Friday, 29 January 2016

এই হিন্দু রাষ্ট্রের স্লোগান আসলে কী ? - ইয়েচুরি

"আর এস এসকে সে রকম বীর বা ত্রাতার বেশে হাজির করতে হলে, একটা মিথ্যা চেতনা সৃষ্টির প্রয়োজন ছিলো যে, হিন্দুরা বঞ্চিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে । সেই সঙ্গে জরুরি ছিলো , এর জন্য দায়ী বলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা জন্মানো (হিটলারের প্রচন্ড ইহুদি বিরোধিতার খেই ধরে) ।

গৈরিক বাহিনীর আজকের ক্রিয়াকলাপ ও প্রচার-কার্য গোলওয়ালকরের কাছে পাওয়া এই দুই নির্দিষ্ট তাত্ত্বিক ইন্ধনের ভিত্তিতেই চলে । অভিষ্ট পূরণে তারা গোয়েবলসীয় কৌশলকে আরও উন্নত ও শানিততর (গোয়েবলস হিটলারের প্রচারমন্ত্রী ছিলেন) করেছে, অর্থাৎ মিথ্যা বলো - পর্বতপ্রমাণ মিথ্যা, যার ফলে মিথ্যাই সত্যরূপে প্রতীয়মান হবে ।"

" "বিদেশি অংশের সামনে দুটি পথ খোলা আছে । হয় দেশ ও জাতির সঙ্গে একাত্ম হও অথবা যতক্ষণ তারা থাকতে দেয় অথবা এ দেশ ছাড়তে হুকুম না দেয়, ততদিন তাদের দয়ায় থাকো ... ।" ... যে ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মকে রাজনীতি ও রাষ্ট্র থেকে পৃথক করে ব্যক্তিগত বিষয়রূপে গণ্য করে, গোলওয়ালকর তাকে খারিজ করলেন । ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রায় ঈশ্বরদ্রোহিতার পর্যায়ে ফেলে তিনি বিতর্ক জুড়ে দেন এই বলে যে,

"ধর্মকে ব্যক্তিগত প্রশ্নরূপে গণ্য করার এবং রাষ্ট্রীয় ও জনজীবনে পরিহারের পক্ষে একটা সাধারণ প্রবণতা দেখা যায় । ধর্মকে ভুল বোঝা এই ঝোঁকের কারণ এবং যাদের গোষ্ঠীতে ধর্ম বলার মতো কিছু নেই তারাই এই ঝোঁকের মূলে" (গোলওয়ালকর, ১৯৩৯, পৃ. ২৩) রয়েছেন ।"

========================================================================

"।। ফ্যাসিবাদের অনুপ্রেরণা ।।

সেই 'প্রাচীন জাতিদের' আচরণ কেমন হবে ? ফ্যাসিস্ত জার্মানির এর চেয়ে রাখঢাকহীন তোষামোদ আর হয় না ।

"প্রাচীন বর্ণাভিমান, যার বলে জার্মান উপজাতিরা সারা ইউরোপ ছেয়ে ফেলেছিলো, এ যুগের জার্মানিতে সে আবার মাথা তুলেছে, ফলে জাতিকে তার লুন্ঠনকারী পূর্বপুরুষ দ্বারা নির্ধারিত লক্ষ্যপূরণের পথ অনুসরণ করতেই হচ্ছে । আমাদের ক্ষেত্রেও একই হবে; বর্ণাভিমান আবার জেগে উঠেছে । এই দেশ যে আধ্যাত্মিক মহাপুরুষকুলের জন্ম দিয়েছে, তাঁরা আজ সৌম্য মহিমায় দৃপ্ত পদভারে মেদিনী কাঁপাচ্ছেন, তাঁরাই এর সাক্ষ্য বহন করছেন ।"
আরও বলেছেন

"জাতির বিশুদ্ধতা ও তার সংস্কৃতিকে অক্ষুণ্ন রাখতে, জার্মানি সেমিটিক জাতির ইহুদিদের বহিষ্কার করে সারা পৃথিবীকে চমকে দিয়েছিলো । এখানে জাত্যাভিমান তার তীব্রতমরূপে প্রকট । জার্মানি দেখিয়ে দিয়েছে যে মূলেই যারা পৃথক, সেই জাতি, সংস্কৃতিকে অভিন্ন সত্তায় সমন্বিত করা প্রায় অসম্ভব । হিন্দুস্তানে আমরা, আমাদের হিতার্থে এ থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিতে পারি" (গোলওয়ালকর, ১৯৩৯, পৃ. ৩৫) ।

এইভাবে হিটলার হয়ে দাঁড়ালেন 'গুরুজির গুরু'। আর এস এসের রাজনৈতিক কর্মসূচির দানবীয় প্রকৃতির এটাই বাস্তব রূপ । হিন্দু ধর্ম ও প্রাচীন সবকিছুর ধ্বজাধারীর বেশে, আদ্যোপান্ত আধুনিক ও পাশ্চাত্য ফ্যাসিবাদী ধারণা আমদানি করতে, তার কোনো বিবেক দংশন নেই । ফ্যাসিবাদ ছাড়া, বাকি সব পাশ্চাত্য ধারণা ও সভ্যতার প্রগতি এদের কাছে 'বিজাতীয়' বলে নিন্দিত ।

ফ্যাসিবাদী ছদ্ম-হিন্দুত্বের কোনো কোনো প্রবক্তা ফ্যাসিবাদের এই নগ্ন স্তাবকতার সপক্ষে উদ্ভূত কুযুক্তি নিয়ে এগিয়ে আসেন ।

"১৯৩৯ সালে ইহুদিদের প্রতি হিটলারের আচরণের বিশেষ কিছু খবর না থাকায়, তার একটি মাত্র উল্লেখ উপেক্ষা করাই উচিত অথবা মানুষটিকে সন্দেহের হাত থেকে ছাড় দেওয়াই সঙ্গত" (মোদক, ১৯৯৩, পৃ. ১১)।

যদি তাই হয়, তবে ১৯৪৭ সালের সংস্করণেও এই অনুচ্ছেদটি অপরিবর্তিত রয়ে গেল কেন ?  ১৯৪৭ সালে হিটলারের অপরাধগুলি সাধারণ মানুষের গোচরে এসেছিলো, যেমন এর আগে ১৯৩৯-এও এসেছিলো । পরবর্তী সংস্করণে গোলওয়ালকর ওই অংশটি বাদ দিলেন না কেন ? তথ্য পাওয়া যায়নি বলে নয়, কারণ হলো গোলওয়ালকর ও আজকের গৈরিক বাহিনী হিটলারের পদ্ধতিকে পাল্লা দিতে চায় ।

জ্বলন্ত অসঙ্গতিও গোলওয়ালকরকে বিচলিত করে না । যদি, তাঁর মতে, হিন্দুরাই আর্য ছিলো, তাহলে হিটলার আবার কোন আর্যদের ত্রাতার ভূমিকা নিয়েছিলেন ? সেগুলোও যদি আর্য হয়, তবে তারা কি ভারত থেকে জার্মানিতে দেশান্তরী হয়েছিলো নাকি উল্টোটা ? তাঁর তত্ত্ব মানলে, ভারত ও জার্মানি উভয়েই একটি অভিন্ন জাতির অংশ !

অনুশীলনটি পুরোপুরিই ফ্যাসিবাদী ঝোঁকের হিন্দুরাষ্ট্রের মতাদর্শগত ভিত্তি জুগিয়েছে, যা গৈরিক বাহিনীর আজকের ব্রতের সারমর্ম ।"

=======================================================================

"হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা আর মুসলিম মৌলবাদ একে অপরকে পুষ্টি যোগায় ।"

"গোলওয়ালকারের বইটি (we or our nationhood defined by guruji) প্রকাশ হওয়ার দু'বছর বাদে, জামাত-এ-ইসলামি গঠিত হয় । ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে, মওলানা আবুল আলা মওদুদির নেতৃত্বে পাঠানকোটে তার প্রতিষ্ঠা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । আর এস এসের কাছে যেমন গোলওয়ালকার, জামাতের ক্ষেত্রে তেমনি মওদুদি । তাঁদের রাজনৈতিক প্রকল্প ও ভূমিকার সাদৃশ্য বাস্তবিকই চমকপ্রদ । হিটলার যেমন গোলওয়ালকারের নায়ক, ঠিক তেমনি মওদুদির কাছেও । গোলওয়ালকার যেমন মানব সভ্যতার আধুনিক সব কিছুকেই - স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং সংসদীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ - বিজাতীয় ধারণা বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, মওদুদির এবং মুসলিম মৌলবাদী দর্শনের ভূমিকাও ছিলো অনুরূপ ।

১৯৪৭ সালের মে মাসে, দেশবিভাগ যখন আসন্ন, মওদুদি হিন্দু শাস্ত্র ও বিধান মেনে রাষ্ট্র ও সমাজ গড়তে ভারতীয়দের আহ্বান জানান, যেমন পাকিস্তানকে তাঁরা গড়বেন 'আল্লা'র বিধান মেনে ।পাকিস্তানে কুআদিআনি-বিরোধী দাঙ্গার অনুসন্ধানে নিযুক্ত এক সদস্য কমিশনের বিচারক মহম্মদ মুনিবের কিছু প্রশ্নের উত্তরে মওদুদি বলেন :

"যদি হিন্দু বিধানের ওপর ভর করে কোনো হিন্দু সরকার ভারতে আসে এবং মনুর বিধান আইনরূপে গৃহীত হয়, এবং যার ফলে মুসলিমরা অস্পৃশ্য বলে বিবেচিত হয়, সরকারে তাদের অংশগ্রহণ করতে না দেওয়া হয় - শুধু তাই নয়, তারা নাগরিক অধিকার থেকে পর্যন্ত বঞ্চিত হয়, তবে আমার আপত্তি নেই" (জেড এ নিজামি, ১৯৭৫)

হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা আর মুসলিম মৌলবাদ একে অপরকে পুষ্টি জোগায় । এও প্রক্রিয়ায়, উভয়েই সাম্প্রদায়িক বিষ গভীর থেকে গভীরে ছড়িয়ে দেয়, আমাদের দেশের ঐক্য ও সংহতির বিন্যাস বিপন্ন করে । উভয়েই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের  --- যাদের প্রতিনিধিরূপে তারা নিজেদের দাবি করে --- স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে । আজ ভারত ধর্মনিরপেক্ষ, কারণ হিন্দু ও মুসলিমদের বৃহত্তর অংশ তাদের এই রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করেছে ।"

পুরাণ ও ইতিহাস - ইয়েচুরি

"বিজেপিকে ভারতের রাজনীতির কেন্দ্রীয় মঞ্চে নিয়ে আসা এই সমগ্র প্রচারকার্যে বেপরোয়াভাবে পুরাণ এবং ইতিহাসের পার্থক্য মুছে দেওয়া হয়েছে, দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের ফারাক ঘুচিয়ে দেওয়া হয়েছে । ধার্মিকতার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোন সম্পর্ক নেই তবুও মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যাপকভাবে অপব্যবহার করে সাম্প্রদায়িকতা এগিয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে ।"

Monday, 25 January 2016

মার্কসবাদ ও ধর্ম - ইয়েচুরি

"ধর্মীয় দুঃখ-কষ্ট একাধারে বাস্তব দুঃখ-কষ্টের প্রকাশ ও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ । ধর্ম নিপীড়িত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন পৃথিবীর সহৃদয়তার কাহিনী, যেন ভৌতিক জীবনের আত্মা, মানুষের জীবনে ধর্ম হচ্ছে আফিম ।"

" ... কোপারনিকাস অথবা একলব্যকে যে নিগ্রহ করা হয়েছিল, মার্কসবাদ তার জন্য ধর্মকেই দায়ী করে না । তার কারণ তৎকালীন সামাজিক শক্তি ও গতিবিধি ধর্মের ভাষাতেই প্রতিফলিত হয়েছিল, কারণ লিপিবদ্ধ ইতিহাসের গোটাটাতেই ধর্মই ছিল প্রধান মতাদর্শ । ধর্ম যতদিন প্রধান মতাদর্শ হয়ে থাকে, ততদিন প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল আদর্শ, শাসকশ্রেণীর কায়েমী স্বার্থ ও শোষিত শ্রেণীর দাবি সমানভাবে ধর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের মনে নিজেদের উপস্থিত করে । তাই মার্কসবাদ ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের প্রগতিশীল উপাদানকেও স্বীকার করে, যেমন সুফি বা ভক্তি আন্দোলন, কিন্তু একইসঙ্গে তাদের সীমাবদ্ধতাকেও দেখিয়ে দেয়, কারণ কেবলমাত্র ধর্মীয় ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে তারা সমাজের কাঙ্খিত পরিবর্তন আনতে পারবে না ।"

একটি নির্দিষ্ট সময়ে যখন সুনির্দিষ্ট শ্রেণী সংগ্রাম ধর্মের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়, তখন অন্য সকল শাসকশ্রেণীর মত সেই ধর্মই শোষক শ্রেণীর হাতিয়ার ও যুক্তিতে পরিণত হয় । যেমন লেনিন বলেছেন, "ধর্ম হলো এক ধরণের আত্মিক শোষণ যা সর্বত্র ব্যাপকতম জনসাধারণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, যারা অন্যের সুবিধার জন্য শুধু খেটেই মরে এবং দারিদ্র্য ও বিচ্ছিন্নতায় নিষ্পেষিত হয় । শোষকদের বিরুদ্ধে শোষিতদের লড়াই করার অক্ষমতা থেকে তৈরি হয় কবরের পর এক উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষা, ঠিক যেমন প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে বর্বরেরা ভগবান, শয়তান, জাদু ইত্যাদির উপর আস্থা রেখেছিল । যে মানুষ সারা জীবন ধরে পরিশ্রম করছে আর কষ্ট করছে ধর্ম তাকে শেখাচ্ছে এই মর্ত্যে যেন সে নম্র হয়, ধৈর্যশীল হয় যাতে সে পরবর্তীকালে স্বর্গে যাবার পুরস্কার পায় এবং যারা অন্যের শ্রমের উপর বেঁচে থাকে, ধর্ম তাদেরকে শেখায় এই মর্ত্যে তুমি দয়া দেখাও, ফলে শোষক হিসাবে টিকে থাকার সস্তা যুক্তি যোগায় এবং স্বর্গীয় যুগের জন্য ঠিকঠাক দামের টিকিট বিক্রি করে ।"

"মার্কসবাদ ধর্মকেই আক্রমণ করে না । মার্কসবাদ আক্রমণ করে সেই পরিস্থিতিকে যা ধর্মের উত্থানে সাহায্য করে এবং সেই অবস্থাকে যা জনগণের উপর ধর্মের আধিপত্যকে বজায় রাখতে সাহায্য করে ।যেহেতু ধর্ম নিজে কোন বস্তু নয়, মার্কসবাদ সেই বস্তুর আমূল বদল চায়, যা ধর্মকে শ্রেণী শোষণের স্থায়ী হাতিয়ারে পরিণত করে ।"

Sunday, 24 January 2016

হিন্দুদের মুসলমান বিরোধ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

হিন্দুমুসলমান (সাময়িক সারসংগ্রহ)

"আমাদের একটা মস্ত কাজ আছে হিন্দু-মুসলমানে সখ্যবন্ধন দৃঢ় করা। অন্য-দেশের কথা জানি না কিন্তু বাংলাদেশে যে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সৌহার্দ্য ছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। বাংলায় হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানের সংখ্যা বেশি এবং হিন্দু-মুসলমানে প্রতিবেশিসম্বন্ধ খুব ঘনিষ্ঠ। কিন্তু আজকাল এই সমন্ধ ক্রমশ শিথিল হইতে আরম্ভ করিয়াছে। একজন সম্ভ্রান্ত বাঙালি মুসলমান বলিতেছিলেন বাল্যকালে তাঁহারা তাঁহাদের প্রতিবেশী ব্রাহ্মণ পরিবারদের সহিত নিতান্ত আত্মীয়ভাবে মেশামেশি করিতেন। তাঁহাদের মা-মাসিগণ ঠাকুরানীদের কোলে পিঠে মানুষ হইয়াছেন। কিন্তু আজকাল শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে নূতন হিন্দুয়ানি অকস্মাৎ নারদের ঢেঁকি অবলম্বন করিয়া অবতীর্ণ হইয়াছে। তাঁহারা নবোপার্জিত আর্য অভিমানকে সজারুর শলাকার মতো আপনাদের চারি দিকে কণ্টকিত করিয়া রাখিয়াছেন; কাহারো কাছে ঘেঁসিবার জো নাই। হঠাৎবাবুর বাবুয়ানার মতো তাঁহাদের হঠাৎ হিঁদুয়ানি অত্যন্ত অস্বাভাবিক উগ্রভাবে প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে। উপন্যাসে নাটকে কাগজে পত্রে অকারণে বিধর্মীদের প্রতি কটাক্ষপাত করা হইয়া থাকে। আজকাল অনেক মুসলমানও বাংলা শিখিতেছেন এবং বাংলা লিখিতেছেন-- সুতরাং স্বভাবতই এক পক্ষ হইতে ইঁট এবং অপরপক্ষ হইতে পাটকেল্ বর্ষণ আরম্ভ হইয়াছে। কোথায় তুর্কীর সুলতান তিনশত পাচক রাখিয়াছেন ইহাই লইয়া ম্লেচ্ছদিগকে তিরস্কার ও হিঁদুয়ানির বড়াই করিয়া আপন পাড়ার প্রতিবেশীদের সহিত বিরোধের সূত্রপাত করিলে তাহাতে হিন্দুদের, মাহাত্ম্য নহে, পরন্তু ক্ষুদ্রতারই পরিচয় দেওয়া হয়। যদি আমাদের ধর্মের এমন কোনো গুণ থাকে যাহাতে আমাদের পুরাতন পাড়ার লোককেও আপন করিয়া লইতে বাধা দেয় তবে সে ধর্মের জন্য অহংকার করিবার কারণ কিছুই দেখি না।"

লোকহিত (কালান্তর)

"অল্পদিন হইল এ-সম্বন্ধে আমাদের একটা শিক্ষা হইয়া গেছে। যে কারণেই হউক যেদিন স্বদেশী নিমকের প্রতি হঠাৎ আমাদের অত্যন্ত একটা টান হইয়াছিল সেদিন আমরা দেশের মুসলমানদের কিছু অস্বাভাবিক উচ্চস্বরেই আত্মীয় বলিয়া ভাই বলিয়া ডাকাডাকি শুরু করিয়াছিলাম।

সেই স্নেহের ডাকে যখন তাহারা অশ্রুগদগদ কণ্ঠে সাড়া দিল না তখন আমরা তাহাদের উপর ভারি রাগ করিয়াছিলাম। ভাবিয়াছিলাম এটা নিতান্তই ওদের শয়তানি। একদিনের জন্যও ভাবি নাই আমাদের ডাকের মধ্যে গরজ ছিল কিন্তু সত্য ছিল না। মানুষের সঙ্গে মানুষের যে একটা সাধারণ সামাজিকতা আছে, যে সামাজিকতার টানে আমরা সহজ প্রীতির বশে মানুষকে ঘরে ডাকিয়া আনি, তাহার সঙ্গে বসিয়া খাই, যদি-বা তাহার সঙ্গে আমাদের পার্থক্য থাকে সেটাকে অত্যন্ত স্পষ্ট করিয়া দেখিতে দিই না-- সেই নিতান্ত সাধারণ সামাজিকতার ক্ষেত্রে যাহাকে আমরা ভাই বলিয়া আপন বলিয়া মানিতে না পারি দায়ে পড়িয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ভাই বলিয়া যথোচিত সতর্কতার সহিত তাহাকে বুকে টানিবার নাট্যভঙ্গী করিলে সেটা কখনোই সফল হইতে পারে না।

এক মানুষের সঙ্গে আর-এক মানুষের, এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আর-এক সম্প্রদায়ের তো পার্থক্য থাকেই, কিন্তু সাধারণ সামাজিকতার কাজই এই-- সেই পার্থক্যটাকে রূঢ়ভাবে প্রত্যক্ষগোচর না করা। ধনী-দরিদ্রে পার্থক্য আছে, কিন্তু দরিদ্র তাহার ঘরে আসিলে ধনী যদি সেই পার্থক্যটাকে চাপা না দিয়া সেইটেকেই অত্যুগ্র করিয়া তোলে তবে আর যাই হউক দায়ে ঠেকিলে সেই দরিদ্রের বুকের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িয়া অশ্রুবর্ষণ করিতে যাওয়া ধনীর পক্ষে না হয় সত্য, না-হয় শোভন।

হিন্দুমুসলমানের পার্থক্যটাকে আমাদের সমাজে আমরা এতই কুশ্রীভাবে বেআব্রু করিয়া রাখিয়াছি যে, কিছুকাল পূর্বে স্বদেশী অভিযানের দিনে একজন হিন্দু স্বদেশী-প্রচারক এক গ্লাস জল খাইবেন বলিয়া তাঁহার মুসলমান সহযোগীকে দাওয়া হইতে নামিয়া যাইতে বলিতে কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করেন নাই। কাজের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার বশে মানুষ মানুষকে ঠেলিয়া রাখে, অপমানও করে-- তাহাতে বিশেষ ক্ষতি হয় না। কুস্তির সময়ে কুস্তিগিরদের গায়ে পরস্পরের পা ঠেকে তাহার হিসাব কেহ জমাইয়া রাখে না, কিন্তু সামাজিকতার স্থলে কথায় কথায় কাহারও গায়ে পা ঠেকাইতে থাকিলে তাহা ভোলা শক্ত হয়। আমরা বিদ্যালয়ে ও আপিসে প্রতিযোগিতার ভিড়ে মুসলমানকে জোরের সঙ্গে ঠেলা দিয়াছি; সেটা সম্পূর্ণ প্রীতিকর নহে তাহা মানি; তবু সেখানকার ঠেলাঠেলিটা গায়ে লাগিতে পারে, হৃদয়ে লাগে না। কিন্তু সমাজের অপমানটা গায়ে লাগে না, হৃদয়ে লাগে। কারণ, সমাজের উদ্দেশ্যই এই যে, পরস্পরের পার্থক্যের উপর সুশোভন সামঞ্জস্যের আস্তরণ বিছাইয়া দেওয়া।

বঙ্গবিচ্ছেদ-ব্যাপারটা আমাদের অন্নবস্ত্রে হাত দেয় নাই, আমাদের হৃদয়ে আঘাত করিয়াছিল। সেই হৃদয়টা যতদূর পর্যন্ত অখণ্ড ততদূর পর্যন্ত তাহার বেদনা অপরিচ্ছিন্ন ছিল। বাংলার মুসলমান যে এই বেদনায় আমাদের সঙ্গে এক হয় নাই তাহার কারণ তাহাদের সঙ্গে আমরা কোনোদিন হৃদয়কে এক হইতে দিই নাই।

সংস্কৃত ভাষায় একটা কথা আছে, ঘরে যখন আগুন লাগিয়াছে তখন কূপ খুঁড়িতে যাওয়ার আয়োজন বৃথা। বঙ্গবিচ্ছেদের দিনে হঠাৎ যখন মুসলমানকে আমাদের দলে টানিবার প্রয়োজন হইল তখন আমরা সেই কূপ-খননেরও চেষ্টা করি নাই-- আমরা মনে করিয়াছিলাম, মাটির উপরে ঘটি ঠুকিলেই জল আপনি উঠিবে। জল যখন উঠিল না কেবল ধুলাই উড়িল তখন আমাদের বিস্ময়ের সীমাপরিসীমা রহিল না। আজ পর্যন্ত সেই কূপখননের কথা ভুলিয়া আছি। আরও বার বার মাটিতে ঘটি ঠুকিতে হইবে, সেই সঙ্গে সে-ঘটি আপনার কপালে ঠুকিব।"

হিন্দুমুসলমান (কালান্তর)

“পৃথিবীতে দুটি ধর্মসম্প্রদায় আছে অন্য সমস্ত ধর্মমতের সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধতা অত্যুগ্র-- সে হচ্ছে খৃস্টান আর মুসলমান-ধর্ম। তারা নিজের ধর্মকে পালন করেই সন্তুষ্ট নয়, অন্য ধর্মকে প্রতিহত করতে উদ্যত। এইজন্যে তাদের ধর্ম গ্রহণ করা ছাড়া তাদের সঙ্গে মেলবার অন্য কোনো উপায় নেই। খৃস্টানধর্মাবলম্বীদের সম্বন্ধে একটি সুবিধার কথা এই যে, তারা আধুনিক যুগের বাহন; তাদের মন মধ্যযুগের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ নয়। ধর্মমত একান্তভাবে তাদের সমস্ত জীবনকে পরিবেষ্টিত করে নেই। এইজন্যে অপরধর্মাবলম্বীদেরকে তারা ধর্মের বেড়ার দ্বারা সম্পূর্ণ বাধা দেয় না। য়ুরোপীয় আর খৃস্টান এই দুটো শব্দ একার্থক নয়। "য়ুরোপীয় বৌদ্ধ' বা "য়ুরোপীয় মুসলমান' শব্দের মধ্যে স্বতোবিরুদ্ধতা নেই। কিন্তু ধর্মের নামে যে-জাতির নামকরণ ধর্মমতেই তাদের মুখ্য পরিচয়। "মুসলমান বৌদ্ধ' বা "মুসলমান খৃস্টান' শব্দ স্বতই অসম্ভব। অপর পক্ষে হিন্দুজাতিও এক হিসাবে মুসলমানদেরই মতো। অর্থাৎ, তারা ধর্মের প্রাকারে সম্পূর্ণ পরিবেষ্টিত। বাহ্য প্রভেদটা হচ্ছে এই যে, অন্য ধর্মের বিরুদ্ধতা তাদের পক্ষে সকর্মক নয়-- অহিন্দু সমস্ত ধর্মের সঙ্গে তাদের শষশ-ৎভষরনশঢ় শষশ-দষ-ষসনক্ষতঢ়ভষশ। হিন্দুর ধর্ম মুখ্যভাবে জন্মগত ও আচারমূলক হওয়াতে তার বেড়া আরও কঠিন। মুসলমানধর্ম স্বীকার ক'রে মুসলমানের সঙ্গে সমানভাবে মেলা যায়, হিন্দুর সে পথও অতিশয় সংকীর্ণ। আহারে ব্যবহারে মুসলমান অপর সম্প্রদায়কে নিষেধের দ্বারা প্রত্যাখ্যান করে না, হিন্দু সেখানেও সতর্ক। তাই খিলাফৎ উপলক্ষ্যে মুসলমান নিজের মসজিদে এবং অন্যত্র হিন্দুকে যত কাছে টেনেছে হিন্দু মুসলমানকে তত কাছে টানতে পারে নি। আচার হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধের সেতু, সেইখানেই পদে পদে হিন্দু নিজের বেড়া তুলে রেখেছে। আমি যখন প্রথম আমার জমিদারি কাজে প্রবৃত্ত হয়েছিলুম তখন দেখেছিলুম, কাছারিতে মুসলমান প্রজাকে বসতে দিতে হলে জাজিমের এক প্রান্ত তুলে দিয়ে সেইখানে তাকে স্থান দেওয়া হত। অন্য-আচার-অবলম্বীদের অশুচি ব'লে গণ্য করার মতো মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের এমন ভীষণ বাধা আর কিছু নেই। ভারতবর্ষের এমনি কপাল যে, এখানে হিন্দু-মুসলমানের মতো দুই জাত একত্র হয়েছে; ধর্মমতে হিন্দুর বাধা প্রবল নয়, আচারে প্রবল; আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয়, ধর্মমতে প্রবল। এক পক্ষের যে দিকে দ্বার খোলা, অন্য পক্ষের সে দিকে দ্বার রুদ্ধ। এরা কী করে মিলবে। এক সময়ে ভারতবর্ষে গ্রীক পারসিক শক নানা জাতির অবাধ সমাগম ও সম্মিলন ছিল। কিন্তু মনে রেখো, সে "হিন্দু'-যুগের পূর্ববর্তী কালে। হিন্দুযুগ হচ্ছে একটা প্রতিক্রিয়ার যুগ-- এই যুগে ব্রাহ্মণ্যধর্মকে সচেষ্টভাবে পাকা ক'রে গাঁথা হয়েছিল। দুর্লঙ্ঘ্য আচারের প্রাকার তুলে এ'কে দুষ্প্রবেশ্য ক'রে তোলা হয়েছিল। একটা কথা মনে ছিল না, কোনো প্রাণবান জিনিসকে একেবারে আটঘাট বন্ধ ক'রে সামলাতে গেলে তাকে মেরে ফেলা হয়। যাই হোক, মোট কথা হচ্ছে, বিশেষ এক সময়ে বৌদ্ধযুগের পরে রাজপুত প্রভৃতি বিদেশীয় জাতিকে দলে টেনে বিশেষ অধ্যবসায়ে নিজেদেরকে পরকীয় সংস্রব ও প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ রক্ষা করবার জন্যেই আধুনিক হিন্দুধর্মকে ভারতবাসী প্রকাণ্ড একটা বেড়ার মতো করেই গড়ে তুলেছিল-- এর প্রকৃতিই হচ্ছে নিষেধ এবং প্রত্যাখ্যান। সকলপ্রকার মিলনের পক্ষে এমন সুনিপুণ কৌশলে রচিত বাধা জগতে আর কোথাও সৃষ্টি হয় নি। এই বাধা কেবল হিন্দু-মুসলমানে তা নয়। তোমার আমার মতো মানুষ যারা আচারে স্বাধীনতা রক্ষা করতে চাই, আমরাও পৃথক, বাধাগ্রস্ত। সমস্যা তো এই, কিন্তু সমাধান কোথায়। মনের পরিবর্তনে, যুগের পরিবর্তনে। য়ুরোপ সত্যসাধনা ও জ্ঞানের ব্যাপ্তির ভিতর দিয়ে যেমন ক'রে মধ্যযুগের ভিতর দিয়ে আধুনিক যুগে এসে পৌঁচেছে হিন্দুকে মুসলমানকেও তেমনি গণ্ডির বাইরে যাত্রা করতে হবে। ধর্মকে কবরের মতো তৈরি করে তারই মধ্যে সমগ্র জাতিকে ভূতকালের মধ্যে সর্বতোভাবে নিহিত করে রাখলে উন্নতির পথে চলবার উপায় নেই, কারো সঙ্গে কারো মেলবার উপায় নেই। আমাদের মানসপ্রকৃতির মধ্যে যে-অবরোধ রয়েছে তাকে ঘোচাতে না পারলে আমরা কোনোরকমের স্বাধীনতাই পাব না। শিক্ষার দ্বারা, সাধনার দ্বারা সেই মূলের পরিবর্তন ঘটাতে হবে-- ডানার চেয়ে খাঁচা বড়ো এই সংস্কারটাকেই বদলে ফেলতে হবে-- তার পরে আমাদের কল্যাণ হতে পারবে। হিন্দু-মুসলমানের মিলন যুগপরিবর্তনের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু এ কথা শুনে ভয় পাবার কারণ নেই; কারণ অন্য দেশে মানুষ সাধনার দ্বারা যুগপরিবর্তন ঘটিয়েছে, গুটির যুগ থেকে ডানা-মেলার যুগে বেরিয়ে এসেছে। আমরাও মানসিক অবরোধ কেটে বেরিয়ে আসব; যদি না আসি তবে, নান্যঃপন্থা বিদ্যতে অয়নায়।”

আত্মপরিচয়

“সকল মানুষেরই "আমার ধর্ম' বলে একটা বিশেষ জিনিস আছে। কিন্তু সেইটিকেই সে স্পষ্ট করে জানে না। সে জানে আমি খৃস্টান, আমি মুসলমান, আমি বৈষ্ণব, আমি শাক্ত ইত্যাদি। কিন্তু সে নিজেকে যে ধর্মাবলম্বী বলে জন্মকাল থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত নিশ্চিন্ত আছে সে হয়তো সত্য তা নয়। নাম গ্রহণেই এমন একটা আড়াল তৈরি করে দেয় যাতে নিজের ভিতরকার ধর্মটা তার নিজের চোখেও পড়ে না।

কোন্ ধর্মটি তার? যে ধর্ম মনের ভিতরে গোপনে থেকে তাকে সৃষ্টি করে তুলছে। জীবজন্তুকে গড়ে তোলে তার অন্তর্নিহিত প্রাণধর্ম। সেই প্রাণধর্মটির কোনো খবর রাখা জন্তুর পক্ষে দরকারই নেই। মানুষের আর-একটি প্রাণ আছে, সেটা শারীর-প্রাণের চেয়ে বড়ো--সেইটে তার মনুষ্যত্ব। এই প্রাণের ভিতরকার সৃজনীশক্তিই হচ্ছে তার ধর্ম। এইজন্যে আমাদের ভাষায় "ধর্ম' শব্দ খুব একটা অর্থপূর্ণ শব্দ। জলের জলত্বই হচ্ছে জলের ধর্ম, আগুনের আগুনত্বই হচ্ছে আগুনের ধর্ম। তেমনি মানুষের ধর্মটিই হচ্ছে তার অন্তরতম সত্য।”


Saturday, 23 January 2016

ভারত উন্নয়ন ও বঞ্চনা - অমর্ত্য সেন জঁ দ্রেজ

"দুনিয়ার অন্য নানা দেশের মতোই ভারতেও গণতন্ত্র তার সম্পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি: 'জনগণের, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য' শাসনের লক্ষ্য পূরণে ঘাটতি ভারতেও থেকে গিয়েছে । "

"ষাট বছরের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ভারত গণতান্ত্রিক দেশগুলির মধ্যে অগ্রণী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে । দক্ষিণ এশিয়া সহ দুনিয়ার অনেক দেশেই যেমন সামরিক বাহিনী এসে নির্বাচিত সরকারকে গদিচ্যুত করে ক্ষমতার দখল নিয়েছে, ভারতে তা হয়নি । বহু ভাষা, ধর্ম  এবং জাতিগোষ্ঠী সমন্বিত একটি দেশে গণতন্ত্র কী ভাবে বিকশিত হতে পারে, ভারত তা প্রত্যয়ের সঙ্গে দেখিয়ে দিয়েছে । "

বি আর আম্বেডকর বলেছিলেন, 'শিক্ষিত করা, বিক্ষুব্ধ করা এবং সংগঠিত করা'র শক্তি সম্পর্কে হতাশ হওয়ার কোনও কারণ নেই, বরং সেই সম্ভাবনাগুলি চরিতার্থ করতে আমাদের যথেষ্ট তৎপর হওয়ার কারণ আছে ।"

"ভারতে সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা প্রথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, এটা গর্ব করার ব্যাপার । রেডিয় এবং টেলিভিশনেও বহু স্টেশন ও চ্যানেল কাজ করছে, বিশেষ করে বহু টিভি চ্যানেলে চব্বিশ ঘন্টা সংবাদ পরিবেশন করা হয়, বিভিন্ন মতের বিতর্কের মধ্য দিয়ে সংবাদের পর্যালোচনা করা হয় । একটা স্তরে এটা অবশ্যই গণতান্ত্রিক পরিসরের বিরাট সাফল্য এবং অবাধ বহুদলীয় নির্বাচনের মতো অন্য বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের উপরেও এর একটা সুপ্রভাব থাকে ।
সংবাদমাধ্যমের  ব্যর্থতার দিকটাও মনে রাখা দরকার । নাগরিকদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক জীবনে যে সব অন্যায় এবং অকুশলতা আছে, সংবাদমাধ্যমে সেগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব পায় না । সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনযাত্রার সংকট এবং সমস্যাগুলি দূর করার কাজে একটা কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে, এ-রকম গভীর এবং উৎকৃষ্ট সাংবাদিকতার নমুনা কমই দেখা যায়; সংবাদমাধ্যম সাধারণত সমাজের সৌভাগ্যবান এবং সফল অংশের উজ্জ্বল ছবি দেখাতেই ব্যস্ত থাকে । কিছু প্রশংসনীয় ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তা ব্যতিক্রমমাত্র ।"

"আয়বৃদ্ধির সামাজিক সুফল এখনও অত্যন্ত সীমিত । সমস্যাটা শুধু এই নয় যে, সাম্প্রতিক কালে আয়ের বৈষম্য রীতিমত বেড়েছে; চিনে যখন প্রকৃত মজুরি দ্রুত বেড়েছে এবং তার ফলে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানে রীতিমত উন্নতি হয়েছে, ভারতে তখন মজুরি কার্যত একই জায়গায় আটকে আছে । পাশাপাশি, আয়বৃদ্ধির ফলে সরকারি রাজস্ব বাড়লেও সেই বাড়তি সম্পদ সামাজিক এবং বস্তুগত পরিকাঠামোর উন্নয়নে যথেষ্ট কাজে লাগানো হয়নি, এ ব্যাপারেও চিনের তুলনায় ভারত অনেক পিছিয়ে ।শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিচর্যা, পানীয় জল বা নিকাশী ব্যবস্থার মতো অপরিহার্য সামাজিক পরিষেবাগুলির সরবারহেও বিপুল ঘাটতি আছে, বহু মানুষ এখনও এই সব পরিষেবা থেকে সম্পূর্ণত বা বহুলাংশে বঞ্চিত ।"

"কুড়ি বছর আগে দক্ষিন এশিয়ার ছ'টি দেশের (ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান) মধ্যে সামাজিক সূচকগুলির তালিকায় ভারত সাধারণত দু'নম্বর জায়গাটিতে থাকত, এখন তার স্থান বেশিরভাগ ব্যাপারেই নীচের দিক থেকে দ্বিতীয় - একমাত্র পাকিস্তানের ওপরে । ভারত মাথাপিছু আয়ের সিঁড়িটিতে ক্রমশ উপরে উঠছে, আর সামাজিক অর্জনের সিঁড়িটিতে ক্রমশ নীচে নামছে । "

"স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় সেই সংগ্রামের নায়করা বলেছিলেন, স্বাধীন ভারতের লক্ষ্য হবে উন্নয়ন ও সমতা । সেই পরিপ্রেক্ষিতে, মানতেই হবে, স্বাধীন ভারতের ব্যর্থতা বিরাট । ব্যর্থতা শুধু এই নয় যে, আয়বৃদ্ধির সুফল বন্টনে বিরাট বৈষম্য ঘটেছে; উন্নয়নের ফলে অর্জিত সম্পদ সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের বিপুল সামাজিক বঞ্চনা দূর করার কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রেও রীতিমত ব্যর্থতা দেখা গেছে ।"

"স্বাধীনতার সময় ভারতে 'রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক গণতন্ত্র' প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়েছিল । কিছুটা অতিসরলিকরণের ঝুঁকি নিয়ে বলা যায়, দুটি ক্ষেত্রে ভারত এই লক্ষ্য পূরণে বিশেষ ভাবে ব্যর্থ : (১) যাঁরা সুবিধাভোগী, তাঁদের সঙ্গে অবশিষ্ট মানুষের অবস্থায় এখনও বিপুল বৈষম্য এবং (২) ভারতীয় অর্থনীতি ও সমাজ যে ভাবে সংগঠিত, তাতে দক্ষতা ও দায়বদ্ধতা এখন অত্যন্ত কম ।"



"সাম্প্রতিক দশকগুলিতে, বিশেষত গত বছর দশেকে ভারতের দ্রুত আয়বৃদ্ধি নিয়ে সঙ্গত কারণেই একটা উচ্ছ্বাস তৈরী হয়েছে । 'মধ্যবিত্ত শ্রেণি'র (প্রচলিত অর্থে, আয়ের দিক থেকে উপরের দিকের কুড়ি শতাংশ মানুষ) জীবন-মানের যতটা উন্নতি হয়েছে, সেটা আগের দশকগুলিতে ভাবা যায়নি । কিন্তু অন্য অনেক ধরনের মানুষের - যেমন রিকশা-চালক, বাড়ির কাজের লোক বা ইটভাটার শ্রমিকের - ক্ষেত্রে গল্পটা অনেক জটিল । এ ধরনের বা এর চেয়েও কম সুবিধাভোগী মানুষের জীবনে আর্থিক সংস্কারের পর্বটিতে উচ্ছ্বসিত হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি । তাঁদের অবস্থায় কোনও উন্নতি হয়নি এমন নয়, কিন্তু পরিবর্তন হয়েছে অত্যন্ত ধীরগতিতে এবং তার ফলে তাঁদের চরম দুর্দশা বিশেষ পাল্টায়নি ।"

"অশোক কোতোয়াল, ভরত রামস্বামী এবং ইউলিমা ওয়াধবা (২০১১) প্রণীত এক সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে এই বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে । ১৯৮৩ এবং ২০০৪-০৫, এই দুটি বছরের এনএসএস সমীক্ষার পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তাঁরা এই গবেষণাটি করেছেন । তাঁদের হিসেবে, এই সময়ের মধ্যে গ্রাম প শহর মিলিয়ে দারিদ্রের মাথা-গুনতি অনুপাত ৪৫ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২৮ শতাংশ । তাঁরা দেখিয়েছেন, দারিদ্র রেখার অঙ্কটি যদি দ্বিগুন করা হয় (তারপরেও কিন্তু অঙ্কটি কমই থাকবে), তা হলে ১৯৮৩ সালে দারিদ্রের অনুপাত ছিল ৮৬ শতাংশ এবং ২০০৪-০৫ সালে ৮০ শতাংশ । কুড়ি বছরে এই উন্নতি অকিঞ্চিৎকর, বিশেষ করে দারিদ্র হ্রাসের সরকারি পরিসংখ্যানের তুলনায় । আরও সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে যে, গত দুই দশকে সামগ্রিকভাবে উন্নতশীল দেশগুলির তুলনায় ভারতে দারিদ্রের মাত্রা হ্রাসের গতি অনেক কম ছিল - ভারতে আয়বৃদ্ধির গতি উন্নতিশীল দুনিয়ার গড় আয়বৃদ্ধির চেয়ে অনেকটা বেশি হওয়া সত্ত্বেও ।"

Tuesday, 19 January 2016

সক্রেটিস

" জাহাজ তৈরী করতে বিশেষজ্ঞের পরামর্শের দরকার হয়, দুর্গ বানাতেও বিশেষজ্ঞ লাগে। .. শুধু জাতীয় নীতির অতি গুরুত্বপূর্ণ ন্যায়-অন্যায় স্থির করার প্রশ্নে যে-খুশি উঠে দাঁড়িয়ে গেল আর কথা বলতে শুরু করল, সঙ্গে সঙ্গে সে হয়ে গেল বিজ্ঞ বিচারক ..."

Sunday, 17 January 2016

ফ্রান্সে শ্রেণী-সংগ্রাম ১৮৪৮ থেকে ১৮৫০ - কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস

"সব থেকে শক্তিশালী, সবচেয়ে সুশৃঙ্খল ও দ্রুততম হারে বিকাশমান সমাজতন্ত্রী দল হিসাবে শুধু বর্তমান থেকেই জার্মান শ্রমিকেরা তাদের আদর্শের জন্য যে কাজ সম্পন্ন করেছিল, সেই প্রথম কাজটি বাদেও তারা আর একটি মস্ত কাজ করেছে । সর্বজনীন ভোটাধিকার কী ভাবে প্রয়োগ করতে হয় - তা দেখিয়ে দিয়ে তারা তাদের সব দেশের কমরেডদের নতুন ও সব থেকে তীক্ষ্ণ একটি হাতিয়ার জোগায় ।"

"যেখানে জনসাধারণ এখন পর্যন্ত আমাদের থেকে দূরে সরে আছে, সেখানে নির্বাচনী প্রচারের মারফত তাদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের, এবং আমাদের আক্রমণের মুখে অন্য সব পার্টিকে সমগ্র জনসাধারণের দরবারে নিজেদের মতামত ও কার্যকলাপের ব্যাখ্যা করতে বাধ্য করার এক অদ্বিতীয় হাতিয়ার আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে এই ভোটাধিকার ।"

"প্রলেতারিয়েতের একটি মাত্র জবরদখল বুর্জোয়ারা মেনে নিতে প্রস্তুত - লড়বার জবরদস্তি ।"

Saturday, 9 January 2016

ধর্ম - মার্ক্সবাদ

দার্শনিক মনীষী কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) ইউরোপের ভাববাদী দার্শনিক হেগেলের (১৭৭০-১৮৩১) আইনের দর্শনের পর্যালোচনার ভূমিকাতে বলেন “ধর্ম হল নিপীড়িত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয় ঠিক যেমন সেটা হল আত্মবিহীন পরিবেশের আত্মা। ধর্ম হল জনগণের জন্য আফিম। মানুষের মায়াময় সুখ হিসেবে ধর্মকে লোপ করাটা হল মানষের প্রকৃত সুখের দাবি করা। বিদ্যমান হালচাল সম্বন্ধে মোহ পরিত্যাগ করার দাবিটা হল যে-হালচালে মোহ আবশ্যক, সেটাকে পরিত্যাগ করার দাবি। তাই ধর্মের সমালোচনা হল ধর্ম যার জ্যোতির্মণ্ডল সেই অশ্রু উপত্যকার (এই পার্থিব জীবনের) সমালোচনার সূত্রপাত।”