কমরেড চিত্তব্রত মজুমদারের সি আই টি ইউ -র পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হওয়া এবং ভারতে নয়া উদারনীতিবাদের প্রবর্তন দুটোই সমসাময়িক। চিত্তদার শ্রমিক ফ্রন্টে বড় অবদানই হলো নয়া উদারনীতিবাদের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের রণকৌশল আয়ত্ত করার জন্য সি আই টি ইউ'র পশ্চিমবঙ্গের সংগঠনকে প্রস্তুত করা। এই কারণেই মতাদর্শগতভাবে এবং ব্যবহারিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে পরিস্থিতির উপযোগী করে সি আই টি ইউ'র রাজ্য কমিটিকে গড়ে তোলার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন।
১৯৯১ সাল থেকে ভারতে নয়া উদারনীতিবাদের অর্থনীতি প্রচলিত হয়। কিন্তু তার এক দশক আগে থেকেই আমাদের দেশে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। রাজ্যের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগেই পার্টির শ্রমিক ফ্রন্টের নেতা হিসাবে তিনি গোটা শ্রমিক শ্রেণীর প্রস্তুতির জন্য কলম ধরেছিলেন। এই সময়ে মার্কসবাদী পথে এবং অন্যান্য পত্রিকায় তিনি স্পষ্টভাবে নতুন পরিস্থিতির আক্রমণাত্মক ভূমিকা এবং তারই প্রতিরোধে শ্রমিকশ্রেণীর ভূমিকা কী হবে তা নির্দিষ্টভাবে উপস্থিত করেন। বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ সমাজতান্ত্রিক দেশ হলেও বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে পুঁজিবাদ যে টিকে গেলো এবং পুঁজির স্ফীতি হলো তার অনেক কারণের মধ্যে একটা বড় কারণ হলো প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবনীয় উন্নতি। যাকে এককথায় এখন বলা হয় প্রযুক্তি বিপ্লব বা তৃতীয় শিল্প বিপ্লব।
পুঁজিবাদ পুঁজির পিছনে ছোটে এবং প্রযুক্তির অবিরাম বিপ্লবী পরিবর্তন করে, মার্কসের এই বিশ্লেষণ গত শতাব্দীর শেষার্ধে তীব্র এবং প্রকট হয়ে উঠেছে। এই নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে ভারতের মতো দেশে শ্রমিকশ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত এবিষয়ে তিনি পার্টি এবং সি আই টি ইউ'র মধ্যে মতাদর্শগত সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। তিনি লেখেন, 'এ প্রসঙ্গে প্রথমেই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সমাজ বিকাশের ধারাকে অনুসরণ করে সামাজিক শ্রমের ফল আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা। উৎপাদনের কাজে আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার প্রয়োগের বিরোধিতা করা এ কারণেই শ্রমিকশ্রেণীর সর্বজনীন নীতি হতে পারে না। আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা নিজে থেকে শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণের কখনোই ক্ষতি করে না । বরং তা সামাজিক উৎপাদনের বিকাশ ঘটায় এবং সামাজিক শ্রমের লাঘব ঘটায়।
কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি বিদ্যার প্রয়োগ কার স্বার্থে এবং কাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণীর ও জনগণের মুখ্য বিচার্য বিষয় এটাই। কোনও দেশে আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা যদি পুঁজিপতি শ্রেণীর দ্বারা তাদের স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত হয়, সেক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণের স্বার্থে ভূমিকা পালন করতে পারে না। এক্ষেত্রে সামাজিক পরিবর্তন ঘটিয়ে, উৎপাদনের উপকরণের ওপরে ব্যক্তিগত মালিকানার বিলোপ ঘটিয়ে সামাজিক মালিকানা কায়েমের মাধ্যমেই শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণ আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যাকে সামাজিক উৎপাদনের বিকাশ এবং সামাজিক শ্রমের লাঘব করতে ব্যবহার করতে পারেন। সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন না ঘটালে শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণ কখনোই আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার সুফল ভোগ করতে পারে না' (মার্কসবাদী পথ, সপ্তম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, ১৯৯৮)।
এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, আমাদের দেশেও উৎপাদনের উপকরণের ওপর এবং প্রযুক্তির মালিকানা দেশী-বিদেশী পুঁজিবাদীদের নিয়ন্ত্রণে, কাজেই সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত উচ্চতর প্রযুক্তিবিদ্যা প্রয়োগের কুফল শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণের একটা বড় অংশকে ভোগ করতেই হয়। কাজেই সমাজ পরিবর্তনটাই হবে শ্রমিকশ্রেণীর মূল লক্ষ্য। এতো গেল রণনীতির কথা। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে জনগণ কী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবে? এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, 'আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার প্রয়োগের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করে শিল্পকে ধ্বংস করে দেওয়া ও সংগঠনকে দুর্বল করা শ্রমিকশ্রেণীর লক্ষ্য হতে পারে না। এই কারণেই সংগ্রাম পরিচালনা করতে শ্রমিকশ্রেণীকে অনেক কিছুই বিবেচনার মধ্যে আনতে হয়। আজ যে শিল্প গড়ে উঠেছে, তা আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যাকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। এর পাশাপাশি পুরাতন যে সমস্ত কারখানা একই জিনিস উৎপাদন করছে, তাদের পক্ষে নতুন কারখানার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব তা দেখা দরকার। পশ্চিমবাংলায় এমন বহু পুরাতন শিল্প আছে, আধুনিকীকরণ না হলে যেগুলির টিকে থাকা সম্ভব নয়। এসব ক্ষেত্রে বরং আধুনিকীকরণের দাবিই শ্রমিকশ্রেণী করে থাকেন' (মার্কসবাদী পথ, সপ্তম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, ১৯৯৮)।
No comments:
Post a Comment