Thursday, 9 December 2021

নবরত্ন - এস.কে.ব্রহ্ম

গান্ধীজি বোম্বাইতে একটি সভায় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আসবার খবর তিনি জানতে পারলেন। তিনি বেশ কিছু পূর্বেই সভাস্থলে উপস্থিত হলেন। সভাস্থলের সামনে কয়েক হাজার শ্রোতা অপেক্ষা করছিল। গান্ধীজি মঞ্চে উঠামাত্রই রণদিভে মঞ্চে চিৎকার করে গান্ধীজিকে বললেন, "আপনি আমাদের সাথে বেইমানী করেছেন কারণ আপনি ভগৎ সিংহের ফাঁসিকে সমর্থন করেছেন আর মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করে অন্তরীন রাখাটাও সমর্থন করেছেন।" এই কথা বলে রণদিভে মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন। গান্ধীজি কোন কথা বললেন না। সভাস্থলে একটা নিস্তব্ধতার মধ্যে হাজার হাজার শ্রোতা এটা লক্ষ করলেন।  

*************************************

ইতিমধ্যে অনেকটা আপোষের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হল। দেশ ভাগও হল। নেহেরু সরকার শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী মানুষের ন্যায্য দাবীতে লড়াই সংগ্রামের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনল। পার্টি লড়াই সংগ্রামকে জারী রাখার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু পার্টির সাধারণ সম্পাদক যোশীর বক্তব্য  সময় জঙ্গী আন্দোলন করলে সরকারী আক্রমণ আরও তীব্র হবে। অতএব এটা না করে নেহেরু সরকারকে কাজ করতে দেওয়া উচিৎ। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নেহেরু এবং তাঁর অনুগামীদের অপসারিত করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও দাঙ্গার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের অনুগামী সরকার গঠন করতে তৎপর। অতএব এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় হচ্ছে সংযুক্ত গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করা যেটা শুধু বামপন্থীদের দ্বারা গঠিত না করে গান্ধী থেকে নেহেরু, সমস্ত সোস্যালিস্ট শক্তি, কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য বামপন্থীদের নিয়ে গঠন করা এবং কাজ করা। যোশীর বক্তব্য নিয়ে পার্টির মধ্যে আলোড়ন শুরু হল। কেন্দ্রীয় কমিটি অবশ্য যোশীর বক্তব্য খারিজ করে দিল। এদিকে রণদিভে এবং ভবানী সেন ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভুল ব্যাখ্যা করে বললেন ভারতের স্বাধীনতা একটা প্রহসন। তাঁরা বললেন যে ভারতের জাতীয় বুর্জোয়ারা সাম্রাজ্যবাদী-জমিদার ও বুর্জোয়া ঐক্যের ছোট শরিক। এঁদের এই ব্যাখ্যা পার্টির মধ্যে আর এক সংকট সৃষ্টি করল।

*************************************    

তিনি ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের পরামর্শ দিতেন যে ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা, জাত-পাতের কোন প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। সকলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। তিনি আরও বলতেন যে ট্রেড ইউনিয়নে অথনৈতিক দাবী অবশ্যই স্থান পাবে কিন্তু সেটা যেন একমাত্র দাবী না হয়। ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের সমাজের সকলের স্বার্থে কর্মকান্ড চালাতে হবে। কৃষকদের স্বার্থে কাজ করতে হবে।  

*************************************    

দেশ স্বাধীন হওয়ার একদিন পূর্বে ১৪ই আগষ্ট, ১৯৪৭ এ নাম্বুদ্রিপাদ সহ অনেক কমিউনিস্টকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তিপ্রাপ্তদের তালিকায় গোপালনের নাম থাকা সত্ত্বেও তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয় না। গোপালন একটি জাতীয় পতাকা নিয়ে আরও কয়েকজনের সাথে কারাগারের মধ্যে ১৫ই আগষ্ট প্রাতঃকালে পতাকা উত্তোলন করেন। 

*************************************

১৯২৯ সালে পুলিশ 'মেছুয়া বাজার মামলায়" নিরঞ্জন সেন, সতীশ পাকড়াশী, পান্নালাল দাসগুপ্ত, সুধাংশু দাসগুপ্ত এবং আরও অনেককে গ্রেফতার করে। প্রমোদ দাসগুপ্ত গ্রেফতার হননি। এইসব বিপ্লবীদের আর্থিক অবস্থা খুবই সঙ্গীন ছিল। মামলার ব্যয় বহন করা কষ্টসাধ্য হচ্ছিল। বাইরে থেকে প্রমোদ দাসগুপ্ত এ ব্যাপারে যথাসাধ্য করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি আর্থিক সাহায্যের জন্য তৎকালীন খ্যাতনামা কংগ্রেস নেতা সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন কিন্তু বসু আর্থিক সাহায্যের ব্যাপারে সরাসরি আপত্তি জানান কারণ তিনি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলেন। 

*************************************

১৯২৭ সালে ভারতে সাইমন কমিশনের প্রতিনিধিরা আগমন করেন। কংগ্রেস সাইমন কমিশনের বিরোধিতা করে। সর্বত্র বিক্ষোভ শুরু হয়। কমিশন বেনারস পৌঁছালে রামমূর্ত্তি অন্যান্য ছাত্রদের সাথে নিয়ে এই কমিশনের বিরোধিতা করে আওয়াজ উঠান "সাইমন কমিশন গো ব্যাক"। রামমূর্ত্তি ভগত সিংয়ের প্রতিষ্ঠিত 'নওজোয়ান ভারত সভাতে' যোগদান করেন এবং তিনি এই সংগঠনে সক্রিয়তার সাথে কর্মকান্ড চালাতে থাকেন। তিনি 'জাতপাত তোড়ো মন্ডলের' সদস্য হন।

*************************************

১৯২০ সালের শেষে লাহোরে কংগ্রেস পার্টির সম্মেলনে রামমূর্ত্তি একজন দর্শক হিসেবে যোগদান করেন। এই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় যে প্রতিবছর ২৬শে জানুয়ারী ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করা হবে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রামমূর্ত্তি ও অন্যান্য ছাত্ররা বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কর্মসূচী নির্দিষ্ট দিনে পালন করেন।        

*************************************

রামমূর্ত্তি শেষ ট্রেড ইউনিয়ন সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কোয়েম্বাটুরে। ১৯৮৭ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর গুরুতর অসুস্থ হয়ে সরকারী জেনারেল হাসপাতালে ভর্ত্তি হন এবং আইসিইউতে রাখা হয়। ৪০ দিন ব্যাপী চিকিৎসার পর একটু সুস্থ হয়ে গৃহে প্রত্যাবর্ত্তন করেন। আবার একই হাসপাতালে ২৪শে নভেম্বর ভর্ত্তি হন। রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাঁকে নিয়মিত দেখতে যেতেন। রাষ্ট্রপতি বেঙ্কটরমন তাঁর সুস্থতা কামনা করে পুষ্পস্তবক প্রেরণ করেন। এই সময় কেন্দ্রীয় সরকার হঠাৎ দেশের মহান স্বাধীনতা যোদ্ধা হিসেবে ৯০ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করে। যার মধ্যে নাম ছিল নাম্বুদ্রিপাদ, হরকিষেণ সিং সুরজিৎ, রামমূর্ত্তি, বি টি রণদিভে, সমর মুখার্জী, রাষ্ট্রপতি ভেঙ্কটরমন ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জৈল সিং। সরকারী অফিসাররা যখন স্বাধীনতা সংগ্রামী পেনশনের কথা হাসপাতালে রামমূর্ত্তিকে জানাতে যান, অফিসারদের পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয় যে পার্টি ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে পার্টির কেউ স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে সরকার থেকে কোন পেনশন গ্রহণ করবে না। অফিসাররা বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যান।

*************************************

সুরজিৎ বিপ্লবী ভগৎ সিং প্রতিষ্ঠিত 'নওজোয়ান ভারত সভা'র সদস্য হন।

*************************************

পূর্ব ইউরোপ এবং সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর কিউবাতে খাদ্য সংকট দেখা দিল। সুরজিৎ পার্টির মধ্যে একটি প্রস্তাব দিলেন যে সিপিআই(এম) কিউবাতে ভাতৃপ্রতিম সাহায্য হিসাবে গম প্রেরণ করবে। পার্টির মধ্যে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন যে এত গম কি করে সংগ্রহ করা যাবে। পার্টি ১০ হাজার টন গম সংগ্রহ করল যাতে সুরজিতের অবদান বিশাল। মোট ৫ কোটি টাকা মূল্যের খাদ্যসামগ্রী নিয়ে জাহাজে করে সুরজিৎ কিউবাতে গেলেন এবং ফিদেল কাস্ত্রো নিজে জাহাজঘাটে উপস্থিত হয়ে সুরজিতের কাছ থেকে খাদ্যসামগ্রী গ্রহণ করলেন।

*************************************

শোকজ্ঞাপন পুস্তকে দেশের রাষ্ট্রপতি কে.আর.নারায়ণন লেখেন - "ই এম এস বিংশ শতাব্দীর এক বিশাল ব্যক্তিত্ব এবং একজন সংগ্রামী জাতীয়তাবাদী যিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে বিপ্লবী ধারাকে যুক্ত করেন। তিনি একজন সমৃদ্ধ চিন্তাবিদ যিনি সঠিক রণনীতি এবং কৌশল প্রয়োগ করে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে অগ্রগতির পথে নিয়ে গেছেন। তাঁর নাম ভারতীয় জনগণ চিরকাল স্মরণে রাখবে।"

*************************************

১৯৪৩ সালে বাংলায় এক ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ হয়। প্রায় ৪৫ লক্ষ মানুষের এতে মৃত্যু হয়। কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েকশত খিচুড়ী রান্নাঘর চালু করা হয় এবং সাধ্যমত মানুষকে এই খাদ্য সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও Bengal Medical Relief Co-ordination Committee গঠিত হয় যার সভাপতি হন ডাঃ বিধান রায় এবং সম্পাদক হন জ্যোতি বসু।

শহীদ-ই-আজম ভগৎ সিং

 ফাঁসি নয়, গুলি করে আমাদের হত্যা করুন 

(লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা ডিফেন্স কমিটি'র আইনবিদদের সিদ্ধান্ত ছিল ফাঁসি থেকে ভগৎ সিং এবং তাঁর দুই সহকর্মীকে বাঁচাতে ব্যাপক চেষ্টা চালাবার জন্য ফাঁসির দিনটি পিছিয়ে দেওয়া। এর একটাই পথ খোলা ছিল, গভর্ণরের কাছে দয়া ভিক্ষা করা। কিন্তু সবাই জানত ভগৎ সিংকে দিয়ে কিছুতেই তা করানো যাবে না। ১৯৩১ সালের ১৯শে মার্চ অ্যাডভোকেট প্রাণনাথ মেহেতা জেলে ওঁদের সঙ্গে দেখা করতে যান। ভগৎ সিং তাঁর কথা শুনতেন। তিনি বারবার মার্সি পিটিশন দেবার কথা বলেন এবং পিটিশনের ভাষা অপমানজনক হবে না বলে আশ্বাস দেন। অবশেষে ভগৎ সিং বলেন, "ঠিক আছে, লিখে আনুন"। পরদিন পিটিশনের খসড়া নিয়ে শ্রী মেহেতা জেলে দেখা করলে ভগৎ সিং বলেন 'মার্সি পিটিশন' তিনি নিজেই পাঠিয়ে দিয়েছেন। এটি ভগৎ সিং-এর সেই ঐতিহাসিক পত্র।)

প্রিয় মহাশয়,

সবিনয় নিবেদন এই যে, লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার শুনানির জন্য ভারতে বৃটিশ সরকারের সর্বোচ্চ আধিকারিক ভাইসরয় একটি বিশেষ অর্ডিনান্স বলে এক ট্রাইবুন্যাল গঠন করেছিলেন। এই ট্রাইবুন্যাল ১৯৩০ সালের অক্টোবর মাসে আমাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছে। আমার বিরুদ্ধে আনীত সবচেয়ে বড় অভিযোগ হল আমি সম্রাট পঞ্চম জর্জের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। ট্রাইবুন্যালের এই সিদ্ধান্ত থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রথমতঃ ইংরেজ জাতি এবং ভারতীয় জনতার মধ্যে যুদ্ধ চলছে এবং দ্বিতীয়তঃ আমি নিশ্চিতভাবে এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছি, সুতরাং আমি একজন রাজদ্রোহী যুদ্ধবন্দী। যদিও এই অভিযোগের ব্যাখ্যাকে অতিশয়োক্তির সীমায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তবুও আমি একথা না বলে পারি না যে, এর দ্বারা আমায় সম্মানিত করা হয়েছে।

প্রথম বিষয়টির ওপর আমি কিছুটা বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করতে চাই। আমার ধারণা প্রত্যক্ষভাবে কোন লড়াই এখনো শুরু হয়নি। যুদ্ধ শুরু হবার ব্যাপারে ট্রাইবুন্যালের মতামত কি, তা আমার জানা নেই। তবু আমি বিষয়টি স্বীকার করে নিচ্ছি এবং সেই সঙ্গে বিষয়টির সম্পর্কে একটি সঠিক ধারণা আমি দিতে চাই।

আমি এই কথা বলতে চাই যে, যুদ্ধ শুরু হয়েছে এবং যতদিন ভারতীয় জনগণ এবং শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার উপায়গুলির ওপর ক্ষমতাশালী ব্যক্তির একাধিপত্য কায়েম থাকবে ততদিন পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলবে, তা সেই ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ইংরেজ পুঁজিপতি, ইংরেজ শাসকই হন অথবা পুরোপুরি ভারতীয়ই হোন। যদি বিশুদ্ধ ভারতীয় পুঁজিপতিদের দ্বারাই কেবল গরীবের রক্ত শোষণ চলতে থাকে, তবুও পরিস্থিতির খুব বেশি পরিবর্তন হবে না। যদি আপনার সরকার কিছু নেতা এবং সমাজের কিছু প্রধান ব্যক্তির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে, যদি কিছু সুবিধা পাইয়ে দেয় অথবা উভয়পক্ষে একটা সমঝোতা হয়ে যায়, তাতেও পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হতে পারে না। জনগণের ওপর এসব কথার প্রভাব খুবই কম।

দেশের যুবকদের আরেকবার ঠকানো হল, একথা ভেবে আমি দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন নই। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা পথভ্রষ্ট হয়েছেন এবং ইংরেজের সঙ্গে আপোষ আলোচনার সময় সেইসব গৃহহারা, নিরাশ্রয়, নিবেদিত প্রাণ সংগ্রামীদের কথা ভুলে গিয়েছেন যাদের দুর্ভাগ্যক্রমে বিপ্লবী পার্টির সদস্য বলে তাঁরা মনে করেন। একথা ভেবেও আমি ভয় পাই না। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা বিপ্লবীদের শত্রু মনে করেন, কারণ তাঁদের বিচারে এরা হিংসায় বিশ্বাসী। আমাদের বীরাঙ্গনারা নিজেদের সব কিছুই বিসর্জন দিয়েছেন। তাঁরা নিজেদের স্বামীদের আত্মদানের বেদীমূলে প্রেরণ করেছেন। তাঁরা নিজেরাই নিজেদের নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু আপনার সরকার তাঁদের বিদ্রোহী মনে করে। আপনাদের দালালরা মিথ্যা কাহিনী তৈরী করে ওঁদের বদনাম দেয় এবং পার্টির সুনামের হানি ঘটাবার চেষ্টা করে। কিন্তু তবুও যুদ্ধ চলছে।

বিভিন্ন সময় এই যুদ্ধ ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করবে। কখনো প্রকাশ্য লড়াই চলবে, কখনো সংগ্রাম চলবে গোপনে। কখনো তা বিক্ষোভের স্তরে থাকবে আবার কখনো মরণপণ সংগ্রাম শুরু হবে। রক্তাক্ত সংগ্রাম হবে, না তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ পথে লড়াই হবে, তা নির্ভর করছে আপনি কোন পথে চলবেন তার ওপর। কাজের পথ আপনিই বেছে নিন। কিন্তু সংগ্রাম চলবেই, তুচ্ছ বিষয়গুলি অবহেলা করে, অর্থহীন নীতিবাগীশ আদর্শবাদকে উপেক্ষা করে নিরবিচ্ছিন্ন লড়াই চলবে। নবীন উদ্যম, অপরিসীম দৃঢ়তা, অপ্রতিরোধ্য সংকল্প নিয়ে সংগ্রাম চলবে যতদিন না সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যতদিন না বর্তমান সমাজব্যবস্থাকে উৎখাত করে সমাজের অবাধ সমৃদ্ধির ভিত্তিতে নতুন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা যায় এবং এই পথে সমস্ত ধরণের শোষণের অবসান ঘটানো যায়। এই পথেই মানব সভ্যতা এগিয়ে যাবে স্থায়ী শান্তির এক নতুন যুগে। অচিরেই শুরু হবে আখেরি লড়াই এবং চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে যাবে।

পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী শোষণের দিন ফুরিয়ে আসছে। এ সংগ্রাম আমরা শুরু করিনি, আমাদের জীবনাবসানের সঙ্গে সঙ্গে এ সংগ্রাম শেষ হয়ে যাবে না। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে,বর্তমান বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই সংগ্রাম অনিবার্যভাবে গড়ে উঠেছে। আমাদের মৃত্যুতে আত্মদানের পুষ্পমাল্যে আর একটি নতুন ফুল গাঁথা হবে। যতীন দাসের অতুলনীয় আত্মদান, ভগবতীচরণের হৃদয়বিদারক অথচ মহান আত্মদান এবং আমাদের প্রিয় সংগ্রামী সাথী আজাদের গৌরবময় আত্মদান ইতিমধ্যেই আত্মদানের সেই পুষ্পমাল্যটিকে বর্ণোজ্জ্বল করেছে।

আমাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে একথা বললে বোধ হয় আপনি দ্বিমত হবেন না যে, আপনি আমাকে ফাঁসি দিতে কৃতসংকল্প এবং আপনি তা করবেনই। আপনার হাতে ক্ষমতা আছে এবং আপনারা মনে করেন ক্ষমতার জোরেই কৃতকর্মের যৌক্তিকতা প্রমাণ করা যায়। আমরা জানি, 'জোর যার, মুলুক তার' - এই নীতি নিয়েই আপনি চলেন। আমাদের বিচারের প্রহসন এর জ্বলন্ত প্রমাণ।

আমরা বলতে চাই, আপনার আদালতের সিদ্ধান্ত হল আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছি অর্থাৎ আমরা যুদ্ধবন্দী। আমরা তাই যুদ্ধবন্দীসুলভ ব্যবহার চাই। আমরা বলতে চাই, ফাঁসি নয়, আমাদের গুলি করে হত্যা করা হোক। আপনার আদালতের বক্তব্যকে আপনি মূল্য দেন একথা প্রমাণের দায়িত্ব আপনার।

আমাদের অনুরোধ এবং আশা, আপনি অনুগ্রহ করে সেনাদপ্তরে আদেশ দিন, তারা যেন সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে আমাদের হত্যা করে।

নিবেদক 

ভগৎ সিং, রাজগুরু, শুকদেব

কীভাবে পশ্চিমবঙ্গে এই পরিবর্তন হলো - দীপক নাগ

গত শতকের ষাটের দশক থেকেই পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র চলছে। বামপন্থীরা যাতে নির্বাচনের মাধ্যমেও ক্ষমতার কাছাকাছি না আসতে পারে তার জন্য মার্কিনিরা দেদার টাকা খরচ করা সহ সমস্ত রকম চেষ্টা চালিয়েছে। ভারতে নিযুক্ত আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ডেনিয়াল প্যাট্রিক ময়নিহান ১৯৭৮ সালে 'এ ডেঞ্জারাস প্লেস' নাম একটি বই প্রকাশ করেন। বইটিতে তিনি বলেন, 'আমরা দুবার - মাত্র দুবার, ভারতের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছি। এজন্য আমরা একটা রাজনৈতিক দলকে টাকা দিয়েছিলাম। দুবারই রাজ্য (বিধানসভা) নির্বাচনের আগে কমিউনিস্টদের সম্ভাব্য বিজয় ঠেকানোর জন্যই আমরা এটা করেছিলাম। একবার কেরালা আর একবার পশ্চিমবঙ্গে - যেখানে কলকাতা অবস্থিত - আমরা টাকা দিয়েছিলাম" (পৃ: ৪১)। ১৯৫৭ সালে কেরালা বিধানসভা নির্বাচনে যাতে বামপন্থীরা সরকার গঠন করতে না পারে, তার জন্যই ময়নিহান টাকা দিয়েছিলেন। আর ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের সম্ভাব্য বিজয় ঠেকানোর জন্যই আমেরিকা টাকা ঢেলেছিল। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধি ১৯৫৭ সালে ছিলেন কংগ্রেসের সভানেত্রী, আর ১৯৬৭ সালে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। বহুল প্রচারিত ময়নিহানের এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে কংগ্রেস কিন্তু কোনো আপত্তি জানায়নি। স্বাধীনতার পর থেকেই কমিউনিস্টরা যাতে ভারতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা না নিতে পারে, তার জন্য প্রত্যেক নির্বাচনের আগে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে। দিব্যি কেটে ময়নিহান দুবার ভারতের নির্বাচনে আমেরিকার হস্তক্ষেপের কথা বললেও ব্যাপারটা যে সেখানেই থেমে থাকেনি, পরবর্তী অনেক ঘটনাতেই তার প্রমাণ মেলে।

ইন্দিরা গান্ধি হত্যার পর ১৯৮৫ সালে ভারতে মধ্যবর্তী নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনেই তখন পর্যন্ত রাজ্য রাজনীতিতে সম্পূর্ণ অপরিচিত মমতা ব্যানার্জি বামপন্থীদের দুর্গ বলে পরিচিত যাদবপুর কেন্দ্র থেকে সবাইকে অবাক করে দিয়ে জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনের আগে কী ঘটেছিলো রুস্তেম গ্যালুইলিন-এর ' দ্য সি আই এ ইন এশিয়া' (১৯৮৮) থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি উল্লেখ করেন : "অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপ-সেনাপ্রধান এস কে সিং পশ্চিমবঙ্গে সিবিআই-র কাছে এক বিবৃতি দেন। সিং স্বীকার করেন যে, আমেরিকার রাষ্ট্রদূত জর্জ শেরম্যান একজন মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির ছদ্মবেশে তাঁর কাছে এক প্রস্তাব নিয়ে কলকাতায় আসেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাঁকে ১৯৮৫ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি সাধারণ নির্বাচনের আগে নিজস্ব কর্মসূচি অনুযায়ী একটা আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার কথা বলেন। রাজনৈতিক দলটি মার্কিন দূতাবাসের ছত্রছায়ায় কাজ করবে। এই দলটিকে সমস্ত বামপন্থী রাজনৈতিক দলের এবং ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিপক্ষ শক্তি হিসেবে কাজ করতে হবে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেনারেলকে জানান, দল গড়ার জন্য সমস্ত টাকা তিনিই খরচ করবেন। এই ঘটনার কথা উল্লেখ করে 'দ্য হিন্দুস্তান টাইমস' পত্রিকা বিষয়টিকে রাজনৈতিক উপায়ে হোয়াইট হাউসের নির্দেশ জারির চেষ্টা বলে উল্লেখ করে"। এর আগে ১৯৮০ সালের ১৮ ডিসেম্বর 'পিপলস ডেমোক্রেসি' পত্রিকায় ভারতের রাজনীতিতে সিআইএ-র হস্তক্ষেপ সম্বন্ধে একটা বেশ বড় প্রবন্ধ ছাপা হয়। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত কার মাধ্যমে এবং কীভাবে কার্যকর করা হয়, তা নিয়ে নানা কথা বাজারে চালু আছে। তবে মার্কিন দূতাবাসের তরফ থেকে যে বিভিন্ন সময়ে মেদিনীপুর, বীরভূম, দার্জিলিঙ, কলকাতা, নন্দীগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে মাওবাদী-তৃণমূলসহ বিভিন্ন মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে একাধিক সভা করা হয়েছে তা নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছে। মার্কিনিরা পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে যে কতখানি উৎসাহী উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্য থেকেই তা স্পষ্ট হয়। রাজ্যের নির্বাচনের মাসখানেক আগেই 'দ্য হিন্দু' পত্রিকায় ২১ এপ্রিল, ২০১১ প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে, ২০০৯ সালের মে মাসে লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের কিছু আসন বেড়ে যাওয়ার পর ২০ অক্টোবর কেবল ২৩০৩৫৩ মারফত আমেরিকার কনসাল জেনারেল বেথ এ পেইন তাঁর সরকারকে পশ্চিমবঙ্গের আগামী বিধানসভা নির্বাচনে আমেরিকার করণীয় কাজ সম্বন্ধে কিছু পরামর্শ দেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি কতখানি সফল হবেন, তা নিয়ে সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও পেইন জানান, "মমতা ব্যানার্জি বর্তমানে রেল দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে এখনও আমেরিকা সফরে না গেলেও মার্কিন সরকারের উচিত পশ্চিমবাংলার "ভাবী মুখ্যমন্ত্রী" হিসেবে তাঁকে মদত দেওয়া চালিয়ে যাওয়া। তাঁর দল তৃণমূল কনফারেস প্রকাশ্যে কখনও আমেরিকার বিরোধিতা করেনি। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে যে, ব্যানার্জি পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ সরকার বর্তমান সিপিআই(এম) পরিচালিত সরকারের চাইতে আমেরিকার প্রতি বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ হবে।" পশ্চিমবাংলা বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে ২০১১ সালের মে মাসে আর ২০০৯ সালেই কলকাতার মার্কিন কনসাল জেনারেল মমতা ব্যানার্জিকে রাজ্যের "ভাবী মুখ্যমন্ত্রী" হিসেবে চিহ্নিত করে আমেরিকায় বার্তা পাঠাচ্ছেন এবং মদত চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন। ব্যাপারটা কী আমাদের একটুও ভাবায় না? তারপর মার্কিন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিন্টন ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের নজিরবিহীনভাবে ভারতের কোন একটা রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎকার কী নিছকই একটা সহজ-সরল ব্যাপার?

আচ্ছা, কোন বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রী যদি জাল 'ডক্টরেট' ডিগ্রিধারী হতেন কিংবা সংবিধান হাতে 'বাপের জমিদারি' বলে চিৎকার করে কোনো বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাম এমএলএ-রা যদি অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করতে করতে বিধানসভা ভাঙচুর করতেন - তাহলে বাংলার কথা বাদ দিন, সারা দুনিয়াতেই বামপন্থীদের কী বলে ডাকা হতো? তাছাড়া গত আড়াই বছরে রাজ্যে যা ঘটেছে যেমন, পার্ক স্ট্রিট, রায়গঞ্জ, ভাঙড়, কামদুনি, ফেসবুক, সারদা, মগরাহাট, কালীঘাট থানা, প্রেসিডেন্সি কলেজ, স্কুল, সার্ভিস কমিশন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগ, ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, পঞ্চায়েত নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচনে ছাপ্পা ভোট, স্কুল-কলেজের নির্বাচনে দুষ্কৃতী হামলা, পুলিস হেপাজতে সুদীপ্ত গুপ্তের হত্যা, ১৪২ জনের মতো বামপন্থী কর্মী হত্যা, হাজার হাজার কর্মী-নেতার ঘরবাড়ি ছাড়া, মিথ্যে মামলা ইত্যাদি - এর দশ ভাগের এক ভাগ ঘটনাও যদি বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রীর আমলে ঘটতো - তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াতো, একবার কেউ কল্পনা করতে পারেন? কী হতো তাহলে সংবাদ মাধ্যমগুলোর ভূমিকা? এখন প্রতিদিন গণতন্ত্র-জবাই চলছে। বামপন্থীদের প্রতিবাদ, আন্দোলন - কোন কিছুকেই দাগ কাটতে দেওয়া হচ্ছে না। একটা ঘটনাকে অন্য ঘটনা দিয়ে চাপা দেওয়া হচ্ছে। বিধানসভা তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। তথাকথিত গণতন্ত্রপ্রেমীরা নীরব। কিন্তু কেন? বুর্জোয়া গণতন্ত্রে সরকারের পৰিৱৰ্তন কোন বড় ঘটনা নয়। এর আগেও দুবার বামপন্থীদের সরকার থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর একবার সরকার গঠন করতেই দেওয়া হয়নি। কিন্তু যে প্রশ্নটা সামনে আসছে তা হলো, কীভাবে এই পরিবতন হলো? ২০০৬ সালে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে মোট ১৯৪৫৬৭৭৬ বৈধ ভোটের মধ্যে বামফ্রন্ট পায় ১৯৮০০৪২৫ ভোট। শতকরা ৫০.১৮ জন ভোটার বামফ্রন্টের কাজে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তৃণমূল-বিজেপি জোট পায় শতকরা মাত্র ২৮.৭৭ ভোট। এই নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক মানুষের সমর্থনে বামফ্রন্ট জয়লাভ করার ঠিক পরেই রাজ্যে কী এমন ঘটলো? ২০০৬ - ২০১১ সালের মধ্যে বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যের লক্ষ লক্ষ বেকারের কাজের ব্যবস্থার জন্য সিঙ্গুর, শালবনী, নয়াচর প্রভৃতি জায়গায় মৌলিক শিল্প গড়ে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করে সফলতার দোরগোড়ায় প্রায় পৌঁছে যায়। এটা যদি কোনো 'ভুল' বা 'অন্যায়' হয়, তা হলে অবশ্য আলাদা কথা। সমস্ত ক্ষেত্রেই বাধা দিয়ে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে লক্ষ লক্ষ মানুষের পেটের ভাত কেড়ে নেবার ব্যবস্থা করা হলো। বাংলার মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা এবং যুব সমাজের চরম সর্বনাশ করেও তৃণমূল ২০০৬-এর চাইতে ৮০ লক্ষের কিছু বেশি ভোট বাড়িয়ে ফেললো। কিন্তু কীভাবে? বিশেষ কোনো শক্তির মদত বা বিশেষ কোনো কৌশল গ্রহণ না করে যে একাজ করা সম্ভব নয়, পৃথিবীর সব চাইতে বোকা মানুষটিও তা বুঝতে পারে।

*****************************************************

এনজিও বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর প্রকৃত উদ্দেশ্য ও ভূমিকা নিয়ে সারা পৃথিবীতে বরাবরই একটা সন্দেহ রয়ে গেছে। সমাজবদ্ধ প্রাণী হিসেবে মানুষ মানুষের জন্য ভাববে বা সমাজটাকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে সাহায্য করবে - এটাই তো স্বাভাবিক। কারণ এই শ্রেণিবিভক্ত সমাজব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় কয়েকজন মানুষ সমাজের প্রায় সমস্ত সম্পত্তির মালিক। আর সম্পত্তি বলতে যা বোঝায়, বেশিরভাগ মানুষেরই তা নেই। তাই ব্যবস্থার পরিবর্তন চাই। ১৮৪৫ সালে সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্কস তাঁর বিখ্যাত রচনা 'থিসিস অন ফয়েরবাখ'-এ প্রথম উল্লেখ করেন : 'দার্শনিকেরা কেবল নানাভাবে জগৎকে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু আসল কথা হলো সেটাকে পরিবর্তন করা'। কমিউনিস্টরাই প্রথম সমাজ পরিবর্তনের কথা বলে এবং তা করে দেখায়। জন্মলগ্ন থেকেই পুঁজিপতিরা মুনাফার জন্য মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ তৈরি করার চেষ্টা করে চলেছে। তারা সঙ্ঘবদ্ধ শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষের ওপর নানা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। এনজিও-দের টাকার মূল উৎস সাম্রাজ্যবাদী তহবিল। সাম্রাজ্যবাদীরা অন্য দেশের শ্রমিক কৃষক ও সাধারণ গরিব মানুষের মঙ্গলের কথা ভাববে, তা কুমীরের মার পুত্রশোকের মতোই অবিশ্বাস্য। আশির দশক থেকেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এই 'ভাড়াটে সমাজসেবার ব্যবসার' রমরমা বাজার হলেও এর সূচনা কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই। ঐ বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই লেনিন 'সাম্রাজ্যবাদ - পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর' নামক তাঁর বিখ্যাত বইটি প্রকাশ করেন। মহাজনী পুঁজি বৃদ্ধি ও পুঁজি রপ্তানি - এই দুটো হলো সাম্রাজ্যবাদের মূল বিষয়। পুঁজি রপ্তানি বা বাজার দখলের জন্য অন্য দেশের সরকার এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী দেশের একটা সুন্দর ভাবমূর্তি তৈরি করা প্রয়োজন। কমিউনিস্টরা সাম্রাজ্যবাদের শত্রু। তারা শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষের সুখে দুঃখে সবসময়ই পাশে থাকে। কমিউনিস্টরাই এই শোষণমূলক সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে সাধারণ মানুষকে নতুন সমাজ গোড়ার স্বপ্ন দেখায়। বিপ্লবের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র গঠিত হওয়ার পর থেকেই পুঁজিবাদ প্রমাদ গুণতে শুরু করে।

কমিউনিস্টদের পালের হাওয়া কেড়ে নেওয়ার জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা নতুন কৌশল নেয়। মার্কিনি তেল সাম্রাজ্যের অন্যতম কর্ণধার জন রকফেলার এবং ইস্পাত শিল্পের একচেটিয়া কারবারি অ্যান্ডু কার্নেগি কমিউনিস্টদের বিকল্প হিসাবে জনসেবামূলক কাজের জন্য যথাক্রমে রকফেলার ফাউন্ডেশন এবং কার্নেগি ফাউন্ডেশন তৈরি করেন। উদ্দেশ্য : সমাজসেবার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মন থেকে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ঘৃণা কমিয়ে দিয়ে কমিউনিস্ট-বিরোধী ঘৃণা জাগিয়ে তোলা। তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই কয়েকশো ফাউন্ডেশন গড়ে ওঠে। ১৯৩৬ সালে আমেরিকার বিখ্যাত ফোর্ড মোটর কোম্পানির উদ্যোগে গড়ে ওঠে ফোর্ড ফাউন্ডেশন। একইভাবে কেলগ ফাউন্ডেশন, গ্রান্ট ফাউন্ডেশন, ফ্রিডম রিসার্চ ফাউন্ডেশন, ব্রাদার্স ব্রাদার ফাউন্ডেশন, আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন, এশিয়া ফাউন্ডেশন ইত্যাদি তৈরি করা হয়। ভারতসহ তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে 'ফেলোশিপের' নামে সম্ভাবনাময় শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী প্রভৃতি বুদ্ধিজীবীদের মগজ ধোলাইয়ের জন্য আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া ছিল এইসব ফাউন্ডেশনের অন্যতম কাজ। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিলাভ করে। ফলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আশঙ্কিত হয়ে পড়ে। শুরু হয় কমিউনিস্ট বিরোধী নানা ষড়যন্ত্র। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোকে বাঁচাতে আমেরিকার স্বরাষ্ট্রসচিব জর্জ মার্শাল এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এটাই মার্শাল প্ল্যান নামে পরিচিত। এরই অঙ্গ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় 'কেয়ার' বা কো-অপারেটিভ ফর আমেরিকান রিলিফ এভরিহোয়ার। এই সংস্থার মাধ্যমেই আমেরিকা তার উদ্বৃত্ত গম বা খাদ্যদ্রব্য সারা পৃথিবীতে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে পাঠাতে শুরু করে। পি এল ৪৮০-র কথা এখনও অনেকের মনে আছে। ভারতসহ ভূখা-মানুষের দেশগুলোতে এই সাহায্য টোপ হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। কমিউনিস্ট মতাদর্শের অগ্রগতি রোধ করে তার মূল লক্ষ্য।

*****************************************************

ভিয়েতনাম যুদ্ধের খলনায়ক মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব রবার্ট ম্যাকনামারা বিশ্বব্যাঙ্কের সভাপতির দায়িত্ব নেবার পর থেকেই ভারতসহ তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দান বা সেবার মাধ্যমে 'স্বেচ্ছামূলক সেবা প্রতিষ্ঠানগুলির আন্দোলন' গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন।

*****************************************************

বিশিষ্ট মার্কিন-রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাইনর উইনার বিভিন্ন দেশের বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠীর মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মার্কিন অনুচর নিয়োগ করার দায়িত্ব পালন করেন। এইসব বুদ্ধিজীবীদের কাজের সুবিধার জন্য 'পার্টিবিহীন রাজনৈতিক সংগঠন' বা 'পার্টিবিহীন রাজনৈতিক আন্দোলন' গড়ে রোলার কথা বলা হলো।

*****************************************************
ম্যাকনামারা বা মাইরন উইনারের অ্যাকশন গ্রুপের তত্ত্বকে ভারতের মাটিতে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ভারতীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রজনী কোঠারী বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন।
*****************************************************
পরমাণু চুক্তি নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তীব্ৰ বিরোধিতা করার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হচ্ছে। আদিবাসীদের স্বার্থ দেখার নাম করে গরিব, নিরপরাধ আদিবাসীদের খুন করা হচ্ছে। আর সবই হচ্ছে মাওবাদীদের নাম করে। এ এক অদ্ভুত সমীকরণ। লালঝাণ্ডাকে যারা ঘৃণা করে, লালঝাণ্ডায় যাদের এলার্জি আছে, তাদের সঙ্গে তথাকথিত মার্কসবাদীদের আঁতাত। ম্যাকানমারা, মাইরন উইনার ও রজনী কোঠারীর সেই বিখ্যাত তত্ত্ব - হতাশাগ্রস্ত কমিউনিস্টদের সঙ্গে নিয়েই কমিউনিস্টদের ওপর আক্রমণ সংগঠিত করতে হবে। বামপন্থীদের স্লোগানসহ রাজ্যের বর্তমান বিরোধীদের প্রায় সব কিছুই ধার করা। তৃণমূল নামটাও ম্যাকানমারার 'গ্রাসরুট'-এর বাংলা অনুবাদ। পরিবর্তন-এর স্লোগানটিও তাঁর। আশ্চর্যজনকভাবে উগ্রবামপন্থী ও উগ্রদক্ষিনপন্থী সবাই এসে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে জড়ো হলেন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-লালগড় ষড়যন্ত্রের অংশীদার হিসাবে।
*****************************************************
তথাকথিত মাওবাদী সংগঠনের জন্মও কিন্তু আমেরিকায়। ১৯৭৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান দেঙ জিয়াও পিঙ আমেরিকা সফরে এলে তাঁর বিরুদ্ধে মাওবাদীদের নেতা বব অ্যাডকিয়ান হোয়াইট হাউসের সামনে বিক্ষোভ দেখান। শোনা যায় তাঁকে গ্রেফতার করে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকে দীর্ঘ ২৫ বছর তাঁর কোন হদিস পাওয়া যায়নি। তাঁর বিদেশে আত্মগোপন করার কথা শোনা যায়। কিছুদিন আগে তাঁর বক্তৃতার চার-ডিস্কের এক সিডি-র হদিশ মিলেছে। মাওবাদীদের উদ্যোগেই 'রেভোলিউশনারি ইন্টারন্যাশনাল মুভমেন্ট (রিম) গঠিত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গোরিলা বাহিনী তৈরি করে সশস্ত্র অভ্যুত্থান করাই এর উদ্দেশ্য বলে জানানো হয়েছে। ভারতের মাওবাদীরাও সেই অর্থে আমেরিকার মাওবাদীদের মতোই মাও-জে দঙ-এর নামে তাঁর চিন্তাধারার বিরোধী কাজকর্ম চালাচ্ছে। বিপ্লবের নামে প্রতিবিপ্লবীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলছে সর্বহারাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ।
*****************************************************

Wednesday, 8 December 2021

কাশ্মীর যুক্তি তর্ক সত্য - শমীক লাহিড়ী

প্রশ্ন-৫) ভারতবর্ষের সংবিধানে উল্লিখিত ৩৭০নং ধারা কি সাময়িক?

উত্তর) সংবিধানের একবিংশ অংশে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ হল ৩৭০ নং ধারা। এটা ঠিক এর শিরোনামে লেখা আছে এটা সাময়িক, পরিবর্তন সাপেক্ষ এবং বিশেষ বিধান। তাই অনেকেই ব্যাখ্যা করেন এই ধারাটি সাময়িক সময়ের জন্য রচিত হয়েছিল। জম্মু-কাশ্মীরের গণপরিষদ এবং পরবর্তীতে জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভা এই ধারার পরিবর্তন, বিলোপসাধন অথবা একই রূপে রেখে দিতে পারে। জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা এই ধারাটিকে বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, ফলে এটি সাময়িক নয়। এই নিয়ে স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে অনেক বিতর্ক দেখা যায়। ১৯৬৯ সালে সম্পৎ প্রকাশ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট এই ধারাকে সাময়িক আখ্যা দেওয়ার আবেদনকে সরাসরি নাকচ করে। দিল্লী হাইকোর্টে কুমারী বিজয়লক্ষ্মী একটি মামলায় দাবী করেন ৩৭০নং ধারা সাময়িক এবং এই ধারাটিকে বহাল রাখা আসলে সংবিধানের প্রতি জালিয়াতি। দিল্লী হাইকোর্ট এই মামলাও খারিজ করে দেয়। ২০১৮ সালের ৩রা এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট আর একটি মামলায় সরাসরি জানিয়ে দেয়, শিরোনামে সাময়িক শব্দটি লেখা থাকলেও এই ধারাটি সাময়িক নয়। বিভিন্ন সময় এই রায়গুলিতে আদালত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় এই ধারাটির শিরোনামে 'সাময়িক' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল তৎকালীন গণপরিষদকে প্রস্তাবিত ধারাটি সংশোধনী-সংযোজনী অথবা বিলোপ সাধনের অধিকার দেওয়ার জন্য। কিন্তু তৎকালীন গণপরিষদ এবং পরবর্তীতে বিধানসভা এই ধারাটি বজায় রাখার পক্ষে মত দেয়, ফলে এটি 'সাময়িক' নয়।


প্রশ্ন-৬) সংবিধানের ৩৭০নং ধারাটি কি বিলোপ করা যেতে পারে?

উত্তর) এটা ঠিক উপধারা ৩৭০(৩) অনুযায়ী ৩৭০নং ধারা বিলোপ করা যেতেই পারে রাষ্ট্রপতির আদেশের ভিত্তিতে। তবে এই আদেশের জন্য জম্মু-কাশ্মীরের গণপরিষদের সম্মতি প্রয়োজন। কিন্তু ১৯৫৭ সালের ২৬শে জানুয়ারী সেই গণপরিষদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাই সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অনেকের মত এই ধারা বিলোপ করা যায় না। আবার একাংশের ব্যাখ্যা এটি বিলোপ করতে হলে রাজ্য বিধানসভার সম্মতি প্রয়োজন। বর্তমান বিজেপি সরকার সংবিধান বিশেষজ্ঞদের এই সব মতামতের তোয়াক্কা না করে, জম্মু-কাশ্মীরের জনসাধারণকে অন্ধকারে রেখে, সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বকে কারাগারে নিক্ষেপ করে, ৭ লক্ষ ৪০ হাজার সৈনিকের বন্দুকের ডগায় সেখানকার মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে রেখে জবরদস্তি এই আইন পাশ করানোর চেষ্টা করেছে। এটা গণতন্ত্র? দেশের উন্নতির জন্য কি ৩৭০নং ধারা কোন অন্তরায় সৃষ্টি করেছে? দেশজোড়া বেকার, অসংখ্য শ্রমিক ছাঁটাই, আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি এইসব সমস্যার দিকে নজর না দিয়ে বন্দুকের ডগায় জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের কোনও মতামত না নিয়ে এই কাজ করার অর্থ কি? এটা দেশের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি সমাধানে ব্যর্থ মোদী সরকারের দৃষ্টি ঘোরানোর প্রয়াস মাত্র। দেশের বাকি ১০টি রাজ্য বিশেষ অধিকার নিয়ে চলতে পারে অথচ জম্মু-কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া হলো কেন? একাজ কি সন্ত্রাসবাদীদের আরো সাহায্য করবে না? পাকিস্তান কাশ্মীর প্রশ্নে বরাবর আন্তর্জাতিক মহল থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল প্রধানত ২টি কারণে - (ক) ভারতবর্ষ জম্মু-কাশ্মীরের মানুষকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দিয়েছিল (খ) পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদীদের জম্মু-কাশ্মীরে ব্যবহার করলেও, ভারতবর্ষ কখনও পাক অধিকৃত কাশ্মীরে কোন জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে মদত দেয়নি। ভারতবর্ষ বরাবরই শান্তিপূর্ণ-দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের পক্ষপাতী। এখন বিজেপির এই পদক্ষেপে জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাতক হিসাবে ভারতবর্ষ চিহ্নিত হবে। ৩৭০নং ধারা বিলোপ করলে ভারতবর্ষের বাকি অংশের কোন মানুষের লাভ হবে? ভারতবর্ষের বেকার যুবক কাজ পাবে? শ্রমিকের মজুরী বাড়বে? জিনিসপত্রের দাম কমবে? দেশে গরীবি কমবে? আসলে সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ মোদী সরকার ধর্মের নামে মানুষকে বিভক্ত করে রাখতে চাইছে, আর এই প্রশ্নে জম্মু-কাশ্মীর, তাঁর হাতের তুরুপের তাস। তাই ভারতবড়হ বা পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী আভ্যন্তরীন বিপদে পড়লেই, দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য জম্মু-কাশ্মীর সমস্যা পরিকল্পিতভাবে সামনে আনে।

প্রশ্ন-১২) সংবিধানের ৩৭০নং ধারা বিলোপ কি প্রয়াত শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের দাবী মেনে?

উত্তর) সংবিধানের ৩৭০নং ধারা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সময় শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন কংগ্রেস দলের সদস্য, সংসদেরও সদস্য এবং ভারতের সংবিধান রচনার জন্য তৈরী গণপরিষদেরও সদস্য। সংসদে অথবা গণপরিষদের কোনও অধিবেশনে শ্রী মুখার্জী ৩৭০নং ধারা গ্রহণ করার সময়ে আপত্তি জানাননি। সংসদে বিভিন্ন বিষয়ে তিনি অনেক বক্তৃতা করেছিলেন কিন্তু এই বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে তিনি কোন বক্তৃতা সংসদে অথবা গণপরিষদে করেননি। বরং ১৯৫৩ সালের ৯ই জানুয়ারী জওহরলাল নেহেরুকে লেখা একটি চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন - "আমাদের নিঃসঙ্কোচে শেখ আব্দুল্লার নেতৃত্বে বিশেষ সুবিধাসহ কাশ্মীর উপত্যকার অস্তিত্ব মেনে নেওয়া দরকার, যতদিন পর্যন্ত তিনি সেই বিশেষ ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন মনে করবেন"। তবে আশ্চর্যজনকভাবে নেহেরু মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের পর পুরানো অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ উল্টো পথে হেঁটে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার বিষয়টি ভারতীয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিরোধীতা শুরু করেন। দেশের শিল্পমন্ত্রী থাকাকালীন শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ৩৭০নং ধারার বিরোধিতা করেননি কারণ তিনি জানতেন আরও অনেকগুলি করদ রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ৩৭১নং ধারা যুক্ত হতে চলেছে, সংবিধানে এদের বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার জন্য। ৩৭০নং ধারার বিরুদ্ধে বিদ্বেষকে তাই ব্যবহার করা হয়েছে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করবার এবং মুসলমান বিরোধী জিগীর তোলাবার জন্য। এরা ৩৭১নং ধারার বিরোধীতা করে না কারণ এটিকে ব্যবহার করে হিন্দু-মুসলমান জনগণকে বিভক্ত করার সুযোগ নেই।

তৎকালীন কাশ্মীরে প্রবেশ করতে গেলে পারমিট নেওয়ার প্রয়োজন হত। শ্রী মুখার্জী 'এক দেশ, এক বিধান, এক নিশান, এক প্রধান' এই স্লোগানকে সামনে রেখে বিনা পারমিটে আইন ভেঙ্গে কাশ্মীর অভিযানে যান এবং গ্রেপ্তার বরণ করেন। একজন সাংসদ কি উদ্দেশ্যে বিনা পারমিটে গায়ের জোরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছিলেন! সাংসদ হিসাবে অনুমতি চাইলেই তো তিনি পারমিট নিয়েই সেখানে যেতে পারতেন। দুঃখজনকভাবে জেলবন্দী থাকা অবস্থাতেই তাঁর মৃত্যু হয়।

প্রশ্ন-১৩) ভারতীয় জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কি অবদান ছিল ভারত গঠনে?

উত্তর) ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে রাউ কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী তৎকালীন আইনমন্ত্রী শ্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল হিন্দু কোড বিল সংসদের সামনে পেশ করেন। দেশভাগ এবং স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম আইনমন্ত্রী ড. বি.আর.আম্বেদকর নেহেরুর মন্ত্রিসভার সামনে এই বিল পেশ করেন এবং তা সিলেক্ট কমিটির বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়। ১৯৪৮ সালের ১২ই আগস্ট সিলেক্ট কমিটির রিপোর্ট ড. আম্বেদকর সংসদে পেশ করেন এবং ৩১শে আগস্ট সংসদের সম্মতির জন্য উত্থাপন করেন। ১৯৪৯ সালে ২৯শে ডিসেম্বর বিলটি পেশ করার কথা থাকলেও হিন্দু মৌলবাদীদের প্রবল বিরোধীতার জন্য সেটি সংসদে পেশ করা হয় ১৯৫১ সালে ৫ই ফেব্রুয়ারী। কিন্তু শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সহ হিন্দুত্ববাদীদের প্রবল বিরোধীতায় নেহেরু সরকার কিছুটা পিছু হঠতে বাধ্য হয়।

কি ছিল এই বিলে - (ক) হিন্দু বিবাহ আইন সংশোধন, (খ) হিন্দু উত্তরাধিকার সম্পত্তি সংক্রান্ত আইন, (গ) হিন্দু নাবালক এবং অভিভাবকত্ব আইন, (ঘ) হিন্দু দত্তক গ্রহন এবং পরিচর্যা সংক্রান্ত আইন। এই আইনগুলির মাধ্যমে হিন্দুদের বহু বিবাহ রদ, হিন্দু মহিলাদের বিবাহ বিচ্ছেদ করবার অধিকার, বাল্যবিবাহ রদ, হিন্দু নারীদের সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি পরিবর্তন আনার চেষ্টা হয়েছিল। শ্রী মুখোপাধ্যায় এই আইনের বিরোধীতা করতে হয়ে সংসদে বলেন - 'কোনভাবেই মহিলাদের বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার দেওয়া যাবে না'। বহু বিবাহের অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে তার সওয়াল ছিল কেবলমাত্র হিন্দুদের থেকে এই অধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না। তাঁর সহযোগী মদনমোহন মালব্য ভিন্ন জাতের মধ্যে বিবাহের ক্ষেত্রে প্রবল বিরোধীতা করে বলেছিলেন - 'একই জাতির মধ্যে বিবাহ হওয়া উচিত কারণ একই ধরণের খাদ্যাভ্যাস এবং অন্যান্য অভ্যাস তাদের মধ্যে মেলামেশা করতে সুবিধা দেয় এবং ব্যক্তি ও জাতির স্বাস্থ্য এবং সুখ বজায় রাখে'। এই হিন্দু কোড বলের বিরোধীতা করে তাঁরা আরও বলেছিলেন - 'যেহেতু বিবাহ হিন্দু সমাজে একটি গভীর দর্শনের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে এবং এটি মৌলিক এবং পবিত্র অধিকার হিন্দুদের, তাই হিন্দু বিবাহ আইনের সংশোধন কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না'। অর্থাৎ বহু বিবাহের পক্ষে এরা সওয়াল করেছেন।

শ্রী মুখার্জী উচ্চবর্ণদের এই আইনের আওতার বাইরে রাখার পক্ষে জোরালো সওয়াল করে বলেছিলেন - '(উচ্চবর্ণের) যারা উত্তরাধিকার সূত্রে বহু বৎসর ধরে এই ধারাবাহিকতা মেনে চলছেন তারা কিছু কম দেশপ্রেমিক নন অন্যান্য (নিচু) জাতির তুলনায়। এদের উপর জবরদস্তি নতুন আইন চাপিয়ে দেবেন না'। ড. আম্বেদকরের তীব্র আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত বলেন - তাহলে সমগ্র ভারতবাসীর জন্য এই আইন প্রয়োগ করা হোক। শ্রী মুখোপাধ্যায় এই আইনের বিরোধীতা করতে গিয়ে অভিযোগ তুলেছিলেন হিন্দুদের আইনের এই পরিবর্তনে হিন্দু ধর্ম নাকি আক্রান্ত হচ্ছে। জবাবে ড. আম্বেদকর বলেছিলেন - 'আমি ওনাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই কেউ স্ত্রীকে মারধর করলে সেটা কি ধর্মীয় পরম্পরার নামে মেনে নেওয়া হবে? একটি আদালতে একজন বিচারক বলেছিলেন - হিন্দুধর্মে এটি গ্রহণযোগ্য। আমি শ্রী মুখোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করতে চাই এই ধরণের নিষ্ঠুরতা কি ধর্ম?'

শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে হিন্দু মৌলবাদী শক্তির প্রবল আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে সেদিন আম্বেদকর ক্ষোভে পদত্যাগ করেছিলেন। এদেরই উত্তরাধিকার বিজেপি আজ ড. আম্বেদকরের গলায় মালা দেন কোন অধিকারে? সেদিন যারা সব হিন্দুর জন্য এক আইনের বিরোধীতা করেছিলেন, আজ কিসের ভিত্তিতে তারা গোটা দেশের জন্য একই আইন প্রণয়নের কথা বলেন? আসলে একই আইনের নাম করে প্রগতির জন্য সমাজ সংস্কার নয়, সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ আনার জন্যই ইউনিফর্ম সিভিল কোডের কথা এরা বলছেন।

প্রশ্ন-১৪) শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কি বাংলাভাগ রুখতে চেয়েছিলেন? তিনি কি দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন?

উত্তর) শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কংগ্রেসের আহ্বানে ভারত ছাড়ো আন্দোলন সম্পর্কে ১৯৪২ সালের ২৬শে জুলাই তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্নর জন হারবার্টকে একটি চিঠিতে লেখেন - 'যে কোন ব্যক্তি যদি বর্তমান যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ) মানুষকে জাগিয়ে তুলে আন্দোলন করবার পরিকল্পনা করেন, যার ফলে আভ্যন্তরীন অস্থিরতা এবং নিরাপত্তাহীনতা তৈরী হতে পারে, সরকারের উচিত তাকে প্রতিহত করা'। তিনি আরও লেখেন - 'আপনার অনুগত একজন মন্ত্রী হিসাবে আমি সম্পূর্ণভাবে আপনার সরকারকে সহযোগীতা করতে চাই এবং আমার রাজ্য ও দেশকে এই সংকটজনক মুহূর্তে সেবা করতে চাই।' প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সেই সময় স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ না নিয়ে ফজুলল হকের নেতৃত্বে মুসলীম লীগের মন্ত্রীসভায় তিনি অর্থমন্ত্রী হিসাবে যোগদান করেছিলেন। যে সময় একদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারত ছাড়ো আন্দোলন গড়ে উঠছে এবং নেতাজী সুভাষ বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠনের কাজ চলছে তখন মুসলীম লীগের মন্ত্রীসভায় উপমুখ্যমন্ত্রী হিসাবে যোগদান করে তিনি ব্রিটিশ সরকারকে সহযোগীতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আর.এস.এস. দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প সংগঠিত করেছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নাম লেখানোর জন্য।

১৯৪৬ সালের শেষের দিকে শ্রী মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলা ভাগের দাবীতে গঠিত হয় - 'Bengal Partition League', পরবর্তীতে যা 'Bengal Provincial Conference' নামে পরিচিত হয়। ঐ বছর ফেব্রুয়ারী মাসে হিন্দু মহাসভার বাংলা শাখা হিন্দুদের জন্য পৃথক বাংলা রাজ্য গঠনের জন্য একটি কমিটি তৈরী করে এবং ২৯শে মার্চ এর বার্ষিক সাধারণ সভায় হিন্দুদের জন্য পৃথক রাজ্যের দাবীতে প্রস্তাব পাশ করে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে শ্রী মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে হুগলী জেলার তারকেশ্বরে বাঙালী হিন্দু সম্মেলন সংগঠিত হয়। এখান থেকেই শ্রী মুখোপাধ্যায় প্রস্তাব দেন 'বাঙলা ভাগই একমাত্র সমস্যা সমাধানের রাস্তা'। এই সম্মেলন থেকে গৃহীত এক প্রস্তাবে তাঁকেই দায়িত্ব দেওয়া হয় - বাঙালি হিন্দুদের জন্য পৃথক রাজ্যের দাবীতে একটি কাউন্সিল গঠন এবং গণপরিষদের কাছে বাংলা ভাগের সীমানা নির্ধারণের আবেদন করার জন্য।

এই প্রসঙ্গে জ্যোতি বসু 'যতদূর মনে পড়ে' এই আত্মকথায় উল্লেখ করেন - 'দেশভাগের প্রশ্নে আমাদের পার্টির কি নীতি ছিল, তা এখানে বলা দরকার। আগেই বলেছি, পার্টি দেশভাগের বিরোধীতা করেছিল - কিন্তু এর প্রতিরোধ করার মত শক্তি ও প্রভাব পার্টির ছিল না। ভারতে তখন আমাদের পার্টি ৩য় বৃহত্তম শক্তি হলেও কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের তুলনায় আমাদের শক্তি খুবই দুর্বল ছিল। আমাদের প্রতিবাদ ও বিরোধীতা সত্ত্বেও দেশ যখন সত্য সত্যই বিভক্ত হলো, তখন এই বাস্তবকে স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া আমাদের পার্টির সামনে আর কোন বিকল্প ছিল না'।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যখন শ্রী মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন তখন ব্রিটিশ পতাকাকে অবমাননা করবার জন্য ১ম ছাত্রকে বেত্রাঘাত করার প্রতিবাদ করে ধরিত্রী গাঙ্গুলী এবং উমাপদ মজুমদার এই দুজন ছাত্রকে বরখাস্ত করেছিলেন - এমন অভিযোগও তাঁর বিরুদ্ধে আছে। তাই ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অন্যতম প্রবক্তার স্বাধীনতা আন্দোলন, সমাজসংস্কার এবং বাংলাভাগের ক্ষেত্রে যে নেতিবাচক ভূমিকা ছিল তা সকলের জানা অত্যন্ত জরুরী।

********************************************

জম্মু-কাশ্মীরের ভারত ভুক্তির অন্যতম প্রধান ভিত্তি ৩৭০নং ধারাকে লঘু করার প্রশ্নে কমিউনিস্টরা বরাবর বিরোধীতা করেছে। ২০০১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা শ্রী জ্যোতি বসু একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন - 'কাশ্মীরীদের স্বশাসন এবং অধিক ক্ষমতা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত সরকার সঠিক নীতি গ্রহণ করেনি। তাই তারা ধীরে ধীরে ভারত থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। ঐ সময় জনসংঘ ও হিন্দুত্ববাদীদের উত্থানেরও প্রভাব পড়েছিল। বিশেষত যখন কাশ্মীরের জনগণের থেকে এই সমস্ত ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া হয়, তখন তরুণ কাশ্মীরীরা পাকিস্তানপন্থী ও ভারত বিরোধী হয়ে উঠেছিলেন। এখন অনেকগুলি গোষ্ঠী রয়েছে। শেখ আব্দুল্লার মতো কয়েকজন পাকিস্তানে যোগ দিতে চাননি, চেয়েছিলেন স্বাধীন কাশ্মীর। জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর তিনি যখন আবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, আমি ওনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম - কেন আপনি এটা চাইছেন? এই ধরণের ছোট রাজ্য নিয়ে আপনি কিভাবে চালাবেন? তিনি আমাকে যুক্তি দিয়েছিলেন - আমি স্বাধীন কাশ্মীর পেলে পাকিস্তান, আমেরিকা ও ভারত আমাকে সমর্থন দেবে। যাই হোক শেষ পর্যন্ত তিনি ভারতবর্ষের সাথেই ছিলেন। আমরা কাশ্মীরকে কখনই পাকিস্তানের হাতে তুলে দিতে পারি না। এ বিষয়টা স্পষ্ট। আমরা কাশ্মীরকে স্বাধীন রাষ্ট্রও হতে দিতে পারি না। কিন্তু আমরা সেই অবস্থানে অনড় আছি যা আগেও বলেছি। জম্মু-কাশ্মীরকে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন দেওয়া প্রয়োজন। শুধু জম্মু-কাশ্মীরে স্বায়ত্বশাসন দিলেই হবে না; কাশ্মীরের মধ্যে জম্মু অন্যান্য অংশেও স্বশাসনের ক্ষমতা দিতে হবে। এভাবেই জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের, বিশেষত মুসলমানদের বিশ্বাস আমরা ফিরে পেতে পারি। তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন; এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। একাজ করতে গেলে তাঁদের অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃত নজর দিতে হবে। এই মুহূর্তে শুধু ৩৭০নং ধারা দিয়ে তাঁদের রাজনৈতিকভাবে খুশি করা যাবে না, যেটা অবশ্য বর্তমান সরকার (বাজপেয়ী সরকার) প্রত্যাহার করতে চায়। কিন্তু এই ধারার পাশাপাশি জওহরলাল নেহেরুর আমলে যেসব ক্ষমতা তাঁদের ছিল সেগুলি ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। কিছু ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন যদি তারা নিজস্ব সুপ্রিম কোর্ট চান বা অন্য কিছু চান, প্রতিরক্ষা এবং বিদেশ নীতি ছাড়া সবকিছুই তাদের দেওয়া উচিত। কিন্তু আর্থিক সহায়তা বহন করা উচিত ভারত সরকারের। এভাবেই মানুষের আস্থা অর্জন করা সম্ভব।' - (কমিউনিস্ট স্মৃতিকথা, এ.জি.নূরানী)