Tuesday, 11 April 2017

জাতিসমস্যায় মার্কসবাদ - সুপ্রকাশ রায়

"জাতি হইল, ইতিহাসের বিভিন্ন যুগের মধ্য দিয়া ক্রমবিকাশ-প্রাপ্ত, এক-ভাষাভাষী, নির্দিষ্ট স্থানে বসবাসকারী, একই অর্থনীতিক জীবন-সম্পন্ন এবং সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপের মধ্য দিয়া প্রকাশিত একই মানসিক গঠনযুক্ত স্থায়ী জনসমাজ ।" - J.V.Stalin : Marxism and the National and Colonial Question

=====================================

অস্ট্রালয়েড, মঙ্গোলয়েড এবং "আর্য" নামক মিশ্রিত মনোবসংখ্যাকে লইয়াই বর্তমান বাঙালী জাতি গঠিত । পণ্ডিতগণের মতে, বাঙালী জাতির মধ্যে "আর্য" রক্তের পরিমাণ শতকরা মাত্র পাঁচ ভাগ । বাকি সমস্তই "অনার্য" রক্ত । কোন সুদূর অতীতে কোল-সাঁওতাল-মুন্ডা-ওরাওঁদের পূর্বপুরুষ অর্থাৎ অস্ট্রালয়েড মানবশাখা, কোচ প্রভৃতি মঙ্গোলয়েড, "দ্রাবিড়" বলিয়া কথিত মিশ্রিত মানবগোষ্ঠী বাঙলাদেশে বন-জঙ্গল সাফ করিয়া বসতি স্থাপন করিয়াছিল । পরে "আর্য" বলিয়া কথিত মানুষ আসিয়া বাঙলাদেশে বাস করিতে থাকে । তাহার পর কালক্রমে এই জনসমষ্টি পরস্পরের সহিত মিশিয়া গিয়া এবং ইতিহাসের অর্থাৎ সমাজ-বিকাশের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করিয়া বাঙালী জাতিতে পরিণত হইয়াছে ।

=====================================

কেবলমাত্র কৃষি মানব-শাখার ঐক্য সাধনে অক্ষম । ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাই উহার শোষণ-কার্যের প্রয়োজনে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মিশ্রণ ঘটাইতে এবং উহাদের একজাতিরূপে গড়িয়া তুলিতে পারে ।

=====================================

বহু ভিন্ন ভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী বা উপজাতির মিশ্রণের ভিত্তিতেই প্রত্যেকটি আধুনিক জাতির জন্ম । এঙ্গেলস-এর কথায় :
"ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপেই কোন জাতিগোষ্ঠী বা উপজাতির মানুষ ভিতরে ও বাইরে সংহত ও ঘনিষ্ঠ হতে বাধ্য হয় । এইভাবে সর্বত্র পরস্পর-সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীও সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া বসবাসের এবং শীঘ্রই পরস্পরের সহিত মিশিয়া যাইবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে । ইহারাই অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ ঐ নিজ নিজ বাসভূমি একত্র করিয়া একটিমাত্র জাতির বাসভূমি সৃষ্টি করে ।"

F.Engels : The Origin of the Family, Private Property and the State

=====================================

আধুনিক ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মূলধনী শ্রেণীর পণ্যের বাজার সৃষ্টির তাগিদে দেশের বিভিন্ন অংশের মধ্যে এবং আদিবাসীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ গড়িয়া উঠে । জাতীয় সংহতি সৃষ্টির কার্যে ধনতন্ত্রের শক্তি অসাধারণ । ধনতন্ত্রই সামন্ততন্ত্রের বাধা চূর্ণ করিয়া জনসমষ্টিকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া তোলে । ধনতন্ত্রই বিশাল শিল্পাঞ্চলগুলিতে শ্রমিকরূপে বিপুল জনসংখ্যার সমাবেশ ঘটায় । ধনতন্ত্রই শিল্পকেন্দ্র শহরের সহিত কাঁচামালের সরবরাহ-ক্ষেত্র গ্রামাঞ্চলের সংযোগ স্থাপন করে এবং সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি করে ইহার সহিত অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধযুক্ত একটি মধ্যশ্রেণী । এই মধ্যশ্রেণীই তখন ধনতন্ত্রের মুখপাত্ররূপে জাতীয়তার ধারণা অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ প্রচার করে । ভারতবর্ষেও ধনতন্ত্রের প্রয়োজনে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় আন্দোলন গড়িয়া উঠিয়াছে । ভারতবর্ষের মূলধনীশ্রেণীও উহার অনুগত মধ্যশ্রেণীর সহায়তায় জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি করিয়াছে এবং উহাদের শোষণের প্রয়োজনে বহু জাতিতে বিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও সকল ভারতবাসীকে এক জাতি বলিয়া প্রচার করিয়াছে এবং এখনও করিতেছে ।

=====================================

"জাতি হইল সমাজের বিকাশ-ধারার বুর্জোয়াযুগের একটি অনিবার্য রূপ --- একটি অতি প্রয়োজনীয় পরিণতি ।"

Lenin : The Teachings of Karl Marx

=====================================

পশ্চিম ইউরোপে এক-একটি জাতি লইয়া এক-একটি রাষ্ট্র গঠিত হইয়াছে । এই সকল রাষ্ট্রে অন্য কোন জাতির অস্তিত্ব না থাকায়, এই সকল একজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে জাতীয় উৎপীড়নের কোন প্রশ্ন উঠে নাই । কিন্তু পূর্ব-ইউরোপে ও প্রাচ্য জগতে, যেমন ভারতবর্ষে, বহুজাতি-ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠিত হইয়াছে । এই সকল বহুজাতি-ভিত্তিক রাষ্ট্রে প্রভুত্ব করিতেছে ঐ রাষ্ট্রেরই কোন একটি বিশেষ উন্নত জাতি, আর অনগ্রসর জাতিগুলি বা জাতীয় জনশাখা বা উপজাতিগুলি প্রথমে ঐ প্রভুত্বকারী জাতিটির রাজনীতিক দাসত্বের এবং পরে অর্থনীতিক দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইয়াছে । প্রাচ্য জগতের এই বহুজাতি-ভিত্তিক রাষ্ট্রগুলিই জাতীয় উৎপীড়নের প্রধান ক্ষেত্র । এই প্রকারের জাতীয় উৎপীড়ন, অর্থাৎ একজাতির উপর অন্য জাতির উৎপীড়ন হইতেই জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ, জাতীয় আন্দোলন, জাতিগত সমস্যা প্রভৃতির সৃষ্টি হইয়াছে ।

=====================================

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বৈপ্লবিক সংগ্রামের জোয়ারে সমগ্র ভারতবর্ষের সাম্রাজ্যবাদী, সামন্ততান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক শোষণ-ব্যবস্থা ভাসিয়া যাইবার উপক্রম হয় তখন প্রত্যক্ষ শাসন আর সম্ভব নয় বুঝিয়া সাম্রাজ্যবাদীরা সমগ্র ভারতবর্ষকে ভাঙিয়া ভারত, পাকিস্তান ও ব্রহ্মদেশ এই তিনটি বহু-জাতিভিত্তিক নূতন রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে এবং এই তিনটি নূতন রাষ্ট্রের বৃহৎ বুর্জোয়া ও সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের হাতে শাসনভার ছাড়িয়া দিয়া পর্দার আড়ালে সরিয়া দাঁড়ায় ।

=====================================

যুদ্ধের সময় ঔপনিবেশিক বা আধা-ঔপনিবেশিক দেশসমূহের জনসাধারণের নিকট সাম্রাজ্যবাদীদের সাহায্যের আবেদনের ফলে উহাদের দুর্বলতা জনসাধারণের নিকট স্পষ্ট হইয়া উঠে, ঔপনিবেশিক দেশগুলির জনসাধারণের মনে আত্মশক্তিতে বিশ্বাস দেখা দেয় এবং সাম্রাজ্যবাদের শোষণ-উৎপীড়ন হইতে মুক্তিলাভের জন্য সংগ্রামের সাহস ও সংকল্প জাগিয়া উঠে । তাহার ফলেই আরাম্ভ হয় জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম । প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ভারতবর্ষেও এই সংগ্রাম চরমরূপ গ্রহণ করিয়াছিল ।

=====================================

প্রথম মহাযুদ্ধের পর আর একটি বিশেষ কারণেও জাতিগত সমস্যা ব্যাপকতর হইয়াছে, উহা বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিক সমস্যায় পরিণত হইয়াছে এবং জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের শক্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে । এই সময় জাতিগত সমস্যা প্রথমে বিচ্ছিন্ন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের আকারে এবং পরে সর্বগ্রাসী দাবাগ্নির আকারে বিশ্বব্যাপী মুক্তি-সংগ্রামরূপে দেখা দিয়াছে । এই বিশেষ কারণটি ছিল, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির দ্বারা তুরস্কের অঙ্গচ্ছেদ এবং রাষ্ট্র হিসাবে উহার অস্তিত্বের বিলোপসাধনের প্রয়াস । সে সময় তুরস্ক ছিল রাজনীতিক দিক থেকে সমগ্র মুসলিম জগতে সর্বাপেক্ষা অগ্রসর এবং অসাধারণ মানমর্যাদার অধিকারী । সাম্রাজ্যবাদীদের এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তুরস্ক উহার জাতীয় স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য সংগ্রাম আরম্ভ করে । তাহার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের পদানত দেশগুলি অর্থাৎ প্রাচ্যের ঔপনিবেশিক জগতের সমগ্র মুসলমান জনসাধারণ তুরস্কের পক্ষে দন্ডায়মান হয় এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ঔপনিবেশিক জগতের মুক্তি-সংগ্রামে যোগদান করে । ইহার ফলে ঔপনিবেশিক জগতের সংগ্রামী শক্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পায় । ভারতবর্ষে 'খিলাফত সংগ্রাম' ইহার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত । এইভাবে সংগ্রামের ক্ষেত্রে অনগ্রসর মুসলমান জনসাধারণের আবির্ভাব জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের পক্ষে একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ।

=====================================

বিশ্বব্যাপী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম দুর্বার হইয়া উঠে ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দে হইতে । বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার গর্ভ হইতে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মত দেখা দেয় 'নভেম্বর বিপ্লব' । তাহার ফলে ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দে ঔপনিবেশিক জগতের মুক্তির বাণী লইয়া আবির্ভূত হয় সমাজতন্ত্রী সোভিয়েত রাষ্ট্র । সাম্রাজ্যবাদের কবল হইতে প্রাচ্যের ঔপনিবেশিক জগতের মুক্তির বাণী ছিল ইহার পতাকায় অঙ্কিত । রুশিয়ার জার সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক দাসত্ব হইতে মুক্তিলাভ করিল বহু জাতি । এই সফলতায়  প্রাচ্যের ঔপনিবেশিক জগতের মানুষ মুক্তি-সংগ্রামের দুর্বার প্রেরণা লইয়া জাগিয়া উঠে । এইভাবে স্তালিনের ভাষায়, 'গড়িয়া উঠে আয়ার্ল্যান্ড হইতে ভারতবর্ষ পর্যন্ত এক অখণ্ড ও বিশাল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ফ্রন্ট ।"

=====================================

প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালের মত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরেও, অর্থাৎ সম্প্রতিকালেও কতকগুলি নূতন বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র আবির্ভূত হইয়াছে । এই সকল রাষ্ট্রও দীর্ঘকালের জাতীয় আন্দোলনের পরেই জন্মলাভ করিয়াছে । বুর্জোয়াশ্রেণীই ছিল এই সকল জাতীয় আন্দোলনের পরিচালক । সুতরাং এই নূতন রাষ্ট্রগুলিও বুর্জোয়া রাষ্ট্র রূপে দেখা দিয়াছে । দৃষ্টান্তস্বরূপ ভারত, পাকিস্তান এবং ব্রহ্মদেশের নাম করা যায় । বুর্জোয়া রাষ্ট্র বলিয়াই এই সকল নবজাত বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রেও বিভিন্ন জাতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হয় নাই এবং বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী বা উপজাতির উপর একটি বা কয়েকটি বৃহৎ ও উন্নততর জাতির শোষণ-উৎপীড়নেরও অবসান ঘটে নাই । ইহার মূল কারণ এই যে, এই সকল নূতন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং শ্রেণীর শোষণ-উৎপীড়নের ভিত্তির উপর, শ্রমিকশ্রেণী ও কৃষকের উপর মূলধনী ও জমিদার শ্রেণীর উপর শ্রেণীর শোষণ-উৎপীড়নের ভিত্তির উপর । সংক্ষেপে বলা যায়, এই নূতন বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রগুলি হইল শ্রেণীরাষ্ট্র এবং ইহারা শোষক-শ্রেণীগুলির শোষণ-উৎপীড়নের যন্ত্র ভিন্ন অন্য কিছু নয় । সুতরাং এই সকল রাষ্ট্র শ্রেণী শোষণ অব্যাহত রাখিবার জন্য পীড়ন-যন্ত্র অর্থাৎ শাসন-ক্ষমতা বা রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যতীত একদিনও টিকিয়া থাকিতে পারে না ।

=====================================

এই প্রকারের রাষ্ট্রই নিজ স্বার্থ রক্ষার জন্য, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ বিগ্রহ পরিচালনার জন্য শেষ পর্যন্ত আর্থিক ও সামরিক দিক হইতে শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির সাহায্যপ্রার্থী হইতে বাধ্য হয় । এই আর্থিক ও সামরিক সাহায্য লাভের শর্ত হিসাবেই এই প্রকারের রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির আজ্ঞাবহ ভৃত্যে পরিণত না হইয়া পারে না,-- যেমন হইয়াছে তথাকথিত স্বাধীন ভারতরাষ্ট্র ।

=====================================

"উৎপীড়িত জাতিসমূহের মুক্তি ও স্বাধীনতা ব্যতীত সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার কথা যেমন ভাবা যায় না, তেমনই বিভিন্ন জাতির উপর উৎপীড়ন ব্যতীত ধনতন্ত্রের অর্থাৎ বুর্জোয়া শাসনের অস্তিত্বের কথাও চিন্তা করা যায় না । যতদিন পর্যন্ত কৃষক জনসাধারণ এবং পাতিবুর্জোয়াশ্রেণী জাতীয়তাবাদের মোহে আচ্ছন্ন হইয়া থাকিবে এবং বুর্জোয়াশ্রেণীর নির্দেশে পরিচালিত হইবে, ততদিন উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ অনিবার্য । কিন্তু যখনই কৃষক জনসাধারণ শ্রমিকশ্রেণীর অনুগামী ও শ্রমিকশ্রেণীর নির্দেশে পরিচালিত হইবে তখনই বিভিন্ন জাতির মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হইবে, এক জাতির উপর হইতে অন্য জাতির শোষণ-উৎপীড়নের অবসান ঘটিবে এবং জাতিসমূহের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত হইবে ।" - স্তালিন

=====================================

মার্কস-এঙ্গেলস তাঁহাদের 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'-তে জাতি-সমস্যাটিকে কোন সংকীর্ণ জাতিগত দৃষ্টিকোণ হইতে বিচার না করিয়া শ্রমিকশ্রেণীর আন্তর্জাতিক আদর্শ দ্বারাই বিচার করিয়াছেন এবং দেখাইয়াছেন যে, কেবল শ্রমিকশ্রেণীর আন্তর্জাতিকতা দ্বারাই এই সমস্যার পূর্ণ সমাধান সম্ভব । এই শ্রমিক আন্তর্জাতিকতাই সমগ্র 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'র মূল আদর্শ । তাই 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো' ঘোষণা করিয়াছে :

"অন্যান্য শ্রমিক পার্টি ও কমিউনিস্টদের মধ্যে পার্থক্য এই যে, - (১) বিভিন্ন দেশের শ্রমিকশ্রেণীর জাতীয় সংগ্রামে কমিউনিস্টরা সমগ্র শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থকে সংকীর্ণ জাতীয়তার প্রশ্ন হইতে স্বতন্ত্রভাবে বিচার করিবে এবং সেই ভাবেই এই প্রশ্নের উপর গুরুত্ব আরোপ করিবে; (২) বুর্জোয়াশ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রাম যে সকল বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করিয়া অগ্রসর হইবে, সংগ্রামের সেই সকল স্তরে কমিউনিস্টরা সকল সময় এবং সমগ্র শ্রমিক-সংগ্রামেরই প্রতিনিধিত্ব করিবে ।"

ইহাই জাতিগত প্রশ্নে কমিউনিস্টদের বিচারের মূল ভিত্তি । শ্রমিকশ্রেণী সকল প্রকারের শোষণ-উৎপীড়নের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করে । সুতরাং তাহারা তাহাদের শ্রেণীগত আদর্শ হিসাবেই প্রত্যেকটি উৎপীড়িত জাতির স্বাধীনতা-সংগ্রামও সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে । কিন্তু তাই বলিয়া শ্রমিকশ্রেণী কখনও "ন্যায়-অন্যায় যাহাই করুক না কেন আমার জাতি, আমার দেশ" অথবা "আমার দেশ সবার ঊর্দ্ধে"-প্রভৃতি বুর্জোয়া ও পাতিবুর্জোয়া নীতি সমর্থন করে না । কোন জাতির মুক্তি-সংগ্রামের গতি প্রকৃতি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের দিকে কিনা তাহা বিচার করিয়াই শ্রমিকশ্রেণী জাতীয় সংগ্রাম সমর্থন করে ।

=====================================

মার্কসবাদীদের মতে, যে প্রতিক্রিয়াশীল শাসন ও শোষণব্যবস্থা ক্ষুদ্র-বৃহৎ সমস্ত জাতির স্বাধীন বিকাশ ও স্বাধীন অস্তিত্বের পক্ষে বাধাস্বরূপ, সেই শোষণ ও শাসন-ব্যবস্থার ধ্বংস সাধনেই প্রত্যেকটি জাতির মূলস্বার্থ রক্ষিত হইতে পারে । সুতরাং জাতীয় স্বাধীনতার জন্য যে সংগ্রাম পরিচালিত হয় তাহা নিঃসন্দেহে প্রগতিশীল । কিন্তু সেই সংগ্রাম আন্তর্জাতিক মুক্তি-সংগ্রামের সহিত কতখানি সম্পর্কযুক্ত তাহাই উহার প্রগতিশীলতার মাপকাঠি । এই জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম যে পরিমাণে বিশ্বের সমগ্র মানবজাতির পশ্চাদপদ অবস্থা ও শোষণ-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে এবং অগ্রগতির জন্য আন্তর্জাতিক সংগ্রামের সহিত সম্পর্কযুক্ত হইবে, জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম কেবল ততখানিই প্রগতিশীল বলিয়া গণ্য হইবে । আন্তর্জাতিক সংগ্রাম হইতে বিচ্ছিন্ন জাতীয়তাবাদকে শ্রমিকশ্রেণী বা মার্কসবাদ অগ্রাহ্য করে ।

=====================================

মার্কস-এঙ্গেলস উৎপীড়ক দেশের শ্রমিকশ্রেণীর কর্তব্য বিশেষভাবে নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন । যে প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা ঐ রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন জাতির শোষণ-উৎপীড়নের জন্য এবং প্রতিবেশী দেশসমূহকে গ্রাস করিবার জন্য ব্যবহৃত হয়, সেই রাষ্ট্রের শ্রমিকশ্রেণী কখনও তাহাদের তথাকথিত পিতৃভূমিকে সমর্থন করিতে পারে না । সেই রাষ্ট্র-ক্ষমতার বিরুদ্ধেই শ্রমিকশ্রেনীকে সংগ্রাম করিতে হইবে ।

=====================================

১৯৬৪ সালে আমেরিকার নিগ্রো জনসাধারণের সংগ্রাম সমর্থন করিবার জন্য সমস্ত বিশ্বের জনসাধারণকে আহবান জানাইয়া মাও সে-তুঙ লিখিয়াছিলেন :
"শেষ বিশ্লেষণে জাতীয় সংগ্রাম মূলত শ্রেণী সংগ্রাম ।"

=====================================

রাজনীতিক ও সামাজিক মুক্তি কেবল বিপ্লবের দ্বারাই সম্ভব । সুতরাং বলা যায় : 'প্রত্যেকটি শোষিত জাতি ও শ্রেণীর পক্ষে বিপ্লবই মূল প্রশ্ন ।' - মাও সে-তুং

=====================================

জাতীয় বিপ্লব জাতির জনসাধারণের - শ্রমিক কৃষকের - প্রত্যেকটি শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেণীর বিপ্লবের প্রশ্ন । কারণ, জাতির সর্বাধিক জনসংখ্যার - শ্রমিক-কৃষক ও অন্যান্য শোষিত শ্রেণীর স্বার্থই জাতীয় স্বার্থ । সুতরাং জাতীয় মুক্তির অর্থ, শোষণ-উৎপীড়ন হইতে জাতির সর্বাধিক জনসংখ্যার, বিশেষত শ্রমজীবী জনসাধারণের, শ্রমিক-কৃষকের মুক্তি ।

=====================================

ভারতের সংশোধনবাদী কমিউনিস্ট নেতৃত্ব সেদিন অর্থাৎ ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলমানের মিলন ও ঐক্যের অজুহাতে কেবল ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দুস্থান-পাকিস্তান এই দুই ভাগে ভারত ভাগের সহায়তা করিয়া মার্কসবাদকে কবরস্থ করিয়াছিল ।

ধর্ম জাতিত্বের কোন নিয়ামক উপাদান হইতে পারে না - এই মার্কসবাদী সত্যটিকে সংশোধনবাদী কমিউনিস্ট নেতৃত্ব সেদিন অস্বীকার করিয়াছিলেন । জাতি-সমস্যার সমাধান যে কেবল বিপ্লবের মধ্য দিয়াই সম্ভব - মার্কসবাদের এই মহাসত্যটিকে এড়াইবার জন্যই কমিউনিস্ট নেতৃত্বের এই বিশ্বাসঘাতকতা ।

=====================================

সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী শ্রেণী বলিয়া শ্রমিকশ্রেণীই হইবে ভারতের ঐক্যবদ্ধ বৈপ্লবিক 'ফ্রন্টের' নায়ক ও সংগঠক । শ্রমিকশ্রেণী একটি আন্তর্জাতিক বিপ্লবী শক্তি । তাই শ্রমিকশ্রেণী জাতি-বন্ধন ও দেশ-বন্ধনের ঊর্ধ্বে । এই জন্য একমাত্র শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বেই জাতি-উপজাতিসমূহের মুক্তি-সংগ্রাম, আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম, মুক্ত জাতি-উপজাতিসমূহের সমাজতন্ত্রের পথে জয়যাত্রার সংগ্রাম সফল হইতে পারে । ভূমির বন্ধনে আবদ্ধ কৃষক-সম্প্রদায়কে একমাত্র শ্রমিকশ্রেণীই পারে সামন্ততন্ত্রের বন্ধন হইতে মুক্ত করিয়া সমাজতন্ত্রের পথে চালিত করিতে । তাই ভারতের শ্রমিকশ্রেণীই হইবে ভারতের ঐক্যবদ্ধ বৈপ্লবিক 'ফ্রন্টের' জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের চালক-শক্তি ।

শ্রমিকশ্রেণী একটি অখণ্ড সর্বভারতীয় শক্তি । বাহিরের দিক হইতে জাতিগতভাবে বিভক্ত হইলেও শ্রেণীগতভাবে ইহারা এক ও অখণ্ড, শ্রেণী-চরিত্রের দিক হইতে অবিভাজ্য । ভারতের শ্রমিকশ্রেণী আজ একটি সর্বভারতীয় বিপ্লবী রাজনীতিক শক্তিরূপে আবির্ভূত, বৈপ্লবিক ভূমিকায় সুপ্রতিষ্ঠিত । তাই ভারতের বিভিন্ন জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামগুলিকে শ্রমিকশ্রেণীই জাতীয় পরিসরে সংগঠিত করিবে, ইহাদের মধ্যে ঐক্য গড়িয়া তুলিবে । ভারতের শ্রমিকশ্রেণীই শহরাঞ্চলের শোষিত মধ্যশ্রেণীর সংগ্রাম, জাতীয়-বুর্জোয়াগোষ্ঠীর সংগ্রাম গড়িয়া তুলিবে, এই সংগ্রামগুলিকে পরিচালিত করিবে এবং এক বৈপ্লবিক 'ফ্রন্টে' ঐক্যবদ্ধ করিবে ।

ভারতের শ্রমিকশ্রেণীই হইবে বিভিন্ন জাতি-উপজাতির এবং বিভিন্ন অঞ্চলের খন্ড খন্ড গণতান্ত্রিক বিপ্লবসমূহের সংগঠক, ঐক্যসাধক ও পরিচালক । শ্রমিকশ্রেণীর পরিচালনায়ই এই জাতীয় ও উপজাতীয় বিপ্লবসমূহ বিচ্ছিন্ন না থাকিয়া এক মহাজাতীয় বিপ্লবে পরিণত হইবে এবং দ্রুত গণতান্ত্রিক স্তর উত্তীর্ণ হইয়া সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে প্রবেশ করিবে ।

=====================================

"মানব-সমাজ যে বিভিন্ন রাষ্ট্রে ও জাতিতে বিভক্ত হইয়া রইয়াছে কেবল তাহার অবসান ঘটানোই সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য নয়, কেবল জাতিসমূহের বাহ্যিক মিলন ঘটানোই সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য নয় , সকল মানুষ যাহাতে মিলিয়ে মিশিয়া একাকার হইয়া যায় তাহাই সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য । ... উৎপীড়িত শ্রেণীসমূহের একনায়কত্বের পরিবর্তনশীল যুগের মধ্য দিয়া যাহাতে মানব জাতির মধ্য হইতে সকল শ্রেণীর অস্তিত্ব লোপ পায়, যাহাতে উৎপীড়িত জাতিসমূহ বিচ্ছিন্নতা ও স্বাধীনতার যুগের মধ্য দিয়া শেষ পর্যন্ত পূর্নমুক্তি লাভ করিয়া মিলিয়ে একাকার হইয়া যাইতে পারে তাহাই সমাজতন্ত্রের চরম লক্ষ্য ।" - Lenin : The Significance of Self-Determination






Thursday, 6 April 2017

শ্রীমদভগবাদগীতা ও বর্ণবৈষম্য

শমঃ,দমঃ,তপঃ শৌচম্‌ ক্ষান্তি আর্জবম্‌ এব চ ।
জ্ঞানম্‌ বিজ্ঞানম্‌ অস্তিকম্‌ ব্রহ্ম কর্ম সভাবজম্‌ ।।(১৮:৪২)
অর্থ - শম, দম, তপ, শৌচ, ক্ষান্তি, সরলতা, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও আস্তিক্য এগুলো ব্রাহ্মনদের স্বভাবজাত কর্ম।

শৌর্যম্‌ তেজঃ ধৃতিঃ দাক্ষ্যম্‌ যুদ্ধে চ অপি অপলায়নম্‌ ।
আনম্‌ ঈশ্বরম্‌ ভাবঃ চ ক্ষাত্রম্‌ কর্ম স্বভবজম্‌ ।।(১৮:৪৩)
অর্থ - শৌর্য, তেজ, ধৃতি, দক্ষ্যতা, যুদ্ধে অপরাম্মুখতা, দানশীলতা ও শাসন ক্ষমতা এইগুলি ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত কর্ম  ।

কৃষি গোরক্ষা বানিজ্যম্‌ বৈশ্য কর্ম স্বভাবজম ।
পরিচর্যা আত্মকম্‌ কর্মঃ শুদ্রস্য অপি স্বভাবজম্‌ ।।(১৮:৪৪)
অর্থ - কৃষি, গোরক্ষা ও বানিজ্য এইগুলো বৈশ্যের স্বভাবজাত কর্ম । পরিচর্যা শুদ্রের স্বভাবজাত কর্ম ।

এই পরিচর্যাত্মাক কর্মের অর্থ হলো সেবা করা।উচ্চ তিন বর্ণের মানুষদের ক্রমাগত সেবা করা । মানে যাকে বলে জন্মদাস এবং এটা নাকি আবার স্বভাবজাত । দাসগিরি করা কিভাবে একটি গোত্রের সকল মানুষের স্বভাব হয়ে গেল তা বোঝা গেল না । ঠিক একই ভাবে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা কিভাবে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদেরই স্বভাব কর্ম হয়ে গেল তাও বোঝা কঠিন । কোন শূদ্র কখনো জ্ঞান চর্চা করতে পারবে না, দেশ শাসন করতে পারবে না, কারণ তার জন্ম একটা শূদ্র পরিবারে । মোটকথা ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয় মিলে খাবে-দাবে, ভোগ করবে, দেশ শাসন করবে, বৈশ্যরা করবে গরু পালন আর চাষবাস, শূদ্ররা হবে জন্মোদাস । কি চমৎকার ভগবানের বাণী !


https://blog.mukto-mona.com/2014/02/04/39541/

Tuesday, 4 April 2017

ড. আম্বেদকর ও জাত বর্ণ শ্রেণি - শ্যামল চক্রবর্তী

ভারতে হিন্দুধর্মের হিংস্র বর্ণ-বৈষম্যের মধ্য থেকে নিম্নবর্ণে থাকা মানুষের মুক্তির জন্য এবং শিক্ষার সার্বিক প্রসারের জন্য তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে থাকেন । তাঁর অদম্য মানসিকতা এবং প্রভূত জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে শাসক ১৯৪২ সালে ২ রা জুলাই ভাইসরয়-এর এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে তাঁকে শ্রম-দপ্তরের সদস্য মনোনীত করে । ঐ পদটি ছিল কার্যত ভারতের শ্রম-মন্ত্রীর পদ । ঐ পদ গ্রহণ করে তিনি অনেক বাধা অতিক্রম করে শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণের জন্য উৎসাহ-ব্যঞ্জক নজির সৃষ্টি করেছিলেন । তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল - (১) শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা ও গৃহ নির্মাণে সাহায্য, (২) ট্রেড ইউনিয়ন করার আইনি স্বীকৃতি, (৩) মৃত শ্রমিকদের পরিবারকে এককালীন অর্থ সাহায্য, (৪) ন্যূনতম বেতন প্রদান, (৫) প্রসুতিকালীন সবেতন ছুটি ইত্যাদি । ফলে ভারতের শ্রমিকশ্রেণীর অধিকারের প্রশ্নে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল ।

=============================

আমাদের দেশে অনেক ধর্ম যেমন আছে আবার হিন্দু ধর্মের মধ্যে অনেক জাতও আছে । প্রায় সাড়ে ছয় হাজার । সেটি আরও বিভক্ত বর্ণাশ্রম জাতিভেদে, অর্থাৎ জাত ব্যবস্থায় । যতগুলি জাত ততোগুলি টুকরো । যার সংখ্যা এখন সাড়ে ছ হাজারেরও বেশি । যার প্রত্যেকটির সাথে প্রত্যেকটির 'বিরাগ' আছে । আর ড. আম্বেদকর বলেছেন 'ভারতের এই জাত ব্যবস্থা হল এমনই একটি বহুতল বাড়ি যার একটা তল থেকে আর একটা তলে যাবার সিঁড়ি নেই ।' কার্ল মার্কস যাকে বলেছেন 'বিরাগ', ড. আম্বেদকর তাকে আরও পরিষ্কার করেছেন 'graded inequality' বলে । অর্থাৎ বিরাগ বা ঘৃণার প্রকৃতিটা হলো ক্রমিক অসাম্য । এই যে হাজারটা জাত, মান মর্যাদায় তারা কিন্তু সবাই সমান নয় । প্রত্যেকটি জাত অপর একটি জাতের হয় উপরে নয়তো নিচে অবস্থান করছে, উলম্ব অবস্থান (vertical lay-out), অনুভূমিক (horizontal) নয় । এখানে কায়স্থরা মনে করে তারা মাহিষ্যদের থেকে উপরে এবং ব্রাহ্মণদের নিচে, মাহিষ্যরা মনে করে তারা সদগোপের থেকে উপরে কিন্তু কায়স্থদের থেকে নিচে, বাগদীরা মনে করে তারা সদগোপের থেকে নিচে কিন্তু ডোমেদের থেকে উপরে । নমঃশূদ্ররা মনে করে তারা পৌন্ড্রদের থেকে উপরে ।

এইভাবে ভারতবর্ষের হিন্দুদের প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের ঠোকাঠুকি । অন্য কারও থেকে উপরে আছে তাই সে সন্তুষ্ট । উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে জোট বাঁধার কথা ভাবতেই পারে না । একদিকে 'বিরাগ' আর অন্যদিকে সন্তুষ্টি, তাই মার্কসের ভাষায় সৃষ্টি হয়েছে 'স্থিতিসাম্য' (static balance) । এই static balance-এর জন্যই বর্ণ ব্যবস্থা এত দীর্ঘ সময় টিকে রয়েছে । এবং এই ব্যবস্থার সুফলটুকু অর্থাৎ ক্ষীরটুকু ব্রাহ্মণরা হিন্দু ধর্মের বড়ি খাইতে শূদ্রদের সম্মতি সাপেক্ষেই আত্মসাৎ করেছে ।

=============================

তিনি অচ্ছুতদের জন্যে জমি আর আলাদা কলোনি দাবি করেছিলেন । অবশ্য কৃষিবিপ্লব ছাড়া এ-সব করা সম্ভব নয় । তবে ভূমিদাসদের মতো অন্য সব জাতের মুখ চেয়ে বসে থাকার ব্যাপারটা থেকে বাঁচতে হলে সমস্ত অস্পৃশ্যকে জমি দেওয়ার ভাবনাচিন্তা খুবই সঠিক । কিন্তু সব ভূমিহীন মানুষের অভিন্ন সংগ্রামের ভেতর দিয়েই তো এই লক্ষ্যে পৌঁছানো যেত ।

আম্বেদকর হিন্দুসমাজের অন্যায় লোকাচারের, অন্যায় আচরণের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যে তাঁর অনুগামীদের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করতে বললেন । কিন্তু অন্যায় ভূমিগত সম্পর্কের ভিতের ওপরে গড়ে উঠেছে সমাজের যে ভয়ঙ্কর বাস্তব অবস্থাটা, তা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেই তো পালায় না । প্রেম আর সাম্যের সন্ধানে বেরিয়ে, তা যে পাওয়া গেল না, তার তো জলজ্যান্ত প্রমাণ সাম্প্রতিক নির্যাতন নিপীড়নের সব কান্ডকারখানা । পরিস্থিতিটা এমন করুন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, সবচেয়ে দলিত মথিত যে সম্প্রদায়গুলো, সেখান থেকেও উদ্ভূত বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টি সমতার সম্বন্ধে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটুকু, আরও চাকরি-বাকরি, আসন সংরক্ষণ, শিক্ষার সুযোগ সুবিধা - এইসব দাবির সঙ্কীর্ণ বেড়াটা পার হয়ে আদর্শগতভাবে আর বেশি দূরে এগুতে পারছে না । বর্তমান আর্থ-সামাজিক কাঠামোখানাকে একদম ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবার কাজটা ওঁদের চৈতন্যের বৃত্তের মধ্যে ঠাঁই পায়নি । ভূমিগত সম্পর্কগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বলতে অন্য আর সকলের সঙ্গে যুথবদ্ধ হয়ে অভিন্ন যুদ্ধ চালানোটাও যে বোঝায় - এটা কিন্তু ওঁদের নজরে পড়ল না । এইসব সম্প্রদায় থেকে যে সব বুদ্ধিজীবী উঠে এসেছেন, এঁরাও কেউ আগে, কেউ বা পরে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কাঠামোখানাকেই মেনে নিয়েছেন; জমির সঙ্গে, শিল্পের সঙ্গে বর্তমান সম্পত্তিগত সম্পর্কের ব্যাপারটা একটুও না ছুঁয়েই গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো সম্বন্ধে একটা সাধারণ ঘোষণায় তৃপ্ত হয়ে রয়েছেন ।

=============================

ভারতীয় সমাজে জাতপাত প্রথা একটি বিশেষ ধরনের বৈশিষ্ট্য । এটা একমাত্র ভারতেরই বৈশিষ্ট্য । বিশ্বের অন্য কোনো দেশে এরকম নেই । ভারতে জাতিভেদ শ্রেণিভিত্তিক ভাগাভাগির একটা লক্ষণ । কারণ জাতিভেদ বর্ণপ্রথার নামে অথবা জাতের নামে সমাজের শ্রমজীবী অংশকে দাবিয়ে রাখার জন্যই তৈরি হয়েছে । জাতিভেদ প্রথা শ্রেণি শোষণেরই একটা হাতিয়ার । উদ্বৃত্ত অংশ যত বেশি সম্ভব আত্মসাৎ করার লক্ষ্যেই জাতপাত প্রথার সৃষ্টি । উৎপাদন সম্পর্কের সাথে জাতপাত প্রথা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ।

জাতপাত প্রথার সৃষ্টি হয়েছে প্রায় তিন হাজার বছর আগে । ক্রমান্বয়ে এর পরিমাণগত পরিবর্তন হয়েছে । কিন্তু শোষণের গুণগত উপাদান প্রায় একই রয়ে গেছে । জাতিভেদ প্রথার কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ আছে এবং কিছু নির্দিষ্ট সীমাও আছে । কিন্তু জাত আর শ্রেণি শোষণ ও জাতপাতভিত্তিক শোষণ মিলে গেলে শোষণের তীব্রতা ও পরিমাণ অনেকগুণ বেড়ে যায় । যে দেশে জাত ব্যবস্থা নেই সেই দেশগুলিতে শ্রমিক বা কৃষক বা উভয়ই অর্থাৎ সব ধরনের শোষিতরা দলবদ্ধভাবে বা সুযোগ পেলে ব্যক্তিগতভাবে মালিকের সঙ্গে দর কষাকষি করতে পারে । ইচ্ছে করলে একটা বৃত্তি বা পেশা থেকে অন্য পেশায় চলে যেতে পারে । কিন্তু জাতের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব না । কারণ পেশা হচ্ছে জাতভিত্তিক । ইচ্ছে থাকলেও কোনো পেশার বাইরে অন্য কোনো কাজ করতে পারবে না । পেশাও ঠিক হবে জন্মসূত্রে । কাজেই তার জোট বাঁধারও কোনো সুযোগ নেই । নীচু জাত হবার সুবাদে সমাজে উচ্চশ্রেণির লোকেরা তাকে দাবিয়ে রাখে । তাকে সবসময় একটা ভয় বা আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয় । শারীরিকভাবেও  নিগৃহীত হতে পারে অথবা তাকে সামাজিক দিক থেকেও বয়কট করা হতে পারে বা সমাজ থেকে বের করে দেওয়া হতে পারে । সমাজ থেকে বের করে দেওয়া বা সামাজিক বয়কট তার মৃত্যুর সমান ।

এই ভারতে সামাজিক বিভাজন ঠিক কবে থেকে শুরু তা নিয়ে কিছু সমস্যা আছে । ভারতে প্রাচীনতম সভ্যতা হরপ্পা সভ্যতা (খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছর) ছিল প্রথম নগর সভ্যতা । শ্রেণি বিভাগ বা শ্রেণি শোষণ ছাড়া নগর সভ্যতা গড়ে উঠতে পারে না । কাজেই শ্রেণি শোষণ ছিল এটা নিশ্চিত । কিন্তু যতদিন পর্যন্ত হরপ্পা লিপি পড়া না যাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত জানা যাবে না যে তখন জাত ভাগ ছিল কিনা । বৈদিক সাহিত্য অনুযায়ী প্রায় খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার সাল নাগাদ প্রথম দেখা যায় বর্ণভেদ ভারতে শুরু হয়েছিল । ঋকবেদের দশম মন্ডলে বর্ণভেদের কথা আছে ।

কিন্তু বিদ্বজ্জনেরা মনে করেন বর্ণ বিভাজন প্রথমে দেখা যায় যজুর্বেদে । পরে তা ঋকবেদে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে । অনুমান করা হয় এক হাজার থেকে আটশত খ্রিস্টপূর্বের মধ্যে বর্ণ বিভাজন হয়ে যায় । সেই সময় সম্পত্তির মালিকানা তৈরি হয়েছিল । ফলে শ্রেণি বিভাজন হয় । ...

... জাত বিভাজন শুধু মাত্র শ্রম বিভাজন নয় । এটা শ্রমিকদের মধ্যেও বিভাজন । যে কোন সমাজে শ্রম বিভাজন দরকার হয় । কিন্তু ভারতে শ্রম বিভাজনটা একটা কৃত্রিম শৃঙ্খলে আবদ্ধ আছে । এখানে শ্রমিকদের মধ্যে এই বিভাজনটা স্তর বিন্যাস করে করা হয়েছে । পৃথিবীর কোন দেশেই শ্রম বিভাজনকে শ্রমিকদের স্তর বিন্যাসের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়নি ।শ্রম বিভাজন স্বতঃস্ফূর্তভাবেও হয়নি । স্বাভাবিক আগ্রহ থেকেও নয় । নিজের পেশা নিজে বেছে নিতে পারলে যে দক্ষতা অর্জন করা যায় বা নিজের জীবনের আর্থিক উন্নতি করা যায়, তা উপর থেকে চাপিয়ে দিলে হয় না ।

=============================

জাতপাত ব্যবস্থা ছিল প্রাথমিক উৎপাদকদের উদ্বৃত্ত থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে সামাজিক চেতনা তৈরি করার লক্ষ্যে একটা ধর্মীয় প্রক্রিয়া ।

=============================

আম্বেদকর একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, যার উত্তর এখনও কোনো জাতীয়তাবাদী দিতে পারেননি । প্রশ্নটার ধরণ ছিল এইরকম - দু'টো পৃথক জাতের যৌন মিলনে জন্ম দেওয়া সন্তানের রক্তের বিশুদ্ধতা নষ্ট হতে পারে এমন যুক্তি না হয় বোঝা গেল । কিন্তু এক পংক্তিতে বসে খেলেও কী রক্তের বিশুদ্ধতা নষ্ট হয়ে যায় ?

=============================

পৃথিবীর কয়েকটা দেশে বর্ণবৈষম্যবাদ এখনও নির্মূল হয়নি । এটা ছিল গায়ের রঙের বর্ণবৈষম্যবাদ । গণতান্ত্রিক পরিবেশের ক্রমশ বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তা দুর্বল হচ্ছে । ভারতে জাতপাতের বিভেদ কেবলমাত্র দু'টো সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে নয় । ভারতের একশো কোটির মানুষের মধ্যে ৮২ কোটি মানুষ হিন্দু । এই হিন্দুদের মধ্যে কত রকমের ভাগ । শুধু ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র নয়, প্রতিটা ভাগে কত উপবিভাগ । প্রতিটা বিভাগ-উপবিভাগের সঙ্গে অন্য বিভাগ-উপবিভাগের ঘৃণা, বিদ্বেষ, রক্ত, খুন মাখানো সম্পর্ক । এর শীর্ষে বসে ডান্ডা ঘোরাচ্ছে সবচেয়ে উঁচুজাতি বলে দাবি করা ব্রাহ্মণরা । প্রায় তিন হাজার বছর ধরে সেই বৈদিক যুগ থেকে মানুষের অভ্যাসের সঙ্গে জীবনচর্চার মধ্যে এই ঘৃণা বিদ্বেষ জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে । দুনিয়ার মধ্যে ভারত একটা নিকৃষ্ট ব্যতিক্রম । এমন দেশটা কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি ।

=============================

খ্রিস্ট্রপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্মের এই অগ্রগতি ও জনগণের দলে দলে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের প্রতিক্রিয়া হিসাবে ব্রাহ্মণ্যবাদে এক পুনরুত্থানবাদী ধারা শুরু হল । গৌতম বুদ্ধ সামাজিক ক্ষেত্রে বর্ণভেদের বিরোধিতা করেননি । বৌদ্ধ ধর্মের বাইরে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যে জাতিভেদের উপাদান রয়েই গেল । কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের উত্থানের ফলে ব্রাহ্মণ পুনরুত্থানবাদীরা আরও আষ্টে-পৃষ্ঠে জাতপাতকে সামাজিক আইনে বেঁধে ফেলল । রাজশক্তি নিজস্বার্থে তাতে মদত দিল । ব্রাহ্মণ পুনরুত্থানবাদ জীবনের সবক্ষেত্রে, ধর্মীয়, বুদ্ধিবৃত্তিগত, গার্হস্থ এবং সামাজিক ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই কঠোর আচরণবিধি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ব্রাহ্মণ্য সাম্রাজ্যের দুর্গ তৈরি করল । স্মৃতি বা ধর্মশাস্ত্রগুলি, মহাভারত ও রামায়ণ মহাকাব্য এবং অন্যান্য ধর্মীয় সাহিত্যে এই পুনরুত্থানবাদী ধারার প্রবাহ চলল । কয়েক শত বৎসর ধরে বহু চারণ কবি রামকে প্রতীক হিসাবে তুলে ধরলেন । এদের বলা হতো লব কুশ । এই ধারা বেয়েই রামায়ণ তৈরি হল । রামের চরিত্র সৃষ্টি ব্রাহ্মণ্যবাদকে সুসংহত করার লক্ষ্যে পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনের ফলশ্রূতি ।

=============================

ঋকবেদীয় পর্বে শ্রম বিভাজন অনেক এগিয়েছিল । অর্থব বেড পর্বের শেষদিকে অবশ্য কর্মবিভাজন (সামাজিক স্তর বিভাজন) হতে থাকে এবং জনগোষ্ঠী ও পরিবার গোষ্ঠী ক্রমে সামাজিক শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে যায় । শর্মার (আর এস শর্মা) মতে শূদ্র জনগোষ্ঠী বা আর্যদের যে অংশ দাসসুলভ কাজ করতেন, তাদের স্থান নির্ধারণ হল চতুর্থ বর্গে । পুরোহিতদের প্রভাবেই বর্ণ ব্যবস্থায় মতাদর্শের প্রভাব ঘটেছিল ।

=============================

বুদ্ধদেবের মতাদর্শে একটা অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব ছিল । তিনি হিন্দু সমাজের চতুর্বর্ণ সমাজের বিরোধিতা করেননি বরং তাকে স্বীকারই করেছিলেন । আবার তিনিই সমাজের বর্ণভেদ ভিত্তিক সামাজিক অসাম্যকে স্বীকার করেননি । তাঁর মত অনুযায়ী, মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব বা মূল্য নির্ধারিত হয় কোন জাতে সে জন্মগ্রহণ করেছে তার ফলে নয়, নির্ধারিত হয় তার আত্মিক ও নৈতিক গুণাবলী দিয়ে ।

=============================

কুরুক্ষেত্রে অর্জুন আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে না চাইলে কৃষ্ণ তাকে উজ্জীবিত করার জন্য নাকি কিছু উপদেশ দেন, এই উপদেশগুলোই হল গীতা । যদিও অনেক শাস্ত্রকার ও ঐতিহাসিক সমাজতত্ত্ববিদ মনে করেন গীতা মূল মহাভারতে ছিল না । খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে ভগবদগীতা পর্যায়ক্রমে রচিত । তারপরে মহাভারতে সংযুক্ত হয়েছিল । গীতার একটা বিখ্যাত উক্তি " স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় -পরধর্ম ভয়াবহ" এই স্বধর্ম কী ? তখন কি কোনো গ্রন্থে হিন্দু ধর্ম নাম কোন ধর্মের কথা বলা হয়েছে ? এখানে জাতপাতকেই ধর্ম বলা হয়েছে ।

=============================

ব্রাহ্মণ্য ধর্মের চরম গোঁড়ামি, জাত-পাত, অস্পৃশ্যতার নিদারুন অত্যাচার ও অবিচারের বিকল্প হিসাবে গৌতম বুদ্ধ সংঘগুলিতে সাম্যের আবহাওয়া সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন । তাই ভারতীয় জনগণের একটা বিশাল অংশ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিল । ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রেও তা একইভাবে প্রযোজ্য । ভারতে ইসলাম এক হাতে কোরান অপর হাতে তরবারি নিয়ে আসেনি । অল্প কিছু ক্ষেত্রে রাজশক্তি বা জোর করে ধর্মান্তর হলেও ইসলামের প্রভাব এখানে বেড়েছে দুটো প্রধান কারণে । সুফি ভক্তিবাদের ফলে এবং হিন্দু সমাজে জাতপাত ভেদের জন্য । নিম্নবর্ণের এবং দলিত জনগণের একাংশ উচ্চবর্ণের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে । স্বামী বিবেকানন্দ একে চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন । ভারতে দলিত মানুষ ইসলামের মধ্যে সাম্যের উপাদান দেখতে পেয়েছিল । বিবেকানন্দের মতে এই জন্য ভারতে (বিবেকানন্দের সময় অবিভক্ত ভারত - লেখক) এক পঞ্চাংশ  ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ।

=============================

হিন্দুধর্মের এবং সাধারণভাবে সমস্ত ধর্মেরই সামাজিক তথা অর্থনৈতিক ভূমিকাকে শ্রমিকশ্রেণির সামনে সঠিকভাবে তুলে না ধরলে আদর্শগত সংগ্রাম সফল হতে পারবে না । কৃষিবিপ্লব ঘটানোর জন্যে সংগ্রাম, একচেটিয়া পুঁজির দাপটচাপট আর সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অবসান ঘটানোর জন্যে সংগ্রাম সমাজতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাবে -- এমন ধরণের জনগণতন্ত্ররাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রাম--এ-সবই তো হচ্ছে আমাদের একালের প্রধান সংগ্রাম । এইসব সংগ্রাম থেকে সমাজের জাতপাতের ভেদাভেদ প্রথাটাকে দূর করে দেওয়ার প্রশ্নটাকে আলাদা করে দেখে ওটাকে খালি হিন্দু সমাজের সংস্কারের প্রশ্ন বলে মনে করা আর চলে না ।

=============================

সংরক্ষণের প্রশ্ন

ভারতের সংবিধানে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণ চালু আছে । জনসংখ্যার অনুপাত অনুযায়ী সংরক্ষণ-এর হার নির্ধারিত হবে কিন্তু কোনো সময়ই তা ৫০ শতাংশ অতিক্রম করতে পারবে না । শুধুমাত্র সরকারী চাকুরির ক্ষেত্রে সরকারি বা সরকার পোষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষেত্রে এই সংরক্ষণ প্রযোজ্য হয় । কিন্তু বেসরকারি ক্ষেত্রে সংরক্ষণ চালু করার প্রস্তাব থাকলেও তা এখনও আলোচনার স্তরে আছে । আর এস এস এবং বিজেপি-র বিভিন্ন মহল থেকে সংরক্ষণ প্রথার বিরোধিতা করা হচ্ছে এবং তা তুলে দেওয়ার জন্য সওয়াল করা হচ্ছে ।

ভারতের মত জাতপাত বিভক্ত সমাজে সংরক্ষণ থাকাটা খুবই প্রয়োজনীয় । কারণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উচ্চবর্ণের মানুষেরা সমাজ শাসন করেছেন, ধর্মের নামে বিভিন্ন বিধি বিধান দিয়েছেন তার অনিবার্য পরিণতিতে নিম্নবর্ণের মানুষদের শিক্ষা এবং সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল এবং তাদের উপরে অনেক বিধিনিষেধ জারি করা ছিল, এখনও কিছু কিছু আছে । উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ডঃ আম্বেদকরকে স্কুলে সহপাঠীদের সাথে একসাথে বসতে দেওয়া হতো না, বাইরে চাটাই পেতে বসতে হতো । পানীয় জলের পাত্রের কাছে যেতে পারতেন না । এমনকি অধ্যাপনার চাকরি পাওয়ার পরেও অধ্যাপকদের জলপানের অধিকার ছিল না । শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তারা উচ্চবর্ণের তুলনায় ক্রমশ পিছিয়ে গেছে । উচ্চবর্ণরা সংখ্যায় কম হয়েও যুগের পর যুগ ধরে সিংহভাগ চাকরিবাকরি, শিক্ষার সুযোগ -সমস্ত কিছুই দখলে রাখতেন ।

ব্রিটিশ আমলে সংরক্ষণের নীতি প্রথম চালু হয়েছিল । মূলস্রোতে আনবার জন্য সংরক্ষণই ছিল দরিদ্র নিম্নবর্ণের মানুষের কাছে একমাত্র অবলম্বন । যারা ইসলাম ধর্ম বা বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা কিন্তু এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল । এদের সংরক্ষণের আওতায় আনবার জন্য ২০১০ সালে রঘুনাথ মিত্র কমিশন রায় দিয়েছিলেন যে আর্থিক দিক থেকে ধর্ম নির্বিশেষে পিছিয়ে পড়া মানুষকে সংরক্ষণের আওতায় আনা যেতে পারে । পশ্চিমবাংলার বামফ্রন্ট সরকারি এটি প্রথম কার্যকরী করে এবং শতকরা ১৭ ভাগ সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষণের সুযোগ পায় ।

সংরক্ষণের সুযোগ নেওয়ার জন্য গ্রূপ ডি চাকরি ছাড়া অন্য পদে ন্যূনতম মাধ্যমিক পাশ করা দরকার । কিন্তু সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী তফশিলভুক্ত জাতির শতকরা ৭১.৩ ভাগ স্কুল ফাইনাল পাশ করার সুযোগ পায় (ভুল সংশোধন - তফশিলভুক্ত জাতির শতকরা ৭১.৩ ভাগ স্কুল ছুট) । ফলে সরকারের খুবই নিম্নস্তরের কাজে প্রতি ৪ জন দরিদ্রের মধ্যে ১ জন মাত্র সংরক্ষণের সুযোগ নিতে পারে । ২০০১-এর আদমসুমারি অনুযায়ী দলিতদের মধ্যে মাত্র ২.২৪% স্নাতক । এখন নয়া উদার অর্থনীতির যুগে সব কিছুর সঙ্গে শিক্ষাও বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে । ফলে সরকারি চাকরির সংখ্যা কমে যাচ্ছে । ১২০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ১ কোটি ৮০ লক্ষ মাত্র সরকারি চাকরি ।

তফশিল জাতি ও উপজাতির জন্য জাতীয় কমিশনের রিপোর্টে দেখা যায় যে কেন্দ্রীয় সরকারের এ গ্রেড অফিসারের ন্যূনতম ১৫ শতাংশ এই অংশের মানুষের হওয়া উচিত সেখানে ৮.৪ শতাংশ মাত্র চাকরি করেন । দিল্লি হাইকোর্টের ২০ জন বিচারকের মধ্যে একজনও দলিত নেই । তামিলনাড়ু সামাজিক ন্যায়ের জন্য বিখ্যাত কিন্তু সেখানেও হাইকোর্টের বিচারকের ৩৮ জনের মধ্যে মাত্র ৪ জন, কেরালায় ২৫ জনের মধ্যে ১ জন তফশিল জাতিভুক্ত ।

২০১১ আদমসুমারি অনুযায়ী ১২০ কোটির মধ্যে তফশিল জাতি ও উপজাতির সংখ্যা ৩০ কোটি । সংরক্ষণের মাধ্যমে আদিবাসিরা চাকরি পে ঝাড়ুদার বা জমাদার ইত্যাদি পদে ।

সংরক্ষণ নিয়ে দুটি প্রশ্ন যথাযথ উঠে এসেছে । তফশিল জাতিভুক্ত অনেক মানুষ আছেন যারা সংরক্ষণের সুবিধা পেয়ে অর্থনৈতিক মর্যাদা পেয়েছেন । যারা ব্যক্তিগতভাবে তফসিলী উপজাতিভুক্ত হওয়ার জন্য অর্থনৈতিক বা শিক্ষাক্ষেত্রে ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অনেক অগ্রসর হয়ে এসেছেন যেমন কলেজের অধ্যক্ষ বা অধ্যক্ষা, চিকিৎসক, সরকারি অফিসার নিম্ন আদালতের বিচারক ইত্যাদি । এইভাবে তফশিলভুক্ত উপজাতির মধ্যে একটা উচ্চতর অংশ তৈরি হয়েছে তাদের পরিবারের মানুষেরা এখন সমাজের প্রভাবশালী অংশের মধ্যে অন্যতম । তারা এখন সমাজের সংরক্ষণের সমগ্র সুবিধা ভোগ করে নিচ্ছেন । তাদের বলা হয় ক্রাম লেয়ার । আবার উচ্চবর্ণের মানুষ হলেও অর্থনৈতিক দিক থেকে খুবই পিছিয়ে পড়া প্রচুর মানুষ আছেন । কিন্তু তারা উচ্চবর্ণের মানুষ এইজন্যই কোনো সুযোগ পান না । তাদের জন্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আয়ের একটা ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া হোক এবং উচ্চবর্ণের হলেও অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদদের সংরক্ষণের সুযোগ দিতে হবে ।

=============================

ভারতে এত জাতি ধর্ম আছে যে তা পরিচিতি সত্তার উর্বর ভূমি ।

বিভিন্ন দলিত গোষ্ঠী, ওবিসি আন্দোলন, সংরক্ষণের জন্য, সম্পদের ভাগ নেবার দাবিতে এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং অন্য নানা কারণে পরস্পর বিরোধী রাজনীতিতে প্রশ্রয় দেয় । কিন্তু এই গোষ্ঠীগুলি মৌলিক সামাজিক কাঠামো এবং শ্রেণি শোষণ বদলানোর দাবিতে আন্দোলন সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যায় না । অন্যান্য নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলাতে তাদের আগ্রহ নেই ।...

...এ ধরনের পরিচিতি সত্তা নির্ভর রাজনীতি শুধুমাত্র দলিত বা পশ্চাৎপদশ্রেণির সংগঠনগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই । নির্বাচনী শক্তি ও সমর্থন ভিত্তি বাড়াতে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলিও পরিচিতি সত্তা-নির্ভর রাজনীতিকে ব্যবহার করে থাকে । উত্তরপ্রদেশে যেমন বিজেপি, এসপি এবং কংগ্রেসের মতো সব দলই জাতপাত ও সাবকাস্ট ভিত্তিক দলীয় সম্মেলনের আয়োজন করে থাকে । পরিচিতি সত্তা-নির্ভর রাজনীতিকে তারা ব্যবহার করে এবং জাতপাতভিত্তিক বিভাজন প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করে ।


=============================

ভারতীয় সমাজে শ্রেণি শোষণ এবং সামাজিক নিপীড়ন দুটোই আছে । আমাদের দেশের আর্থ সামাজিক কাঠামোয় জাতপাতভিত্তিক, জাতিগোষ্ঠীগত ও লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক নিপীড়ন একই সঙ্গে পুঁজিবাদী ও আধা সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণি শোষণের সঙ্গেই বিদ্যমান । শাসকশ্রেণিগুলি উদবৃত্ত শ্রম শোষণ করে শ্রেণি শোষণের মাধ্যমে এবং তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে তারা বিভিন্ন ধরণের সামাজিক নিপীড়নকে কাজে লাগায় । সে জন্যই শ্রেণি সংগ্রাম চালিয়ে নিয়ে যাবার গুরুত্বের উপরও জোর দেবার পাশাপাশি সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামও চালাতে হবে । বিশ্বজোড়া লগ্নিপুঁজির দাপট বাড়ার এবং সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন মাথাচাড়া দেবার পরই শাসকশ্রেণিগুলি পরিচিতি সত্তা-নির্ভর রাজনীতি ও আন্দোলনকে বড় আকারে মদত দিচ্ছে । এ ধরনের আন্দোলন নিপীড়িত শ্রেণীগুলির মধ্যে পেটি বুর্জোয়াদের একটা অংশকে ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসার সুযোগ করে দেয় ।