Monday, 18 January 2021

আসামে নাগরিকপঞ্জির সাতকাহন - দেবর্ষি দাস

উপনিবেশি আসামে শ্রমজীবীদের প্রব্রজন অনবরত হয়ে চলেছে। মোটের ওপর তিনটে ভাগে ফেলা যায়।

১। সরকার চালানোর জন্য চাই অফিসের বড়বাবু, মেজবাবু, ছোটবাবু, কেরানি, পিওন, আর্দালিদের দঙ্গল। বৃটিশ ফৌজের সাথে আছে নানা স্তরের কলমচি, ছোট সরকারি চাকুরে। বিচারব্যবস্থার সাথে যুক্ত পেশাদারেরা - বিচারক, উকিল, মোক্তার, কেরানি। আছে রসদ যোগানদারেরা, মানে সাপ্লায়ার ও ব্যবসায়ীরা। কলমচি ও ব্যবসায়ীর দল বৃটিশদের পেছন পেছন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বসতি পত্তন করে। এর মধ্যে বাঙালি, মারোয়াড়ি বা অন্য ভাষাভাষিরা পড়বেন। বাঙালি বলতে হিন্দু বাঙালি। ইংরেজদের চালু করা শিক্ষা বাকিদের তুলনায় হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে বেশি ছড়িয়েছিল। রাজস্বের খাতিরে ১৮৭৪ সালে সিলেট জেলাকে পূর্ববঙ্গ থেকে কেটে আসামের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়। লেখাপড়া জানা হিন্দু বাঙালির ঠাটবাট বাড়ে। 

২। দুই নম্বর প্রব্রজন শুরু হয় চা বাগানগুলো ফুলেফেঁপে ওঠার পর। ১৮৩০-এর দশকে প্রথম চা বাগান পত্তন হয়। প্রথম দিকে চা শ্রমিকদের চীন থেকে আনা হত। চা চাষ, চা পাতা থেকে পানীয়যোগ্য চা তৈরি করার কৌশল চীনারাই জানত সে যুগে। উৎপাদন বাড়ার সাথে সাথে শ্রমিকের প্রয়োজন বাড়ে, স্থানীয় শ্রমিকদের নিয়োগ চালু হয়। বোড়ো কসারি জনজাতিদের দিয়ে কাজ করানো হত। কিন্তু বাগান মালিকেরা অচিরেই ফাঁপরে পড়লেন। জনজাতি মানুষেরা স্থায়ী বসবাসে অভ্যস্ত হননি, তাঁদের এক জায়গায় বেশিদিন থাকার অভ্যাস নেই। তার ওপরে জনজাতি মানুষদের জনসংখ্যা অপ্রতুল। বিকল্পের সন্ধান চলল। অবশেষে শ্রমিক আমদানি করা শুরু হল। ১৮৫০-এর দশক থেকে ভিন রাজ্য থেকে ব্যাপক মাত্রায় চুক্তি শ্রমিক আমদানি আরম্ভ হল। ভারত ভূখন্ডের সবচেয়ে গরিব অঞ্চলগুলো থেকে আড়কাঠি লাগিয়ে, ঠকিয়ে, লোভ দেখিয়ে, আগাম ধার দিয়ে, চা-শ্রমিকদের আনা হত। ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল থেকে সাঁওতাল, ওঁরাও, গোন্ডদের স্রোত বিশ শতক পর্যন্ত চলেছে।

"চল মিনি আসাম যাব, দেসে বড় দুখ রে..."

কাজের লোভে, রোজগারপাতির প্রতিশ্রুতিতে বহু মিনি-র দরিদ্র প্রেমিক অচেনা 'আসাম দেসের' দিকে পা বাড়িয়েছিল। তারপর কী হল গানে নেই। আছে অন্য এক বাগানিয়া গানে। ১৯৭০-এর দশকে বেরোনো 'চামেলি মেমসাহেব' সিনেমা দেখেছেন? অসমিয়া ও বাংলা দুই ভাষাতে 'চামেলি মেমসাব' বা 'চামেলি মেমসাহেব' বেরিয়েছিল। লোকগানের সুরে ভূপেন হাজরিকা সাজিয়েছিলেন মজদুর চামেলির সাথে বাগানের সাহেবের অসম ভালবাসার গল্প।

"সর্দার বলে কাম কাম 

বাবু বলে ধরি আন

সাহেব বলে লিব পিঠের চাম 

... ফাঁকি দিয়া আনিল আসাম।"

সর্দার জনজাতি। সাহেব, মানে বাগানের মালিক বা ম্যানেজার, গোরা ইউরোপীয়। আর বাবুরা প্রায়ই বাঙালি বা অসমিয়া ভদ্রলোক হত। শোষণের তিন পরতের চাপ একদম নিচের মহলের চা মজদুরেরা পিঠে সইত আর বইত।

অজানা দেশে জঞ্জল কেটে চা বাগানের পত্তন করে, ম্যালেরিয়া কালাজ্বরের সাথে পাঞ্জা লড়ে, মালিকের চাবুক খেয়ে দিন গুজরান সহজ নয়। অনেক শ্রমিক পালিয়ে যেত। বলা ভাল পালানোর চেষ্টা করত, কেননা বিদেশ বিভুঁইয়ে পালিয়ে বেশিদূর যাওয়া শক্ত। ধরা পড়লে কপালে জুটত কড়া সাজা। দ্বিতীয় স্রোতের অভিবাসীদের নাম হালে দেওয়া হয়েছে চা-জনজাতি গোষ্ঠী।

৩। ওপরের দুই ধরণের প্রব্রজনের ঠেলায় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার জনবিন্যাস বদলে যায়। ১৮৯১ সালের জনগণনাতে দেখা যাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চারজনের মধ্যে একজন বহিরাগত। তাদের পূর্বপুরুষ বা তারা বাইরে থেকে এসেছে। প্রব্রজনের তিন নম্বর ঢেউ পূর্ববঙ্গ থেকে আসে। চা শ্রমিকদের আনা হয়েছিল চা কোম্পানির মুনাফার স্বার্থে, পূর্ববঙ্গের চাষি প্রব্রজনের পেছনে ছিল সরকারের কর তোলার খাঁই।

প্রথমত, আসামে জমির অভাব ছিল না। অভাব ছিল মানুষের, যারা জমিকে চাষের আওতায় এনে সরকারকে খাজনা দেবে। 'ওয়েস্টল্যান্ড' বা অনাবাদি জমি নিয়ে সরকারের দুশ্চিন্তা প্রথম থেকেই ছিল। জমি এমনি খালি পড়ে আছে, বসতি নেই, সরকারকে খাজনা দেওয়ার লোক নেই, এই ঘটনাটাই বরদাস্ত করা যাচ্ছিল না।

দ্বিতীয়ত, জমির জন্য চাহিদা ছিল। বিশ শতকের শুরুতে বাংলায় দুটো ঘটনা ঘটে যা জমির চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। (ক) কলকাতার আশেপাশে চটকল গড়ে ওঠে। আগে বাংলা থেকে, বিশেষত পূর্ববাংলা থেকে, কাঁচা পাট রপ্তানি হত সাগরের ওই পারে বৃটেনের চটকলে। উনিশ শতকের শেষ দিকে ভারতের মাটিতেই চটকল তৈরি হতে থাকে। হুগলী নদীর দুই পারে চটকলগুলো গজিয়ে ওঠে। খালি ইউরোপীয় মালিকানায় নয়, দেশীয় পুঁজিপতিরাও, মারোয়াড়িরা, চটকল স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা নেয়। ভারত থেকে পাটসামগ্রীর রপ্তানি বাড়তে থাকে, ফলে আরো চটকল গড়ে ওঠে, কাঁচামালের চাহিদা তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকে। (খ) বিশ শতকের শুরুতে পূর্ববঙ্গের পাট উৎপাদনের জমি শেষ হয়ে আসে। পূর্ববঙ্গ এমনিতেই জনবহুল কৃষিপ্রধান অঞ্চল। এই জমি চটকলগুলোর খিদে মেটাচ্ছিল। জমি শেষ হয়ে আসার ফলে উপনিবেশি প্রভুরা নতুন জমির সন্ধান করতে থাকেন।

আসামের নদী অববাহিকার নিচু, পলিমাটি পাটচাষের জন্য উপযুক্ত। তাই দেখা গেল আসামে অনাবাদি জমির যোগান ও তার জন্য চাহিদা দুটোই ছিল। জমিনের সাথে দরকার ছিল মানবের। এই ঘাটতি পূরণের জন্য পূর্ববঙ্গীয় চাষিদের দিয়ে বসতি পত্তন শুরু হয়। প্রব্রজনকারীরা ছিলেন আর্থিক দিক দিয়ে গরিব, পেশায় ভূমিহীন বা প্রান্তিক চাষি, ধর্মে মুসলমান।

পথ দেখান গোয়ালপাড়ার জমিদারেরা। ব্রহ্মপুত্রের চর ও নদের পাশের নিচু অঞ্চলগুলোকে অসমিয়াতে 'চর-চাপরি' বলে। সাধারণত কেউ সেখানে বসবাস করত না। পূর্ববঙ্গের চাষিদের দিয়ে জমি আবাদ করানোয় গোয়ালপাড়ার জমিদারেরা উৎসাহ দিচ্ছিলেন। বৃটিশ সরকারের আগ্রহে প্রব্রজনের স্রোত উপত্যকার পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে এগোতে থাকে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হয়, পূর্ববঙ্গকে কেটে আসামের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়। ফলে পূর্ববঙ্গ থেকে প্রব্রজনের ঢেউ আরো জোরদার হয়ে ওঠে। ১৯৩০-৪০-এ একাধিক মুসলিম লীগ সরকার আসামে চলার সময়ে প্রব্রজনের স্রোত বেড়েছিল বলে অনুমান। স্বাধীনতার পর কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানে অস্থির রাজনৈতিক অবস্থা চলছিল। অর্থনীতির হালও বলার মত নয়। দরিদ্র শ্রমজীবীদের প্রব্রজন দেশভাগের পরও চলতে থাকে। প্রব্রজনকারীদের প্রধানভাগ মুসলমান, ফলে আসামের জনসংখ্যায় মুসলমান ভাগ বাড়তে থাকে। ১৮৭৪ সালে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মাত্র ৫.৯% জনসংখ্যা মুসলমান ছিল। ১৯৪১ সালে বেড়ে হয় ২৩%। ২০১১ সালের জনগণনা বলছে আসামের জনসংখ্যার ৩৪% মুসলমান।

১৯০১ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ফি দশকে আসামের জনসংখ্যার গতি ভারতের থেকে বেশি। শুধু বেশি না, অনেকটাই বেশি। আন্দাজ করা যায়, আসামে ওই সাত দশক জুড়ে প্রব্রজন হয়ে চলেছে। ১৯৭১-এর পর অবশ্য দেখা যায় আসামের জনসংখ্যার গতি কমে গেছে, ভারতের থেকে ঢিমে তালে বেড়েছে।

এখানে দু'টো কথা মনে রাখা ভাল। এক, প্রব্রজন শুধু পূর্ববঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে হয়েছে এমন নয়। ভারতের অন্য রাজ্য থেকে প্রব্রজন হলেও আসামের জনসংখ্যা ভারতের থেকে বেশি হারে বাড়বে। দুই, পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে যত প্রব্রজন হয়েছে, তার পুরোটা মুসলমান নয়। দেশভাগের সময় হিন্দু উদ্বাস্তুদের স্রোত আসামে এসেছে। দেশভাগের পরে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের ফলে দফায় দফায় মানুষের ঢেউ এপারে এসেছে। পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধের সময়ে প্রায় এক কোটি উদ্বাস্তু ভারতে আশ্রয় নেন। ভারতের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়ার কাগজেকলমে কারণ উদ্বাস্তু প্রবেশ। বাংলাদেশের জন্মের পর সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার থেমে যায়নি। 'শত্রু সম্পত্তি' বাজেয়াপ্ত করার আইন বাংলাদেশে আছে। হিন্দুদের সম্পত্তি কতখানি সুরক্ষিত তার ওপর প্রশ্নচিহ্ন আছে। সাথে আছে ছুটকো-ছাটকা দাঙ্গা। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দাঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সীমানা পেরোনোর সময় দাঙ্গার চরিত্র মুসলমান-বিরোধী থেকে বদলে হিন্দু-বিরোধী হয়ে যায়।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, এক, সাহেবরা আসার আগে আসাম (বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা) মূল ভূখন্ডের থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন ছিল। আহোম রাজারা বিদেশি মানুষ ও পণ্যের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। দুই, উপনিবেশি শাসনের সাথে প্রব্রজনের সম্পর্ক রয়েছে। তিন, বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অভিবাসী মানুষ আসামে এসেছেন। এই স্রোত বহুদিন ধরে চলছে।

======================================================

ভূমিপুত্ররক্ষার রাজনীতিকে আসাম আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই রাজনীতিই কালে কালে বেড়ে অসমিয়া জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করে দিয়েছে। এটা দুই ভাবে হয়েছে। একটা নিচ থেকে। বোড়ো, কার্বি ও অন্য জনজাতিগোষ্ঠীরা অসমিয়া জাতীয়তাবাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। জনজাতিরা নিজেদের আলাদা স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল চালাচ্ছে। অন্য রাজ্যের দাবি উঠেছে। দ্বিতীয়টা ওপর থেকে। গত তিরিশ বছরে ভারতীয় রাজনীতিতে ভারতীয় জনতা পার্টি উঠে এসেছে। তিরিশ বছর আগে কে ভাবতে পেরেছিল অগপ বিজেপি-র ছোট শরিক হয়ে আসামে সরকার চালাবে? হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিও এক ধরণের ভূমিপুত্র রাজনীতি। তবে এরা অসমিয়া জাতীয়তাবাদের থেকে অনেক বড় মাঠে খেলাধুলো করে। সর্বভারতীয় বিজেপি-র পেছনে তাবৎ বড় পুঁজির মালিকরা আছেন। সংঘের রাজনীতির উচ্চাকাঙ্খা অসমিয়া জাতীয়তাবাদীদের তুলনায় অনেক বেশি এবং সহিষ্ণুতা কম।

কিন্তু আসাম চুক্তির কী হল? কতজনকে শনাক্ত বা বহিষ্কার করা হল? ২০১২ সালের হিসেব বলছে ২,৪৪২ জন মানুষকে বহিষ্কার করা হয়েছে, আর ৫৪,০০০ মানুষকে বাংলাদেশি হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। অথচ কথা তো হচ্ছিল ৪০ লক্ষ বিদেশির। আসলে বিদেশি ক'জন আছেন আসামে? এই নিয়ে ভাল গবেষণা নেই। লোকে ৪০ লক্ষ, ৫০ লক্ষ যা হোক একটা বলে দিচ্ছে। গত ১০০ বছরের জনসংখ্যা দেখলে বোঝা যায় ১৯৭১ সালের আগে পর্যন্ত আসামের জনসংখ্যা ভারতের থেকে বেশি হারে বেড়েছে। এর জন্য সম্ভবত পূর্ববঙ্গ থেকে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রব্রজন দায়ী। ১৯৭১-এর পরে ছবিটা পাল্টে যায়। দেখা যাচ্ছে ভারতের থেকে আসামের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম। প্রব্রজনের স্রোত একেবারে গায়েব না হলেও নগণ্য হয়েছে অনুমান করা ভুল হবে না।

তাতে অবশ্য রাজনীতির ব্যাপারীদের কিছু এসে যায় না। "কম লোককে বিদেশি শনাক্ত করা হল, এটা কি আসাম চুক্তির বিফলতা নয়? ৮৫৫ শহিদের বলিদান কি জলে যাবে?" জাতীয়তাবাদীরা এই বলে মানুষকে তাতাচ্ছে। তবে জাতীয়তাবাদীদের আজকে অত ক্ষমতা নেই যে ফের রাজ্যজুড়ে আন্দোলন তৈরি করবে। তারা আইনি পথে ঝুঁকে পড়েছে। নাগরিকপঞ্জি এক মরিয়া চেষ্টা। বিদেশিদের বহিষ্কারের দাবি জানিয়ে সুপ্রীম কোর্টে মামলা হয়েছে। কোর্ট ২০১৪ সালে এনআরসি বা নাগরিকপঞ্জি নবীকরণের নির্দেশ দিয়েছে। গোটা রাজ্যের বাসিন্দাদের বৈধ নাগরিক হওয়ার প্রমাণ দিতে হবে। বংশবৃক্ষ দাখিল করে ১৯৫১ সালের নাগরিকপঞ্জিতে অন্তর্ভুক্ত লোকেদের সাথে বা ১৯৭১ সালের আগের ভোটার লিস্টের লোকেদের সাথে নিজের রক্তসম্পর্ক প্রমাণ করতে হবে।

কথা হল, রাজ্যে অবৈধ বিদেশি থাকলে প্রশাসন-পুলিশ-বিচার ব্যবস্থা তাদের ধরুক। নির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে মামলা করুক। সরকারের অপদার্থতার বোঝা সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে কেন? এরকম প্রশ্ন অনেকের মনেই উঠছে। এ যেন মাছ ধরার জন্য গোটা পুকুরের জল ছেঁচে ফেলার মত হঠকারিতা। রাজ্যে ক'জন বিদেশি বসবাসকারী আছেন তার কোনও বিশ্বাসযোগ্য হিসেব নেই। অন্তত এই কাজটা যদি গত ৩০ বছরে পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগের সাহায্যে মনোযোগ দিয়ে করা হত তাহলে বাংলাদেশি খেদানোর রাজনীতির দোকান এতদিনে বন্ধ হয়ে যেত। যেহেতু প্রামাণ্য তথ্য নেই, নেতারা আজব সব কথা বলে লোক খেপাচ্ছেন। আসামের বিজেপি-র এক সাংসদ বলেছেন গোটা দেশে পাঁচ কোটি বাংলাদেশি আছে, যা আদতে বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ! বিজেপি-র নেতারা গোটা দেশে এনআরসি-র দাবি করেছেন।

NRC - শমীক লাহিড়ী

আসামে নাগরিকপঞ্জী প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে ১৯ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১২ লক্ষ মানুষই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। সেই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের সময় বিজেপি প্রচার করেছিল নাগরিকপঞ্জী হলে কোন হিন্দুর নাম বাদ যাবে না। এমনকি এই ধরণের ঘৃণ্য-বিভেদকামী-জঘন্য প্রচার করেছিল, নাগরিকপঞ্জী তৈরী করে সব মুসলমানকে তাড়ানো হবে এবং সেই মুসলমানদের সম্পত্তি হিন্দুরা দখল করতে পারবে। দুঃখের হলেও এক বিরাট অংশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ প্রলুব্ধ হয়ে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল এবং এর ফলে বিজেপি সরকার গঠন করতে পেরেছিল। কিন্তু নাগরিকপঞ্জীর ফল প্রকাশের পর উল্টো চিত্রই দেখা যাচ্ছে। এখন নিজেদের পিঠ বাঁচানোর জন্য বিজেপি দুটো প্রচার করা শুরু করেছে। (১) সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে নাগরিকপঞ্জী  হচ্ছে, এক্ষেত্রে বিজেপির কোন হাত নেই। (২) ২০১৬ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী বিল (CAB) পাশ করিয়ে হিন্দুদের এদেশে শরণার্থী হিসাবে রেখে দেওয়া হবে, তাই হিন্দুদের দেশ ছাড়া হওয়ার কোন ভয় নেই।

এই দুটি কথাই সর্বৈব অসত্য। প্রথমত - বর্তমানে আসাম বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা করেন এবং তাঁর আবেদনের ভিত্তিতেই সুপ্রিম কোর্ট ২০০৫ সালের ১২ই জুলাই IMDT (Illegal Migrants Determination by Tribunal Act.) আইনের সেই ধারাটি বাতিল বলে ঘোষণা করে, যে আইনে কারোর বিরুদ্ধে বিদেশী অভিযোগ আনলে অভিযোগকারীকে প্রমাণ করতে হবে অভিযোগের সত্যতা। সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশে এখন যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাকেই প্রমাণ করতে হবে যে অভিযোগ অসত্য। মানুষকে বিপদে ফেলার কাজ কে শুরু করেছিল এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত - আসাম চুক্তি অনুযায়ী নাগরিকপঞ্জী তৈরীর কাজ হচ্ছে না এই অভিযোগ জানিয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্র ও আসাম রাজ্যে সরকারের মতামত জানতে চায়। বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার দুজনেই সম্মতি দেয় দ্রুত নাগরিকপঞ্জী তৈরীর কাজকে শেষ করার পক্ষে। তাদের মতামতের ভিত্তিতেই আসামে এই নাগরিকপঞ্জী গঠনের নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। এই সত্য বেমালুম গোপন করার চেষ্টা করছে বিজেপি।

তৃতীয়ত - ২০১৬ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল যা লোকসভায় পাশ হলেও রাজ্যসভায় পাশ হয়নি সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে, সেই আইন পাশ হলেও বিদেশী হিসাবে চিহ্নিত হিন্দুধর্মাবলম্বীরা কেবলমাত্র শরণার্থী রূপেই চিহ্নিত হবেন। ৬ বছর এদেশের থাকার সুযোগ পেলেও কোন সরকারী সুযোগ-সুবিধা, ব্যাঙ্ক একাউন্ট খোলা, রেশনকার্ড, সরকারী ভাতা, সরকারী-বেসরকারী চাকুরী, ভোটার তালিকায় নাম তোলা সহ অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক সুবিধার থেকে বঞ্চিত থাকবেন। ৬ বছর বাদে তারা নাগরিক হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারেন, কিন্তু নাগরিক হতে পারবেন কিনা এমন নিশ্চয়তা প্রস্তাবিত আইনে দেওয়া নেই। তাই ৬ বছর বসবাস করবার পরে এদের ভবিষ্যত কি, এই প্রশ্নের উত্তর নেই।

১০টি মিথ্যা - ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)

 মিথ্যা নং ৩ : নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন অর্থাৎ সিএএ-র জাতীয় নাগরিক নিবন্ধক (এনআরসি)-র সাথে কোনও সম্পর্ক নেই। এটি সম্পূর্ণ পৃথক এবং বিরোধীরা মিথ্যাভাবে দুটিকে যুক্ত করার চেষ্টা করছে।

সত্য : সিএএ এবং এনআরসি একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বিজেপি'র পরিকল্পনা প্রথমে সিএএ বাস্তবায়ন, যা আফগানিস্তান, বাংলাদেশ বা পাকিস্তান এই তিনটি দেশ থেকে আসা সমস্ত অমুসলিমকে নাগরিকত্বের অধিকার দেবে। তারপরে এনআরসি দিয়ে "অনুপ্রবেশকারী" সনাক্ত করবে। অনুপ্রবেশকারী এবং শরণার্থীদের মধ্যে পার্থক্য কী? কেবলমাত্র মুসলমানরা সিএএ-তে শরণার্থী হিসাবে যোগ্যতা অর্জন করে না এবং তাই তারা অনুপ্রবেশকারী। নিম্নলিখিত উদাহরণগুলিতে দেখা যায় যে দুটোর মধ্যে মারাত্মক সংযোগ বিজেপি নিজেই স্পষ্ট করে দিয়েছে :

এপ্রিল ২০১৯-এ অমিত শাহ বলেছিলেন, "প্রথমে সিএবি আসবে। সমস্ত শরণার্থী নাগরিকত্ব পাবেন। তারপরেই এনআরসি আসবে। এ জন্যে শরণার্থীদের দুশ্চিন্তা করা উচিত নয়, অর্থাৎ দুশ্চিন্তার বিষয় কেবল অনুপ্রবেশকারীদের। কালানুক্রম বুঝুন - সিএবি আসবে এবং তারপরে এনআরসি। এনআরসি কেবল বাংলার জন্য নয়, এটি পুরো দেশের জন্য" (বিজেপি'র অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ভিডিও)।

৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ : অমিত শাহ সংসদে বলেছিলেন যে সিএএ পাসের পর একটি দেশব্যাপী এনআরসি হবে। লোকসভায় সিএএ নিয়ে বিতর্ক চলাকালীন তিনি বলেছিলেন, "আমরা দেশজুড়ে এনআরসি নিয়ে আসব। একজনও অনুপ্রবেশকারীকে রেহাই দেওয়া হবে না।"

১৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ : বিজেপি'র কার্যনির্বাহী সভাপতি জে পি নাড্ডা জানিয়েছিলেন যে সিএএ বাস্তবায়িত হবে এবং "এগিয়ে গিয়ে এনআরসিও আনা হবে।" তিনি আরও বলেছিলেন, "প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে চলেছে এবং চলবে। নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন কার্যকর করা হবে, ভবিষ্যতে এনআরসিও হবে।"

না, বিরোধী দলগুলো সিএএ এবং এনআরসি'কে সংযুক্ত করেনি, বিজেপি'র কলঙ্কিত পরিকল্পনাই এই দুটির যোগসূত্র।

এন আর সি বিভাজনের রাজনীতি - হরিলাল নাথ

হিন্দু রাষ্ট্রের মৌলিক ভাবনায় নাগরিকত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। হিন্দু রাষ্ট্রের নাগরিকদের দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে। ১৯২১ সালে সাভারকার যে হিন্দুত্ববাদের সূচনা করেছেন তাতে এই দুই শর্তের স্পষ্ট ব্যাখ্যা আছে। একটি পিতৃভূমি। কোনো ব্যক্তির পিতৃপুরুষ যে ভৌগোলিক অঞ্চলে জন্মেছেন সেটাই তাঁর পিতৃভূমি। দ্বিতীয়টি দেবভূমি। কোনো ব্যক্তি যে ধর্মের অনুসারি সেই ধর্মের উৎসভূমি হল দেবভূমি। এই সূত্র অনুযায়ী বৈদিকবাদ, সনাতনবাদ, জৈন, বৌদ্ধ, লিঙ্গায়েত, শিখ, আর্য সমাজ, ব্রহ্ম সমাজ, দেব সমাজ, প্রার্থনা সমাজ-সহ অনুরূপ ধর্মমতগুলির উৎস 'হিন্দুস্থান' এবং এগুলি সবই হিন্দু ধর্মের শাখা বা অংশ। এই ধর্মাবলম্বীদের সকলেরই পিতৃভূমি ভারত। কিন্তু ভারতীয় মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, পার্সিদের পিতৃভূমি ভারত হলেও তাদের 'হিন্দুস্থানি' বলে গণ্য করা হবে না। কারণ তাদের দেবভূমি অর্থাৎ ধর্মের উৎসভূমি 'হিন্দুস্থান' নয়। একইভাবে জাপানি চীনা-সহ অন্য অনেক দেশের মানুষ যাদের দেবভূমি ভারত হলেও (বৌদ্ধ ধর্মের সূত্রে) পিতৃভূমি ভারত নয়।

========================================================

এনআরসি-কে কেন্দ্র করে অনেকগুলি গুরুতর প্রশ্ন সামনে এসেছে। তার কোনো সদুত্তর মিলছে না।

১। ১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তি অনুযায়ী আসামে এনআরসি হচ্ছে। সেই চুক্তিতে সারা দেশে এনআরসি-র কোনো কথা নেই। তাহলে সারা দেশে এনআরসি-র প্রসঙ্গ উঠছে কেন? তা ছাড়া আসামে প্রথম এনআরসি হয় ১৯৫১ সালে। পরবর্তীকালে নির্দিষ্ট সময় অন্তর তা আপডেট বা সময়োপযোগী করার কথা। অর্থাৎ এখন যে এনআরসি হচ্ছে সেটা আসলে আপডেট হবার কথা।

২। এনআরসি আবেদন ভিত্তিক ব্যবস্থা। দেশের সব অধিবাসীকেই নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে। তার মানে বর্তমানে দেশে একজনও নাগরিক নেই। নাগরিক হবার জন্য তাদের সকলকে আবেদন জানাতে হবে। তবে কি স্বাধীনতার পর ৭০ বছর ধরে ভারত নামক দেশে একজনও নাগরিক ছিল না? নাগরিকহীনভাবেই ৭০ বছর ধরে একটা দেশ চলেছে। যদি এতদিন নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হত তাহলে নতুন করে নাগরিকত্ব প্রমাণের প্রশ্ন থাকে না। সকলকে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য আবেদন করতে বলার অর্থ তাঁরা নাগরিক নন। তবে কি এতদিন অনাগরিকরাই ভোট দিয়ে সরকার গঠন করত, সরকারি সুযোগ সুবিধা ও অধিকার ভোগ করত? এমন আজব কাণ্ড সম্ভবত ভারতেই সম্ভব।

৩। আসামে ১৯ লক্ষ বাংলাদেশি চিহ্নিত। পশ্চিমবঙ্গে নাকি ২ কোটি বাংলাদেশি আছে। সারা দেশে আরও বেশ কয়েক লক্ষ হবে। এঁদের নাকি তাড়ানো হবে। কোথায় তাড়ানো হবে? বাংলাদেশ নেবে না। তাহলে যাবে কোথায়? তাদের ভবিষ্যৎ কি? উত্তর নেই।

৪। আসামে ডিটেনশন কেন্দ্রে আপাতত ৯ হাজার জনের থাকার ব্যবস্থা। বাকি ১৮ লক্ষ ৯৭ হাজারকে কোথায় রাখা হবে? এদিকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ কাউকে ৩ বছরের বেশি আটক রাখা যাবে না। ছেড়ে দিতে হবে। তাহলে কিভাবে ছাড়া হবে? ছাড়ার পর তাঁরা কি করবেন? চিহ্নিত বিদেশিদের জমিজমা, বাড়িঘর, অর্থ-সম্পদ কারা ভোগ করবে?

৫। প্রথমে ট্রাইবুনাল, তারপর হাইকোর্ট, শেষে সুপ্রিম কোর্ট। বিচার পর্ব শেষ করতে কত বছর সময় লাগবে কেউ জানে না। ততদিন বাতিলদের অবস্থান কি হবে? যে গতিতে ভারতে মামলার নিষ্পত্তি হয় এবং যে বিপুল সংখ্যক মামলা বকেয়া আছে তাতে শুধু আসামের বিদেশি নিশ্চিত করতে এক দশক সময় লেগে যেতে পারে। এরপর পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা দেশে এনআরসি হলে তার ধাক্কা সামলাতে আরও কয়েক দশক কেটে যাবে।

৬। সারা দেশে দাবি অনুযায়ী দু কোটি বাংলাদেশি চিহ্নিত হয় তাহলে তাদের ডিটেনশন সেন্টারে রেখে নূন্যতম প্রয়োজনের যোগান দিতে সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। অর্থ সঙ্কটের সময় এই বাড়তি দায় বহন করা সরকারের পক্ষে কতটা সম্ভব?

এমন উত্তরহীন প্রশ্ন আরও অনেক আছে। বোঝা যাচ্ছে সরকার চলছে বিভ্রান্তি আর উদ্বেগের ঘোলা জলে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে।

Wednesday, 13 January 2021

বিপন্ন কৃষি ও কৃষক

 তিনটি আইন আলাদা আলাদাভাবে বলবৎ হলেও তিনটি আইন অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। এই তিনটি আইন কৃষকের স্বার্থে নয়। এমনকী, কৃষি উৎপাদনের যাঁরা চূড়ান্ত ভোক্তা, তাঁদের স্বার্থেও নয়। আইনগুলি খোলা মনে পর্যালোচনা করলেই ধরা পড়ে এই সত্য। তিনটি আইনের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি -

১। কৃষকের জন্য নূন্যতম সহায়ক মূল্যের প্রতিশ্রুতি কোথাও নেই।

২। মজুতদারি আর বেআইনি বলে গণ্য হবে না।

৩। চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, তৈলবীজ, খাদ্যযোগ্য তেল ইত্যাদি পণ্যগুলির মজুতদারি ও দামে সরকারি তরফে নিয়ন্ত্রণ হবে কেবলমাত্র যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অন্যান্য সাধারণ দাম বৃদ্ধি এবং মারাত্মক দুর্যোগ ইত্যাদি অনন্য সাধারণ পরিস্থিতিতে।

৪। সেক্ষেত্রেও সবজি ও ফল ইত্যাদির ক্ষেত্রে ১০০% ও অপচনশীল কৃষিজ পণ্য অর্থাৎ তেল, চা, চিনি ইত্যাদির ক্ষেত্রে ৫০% দাম বৃদ্ধি ঘটলে তবেই সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

৫। সেক্ষেত্রেও মূল্য সংযোগশৃঙ্খলে উৎপাদনের মধ্যবর্তী স্তরে কোনো কারবার বা কারবারির উপর সেই নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্ত হবে না। উদাহরণ, কোনো আলুভাজা প্রস্তুতকারক সংস্থা বাজারে আলুর দাম আগুন হলেও যথেচ্ছ আলু মজুত রাখতে পারবে কিংবা, চিনির দর আকাশ ছুঁলেও চিনি কল আখ মজুত করে চলবে।

৬। রাজ্যের হাত থেকে কৃষি ব্যবস্থা পুরোপুরি কেন্দ্রের অধিকারে চলে যাবে।

৭। রাজ্যের হাতে মান্ডির বাইরে কৃষি থেকে আয়ের কোনো উপায় থাকবে না।

৮। কৃষি পণ্যের কারবারিরা নিজেদের স্বার্থে মান্ডির কমিশন এজেন্ট বা ফড়েদের মাধ্যমে কৃষকের পণ্য মাঠ থেকে সরাসরি হাতিয়ে নেবার উদ্যোগ নেবেন।

৯। এমএসপি নির্ধারিত দাম মান্ডির বাইরে আদায় হওয়ার বাধ্যবাধকতা না থাকায় জবরদস্তি করার সুযোগ থাকবে।

১০। অত্যাবশ্যক নিত্য প্রয়োজনীয় চাল, ডাল, তৈলবীজ, পেঁয়াজ আর আলু অত্যাবশ্যক থাকবে না। রাজ্যের হাতেও বাজারের দাম নিয়ন্ত্রকের কোনো অধিকার থাকবে না। ফলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সঙ্কটের সম্মুখীন হতে বাধ্য।

১১। বর্তমানে নানান আইন সত্ত্বেও ছোটো কৃষকেরা ফড়েদের হাতের শিকার। যেটুকু আইনি ব্যবস্থা ছিল কৃষক স্বার্থ রক্ষায় তাও তুলে নেওয়া হবে নতুন ব্যবস্থায়। কৃষি পণ্য লেনদেনে কৃষক স্বার্থ দেখার খাতাকলমের ব্যবস্থাটুকুও তুলে নেওয়া হবে এই নতুন ব্যবস্থায়।

১২। তৈরি হবে তিন ধরনের বাজার। মান্ডি, চুক্তি চাষ, মান্ডির বাইরের বাজার। মান্ডি তৈরি হয়েছিল ফড়েরা যাতে কৃষকদের জমি থেকে পণ্য তুলে তাদের অত্যাচার না করতে পারে। নতুন ব্যবস্থায় কৃষকের বাড়ি পর্যন্ত ফড়েদের যাওয়ার রাস্তা আরও প্রশস্ত হবে।

১৩। চুক্তি চাষ হবে। চুক্তি হবে কৃষক ও বাণিজ্য সংস্থার মধ্যে। চুক্তিতে ফসলের পরিমাণ, গুনগত মান, দাম ইত্যাদি সমস্তই আগাম নির্ধারিত থাকবে।

১৪। চুক্তিভঙ্গে সরকার সাধারন কৃষকের পাশে কীভাবে থাকবে অথবা থাকবে কিনা তা অনুচ্চারিত।

১৫। এই চুক্তি সম্পাদিত হবে মহকুমাশাসকের কর্তৃত্বের এক্তিয়ারে।

১৬। এই চুক্তির উপর রাজ্যের নিজস্ব আইন বা আদেশের কোনো প্রভাব থাকবে না।

১৭। চুক্তি খেলাপ করার অভিযোগ উঠলে, তার বিচার দেশের দেওয়ানি আদালতে হবে না।

১৮। চুক্তি সংক্রান্ত যাবতীয় বিবাদের বিচার করবেন মহকুমা শাসক। তাঁর বিচারে সন্তুষ্ট না হলে আপিল করতে হবে জেলা শাসক বা অতিরিক্ত জেলা শাসকের অধীন উত্তর-বিচার কর্তৃপক্ষের কাছে। এক্ষেত্রে মহকুমাশাসক, জেলা শাসক তথা উত্তর-বিচার কর্তৃপক্ষের রায় দেশের দেওয়ানি আদালতের রায়ের সমান মান্যতা পাবে।

১৯। সরকারি তরফে কৃষির বাজার ও বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষেত্র সমস্তটাই কুক্ষিগত থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। রাজ্যের আইন এক্ষেত্রে প্রশ্ন তুলতে পারবে না। দেশের আদালত তথা মূল বিচার ব্যবস্থার কোনও ভূমিকাই নেই। কেন্দ্রের সঙ্গে সরাসরি প্রশাসনিক যোগাযোগ থাকবে জেলা শাসক ও মহকুমা শাসকের। রাজ্য প্রশাসন থাকবে নীরব দর্শক। আসলে এই তিনটি কৃষি আইন ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, স্বেচ্ছাচার, একনায়কতন্ত্র ও কর্পোরেট আনুগত্যের দলিল।

এক দেশ, এক বাজার শ্লোগানকে সামনে রেখে অবাধ বাণিজ্যের বিষয়টিকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। কৃষকের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে কর্পোরেটরা এর ফলে সুবিধা ভোগ করবে। সহায়ক মূল্য ও মূল্য স্হিতিশীল রাখার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় কৃষক সমাজকে সার্বিকভাবেই কৃষি ব্যবসার কর্পোরেটদের দয়া দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করতে হবে। এই তিনটি আইন আগ্রাসী নয়া উদারবাদী ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে। অনাহার, দুর্দশা, অসহায় অবস্থার মধ্যে থাকা কৃষক সমাজ ও গ্রামের গরিব মানুষের উপর তীব্র অর্থনৈতিক আক্রমণ নেমে আসবে।