Saturday, 24 June 2017

বিবেকানন্দ ভারতীয় নব জাগরণের দার্শনিক - শ্যামল চক্রবর্তী

বিবেকানন্দের ভাবনায় সমাজভাবনা ও সমাজতন্ত্র 

স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তায় স্বদেশচেতনা এবং শ্রমিকস্বার্থবোধ একাত্মতা লাভ করেছিল । তিনি শিকাগো থেকে দেওয়ান হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লিখেছেন (নভেম্বর, ১৮৯৪), "কোথায় ইতিহাসের কোন যুগে ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়, পুরোহিত ও ধর্মধ্বজিগণ দীনদুঃখীদের জন্য চিন্তা করিয়াছে ? অথচ ইহাদের নিষ্পেষণ করাতেই তাহাদের ক্ষমতার প্রাণশক্তি । ... দরিদ্রগণের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা এত বেশী কেন ? একথা বলা মূর্খতা যে তরবারির সাহায্যে তাহাদিগকে ধর্মান্তরগ্রহণে বাধ্য করা হইয়াছিল । ... বস্তুত জমিদার ও পুরোহিতবর্গের হস্ত হইতে নিষ্কৃতিলাভের জন্যই উহারা ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছিল । আর সেইজন্য বাংলাদেশ, যেখানে জমিদারের বিশেষ সংখ্যাধিক্য, সেখানে কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানেরই সংখ্যা বেশী ।"

ভারতে অনেকরকম সাধু-সন্ন্যাসী দেখা যায় । তাঁরা সমাজ ও জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান । কিন্তু বিবেকানন্দ ছিলেন সম্পূর্ণ অন্য ধরণের মানুষ । তিনি সারা ভারত পদব্রজে পর্যটন করেন এবং ধনি-গরিব নির্বিশেষে নানাধরণের মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটে । তিনি ইউরোপ-আমেরিকা পর্যটন করে ধনতান্ত্রিক ও বিভিন্ন ধরনের সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হন । এই প্রক্রিয়ার মধ্য থেকেই সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে তার চিন্তার মিশ্রণ ঘটে । তাঁর ধর্মচেতনা মানুষকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল ।

নতুন সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল তাঁর চোখে । বিবেকানন্দের সমসাময়িক চিন্তাবিদদের সঙ্গে বিবেকানন্দের পার্থক্য ছিল এই যে, অন্য চিন্তাবিদরা শুধু সমাজ সংস্কারের কথা বলতেন । বিবেকানন্দ আমূল পরিবর্তনের কথা ভাবতেন । উগ্র জাতীয়তাবাদী ও হিন্দুত্ববাদীরা ভারতকে  পুরোনো দিনে ফিরে যাবার কথা বলতেন । কিন্তু বিবেকানন্দ তাঁদের সঙ্গে আদৌ একমত ছিলেন না । তিনি নতুন ভারতের কথা বলতেন । যে ভারতের শাসকরা হবেন সমাজের একেবারে নীচের তোলার মানুষ অর্থাৎ শূদ্র । তিনি নতুন সমাজের যে কল্পনা করেছিলেন তা হল বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামিক দেহ ।

শূদ্র জাগরণ সম্পর্কে বিবেকানন্দ বলেছিলেন : 'আর যাহাদের শারীরিক পরিশ্রমে ব্রাহ্মণের আধিপত্য, ক্ষত্রিয়ের ঐশ্বর্য, বৈশ্যের ধনধান্য সম্ভব, তাহারা কোথায়? সমাজের যাহারা সর্বাঙ্গ হইয়াও সর্ব দেশে সর্বকালে ... ভারবাহী পশু, সে শূদ্রজাতির কি গতি?' এই যে অপরিসীম বেদনাবোধের সঙ্গে তিনি শূদ্রদের সম্বন্ধে ভেবেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তিনি বুঝেছেন বৈশ্য সভ্যতাই মানুষের ইতিহাসে সবটুকু নয়, তার একটা ধারা থাকতে পারে । এ বিষয়টি স্বামীজীর চোখে ধরা পড়েছিল বলেই বৈশ্য সভ্যতার ভালো দিকটি বলবার সঙ্গে শূদ্র জাগরণের অনিবার্য ভবিষ্যতের প্রতিও ইঙ্গিত দিয়েছেন তাঁর পত্রাবলীতে ।

বিবেকানন্দ ভারত ইতিহাসে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় তথ্য তুলে ধরে আমাদের জানিয়েছেন শাসক শ্রেণী সব সময় শোষিতদের অগ্রসর অংশের প্রতিনিধিদের কিনে এবং তাদেরই ব্যবহার করে নীচেকার মানুষকে পদদলিত করবার জন্যে । তিনি উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন - 'বশিষ্ঠ, নারদ, জাবাল, সত্যকাম, ব্যাস, কৃপ, দ্রোণ এবং কর্ণ । শ্রেণী আভিজাত্যের দিক থেকে এদের প্রত্যেকেরই জন্মকাহিনী, পিতৃপরিচয় বা মাতৃপরিচয় সন্দিগ্ধ রহস্যে আবৃত ' । 'জ্ঞান ও বীরত্বের পুরস্কারস্বরূপ এঁরা কেউবা ব্রাহ্মণ সমাজে কেউবা ক্ষত্রিয় সমাজে উন্নীত হলেন ।' বিবেকানন্দ মন্তব্য করেছেন - 'এঁদের এই সামাজিক ঊর্দ্ধগতির ফলে গণিকা, দাসী, মৎস্যজীবি বা শকটচালক সম্প্রদায়ের কি যে উপকার হল তা বোঝা দুষ্কর ।

স্বামীজী বলেছেন, ভারতবর্ষের প্রকৃত শাসনক্ষমতা জনসাধারণের হাতে ছিল না । যারা ক্ষুধিত বঞ্চিত, যারা নিচুরতলার মানুষ, মার-খাওয়া মানুষ, যারা ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্তভাবে সংগ্রাম করছে, তারা কোনো সময়ে এমনভাবে দানা বাঁধতে পারেনি, যাতে ক্ষমতাটা তাদের হাতে আসতে পারে । পারস্পরিক স্বার্থের খাতিরে ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়েরা একত্র হয়েছে । কিন্তু গণশোষণের বন্যার গতিটি কোনো সময়ে স্তিমিত হয়নি, বরং ক্ষুরধার হয়েছে । স্বামীজীর বিশ্লেষণ অনুযায়ী পশ্চিমী মুসলমানেরা যখন আমাদের দেশ বিজয় করতে এলো, তাদের হাতে আমরা মার খেয়েছি, তাদের বুকের সাহস এবং বীর্যবত্তায় ভারতবর্ষ পরাভূত হয়েছে । পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গিয়েছে, Royal Power-এর হাত থেকে শূদ্র শ্রেণী কোনোদিন রক্ষা পায়নি । (অনেক পরে পৃথিবীর ইতিহাসে, ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে, প্রথম শূদ্রের বিপ্লব ঘটেছে রুশ দেশে - লেখক)।

 স্বামীজী তাঁর সন্ধানী দৃষ্টিতে নূতন সমাজের যে চেহারা দেখেছিলেন পশ্চিমী সমাজ তাতে বিস্মিত হয়, তার কারণ এই যে আসন্ন শূদ্ররাজত্ব সম্পর্কে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নিঃসংশয় । 'বর্তমান ভারত' -এ তিনি বলেছেন "সোশ্যালিজম, অ্যানার্কিজম, নিহিলিজম এবং এ-জাতীয় মতবাদগুলি আসন্ন সমাজ-বিপ্লবের অগ্রদূত ।" অ্যানার্কিজম, নিহিলিজম দিয়ে সমাজ বিপ্লব করা যাবে কিনা আমরা এ নিয়ে তর্কের ঝড় তুলতে পারি, কিন্তু এ মতবাদগুলো যে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ, একথাটা যদি আমরা বুঝতে চেষ্টা করি তা হলে স্বামীজীর বক্তব্যের মর্মবাণীর দিকে আমরা বোধ হয় দৃষ্টি ফেরাতে পারি । বিনা দ্বিধায় অবিকম্পিত স্বরে তিনি ঘোষণা করেছেন শূদ্রের আধিপত্য অবশ্যম্ভাবী, কেউ একে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না । "... Time will come when there will be the rising of the Sudra class and their Sudrahood"

তিনি আরও বলেছিলেন, "নতুন ভারত বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে, ঝোপ-জঙ্গল-পাহাড়-পর্বত থেকে" । তাঁর ভরসার স্থল ছিল সাধারণ মানুষ । কেন তাঁর ধারণা ছিল মধ্যবিত্ত এবং অভিজাতরা শরীর এবং মনে একেবারে মরে গেছে । তিনি আরও বলেছিলেন ধনীরা কারও কোন উপকার করেনি । শোষিতদের জন্য সংগঠনের অভাব তিনি খুব অনুভব করেছিলেন । শূদ্রদের আত্মশক্তি প্রয়োগের পথে ঐক্য এবং সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা তিনি দৃঢ়ভাবে অনুভব করেছিলেন ।

স্বামী বিবেকানন্দের সমকালীন সময় ছিল ভারতের নব জাগরণের যুগ । কিন্তু ইউরোপে নবজাগরণ তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল এবং পুরোনো সমাজের গর্ভে নতুন সমাজের আবির্ভাবের দার্শনিক, অর্থনৈতিক ও সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি সূচিত করেছিল । একদিকে বুর্জোয়া গণতন্ত্রে পতাকা উড়ছে, পুঁজিবাদ পোক্ত হচ্ছে । পুঁজিবাদের স্থায়িত্বের দর্শন প্রভাব বিস্তার করেছে । অপরদিকে প্রকৃতি বিজ্ঞানের বিকাশ ভাববাদী দর্শনের ভিত্তিমূলকে নাড়িয়ে দিচ্ছে । মার্কস-এঙ্গেলেসের হাত ধরে উন্নত হচ্ছে । শক্তিশালী হচ্ছে বস্তুবাদী দর্শন, সমাজতান্ত্রিক দর্শনের ভিত্তি গঠনের তত্ত্ব । ইংল্যান্ডে ছিলেন 'ওয়েল' পন্থীরা এবং ফ্রান্সে ছিলেন ফুলিয়ের অনুগামী সমর্থকরা । এরা ছাড়া ছিলেন ইউটোপিয়া সমাজতন্ত্রের পক্ষে সরব । আরও ছিলেন পুঁজি বা মুনাফার ক্ষতি হবে না অথচ সামাজিক ন্যায় বিচারও থাকবে, এমন অদ্ভুত তত্ত্বের প্রবর্তকেরা । এর বিপরীতে চুল মার্কস ও এঙ্গেলস, তাঁরা ঐ দু-ধরনের সমাজতন্ত্রীদের মতবাদের ত্রুটিগুলি ধরিয়ে দেন এবং সমাজ পরিবর্তনের গতিধারা এবং তার অন্তর্নিহিত বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া উদঘাটন করেন । এই সময় আট ঘন্টার কাজের দাবিও শুরু হয়ে যায় ।

যে মতবাদেরই হোন না কেন - সমাজতন্ত্রীরা চার্চদের ভূমিকার বিরুদ্ধে ছিলেন । তারা ধর্মের সমালোচনা করতেন এবং সমাজের ঘটতে থাকা ঘটনাগুলির মধ্যে চার্চের হস্তক্ষেপের নিন্দা করতেন । এই অংশটার সঙ্গে বিবেকানন্দের যোগাযোগ হয়েছিল । কিন্তু মার্কস-এঞ্জেলেসের ধারণার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল -- এমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি ।

ভারতে এই ভাবধারা প্রবেশ করলেও কোন তত্ত্বগত এবং সংগঠিত রূপ প্রকাশ পায়নি । স্বামী বিবেকানন্দ ছাত্র অবস্থাতেই ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে ভালোভাবেই পরিচিত হয়েছিলেন । তিনি পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন । ঐ সময় বিদেশে সম্ভবত স্বামী বিবেকানন্দ সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন । পরবর্তীকালে আমেরিকা ও ইউরোপ পর্যটনের সময় তিনি বিভিন্ন ধরনের সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন ।

বিবেকানন্দ মনে করতেন ভারতবর্ষের ইতিহাস হল - শ্রেণী শাসনের ইতিহাস (তৎকালীন সময়ে মার্কসবাদরা ছাড়া একমাত্র বিবেকানন্দই একথা ভাবতে পেরেছিলেন)। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, ইতিহাসের আদি অধ্যায় ছিল ব্রাহ্মণ শাসন, তারপর ক্ষত্রিয় শাসন, তারপরে বৈশ্য শাসন (বিবেকানন্দের কথায় তা তখনও চলছে) তার পরেই মুদির দোকানের মত জায়গাগুলো থেকে বের করে ভারতকে শূদ্র শাসনের অধীনে নিয়ে আসার কথা বলেছিলেন ।

ভারতের বৈশ্য শাসন সম্পর্কে তিনি যে মন্তব্য করেছেন তা প্রকৃতপক্ষে বৈশ্য শাসনকে পুঁজিবাদী শোষণের সমগোত্রীয় বলে চিহ্নিত করা । বৈশ্য শাসন সম্পর্কে তিনি বলেছেন এটা হচ্ছে 'রক্ত পিপাসু ক্ষমতা' । পুঁজিবাদী শাসন যে নিঃসন্দেহে শোষণ করে তা বিবেকানন্দের চিন্তাকে এড়িয়ে যেতে পারেনি । তবে বিবেকানন্দ শুধু বৈশ্য সভ্যতার সমালোচনাই করেননি, একই সঙ্গে বৈশ্য সভ্যতা যে জ্ঞান, বিজ্ঞান, কৃষি এবং প্রযুক্তির অভাবনীয় সম্পদ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে তারও তিনি সোচ্চার প্রশংসা করেছেন । বৈশ্যদের এই বিষয়ে প্রশংসা করলেও তিনি বলেছিলেন এই শূদ্রের শ্রমের ওপরেই নির্ভর করে ব্রাহ্মণের প্রভাব ক্ষত্রিয়ের ক্ষমতা এবং বৈশ্যের সম্পদ সম্ভব হয়েছে । যাদের নাম দেওয়া হয়েছে নীচু জাতি অন্ত্যজ তারাই হল আসলে সমাজের শরিক, কিন্তু তাদের ইতিহাস কোথায় ? তারা লেখাপড়া শিখলে তাদের জিভ ও মাংস উপড়ে দেওয়া হতো । বিবেকানন্দ আর-একটি কথা বলেছেন যা মার্কসবাদী হিসেবে আমাদের কাছে প্রণিধানযোগ্য । ক্ষত্রিয়ের হাত থেকে ক্ষমতা নেওয়ার সময় বৈশ্যদের এমন কোনো সদিচ্ছা ছিল না যে, ক্ষমতা শূদ্রদের হাতে গিয়ে পড়ুক । মার্কসবাদীরা মিলিয়ে নিতে পারবেন সামন্ততন্ত্রের হাত থেকে পুঁজিবাদী যখন ক্ষমতা দখল করল তারাও শ্রমিক শ্রেণীর হাত থেকে নিজেদের ক্ষমতা বাঁচাতে চাইছিল । বিবেকানন্দ বলেছিলেন, 'সোসালিজম, অ্যানার্কিজম অ্যান্ড নিহিলিজম এই জাতীয় অন্যান্য মতামতগুলি আসন্ন সমাজ বিপ্লবের অগ্রদূত' (বিবেকানন্দ মডার্ন ইন্ডিয়া) 'শূদ্রের আধিপত্য অবশ্যম্ভাবি কেউ একে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না ।'

শূদ্র শাসন কী হিংসার পথে হাঁটবে, না অহিংসার পথে হাঁটবে এ ক্ষেত্রে বিবেকানন্দের স্পষ্ট মত ছিল অহিংসার পথেই হাঁটা উচিত । কিন্তু বাস্তবে কি তা সম্ভব ? কারণ বলবানরা সবসময় দুর্বলদের ওপর অত্যাচার করে । এইজন্য তিনি শূদ্রদেড় উদ্দেশ্যে বলেছিলেন 'বিদ্রোহে তোমার চির অধিকার ।' তিনি আরো বলেছিলেন, সন্ন্যাসীদের পক্ষে অহিংসা সম্ভব কিন্তু ওটা সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভব নয় । উচ্চ-জাতির উচিত হচ্ছে নিম্ন জাতিদের ন্যায্য অধিকার পেতে সাহায্য করা, তা না করে তাদের অবনমিত করতে চাইলে তারা নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যাবে, নিজেদের সমাধি নিজেদেরই খুঁড়তে হবে । যত বিলম্ব বাড়বে তত মার খাবে । কোনো দেশে সাধারণ মানুষের যদি অধিকার না থাকে তাহলে জাতি সংগঠিত হতে পারে না ।

বিবেকানন্দ বলেছিলেন 'আমি সমাজতন্ত্রী তার মানে এই নয় যে, সমাজতন্ত্রকে আমি একটা পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ সমাজব্যবস্থা বলে মনে করি, কারণটা এই যে উপবাস করার চেয়ে আধখানা রুটি খাওয়া ভালো ।' স্বামী বিবেকানন্দের এই উক্তি থেকে বোঝা যায় সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর কিছু ধারণা হয়েছিল । যদিও তিনি ইউটোপিও সমাজব্যবস্থার কথা শুনেছিলেন সেটাই তাঁর প্রেরণার উৎস স্থল ছিল । কিন্তু তাঁর ধারণার মধ্যে কী ভুল ছিল ? ধারণার মধ্যে ভুল ছিল সেটা বলা যাবে না, আমরা যারা মার্কসবাদী তারা জানি সমাজতন্ত্র সাম্যবাদের আগের ধাপ । আবার সমাজতন্ত্রকে বহু পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করতে হয় । সমাজতন্ত্র যত অগ্রসর হয় তত প্রাচুর্য বাড়ে । একবিংশ শতাব্দীর চিন, এ বিষয়ে আমাদের কাছে একটা জ্বলন্ত উদাহরণ । স্বামী বিবেকানন্দের এই উক্তি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে তৎকালীন ভারতীয় সাধক-সন্ন্যাসীদের ও মনীষীদের মধ্যে সর্বপ্রথম শ্রেণীস্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজবিবর্তনের ধারা অনুধাবন করার মতো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয় ।

বিবেকানন্দ কেন প্রত্যক্ষভাবে সমাজ সংস্কারের পথে অগ্রসর না হয়ে ধর্ম সংস্কার ও ধর্ম প্রচারের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন ? বিবেকানন্দ ধর্মের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র ও মানবতন্ত্রের কথাই বেশি বলেছেন । ভারতে তিনিই সর্বপ্রথম সমাজতন্ত্রের আদর্শ প্রচার করেছেন, সেকথা ভুলে গিয়ে তাকে যদি শুধু ধর্ম সংস্কারক বা ধর্মের বিচারক বলে প্রচার করা হয় তবে তাঁর আদর্শকে ও জীবনের ব্রতকে বিকৃত ও খণ্ডিত করা হবে ।

বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক লেখক বিনয় ঘোষের মতে প্রত্যক্ষভাবে সমাজ সংস্কারের পথে না গিয়ে বিবেকানন্দ ধর্মসংস্কারের ওপর জোর দিয়েছেন কেন ? বিবেকানন্দের কাছে ধর্ম মানে কতকগুলি মন্ত্র বা আচার ছিল না । তাঁর কাছে ধর্ম ছিল কতকগুলি প্রত্যয়, বিশ্বাস, ধ্যানধারণা, ন্যায়-অন্যায়, নীতিবোধ ইত্যাদি । সমগ্র জাতির মানস সত্তার মূল ভিত্তিটিকে তিনি সবার আগে শক্ত করতে চেয়েছিলেন । দ্বিতীয়ত তিনি মনে করেছিলেন বৃহত্তর হিন্দু সমাজের কল্যাণের জন্য কিছু করতে হলে প্রথমেই হিন্দু ধর্মকে অপবাদ ও কুসংস্কারের পঙ্ককুন্ড থেকে উদ্ধার করা দরকার । তৃতীয়ত ব্রাহ্ম সমাজের জটিল তত্ত্ব জনসাধারণের কাছে বোধগম্য ছিল না তা ছিল উচ্চশিক্ষিত, উচ্চবিত্তদের মধ্যে আবদ্ধ ব্রাহ্মবাদীরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন । চতুর্থত, সনাতন পন্থী ও হিন্দু জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল । বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ কখনই সংকীর্ণ সনাতনপন্থী ছিলেন না । বিবেকানন্দ ধর্মের মাধ্যমে সমাজতত্ত্ব ও মানবতত্ত্বের কথা বলেছেন । আমাদের দেশে সমাজতন্ত্রের আদর্শ সম্ভবত সর্বপ্রথম বিবেকানন্দই স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন । সুতরাং তাকে শুধু ধর্মসংস্কারক বা ধর্মপ্রচারক বললে ভুল হবে । তাঁর জীবনের ব্রতকেও যথোচিত মর্যাদা দেওয়া হবে না ।

================================================================

আমাদের দেশে যদি আধুনিক রাষ্ট্র চিন্তা ও সমাজচিন্তার ইতিহাস কোনোদিন লেখা হয় তবে স্বামী বিবেকানন্দ যে সেখানে কেবল স্বাদেশিকতা ও স্বাজাত্যবোধের অন্যতম উদ্বোধক বলে স্থান পাবেন তা নয়, তার সঙ্গে সমানাধিকার ও সমাজতন্ত্রের আদর্শের প্রথম প্রবক্তার কৃতিত্বও তিনি দাবি করবেন এবং সে-দাবি ঐতিহাসিক বা সমাজবিজ্ঞানীর পক্ষে অস্বীকার করাও সম্ভব হবে না । তাঁর কালে এই আদর্শের কথা নির্ভীককণ্ঠে প্রচার করতে যে কি প্রচন্ড পৌরুষের প্রয়োজন হয়েছিল তা আজ আমরা কল্পনাও করতে পারব না । কল্পনা করুন আজ থেকে ৭০/৮০ বছর আগে - বিদেশি ব্রিটিশরাজের একচ্ছত্র রাজত্বের যুগে -- কেবল স্বদেশপ্রেমের কথা নয় -- তিনি দেশের উচ্চশ্রেণী ও উচ্চসমাজের মুখের উপর বলেছেন -- 'তোমরা শূন্যে বিলীন হও, নূতন ভারত বেরুক, বেরুক চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে, মালো, মেথরের ঝুপড়ির মধ্য থেকে ।'

সর্ব নিম্নস্তরের মানুষের কাছেও প্রাণের অভিনন্দন পাওয়া যায় - এ তিনি জানতেন । কিন্তু বৈরাগ্যের বাণী বা ধর্মতত্ত্বের কথা তিনি মানুষের কাছে প্রচার করেননি । প্রচার করেছেন ঐতিহ্যের কথা, দেশাত্মবোধের কথা এবং জাতিভেদহীন শ্রেণীভেদহীন সমাজগঠনের কথা । আজকের জাতীয় সংকটের দিনে বিশেষ করে স্বামী বিবেকানন্দের দেশাত্মবোধ ও দেশীয় ঐতিহ্যবোধের আদর্শ এবং তাঁর ভেদবৈষম্যহীন ভারতীয় সমাজগঠনের আদর্শ থেকে আমরা খানিকটা প্রেরণা পেতে পারি । 

Thursday, 15 June 2017

ভারতে সাম্প্রদায়িকতা স্বরূপ-সন্ধান ও আশুবিপদ - একটি নোট - বিজয় পাল

ধর্ম ও মৌলবাদ

বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্ম সবন্ধে বলছেন, " হিন্দু ধর্মের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হইল অন্যান্য ধর্ম ও বিশ্বাস সমূহের প্রতি সহিষ্ণুতা । ... যদি কেউ মনে করে থাকেন যে, ঐক্য আসবে কোন একটি ধর্মের জয়ের ও অন্য সব ধর্মের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে, তাকে আমি বলব : হে আমার ভাই, এটা তোমার ভ্রান্ত আশা । আমি কি চাইব যে, খ্রিস্টানরা হিন্দুধর্ম গ্রহণ করুক ? ঈশ্বর করুন, কখনই না । ... খ্রিস্টান হিন্দু বা বৌদ্ধ হবে না অথবা হিন্দুও বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান হবে না । কিন্তু প্রত্যেককেই অপরের আদর্শ থেকে তার মর্মকথা আত্মস্থ করতে হবে ।"

=========================================================

আদিম মানুষের প্রকৃতির কাছে অসহায়তা থেকে উদ্ভূত অলৌকিক ধারণা পরবর্তীকালে সমাজে আধিপত্য সৃষ্টিকারী শক্তির হাতে ধর্ম বিশ্বাসের মাধ্যমে শ্রেণি শাসনের হাতিয়ারে পরিণত হয় । শ্রেণি শাসনে গরিব মানুষের আর্থিক ও সামাজিক অসহায়তা আরও তীব্র হওয়ায় 'ধর্ম বিশ্বাসের' শেকড় আরও শক্তপোক্ত হয়ে ওঠে ।

... প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়তাজনিত অতিলৌকিক বিশ্বাসকে সমাজে প্রভুত্বকারী শ্রেণি ধর্মের মোড়কে হাজির করেছে এবং তাকে ব্যবহার করেছে, যার শেকড় রয়েছে মানুষের জীবন জীবিকার অধিকারের অপ্রাপ্তি ও অনিশ্চয়তাজনিত হতাশা ও ব্যর্থতার দীর্ঘ নিঃশ্বাসের গভীরে ।

=========================================================

ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম সাম্প্রদায়িকতা 

ধর্মনিরপেক্ষতার ঠিক বিপরীতে রয়েছে সাম্প্রদায়িকতা । আমাদের দেশের সংবিধানে ১৯৭৭ সালে প্রথম 'ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি যুক্ত করা হয় । ধর্মনিরপেক্ষতা ধারণাটি এসেছে ইউরোপের ইতিহাস থেকে । ইউরোপের উদীয়মান বুর্জোয়াদের সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে সংগ্রাম করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে হয়েছিল । সামন্ত প্রভুদের সঙ্গে গীর্জার পাদ্রীদের দৃঢ় গাঁটছড়া বাঁধা ছিল । ফলে সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে তাদের গীর্জার বিরুদ্ধেও লড়তে হয়েছে । ইতিহাসে এই যুদ্ধ 'ক্রুসেড' নামে খ্যাত । এই সংগ্রামের মাধ্যমেই বুর্জোয়ারা বুঝেছিল রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক ছেদ করতে হবে । রাষ্ট্র ধর্মের সঙ্গে যুক্তও হবে না আবার ধর্ম-বিরোধীও হবে না । প্রত্যেক নাগরিকেরই স্বাধীন ধর্মাচরণের অধিকার থাকবে । তবে কেউ কাউকে ধর্মাচরণ করতে বাধ্য করবে না, কারও ধর্মাচরণে বাধাও দেবে না । ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের এই সম্পর্ককেই ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে গণ্য করা হয় । সেজন্যই ইউরোপের বিশেষত ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে কার্যত সকলেই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও ওরা ওদের দেশকে খ্রিস্টান ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেনি ।

=========================================================

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেদ, উপনিষদের উপর ভিত্তি করেই তাঁর আন্তর্জাতিক মানবতাবাদ গড়ে তুলেছিলেন । সেই উপলব্ধি থেকে তিনি লিখলেন, "এই বহু দেব দেবী, বিচিত্র পুরাণ এবং অন্ধ লোকাচার সংকুল আধুনিক বৃহৎ বিকারের নাম হিন্দুত্ব ।" "সাহেবি অনুকরণ আমাদের পক্ষে নিষ্ফল, হিন্দুয়ানী গোঁড়ামী আমাদের পক্ষে মৃত্যু ।" (হিন্দুর ঐক্য) ।

উভয় সাম্প্রদায়িক শক্তির উগ্র প্রচারে বিরক্ত কবি লিখলেন, "একটা দিন আসিল যখন হিন্দু আপন হিন্দুত্ব লইয়া গৌরব করিতে উদ্যত হইল। তখন মুসলমান যদি হিন্দুর গৌরব মানিয়া লইয়া নিজেরা চুপচাপ পড়িয়া থাকিত তবে হিন্দু খুব খুশি হইত সন্দেহ নাই, কিন্তু যে কারণে হিন্দুর হিন্দুত্ব উগ্র হইয়া উঠিল সেই কারণেই মুসলমানের মুসলমানি মাথা তুলিয়া উঠিল। ... আমি হিন্দুর তরফ থেকেই বলছি, মুসলমানের ত্রুটি বিচারটা থাক্‌-- আমরা মুসলমানকে কাছে টানতে যদি না পেরে থাকি তবে সেজন্যে যেন লজ্জা স্বীকার করি।"

তিনি আরও বললেন, "ভারতবর্ষের অধিবাসীদের দুই মোটা ভাগ, হিন্দু ও মুসলমান। যদি ভাবি, মুসলমানদের অস্বীকার করে এক পাশে সরিয়ে দিলেই দেশের সকল মঙ্গলপ্রচেষ্টা সফল হবে, তা হলে বড়োই ভুল করব। ছাদের পাঁচটা কড়িকে মানব, বাকি তিনটে কড়িকে মানবই না, এটা বিরক্তির কথা হতে পারে, কিন্তু ছাদ-রক্ষার পক্ষে সুবুদ্ধির কথা নয়। আমাদের সবচেয়ে বড়ো অমঙ্গল বড়ো দুর্গতি ঘটে যখন মানুষ মানুষের পাশে রয়েছে অথচ পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ নেই, অথবা সে সম্বন্ধ বিকৃত।" এভাবেই উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলার মাধ্যমেই ভারতের প্রকৃত মঙ্গল হতে পারে বলে কবি দৃঢ় মত পোষণ করেন ।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীভৎসতা দেখে তিনি উপলব্ধি করে লিখলেন, "এই মোহমুগ্ধ ধর্ম বিভীষিকার চেয়ে সোজাসুজি নাস্তিকতা অনেক ভাল ।  আজ মিছে ধর্মকে পুড়িয়ে ফেলে ভারত যদি খাঁটি ধর্ম, খাঁটি নাস্তিকতা পায় তবে ভারত সত্যই নব জীবন লাভ করবে ।"

আর এস এস হিন্দু ধর্ম প্রচারের নামে 'হিন্দুত্ব' শব্দটিকে সামনে এনেছে । 'হিন্দুত্ব' শব্দটি হিন্দু ধর্মের কোথাও নেই । কোন হিন্দু ধর্ম গুরুর লেখাতে এই শব্দটি পাওয়া যায় না । হিন্দু ধর্মকে ফ্যাসিবাদের মোড়কে হাজির করার উদ্দেশ্যেই প্রথমে হিন্দু মহাসভা পরে আর এস এস নেতা সাভারকার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ১৯২৩ সালে প্রথম 'হিন্দুত্ব' শব্দটি ব্যবহার করেন । 'হিন্দুত্ব' শব্দের আড়ালে তিনি ভারতে বসবাসকারী সকলকে হিন্দুত্বের অনুসারী হওয়ার নিদান দেন । অর্থাৎ অন্য ধর্ম মতগুলির বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে ধর্মীয় বিভাজনের উদ্দেশ্যে একাজ তিনি করেন । তিনি দাবি করেন 'হিন্দুত্ব' হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট জীবন-ধারা, যার উদ্ভব ভারতেই । অতএব ভারতে থাকতে হলে হিন্দুত্বের জীবনধারা গ্রহণ করতে হবে । এর বাইরে যারা থাকবেন তাদের ভারতের নাগরিকত্ব থাকবে না অর্থাৎ তাদের ভারত ত্যাগ করতে হবে নইলে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো করে থাকতে হবে । এটা খোলাখুলি অন্য ধর্মগুলির প্রতি আক্রমণের আহবান । সোজা কথায় মুসলিম নিধনের আহবান ।

অথচ যে বিবেকানন্দকে ওরা ওদের মতের সপক্ষে বিকৃতভাবে প্রচার করে, তিনি বলছেন, "আমাদের দৃঢ় ধারণা যে, বেদান্তের মতবাদ যতই সূক্ষ্ম ও বিস্ময়কর হউক না কেন, কর্ম পরিণত ইসলাম ধর্মের সহায়তা ব্যতীত তাহা মানব সাধারণের অধিকাংশের নিকট সম্পূর্ণরূপে নিরর্থক। আমরা মানবজাতির সেই স্থানে লইয়া যাইতে চাই — যেখানে বেদও নাই, বাইবেলও নাই, কোরানও নাই , অথচ বেদ, বাইবেল ও কোরানের সমন্বয় দ্বারাই ইহা করিতে হইবে। মানবকে শিখাইতে হইবে যে, সকল ধর্ম একত্বরূপ সেই এক ধর্মেরই বিবিধ প্রকাশ মাত্র, সুতরাং যাহার যেটি সর্বাপেক্ষা উপযোগী সেইটিকেই সে বাছিয়া লইতে পারে । আমাদের মাতৃভূমির পক্ষে হিন্দু ও ইসলাম ধর্ম-রূপ এই দুই মহান মতের সমন্বয়ই বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ - একমাত্র আশা । আমি মানসচক্ষে দেখিতেছি, এই বিবাদ বিশৃঙ্খলা ভেদপূর্বক ভবিষ্যৎ পূর্ণাঙ্গ ভারত বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামিক দেহ লইয়া মহা মহিমায় ও অপরাজেয় শক্তিতে জাগিয়া উঠিতেছে।"

সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে ধিক্কার জানিয়ে তিনি লিখছেন, 'কোনও ধর্মই কখনও মানুষের উপর অত্যাচার করে নাই, কোন ধর্মই কখনও এই ধরনের অন্যায় কার্যের সমর্থন করে নাই । তবে মানুষকে এ-সকল কার্যে উত্তেজিত করিল কিসে ? রাজনীতিই মানুষকে এই সকল অন্যায় কার্য করিতে প্ররোচিত করিয়াছে, ধর্ম নয় ।"

তিনি আরও লিখছেন, "সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি ও এগুলির ভয়াবহ ফল স্বরূপ ধর্মোন্মত্ততা এই সুন্দর পৃথিবীকে বহুকাল অধিকার করিয়া রাখিয়াছে । ইহারা পৃথিবীকে হিংসায় পূর্ণ করিয়া রাখিয়াছে । ইহারা পৃথিবীকে হিংসায় পূর্ণ করিয়াছে, বারবার ইহাকে নরশোণিতে সিক্ত করিয়াছে, সভ্যতা ধ্বংস করিয়াছে এবং সমগ্র জাতিকে হতাশায় মগ্ন করিয়াছে । এই সকল ভীষণ পিশাচ যদি না থাকিত, তাহা হইলে মানব সমাজ আজ পূর্বাপেক্ষা অনেক উন্নত হইত । তবে ইহাদের মৃত্যুকাল উপস্থিত ।"

"যদি এই ভারতে যেখানে চিরদিন সকল সম্প্রদায়ই সম্মানিত হইয়া আসিয়াছেন সেই ভারতে এখনও এইসব সাম্প্রদায়িক বিবাদ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পর দ্বেষহিংসা থাকে, তবে ধিক্ তাহাদিগকে, যাহারা সেই মহিমান্বিত পূর্ব পুরুষগণের বংশধর বলিয়া নিজদের পরিচয় দেয়। ... আমরা সকলকেই আমাদের ভাবে আনিতে পারি না । আমরা যেরূপ ব্যাখ্যা করিব, সকলকেই সে ব্যাখ্যা গ্রহণ করিতে হইবে বা সকলকেই আমাদের প্রণালী অবলম্বন করিয়া চলিতে হইবে জোর করিয়া এরূপ চেষ্টা করা অত্যন্ত অন্যায় । ... অপরকে ঘৃণা করিতে থাকিলে কেহই নিজে অবনত না হইয়া থাকিতে পারে না ... সম্প্রসারণই জীবন, সঙ্কীর্ণতাই মৃত্যু, প্রেমই জীবন, দ্বেষই মৃত্যু ।"

ভাবলে শিউরে উঠতে হয় আর এস এস বিবেকানন্দকে যেভাবে তাদের স্বার্থে প্রচার করছে, বেঁচে থাকলে তিনি এদের সম্বন্ধে কী বলতেন ।

আজীবন নিষ্ঠাভরে হিন্দু ধর্মাচরণ পালন করেও গান্ধীজি আর এস এস-এর সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে স্পষ্ট করে বললেন, "কোটি কোটি ভারতবাসী যারা হিন্দু ছিল ও পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা আর ভারতীয় রইল না --- এই ধারণার বিরুদ্ধে আমি বিদ্রোহ ঘোষণা করি । ... হিন্দু ধর্ম ও ইসলাম দুটি পরস্পর বিরোধী মতবাদ ও সংস্কৃতি - এই ধারণার বিরুদ্ধেও আমার সমস্ত প্রাণ মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে ।"

কমিউনিস্টরা ধর্মাচরণ না করাকেই শ্রেয় মনে করে, কারণ তাঁরা বিশ্ব - প্রকৃতির যাবতীয় সৃষ্টি ও ঘটনা, তার উদ্ভব ও লয়ের কারণ বাইরের কোন শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে - এই ভ্রান্ত ধারণার দ্বারা পরিচালিত হয় না । তাই বলে তারা কারও ধর্মবিশ্বাসকে আঘাত করে না । তারা শুধু মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, কারও সম্পদের পাহাড়, কারও নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার জন্য ঈশ্বরকে দায়ী করা বা তাঁর ইচ্ছাতেই সব হচ্ছে এই ধারণার দ্বারা পরিচালিত না হওয়ার জন্য মানুষকে সমবেত করার চেষ্টা করে । বৈষম্যের কারণ বর্তমান বিশ্ব-ব্যবস্থা তথা আর্থিক-নীতির মধ্যেই নিহিত রয়েছে - এই সত্য তুলে ধরে তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মহাসাগরে সকলকে মেলাতে চায় ।

=========================================================





=========================================================

আমেরিকায় প্রবাসকালে বিবেকানন্দ গো মাংস ভক্ষণ করেছেন । এর বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা অভিযোগ করলে তিনি দৃঢ়ভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন এবং বলেন "ভারতবাসীরা যদি চায় আমি একমাত্র হিন্দু খাবার খাই, তারা যেন আমাকে একজন রান্নার লোক এবং তার জন্য অনেক টাকা পাঠায় ... আমি কারও আদেশে চলিনা, আমি আমার জীবনের উদ্দেশ্য জানি এবং আমার কোন সংকীর্ণতা নেই । আমি যতখানি ভারতীয় ততখানি বিশ্বমানব ।  তোমরা কি বলতে চাও যে আমি ঐ জাতিভেদে জর্জরিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন, নিষ্ঠুর, ভন্ড, নাস্তিক ও কাপুরুষ শিক্ষিত হিন্দুদের মধ্যেই জীবন কাটাবার জন্য এবং মরবার জন্য জন্মেছি ?" (আলা সিংগা নামে তাঁর এক মাদ্রাজি শিষ্যকে লন্ডন থেকে ১৮৯৫ এর ১৮ নভেম্বর লেখা পত্র সংকলনে পাওয়া যায়) । ১৯০২ সালে বিবেকানন্দের মৃত্যুর পরে অমৃতবাজার পত্রিকায় 'The Meat Eating Swami' নামে একটি সম্পাদকীয় লেখা হয়েছিল । (সূত্র - 'সহাস্য বিবেকানন্দ' - শঙ্করীপ্রসাদ বসু )।

=========================================================

Wednesday, 14 June 2017

কমিউনিজমের সামাজিক ও রাজনৈতিক মতবাদ - রজনী পাম দত্ত



সাম্যবাদের লক্ষ্য হল মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য সমাজের এবং অবশেষে একটি একীভূত অখণ্ড সত্তা হিসেবে সমগ্র বিশ্ব-সমাজের উৎপাদিকা শক্তিগুলিকে সংগঠিত করা, বিদ্যমান প্রাকৃতিক সম্পদ, বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা ও কার্যক্ষম প্রতিটি মানুষের সহযোগমূলক শ্রমকে যথাসম্ভব ভালভাবে ব্যবহার করা এবং এর সাহায্যে ত্রুটিপূর্ণ উপায়ে প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগানোর বর্তমান নির্ভরতা থেকে মানবসমাজেকে মুক্ত করা, সেইসঙ্গে বর্তমানের নানান বৈরিতা ও শ্রেণীবিভাজন থেকেও মানবসমাজের মুক্তি ঘটানো । এই পথেই বাস্তবায়িত হবে ভবিষ্যতের স্বাধীন সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা ।

==============================================

সমাজ-গঠনের উচ্চতর পর্যায় হিসেবে সাম্যবাদের সুবিধাগুলি একান্তই স্পষ্ট ।

প্রথমত, বিদ্যমান উৎপাদিকা-শক্তিগুলি, যেগুলি আজ ক্রমবর্ধিত মাত্রায় অব্যবহৃত, অপব্যবহৃত অথবা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে চলেছে, সেগুলিকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হবে ।

দ্বিতীয়ত, বাজারের বেপরোয়া অধিপত্যের নৈরাজ্য, প্রাকৃতিক ও সামাজিক সম্পদের সীমাহীন অপচয় এবং ক্রমবর্ধিত বিধ্বংসী সংকটের বদলে সুসমঞ্জসভাবে পরিকল্পিত উৎপাদন ও উন্নয়ন ।

তৃতীয়ত, ক্রমবর্ধিত চাহিদা পূরণের জন্য উৎপাদনের অবাধ ও সুসমঞ্জস বিস্তার ঘটানো সম্ভব হবে - সেক্ষেত্রে সমাজের শ্রেণীকাঠামো ও পণ উৎপাদনের অবস্থা নিজের মর্জিমাফিক কোনও বাজার-সীমা চাপিয়ে দিয়ে তাকে ব্যাহত করতে পারবে না । উৎপাদনের বিস্তার এবং কলাকৌশলের উন্নতি বিদ্যমান যাবতীয় চাহিদাকে পূরণ করতে সক্ষম হলে তার ফলস্বরূপ আর দারিদ্র্য, সংকট ও সার্বিক বেকারিত্ব দেখা দেবে না, বরং সৃষ্টি হবে বাড়তি চাহিদা পূরণ করার এবং শ্রমের ভার লাঘব করার সম্ভাবনা ।

চতুর্থত, উৎপাদনের বিশ্বব্যাপী সংগঠন - যা একমাত্র সাম্যবাদী ভিত্তিতেই গড়ে উঠতে পারে - অন্য দেশ দখল করা, কাঁচামাল ও শোষণের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে নিজেদের কব্জায় আনার জন্য সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক সংঘাতের অবসান ঘটাবে এবং তার ফলস্বরূপ অবসান ঘটবে অস্ত্রশস্ত্রের বিপুল অপচয় ও বিধ্বংসী যুদ্ধের, যা এই মুহূর্তে গ্রাস করতে চলেছে সমগ্র মানবসমাজকে ।

পঞ্চমত, উন্নত ও পশ্চাদ্পদ জাতি ও দেশগুলির মধ্যেকার, শাসক ও শোষিত দেশগুলির মধ্যেকার পার্থক্য অন্তর্হিত হবে এবং অবসান ঘটবে বর্তমানের ভারসাম্যহীন বিশ্ব-বিকাশের, যেখানে পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চল উন্নত উৎপাদন চালু করার মতো যাবতীয় সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আদিম কলাকৌশল আর শস্তা শ্রমের ঔপনিবেশিক এলাকা হিসেবে পিছিয়ে পড়ে আছে । এইসব এলাকা এবং সেখানকার বাসিন্দাদের দ্রূত উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে সর্বাধিক উন্নত দেশগুলির সমান মাত্রায় উন্নীত করার কাজে ব্যবহার করা হবে বিশ্বের সম্পদকে । সমস্ত দেশের স্বাধীনতা ও সমতার মধ্যে দিয়েই উন্মুক্ত হবে ভবিষ্যতের ঐক্যবদ্ধ মানবজাতি গঠনের পথ ।

ষষ্ঠত, শ্রেণীসমূহের অবলুপ্তির ফলে অবসান ঘটবে বর্তমান সমাজকাঠামোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত পরজীবীবৃত্তি ও অপচয়ের - অবসান ঘটবে ওপরতলার অলসতা আর লুণ্ঠনমূলক কার্যকলাপের, নীচের তোলার মানুষদের বিপথগামী শ্রম, অত্যাধিক মেহনত আর উন্নয়নহীনতার, এবং অর্থহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বিপণন-ব্যবস্থা ও অনুৎপাদিকা কার্যকলাপে সমাজের শ্রমশক্তির ক্রমবর্ধমান অপচয়ের । শ্রেণীর অবলুপ্তি ঘটলে এই সবকিছুরই অবসান ঘটবে ।

সপ্তমত, শ্রেণীগুলির অবলুপ্তি ঘটলে শ্রেণী-সংঘাতের সর্বনাশা বোঝার হাত থেকে মুক্তি পাবে সমাজ, আর তার ফলস্বরূপ অবসান ঘটবে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার এবং সার্বজনীন গঠনমূলক কর্তব্যের বদলে শ্রমশক্তির ভিন্নপথে চালিত হওয়ার (যা বর্তমানে অপরিহার্য ও প্রয়োজনীয়, সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে উৎপাদনের উপকরণসমূহের সামাজিক মালিকানা অর্জিত না-হওয়া পর্যন্ত যা টিকে থাকবে)।

অষ্টমত, বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেক হল নারীরা, যারা এখনও পরাধীন ও অনুন্নতই রয়ে গেছে । তাদের প্রকৃত মুক্তি একমাত্র তখনই সম্ভব, যখন সামাজিক উৎপাদনে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে নারীরা, যখন মাতৃত্বের দায়িত্ব সামাজিকভাবে বহন করা হবে এবং যখন অর্থনৈতিকভাবে নারীরা আর পুরুষদের ওপর নির্ভরশীল থাকবে না ।

নবমত, সংস্কৃতি আর একটিমাত্র শ্রেণীর একচেটিয়া সম্পত্তি হয়ে থাকবে না, তা পরিণত হবে সকলের সাধারণ ঐতিহ্যে । শ্রেণীগত পার্থক্যের যাবতীয় অবশেষ নিশ্চিহ্ন হওয়ার পর এবং নতুন ও পূর্ণবিকশিত সাম্যবাদী মানবতার বিবর্তন সম্পূর্ণ হওয়ার পর, মানসিক শ্রম ও কায়িক শ্রমের মধ্যেকার বৈরিতা, শহর ও গ্রামের মধ্যেকার বৈরিতা এবং বিদ্যমান শ্রমবিভাজনের উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ সম্পূর্ণভাবে অবলুপ্ত হবে ।

দশমত, শ্রেণীগত পার্থক্য সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পরবর্তী সাম্যবাদী সমাজে একটি অধীনস্থ শ্রেণীকে দমন করার এবং সামাজিক দ্বন্দ্বকে বলপ্রয়োগের সাহায্যের স্তব্ধ করার যন্ত্র হিসেবে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অবসান ঘটবে । তখন সামনে এসে দাঁড়াবে সামাজিক উৎপাদনের যৌথ পরিচালনার সার্বজনীন দায়িত্ব, যে-কাজে সকলেই অবাধে ও সচেতনভাবে অংশগ্রহণ করবে । মানবিক সম্পর্কের সমগ্র ব্যবস্থা থেকে অন্তর্হিত হবে সব ধরণের দমনপীড়ন । পরিপূর্ণভাবে বিকশিত সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার নীতি হল, 'প্রত্যেকে দেবে তার সামর্থ্য অনুযায়ী, পাবে তার প্রয়োজন অনুযায়ী ।'

সাম্যবাদের এইসব ধারণা নিছকই 'আকাশকুসুম', 'কাল্পনিক' ও 'ভাববাদী' হিসেবে প্রতিভাত হবে আজকের দিনের বাণিজ্যিক বা প্রশাসনিকভাবে প্রশিক্ষিত 'বাস্তববাদী মানুষ' বা 'সম্মানিত নাগরিক'-দের কাছে, যারা 'জানে' যে এই ধরনের কোনও সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার সামর্থ্য মানবচরিত্রের নেই, লোভ, অলসতা, দ্বন্দ্বপ্রিয়তা আর ব্যক্তিগত ক্ষমতালিপ্সাই মানবচরিত্রের সহজাত বৈশিষ্ট্য, মানবসমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে কাজ করতে ও নিজেদের ভাগ্যকে মেনে নিতে বাধ্য করানোর জন্য দমনপীড়ন ও বাহ্যিক শৃঙ্খলার চাবুক আর অনাহারের ভীতির মধ্যে রেখে দেওয়া একান্তই অপরিহার্য ।

তবে এইসব অদূরদর্শী ও সংকীর্ণমনা 'বাস্তববাদী মানুষরা', যারা একটি বিশেষ ঐতিহাসিক পর্যায়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে মানবজাতির তথাকথিত চিরন্তন ও বিশ্বজনীন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খুঁজে বেড়ায়, তারা যেমনটা ভাবে কমিউনিস্টরা তেমন বাস্তবতাবর্জিত নয় । কমিউনিস্টরা খুব ভালভাবেই জানে যে তথাকথিত অপরিবর্তনীয় - বাস্তবে নিরন্তন পরিবর্তনশীল - মানবচরিত্র হচ্ছে প্রতিটি ঐতিহাসিক পর্যায়ে সেই পর্যায়ের সামাজিক অবস্থারই ফসল । তারা এ-ও জানে যে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা অবশ্যম্ভাবীরূপে অত্যন্ত কুৎসিত ও সমাজবিরোধী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্ম দেয় এবং যারা এক নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে তাদের মধ্যে প্রথমদিকে পুরনো পুঁজিবাদী দুনিয়ার বেশ কিছু অভ্যাস ও দৃষ্টিভঙ্গি রয়ে যেতে বাধ্য, নতুন সমাজব্যবস্থা গঠনের চলমান প্রক্রিয়াই তার নির্মাণকারীদের চরিত্র ও সাংস্কৃতিক মানের উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম ।

এই কারণেই প্রকৃত সাম্যবাদী সমাজে উত্তরণ রাতারাতি বা এক বছরের মধ্যে ঘটে যেতে পারে না (এবং কল্পিত যাবতীয় সমস্যাগুলি এই ধরনের উদ্ভট অনুমান থেকেই জন্ম নেয়), বরং সেই উত্তরণ হচ্ছে বিকাশের এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ারই চূড়ান্ত ফল । সাম্যবাদী সমাজমুখী এই বিকাশ একটি নিম্নতর স্তর অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের পথ বেয়ে অগ্রসর হয়ে উন্নীত হবে উচ্চতর স্তরে অর্থাৎ সাম্যবাদে ।

==============================================

বিজ্ঞানী, বিশেষ বৃত্তিজীবী ব্যক্তি, স্থপতি ও প্রশিক্ষিত প্রশাসকদের মতো প্রকরণগত বুদ্ধিজীবীরা, সেইসঙ্গে চিকিৎসক, শিক্ষক ও অন্যান্যরা শ্রমিকশ্রেণী কর্তৃক ক্ষমতাদখল এবং তার পরবর্তী সমাজতন্ত্র নির্মাণের কাজে এক অমূল্য সহযোগীর ভূমিকা পালন  করতে পারেন । কিন্তু তাঁরা কোনও স্বাধীন ভূমিকা পালন করতে পারেন না (যেমনটা অনেক সময় বলা হয়ে থাকে) । উৎপাদনেরউপায়সমূহের স্বাধীন মালিকানা অর্জন করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয় । তাঁদের সামনে দু'টিমাত্র পথ আছে : হয় পুঁজিপতি শ্রেণীর সেবা করা, নয়তো শ্রমিকশ্রেণীর সেবা করা । এঁদের মধ্যেকার সবথেকে প্রগতিশীল ব্যক্তিরা ক্রমশই এ-সত্য উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন এবং শ্রমিকশ্রেণীর পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন ।

==============================================

শ্রমিকশ্রেণীর সচেতন অংশ অর্থাৎ অগ্রগামী কমিউনিস্টরা এই প্রক্রিয়ার বিকাশে সহায়তা করতে ও তাকে ত্বরান্বিত করতে পারে, এবং এর অবশ্যম্ভাবী ক্ষয়ক্ষতিকে কমিয়ে আনতে পারে, কিন্তু এই প্রক্রিয়াকে পরিহার করার কোনও সংক্ষিপ্ত পথ নেই --- কেননা এই প্রক্রিয়ায় শ্রমিকরা তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার সাহায্যে শিক্ষালাভ করে ।

==============================================

গুরুত্বপূর্ণ সোভিয়েতগুলিতে - পেত্রোগ্রাদ ও মস্কো সোভিয়েত, প্রাক-সংসদে ট্রেড ইউনিয়নভিত্তিক প্রতিনিধিত্বে, উত্তরাঞ্চলীয় সৈন্যবাহিনীতে, পেত্রোগ্রাদ  ও মস্কোর স্থানীয় নির্বাচন ইত্যাদিতে প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে বলশেভিক পার্টি সংখ্যাধিক্য অর্জন না-করা পর্যন্ত বলশেভিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়নি ।

==============================================

বিপ্লব অথবা একনায়কত্বকে কেউ নিশ্চয়ই গোলাপের রঙে চিত্রিত করার চেষ্টা করবেন না । কোনও বর্বর ও নির্মম শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের কঠোর বাস্তবতাকে সহ্য করতে অপারগ ভাবপ্রবণ সমর্থনের বদলে পাঠক যদি কমিউনিজমের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, তা-ও বরং ভাল । তবে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার আগে তাঁরা নিশ্চিতভাবে জেনে নিন-যে-জগতের দিকে তাঁরা মুখ ফেরাচ্ছেন সে-জগৎ হল ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ  ঔপনিবেশিক দাসত্বের জগৎ, যাদের কৃত নির্বিচার গণহত্যা ও ধ্বংসের পরিমাণ সর্বহারা বিপ্লবের সমগ্র ঘটনার তুলনায় সহস্রগুণ অধিক । 

Thursday, 1 June 2017

শহীদ স্মৃতি - শিব বর্মা


এই স্মৃতিকথা পড়ে জনৈক বন্ধু মন্তব্য করেছিল যে, এতে মন্দিরের দেবতাগুলি ভেঙে যেতে পারে । আমি তার সঙ্গে একমত হতে পারিনি । আমার বিশ্বাস যখন মহাপুরুষের পদচিহ্ন ধরে আমরা চলতে চাই না অথবা তাঁর মতো নিজে হতে চাই না তখন তাঁকে দেবতা বানিয়ে মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করি, তখন তিনি মানুষের সারি থেকে পৃথক হয়ে শুধু পূজার বস্তু হয়ে পড়েন যার গুনগান করা যায় বটে কিন্তু তাঁর মতো নিজেকে গড়ে তোলার কথা চিন্তা করা যায় না, কেন না সব মানুষ দেবতা হতে পারে না । তাছাড়া যখন আমরা কোন মানুষকে দেবতারূপে গড়ার জন্য যত্নবান হই তখন তার মানবসুলভ রূপ চাপা পড়ে যায় এবং সেখানে একটি কৃত্রিম বা মন-গড়া প্রতিমা তৈরি হয় । আদর্শ হলেও সে মূর্তি, কৃত্রিম হয়ে থাকে । আমরা তাকে সহৃদয়তা দিয়ে ভালোবাসতে পারি না । পারি না তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে আপন করে নিতে । এই স্মৃতিকথায়, আমি সাথীদের মানুষ হিসাবে যেমন পেয়েছিলাম, তেমন ভাবেই তাঁদের চিত্রিত করতে প্রয়াস পেয়েছি । রিটাচিং বা কাট-ছাঁট করে এদের দেবতা বানানো যেত । কিন্তু তাহলে এদের স্বাভাবিক আকর্ষণ মুছে যেত । তখন এই চিত্রের এই প্রতিমার সামনে মাথা নত হতো ঠিকই কিন্তু তাদের তুলে নিয়ে চুমো খাবার ইচ্ছা হয়তো হতো না । তাকে হয়তো পুষ্পার্ঘ্য নিশ্চয়ই দেওয়া হতো কিন্তু কর্মক্ষেত্রে তারা প্রেরণা যোগাতে পারতো না । - শিব বর্মা

=================================================

সর্দার ভগত সিংহ

ভগৎ সিংহের আগে বিপ্লবীদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল দেশের স্বাধীনতা । তবে এই স্বাধীনতা সম্পর্কে আমাদের কি মনোভাব, তার আগে সে-সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্বচ্ছ ছিল না । ইংরেজ বড়োলাটকে হঠিয়ে সেই জায়গায় কোন ভারতীয়কে বসিয়ে দিলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ? সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং তার ভিত্তিতে মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ অব্যাহত থাকতে আমরা কি যথার্থভাবে স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারবো ? স্বাধীনতার পর সরকার কার হবে, ভাবী সমাজের রূপরেখা কেমন হবে ইত্যাদি বিষয়ে বিপ্লবীদের মধ্যে বিশেষ অস্পষ্টতা ছিল । বিপ্লবীদের মধ্যে ভগত সিংহই প্রথম এই সব প্রশ্ন উত্থাপন করে এবং সমাজবাদকে দলের উদ্দিষ্টরূপে সামনে নিয়ে আসে । তার বক্তব্য, দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্যে লড়াই লক্ষ্যের দিকে প্রথম পদক্ষেপ মাত্র । সেখানে পৌঁছে যদি আমরা থেমে যাই তাহলে অভিযান আমাদের অর্ধ সমাপ্ত থেকেই যাবে । সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা আসলে অল্পসংখ্যক লোকের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবার স্বাধীনতাই হয়ে দাঁড়াবে । শোষণ ও বৈষম্যের মূলোৎপাটন করার ভিত্তিতে গঠিত সমাজবাদী সমাজ ও সমাজবাদী রাষ্ট্র ক্ষমতাই রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটাতে পারে ।

সে সময়টায় সমাজবাদ ছিল যুগের ডাক । বিপ্লবীদের মধ্যে ভগত সিংহই সর্বপ্রথম সেই ডাক শুনে চিনতে পারে । তার অন্যান্য সাথীদের চেয়ে এইখানটায় তার মহত্ত্ব ।

=================================================

হাইকোর্টের সামনে বিপ্লবের পরিভাষা করতে গিয়ে সে বলে : "বিপ্লব হলো জগতের নিয়ম । এটা হলো মানব প্রকৃতির রহস্য ।" কিন্তু "এতে রক্তেরাঙ্গা সংঘর্ষ অনিবার্য, তাতে না আছে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার কোন স্থান । সেটা বোমা ও পিস্তলের কোন সম্প্রদায় নয় ।"

"বিপ্লব বিরোধীরা কেবল পিস্তল, বোমা, তলোয়ার ও রক্তপাতকেই বিপ্লব বলে থাকে । কিন্তু বিপ্লব এগুলিতেই সীমাবদ্ধ নয় । এই জিনিসগুলি বিপ্লবের উপকরণ হতে পারে কিন্তু এগুলির ব্যবহারের পেছনে বিপ্লবের বাস্তবিক শক্তি জনগণের, সমাজের অর্থনীতিক ও রাজনীতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের উদ্দেশ্যের মধ্যেই নিহিত থাকে ।"

"আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিপ্লবের উদ্দেশ্য কিছু ব্যক্তির রক্তপাত করা নয় । আমাদের উদ্দেশ্য হলো মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ ব্যবস্থাকে শেষ করে এই দেশের জন্য আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রাপ্ত করা ।"

=================================================

"আপনি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কথা বলছেন । আমি জিজ্ঞেস করি, সর্বশক্তিমান হওয়া সত্ত্বেও আপনার ভগবান অন্যায়, অত্যাচার, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, শোষণ, অসাম্য, দাসত্ব, মহামারী, হিংসা ও যুদ্ধ প্রভৃতিকে শেষ করে দেয় না কেন ? এসবকে শেষ করে দেবার শক্তি থাকা সত্ত্বেও যদি সে মানবজাতিকে এই অভিশাপগুলি থেকে মুক্ত না করে তাহলে নিশ্চয়ই তাকে ভালো ভগবান বলা যায় না । আর যদি এগুলিকে শেষ করার ক্ষমতা তার না থাকে তাহলে সে সর্বশক্তিমান নয় । যদি সে এসব খানিকটা খেলা দেখাবার জন্য লীলার ছলে করে তাহলে একথাই বলতে হবে যে সে অসহায়দের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মজা দেখার এক নির্দয় ক্রূর সত্তা । জনহিতের জন্য সে যত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় ততই ভালো । মায়াবাদ, ভাগ্যবাদ, ঈশ্বরবাদ ইত্যাদিকে আমি মুষ্টিমেয় ক্ষমতালোভী শোষকদের জনসাধারণকে ভুলিয়ে রাখার জন্য আবিষ্কৃত বিষাক্ত জিনিস ছাড়া আর কিছু মনে করি না ।"

=================================================

"আমি বিশ্বাস করি যে এপর্যন্ত যে অর্থে এই শব্দের ব্যবহার হয়ে এসেছে সেই অর্থে এখন এর আর বাজার নেই । আজ পর্যন্ত প্রায় সব ধর্মই মানুষকে পরস্পরের কাছ থেকে আলাদা করেছে, নিজেদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করেছে । জগতে আজ পর্যন্ত যত রক্তপাত ধর্মের নামে ধর্মের ঠিকাদাররা করেছে অত বোধ হয় কেউ করেনি । সত্য কথা হলো এই যে এই ধরিত্রীর স্বর্গকে ধর্মের নামেই তচনচ করা হয়েছে । যে ধর্ম মানুষকে মানুষ থেকে পৃথক করে, ভালোবাসার জায়গায় পরস্পরকে ঘৃণা করতে শেখায়, অন্ধবিশ্বাসকে উৎসাহ দান করে, মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে, বুদ্ধিভ্রংশ ঘটায়, সেই ধর্ম কোনদিনই আমার ধর্ম হতে পারবে না । যা প্রতিপদে মানুষকে সুখী করতে পারে, সমতা, সমৃদ্ধি ও ভ্রাতৃত্বের পথে তাকে এক পা এগিয়ে দিতে পারে, আমার কাছে তাই হলো ধর্ম । অল্প কথায় বলতে গেলে এই পৃথিবী আর ভারতের এই পবিত্রভূমি হলো আমার স্বর্গ । এর মাটিতে বিচরণকারী প্রতিটি ব্যক্তি, প্রতিটি মানুষ আমার দেবতা, আমার ভগবান । আর ভগবানকে ভগবানের সঙ্গে লড়িয়ে আমার স্বর্গকে যে শক্তিগুলি নরক করে তুলেছে সেগুলিকে শেষ করে মানুষকে শ্রেণীহীন সমাজের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রত্যেকটি প্রচেষ্টা, প্রত্যেকটি পদক্ষেপ আমার ধর্ম ।"

=================================================

তাদের কাছ থেকে শেষবারের বিদায় নিয়ে আমরা যখন চলে যাচ্ছি তখন আমাদের মধ্যে একজন (জয়দেব কপূর) ভগত সিংহকে জিজ্ঞেস করলো, "সরদার, তুমি মরতে যাচ্ছ । আমি জানতে চাই তুমি এর জন্য আফসোস করছো না তো?"

প্রশ্নটি শুনে প্রথমে সরদার অট্টহাস্য করলো তারপর গম্ভীর হয়ে বললো, "বিপ্লবের পথে পা বাড়াবার সময় আমি ভেবেছিলুম যদি আমি আমার জীবন দিয়ে দেশের চতুর্দিকে ইনকিলাব জিন্দাবাদ-এর ধ্বনি পৌঁছে দিতে পারি তাহলে মনে করবো যে আমি আমার জীবনে মূল্য পেয়ে গিয়েছি । আজ ফাঁসির এই কুঠুরির মধ্যে গরাদের পিছনে বসেও আমি কোটি কোটি দেশবাসীর কণ্ঠ থেকে সেই ধ্বনির হুঙ্কার শুনতে পাই । আমি বিশ্বাস করি আমার এই ধ্বনি স্বাধীনতা সংগ্রামের চালক শক্তিরূপে সাম্রাজ্যবাদীদের ওপর শেষ পর্যন্ত আঘাত করতে থাকবে ।" আবার কিছুটা থেমে নিজের স্বাভাবিক স্মিতহাস্যের মধ্যে সে ধীরে বললো, "আর এত ছোট জীবনের এর চেয়ে বেশি মূল্য কিই বা হতে পারে ?"

=================================================

ফাঁসির মঞ্চে ওঠার সময় ভগত সিংহ একজন ইংরাজ ম্যাজিস্ট্রেটকে সম্বোধন করে বললো, "ম্যাজিস্ট্রেট মহাশয়, আপনি সত্যি সত্যিই বড় ভাগ্যবান, কারণ আপনি এই দৃশ্য দেখার সুযোগ পাচ্ছেন যে একজন ভারতীয় বিপ্লবী তার মহান আদর্শের জন্য কিভাবে হাসতে হাসতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে।"

=================================================

চন্দ্রশেখর 'আজাদ' 

এ কথা ঠিক যে আমরা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রবক্তা ছিলাম কিন্তু সে বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল প্রত্যেক মানুষের যাতে সুখ শান্তি হয় তার ব্যবস্থা করা । 'বসুধৈব কুটুম্বকম্' ছিল আমাদের উদ্দেশ্য । তাই প্রত্যেক মানুষের জীবনের প্রতি আমাদের ছিল গভীর মমত্ববোধ । আমরা সমকালীন ব্যবস্থার বিরোধী ছিলাম । কোন ব্যক্তি বিশেষের শত্রূ ছিলাম না । ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে আমাদের কঠোর নীতি সেই সূত্রেই আসতো যখন যে চলতি রাজনীতি ও সামাজিক অসাম্য-ব্যবস্থার প্রতিনিধিরূপে আমাদের সম্মুখীন হতো ।

=================================================

যাঁরা আজাদকে ফ্যাসিস্ত বলেছেন তাঁরা তার কতকগুলি বাহ্যিক আচার আচরণই দেখেছেন । বস্তুত আজাদের অন্তর যে সর্বদাই আদর্শবোধে সজাগ থাকতো তা এরা বুঝতে পারেননি অথবা বুঝেও না বোঝার ভান করেছেন । অহিংসা নীতিতে অবিশ্বাস, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ত্রাস নীতি, সেনাবাহিনীর প্রাধান্য হলো ফ্যাসিবাদের বাহ্যিক প্রকাশ । আজাদও অহিংসায় বিশ্বাস করতো না ঠিকই । নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে তার জন্ম এবং ছোটকাল থেকেই সে সামরিক প্রকৃতিরই ছিল । কিন্তু এটুকুর জন্য কি তাকে ফ্যাসিস্ত বলা যায় ? ফ্যাসিবাদের লক্ষ্য হলো বর্তমান বিপ্লবী আন্দোলনে বাধা সৃষ্টি করা, তাকে বিপথগামী করা, সাম্রাজ্যবাদের শক্তি বৃদ্ধি করা এবং সাধারণ মানুষকে গালভরা কথায় ভুলিয়ে ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদকে জিইয়ে রাখা । আজাদ এবং তার দল সম্পর্কে এর মধ্যে একটা কথাও প্রযোজ্য নয় । আজাদ ছিল সাম্রাজ্যবাদের ঘোরতর শত্রু । তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদের অবসান ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা স্থাপন করা ।

=================================================

শিবরাম হরি রাজগুরু

বিপ্লবী জীবনে ভগত সিংহকে তার সব চেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে গণ্য করতো রাজগুরু । জাতীয় মুক্তি অর্জনের সংগ্রামে কে এগিয়ে গিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়বে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল তার জন্য । ভগত সিংহ তার আগে যেন শহীদ না হয় এটাই ছিল তার নিয়ত চিন্তা । যখনই কোন অ্যাকশনের কথা হতো তার একমাত্র দাবি থাকতো তাকে উক্ত অ্যাকশনে আগে পাঠাতে হবে ।

=================================================

দেশ ও জাতির পুনর্বাসনের প্রকৃষ্ট পন্থা যে সাম্যবাদ অথবা সমাজতন্ত্রবাদ, এ-বিশ্বাস তার পূর্ণমাত্রায় ছিল । এর মানে এই নয় যে এই উভয় তত্ত্ব সম্পর্কে সে গভীর ও বিস্তৃত জ্ঞান অর্জন করেছিল । সমাজতন্ত্রবাদ বলতে কি বোঝায়, এর রূপায়ণের জন্য কি ও কোন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে, সমাজতান্ত্রিক সমাজের মৌল লক্ষণসমূহ কি হবে, ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর দিতে সমর্থ ছিল তাও বলছি না । মূল কথা সে যা বুঝেছিল তা হলো, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যারা বিবিধ সম্পদ তৈরি করে তারা শ্রমের বিনিময়ে যৎসামান্যই পেয়ে থাকে । সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়  এ বৈষম্য দূর করা সম্ভব হবে । সেখানে ধনী-দরিদ্র বিভেদ থাকবে না । সবাইকে শ্রম করে খেতে-পরতে হবে । কোন ব্যক্তি বিশেষ বা সম্প্রদায় বিশেষ কারো পরিশ্রমলব্ধ তৈরি সম্পদ আত্মস্বার্থে বা সম্প্রদায়-স্বার্থে ব্যবহার করতে পারবে না । সমগ্র সমাজের কল্যাণে উদ্বৃত্ত সম্পদ ব্যয়িত হবে । অপর কথায় শোষণব্যবস্থা লুপ্ত হবে । কোন দেশ তদ্দেশীয় কোন বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে অপর দেশ অধিকার করে তা লুন্ঠন করবে না । অর্থাৎ দুর্বল ও অনগ্রসর দেশ ও জাতি সমূহকে গোলামে পরিণত করবে না ।

মার্কসবাদী তত্ত্ব এবং সাম্যবাদের বুনিয়াদী মতাদর্শ সমূহ না জানলেও রাজগুরু তার নিজ জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে গভীরভাবেই বুঝেছিল দারিদ্র্যের কি দুঃসহ জ্বালা, পদে-পদে কি ভীষণ লাঞ্ছনা, অনাদর আর অবহেলা । এই অভিজ্ঞতাই, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতি তার নিষ্ঠা সঞ্চার করার ভিত্তি রচনা করেছিল; এই আদর্শে অনুপ্রাণিত করেছিল । কালক্রমে এটাই গভীর প্রত্যয় এবং প্রেরণা রূপে তার হৃদয়ে গেঁথে যায় ।

=================================================

আমি ঢাকা-ঢাকি না করে সোজাসুজিই বললাম, "মরতে ভয় পাচ্ছ ? যা কিছু করেছো তার জন্য অনুশোচনা হচ্ছে ?"

আমার কথা শুনে প্রথমে মৃদু হাসল । পরক্ষণেই গম্ভীর ও দৃঢ় কণ্ঠে বললো "তোমার কাছে এধরনের কথা শুনবো ভাবতে পারিনি । অন্তত তুমি ভালোভাবেই জান যে আমি মরতে ভয় পাই না ।  আজ তোমাকে যা বললাম তা হলো আমার অন্তরের অনুরণন । দারিদ্র্য হলো অভিশাপ । আর স্নেহ-প্রীতি-মমতার অনাস্বাদ হলো নরক । এই অনুভূতি হলো আমার বাইশ বছরের জীবন নিঙড়ানো বিশ্লেষণ । কিছু লোক আমাদের দারিদ্র্যের পঙ্কে ডুবিয়ে রাখে । স্নেহ-ভালোবাসার পরিবেশ থেকে বঞ্চিত করে তাই । এ পৃথিবী সুন্দর, মনোরম আর সুখকর । তাই এই সুন্দর পৃথিবীতে ভালোবাসা ও প্রীতির মধুর স্পর্শ আরো কিছুকাল ভোগ করতে কার না সাধ হয় । এই স্বাভাবিক মানবিক অনুভূতিকে তুমি বলবে মৃত্যুকে ভয় করা?" রাজগুরু কিছু সময়ের জন্য নীরব হয়ে গেল । আবার বলতে লাগল, "মৃত্যুর সঙ্গে গলাগলি করার জন্য প্রস্তুত হয়েই তো এই সত্যকে চিনেছি । তুমি কি ভাবছ যে সে সংগ্রামের এই অন্তিম পর্বে এসে, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলবো আমায় ছেড়ে দাও । মনে রেখো আমি যা কিছু করছি তা তোমাদের মতো প্রত্যয়দৃঢ় হয়েই করেছি । যে স্বর্গ আমরা রচনা করতে চাই তার আবরণ উন্মোচন করে যদি এতটুকু আলোও দেখাতে ওয়ারী কোটি কোটি দেশবাসীকে আমার প্রাণের বিনিময়ে তা'হলে তাই হবে অনেক । বাকি কাজ দেশের মানুষ নিজেরাই পূর্ণ করে নেবে । এমন আলোকোজ্জ্বল মহান মৃত্যুকে যে ভয় করে তাকে মূর্খ ছাড়া আর কি বলবো । একজন বিপ্লবীর নিকট এ মৃত্যু আশীর্বাদ ।"

=================================================

সুখদেব

বিপ্লবীদের উদ্দেশ্যের সাফল্যে তার বিশ্বাস কতখানি অটল ছিল তার প্রমাণ ফাঁসির কিছু পূর্বে গান্ধীকে লেখা তার চিঠি । "বিপ্লবীদের লক্ষ্য হলো এদেশে সোস্যালিস্ট গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা । এ লক্ষ্যের সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই । ... আমি মনে করি ... আপনার এই ধারণা হবে না যে বিপ্লবীরা যুক্তিহীন হয় এবং তারা নিছক ধ্বংসের কাজে আনন্দ পায় । আমরা আপনাকে জানিয়ে দিতে চাই যে, সত্য কথা এর বিপরীত । তারা প্রত্যেকটি পদক্ষেপের পূর্বে চারদিককার সম্বন্ধে বিচার করে নেয় । তারা তাদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সদা সচেতন থাকে । তারা আপন বিপ্লবী বিধানে গঠনমূলক কাজের উপযোগিতাকে মুখ্য স্থান দেয়, যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে তার ধ্বংসাত্মক দিকটাই বেশি নজর দিতে হয়েছে ।"

"... সে দিন আর বেশী দূর নেই তাদের (বিপ্লবীদের) নেতৃত্বে ও তাদের পতাকার তলে জনগণকে তাদের সমাজবাদী প্রজাতন্ত্রের উচ্চ লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে দেখা যাবে ।"

এই চিঠির এক স্থলে তার ফাঁসির সাজা সম্বন্ধে সে লিখলো, "লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার তিন জন অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ডের হুকুম হয়েছে এবং যারা ঘটনাক্রমে দেশে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেছে তারাই বিপ্লবী দলের সব কিছু নয় । বাস্তবিক পক্ষে তাদের মৃত্যুদণ্ড মকুব হলে দেশের পক্ষে ততো কল্যাণকর হবে না যতখানি হবে তাদের ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুবরণ করলে ।"

=================================================

মহাবীর সিংহ

মহাবীরের বাবার সে চিঠির অক্ষর ও শব্দ আজ বিয়াল্লিশ বছর পরও আমার হুবহু মনে পড়ছে । তিনি লিখেছিলেন :

"একথা জেনে খুবই আনন্দিত হলাম যে, তুমি দেশের কাজে নিজেকে অর্পণ করতে কৃতনিশ্চয় হয়েছ । আমার তো ধারণা হয়েছিল যে, আমাদের বংশে পূর্বপুরুষের রক্ত আর নেই । সবাই মনে-প্রাণে দাসত্ব মেনে নিয়েছে । তোমার চিঠি পড়ে আজ আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি ।"

"যেখানে তোমার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল, তাদের আজ উত্তর লিখে দিয়েছি । তুমি এ বিষয়ে নিশ্চিত থেকো যে আমি এমন কিছু করবো না যাতে তোমার সংকল্পে বাধা সৃষ্টি হয় ।"

"দেশ সেবার যে পথ তুমি বেছে নিয়েছ, মনে রেখো, তা সাধনার পথ, বড়ই দুরূহ সেই পথ । তবু তুমি যখন এই পথে পা বাড়িয়েছ তখন আর পিছনে ফফিরে তাকাবে না । সাথীদের ধোঁকা দিও না এবং তোমার বৃদ্ধ পিতার নামের খেয়াল রেখো ।"

"তুমি যেখানেই থাক না কেন আমার আশীর্বাদ তোমার সঙ্গে থাকবে ।"

- তোমার পিতা, দেবী সিংহ

=================================================

অনশন শেষ হবার পর সহকর্মী জয়দেব কাপুর মহাবীর সিংহের একটি নোট বই পেয়েছিল । কাপুরের কথায় ঐ নোট বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় পুশকিনের একটি ছোট কবিতা লেখা ছিল যা মহাবীর সিংহের উপযুক্ত । ওই কবিতা ও তার অনুবাদ নিচে দিলাম । এই কবিতার ছত্রগুলি মহাবীর সিংহের বিপ্লবী জীবন বুঝতে সাহায্য করবে ।


I know destruction awaits him,
who first rises
Against the oppressor's yoke;
My fate is sealed aand closed,
But tell me where and when
Without victims
Was ever freedom won?
For my native land I perish
I feel it and I know it
And in my heart O Holy father!
My fatal star
I bless!

=================================================

যতীন্দ্রনাথ দাশ

লাহোরে কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৬২ দিন অনশন সংগ্রাম চালানোর পর শহীদের মৃত্যুবরণ করেন ।

অবশেষে ১৩ই জুলাই, ভগত সিংহ ও দত্তের সমর্থনে আমাদের মধ্যে দু'চার জন ব্যতীত আর সবাই অনশন সংগ্রাম আরম্ভ করলো ।

আমাদের মধ্যে একমাত্র যতীন দাশ ছাড়া কারো অনশনের অভিজ্ঞতা ছিল না । ভাবাবেগে চালিত হয়ে অনশন সংগ্রামে যোগ দিতে যতীন্দ্রনাথ নিষেধ করলো সাথীদের । সে বললো, "রিভালবার পিস্তল নিয়ে লড়াই করার চেয়ে  অনেক বেশি কঠিন এক অনশন সংগ্রামে আমরা নামছি । অনশন সংগ্রামীকে তিল-তিল করে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যেতে হয় । শত্রুর সঙ্গে সম্মুখ লড়াইয়ে গুলির আঘাতে প্রাণ দেওয়া, বা ফাঁসির রশিতে জীবন দেওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ । অনশনে অংশ নিয়ে পরে পিছু হটলে বিপ্লবীদের প্রতিষ্ঠা ধুলায় লুটিয়ে পড়বে । তাই বলছি যে যোগ দিয়ে পিছিয়ে পড়ার চেয়ে প্রথম থেকেই অনশনে যোগ না দেওয়াই সমীচীন ।"

সে আরো বলে যে, সে নিজে অনশন আরম্ভ করলে যতদিন না সরকার দাবিসনদ মেনে না নেয়, ততদিন অনশন চালিয়ে যাবে । সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে বলে যে, তাড়াহুড়ো করে কিছু না করাই ভালো । আরো একদিন সময় নিক তারা । ভালো করে বুঝে-সুঝে অনশনে যোগ দিক । যারা নিজেদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবলে সন্দিহান, তাদের অনশনে যোগ না দেওয়াই বাঞ্চনীয় । সে একথাও স্পষ্ট করে বলে যে, যারা অনশন করবে না তারাও অন্যদের মতো সম্মানিত বিপ্লবী হিসাবে গণ্য হবে ।

=================================================

সেইদিন থেকে তিলে তিলে তার মৃত্যুর পথে যাত্রা শুরু হলো । শহীদের মৃত্যুবরণের পথে প্রত্যেকটি মুহূর্তে তার শান্ত ও সৌম্য চেহারায় দৃঢ় সংকল্পের রেখা আরও গভীর হয়ে ফুটে উঠলো ।

কয়েকদিনের মধ্যে তার অবস্থা খারাপ হলো । সারা দেহে বিষক্রিয়া ছড়িয়ে গেল । চোখ বন্ধ হয়ে এল । ডাক্তার ডুশ প্রয়োগ করতে চাইল । কিন্তু সে অসম্মতি জানাল । কংগ্রেসের বহু নেতা, ডিফেন্স কমিটির সদস্যবৃন্দও অনুরোধ জানালো । কিন্তু তাতে কাজ হলো না । সরকারকে কেউ জানালো যে, হয়তো সে ভগত সিংহের কথা মানবে । এই পরামর্শ পাবার পর ভগত সিংহকে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আনা হলো । ভগত সিংহ তাকে একবার অনুরোধ করাতে দাশ ডুশ নিতে রাজি হলো । জেলের জনৈক কর্তাব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেছিল যতীন্দ্রনাথকে "আপনি কারো অনুরোধ রাখেননি । কিন্তু ভগত সিংহ বলতেই রাজি হলেন কেন ?" উত্তরে সে বলে, "আপনি জানেন না ভগত সিংহ কি ধরনের বীরপুরুষ । আমি কখনো তার কথা ফেলতে পারি না ।"

আর একবার ভগত সিংহ তাকে ওষুধ খেতে অনুরোধ করে । তখন সে জবাব দেয়, "শোন ভগত সিংহ, আমি জানি যে, আমার শপথ ভঙ্গ করা উচিত নয় । কিন্তু তোমার অনুরোধও অগ্রাহ্য করতে পারি না । যাই হোক, এর পর কোন অনুরোধ আমায় করো না ।" তার অবস্থার অবনতি দেখে তাকে মেয়ো হাসপাতালে পাঠাতে চাইলো সরকার । কিন্তু যতীন্দ্রনাথ সে হাসপাতালে যেতে অস্বীকার করলে সরকার তাকে জামিনে খালাস করার সিদ্ধান্ত নিলো । জনৈক সাজানো শেঠ জামিনদার হতে রাজিও হলো । হঠাৎ ছাড়া পাবার খবর পেয়ে যতীন্দ্রনাথ সবাইকে তার পাশে ডেকে নিয়ে বসলো "এ সব ধোঁকাবাজি, সরকার জানে আমার দিন ঘনিয়ে এসেছে । আমার মৃত্যুর দায়িত্ব সে নিতে চায় না । তাই আমাকে জেলের বাইরে বার করে দিয়ে আমার থেকে রেহাই পেতে চায় । আমি এটা হতে দেব না ।" এ-কথা বলে আমাদের দিকে তাকাল । বললো, "আমি এখানে মাঝে থেকে, লড়াই করেই মরতে চাই । আমি চাই তোমরাও সাধ্যমতো বাধা দাও যাতে আমাকে এখান থেকে না সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে ।"

=================================================