্থা, মেহনতকারী মানুষদের বেলাতেও খানিকটা সেই ধরণেরই ব্যবস্থা গড়ে উঠলো। এই ব্যবস্থাটার নাম ধর্ম। ধর্ম বলে ব্যাপারটা অবশ্য নেহাতই জটিল; তাই নিয়ে অনেক কিছু ভাববার আর বোঝবার আছে। তবু আমাদের গল্পের এখানে যেটা বিশেষ করে বোঝা দরকার শুধু সেটুকুই বলবো। যাতে মেহনতকারী মানুষেরা মাথা তুলতে না পারে, যাতে তারা ঝিমিয়ে থাকতে বাধ্য হয়, তারই একটা বড়ো উপায় বলতে ধর্ম। 

সিপাই-শান্ত্রীর সহায় হিসেবে দেখা দিলো পাণ্ডা-পুরুতের দল। মেহনতকারী মানুষ যাতে মাথা তুলতে না পারে, যাতে ঝিমিয়ে থাকতে বাধ্য হয়, সেই জন্যে পাণ্ডা আর পুরুত। সিপাই-শান্ত্রীর হাতে তীর-ধনুক আর বল্লম-বর্শা, পাণ্ডা-পুরুতের ঝুলিতে ধর্মের আফিম। তারা মানুষকে বুঝিয়ে বেড়াতে লাগলো পৃথিবীর সুখ-দুঃখ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। মানুষের এই নশ্বর জীবনে যদি সুখ না জোটে, যদি দুঃখ ভোগ করতে হয়, তাহলেও তাই নিয়ে মন-মেজাজ গরম করবার কোনো মানে হয় না। কেননা, করুণাময় ভগবান সৃষ্টি করেছেন এই পৃথিবী, এখানে যা কিছু ঘটছে তা সবই সেই মঙ্গলময়ের ইচ্ছায়। তিনি সব মানুষকেই সমান ভালোবাসেন। তাহলে কারুর কপালে অতো সুখ আর কারুর কপালে অতো দুঃখ কেন? বিশেষ করে আমাদের দেশে যারা ধর্মের প্রচারক তারা বললে : ঐ তো মজা! আসলে যে-লোক আগের জন্মে ভালো কাজ করেছে এ-জন্মে সে সুখভোগ করছে, যে-লোক আগের জন্মে খারাপ কাজ করেছে এ-জন্মে সে দুঃখভোগ করছে। এই হলো ভগবানের নিয়ম। তাই এ-জন্মে সুখ পাচ্ছো, না, দুঃখ পাচ্ছো তাই নিয়ে মাথা ঘামিও না। মুখ বুজে ভগবানের আদেশ হলো রাজাকে ভক্তি করবার আদেশ, পাণ্ডা আর পুরোহিতের কথা মানবার আদেশ। যদি মুখ বুজে এই সব আদেশ পালন করতে পারো তাহলে পরজন্মে বা পরকালে তোমার কপালেও অনেক সুখ জুটবে। এ-জন্মে শাকান্ন পাচ্ছো না বলে ভগবানে ভক্তি হারিও না। আসলে ভগবান তোমাকে দুঃখ দিয়ে পরখ করে নিচ্ছেন। ইহকালে শাকান্নের অভাবটা যদি হাসিমুখে মানতে পারো তাহলে পরকালে তোমার পরমান্ন একেবারে সুনিশ্চিত। জীবনে যে-আনন্দ তুমি পেলে না সে-আনন্দ পাবার আশায় নিজে নিজে কিছু করে বসাটা একেবারে মূর্খতা; মঙ্গলময়ের পায়ে মাথা কোটো, তাঁর মনে করুণার উদ্রেক করো, তিনি তোমার মনস্কামনা পূরণ করবেন। তাঁর ইচ্ছে অনুসারেই পৃথিবী চলে, তাই তাঁর কাছে করুণা ভিক্ষে করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

অবশ্যই, মেহনতকারী মানুষরা যদি ভগবানের পায়ে শুধু মাথাই কোটে তাহলে পাণ্ডা-পুরুতদের সংসারই বা চলে কেমন করে? তাই ওরা প্রচার করতে শুরু করলো, শুধু কথায় ভগবানের মন ভেজে না। তার পায়ে মাথা কুটতে হবে, কিন্তু সেই সঙ্গেই তাকে চালকলার নৈবেদ্য খাওয়াতে হবে, আর এই ভগবানের সঙ্গে যেহেতু পাণ্ডা-পুরুতদের খুব ভাবসাব সেই হেতু এদের জন্যে কিছু নগদ দক্ষিণা না আনলেই বা চলবে কেন?

প্রার্থনার মাহাত্ম্য। করুণা চাওয়া, ভিক্ষে চাওয়া, মাথা কোটা। মনে রাখতে হবে, মানুষ যতোদিন ছেলেমানুষ ছিলো, ছিলো দল বেঁধে মিলে মিশে সমানে-সমান হয়ে, ততদিন মানুষের মাথায় এই করুণা-চাওয়া, ভিক্ষে চাওয়া প্রার্থনা করবার কথা আসেনি। ততোদিন ছিল ইন্দ্রজাল। ইন্দ্রজালের মধ্যে কল্পনার আর আজগুবি ধারণার দিকটা যতোখানিই থাকুক না কেন, এর আসল ঝোঁক হলো পৃথিবীটাকে জয় করবার দিকে। কিন্তু আগেকার সেই সমানে-সমান জীবন ভেঙে যাবার পর থেকে নষ্ট হলো জয় করবার দিকে ঝোঁকটাও। মানুষ শিখলো মাথা কুটতে, মানুষ ভাবলো বিধাতার কথা। যারা শোষক, পরের মেহনত লুঠ করে বড়োলোক হয়, তারা বাকি সবাইকে শেখাতে লাগলো এই বিধাতার কথাটা : সবই ঘটছে বিধাতার কৃপায়, বড়োলোকদের ওপরে রাগ করে লাভ নেই, লাভ শুধু বিধাতার পায়ে মাথা কুটে।

***************************************************

আরো একটুখানি তলিয়ে দেখা যাক, দেখা যাক ঠিক কোন ধরনের কথাগুলো শাসকদের মনের মতো কথা। খুব মোটামুটি বললে বলতে হবে, এই ধরনের কথা আছে দুটো। এক হলো, এই যে দুনিয়া এটা আসলে সত্যি জিনিস নয়। আর দু-নম্বরের কথা হলো, এই দুনিয়াতে আসলে কোনো অদলবদল নেই, যা সত্য তা চিরকাল একই রকম, তা বদলায় না। কথা দুটোকে ভালো করে বোঝবার দরকার আছে।

প্রথমত, দুনিয়াটাকে আমরা যেভাবে দেখি সেইভাবে দেখাটা ঠিক দেখা নয়। আমরা দেখি, এই দুনিয়ায় মাটি আছে, মাটির বুকে ফসল ফলায় মানুষ আর সেই ফসল খেয়ে পেট ভরে মানুষের। শাসকদের মনের কথা হলো, এই সবই ভুল দেখা। যেমন, ভুল করে মানুষ অনেক সময় দড়িতে সাপ দেখে সেইরকম। আসলে ওখানে আছে দড়ি, সাপ নয়। তবু অন্ধকার আর অজ্ঞানের ঘোরে ভুল করে কেউবা ভাবলো সাপই। এও তেমনি। আছে অন্য রকমের জিনিস, সাধারণ মানুষ ভুল করে দেখছে মাটির পৃথিবী, রক্তমাংসে গড়া মানুষ, এই রকম কতোই না!

কিন্তু এই ধরনের কথাটাই শাসকদের মনের কথা কেন? কেননা, সাধারণ মানুষকে যদি কোনোমতে বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে এই মাটির পৃথিবীটা সত্যি নয়, রক্ত-মাংস দিয়ে গড়া মানুষগুলোও সত্যি নয়, সত্যি নয় মানুষের পেটের জ্বালা, সত্যি নয় অন্ন-বস্ত্র যা দিয়ে পেটের জ্বালা মেটানো যায়, শীতের হাত থেকে শরীরকে বাঁচানো যায় - তাহলে সাধারণ মানুষের মনটা অন্য দিকে যাবে, মাটির পৃথিবীর কাছ থেকে আদায় করা জিনিসপত্তরগুলোকে আর তারা অতো দামী মনে করবে না। আর সাধারণ মানুষের মন যদি সত্যিই অন্যদিকে যায় তাহলে শোষকরা তো দিব্বি নিশ্চিন্তি।

ভেবে দেখো একবার। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাটির বুকে ফসল ফলায় তারা যদি বলতে শুরু করে: 'ওই ফসলটা হলো সত্যি, ওই ফসল দিয়ে পেট ভরানোটাই হলো সত্যি; আমি চাই ওই ফসল, যতোটা আমার মেহনত দিয়ে তৈরি ততোটারই ওপর দখল শুধু আমার, আর কারুর নয়' তাহলে? যদি সমস্ত মেহনতকারী মানুষ মাটির পৃথিবীটাকে এইভাবে সত্যি বলে চিনতে শুরু করে, তাহলে শাসকদের মন ভয়ে কেঁপে উঠবে না কি? তাই শাসকদের মনের কথাটা উলটো ধরনের কথা। মাটির পৃথিবীটা সত্যি জিনিস নয়, এর পেছনে অন্য কিছু আছে, যা সত্যি, যা বাস্তব।

আর অদল-বদল। পৃথিবীটা কি সত্যিই বদলে যায়? আজ তার চেহারাটা যে-রকম আগামীকাল কি সেই রকম আর থাকবে না? বদলে গিয়ে অন্য রকম হয়ে যাবে? শাসকের দল নিশ্চয়ই আর্তনাদ করে বলবে : না না, তা কিছুতেই নয়, তা কখনো হতেই পারে না। আজকের দিনে পরের মেহনত দিয়ে গড়া জিনিস লুঠ করে যে-রকম মজায় দিন কাটছে বরাবরই যেন সেইরকম ভাবে দিন কাটে। পৃথিবী বদলে গিয়ে অন্যরকম হয়ে গেলে চলবে কেন? আসলে, পৃথিবীতে অদল-বদল বলে আমরা যা কিছু দেখি তার সবটুকুই হলো দেখার ভুল। বদল আসলে নেই, ভুল করে মনে করছি বদল দেখছি বুঝি। এও ওই দড়িতে সাপ দেখার মতো। শোষকের দল এই কথাটাও সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করাতে চায়। বলতে চায়, পৃথিবীটা চিরন্তন, অদল-বদল বলে বাস্তবিকই কিছু নেই পৃথিবীতে।

মোটামুটি এই দুটো কথাই হলো শাসকদের মনের মতো কথা। এই দুটো কথা যদি সাধারণ মানুষের মনে খুব গভীরভাবে গেঁথে দেওয়া যায় তাহলে তার মন একেবারে চিরকালের মতো পঙ্গু হয়ে থাকবে, শোষণের বিরুদ্ধে, শাসনের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, এই মন কোনোদিন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। আর মন যদি না ওঠে তাহলে হাতও উঠবে না। হাত না উঠলে নিশ্চিন্তি।

তাই ধর্ম ছাড়াও শাসকদের তরফ থেকে অন্য রকম ব্যবস্থার বন্দোবস্ত আছে। মস্ত বড় বড় পণ্ডিতদের মুখ দিয়ে এই কথাগুলো প্রচার করানো। তারা সব এমনটাই ডাকসাইটে পণ্ডিত যে তর্ক করে দিনকে রাত বলে প্রমাণ দিতে পারেন। তুমি হয়তো স্পষ্টই বুঝছো যে তোমার দারুণ খিদে পেয়েছে, এক দলা ভাত গিললেই তোমার পেটের জ্বালা জুড়োবে। কিন্তু ওই সব বড়ো বড়ো পণ্ডিতেরা এমন সব তর্কের মারপ্যাঁচ শুরু করবে যে তোমার কাছে সব কিছু গোলমাল হয়ে যাবে, আর তুমি শেষ পর্যন্ত মানতে বাধ্য হবে যে তোমার কথাটাই ভুল, ওদের কথাটাই সত্যি। মেহনত করবার সময়, গতর খাটাবার সময়, মানুষ স্পষ্টই দেখছে যে তার হাতের কোদালটা সত্যিকারের কোদাল, যে-ফসলটা ফলছে সেটাও নেহাতই সত্যিকারের ফসল। কিন্তু মেহনতের কথাটা, গতর খাটাবার কথাটা আলাদা কথা। যখন থেকে মানুষের সমাজ চিড় খেয়ে দু-ভাগে ভেঙে গিয়েছে তখন থেকেই গতর খাটানো আর মাথা খাটানোর মধ্যে মুখ দেখাদেখি নেই, গতর খাটাবার সময় যে-কথাটাকে স্পষ্ট আর সত্যি বলে মনে হয় মাথা খাটিয়ে সেই কথাটাকেই একেবারে ভুল আর বাজে কথা বলে প্রমাণ করে দেওয়া।

যতো দিন কেটেছে ততোই ধারালো হয়েছে, শাণিত হয়েছে শাসকদলের পণ্ডিতদের এই সব যুক্তি-তর্কগুলো। দিনের পর দিন ধরে তারা দিনকে রাত করে চলেছে, আর সবাই মুগ্ধ হয়ে বলেছে : কী অসাধারণ পণ্ডিত! কী বিদ্যা! কী বুদ্ধি! শোষকরা খাতির করে সভায় ডেকে এনেছে এই সব পণ্ডিতদের।

এমন কি আজকের পৃথিবীতেও এই ধরণের ব্যাপারে শেষ নেই। তার কারণ আজকের পৃথিবীতেও একদিকে শোষক আর একদিকে মেহনতকারী মানুষ, যাদের ভুল বোঝানো দরকার। তারা হয়তো ক্ষেপে উঠবে, বলবে : 'পৃথিবীকে বদল করবো আমরা! শেষ হবে শোষণ, পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী আসবে।'

Wednesday, 20 March 2024

স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা - চতুর্থ খণ্ড (সমালোচনামূলক লেখা)

১) "ভক্তিযোগ প্রেমের এই উচ্চতম বিকাশের বিজ্ঞানস্বরূপ।" (পৃষ্ঠা ৪১)

"ভারতবাসীর মনের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করিলে জানা যায়, কি জড়বিজ্ঞান, কি মনোবিজ্ঞান, কি ভক্তিতত্ত্ব, কি দর্শন—সর্ব বিভাগেই উহা চিরকাল এই বহুর মধ্যে এক সর্বগত তত্ত্বের অপূর্ব অনুসন্ধানে নিয়োজিত।" (পৃষ্ঠা ৪৮)

"যদি কোন ব্যক্তি আমাকে গতিবিজ্ঞান, রসায়ন বা অন্য কোন জড়বিজ্ঞান সম্বন্ধে কিছু শিখাইতে ইচ্ছা করে, সে যে চরিত্রেরই হউক, তাহাতে ক্ষতি নাই; সে অনায়াসে উহা শিক্ষা দিতে পারে। ইহা সম্পূর্ণ সত্য—কারণ জড়বিজ্ঞান শিখাইতে যে জ্ঞানের প্রয়োজন তাহা কেবল বুদ্ধিবিষয়ক বলিয়া বুদ্ধিজাত শক্তির উপর নির্ভর করে; এরূপ ক্ষেত্রে আত্মার কিছুমাত্র বিকাশ না থাকিলেও একজনের দারুণ-বুদ্ধিশক্তি থাকিতে পারে। কিন্তু অধ্যাত্মবিজ্ঞানে—যে ব্যক্তি অশুদ্ধচিত্ত, তাহার হৃদয়ে কোনপ্রকার আধ্যাত্মিক আলোক প্রতিভাত হওয়া অসম্ভব। সে কি শিক্ষা দিবে? সে তো নিজেই কিছু জানে না। চিত্তের শুদ্ধিই আধ্যাত্মিক সত্য।" (পৃষ্ঠা ৯১)

"বিজ্ঞানবাদী বলেন, আমি বদ্ধ বলে যে জ্ঞান হয়, সেটাই ভ্রম। বেদান্তবাদী বলেন, তুমি মুক্ত ও বদ্ধ দুই-ই। ব্যাবহারিক ভূমিতে তুমি কখনই মুক্ত নও, কিন্তু পারমার্থিক বা আধ্যাত্মিক ভূমিতে তুমি নিত্যমুক্ত।" (পৃষ্ঠা ১৮২)

"ধর্মবিজ্ঞানের মধ্যে একমাত্র রাজযোগই প্রমাণ করে দেখানো যেতে পারে, আর আমি নিজে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করে যা ঠিক বলে জেনেছি, শুধু তাই শিক্ষা দিয়ে থাকি। বিচার-শক্তির সম্পূর্ণ বিকাশপ্রাপ্ত অবস্থাই প্রাতিভ জ্ঞান, কিন্তু তা কখনও যুক্তিবিরোধী হতে পারে না।" (পৃষ্ঠা ১৮৮)

"কেবল যদি তিনি আধ্যাত্মিক সত্য আবিষ্কার করেন, আমরা তাঁকে ঋষি বা অবতার বলি; আর যখন সেটা জড়জগতের কোন সত্য হয়, তখন তাঁকে বৈজ্ঞানিক বলি। যদিও সকল সত্যের মূল সেই এক ব্রহ্ম, তথাপি আমরা প্রথমোক্ত শ্রেণীকে উচ্চতর আসন দিয়ে থাকি।" (পৃষ্ঠা ১৮৯)

"ব্রহ্মবিদ্যাই পরা বিদ্যা; অপরা বিদ্যা হচ্ছে বিজ্ঞান। মুণ্ডকোপনিষৎ অর্থাৎ সন্ন্যাসীদের জন্য উপদিষ্ট উপনিষৎ এই উপদেশ দিচ্ছেন।৩৯ দুই প্রকার বিদ্যা আছে—পরা ও অপরা। তন্মধ্যে বেদের যে অংশে দেবোপাসনা ও নানাবিধ যাগযজ্ঞের উপদেশ—সেই কর্মকাণ্ড এবং সর্ববিধ লৌকিক জ্ঞানই অপরা বিদ্যা। যে বিদ্যা দ্বারা সেই অক্ষর পুরুষকে লাভ করা যায়, তাই পরা বিদ্যা। সেই অক্ষর পুরুষ নিজের মধ্যে থেকেই সমুদয় সৃষ্টি করছেন—বাইরে অপর কিছু নেই, যা জগৎকারণ হতে পারে।" (পৃষ্ঠা ১৯১)

"আধুনিক বিজ্ঞান বাস্তবিকই প্রকৃত ধর্মের ভিত্তিকে আরও দৃঢ় করেছে। সমুদয় ব্রহ্মাণ্ডটা যে এক অখণ্ড বস্তু, তা বিজ্ঞানের দ্বারা প্রমাণ করা যেতে পারে। দার্শনিক যাকে ‘সত্তা’ (being) বলেন, বৈজ্ঞানিক তাকেই ‘জড়’ (matter) বলে থাকেন; কিন্তু ঠিক ঠিক দেখতে গেলে, এদের দুজনের মধ্যে কোন বিরোধ নেই, কারণ তত্ত্বতঃ দুই-ই এক জিনিষ।" (পৃষ্ঠা ১৯৯)

"ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান যে সম্পূর্ণ ভ্রম, পদার্থবিজ্ঞান তা প্রমাণ করে দেয়; আমরা কোন জিনিষকে যেমন দেখি, শুনি, স্পর্শ ঘ্রাণ বা আস্বাদ করি, স্বরূপতঃ জিনিষটা বাস্তবিক তা নয়।" (পৃষ্ঠা ২০৬)

"প্রত্যেক বিজ্ঞানেরই নিজস্ব বিশেষ প্রণালী ও বিশেষ যন্ত্রের প্রয়োজন। একজন জ্যোতির্বিদ্ রান্নাঘরের সমস্ত হাঁড়িকুড়ির সাহায্য নিয়ে শনিগ্রহের বলয়গুলি দেখাতে পারেন না, তার জন্য দূরবীক্ষণযন্ত্র প্রয়োজন। সেইরূপ ধর্মের মহান্ সত্যাসমূহ দেখতে হলে, যারাঁ পূর্বেই সেগুলি প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁদের প্রণালীগুলি অনুসরণ করতে হবে। যে বিজ্ঞান যত বড়, তার শিক্ষা করবার উপায়ও তত নানাবিধ।" (পৃষ্ঠা ২১৩)

"ইন্দ্রিয়গুলো দিবারাত্র তোমায় (ভুলজ্ঞান এনে দিয়ে) প্রতারিত করছে। বেদান্ত অনেককাল আগে এটি আবিষ্কার করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞান সবেমাত্র ঐ তত্ত্বটি বুঝতে আরম্ভ করেছে।" (পৃষ্ঠা ২২৩)

"বড় বড় ধর্মাচার্যদের কাছে জড়বিজ্ঞান শিখতে যেও না, তাঁদের সমগ্র শক্তি আধ্যাত্মিক বিষয়ে প্রযুক্ত হয়েছে।" (পৃষ্ঠা ২৩৩)

"যেখানে বুদ্ধিবিচারের শেষ, সেইখানেই ধর্মের আরম্ভ।" (পৃষ্ঠা ২৪০)   

"আমরা যাতে এই বন্ধনের বাইরে যেতে পারি, বিজ্ঞান ও ধর্ম দুই-ই আমাদের সে-বিষয়ে সাহায্য করতে চেষ্টা করছে। তবে ধর্ম বিজ্ঞানের চেয়ে প্রাচীন, আর আমাদের এই কুসংস্কার রয়েছে যে, ধর্ম বিজ্ঞানের চেয়ে পবিত্র। এক হিসাবে পবিত্রও বটে, কারণ ধর্ম নীতি বা চরিত্রকে (morality) তার একটি অত্যাবশ্যক অঙ্গ বলে মনে করে, কিন্তু বিজ্ঞান তা করে না।" (পৃষ্ঠা ২৫১)

"নিয়মের বাহিরে যাইবার জন্যই আমরা প্রথমে নিয়ম মানিয়া চলি, নিয়ম মানিয়া না চলাই হইল সমগ্র জীবনের সংগ্রাম। এই কারণেই আমি ‘ক্রিশ্চান সায়াণ্টিস্ট’দের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করিয়া থাকি; তাঁহারা মানবের স্বাধীনতা ও আত্মার দেবত্ব সম্বন্ধে শিক্ষা দিয়া থাকেন। আত্মা সর্বপ্রকার পারিপার্শ্বিকতার ঊর্ধ্বে।" (পৃষ্ঠা ২৬৪)

"আমাকে প্রশ্ন করা হয়—তোমাদের ধর্ম, সমাজের কোন্ কাজে লাগে? সমাজকে সত্য-পরীক্ষার কষ্টিপাথর করা হইয়াছে; কিন্তু ইহা অত্যন্ত অযৌক্তিক। সমাজ আমাদের ক্রমোন্নতির একটি সোপান মাত্র—ইহা অতিক্রম করিয়া যাইতে হইবে। নতুবা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের গুণাগুণ এবং প্রয়োজনীয়তাও শিশুর প্রয়োজনের মাপকাঠিতে বিচার করিতে হয়। ইহা অত্যন্ত আসুরিক।" (পৃষ্ঠা ২৬৮)

মতামত: প্রতিটি অবান্তর যুক্তি-বিবর্জিত মন্তব্য। যে কোনো উপায়ে, বিভিন্নরকম কু-যুক্তির উপস্থাপনা করে বিজ্ঞানের ওপর ধর্মের জয়যাত্রা সুনিশ্চিত করতে উদ্যত স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ।

ধর্মবিশ্বাসীরা আমাদের আশেপাশের কতিপয় বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞানী বা চিকিৎসকদের স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি অনুরাগকে সম্বল করে ওঁকে অভ্রান্ত হিসেবে তুলে ধরতে চান কিন্তু বাস্তবে এই মানুষগুলোও স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে প্রচারের শিকার। 

এঁরা সামাজিক বা পারিবারিক ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণেই স্বামীজীর প্রতি অনুরক্ত, তার বেশি কিছু নয় (এরকম মনে করার কোনো কারণ নেই যে এঁরা স্বামীজীর প্রতিটি লেখা খুব খুঁটিয়ে পড়ে তারপর তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়েছেন) আর স্বামীজীর এই বক্তব্যগুলো ওঁদের সামনে রাখলে ওঁরাও এইসব আজগুবি, অবান্তর, কাঁঠালের আমসত্ত্ব মার্কা কথাবার্তাগুলোকে মান্যতা দিতে পারবেন না।

২) "ভগবৎ-প্রেমের এই পবিত্র উন্মত্ততাই কেবল আমাদের সংসার-ব্যাধি চিরকালের জন্য আরোগ্য করিতে পারে।" (পৃষ্ঠা ৬২)

"স্বর্গে বিবাহ করা নেই, বিবাহ দেওয়াও নেই—তাই যদি হয়, এখনই তা আরম্ভ করে দাও না কেন? এইখানেই বিবাহ তুলে দাও না কেন? সন্ন্যাসীর গৈরিক বসন মুক্তপুরুষের চিহ্ন। সংসারিত্ব-রূপ ভিক্ষুকের বেশ ফেলে দাও। মুক্তির পতাকা—গৈরিক বস্ত্র ধারণ কর।" (পৃষ্ঠা ২৪১)

মতামত: স্বামী বিবেকানন্দের বহু বক্তব্য এমনই দ্বিচারিতায় পরিপূর্ণ। দ্বিতীয় খণ্ডে উনি নিজেই বলেছেন, "তিব্বতে বিবাহ নাই, সুতরাং সেখানে প্রেমের ঈর্ষাও নাই; কিন্তু তথাপি আমরা জানি, বিবাহ অপেক্ষাকৃত উন্নত সমাজের পরিচায়ক।" (পৃষ্ঠা ১১৬)

বিবাহ যদি উন্নত সমাজের পরিচায়ক হয় তাহলে বিবাহ / সংসারের প্রতি স্বামীজীর এতো ক্ষোভ কেন?

৩) "খাদ্য সম্বন্ধে দ্বিতীয় দোষের নাম ‘আশ্রয়দোষ’। পাশ্চাত্যগণের পক্ষে এটি বুঝা আরও কঠিন। ‘আশ্রয়দোষ’ অর্থে বুঝিতে হইবে, যে ব্যক্তির নিকট হইতে খাদ্য আসিতেছে, তাহার সংস্পর্শে খাদ্যে যে দোষ জন্মে। এটি হিন্দুদের একটি রহস্যপূর্ণ মতবাদ। ইহার তাৎপর্য এই যে, প্রত্যেক ব্যক্তির দেহের চতুর্দিকে এক প্রকার জ্যোতি রহিয়াছে। ঐ ব্যক্তি যাহা কিছু স্পর্শ করে, তাহাতেই যেন তাহার প্রভাব, তাহার মনের—তাহার চরিত্রের বা ভাবের কিছু অংশ লাগিয়া থাকে। প্রত্যেক ব্যক্তির দেহ হইতে তাহার শক্তির মত চরিত্রবৈশিষ্ট্যও যেন বহির্গত হইতেছে, আর ঐ ব্যক্তি যাহা কিছু স্পর্শ করে, তাহাই তাহা দ্বারা প্রভাবিত হয়। অতএব রন্ধনের সময় কে আমাদের খাদ্য স্পর্শ করিল, সে-দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখিতে হইবে। কোন দুশ্চরিত্র বা মন্দ ব্যক্তি যেন উহা স্পর্শ না করে। যিনি ভক্ত হইতে চান, তিনি যাহাদিগকে অসচ্চরিত্র বলিয়া জানেন, তাহাদের সহিত একসঙ্গে খাইতে বসিবেন না, কারণ খাদ্যের মধ্য দিয়া তাঁহার ভিতর অসদ্ভাব সংক্রামিত হইবে।" (পৃষ্ঠা ৭১)

মতামত: সরাসরি সমাজের বহু প্রাচীন, অমানবিক, বর্বর "অস্পৃশ্যতা" প্রথাকে নির্লজ্জ সমর্থন। যদিও ওপরের উক্তিটি স্বামী বিবেকানন্দের নয়, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী প্রচারক রামানুজাচার্যের; তারপরেও স্বামীজী এই মতেরই সমর্থক ছিলেন কারণ উনি নিজেই বলেছেন, "তাহা হইলেও বলিতেছি, রামানুজকৃত ব্যাখ্যাটিকে অবহেলা করা চলিবে না।" (পৃষ্ঠা ৭২)

(আগ্রহী পাঠক মনুসংহিতার ৪র্থ অধ্যায়ের ২১৮ থেকে ২২৪ নম্বর শ্লোক পড়ে দেখতে পারেন।)

৪) "শরীরের কোন অংশে স্নায়ুবিশেষ নড়িতেছে কিনা দেখিবার জন্য একটি প্রাণীকে কাটিয়া দেখা—কি বীভৎস ব্যাপার ভাবুন দেখি! এমন সময় আসিবে, যখন সকল দেশেই—যে ব্যক্তি এরূপ করিবে, সে দণ্ডনীয় হইবে। আমাদের দেশে বৈদেশিক সরকার এরূপ কার্যে যতই উৎসাহ দিক্‌ না কেন, হিন্দুরা যে এ-বিষয়ে সহানুভূতি করেন না, তাহাতে আমি খুশী।" (পৃষ্ঠা ৭৫)

মতামত: বিজ্ঞানের ওপর প্রটেস্টান্টদের ফতেয়া নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ সমালোচনা করে বলেছেন, "এইরূপ গ্রন্থ বা শাস্ত্র-উপাসনা সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট পৌত্তলিকতা—ওটা আমাদের হাত-পা একেবারে বেঁধে রেখে দেয়। এদের মতে কি বিজ্ঞান, কি ধর্ম, কি দর্শন—সবকিছুই ঐ শাস্ত্রের মতানুযায়ী হতে হবে। প্রটেস্টাণ্টদের এই বাইবেলের অত্যাচার সর্বাপেক্ষা ভয়ানক অত্যাচার।" (পৃষ্ঠা ১৮১) অথচ নিজেই হিন্দু ধর্মকে ব্যবহার করে বিজ্ঞানের ওপর ফতেয়া জারি করলেন। 

তিনি জীবনবিজ্ঞানে ব্যাঙ ব্যবচ্ছেদ বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্বার্থে ইঁদুরকে ব্যবহারের বিপক্ষে গিয়ে দাঁড়ালেন। যিনি বিশ্বাস করেন যে "মানসিক শক্তির দ্বারা লোকের রোগ সারাইতে আমি দেখিয়াছি।"  (পৃষ্ঠা ৩৩২, তৃতীয় খণ্ড) তাঁর পক্ষে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এরকম অবান্তর বিরোধিতা করাটাই স্বাভাবিক। 

আমাদের মতো যুক্তিবাদীদের মত হল, বিজ্ঞান কোনোদিনই কোনো দেশ, ধর্ম, জাতি বা বর্ণের সম্পত্তি হতে পারে না; বিজ্ঞানের চরিত্র সর্বদা আন্তর্জাতিক; বাকি যে সব চিকিৎসকরা খুব গর্ব করে স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রচার করেন, এই তর্কের সমাধানটা না হয় তাঁদের ওপরেই ছেড়ে রাখলাম। 

৫) "আমি দেখিয়াছি—অতি ভয়ানক অসুরপ্রকৃতি ব্যক্তিগণও অদ্ভুত অদ্ভুত অলৌকিক কার্য করিয়াছে, তাহারা মাটি হইতে ফল উৎপন্ন করিয়া দিবে। আমি দেখিয়াছি অনেক মূর্খ ও পিশাচপ্রকৃতি ব্যক্তি ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান ঠিক ঠিক বলিয়া দিতে পারে। আমি দেখিায়াছি, অনেক মূর্খ একবার মাত্র দৃষ্টিপাত করিয়া অতি ভয়ানক রোগ সারাইয়া দিয়াছে। এগুলি শক্তি বটে, কিন্তু অনেক সময়েই এগুলি পৈশাচিক শক্তি।" (পৃষ্ঠা ৯৭)

মতামত: বিজ্ঞান সচেতনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে অজ্ঞানতা, কুসংস্কারের বদ্ধ জালে পুরো ভক্তকুলকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে উদ্যত স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ। স্বামীজী জ্যোতিষকে মান্যতা দিতে চান, মান্যতা দিতে চান ঝাড়ফুঁক, তুকতাক, তাবিজকে। বাস্তবটা কিন্তু এতো সহজ নয়। এইসব বাবাজীরা নিজের ভক্তদের সামনে যতই বিজ্ঞানের ওপর ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান না কেন, বাস্তবে তাঁরাও শরীর খারাপ হলে চিকিৎসকদেরই শরণাপন্ন হন। 

https://www.anandabazar.com/west-bengal/bengal-cm-mamata-banerjee-visit-hospital-to-see-swami-smarananandaji-maharaj-of-ramkrishna-math-dgtl/cid/1501345

৬) "পাশ্চাত্যের লোকেরা বলিয়া থাকে, মূর্তির সম্মুখে হাঁটু গাড়িয়া বসা বড়ই খারাপ, কিন্তু তাহারা কোন নারীর সম্মুখে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া তাহাকে অনায়াসে বলিতে পারে, ‘তুমি আমার প্রাণ, তুমি আমার জীবনের আলো। তুমি আমার নয়নের মণি, তুমি আমার আত্মা’—এই-সব। তাহাদের যদি চারিটি করিয়া পা থাকিত, তবে তাহারা চার পায়ের হাঁটু গাড়িয়া বসিত! ইহা নিকৃষ্টতর পৌত্তলিকতা বা পৌত্তলিকতা অপেক্ষা নিকৃষ্ট। পশুরা ঐরূপে হাঁটু গাড়িয়া বসিবে। একটি নারীকে ‘আমার প্রাণ, আমার আত্মা’ বলার অর্থ কি? এ ভাব তো পাঁচ দিনের মধ্যেই উবিয়া যায়, এ কেবল ইন্দ্রিয়গত আসক্তি মাত্র। তাই যদি না হইবে, তবে পুরুষ পুরুষের নিকট ঐরূপ হাঁটু গাড়িয়া বসে না কেন?" (পৃষ্ঠা ১১১)

মতামত: সমকামী প্রেম হলে একজন পুরুষ আরেকজন পুরুষের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসতেই পারেন; সমকামিতাকে ‘বিদেশি প্রভাব’ বলে দাগিয়ে দেওয়ারও কোনো ভিত্তি নেই কারণ বহু হিন্দু শাস্ত্র ও পুরাণেও সমকামিতার উল্লেখ আছে। যদিও মনুবাদী স্বামী বিবেকানন্দ সমকামী প্রেমকে মান্যতা দিতে রাজি নন।

মনুসংহিতাতে লেখা আছে, "আর যদি কোনও কন্যা অন্য কন্যাকে অঙ্গুলি-প্রক্ষেপে নষ্ট করে, উহার দুই শত পণ দণ্ড করিবেন এবং শুল্ক দ্বিগুণ দেওয়াইবেন ও দশবার বেত্রাঘাত করিবেন।" (৮/৩৬৯) 
(মনুসংহিতা, ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৭৩৭)

"যে প্রগল্ভা স্ত্রী, কন্যাকে এইরূপে নষ্ট করে, ঐ স্ত্রীর মস্তক মুণ্ডন করাইয়া দিবেন; দুই অঙ্গুলিচ্ছেদ করিবেন, গর্দভে চড়াইয়া রাজমার্গে ভ্রমণ করাইবেন; দোষের নূন্যাধিক্যানুসারে প্রকারত্রয় জানিবে।" (৮/৩৭০) 
(মনুসংহিতা, ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৭৩৮)

"যে কোনো স্থানে হউক, পুরুষ মৈথুন করিয়া শকটে ও জলে এবং দিনে স্ত্রীতে মৈথুন করিয়া সেই বস্ত্রের সহিত তৎক্ষণাৎ স্থান করিবে।" (১১/১৭৫)
(মনুসংহিতা, ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৯৫৯) 

"A twice-born man who commits an unnatural offence with a male, or has intercourse with a female in a cart drawn by oxen, in water, or in the day-time, shall bathe, dressed in his clothes." (The Sacred Books of the East, F. Max Muller, Page - 466)

https://www.anandabazar.com/editorial/old-indian-mythology-have-some-hints-of-homosexuality-but-still-people-thinks-its-foreign-culture-1.864964  

৭) "আমাদের মধ্যে প্রত্যেকেই আমাদের অতীত অভিজ্ঞতার ফলস্বরূপ বিশেষ বিশেষ প্রকৃতি লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছি। হয় বলুন—উহা আমাদের পূর্বজন্মের কর্মফল, নয় বলুন—পুরুষানুক্রমে আমরা ঐ প্রকৃতি পাইয়াছি। যে ভাবেই আপনারা উহা নির্দেশ করুন না কেন, এই অতীতের প্রভাব আমাদের মধ্যে যেরূপেই আসিয়া থাকুক না কেন, ইহা সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে, আমরা আমাদের অতীত অবস্থার ফলস্বরূপ। এই কারণেই আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে বিভিন্ন ভাব, প্রত্যেকের দেহমনের বিভিন্ন গতি দেখিতে পাওয়া যায়। সুতরাং প্রত্যেককেই নিজ নিজ পথ বাছিয়া লইতে হইবে।" (পৃষ্ঠা ১১৭)

মতামত: পূর্বজন্মের কর্মফল আর জন্মান্তরবাদ নামক কুসংস্কারগুলো থেকে আমাদের সমাজ থেকে দূরীভূত হলেই কতিপয় উচ্চবর্ণের ধনী ব্যক্তির দ্বারা সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নশ্রেণির শ্রমজীবী মানুষের ওপর শোষণের পথ বন্ধ হবে; যুগে যুগে এভাবেই শাসকদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে এসেছেন এই ধর্মব্যবসায়ীরা, তার বদলে তাঁদের সামন্ত প্রভুদের থেকে পেয়েছেন উদার আর্থিক সাহায্য। আমরা সকলেই জানি যে কোনো কাজ না করে, শুধু সারাদিন ঠাকুর, ঠাকুর করার পরেও এই ধর্মব্যবসায়ীদের দু'বেলা অন্নসংস্থানে কোনসময় কোনো ঘাটতি হয় না।

উপরের উক্তি প্রমাণ করে, সেই একইপথের যাত্রী স্বামী বিবেকানন্দ।  

৮) "ভারতে কিন্তু ধর্ম বিষয়ে ভিন্ন মত অবলম্বন করার দরুন কখনও কাহার উপর অত্যাচার করা হয় নাই।" (পৃষ্ঠা ১২২)

মতামত: সর্বৈব মিথ্যা কথা। সতীদাহ থেকে শুরু করে বাল্যবিবাহ, কুলিন ব্রাহ্মণদের একাধিক স্ত্রী থেকে দেবদাসী বা বিধবা মহিলাদের পুনরায় বিবাহের অন্তরায় পরিস্থিতি হিন্দুরা ধর্মকে ব্যবহার করেই সৃষ্টি করেছিল।

৯) "দিব্য প্রেরণা ও প্রতারণার মধ্যে পার্থক্য কিরূপে বুঝা যাইবে? প্রথমতঃ দিব্যজ্ঞান কখনও যুক্তিবিরোধী হইবে না। বৃদ্ধাবস্থা শৈশবের বিরোধী নয়, উহার বিকাশমাত্র। এইরূপে আমরা যাহাকে প্রাতিভ বা দিব্যজ্ঞান বলি, তাহা যুক্তিবিচারজনিত জ্ঞানের বিকাশমাত্র। যুক্তিবিচারের ভিতর দিয়াই দিব্যজ্ঞানে পৌঁছিতে হয়। দিব্যজ্ঞান কখনই যুক্তির বিরোধী হইবে না। যদি হয়, তবে উহাকে টানিয়া দূরে ফেলিয়া দিন।" (পৃষ্ঠা ১২৩) 

আবার স্বামীজী নিজেই বলেছেন, "ধর্ম—মতমতান্তরে নাই, তর্কযুক্তিতে নাই; ধর্ম—হওয়া; ধর্ম অপরোক্ষানুভূতি।" (পৃষ্ঠা ১৩০)

বক্তব্য দুটি সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।

১০) "দিব্যপ্রেরণাসম্পন্না নারী যত আছে, ঐরূপ পুরুষও তত আছে। যদিও মেয়েদের এইটুকু বিশেষত্ব যে, তাঁহাদের মধ্যে বিশেষ প্রকার মূর্ছা ও স্নায়ুরোগ বেশী।" (পৃষ্ঠা ১২৪)

মতামত: আবার একটি নারীবিদ্বেষী মতামত, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বেশ কিছু স্নায়ুর রোগ নারীদের অপেক্ষা পুরুষদের বেশি হয় আর কিছু স্নায়ুর রোগ পুরুষদের অপেক্ষা নারীদের বেশি হয়। মূর্ছা রোগীদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একইরকম।

https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC4829467/#:~:text=Several%20neurological%20conditions%20are%20associated,and%20Multiple%20sclerosis%20in%20women.

https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC7561535/#:~:text=In%20another%20study%20%5B21%5D%20the,often%20in%20the%20NTG%20phase.

১১) "আমাদিগকে সর্বদা স্মরণ রাখিতে হইবে যে, ঈশ্বর প্রেমস্বরূপ—তিনি এ-সব অদ্ভুত ব্যাপারের ভিতর নাই। ‘উষিত্বা জাহ্নবীতীরে কূপং খনতি দুর্মতিঃ’—সে মূর্খ, যে গঙ্গাতীরে বাস করিয়া জলের জন্য একটা কূপ খুঁড়িতে যায়। সে মূর্খ, যে হীরার খনির নিকট থাকিয়া কাচদণ্ডের অন্বেষণে জীবন অতিবাহিত করে। ঈশ্বরই সেই হীরক-খনি। আমরা ভূতের অথবা এইরূপ সমুদয় উড়ন্ত পরীর গল্পের প্রতি বৃথা আসক্ত হইয়া ভগবানকে ত্যাগ করিতেছি—ইহা বাস্তবিক আমাদের মূর্খতা।" (পৃষ্ঠা ১২৪)

মতামত: আবার দ্বিচারিতা। তৃতীয় খণ্ডে স্বামীজী নিজেই বলেছেন, "যোগীদের মধ্যে কেহ কেহ দাবী করেন যে, এই শরীর তরল বাষ্প ইত্যাদিতে পরিণত হইবে। তুমি শরীর দ্বারা যাহা খুশী করিতে পারিবে—ইহাকে ছোট করিতে পার, এমন কি বাষ্পেও পরিণত করিতে পার, এই দেওয়ালের মধ্য দিয়া যাতায়াতও সম্ভব হইতে পারে—এই রকম তাঁহারা দাবী করেন। আমার অবশ্য তাহা জানা নাই। আমি কখনও কাহাকেও এরূপ করিতে দেখি নাই। কিন্তু যোগশাস্ত্রে এই-সব কথা আছে। যোগশাস্ত্রগুলিকে অবিশ্বাস করিবার কোন হেতু নাই।" (পৃষ্ঠা ৩৩৬)

ওঁর এই বক্তব্যটা ভূত বা উড়ন্ত পরীর গপ্পোর থেকে কম কিসে!

১২) "এই জগৎটা একটি ছোট শিশুর খেলার মত; আমরা যখন তা জানি, তখন জগতে যাই হোক না কেন, কিছুতেই আমাদের চঞ্চল করতে পারবে না।" (পৃষ্ঠা ১৬২)

মতামত: আমাদের চারপাশে বহু মানুষ অর্থের অভাবে দুবেলা পেট ভরে খেতে পায় না, কারো বা সন্তান দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, একটু চিকিৎসা করানোর মতো অর্থও জোগাড় করে উঠতে পারেন না - তারপরেও নাকি "জগৎটা ছোট শিশুর খেলার মত"! 

আসলে এই বাবাজীরা কোনোরকম কাজ না করেও শুধুমাত্র শাসক শ্রেণির তাঁবেদারি করে আর ভক্তদের সামনে আত্মা, পুনর্জন্ম আর পূর্বজন্মের কর্মফলের গাজর ঝুলিয়ে নিজেদের জন্য অন্নসংস্থান সহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাজের জন্য অর্থ জুগিয়ে নিতে পারেন; বাকিদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয় - তাই এইসব বাবাজীদের মুখেই এরকম অমানবিক, অবাস্তব কথাবার্তা শোভা পায়। 

১৩) "শ্রীরামকৃষ্ণদেব জগতের ভিতর পাপ বা অশুভ দেখতে পেতেন না—তিনি জগতে কিছু মন্দ দেখতে পেতেন না, কাজেই সেই মন্দ দূর করবার জন্য চেষ্টা করারও কোন প্রয়োজন বোধ করতেন না।" (পৃষ্ঠা ১৬৭)

"শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের ভিতর মানুষ-ভাবটা মরে গিছল, কেবল ঈশ্বরত্ব অবশিষ্ট ছিল। বাস্তবিকই তিনি পাপ দেখতে পেতেন না—যে-চোখে মানুষ পাপ বা অন্যায় দেখে, তার চেয়ে তাঁর দৃষ্টি পবিত্রতর ছিল।" (পৃষ্ঠা ২৩৩)

মতামত: সর্বৈব মিথ্যা কথা। "রামকৃষ্ণদেব রোগ যখন খুব বাড়াবাড়ি, ডাক্তার কোটস নামে এক ইউরোপীয় ডাক্তারকে ঠাকুরের কাছে আনা হয়। তিনি পরীক্ষা করে চলে যাবার পর ঠাকুরের আদেশে বিছানায় গঙ্গাজল ছিটানো হয়।" (শ্রীরামকৃষ্ণ কিছু অজানা প্রসঙ্গ, সুনীত দে, পৃষ্ঠা ১০০)

এরকম উদাহরণ আরো আছে।

https://www.anandabazar.com/patrika/last-days-of-ramakrishna-1.1189900

১৪) "স্ত্রীজাতি শক্তিস্বরূপিণী, কিন্তু এখন ঐ শক্তি কেবল মন্দ বিষয়ে প্রযুক্ত হচ্ছে। তার কারণ, পুরুষ তার উপর অত্যাচার করছে।" (পৃষ্ঠা ১৭৩)

"যীশুখ্রীষ্ট অসম্পূর্ণ ছিলেন, কারণ তিনি যে আদর্শ প্রচার করেছিলেন, তদনুসারে সম্পূর্ণভাবে জীবনযাপন করেননি, আর সর্বোপরি তিনি নারীগণকে পুরুষের তুল্য মর্যাদা দেননি।" (পৃষ্ঠা ২২৬)

মতামত:  পুনঃপুন সেই এক দ্বিচারিতা। "নবযুগের মহাপুরুষ" গ্রন্থে বর্ণিত আছে -

"স্বামীজী আত্মানন্দ প্রমুখ সন্ন্যাসী শিষ্যদের একদিন বলেছিলেন, "ভক্তের বাড়ীতে গিয়ে স্ত্রীভক্তের হাতের রান্না খেও না। এইরূপ করলে শরীর নষ্ট ও মন নিম্নমুখী হয়।"" (পৃষ্ঠা ১৫৬)

যে সব মহিলারা এখনও ঘরে স্বামী বিবেকানন্দের ছবি টাঙিয়ে রেখে রোজ পুজো করে যাচ্ছেন, তাঁরা একবার ভেবে দেখুন! 

১৫) "রামকৃষ্ণ বর্তমান যুগের উপযোগী ধর্মশিক্ষা দিতে এসেছিলেন, তাঁর ধর্ম গঠনমূলক, এতে ধ্বংসমূলক কিছু নেই। তাঁকে নূতন করে প্রকৃতির কাছে গিয়ে সত্য জানবার চেষ্টা করতে হয়েছিল, ফলে তিনি বৈজ্ঞানিক ধর্ম লাভ করেছিলেন।" (পৃষ্ঠা ১৭৫)

মতামত: "শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত" গ্রন্থ থেকে শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে কথোপকথনটা লক্ষ্য করুন -

"শ্রীরামকৃষ্ণ (বঙ্কিমের প্রতি) — কেউ কেউ মনে করে শাস্ত্র না পড়লে, বই না পড়লে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। তারা মনে করে, আগে জগতের বিষয়, জীবের বিষয় জানতে হয়, আগে সায়েন্স পড়তে হয়। (সকলের হাস্য) তারা বলে ঈশ্বরের সৃষ্টি এ-সব না বুঝলে ঈশ্বরকে জানা যায় না। তুমি কি বল? আগে সায়েন্স না আগে ঈশ্বর?

বঙ্কিম — হাঁ, আগে পাঁচটা জানতে হয়, জগতের বিষয়। একটু এ দিককার জ্ঞান না হলে, ঈশ্বর জানব কেমন করে? আগে পড়াশুনা করে জানতে হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ওই তোমাদের এক। আগে ঈশ্বর, তারপর সৃষ্টি। তাঁকে লাভ করলে, দরকার হয়তো সবই জানতে পারবে।"

এই হলো শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বৈজ্ঞানিক ধর্মের নমুনা।  

"নবযুগের মহাপুরুষ" গ্রন্থ থেকে আরেকটা উদাহরণ দেখে নেওয়া যাক -

"ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসিয়া বাবুরামের মন অন্তর্মুখী হইল। তিনি আর লেখাপড়ায় পূর্ববৎ মনোযোগ দিতে পারিলেন না। ১৮৮৩ বা ১৮৮৪ খৃষ্টাব্দে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষা দিলেন, কিন্তু উত্তীর্ণ হইতে পারিলেন না। এই সংবাদ পাইয়া ঠাকুর বলিলেন, 'ভালই হ'ল। তার বন্ধন ছিন্ন হ'ল। পাশ ত' নয়, পাশ (বন্ধন )।'" (পৃষ্ঠা ৬১)

এই হলো বর্তমান যুগের উপযোগী ধর্মের নমুনা।
 
https://www.ramakrishnavivekananda.info/kathamrita/unicodekathamrita/58_d_godorscience_1121_1123.html

১৬) "সর্বশক্তিমত্তা, সর্বব্যাপিতা ও অনন্ত দয়া—সেই জগজ্জননী ভগবতীর গুণ। জগতে যত শক্তি আছে, তিনিই তার সমষ্টিরূপিণী। জগতে যত শক্তির বিকাশ দেখা যায়, সবই সেই মা। তিনিই প্রাণরূপিণী, তিনিই বুদ্ধিরূপিণী, তিনিই প্রেমরূপিণী। তিনি সমগ্র জগতের ভিতর রয়েছেন, আবার জগৎ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক্। তিনি একজন ব্যক্তি—তাঁকে জানা যেতে পারে এবং দেখা যেতে পারে (যেমন রামকৃষ্ণ তাঁকে জেনেছিলেন ও দেখেছিলেন)।" (পৃষ্ঠা ১৭৭) 

মতামত: পুনরায় দ্বিচারিতা। দ্বিতীয় খণ্ডে স্বামী বিবেকানন্দ নিজেই বলেছিলেন, "আমরা ঈশ্বরকে ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করিতে পারি না। কেহই চক্ষুর দ্বারা ঈশ্বর দর্শন করে নাই, কখনও করিবেও না।" (পৃষ্ঠা ৩০৩)

হয় শ্রীরামকৃষ্ণ ঠিক, স্বামী বিবেকানন্দ ভুল নয়তো স্বামী বিবেকানন্দ ঠিক , শ্রীরামকৃষ্ণ ভুল। 

১৭) "আমাদের অনুভূত এই জগৎ সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণে উৎপন্ন। যেমন বল-সামান্তরিকে৩২ দুই বিভিন্নমুখী বলপ্রয়োগের ফলে একটি বস্তুতে কর্ণাভিমুখী গতির উৎপত্তি হয়, সেরূপ এই সংসারও আমাদের উপর প্রযুক্ত বিভিন্ন বিরুদ্ধ শক্তিসমূহের ফলস্বরূপ। এই জগৎ ব্রহ্মস্বরূপ ও সত্য; কিন্তু আমরা জগৎকে সেভাবে দেখছি না; যেমন শুক্তিতে রজত-ভ্রম হয়, তেমনি আমাদেরও ব্রহ্মে জগদ্‌ভ্রম হয়েছে। একেই বলে ‘অধ্যাস’। যে সত্তা একটা সত্য বস্তুর অস্তিত্বের উপর নির্ভর করে, তাকেই অধ্যস্ত সত্তা বলে।" (পৃষ্ঠা ১৮৩)

"বৃক্ষের বৃক্ষত্বটা মায়া—গাছ দেখবার সময় আমরা প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মস্বরূপকেই দেখছি, মায়া-আবরণে ঢাকা। কোন ঘটনা সম্বন্ধে ‘কেন’—এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসাটাই মায়ার অন্তর্গত। সুতরাং ‘মায়া কিরূপে এল?’—এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা বৃথা, কারণ মায়ার মধ্য থেকে ওর উত্তর কখনও দেওয়া যেতে পারে না; আর মায়ার পরে কে ঐ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে? মন্দ বা মায়া অসদ্‌দৃষ্টিই ‘কেন’—এই প্রশ্নের সৃষ্টি করে, কিন্তু ‘কেন’ প্রশ্ন থেকে মায়া আসে না—মায়াই ঐ ‘কেন’ জিজ্ঞাসা করে। ভ্রমই ভ্রমকে নষ্ট করে দেয়। যুক্তি-বিচার নিজেই একটা বিরোধের উপর প্রতিষ্ঠিত, সুতরাং এটা একটা চক্রস্বরূপ, কাজেই যুক্তি নিজেই নিজেকে ধ্বংস করবে। ইন্দ্রিয়জ অনুভূতি একটা আনুমানিক জ্ঞান, আবার সব আনুমানিক জ্ঞানের ভিত্তি অনুভূতি।" (পৃষ্ঠা ২১৫)

"আত্মাই সকল বস্তুর মূল সত্যস্বরূপ; আমরা যা কিছু দেখছি, সবই আত্মা—কিন্তু আমরা যেভাবে এদের নামরূপাকারে দেখছি, সেভাবে নয়। ঐ নামরূপ আবরণের অন্তর্গত—মায়ার অন্তর্গত।" (পৃষ্ঠা ২২৪)

"এই সমগ্র জগৎটাই একটা ভ্রমমাত্র, এটা যেন তোমায় আর প্রতারিত করতে না পারে। জগৎটা যা নয়, তুমি তাকে তাই বলে জেনেছ, অবস্তুতে বস্তু জ্ঞান করেছ, এখন এটা বাস্তবিক যা, একে তাই বলে জান।" (পৃষ্ঠা ২৪১)

"ভাবিয়া দেখুন, জগতের কোন বস্তুকেই আমরা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বস্তুরূপে চিন্তা করিতে পারি না। সর্বত্রই আমরা বস্তুর সঙ্গে স্বীয় মনকে সংযুক্ত করিয়া লই। বস্তুতঃ প্রকৃত চেয়ার হইতেছে—চেয়ার ও মনের উপর চেয়ার-বস্তুটির প্রতিক্রিয়ার সংযোগ।" (পৃষ্ঠা ২৬৩)

মতামত: এইসব ভাববাদী যুক্তিগুলোকে খণ্ডন করতে গেলে আমাদের বস্তুবাদী দর্শনের সাহায্য নিতে হবে।

"ভাববাদের প্রত্যক্ষ বিপরীতটা-ই হচ্ছে বস্তুবাদ।

বস্তুর একটা চৈতন্য নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র সত্তা আছে। এই যে সব ধারণা, - 'ব্রহ্ম সত্য', 'জগৎ মিথ্যা' বা 'জগৎ পরমাত্মার প্রকটিত রূপ মাত্র' অথবা 'পার্থিব যা কিছু তা কেবলমাত্র চৈতন্য কর্তৃকই অনুভূত উপলব্ধির সমষ্টি মাত্র', - মার্কসীয় বস্তুবাদ এগুলিকে ভাববাদী ধ্যানধারণা বলে অভিহিত করে ও তাকে বর্জন করে।

এই যে বিশ্বপ্রকৃতি তা ইন্দ্রিয়াতীত কোনও পরমাত্মার প্রকটিত রূপ নয়, নয় কোন মায়া। অপর পক্ষে তা রীতিমত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও স্বভাবতই তার মর্ম একেবারেই বস্তুগত। জগৎ সংসারের যা কিছু তা কোনও পরম চৈতন্যের লীলা খেলা নয়। বরঞ্চ তা বস্তুর গতিশীলতার-ই বিচিত্র অভিব্যক্তি মাত্র।

বস্তুর সত্তা স্বতন্ত্র এবং তা চৈতন্য নিরপেক্ষ। কিন্তু বস্তুর সাথে চেতনার কোনও সম্পর্ক আছে কি? হ্যাঁ, আছে। বস্তু এবং চেতনার পারস্পরিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে কার কি ধারণা সেই কষ্টি পাথর দিয়েই মার্কসীয় বস্তুবাদ বিচার করে থাকে, - কোন ধারণাটা বস্তুবাদী আর কোনটা ভাববাদী। যাঁরা মনে করে থাকেন, চেতনা নিরপেক্ষ বস্তুর স্বাধীন সত্তা আছে, চেতনা বস্তুরই প্রতিফলন মাত্র এবং বস্তু মুখ্য চেতনা গৌণ, তাঁরাই হলেন বস্তুবাদী। অপর পক্ষে যাঁরা মনে করেন চেতনা নিরপেক্ষ কোনও স্বাধীন সত্তা বস্তুর নাই, বস্তু চেতনার-ই নিছক একটা অনুভূতি মাত্র এবং চেতনা মুখ্য বস্তুই গৌণ, তাঁরা সকলেই হলেন কোন না কোন ধরণের ভাববাদী।

মনে করা যাক, চোখের সম্মুখে বাগানে একটা গোলাপ ফুল এবং তার রংটা লাল। ভাববাদীরা বলবেন, ওটাকে গোলাপ ফুল বলে মনে করা হচ্ছে ও তার রংটাকে লাল বলে অনুভূত হচ্ছে বলেই ওটা একটা লাল গোলাপ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তাঁদের মতে ঐ লাল গোলাপের চেতনা নিরপেক্ষ কোন স্বতন্ত্র সত্তা নাই। বস্তুবাদীরা বলবেন, ওটা অন্য ফুল না হয়ে গোলাপ বলেই গোলাপ ফুল মনে হচ্ছে এবং সেটা লাল বলেই সকলের অনুভূতিতে তার রক্তিম সাড়া জাগিয়েছে। চেতনা নিরপেক্ষ ঐ লাল বলেই সকলের অনুভূতিতে তার রক্তিমা সাড়া জাগিয়েছে। চেতনা নিরপেক্ষ ঐ লাল গোলাপটির একটা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব না থাকলে রাম, শ্যাম ও যদু - এই তিনটি সুস্থ মানুষই তাকে লাল গোলাপ বলে দেখতো না। কেউ তাকে নীল অপরাজিতা বা সাদা রজনীগন্ধা বলেও দেখতো। প্রকৃতপক্ষে বস্তুর প্রতিফলনেই অনুভূতির সঞ্চার।

মার্কসীয় বস্তুবাদের মতে, যে বস্তু চিন্তা করে তা থেকে চেতনাকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। কারণ বস্তুর স্বাধীন সত্তার প্রতিফলনে যেখানে চেতনার সঞ্চার ঘটে বা চিন্তার উদয় হয় সে মস্তিস্ক নিজেই মানব দেহের বস্তু সত্তা বিশিষ্ট অতীব সুসংগঠিত একটা অংশ। 

বস্তুর গতিশীলতার বিচিত্র অভিব্যক্তিতে সমৃদ্ধ এই যে বিশ্বপ্রকৃতি তা ইন্দ্রিয়গোচর এবং অবশ্যই স্বীকার্য যে, ইন্দ্রিয়ানুভূতির মাধ্যমেই তার প্রতিফলন মানব চেতনায় সঞ্চারিত হয়। কিন্তু, এই মানব ইন্দ্রিয়গুলি তো বস্তু সত্তাবিশিষ্ট এবং অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য। সুতরাং বস্তুজগৎ 'স্বয়ং সিদ্ধ সত্তায়' রহস্যাবৃত হয়ে মানুষের কাছে চির অজ্ঞেয় হয়ে থাকতে পারে না। কোনও একটা নির্দিষ্ট সময়ে বস্তুজগতের এই সত্তা বিষয়ে মানুষের জ্ঞান হয়তোঅসম্পূর্ণ বা সীমিত থাকতে পারে। কিন্তু ক্রমবর্ধিষ্ণু এই জ্ঞান ভাণ্ডারে আজ যা নাই, তা কালকের সংগ্রহের অপেক্ষায় আছে মাত্র। অতীতে এমন অনেক কিছু ছিল যার বস্তুসত্তা সেই সময়ে মানুষের কাছে দুর্জ্ঞেয় ছিল। কিন্তু কালক্রমে রসায়ন বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ তার গঠন প্রকৃতি শুধুমাত্র আবিষ্কার করেই ক্ষান্ত হয়নি, নিজ হাতে তাকে তৈরী করে তবে তৃপ্ত হয়েছে। সুতরাং বিশ্বপ্রকৃতির সত্তা অজ্ঞেয় বলে যে প্রচারিত ধারণা তাও এক রকমের ভাববাদ ছাড়া আর কিছু নয়। 

'অমৃতস্য পুত্রাঃ' বলেই অভিহিত করা হোক অথবা 'আশরাফুল মাখলুকাত' বলেই বর্ণনা করা হোক, এই যে মানুষ তা কোন 'পরমাত্মা'-র অংশ নয় অথবা কোনও অতি প্রাকৃত সর্বশক্তিমানের সৃষ্টি নয়। মানুষ বস্তুসত্তা সম্পন্ন এই বিশাল প্রকৃতিরই একটা অংশ মাত্র। 'সমগ্র'-র সাথে তার একটা 'অংশ'-র যে সম্পর্ক, প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্কটা সেইরকম। এই প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই একটা নিছক জীব থেকে তার মানুষ হয়ে গড়ে ওঠা। বেঁচে থাকবার তাগিদে, বেড়ে উঠবার তাগিদে মানুষের সাথে অবশিষ্ট প্রকৃতির যে সংগ্রাম সেই সংগ্রামের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠেছে মানুষের সমাজ। মানুষের কোন বিমূর্ত চৈতন্য তার অস্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে না। বরঞ্চ মানুষের সামাজিক অস্তিত্ব-ই তার চেতনাকে করছে নিয়ন্ত্রিত। সেই সমাজে যখন কোন পরিবর্তনের তাগিদ দেখা দেয় তখন সেই তাগিদ মানুষকেও পরিবর্তনের সপক্ষে সক্রিয় করে তোলে।"

(আগ্রহী পাঠকেরা শ্রী অরুণ চৌধুরী মহাশয়ের লেখা "দর্শ ধর্ম নৈতিকতা" বইটা পড়ে দেখতে পারেন)।

১৮) "রামানুজ বলেন, বেদই সর্বাপেক্ষা পবিত্র পঠনীয় গ্রন্থ। ত্রৈবর্ণিক অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য—এই তিন উচ্চ বর্ণের সন্তানদের যজ্ঞোপবীত-গ্রহণের পর অষ্টম, দশম বা একাদশ বর্ষ বয়সে বেদাধ্যয়ন আরম্ভ করা উচিত।" (পৃষ্ঠা ১৮৭)

মতামত: লক্ষণীয় যে, রামানুজের এই বক্তব্যকে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বক্তব্যের মধ্যে তুলে ধরলেও, এই বক্তব্যের তিনি কোনোরূপ বিরোধিতা করেননি। প্রাচীন সমাজে শূদ্রদের বেদাধ্যয়নের কোনো অধিকার ছিল না। 

মনুসংহিতাতে লেখা আছে, "অস্পষ্টরূপে বেদ পাঠ করিবে না, শূদ্রের নিকট কখন বেদ পড়িবে না, রাত্রির শেষ প্রহরে উঠিয়া বেদপাঠে শ্রান্ত হইলে আর শয়ন করিবে না।" (৪/৯৯)
(মনুসংহিতা, সম্পাদনা ও অনুবাদ ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৩৪৭)  

"যদি শূদ্র দর্প করিয়া দ্বিজাতিকে, তোমাদের এই ধর্ম্ম অনুষ্ঠেয়, এইরূপ ধর্ম্মোপদেশ দেয়, তবে রাজা উহার মুখে ও কর্ণে তপ্ত তৈল নিক্ষেপ করিবেন।" (৮/২৭২)
(মনুসংহিতা, সম্পাদনা ও অনুবাদ ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৭০৫)  

স্বামীজী "ধর্মে জাতিভেদ নাই; জাতিভেদ কেবল সামাজিক ব্যবস্থা" বলে বর্বর জাতিভেদ প্রথাকে যতই তিনি আড়াল করতে চেষ্টা করুন না কেন, বাস্তবে তিনি ছিলেন জাতিভেদ প্রথার উগ্র সমর্থক। (প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫) 

১৯) "কর্ম কর, কিন্তু কর্মফল ভগবানে অর্পণ কর।" (পৃষ্ঠা ১৮৮)

মতামত: শ্লোকটা গীতা থেকে নেওয়া। বাস্তবে এই সকল প্রতিষ্ঠানিক ধর্মসমূহের ঠিকাদারেরা সর্বদাই শাসকের তাঁবেদারি করে। এই উক্তিটিকে মুক্তমনে পড়লে বোঝা যায় যে এইরূপ শ্লোকের দ্বারা উচ্চবর্ণের স্বার্থে নিম্নশ্রেণীকে বেগার খাটার জন্য আহ্বান করা হচ্ছে। 

স্বামী বিবেকানন্দও ছিলেন সামন্তবাদ সমাজের সমর্থক, তাই তিনি বারংবার আত্মা, পূর্বজন্মের কর্মফল, জন্মান্তরবাদ নামক তত্ত্বগুলোকে সামনে রেখে সংখ্যাগরিষ্ঠ শূদ্র, নিপীড়িতদের ক্ষোভে জল ঢালার কাজ করে গেছেন; যেন তাঁরা কোনোভাবেই শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা না করে।

২০) "বেদের প্রমাণ এই যে, তা ব্রহ্ম হতে প্রসূত হয়েছে, আবার ব্রহ্মের প্রমাণ এই যে, বেদের মত অদ্ভুত গ্রন্থ ব্রহ্ম ব্যতীত আর কারও প্রকাশ করবার সাধ্য নেই।" (পৃষ্ঠা ১৯০)

মতামত: যুক্তিবাদের ভাষায় শঙ্কর বা স্বামীজীর এই বক্তব্য চক্রাকার কুযুক্তি বা ফ্যালাসি (Circular logic Fallacy)।

https://www.shongshoy.com/%e0%a6%95%e0%a7%81%e0%a6%af%e0%a7%81%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%bf-%e0%a6%ac%e0%a6%be-%e0%a6%ab%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%bf/

২১) "ক্রিয়া হতে থাক, কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া যেন না আসে; ক্রিয়া থেকে সুখই হয়ে থাকে, সমুদয় দুঃখ হচ্ছে প্রতিক্রিয়ার ফল। শিশু আগুনে হাত দেয়—তার সুখ হয় বলেই; কিন্তু যখনই তার শরীর প্রতিক্রিয়া করে, তখনই পুড়ে যাওয়ার কষ্টবোধ হয়ে থাকে। ঐ প্রতিক্রিয়াটা বন্ধ করতে পারলে আমাদের আর ভয়ের কারণ কিছু নেই। মস্তিষ্ককে নিজের বশে নিয়ে এস, যেন সে প্রতিক্রিয়াটার খবর না রাখতে পারে।" (পৃষ্ঠা ১৯৮)

মতামত: কাঁঠালের আমসত্ত্ব।

২২) "যারা উত্তম অধিকারী, তারা যোগে খুব শীঘ্র শীঘ্র উন্নতি করতে পারে—ছ-মাসে তারা যোগী হতে পারে। যারা তদপেক্ষা নিম্নাধিকারী, তাদের যোগে সিদ্ধিলাভ করতে কয়েক বৎসর লাগতে পারে, আর যে-কোন ব্যক্তি নিষ্ঠার সঙ্গে সাধন করলে, অন্য সব কাজ ছেড়ে দিয়ে কেবল সদা সর্বদা সাধনে রত থাকলে দ্বাদশ বর্ষে সিদ্ধিলাভ করতে পারে। এই-সব মানসিক ব্যায়াম না করে কেবল ভক্তি দ্বারাও ঐ অবস্থায় যেতে পারা যায়, কিন্তু তাতে কিছু বিলম্ব হয়।" (পৃষ্ঠা ২১১)

মতামত: এ কী! এতো পুরো যোগ শাস্ত্রের ওয়ারেন্টি কার্ড (warranty card)।

২৩) "আমরা যে অপরের সেবা করতে পারছি, এ আমাদের একটা বিশেষ সৌভাগ্য—কারণ ঐরূপ অনুষ্ঠানের দ্বারাই আমাদের আত্মোন্নতি হবে। লোকে যে কষ্ট পাচ্ছে, তার কারণ তার উপকার করে আমাদের কল্যাণ হবে।" (পৃষ্ঠা ২১৭)

মতামত: স্বামীজীর বারংবার বাসনামুক্ত হওয়ার কথা বলেছেন কিন্তু নিজেদের আত্মোন্নতি বা কল্যাণের কামনা করাটাও কী বাসনা নয়? 

ভবিষ্যতে বিজ্ঞান যদি বন্যার স্থায়ী সমাধান করতে পারে, তাহলে মিশনের বাবাজীরা কাকে খিচুড়ি খাওয়াবেন? 

মানুষের সমস্যা সমাধান করার জন্য বিজ্ঞান চেষ্টা চালিয়ে যাবে কিন্তু রামকৃষ্ণ মিশনের মতো আধ্যাত্মিক সংগঠনগুলো চাইবে যে বন্যা হতে থাকুক, যাতে বাবাজীরা খিচুড়ি বিলিয়ে নিজেদের কল্যাণ করতে পারেন। 

২৪) "কজন অন্ধ বলে, ‘প্রত্যেক জিনিষের ভিন্ন ভিন্ন রকমের প্রতিধ্বনি আছে, সুতরাং আমি হাততালি দিয়ে বিভিন্ন জিনিষের প্রতিধ্বনি দ্বারা আমার চতুর্দিকে কোথায় কি আছে, ঠিক ঠিক বলতে পারি।’" (পৃষ্ঠা ২১৯)

মতামত: বাস্তবে এরকম হলে অন্ধ ব্যক্তিদের White Canes ব্যবহারের প্রয়োজন হতো না। এখন অন্ধদের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত এই লাঠিটি সামনের, ডানদিকের, বামদিকের বাধাগুলিকে সনাক্ত এবং এড়ানোর জন্য অন্ধব্যক্তিকে সাহায্য  করতে পারে। আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে White Canes-কে দিনে দিনে আরো উন্নত করার জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। 

https://www.healthline.com/health/white-cane
https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC6339061/

২৫) "মানুষ নিজের মস্তিষ্ক থেকে ভগবানকে সৃষ্টি করে না; তবে তার যতদূর শক্তি, সে সেইভাবে তাঁকে দেখতে পারে, আর তার যত ভাল ভাল ধারণা তাঁতে আরোপ করে।" (পৃষ্ঠা ২৩১)

মতামত: আবার একটা দ্বিচারিতা। তৃতীয় খণ্ডে স্বামীজী নিজেই বলেছেন, "‘ঈশ্বর মানুষকে নিজ প্রতিবিম্বরূপে সৃষ্টি করিলেন’—এ কথা ভুল। মানুষ নিজ প্রতিবিম্ব অনুযায়ী ঈশ্বরকে সৃষ্টি করে—এই কথাই সত্য। সমগ্র জগতে আমরা আমাদের প্রতিবিম্ব অনুযায়ী ঈশ্বর বা দেবতা সৃষ্টি করিতেছি।" (পৃষ্ঠা ৫৩)

দুটি বক্তব্য সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী। 

২৬) "যদি অদ্বৈতবাদী হও, তবে তুমি তো স্বয়ংই ব্রহ্মস্বরূপ—তোমার আবার কর্তব্য কি? তোমার স্বামী, ছেলেপুলে, বন্ধুবান্ধব—কারও প্রতি কিছু কর্তব্য নেই। যা হচ্ছে হয়ে যাক্, চুপচাপ করে পড়ে থাক।" (পৃষ্ঠা ২৪১)

মতামত: নিজের ইচ্ছেয় একটি শিশুকে পৃথিবীতে এনে তাঁর প্রতি কর্তব্য না করার বিধান কতটা ন্যায় সঙ্গত তার বিচার পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিলাম।

এমনকি শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য ও স্বামী বিবেকানন্দের গুরুভ্রাতা, স্বামী ব্রহ্মানন্দ তাঁর স্ত্রী বিশ্বেশ্বরী দেবী ও তাঁর পুত্রসন্তানকে ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হন, নিজ স্বামীকে হারিয়ে বিশ্বেশ্বরী দেবী আত্মহত্যার পথ গ্রহণ করতে বাধ্য হন। (ব্রহ্মানন্দ-লীলাকথা, পৃষ্ঠা ১৬, ১৭)

২৭) "নারীজাতি শত শত যুগ ধরে দুঃখকষ্ট সহ্য করেছে, তাই তাদের ভিতর অসীম ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের বিকাশ হয়েছে। তারা একটা ভাব আঁকড়ে ধরে থাকে, সহজে ছাড়তে চায় না। এই জন্যই সকল দেশে তারা এমন-কি কুসংস্কারপূর্ণ ধর্মসমূ্হের এবং পুরোহিতদের পৃষ্ঠপোষক-স্বরূপ হয়ে থাকে, আর এইটেই পরে তাদের স্বাধীনতার কারণ হবে।" (পৃষ্ঠা ২৪৩)

"পুরুষেরা ধর্মের দার্শনিক বিচারে সমর্থ। নারী স্বভাবতঃ ভক্তিপ্রবণ; সে ভগবানকে ভালবাসে হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে, বুদ্ধি দিয়ে নয়।" (পৃষ্ঠা ৩২২)

মতামত: নারীদের সম্বন্ধে স্বামীজীর মনুবাদী ধারণাসমূহ, কারণ ওঁর দৃষ্টিতে নারী পুরুষের কখনও সমান নয় আর এই কারণেই উনি মনুবাদী।

মনুসংহিতাতে লেখা আছে, "শয়ন, উপবেশন, ভূষণ, কাম, ক্রোধ, কৌটিল্য, পরহিংসা, ঘৃণিত ব্যবহার, এই সকল স্ত্রীলোকের স্বভাবগত, ইহা সৃষ্টিসময়ে মনু স্বয়ং কল্পনা করিয়াছেন।" (৯/১৭)

"যেহেতু স্ত্রীলোকদিগের মন্ত্র দ্বারা জাতকর্ম্মাদি সংস্কার হয় না, এজন্য উহাদিগের নির্ম্মল অন্তঃকরণ হয় না, এবং বেদস্মৃতিতে অধিকার নাই, এজন্য উহারা ধর্মজ্ঞ হইতে পারে না, এবং ইহাদিগের কোন মন্ত্রে অধিকার নাই, এজন্য পাপ হইলে মন্ত্র দ্বারা তাহা ক্ষালন করিতে পারে না; অতএব ইহারা কেবল মিথ্যা পদার্থ।" (৯/১৮)   
(মনুসংহিতা, ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৭৬০)

"লোভহীন এক ব্যক্তিও সাক্ষী হইবে, অনেক স্ত্রীলোক শুচি হইলেও অস্থিরবুদ্ধি প্রযুক্ত সাক্ষী হইতে পারিবে না, এবং চৌর্য্যাদি দোষাক্রান্ত ব্যক্তি স্ত্রী বা পুরুষ হউক, সাক্ষী হইতে পারে না।" (৮/৭৭)
(মনুসংহিতা, ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৬২৬)

২৮) "জগতের ইতিহাস হইল—পবিত্র, গম্ভীর, চরিত্রবান্‌ এবং শ্রদ্ধাসম্পন্ন কয়েকটি মানুষের ইতিহাস।" (পৃষ্ঠা ২৬৮)

মতামত: আজ্ঞে না, আজও পর্যন্ত আবিষ্কৃত সমস্ত সমাজের ইতিহাস হল শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস।

বস্তুবাদী ব্যাখ্যায় আজ পর্যন্ত সমাজ বিকাশের পাঁচটি স্তর দেখা যায় - (১) আদিম সাম্যবাদী সমাজ (২) দাস সমাজ (৩) সামন্ততান্ত্রিক সমাজ (৪) ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী সমাজ (৫) সমাজতান্ত্রিক সমাজ। শ্রেণী সংগ্রামের মধ্য দিয়েই মানুষ একটি স্তর থেকে পরবর্তী স্তরে পদার্পন করতে পারে।

২৯) "একদিন সন্ধ্যার সময় আমি একটি যুবককে একটি তরুণীর জন্য অপেক্ষা করিতে দেখিয়াছিলাম। ... মনে করিলাম, যুবককে পরীক্ষা করিবার ইহা একটি উপযুক্ত অবসর। সে তাহার প্রেমের গভীরতার মধ্য দিয়া অতীন্দ্রিয় দর্শন ও দূর-শ্রবণের ক্ষমতা লাভ করে। ষাট কি সত্তর বার যুবকটি একবারও ভুল করে নাই, এবং তরুণী ছিল দুইশত মাইল দূরে। (সে বলিত) ‘এইভাবে তরুণী সাজগোজ করিয়াছে।’ (কিংবা) ‘ঐ সে চলিয়া যাইতেছে।’ আমি ইহা নিজের চোখে দেখিয়াছি।" (পৃষ্ঠা ২৮৭)

"গুরু আপনার নিকট মানবরূপে আসিতে পারেন এবং আপনি তাঁহার নিকট শক্তিলাভও করিতে পারেন। কখনও কখনও তিনি স্বপ্নে দেখা দিয়া শক্তি সঞ্চার করেন। গুরুর শক্তি আমাদের নিকট নানাভাবে আসিতে পারে।" (পৃষ্ঠা ৩১২)

মতামত: এইসব অসার বক্তব্যগুলোকে গল্পের গোরুকে গাছে চড়ানো ছাড়া আর কিছু বলতে পারি না।

৩০) "আমার গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণ অসুস্থ হইয়া পড়িলে জনৈক ব্রাহ্মণ রোগমুক্তির জন্য তাঁহাকে তাঁহার প্রবল মনঃশক্তি প্রয়োগ করিতে বলিয়াছিল। তাহার মতে—আচার্যদেব যদি দেহের রোগাক্রান্ত অংশটির উপর তাঁহার মন একাগ্র করেন,—তবে অসুখ সারিয়া যাইবে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলিলেন, ‘কি! যে-মন ঈশ্বরকে দিয়াছি, সেই মন এই তুচ্ছ শরীরে নামাইয়া আনিব?’ দেহ এবং রোগের কথা তিনি ভাবিতে চাহিলেন না। তাঁহার মন সর্বদা ঈশ্বরে তন্ময় হইয়া থাকিত। সে-মন সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরে অর্পিত হইয়াছিল। তিনি এই মন অন্য কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করিতে রাজী ছিলেন না।" (পৃষ্ঠা ৩১০)

মতামত: মুখে যতই বিজ্ঞানের সব কিছু ধর্মগ্রন্থে আছে বলে দাবী করুন না কেন, বাস্তবে বাবাজীদের শরীর খারাপ হলে সেই চিকিৎসা বিজ্ঞানেরই সাহায্য নিয়ে থাকেন। শ্রীরামকৃষ্ণের শরীর খারাপের সময় বহু ডাক্তারকে দেখানো হয়েছিল; তার মধ্যে অন্যতম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় এমডি ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার। এছাড়াও সময়ে সময়ে হোমিয়োপ্যাথিক ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল দত্ত, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডাক্তার জে এম কোটস শ্রীরামকৃষ্ণের চিকিৎসা করেছেন। 

৩১) "আমরা সারা জীবন পুস্তক পাঠ করিতে পারি, খুব একজন বুদ্ধিমান্ হইয়া উঠিতে পারি, কিন্তু শেষে দেখিব—আধ্যাত্মিক উন্নতি কিছুই হয় নাই। বুদ্ধিবৃত্তির উন্নতি হইলেই যে সঙ্গে সঙ্গে আধ্যাত্মিক উন্নতিও খুব হইবে, তাহার কোন অর্থ নাই। গ্রন্থপাঠ করিতে করিতে অনেক সময় ভ্রমবশতঃ ভাবি, আমাদের আধ্যাত্মিক উপকার হইতেছে। কিন্তু গ্রন্থপাঠে আমাদের কি ফল হইয়াছে, তাহা যদি ধীরভাবে বিশ্লেষণ করি, তবে দেখিব বড়জোর আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির উন্নতি হইয়াছে, অন্তরাত্মার কিছুই হয় নাই। আমাদের মধ্যে প্রায় সকলেরই আধ্যাত্মিক বাক্যবিন্যাসে অদ্ভুত নৈপুণ্য থাকিলেও কার্যকালে—প্রকৃত ধর্মভাবে জীবন-যাপন করিবার সময়—কেন এত ভয়াবহ ত্রুটিবিচ্যুতি লক্ষিত হয়, তাহার কারণ—আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতির পক্ষে গ্রন্থরাশি পর্যাপ্ত নয়। জীবাত্মার শক্তি জাগ্রত করিতে হইলে অপর এক আত্মা হইতে শক্তি সঞ্চারিত হওয়া আবশ্যক।" (পৃষ্ঠা ১৭)

"বাজে পুস্তক না পড়িয়া ঈশ্বর-বিষয়ক সদ্গ্রন্থ পড়িতে হইবে।" (পৃষ্ঠা ৭৪)

"আপনারা জগতের সব গ্রন্থ পড়িতে পারেন, কিন্তু বক্তৃতাশক্তি, উচ্চতম মেধা বা নানাবিধ বিজ্ঞান অধ্যয়নের দ্বারা এই প্রেম লাভ করা যায় না। তিনি যাহাকে ইচ্ছা করেন, সেই তাঁহাকে লাভ করে। তাহার নিকটই ভগবান্ আত্মপ্রকাশ করেন।" (পৃষ্ঠা ৮৫)

"এই-সব বই, এই-সব বিজ্ঞান—আমাদিগকে কিছুই শিখাইতে পারিবে না। বই পড়িয়া আমরা তোতাপাখি হই, বই পড়িয়া কেহ পণ্ডিত হয় না। যে ব্যক্তি প্রেমের একটি অক্ষর পাঠ করিয়াছে, সে-ই প্রকৃত পণ্ডিত।" (পৃষ্ঠা ৮৫)

"বাহির হইতে যে-শক্তি আসার কথা বলা হইল, উহা গ্রন্থ হইতে পাওয়া যায় না। এক আত্মা অপর আত্মা হইতেই শক্তি লাভ করিতে পারে, অন্য কিছু হইতে নয়। আমরা সারা জীবন বই পড়িতে পারি, খুব বুদ্ধিমান্ হইয়া উঠিতে পারি, কিন্তু পরিণামে দেখিব—আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি কিছুমাত্র হয় নাই। বুদ্ধি খুব উন্নত ও বিকশিত হইলেও যে সঙ্গে সঙ্গে তদনুযায়ী আধ্যাত্মিক উন্নতিও হইবে, তাহার কোন যুক্তি নাই; বরং আমরা প্রায় প্রত্যহই দেখিতে পাই, বুদ্ধির যতটা উন্নতি হইয়াছে, আত্মার সেই পরিমাণে অবনতি ঘটিয়াছে।

বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে গ্রন্থ হইতে অনেক সাহায্য পাওয়া যায় বটে, কিন্তু আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করিতে গেলে গ্রন্থ হইতে কোন সাহায্যই পাওয়া যায় না বলিলেই হয়। গ্রন্থ পাঠ করিতে করিতে কখনও কখনও ভ্রমবশতঃ আমরা মনে করি, উহা হইতে আধ্যাত্মিক সহায়তা পাইতেছি, কিন্তু যদি অন্তর বিশ্লেষণ করিয়া দেখি, তবে বুঝিব—উহাতে আমাদের বুদ্ধিই কিছুটা সাহায্য পাইয়াছে মাত্র, আত্মার কিছুই হয় নাই। এই জন্যই আমরা প্রায় সকলেই ধর্মসম্বন্ধে সুন্দর সুন্দর বক্তৃতা দিতে পারি, অথচ ধর্মানুযায়ী জীবন-যাপনের সময় অনুভব করি—আমাদের শোচনীয় অক্ষমতা। ইহার কারণ—আধ্যাত্মিক উদ্দীপনার জন্য বাহির হইতে যে শক্তির প্রয়োজন, পুস্তক হইতে তাহা পাওয়া যায় না। আত্মাকে জাগ্রত করিতে হইলে অপর এক আত্মা হইতেই শক্তি সঞ্চারিত হওয়া একান্ত আবশ্যক।" (পৃষ্ঠা ৮৭)

"হৃৎপদ্ম একবার প্রস্ফুটিত হইলে নদী-প্রস্তর চন্দ্র-তারকা প্রভৃতি হইতে শিক্ষা গ্রহণ করা যাইতে পারে—ইহাদের সকলের নিকট হইতেই কিছু না কিছু আধ্যাত্মিক শিক্ষা পাওয়া যাইতে পারে। কিন্তু যাহার হৃৎপদ্ম এখনও প্রস্ফুটিত হয় নাই, সে শুধু নদী ও প্রস্তরই দেখিবে।" (পৃষ্ঠা ৯২)

"জ্ঞান অপেক্ষা উচ্চতর ও পবিত্রতর আর কিছু নাই; গুরুর মাধ্যমে উহা মানবাত্মায় আবির্ভূত হইয়া থাকে। সিদ্ধ যোগী হইলে ঐ জ্ঞান আপনা-আপনি আসিয়া থাকে, গ্রন্থ হইতে উহা লাভ করা যায় না!" (পৃষ্ঠা ৯৩)

"বই পড়িলেই ধর্ম হয় না, তর্কবিচার করিতে পারিলেই ধর্ম হয় না, অথবা কতকগুলি মতবাদে সম্মতি প্রকাশ করিলেই ধর্ম হয় না।" (পৃষ্ঠা ৯৮)

"আপনারা সকলেই সম্ভবতঃ বিজ্ঞানবাদ (Idealism) সম্বন্ধে অনেক গ্রন্থ পড়িয়াছেন। এই মতবাদ অনুসারে এই জগতের অস্তিত্ব নাই, আপনাদেরও অস্তিত্ব নাই। এরূপ কথা যাহারা বলে, আপনারা তাহাদের কথা বিশ্বাস করেন না, কারণ তাহারা নিজেরাই নিজেদের কথা বিশ্বাস করে না। তাহারা জানে যে, ইন্দ্রিয়গণের সাক্ষ্য এইরূপ সহস্র সহস্র বৃথা বাগাড়ম্বর অপেক্ষা বলবান্। ধার্মিক হইতে গেলে আপনাদিগকে প্রথমেই গ্রন্থ ফেলিয়া দিতে হইবে। বই যত কম পড়েন, ততই ভাল।" (পৃষ্ঠা ৯৯)

"বয়সে বড় হইতে পারি এবং জগতের সব বই পড়িয়া ফেলিতে পারি, কিন্তু ধর্মরাজ্যে আমরা শিশুমাত্র।" (পৃষ্ঠা ১০১)

"আমার মতে গ্রন্থ দ্বারা জগতে ভাল অপেক্ষা মন্দ অধিক হইয়াছে। এই যে নানা ক্ষতিকর মতবাদ দেখা যায়, সেগুলির জন্য এই-সকল গ্রন্থই দায়ী। মতামতগুলি সব গ্রন্থ হইতেই আসিয়াছে, আর গ্রন্থগুলিই জগতে যত প্রকার অত্যাচার ও গোঁড়ামির জন্য দায়ী। বর্তমানকালে গ্রন্থসমূহই সর্বত্র মিথ্যাবাদী সৃষ্টি করিতেছে। সকল দেশেই মিথ্যাবাদীর সংখ্যা বাড়িতেছে দেখিয়া আমি আশ্চর্য হই।" (পৃষ্ঠা ১০৯)

"প্রাচীন হিন্দুরা অদ্ভুত পণ্ডিত ছিলেন—যেন জীবন্ত বিশ্বকোষ। তাঁরা বলতেন, বিদ্যা যদি পুঁথিগত হয়, আর ধন যদি পরের হাতে থাকে, কার্যকাল উপস্থিত হলে সে-বিদ্যা বিদ্যা নয়, সে-ধনও ধন নয়।" (পৃষ্ঠা ১৮৯)

"শাস্ত্র বা বই পড়ে দার্শনিক জ্ঞান বা তত্ত্বজ্ঞান হয় না; বরং যত বই পড়বে, ততই মন গুলিয়ে যাবে।" (পৃষ্ঠা ১৯৭)

"নিজের ঘরে গিয়ে বস, আর নিজের অন্তরাত্মার ভিতর থেকে উপনিষদের তত্ত্বগুলি আবিষ্কার কর। তুমি সকল বিষয়ের অনন্তখনিস্বরূপ, ভূত-ভবিষ্যৎ সকল গ্রন্থের মধ্যে তুমিই শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।" (পৃষ্ঠা ২২০)

"গ্রন্থাদিও ধাত্রীর কাজই করিয়া থাকে, কিন্তু আমাদের চেষ্টা করিয়া সেই অবস্থায় উপনীত হইতে হইবে, যেখানে মানুষ উপলব্ধি করিবে, সে তাহার শরীরের প্রভু।" (পৃষ্ঠা ২৬৪)

"এ-সকল রহস্যপূর্ণ পবিত্র শব্দরাশি আমরা জানি এবং বুঝিতে পারি, কিন্তু কেবল গ্রন্থাদিতে পড়িলেই ঐগুলি আমাদের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করিতে পারিবে না। শব্দগুলি ভাবপূর্ণ হইলে এবং সাধনা করিয়া যিনি স্বয়ং ভগবানের স্পর্শ লাভ করিয়াছেন এবং এখনও ভাগবত জীবন যাপন করেন, এরূপ ব্যক্তির স্পর্শ থাকিলে ঐগুলি ফলপ্রদ হয়।" (পৃষ্ঠা ২৬৫)

"মনে রাখিও—পাণ্ডিত্যের কোন মূল্য নাই। পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে তোমাদের সকলেরই ধারণা ভুল। মনকে বলিষ্ঠ ও সুনিয়ন্ত্রিত করার মধ্যেই জ্ঞানের একমাত্র মূল্য। আমি অবাক্ হইতেছি যে অনন্ত কাল ধরিয়া এই গলাধঃকরণের দ্বারা আমাদের বদহজম হইতেছে না কেন? আমাদের এইখানেই থাকিয়া যাবতীয় পুস্তক পুড়াইয়া ফেলা প্রয়োজন এবং নিজেদের অন্তরে চিন্তা করা কর্তব্য।" (পৃষ্ঠা ২৭৩)

"জগতে অনেক লোক-শিক্ষক আছেন, কিন্তু দেখিতে পাইবে—(তাঁহাদের অধিকাংশই) একদেশী। কাহারও দৃষ্টি বুদ্ধিবৃত্তির প্রখর মধ্যাহ্নসূর্যের উপর, অন্য কিছুই তাঁহার চোখে পড়ে না। অপর কেহ বা শুনেন প্রেমের সুমধুর গীতি এবং ইহা ছাড়া আর কিছুতে কান দিতে পারেন না। আবার আর একজন আছেন কাজে (ডুবিয়া), তাঁহার অনুভূতি বা চিন্তার সময় নাই। এরূপ একজন মহামানব কেন (চাও) না—যিনি যেমন কর্মী, তেমনি জ্ঞানী, আবার সমানভাবে প্রেমিক? ইহা কি সম্ভব?—নিশ্চয়ই নয়।" (পৃষ্ঠা ২৭৮)

"(কেবলমাত্র) গ্রন্থ-অধ্যয়নে (লোকে) শুষ্ক হইয়া যায়। কে বিদ্বান্‌?—যে অন্ততঃ একবিন্দু প্রেমও অনুভব করিতে পারে।" (পৃষ্ঠা ২৮৮)

"শুধু বুদ্ধির দ্বারা জানা যায় না। ... হাজার হাজার বই পড়িয়াও তুমি জানিতে সমর্থ হইবে না ... যখন আমরা ইহা বুঝিতে আরম্ভ করি, সমুদয় জগৎ-রহস্য যেন আমাদের সম্মুখে খুলিয়া যায়। ... একটি ছোট মেয়ে তাহার পুতুল লইয়া খেলিতেছে—সব সময় সে নূতন নূতন স্বামী পাইতেছে, কিন্তু যখন তাহার সত্যকারের স্বামী আসে, তখন (চিরদিনের জন্য) সে তাহার পুতুল-স্বামীগুলি দূরে ফেলিয়া দেয়। ... জগতের সবকিছু সম্বন্ধে ঐ একই কথা।" (পৃষ্ঠা ২৯১)

"আমরা বক্তৃতা শুনি, পুস্তক পড়ি, ঈশ্বর আত্মা ধর্ম ও মুক্তি সম্বন্ধে তর্কবিতর্ক করি। এগুলি আধ্যাত্মিকতা নয়, কারণ আধ্যাত্মিকতা পুস্তকে দর্শনে বা মতবাদে নাই। ইহা বিদ্যা বা বিচারে নাই, অন্তরের প্রকৃত বিকাশে নিহিত। তোতাপাখিও বুলি মনে রাখিয়া আওড়াতেই পারে। যদি আপনি বিদ্বান্ হইয়া থাকেন, তাহাতে কি আসে যায়? গর্দভেরা সমগ্র গ্রন্থাগারটি পৃষ্ঠে বহন করিয়া লইয়া যাইতে পারে। সুতরাং যখন যথার্থ আলোক আসিবে, তখন পুঁথিগত বিদ্যার আর প্রয়োজন হইবে না। নিজের নামটি পর্যন্ত সই করতে অক্ষম ব্যক্তিও ধার্মিক হইতে পারেন, আবার পৃথিবীর যাবতীয় গ্রন্থাগারের জ্ঞানরাশি যাঁহার মস্তকে পুঞ্জীভূত আছে, তিনিও পারেন না। আধ্যাত্মিক উন্নতি পুঁথিগত বিদ্যার অপেক্ষা রাখে না। পাণ্ডিত্যের উপর আধ্যাত্মিকতা নির্ভর করে না। গুরুর স্পর্শ—শক্তি-সঞ্চার দ্বারা আপনার হৃদয় জাগ্রত হইবে।" (পৃষ্ঠা ৩১২)

মতামত: স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বহু বক্তব্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সরাসরি বিরোধিতা করছেন কারণ, বিজ্ঞান নির্ভর, কুসংস্কার-মুক্ত শিক্ষাই আমাদের ধর্মের বেড়াজাল ভেঙে বের করে আনতে পারে; বিচার বুদ্ধি যুক্তিবোধ তৈরী করে, প্রশ্ন করতে শেখায়, যেটা কখনই তাঁর কাম্য ছিল না। বক্তব্যগুলো মুক্ত মনে পড়লেই বোঝা যায় যে, তিনি তাঁর ভক্তদের বিজ্ঞান নির্ভর শিক্ষা থেকে সরিয়ে বেদান্তভিত্তিক অনন্ত সর্বজ্ঞ আত্মাকে খুঁজে বেড়ানোর কাজে প্রভাবিত করতে চান; যাতে তাঁর সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের শোষণের ক্ষেত্রকে সুরক্ষিত করে রাখা যায়।

একটা প্রশ্ন থেকেই যায় - স্বামীজীর কথা অনুযায়ী বইপত্র পড়ে যখন কিছুই হয় না, তারপরেও রামকৃষ্ণ মিশন তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে চালিয়ে যাচ্ছে কেন? আর্থিক লাভের জন্য নয় নিশ্চয়ই!