Saturday, 11 November 2023

শ্রীরামকৃষ্ণ কিছু অজানা প্রসঙ্গ - সুনীত দে

আমাদের সভ্যতা সেই কবেকার। যার তুলনায় ইউরোপীয় সভ্যতা নেহাৎ শিশু মাত্র। কিন্তু তারাই আজ কোথায় এগিয়ে চলে গেল, আমরা পড়ে রইলাম পিছনে। কেন এমন হলো? আমাদেরই তো উচিত ছিল সবার আগে থাকার। কিন্তু তা তো হল না। কোটি কোটি টাকা বিদেশী ঋণের বোঝার নীচে আমরা চাপা পড়ে রইলাম। নিশ্চয়ই এর পিছনে অনেক কারণ আছে। সব কারণ আমার জানা নেই। তবে একটা কারণ নিশ্চিৎ - তা হলো যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞানকে অবহেলা করে ধর্ম নিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের অত্যাধিক গবেষণা। যার নীট ফল আজকের ভারতবর্ষ। যার প্রতিটি মানুষ জন্মের আগেই কয়েক কোটি টাকার বিদেশী ঋণের কাছে বিকিয়ে বসে আছে। এদেশে ধর্ম আন্দোলন নয়, বিজ্ঞান আন্দোলনের শরীক হওয়া উচিত প্রত্যেকের।


'সেবা' নামক বস্তুটিকে আমরা বড্ড বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। কিন্তু জেনে রাখুন সেবা মানুষকে হীন প্রতিপন্নই করে। সেবার দ্বারা ব্যক্তি বিশেষের কিছু উপকার হতে পারে বটে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে মানব জাতির কোন উপকার এভাবে হয় না, হবেও না। প্রচ্ছন্নভাবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সেবা সবসময় একটি শর্তমূলক বিনিময়। এই বিনিময়টা কেমন জানেন? মাদার দুঃস্থ রোগীকে বলছেন, "ওষুধটা খেয়ে নাও, যীশুর কৃপায় ভাল হয়ে যাবে।" রোগ সরানো যেমন জরুরি, মাথায় যীশুর নাম চালান করে দেওয়াও সমান জরুরি। সেবা প্রতিষ্ঠানের সেবার অলিখিত শর্ত এটিই।


সেবার দায়িত্ব নিক রাষ্ট্র, সেবার দায়িত্ব নিক সরকার। যদিও সে ভাবনাও গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেলের মতই অবাস্তব। সরকারী স্তরে যা চুরি জোচ্চুরির বহর, কোন দিকেই আমাদের এগোনোর রাস্তা নেই। অতএব শেষ আশ্রয় সেই ধর্ম। যার গমন পথ সততই সময়ের বিপরীতমুখী।  


*********************************************************


রামচন্দ্র দত্ত তার 'পরমহংসদেবের জীবন বৃত্তান্ত" গ্রন্থে যোগ করেছেন "তিনি যে কি জন্য মন্দিরের সামগ্রী স্পর্শ করেন নাই, আমরা তাহার কোন কারণ প্রদর্শন করিতে পারিলাম না।" (পৃষ্ঠা - ৬)। রামচন্দ্র দত্ত একজন ডাক্তার, রসায়নবিদ, এমনকি 'কুর্চিসীন' নামক একটি ওষুধের আবিস্কারক। তিনিও বুঝে উঠতে পারছেন না কেন রামকৃষ্ণদেব মন্দিরের প্রসাদ গ্রহণ করছেন না। আসলে 'গুরুদেব নীচ জাতের অন্ন স্পর্শ করেন না" এই বোমাটি বুকের উপর ফেটে যায় এই ভয়। এমন কি রাম দত্তের বাড়িতে একবার অন্য গ্রহণের প্রস্তাব রামকৃষ্ণদেব স্বযত্নে প্রত্যাখ্যান করেন। বলেন 'তুমি তো ব্রাহ্মণ নও'। রামচন্দ্র দত্ত ছিলেন সম্পর্কে স্বামীজীর দাদু। যদিও বয়সের তফাৎ সামান্য হওয়ায় রামদাদা নামেই তিনি খ্যাত ছিলেন। সম্ভবতঃ তিনিই ছিলেন রামকৃষ্ণদেবের প্রথম শিষ্য ও প্রচারক।


'শ্রীরামকৃষ্ণ লীলামৃত' গ্রন্থে বৈকুন্ঠনাথ সান্যাল বলেছেন 'মন্দিরের প্রসাদ গ্রহণ না করে তিনি আমাদের লোভ সংবরণ শিক্ষা দিয়ে গেছেন।' 'নীচু জাতের অন্ন ছুঁই না' এর মধ্যে লোভ সংবরণের কি শিক্ষা আছে তা ঠিক বুঝতে পারলাম না।


... রামকৃষ্ণদেব এখন দক্ষিণেশ্বরে রয়ে গেছেন। নিজে হাতে গঙ্গা জলে রান্না করে খাচ্ছেন। রাতে কিন্তু তিনি আর সকলের সাথে মন্দিরের প্রসাদী লুচিই খান। ভাগ্নে হৃদয়রাম বলছেন, "কত দিন দেখিয়াছি ঐরূপে লুচি খাইতে খাইতে তাহার চক্ষে জল আসিয়াছে এবং আক্ষেপ করিয়া শ্রী শ্রী জগন্মাতাকে বলিয়াছেন, 'মা, আমাকে কৈবর্তের অন্ন খাওয়ালি'!" (পৃষ্ঠা - ১৯৫)।


*********************************************************


প্রশ্ন ধর্ম জগতে গুরুতর পাপ। 'ঈশ্বর সত্য' এই কথা মেনে নিয়ে তবেই প্রশ্ন হতে পারে। যেমন তিনি সাকার না নিরাকার, গরীবের নকুল দানায় তুষ্ট না ধনীর রাজভোগে, পাঁচীর মার বেলপাতায় না বেবিফুডে ময়দা মেশানো কোটিপতির সোনার হারে। এইসব গুরুতর প্রশ্ন চলতে পারে ঈশ্বরকে মেনে নিয়েই। কিন্তু ঈশ্বর নিজেই সত্য কিনা এ প্রশ্ন করা একদম চলবে না। পড়াশুনা শিখলে মানুষের মনে এ প্রশ্ন আসতেও পারে। তাই ধর্ম নেতারা বলে থাকেন, আগে ঈশ্বর লাভ, পরে অন্য কিছু। এই ঈশ্বর লাভের আশাতেই আমার বাপ-ঠাকুরদা মায় চোদ্দ পুরুষের জীবন শেষ হয়েছে। আমাদের হবে। আমাদের দেখাদেখি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পতাকা তুলে নেবে। এর কোনো শেষ নেই। 


মাস্টারমশাই শ্ৰীম বলছেন, "ঈশ্বরকে জানার নাম জ্ঞান। নানান খানা জানার নাম অজ্ঞান। ঈশ্বরকে জানার পর দরকার হয় অন্য সব জানা যায়। ঈশ্বরের জ্ঞান ছেড়ে অন্য সব জানা দুঃখ  অশান্তির কারণ।" কেন মিছিমিছি বই পড়ে খেটে মরব। যা জানার সব তো তিনিই জানাবেন।আর তাকে জানতে গেলে অধ্যয়ন নয়, চাই সাধন। 'অধ্যয়নে তিনি এত মগ্ন ছিলেন যে ঠাকুর তিন বার ডাকা সত্ত্বেও তিনি সাড়া দেন নাই। ঠাকুরের কাছে যাইতেই তিনি শশীকে (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) জিজ্ঞাসা করিলেন, " অপরা বিদ্যা লাভের জন্য যদি তুই ধর্মবিষয়ক কর্তব্য অবহেলা করিস, তোর ভক্তিলাভ হইবে না।" শশী ঠাকুরের উপদেশের গূঢ়ার্থ হৃদ্গত করিয়া গ্রন্থগুলি গঙ্গাজলে ফেলিয়া দিলেন। তখন হইতে গ্রন্থ পাঠের প্রতি তাহার অনুরাগ কমিয়া গেল এবং তিনি গুরু সেবায় এবং ধর্ম সাধনায় অধিকতর মনোযোগ দিতে লাগিলেন।' (নবযুগের মহাপুরুষ, পৃ-১৩৫)। মাষ্টারমশাই শ্ৰীম ছাত্রদের উপদেশ দিচ্ছেন, 'একজন ছোকরা ভক্ত বইটই পড়ত। ঠাকুর তাকে বলেছিলেন, আর বইতে কি আছে? যদি পনেরো মিনিট তাকে ডাকিস তাহলে যে হবে তোর, একবছর বই পড়ে কী তা হবে?' (শ্ৰীম দর্শন, ষষ্ঠ খন্ড, পৃ-২৩২)। আবার বলছেন, শ্ৰীম (ভক্তদের প্রতি) -- বিদ্যালাভ এই জন্য করা, এতে প্রকৃত শান্তিলাভ হয় না, এই কথাটা জানতে। তর্কপ্রধান লোকেদের এসব জানা দরকার। তাদের সংশয় যেতে চায় না কিছুতেই। এইটা জেনে, সব বই-টই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে 'মা-মা' বলে কাঁদা। ঠাকুর কেঁদে কেঁদে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন। এটা সোজা পার্থ এ যুগের পক্ষে। তাই ঠাকুর এ পথটা নিয়েছিলেন লোকশিক্ষার জন্য। (শ্ৰীম দর্শন - দশম ভাগ পৃ-৮০)। এই লোকশিক্ষা আমাদের দেশে অতি প্রবল বলেই শিক্ষা এবং শিক্ষিতের হার-এ আমরা ভীষণ ভীষণ পিছিয়ে। 'অশিক্ষিতের দেশ' এই তকমা আমাদের পিঠে দগদগে ঘায়ের মত শোভা পায়। যদিও ধর্ম শিক্ষায় শিক্ষিতের হার আমাদের প্রায় একশ শতাংশ। গোটা পৃথিবীতে ইসলাম অধ্যুষিত কিছু দেশ ছাড়ি, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। স্বামী বিবেকানন্দও বলে গেছেন এ মহামানবের জাত, দেবতার জাত, অমৃতস্য পুত্রাঃ, সব্বাই, ওফ, কি মধুর বচন। 


স্বামী প্রেমানন্দ, স্বামী সারদানন্দ, স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ, স্বামী অভেদানন্দ, নরেন্দ্রনাথ এরা প্রত্যেকেই যখন রামকৃষ্ণের কাছে এসেছেন প্রত্যেকেরই অল্প বয়স এবং স্কুল কলেজের ছাত্র। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাবে এরা প্রত্যেকেই ছাত্রজীবনের উপর দাঁড়ি টেনে দিয়েছেন। '১৮৮৩ বা ৮৪ খৃষ্টাব্দে বাবুরাম (স্বামী প্রেমানন্দ) প্রবেশিকা পরীক্ষা দিলেন। কিন্তু উত্তীর্ণ হইতে পারিলেন না। একথা শুনে ঠাকুর বলিলেন - "ভালই হল। তার বন্ধন ছিন্ন হল। পাস তো নয়, পাশ (বন্ধন)"।' (নবযুগের মহাপুরুষ, পৃ-৬১)।


ছোট ছোট ছেলেদের দিকেই তার টান বেশি ছিল। বলতেন "ইহাদিগের মন এখনও স্ত্রী-পুত্র, মান-যশাদির ভিতর ছড়াইয়া পড়ে নাই, উপযুক্ত শিক্ষা পাইলে ইহারা সহজেই ষোলআনা মন ঈশ্বরে দিতে পারবে।" গোয়েবলস থিওরি ব্যবহার করে ঈশ্বরকে মগজে গেঁথে দেবার নামই উপযুক্ত শিক্ষা। সারা পৃথিবী জুড়ে, ঘরে ঘরে এই শিক্ষা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।


এখানে একটা কথা বলার আছে। শুধু রামকৃষ্ণদেবই নন প্রায় সব ধর্মগুরুরই কম বয়সী ছেলেদের প্রতি একটা টান থাকে। কি করে তাদের ঈশ্বর লাভ হয় সে নিয়ে তাদের খুব চিন্তা। কিন্তু ছোট ছোট মেয়েদের কথা তো তারা কখনই বলেন না। মেয়েদের কি ঈশ্বর লাভ করতে নেই?


অক্ষয় সেন খাঁটি সত্যি কথাটি বলে গেছেন -

নিরক্ষর  বেশে আসা তাহার কারণ।

বিদ্যার করিতে গর্ব খর্ব বিলক্ষণ।। (রামকৃষ্ণ পুঁথি, পৃষ্ঠা-৩৩৮)


শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে নিরক্ষর ছিলেন। দেশবাসীকেও নিরক্ষর থাকার রাস্তা দেখিয়ে গেছেন। সব সময় বলতেন 'বই পড়ে কি কখনো কেউ ঈশ্বর লাভ করেছে রে! ঈশ্বর লাভ হয় স্মরণাগতি দ্বারা। তার কাছে আকুল হয়ে কাঁদতে হয়। বলতে হয় আমি শক্তিহীন, ভক্তিহীন, কি করে তোমায় ডাকব জানি না, তুমি নিজে প্রকট হয়ে আমাকে সব জানিয়ে দাও মা।' এই প্রার্থনার কথা তিনি আমাদের শিখিয়েছেন আর শিখিয়েছেন পড়াশুনা করে কেউ কখনো ভগবান লাভ করেনি। তবে আর কি। ধৈর্য সাপেক্ষ অধ্যবসায় থেকে হরিকীর্ত্তন অনেক সোজা। তাই নিজেই মেতে থাকি আমরা। জ্ঞানচর্চা করে বড়জোর শুষ্ক তার্কিক হওয়া যায়, তার বেশি নয়। একে বলে চাল কলা বাঁধা বিদ্যা। কেন বই নিয়ে বসতে যাব! স্বয়ং গুরুদেব যেখানে বলে দিয়েছেন ওতে ভগবান নেই। গুরুবাক্য আগে মান্য করতে হবে, পরে বিদ্যাসাগর, তার বর্ণপরিচয়। বলতেন, 'যার যটা পাস, তার তটা পাশ।' 


এখানে প্রশ্ন হতে পারে মিশনের দর্শন যদি শিক্ষা বিরোধীই হয় এত এত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেখানে হলো কেন! বেশ জটিল প্রশ্ন বটে। দেখুন, ভাববাদ দর্শনে কোথাও সেবা বা শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তবুও বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জরুরি। যদিও আঠারো নম্বর বস্তির প্রায় অনাথ ছেলেমেয়েগুলিকে শিক্ষিত করে তোলা এর উদ্দেশ্য নয়। সমাজের সেরা ছাত্রকটিকে টেনে নিয়ে তাদের ফার্স্ট সেকেন্ড করানোই উদ্দেশ্য। এতেই লোকের চোখ টানে বেশি। এবার মাধ্যমিকে ফার্স্ট হলে কে, না রহড়া মিশন। ব্যস, সবার ওপরে মিশন সত্য, তাহার উপরে নাই।


*********************************************************


"স্ত্রী লোক নিয়ে মায়ার সংসার করা। তাতে ঈশ্বর ভুল হয়ে যায়। যিনি জগতের মা, তিনিই এই মায়ার রূপ -- স্ত্রী লোকের রূপ ধরেছেন। এটি ঠিক জানলে আর মায়ার সংসার করতে ইচ্ছে হয় না। সব স্ত্রী লোককে ঠিক মা বোধ হলে, তবে বিদ্যার সংসার করতে পারে। ঈশ্বর দর্শন না হলে স্ত্রী লোক কি বোঝা যায় না।" নারী সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণের মতামত ঠিক এই রকমই। নারীর সাথে সংসার করছ, কি নারীর সাথে মেলামেশা করছ , তো তোমার ঈশ্বর ভুল হয়ে যাবে। নারীকে তিনি শুধুই 'মা' বলে ভাবতে পারেন। 'নারী' বলে নয়। এটাই আপত্তিকর। নারীকে শুধুই একজন নারী বলে ভাবা হবে না কেন? 'মায়ের জাত' তকমা লাগিয়ে কেন হেঁসেল, পতিসেবা, আর বাচ্চা পালার যন্ত্র বানিয়ে দেওয়া হবে?


আচার্য শঙ্করাচার্য বলেছেন 'নারী নরকের দ্বার'। এই মতটিকেই সমাজ সোজা পথে না মেনে বাঁকা পথে মেনে নিয়েছে।


সেই  বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, শাস্ত্র থেকে একই ধারা বয়ে চলেছে। সর্বত্রই পুরুষের জয়গান, আর নারীর অবমাননা। নারীকে সর্বত্র এতই হীন চোখে দেখা হয় যে হিন্দু শাস্ত্রের নির্দেশানুযায়ী পুত্র সন্তান ছাড়া কন্যা সন্তানকে বংশধর রূপে স্বীকৃতি দেওয়াই হয় না। এমন কি যাদের কেবল মাত্র কন্যা সন্তান আছে, তাদের মৃত্যুর পর, কন্যা সন্তান থাকা সত্ত্বেও শাস্ত্রানুযায়ী তাদের বংশ লোপ হয়ে যায়। অতএব শুধুমাত্র কন্যার পিতামাতা জেনে রাখুন আপনারা কিন্তু নির্বংশ হয়েছেন। অবশ্য যদি হিন্দু শাস্ত্র মানেন তো। ব্রাহ্মণকে মূল্য ধরে দিয়ে রেহাই নেই। কিহু কিছু বিধান তারা সুবিধামতো পাল্টে দিতে পারেন বটে, তবে সব বিধান পাল্টে দেওয়া ব্রাহ্মণের কম্মো নয়।


আমাদের বর্তমান হিন্দু সমাজ মনুসংহিতার অনুশাসনে পরিচালিত। চোদ্দ জন মনুর নির্দেশ সমৃদ্ধ সংহিতা দ্বাদশ অধ্যায় বিভক্ত। সংহিতার নবম অধ্যায়ে দায়ভাগ নিয়ম অনুযায়ী কন্যা সন্তান বংশধর হয় না। এই নিয়মটিই বর্তমানে শাস্ত্র নিয়ম রূপে স্বীকৃত এবং এখনো অপরিবর্তনীয়।


ঋষি ঋণ, দেব ঋণ, পিতৃ ঋণ, নৃ ঋণ এবং ভূত ঋণ - এই পাঁচ ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে হিন্দুরা পৃথিবীতে আসে। পরবর্তীকালে পুত্র সন্তান লাভ হলে পিতৃ তর্পণে পিতৃ ঋণ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অন্য ঋণগুলি এখানে বিচার্য নয়। পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে না পারলে, অপদার্থ কন্যা সন্তানের পিতামাতা "পুৎ' নরক প্রাপ্ত হন। সেখানে পাঁচ হাজার বছর রেপসিড তেলে ফ্রাই। তারপর যমদূতেরা ... থাক, সে বড় ভয়ঙ্কর।


তবে এখানে মহামতি মনু বিধবা নারীর প্রতি কিছুটা সদয়। তার বিধান 'পতির মৃত্যুতে সাধ্যি বিধবা পুত্রহীনা হইলেও ব্রহ্মচর্য পালনের ফলে স্বর্গে গমন করেন।' বেশ ভাল বিধান। পুত্রহীনা বিধবার স্বর্গে যাবার তবু একটা রাস্তা বেরল। পুরুষ কিন্তু এ আশীর্বাদে বঞ্চিত। তবে একটু ঘুর পথে বিচার করলেই দেখা যাবে এর পেছনেও নারীকে দমিয়ে রাখার নীতিই কাজ করছে। পুরুষ চরে খাক। আসলে আমাদের সমস্ত পুরাণ শাস্ত্রই নারী বিদ্বেষী। স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণও পুত্র কন্যা হীন। সুতরাং পিতৃঋণ থেকে মুক্ত নন।


ঐতরেয় ব্রাহ্মণ অনুসারে 'পুত্রলাভ করে পিতা অন্ধকার অতিক্রম করেন। পুত্র হল জ্যোতিঃ, কিন্তু কন্যা বা দুহিতা হল কৃপণ বা দুঃখের কারণ।' 'ঋগ্বেদে' জননী দশটি পুত্র কামনা করছেন। পক্ষান্তরে কন্যাকে 'বন্ধকী' দ্রব্যের সাথে তুলনা করা হয়েছে। যেখানে পুত্র সম্পদ স্বরূপ। 'অথর্ব বেদে'ও শুধুই পুত্রের জন্য যজ্ঞ। মনু বলেছেন - 'পুত্র' পিতাকে 'পুৎ' নরক থেকে পরিত্রাণ করে, এজন্য ব্রহ্মা স্বয়ং 'পুত্র' এই নাম রেখেছেন। আরও বলছেন 'পুত্রের দ্বারাই মানুষ স্বর্গাদি লাভ করে।' 'ভাগবৎ গীতা' বৈশ্য, শূদ্র এবং নারী তিনজনকেই 'পাপ যোনি' বলে অভিহিত করছেন।


গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন - "হে পার্থ, যাহারা নিকৃষ্ট কূল যাত্ৰা নিতান্ত পাপাত্মা, যাহারা কৃষ্যাদি নিরত বৈশ্য ও যাহারা অধ্যয়ণ বিরোহিত শূদ্র এবং স্ত্রী লোক - ইহারাও আমাকে আশ্রয় করিলে অতুৎকৃষ্ট গতি লাভ করবে।" লক্ষ্য করে দেখুন নারীকে সোজা কথায় 'এই তোরা একদম ফালতু' এই ভাবে নিচে নামানো হয়নি, নামানো হয়েছে একটু অন্যভাবে। ঘুষখোর, জুয়াচোর, বেবীফুডে ভেজালদার, স্ত্রীলোক , এরা সবাই মুক্তি পাবে যদি তাকে ডাকে। স্ত্রীলোকের স্থান কোথায় নির্দিষ্ট হয়েছে একবার ভেবে দেখুন। (গীতা, রাজবিদ্যারাজগুহ্যযোগ, ৯ম অধ্যায়, ৩২ নং শ্লোক)।


এছাড়াও নানান সংহিতা, বিভিন্ন উপনিষদ, মায় আমাদের সমস্ত শাস্ত্র পুরাণেই কেবল মাত্র পুত্রের জয়গান। লম্পট, মাতাল হলেও সে গুণবতী কন্যা অপেক্ষা সব সময় শ্রেষ্ঠ। কোন কারণ ছাড়াই নারী অবমাননা শাস্ত্রের যত্রতত্র ছড়িয়ে রয়েছে। ...


... অতএব হে নারী, যতই তুমি 'নারী মুক্তি' আন্দোলন কর না কেন, তোমার প্রাপ্ত স্বাধীনতাটুকু পুরুষের দয়ার দেন বলেই যেন। অধিকার করে নিতে গেলে এখনো তোমাকে বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। গার্গী, মৈত্রেয়ী, ভাবা, সীতা, সাবিত্রীর স্বাধীনতা সম্মানের গল্প শুনিয়ে, আয় ঘুম যায় ঘুম দত্ত পাড়া দিয়ে, বলে তোমাকে শীত ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে, আগে সে ঘুম কাটুক, তবে তো স্বাধীনতা। দু চারটি ক্রীতদাস শ্রেণীর পুরুষ দিয়ে যেমন পুরুষ জাতির স্বাধীনতা বিচার হয় না, তেমনই দু চারটি ইন্দিরা গান্ধী, হেমামালিনী, পি টি ঊষা অথবা পার্কস্ট্রীটের জীনস পরা, মোবাইল হাতে ইংরাজী বলা সুন্দরী দিয়েও সমগ্র নারী জাতির স্বাধীনতা বিচার হয় না। যতক্ষণ তোমার ওপর শাস্ত্রীয় বিধান বলবৎ, ততক্ষণ তোমার পরাধীনতাও বলবৎ।


কথা হতে পারে শাস্ত্রের সেই দূষিত অংশগুলির পরিমার্জনা করা যায় কিনা, অথবা সেগুলি বর্জন করা যায় কিনা। আমি বলি কি, তা যায় না। কারণ যে নারী বিদ্বেষমূলক ভাবটি সমগ্র ধর্ম সাহিত্যের মধ্যে একাত্ম হয়ে মিশে রয়েছে দুটো লাইন কেটে দিয়ে সেই ভাব থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। 'পুরুষ আপাদমস্তক পবিত্র'। 'ব্রহ্মার মুখ থেকে জন্মেছে তাই - ব্রাহ্মণ'। 'ব্রাহ্মণই একমাত্র শিক্ষা লাভ ও দানের অধিকারি'। 'শূদ্র অভিবাদনের যোগ্য নহে'। 'নারী নরকের দ্বার'। 'শুধু কামনা মেটাতে যুবতী শূদ্রা গ্রহণ করা যায়'। 'ব্রাহ্মণের গৃহে শূদ্র অতিথি হলে তাকে চাকরদের সাথে খেতে দিতে হবে'। 'বিধাতা দাসত্বের জন্যই শূদ্রের জন্ম দিয়েছেন'। 'নারী, শূদ্র সম্পত্তির অধিকারী নহে'। 'নারী স্বাধীনতার যোগ্যই নহে'। 'স্মৃতি ও বেদে নারীর অধিকার নাই তাই - অপদার্থ '। এ সবই আমাদের পুরাণ শাস্ত্রের কথা। এর কটাকে কেটে বাদ দেবেন। কাটতে কাটতে হাত ব্যথা হয়ে যাবে। এমন হাজার হাজার ধ্যান ধারণা আমাদের পুরাণ শাস্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে রয়েছে।


*********************************************************


সংসারীজনকে শ্রীরামকৃষ্ণ 'এই এই' আদর্শ শিখিয়ে গেছেন বলে শুনতে পাই। আমি কিন্তু দেখি শুধু 'এ কুল রাখতে হয়, ও-কুলও রাখতে হয়' গোছের একটা জড়িবুটি মেশানো টনিক তিনি সংসারীর জন্য তৈরি করে রেখেছিলেন। সংসারী লোক তার কাছে গেলেই ছিপি খুলে এক ঢোক মুখে ঢেলে দিতেন। ভক্ত সংসারী জড়িবুটির পাঁচন খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে সংসারের কাজে লেগে যেত।


আসলে শ্রীরামকৃষ্ণ ও তার শিষ্যরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, যে সংসার সাগরে নেমেছে সে ডুবেছে। ভগবান লাভ তার কাছে দূরঅস্ত। মুখে যদি ভাল ভাল কথাই বলতেন কিন্তু মনেপ্রাণে জানতেন সংসারীর জন্য ভগবানের দরজা বন্ধ। স্বামী সারদানন্দ বলেন - 'ঠাকুরকে আমরা ওই কথা প্রসঙ্গে সময় সময় বলিতে শুনিয়াছি যে, "একটা ভেকধারী সাধারণ পেট বৈরাগী ও একজন চরিত্রবান গৃহীর ভিতর তুলে করিলে পূর্বোক্তকেই বড় বলিতে হয়"।' (লীলাপ্রসঙ্গ, পৃষ্ঠা - ৫৯৯)। ভেবে দেখুন একবার, ঘরবাড়ী ছেড়ে আসা যে গেরুয়াধারীকে তিনি 'ভেকধারী পেট বৈরাগীর' বেশী কিছু ভাবেন না, তাকেও তিনি 'চরিত্রবান গৃহীর' উপরে রাখছেন। গৃহী তবুও বলে ঠাকুর তাদের জন্য অনেক রেখে গেছেন।


স্বামী বিবেকানন্দও বলেছেন 'পর্বত এবং সরষে দানায় যে প্রভেদ, সমুদ্র ও গোষ্পদে যে প্রভেদ, সন্ন্যাসী ও গৃহীতেও সেই প্রভেদ।'এমনকি কোন ভন্ড সাধুকে গৃহীর থেকে তিনিও এগিয়ে রাখেন। (স্বামীজির সহিত হিমালয়ে - নিবেদিতা, দ্বাদশ সংস্করণ, পৃ- ৮০)। অথবা, 'আদর্শটি খাঁটি হলে একজন ভ্রষ্ট সন্ন্যাসীও গৃহস্থ অপেক্ষা শতগুণে শ্রেষ্ঠ।' (বাণী ও রচনা, পঞ্চম খন্ড, পৃ - ৪০০)। ভ্রষ্ট যে, তার আবার আদর্শ কী! তবুও সে গৃহীর তুলনায় মহৎ। বাবা, মায়ের উদ্দেশ্যে বলছেন - 'শিশুদের শেখাও জোনাকি পোকা ও সূর্যের মধ্যে যে তফাৎ, গৃহী ও সন্ন্যাসীর মধ্যেও সেই তফাৎ।' (বাণী ও রচনা, দশম খন্ড, পৃ - ৩০৫)। তার ধারণায় - সংসারে থেকে ব্রহ্মজ্ঞান কথার কথা মাত্র। (স্বামী শিষ্য সংবাদ, পৃ - ৮৯, ৯১)।


শ্রীরামকৃষ্ণ তার সন্ন্যাসী শিষ্যদের গৃহীদের সাথে মেলামেশা আদপেই পছন্দ করতেন না। তা বলে কি তিনি গৃহীদের ঘাড় ধরে তাড়াবেন? তা তো হয় না। একশ জন তার কাছে গেলে সাতানব্বই জনই গৃহী। এদের বিদায় করলে থাকে তিন জন। এই নিয়ে কি সাধুজীবন চলে! তবুও এর মধ্যেই তিনি একটি গোপন ভেদরেখা টেনে চলতেন। অন্য গৃহী ভক্তদের কথা তো ছেড়েই দিলাম, টের বীর ভক্ত গিরিশ ঘোষ, যাকে তিনি সারা জীবনই বিরাট ভক্তের মর্যাদা দিয়েছেন। গোপনে তার কাছ থেকেও তার সন্ন্যাসী শিষ্যদের তফাৎ করিয়ে দিতেন। কারণ গিরিশ সংসারী। 'শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে। নরেন্দ্রকে বারণ করিতেছেন গিরিশ ঘোষের সঙ্গে বেশি মিশিতে। গিরিশ অনন্য স্মরণ ভক্ত হইলেও গৃহস্থ আশ্রমে রহিয়াছেন।' (শ্ৰীম দর্শন, পঞ্চম ভাগ, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা - ১৭৬)। কথামৃতের অংশ এটি। আমি শ্ৰীম দর্শন এখানে ব্যবহার করলাম। তার একটু অন্য কারণও আছে। মাস্টারমশাই এক ভক্তকে দিয়ে কথামৃতের এই অংশটি পড়াচ্ছেন। সংসারী কীট যে কতদূর জঘন্য তার বর্ণনা আছে এখানে। উদ্দেশ্য শান্তি নাম এক যুবক। ডাক্তারি ক্লাসের ছাত্র। বাড়ি থেকে বিয়ের চেষ্টা চলছে। পড়া হলে শ্ৰীম (শান্তির প্রতি) - "তোমার জন্য পড়া হল। তুমি কি করবে - ফার্স্ট ক্লাস, না সেকেন্ড ক্লাস?" শান্তি - "মন যে মানে না।" শ্ৰীম - "সে কি তোমার ইচ্ছা? গুরু যখন হয়েছে তখন তোমার ইচ্ছা আর নাই।"


শ্ৰীম একজন স্কুলের হেডমাস্টার, তিনিই একজন ডাক্তারির ছাত্রকে পড়াশুনা করা থেকে কিভাবে নিরুৎসাহিত করছেন। যেখান চিরকালই আমাদের দেশে ডাক্তারের অভাব, সেখানে শিক্ষাবিদ হয়েও একজন হবু ডাক্তারকে সাধু বানাচ্ছেন। তবে এই যে ডাক্তারী পড়তে বাধা দিচ্ছেন, এ কিন্তু অকারণে নয়। এর পিছনেও গুরুদেবের আদর্শ কাজ করছে। 'ঠাকুর বলতেন, " উকিল, দালাল ও ডাক্তারের ধর্ম নেই।" -ই ক্ষেতড়ির মহারাজের কাছ থেকে খরচ নিয়ে ব্যারিস্টারী পড়ার জন্য বিলেত গেছেন। স্বামীজী তখন সেখানে। ওকে কিছুতেই উকিল হতে দিলেন না - চিঠি দিয়ে খরচ পাঠান বন্ধ করলেন।' (জীবন্মুক্তি সুখপ্রাপ্তি - প্রকাশক স্বামী সত্যব্রতানন্দ, উদ্বোধন, দ্বিতীয় সং ১৯৮৯ পৃষ্ঠা - ৩২)। এই ছেলেটি অত্যন্ত অভাবী ও মেধাবী। সংসারে মা ভাই ইত্যাদি আছে। ভেবেছিল উকিল হয়ে একটু সুখের মুখ দেখবে। কিন্তু স্বামীজী 'আমাদের (স্বামী তুরীয়ানন্দ) বললেন, "মা ভাই না খেয়ে মরে, সেও স্বীকার। দেখি ঠাকুরের পথে চলতে পারি কিনা।" ঠাকুর বিধান দিয়ে গেছেন উকিল-ডাক্তার ধর্মহীন। অতএব ডাক্তারী পড়ুয়াকে নিরাশ করে সাধু বানিয়ে দাও, অভাবী হবু উকিলের অনুদান বন্ধ করিয়ে, দেখি হতচ্ছাড়া কেমন করে হাইকোর্টের চৌকাঠ মাড়ায়। কু-সংস্কার, অন্ধবিশ্বাস। এই বিশ্বাস নিয়ে ভারত জাগলে জগৎ অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। এমন কি স্বামীজী নিজের ভাই মহেন্দ্রনাথকেও ওকালতি পড়তে দেননি।


স্বয়ং মাস্টারমশাইও একবার এই 'গৃহী সন্ন্যাসীর' ফাঁদে পড়েছিলেন। অসুস্থ রামকৃষ্ণদেবের সাথে তখন গৃহী ভক্তদের সাক্ষাৎ প্রায় বন্ধই করে দিয়েছিলেন তার ত্যাগী শিষ্যরা। শ্ৰীম এসেছিলেন রামকৃষ্ণদেবের সাথে দেখা করতে। (সম্ভবত কাশীপুর উদ্যানে)। কিন্তু তাকে প্রথম দফায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কারণ তিনি গৃহী। পরে অবশ্য দেখা করতে দেওয়া হয়।


কথামৃতকার শ্রীমকে ভক্তরা গৃহস্থ ঋষি রূপেই দেখেন। স্বয়ং রামকৃষ্ণদেব তেমনই ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, 'গৃহস্থ ঋষি-কতকগুলি অর্থহীন কিম্ভূত কিমাকার কথা মাত্র।' (বাণী ও রচনা, পঞ্চম খন্ড, পৃ-৩৯৮)।


আসল কথা হল রামকৃষ্ণদেব এবং তার শিষ্যরা যতটা সম্ভব গৃহীদের এড়িয়ে চলার চেষ্টাই করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর দেখতে পাই কাশীপুর বাগানে তার শিষ্যরা নিজেদের মধ্যে নিয়ম করে রেখেছেন গৃহী ভক্তরা মঠে এলে তাদের সাথে বেশিক্ষণ কথা বলা চলবে না, তারা সন্ন্যাসীদের বিছানায় বসবে না। এই রকম অনেক অলিখিত নিয়ম।


শ্ৰীম তার ভক্তদের উপদেশ দিতে গিয়ে বলছেন 'এরা, মানে সন্ন্যাসীরা, মা-বাবাকে চোখের জলে ভাসিয়ে দিয়েও সিদ্ধ যোগী হবার জন্য মঠে যোগ দিয়েছেন। সংসারীর সাথে এদের তুলনা।' প্রসঙ্গ ধরে একটি কাহিনী বলছি। ভাল লাগতেও পারে - শুকুল মহারাজ, স্বামী আত্মানন্দ, স্বামীজীর এক প্রধান মন্ত্র শিষ্য। দীক্ষার আগে এক জমিদারের সেরেস্তায় হিসাব রক্ষকের কাজ করতেন। বৌকে ফেল রেখে চলে এলেন রামকৃষ্ণ মিশনে, সন্ন্যাসী হবেন।বৌ জমিদার বাড়ি এসে কান্না-কাটি শুরু করেছে। 'হুজুর আমার স্বামীকে আনিয়ে দিন।' জমিদারবাবু আর করেন কি, বৌকে সেখানেই থাকতে বলে মঠের ঠিকানায় চিঠি লিখলেন, বিষয় সম্পত্তির প্রসঙ্গ তুলে। পরের অংশ - 'পত্র পাইয়া গোবিন্দচন্দ্র (শুকুল মহারাজ) অবিলম্বে জমিদারের বাড়ি গেলেন। কিন্তু জমিদার আর বিষয় সম্পত্তির কথাই উল্লেখ করিলেন না। তিনি যে ঘরে গোবিন্দচন্দ্রের সহিত কথা বলিতেছেন সেই ঘরে ব্রাহ্মণী আসিয়া পতিকে দর্শন ও প্রণাম করিবামাত্র উর্দ্ধশ্বাসে সাধু পালাইয়া গেলেন, আর জমিদার বাড়ি ফিরিলেন না। সাধুর নিকট পত্নী ও সংসার অন্ধকার অতল কূপতুল্য বোধ হইল।' (নবযুগের মহাপুরুষ, পৃ - ১৫০)। উনি সাধু হলেন, বৌ-টার কি হল কে জানে।


একবার জ্ঞান মহারাজের ঘরে সংসারী বড় অমূল্য (যাকে শ্ৰীম অতি সত্ত্ব গুণের ভক্ত বলে চিহ্নিত করেছেন) গায়ের জামা খুলে রাখে। অন্য এক সন্ন্যাসী জামাটি দেখে সেটি বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ঠাকুরের আদেশ "মুড়ি-মিছরির এক দর যেন না হয়।" শ্ৰীম বলতে থাকেন "বিবেকানন্দ আমাকে বলেছিলেন, 'অমুক' মশাইয়ের কথা। বলেছিলেন - "এই দেখুন, ইনি এসে আমার বিছানায় শুয়ে পড়েন। শেষে আমি সব ছাড়লুম এই জন্যে।" (শ্রীম দর্শন, দ্বাদশ ভাগ, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা - ১৪২ - ৪৩)। পুরোনো দিনের ভক্ত। সে ভাবছে সব ভাই ভি বুঝি। বিবেকানন্দ মহারাজ কিন্তু হুঁশিয়ার, সংসারী লোক, এ কি তার বেলেল্লাপনা। মুড়ি-মিছরি এক করে দেবে নাকি? তাই তার অভিযোগ 'শেষে ঘর ছাড়লুম কি এই জন্য নাকি?'


লাটু মহারাজের 'সৎকথা'র ছয় নম্বর উপদেশ - তিনি (রামকৃষ্ণ) জোর করে বলতেন - "বিয়ে করিস নে, বিয়ে না কল্লে একদিন না একদিন ধর্ম বুঝতে পারবি।" (সৎকথা - স্বামী সিদ্ধানন্দ, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা - ৫)। বিয়ে মানেই সংসার, সংসার মানেই ধর্ম হানি। ৭৩ পাতায় ১৫নং উপদেশে বলছেন "ব্রহ্মচর্য না থাকলে ভগবান লাভ হয় না।" গৃহী যাই ভাবুন না কেন তাদের পথ ভগবানমুখী নয়। স্বামী বিবেকানন্দ গুরুর পথ ধরেই বলে গেছেন "সংসারীর ব্রহ্মজ্ঞান - বাতুলের চিন্তা মাত্র।" (স্বামী বিবেকানন্দ - প্রমথনাথ বসু, দ্বিতীয় ভাগ, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃ - ৬৪৯)।


একবার এক ভক্ত সারদামণিকে বলে বসেন, 'এখানে যারা আসছেন কি সন্ন্যাসী, কি গৃহী, সবই তো সমান - কারণ সকলেই মুক্ত হবে?' শুনে সারদামণি আঁতকে ওঠেন, "সে কি! ত্যাগী আর গৃহস্থ কি সমান? ওদের কামনা বাসনা কত কি রয়েছে, আর এরা তার জন্য সব ছেড়ে চলে এসেছে। এদের আর তিনি ভিন্ন কি আছে? সাধুদের সাথে কি ওদের তুলনা হয়?" (শ্রী শ্রী মায়ের কথা, দ্বিতীয় ভাগ, চতুর্থ সংস্করণ, পৃষ্ঠা - ২৮ -২৯)। সংসারী যাই ভাবুন না কেন, ঈশ্বর লাভ তাদের জন্য নয়। 'এখানে যারা আসে সবাই মুক্ত হবে' ধারণাটাও ঠিক নয়।


*********************************************************


সারদাদেবীর যখন বিয়ে হয় তিনি তখন নেহাত শিশু মাত্র। তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে, দু একবার শ্রীরামকৃষ্ণের সাথে তার দেখাও হয়েছে। কিন্তু স্বামীর সাথে একত্রে বাস এখনও হয়ে ওঠেনি। ১৮৭২ সালের চৈত্র সংক্রান্তির সময় তিনি দক্ষিণেশ্বরে এসে পৌঁছেছেন। প্রায় দু মাস হয়ে গেল সেখানেই রয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সাথে এক বিছানায় শয়নও করছেন। ঠিক এই সময়কার অবস্থাটা যে ভাবে বুঝেছি প্রকাশ করার চেষ্টা করব। সেই সাথে এই সময় শ্রীরামকৃষ্ণের এবং সারদাদেবী র মানসিক অবস্থাটাও আমার দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী প্রকাশ করবার চেষ্টা করব।


শ্রীরামকৃষ্ণ আজীবন স্ত্রী সঙ্গের ঘোরতর বিরোধী। তার কাছে নতুন কেউ এলে প্রথমেই তিনি জিজ্ঞেস করতেন বিয়ে হয়েছে কিনা। বিয়ে হয়ে গেছে শুনলে তিনি হতাশ হয়ে পড়তেন। এ অবস্থায় কি ভাবে স্ত্রীকে পাশ কাটিয়ে সাধন ভজন নিয়ে থাকা যায় তার পরামর্শ দিতেন। এমন কী স্ত্রীকে ছেড়েছুড়ে ভগবৎ ভজনায় জীবন কাটানোর ব্যবস্থাও তিনি করে দিতে পারেন, এমন কথাও বলতেন।


সদ্য বিবাহিত শিষ্যকে তিনি বলছেন - "একদিন স্ত্রীকে এখানে নিয়ে আসিস - তাহাকেও তোকে সেইরূপ করিয়া দিব; আর যদি সংসার ত্যাগ করিয়া ঈশ্বর লাভ করিতে চাস, তা হইলে তাহাই করিয়া দিব।" (লীলাপ্রসঙ্গ, পৃষ্ঠা - ৭৬৫)। অথবা মহেন্দ্র মাস্টারের সাথে কথোপকথন - 'মনি (রামকৃষ্ণের প্রতি) - "স্ত্রী যদি বলে, আমায় দেখছো না, আমি আত্মহত্যা করব। তাহলে কি হবে?" শ্রীরামকৃষ্ণ (গম্ভীর স্বরে) - "অমন স্ত্রী ত্যাগ করবে। যে ঈশ্বর পথ বিঘ্ন করে। আত্মহত্যাই করুক, আর যাই করুক।"।' (কথামৃত, দ্বিতীয় ভাগ, পৃ - ১১)।


ঠিক এই ঝামেলা তে ডুবে গিয়েই স্বামী ব্রহ্মানন্দের স্ত্রী বিশ্বেশ্বরীদেবী গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। যার স্বামী, স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে ফেলে রেখে শ্রীরামকৃষ্ণের কোলে শুয়ে দুধ খায়, ঘরে ফিরে আসার আর কোন আশাই নেই,এটার পক্ষে আত্মহত্যাই বাঁচবার একমাত্র রাস্তা। তিনি মরে বেঁচেছেন। (ব্রহ্মানন্দ লীলাকথা - ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য, পৃ - ২০)।


শ্রীরামকৃষ্ণ, তার ভক্ত শিষ্যরা যদি বিয়ে না করে থাকে বা তাদের যদি বিয়ে করার ইচ্ছে নেই শোনেন তো আনন্দে আটখানা হয়ে উঠতেন। একটি দুটি ছেলেমেয়ে হয়ে গেলে সংসারী কেমন ভাই বোনের মত থাকবে, এই সব বোঝাতেন। তাকেই তিনি মরদ মানতেন যে স্ত্রীর পাশে শুয়ে নাক ডেকে ঘুমোবে। এই রকম সব চিন্তা ভাবনা শ্রীরামকৃষ্ণের মনে সব সময় গিজ গিজ করত। একান্ত পার্ষদদের আশীর্বাদ করতেন - 'তোদের বংশ নির্বংশ হয়ে যাক'।


তা রামকৃষ্ণদেব এখন করেন কি? হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় বিয়েতে রাজি হয়ে গেছেন। এতদিন স্ত্রীকে ফেলে রেখে দক্ষিণেশ্বরে দিব্যি কাটছিল। এখন আবার তিনি এসে হাজির। আবার এক ঘরে শুচ্ছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের পক্ষে এসব মেনে নেওয়া ভীষণ কঠিন। তার মনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে। পাশে শায়িতা স্ত্রীর দিকে যাবেন, না ঠাকুর দেবতা নিয়ে যেমন আছেন তেমনই থাকবেন। মনের মধ্যে তীব্র ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সেই ঝড়ের বেগ তার দুর্বল, অসুস্থ, হিষ্টিরিয়া রোগগ্রস্ত শরীর সহ্য করতে পারছে না। তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়ছেন। (শ্রীশ্র্রী মা সারদামণী দেবী - মানদা শঙ্কর দাশগুপ্ত, পৃ - ২৩)। এই অচৈতন্য হয়ে পড়ার নামই ভাব সমাধি। ভক্তেরা ভক্তি মার্গের লোক, সমাধি টমাধি তারাই বোঝেন ভাল। আমরা সে অমৃতে বঞ্চিত। আসলে পরমেশ্বর আমাদের মতো অপাঙতেয়দের জন্য এ বোধটুকুও বরাদ্দ করেননি।


শ্রীরামকৃষ্ণ - "বিয়ের পর ব্যাকুল হয়ে জগদম্বার কাছে প্রার্থনা করেছিলুম, মা, আমার স্ত্রীর ভেতর থেকে কামভাব একেবারে দূর করে দে।" (ঐ , পৃ - ২৩)।


শ্রীরামকৃষ্ণ চান ভগবান। কিন্তু সারদাদেবী তো তা চান না, তিনি চান সন্তান। 'মা'র প্রাণে সত্যই ছেলের জন্য একটা দুর্দমনীয় বাসনা ছিল। তিনি নিকুঞ্জদেবীর নিকট বলিয়াছেন,"ঠাকুর একদিন বলিলেন, ছেলে কি হবে? এই দেখছো সব মরছে। তা আমি বললাম সব কি যায়! আর রামদত্ত প্রভৃতিকে একদিন বললেন, দেখ, বড় ছেলে ছেলে করে। তোমরা একবার নহবতে যাও, আর বলে এসো আমরাই আপনার ছেলে।" মার এই উক্তি দুইটি হইতে বোঝা যায় ছেলের জন্য তাহার প্রাণে কি গভীর আকাঙ্খা জাগিত।'(ঐ, পৃষ্ঠা - ৮৮)। শ্রীরামকৃষ্ণ তাকে বোঝাচ্ছেন 'তুমি একটি সন্তান চাইছ, কালে হাজার সন্তানের মা মা ডাক তোমাকে শুনতে হবে।' 'মন্দিরে মূর্তি হয়ে যে পূজা নিচ্ছে, আমার পা টিপে সেবা করছেও সে।'


ভগবানের স্ত্রী। সুতরাং ভগবতী হবার একটা সম্ভাবনা সারদাদেবীর রয়েই গেছে। রামকৃষ্ণদেব চাইছেন সেই দরজাটা খুলে দিতে। যাতে তিনি নিজেই ভাবতে পারেন, আরে, আমি কি একটা সাধারণ মেয়ে যে একটা ছেলের জন্য বায়না ধরব! আর এতেই রামকৃষ্ণদেবের মুক্তি। তাই রামকৃষ্ণদেব সারদাদেবীর মনকে প্রভাবিত করতে চাইছেন। মন্দিরের দেবতা আর যে আমার পা টিপছে অর্থাৎ সারদাদেবী, এরা আদতে একই।


এই সব বলে তিনি তার সমস্যাকে চাপা দিচ্ছেন, কিন্তু এতে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। চাই বরাবরের মত নিষ্কৃতি। তার জন্য যদি স্ত্রীকে পুজো করতেই হয়, তাই তিনি করবেন।



কুমারী পুজো চলবে না। ঊনিশ বছর বয়স হলেও ষোড়শী পুজো চলতে পারে। তাই হোক, এসব করে যদি সারদাদেবীর মনের সন্তান বাসনাকে চাপা দেওয়া যায়। যদি একবার তাকে ভাবান যায় 'আমি তো ভগবতী, আমার আবার কামনা বাসনা কিসের!'


ফলহারিণী কালী পূজার অমাবস্যা তিথিতে সারদাদেবীকে রামকৃষ্ণদেব ষোড়শী রূপে পুজো করলেন। দীনু পূজারী নামে সারদাদেবীর এক ভাসুর পুত্র এই পুজোয় শ্রীরামকৃষ্ণকে সাহায্য করেন। পুজো হয়ে গেল, সারদাদেবী ভগবতী হয়ে তার ঘরে চলে গেলেন। রামকৃষ্ণদেব অর্ধচৈতন্য অবস্থায় পড়ে রইলেন তার ঘরে।


ষোড়শী পুজোর কারণ একটাই, সারদামণির মন থেকে সন্তান বাসনা মুছে ফেলা। সারদাদেবী জানলেন, যে তাকে ভগবতী জ্ঞানে পুজো করেছে তার কাছ থেকে ফুল চন্দন চাওয়া যায়,সন্তান কামনা, সে হতে পারে না।


ষোড়শী পুজো সারদাদেবীর কাছে একটা অলিখিত শর্ত হয়ে রয়ে গেল, যে শর্ত বলে তিনি স্বামীর কাছে সন্তানবতী হবার আবদারটুকু থেকেও বঞ্চিত হলেন।


শ্রীরামকৃষ্ণ ঠিক এটাই চেয়েছিলেন। কিন্তু এসব করেও রামকৃষ্ণদেবের মনে ভয়ও কম ছিল না। 'শ্রীশ্রী লক্ষ্মীমণিদেবী' - শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র সেনগুপ্ত, ৫৭ পাতা থেকে কিছু অংশ এখানে তুলে দিলাম -


ঔষধ না করিতে শ্রীমাকে ঠাকুরের অনুরোধ 

'কোন কোন স্ত্রী স্বামীকে বশীভূত করিবার জন্য ঔষধ প্রয়োগ কর। সেই প্রসঙ্গ লইয়া ঠাকুর শ্রীমাকে যাহা বলিয়াছিলেন , মা (লক্ষ্মীমণিদেবী) তাহার আবৃত্তি করিয়া বলিতেছেন, - "দেখ, ওরা (নানান জায়গার মেয়েরা) সব এসে হাঁস পুকুরে ঘুরে বেড়ায়। আর আমায় দেখে শুনে গিয়ে সব আপনাদের ভিতর কত কথাবার্তা কয়। আমি সব শুনতে পাই। বলে - এর সবই ভালো, তবে ঐ যে রাত্তিরে স্ত্রীর সঙ্গে একত্তরে শোন না - এই যা। ওদের কথাবার্তা, পরামর্শ তুমি শুনোনি বাপু। ওরা সব বলবে, এর মন ফেরাতে ঔষধ পালা কর। দেখ বাপু, ওদের কথায় আমায় ওষুধ পালা করোনি। আমার সব আছে। তবে ভগবানের জন্য, সব শক্তি তাকে দিয়ে দিয়েছি। শ্রীমা আলতো আলতো ভাষায় জবাব দিতেন - না না। সে কি কথা।" (শ্রীশ্রী মায়ের পদপ্রান্তে, ৪র্থ খন্ড, পৃ - ৯০৪)।


যে সারদাদেবীকে রামকৃষ্ণদেব পুজো করছেন, সকলের কাছে বলছেন এ মানুষ নয়, সাক্ষাৎ ভগবতী। দেবী সরস্বতী, রূপ লুকিয়ে এসেছে, আরো কত কি। আবার তাকেই তিনি ভয় পাচ্ছেন, তাকে ওষুধ পালা না করে ফেলে। কিন্তু এ সব তো গ্রামের অশিক্ষিতা মেয়েরা তাদের স্বামীকে বশে আনতে করে থাকে। যে কিনা সাক্ষাৎ ভগবতী এটার কাছ থেকে এ ভয় কেন?


ঐ বইয়ের ২৩৬ পাতায় একই বিষয়ের আর একবার উল্লেখ পাচ্ছি। স্বামী সারদানন্দ এসেছেন লক্ষ্মীমণিদেবীর সাথে দেখা করতে। একথা সেকথার মধ্যে লক্ষ্মীদেবী বললেন "ঠাকুর তার মানসিক পরিবর্তনের জন্য ঔষধ প্রয়োগ করতে শ্রীমাকে মধ্যে মধ্যে বারণ করিতেন।..." শরৎ মহারাজ ইহা শুনিয়া বলিলেন, "ঠাকুরকে ঔষধ করিবার জন্য কয়েকবার চেষ্টা হইয়াছিল।" স্বামী চেতনানন্দের 'শ্রী রামকৃষ্ণকে যেরূপ দেখিয়াছি', প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা - ১৩, সেখানেও ওষুধপালা বিষয়ের সাক্ষ্য পাওয়া যায়।


একবার নহবতে সারদাদেবী আর ভাইঝি লক্ষ্মীকে ভাগ্নে হৃদয় প্রসাদ দিতে একটু বেশি সময় হাসি ঠাট্টা করেছে। রামকৃষ্ণদেব কিন্তু সব লক্ষ্য রেখেছেন। হৃদয় ফিরে এলে দেরী করার জন্য তাকে তিরস্কার করে বলছেন "যাবি আর দিয়ে চলে আসবি।  খবরদার , কখনো যেন আর দেরী না হয়।" (শ্ৰীশ্ৰী সারদামণি দেবী - মানদাশঙ্কর দাশগুপ্ত, পৃ - ৫৭)। শ্রীরামকৃষ্ণের এ ধমকের কারণ যেন কিছুর ইঙ্গিতবাহী।


*********************************************************


সমাজকে শিক্ষার আলো দেখাচ্ছেন যে স্বামী বিবেকানন্দ তিনি বলে গেছেন - "যে একটা ভূত দেখেছে, সে বই পড়া পণ্ডিতের চেয়ে অনেক বড়।" (স্বামীজির কথা - উদ্বোধন, পৃ - ১৬৭)। সব অবান্তর এবং কুসংস্কারে পরিপূর্ণ শিক্ষা দিয়েও যে দেশের শিক্ষাবিদরা গুরুত্ব পেয়ে থাকেন, তাদের শিক্ষা এবং শিক্ষিতের হার তলানিতে গিয়ে ঠেকবেই। চারটি স্কুল তৈরি করে, সেরা ছাত্রকটিকে টেনে নিয়ে, তাদের ফার্স্ট সেকেন্ড করিয়ে নাম কেনা যায় ঠিকই, সমাজকে শিক্ষার আলো দেখানো যায় না। স্বামীজী আরও বলে গেছেন "আসল ধর্মের রাজ্য যেখানে, সেখানে লেখাপড়ার প্রবেশের কোন অধিকার নেই।" (বাণী ও রচনা, দশম খন্ড, ১ম সংস্করণ, পৃ - ২৭৬)। এটিই আসল কথা, মহাপুরুষের বাণী। কে ফার্স্ট হল, আর কে সেকেন্ড হল তাতে আমার কি! ফার্স্ট বয়-রা কি ভগবান দেখে! আমার দরকার ভগবান, পড়াশুনো করে হবেটা কি? বলেছেন, 'গ্রন্থ পাঠে যা না শিখতে পারো, মন্দির তার চেয়ে বেশি শিক্ষা দেবে'। (ভারতে বিবেকানন্দ - স্বামী শুদ্ধানন্দ, পৃ - ৩১৮)। 'যদি আমরা লিখতে পড়তে না জানি তো আমরা ধন্য, আমাদের ঈশ্বরের কাছ থেকে তফাৎ করার জিনিস অনেক কমে গেল।' (বাণী ও রচনা, চতুর্থ খন্ড, পৃ - ২১৬)। বলতেন - 'বিজ্ঞানবাদ-আত্মা ও ভগবানের আলোকেই লিখতে হবে, নতুবা তা কলুষিত।' (স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি - নিবেদিতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃ - ৩৩৪)। স্বামীজী সম্পর্কে বাজার চলতি বিখ্যাত বইগুলি পড়ে কিছুই বোঝা যাবে না। আকর গ্রন্থগুলি পড়ে দেখুন, শুধু ধর্ম আর ধর্ম। 


*********************************************************


গাছ থেকে আপেল পড়া, সোনার মুকুট জলে ডোবার পক্ষে বিপক্ষে বেদ উপনিষদ গীতায় তেমন কিছু বলা নেই। সমালোচনার হাত থেকে বেঁচে গেছেন বহু বৈজ্ঞানিক। কিন্তু বেদ উপনিষদে উল্লেখ আছে এমন কোন বিষয়, যা কিনা আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে মিলছে না, তা কিন্তু সমালোচনার হাত থেকে রেহাই পায়নি।


মানুষের উদ্ভব সম্বন্ধে শাস্ত্রে যা বলা আছে ডারউইনিসিম এর সাথে তার কোন মিল নেই। ডারউইন কিন্তু বিশ্বজোড়া ধর্মনেতাদের হাত থেকে নিস্তার পাননি। এক প্রশ্নকারীকে স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন - "ডারউইনের কথা সঙ্গত হইলেও evolution এর কারণ সম্বন্ধে উহা যে চূড়ান্ত মীমাংসা একথা আমি স্বীকার করিতে পারি না।" "সাংখ্য দর্শনে ঐ বিষয়ে সুন্দর আলোচিত হইয়াছে। ভারতের প্রাচীন দার্শনিকদের সিদ্ধান্তই ক্রমবিকাশের কারণ সম্বন্ধে চূড়ান্ত মীমাংসা বলিয়া আমার ধারণা।" উত্তর শুনে ভক্ত প্রশ্ন কর্তা আহ্লাদে আটখানা। "আপনার ক্রমবিকাশের নতুন ব্যাখ্যা শুনিয়া আমি পরম আহ্লাদিত হইলাম।" (স্বামী শিষ্য সংবাদ - শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী, পৃষ্ঠা - ১৭৩ - ৭৫)। অনেকে অনেক কিছুতেই আহ্লাদে ফুটিফাটা হয়। বিজ্ঞান কিন্তু হাসির খোরাক ছাড়া কিছুই পায় না। বলতেন 'বিবর্তনবাদের নিরিখে ডারউইনের তুলনায় পাতঞ্জল সর্বাংশে শ্রেষ্ঠ।' (স্বামী বিবেকানন্দ - প্রমথনাথ বস, দ্বিতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা - ৭৯৯)।


স্বামী অভেদানন্দ আবার একটু ঘুর পথে ডারউইনকে আক্রমণ করেছেন। তিনি আবার ক্রমবিকাশ তত্ত্বের সাথে বংশানুক্রমিক গুণাবলীকে যোগ করে নিয়েছেন। এবং তারপরে বলেছেন - "প্রকৃত কথা বলিতে কি, ডারউইনের মতবাদের দ্বারা বংশানুক্রমিক নিয়ম বা ধারার কোন সমস্যাই হয় না।" (পুনর্জন্মবাদ - স্বামী অভেদানন্দ, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা - ৪৭)। অধ্যাপক গলটন, রথ, ওয়াইজম্যানের মতো ভাববাদী দার্শনিকেরা ডারউইনকে উড়িয়ে দিয়েছেন, একথাও তিনি বলে রেখেছেন।


"পিতামাতার অর্জিত গুণাবলী সন্তানে বর্তায়, একথা বিশ্বাস করার ইচ্ছাও আমাদের নাই।" (ঐ, পৃষ্ঠা - ৫২)। "খ্রীষ্টান বা অন্য মতাবলম্বীর এ ব্যাপারে যা বলেন, তাহার দ্বারাও কোন সমস্যার সমাধান আজ পর্যন্ত হয় নাই।" (ঐ, পৃষ্ঠা - ৫৩)। "তবে বেদান্ত দর্শন ঐ প্রাণ বীজ, জীবাণু অথবা জীবকোষে নিহিত অব্যক্ত শক্তিগুলির যথাযথ কারণ নির্ণয় করিতে সক্ষম হইয়াছে। ... ঐ প্রাণ বীজকেই সূক্ষ্ম দেহ বলিতে পারি।" (ঐ, পৃষ্ঠা - ৫৪ - ৫৫)। "সুতরাং ক্রমবিকাশবাদকে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিতে হইলে পুনর্জন্মবাদের প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক হয়।" (ঐ, পৃষ্ঠা - ৮৮)। এইভাবেই অভেদানন্দজী ডারউইনবাদকে ছোট করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সেই সাথে চেষ্টা করেছেন আমাদের কোন মুনি ঋষি এই প্রসঙ্গে কি বাণী রেখে গেছেন, সেই মত প্রতিষ্ঠা করতে। হরি মহারাজ স্বামী তুরিয়ানন্দও ডারউইনকে কচুকাটা করে বলেছেন 'আমরা অমৃতের সন্তান, বানরের সন্তান হতে যাব কেন?'


শিক্ষাবিদ মহেন্দ্র মাস্টার। তিনিও ডারউইনের সমালোচনায় সমান মুখর। বলেছেন - "western evolutionists-এ পাশ্চাত্য ক্রমবিকাশবাদীদের র দৃষ্টি নাই। তারা নিম্ন দৃষ্টি দিয়ে জগৎকে দেখছে। জগতের স্রষ্টার দিকে তাদের দৃষ্টি নাই। ডারউইন এই নিম্ন দৃষ্টি দিয়ে জগৎকে দেখে বলেছেন, মানুষ সৃষ্ঠ জীবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। পাথর, পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, পশুপক্ষী হতে ক্রমে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। Involution, অর্থাৎ ঈশ্বরই এই সব হয়ে আছেন, এ কথা তারা মানে না। এ দৃষ্টি তাদের নেই। এই দৃষ্টি হয় আত্মদ্রষ্টাদের, ব্রহ্মদ্রষ্টাদের।" (শ্ৰীম দর্শন, অষ্টম ভাগ, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা - ২১৭)।


আরও বলেছেন - "বর্তমান biologist-দের দৃষ্টিও নিম্ন দৃষ্টি, সীমাবদ্ধ দৃষ্টি। শাস্ত্র দৃষ্টি, বেদ দৃষ্টি, অবতার দৃষ্টিতেই কেবল সকল সমস্যার সমাধান হয়। যে সরল বিশ্বাসে ঠাকুরের কথা বিশ্বাস করবে তাকে অতশত ভাবতে হবে না। জগদম্বার মুক্তার হার তার গলায় শোভা পাবে।" (ঐ, পৃষ্ঠা - ২১৮)।


বিদ্যাসাগর তার স্কুল থেকে স্বামী বিবেকানন্দ, মহেন্দ্রনাথকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন কেন জানেন? এদের মত পন্ডিত ধার্মিকেরাই ডারউইনের ছবিতে বাঁদরের শরীর বসিয়েছিল, এই কারণে।


সারদাদেবীকে একবার এক ভক্ত প্রশ্ন করেন - "আচ্ছা, এই যে অসংখ্য প্রাণী - ছোট, বড়, সব কি এক সময়ে সৃষ্টি হয়েছে নাকি? মা - "চিত্রকর যেমন তুলি দিয়ে চোখটি, মুখটি, নাকটি - এমনি একটু একটু করে পুতুলটি তয়ের করে, ভগবান কি এমনি একটি একটি করে সৃষ্টি করেছেন? না, তার একটা শক্তি আছে। তার 'হাঁ' তে জগতের সব হচ্ছে, 'না'তে লোপ পাচ্ছে। যা হয়েছে সব এককালে হয়েছে। একটি একটি করে হয়নি।" (শ্রীশ্রী মায়ের কথা, উদ্বোধন কার্যালয়, দ্বিতীয় ভাগ, চতুর্থ সংস্করণ, পৃষ্ঠা - ৩০)। সৃষ্টির পৌরাণিক ব্যাখ্যা।


আর এক পৌরাণিক ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন স্বামী বিবেকানন্দ। 'কর্মফল' নিয়ে আলোচনা কালে সুরেন্দ্র নাথ সেন প্রশ্ন করেন - '"সবই কর্মের ফল হলেও, গোড়া তো একটা আছে! সেই গোড়াতেই বা আমাদের প্রবৃত্তির ভালো মন্দ হয় কেন?" স্বামীজী - "কে বললে গোড়া আছে? সৃষ্টি যে অনাদি, বেদের এই মত। ভগবান যত দিন আছেন, তার সৃষ্টিও ততদিন আছে।" (স্মৃতির আলোয় স্বামীজী - স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ, পৃষ্ঠা - ২০৯)। অর্থাৎ স্বামীজীর মতে পৃথিবীতে প্রথম প্রাণ বলে কিছু নেই। সৃষ্টি ও প্রাণ সব সময় ছিল, সব সময় আছে। ধার্মিকের বিজ্ঞান ব্যাখ্যা।


*********************************************************


No comments:

Post a Comment