বিবেকানন্দের ভাবনায় সমাজভাবনা ও সমাজতন্ত্র
স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তায় স্বদেশচেতনা এবং শ্রমিকস্বার্থবোধ একাত্মতা লাভ করেছিল । তিনি শিকাগো থেকে দেওয়ান হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লিখেছেন (নভেম্বর, ১৮৯৪), "কোথায় ইতিহাসের কোন যুগে ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়, পুরোহিত ও ধর্মধ্বজিগণ দীনদুঃখীদের জন্য চিন্তা করিয়াছে ? অথচ ইহাদের নিষ্পেষণ করাতেই তাহাদের ক্ষমতার প্রাণশক্তি । ... দরিদ্রগণের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা এত বেশী কেন ? একথা বলা মূর্খতা যে তরবারির সাহায্যে তাহাদিগকে ধর্মান্তরগ্রহণে বাধ্য করা হইয়াছিল । ... বস্তুত জমিদার ও পুরোহিতবর্গের হস্ত হইতে নিষ্কৃতিলাভের জন্যই উহারা ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছিল । আর সেইজন্য বাংলাদেশ, যেখানে জমিদারের বিশেষ সংখ্যাধিক্য, সেখানে কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানেরই সংখ্যা বেশী ।"
ভারতে অনেকরকম সাধু-সন্ন্যাসী দেখা যায় । তাঁরা সমাজ ও জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান । কিন্তু বিবেকানন্দ ছিলেন সম্পূর্ণ অন্য ধরণের মানুষ । তিনি সারা ভারত পদব্রজে পর্যটন করেন এবং ধনি-গরিব নির্বিশেষে নানাধরণের মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটে । তিনি ইউরোপ-আমেরিকা পর্যটন করে ধনতান্ত্রিক ও বিভিন্ন ধরনের সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হন । এই প্রক্রিয়ার মধ্য থেকেই সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে তার চিন্তার মিশ্রণ ঘটে । তাঁর ধর্মচেতনা মানুষকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল ।
নতুন সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল তাঁর চোখে । বিবেকানন্দের সমসাময়িক চিন্তাবিদদের সঙ্গে বিবেকানন্দের পার্থক্য ছিল এই যে, অন্য চিন্তাবিদরা শুধু সমাজ সংস্কারের কথা বলতেন । বিবেকানন্দ আমূল পরিবর্তনের কথা ভাবতেন । উগ্র জাতীয়তাবাদী ও হিন্দুত্ববাদীরা ভারতকে পুরোনো দিনে ফিরে যাবার কথা বলতেন । কিন্তু বিবেকানন্দ তাঁদের সঙ্গে আদৌ একমত ছিলেন না । তিনি নতুন ভারতের কথা বলতেন । যে ভারতের শাসকরা হবেন সমাজের একেবারে নীচের তোলার মানুষ অর্থাৎ শূদ্র । তিনি নতুন সমাজের যে কল্পনা করেছিলেন তা হল বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামিক দেহ ।
শূদ্র জাগরণ সম্পর্কে বিবেকানন্দ বলেছিলেন : 'আর যাহাদের শারীরিক পরিশ্রমে ব্রাহ্মণের আধিপত্য, ক্ষত্রিয়ের ঐশ্বর্য, বৈশ্যের ধনধান্য সম্ভব, তাহারা কোথায়? সমাজের যাহারা সর্বাঙ্গ হইয়াও সর্ব দেশে সর্বকালে ... ভারবাহী পশু, সে শূদ্রজাতির কি গতি?' এই যে অপরিসীম বেদনাবোধের সঙ্গে তিনি শূদ্রদের সম্বন্ধে ভেবেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তিনি বুঝেছেন বৈশ্য সভ্যতাই মানুষের ইতিহাসে সবটুকু নয়, তার একটা ধারা থাকতে পারে । এ বিষয়টি স্বামীজীর চোখে ধরা পড়েছিল বলেই বৈশ্য সভ্যতার ভালো দিকটি বলবার সঙ্গে শূদ্র জাগরণের অনিবার্য ভবিষ্যতের প্রতিও ইঙ্গিত দিয়েছেন তাঁর পত্রাবলীতে ।
বিবেকানন্দ ভারত ইতিহাসে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় তথ্য তুলে ধরে আমাদের জানিয়েছেন শাসক শ্রেণী সব সময় শোষিতদের অগ্রসর অংশের প্রতিনিধিদের কিনে এবং তাদেরই ব্যবহার করে নীচেকার মানুষকে পদদলিত করবার জন্যে । তিনি উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন - 'বশিষ্ঠ, নারদ, জাবাল, সত্যকাম, ব্যাস, কৃপ, দ্রোণ এবং কর্ণ । শ্রেণী আভিজাত্যের দিক থেকে এদের প্রত্যেকেরই জন্মকাহিনী, পিতৃপরিচয় বা মাতৃপরিচয় সন্দিগ্ধ রহস্যে আবৃত ' । 'জ্ঞান ও বীরত্বের পুরস্কারস্বরূপ এঁরা কেউবা ব্রাহ্মণ সমাজে কেউবা ক্ষত্রিয় সমাজে উন্নীত হলেন ।' বিবেকানন্দ মন্তব্য করেছেন - 'এঁদের এই সামাজিক ঊর্দ্ধগতির ফলে গণিকা, দাসী, মৎস্যজীবি বা শকটচালক সম্প্রদায়ের কি যে উপকার হল তা বোঝা দুষ্কর ।
স্বামীজী বলেছেন, ভারতবর্ষের প্রকৃত শাসনক্ষমতা জনসাধারণের হাতে ছিল না । যারা ক্ষুধিত বঞ্চিত, যারা নিচুরতলার মানুষ, মার-খাওয়া মানুষ, যারা ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্তভাবে সংগ্রাম করছে, তারা কোনো সময়ে এমনভাবে দানা বাঁধতে পারেনি, যাতে ক্ষমতাটা তাদের হাতে আসতে পারে । পারস্পরিক স্বার্থের খাতিরে ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়েরা একত্র হয়েছে । কিন্তু গণশোষণের বন্যার গতিটি কোনো সময়ে স্তিমিত হয়নি, বরং ক্ষুরধার হয়েছে । স্বামীজীর বিশ্লেষণ অনুযায়ী পশ্চিমী মুসলমানেরা যখন আমাদের দেশ বিজয় করতে এলো, তাদের হাতে আমরা মার খেয়েছি, তাদের বুকের সাহস এবং বীর্যবত্তায় ভারতবর্ষ পরাভূত হয়েছে । পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গিয়েছে, Royal Power-এর হাত থেকে শূদ্র শ্রেণী কোনোদিন রক্ষা পায়নি । (অনেক পরে পৃথিবীর ইতিহাসে, ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে, প্রথম শূদ্রের বিপ্লব ঘটেছে রুশ দেশে - লেখক)।
স্বামীজী তাঁর সন্ধানী দৃষ্টিতে নূতন সমাজের যে চেহারা দেখেছিলেন পশ্চিমী সমাজ তাতে বিস্মিত হয়, তার কারণ এই যে আসন্ন শূদ্ররাজত্ব সম্পর্কে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নিঃসংশয় । 'বর্তমান ভারত' -এ তিনি বলেছেন "সোশ্যালিজম, অ্যানার্কিজম, নিহিলিজম এবং এ-জাতীয় মতবাদগুলি আসন্ন সমাজ-বিপ্লবের অগ্রদূত ।" অ্যানার্কিজম, নিহিলিজম দিয়ে সমাজ বিপ্লব করা যাবে কিনা আমরা এ নিয়ে তর্কের ঝড় তুলতে পারি, কিন্তু এ মতবাদগুলো যে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ, একথাটা যদি আমরা বুঝতে চেষ্টা করি তা হলে স্বামীজীর বক্তব্যের মর্মবাণীর দিকে আমরা বোধ হয় দৃষ্টি ফেরাতে পারি । বিনা দ্বিধায় অবিকম্পিত স্বরে তিনি ঘোষণা করেছেন শূদ্রের আধিপত্য অবশ্যম্ভাবী, কেউ একে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না । "... Time will come when there will be the rising of the Sudra class and their Sudrahood"
তিনি আরও বলেছিলেন, "নতুন ভারত বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে, ঝোপ-জঙ্গল-পাহাড়-পর্বত থেকে" । তাঁর ভরসার স্থল ছিল সাধারণ মানুষ । কেন তাঁর ধারণা ছিল মধ্যবিত্ত এবং অভিজাতরা শরীর এবং মনে একেবারে মরে গেছে । তিনি আরও বলেছিলেন ধনীরা কারও কোন উপকার করেনি । শোষিতদের জন্য সংগঠনের অভাব তিনি খুব অনুভব করেছিলেন । শূদ্রদের আত্মশক্তি প্রয়োগের পথে ঐক্য এবং সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা তিনি দৃঢ়ভাবে অনুভব করেছিলেন ।
স্বামী বিবেকানন্দের সমকালীন সময় ছিল ভারতের নব জাগরণের যুগ । কিন্তু ইউরোপে নবজাগরণ তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল এবং পুরোনো সমাজের গর্ভে নতুন সমাজের আবির্ভাবের দার্শনিক, অর্থনৈতিক ও সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি সূচিত করেছিল । একদিকে বুর্জোয়া গণতন্ত্রে পতাকা উড়ছে, পুঁজিবাদ পোক্ত হচ্ছে । পুঁজিবাদের স্থায়িত্বের দর্শন প্রভাব বিস্তার করেছে । অপরদিকে প্রকৃতি বিজ্ঞানের বিকাশ ভাববাদী দর্শনের ভিত্তিমূলকে নাড়িয়ে দিচ্ছে । মার্কস-এঙ্গেলেসের হাত ধরে উন্নত হচ্ছে । শক্তিশালী হচ্ছে বস্তুবাদী দর্শন, সমাজতান্ত্রিক দর্শনের ভিত্তি গঠনের তত্ত্ব । ইংল্যান্ডে ছিলেন 'ওয়েল' পন্থীরা এবং ফ্রান্সে ছিলেন ফুলিয়ের অনুগামী সমর্থকরা । এরা ছাড়া ছিলেন ইউটোপিয়া সমাজতন্ত্রের পক্ষে সরব । আরও ছিলেন পুঁজি বা মুনাফার ক্ষতি হবে না অথচ সামাজিক ন্যায় বিচারও থাকবে, এমন অদ্ভুত তত্ত্বের প্রবর্তকেরা । এর বিপরীতে চুল মার্কস ও এঙ্গেলস, তাঁরা ঐ দু-ধরনের সমাজতন্ত্রীদের মতবাদের ত্রুটিগুলি ধরিয়ে দেন এবং সমাজ পরিবর্তনের গতিধারা এবং তার অন্তর্নিহিত বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া উদঘাটন করেন । এই সময় আট ঘন্টার কাজের দাবিও শুরু হয়ে যায় ।
যে মতবাদেরই হোন না কেন - সমাজতন্ত্রীরা চার্চদের ভূমিকার বিরুদ্ধে ছিলেন । তারা ধর্মের সমালোচনা করতেন এবং সমাজের ঘটতে থাকা ঘটনাগুলির মধ্যে চার্চের হস্তক্ষেপের নিন্দা করতেন । এই অংশটার সঙ্গে বিবেকানন্দের যোগাযোগ হয়েছিল । কিন্তু মার্কস-এঞ্জেলেসের ধারণার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল -- এমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি ।
ভারতে এই ভাবধারা প্রবেশ করলেও কোন তত্ত্বগত এবং সংগঠিত রূপ প্রকাশ পায়নি । স্বামী বিবেকানন্দ ছাত্র অবস্থাতেই ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে ভালোভাবেই পরিচিত হয়েছিলেন । তিনি পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন । ঐ সময় বিদেশে সম্ভবত স্বামী বিবেকানন্দ সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন । পরবর্তীকালে আমেরিকা ও ইউরোপ পর্যটনের সময় তিনি বিভিন্ন ধরনের সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন ।
বিবেকানন্দ মনে করতেন ভারতবর্ষের ইতিহাস হল - শ্রেণী শাসনের ইতিহাস (তৎকালীন সময়ে মার্কসবাদরা ছাড়া একমাত্র বিবেকানন্দই একথা ভাবতে পেরেছিলেন)। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, ইতিহাসের আদি অধ্যায় ছিল ব্রাহ্মণ শাসন, তারপর ক্ষত্রিয় শাসন, তারপরে বৈশ্য শাসন (বিবেকানন্দের কথায় তা তখনও চলছে) তার পরেই মুদির দোকানের মত জায়গাগুলো থেকে বের করে ভারতকে শূদ্র শাসনের অধীনে নিয়ে আসার কথা বলেছিলেন ।
ভারতের বৈশ্য শাসন সম্পর্কে তিনি যে মন্তব্য করেছেন তা প্রকৃতপক্ষে বৈশ্য শাসনকে পুঁজিবাদী শোষণের সমগোত্রীয় বলে চিহ্নিত করা । বৈশ্য শাসন সম্পর্কে তিনি বলেছেন এটা হচ্ছে 'রক্ত পিপাসু ক্ষমতা' । পুঁজিবাদী শাসন যে নিঃসন্দেহে শোষণ করে তা বিবেকানন্দের চিন্তাকে এড়িয়ে যেতে পারেনি । তবে বিবেকানন্দ শুধু বৈশ্য সভ্যতার সমালোচনাই করেননি, একই সঙ্গে বৈশ্য সভ্যতা যে জ্ঞান, বিজ্ঞান, কৃষি এবং প্রযুক্তির অভাবনীয় সম্পদ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে তারও তিনি সোচ্চার প্রশংসা করেছেন । বৈশ্যদের এই বিষয়ে প্রশংসা করলেও তিনি বলেছিলেন এই শূদ্রের শ্রমের ওপরেই নির্ভর করে ব্রাহ্মণের প্রভাব ক্ষত্রিয়ের ক্ষমতা এবং বৈশ্যের সম্পদ সম্ভব হয়েছে । যাদের নাম দেওয়া হয়েছে নীচু জাতি অন্ত্যজ তারাই হল আসলে সমাজের শরিক, কিন্তু তাদের ইতিহাস কোথায় ? তারা লেখাপড়া শিখলে তাদের জিভ ও মাংস উপড়ে দেওয়া হতো । বিবেকানন্দ আর-একটি কথা বলেছেন যা মার্কসবাদী হিসেবে আমাদের কাছে প্রণিধানযোগ্য । ক্ষত্রিয়ের হাত থেকে ক্ষমতা নেওয়ার সময় বৈশ্যদের এমন কোনো সদিচ্ছা ছিল না যে, ক্ষমতা শূদ্রদের হাতে গিয়ে পড়ুক । মার্কসবাদীরা মিলিয়ে নিতে পারবেন সামন্ততন্ত্রের হাত থেকে পুঁজিবাদী যখন ক্ষমতা দখল করল তারাও শ্রমিক শ্রেণীর হাত থেকে নিজেদের ক্ষমতা বাঁচাতে চাইছিল । বিবেকানন্দ বলেছিলেন, 'সোসালিজম, অ্যানার্কিজম অ্যান্ড নিহিলিজম এই জাতীয় অন্যান্য মতামতগুলি আসন্ন সমাজ বিপ্লবের অগ্রদূত' (বিবেকানন্দ মডার্ন ইন্ডিয়া) 'শূদ্রের আধিপত্য অবশ্যম্ভাবি কেউ একে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না ।'
শূদ্র শাসন কী হিংসার পথে হাঁটবে, না অহিংসার পথে হাঁটবে এ ক্ষেত্রে বিবেকানন্দের স্পষ্ট মত ছিল অহিংসার পথেই হাঁটা উচিত । কিন্তু বাস্তবে কি তা সম্ভব ? কারণ বলবানরা সবসময় দুর্বলদের ওপর অত্যাচার করে । এইজন্য তিনি শূদ্রদেড় উদ্দেশ্যে বলেছিলেন 'বিদ্রোহে তোমার চির অধিকার ।' তিনি আরো বলেছিলেন, সন্ন্যাসীদের পক্ষে অহিংসা সম্ভব কিন্তু ওটা সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভব নয় । উচ্চ-জাতির উচিত হচ্ছে নিম্ন জাতিদের ন্যায্য অধিকার পেতে সাহায্য করা, তা না করে তাদের অবনমিত করতে চাইলে তারা নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যাবে, নিজেদের সমাধি নিজেদেরই খুঁড়তে হবে । যত বিলম্ব বাড়বে তত মার খাবে । কোনো দেশে সাধারণ মানুষের যদি অধিকার না থাকে তাহলে জাতি সংগঠিত হতে পারে না ।
বিবেকানন্দ বলেছিলেন 'আমি সমাজতন্ত্রী তার মানে এই নয় যে, সমাজতন্ত্রকে আমি একটা পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ সমাজব্যবস্থা বলে মনে করি, কারণটা এই যে উপবাস করার চেয়ে আধখানা রুটি খাওয়া ভালো ।' স্বামী বিবেকানন্দের এই উক্তি থেকে বোঝা যায় সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর কিছু ধারণা হয়েছিল । যদিও তিনি ইউটোপিও সমাজব্যবস্থার কথা শুনেছিলেন সেটাই তাঁর প্রেরণার উৎস স্থল ছিল । কিন্তু তাঁর ধারণার মধ্যে কী ভুল ছিল ? ধারণার মধ্যে ভুল ছিল সেটা বলা যাবে না, আমরা যারা মার্কসবাদী তারা জানি সমাজতন্ত্র সাম্যবাদের আগের ধাপ । আবার সমাজতন্ত্রকে বহু পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করতে হয় । সমাজতন্ত্র যত অগ্রসর হয় তত প্রাচুর্য বাড়ে । একবিংশ শতাব্দীর চিন, এ বিষয়ে আমাদের কাছে একটা জ্বলন্ত উদাহরণ । স্বামী বিবেকানন্দের এই উক্তি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে তৎকালীন ভারতীয় সাধক-সন্ন্যাসীদের ও মনীষীদের মধ্যে সর্বপ্রথম শ্রেণীস্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজবিবর্তনের ধারা অনুধাবন করার মতো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয় ।
বিবেকানন্দ কেন প্রত্যক্ষভাবে সমাজ সংস্কারের পথে অগ্রসর না হয়ে ধর্ম সংস্কার ও ধর্ম প্রচারের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন ? বিবেকানন্দ ধর্মের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র ও মানবতন্ত্রের কথাই বেশি বলেছেন । ভারতে তিনিই সর্বপ্রথম সমাজতন্ত্রের আদর্শ প্রচার করেছেন, সেকথা ভুলে গিয়ে তাকে যদি শুধু ধর্ম সংস্কারক বা ধর্মের বিচারক বলে প্রচার করা হয় তবে তাঁর আদর্শকে ও জীবনের ব্রতকে বিকৃত ও খণ্ডিত করা হবে ।
বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক লেখক বিনয় ঘোষের মতে প্রত্যক্ষভাবে সমাজ সংস্কারের পথে না গিয়ে বিবেকানন্দ ধর্মসংস্কারের ওপর জোর দিয়েছেন কেন ? বিবেকানন্দের কাছে ধর্ম মানে কতকগুলি মন্ত্র বা আচার ছিল না । তাঁর কাছে ধর্ম ছিল কতকগুলি প্রত্যয়, বিশ্বাস, ধ্যানধারণা, ন্যায়-অন্যায়, নীতিবোধ ইত্যাদি । সমগ্র জাতির মানস সত্তার মূল ভিত্তিটিকে তিনি সবার আগে শক্ত করতে চেয়েছিলেন । দ্বিতীয়ত তিনি মনে করেছিলেন বৃহত্তর হিন্দু সমাজের কল্যাণের জন্য কিছু করতে হলে প্রথমেই হিন্দু ধর্মকে অপবাদ ও কুসংস্কারের পঙ্ককুন্ড থেকে উদ্ধার করা দরকার । তৃতীয়ত ব্রাহ্ম সমাজের জটিল তত্ত্ব জনসাধারণের কাছে বোধগম্য ছিল না তা ছিল উচ্চশিক্ষিত, উচ্চবিত্তদের মধ্যে আবদ্ধ ব্রাহ্মবাদীরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন । চতুর্থত, সনাতন পন্থী ও হিন্দু জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল । বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ কখনই সংকীর্ণ সনাতনপন্থী ছিলেন না । বিবেকানন্দ ধর্মের মাধ্যমে সমাজতত্ত্ব ও মানবতত্ত্বের কথা বলেছেন । আমাদের দেশে সমাজতন্ত্রের আদর্শ সম্ভবত সর্বপ্রথম বিবেকানন্দই স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন । সুতরাং তাকে শুধু ধর্মসংস্কারক বা ধর্মপ্রচারক বললে ভুল হবে । তাঁর জীবনের ব্রতকেও যথোচিত মর্যাদা দেওয়া হবে না ।
================================================================
আমাদের দেশে যদি আধুনিক রাষ্ট্র চিন্তা ও সমাজচিন্তার ইতিহাস কোনোদিন লেখা হয় তবে স্বামী বিবেকানন্দ যে সেখানে কেবল স্বাদেশিকতা ও স্বাজাত্যবোধের অন্যতম উদ্বোধক বলে স্থান পাবেন তা নয়, তার সঙ্গে সমানাধিকার ও সমাজতন্ত্রের আদর্শের প্রথম প্রবক্তার কৃতিত্বও তিনি দাবি করবেন এবং সে-দাবি ঐতিহাসিক বা সমাজবিজ্ঞানীর পক্ষে অস্বীকার করাও সম্ভব হবে না । তাঁর কালে এই আদর্শের কথা নির্ভীককণ্ঠে প্রচার করতে যে কি প্রচন্ড পৌরুষের প্রয়োজন হয়েছিল তা আজ আমরা কল্পনাও করতে পারব না । কল্পনা করুন আজ থেকে ৭০/৮০ বছর আগে - বিদেশি ব্রিটিশরাজের একচ্ছত্র রাজত্বের যুগে -- কেবল স্বদেশপ্রেমের কথা নয় -- তিনি দেশের উচ্চশ্রেণী ও উচ্চসমাজের মুখের উপর বলেছেন -- 'তোমরা শূন্যে বিলীন হও, নূতন ভারত বেরুক, বেরুক চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে, মালো, মেথরের ঝুপড়ির মধ্য থেকে ।'
সর্ব নিম্নস্তরের মানুষের কাছেও প্রাণের অভিনন্দন পাওয়া যায় - এ তিনি জানতেন । কিন্তু বৈরাগ্যের বাণী বা ধর্মতত্ত্বের কথা তিনি মানুষের কাছে প্রচার করেননি । প্রচার করেছেন ঐতিহ্যের কথা, দেশাত্মবোধের কথা এবং জাতিভেদহীন শ্রেণীভেদহীন সমাজগঠনের কথা । আজকের জাতীয় সংকটের দিনে বিশেষ করে স্বামী বিবেকানন্দের দেশাত্মবোধ ও দেশীয় ঐতিহ্যবোধের আদর্শ এবং তাঁর ভেদবৈষম্যহীন ভারতীয় সমাজগঠনের আদর্শ থেকে আমরা খানিকটা প্রেরণা পেতে পারি ।
স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তায় স্বদেশচেতনা এবং শ্রমিকস্বার্থবোধ একাত্মতা লাভ করেছিল । তিনি শিকাগো থেকে দেওয়ান হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লিখেছেন (নভেম্বর, ১৮৯৪), "কোথায় ইতিহাসের কোন যুগে ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়, পুরোহিত ও ধর্মধ্বজিগণ দীনদুঃখীদের জন্য চিন্তা করিয়াছে ? অথচ ইহাদের নিষ্পেষণ করাতেই তাহাদের ক্ষমতার প্রাণশক্তি । ... দরিদ্রগণের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা এত বেশী কেন ? একথা বলা মূর্খতা যে তরবারির সাহায্যে তাহাদিগকে ধর্মান্তরগ্রহণে বাধ্য করা হইয়াছিল । ... বস্তুত জমিদার ও পুরোহিতবর্গের হস্ত হইতে নিষ্কৃতিলাভের জন্যই উহারা ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছিল । আর সেইজন্য বাংলাদেশ, যেখানে জমিদারের বিশেষ সংখ্যাধিক্য, সেখানে কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানেরই সংখ্যা বেশী ।"
ভারতে অনেকরকম সাধু-সন্ন্যাসী দেখা যায় । তাঁরা সমাজ ও জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান । কিন্তু বিবেকানন্দ ছিলেন সম্পূর্ণ অন্য ধরণের মানুষ । তিনি সারা ভারত পদব্রজে পর্যটন করেন এবং ধনি-গরিব নির্বিশেষে নানাধরণের মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটে । তিনি ইউরোপ-আমেরিকা পর্যটন করে ধনতান্ত্রিক ও বিভিন্ন ধরনের সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হন । এই প্রক্রিয়ার মধ্য থেকেই সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে তার চিন্তার মিশ্রণ ঘটে । তাঁর ধর্মচেতনা মানুষকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল ।
নতুন সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল তাঁর চোখে । বিবেকানন্দের সমসাময়িক চিন্তাবিদদের সঙ্গে বিবেকানন্দের পার্থক্য ছিল এই যে, অন্য চিন্তাবিদরা শুধু সমাজ সংস্কারের কথা বলতেন । বিবেকানন্দ আমূল পরিবর্তনের কথা ভাবতেন । উগ্র জাতীয়তাবাদী ও হিন্দুত্ববাদীরা ভারতকে পুরোনো দিনে ফিরে যাবার কথা বলতেন । কিন্তু বিবেকানন্দ তাঁদের সঙ্গে আদৌ একমত ছিলেন না । তিনি নতুন ভারতের কথা বলতেন । যে ভারতের শাসকরা হবেন সমাজের একেবারে নীচের তোলার মানুষ অর্থাৎ শূদ্র । তিনি নতুন সমাজের যে কল্পনা করেছিলেন তা হল বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামিক দেহ ।
শূদ্র জাগরণ সম্পর্কে বিবেকানন্দ বলেছিলেন : 'আর যাহাদের শারীরিক পরিশ্রমে ব্রাহ্মণের আধিপত্য, ক্ষত্রিয়ের ঐশ্বর্য, বৈশ্যের ধনধান্য সম্ভব, তাহারা কোথায়? সমাজের যাহারা সর্বাঙ্গ হইয়াও সর্ব দেশে সর্বকালে ... ভারবাহী পশু, সে শূদ্রজাতির কি গতি?' এই যে অপরিসীম বেদনাবোধের সঙ্গে তিনি শূদ্রদের সম্বন্ধে ভেবেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তিনি বুঝেছেন বৈশ্য সভ্যতাই মানুষের ইতিহাসে সবটুকু নয়, তার একটা ধারা থাকতে পারে । এ বিষয়টি স্বামীজীর চোখে ধরা পড়েছিল বলেই বৈশ্য সভ্যতার ভালো দিকটি বলবার সঙ্গে শূদ্র জাগরণের অনিবার্য ভবিষ্যতের প্রতিও ইঙ্গিত দিয়েছেন তাঁর পত্রাবলীতে ।
বিবেকানন্দ ভারত ইতিহাসে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় তথ্য তুলে ধরে আমাদের জানিয়েছেন শাসক শ্রেণী সব সময় শোষিতদের অগ্রসর অংশের প্রতিনিধিদের কিনে এবং তাদেরই ব্যবহার করে নীচেকার মানুষকে পদদলিত করবার জন্যে । তিনি উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন - 'বশিষ্ঠ, নারদ, জাবাল, সত্যকাম, ব্যাস, কৃপ, দ্রোণ এবং কর্ণ । শ্রেণী আভিজাত্যের দিক থেকে এদের প্রত্যেকেরই জন্মকাহিনী, পিতৃপরিচয় বা মাতৃপরিচয় সন্দিগ্ধ রহস্যে আবৃত ' । 'জ্ঞান ও বীরত্বের পুরস্কারস্বরূপ এঁরা কেউবা ব্রাহ্মণ সমাজে কেউবা ক্ষত্রিয় সমাজে উন্নীত হলেন ।' বিবেকানন্দ মন্তব্য করেছেন - 'এঁদের এই সামাজিক ঊর্দ্ধগতির ফলে গণিকা, দাসী, মৎস্যজীবি বা শকটচালক সম্প্রদায়ের কি যে উপকার হল তা বোঝা দুষ্কর ।
স্বামীজী বলেছেন, ভারতবর্ষের প্রকৃত শাসনক্ষমতা জনসাধারণের হাতে ছিল না । যারা ক্ষুধিত বঞ্চিত, যারা নিচুরতলার মানুষ, মার-খাওয়া মানুষ, যারা ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্তভাবে সংগ্রাম করছে, তারা কোনো সময়ে এমনভাবে দানা বাঁধতে পারেনি, যাতে ক্ষমতাটা তাদের হাতে আসতে পারে । পারস্পরিক স্বার্থের খাতিরে ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়েরা একত্র হয়েছে । কিন্তু গণশোষণের বন্যার গতিটি কোনো সময়ে স্তিমিত হয়নি, বরং ক্ষুরধার হয়েছে । স্বামীজীর বিশ্লেষণ অনুযায়ী পশ্চিমী মুসলমানেরা যখন আমাদের দেশ বিজয় করতে এলো, তাদের হাতে আমরা মার খেয়েছি, তাদের বুকের সাহস এবং বীর্যবত্তায় ভারতবর্ষ পরাভূত হয়েছে । পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গিয়েছে, Royal Power-এর হাত থেকে শূদ্র শ্রেণী কোনোদিন রক্ষা পায়নি । (অনেক পরে পৃথিবীর ইতিহাসে, ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে, প্রথম শূদ্রের বিপ্লব ঘটেছে রুশ দেশে - লেখক)।
স্বামীজী তাঁর সন্ধানী দৃষ্টিতে নূতন সমাজের যে চেহারা দেখেছিলেন পশ্চিমী সমাজ তাতে বিস্মিত হয়, তার কারণ এই যে আসন্ন শূদ্ররাজত্ব সম্পর্কে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নিঃসংশয় । 'বর্তমান ভারত' -এ তিনি বলেছেন "সোশ্যালিজম, অ্যানার্কিজম, নিহিলিজম এবং এ-জাতীয় মতবাদগুলি আসন্ন সমাজ-বিপ্লবের অগ্রদূত ।" অ্যানার্কিজম, নিহিলিজম দিয়ে সমাজ বিপ্লব করা যাবে কিনা আমরা এ নিয়ে তর্কের ঝড় তুলতে পারি, কিন্তু এ মতবাদগুলো যে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ, একথাটা যদি আমরা বুঝতে চেষ্টা করি তা হলে স্বামীজীর বক্তব্যের মর্মবাণীর দিকে আমরা বোধ হয় দৃষ্টি ফেরাতে পারি । বিনা দ্বিধায় অবিকম্পিত স্বরে তিনি ঘোষণা করেছেন শূদ্রের আধিপত্য অবশ্যম্ভাবী, কেউ একে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না । "... Time will come when there will be the rising of the Sudra class and their Sudrahood"
তিনি আরও বলেছিলেন, "নতুন ভারত বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে, ঝোপ-জঙ্গল-পাহাড়-পর্বত থেকে" । তাঁর ভরসার স্থল ছিল সাধারণ মানুষ । কেন তাঁর ধারণা ছিল মধ্যবিত্ত এবং অভিজাতরা শরীর এবং মনে একেবারে মরে গেছে । তিনি আরও বলেছিলেন ধনীরা কারও কোন উপকার করেনি । শোষিতদের জন্য সংগঠনের অভাব তিনি খুব অনুভব করেছিলেন । শূদ্রদের আত্মশক্তি প্রয়োগের পথে ঐক্য এবং সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা তিনি দৃঢ়ভাবে অনুভব করেছিলেন ।
স্বামী বিবেকানন্দের সমকালীন সময় ছিল ভারতের নব জাগরণের যুগ । কিন্তু ইউরোপে নবজাগরণ তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল এবং পুরোনো সমাজের গর্ভে নতুন সমাজের আবির্ভাবের দার্শনিক, অর্থনৈতিক ও সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি সূচিত করেছিল । একদিকে বুর্জোয়া গণতন্ত্রে পতাকা উড়ছে, পুঁজিবাদ পোক্ত হচ্ছে । পুঁজিবাদের স্থায়িত্বের দর্শন প্রভাব বিস্তার করেছে । অপরদিকে প্রকৃতি বিজ্ঞানের বিকাশ ভাববাদী দর্শনের ভিত্তিমূলকে নাড়িয়ে দিচ্ছে । মার্কস-এঙ্গেলেসের হাত ধরে উন্নত হচ্ছে । শক্তিশালী হচ্ছে বস্তুবাদী দর্শন, সমাজতান্ত্রিক দর্শনের ভিত্তি গঠনের তত্ত্ব । ইংল্যান্ডে ছিলেন 'ওয়েল' পন্থীরা এবং ফ্রান্সে ছিলেন ফুলিয়ের অনুগামী সমর্থকরা । এরা ছাড়া ছিলেন ইউটোপিয়া সমাজতন্ত্রের পক্ষে সরব । আরও ছিলেন পুঁজি বা মুনাফার ক্ষতি হবে না অথচ সামাজিক ন্যায় বিচারও থাকবে, এমন অদ্ভুত তত্ত্বের প্রবর্তকেরা । এর বিপরীতে চুল মার্কস ও এঙ্গেলস, তাঁরা ঐ দু-ধরনের সমাজতন্ত্রীদের মতবাদের ত্রুটিগুলি ধরিয়ে দেন এবং সমাজ পরিবর্তনের গতিধারা এবং তার অন্তর্নিহিত বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া উদঘাটন করেন । এই সময় আট ঘন্টার কাজের দাবিও শুরু হয়ে যায় ।
যে মতবাদেরই হোন না কেন - সমাজতন্ত্রীরা চার্চদের ভূমিকার বিরুদ্ধে ছিলেন । তারা ধর্মের সমালোচনা করতেন এবং সমাজের ঘটতে থাকা ঘটনাগুলির মধ্যে চার্চের হস্তক্ষেপের নিন্দা করতেন । এই অংশটার সঙ্গে বিবেকানন্দের যোগাযোগ হয়েছিল । কিন্তু মার্কস-এঞ্জেলেসের ধারণার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল -- এমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি ।
ভারতে এই ভাবধারা প্রবেশ করলেও কোন তত্ত্বগত এবং সংগঠিত রূপ প্রকাশ পায়নি । স্বামী বিবেকানন্দ ছাত্র অবস্থাতেই ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে ভালোভাবেই পরিচিত হয়েছিলেন । তিনি পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন । ঐ সময় বিদেশে সম্ভবত স্বামী বিবেকানন্দ সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন । পরবর্তীকালে আমেরিকা ও ইউরোপ পর্যটনের সময় তিনি বিভিন্ন ধরনের সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন ।
বিবেকানন্দ মনে করতেন ভারতবর্ষের ইতিহাস হল - শ্রেণী শাসনের ইতিহাস (তৎকালীন সময়ে মার্কসবাদরা ছাড়া একমাত্র বিবেকানন্দই একথা ভাবতে পেরেছিলেন)। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, ইতিহাসের আদি অধ্যায় ছিল ব্রাহ্মণ শাসন, তারপর ক্ষত্রিয় শাসন, তারপরে বৈশ্য শাসন (বিবেকানন্দের কথায় তা তখনও চলছে) তার পরেই মুদির দোকানের মত জায়গাগুলো থেকে বের করে ভারতকে শূদ্র শাসনের অধীনে নিয়ে আসার কথা বলেছিলেন ।
ভারতের বৈশ্য শাসন সম্পর্কে তিনি যে মন্তব্য করেছেন তা প্রকৃতপক্ষে বৈশ্য শাসনকে পুঁজিবাদী শোষণের সমগোত্রীয় বলে চিহ্নিত করা । বৈশ্য শাসন সম্পর্কে তিনি বলেছেন এটা হচ্ছে 'রক্ত পিপাসু ক্ষমতা' । পুঁজিবাদী শাসন যে নিঃসন্দেহে শোষণ করে তা বিবেকানন্দের চিন্তাকে এড়িয়ে যেতে পারেনি । তবে বিবেকানন্দ শুধু বৈশ্য সভ্যতার সমালোচনাই করেননি, একই সঙ্গে বৈশ্য সভ্যতা যে জ্ঞান, বিজ্ঞান, কৃষি এবং প্রযুক্তির অভাবনীয় সম্পদ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে তারও তিনি সোচ্চার প্রশংসা করেছেন । বৈশ্যদের এই বিষয়ে প্রশংসা করলেও তিনি বলেছিলেন এই শূদ্রের শ্রমের ওপরেই নির্ভর করে ব্রাহ্মণের প্রভাব ক্ষত্রিয়ের ক্ষমতা এবং বৈশ্যের সম্পদ সম্ভব হয়েছে । যাদের নাম দেওয়া হয়েছে নীচু জাতি অন্ত্যজ তারাই হল আসলে সমাজের শরিক, কিন্তু তাদের ইতিহাস কোথায় ? তারা লেখাপড়া শিখলে তাদের জিভ ও মাংস উপড়ে দেওয়া হতো । বিবেকানন্দ আর-একটি কথা বলেছেন যা মার্কসবাদী হিসেবে আমাদের কাছে প্রণিধানযোগ্য । ক্ষত্রিয়ের হাত থেকে ক্ষমতা নেওয়ার সময় বৈশ্যদের এমন কোনো সদিচ্ছা ছিল না যে, ক্ষমতা শূদ্রদের হাতে গিয়ে পড়ুক । মার্কসবাদীরা মিলিয়ে নিতে পারবেন সামন্ততন্ত্রের হাত থেকে পুঁজিবাদী যখন ক্ষমতা দখল করল তারাও শ্রমিক শ্রেণীর হাত থেকে নিজেদের ক্ষমতা বাঁচাতে চাইছিল । বিবেকানন্দ বলেছিলেন, 'সোসালিজম, অ্যানার্কিজম অ্যান্ড নিহিলিজম এই জাতীয় অন্যান্য মতামতগুলি আসন্ন সমাজ বিপ্লবের অগ্রদূত' (বিবেকানন্দ মডার্ন ইন্ডিয়া) 'শূদ্রের আধিপত্য অবশ্যম্ভাবি কেউ একে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না ।'
শূদ্র শাসন কী হিংসার পথে হাঁটবে, না অহিংসার পথে হাঁটবে এ ক্ষেত্রে বিবেকানন্দের স্পষ্ট মত ছিল অহিংসার পথেই হাঁটা উচিত । কিন্তু বাস্তবে কি তা সম্ভব ? কারণ বলবানরা সবসময় দুর্বলদের ওপর অত্যাচার করে । এইজন্য তিনি শূদ্রদেড় উদ্দেশ্যে বলেছিলেন 'বিদ্রোহে তোমার চির অধিকার ।' তিনি আরো বলেছিলেন, সন্ন্যাসীদের পক্ষে অহিংসা সম্ভব কিন্তু ওটা সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভব নয় । উচ্চ-জাতির উচিত হচ্ছে নিম্ন জাতিদের ন্যায্য অধিকার পেতে সাহায্য করা, তা না করে তাদের অবনমিত করতে চাইলে তারা নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যাবে, নিজেদের সমাধি নিজেদেরই খুঁড়তে হবে । যত বিলম্ব বাড়বে তত মার খাবে । কোনো দেশে সাধারণ মানুষের যদি অধিকার না থাকে তাহলে জাতি সংগঠিত হতে পারে না ।
বিবেকানন্দ বলেছিলেন 'আমি সমাজতন্ত্রী তার মানে এই নয় যে, সমাজতন্ত্রকে আমি একটা পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ সমাজব্যবস্থা বলে মনে করি, কারণটা এই যে উপবাস করার চেয়ে আধখানা রুটি খাওয়া ভালো ।' স্বামী বিবেকানন্দের এই উক্তি থেকে বোঝা যায় সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর কিছু ধারণা হয়েছিল । যদিও তিনি ইউটোপিও সমাজব্যবস্থার কথা শুনেছিলেন সেটাই তাঁর প্রেরণার উৎস স্থল ছিল । কিন্তু তাঁর ধারণার মধ্যে কী ভুল ছিল ? ধারণার মধ্যে ভুল ছিল সেটা বলা যাবে না, আমরা যারা মার্কসবাদী তারা জানি সমাজতন্ত্র সাম্যবাদের আগের ধাপ । আবার সমাজতন্ত্রকে বহু পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করতে হয় । সমাজতন্ত্র যত অগ্রসর হয় তত প্রাচুর্য বাড়ে । একবিংশ শতাব্দীর চিন, এ বিষয়ে আমাদের কাছে একটা জ্বলন্ত উদাহরণ । স্বামী বিবেকানন্দের এই উক্তি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে তৎকালীন ভারতীয় সাধক-সন্ন্যাসীদের ও মনীষীদের মধ্যে সর্বপ্রথম শ্রেণীস্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজবিবর্তনের ধারা অনুধাবন করার মতো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয় ।
বিবেকানন্দ কেন প্রত্যক্ষভাবে সমাজ সংস্কারের পথে অগ্রসর না হয়ে ধর্ম সংস্কার ও ধর্ম প্রচারের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন ? বিবেকানন্দ ধর্মের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র ও মানবতন্ত্রের কথাই বেশি বলেছেন । ভারতে তিনিই সর্বপ্রথম সমাজতন্ত্রের আদর্শ প্রচার করেছেন, সেকথা ভুলে গিয়ে তাকে যদি শুধু ধর্ম সংস্কারক বা ধর্মের বিচারক বলে প্রচার করা হয় তবে তাঁর আদর্শকে ও জীবনের ব্রতকে বিকৃত ও খণ্ডিত করা হবে ।
বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক লেখক বিনয় ঘোষের মতে প্রত্যক্ষভাবে সমাজ সংস্কারের পথে না গিয়ে বিবেকানন্দ ধর্মসংস্কারের ওপর জোর দিয়েছেন কেন ? বিবেকানন্দের কাছে ধর্ম মানে কতকগুলি মন্ত্র বা আচার ছিল না । তাঁর কাছে ধর্ম ছিল কতকগুলি প্রত্যয়, বিশ্বাস, ধ্যানধারণা, ন্যায়-অন্যায়, নীতিবোধ ইত্যাদি । সমগ্র জাতির মানস সত্তার মূল ভিত্তিটিকে তিনি সবার আগে শক্ত করতে চেয়েছিলেন । দ্বিতীয়ত তিনি মনে করেছিলেন বৃহত্তর হিন্দু সমাজের কল্যাণের জন্য কিছু করতে হলে প্রথমেই হিন্দু ধর্মকে অপবাদ ও কুসংস্কারের পঙ্ককুন্ড থেকে উদ্ধার করা দরকার । তৃতীয়ত ব্রাহ্ম সমাজের জটিল তত্ত্ব জনসাধারণের কাছে বোধগম্য ছিল না তা ছিল উচ্চশিক্ষিত, উচ্চবিত্তদের মধ্যে আবদ্ধ ব্রাহ্মবাদীরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন । চতুর্থত, সনাতন পন্থী ও হিন্দু জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল । বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ কখনই সংকীর্ণ সনাতনপন্থী ছিলেন না । বিবেকানন্দ ধর্মের মাধ্যমে সমাজতত্ত্ব ও মানবতত্ত্বের কথা বলেছেন । আমাদের দেশে সমাজতন্ত্রের আদর্শ সম্ভবত সর্বপ্রথম বিবেকানন্দই স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন । সুতরাং তাকে শুধু ধর্মসংস্কারক বা ধর্মপ্রচারক বললে ভুল হবে । তাঁর জীবনের ব্রতকেও যথোচিত মর্যাদা দেওয়া হবে না ।
================================================================
আমাদের দেশে যদি আধুনিক রাষ্ট্র চিন্তা ও সমাজচিন্তার ইতিহাস কোনোদিন লেখা হয় তবে স্বামী বিবেকানন্দ যে সেখানে কেবল স্বাদেশিকতা ও স্বাজাত্যবোধের অন্যতম উদ্বোধক বলে স্থান পাবেন তা নয়, তার সঙ্গে সমানাধিকার ও সমাজতন্ত্রের আদর্শের প্রথম প্রবক্তার কৃতিত্বও তিনি দাবি করবেন এবং সে-দাবি ঐতিহাসিক বা সমাজবিজ্ঞানীর পক্ষে অস্বীকার করাও সম্ভব হবে না । তাঁর কালে এই আদর্শের কথা নির্ভীককণ্ঠে প্রচার করতে যে কি প্রচন্ড পৌরুষের প্রয়োজন হয়েছিল তা আজ আমরা কল্পনাও করতে পারব না । কল্পনা করুন আজ থেকে ৭০/৮০ বছর আগে - বিদেশি ব্রিটিশরাজের একচ্ছত্র রাজত্বের যুগে -- কেবল স্বদেশপ্রেমের কথা নয় -- তিনি দেশের উচ্চশ্রেণী ও উচ্চসমাজের মুখের উপর বলেছেন -- 'তোমরা শূন্যে বিলীন হও, নূতন ভারত বেরুক, বেরুক চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে, মালো, মেথরের ঝুপড়ির মধ্য থেকে ।'
সর্ব নিম্নস্তরের মানুষের কাছেও প্রাণের অভিনন্দন পাওয়া যায় - এ তিনি জানতেন । কিন্তু বৈরাগ্যের বাণী বা ধর্মতত্ত্বের কথা তিনি মানুষের কাছে প্রচার করেননি । প্রচার করেছেন ঐতিহ্যের কথা, দেশাত্মবোধের কথা এবং জাতিভেদহীন শ্রেণীভেদহীন সমাজগঠনের কথা । আজকের জাতীয় সংকটের দিনে বিশেষ করে স্বামী বিবেকানন্দের দেশাত্মবোধ ও দেশীয় ঐতিহ্যবোধের আদর্শ এবং তাঁর ভেদবৈষম্যহীন ভারতীয় সমাজগঠনের আদর্শ থেকে আমরা খানিকটা প্রেরণা পেতে পারি ।