Saturday, 25 November 2023

ইসলাম ও নারী - কঙ্কর সিংহ

মধ্যপ্রাচ্যের তিন সেমেটিক ধর্ম - ইহুদী, খ্রিস্টান ও ইসলাম। তিন ধর্মেই নারী সৃষ্টির একটি সাধারণ কাহিনী রয়েছে। খ্রিস্টানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ইঞ্জিল, যার উল্লেখ বারবার দেখা যায় কোরানে। সেখানে বিধাতাপুরুষের নারী সৃষ্টির বর্ণনা রয়েছে, "সদাপ্রভু ঈশ্বর আদি মানব আদমকে নিদ্রায় মগ্ন করলে তিনি নিদ্রিত হলেন, ঈশ্বর তখন আদমের পাঁজরের একটা হাড় নিয়ে তা মাংস দিয়ে পূরণ করেন। সদাপ্রভু আদম হতে গৃহীত সে পঞ্জরে এক স্ত্রী নির্মাণ করে আদমের কাছে নিয়ে আসেন, তখন আদম বলেন এই স্ত্রী তাঁর অস্থির অস্থি। এঁর নাম হবে নারী। কেননা তিনি নর হতে তৈরী হয়েছেন।" এই কাহিনীটি দেখা যায় কোরানেও। আদম কোনও নারী সন্তান নয়, তাঁর কোনও জননী নেই, স্বয়ং বিধাতা তাঁকে সৃষ্টি করেছেন মাটি হতে। মানবের আদি পিতার জন্ম মৃত্তিকা হতে। সেমেটিক ধর্মসমূহের স্রষ্টা তা বারবার ঘোষণা করেছেন ধর্মপুস্তকে। তৌরাত, ইঞ্জিল, কোরানে। ইহুদী-খ্রিস্টান-ইসলাম - তিন ধর্মেই অস্বীকার করা হয়েছে মানুষের স্বাভাবিক জন্মপ্রক্রিয়া। শুধু তাই নয়। নারীকে করে তুলেছে তার সৃষ্টির জন্যে পুরুষের দেহের কাছে ঋণী। পুরুষের পঞ্জর না হলে নারী সৃষ্টি হত না। পুরুষ তার অন্য বিধাতা। ঈশ্বরের ধর্মগ্রন্থে নর নারীর জন্মদাতা। যে অস্থিপঞ্জর থেকে নারীকে সৃষ্টি করা হল সেই পঞ্জরও আবার সহজসরল নয় - বক্র। বক্র হাড় থেকে জন্ম বলে নারীর স্বভাবও বক্র। তাকে নিন্দা করেই এরপর ধরনীর ধূলায় নেমেছেন ঈশ্বরের প্রেরিত দূত - নবী রসুলরা, বিধাতাপুরুষের সাথে তাঁরাও কণ্ঠ মিলিয়েছেন নারী নিন্দায়। যে নারীনিন্দা তাঁদের অনুগামী পুরুষদের কাছে হয়ে উঠেছে পবিত্র ধর্মপুস্তক, কখনও তা ঈশ্বরের ঐশীবাণী, কখনও তা প্রেরিত পুরুষের জীবন বিধান ও কর্মনির্দেশ। যাকে অবনত মস্তকে শুধু মেনে নিতে হয়। অবহেলা কিংবা অস্বীকার করা যায় না। করলেই ধর্মচ্যুতি। যার জন্যে রয়েছে চরম জাগতিক শাস্তির বিধান। এইসব ধর্মপুস্তক, বিধি-বিধান হয়ে উঠেছে সব সামাজিক  জাগতিক আইনের উৎসব। যা ক্রমাগতভাবে পুরুষকে তৈরী করে দিয়েছে নারীর বিধাতারূপে। তাকে আষ্টে-পৃষ্টে করেছে শৃঙ্খলিত। নারী সেই শৃঙ্খল খুলতে পারেনি। কারণ আইন হল বিধাতার। নির্দেশও তাঁর প্রেরিত পুরুষ দ্বিতীয় বিধাতার।


*********************************************************

ইসলাম পৃথিবীর স্বীকৃত ধর্মগুলির মধ্যে কনিষ্ঠতম ধর্ম। হজরত মোহাম্মদ এই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। যদিও ইসলাম ধর্মানুসারীদের বিশ্বাস সৃষ্টির আদি পিতা আদম হতে ইসলামের উদ্ভব। আদম ইসলামের প্রথম নবী।
*************************
মোহাম্মদ কোরানকে ধারণ করেছিলেন, অনেক সুরা ও আয়াত লিখেও রেখেছিলেন। বেশীটাই ছিল হাফেজ (কোরান মুখস্ত যাদের আছে) দের কণ্ঠে। কিন্তু কোনও সংকলিত রূপ দিয়ে যাননি বা যেতে পারেননি। কোরান পূর্ণাঙ্গরূপে সংকলিত হয় মোহাম্মদের মৃত্যুর দুই দশক পরে ইসলামের ৩য় খলিফা হজরত ওসমানের হাতে। খলিফা ওসমানকে তাই বলা হয় 'জামেউল কোরান' বা কোরান সংকলক।
*************************
মক্কার কাছে হেরা পর্বতে প্রথম যে ওহী অবতীর্ণ হয়েছিল মোহাম্মদের ওপর তা সুরা আলাক।

পাঠ কর তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্তপিন্ড হতে। - সুরা আলাক, ৯৬/১-২
*************************
বর্তমানে কোরানকে যেভাবে পাওয়া যায় তাতে নারী'র প্রথম দর্শন দেখা যায় - সুরা বাকারায়। মদীনায় এই সুরাটি অবতীর্ণ হয়েছিল। এই সুরার আত্মপ্রকাশ তাই মোহাম্মদের নবুয়ত লাভের অনেক পরের দিকে।

সুরা বাকারার সেই বিখ্যাত আয়াতটি তুলে ধরছি -

তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের শস্যক্ষেত্র, অতএব তোমরা 
তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা যেতে পার। - সুরা বাকারা, ২/২২৩

কোরানের এই আয়াত নারীকে একেবারে পৌঁছে দিয়েছে পৃথিবীর আদিমতম সমাজে। নবীন ধর্ম ইসলামের অনুগত মুসলমানদের জন্যে এই আয়াতের 'নির্দেশ' নারীর জন্যে চরম অবমাননার। এখানে নারীর অবনমন চূড়ান্ত। প্রাচীন বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই মনে করা হত যে নারীর সাথে উর্বরা প্রকৃতির কোনোও প্রভেদ নেই। প্রকৃতির ক্ষেত্রকে কর্ষণ করলে যেমন শস্য পাওয়া যায়, নারীকে মৈথুন করলেও তেমনি সন্তানের জন্ম হয়। সন্তান জন্মে নারীর কোনও ভূমিকা নেই। যেমন নেই শস্যক্ষেত্রের। কর্ষণ করে বীজ বপন করলে শস্য আর মৈথুনের বীজ থেকে সন্তান। এই আয়াত নারীকে শুধু পদানতই করেনি, তাকে পরিণত করেছে পুরোপুরি যৌন কর্ষণের ক্ষেত্ররূপে। নবীনতম ধর্ম ইসলাম দাবি করে, এই ধর্ম নারীকে যত অধিকার দিয়েছে বিশ্বের অন্য কোনও ধর্ম তা দেয়নি। দিতে পারেনি। ইসলাম নারীকে অন্ধকার জগ থেকে তুলে এনে নতুন মহিমায় গরিয়সী করেছে। ইসলাম নারীকে কোনও ভাবেই মহিয়সী করেনি। নারীকে উর্বরা শস্যক্ষেত্রের সাথে উপমা তাকে আদিম থেকে আদিমতর স্তরে অবনমিত করে। সুরা বাকারার ২/২২৩ আয়াত সেটাই বুঝিয়ে দেয় আমাদের।
*************************
রোজার রাত্রিতে তোমাদের জন্য স্ত্রী সহবাস বৈধ করা হয়েছে। - সুরা বাকারা, ২/১৮৭

রমজান মাস মুসলমানদের জন্যে সংযমের মাস, রিপুকে দমনের মাস। সেই পবিত্র মাসেও মুসলমানদের জন্যে স্ত্রী-সহবাস হালাল করে দিলেন আল্লাহ এই আয়াতে। ... রসুল মোহাম্মদ নিজেও রোজার মাসে স্ত্রীসম্ভোগ করতেন। হাদীসে তার উল্লেখ রয়েছে।

মোহাম্মদের পত্নী আয়েশা এবং উস্মে সালমা উভয়েই বলেছেন যে কোনও কোনও সময় রসুল স্ত্রীর সাথে সঙ্গমের পর 'জানাবত' অবস্থায় সোবেহ সাদেক (রাত্রি শেষে প্রত্যুষের আলো ফোটার আগের মুহূর্ত) হয়ে যেত। তখন তিনি স্নান করতেন এবং রোজা রাখতেন। (৯৯৫ / বোখারী শরীফ, মাওলানা আজিজুল হক অনুদিত)
*************************
মূর্তিপূজারী কাফের রমণীকে ধর্মান্তরিত না করে বিয়ে করা যায় না। কোরানের নির্দেশ তাই।

আর অংশীবাদী রমণী যে-পর্যন্ত না বিশ্বাস করে তোমরা তাকে বিয়ে কোরো না। অবিশ্বাসী নারী তোমাদের চমৎকৃত করলেও নিশ্চয় ধর্মে বিশ্বাসী ক্রীতদাসী তার চেয়ে ভালো। - সুরা বাকার, ২/২২১
*************************
কোরানেও রজঃস্বলা নারীকে দেখা হয়েছে নিষিদ্ধ ও দূষিত প্রাণী রূপে। এখানে ইসলামের বিধান পুরুষতান্ত্রিক অন্যসব ধর্মের চেয়ে আলাদা নয়। ইসলাম এখানে কোনও আধুনিকতা পরিচয় দিতে পারেনি। রজঃস্রাব চলাকালীন নারী অশুচি হয় না। তবে তার প্রয়োজন হয় বিশ্রামের, বিশেষ করে যৌনসংগম থেকে।

লোকে তোমাকে রজঃস্রাব সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। তুমি বলো, 'তা অশুচি', তাই রজঃস্রাবকালে স্ত্রীসঙ্গ বর্জন করবে। - সুরা বাকারা, ২/২২২

ঋতুমতী নারীর রজঃ অশুচি। এই বার্তা কোরানে বলা হলেও রসুল মোহাম্মদ কামুক পুরুষদের জন্যে স্ত্রী সংসর্গ পুরোপুরি বন্ধ করেননি। তিনি ইচ্ছে করেই যেন কোরানকে অতিক্রম করেছিলেন। তিনি অবশ্য কিছু শাস্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। একটি হাদীসে বলা হয়েছে -

রজঃস্বলা স্ত্রীর সাথে কোনও পুরুষ সংগত হলে তাকে এই কাজের জন্যে এক দিরহাম সদকা দিতে হবে। রক্তের রং কিছুটা হলদেটে হলে সদকার পরিমাণ হবে অর্দ্ধ দিনার আর সম্পূর্ণ লাল হলে এক দিনার। (মিশকাত - ৫৫৩,৫৫৪)

কোরান যা নিষিদ্ধ করেছে তা থেকেও রেহাই পাওয়া যায় কিছু সদকা দিলে যদি তা স্ত্রী সংসর্গ জনিত হয়। সমর্থ পুরুষের জন্যে এই সদকা সংগ্রহ করা খুব কঠিন নয়। যৌন-সংযম বলে কিছু যেন থাকতে নেই ইসলামে। ইসলাম নারীকে দেখেছে মূর্তিমতী কাম বলে, যে নারী একদিন তাকে করেছিল স্বর্গভ্রষ্ট, লিপ্ত করেছিল 'পাপকাজে'। সে নারীকে ইসলাম ক্ষমা করেনি।
*************************
ইসলাম দাবি করে নারীকে সম্পত্তির ওপর অধিকার প্রদান এর আগে কোনও ধর্ম-সমাজ দেয়নি, এটা এক বৈপ্লবিক উদাহরণ। ইসলাম পুরুষের সাথে নারীকেও সম্পত্তির অধিকারী করেছে। ইসলাম নারীকে সম্পত্তির অধিকার দিলেও সমান অধিকার দেয়নি, সব স্থানেই নারী পুরুষের অর্দ্ধেক। অর্থাৎ একজন পুরুষের সমান দুজন নারী। পিতা-মাতা-ভ্রাতা-স্বামী-পুত্র--সবার সম্পত্তিতেই নারীর উত্তরাধিকার স্বীকৃত হলেও তা নিরংকুশ নয়। সেখানেও লিঙ্গ-বৈষম্য তাকে পূর্ণ মানব না করে অর্দ্ধমানবী করে রেখে দিয়েছে।

সুরা নিসার ৭, ১১ এবং ১২ নং আয়াতেও বলা হয়েছে -

পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে। আর পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছে, তা অল্পই হোক অথবা বেশিই হোক, এক নির্ধারিত অংশ।

আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন তোমাদের সন্তানসন্ততি সম্পর্কে: এক ছেলে পাবে দুই মেয়ের অংশের সমান; যদি দুই মেয়ের বেশি থাকে তবে তারা পাবে যা সে রেখে গেছে তার দুই-তৃতীয়াংশ, আর যদি এক মেয়ে থাকে তবে সে পাবে অর্ধেক, আর তার যদি সন্তান থাকে তবে তার পিতামাতা প্রত্যেকে পাবে তার ছয় ভাগের এক ভাগ, কিন্তু যদি তার সন্তান না থাকে, শুধু পিতামাতা তার উত্তরাধিকারী হয় তবে তার মা পাবে তিন ভাগের এক ভাগ; কিন্তু যদি তা ভাইয়েরা থাকে তবে তার মা পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ।

তোমাদের স্ত্রী যা রেখে যায় তার অর্ধেক তোমরা পাবে। যদি তাদের একটি সন্তান থাকে তবে তোমরা পাবে তাদের রেখে-যাওয়া সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ, তাদের অসিয়তের দাবি বা ঋণ পরিশোধের পরে। আর তারা পাবে তোমরা যা রেখে যাও তার চার ভাগের এক ভাগ যদি তোমাদের সন্তান না থাকে, কিন্তু যদি একটি সন্তান থাকে তবে যা রেখে যায় তার আট ভাগের এক ভাগ তারা পাবে, তোমাদের অসিয়তের দাবি বা ঋণ পরিশোধের পরে। আর যদি কোনো পুরুষ বা স্ত্রীলোক সম্পত্তি রেখে যায় তার আছে এক ভাই বা এক বোন তবে তাদের প্রত্যেকে পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ। - সুরা নিসা, ৪/৭, ১১, ১২

ইসলাম নারীকে সম্পত্তির অধিকার দিয়ে কিছুটা আর্থিক সুবিধা দিলেও কেড়ে দিয়েছে অনেক কিছু। নারীকে এই সুবিধা দানের জন্যে অহংকারও কম নেই ইসলামের। কিন্তু ইসলামের আইনে নারী পিতা ও স্বামীর যে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়েছে তাতে তার অংশ খুবই কম, সব ক্ষেত্রেই তা পুরুষের অর্দ্ধেক। মুসলমানরা দাবি করেন নারী যেভাবে পিতৃকুল ও পতির কুলে সম্পত্তি পায় তা যোগ করলে পুরুষের অংশকে ছাড়িয়ে যাবে, কিন্তু তা সত্যি নয়। সব রকম হিসেব-নিকেশ করে দেখা গেছে একই অবস্থানে নারী কোনও ভাবেই পুরুষের অংশ ছাড়িয়ে যায় না।

সুরা নিসায় কোরানের স্রষ্টা আবার পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেছেন -

পুরুষ নারীর রক্ষাকর্তা, কারণ আল্লাহ তাদের এককে অপরের ওপর বিশিষ্টতা দান করেছেন, আর এজন্য যে, পুরুষরা তাদের ধনসম্পদ থেকে ব্যয় করে। - সুরা নিসা, ৪/৩৪

এই বিষয়ে সতর্কবাণীও রয়েছে আল্লাহর -

যা দিয়ে আল্লাহ তোমাদের কাউকে কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন তোমরা তার লালসা কোরোনা। পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য, আর নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য। - সুরা নিসা, ৪/৩২

আল্লাহ পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে এ নারী। এটা আল্লাহর বিধান। এই বিধান থেকেই গড়ে উঠেছে ইসলামের সব আইনকানুন যা নারীকে করেছে শৃঙ্খলিত। যা থেকে ইসলামের বিশ্ব নারীকে আর মুক্তি দেয়নি। মুসলমানরা বলেন ইসলাম নারীকে যত সন্মান দিয়েছে অন্য কেউ তা দেয়নি। এখানে কোথায় সেই সন্মান। কোথায় বা পরিপূর্ণ সামাজিক অধিকার। একজনকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করলে অন্যজনের অধিকার সংকুচিত করে নিতে হয়। তার সমান অধিকারের দাবি তুলে নিতে হয়। কোরান নারীকে সেই কথাই শিখিয়েছে।

*********************************************************
ইসলামে বিয়ে কোনও ঐশী ধর্মানুষ্ঠান নয়। বিয়ে একটা চুক্তি। রসকষহীন, কর্কশ। বলেছেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদরা। এই চুক্তি দুটি সমমানুষের মধ্যে নয়, অসম মানুষের মধ্যে, যেখানে একজনের শ্রেষ্ঠত্ব অপরের ওপরে আরোপিত। ইসলামে বিয়ে এক অসম চুক্তি। 
*************************
ইসলাম পুরুষকে করেছে বহুভোগ্যা। সুরা নিসার প্রথমেই আল্লাহ বলে দিয়েছেন -

তবে বিয়ে করবে (স্বাধীন) নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভালো লাগে, দুই, তিন বা চার জনকে। আর যদি আশঙ্কা কর যে সুবিচার করতে পারবে না তবে একজনকে বা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকে। এভাবেই তোমাদের পক্ষপাতিত্ব না করার সম্ভাবনা বেশি। সুরা নিসা, ৪/৩
*************************
পতি-পত্নীর দাম্পত্য জীবন তো শুধু অশন-বসনে সীমাবদ্ধ নয়। কিন্তু তার বাইরে যদি নিয়ে যাওয়া হয় সেই 'সুবিচার'কে তাহলে কার্যত তা কোনও মানব-সন্তানের পক্ষে সম্ভব নয়। বিশ্বের সর্বকালের 'শ্রেষ্ঠ মানব' যাঁকে বলা হয়, সেই রসুল মোহাম্মদও তা পারেননি। ... আল্লাহ নিজেও জানতেন তাঁর কোনও বান্দার পক্ষে তা সম্ভব নয়, তাই সুরা নিসার অন্য একটি আয়াতে তিনি বললেন -

আর তোমরা যতই ইচ্ছা কর না কেন তোমাদের স্ত্রীদের সাথে কখনোই সমান ব্যবহার করতে পারবে না। তবে তোমরা কোনো-একজনের দিকে সম্পূর্ণ রূপে ঝুঁকে পড়ো না ও অপরকে ঝুলিয়ে রেখো না। - সুরা নিসা, ৪/১২৯
*************************
ইসলামে কোনো বৈরাগ্য নেই। পুরুষের জন্যে তা হারাম। নারীর তো কোনও স্বাধীন সত্ত্বাই নেই। নারীকে তো সৃষ্টি করা হয়েছে পুরুষের অবাধ গমনের শস্যক্ষেত্র রূপেই। রসুলের একটি হাদিসে বলা হয়েছে "যখন কোনও ব্যক্তি বিয়ে করে তার অর্ধেক ইবাদত (প্রার্থনা) পূর্ণ হয়ে যায়। বাকী অর্ধেকের জন্য যেন সে আল্লাহকে ভয় করে।" অন্য একটি হাদিসে রয়েছে "বিয়ে করা আমার সুন্নত। যে আমার সুন্নত হতে বিরত থাকবে সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য নহে।" বিবাহ ইসলামের জীবনবিধানে এমন একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য যা না করলে রসুলের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়। তার সরল অর্থ সে ব্যক্তি আর মুসলমান থাকে না। বিবাহ সম্বন্ধে আর একটি হাদীস হল, "বিবাহিত পুরুষের এক রাকাত (নামাজের এক অংশ) নামাজ অবিবাহিত পুরুষের সত্তর রাকাত নামাজ হতেও উত্তম।" এই হাদীসে বিবাহ পেয়ে গেছে নামাজের মর্যাদা। তাকে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে আল্লাহর ইবাদতের সাথে। এর পর কোনও মুসলমান পুরুষ অবিবাহিত থাকার জীবন বেছে নিতে পারে। বিয়ে করা তার কাছে পূণ্য অর্জনের পথে পা বাড়ানো।
*************************
ইসলামী বিবাহ প্রথায় 'দেনমোহর' গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিয়ের চুক্তির ফলে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে পায় দেনমোহর। কিছু অর্থ, অলংকার বা সম্পত্তির লিখিত প্রতিশ্রুতি। যার বিনিময়ে স্বামী নামে পুরুষটি লাভ করে স্ত্রী নামে নারীটির দেহের ওপর একচ্ছত্র অধিকার। তখন স্ত্রী পরিণত হয়ে যায় অনুগতা বৈধ যৌনদাসীতে। সেখানে যখন খুশী গমন করে কর্ষণ করা যায়। দেনমোহর শুধু কাবিনে লেখা থাকে। স্ত্রী সাধারণত তা নগদে পায় না। এমন কী বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও তা সাধারণত আদায় হয় না। দেনমোহর পরিমাণে খুব বেশী হয় না। ইসলামের আইনী মজহাব হানাফী আইনে বলা হয়েছে দেনমোহর হবে কম পক্ষে ১০ দিরহাম। অন্য মজহাব মালিকি আইনে কমপক্ষে ৩ দিরহাম। আর হাদিস অনুসারে কমপক্ষে ১টি লোহার আংটি। রসুল মোহাম্মদ বলেছেন "নিশ্চয়ই এই ধরনের বিবাহে বরকত বেশী হয় যে বিবাহের মোহর কম থাকে।" তিনি আরও বলেছেন "ঐ স্ত্রীলোক অতি উত্তম যে দেখিতে সুন্দরী এবং যাহার মোহর অতি নগন্য।" হজরত মোহাম্মদ অসুন্দরী নারীদের পছন্দ করতেন না। বিয়েতে দেনমোহরের পরিমাণ নিয়ে কনে ও বরপক্ষের মধ্যে দরকষাকষি চলে দুই পক্ষের অভিভাবকের মধ্যে। এটা স্বীকৃত প্রথা। সেখানে কনের কোনও ভূমিকা থাকে না। কিন্তু তার শরীর নিয়েই চলে হাটের দরাদরি।

নারীদের দেনমোহর খুশি মনে দিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছে কোরান। সেই সাথে স্ত্রীদেরও উপদেশ দেওয়া হয়েছে তারা যেন খুশি মনে দেনমোহরের কিছু অংশ ছেড়ে দেয়।

আর তোমরা নারীদেরকে তাদের দেনমোহর খুশি মনে দিয়ে দাও। যদি তারা খুশি মনে তার কিছু ছেড়ে দেয় তোমরা তা স্বচ্ছন্দে ভোগ করো। - সুরা নিসা, ৪/৪

কোরান পুরুষকে শুধু নারীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব এবং কর্তৃত্বই দান করেনি, অবাধ্য স্ত্রীকে প্রহার করার নির্দেশ পর্যন্ত দিয়েছে।

স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের ভাল করে উপদেশ দাও, তারপর তাদের বিছানায় যেওনা ও তাদেরকে প্রহার করো। যদি তারা তোমাদের অনুগত হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পথ খুঁজবে না। - সুরা নিসা, ৪/৩৪ 

কোরানে পুরুষ কোন কোন নারীকে বিয়ে করতে পারবে না তার তালিকা রয়েছে (সুরা নিসা, ৪/২২ - ২৩)। সেই তালিকায় উল্লিখিত সম্পর্ক ছাড়া সব নারীকে মুসলমানরা বিয়ে করতে পারেন শুধু সধবা (যার স্বামী বর্তমান) নারী ছাড়া (সুরা নিসা, ৪/২৪)। এই সধবা শুধু  মুসলিম নারীদের বেলা প্রযোজ্য। কাফের বা অংশীবাদী নারী হলে এই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য নয়। ... পরধর্মের কোনও সধবা নারী যদি ইসলাম গ্রহণ করে কিংবা মুসলমানদের অধিকারভুক্ত হয় যুদ্ধবন্দীরূপে বা অন্যভাবে, তাহলে তার পূর্ববর্তী বিবাহ বাতিল হয়ে যায় তিনি না চাইলেও। তার স্বামী তখন পরপুরুষ হয়ে যান তার কাছে, সেই সধবা নারী তখন আর সধবা থাকেন না ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে। তখন যে কোনও মুসলমান পুরুষের সাথে তার বিবাহ হতে পারে। তার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে তাকে অধিকার করে নিয়ে। খুব সহজ আইন ইসলামের।

একজন মুসলমান পুরুষ চারটি বৈধ স্ত্রী রাখার পরও যত খুশী 'ডান হাতের অধিকারভুক্ত' দাসীকে সম্ভোগ করতে পারে, কোনও বাধা নেই ইসলামী আইনে বা নৈতিকতায়। দাসী সম্ভোগ ইসলামে বৈধ। ডান হাতের অধিকারভুক্ত দাসীদের বেলায় কোনও সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি কোরানে।

আমি তোমার জন্য তোমাদের স্ত্রীদেরকে বৈধ করেছি যাদেরকে তুমি দেনমোহর দিয়েছ ও বৈধ করেছি তোমার ডানহাতের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকে। - সুরা আহজাব, ৩৩/৫০
*************************
কোরান তালাক সম্বন্ধে কী বলে আমরা দেখে নিতে পারি। সুরা বাকারায় আছে -

আর যদি তারা তালাক দিতে সংকল্প করে তবে তো আল্লাহ সব শোনেন, সব জানেন। 
তালাকপ্রাপ্ত নারীগণ তিন রজঃস্রাব কাল প্রতীক্ষায় থাকবে।
এ তালাক দুবার, তারপর হয় ভালভাবে রাখবে বা সদয়ভাবে বিদায় দেবে। - সুরা বাকারা, ২/২২৭ - ২২৯

বিয়ে হয়ে গেছে, কিন্তু স্ত্রীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি কিংবা দেনমোহর ধার্য হয়নি তেমন স্ত্রীকে অবাধে তালাক দেওয়া যায়। যদি দেনমোহর ধার্য হয় তা হলে তার পরিমান হবে অর্দ্ধেক। তবে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী মাফ করে দিলে সেই দেনমোহরও দিতে হবে না।

স্ত্রীকে স্পর্শ করার বা দেনমোহর ধার্য করার পূর্বে যদি তাদেরকে তালাক দাও, তবে কোনো পাপ হবে না, আর তোমরা যদি স্পর্শ করার পূর্বে স্ত্রীদের তালাক দাও, অথচ দেনমোহর পূর্বেই ধার্য করে থাক - তা হলে নির্দিষ্ট দেনমোহরের অর্দ্ধেক তোমাদেরকে আদায় করতে হবে। - সুরা বাকারা, ২/২৩৬ - ২৩৭

তালাকপ্রাপ্ত নারীকে ভরণপোষণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে - তবে তা বাধ্যতামূলক নয়, তা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে মুসলমান পুরুষের সদিচ্ছা ও সামর্থের ওপর। নারী তালাক দিতে পারে এমন কথা কোরানে বলা নেই। কোরানের তফসিরকাররা এ বিষয়ে বিভিন্ন মত পোষণ করলেও একটা বিষয়ে বোধহয় ভিন্নমত নেই যে স্ত্রী শুধু তালাক চাইতে পারে যদি তার স্বামী নামে প্রভুটি তা অনুমোদন করে। সেক্ষেত্রে নারীকে তার দেনমোহরের দাবি পরিত্যাগ করতে হয়। স্বামীর কোনও রকম সম্পত্তির ওপরও তার অধিকার থাকে না।

ইসলামে বিয়ে নামে যে চুক্তি তা স্বেচ্ছাচারী স্বামী যে কোনও মুহূর্তে ভেঙ্গে দিতে পারে। "ইসলামে বিবাহ-বিচ্ছেদ বা তালাক গেলাস থেকে জল ঢালা থেকেও সহজ স্বামীর জন্যে, আর স্ত্রীর জন্য ফাঁসির রজ্জু খোলার থেকেও তা কঠিন।" অনেক পণ্ডিত প্রবর মনে করেন কোরানে এক সাথে তিন তালাক দেওয়ার বিধান নেই। দুই তালাক দেওয়ার পর ইচ্ছা করলে তালাক ফিরিয়ে নেওয়ার কথাও সেখানে রয়েছে। ৩য় তালাকের খড়্গ সেখানে ঝুলিয়ে রাখা হলেও পরে তা গ্রহণ করা হয়নি। ইসলামের শ্রেষ্ঠ খলিফা বলা হয় হজরত ওমরকে। তিনি কোরানকে অতিক্রম করেছেন একথা ভাবা যায় না। তিন তালাক নিয়ে কোরানের ভাষ্যকাররা যে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছিলেন খলিফা ওমরের খেলাফতের কালে তাতে তিন তালাক একসাথে দিতে পারার বৈধতা পায়। সেই থেকে মুসলমান সমাজে তিন তালাক নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। ইসলামের ইতিহাস এই বলে। ...

... এই ওমরের খেলাফতেই তিন তালাক নিয়ে সব বিতর্কের অবসান হয়। কিন্তু ওমরের কথা বলা হলেও, ইসলামের শ্রেষ্ঠ ইমামগণ - ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেরী, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল - সকলেই একমত যে আলাদা আলাদা বা এক সাথে যেভাবেই তিন তালাক দেওয়া হোক, তালাক কার্যকর হয়ে যাবে। ...

... কোরানের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে ইসলামের শরীয়া আইন। সেই আইনে একসাথে তিন তালাক দেওয়া বৈধ। তালাক সম্বন্ধে আরো কিছু কথা -

তালাক (শব্দটা উচ্চারণ বা অন্য যে কোন ভাবে তিনবার একসাথে বা আলাদাভাবে প্রকাশ করা।, লেয়ান (প্রমাণ করতে পারুক বা না-ই পারুক স্ত্রীর ওপর ব্যাভিচারের অপবাদ আনলেই বিয়ে ভেঙ্গে যায়), এই দুই পদ্ধতিতে স্বামী এক মিনিটেই বিয়ে বাতিল করতে পারে। আর যিহার (স্ত্রীর শরীরের কোন অংশের সাথে স্বামী তার মায়ের শরীরের ওই অংশের তুলনা করলে বিয়ে ভেঙ্গে যায় - আরব বেদুঈনদের প্রাচীন সংস্কৃতি) এই তিন পদ্ধতিতে স্বামী এক তালাক দিতে পারে। শারিয়ায় তালাকের একচ্ছত্র অধিকার আছে শুধুমাত্র স্বামীর হাতে, স্ত্রীর হাতে নয়। পৃথিবীর কোন সংগঠন বা ব্যক্তির অধিকার নেই স্বামীকে তালাক থেকে বিরত রাখতে পারে বা তালাকের কারণ জিজ্ঞেস করতে পারে। লেয়ান আর যিহার আজকাল আর দেখা যায় না কিন্তু তাৎক্ষণিক তালাকের বজ্র স্ত্রীদের মাথায় নেমে আসে মুসলিম সমাজে। আরও লক্ষণীয় যে দাসী-স্ত্রীদের বেলায় তিনবার নয়, তালাক হয়ে যায় দু'বারেই। এবং তালাকের পরে সাধারণ স্ত্রীরা তিন এবং দাসী-স্ত্রীরা দুই ইদ্দতের পরে বিয়ে করতে পারে।

লক্ষণীয় যে শারিয়া-আইনে মাদক বা মদের ঘোরে, অত্যাচারের চাপে, রাসায়নিক প্রভাবে, হাসিঠাট্টার ছলে বা চাপের মুখে তালাক উচ্চারণ করলেও তাৎক্ষণিক ভাবে তালাক পুরো হয়ে যায়। কারণ, স্বামী নাকি বিভিন্ন সম্ভাবনার মধ্যে "সর্বশ্রেষ্ঠ" সিদ্ধান্ত নেয় তালাক দেবার, যে অধিকার তাকে নাকি আল্লাহই দিয়েছেন।"
*************************
মৃত স্বামী বা তালাক দেওয়া স্বামীর জন্যে নারীর ইদ্দত পালন বাধ্যতামূলক। কিন্তু স্ত্রী মারা গেলে স্বামীকে মাত্র তিনদিন অপেক্ষা করতে হয়, বেশী নয়। আর এক স্ত্রীকে তালাক দিয়ে সাথে সাথে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করা যায়, এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে হয় না স্বামী নামে পুরুষটিকে।

যেখানেই তালাক সেখানেই তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে পুনর্বিবাহ করার প্রশ্নটা চলে আসে। কারণ অনেক সময় ভুলবশতও তালাক দেওয়া হয় স্ত্রীকে। কোরানে তালাক দেওয়া স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করার বিধান রয়েছে,

তারপর ঐ স্ত্রীকে যদি সে তালাক দেয় তবে যে-পর্যন্ত না ঐ স্ত্রী অন্য স্বামীকে বিবাহ করছে তার পক্ষে সে বৈধ হবে না। তারপর যদি সে (দ্বিতীয় স্বামী) তাকে তালাক দেয় তবে তাদের মিলনে কোনো দোষ নেই। - সুরা বাকারা, ২/২৩

... কোরানের তফসিরকাররা বলে থাকেন তালাককে নিরুৎসাহ করার জন্যেই এত কঠিন বিধি। কিন্তু যে পুরুষ ভুল করে তাকে তো কিছুই হারাতে হয় না, সব মূল্য দিতে হয় নারীকে। সুরা বাকারার এই আয়াত নারীর জন্যে যে চরম অসম্মানের তা ভেবে দেখেন না কোরান বিশেষজ্ঞরা। ... রসুল বলে গেছেন মুহাল্লিলের সাথে বিয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত বৈধ নয় যতক্ষণ পর্যন্ত দুজনের মধ্যে যৌন-মিলন ঘটে (বোখারী হাদিস - ২০৭৮, ২০৭৯)। আসলে ইসলামে কোনও বিয়েই যৌন মিলন ছাড়া বৈধতা পায় না।
*************************
ইসলামের প্রথম যুগে আরও এক প্রকার বিবাহ-বিধি প্রচলিত ছিল। যাকে বলা হয়েছে চুক্তি বিবাহ। ইসলামের পরিভাষায় যার নাম মুতা-বিবাহ। ইসলামের গরিষ্ঠ অংশ সুন্নীদের মধ্যে মুতা বিবাহ আর চালু না থাকলেও শিয়াদের মধ্যে এখনো এই বিবাহ প্রথা মান্যতা পায়।

"শিয়া মুসলিমদের একটি অংশ অস্থায়ী বিবাহকে আইনসঙ্গত মনে করেন।" (সৈয়দ আমীর আলী - 'দ্য স্পিরিট অব ইসলাম') 
*************************
ইসলামে নারীকে বলা হয় 'ফিৎনা'। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী।

*********************************************************
আরব নারীরা অবরোধবাসিনী ছিলেন না। ইসলাম তাদের মুক্ত পৃথিবী থেকে অবরোধে ঢুকিয়েছে। ইসলাম-পূর্ব আরব সমাজে নারীদের যে অধিকার ও স্বাধীনতা ছিল, ইসলাম তা হরণ করে। নবীপত্নীদের দিয়ে তার সূচনা।

হে নবীপত্নীগণ! তোমরা তো অন্য নারীদের মত নও, যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পরপুরুষের সঙ্গে কোমল কণ্ঠে কথা বলবে না যাতে অন্তরে যার ব্যাধি আছে সে প্রলুব্ধ হয়। তোমরা ভালভাবে কথাবার্তা বলবে। আর তোমরা ঘরে থাকবে, জাহেলিয়া (প্রাগইসলামি) যুগের মতো নিজেদেরকে দেখিয়ে বেড়িয়ো না। - সুরা আহজাব, ৩৩/৩২, ৩৩

পত্নীদের অবরোধবাসিনী করতে চেয়েছিলেন রসুল মোহাম্মদ। আল্লাহ অনুমোদন তিনি পেয়েছিলেন। তিনি যা কামনা করেন আল্লাহ তা দান করেন। আল্লাহ তো অন্তর্যামী। সুরা আহজাব মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছিল। নবীপত্নীদের জন্যে সাবধানবাণীও রয়েছে এই সুরায়।

হে নবি! তুমি তোমার স্ত্রীদের বলো, তোমরা যদি পার্থিব জীবনের ভোগ ও বিলাসিতা কামনা কর, তবে এসো, আমি তোমাদের ভোগবিলাসের ব্যবস্থা করে দিই আর তোমাদেরকে ভদ্রতার সাথে বিদায় দিই।

হে নবীপত্নীগণ! যে কাজ স্পষ্টত অশ্লীল তোমাদের মধ্যে কেউ তা করলে তাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেওয়া হবে। - সুরা আজহার, ৩৩/২৮ - ৩০

... নবীপত্নী ছাড়া অন্যদের জন্যে অবতীর্ণ হয়েছিল সুরা নূরের এই আয়াত।

বিশ্বাসী নারীদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে ও তাদের যৌন অঙ্গকে হেফাজত করে। যা সাধারণত প্রকাশমান তা ছাড়া তারা যেন তাদের সৌন্দর্য (বা অলংকার) প্রদর্শন না করে। তাদের ঘাড় ও বুক যেন মাথার কাপড় দ্বারা ঢাকা থাকে। তারা যেন নিজের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, নিজেদের মেয়েছেলে, তাদের অধিকার ভুক্ত দাস-দাসী, যৌনকামনারিক্ত পুরুষ আর সেইসব ছেলে যাদের নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে জ্ঞান হয়নি তাদের ছাড়া কারও কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তারা যেন তাদের গোপন সৌন্দর্য (বা অলংকার) প্রকাশের জন্য সজোরে পা ফেলে না চলে। - সুরা নূর, ২৪/৩১
*************************
প্রাক-ইসলামী যুগে আরবে নারীরা সংগীত চর্চা করতেন। তাদের খ্যাতি ছিল। সে জন্যেই কী ইসলামে নারীদের কলা-সংস্কৃতি ও সঙ্গীত সাধনা একরকম নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল। 'অন্ধকার যুগে'র নারীদের সংগীত প্রতিভার কথা এখন ইসলামের ইতিহাসবিদরাও স্বীকার করেন।

অনেক নামী মহিলা কবি ছিল তখন আরবে। তাদেরও খ্যাতি ছিল। অস্বীকার করাও যেত না তাদের। নবীর বিরুদ্ধে ব্যঙ্গাত্মক কবিতা রচনা করার অপরাধে ইহুদী কবি, বনি গোত্রের আসমা বিনতে মারোয়ান নামে এক নারীকে হত্যা কেন জনৈক মুসলমান। এই হত্যাকাণ্ড রসুল অনুমোদন করেছিলেন এবং খুশী হয়েছিল। কবি আসমা বিনতে মারোয়ানের সামাজিক প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ না হলে তাঁকে হত্যা করা হত না।

ইসলাম কবির স্বাধীনতাকে স্বীকার করে না। কবি ও কবিতার সাথে যেন ইসলামের জন্মবিরোধ। এই সেই সাবধান বাণী,

এবং কবিদের অনুসরণ করে তারা যারা বিভ্রান্ত। - সুরা শোআরা, ২৬/২২৪

হাদীসে আছে -

কাহারও অভ্যন্তর কবিতায় পরিপূর্ণ হওয়া অপেক্ষা পুঁজে পরিপূর্ণ হওয়া উত্তম। - বোখারী শরীফ, ২৩৫০

*********************************************************

আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক, পরম করুণাময়, পরম দয়াময়। তিনি বিচারদিনের মালিক (সুরা ফাতিহা, ১/১ - ৩)। কিন্তু আল্লাহ পুরুষ। পিতৃতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা। উজ্জ্বল তাঁর প্রতিষ্ঠা। তিনি নারী পুরুষের যুগ্ম অস্তিত্ব নন। সেজন্যেই তাঁর পক্ষপাতিত্ব পুরুষতন্ত্রের প্রতি। আল্লাহ যে পুরুষ সে কথা তিনি ঘোষণা করেছেন কোরানে। কোনও দ্বিধা নেই তাতে। সুরা আনআমে বলা হয়েছে,

তিনি আকাশ পৃথিবীর স্রষ্টা, তাঁর সন্তান হবে কেমন করে? তাঁর তো কোনো স্ত্রী নেই, তিনিই তো সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন। - সুরা আনআম, ৬/১০১
*************************
আল্লাহ কোনো সন্তান গ্রহণ করেননি। - সুরা মুমিনুন, ২৩/৯১
*************************
আকাশ ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব তাঁরই। তিনি কোনো সন্তান গ্রহণ করেননি। - সুরা ফুরকান, ২৫/২
*************************
আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করতে চাইলে তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করতে পারতেন। - সুরা জুমার, ৩৯/৪
*************************
আর আমরা এ-ও বিশ্বাস করেছি যে, আমাদের প্রতিপালকের মর্যাদা অনেক ওপরে। তিনি কোনো স্ত্রী নেননি ও তাঁর কোনো সন্তানও নেই। - সুরা জিন, ৭২/৩
*************************
তিনি কাউকে জন্ম দেননি ও তাকেও কেউ জন্ম দেয়নি। - সুরা ইখলাস, ১১২/৩

*********************************************************

পুরুষের স্খলিত, বেগবান শুক্রকে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে কোরানে। কিন্তু নারীর নারীত্ব সেখানে উপেক্ষিত। কোনও স্বীকৃতি নেই, সব পুরুষকেই তার জন্মের জন্য ঋণী থাকতে হয় নারীর কাছে। সেই ঋণ শুধু নারী জঠরে সন্তান ধারণ করে বলেই নয়। উন্নত চিকিৎসাবিজ্ঞান নারীকে অন্যের সন্তান গর্ভে গ্রহণ করার ক্ষমতাও দিয়েছে, কিন্তু সেখানেও আরও একজন নারী তার ডিম্বানু দান করেছিল বলেই ভ্রুণ সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। শুধু পুরুষ দ্বারা সৃষ্টি প্রস্ফুটিত হয় না। কোনও কালেই হয়নি। আল্লাহর কোরানে তার বিন্দুমাত্র উল্লেখ নেই বলে আমাদের তা ব্যথিত করে। অথচ ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর একমাত্র ধর্ম -

নিশ্চয় ইসলাম আল্লাহর একমাত্র ধর্ম। - সূরা আল-ই-ইমরান, ৩/১৯
আর মুসলমান হচ্ছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবদল। তোমরাই শ্রেষ্ঠ দল। মানবজাতির জন্য তোমাদের অভ্যুত্থান হয়েছে। 
তোমরাই হবে শ্ৰেষ্ঠ, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও। - সুরা-আল-ই, ইমরান, ৩/১১০, ১৩৯

আল্লাহর এই ইসলামে নারীকে সৃষ্টিধাত্রী রূপে পূর্ণ স্বীকৃতি নেই। নারীকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন পুরুষের দেহ থেকে। তার নর্ম সংগিনীরূপে। নতুন সৃষ্টির জন্যে নয়, নারী তার জন্মের জন্যে পুরুষের কাছে ঋণী, পুরুষ তার জন্মের জন্যে ঋণী নয় নারীর কাছে।

*********************************************************

বিবি খদিজার নামে আমি এই পদ্যটি লিখি;
বিসমিল্লাহ কহিবনা, শুধু খদিজার নাম নেবো।
প্রভু, অনুমতি দাও। গোস্বা করিওনা, একবার
শুধু তাঁর নামে এই পদ্যখানি লিখিব মা'বুদ।

নবীজীর নাম? উঁহু, তাঁর নামও নেবোনা মালিক
শুধু খদিজার নাম - অপরূপ খদিজার নামে
একবার দুনিয়ায় আমি সব নাম ভুলে যাবো
তোমাকেও ভুলে যাবো ভুলে যাবো নবীকে আমার।

একমাত্র তিনি, প্রভু, একমাত্র তাঁর চাকুরিতে
উট ও ব্যবসা লয়ে ছিল মোর নবীজী বহাল।
তুমি ডাঁট মারিওনা - নবী ছিল তোমার হাবীব
কিন্তু খদিজার ছিল বেতনের বাঁধা কর্মচারী -

সব নারী জানে তুমি খাটো হয়ে আছো এইখানে
তোমার খাতিরে তবু তা প্রকাশ্যে জাহির করেনা।

(ফরহাদ মজহার, 'বিবি খদিজা', এবাদত নামা: ৩৬)
*************************
ইবনে হাজম আরো বলেছেন যতক্ষণ পর্যন্ত কন্যা অক্ষতা কুমারী থাকে ততক্ষণ সে পিতা বা অভিভাবকের সম্পত্তি। বিয়েতে তার মত গ্রহণের কোনও প্রয়োজন নেই। কন্যার একবার বিয়ে হয়ে গেলে তার কুমারীত্ব মুছে যায়। শুধু তখনি তার নিজের ওপর অধিকার জন্মে। স্বামী মারা গেলে বা তালাক দিলে পুনর্বিবাহেই শুধু সে মত দিতে পারে। কুমারী অবস্থায় একটি মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে এই হল ইসলামের অধিকার।
*************************
এক পর্যায়ে আল্লাহ মোহাম্মদকে বিয়ের ব্যাপারে ইতি টানতে বলেছিলেন (সুরা আজহাব, ৩২/৫২)। তবে তিনি মোহাম্মদের জন্যে পত্নীদের তালাক দেওয়া নিষিদ্ধ করেছিলেন তা বোধ হয় ঠিক নয় (সুরা তাহরিম, ৬৬/৫)।
*************************
এই যে প্রিয়তমা পত্নী কিশোরী আয়েশা তাঁকেও ভুল বুঝেছিলেন রসুল। সাফওয়ান-ইবনে মোয়াত্তাল নামে একজন সাহাবাকে জড়িয়ে আয়েশাকে নিয়ে একটি অপবাদ রটেছিল। রসুল সেই অপবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এক পর্যায়ে আয়েশাকে তালাক পর্যন্ত দিতে চেয়েছিলেন তিনি। হজরত আলীর বক্তব্য থেকে এর ইঙ্গিত পাওয়া যায় হাদীসে (বোখারী শরীফ, ১৮৫৯-৬১)। কোরানেও এর ইঙ্গিত রয়েছে।

যারা মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে তারা তো আমাদেরই একটি দল। এই অপবাদকে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্ঠকর মনে কোরো না, বরং এ তো তোমাদের জন্য কল্যাণকর। ওদের প্রত্যেকের জন্য আছে ওদের কৃত পাপকর্মের ফল আর ওদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে তার জন্য আছে কঠিন শাস্তি।

যারা সাধ্বী, নিরীহ ও বিশ্বাসী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে তারা ইহলোকে ও পরলোকে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। - সুরা নূর, ২৪/১১, ২৩
*************************
হজরত মোহাম্মদের জীবনে সবচেয়ে বিতর্কিত বিয়ে ছিল জয়নবের সাথে বিয়ে। জয়নব ছিলেন হজরতের ফুফাতো (পিসতুতো) বোন। জায়েদ বিন হারিস ছিলেন দক্ষিণ সিরিয়ার বনি কাম নামে এক খ্রিস্টান গোত্রের ছেলে। শৈশবে তাঁকে দস্যুরা হরণ করে মক্কায় বিক্রি করে দেয়। বিবি খাদিজা তাঁকে ক্রয় করে মোহাম্মদকে উপহার দেন। মোহাম্মদ জায়েদকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। জায়েদকে মুক্ত করে দেন তিনি। খবর পেয়ে জায়েদের পিতা ও ভ্রাতা তাঁকে ফিরিয়ে নিতে আসলে তিনি যেতে অস্বীকৃত হন। প্রথম যে কজন পুরুষ ইসলাম গ্রহণ করেন জায়েদ তাঁদের একজন। মোহাম্মদ জায়েদকে পালিতপুত্র রূপে গ্রহণ করেন এবং নিজের নাম জায়েদের সাথে যুক্ত করে দেন। সেই থেকে জায়েদ পরিচিত হন জায়েদ বিন মোহাম্মদ বলে। মোহাম্মদ ঘোষণা করেন জায়েদ তাঁর পুত্র। তিনি জায়েদের উত্তরাধিকার গ্রহণ করবেন এবং জায়েদ করবেন তাঁর (W. Muir - 'The life of Mohammad', p-35)। জয়নাবকে মোহাম্মদ পছন্দ করেন জায়েদের বধূরূপে। উচ্চ হাশেমী বংশের কন্যা জয়নাবের এই বিয়েতে প্রথমে আপত্তি থাকলেও মেনে নেন রসুলের নির্দেশে। আল্লাহ এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন।

আল্লাহ ও রসুল কোনো বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোনো বিশ্বাসী পুরুষ বা নারীর সে-বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না। - সুরা আহজাব, ৩৩/৩৬

বিয়ের পর জায়েদকে মেনে নিতে পারছিলেন না জয়নব। তিনি মোহম্মদের অন্যতমা পত্নী হতে চাইলেন। শেষ পর্যন্ত জায়েদ জয়নবকে তালাক দেন। এই ব্যাপারেও রসুলের নির্দেশ ছিল বলে ইতিহাসবিদরা মনে করেন। পরে জয়নবকে মোহাম্মদ তাঁর অন্যতম পত্নী রূপে গ্রহণ করেন। পালিত পুত্রের বধূকে বিয়ে করা যায় কিনা তা নিয়ে মোহাম্মদ বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাঁকে উদ্ধার করেন, অবতীর্ণ হয় ওহী।

তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন করেছিলে আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেন। তুমি লোক ভয় করেছিলে, অথচ আল্লাহকে ভয় করা তোমার পক্ষে অধিকতর সংগত ছিল। তারপর জায়েদ যখন (জয়নবের সাথে) বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করল তখন আমি তাকে তোমার সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করলাম যাতে বিশ্বাসীদের পোষ্যপুত্ররা নিজ স্ত্রীর সাথে বিবাহ সূত্র ছিন্ন করলে সেসব রমনীকে বিয়ে করতে বিশ্বাসীদের কোনো বাধা না হয়।
আল্লাহ নবির জন্য যা বিধিসম্মত করেছেন তা করতে তার জন্য কোনো বাধা নেই। - সুরা আজহাব, ৩৮/৩৭ - ৩৮

জয়নবের সাথে মোহাম্মদের বিয়ের খবর শুনে বিবি আয়েশা মন্তব্য করেছিলেন, "রসুল যা কামনা করেন আল্লাহ সাথে সাথে তা অনুমোদন করেন"। এই উক্তি অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। ইসলামের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে আয়েশার এই মন্তব্য।

সেই থেকে ইসলামে দত্তক বা পালিত সন্তান গ্রহণ নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

আর পোষ্যপুত্র যাদেরকে তোমরা পুত্র বল, আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের পুত্র করেননি। তোমরা ওদেরকে ডাকো ওদের পিতৃপরিচয়ে। - সুরা আজহাব, ৩৩/৪ - ৫
*************************
রসুল বলেছেন আল্লাহ সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করেন তালাককে। কিন্তু দেখা যায় তিনিও বারবার তালাক নামে অস্ত্র ব্যবহার করতে চেয়েছেন পত্নীদের ওপর। আল্লাহর রসুলের পত্নীদের প্রতি যদি সহনশীলতা এই পর্যায়ে থাকে তাহলে সাধারণ মুসলমানদের অবস্থা সেই যুগেও কী ছিল আমরা তা ভেবে নিতে পারি।

তবে রসুল কোনও স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেনি শেষ পর্যন্ত সেকথাও সত্যি নয়। রসুলের এক বিবাহিতা পত্নী ছিলেন আসমা (নোমান কিন্দির কন্যা)। তিনি নিজেই নাকি মুক্তি চেয়েছিলেন। তাই রসুল তাঁকে তালাক দিয়েছিলেন। রসুলের কোনও কোনও জীবনীকার উল্লেখ করেছেন যে, মোহাম্মদের সাথে আসমার কোনরকম যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি অর্থাৎ বিয়ে কনজুমেট করেনি (সা'দ উল্লাহ - 'ইসলাম ও নারী', দৈনিক জনকণ্ঠ, ঢাকা, ২২ আগস্ট, ১৯৯৭)। আমরা ধরে নিতে পারি এই বিয়ে ধরে রাখতে চাননি আসমা।
*************************
রসুল অনেক বিধবা নারীকে বিয়ে করে তাঁদের উদ্ধার করেছিলেন বলে দাবি করা হয়। কিন্তু রসুলের মৃত্যুর পর তাঁর বিধবাদের পুনর্বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়। তাদের বলা হয় উম্মুল মুমেনীন, মুসলমানদের জননীস্বরূপা। কোরানে আল্লাহ নির্দেশ পাঠান রসুলের উম্মতদের প্রতি।

নবি বিশ্বাসীদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়েও কাছের, আর তার স্ত্রীরা তাদের মায়ের মতো। তোমাদের কারও পক্ষে আল্লাহর রসুলকে কষ্ট দেওয়া বা তার মৃত্যুর পর তাদের স্ত্রীদেরকে বিবাহ করা সংগত হবে না। - সুরা আহজাব, ৩৩/৬, ৫৩

মোহাম্মদ যখন মারা যান তখন আয়েশার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। দীর্ঘজীবন লাভ করেছিলেন তিনি। ভোগ করেছিলেন দীর্ঘ বৈধব্য-যন্ত্রণা। তাঁর কোনও সন্তান ছিল না। 
*************************
মোহাম্মদ মুসলমান ছাড়াও ইহুদী ও খ্রিস্টান রমণীকে বিয়ে করেছিলেন। এই দুই ধর্মানুসারীদের ইসলাম কিতাবের অধিকারী বলে মনে করে। ইহুদীদের তৌরাত ও খ্রিস্টানদের ইঞ্জিল কোরানেও মান্যতা পায়। তাই পূর্বে ধর্মান্তরিত না করেও এই দুই ধর্মের নারীকে বিয়ে করতে ইসলাম কোনও বাধা নিষেধ আরোপ করে না। পরে ধর্মান্তরিত হলেও চলে। কিন্তু পৌত্তলিকদের বেলায় ইসলামে ধর্মান্তরিত এ হলে কোন ভাবেই নয়। ইসলামে ধর্মান্তরিত হলে অবশ্য ভিন্ন কথা। কিন্তু যেখানে সুযোগ নেই সেখানেও ইসলাম কোনও ছাড় দেয় না।

নারী তো শুধু পত্নী নয়, জননীও। হাদীসে বলা হয়েছে, "জননীর পায়ের নীচে বেহেশত।" এখানে যোগ করা উচিত ছিল সেই জননীকে হতে হবে বিশ্বাসী নারী। না হলে তো আর বেহেশত থাকবে না। মোহাম্মদের মা আমিনা তাঁর শৈশবেই মারা যান। তখনো ধর্ম হিসাবে ইসলামের উন্মেষ হয়নি। আমিনানন্দন মোহাম্মদের নবুয়ত লাভ তো অনেক অনেক পরের ঘটনা। স্বাভাবিক কারণেই মোহাম্মদজননী আমিনা ইসলাম-বিশ্বাসী নারী ছিলেন না। সেই জন্যে মোহাম্মদ গর্ভধারিনীকেও মর্যাদা দিতে পারেননি। জননীর কবর তিনি কোনওদিন জিয়ারত (ইসলামী অনুযায়ী পরলোকগত আত্মার শান্তি কামনা করে প্রার্থনা) করতে চাননি, তিনি পৌত্তলিক ছিলেন বলে। জননীর প্রতি শ্রদ্ধাকে এখানে ছাড়িয়ে গেছে ধর্মবিশ্বাস। ইসলামে সব কিছুই যেন খণ্ডিত। মহত্তর মানবিক চেতনায় উদ্ভাসিত নয়। মোহাম্মদ জননীর বেলায়ও সেই গণ্ডী অতিক্রম করতে পারেননি।

*********************************************************

রসুল হজরত মোহাম্মদের শাসনকালে নারীরা মসজিদে যেতেন। মৃত্যুর পর মৃতের জানাজায়ও অংশ নিতেন। রসুলের একটি হাদীস রয়েছে, যাতে বলা হয়েছে "আল্লাহর বান্দীগণকে আল্লাহর মসজিদে যাইতে নিষেধ করিও না।" (বোখারী শরীফ - ৪১২)। রসুলের জানাজায়ও নারীরা অংশ নিয়েছিলেন। হজরত ওমর এসব পছন্দ করতেন না। তিনি অসিয়ত করে যান যে তাঁর জানাজায় যেন কোনও নারী অংশগ্রহণ না করে। হজরত ওমরের খেলাফত থেকেই নারীদের মসজিদে যাওয়া এবং জানাজায় অংশগ্রহণ করা নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

তালাক আইনও সংশোধন করে যান খলিফা ওমর। আগে তিন তালাক একসাথে দেওয়া যেত না। ওমরের সময় একসাথে তিন তালাক দেওয়ার নিয়ম চালু হয়ে যায়।
*************************
একেবারে হাল আমলের ঘটনা, বিংশ শতাব্দীর। ইসলামের দুই পবিত্র ও পূণ্য নগরী মক্কা মোয়াজ্জেমা ও মদীনা মনোয়ারা। তার হেফাজতকারী এখন সৌদি আরবের রাজকীয় সরকার। যে রাজকীয় শাসনব্যবস্থা ইসলাম অনুমোদন করে না বলেই দাবি করা হয়। সৌদি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা আমীর মোহম্মদ ইবনে সউদের বংশধর বাদশাহ (Absolute King) আবদুল আজিজ ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন সউদি আরব নামে রাষ্ট্রটি। বাদশাহ আবদুল আজিজ বিয়ে করেছিলেন ৩০০-র বেশি নারীকে। তাঁর একসময়ের বিবাহিত পত্নীরা তালাকপ্রাপ্ত হয়ে উপপত্নীরূপে ঢুকে যেত বাদশাহের হারেমে। বাদশাহ আবদুল আজিজের ছিল ৪৪টি পুত্র এবং অসংখ্য কন্যা সন্তান। অন্তত দুই হাজার রাজকুমার এখন বাদশাহ আজিজ ইবনে সউদের বংশধর।

ইসলামের খলিফা, শাহেনশা, বাদশাহ, নবাবরা নাকি কোরানকে অতিক্রম করেননি।

আর যদি তোমরা এক স্ত্রীর জায়গায় অন্য স্ত্রী নেওয়া ঠিক কর আর তাদের একজনকে প্রচুর অর্থ দিয়ে থাক তবুও তার থেকে কিছুই নেবে না। - সুরা নিসা, ৪/২০

ইসলামে পুরুষদের বহু বিবাহের এই উত্তরাধিকার তাদের ধর্মীয় অধিকার।

*********************************************************

আরবভূমির ঊষর মরু অঞ্চলে মোহাম্মদের জন্ম ও জীবনকাল। তাঁর কর্মভূমি। যে দুটি নগরী মক্কা ও মদীনাকে কেন্দ্র করে তিনি আবর্তিত হয়েছেন সেখানে জলের বড় অভাব। বেগবতী কোনও স্রোতস্বিনী নেই। ছোট নদীও নয়। আছে শুধু কিছু মরুদ্যান নগর থেকে বাইরে গেলে ধূ ধূ প্রান্তরের মধ্যে। কিন্তু নদীর কথা আরববাসীরা শুনেছেন। যদি যেন তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। তাই এই জীবনে যা দেখা হল না পরলোকে গিয়ে যদি তার দেখা মেলে। আল্লাহ মুসলমানদের সেই নদীর দেশ জান্নাতে নিয়ে যেতে চান। নদী আছে আরব মরুবাসীর স্বপ্নে। সেই নদীর দেশে যাওয়ার জন্যে আল্লাহ তাদের প্রলুব্ধ করেন। আল্লাহ তাই কোরানের অনেক সুরায় বারংবার বলেছেন সেই কথা, "জান্নাতের নিচে নদী বইবে।" কোরানের দ্বিতীয় সুরা, সুরা বাকারায় আমরা প্রথম জন্নত ও নদীকে একসাথে খুঁজে পাই।

যারা বিশ্বাস করে তাদেরকে সুখবর দাও যে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত যার নিচে নদী বইবে। - সুরা বাকারা, ২/২৫

কোরানের একেবারে শুরুতেই আমরা জান্নাতের দর্শন পেলাম। পেয়ে গেলাম নদীকেও। যে নদী জান্নাতের নিচে বহমান। এরপর এই নদীকে আমরা বহমান দেখেছি সুরা থেকে সুরায়। আয়াত থেকে আয়াতে। কোরানে অন্তত ২৩টি আয়াতে বলা হয়েছে জান্নাতের নিচে নদী বইবে।
*************************
জান্নাতের প্রতিশ্রুতি ও বর্ণনা কোরানের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে। কোরানের মোট আয়াতের সংখ্যা ৬৬৬৬ এবং সুরার সংখ্যা ১১৪। বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রাক্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান মুহম্মদ হাবিবুর রহমান বিশিষ্ট কোরান বিশেষজ্ঞ। তাঁর 'কোরান সূত্র' কোরানের বিষয়ভিত্তিক বিন্যাস, অসামান্য একটি গ্রন্থ। ... তিনি দেখিয়েছেন কোরানের ১১৪টি সুরার মধ্যে ৫২টিতে জান্নাতের কথা রয়েছে। আর জান্নাত সংক্রান্ত আয়াতের সংখ্যা ২৮৯।
*************************
জান্নাত হল মুসলমান পুরুষদের জন্যে প্রলোভন। জান্নাত অর্থ অনন্ত কামনা। জান্নাত অর্থ চূড়ান্ত ভোগ। যা মর্ত্যবাসীর কল্পনাতে আসবে না। জান্নাতে মিলবে সুস্বাদু ফল-মূল-দ্রাক্ষা, খেজুর, ডালিম, কলা ও কণ্টকবিহীন বদরি (যা আরববাসীর প্রিয়), ছায়া (আরবে কোথায় আর সেই ছায়া) দুধের আর মধুর নহর। যা চাওয়া হবে তাই পাওয়া যাবে কামনার সব কিছু। মদিরা আর শরাব। পবিত্র সুরা (জান্নাতের সুরাও পবিত্র)। কনক থালায় পরিবেশিত হবে খাদ্য। উজ্জ্বল একখানি পাত্রে শরাব। যত খুশি খাওয়া যাবে। জান্নাতে মাতাল হবে না কেউ। সেখানে তাদের স্বর্ণনির্মিত ও মুক্তাখচিত কঙ্কন দিয়ে অলংকৃত করা হবে, সেখানে তাদের পোশাক পরিচ্ছদ হবে রেশমের। এই দুনিয়াতে এইসব তাদের পরতে দেওয়া হয়নি। তাই আখেরেতে সেই সুযোগ করে দেওয়া। চাওয়ার আগেই তারা পেয়ে যাবে সবুজ মিহি মখমল ও রেশমের সব আবরণ। সবুজ রং আল্লাহর বড় প্রিয়। তাই জান্নাতের পোশাকের রংয়ের এই নির্বাচন। জান্নাতে মিলবে নারী আর নারী। এক-দুই-তিন-চার নয়, প্রতিটি পুরুষের জন্যে ৭২টি হুর (সংখ্যাটা কোরানে নেই। রয়েছে রসুলের হাদীস তিরমিজি শরীফে)। জান্নাতে যে আসন মিলবে তার যে কত বর্ণনা। সেখানে মুখোমুখি হেলান দিয়ে বসা যাবে। হুররা সব চিরকুমারী, আয়তনয়না, সমবয়স্কা। প্রেমময়ী সুরক্ষিত ডিমের মত উজ্জ্বল। তারা সব পবিত্র সঙ্গিনী। যাদের এর আগে কোনও মানুষ বা জিন স্পর্শ করেনি, অক্ষত যোনী সব তারা, মুক্তা, প্রবাল ও পদ্মরাগমণির মত। আয়তলোচনা হুরের সাথে শুধু মিলন আর মিলন। এই সব বর্ণনা কোরানের বিভিন্ন আয়াতের। সব কিছু ছাড়িয়ে কোরানের জান্নাত হল শরাব আর হুর। যৌনতার মানসভূমি। বাধাবন্ধনহীন উদ্দাম সেই যৌনতা, তাই পারস্যের কবি হাফিজ এই দুনিয়াতেই তা পেতে চাইলেন। বেহেশতে যা পাওয়া যায় এই দুনিয়াতে তা চাওয়ার মধ্যে কোনও অপরাধ দেখেননি তিনি।

কোরান হাদীস সবাই বলে 
পবিত্র সেই বেহেশত নাকি 
সেথায় গেলে মিলবে শরাব     
তন্বী হুরী ডাগর আঁখি।
শরাব এবং প্রিয়ায় মিলে 
দিন কাটে মোর দোষ কী তাতে?
বেহেশত যা হারাম নহে 
মর্ত্যে হবে হারাম তা কি!

ইরানের কবি এখানে যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন তার উত্তর আমরা দিতে পারব না।
*************************
জান্নাতের কত বর্ণনা যে হাদীসে রয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। রসুল মোহাম্মদ বলেছেন 'জান্নাতের মাটি হবে মেশাক জাফরানের। আল্লাহ কনক ও রজতের ইঁট দিয়ে তা নির্মাণ করেছেন। জান্নাতের সুখ ও সৌন্দর্য বর্ণনা করা কোনও মানবসন্তানের পক্ষে সম্ভব নয়, মর্তের মুসলমানরা সেখানে ৩০ বছরের যুবক হয়ে প্রবেশ করবে আর মুসলমান নারীরা রূপান্তরিত হবে ১৬ বছরের পূর্ণ যুবতীতে। হুররাও সকলেই ১৬ বছরের পূর্ণ যুবতী সমতুল হবে। জান্নাতে হুর, নারী, পুরুষ কারো বয়স বৃদ্ধি পাবে না। তারা চিরযৌবন লাভ করবে সেখানে।'
*************************
হাদীসে আরো বলা হয়েছে - 'আল্লাহ হুরদের এত সৌন্দর্য দান করেছেন যে তা কোনও মানুষ বর্ণনা করতে পারবে না। তাদের মুখের থুথু এত সুগন্ধপূর্ণ হবে যে তার এক ফোঁটা জলে পড়লে সমস্ত জল দুধের মত শুভ্র ও আতরের মত সুগন্ধময় হয়ে যাবে। যদি কোনও হুর রজনীর দিকে তাকান তবে সেই রজনী দিবসে রূপান্তরিত হয়। জান্নাতের এই হুররা হবে জান্নাতবাসী মুসলমানদের দাসী।'
*************************
জান্নাতের পরিকল্পনা এবং মানসসৃষ্টি সম্পূর্ণরূপে মর্ত্যের মুসলমান পুরুষদের জন্যে। এখানে যে প্রলোভন দেওয়া হয়েছে তা কাম উত্তেজনার, যৌনতার, প্রমোদের। এই জান্নাত মুসলমান রমনীদের জন্যে নয়। সতী-সাধ্বী মুসলমান স্ত্রীর জন্যেও নয়। আল্লাহর দুনিয়ায় তাদের অবস্থান অবরোধে, পুরুষের মনোরঞ্জনে আর সন্তান উৎপাদন। কল্পিত জান্নাতে তাদের জায়গা দেওয়া হয়নি। তারা সেখানে উপেক্ষিতা। অত হুরের মধ্যে সেখানে তারা কাকে খুঁজবে, করবেই বা কী? কোরানে পুরুষদের জান্নাতে প্রবেশের কথা কতবার কতভাবে বলা হয়েছে। নারীদের ক্ষেত্রে তার কিছুই বলা হয়নি। জান্নাতের ওপর কোরানে ২৮৯টি আয়াত আছে। তার মধ্যে মাত্র ৫টি আয়াতে নারীকে খুঁজে পাওয়া যায়।

আল্লাহ বিশ্বাসী নর ও নারীকে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যার নিচে নদী বইবে - সেখানে তারা থাকবে চিরকাল - প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্থায়ী জান্নাতে উত্তম বাসস্থানের। - সুরা তওবা, ৯/৭২

তোমরা ও তোমাদের স্ত্রীরা সানন্দে জান্নাতে প্রবেশ করো। - সুরা জুখরফ, ৪৩/৭০

(তিনি জিহাদের নির্দেশ দিয়েছেন) এজন্য যে তিনি বিশ্বাসী পুরুষ ও বিশ্বাসী নারীদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার নিচে নদী বইবে - যেখানে তারা স্থায়ী হবে। - সুরা ফাতাহ, ৪৮/৫

সেদিন তুমি দেখবে বিশ্বাসী পুরুষ  বিশ্বাসী নারীদেরকে। তাদের সামনে ও ডানপাশে তাদের জ্যোতি বিচ্ছুরিত হবে। বলা হবে, আজ তোমাদের জন্য সুখবর জান্নাতের, যার নিচে নদী বইবে।

স্থায়ী জান্নাত। সেখানে তারা প্রবেশ করবে আর তাদের পিতামাতা, পতিপত্নী ও সন্তান সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে তারাও। - সুরা রা'দ, ১৩/২৩

জান্নাত নিয়ে এত আয়াতের মধ্যে মাত্র ৫টি আয়াতে আমরা নারীকে দেখতে পাই। জান্নাতে নারীরা তাদের মর্তের স্বামীকে খুঁজে পাবে কিনা সে কথা কোথাও বলা নেই। যদি দেখাও মেলে স্বামী নামে সেই পুরুষটি মর্তের পুণ্যের ফলে ৭২ জন আয়তলোচনা চিরযৌবনময়ী হুর নিয়ে 'নয় জীবন' যাপন করবে। মর্তের স্ত্রীদের জান্নাতে তো তার প্রয়োজন নেই। জান্নাতে সেইসব স্ত্রীদের চিনে নিয়েই বা কী হবে। এই হল ইহলোকে পতিব্রতা নারীদের জান্নাতের পুরস্কার। অবশ্য নারীরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারলে 'উত্তম বাসস্থান' পাবেন। সেই প্রতিশ্রুতি তাদের দেওয়া হয়েছে। তবে উত্তম বাসস্থানে কীভাবে তারা দিন কাটাবেন তা কোথাও বলা নেই। মনে হয় সেখানেও তাদের অবরোধে থাকতে হবে। আল্লার তাই ইচ্ছা। তাদের দেহ তো আলো থেকে সৃষ্ট নয়। তারা তো জান্নাতের হুর নয়, তাদের জান্নাতের জীবন যেন আরও কষ্টের। ইহলোকে চতুর্থাংশ স্বামী হলেও বরাদ্দ ছিল তাদের জন্যে। জান্নাতে তেমন প্রতিশ্রতি নেই।

যে ৫টি আয়াতে জান্নাতে নারীর প্রবেশের কথা বলা আছে তার মধ্যে একটি হল জেহাদ-সংক্রান্ত (৪৮/৫)। জেহাদ অর্থ ধর্মযুদ্ধ। ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে যুদ্ধ। রসুলের আমলে একটাই অর্থ ছিল জেহাদের। ইসলাম মুসলমান পুরুষের জন্যে জেহাদকে বাধ্যতামূলক করেছে। নারীর জন্যে নয়। কোরানের পরের যুগের ভাষ্যকাররা (তফসিরকার) জেহাদকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁরা জেহাদকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। একটি হল আল-জেহাদ আল আকবর। অন্যটি আল-জেহাদ আল-আসগর। এদের মধ্যে প্রথমটিকে বলা যেতে পারে অন্তৰ্জেহাদ। রসুলের যুগে অন্তৰ্জেহাদের সুযোগ ছিল না। যারা জেহাদী তারাই শুধু জান্নাতের অধিকার পাবে। সুরা ফাতাহতে তাই বুঝি বলা হয়েসে। কিন্তু নারী তো এই আয়াতের অধিকার নিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না? এই প্রশ্নের সরল উত্তর কোরানে নেই। কিন্তু হাদীসে আছে। "নারীর জন্য জেহাদ হল হজ", একটি হাদীসে বলা হয়েছে। অন্য একটি হাদীসে এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে পতি সেবাকে। ইহলোকে পতিব্রতা নারীর আখেরেতে জান্নাত লাভ। পতির সেবা এমন-ই মহৎ কর্ম। এর পর আর বিতর্ক চলে না। সুরা রা'দের ১৩/২৩ আয়াতে নারীর কথা আলাদা করে বলা হয়নি। মাতা-পিতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে নারী আছে। যার যার পুণ্যে সে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কিন্তু জান্নাতে প্রবেশ করে পিতামহ-পিতা-পুত্র-পৌত্র সকলেই তো নতুন জীবন লাভ করে যৌবন ফিরে পাবে। তাদের একই বয়স হবে। নতুন ভুবনে তারা ব্যস্ত থাকবেন হরিণনয়না হুরদের সেবা নিয়ে, ইহলোকের পরমাত্মীয়দের জান্নাতে খুঁজে তো লাভ নেই কোনও। প্রমোদে টান পড়া শুধু। মাতা-জায়া-কন্যারা জান্নাতে গেলে তাদের চলে যেতে হবে সুন্দর বাসস্থানে, যার নিচে নদী বইবে। তাদের আর যেন কোনও চাওয়া থাকতে নেই। জান্নাতে নারীর জন্যে কোনও প্রলোভন নেই। সেখানে শুধু পুরুষের সহস্র পাওয়া। জান্নাতে নারীরা অবশ্য যৌবনবতী হয়েই প্রবেশ করবেন। কারণ সেখানে শুধু জয়গান যৌবনের। যুবতী হয়েই সেখানে প্রবেশ করতে হবে - এটাই জান্নাতের শর্ত। সে কথা রসুল বলে গেছেন তাঁর হাদীসে। কিন্তু তিনি আবার এও বলে গেছেন জান্নাতে নারীরা কম সংখ্যায় প্রবেশ করবে, দোজখীদের মধ্যে নারীরা হবে সখ্যাগরিষ্ঠ। ...

... দুনিয়ার সতী-সাধ্বী এরই বেহেশতে গিয়ে অনন্ত-যৌবনা হবে সে কথা স্পষ্ট করে বলা নেই। পুরুষের বেলায় আছে। এই নারী বেহেশতে গিয়ে আদৌ তার স্বামীর সাথে অত হুরদের ডিঙিয়ে মিলতে পারবে কিনা তাও বলা নেই। জান্নাতে মর্ত্যের পতিকে না হয় নাই পেল সাধ্বী পত্নীরা। কিন্তু তাদের জন্যে অন্য ব্যবস্থা কোথায়? কোরানে কোনও ইঙ্গিত পর্যন্ত নেই। তাহলে বেহেশতে অনন্তযৌবন নিয়ে তারা কী করবে। পুরুষের বাহাত্তর হুর আর সহস্র দাসের বিপরীতে নারীর প্রাপ্তি শুধু উত্তম বাসস্থান। যার যোগফল শূন্য। নারীর জন্যে এই কোরানের জান্নাত। বেহেশতের মেওয়া।

শুধু হুর নয়। আল্লাহ পুরুষের জন্যে অন্য ব্যবস্থাও করে রেখেছেন জান্নাতে। পুরুষদের যে সমকামিতা এই দুনিয়ায় নিন্দনীয় জান্নাতে যেন তা বৈধ করে দিয়েছেন আল্লাহ। কোরানে নিষিদ্ধ সমকামিতার কথা বলা হয়েছে মাত্র দুটি আয়াতে -

আর তোমাদের পুরুষদের মধ্যে যে-দুজন এ (ব্যাভিচার) করবে তাদেরকে শাস্তি দেবে। তবে তারা যদি তওবা করে ও শুদ্ধ হয় তবে তাদের রেহাই দেবে। - সুরা নিসা, ৪/১৬

তোমরা কি যৌন তৃপ্তির জন্য নারীকে ছেড়ে পুরুষের কাছে যাবে? - সুরা নামল, ২৭/৫৫

দুটি আয়াতেই পুরুষের সমকামিতাকে খুব জোরের সাথে নিন্দা করা হয়নি। তওবা করে শুদ্ধ সমকামী দুই পুরুষকে ক্ষমা করে দিতে বলা হয়েছে। সুরা নিসার সংলগ্ন আয়াতেই (৪/১৫) অবৈধ যৌনাচারের জন্যে নারীকে যেখানে মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেওয়া হয়েছে, সেখানে এই শাস্তি তুচ্ছ মনে হয়। এর কারণ হয়তো তৎকালীন আরব সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষিত। ইসলাম পূর্ব আমলে আরব দেশে পুরুষদের মধ্যে সমকামিতার প্রচলন ছিল। মোহাম্মদ তাকে নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই ব্যাপারে তাঁর মন এক জায়গায় আবদ্ধ ছিল না। তিনি মনে করেছিলেন দুনিয়ায় এই যৌনসংগম নিষিদ্ধ করলে জান্নাতে তার সুযোগ এবং প্রলোভন থাকা উচিত। আরববাসীর মনের খবর তিনি রাখতেন। প্রাক ইসলামী যুগে আরবের এক বিখ্যাত কবি ছিলেন আবু-নুয়াস। সমকামি প্রেমকে উৎসাহিত করে তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতার কটি লাইন :

A lad whom all can see girt with sword and belt 
not like your whore who has to go veiled
Make for smooth-faced boys and do your very best
to mount them, for women are the mounts of the devils. (Perfumed devils)

জান্নাতে পাওয়া যাবে গিলমানদের। তাদের বাংলা অনুবাদে বলা হয়েছে 'চির কিশোর', তারা জান্নাতী পুরুষদের সেবা করবে। সেটা কোন সেবা? এত হুর থাকতে আবার গিলমানদের প্রয়োজন হল কেন? ভিন্ন রুচির পুরুষদের জন্যে? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা পাইনি কোরানে-হাদীসে। জান্নাতের পুরুষরা যা কামনা করবে তাই তো পাবে। আল্লাহ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি তো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। জান্নাতে গিলমানরা রয়েছে ৪টি আয়াতে -

তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকবে গিলমান (কিশোরেরা), যারা সংরক্ষিত মুক্তোর মতো। - সুরা তুর, ৫২/২৪

তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকবে চিরকিশোরেরা।
পানপাত্র, কুঁজো ও ঝরনাঝরা সুরায় ভরা পেয়ালা নিয়ে। - সুরা ওয়াকিয়া, ৫৬/১৭-১৮

তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকবে চিরকিশোরেরা, যাদের দেখে মনে হবে ওরা যেন বিক্ষিপ্ত মুক্তো। - সুরা দাহর, ৭৬/১৯

সংরক্ষিত মুক্তো বা বিক্ষিপ্ত মুক্তোর মত এই গিলমান বা চিরকিশোরেরা শুধু কী জান্নাতী পুরুষদের হাতে তুলে দেবে সোনার পানপাত্র? তার জন্যে চিরকিশোরদের কী প্রয়োজন ছিল? সেই কাজ তো আলোর হুর-রাই করছিল। এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই।
*************************
সৈয়দ আমীর আলী আরো বলেছেন কোরানের জান্নাতে হুরদের ধারণা জরথুস্ট্রদের কাছ থেকে প্রাপ্ত। জান্নাতের ধারণাও।  

*********************************************************

কোরান ইসলামের একমাত্র ধর্মগ্রন্থ, পবিত্রতম। ইসলাম ধর্ম অনুসারী মুসলমানদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হয় কোরান দ্বারা। ইসলামের সব আইনের ভিত্তি হল কোরান।

এরপরেই হাদীসের স্থান। হাদীসকে বলা হয় কোরানের ব্যাখ্যা (Interpretation)। কোরান ইসলামের মূল সংবিধান, হাদীস শব্দের শাব্দিক অর্থ কথাবার্তা। নতুন কিছু যা পূর্বে ছিল না। আর শব্দের পরিভাষা হল নবী মোহাম্মদের কথাবার্তা, ক্রিয়াকলাপ এবং প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মৌল সম্মতি। মোহাম্মদ যা বলেছেন, যা করেছেন এবং যে বিষয়ের প্রতি তাঁর সমর্থন পাওয়া গেছে তাই হল হাদীস। কোরান প্রকাশ্য আর হাদীস গোপনীয় ওহী। এর অর্থ নবী মোহাম্মদ নিজে থেকে কখনও কিছু বলেননি। যা বলেছেন আল্লাহর কাছ থেকে প্রত্যাদেশ পেয়েই বলেছেন, সেই অর্থে কোরান ও হাদীসের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। পার্থক্য যে-টুকু তা হল কোরানের অর্থ ও ভাষা (text) উভয়ই অক্ষরে অক্ষরে আল্লাহর ওহী দ্বারা অবতীর্ণ। কোরান হল 'ওহী মতলু' বা আল্লাহর কালাম। কিন্তু হাদীসের অর্থ ও বিষয়বস্তু আল্লাহর ওহী দ্বারা প্রাপ্ত বটে। কিন্তু ইহার শব্দ ও বাক্য রসুলের রচিত। কোরান  হাদীসের আসল উৎস একই। তাই মুসলমানদের কাছে হাদীসের মর্যাদা কোরানের পরেই।
*************************
প্রথমে আমরা হাদীস-সম্রাট ইমাম বোখারীর সহীহ হাদীস থেকে কয়েকটি নির্বাচিত হাদীস তুলে ধরব। ...

পুরুষের পরে নারী অপেক্ষা ক্ষতিকর বিপদের জিনিস আমি আমার পরে আর কিছু রেখে যাচ্ছি না।
যদি বিবি হাওয়া না হতেন তবে কখনো কোনও নারী স্বামীর ক্ষতি করত না।    
তোমরা দুনিয়া সম্পর্কে সতর্ক হও। সতর্ক হও নারী জাতি সম্পর্কে। কেননা বনি ইস্রাইলের প্রতি প্রথম যে বিপদ এসেছিল তা নারী জাতির ভিতর দিয়েই।
পুরুষ নারীর বাধ্য হলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

নারীকে বিশ্বাস না করার জন্য কত সতর্কবাণী। নারী এখানে আর মানবীসত্ত্বায় নেই। হয়ে উঠেছে দানবী। তাকে বিশ্বাস করলে তার ওপর নির্ভর করলে অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। নারীকে বিশ্বাস করে আদিপিতা আদম বিপথে চালিত হয়ে আল্লার রোষানলে পড়ে জান্নাতভ্রষ্ট হন। বাইবেলে (কোরান-হাদীসেও এই কাহিনী রয়েছে) বর্ণিত স্বর্গ হতে পতনের সে কাহিনী নারীকে করে তুলেছে চির-অপরাধী। তাকে তুলে ধরেছে পুরুষের কীর্তি-সুখ-শান্তি ধ্বংসকারী রূপে। অথচ নারী না হলেতো সৃষ্টির রহস্যই উন্মোচিত হত না। নারী তো সৃষ্টির ধাত্রী।

বোখারী শরীফ থেকে আরো কিছু হাদীস -

হযরত নবী (দঃ) বলিয়াছেন, আমার পরে দ্বীন-বিনষ্টকারী এবং মানুষকে বিপথগামী করার বহু সূত্রই সৃষ্টি হইবে। কিন্তু এই শ্রেণীর ক্ষতিসাধনকারী বস্তুসমূহের মধ্যে পুরুষদের জন্য নারীগণই হইবে সর্বাধিক ক্ষতিকারিনী - পুরুষের জন্য নারীদের সমতুল্য পথভ্রষ্টকারী ক্ষতিকারক আর কোন কিছু হইবে না।
নারী (জাতির মূল অর্থাৎ সর্বপ্রথম নারী - আদি-মাতা হাওয়া) পাঁজরের (ঊর্দ্ধতম) হাড় হইতে সৃষ্ট। পাঁজরের হাড়সমূহের মধ্যে ঊর্দ্ধতম হাড়খানাই সর্বাধিক বাঁকা।
দোজখীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হইবে।
স্বামী যদি স্ত্রীকে স্বীয় বিছানায় প্রতি ডাকে এবং স্ত্রী তাহাতে অসম্মতি প্রকাশ করে যদ্দরুণ স্বামী অসন্তুষ্টির সহিত রাত্রিযাপন করিয়াছেন, তবে সেই স্ত্রীর রাত্রি এই অবস্থায় অতিবাহিত হয় যে, ফেরেশতাগণ ভোর পর্যন্ত সারারাত্র তাহার প্রতি লানৎ (বা অভিশাপ) বর্ষণ করিয়া থাকেন।
• অকল্যাণ তিন জিনিসে - নারী, বাসস্থান ও পশুতে।

ইসলামে, রসুলের হাদীসে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আনুগত্য প্রশ্নাতীত। সেখানে কোনও শর্ত নেই। কিন্তু স্বামী স্ত্রী বা স্ত্রীদের প্রতি অনুগত হবে এমন কোনও হাদীস নেই, স্ত্রীকে যখন ডাক দেবে স্বামী শয্যায় তাকে আসতেই হবে যৌনমিলনের জন্যে। সেখানে স্ত্রী নামে বস্তুটির ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনও মূল্য নেই। স্বামী স্ত্রী বা স্ত্রীদের ঘরে রেখে কোনও উপপত্নীতে উপগত হলেও স্বামীর ওপর কোনও লানত বর্ষণ হবে না। তেমন কোনও হাদীস আমাদের চোখে পড়েনি।

মহানবী মোহাম্মদকে দোজখ বা জাহান্নম দেখানো হয়েছিল। সেখানে তিনি দেখেছেন দোজখীদের অধিকাংশ নারী। রোজ কিয়ামতের পূর্বে কাদের বিচার করা হল। আল্লাহ কেন নারীদের দিয়ে দোজখ পূর্ণ করলেন তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা হাদীসে নেই।  ... রসুল মোহাম্মদকে প্রশ্ন করা হয়েছিল নারীরা কেন এত বেশী সংখ্যায় দোজখে যাবে। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন নারীরা যে 'কুফরী' বেশী করে থাকে তা হল স্বামীর কুফরী (নাশোকরী ও নেমকহারামী)। নারীর স্বভাবই হল এই কুফরী করা। এখানেও সেই স্বামী নামে প্রভুর আনুগত্যের প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে। (সূত্র: বোখারী শরীফ, অনুবাদ - মাওলানা আজিজুল হক)

বোখারী শরীফ থেকে আরো কিছু নির্বাচিত হাদীস -

নারী জাতি আড়ালে থাকার বস্তু। আড়াল থেকে নারী বের হলেই শয়তান তাদের প্রতি উঁকি মারে। এই জন্যেই নারীর নাম হল আওরত বা আবরণীয় জিনিস। 
নারী শয়তানের ফাঁদ।
নারী শয়তানের আকৃতিতে সামনে আসে এবং শয়তানের আকৃতিতে চলে যায়।

নারী তো শুধু দয়িতা নয়। মাতা-কন্যা-ভগ্নীও, তারাও কী পুত্র-পিতা ও ভ্রাতার কাছে শয়তানের রূপ ধরে আসে? এই প্রশ্নের উত্তর কোথায় খুঁজি। এই সব হাদীসে নারীর প্রতি অসম্মান চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে। নারী বেগানা পুরুষের সামনে আসলেই শয়তান তার ওপর ভর করে এবং শয়তানের আকৃতি পেয়ে যায় সেই নারী, এরপর যদি সেই নারী আড়ালেও চলে যায়, শয়তানের আকৃতির রেখাপাত রেখে দেয় সেই পুরুষের হৃদয় পটে। তাই সব দিকে আবড়িত করে ঘরে বন্দী করে রাখতেই হয় নারীকে। সেটাই উত্তম কাজ। নারীকে শয়তানের দৃষ্টি থেকে রক্ষা করার এ ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। এটাও এক ব্যাখ্যা হাদীসের। অনুরূপ বোখারী হাদীসে রসুল বলেছেন -

স্বামীর অনুপস্থিতিতে নারীদের কাছে যেও না। কারণ শয়তান তোমাদের প্রত্যেকের রক্ত চলাচলের পথে চলতে সক্ষম।
একাকী কোনও নারীর সঙ্গে দেখা হলেই শয়তান তাদের তৃতীয় জন হয়।

শয়তান কী শুধু নারীকেই দেখে? পুরুষকে দেখে না। দেখার কথা নয়। কারণ শয়তানও আল্লাহর সৃষ্টি আরেক পুরুষ, তারও প্রয়োজন নারীর। নারীর সাথে তার জন্মবিরোধ। সেটাই হয়তো আরেক ব্যাখ্যা নারী ও শয়তানের সম্পর্কের।
*************************
আর একটি হাদীস -

কোনও নারী অথবা কুকুর যদি নামাজরত অবস্থায় সম্মুখ দিয়ে যায় তাহলে তার এবাদত আল্লাহর কাছে পৌঁছাবে না। (বোখারী শরীফ - ৩১৬)
*************************
পর্দার বা অবরোধের বিধায় যে যে অঙ্গ নারীকে ঢেকে রাখতে হবে তার একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে বোখারী শরীফে। তাকে বলা হচ্ছে 'ছতর' বা 'সতর'। নারীদের দেহ ঢেকে রাখা সম্পর্কে দুটি নির্দেশ রয়েছে। প্রথম হল সতর। অন্যটি হেজাব বা পর্দা। সতরের পরে হেজাব। সতরের অঙ্গ ও সীমা কেউ না দেখলেও আবৃত রাখতে হবে। তাছাড়া সতরের সীমা ও অঙ্গ সমূহ আবৃত রাখা নামাজের একটি অন্যতম ফরজ নারীর জন্যে। যা অবশ্য পালনীয়। পক্ষান্তরে পর্দা বা হেজাবের অঙ্গ শুধুমাত্র দর্শক হতে আবৃত রাখা আবশ্যক। অর্থাৎ ঘরের ভেতর অবরোধে থাকাকালীন হেজাব না পরলেও চলতে পারে।

*********************************************************

ইসলামের বিচারালয়ে নারীকে কখনো পূর্ণ মানুষ রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। নারীকে বিবেচনা করা হয় পুরুষের অর্দ্ধেক বলে। দুজন নারী মিলে একজন পুরুষের সমকক্ষ হওয়া যায়। কোনও বিচারে সাক্ষ্য দিতে হলে যেখানে একজন পুরুষ হলে চলতে পারে সেখানে প্রয়োজন হবে দুজন নারীর। এ থেকেই ইসলামের বিচারব্যবস্থায় নারীর অবস্থা ও অবস্থান দুটোই বুঝে নেওয়া যায়।

আর তোমাদের পছন্দমতো দুইজন পুরুষকে সাক্ষী রাখবে। আর যদি দুজন পুরুষ না থাকে, তবে একজন পুরুষ ও দুইজন স্ত্রীলোক। - সুরা বাকারা, ২/২৮২

বোখারী শরীফে রয়েছে -

তোমাদের পুরুষদের মধ্য হতে দুজন সাক্ষী সংগ্রহ করতে হবে। যদি দুজন পুরুষ না থাকে একজন পুরুষ ও দুজন নারী হলে হবে।

কোরানের প্রতিধ্বনি হাদীসে। কোরানের এই আয়াত ও এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে নারীর রয়েছে সৃষ্টিগত দুর্বলতা। তাই আল্লাহ নারীর ওপর পুরুষকে শ্ৰেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আর কোনও ব্যাখ্যা আমরা খুঁজে পাইনি। এই শ্রেষ্ঠত্ব থেকেই নারীর উত্তরাধিকার পুরুষের অর্দ্ধেক। সে সম্পত্তির অধিকার পেলেও পিতা, স্বামী, ভাই, পুত্র কারো সম্পত্তিতেই পুরুষের সমান অধিকার পায় না। পায় পুরুষের অর্ধাংশ।
*************************
শরিয়তী আইনে 'জেনা'র জন্যে চরম শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ব্যাভিচার, বিবাহ-বহির্ভূত যৌনমিলন, ধর্ষণ ও পতিতাবৃত্তিকে জেনা বলা হয়েছে। অর্থাৎ পরস্পরের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কের কোনও চুক্তি নেই এমন দুজন নরনারীর যৌনমিলন হল জেনা। শরিয়তী আইনে জেনা বা ব্যাভিচারের জন্যে চরম শাস্তির বিধান রাখা হলেও নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে শাস্তি দুরকম। জেনার জন্যে অবিবাহিত পুরুষের ক্ষেত্রে তা ১০০ ঘা বেত্রদণ্ড বিবাহিত পুরুষের ক্ষেত্রে ৮০ ঘা বেত্রদণ্ড। কিন্তু নারীর বেলায় এই শাস্তি প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড। অপরাধ প্রমাণ করতে চারজন পুরুষ সাক্ষীর প্রয়োজন হয়। কোনও ভাবেই নারীর সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হয় না। এই প্রসঙ্গে কোরানের এই আয়াতটি স্মরণীয় -

তোমাদের নারীদের মধ্যে যারা ব্যাভিচার করে তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের মধ্য থেকে চারজন সাক্ষী নেবে। যদি তারা সাক্ষ্য দেয়, তবে তাদেরকে ঘরে আটক করবে। যে পর্যন্ত না তাদের মৃত্যু হয় বা আল্লাহ তাদের জন্য ওই কোনো ব্যবস্থা করেন। - সুরা নিসা, ৪/১৫

পুরুষ ব্যাভিচার করলে তাকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘরে আটক রাখার নির্দেশ কোরানের কোনও আয়াতে নেই। পুরুষ যেন ব্যাভিচার করতেই পারে না যদি না নারী তাকে প্রলুব্ধ করে। কারণ হাদীসের ভাষায় শয়তানের পাতা ফাঁদে পা দেয় নারী পুরুষ নয়। 
*************************
শরীয়া আইনে নারী তো কোনদিন বিচারক হতে পারেন না।

*********************************************************

শতবর্ষ পূর্বে বাংলার এক মুসলমান নারী মহিয়সী বেগম রোকেয়া ঘোষণা করেছিলেন -

"আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ এই ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।" পিতৃতন্ত্রের দীর্ঘ ইতিহাসে এই প্রথম কোনো নারী সরাসরি বাতিল করে দেন কোনো বিশেষ একটি ধর্মগ্রন্থকে নয়। সমস্ত ধর্মগ্রন্থকে; ধর্মগ্রন্থের পেছনের সত্যকে প্রকাশ করেন অকপটে। (রোকেয়া রচনাবলী, সম্পাদকের নিবেদন)

আমাদের যথাসম্ভব অধঃপতন হওয়ার পর দাসত্বের বিরুদ্ধে কখনও মাথা তুলিতে পারি নাই; ...যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। ... আমরা প্রথমতঃ যাহা সহজে মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি। এখন ত অবস্থা এই যে, ভূমিষ্ঠ হওয়ামাত্রই শুনিতে পাস: 'প্যাট! তুই জন্মেছিস গোলাম, থাকবি গোলাম!' সুতরাং আমাদের আত্মা পর্যন্ত গোলাম হইয়া যায়। ...

আমরা যখনই উন্নত মস্তকে অতীত ও বর্তমানের প্রতি দৃষ্টিপাত করি, অমনই সমাজ বলে: 'ঘুমাও, ঘুমাও, ঐ দেখ নরক।' মনে বিশ্বাস না হইলেও অন্ততঃ আমরা মুখে কিছু না বলিয়া নীরব থাকি। ...

আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। ...

এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ-রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। মুণিদের বিধানে যে-কথা শুনিতে পান, কোন স্ত্রী মুণির বিধান হয়ত তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন। যাহা হউক, ধর্মগ্রন্থসমূহ ঈশ্বর প্রেরিত কি না, তাহা কেহই নিশ্চয় বলিতে পারে না। যদি ঈশ্বর কোন দূত রমণী-শাসনের নিমিত্ত প্রেরণ করিতেন, তবে সে দদূত বোধ হয় কেবল এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিতেন না। ... এখন আমাদের আর ধর্মের নামে নত মস্তকে নরের অযথা প্রভুত্ব সহা উচিত নহে। আরো দেখ, যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ়, সেখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক। ...

ধর্ম শেষে আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছে, ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন। ...

(রোকেয়া রচনাবলী)

Saturday, 11 November 2023

শ্রীরামকৃষ্ণ কিছু অজানা প্রসঙ্গ - সুনীত দে

আমাদের সভ্যতা সেই কবেকার। যার তুলনায় ইউরোপীয় সভ্যতা নেহাৎ শিশু মাত্র। কিন্তু তারাই আজ কোথায় এগিয়ে চলে গেল, আমরা পড়ে রইলাম পিছনে। কেন এমন হলো? আমাদেরই তো উচিত ছিল সবার আগে থাকার। কিন্তু তা তো হল না। কোটি কোটি টাকা বিদেশী ঋণের বোঝার নীচে আমরা চাপা পড়ে রইলাম। নিশ্চয়ই এর পিছনে অনেক কারণ আছে। সব কারণ আমার জানা নেই। তবে একটা কারণ নিশ্চিৎ - তা হলো যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞানকে অবহেলা করে ধর্ম নিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের অত্যাধিক গবেষণা। যার নীট ফল আজকের ভারতবর্ষ। যার প্রতিটি মানুষ জন্মের আগেই কয়েক কোটি টাকার বিদেশী ঋণের কাছে বিকিয়ে বসে আছে। এদেশে ধর্ম আন্দোলন নয়, বিজ্ঞান আন্দোলনের শরীক হওয়া উচিত প্রত্যেকের।


'সেবা' নামক বস্তুটিকে আমরা বড্ড বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। কিন্তু জেনে রাখুন সেবা মানুষকে হীন প্রতিপন্নই করে। সেবার দ্বারা ব্যক্তি বিশেষের কিছু উপকার হতে পারে বটে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে মানব জাতির কোন উপকার এভাবে হয় না, হবেও না। প্রচ্ছন্নভাবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সেবা সবসময় একটি শর্তমূলক বিনিময়। এই বিনিময়টা কেমন জানেন? মাদার দুঃস্থ রোগীকে বলছেন, "ওষুধটা খেয়ে নাও, যীশুর কৃপায় ভাল হয়ে যাবে।" রোগ সরানো যেমন জরুরি, মাথায় যীশুর নাম চালান করে দেওয়াও সমান জরুরি। সেবা প্রতিষ্ঠানের সেবার অলিখিত শর্ত এটিই।


সেবার দায়িত্ব নিক রাষ্ট্র, সেবার দায়িত্ব নিক সরকার। যদিও সে ভাবনাও গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেলের মতই অবাস্তব। সরকারী স্তরে যা চুরি জোচ্চুরির বহর, কোন দিকেই আমাদের এগোনোর রাস্তা নেই। অতএব শেষ আশ্রয় সেই ধর্ম। যার গমন পথ সততই সময়ের বিপরীতমুখী।  


*********************************************************


রামচন্দ্র দত্ত তার 'পরমহংসদেবের জীবন বৃত্তান্ত" গ্রন্থে যোগ করেছেন "তিনি যে কি জন্য মন্দিরের সামগ্রী স্পর্শ করেন নাই, আমরা তাহার কোন কারণ প্রদর্শন করিতে পারিলাম না।" (পৃষ্ঠা - ৬)। রামচন্দ্র দত্ত একজন ডাক্তার, রসায়নবিদ, এমনকি 'কুর্চিসীন' নামক একটি ওষুধের আবিস্কারক। তিনিও বুঝে উঠতে পারছেন না কেন রামকৃষ্ণদেব মন্দিরের প্রসাদ গ্রহণ করছেন না। আসলে 'গুরুদেব নীচ জাতের অন্ন স্পর্শ করেন না" এই বোমাটি বুকের উপর ফেটে যায় এই ভয়। এমন কি রাম দত্তের বাড়িতে একবার অন্য গ্রহণের প্রস্তাব রামকৃষ্ণদেব স্বযত্নে প্রত্যাখ্যান করেন। বলেন 'তুমি তো ব্রাহ্মণ নও'। রামচন্দ্র দত্ত ছিলেন সম্পর্কে স্বামীজীর দাদু। যদিও বয়সের তফাৎ সামান্য হওয়ায় রামদাদা নামেই তিনি খ্যাত ছিলেন। সম্ভবতঃ তিনিই ছিলেন রামকৃষ্ণদেবের প্রথম শিষ্য ও প্রচারক।


'শ্রীরামকৃষ্ণ লীলামৃত' গ্রন্থে বৈকুন্ঠনাথ সান্যাল বলেছেন 'মন্দিরের প্রসাদ গ্রহণ না করে তিনি আমাদের লোভ সংবরণ শিক্ষা দিয়ে গেছেন।' 'নীচু জাতের অন্ন ছুঁই না' এর মধ্যে লোভ সংবরণের কি শিক্ষা আছে তা ঠিক বুঝতে পারলাম না।


... রামকৃষ্ণদেব এখন দক্ষিণেশ্বরে রয়ে গেছেন। নিজে হাতে গঙ্গা জলে রান্না করে খাচ্ছেন। রাতে কিন্তু তিনি আর সকলের সাথে মন্দিরের প্রসাদী লুচিই খান। ভাগ্নে হৃদয়রাম বলছেন, "কত দিন দেখিয়াছি ঐরূপে লুচি খাইতে খাইতে তাহার চক্ষে জল আসিয়াছে এবং আক্ষেপ করিয়া শ্রী শ্রী জগন্মাতাকে বলিয়াছেন, 'মা, আমাকে কৈবর্তের অন্ন খাওয়ালি'!" (পৃষ্ঠা - ১৯৫)।


*********************************************************


প্রশ্ন ধর্ম জগতে গুরুতর পাপ। 'ঈশ্বর সত্য' এই কথা মেনে নিয়ে তবেই প্রশ্ন হতে পারে। যেমন তিনি সাকার না নিরাকার, গরীবের নকুল দানায় তুষ্ট না ধনীর রাজভোগে, পাঁচীর মার বেলপাতায় না বেবিফুডে ময়দা মেশানো কোটিপতির সোনার হারে। এইসব গুরুতর প্রশ্ন চলতে পারে ঈশ্বরকে মেনে নিয়েই। কিন্তু ঈশ্বর নিজেই সত্য কিনা এ প্রশ্ন করা একদম চলবে না। পড়াশুনা শিখলে মানুষের মনে এ প্রশ্ন আসতেও পারে। তাই ধর্ম নেতারা বলে থাকেন, আগে ঈশ্বর লাভ, পরে অন্য কিছু। এই ঈশ্বর লাভের আশাতেই আমার বাপ-ঠাকুরদা মায় চোদ্দ পুরুষের জীবন শেষ হয়েছে। আমাদের হবে। আমাদের দেখাদেখি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পতাকা তুলে নেবে। এর কোনো শেষ নেই। 


মাস্টারমশাই শ্ৰীম বলছেন, "ঈশ্বরকে জানার নাম জ্ঞান। নানান খানা জানার নাম অজ্ঞান। ঈশ্বরকে জানার পর দরকার হয় অন্য সব জানা যায়। ঈশ্বরের জ্ঞান ছেড়ে অন্য সব জানা দুঃখ  অশান্তির কারণ।" কেন মিছিমিছি বই পড়ে খেটে মরব। যা জানার সব তো তিনিই জানাবেন।আর তাকে জানতে গেলে অধ্যয়ন নয়, চাই সাধন। 'অধ্যয়নে তিনি এত মগ্ন ছিলেন যে ঠাকুর তিন বার ডাকা সত্ত্বেও তিনি সাড়া দেন নাই। ঠাকুরের কাছে যাইতেই তিনি শশীকে (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) জিজ্ঞাসা করিলেন, " অপরা বিদ্যা লাভের জন্য যদি তুই ধর্মবিষয়ক কর্তব্য অবহেলা করিস, তোর ভক্তিলাভ হইবে না।" শশী ঠাকুরের উপদেশের গূঢ়ার্থ হৃদ্গত করিয়া গ্রন্থগুলি গঙ্গাজলে ফেলিয়া দিলেন। তখন হইতে গ্রন্থ পাঠের প্রতি তাহার অনুরাগ কমিয়া গেল এবং তিনি গুরু সেবায় এবং ধর্ম সাধনায় অধিকতর মনোযোগ দিতে লাগিলেন।' (নবযুগের মহাপুরুষ, পৃ-১৩৫)। মাষ্টারমশাই শ্ৰীম ছাত্রদের উপদেশ দিচ্ছেন, 'একজন ছোকরা ভক্ত বইটই পড়ত। ঠাকুর তাকে বলেছিলেন, আর বইতে কি আছে? যদি পনেরো মিনিট তাকে ডাকিস তাহলে যে হবে তোর, একবছর বই পড়ে কী তা হবে?' (শ্ৰীম দর্শন, ষষ্ঠ খন্ড, পৃ-২৩২)। আবার বলছেন, শ্ৰীম (ভক্তদের প্রতি) -- বিদ্যালাভ এই জন্য করা, এতে প্রকৃত শান্তিলাভ হয় না, এই কথাটা জানতে। তর্কপ্রধান লোকেদের এসব জানা দরকার। তাদের সংশয় যেতে চায় না কিছুতেই। এইটা জেনে, সব বই-টই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে 'মা-মা' বলে কাঁদা। ঠাকুর কেঁদে কেঁদে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন। এটা সোজা পার্থ এ যুগের পক্ষে। তাই ঠাকুর এ পথটা নিয়েছিলেন লোকশিক্ষার জন্য। (শ্ৰীম দর্শন - দশম ভাগ পৃ-৮০)। এই লোকশিক্ষা আমাদের দেশে অতি প্রবল বলেই শিক্ষা এবং শিক্ষিতের হার-এ আমরা ভীষণ ভীষণ পিছিয়ে। 'অশিক্ষিতের দেশ' এই তকমা আমাদের পিঠে দগদগে ঘায়ের মত শোভা পায়। যদিও ধর্ম শিক্ষায় শিক্ষিতের হার আমাদের প্রায় একশ শতাংশ। গোটা পৃথিবীতে ইসলাম অধ্যুষিত কিছু দেশ ছাড়ি, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। স্বামী বিবেকানন্দও বলে গেছেন এ মহামানবের জাত, দেবতার জাত, অমৃতস্য পুত্রাঃ, সব্বাই, ওফ, কি মধুর বচন। 


স্বামী প্রেমানন্দ, স্বামী সারদানন্দ, স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ, স্বামী অভেদানন্দ, নরেন্দ্রনাথ এরা প্রত্যেকেই যখন রামকৃষ্ণের কাছে এসেছেন প্রত্যেকেরই অল্প বয়স এবং স্কুল কলেজের ছাত্র। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাবে এরা প্রত্যেকেই ছাত্রজীবনের উপর দাঁড়ি টেনে দিয়েছেন। '১৮৮৩ বা ৮৪ খৃষ্টাব্দে বাবুরাম (স্বামী প্রেমানন্দ) প্রবেশিকা পরীক্ষা দিলেন। কিন্তু উত্তীর্ণ হইতে পারিলেন না। একথা শুনে ঠাকুর বলিলেন - "ভালই হল। তার বন্ধন ছিন্ন হল। পাস তো নয়, পাশ (বন্ধন)"।' (নবযুগের মহাপুরুষ, পৃ-৬১)।


ছোট ছোট ছেলেদের দিকেই তার টান বেশি ছিল। বলতেন "ইহাদিগের মন এখনও স্ত্রী-পুত্র, মান-যশাদির ভিতর ছড়াইয়া পড়ে নাই, উপযুক্ত শিক্ষা পাইলে ইহারা সহজেই ষোলআনা মন ঈশ্বরে দিতে পারবে।" গোয়েবলস থিওরি ব্যবহার করে ঈশ্বরকে মগজে গেঁথে দেবার নামই উপযুক্ত শিক্ষা। সারা পৃথিবী জুড়ে, ঘরে ঘরে এই শিক্ষা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।


এখানে একটা কথা বলার আছে। শুধু রামকৃষ্ণদেবই নন প্রায় সব ধর্মগুরুরই কম বয়সী ছেলেদের প্রতি একটা টান থাকে। কি করে তাদের ঈশ্বর লাভ হয় সে নিয়ে তাদের খুব চিন্তা। কিন্তু ছোট ছোট মেয়েদের কথা তো তারা কখনই বলেন না। মেয়েদের কি ঈশ্বর লাভ করতে নেই?


অক্ষয় সেন খাঁটি সত্যি কথাটি বলে গেছেন -

নিরক্ষর  বেশে আসা তাহার কারণ।

বিদ্যার করিতে গর্ব খর্ব বিলক্ষণ।। (রামকৃষ্ণ পুঁথি, পৃষ্ঠা-৩৩৮)


শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে নিরক্ষর ছিলেন। দেশবাসীকেও নিরক্ষর থাকার রাস্তা দেখিয়ে গেছেন। সব সময় বলতেন 'বই পড়ে কি কখনো কেউ ঈশ্বর লাভ করেছে রে! ঈশ্বর লাভ হয় স্মরণাগতি দ্বারা। তার কাছে আকুল হয়ে কাঁদতে হয়। বলতে হয় আমি শক্তিহীন, ভক্তিহীন, কি করে তোমায় ডাকব জানি না, তুমি নিজে প্রকট হয়ে আমাকে সব জানিয়ে দাও মা।' এই প্রার্থনার কথা তিনি আমাদের শিখিয়েছেন আর শিখিয়েছেন পড়াশুনা করে কেউ কখনো ভগবান লাভ করেনি। তবে আর কি। ধৈর্য সাপেক্ষ অধ্যবসায় থেকে হরিকীর্ত্তন অনেক সোজা। তাই নিজেই মেতে থাকি আমরা। জ্ঞানচর্চা করে বড়জোর শুষ্ক তার্কিক হওয়া যায়, তার বেশি নয়। একে বলে চাল কলা বাঁধা বিদ্যা। কেন বই নিয়ে বসতে যাব! স্বয়ং গুরুদেব যেখানে বলে দিয়েছেন ওতে ভগবান নেই। গুরুবাক্য আগে মান্য করতে হবে, পরে বিদ্যাসাগর, তার বর্ণপরিচয়। বলতেন, 'যার যটা পাস, তার তটা পাশ।' 


এখানে প্রশ্ন হতে পারে মিশনের দর্শন যদি শিক্ষা বিরোধীই হয় এত এত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেখানে হলো কেন! বেশ জটিল প্রশ্ন বটে। দেখুন, ভাববাদ দর্শনে কোথাও সেবা বা শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তবুও বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জরুরি। যদিও আঠারো নম্বর বস্তির প্রায় অনাথ ছেলেমেয়েগুলিকে শিক্ষিত করে তোলা এর উদ্দেশ্য নয়। সমাজের সেরা ছাত্রকটিকে টেনে নিয়ে তাদের ফার্স্ট সেকেন্ড করানোই উদ্দেশ্য। এতেই লোকের চোখ টানে বেশি। এবার মাধ্যমিকে ফার্স্ট হলে কে, না রহড়া মিশন। ব্যস, সবার ওপরে মিশন সত্য, তাহার উপরে নাই।


*********************************************************


"স্ত্রী লোক নিয়ে মায়ার সংসার করা। তাতে ঈশ্বর ভুল হয়ে যায়। যিনি জগতের মা, তিনিই এই মায়ার রূপ -- স্ত্রী লোকের রূপ ধরেছেন। এটি ঠিক জানলে আর মায়ার সংসার করতে ইচ্ছে হয় না। সব স্ত্রী লোককে ঠিক মা বোধ হলে, তবে বিদ্যার সংসার করতে পারে। ঈশ্বর দর্শন না হলে স্ত্রী লোক কি বোঝা যায় না।" নারী সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণের মতামত ঠিক এই রকমই। নারীর সাথে সংসার করছ, কি নারীর সাথে মেলামেশা করছ , তো তোমার ঈশ্বর ভুল হয়ে যাবে। নারীকে তিনি শুধুই 'মা' বলে ভাবতে পারেন। 'নারী' বলে নয়। এটাই আপত্তিকর। নারীকে শুধুই একজন নারী বলে ভাবা হবে না কেন? 'মায়ের জাত' তকমা লাগিয়ে কেন হেঁসেল, পতিসেবা, আর বাচ্চা পালার যন্ত্র বানিয়ে দেওয়া হবে?


আচার্য শঙ্করাচার্য বলেছেন 'নারী নরকের দ্বার'। এই মতটিকেই সমাজ সোজা পথে না মেনে বাঁকা পথে মেনে নিয়েছে।


সেই  বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, শাস্ত্র থেকে একই ধারা বয়ে চলেছে। সর্বত্রই পুরুষের জয়গান, আর নারীর অবমাননা। নারীকে সর্বত্র এতই হীন চোখে দেখা হয় যে হিন্দু শাস্ত্রের নির্দেশানুযায়ী পুত্র সন্তান ছাড়া কন্যা সন্তানকে বংশধর রূপে স্বীকৃতি দেওয়াই হয় না। এমন কি যাদের কেবল মাত্র কন্যা সন্তান আছে, তাদের মৃত্যুর পর, কন্যা সন্তান থাকা সত্ত্বেও শাস্ত্রানুযায়ী তাদের বংশ লোপ হয়ে যায়। অতএব শুধুমাত্র কন্যার পিতামাতা জেনে রাখুন আপনারা কিন্তু নির্বংশ হয়েছেন। অবশ্য যদি হিন্দু শাস্ত্র মানেন তো। ব্রাহ্মণকে মূল্য ধরে দিয়ে রেহাই নেই। কিহু কিছু বিধান তারা সুবিধামতো পাল্টে দিতে পারেন বটে, তবে সব বিধান পাল্টে দেওয়া ব্রাহ্মণের কম্মো নয়।


আমাদের বর্তমান হিন্দু সমাজ মনুসংহিতার অনুশাসনে পরিচালিত। চোদ্দ জন মনুর নির্দেশ সমৃদ্ধ সংহিতা দ্বাদশ অধ্যায় বিভক্ত। সংহিতার নবম অধ্যায়ে দায়ভাগ নিয়ম অনুযায়ী কন্যা সন্তান বংশধর হয় না। এই নিয়মটিই বর্তমানে শাস্ত্র নিয়ম রূপে স্বীকৃত এবং এখনো অপরিবর্তনীয়।


ঋষি ঋণ, দেব ঋণ, পিতৃ ঋণ, নৃ ঋণ এবং ভূত ঋণ - এই পাঁচ ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে হিন্দুরা পৃথিবীতে আসে। পরবর্তীকালে পুত্র সন্তান লাভ হলে পিতৃ তর্পণে পিতৃ ঋণ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অন্য ঋণগুলি এখানে বিচার্য নয়। পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে না পারলে, অপদার্থ কন্যা সন্তানের পিতামাতা "পুৎ' নরক প্রাপ্ত হন। সেখানে পাঁচ হাজার বছর রেপসিড তেলে ফ্রাই। তারপর যমদূতেরা ... থাক, সে বড় ভয়ঙ্কর।


তবে এখানে মহামতি মনু বিধবা নারীর প্রতি কিছুটা সদয়। তার বিধান 'পতির মৃত্যুতে সাধ্যি বিধবা পুত্রহীনা হইলেও ব্রহ্মচর্য পালনের ফলে স্বর্গে গমন করেন।' বেশ ভাল বিধান। পুত্রহীনা বিধবার স্বর্গে যাবার তবু একটা রাস্তা বেরল। পুরুষ কিন্তু এ আশীর্বাদে বঞ্চিত। তবে একটু ঘুর পথে বিচার করলেই দেখা যাবে এর পেছনেও নারীকে দমিয়ে রাখার নীতিই কাজ করছে। পুরুষ চরে খাক। আসলে আমাদের সমস্ত পুরাণ শাস্ত্রই নারী বিদ্বেষী। স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণও পুত্র কন্যা হীন। সুতরাং পিতৃঋণ থেকে মুক্ত নন।


ঐতরেয় ব্রাহ্মণ অনুসারে 'পুত্রলাভ করে পিতা অন্ধকার অতিক্রম করেন। পুত্র হল জ্যোতিঃ, কিন্তু কন্যা বা দুহিতা হল কৃপণ বা দুঃখের কারণ।' 'ঋগ্বেদে' জননী দশটি পুত্র কামনা করছেন। পক্ষান্তরে কন্যাকে 'বন্ধকী' দ্রব্যের সাথে তুলনা করা হয়েছে। যেখানে পুত্র সম্পদ স্বরূপ। 'অথর্ব বেদে'ও শুধুই পুত্রের জন্য যজ্ঞ। মনু বলেছেন - 'পুত্র' পিতাকে 'পুৎ' নরক থেকে পরিত্রাণ করে, এজন্য ব্রহ্মা স্বয়ং 'পুত্র' এই নাম রেখেছেন। আরও বলছেন 'পুত্রের দ্বারাই মানুষ স্বর্গাদি লাভ করে।' 'ভাগবৎ গীতা' বৈশ্য, শূদ্র এবং নারী তিনজনকেই 'পাপ যোনি' বলে অভিহিত করছেন।


গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন - "হে পার্থ, যাহারা নিকৃষ্ট কূল যাত্ৰা নিতান্ত পাপাত্মা, যাহারা কৃষ্যাদি নিরত বৈশ্য ও যাহারা অধ্যয়ণ বিরোহিত শূদ্র এবং স্ত্রী লোক - ইহারাও আমাকে আশ্রয় করিলে অতুৎকৃষ্ট গতি লাভ করবে।" লক্ষ্য করে দেখুন নারীকে সোজা কথায় 'এই তোরা একদম ফালতু' এই ভাবে নিচে নামানো হয়নি, নামানো হয়েছে একটু অন্যভাবে। ঘুষখোর, জুয়াচোর, বেবীফুডে ভেজালদার, স্ত্রীলোক , এরা সবাই মুক্তি পাবে যদি তাকে ডাকে। স্ত্রীলোকের স্থান কোথায় নির্দিষ্ট হয়েছে একবার ভেবে দেখুন। (গীতা, রাজবিদ্যারাজগুহ্যযোগ, ৯ম অধ্যায়, ৩২ নং শ্লোক)।


এছাড়াও নানান সংহিতা, বিভিন্ন উপনিষদ, মায় আমাদের সমস্ত শাস্ত্র পুরাণেই কেবল মাত্র পুত্রের জয়গান। লম্পট, মাতাল হলেও সে গুণবতী কন্যা অপেক্ষা সব সময় শ্রেষ্ঠ। কোন কারণ ছাড়াই নারী অবমাননা শাস্ত্রের যত্রতত্র ছড়িয়ে রয়েছে। ...


... অতএব হে নারী, যতই তুমি 'নারী মুক্তি' আন্দোলন কর না কেন, তোমার প্রাপ্ত স্বাধীনতাটুকু পুরুষের দয়ার দেন বলেই যেন। অধিকার করে নিতে গেলে এখনো তোমাকে বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। গার্গী, মৈত্রেয়ী, ভাবা, সীতা, সাবিত্রীর স্বাধীনতা সম্মানের গল্প শুনিয়ে, আয় ঘুম যায় ঘুম দত্ত পাড়া দিয়ে, বলে তোমাকে শীত ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে, আগে সে ঘুম কাটুক, তবে তো স্বাধীনতা। দু চারটি ক্রীতদাস শ্রেণীর পুরুষ দিয়ে যেমন পুরুষ জাতির স্বাধীনতা বিচার হয় না, তেমনই দু চারটি ইন্দিরা গান্ধী, হেমামালিনী, পি টি ঊষা অথবা পার্কস্ট্রীটের জীনস পরা, মোবাইল হাতে ইংরাজী বলা সুন্দরী দিয়েও সমগ্র নারী জাতির স্বাধীনতা বিচার হয় না। যতক্ষণ তোমার ওপর শাস্ত্রীয় বিধান বলবৎ, ততক্ষণ তোমার পরাধীনতাও বলবৎ।


কথা হতে পারে শাস্ত্রের সেই দূষিত অংশগুলির পরিমার্জনা করা যায় কিনা, অথবা সেগুলি বর্জন করা যায় কিনা। আমি বলি কি, তা যায় না। কারণ যে নারী বিদ্বেষমূলক ভাবটি সমগ্র ধর্ম সাহিত্যের মধ্যে একাত্ম হয়ে মিশে রয়েছে দুটো লাইন কেটে দিয়ে সেই ভাব থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। 'পুরুষ আপাদমস্তক পবিত্র'। 'ব্রহ্মার মুখ থেকে জন্মেছে তাই - ব্রাহ্মণ'। 'ব্রাহ্মণই একমাত্র শিক্ষা লাভ ও দানের অধিকারি'। 'শূদ্র অভিবাদনের যোগ্য নহে'। 'নারী নরকের দ্বার'। 'শুধু কামনা মেটাতে যুবতী শূদ্রা গ্রহণ করা যায়'। 'ব্রাহ্মণের গৃহে শূদ্র অতিথি হলে তাকে চাকরদের সাথে খেতে দিতে হবে'। 'বিধাতা দাসত্বের জন্যই শূদ্রের জন্ম দিয়েছেন'। 'নারী, শূদ্র সম্পত্তির অধিকারী নহে'। 'নারী স্বাধীনতার যোগ্যই নহে'। 'স্মৃতি ও বেদে নারীর অধিকার নাই তাই - অপদার্থ '। এ সবই আমাদের পুরাণ শাস্ত্রের কথা। এর কটাকে কেটে বাদ দেবেন। কাটতে কাটতে হাত ব্যথা হয়ে যাবে। এমন হাজার হাজার ধ্যান ধারণা আমাদের পুরাণ শাস্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে রয়েছে।


*********************************************************


সংসারীজনকে শ্রীরামকৃষ্ণ 'এই এই' আদর্শ শিখিয়ে গেছেন বলে শুনতে পাই। আমি কিন্তু দেখি শুধু 'এ কুল রাখতে হয়, ও-কুলও রাখতে হয়' গোছের একটা জড়িবুটি মেশানো টনিক তিনি সংসারীর জন্য তৈরি করে রেখেছিলেন। সংসারী লোক তার কাছে গেলেই ছিপি খুলে এক ঢোক মুখে ঢেলে দিতেন। ভক্ত সংসারী জড়িবুটির পাঁচন খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে সংসারের কাজে লেগে যেত।


আসলে শ্রীরামকৃষ্ণ ও তার শিষ্যরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, যে সংসার সাগরে নেমেছে সে ডুবেছে। ভগবান লাভ তার কাছে দূরঅস্ত। মুখে যদি ভাল ভাল কথাই বলতেন কিন্তু মনেপ্রাণে জানতেন সংসারীর জন্য ভগবানের দরজা বন্ধ। স্বামী সারদানন্দ বলেন - 'ঠাকুরকে আমরা ওই কথা প্রসঙ্গে সময় সময় বলিতে শুনিয়াছি যে, "একটা ভেকধারী সাধারণ পেট বৈরাগী ও একজন চরিত্রবান গৃহীর ভিতর তুলে করিলে পূর্বোক্তকেই বড় বলিতে হয়"।' (লীলাপ্রসঙ্গ, পৃষ্ঠা - ৫৯৯)। ভেবে দেখুন একবার, ঘরবাড়ী ছেড়ে আসা যে গেরুয়াধারীকে তিনি 'ভেকধারী পেট বৈরাগীর' বেশী কিছু ভাবেন না, তাকেও তিনি 'চরিত্রবান গৃহীর' উপরে রাখছেন। গৃহী তবুও বলে ঠাকুর তাদের জন্য অনেক রেখে গেছেন।


স্বামী বিবেকানন্দও বলেছেন 'পর্বত এবং সরষে দানায় যে প্রভেদ, সমুদ্র ও গোষ্পদে যে প্রভেদ, সন্ন্যাসী ও গৃহীতেও সেই প্রভেদ।'এমনকি কোন ভন্ড সাধুকে গৃহীর থেকে তিনিও এগিয়ে রাখেন। (স্বামীজির সহিত হিমালয়ে - নিবেদিতা, দ্বাদশ সংস্করণ, পৃ- ৮০)। অথবা, 'আদর্শটি খাঁটি হলে একজন ভ্রষ্ট সন্ন্যাসীও গৃহস্থ অপেক্ষা শতগুণে শ্রেষ্ঠ।' (বাণী ও রচনা, পঞ্চম খন্ড, পৃ - ৪০০)। ভ্রষ্ট যে, তার আবার আদর্শ কী! তবুও সে গৃহীর তুলনায় মহৎ। বাবা, মায়ের উদ্দেশ্যে বলছেন - 'শিশুদের শেখাও জোনাকি পোকা ও সূর্যের মধ্যে যে তফাৎ, গৃহী ও সন্ন্যাসীর মধ্যেও সেই তফাৎ।' (বাণী ও রচনা, দশম খন্ড, পৃ - ৩০৫)। তার ধারণায় - সংসারে থেকে ব্রহ্মজ্ঞান কথার কথা মাত্র। (স্বামী শিষ্য সংবাদ, পৃ - ৮৯, ৯১)।


শ্রীরামকৃষ্ণ তার সন্ন্যাসী শিষ্যদের গৃহীদের সাথে মেলামেশা আদপেই পছন্দ করতেন না। তা বলে কি তিনি গৃহীদের ঘাড় ধরে তাড়াবেন? তা তো হয় না। একশ জন তার কাছে গেলে সাতানব্বই জনই গৃহী। এদের বিদায় করলে থাকে তিন জন। এই নিয়ে কি সাধুজীবন চলে! তবুও এর মধ্যেই তিনি একটি গোপন ভেদরেখা টেনে চলতেন। অন্য গৃহী ভক্তদের কথা তো ছেড়েই দিলাম, টের বীর ভক্ত গিরিশ ঘোষ, যাকে তিনি সারা জীবনই বিরাট ভক্তের মর্যাদা দিয়েছেন। গোপনে তার কাছ থেকেও তার সন্ন্যাসী শিষ্যদের তফাৎ করিয়ে দিতেন। কারণ গিরিশ সংসারী। 'শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে। নরেন্দ্রকে বারণ করিতেছেন গিরিশ ঘোষের সঙ্গে বেশি মিশিতে। গিরিশ অনন্য স্মরণ ভক্ত হইলেও গৃহস্থ আশ্রমে রহিয়াছেন।' (শ্ৰীম দর্শন, পঞ্চম ভাগ, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা - ১৭৬)। কথামৃতের অংশ এটি। আমি শ্ৰীম দর্শন এখানে ব্যবহার করলাম। তার একটু অন্য কারণও আছে। মাস্টারমশাই এক ভক্তকে দিয়ে কথামৃতের এই অংশটি পড়াচ্ছেন। সংসারী কীট যে কতদূর জঘন্য তার বর্ণনা আছে এখানে। উদ্দেশ্য শান্তি নাম এক যুবক। ডাক্তারি ক্লাসের ছাত্র। বাড়ি থেকে বিয়ের চেষ্টা চলছে। পড়া হলে শ্ৰীম (শান্তির প্রতি) - "তোমার জন্য পড়া হল। তুমি কি করবে - ফার্স্ট ক্লাস, না সেকেন্ড ক্লাস?" শান্তি - "মন যে মানে না।" শ্ৰীম - "সে কি তোমার ইচ্ছা? গুরু যখন হয়েছে তখন তোমার ইচ্ছা আর নাই।"


শ্ৰীম একজন স্কুলের হেডমাস্টার, তিনিই একজন ডাক্তারির ছাত্রকে পড়াশুনা করা থেকে কিভাবে নিরুৎসাহিত করছেন। যেখান চিরকালই আমাদের দেশে ডাক্তারের অভাব, সেখানে শিক্ষাবিদ হয়েও একজন হবু ডাক্তারকে সাধু বানাচ্ছেন। তবে এই যে ডাক্তারী পড়তে বাধা দিচ্ছেন, এ কিন্তু অকারণে নয়। এর পিছনেও গুরুদেবের আদর্শ কাজ করছে। 'ঠাকুর বলতেন, " উকিল, দালাল ও ডাক্তারের ধর্ম নেই।" -ই ক্ষেতড়ির মহারাজের কাছ থেকে খরচ নিয়ে ব্যারিস্টারী পড়ার জন্য বিলেত গেছেন। স্বামীজী তখন সেখানে। ওকে কিছুতেই উকিল হতে দিলেন না - চিঠি দিয়ে খরচ পাঠান বন্ধ করলেন।' (জীবন্মুক্তি সুখপ্রাপ্তি - প্রকাশক স্বামী সত্যব্রতানন্দ, উদ্বোধন, দ্বিতীয় সং ১৯৮৯ পৃষ্ঠা - ৩২)। এই ছেলেটি অত্যন্ত অভাবী ও মেধাবী। সংসারে মা ভাই ইত্যাদি আছে। ভেবেছিল উকিল হয়ে একটু সুখের মুখ দেখবে। কিন্তু স্বামীজী 'আমাদের (স্বামী তুরীয়ানন্দ) বললেন, "মা ভাই না খেয়ে মরে, সেও স্বীকার। দেখি ঠাকুরের পথে চলতে পারি কিনা।" ঠাকুর বিধান দিয়ে গেছেন উকিল-ডাক্তার ধর্মহীন। অতএব ডাক্তারী পড়ুয়াকে নিরাশ করে সাধু বানিয়ে দাও, অভাবী হবু উকিলের অনুদান বন্ধ করিয়ে, দেখি হতচ্ছাড়া কেমন করে হাইকোর্টের চৌকাঠ মাড়ায়। কু-সংস্কার, অন্ধবিশ্বাস। এই বিশ্বাস নিয়ে ভারত জাগলে জগৎ অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। এমন কি স্বামীজী নিজের ভাই মহেন্দ্রনাথকেও ওকালতি পড়তে দেননি।


স্বয়ং মাস্টারমশাইও একবার এই 'গৃহী সন্ন্যাসীর' ফাঁদে পড়েছিলেন। অসুস্থ রামকৃষ্ণদেবের সাথে তখন গৃহী ভক্তদের সাক্ষাৎ প্রায় বন্ধই করে দিয়েছিলেন তার ত্যাগী শিষ্যরা। শ্ৰীম এসেছিলেন রামকৃষ্ণদেবের সাথে দেখা করতে। (সম্ভবত কাশীপুর উদ্যানে)। কিন্তু তাকে প্রথম দফায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কারণ তিনি গৃহী। পরে অবশ্য দেখা করতে দেওয়া হয়।


কথামৃতকার শ্রীমকে ভক্তরা গৃহস্থ ঋষি রূপেই দেখেন। স্বয়ং রামকৃষ্ণদেব তেমনই ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, 'গৃহস্থ ঋষি-কতকগুলি অর্থহীন কিম্ভূত কিমাকার কথা মাত্র।' (বাণী ও রচনা, পঞ্চম খন্ড, পৃ-৩৯৮)।


আসল কথা হল রামকৃষ্ণদেব এবং তার শিষ্যরা যতটা সম্ভব গৃহীদের এড়িয়ে চলার চেষ্টাই করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর দেখতে পাই কাশীপুর বাগানে তার শিষ্যরা নিজেদের মধ্যে নিয়ম করে রেখেছেন গৃহী ভক্তরা মঠে এলে তাদের সাথে বেশিক্ষণ কথা বলা চলবে না, তারা সন্ন্যাসীদের বিছানায় বসবে না। এই রকম অনেক অলিখিত নিয়ম।


শ্ৰীম তার ভক্তদের উপদেশ দিতে গিয়ে বলছেন 'এরা, মানে সন্ন্যাসীরা, মা-বাবাকে চোখের জলে ভাসিয়ে দিয়েও সিদ্ধ যোগী হবার জন্য মঠে যোগ দিয়েছেন। সংসারীর সাথে এদের তুলনা।' প্রসঙ্গ ধরে একটি কাহিনী বলছি। ভাল লাগতেও পারে - শুকুল মহারাজ, স্বামী আত্মানন্দ, স্বামীজীর এক প্রধান মন্ত্র শিষ্য। দীক্ষার আগে এক জমিদারের সেরেস্তায় হিসাব রক্ষকের কাজ করতেন। বৌকে ফেল রেখে চলে এলেন রামকৃষ্ণ মিশনে, সন্ন্যাসী হবেন।বৌ জমিদার বাড়ি এসে কান্না-কাটি শুরু করেছে। 'হুজুর আমার স্বামীকে আনিয়ে দিন।' জমিদারবাবু আর করেন কি, বৌকে সেখানেই থাকতে বলে মঠের ঠিকানায় চিঠি লিখলেন, বিষয় সম্পত্তির প্রসঙ্গ তুলে। পরের অংশ - 'পত্র পাইয়া গোবিন্দচন্দ্র (শুকুল মহারাজ) অবিলম্বে জমিদারের বাড়ি গেলেন। কিন্তু জমিদার আর বিষয় সম্পত্তির কথাই উল্লেখ করিলেন না। তিনি যে ঘরে গোবিন্দচন্দ্রের সহিত কথা বলিতেছেন সেই ঘরে ব্রাহ্মণী আসিয়া পতিকে দর্শন ও প্রণাম করিবামাত্র উর্দ্ধশ্বাসে সাধু পালাইয়া গেলেন, আর জমিদার বাড়ি ফিরিলেন না। সাধুর নিকট পত্নী ও সংসার অন্ধকার অতল কূপতুল্য বোধ হইল।' (নবযুগের মহাপুরুষ, পৃ - ১৫০)। উনি সাধু হলেন, বৌ-টার কি হল কে জানে।


একবার জ্ঞান মহারাজের ঘরে সংসারী বড় অমূল্য (যাকে শ্ৰীম অতি সত্ত্ব গুণের ভক্ত বলে চিহ্নিত করেছেন) গায়ের জামা খুলে রাখে। অন্য এক সন্ন্যাসী জামাটি দেখে সেটি বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ঠাকুরের আদেশ "মুড়ি-মিছরির এক দর যেন না হয়।" শ্ৰীম বলতে থাকেন "বিবেকানন্দ আমাকে বলেছিলেন, 'অমুক' মশাইয়ের কথা। বলেছিলেন - "এই দেখুন, ইনি এসে আমার বিছানায় শুয়ে পড়েন। শেষে আমি সব ছাড়লুম এই জন্যে।" (শ্রীম দর্শন, দ্বাদশ ভাগ, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা - ১৪২ - ৪৩)। পুরোনো দিনের ভক্ত। সে ভাবছে সব ভাই ভি বুঝি। বিবেকানন্দ মহারাজ কিন্তু হুঁশিয়ার, সংসারী লোক, এ কি তার বেলেল্লাপনা। মুড়ি-মিছরি এক করে দেবে নাকি? তাই তার অভিযোগ 'শেষে ঘর ছাড়লুম কি এই জন্য নাকি?'


লাটু মহারাজের 'সৎকথা'র ছয় নম্বর উপদেশ - তিনি (রামকৃষ্ণ) জোর করে বলতেন - "বিয়ে করিস নে, বিয়ে না কল্লে একদিন না একদিন ধর্ম বুঝতে পারবি।" (সৎকথা - স্বামী সিদ্ধানন্দ, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা - ৫)। বিয়ে মানেই সংসার, সংসার মানেই ধর্ম হানি। ৭৩ পাতায় ১৫নং উপদেশে বলছেন "ব্রহ্মচর্য না থাকলে ভগবান লাভ হয় না।" গৃহী যাই ভাবুন না কেন তাদের পথ ভগবানমুখী নয়। স্বামী বিবেকানন্দ গুরুর পথ ধরেই বলে গেছেন "সংসারীর ব্রহ্মজ্ঞান - বাতুলের চিন্তা মাত্র।" (স্বামী বিবেকানন্দ - প্রমথনাথ বসু, দ্বিতীয় ভাগ, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃ - ৬৪৯)।


একবার এক ভক্ত সারদামণিকে বলে বসেন, 'এখানে যারা আসছেন কি সন্ন্যাসী, কি গৃহী, সবই তো সমান - কারণ সকলেই মুক্ত হবে?' শুনে সারদামণি আঁতকে ওঠেন, "সে কি! ত্যাগী আর গৃহস্থ কি সমান? ওদের কামনা বাসনা কত কি রয়েছে, আর এরা তার জন্য সব ছেড়ে চলে এসেছে। এদের আর তিনি ভিন্ন কি আছে? সাধুদের সাথে কি ওদের তুলনা হয়?" (শ্রী শ্রী মায়ের কথা, দ্বিতীয় ভাগ, চতুর্থ সংস্করণ, পৃষ্ঠা - ২৮ -২৯)। সংসারী যাই ভাবুন না কেন, ঈশ্বর লাভ তাদের জন্য নয়। 'এখানে যারা আসে সবাই মুক্ত হবে' ধারণাটাও ঠিক নয়।


*********************************************************


সারদাদেবীর যখন বিয়ে হয় তিনি তখন নেহাত শিশু মাত্র। তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে, দু একবার শ্রীরামকৃষ্ণের সাথে তার দেখাও হয়েছে। কিন্তু স্বামীর সাথে একত্রে বাস এখনও হয়ে ওঠেনি। ১৮৭২ সালের চৈত্র সংক্রান্তির সময় তিনি দক্ষিণেশ্বরে এসে পৌঁছেছেন। প্রায় দু মাস হয়ে গেল সেখানেই রয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সাথে এক বিছানায় শয়নও করছেন। ঠিক এই সময়কার অবস্থাটা যে ভাবে বুঝেছি প্রকাশ করার চেষ্টা করব। সেই সাথে এই সময় শ্রীরামকৃষ্ণের এবং সারদাদেবী র মানসিক অবস্থাটাও আমার দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী প্রকাশ করবার চেষ্টা করব।


শ্রীরামকৃষ্ণ আজীবন স্ত্রী সঙ্গের ঘোরতর বিরোধী। তার কাছে নতুন কেউ এলে প্রথমেই তিনি জিজ্ঞেস করতেন বিয়ে হয়েছে কিনা। বিয়ে হয়ে গেছে শুনলে তিনি হতাশ হয়ে পড়তেন। এ অবস্থায় কি ভাবে স্ত্রীকে পাশ কাটিয়ে সাধন ভজন নিয়ে থাকা যায় তার পরামর্শ দিতেন। এমন কী স্ত্রীকে ছেড়েছুড়ে ভগবৎ ভজনায় জীবন কাটানোর ব্যবস্থাও তিনি করে দিতে পারেন, এমন কথাও বলতেন।


সদ্য বিবাহিত শিষ্যকে তিনি বলছেন - "একদিন স্ত্রীকে এখানে নিয়ে আসিস - তাহাকেও তোকে সেইরূপ করিয়া দিব; আর যদি সংসার ত্যাগ করিয়া ঈশ্বর লাভ করিতে চাস, তা হইলে তাহাই করিয়া দিব।" (লীলাপ্রসঙ্গ, পৃষ্ঠা - ৭৬৫)। অথবা মহেন্দ্র মাস্টারের সাথে কথোপকথন - 'মনি (রামকৃষ্ণের প্রতি) - "স্ত্রী যদি বলে, আমায় দেখছো না, আমি আত্মহত্যা করব। তাহলে কি হবে?" শ্রীরামকৃষ্ণ (গম্ভীর স্বরে) - "অমন স্ত্রী ত্যাগ করবে। যে ঈশ্বর পথ বিঘ্ন করে। আত্মহত্যাই করুক, আর যাই করুক।"।' (কথামৃত, দ্বিতীয় ভাগ, পৃ - ১১)।


ঠিক এই ঝামেলা তে ডুবে গিয়েই স্বামী ব্রহ্মানন্দের স্ত্রী বিশ্বেশ্বরীদেবী গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। যার স্বামী, স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে ফেলে রেখে শ্রীরামকৃষ্ণের কোলে শুয়ে দুধ খায়, ঘরে ফিরে আসার আর কোন আশাই নেই,এটার পক্ষে আত্মহত্যাই বাঁচবার একমাত্র রাস্তা। তিনি মরে বেঁচেছেন। (ব্রহ্মানন্দ লীলাকথা - ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য, পৃ - ২০)।


শ্রীরামকৃষ্ণ, তার ভক্ত শিষ্যরা যদি বিয়ে না করে থাকে বা তাদের যদি বিয়ে করার ইচ্ছে নেই শোনেন তো আনন্দে আটখানা হয়ে উঠতেন। একটি দুটি ছেলেমেয়ে হয়ে গেলে সংসারী কেমন ভাই বোনের মত থাকবে, এই সব বোঝাতেন। তাকেই তিনি মরদ মানতেন যে স্ত্রীর পাশে শুয়ে নাক ডেকে ঘুমোবে। এই রকম সব চিন্তা ভাবনা শ্রীরামকৃষ্ণের মনে সব সময় গিজ গিজ করত। একান্ত পার্ষদদের আশীর্বাদ করতেন - 'তোদের বংশ নির্বংশ হয়ে যাক'।


তা রামকৃষ্ণদেব এখন করেন কি? হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় বিয়েতে রাজি হয়ে গেছেন। এতদিন স্ত্রীকে ফেলে রেখে দক্ষিণেশ্বরে দিব্যি কাটছিল। এখন আবার তিনি এসে হাজির। আবার এক ঘরে শুচ্ছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের পক্ষে এসব মেনে নেওয়া ভীষণ কঠিন। তার মনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে। পাশে শায়িতা স্ত্রীর দিকে যাবেন, না ঠাকুর দেবতা নিয়ে যেমন আছেন তেমনই থাকবেন। মনের মধ্যে তীব্র ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সেই ঝড়ের বেগ তার দুর্বল, অসুস্থ, হিষ্টিরিয়া রোগগ্রস্ত শরীর সহ্য করতে পারছে না। তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়ছেন। (শ্রীশ্র্রী মা সারদামণী দেবী - মানদা শঙ্কর দাশগুপ্ত, পৃ - ২৩)। এই অচৈতন্য হয়ে পড়ার নামই ভাব সমাধি। ভক্তেরা ভক্তি মার্গের লোক, সমাধি টমাধি তারাই বোঝেন ভাল। আমরা সে অমৃতে বঞ্চিত। আসলে পরমেশ্বর আমাদের মতো অপাঙতেয়দের জন্য এ বোধটুকুও বরাদ্দ করেননি।


শ্রীরামকৃষ্ণ - "বিয়ের পর ব্যাকুল হয়ে জগদম্বার কাছে প্রার্থনা করেছিলুম, মা, আমার স্ত্রীর ভেতর থেকে কামভাব একেবারে দূর করে দে।" (ঐ , পৃ - ২৩)।


শ্রীরামকৃষ্ণ চান ভগবান। কিন্তু সারদাদেবী তো তা চান না, তিনি চান সন্তান। 'মা'র প্রাণে সত্যই ছেলের জন্য একটা দুর্দমনীয় বাসনা ছিল। তিনি নিকুঞ্জদেবীর নিকট বলিয়াছেন,"ঠাকুর একদিন বলিলেন, ছেলে কি হবে? এই দেখছো সব মরছে। তা আমি বললাম সব কি যায়! আর রামদত্ত প্রভৃতিকে একদিন বললেন, দেখ, বড় ছেলে ছেলে করে। তোমরা একবার নহবতে যাও, আর বলে এসো আমরাই আপনার ছেলে।" মার এই উক্তি দুইটি হইতে বোঝা যায় ছেলের জন্য তাহার প্রাণে কি গভীর আকাঙ্খা জাগিত।'(ঐ, পৃষ্ঠা - ৮৮)। শ্রীরামকৃষ্ণ তাকে বোঝাচ্ছেন 'তুমি একটি সন্তান চাইছ, কালে হাজার সন্তানের মা মা ডাক তোমাকে শুনতে হবে।' 'মন্দিরে মূর্তি হয়ে যে পূজা নিচ্ছে, আমার পা টিপে সেবা করছেও সে।'


ভগবানের স্ত্রী। সুতরাং ভগবতী হবার একটা সম্ভাবনা সারদাদেবীর রয়েই গেছে। রামকৃষ্ণদেব চাইছেন সেই দরজাটা খুলে দিতে। যাতে তিনি নিজেই ভাবতে পারেন, আরে, আমি কি একটা সাধারণ মেয়ে যে একটা ছেলের জন্য বায়না ধরব! আর এতেই রামকৃষ্ণদেবের মুক্তি। তাই রামকৃষ্ণদেব সারদাদেবীর মনকে প্রভাবিত করতে চাইছেন। মন্দিরের দেবতা আর যে আমার পা টিপছে অর্থাৎ সারদাদেবী, এরা আদতে একই।


এই সব বলে তিনি তার সমস্যাকে চাপা দিচ্ছেন, কিন্তু এতে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। চাই বরাবরের মত নিষ্কৃতি। তার জন্য যদি স্ত্রীকে পুজো করতেই হয়, তাই তিনি করবেন।



কুমারী পুজো চলবে না। ঊনিশ বছর বয়স হলেও ষোড়শী পুজো চলতে পারে। তাই হোক, এসব করে যদি সারদাদেবীর মনের সন্তান বাসনাকে চাপা দেওয়া যায়। যদি একবার তাকে ভাবান যায় 'আমি তো ভগবতী, আমার আবার কামনা বাসনা কিসের!'


ফলহারিণী কালী পূজার অমাবস্যা তিথিতে সারদাদেবীকে রামকৃষ্ণদেব ষোড়শী রূপে পুজো করলেন। দীনু পূজারী নামে সারদাদেবীর এক ভাসুর পুত্র এই পুজোয় শ্রীরামকৃষ্ণকে সাহায্য করেন। পুজো হয়ে গেল, সারদাদেবী ভগবতী হয়ে তার ঘরে চলে গেলেন। রামকৃষ্ণদেব অর্ধচৈতন্য অবস্থায় পড়ে রইলেন তার ঘরে।


ষোড়শী পুজোর কারণ একটাই, সারদামণির মন থেকে সন্তান বাসনা মুছে ফেলা। সারদাদেবী জানলেন, যে তাকে ভগবতী জ্ঞানে পুজো করেছে তার কাছ থেকে ফুল চন্দন চাওয়া যায়,সন্তান কামনা, সে হতে পারে না।


ষোড়শী পুজো সারদাদেবীর কাছে একটা অলিখিত শর্ত হয়ে রয়ে গেল, যে শর্ত বলে তিনি স্বামীর কাছে সন্তানবতী হবার আবদারটুকু থেকেও বঞ্চিত হলেন।


শ্রীরামকৃষ্ণ ঠিক এটাই চেয়েছিলেন। কিন্তু এসব করেও রামকৃষ্ণদেবের মনে ভয়ও কম ছিল না। 'শ্রীশ্রী লক্ষ্মীমণিদেবী' - শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র সেনগুপ্ত, ৫৭ পাতা থেকে কিছু অংশ এখানে তুলে দিলাম -


ঔষধ না করিতে শ্রীমাকে ঠাকুরের অনুরোধ 

'কোন কোন স্ত্রী স্বামীকে বশীভূত করিবার জন্য ঔষধ প্রয়োগ কর। সেই প্রসঙ্গ লইয়া ঠাকুর শ্রীমাকে যাহা বলিয়াছিলেন , মা (লক্ষ্মীমণিদেবী) তাহার আবৃত্তি করিয়া বলিতেছেন, - "দেখ, ওরা (নানান জায়গার মেয়েরা) সব এসে হাঁস পুকুরে ঘুরে বেড়ায়। আর আমায় দেখে শুনে গিয়ে সব আপনাদের ভিতর কত কথাবার্তা কয়। আমি সব শুনতে পাই। বলে - এর সবই ভালো, তবে ঐ যে রাত্তিরে স্ত্রীর সঙ্গে একত্তরে শোন না - এই যা। ওদের কথাবার্তা, পরামর্শ তুমি শুনোনি বাপু। ওরা সব বলবে, এর মন ফেরাতে ঔষধ পালা কর। দেখ বাপু, ওদের কথায় আমায় ওষুধ পালা করোনি। আমার সব আছে। তবে ভগবানের জন্য, সব শক্তি তাকে দিয়ে দিয়েছি। শ্রীমা আলতো আলতো ভাষায় জবাব দিতেন - না না। সে কি কথা।" (শ্রীশ্রী মায়ের পদপ্রান্তে, ৪র্থ খন্ড, পৃ - ৯০৪)।


যে সারদাদেবীকে রামকৃষ্ণদেব পুজো করছেন, সকলের কাছে বলছেন এ মানুষ নয়, সাক্ষাৎ ভগবতী। দেবী সরস্বতী, রূপ লুকিয়ে এসেছে, আরো কত কি। আবার তাকেই তিনি ভয় পাচ্ছেন, তাকে ওষুধ পালা না করে ফেলে। কিন্তু এ সব তো গ্রামের অশিক্ষিতা মেয়েরা তাদের স্বামীকে বশে আনতে করে থাকে। যে কিনা সাক্ষাৎ ভগবতী এটার কাছ থেকে এ ভয় কেন?


ঐ বইয়ের ২৩৬ পাতায় একই বিষয়ের আর একবার উল্লেখ পাচ্ছি। স্বামী সারদানন্দ এসেছেন লক্ষ্মীমণিদেবীর সাথে দেখা করতে। একথা সেকথার মধ্যে লক্ষ্মীদেবী বললেন "ঠাকুর তার মানসিক পরিবর্তনের জন্য ঔষধ প্রয়োগ করতে শ্রীমাকে মধ্যে মধ্যে বারণ করিতেন।..." শরৎ মহারাজ ইহা শুনিয়া বলিলেন, "ঠাকুরকে ঔষধ করিবার জন্য কয়েকবার চেষ্টা হইয়াছিল।" স্বামী চেতনানন্দের 'শ্রী রামকৃষ্ণকে যেরূপ দেখিয়াছি', প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা - ১৩, সেখানেও ওষুধপালা বিষয়ের সাক্ষ্য পাওয়া যায়।


একবার নহবতে সারদাদেবী আর ভাইঝি লক্ষ্মীকে ভাগ্নে হৃদয় প্রসাদ দিতে একটু বেশি সময় হাসি ঠাট্টা করেছে। রামকৃষ্ণদেব কিন্তু সব লক্ষ্য রেখেছেন। হৃদয় ফিরে এলে দেরী করার জন্য তাকে তিরস্কার করে বলছেন "যাবি আর দিয়ে চলে আসবি।  খবরদার , কখনো যেন আর দেরী না হয়।" (শ্ৰীশ্ৰী সারদামণি দেবী - মানদাশঙ্কর দাশগুপ্ত, পৃ - ৫৭)। শ্রীরামকৃষ্ণের এ ধমকের কারণ যেন কিছুর ইঙ্গিতবাহী।


*********************************************************


সমাজকে শিক্ষার আলো দেখাচ্ছেন যে স্বামী বিবেকানন্দ তিনি বলে গেছেন - "যে একটা ভূত দেখেছে, সে বই পড়া পণ্ডিতের চেয়ে অনেক বড়।" (স্বামীজির কথা - উদ্বোধন, পৃ - ১৬৭)। সব অবান্তর এবং কুসংস্কারে পরিপূর্ণ শিক্ষা দিয়েও যে দেশের শিক্ষাবিদরা গুরুত্ব পেয়ে থাকেন, তাদের শিক্ষা এবং শিক্ষিতের হার তলানিতে গিয়ে ঠেকবেই। চারটি স্কুল তৈরি করে, সেরা ছাত্রকটিকে টেনে নিয়ে, তাদের ফার্স্ট সেকেন্ড করিয়ে নাম কেনা যায় ঠিকই, সমাজকে শিক্ষার আলো দেখানো যায় না। স্বামীজী আরও বলে গেছেন "আসল ধর্মের রাজ্য যেখানে, সেখানে লেখাপড়ার প্রবেশের কোন অধিকার নেই।" (বাণী ও রচনা, দশম খন্ড, ১ম সংস্করণ, পৃ - ২৭৬)। এটিই আসল কথা, মহাপুরুষের বাণী। কে ফার্স্ট হল, আর কে সেকেন্ড হল তাতে আমার কি! ফার্স্ট বয়-রা কি ভগবান দেখে! আমার দরকার ভগবান, পড়াশুনো করে হবেটা কি? বলেছেন, 'গ্রন্থ পাঠে যা না শিখতে পারো, মন্দির তার চেয়ে বেশি শিক্ষা দেবে'। (ভারতে বিবেকানন্দ - স্বামী শুদ্ধানন্দ, পৃ - ৩১৮)। 'যদি আমরা লিখতে পড়তে না জানি তো আমরা ধন্য, আমাদের ঈশ্বরের কাছ থেকে তফাৎ করার জিনিস অনেক কমে গেল।' (বাণী ও রচনা, চতুর্থ খন্ড, পৃ - ২১৬)। বলতেন - 'বিজ্ঞানবাদ-আত্মা ও ভগবানের আলোকেই লিখতে হবে, নতুবা তা কলুষিত।' (স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি - নিবেদিতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃ - ৩৩৪)। স্বামীজী সম্পর্কে বাজার চলতি বিখ্যাত বইগুলি পড়ে কিছুই বোঝা যাবে না। আকর গ্রন্থগুলি পড়ে দেখুন, শুধু ধর্ম আর ধর্ম। 


*********************************************************


গাছ থেকে আপেল পড়া, সোনার মুকুট জলে ডোবার পক্ষে বিপক্ষে বেদ উপনিষদ গীতায় তেমন কিছু বলা নেই। সমালোচনার হাত থেকে বেঁচে গেছেন বহু বৈজ্ঞানিক। কিন্তু বেদ উপনিষদে উল্লেখ আছে এমন কোন বিষয়, যা কিনা আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে মিলছে না, তা কিন্তু সমালোচনার হাত থেকে রেহাই পায়নি।


মানুষের উদ্ভব সম্বন্ধে শাস্ত্রে যা বলা আছে ডারউইনিসিম এর সাথে তার কোন মিল নেই। ডারউইন কিন্তু বিশ্বজোড়া ধর্মনেতাদের হাত থেকে নিস্তার পাননি। এক প্রশ্নকারীকে স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন - "ডারউইনের কথা সঙ্গত হইলেও evolution এর কারণ সম্বন্ধে উহা যে চূড়ান্ত মীমাংসা একথা আমি স্বীকার করিতে পারি না।" "সাংখ্য দর্শনে ঐ বিষয়ে সুন্দর আলোচিত হইয়াছে। ভারতের প্রাচীন দার্শনিকদের সিদ্ধান্তই ক্রমবিকাশের কারণ সম্বন্ধে চূড়ান্ত মীমাংসা বলিয়া আমার ধারণা।" উত্তর শুনে ভক্ত প্রশ্ন কর্তা আহ্লাদে আটখানা। "আপনার ক্রমবিকাশের নতুন ব্যাখ্যা শুনিয়া আমি পরম আহ্লাদিত হইলাম।" (স্বামী শিষ্য সংবাদ - শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী, পৃষ্ঠা - ১৭৩ - ৭৫)। অনেকে অনেক কিছুতেই আহ্লাদে ফুটিফাটা হয়। বিজ্ঞান কিন্তু হাসির খোরাক ছাড়া কিছুই পায় না। বলতেন 'বিবর্তনবাদের নিরিখে ডারউইনের তুলনায় পাতঞ্জল সর্বাংশে শ্রেষ্ঠ।' (স্বামী বিবেকানন্দ - প্রমথনাথ বস, দ্বিতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা - ৭৯৯)।


স্বামী অভেদানন্দ আবার একটু ঘুর পথে ডারউইনকে আক্রমণ করেছেন। তিনি আবার ক্রমবিকাশ তত্ত্বের সাথে বংশানুক্রমিক গুণাবলীকে যোগ করে নিয়েছেন। এবং তারপরে বলেছেন - "প্রকৃত কথা বলিতে কি, ডারউইনের মতবাদের দ্বারা বংশানুক্রমিক নিয়ম বা ধারার কোন সমস্যাই হয় না।" (পুনর্জন্মবাদ - স্বামী অভেদানন্দ, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা - ৪৭)। অধ্যাপক গলটন, রথ, ওয়াইজম্যানের মতো ভাববাদী দার্শনিকেরা ডারউইনকে উড়িয়ে দিয়েছেন, একথাও তিনি বলে রেখেছেন।


"পিতামাতার অর্জিত গুণাবলী সন্তানে বর্তায়, একথা বিশ্বাস করার ইচ্ছাও আমাদের নাই।" (ঐ, পৃষ্ঠা - ৫২)। "খ্রীষ্টান বা অন্য মতাবলম্বীর এ ব্যাপারে যা বলেন, তাহার দ্বারাও কোন সমস্যার সমাধান আজ পর্যন্ত হয় নাই।" (ঐ, পৃষ্ঠা - ৫৩)। "তবে বেদান্ত দর্শন ঐ প্রাণ বীজ, জীবাণু অথবা জীবকোষে নিহিত অব্যক্ত শক্তিগুলির যথাযথ কারণ নির্ণয় করিতে সক্ষম হইয়াছে। ... ঐ প্রাণ বীজকেই সূক্ষ্ম দেহ বলিতে পারি।" (ঐ, পৃষ্ঠা - ৫৪ - ৫৫)। "সুতরাং ক্রমবিকাশবাদকে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিতে হইলে পুনর্জন্মবাদের প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক হয়।" (ঐ, পৃষ্ঠা - ৮৮)। এইভাবেই অভেদানন্দজী ডারউইনবাদকে ছোট করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সেই সাথে চেষ্টা করেছেন আমাদের কোন মুনি ঋষি এই প্রসঙ্গে কি বাণী রেখে গেছেন, সেই মত প্রতিষ্ঠা করতে। হরি মহারাজ স্বামী তুরিয়ানন্দও ডারউইনকে কচুকাটা করে বলেছেন 'আমরা অমৃতের সন্তান, বানরের সন্তান হতে যাব কেন?'


শিক্ষাবিদ মহেন্দ্র মাস্টার। তিনিও ডারউইনের সমালোচনায় সমান মুখর। বলেছেন - "western evolutionists-এ পাশ্চাত্য ক্রমবিকাশবাদীদের র দৃষ্টি নাই। তারা নিম্ন দৃষ্টি দিয়ে জগৎকে দেখছে। জগতের স্রষ্টার দিকে তাদের দৃষ্টি নাই। ডারউইন এই নিম্ন দৃষ্টি দিয়ে জগৎকে দেখে বলেছেন, মানুষ সৃষ্ঠ জীবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। পাথর, পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, পশুপক্ষী হতে ক্রমে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। Involution, অর্থাৎ ঈশ্বরই এই সব হয়ে আছেন, এ কথা তারা মানে না। এ দৃষ্টি তাদের নেই। এই দৃষ্টি হয় আত্মদ্রষ্টাদের, ব্রহ্মদ্রষ্টাদের।" (শ্ৰীম দর্শন, অষ্টম ভাগ, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা - ২১৭)।


আরও বলেছেন - "বর্তমান biologist-দের দৃষ্টিও নিম্ন দৃষ্টি, সীমাবদ্ধ দৃষ্টি। শাস্ত্র দৃষ্টি, বেদ দৃষ্টি, অবতার দৃষ্টিতেই কেবল সকল সমস্যার সমাধান হয়। যে সরল বিশ্বাসে ঠাকুরের কথা বিশ্বাস করবে তাকে অতশত ভাবতে হবে না। জগদম্বার মুক্তার হার তার গলায় শোভা পাবে।" (ঐ, পৃষ্ঠা - ২১৮)।


বিদ্যাসাগর তার স্কুল থেকে স্বামী বিবেকানন্দ, মহেন্দ্রনাথকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন কেন জানেন? এদের মত পন্ডিত ধার্মিকেরাই ডারউইনের ছবিতে বাঁদরের শরীর বসিয়েছিল, এই কারণে।


সারদাদেবীকে একবার এক ভক্ত প্রশ্ন করেন - "আচ্ছা, এই যে অসংখ্য প্রাণী - ছোট, বড়, সব কি এক সময়ে সৃষ্টি হয়েছে নাকি? মা - "চিত্রকর যেমন তুলি দিয়ে চোখটি, মুখটি, নাকটি - এমনি একটু একটু করে পুতুলটি তয়ের করে, ভগবান কি এমনি একটি একটি করে সৃষ্টি করেছেন? না, তার একটা শক্তি আছে। তার 'হাঁ' তে জগতের সব হচ্ছে, 'না'তে লোপ পাচ্ছে। যা হয়েছে সব এককালে হয়েছে। একটি একটি করে হয়নি।" (শ্রীশ্রী মায়ের কথা, উদ্বোধন কার্যালয়, দ্বিতীয় ভাগ, চতুর্থ সংস্করণ, পৃষ্ঠা - ৩০)। সৃষ্টির পৌরাণিক ব্যাখ্যা।


আর এক পৌরাণিক ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন স্বামী বিবেকানন্দ। 'কর্মফল' নিয়ে আলোচনা কালে সুরেন্দ্র নাথ সেন প্রশ্ন করেন - '"সবই কর্মের ফল হলেও, গোড়া তো একটা আছে! সেই গোড়াতেই বা আমাদের প্রবৃত্তির ভালো মন্দ হয় কেন?" স্বামীজী - "কে বললে গোড়া আছে? সৃষ্টি যে অনাদি, বেদের এই মত। ভগবান যত দিন আছেন, তার সৃষ্টিও ততদিন আছে।" (স্মৃতির আলোয় স্বামীজী - স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ, পৃষ্ঠা - ২০৯)। অর্থাৎ স্বামীজীর মতে পৃথিবীতে প্রথম প্রাণ বলে কিছু নেই। সৃষ্টি ও প্রাণ সব সময় ছিল, সব সময় আছে। ধার্মিকের বিজ্ঞান ব্যাখ্যা।


*********************************************************


Thursday, 7 September 2023

চিঠিপত্র - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর - শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র শ্রীঅরবিন্দমোহন বসুকে লিখিত

ধর্ম্মকে দেশে প্রতিষ্ঠা না করে দেশকেই ঈশ্বরের এবং ধর্ম্মের আসনে প্রতিষ্ঠিত করবার যে চেষ্টা তাকে য়ুরোপীয় নজিরের খাতিরে আমরা কখনই শ্রদ্ধা করতে পারবনা। Manlinessএর দোহাই দিয়ে ধর্ম্মকে দুর্ব্বল Sentimentalism বলে উড়িয়ে দেবার একটা প্রথা য়ুরোপে আছে আমরাও তার নকল করতে সুরু করেছি - কিন্তু আমাদের দেশে যাকে মনুষ্যত্ব বলে তা Manlinessএর চেয়ে অনেক বড় - আমরা যেন ঐ য়ুরোপীয় Manlinessএর ধিক্কারে লজ্জিত হয়ে তাড়াতাড়ি ঐ মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত না হই। আমাদের দেশে বলেচেন, "ভূমাত্বেব বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ" ভূমা অর্থাৎ যিনি সকলের চেয়ে বড় তাঁকেই জানতে তাঁকেই লাভ করতে চাইবে - তাঁকে আর কিছুরই কাছে ছোট করতে চাইবেনা - যদি তাঁকে খর্ব্ব করে প্যাট্রিয়টিজ্ম্কেই একটা ঘোরতর অন্ধতা; আমাদের দেশের হাঁচি টিকটিকি, ওলাবিবি ঘেঁটুপুজার মতই অন্ধতা; প্রভেদ এই যে, এই অন্ধতার উপর সভ্যদেশের ছাপ মারা আছে - এই অন্ধতা বড় নাম ধরে আমাদের বড় রকম করে ভোলাতে পারে। একথা নিশ্চয় মনে রাখতে হবে দেশ আমাদের দেবতা নয় - অর্থাৎ ঈশ্বরের পরিবর্তে আমরা দেশকে বরণ করতে পারিনে। ... সংসারের সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে প্রবৃত্তির সমস্ত উত্তেজনার মধ্যে, প্রয়োজনের সমস্ত প্রলোভনের মধ্যে এই একটি হাল অটলভাবে চেপে ধরে থাকতেই হবে যে, লাভই হোক আর ক্ষতিই হোক, বাঁচিই আর মরিই, ধর্ম্মকে, ভূমাকে, অর্থাৎ শ্রেষ্ঠতম সত্যকে মহত্তম মঙ্গলকে সর্ব্বান্তঃকরণে স্বীকার করবই - দুর্ব্বলতাবশত তার থেকে ভ্রষ্ট হতে পারি কিন্তু স্পর্দ্ধা করে কোনোদিন যেন একথা মনে চিন্তাও না করি যে ধর্ম্ম চুলোয় যাক দেশকে আমি বড় করে তুলব দেশের জন্য চুরি করব, ডাকাতি করব, অন্যায় করব। দৈশিকতা (প্যাট্রিয়টিজ্ম্) আমাদের আত্মাকে চরম আশ্রয় দিতে পারবেনা, আমি মনুষ্যত্বকে বরণ করে নিয়েছি - আমি হীরের মূল্যে কাচ কিনব না - দৈশিকতা যে মনুষ্যত্বকে লঙ্ঘন করবে এত আমি আমার জীবনে ঘটতে দিতে পারবনা - সেই পথে দু পা বাড়িয়েই দেখলুম পারলুম না - দেশকে ছাড়িয়ে যদি ধর্ম্মকে যদি বিশ্ব মানবকে না দেখতে পাই, যদি দেশের সংস্কারে আমার ঈশ্বরকে আচ্ছন্ন করে তাহলে আমি আমার আত্মার খাদ্য হতে বঞ্চিত হই।

Wednesday, 21 June 2023

ঝড়ের খেয়া - শ্যামল চক্রবর্তী

কমরেড চিত্তব্রত মজুমদারের সি আই টি ইউ -র পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হওয়া এবং ভারতে নয়া উদারনীতিবাদের প্রবর্তন দুটোই সমসাময়িক। চিত্তদার শ্রমিক ফ্রন্টে বড় অবদানই হলো নয়া উদারনীতিবাদের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের রণকৌশল আয়ত্ত করার জন্য সি আই টি ইউ'র পশ্চিমবঙ্গের সংগঠনকে প্রস্তুত করা। এই কারণেই মতাদর্শগতভাবে এবং ব্যবহারিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে পরিস্থিতির উপযোগী করে সি আই টি ইউ'র রাজ্য কমিটিকে গড়ে তোলার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন।


১৯৯১ সাল থেকে ভারতে নয়া উদারনীতিবাদের অর্থনীতি প্রচলিত হয়। কিন্তু তার এক দশক আগে থেকেই আমাদের দেশে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। রাজ্যের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগেই পার্টির শ্রমিক ফ্রন্টের নেতা হিসাবে তিনি গোটা শ্রমিক শ্রেণীর প্রস্তুতির জন্য কলম ধরেছিলেন। এই সময়ে মার্কসবাদী পথে এবং অন্যান্য পত্রিকায় তিনি স্পষ্টভাবে নতুন পরিস্থিতির আক্রমণাত্মক ভূমিকা এবং তারই প্রতিরোধে শ্রমিকশ্রেণীর ভূমিকা কী হবে তা নির্দিষ্টভাবে উপস্থিত করেন। বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ সমাজতান্ত্রিক দেশ হলেও বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে পুঁজিবাদ যে টিকে গেলো এবং পুঁজির স্ফীতি হলো তার অনেক কারণের মধ্যে একটা বড় কারণ হলো প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবনীয় উন্নতি। যাকে এককথায় এখন বলা হয় প্রযুক্তি বিপ্লব বা তৃতীয় শিল্প বিপ্লব।


পুঁজিবাদ পুঁজির পিছনে ছোটে এবং প্রযুক্তির অবিরাম বিপ্লবী পরিবর্তন করে, মার্কসের এই বিশ্লেষণ গত শতাব্দীর শেষার্ধে তীব্র এবং প্রকট হয়ে উঠেছে। এই নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে ভারতের মতো দেশে শ্রমিকশ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত এবিষয়ে তিনি পার্টি এবং সি আই টি ইউ'র মধ্যে মতাদর্শগত সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। তিনি লেখেন, 'এ প্রসঙ্গে প্রথমেই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সমাজ বিকাশের ধারাকে অনুসরণ করে সামাজিক শ্রমের ফল আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা। উৎপাদনের কাজে আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার প্রয়োগের বিরোধিতা করা এ কারণেই শ্রমিকশ্রেণীর সর্বজনীন নীতি হতে পারে না। আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা নিজে থেকে শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণের কখনোই ক্ষতি করে না । বরং তা সামাজিক উৎপাদনের বিকাশ ঘটায় এবং সামাজিক শ্রমের লাঘব ঘটায়।


কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি বিদ্যার প্রয়োগ কার স্বার্থে এবং কাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণীর ও জনগণের মুখ্য বিচার্য বিষয় এটাই। কোনও দেশে আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা যদি পুঁজিপতি শ্রেণীর দ্বারা তাদের স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত হয়, সেক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণের স্বার্থে ভূমিকা পালন করতে পারে না। এক্ষেত্রে সামাজিক পরিবর্তন ঘটিয়ে, উৎপাদনের উপকরণের ওপরে ব্যক্তিগত মালিকানার বিলোপ ঘটিয়ে সামাজিক মালিকানা কায়েমের মাধ্যমেই শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণ আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যাকে সামাজিক উৎপাদনের বিকাশ এবং সামাজিক শ্রমের লাঘব করতে ব্যবহার করতে পারেন। সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন না ঘটালে শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণ কখনোই আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার সুফল ভোগ করতে পারে না' (মার্কসবাদী পথ, সপ্তম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, ১৯৯৮)।


এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, আমাদের দেশেও উৎপাদনের উপকরণের ওপর এবং প্রযুক্তির মালিকানা দেশী-বিদেশী পুঁজিবাদীদের নিয়ন্ত্রণে, কাজেই সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত উচ্চতর প্রযুক্তিবিদ্যা প্রয়োগের কুফল শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণের একটা বড় অংশকে ভোগ করতেই হয়। কাজেই সমাজ পরিবর্তনটাই হবে শ্রমিকশ্রেণীর মূল লক্ষ্য। এতো গেল রণনীতির কথা। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে জনগণ কী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবে? এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, 'আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার প্রয়োগের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করে শিল্পকে ধ্বংস করে দেওয়া ও সংগঠনকে দুর্বল করা শ্রমিকশ্রেণীর লক্ষ্য হতে পারে না। এই কারণেই সংগ্রাম পরিচালনা করতে শ্রমিকশ্রেণীকে অনেক কিছুই বিবেচনার মধ্যে আনতে হয়। আজ যে শিল্প গড়ে উঠেছে, তা আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যাকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। এর পাশাপাশি পুরাতন যে সমস্ত কারখানা একই জিনিস উৎপাদন করছে, তাদের পক্ষে নতুন কারখানার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব তা দেখা দরকার। পশ্চিমবাংলায় এমন বহু পুরাতন শিল্প আছে, আধুনিকীকরণ না হলে যেগুলির টিকে থাকা সম্ভব নয়। এসব ক্ষেত্রে বরং আধুনিকীকরণের দাবিই শ্রমিকশ্রেণী করে থাকেন' (মার্কসবাদী পথ, সপ্তম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, ১৯৯৮)।

Monday, 29 May 2023

নেতাজীর সিক্রেট সার্ভিস - ডাঃ পবিত্রমোহন রায়

ডস্টয়েভক্সির 'ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট' পড়ছিলাম। ডস্টয়েভক্সি ছিলেন বিপ্লবী দলে। রাজার বিরুদ্ধে আমাদেরই মতো যুদ্ধ চালানোর অভিযোগে জার সম্রাটের হুকুমে তার ও আরও কুড়িজনের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়। কনকনে ঠান্ডা এক সকালে তাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে লোহার খুঁটিতে বেঁধে দেওয়া হয়। ঘাতকের দল রাইফেল নিয়ে প্রস্তুত। শুধু সংকেতের অপেক্ষা। চোখের নিমেষে তারপর মাথার খুলি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। মাটিতে লুটিয়ে পড়বে রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন শরীর।   


এমন সময় দূর দিগন্তে দেখা গেল একজন ঘোড়সওয়ার জোর কদমে ছুটে আসছেন। সম্রাট মৃত্যুদন্ড মকুব করে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ দিয়েছেন। রাশিয়ার পালাবদলের কয়েক বছরের মধ্যেই অবশ্য তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। 'ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট'-এর নায়ক হত্যার অপরাধে অপরাধী। বাঁচার অদম্য আকাঙ্খা তাকে পাগল করে তুলেছিল। কিন্তু মৃত্যু কুঠরিতে বসে আমাদের সেই অনুভূতি নেই কেন? বিশাল সমুদ্রের মধ্যে ছোট্ট একটি দ্বীপে একখন্ড পাথরের ওপর এক পা মাত্র স্পর্শ করে সে বাঁচতে চেয়েছিল। আর আমি? প্রাণ মৃত্যহীন, মরার পরেও আমি আবার নতুন করে বেঁচে উঠব - এই চিন্তা আমাকে আসন্ন মৃত্যু সম্পর্কে উদাসীন করে তুলেছিল। এখন মনে হল, যদি বাঁচতে হয় তাহলে মানুষের মধ্যে মানুষ হয়েই বাঁচব। অত্যাচার ও নিপীড়নের দেশে ঘরকুনো 'ভালো ছেলের' জীবন পরাধীন ভারতবাসীর নয়। 


আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাদের দিল্লীর লাল কেল্লায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শুনলাম - কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের বিচার শুরু হবে। সিমলা বৈঠকের ব্যর্থতার পর এদিকে পন্ডিত জওহরলাল নেহরু এই প্রথম আজাদ হিন্দের কথা জনসাধারণের কাছে বলতে লাগলেন। দেখতে দেখতে কয়েক দিনের মধ্যেই সারা ভারতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বীরত্বগাঁথা ছড়িয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে ভারত সরকার দিল্লীর লালকেল্লার শাহনওয়াজ, ধীলন ও সেগলের ঐতিহাসিক বিচার শুরু করলেন। যে আজাদ হিন্দ বাহিনীর কথা ভারতবাসী জানত না, সেই আজাদ হিন্দের লোকদেরই তারা নিজের মানুষ বলে গ্রহণ করেছে। আমরা আমাদের কথা কখনও মানুষকে মুখ ফুটে বলতে পারিনি। ফাঁসির ঘরে এসেই আমরা আমাদের কথা যথাসাধ্য জোর গলায় আশেপাশের বন্দীদের শোনাতে লাগলাম।


সারা দেশে তখন আজাদ হিন্দের নাম উত্তাল একটা ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক চেতনার ওপর ভিত্তি করে শুরু হয়েছিল অগাস্ট বিপ্লব। আজাদ হিন্দ ফৌজের আদর্শ ও নেতাজীর নেতৃত্ব সারা ভারতের মানুষের মনে একটা নতুন বৈপ্লবিক চেতনার সৃষ্টি করেছিল। জাতি, বর্ণ, ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে সবাই ঐক্যবদ্ধ হলেন। আজাদ হিন্দ আন্দোলনের সঙ্গে দেশবাসী একাত্মবোধ করতে লাগলেন। ভারতের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার হৃদয় তোলপাড় করে তখন ধ্বনিত হচ্ছে একটি নাম - নেতাজী আর তার আজাদ হিন্দ ফৌজ।


সারা ভারতের এই পরিস্থিতির পটভূমিকায় অমিতা মিত্র বোম্বাই ও পুনায় গিয়ে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আমাদের বিষয়ে আলোচনা করলেন। যারা অহিংসা মন্ত্রের উপাসক নয়, যারা পরাধীন দেশের মুক্তিসাধনায় নিজের অস্ত্রে শত্রুর রক্তে মায়ের শ্বেত কমল লালে লাল করে তুলেছে, যারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে নিজের কাটামুন্ড নিয়ে মরণোৎসবে হোলি খেলেছে, আজ তাদেরই জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন অহিংসা মন্ত্রের ভাবমূর্তি মহাত্মা গান্ধী স্বয়ং।


ইতিমধ্যে আরও প্রায় চার মাস কেটে গেল। তিন তিনবার আমাদের ফাঁসির সব ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হল, তিন তিনবারই দিল্লী থেকে তা বন্ধ করা হল। এখানে খাওয়ার অসুবিধা নেই, চিন্তাভাবনার হাত থেকেও মুক্তি পেয়েছি, মেনে নিয়েছি যে, মৃত্যু আমাদের অবধারিত। তবে এ মৃত্যু মহান, এ মৃত্যু কাম্য। কারণ আজ প্রতিটি ভারতবাসী আজাদ হিন্দ আন্দোলনকে বুক দিয়ে ভালবেসেছে, আমাদের জন্য তারা প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। আমাদের আদর্শ জয়লাভ করেছে। মৃত্যুর আগে একথা জেনে যাওয়ার মতো আনন্দ, সৌভাগ্য ও কৃতিত্ব আর কী থাকতে পারে।


সে এক দারুন গ্রীষ্মের দুপুরে এই রুদ্ধঘরে প্রবেশ করেছিলাম। এই ঘরে বসে চোখের সামনে নিবিড় বর্ষার ক্লান্ত সন্ধ্যার ঘনায়মান ছায়া দেখলাম, শরৎকালের অসংখ্য তারকাখচিত দিগন্তছোঁয়া নির্মল আকাশ দেখলাম। হেমন্ত শেষ হয়ে এখন শীতের আমেজ পাওয়া যাচ্ছে। ১৯৪৫-এর ৪ নভেম্বর। ঘরে ঘরে কালীপুজো ও দেওয়ালির উৎসব। আজাদ হিন্দের পক্ষ থেকে দেশজোড়া বিপুল আন্দোলনে ও মহাত্মা গান্ধীর অমোঘ প্রভাবে ব্রিটিশ 'সিংহ' মাথা নিচু করল। ভাইসরয় মহাত্মাজীর অকাট্য যুক্তির কাছে হার মেনে আমাদের চারজনের ফাঁসির হুকুম রদ করলেন। যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ হল।


তাঁতের অন্ধকারের আড়ালে এই বদ্ধ প্রকোষ্ঠের লৌহকপাট সশব্দে উন্মুক্ত হল। আমরা ফাঁসির ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। পরস্পরকে আলিঙ্গন করলাম। রাজবন্দীর অভিনন্দন জানালেন।


যাবজ্জীবন কারাদন্ডের পালা শুরু হল। জয়হিন্দ!