Wednesday, 24 February 2021

রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বাঁচাও ভারত বাঁচাও - ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)

গত তিন বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখাগুলির ধারাবাহিকভাবে হ্রাস এবং বেসরকারি খাতের শাখাগুলির দ্রুত বৃদ্ধি ঘটেছে।

সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে তার শেয়ার হোল্ডিং কমিয়ে ৫২ শতাংশ করার অনুমোদন দিয়েছে। ব্যাঙ্কস বোর্ড ব্যুরো গঠন এবং পরবর্তীকালে একটি হোল্ডিং সংস্থা গঠনের জন্য যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যেটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে সরকারি বিনিয়োগের বিলিব্যবস্থা করবে। এগুলিই বেসরকারিকরণের দিকে প্রথম পদক্ষেপ।

পি জে নায়েক কমিটির অংশীদারিত্বকে হ্রাস করে ৪০ শতাংশ করার সুপারিশ সরকার গ্রহণ করেছে। অতীতে সরকারগুলি আইসিআইসিআই-কে বেসরকারিকরণ করে বেসরকারি ব্যাঙ্ক করেছিল, যদিও আইসিআইসিআই শিল্প নির্মাণে উৎসাহ দেবার জন্যে শুরু হয়েছিল। ইউটিআইকে ইউটিআই ব্যাঙ্কে এবং তারপরে অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক হিসাবে রূপান্তরিত করে বেসরকারিকরণ করা হয়েছিল। এইচডিএফসি, যা আবাসন ক্ষেত্রকে উন্নীত করার জন্য চালু করা হয়েছিল তা বেসরকারি সেক্টরে এইচডিএফসি ব্যাঙ্কে পরিণত হয়েছে। এখন সরকার ঘোষণা করেছে আইডিবিআই ব্যাঙ্কের সরকারি অংশীদারিত্ব হ্রাস করে ৪৫ শতাংশে নামিয়ে আনবে।

মেক ইন ইন্ডিয়া, স্বচ্ছ ভারত, ডিজিটাল ইন্ডিয়া পেনশন যোজনা এবং স্টার্ট আপগুলিকে সফল করতে হলে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলিকে এদের তহবিল সরবারহ করতে হবে। বেসরকারি ক্ষেত্র কখনই এই প্রকল্পগুলিকে তহবিল দেয় না কারণ এগুলি তাৎক্ষণিক মুনাফা অর্জন করবে না এবং ব্যর্থও হতে পারে। কৃষকদের যদি কৃষি ঋণ পেতে হয়, যদি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলিকে পর্যাপ্ত ঋণ পেতে হয়, আমাদের সন্তানদের যদি শিক্ষা ঋণ নিতে হয় এবং স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে ঋণ পেতে হয়, আমাদের সন্তানদের যদি শিক্ষা ঋণ নিতে হয় এবং স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে ঋণ পেতে হয়, তবে কেবলমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি তা সরবারহ করতে পারে। সুতরাং আসুন রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলিকে সমর্থন করি। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলি বাঁচান এবং তাদের সুরক্ষার জন্যে এগিয়ে আসুন। উন্নয়ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের দাবি করুন।

**********************************************

এখন এনডিএ সরকারের দ্বিতীয় অবতার সবকিছুই বেসরকারি করতে চায়, কৃষকদের বীজ বিক্রি করতে বাধ্য করা বা মঙ্গলসূত্র বিক্রি করতে কোনও ভদ্রমহিলাকে বাধ্য করার মতোই সব তারা জ্বলাঞ্জলি দেবে প্রাইভেটের সেবায়। 

দেশের সম্পদ, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র সব তুলে দিতে চায় দেশ এবং বিদেশের বৃহদাকার কর্পোরেটদের হাতে। এদের মদতেই এনডিএ ক্ষমতায়।

কয়েকটি সাম্প্রতিক সংবাদ প্রতিবেদনের দিকে তাকান :

* রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বিমান জ্বালানি বিক্রির জন্য ভারত পেট্রোলিয়ামের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করছে।

* এনটিপিসি বেসরকারি হতে চলেছে।

* সরকারের বিলগ্নিকরণের তাড়ায় তালিকায় ফিরে এল এলআইসি'র নাম।

* ৪০০০০ ঘর নির্মাণের ভার এনবিসিসি'র কাছে হস্তান্তর করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের রায় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বিশাল অবদানের স্বীকৃতি।

* শীঘ্রই আসছে। দ্য গ্রেট সরকারি সেল - পাওয়ার গ্রিড, গেইল, বিএসএনএল এবং এমটিএনএল, সাথে জমিও পাওয়া যাবে।

* সরকার সম্পূর্ণভাবে এয়ার ইন্ডিয়া থেকে হাত গুটিয়ে নেবার পরিকল্পনা করছে।

* কৃষ্ণপট্টম বন্দরের ৭০ শতাংশ শেয়ার কিনতে প্রস্তুত হয়ে আছে আদানি।

* রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সেবায় এলআইসি'র ১৭০০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। 

* ভারতীয় নৌসেনার ৪৫০০০ কোটি টাকার সাবমেরিন প্রকল্পের শেষ মুহূর্তের পরীক্ষার জন্যে আদানি গ্রুপের প্রস্তুতি।

* পাবলিক সেক্টর ইউনিটগুলিতে শেয়ারের হোল্ডিং ৫০%-এর নিচে হ্রাস করার পরিকল্পনা নিচ্ছে সরকার।

গোটা দেশটাই কর্পোরেট, ভারতীয় ও বহুজাতিক সংস্থাগুলির কাছে বিক্রি হওয়ার মুখে। এর সাথে সংরক্ষণ নীতিও খতম হবে।

**********************************************

বামপন্থীদের দাবি 
* রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ বন্ধ করো। প্রতিরক্ষা ও কয়লা ক্ষেত্রে ১০০ ভাগ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহার করো। বিএসএনএল, অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি, ভারতীয় রেল, এয়ার ইন্ডিয়া ইত্যাদি বৃহদাকায় বেসরকারিকরণ বন্ধ করো।
* কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে চাই বর্ধিত সরকারি বিনিয়োগ। তা না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারকে বেকার যুবকদের ভাতা দিতে হবে।
* প্রতি মাসে ২১ হাজার টাকা নূন্যতম মজুরি সুনিশ্চিত করতে হবে।
* যে বিরাট সংখ্যক শ্রমিকরা কর্মচ্যূত হয়েছেন তাঁদের জীবনমান রক্ষার মতো মাসিক মজুরি সরকারকে সুনিশ্চিত করতে হবে।
* পুরনো বকেয়া মেটানো, নির্দিষ্ট নূন্যতম মজুরিতে নূন্যতম ২০০ দিনের কাজ দেওয়া সুনিশ্চিত করতে 'রেগা'য় বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
* কৃষি সঙ্কটের মোকাবিলায়, ক্রমবর্ধমান কৃষক আত্মহত্যা রুখতে এবং ফসলের উৎপাদন খরচের দেড় গুণেরও বেশি নূন্যতম সহায়ক মূল্য কার্যকর করতে কৃষকদের জন্য একেবারেই ঋণ মকুবের ব্যবস্থা করতে হবে।
* নূন্যতম মাসিক বার্ধক্য ও বিধবা পেনশন ৩ হাজার টাকা করতে হবে।

Thursday, 11 February 2021

ভগৎ সিং শহিদ-এ-আজম - তীর্থঙ্কর চট্টোপাধ্যায়

আসফাকউল্লা ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। বস্তুবাদী নন, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী তো কোনোভাবেই না। অথচ তিনি ভবিষ্যতের স্বাধীন ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে তাঁর ধারণাকে এই ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন: "বিদেশি শাসনকে কদর্য মনে করি এবং একই সঙ্গে ঘৃণা করি এমন কোনো ভারতীয় গণতান্ত্রিক শাসনকে, যা দরিদ্র ও দুর্বলের অধিকারকে অস্বীকার করবে, অথবা যদি তা ধনী ও জমিদারদের তৈরি ওই, অথবা যদি তাতে কৃষক ও শ্রমিকের সমান অংশগ্রহণ না থাকে, অথবা যদি সরকারের আইন অসাম্য ও পার্থক্যের ভিত্তিতে রচিত হয়। যদি ভারত স্বাধীন হয় এবং যদি শ্বেতকায় প্রভুদের হাত থেকে দেশ শাসনের বলগা আমার দেশের ভাইরা কেড়ে নেবার পরেও ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অসমতা, জমিদার-রায়তের মধ্যে অসমতা রয়ে যায়, তবে আমি আল্লাহ-র কাছে প্রার্থনা করি, যতদিন তাঁর সৃষ্টিতে সাম্য না প্রতিষ্ঠিত হয়, ততদিন আমি স্বাধীনতা চাই না। যদি এই সব ধারণার জন্য লোকে আমায় কমিউনিস্ট বলে তো বলুক। আমার থোড়াই এসে যায়।"

কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলার আর একজন অভিযুক্ত মহাবীর সিং-এর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়েছিল। তিনি তাঁর বাবাকে আন্দামান-যাত্রার ঠিক আগে একটি চিঠি লেখেন। তাতে লিখেছিলেন: "সমাজ বলতে আমি আর্য সমাজ বা অন্য কোনো সংকীর্ণ সমিতি বুঝি না, আমি বুঝি সমস্ত সাধারণ মানুষের সমাজ। তার কারণ, এই ধর্মীয় সমিতিগুলি এত অদূরদর্শী যে আমার কাছে তারা অর্থহীন। উপরন্তু আমি সব ধর্ম থেকেই দূরে  থাকতে চাই, কারণ তারা সংকীর্ণ, আত্মকেন্দ্রিক, অবিচারভিত্তিক। আমি চাই, অন্যেরাও তা থেকে দূরে থাকুক। মানুষ ও সমাজের পক্ষে যা সবচেয়ে মূল্যবান বলে আমি মনে করি, তা হল নিম্নলিখিত আদর্শ। জাতি, গাত্রবর্ণ, ধর্ম বা অর্থের ওপর ভিত্তি করে কোনো মানবিক সম্পর্ক গড়া উচিত নয়।" 

*************************************************

নিম্ন আদালতে ভগৎ সিং-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, 'বিপ্লব' বলতে তিনি কী বোঝেন? তাঁর উকিল আসফ আলি এই প্রশ্নে আপত্তি করলে আদালত প্রশ্ন নাকচ করে। কিন্তু দায়রা আদালতে নিজের মতাদর্শ ঘোষণার সুযোগ হিসেবে স্বেচ্ছায় ভগৎ সিং প্রশ্নটির উত্তর দেন। "বিপ্লব সর্বদা রক্তাক্ত সংঘাতে জড়িত নয় এবং তার মধ্যে ব্যক্তিগত প্রতিশোধেরও স্থান নেই। বিপ্লব মানে বোমা-পিস্তলের পূজা নয়। বিপ্লব বলতে আমরা বুঝি যে, বর্তমান ব্যবস্থা যা স্পষ্টতই অন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তাকে পাল্টাতে হবে। যদিও যারা স্পষ্টতই উৎপাদক বা শ্রমিক, তারাই সমাজের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান, তবু তারা তাদের শ্রমের ফল থেকে শোষকদের দ্বারা বঞ্চিত, তাদের মৌলিক অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। ... অতএব একটা মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন এবং যারা এ কথা উপলব্ধি করেছে তাদেরই দায়িত্ব সমাজকে সমাজতান্ত্রিক ভিত্তির ওপরে পুনর্গঠিত করা। এই কাজ সমাধা না হলে এবং মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ এবং এক দেশ দ্বারা অপর দেশের শোষণ, যা সাম্রাজ্যবাদের মুখোশ পরে আছে, বন্ধ না হলে, সমাজের সামনে আজ যে কষ্টভোগ ও হত্যালীলার  বিপদ, তাকে রোখা যাবে না এবং যুদ্ধের অবসান ও বিশ্বশান্তির যুগ উদ্বোধনের সব কথাই ছদ্মবেশহীন কপটতা বলে বোঝা যাবে। বিপ্লব বলতে আমরা বুঝি শেষ পর্যন্ত এমন একটা সমাজব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা যা এই রকম ধ্বংসের ভয়ে ত্রস্ত নয়, যেখানে সর্বহারার সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত যার ফলে আসবে এমন একটা বিশ্ব-ফেডারেশন যা বিশ্বমানবকে উদ্ধার করবে পুঁজিবাদের দাসত্ব থেকে ও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের দৈন্য থেকে।" পরিশেষে তাঁরা সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর সংগ্রামের কথা বলেছেন এবং বিবৃতি শেষ করছেন 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' লিখে।

*************************************************

১৩ সেপ্টেম্বর সকালে ৬২ দিন অনশনের পর যতীন দাস শহীদের মৃত্যু বরণ করলেন। শেষ অবধি তাঁর মনোবল অটুট ছিল। প্রায় অচৈতন্য অবস্থাতেও তিনি খাদ্য প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সারা দেশ আগের সাত দিন উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করছিল। চরম মুহূর্তের পর সারা দেশে ক্ষোভ ও শোকের বন্যা বয়ে গেল। তখনকার দিনে টেলিভিশন ছিল না, খুব কম বাড়িতেই রেডিয়ো ছিল, টেলিফোন ব্যবস্থাও দুর্বল ছিল। তবু খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে দুপুরের মধ্যে।

এই মৃত্যুসংবাদ শান্তিনিকেতনে পৌঁছাল সন্ধ্যা নাগাদ। ভাদ্রের শেষ; আসন্ন পুজোর ছুটির ঠিক আগে 'তপতী' নাটকের অভিনয় হবে। রবীন্দ্রনাথ ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নাটকের মহলা দিচ্ছিলেন। যতীন দাসের খবর আসতে রিহার্সাল বন্ধ হয়ে গেল। যে যার ঘরে ফিরে গেলেন। সেই রাতে রবীন্দ্রনাথ একটি গান লিখলেন। পরের দিন রিহার্সালে এসে বললেন, এই নতুন গানটি সকলকে শিখে নিতে হবে। ওই কোরাস দিয়েই 'তপতী' শুরু হবে।


সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ

হে ভৈরব, শক্তি দাও, ভক্ত-পানে চাহো।

দূর করো মহারুদ্র   যাহা মুগ্ধ, যাহা ক্ষুদ্র

মৃত্যুরে করিবে তুচ্ছ প্রাণের উৎসাহ।

দুঃখের মন্থনবেগে উঠিবে অমৃত,

শঙ্কা হতে রক্ষা পাবে যারা মৃত্যুভীত।

তব দীপ্ত রৌদ্র তেজে   নির্ঝরিয়া গলিবে যে

প্রস্তরশৃঙ্খলোন্মুক্ত ত্যাগের প্রবাহ।

*************************************************

দ্বিতীয় পাঞ্জাব ছাত্র সম্মেলনের মুক্ত অধিবেশন হয়েছিল ১৯ অক্টোবর ১৯২৯। সভাপতিত্ব করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। এই সভায় পড়া হয়েছিল ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত-র বার্তা, জেল থেকে পাঠানো।

কমরেডগণ,
আজ আমরা যুবসমাজকে পিস্তল-বোমা হাতে তুলে নিতে বলতে পারি না। আজ ছাত্রদের সামনে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। আগামী লাহোর অধিবেশনে কংগ্রেস দেশের স্বাধীনতার জন্য কঠোর সংগ্রামের ডাক দেবে। জাতীয় ইতিহাসের এই সংকটকালে যুবসমাজকে এক বিশাল দায়িত্ব নিতে হবে। ... তাদের দায়িত্ব শিল্প এলাকার কোটি কোটি বস্তিবাসী ও কোটি কোটি জীর্ণ কুটিরবাসী গ্রামীণ মানুষকে জাগিয়ে তোলা, যাতে আমরা স্বাধীন হতে পারি, যাতে মানুষের হাতে মানুষের শোষণ হয়ে ওঠে অসম্ভব। ...শহীদ যতীন্দ্রনাথ দাসের কাছ থেকে প্রেরণা নিয়ে, এবং দেশের প্রতি অশেষ ভক্তি নিয়ে, তাদের প্রমাণ করতে হবে যে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা অনড় পণ নিয়ে লড়তে সক্ষম।

সভাস্থলে এই বার্তা পরে দেবার পরে সমবেত কণ্ঠে ধ্বনি ওঠে, "ভগৎ সিং জিন্দাবাদ" - সেই সঙ্গে ঘন ঘন হাততালি।

*************************************************

আজ একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে পৌঁছে ভারতে এমনই এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে হিন্দুত্ববাদীদের দাপটে ইতিহাস থেকে আরম্ভ করে গৃহস্থের খাদ্যতালিকা পর্যন্ত পাল্টে দিচ্ছে নয়া-সন্ত্রাসের অঙ্গুলিনির্দেশ। ইতিহাসকে বলা হচ্ছে কল্পনা আর কাল্পনিক কাহিনিকে বলা হচ্ছে ইতিহাস। চেষ্টা চলছে ভগৎ সিং-কে হিন্দু বীর হিসেবে প্রতিপন্ন করার এবং তাঁর আত্মদানকে হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার ভিত্তিরূপে স্থাপনের। সযত্নে চাপা দেওয়া হচ্ছে তাঁর লেখা 'কেন আমি নাস্তিক' প্রবন্ধ। অনুল্লিখিত থাকছে আরও দুটি লেখা: "ধর্ম এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম" এবং "সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও তার প্রতিকার"।

শেষোক্ত প্রবন্ধটি ১৯২৮ সালের জুন মাসে 'কীর্তি' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধে ভগৎ সিং লক্ষ্য করেছেন, ১৯২০-২১ সালের অসহযোগ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ার পর একের পর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটছে। তাঁর লেখার অব্যবহিত আগের ঘটনা হল কোহাট শহরের ভয়াবহ দাঙ্গা। তিনি লক্ষ্য করেছেন, বর্ণনায় প্রাধান্য পাচ্ছে মুসলমান নৃশংসতা হিন্দুদের ওপর বা শিখদের ওপর, কিংবা মুসলমানের ওপর অন্যদের অত্যাচার। কিন্তু মূল কারণটা সকলেই বাদ দিয়ে যায়। মূল কারণ অর্থনৈতিক। দারিদ্র এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে চার আনা পয়সার জন্যেও অন্যায় কাজে নাম্বার জন্য বহু মানুষ, কী হিন্দু কী শিখ কী মুসলমান প্রস্তুত। এরই সুযোগ পুঁজিবাদীরা নেয়, যাতে সব গরিব মানুষের আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তু তারা না হয়। ভগৎ সিং লিখছেন, "দাঙ্গা সর্বদাই হতাশাজনক খবরে ভর্তি, কিন্তু কলকাতার দাঙ্গায় একটা ভালো জিনিসও ঘটেছিল। শ্রমিকরা দাঙ্গায় অংশ নেয়নি, এমনকি ট্রেড ইউনিয়নগুলি চেষ্টা করেছিল মারমুখো জনতাকে শান্ত করতে। এই সব লোক শ্রেণিসচেতন হয়ে উঠেছিল এবং নিজেদের শ্রেণিস্বার্থ খুঁজতে শিখেছিল। শ্রেণিচেতনাই প্রধান হাতিয়ার যা সহায় হতে পারে দাঙ্গা রুখতে।" উপসংহারে বলছেন, "ধর্মকে যদি রাজনীতি থেকে পৃথক করা যায়, তাহলে আমরা সকলে যৌথভাবে সামিল হতে পারি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়, ধর্মীয় বিষয়ে যতই তফাত থাকুক না কেন। আমরা অনুভব করছি যে ভারতের প্রকৃত হিতৈষীরা এই নীতিগুলো অনুসরণ করে ভারতকে বাঁচাবেন সেই আত্মহননের পথ থেকে যে পথে আজ সে চলছে।" এর প্রত্যেকটি কথা আজকের ভারতেও প্রযোজ্য। ধর্ম আর রাজনীতির পৃথকীকরণ, যা ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞার্থ, আজকের ভারতে যতটা প্রয়োজন, ততখানি স্বাধীনতার পরে আর কখনও ছিল না।

একই মাসে (জুন ১৯২৮) প্রকাশিত হয়েছিল "অস্পৃশ্যতার সমস্যা"। সেখানেও তথাকথিত অস্পৃশ্যদের আহ্বান করা হয়েছিল নিজের শ্রেণিসত্তাকে উপলব্ধি করে শ্রেণিসংগ্রামে অংশ নিতে। তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, "তোমরাই আসল শ্রমিক শ্রেণি।" ঠিক পরের লাইনে উদ্ধৃত করেছিলেন মার্কস-এঙ্গেলসের অমর পঙক্তি: "দুনিয়ার মজদুর এক হও, শৃঙ্খল ছাড়া আর কিছু তোমাদের হারাবার নেই।" ভগৎ সিং তার সঙ্গে যোগ করেছিলেন, "সামাজিক আন্দোলন থেকে বিপ্লব শুরু করো।" আজকের জাতপাতের উৎপাতে ক্লিষ্ট ভারতে প্রত্যেকটি কথা গুরুত্বপূর্ণ।

ভগৎ সিং আজও যুগোপযোগী। 


Tuesday, 9 February 2021

CAA ও ভারতীয় নাগরিক - গৌতম রায়

রাজীব-মোহন্ত চুক্তির ভিতর দিয়ে আসামের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে নাগরিকত্ব আইনের ৬-এ ধারা তৈরির যে পথ খুলে দেওয়া হয়েছিল, সেটিকেই পরবর্তীকালে কেন্দ্রে এন ডি এ নামক নীতিবিহীন, সুবিধাবাদী জোট সরকারের প্রধান শরিক হিসেবে বিজেপি-র নেতৃত্বাধীন অটলবিহারী সরকারের ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের ১৪-এ ধারা সংযোজনের সুযোগ করে দেয়।

**********************************************************

সাধারণ মানুষ যাতে খাদ্যের দাবিতে সোচ্চার না হয়, শিক্ষার দাবিতে সোচ্চার না হয়, বেকারত্ব নিরসনের দাবি না তোলে, স্বাস্থ্যের অধিকারের দাবি না তোলে, নারীর ক্ষমতায়নের দাবি না তোলে, সংখ্যালঘুর অধিকার ব্রিটিশের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের কালের চুক্তি অনুযায়ী, সংখ্যালঘুর অধিকারের কথা না তোলে, আদিবাসী, দলিত-তফসিলি জাতি, উপজাতিভুক্ত মানুষ, যাতে তাঁদের অধিকার, কর্মসংস্থান - ইত্যাদির প্রশ্ন না তোলে, একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কোম্পানি, কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের কাছে বেচে দেওয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে কোনো প্রশ্ন যাতে তৈরি না হতে পারে, নতুন কোনো শিল্পের সম্ভাবনা কেন ভারতবর্ষে তৈরি করতে দেশের সরকার যত্নবান নয় - এই প্রশ্ন যাতে মানুষ না করেন - সেই জন্যই কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি এন আর সি-র জুজু সাধারণ মানুষকে দেখিয়ে চলেছেন।

**********************************************************

পোশাক, বেশভূষা, সাজসজ্জার উপর নির্ভর করে যিনি মানুষের ধর্ম নিরূপণ করতে চান, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতবর্ষের সংস্কৃতি, সভ্যতা সম্পর্কে কতখানি অজ্ঞ - তা ভাবলে সত্যিই আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। পবিত্র ইসলামীয় সংস্কৃতি ভারতবর্ষের রীতিনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতিতে সেলাই করে পড়া কাপড়ের কোন প্রচলন ছিল না। দর্জির দ্বারা জামাকাপড় নির্মাণের ধারণাই পবিত্র ইসলামের ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার পর ভারতবর্ষের মানুষ জেনেছেন। তার আগে এদেশের মানুষ কখনো সেলাই করা কাপড় পরতেন না। যে ব্রাহ্মণ্যবাদী - জাতপাতভিত্তিক - বর্ণভিত্তিক সংস্কৃতিকে ভারতবর্ষের ধ্যানজ্ঞান হিসেবে বিকৃতরূপে দেখিয়ে, রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চায় হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, সন্ত্রাসী শক্তি, সেই প্রাচীন ভারতীয় ধ্যানধারণায় স্টিচ করা কোনো জামাকাপড় পরবার কোন প্রচলনই ছিল না।

**********************************************************

ধর্মবিশ্বাসে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় ব্রাহ্ম ছিলেন। প্রফুল্লচন্দ্র সেন হিন্দু ধর্মের প্রচলিত রীতিনীতির প্রতি ছিলেন আস্থাবান। কার্যত প্রফুল্লচন্দ্র সেনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে জয়রামবাটিতে শ্রীশ্রী মা সারদা দেবীর জন্মস্থানকে তাঁর পরিবারের লোকজনের নানা আপত্তিকে অতিক্রম করে সম্পূর্ণভাবে রামকৃষ্ণ মিশনের আওতায় আনা সম্ভবপর হয়েছে।

জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মত মানুষ, তাঁরা ব্যক্তিজীবনে ছিলেন নাস্তিক। তা সত্ত্বেও তাঁরা একটি বারের জন্যেও অপরের ধর্মাচরণ ঘিরে কখনো কোনোরকম বাধা সৃষ্টি করেননি। জ্যোতি বাবু তাঁর ব্যক্তিজীবনে কখনো ধর্মচর্চার ধারপাশ দিয়ে না হাঁটলেও, ইন্দিরা গান্ধীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর শিখবিরোধী দাঙ্গা প্রশমনে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষদের সব ধরনের নিরাপত্তা প্রদানের উদ্দেশ্যে যখন গুরুদ্বারে গিয়েছেন, তখন শিখ ধর্মের প্রচলিত রীতিনীতিকে মান্যতা দিয়ে মাথায় উষ্ণীষ পড়েই গুরুর দ্বারে প্রবেশ করেছেন।

জ্যোতিবাবুর ব্যক্তিজীবন চর্চাতে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের এতটুকু গুরুত্ব না থাকলেও, শিখ সম্প্রদায়ের মানুষকে বাঁচানোর স্বার্থে, প্রবল বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জ্যোতি বসু যেমন কোনরকম জেদাজেদির মধ্যে যাননি, তেমনই এই বিষয়টিকে তাঁর রাজনৈতিক প্রচারের একটু মাধ্যম হিসেবে একটি বারের জন্যও তুলে ধরেননি।

**********************************************************

 ... তথাকথিত বিশেষজ্ঞরা এটাই বলবার চেষ্টা করছিলেন যে, কেরলে যেহেতু বামপন্থীদের প্রধান শত্রু হচ্ছে কংগ্রেস, তাই কেরলের প্রেক্ষিতকে সামনে রেখে, কোনো অবস্থাতে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টভুক্ত দলগুলি কেরালাতে দলের সঙ্গে শত্রুতার সম্পর্ক যে রাজনৈতিক দলের, সেই দলের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের সংগ্রামের ক্ষেত্রে কোনো বোঝাপড়া বা গণআন্দোলনের ক্ষেত্রে কোন বোঝাপড়া করে উঠতে পারেন না।

এই অভিমতটি সম্পূর্ণভাবেই একাংশের তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের একান্ত নিজস্ব অভিমত। তা নিয়ে নতুন করে বলবার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ গোটা বিষয়টি নিয়ে আলাপ আলোচনার যে নির্যাস বামপন্থী দলগুলোর পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে কোনো অবস্থাতেই এই তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের অভিমতকে সিলমোহর দেওয়া হয়নি।

তবুও রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে, কেরলে ক্ষমতাসীন বামপন্থীদের সঙ্গে বিরোধী কংগ্রেসের রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রেক্ষিতে, জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের আনা এন আর সি, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা তারও আগের প্রেক্ষিতে - সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারা ও ৩৫এর এ ধারার অবলুপ্তি, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের জমি সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়দানের পর যে পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার প্রেক্ষিতে, গোটা দেশকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের হাত থেকে রক্ষা করতে, সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়কে সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় নিরাপত্তা দেওয়ার স্বার্থে, সমস্ত রকমের রাজনৈতিক বিরোধকে পাশে রেখে, একযোগে কেন্দ্রের ভারতবর্ষের মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত করে, ভারতবর্ষকে রাজনৈতিক হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করবার এই ভয়ঙ্কর চক্রান্তের বিরুদ্ধে, একযোগে আন্দোলন সাম্প্রতিক ভারতের গণআন্দোলনের ইতিহাসের ক্ষেত্রে এক নয়া দিগন্ত উন্মোচিত করেছে।

কেরালাতে সেখানকার শাসক ও বিরোধী দলের কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের এই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধে একযোগে লড়াইকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ এই প্রশ্নের অবতারণা করছেন যে, পরস্পর বিরোধী দুটি রাজনৈতিক দল যদি কেরালায় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে একত্রে লড়াই করতে পারে, তাহলে কেন, পশ্চিমবঙ্গে, এখানকার শাসক তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিরোধী বামপন্থীরা একযোগে লড়াই করতে পারবে না?

বস্তুত এই তত্ত্বটি অনেকদিন ধরে সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতিক, যারা বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমতাসীন করবার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ভূমিকা নিয়েছিল, তারা বাতাসে ভাসিয়ে দিতে শুরু করেছিল। সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে রুখতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বামপন্থীদের একযোগে আন্দোলনে নামা উচিত - এমন আজগুবি তত্ত্ব তারা অনেকদিন ধরে নানা পত্র-পত্রিকায় সন্দর্ভের ভিতর দিয়ে, সামাজিক গণমাধ্যমের ভিতর দিয়ে, সাধারণ আলাপচারিতার মধ্যে দিয়ে তুলে আনবার চেষ্টা করছিল।

এই প্রশ্নের প্রথম এবং প্রধান উত্তর হলো এই যে, অর্থনৈতিক প্রশ্ন এবং শ্রেণি অবস্থানের প্রশ্নে কংগ্রেস দলের সম্পর্কে যথেষ্ট প্রশ্ন এবং সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও একথা অত্যন্ত জোর দিয়ে বলতে হয় যে, কংগ্রেস দল নীতিগতভাবে কোনো অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িক নয়। আজ পর্যন্ত কি কেন্দ্রে কি কোনো রাজ্যে সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে কংগ্রেস দল বামপন্থীদের মতোই, কোনো সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী দলের সঙ্গে আঁতাত করে সরকারে থাকেনি।

অপরপক্ষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তাঁর তৃণমূল কংগ্রেস প্রকাশ্যে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করলেও, নয়ের দশকের শেষভাগ থেকে তারা বিজেপির জোটসঙ্গী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। পরবর্তীকালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এন ডি এ নামক নীতিহীন সুবিধাবাদী জোটের শরিক হয়ে একটানা সাড়ে ছয় বছর কেন্দ্রে ক্ষমতার মৌতাত উপভোগ করেছে। এই সময়কালে সর্বনাশা অর্থনৈতিক নানা ধরনের সিদ্ধান্তের পাশাপাশি গোটা দেশজুড়ে বিজেপি এবং তার সঙ্গীসাথীরা ও তাদের মূল মস্তিস্ক আর এস এস যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন চালিয়েছে, সে সম্পর্কে কিন্তু কেন্দ্রে মন্ত্রী থাকাকালীন বা তারপরেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি প্রতিবাদসূচক শব্দ আজ পর্যন্ত ব্যবহার করেননি।

এমনকি গুজরাত গণহত্যা যখন সংগঠিত হয় নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে, সেই সময়কালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শরিক থেকেছেন এন ডি এ-র। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে দেখেছেন সব কিছু। কিন্তু একটিবারের জন্য সেই গণহত্যার এতটুকুও প্রতিবাদ তাঁর কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়নি। শুধু তাই নয়, গুজরাট গণহত্যায় হাজার হাজার সংখ্যালঘু মুসলমানের রক্তে হাত লাল করে নরেন্দ্র মোদি যখন বিধানসভা নির্বাচনে আবার জিতে আসেন, তখন এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই নরেন্দ্র মোদিকে আজকের বিজেপি নেতা মুকুল রায়ের মাধ্যমে ফুল পাঠিয়ে শুভেচ্ছা পর্যন্ত জানিয়েছিলেন।

অস্ট্রেলিয়ার মিশনারী ফাদার গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টেইন্সকে দুই শিশুপুত্র সহ জিপে আগুন লাগিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে আর এস এসের সহযোগী বজরং দল। গোটা উড়িষ্যা জুড়ে সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষদের উপরে নানা ধরনের অত্যাচার চালায় আর এস এস ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো। বাজপেয়ী জমানাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় অবস্থান করে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু একটিবারও সেইসব অপকর্মের কোনরকম বিরোধিতা করেননি।

রাজনৈতিক হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে বাজপেয়ী সরকারের আমলে যেভাবে এন সি আর টি থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইতিহাস পাঠক্রমকে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক অভিধারায় বিকৃত করা শুরু হয়েছিল, সে সম্পর্কে কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটিবারের জন্য কোনো রকম প্রতিবাদ করেননি। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের ক্ষমতাচ্যুত করতে সেই সময় এ রাজ্যের বুকে বিজেপি এবং তাদের মূল মস্তিস্ক আর এস এসের বিভিন্ন ধরনের তথাকথিত সামাজিক সংগঠনগুলির শ্রীবৃদ্ধিতে সবরকমভাবে সাহায্য করেছিলেন।

বস্তুত পশ্চিমবঙ্গের বুকে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর হিন্দু সাম্প্রদায়িক, রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে সংসদীয় গণতন্ত্রের নিরিখে এবং সামাজিক অবস্থানের নিরিখে পায়ের নিচে জমি করে দেওয়ার ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে ন্যক্কারজনক ভূমিকা, তার প্রেক্ষিতে সেই ব্যক্তির বিজেপি বিরুদ্ধতার মধ্যে আদৌ সততা আছে কিনা - এই প্রশ্নটি প্রথম তোলা দরকার।