১) "ভক্তিযোগ প্রেমের এই উচ্চতম বিকাশের বিজ্ঞানস্বরূপ।" (পৃষ্ঠা ৪১)
"ভারতবাসীর মনের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করিলে জানা যায়, কি জড়বিজ্ঞান, কি মনোবিজ্ঞান, কি ভক্তিতত্ত্ব, কি দর্শন—সর্ব বিভাগেই উহা চিরকাল এই বহুর মধ্যে এক সর্বগত তত্ত্বের অপূর্ব অনুসন্ধানে নিয়োজিত।" (পৃষ্ঠা ৪৮)
"যদি কোন ব্যক্তি আমাকে গতিবিজ্ঞান, রসায়ন বা অন্য কোন জড়বিজ্ঞান সম্বন্ধে কিছু শিখাইতে ইচ্ছা করে, সে যে চরিত্রেরই হউক, তাহাতে ক্ষতি নাই; সে অনায়াসে উহা শিক্ষা দিতে পারে। ইহা সম্পূর্ণ সত্য—কারণ জড়বিজ্ঞান শিখাইতে যে জ্ঞানের প্রয়োজন তাহা কেবল বুদ্ধিবিষয়ক বলিয়া বুদ্ধিজাত শক্তির উপর নির্ভর করে; এরূপ ক্ষেত্রে আত্মার কিছুমাত্র বিকাশ না থাকিলেও একজনের দারুণ-বুদ্ধিশক্তি থাকিতে পারে। কিন্তু অধ্যাত্মবিজ্ঞানে—যে ব্যক্তি অশুদ্ধচিত্ত, তাহার হৃদয়ে কোনপ্রকার আধ্যাত্মিক আলোক প্রতিভাত হওয়া অসম্ভব। সে কি শিক্ষা দিবে? সে তো নিজেই কিছু জানে না। চিত্তের শুদ্ধিই আধ্যাত্মিক সত্য।" (পৃষ্ঠা ৯১)
"বিজ্ঞানবাদী বলেন, আমি বদ্ধ বলে যে জ্ঞান হয়, সেটাই ভ্রম। বেদান্তবাদী বলেন, তুমি মুক্ত ও বদ্ধ দুই-ই। ব্যাবহারিক ভূমিতে তুমি কখনই মুক্ত নও, কিন্তু পারমার্থিক বা আধ্যাত্মিক ভূমিতে তুমি নিত্যমুক্ত।" (পৃষ্ঠা ১৮২)
"ধর্মবিজ্ঞানের মধ্যে একমাত্র রাজযোগই প্রমাণ করে দেখানো যেতে পারে, আর আমি নিজে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করে যা ঠিক বলে জেনেছি, শুধু তাই শিক্ষা দিয়ে থাকি। বিচার-শক্তির সম্পূর্ণ বিকাশপ্রাপ্ত অবস্থাই প্রাতিভ জ্ঞান, কিন্তু তা কখনও যুক্তিবিরোধী হতে পারে না।" (পৃষ্ঠা ১৮৮)
"কেবল যদি তিনি আধ্যাত্মিক সত্য আবিষ্কার করেন, আমরা তাঁকে ঋষি বা অবতার বলি; আর যখন সেটা জড়জগতের কোন সত্য হয়, তখন তাঁকে বৈজ্ঞানিক বলি। যদিও সকল সত্যের মূল সেই এক ব্রহ্ম, তথাপি আমরা প্রথমোক্ত শ্রেণীকে উচ্চতর আসন দিয়ে থাকি।" (পৃষ্ঠা ১৮৯)
"ব্রহ্মবিদ্যাই পরা বিদ্যা; অপরা বিদ্যা হচ্ছে বিজ্ঞান। মুণ্ডকোপনিষৎ অর্থাৎ সন্ন্যাসীদের জন্য উপদিষ্ট উপনিষৎ এই উপদেশ দিচ্ছেন।৩৯ দুই প্রকার বিদ্যা আছে—পরা ও অপরা। তন্মধ্যে বেদের যে অংশে দেবোপাসনা ও নানাবিধ যাগযজ্ঞের উপদেশ—সেই কর্মকাণ্ড এবং সর্ববিধ লৌকিক জ্ঞানই অপরা বিদ্যা। যে বিদ্যা দ্বারা সেই অক্ষর পুরুষকে লাভ করা যায়, তাই পরা বিদ্যা। সেই অক্ষর পুরুষ নিজের মধ্যে থেকেই সমুদয় সৃষ্টি করছেন—বাইরে অপর কিছু নেই, যা জগৎকারণ হতে পারে।" (পৃষ্ঠা ১৯১)
"আধুনিক বিজ্ঞান বাস্তবিকই প্রকৃত ধর্মের ভিত্তিকে আরও দৃঢ় করেছে। সমুদয় ব্রহ্মাণ্ডটা যে এক অখণ্ড বস্তু, তা বিজ্ঞানের দ্বারা প্রমাণ করা যেতে পারে। দার্শনিক যাকে ‘সত্তা’ (being) বলেন, বৈজ্ঞানিক তাকেই ‘জড়’ (matter) বলে থাকেন; কিন্তু ঠিক ঠিক দেখতে গেলে, এদের দুজনের মধ্যে কোন বিরোধ নেই, কারণ তত্ত্বতঃ দুই-ই এক জিনিষ।" (পৃষ্ঠা ১৯৯)
"ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান যে সম্পূর্ণ ভ্রম, পদার্থবিজ্ঞান তা প্রমাণ করে দেয়; আমরা কোন জিনিষকে যেমন দেখি, শুনি, স্পর্শ ঘ্রাণ বা আস্বাদ করি, স্বরূপতঃ জিনিষটা বাস্তবিক তা নয়।" (পৃষ্ঠা ২০৬)
"প্রত্যেক বিজ্ঞানেরই নিজস্ব বিশেষ প্রণালী ও বিশেষ যন্ত্রের প্রয়োজন। একজন জ্যোতির্বিদ্ রান্নাঘরের সমস্ত হাঁড়িকুড়ির সাহায্য নিয়ে শনিগ্রহের বলয়গুলি দেখাতে পারেন না, তার জন্য দূরবীক্ষণযন্ত্র প্রয়োজন। সেইরূপ ধর্মের মহান্ সত্যাসমূহ দেখতে হলে, যারাঁ পূর্বেই সেগুলি প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁদের প্রণালীগুলি অনুসরণ করতে হবে। যে বিজ্ঞান যত বড়, তার শিক্ষা করবার উপায়ও তত নানাবিধ।" (পৃষ্ঠা ২১৩)
"ইন্দ্রিয়গুলো দিবারাত্র তোমায় (ভুলজ্ঞান এনে দিয়ে) প্রতারিত করছে। বেদান্ত অনেককাল আগে এটি আবিষ্কার করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞান সবেমাত্র ঐ তত্ত্বটি বুঝতে আরম্ভ করেছে।" (পৃষ্ঠা ২২৩)
"বড় বড় ধর্মাচার্যদের কাছে জড়বিজ্ঞান শিখতে যেও না, তাঁদের সমগ্র শক্তি আধ্যাত্মিক বিষয়ে প্রযুক্ত হয়েছে।" (পৃষ্ঠা ২৩৩)
"যেখানে বুদ্ধিবিচারের শেষ, সেইখানেই ধর্মের আরম্ভ।" (পৃষ্ঠা ২৪০)
"আমরা যাতে এই বন্ধনের বাইরে যেতে পারি, বিজ্ঞান ও ধর্ম দুই-ই আমাদের সে-বিষয়ে সাহায্য করতে চেষ্টা করছে। তবে ধর্ম বিজ্ঞানের চেয়ে প্রাচীন, আর আমাদের এই কুসংস্কার রয়েছে যে, ধর্ম বিজ্ঞানের চেয়ে পবিত্র। এক হিসাবে পবিত্রও বটে, কারণ ধর্ম নীতি বা চরিত্রকে (morality) তার একটি অত্যাবশ্যক অঙ্গ বলে মনে করে, কিন্তু বিজ্ঞান তা করে না।" (পৃষ্ঠা ২৫১)
"নিয়মের বাহিরে যাইবার জন্যই আমরা প্রথমে নিয়ম মানিয়া চলি, নিয়ম মানিয়া না চলাই হইল সমগ্র জীবনের সংগ্রাম। এই কারণেই আমি ‘ক্রিশ্চান সায়াণ্টিস্ট’দের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করিয়া থাকি; তাঁহারা মানবের স্বাধীনতা ও আত্মার দেবত্ব সম্বন্ধে শিক্ষা দিয়া থাকেন। আত্মা সর্বপ্রকার পারিপার্শ্বিকতার ঊর্ধ্বে।" (পৃষ্ঠা ২৬৪)
"আমাকে প্রশ্ন করা হয়—তোমাদের ধর্ম, সমাজের কোন্ কাজে লাগে? সমাজকে সত্য-পরীক্ষার কষ্টিপাথর করা হইয়াছে; কিন্তু ইহা অত্যন্ত অযৌক্তিক। সমাজ আমাদের ক্রমোন্নতির একটি সোপান মাত্র—ইহা অতিক্রম করিয়া যাইতে হইবে। নতুবা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের গুণাগুণ এবং প্রয়োজনীয়তাও শিশুর প্রয়োজনের মাপকাঠিতে বিচার করিতে হয়। ইহা অত্যন্ত আসুরিক।" (পৃষ্ঠা ২৬৮)
মতামত: প্রতিটি অবান্তর যুক্তি-বিবর্জিত মন্তব্য। যে কোনো উপায়ে, বিভিন্নরকম কু-যুক্তির উপস্থাপনা করে বিজ্ঞানের ওপর ধর্মের জয়যাত্রা সুনিশ্চিত করতে উদ্যত স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ।
ধর্মবিশ্বাসীরা আমাদের আশেপাশের কতিপয় বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞানী বা চিকিৎসকদের স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি অনুরাগকে সম্বল করে ওঁকে অভ্রান্ত হিসেবে তুলে ধরতে চান কিন্তু বাস্তবে এই মানুষগুলোও স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে প্রচারের শিকার।
এঁরা সামাজিক বা পারিবারিক ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণেই স্বামীজীর প্রতি অনুরক্ত, তার বেশি কিছু নয় (এরকম মনে করার কোনো কারণ নেই যে এঁরা স্বামীজীর প্রতিটি লেখা খুব খুঁটিয়ে পড়ে তারপর তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়েছেন) আর স্বামীজীর এই বক্তব্যগুলো ওঁদের সামনে রাখলে ওঁরাও এইসব আজগুবি, অবান্তর, কাঁঠালের আমসত্ত্ব মার্কা কথাবার্তাগুলোকে মান্যতা দিতে পারবেন না।
২) "ভগবৎ-প্রেমের এই পবিত্র উন্মত্ততাই কেবল আমাদের সংসার-ব্যাধি চিরকালের জন্য আরোগ্য করিতে পারে।" (পৃষ্ঠা ৬২)
"স্বর্গে বিবাহ করা নেই, বিবাহ দেওয়াও নেই—তাই যদি হয়, এখনই তা আরম্ভ করে দাও না কেন? এইখানেই বিবাহ তুলে দাও না কেন? সন্ন্যাসীর গৈরিক বসন মুক্তপুরুষের চিহ্ন। সংসারিত্ব-রূপ ভিক্ষুকের বেশ ফেলে দাও। মুক্তির পতাকা—গৈরিক বস্ত্র ধারণ কর।" (পৃষ্ঠা ২৪১)
মতামত: স্বামী বিবেকানন্দের বহু বক্তব্য এমনই দ্বিচারিতায় পরিপূর্ণ। দ্বিতীয় খণ্ডে উনি নিজেই বলেছেন, "তিব্বতে বিবাহ নাই, সুতরাং সেখানে প্রেমের ঈর্ষাও নাই; কিন্তু তথাপি আমরা জানি, বিবাহ অপেক্ষাকৃত উন্নত সমাজের পরিচায়ক।" (পৃষ্ঠা ১১৬)
বিবাহ যদি উন্নত সমাজের পরিচায়ক হয় তাহলে বিবাহ / সংসারের প্রতি স্বামীজীর এতো ক্ষোভ কেন?
৩) "খাদ্য সম্বন্ধে দ্বিতীয় দোষের নাম ‘আশ্রয়দোষ’। পাশ্চাত্যগণের পক্ষে এটি বুঝা আরও কঠিন। ‘আশ্রয়দোষ’ অর্থে বুঝিতে হইবে, যে ব্যক্তির নিকট হইতে খাদ্য আসিতেছে, তাহার সংস্পর্শে খাদ্যে যে দোষ জন্মে। এটি হিন্দুদের একটি রহস্যপূর্ণ মতবাদ। ইহার তাৎপর্য এই যে, প্রত্যেক ব্যক্তির দেহের চতুর্দিকে এক প্রকার জ্যোতি রহিয়াছে। ঐ ব্যক্তি যাহা কিছু স্পর্শ করে, তাহাতেই যেন তাহার প্রভাব, তাহার মনের—তাহার চরিত্রের বা ভাবের কিছু অংশ লাগিয়া থাকে। প্রত্যেক ব্যক্তির দেহ হইতে তাহার শক্তির মত চরিত্রবৈশিষ্ট্যও যেন বহির্গত হইতেছে, আর ঐ ব্যক্তি যাহা কিছু স্পর্শ করে, তাহাই তাহা দ্বারা প্রভাবিত হয়। অতএব রন্ধনের সময় কে আমাদের খাদ্য স্পর্শ করিল, সে-দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখিতে হইবে। কোন দুশ্চরিত্র বা মন্দ ব্যক্তি যেন উহা স্পর্শ না করে। যিনি ভক্ত হইতে চান, তিনি যাহাদিগকে অসচ্চরিত্র বলিয়া জানেন, তাহাদের সহিত একসঙ্গে খাইতে বসিবেন না, কারণ খাদ্যের মধ্য দিয়া তাঁহার ভিতর অসদ্ভাব সংক্রামিত হইবে।" (পৃষ্ঠা ৭১)
মতামত: সরাসরি সমাজের বহু প্রাচীন, অমানবিক, বর্বর "অস্পৃশ্যতা" প্রথাকে নির্লজ্জ সমর্থন। যদিও ওপরের উক্তিটি স্বামী বিবেকানন্দের নয়, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী প্রচারক রামানুজাচার্যের; তারপরেও স্বামীজী এই মতেরই সমর্থক ছিলেন কারণ উনি নিজেই বলেছেন, "তাহা হইলেও বলিতেছি, রামানুজকৃত ব্যাখ্যাটিকে অবহেলা করা চলিবে না।" (পৃষ্ঠা ৭২)
(আগ্রহী পাঠক মনুসংহিতার ৪র্থ অধ্যায়ের ২১৮ থেকে ২২৪ নম্বর শ্লোক পড়ে দেখতে পারেন।)
৪) "শরীরের কোন অংশে স্নায়ুবিশেষ নড়িতেছে কিনা দেখিবার জন্য একটি প্রাণীকে কাটিয়া দেখা—কি বীভৎস ব্যাপার ভাবুন দেখি! এমন সময় আসিবে, যখন সকল দেশেই—যে ব্যক্তি এরূপ করিবে, সে দণ্ডনীয় হইবে। আমাদের দেশে বৈদেশিক সরকার এরূপ কার্যে যতই উৎসাহ দিক্ না কেন, হিন্দুরা যে এ-বিষয়ে সহানুভূতি করেন না, তাহাতে আমি খুশী।" (পৃষ্ঠা ৭৫)
মতামত: বিজ্ঞানের ওপর প্রটেস্টান্টদের ফতেয়া নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ সমালোচনা করে বলেছেন, "এইরূপ গ্রন্থ বা শাস্ত্র-উপাসনা সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট পৌত্তলিকতা—ওটা আমাদের হাত-পা একেবারে বেঁধে রেখে দেয়। এদের মতে কি বিজ্ঞান, কি ধর্ম, কি দর্শন—সবকিছুই ঐ শাস্ত্রের মতানুযায়ী হতে হবে। প্রটেস্টাণ্টদের এই বাইবেলের অত্যাচার সর্বাপেক্ষা ভয়ানক অত্যাচার।" (পৃষ্ঠা ১৮১) অথচ নিজেই হিন্দু ধর্মকে ব্যবহার করে বিজ্ঞানের ওপর ফতেয়া জারি করলেন।
তিনি জীবনবিজ্ঞানে ব্যাঙ ব্যবচ্ছেদ বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্বার্থে ইঁদুরকে ব্যবহারের বিপক্ষে গিয়ে দাঁড়ালেন। যিনি বিশ্বাস করেন যে "মানসিক শক্তির দ্বারা লোকের রোগ সারাইতে আমি দেখিয়াছি।" (পৃষ্ঠা ৩৩২, তৃতীয় খণ্ড) তাঁর পক্ষে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এরকম অবান্তর বিরোধিতা করাটাই স্বাভাবিক।
আমাদের মতো যুক্তিবাদীদের মত হল, বিজ্ঞান কোনোদিনই কোনো দেশ, ধর্ম, জাতি বা বর্ণের সম্পত্তি হতে পারে না; বিজ্ঞানের চরিত্র সর্বদা আন্তর্জাতিক; বাকি যে সব চিকিৎসকরা খুব গর্ব করে স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রচার করেন, এই তর্কের সমাধানটা না হয় তাঁদের ওপরেই ছেড়ে রাখলাম।
৫) "আমি দেখিয়াছি—অতি ভয়ানক অসুরপ্রকৃতি ব্যক্তিগণও অদ্ভুত অদ্ভুত অলৌকিক কার্য করিয়াছে, তাহারা মাটি হইতে ফল উৎপন্ন করিয়া দিবে। আমি দেখিয়াছি অনেক মূর্খ ও পিশাচপ্রকৃতি ব্যক্তি ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান ঠিক ঠিক বলিয়া দিতে পারে। আমি দেখিায়াছি, অনেক মূর্খ একবার মাত্র দৃষ্টিপাত করিয়া অতি ভয়ানক রোগ সারাইয়া দিয়াছে। এগুলি শক্তি বটে, কিন্তু অনেক সময়েই এগুলি পৈশাচিক শক্তি।" (পৃষ্ঠা ৯৭)
মতামত: বিজ্ঞান সচেতনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে অজ্ঞানতা, কুসংস্কারের বদ্ধ জালে পুরো ভক্তকুলকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে উদ্যত স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ। স্বামীজী জ্যোতিষকে মান্যতা দিতে চান, মান্যতা দিতে চান ঝাড়ফুঁক, তুকতাক, তাবিজকে। বাস্তবটা কিন্তু এতো সহজ নয়। এইসব বাবাজীরা নিজের ভক্তদের সামনে যতই বিজ্ঞানের ওপর ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান না কেন, বাস্তবে তাঁরাও শরীর খারাপ হলে চিকিৎসকদেরই শরণাপন্ন হন।
https://www.anandabazar.com/west-bengal/bengal-cm-mamata-banerjee-visit-hospital-to-see-swami-smarananandaji-maharaj-of-ramkrishna-math-dgtl/cid/1501345
৬) "পাশ্চাত্যের লোকেরা বলিয়া থাকে, মূর্তির সম্মুখে হাঁটু গাড়িয়া বসা বড়ই খারাপ, কিন্তু তাহারা কোন নারীর সম্মুখে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া তাহাকে অনায়াসে বলিতে পারে, ‘তুমি আমার প্রাণ, তুমি আমার জীবনের আলো। তুমি আমার নয়নের মণি, তুমি আমার আত্মা’—এই-সব। তাহাদের যদি চারিটি করিয়া পা থাকিত, তবে তাহারা চার পায়ের হাঁটু গাড়িয়া বসিত! ইহা নিকৃষ্টতর পৌত্তলিকতা বা পৌত্তলিকতা অপেক্ষা নিকৃষ্ট। পশুরা ঐরূপে হাঁটু গাড়িয়া বসিবে। একটি নারীকে ‘আমার প্রাণ, আমার আত্মা’ বলার অর্থ কি? এ ভাব তো পাঁচ দিনের মধ্যেই উবিয়া যায়, এ কেবল ইন্দ্রিয়গত আসক্তি মাত্র। তাই যদি না হইবে, তবে পুরুষ পুরুষের নিকট ঐরূপ হাঁটু গাড়িয়া বসে না কেন?" (পৃষ্ঠা ১১১)
মতামত: সমকামী প্রেম হলে একজন পুরুষ আরেকজন পুরুষের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসতেই পারেন; সমকামিতাকে ‘বিদেশি প্রভাব’ বলে দাগিয়ে দেওয়ারও কোনো ভিত্তি নেই কারণ বহু হিন্দু শাস্ত্র ও পুরাণেও সমকামিতার উল্লেখ আছে। যদিও মনুবাদী স্বামী বিবেকানন্দ সমকামী প্রেমকে মান্যতা দিতে রাজি নন।
মনুসংহিতাতে লেখা আছে, "আর যদি কোনও কন্যা অন্য কন্যাকে অঙ্গুলি-প্রক্ষেপে নষ্ট করে, উহার দুই শত পণ দণ্ড করিবেন এবং শুল্ক দ্বিগুণ দেওয়াইবেন ও দশবার বেত্রাঘাত করিবেন।" (৮/৩৬৯)
(মনুসংহিতা, ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৭৩৭)
"যে প্রগল্ভা স্ত্রী, কন্যাকে এইরূপে নষ্ট করে, ঐ স্ত্রীর মস্তক মুণ্ডন করাইয়া দিবেন; দুই অঙ্গুলিচ্ছেদ করিবেন, গর্দভে চড়াইয়া রাজমার্গে ভ্রমণ করাইবেন; দোষের নূন্যাধিক্যানুসারে প্রকারত্রয় জানিবে।" (৮/৩৭০)
(মনুসংহিতা, ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৭৩৮)
"যে কোনো স্থানে হউক, পুরুষ মৈথুন করিয়া শকটে ও জলে এবং দিনে স্ত্রীতে মৈথুন করিয়া সেই বস্ত্রের সহিত তৎক্ষণাৎ স্থান করিবে।" (১১/১৭৫)
(মনুসংহিতা, ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৯৫৯)
"A twice-born man who commits an unnatural offence with a male, or has intercourse with a female in a cart drawn by oxen, in water, or in the day-time, shall bathe, dressed in his clothes." (The Sacred Books of the East, F. Max Muller, Page - 466)
https://www.anandabazar.com/editorial/old-indian-mythology-have-some-hints-of-homosexuality-but-still-people-thinks-its-foreign-culture-1.864964
৭) "আমাদের মধ্যে প্রত্যেকেই আমাদের অতীত অভিজ্ঞতার ফলস্বরূপ বিশেষ বিশেষ প্রকৃতি লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছি। হয় বলুন—উহা আমাদের পূর্বজন্মের কর্মফল, নয় বলুন—পুরুষানুক্রমে আমরা ঐ প্রকৃতি পাইয়াছি। যে ভাবেই আপনারা উহা নির্দেশ করুন না কেন, এই অতীতের প্রভাব আমাদের মধ্যে যেরূপেই আসিয়া থাকুক না কেন, ইহা সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে, আমরা আমাদের অতীত অবস্থার ফলস্বরূপ। এই কারণেই আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে বিভিন্ন ভাব, প্রত্যেকের দেহমনের বিভিন্ন গতি দেখিতে পাওয়া যায়। সুতরাং প্রত্যেককেই নিজ নিজ পথ বাছিয়া লইতে হইবে।" (পৃষ্ঠা ১১৭)
মতামত: পূর্বজন্মের কর্মফল আর জন্মান্তরবাদ নামক কুসংস্কারগুলো থেকে আমাদের সমাজ থেকে দূরীভূত হলেই কতিপয় উচ্চবর্ণের ধনী ব্যক্তির দ্বারা সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নশ্রেণির শ্রমজীবী মানুষের ওপর শোষণের পথ বন্ধ হবে; যুগে যুগে এভাবেই শাসকদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে এসেছেন এই ধর্মব্যবসায়ীরা, তার বদলে তাঁদের সামন্ত প্রভুদের থেকে পেয়েছেন উদার আর্থিক সাহায্য। আমরা সকলেই জানি যে কোনো কাজ না করে, শুধু সারাদিন ঠাকুর, ঠাকুর করার পরেও এই ধর্মব্যবসায়ীদের দু'বেলা অন্নসংস্থানে কোনসময় কোনো ঘাটতি হয় না।
উপরের উক্তি প্রমাণ করে, সেই একইপথের যাত্রী স্বামী বিবেকানন্দ।
৮) "ভারতে কিন্তু ধর্ম বিষয়ে ভিন্ন মত অবলম্বন করার দরুন কখনও কাহার উপর অত্যাচার করা হয় নাই।" (পৃষ্ঠা ১২২)
মতামত: সর্বৈব মিথ্যা কথা। সতীদাহ থেকে শুরু করে বাল্যবিবাহ, কুলিন ব্রাহ্মণদের একাধিক স্ত্রী থেকে দেবদাসী বা বিধবা মহিলাদের পুনরায় বিবাহের অন্তরায় পরিস্থিতি হিন্দুরা ধর্মকে ব্যবহার করেই সৃষ্টি করেছিল।
৯) "দিব্য প্রেরণা ও প্রতারণার মধ্যে পার্থক্য কিরূপে বুঝা যাইবে? প্রথমতঃ দিব্যজ্ঞান কখনও যুক্তিবিরোধী হইবে না। বৃদ্ধাবস্থা শৈশবের বিরোধী নয়, উহার বিকাশমাত্র। এইরূপে আমরা যাহাকে প্রাতিভ বা দিব্যজ্ঞান বলি, তাহা যুক্তিবিচারজনিত জ্ঞানের বিকাশমাত্র। যুক্তিবিচারের ভিতর দিয়াই দিব্যজ্ঞানে পৌঁছিতে হয়। দিব্যজ্ঞান কখনই যুক্তির বিরোধী হইবে না। যদি হয়, তবে উহাকে টানিয়া দূরে ফেলিয়া দিন।" (পৃষ্ঠা ১২৩)
আবার স্বামীজী নিজেই বলেছেন, "ধর্ম—মতমতান্তরে নাই, তর্কযুক্তিতে নাই; ধর্ম—হওয়া; ধর্ম অপরোক্ষানুভূতি।" (পৃষ্ঠা ১৩০)
বক্তব্য দুটি সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।
১০) "দিব্যপ্রেরণাসম্পন্না নারী যত আছে, ঐরূপ পুরুষও তত আছে। যদিও মেয়েদের এইটুকু বিশেষত্ব যে, তাঁহাদের মধ্যে বিশেষ প্রকার মূর্ছা ও স্নায়ুরোগ বেশী।" (পৃষ্ঠা ১২৪)
মতামত: আবার একটি নারীবিদ্বেষী মতামত, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বেশ কিছু স্নায়ুর রোগ নারীদের অপেক্ষা পুরুষদের বেশি হয় আর কিছু স্নায়ুর রোগ পুরুষদের অপেক্ষা নারীদের বেশি হয়। মূর্ছা রোগীদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একইরকম।
https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC4829467/#:~:text=Several%20neurological%20conditions%20are%20associated,and%20Multiple%20sclerosis%20in%20women.
https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC7561535/#:~:text=In%20another%20study%20%5B21%5D%20the,often%20in%20the%20NTG%20phase.
১১) "আমাদিগকে সর্বদা স্মরণ রাখিতে হইবে যে, ঈশ্বর প্রেমস্বরূপ—তিনি এ-সব অদ্ভুত ব্যাপারের ভিতর নাই। ‘উষিত্বা জাহ্নবীতীরে কূপং খনতি দুর্মতিঃ’—সে মূর্খ, যে গঙ্গাতীরে বাস করিয়া জলের জন্য একটা কূপ খুঁড়িতে যায়। সে মূর্খ, যে হীরার খনির নিকট থাকিয়া কাচদণ্ডের অন্বেষণে জীবন অতিবাহিত করে। ঈশ্বরই সেই হীরক-খনি। আমরা ভূতের অথবা এইরূপ সমুদয় উড়ন্ত পরীর গল্পের প্রতি বৃথা আসক্ত হইয়া ভগবানকে ত্যাগ করিতেছি—ইহা বাস্তবিক আমাদের মূর্খতা।" (পৃষ্ঠা ১২৪)
মতামত: আবার দ্বিচারিতা। তৃতীয় খণ্ডে স্বামীজী নিজেই বলেছেন, "যোগীদের মধ্যে কেহ কেহ দাবী করেন যে, এই শরীর তরল বাষ্প ইত্যাদিতে পরিণত হইবে। তুমি শরীর দ্বারা যাহা খুশী করিতে পারিবে—ইহাকে ছোট করিতে পার, এমন কি বাষ্পেও পরিণত করিতে পার, এই দেওয়ালের মধ্য দিয়া যাতায়াতও সম্ভব হইতে পারে—এই রকম তাঁহারা দাবী করেন। আমার অবশ্য তাহা জানা নাই। আমি কখনও কাহাকেও এরূপ করিতে দেখি নাই। কিন্তু যোগশাস্ত্রে এই-সব কথা আছে। যোগশাস্ত্রগুলিকে অবিশ্বাস করিবার কোন হেতু নাই।" (পৃষ্ঠা ৩৩৬)
ওঁর এই বক্তব্যটা ভূত বা উড়ন্ত পরীর গপ্পোর থেকে কম কিসে!
১২) "এই জগৎটা একটি ছোট শিশুর খেলার মত; আমরা যখন তা জানি, তখন জগতে যাই হোক না কেন, কিছুতেই আমাদের চঞ্চল করতে পারবে না।" (পৃষ্ঠা ১৬২)
মতামত: আমাদের চারপাশে বহু মানুষ অর্থের অভাবে দুবেলা পেট ভরে খেতে পায় না, কারো বা সন্তান দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, একটু চিকিৎসা করানোর মতো অর্থও জোগাড় করে উঠতে পারেন না - তারপরেও নাকি "জগৎটা ছোট শিশুর খেলার মত"!
আসলে এই বাবাজীরা কোনোরকম কাজ না করেও শুধুমাত্র শাসক শ্রেণির তাঁবেদারি করে আর ভক্তদের সামনে আত্মা, পুনর্জন্ম আর পূর্বজন্মের কর্মফলের গাজর ঝুলিয়ে নিজেদের জন্য অন্নসংস্থান সহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাজের জন্য অর্থ জুগিয়ে নিতে পারেন; বাকিদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয় - তাই এইসব বাবাজীদের মুখেই এরকম অমানবিক, অবাস্তব কথাবার্তা শোভা পায়।
১৩) "শ্রীরামকৃষ্ণদেব জগতের ভিতর পাপ বা অশুভ দেখতে পেতেন না—তিনি জগতে কিছু মন্দ দেখতে পেতেন না, কাজেই সেই মন্দ দূর করবার জন্য চেষ্টা করারও কোন প্রয়োজন বোধ করতেন না।" (পৃষ্ঠা ১৬৭)
"শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের ভিতর মানুষ-ভাবটা মরে গিছল, কেবল ঈশ্বরত্ব অবশিষ্ট ছিল। বাস্তবিকই তিনি পাপ দেখতে পেতেন না—যে-চোখে মানুষ পাপ বা অন্যায় দেখে, তার চেয়ে তাঁর দৃষ্টি পবিত্রতর ছিল।" (পৃষ্ঠা ২৩৩)
মতামত: সর্বৈব মিথ্যা কথা। "রামকৃষ্ণদেব রোগ যখন খুব বাড়াবাড়ি, ডাক্তার কোটস নামে এক ইউরোপীয় ডাক্তারকে ঠাকুরের কাছে আনা হয়। তিনি পরীক্ষা করে চলে যাবার পর ঠাকুরের আদেশে বিছানায় গঙ্গাজল ছিটানো হয়।" (শ্রীরামকৃষ্ণ কিছু অজানা প্রসঙ্গ, সুনীত দে, পৃষ্ঠা ১০০)
এরকম উদাহরণ আরো আছে।
https://www.anandabazar.com/patrika/last-days-of-ramakrishna-1.1189900
১৪) "স্ত্রীজাতি শক্তিস্বরূপিণী, কিন্তু এখন ঐ শক্তি কেবল মন্দ বিষয়ে প্রযুক্ত হচ্ছে। তার কারণ, পুরুষ তার উপর অত্যাচার করছে।" (পৃষ্ঠা ১৭৩)
"যীশুখ্রীষ্ট অসম্পূর্ণ ছিলেন, কারণ তিনি যে আদর্শ প্রচার করেছিলেন, তদনুসারে সম্পূর্ণভাবে জীবনযাপন করেননি, আর সর্বোপরি তিনি নারীগণকে পুরুষের তুল্য মর্যাদা দেননি।" (পৃষ্ঠা ২২৬)
মতামত: পুনঃপুন সেই এক দ্বিচারিতা। "নবযুগের মহাপুরুষ" গ্রন্থে বর্ণিত আছে -
"স্বামীজী আত্মানন্দ প্রমুখ সন্ন্যাসী শিষ্যদের একদিন বলেছিলেন, "ভক্তের বাড়ীতে গিয়ে স্ত্রীভক্তের হাতের রান্না খেও না। এইরূপ করলে শরীর নষ্ট ও মন নিম্নমুখী হয়।"" (পৃষ্ঠা ১৫৬)
যে সব মহিলারা এখনও ঘরে স্বামী বিবেকানন্দের ছবি টাঙিয়ে রেখে রোজ পুজো করে যাচ্ছেন, তাঁরা একবার ভেবে দেখুন!
১৫) "রামকৃষ্ণ বর্তমান যুগের উপযোগী ধর্মশিক্ষা দিতে এসেছিলেন, তাঁর ধর্ম গঠনমূলক, এতে ধ্বংসমূলক কিছু নেই। তাঁকে নূতন করে প্রকৃতির কাছে গিয়ে সত্য জানবার চেষ্টা করতে হয়েছিল, ফলে তিনি বৈজ্ঞানিক ধর্ম লাভ করেছিলেন।" (পৃষ্ঠা ১৭৫)
মতামত: "শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত" গ্রন্থ থেকে শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে কথোপকথনটা লক্ষ্য করুন -
"শ্রীরামকৃষ্ণ (বঙ্কিমের প্রতি) — কেউ কেউ মনে করে শাস্ত্র না পড়লে, বই না পড়লে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। তারা মনে করে, আগে জগতের বিষয়, জীবের বিষয় জানতে হয়, আগে সায়েন্স পড়তে হয়। (সকলের হাস্য) তারা বলে ঈশ্বরের সৃষ্টি এ-সব না বুঝলে ঈশ্বরকে জানা যায় না। তুমি কি বল? আগে সায়েন্স না আগে ঈশ্বর?
বঙ্কিম — হাঁ, আগে পাঁচটা জানতে হয়, জগতের বিষয়। একটু এ দিককার জ্ঞান না হলে, ঈশ্বর জানব কেমন করে? আগে পড়াশুনা করে জানতে হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ওই তোমাদের এক। আগে ঈশ্বর, তারপর সৃষ্টি। তাঁকে লাভ করলে, দরকার হয়তো সবই জানতে পারবে।"
এই হলো শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বৈজ্ঞানিক ধর্মের নমুনা।
"নবযুগের মহাপুরুষ" গ্রন্থ থেকে আরেকটা উদাহরণ দেখে নেওয়া যাক -
"ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসিয়া বাবুরামের মন অন্তর্মুখী হইল। তিনি আর লেখাপড়ায় পূর্ববৎ মনোযোগ দিতে পারিলেন না। ১৮৮৩ বা ১৮৮৪ খৃষ্টাব্দে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষা দিলেন, কিন্তু উত্তীর্ণ হইতে পারিলেন না। এই সংবাদ পাইয়া ঠাকুর বলিলেন, 'ভালই হ'ল। তার বন্ধন ছিন্ন হ'ল। পাশ ত' নয়, পাশ (বন্ধন )।'" (পৃষ্ঠা ৬১)
এই হলো বর্তমান যুগের উপযোগী ধর্মের নমুনা।
https://www.ramakrishnavivekananda.info/kathamrita/unicodekathamrita/58_d_godorscience_1121_1123.html
১৬) "সর্বশক্তিমত্তা, সর্বব্যাপিতা ও অনন্ত দয়া—সেই জগজ্জননী ভগবতীর গুণ। জগতে যত শক্তি আছে, তিনিই তার সমষ্টিরূপিণী। জগতে যত শক্তির বিকাশ দেখা যায়, সবই সেই মা। তিনিই প্রাণরূপিণী, তিনিই বুদ্ধিরূপিণী, তিনিই প্রেমরূপিণী। তিনি সমগ্র জগতের ভিতর রয়েছেন, আবার জগৎ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক্। তিনি একজন ব্যক্তি—তাঁকে জানা যেতে পারে এবং দেখা যেতে পারে (যেমন রামকৃষ্ণ তাঁকে জেনেছিলেন ও দেখেছিলেন)।" (পৃষ্ঠা ১৭৭)
মতামত: পুনরায় দ্বিচারিতা। দ্বিতীয় খণ্ডে স্বামী বিবেকানন্দ নিজেই বলেছিলেন, "আমরা ঈশ্বরকে ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করিতে পারি না। কেহই চক্ষুর দ্বারা ঈশ্বর দর্শন করে নাই, কখনও করিবেও না।" (পৃষ্ঠা ৩০৩)
হয় শ্রীরামকৃষ্ণ ঠিক, স্বামী বিবেকানন্দ ভুল নয়তো স্বামী বিবেকানন্দ ঠিক , শ্রীরামকৃষ্ণ ভুল।
১৭) "আমাদের অনুভূত এই জগৎ সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণে উৎপন্ন। যেমন বল-সামান্তরিকে৩২ দুই বিভিন্নমুখী বলপ্রয়োগের ফলে একটি বস্তুতে কর্ণাভিমুখী গতির উৎপত্তি হয়, সেরূপ এই সংসারও আমাদের উপর প্রযুক্ত বিভিন্ন বিরুদ্ধ শক্তিসমূহের ফলস্বরূপ। এই জগৎ ব্রহ্মস্বরূপ ও সত্য; কিন্তু আমরা জগৎকে সেভাবে দেখছি না; যেমন শুক্তিতে রজত-ভ্রম হয়, তেমনি আমাদেরও ব্রহ্মে জগদ্ভ্রম হয়েছে। একেই বলে ‘অধ্যাস’। যে সত্তা একটা সত্য বস্তুর অস্তিত্বের উপর নির্ভর করে, তাকেই অধ্যস্ত সত্তা বলে।" (পৃষ্ঠা ১৮৩)
"বৃক্ষের বৃক্ষত্বটা মায়া—গাছ দেখবার সময় আমরা প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মস্বরূপকেই দেখছি, মায়া-আবরণে ঢাকা। কোন ঘটনা সম্বন্ধে ‘কেন’—এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসাটাই মায়ার অন্তর্গত। সুতরাং ‘মায়া কিরূপে এল?’—এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা বৃথা, কারণ মায়ার মধ্য থেকে ওর উত্তর কখনও দেওয়া যেতে পারে না; আর মায়ার পরে কে ঐ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে? মন্দ বা মায়া অসদ্দৃষ্টিই ‘কেন’—এই প্রশ্নের সৃষ্টি করে, কিন্তু ‘কেন’ প্রশ্ন থেকে মায়া আসে না—মায়াই ঐ ‘কেন’ জিজ্ঞাসা করে। ভ্রমই ভ্রমকে নষ্ট করে দেয়। যুক্তি-বিচার নিজেই একটা বিরোধের উপর প্রতিষ্ঠিত, সুতরাং এটা একটা চক্রস্বরূপ, কাজেই যুক্তি নিজেই নিজেকে ধ্বংস করবে। ইন্দ্রিয়জ অনুভূতি একটা আনুমানিক জ্ঞান, আবার সব আনুমানিক জ্ঞানের ভিত্তি অনুভূতি।" (পৃষ্ঠা ২১৫)
"আত্মাই সকল বস্তুর মূল সত্যস্বরূপ; আমরা যা কিছু দেখছি, সবই আত্মা—কিন্তু আমরা যেভাবে এদের নামরূপাকারে দেখছি, সেভাবে নয়। ঐ নামরূপ আবরণের অন্তর্গত—মায়ার অন্তর্গত।" (পৃষ্ঠা ২২৪)
"এই সমগ্র জগৎটাই একটা ভ্রমমাত্র, এটা যেন তোমায় আর প্রতারিত করতে না পারে। জগৎটা যা নয়, তুমি তাকে তাই বলে জেনেছ, অবস্তুতে বস্তু জ্ঞান করেছ, এখন এটা বাস্তবিক যা, একে তাই বলে জান।" (পৃষ্ঠা ২৪১)
"ভাবিয়া দেখুন, জগতের কোন বস্তুকেই আমরা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বস্তুরূপে চিন্তা করিতে পারি না। সর্বত্রই আমরা বস্তুর সঙ্গে স্বীয় মনকে সংযুক্ত করিয়া লই। বস্তুতঃ প্রকৃত চেয়ার হইতেছে—চেয়ার ও মনের উপর চেয়ার-বস্তুটির প্রতিক্রিয়ার সংযোগ।" (পৃষ্ঠা ২৬৩)
মতামত: এইসব ভাববাদী যুক্তিগুলোকে খণ্ডন করতে গেলে আমাদের বস্তুবাদী দর্শনের সাহায্য নিতে হবে।
"ভাববাদের প্রত্যক্ষ বিপরীতটা-ই হচ্ছে বস্তুবাদ।
বস্তুর একটা চৈতন্য নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র সত্তা আছে। এই যে সব ধারণা, - 'ব্রহ্ম সত্য', 'জগৎ মিথ্যা' বা 'জগৎ পরমাত্মার প্রকটিত রূপ মাত্র' অথবা 'পার্থিব যা কিছু তা কেবলমাত্র চৈতন্য কর্তৃকই অনুভূত উপলব্ধির সমষ্টি মাত্র', - মার্কসীয় বস্তুবাদ এগুলিকে ভাববাদী ধ্যানধারণা বলে অভিহিত করে ও তাকে বর্জন করে।
এই যে বিশ্বপ্রকৃতি তা ইন্দ্রিয়াতীত কোনও পরমাত্মার প্রকটিত রূপ নয়, নয় কোন মায়া। অপর পক্ষে তা রীতিমত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও স্বভাবতই তার মর্ম একেবারেই বস্তুগত। জগৎ সংসারের যা কিছু তা কোনও পরম চৈতন্যের লীলা খেলা নয়। বরঞ্চ তা বস্তুর গতিশীলতার-ই বিচিত্র অভিব্যক্তি মাত্র।
বস্তুর সত্তা স্বতন্ত্র এবং তা চৈতন্য নিরপেক্ষ। কিন্তু বস্তুর সাথে চেতনার কোনও সম্পর্ক আছে কি? হ্যাঁ, আছে। বস্তু এবং চেতনার পারস্পরিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে কার কি ধারণা সেই কষ্টি পাথর দিয়েই মার্কসীয় বস্তুবাদ বিচার করে থাকে, - কোন ধারণাটা বস্তুবাদী আর কোনটা ভাববাদী। যাঁরা মনে করে থাকেন, চেতনা নিরপেক্ষ বস্তুর স্বাধীন সত্তা আছে, চেতনা বস্তুরই প্রতিফলন মাত্র এবং বস্তু মুখ্য চেতনা গৌণ, তাঁরাই হলেন বস্তুবাদী। অপর পক্ষে যাঁরা মনে করেন চেতনা নিরপেক্ষ কোনও স্বাধীন সত্তা বস্তুর নাই, বস্তু চেতনার-ই নিছক একটা অনুভূতি মাত্র এবং চেতনা মুখ্য বস্তুই গৌণ, তাঁরা সকলেই হলেন কোন না কোন ধরণের ভাববাদী।
মনে করা যাক, চোখের সম্মুখে বাগানে একটা গোলাপ ফুল এবং তার রংটা লাল। ভাববাদীরা বলবেন, ওটাকে গোলাপ ফুল বলে মনে করা হচ্ছে ও তার রংটাকে লাল বলে অনুভূত হচ্ছে বলেই ওটা একটা লাল গোলাপ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তাঁদের মতে ঐ লাল গোলাপের চেতনা নিরপেক্ষ কোন স্বতন্ত্র সত্তা নাই। বস্তুবাদীরা বলবেন, ওটা অন্য ফুল না হয়ে গোলাপ বলেই গোলাপ ফুল মনে হচ্ছে এবং সেটা লাল বলেই সকলের অনুভূতিতে তার রক্তিম সাড়া জাগিয়েছে। চেতনা নিরপেক্ষ ঐ লাল বলেই সকলের অনুভূতিতে তার রক্তিমা সাড়া জাগিয়েছে। চেতনা নিরপেক্ষ ঐ লাল গোলাপটির একটা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব না থাকলে রাম, শ্যাম ও যদু - এই তিনটি সুস্থ মানুষই তাকে লাল গোলাপ বলে দেখতো না। কেউ তাকে নীল অপরাজিতা বা সাদা রজনীগন্ধা বলেও দেখতো। প্রকৃতপক্ষে বস্তুর প্রতিফলনেই অনুভূতির সঞ্চার।
মার্কসীয় বস্তুবাদের মতে, যে বস্তু চিন্তা করে তা থেকে চেতনাকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। কারণ বস্তুর স্বাধীন সত্তার প্রতিফলনে যেখানে চেতনার সঞ্চার ঘটে বা চিন্তার উদয় হয় সে মস্তিস্ক নিজেই মানব দেহের বস্তু সত্তা বিশিষ্ট অতীব সুসংগঠিত একটা অংশ।
বস্তুর গতিশীলতার বিচিত্র অভিব্যক্তিতে সমৃদ্ধ এই যে বিশ্বপ্রকৃতি তা ইন্দ্রিয়গোচর এবং অবশ্যই স্বীকার্য যে, ইন্দ্রিয়ানুভূতির মাধ্যমেই তার প্রতিফলন মানব চেতনায় সঞ্চারিত হয়। কিন্তু, এই মানব ইন্দ্রিয়গুলি তো বস্তু সত্তাবিশিষ্ট এবং অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য। সুতরাং বস্তুজগৎ 'স্বয়ং সিদ্ধ সত্তায়' রহস্যাবৃত হয়ে মানুষের কাছে চির অজ্ঞেয় হয়ে থাকতে পারে না। কোনও একটা নির্দিষ্ট সময়ে বস্তুজগতের এই সত্তা বিষয়ে মানুষের জ্ঞান হয়তোঅসম্পূর্ণ বা সীমিত থাকতে পারে। কিন্তু ক্রমবর্ধিষ্ণু এই জ্ঞান ভাণ্ডারে আজ যা নাই, তা কালকের সংগ্রহের অপেক্ষায় আছে মাত্র। অতীতে এমন অনেক কিছু ছিল যার বস্তুসত্তা সেই সময়ে মানুষের কাছে দুর্জ্ঞেয় ছিল। কিন্তু কালক্রমে রসায়ন বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ তার গঠন প্রকৃতি শুধুমাত্র আবিষ্কার করেই ক্ষান্ত হয়নি, নিজ হাতে তাকে তৈরী করে তবে তৃপ্ত হয়েছে। সুতরাং বিশ্বপ্রকৃতির সত্তা অজ্ঞেয় বলে যে প্রচারিত ধারণা তাও এক রকমের ভাববাদ ছাড়া আর কিছু নয়।
'অমৃতস্য পুত্রাঃ' বলেই অভিহিত করা হোক অথবা 'আশরাফুল মাখলুকাত' বলেই বর্ণনা করা হোক, এই যে মানুষ তা কোন 'পরমাত্মা'-র অংশ নয় অথবা কোনও অতি প্রাকৃত সর্বশক্তিমানের সৃষ্টি নয়। মানুষ বস্তুসত্তা সম্পন্ন এই বিশাল প্রকৃতিরই একটা অংশ মাত্র। 'সমগ্র'-র সাথে তার একটা 'অংশ'-র যে সম্পর্ক, প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্কটা সেইরকম। এই প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই একটা নিছক জীব থেকে তার মানুষ হয়ে গড়ে ওঠা। বেঁচে থাকবার তাগিদে, বেড়ে উঠবার তাগিদে মানুষের সাথে অবশিষ্ট প্রকৃতির যে সংগ্রাম সেই সংগ্রামের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠেছে মানুষের সমাজ। মানুষের কোন বিমূর্ত চৈতন্য তার অস্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে না। বরঞ্চ মানুষের সামাজিক অস্তিত্ব-ই তার চেতনাকে করছে নিয়ন্ত্রিত। সেই সমাজে যখন কোন পরিবর্তনের তাগিদ দেখা দেয় তখন সেই তাগিদ মানুষকেও পরিবর্তনের সপক্ষে সক্রিয় করে তোলে।"
(আগ্রহী পাঠকেরা শ্রী অরুণ চৌধুরী মহাশয়ের লেখা "দর্শ ধর্ম নৈতিকতা" বইটা পড়ে দেখতে পারেন)।
১৮) "রামানুজ বলেন, বেদই সর্বাপেক্ষা পবিত্র পঠনীয় গ্রন্থ। ত্রৈবর্ণিক অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য—এই তিন উচ্চ বর্ণের সন্তানদের যজ্ঞোপবীত-গ্রহণের পর অষ্টম, দশম বা একাদশ বর্ষ বয়সে বেদাধ্যয়ন আরম্ভ করা উচিত।" (পৃষ্ঠা ১৮৭)
মতামত: লক্ষণীয় যে, রামানুজের এই বক্তব্যকে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বক্তব্যের মধ্যে তুলে ধরলেও, এই বক্তব্যের তিনি কোনোরূপ বিরোধিতা করেননি। প্রাচীন সমাজে শূদ্রদের বেদাধ্যয়নের কোনো অধিকার ছিল না।
মনুসংহিতাতে লেখা আছে, "অস্পষ্টরূপে বেদ পাঠ করিবে না, শূদ্রের নিকট কখন বেদ পড়িবে না, রাত্রির শেষ প্রহরে উঠিয়া বেদপাঠে শ্রান্ত হইলে আর শয়ন করিবে না।" (৪/৯৯)
(মনুসংহিতা, সম্পাদনা ও অনুবাদ ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৩৪৭)
"যদি শূদ্র দর্প করিয়া দ্বিজাতিকে, তোমাদের এই ধর্ম্ম অনুষ্ঠেয়, এইরূপ ধর্ম্মোপদেশ দেয়, তবে রাজা উহার মুখে ও কর্ণে তপ্ত তৈল নিক্ষেপ করিবেন।" (৮/২৭২)
(মনুসংহিতা, সম্পাদনা ও অনুবাদ ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৭০৫)
স্বামীজী "ধর্মে জাতিভেদ নাই; জাতিভেদ কেবল সামাজিক ব্যবস্থা" বলে বর্বর জাতিভেদ প্রথাকে যতই তিনি আড়াল করতে চেষ্টা করুন না কেন, বাস্তবে তিনি ছিলেন জাতিভেদ প্রথার উগ্র সমর্থক। (প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫)
১৯) "কর্ম কর, কিন্তু কর্মফল ভগবানে অর্পণ কর।" (পৃষ্ঠা ১৮৮)
মতামত: শ্লোকটা গীতা থেকে নেওয়া। বাস্তবে এই সকল প্রতিষ্ঠানিক ধর্মসমূহের ঠিকাদারেরা সর্বদাই শাসকের তাঁবেদারি করে। এই উক্তিটিকে মুক্তমনে পড়লে বোঝা যায় যে এইরূপ শ্লোকের দ্বারা উচ্চবর্ণের স্বার্থে নিম্নশ্রেণীকে বেগার খাটার জন্য আহ্বান করা হচ্ছে।
স্বামী বিবেকানন্দও ছিলেন সামন্তবাদ সমাজের সমর্থক, তাই তিনি বারংবার আত্মা, পূর্বজন্মের কর্মফল, জন্মান্তরবাদ নামক তত্ত্বগুলোকে সামনে রেখে সংখ্যাগরিষ্ঠ শূদ্র, নিপীড়িতদের ক্ষোভে জল ঢালার কাজ করে গেছেন; যেন তাঁরা কোনোভাবেই শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা না করে।
২০) "বেদের প্রমাণ এই যে, তা ব্রহ্ম হতে প্রসূত হয়েছে, আবার ব্রহ্মের প্রমাণ এই যে, বেদের মত অদ্ভুত গ্রন্থ ব্রহ্ম ব্যতীত আর কারও প্রকাশ করবার সাধ্য নেই।" (পৃষ্ঠা ১৯০)
মতামত: যুক্তিবাদের ভাষায় শঙ্কর বা স্বামীজীর এই বক্তব্য চক্রাকার কুযুক্তি বা ফ্যালাসি (Circular logic Fallacy)।
https://www.shongshoy.com/%e0%a6%95%e0%a7%81%e0%a6%af%e0%a7%81%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%bf-%e0%a6%ac%e0%a6%be-%e0%a6%ab%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%bf/
২১) "ক্রিয়া হতে থাক, কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া যেন না আসে; ক্রিয়া থেকে সুখই হয়ে থাকে, সমুদয় দুঃখ হচ্ছে প্রতিক্রিয়ার ফল। শিশু আগুনে হাত দেয়—তার সুখ হয় বলেই; কিন্তু যখনই তার শরীর প্রতিক্রিয়া করে, তখনই পুড়ে যাওয়ার কষ্টবোধ হয়ে থাকে। ঐ প্রতিক্রিয়াটা বন্ধ করতে পারলে আমাদের আর ভয়ের কারণ কিছু নেই। মস্তিষ্ককে নিজের বশে নিয়ে এস, যেন সে প্রতিক্রিয়াটার খবর না রাখতে পারে।" (পৃষ্ঠা ১৯৮)
মতামত: কাঁঠালের আমসত্ত্ব।
২২) "যারা উত্তম অধিকারী, তারা যোগে খুব শীঘ্র শীঘ্র উন্নতি করতে পারে—ছ-মাসে তারা যোগী হতে পারে। যারা তদপেক্ষা নিম্নাধিকারী, তাদের যোগে সিদ্ধিলাভ করতে কয়েক বৎসর লাগতে পারে, আর যে-কোন ব্যক্তি নিষ্ঠার সঙ্গে সাধন করলে, অন্য সব কাজ ছেড়ে দিয়ে কেবল সদা সর্বদা সাধনে রত থাকলে দ্বাদশ বর্ষে সিদ্ধিলাভ করতে পারে। এই-সব মানসিক ব্যায়াম না করে কেবল ভক্তি দ্বারাও ঐ অবস্থায় যেতে পারা যায়, কিন্তু তাতে কিছু বিলম্ব হয়।" (পৃষ্ঠা ২১১)
মতামত: এ কী! এতো পুরো যোগ শাস্ত্রের ওয়ারেন্টি কার্ড (warranty card)।
২৩) "আমরা যে অপরের সেবা করতে পারছি, এ আমাদের একটা বিশেষ সৌভাগ্য—কারণ ঐরূপ অনুষ্ঠানের দ্বারাই আমাদের আত্মোন্নতি হবে। লোকে যে কষ্ট পাচ্ছে, তার কারণ তার উপকার করে আমাদের কল্যাণ হবে।" (পৃষ্ঠা ২১৭)
মতামত: স্বামীজীর বারংবার বাসনামুক্ত হওয়ার কথা বলেছেন কিন্তু নিজেদের আত্মোন্নতি বা কল্যাণের কামনা করাটাও কী বাসনা নয়?
ভবিষ্যতে বিজ্ঞান যদি বন্যার স্থায়ী সমাধান করতে পারে, তাহলে মিশনের বাবাজীরা কাকে খিচুড়ি খাওয়াবেন?
মানুষের সমস্যা সমাধান করার জন্য বিজ্ঞান চেষ্টা চালিয়ে যাবে কিন্তু রামকৃষ্ণ মিশনের মতো আধ্যাত্মিক সংগঠনগুলো চাইবে যে বন্যা হতে থাকুক, যাতে বাবাজীরা খিচুড়ি বিলিয়ে নিজেদের কল্যাণ করতে পারেন।
২৪) "কজন অন্ধ বলে, ‘প্রত্যেক জিনিষের ভিন্ন ভিন্ন রকমের প্রতিধ্বনি আছে, সুতরাং আমি হাততালি দিয়ে বিভিন্ন জিনিষের প্রতিধ্বনি দ্বারা আমার চতুর্দিকে কোথায় কি আছে, ঠিক ঠিক বলতে পারি।’" (পৃষ্ঠা ২১৯)
মতামত: বাস্তবে এরকম হলে অন্ধ ব্যক্তিদের White Canes ব্যবহারের প্রয়োজন হতো না। এখন অন্ধদের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত এই লাঠিটি সামনের, ডানদিকের, বামদিকের বাধাগুলিকে সনাক্ত এবং এড়ানোর জন্য অন্ধব্যক্তিকে সাহায্য করতে পারে। আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে White Canes-কে দিনে দিনে আরো উন্নত করার জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে।
https://www.healthline.com/health/white-cane
https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC6339061/
২৫) "মানুষ নিজের মস্তিষ্ক থেকে ভগবানকে সৃষ্টি করে না; তবে তার যতদূর শক্তি, সে সেইভাবে তাঁকে দেখতে পারে, আর তার যত ভাল ভাল ধারণা তাঁতে আরোপ করে।" (পৃষ্ঠা ২৩১)
মতামত: আবার একটা দ্বিচারিতা। তৃতীয় খণ্ডে স্বামীজী নিজেই বলেছেন, "‘ঈশ্বর মানুষকে নিজ প্রতিবিম্বরূপে সৃষ্টি করিলেন’—এ কথা ভুল। মানুষ নিজ প্রতিবিম্ব অনুযায়ী ঈশ্বরকে সৃষ্টি করে—এই কথাই সত্য। সমগ্র জগতে আমরা আমাদের প্রতিবিম্ব অনুযায়ী ঈশ্বর বা দেবতা সৃষ্টি করিতেছি।" (পৃষ্ঠা ৫৩)
দুটি বক্তব্য সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।
২৬) "যদি অদ্বৈতবাদী হও, তবে তুমি তো স্বয়ংই ব্রহ্মস্বরূপ—তোমার আবার কর্তব্য কি? তোমার স্বামী, ছেলেপুলে, বন্ধুবান্ধব—কারও প্রতি কিছু কর্তব্য নেই। যা হচ্ছে হয়ে যাক্, চুপচাপ করে পড়ে থাক।" (পৃষ্ঠা ২৪১)
মতামত: নিজের ইচ্ছেয় একটি শিশুকে পৃথিবীতে এনে তাঁর প্রতি কর্তব্য না করার বিধান কতটা ন্যায় সঙ্গত তার বিচার পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিলাম।
এমনকি শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য ও স্বামী বিবেকানন্দের গুরুভ্রাতা, স্বামী ব্রহ্মানন্দ তাঁর স্ত্রী বিশ্বেশ্বরী দেবী ও তাঁর পুত্রসন্তানকে ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হন, নিজ স্বামীকে হারিয়ে বিশ্বেশ্বরী দেবী আত্মহত্যার পথ গ্রহণ করতে বাধ্য হন। (ব্রহ্মানন্দ-লীলাকথা, পৃষ্ঠা ১৬, ১৭)
২৭) "নারীজাতি শত শত যুগ ধরে দুঃখকষ্ট সহ্য করেছে, তাই তাদের ভিতর অসীম ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের বিকাশ হয়েছে। তারা একটা ভাব আঁকড়ে ধরে থাকে, সহজে ছাড়তে চায় না। এই জন্যই সকল দেশে তারা এমন-কি কুসংস্কারপূর্ণ ধর্মসমূ্হের এবং পুরোহিতদের পৃষ্ঠপোষক-স্বরূপ হয়ে থাকে, আর এইটেই পরে তাদের স্বাধীনতার কারণ হবে।" (পৃষ্ঠা ২৪৩)
"পুরুষেরা ধর্মের দার্শনিক বিচারে সমর্থ। নারী স্বভাবতঃ ভক্তিপ্রবণ; সে ভগবানকে ভালবাসে হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে, বুদ্ধি দিয়ে নয়।" (পৃষ্ঠা ৩২২)
মতামত: নারীদের সম্বন্ধে স্বামীজীর মনুবাদী ধারণাসমূহ, কারণ ওঁর দৃষ্টিতে নারী পুরুষের কখনও সমান নয় আর এই কারণেই উনি মনুবাদী।
মনুসংহিতাতে লেখা আছে, "শয়ন, উপবেশন, ভূষণ, কাম, ক্রোধ, কৌটিল্য, পরহিংসা, ঘৃণিত ব্যবহার, এই সকল স্ত্রীলোকের স্বভাবগত, ইহা সৃষ্টিসময়ে মনু স্বয়ং কল্পনা করিয়াছেন।" (৯/১৭)
"যেহেতু স্ত্রীলোকদিগের মন্ত্র দ্বারা জাতকর্ম্মাদি সংস্কার হয় না, এজন্য উহাদিগের নির্ম্মল অন্তঃকরণ হয় না, এবং বেদস্মৃতিতে অধিকার নাই, এজন্য উহারা ধর্মজ্ঞ হইতে পারে না, এবং ইহাদিগের কোন মন্ত্রে অধিকার নাই, এজন্য পাপ হইলে মন্ত্র দ্বারা তাহা ক্ষালন করিতে পারে না; অতএব ইহারা কেবল মিথ্যা পদার্থ।" (৯/১৮)
(মনুসংহিতা, ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৭৬০)
"লোভহীন এক ব্যক্তিও সাক্ষী হইবে, অনেক স্ত্রীলোক শুচি হইলেও অস্থিরবুদ্ধি প্রযুক্ত সাক্ষী হইতে পারিবে না, এবং চৌর্য্যাদি দোষাক্রান্ত ব্যক্তি স্ত্রী বা পুরুষ হউক, সাক্ষী হইতে পারে না।" (৮/৭৭)
(মনুসংহিতা, ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৬২৬)
২৮) "জগতের ইতিহাস হইল—পবিত্র, গম্ভীর, চরিত্রবান্ এবং শ্রদ্ধাসম্পন্ন কয়েকটি মানুষের ইতিহাস।" (পৃষ্ঠা ২৬৮)
মতামত: আজ্ঞে না, আজও পর্যন্ত আবিষ্কৃত সমস্ত সমাজের ইতিহাস হল শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস।
বস্তুবাদী ব্যাখ্যায় আজ পর্যন্ত সমাজ বিকাশের পাঁচটি স্তর দেখা যায় - (১) আদিম সাম্যবাদী সমাজ (২) দাস সমাজ (৩) সামন্ততান্ত্রিক সমাজ (৪) ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী সমাজ (৫) সমাজতান্ত্রিক সমাজ। শ্রেণী সংগ্রামের মধ্য দিয়েই মানুষ একটি স্তর থেকে পরবর্তী স্তরে পদার্পন করতে পারে।
২৯) "একদিন সন্ধ্যার সময় আমি একটি যুবককে একটি তরুণীর জন্য অপেক্ষা করিতে দেখিয়াছিলাম। ... মনে করিলাম, যুবককে পরীক্ষা করিবার ইহা একটি উপযুক্ত অবসর। সে তাহার প্রেমের গভীরতার মধ্য দিয়া অতীন্দ্রিয় দর্শন ও দূর-শ্রবণের ক্ষমতা লাভ করে। ষাট কি সত্তর বার যুবকটি একবারও ভুল করে নাই, এবং তরুণী ছিল দুইশত মাইল দূরে। (সে বলিত) ‘এইভাবে তরুণী সাজগোজ করিয়াছে।’ (কিংবা) ‘ঐ সে চলিয়া যাইতেছে।’ আমি ইহা নিজের চোখে দেখিয়াছি।" (পৃষ্ঠা ২৮৭)
"গুরু আপনার নিকট মানবরূপে আসিতে পারেন এবং আপনি তাঁহার নিকট শক্তিলাভও করিতে পারেন। কখনও কখনও তিনি স্বপ্নে দেখা দিয়া শক্তি সঞ্চার করেন। গুরুর শক্তি আমাদের নিকট নানাভাবে আসিতে পারে।" (পৃষ্ঠা ৩১২)
মতামত: এইসব অসার বক্তব্যগুলোকে গল্পের গোরুকে গাছে চড়ানো ছাড়া আর কিছু বলতে পারি না।
৩০) "আমার গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণ অসুস্থ হইয়া পড়িলে জনৈক ব্রাহ্মণ রোগমুক্তির জন্য তাঁহাকে তাঁহার প্রবল মনঃশক্তি প্রয়োগ করিতে বলিয়াছিল। তাহার মতে—আচার্যদেব যদি দেহের রোগাক্রান্ত অংশটির উপর তাঁহার মন একাগ্র করেন,—তবে অসুখ সারিয়া যাইবে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলিলেন, ‘কি! যে-মন ঈশ্বরকে দিয়াছি, সেই মন এই তুচ্ছ শরীরে নামাইয়া আনিব?’ দেহ এবং রোগের কথা তিনি ভাবিতে চাহিলেন না। তাঁহার মন সর্বদা ঈশ্বরে তন্ময় হইয়া থাকিত। সে-মন সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরে অর্পিত হইয়াছিল। তিনি এই মন অন্য কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করিতে রাজী ছিলেন না।" (পৃষ্ঠা ৩১০)
মতামত: মুখে যতই বিজ্ঞানের সব কিছু ধর্মগ্রন্থে আছে বলে দাবী করুন না কেন, বাস্তবে বাবাজীদের শরীর খারাপ হলে সেই চিকিৎসা বিজ্ঞানেরই সাহায্য নিয়ে থাকেন। শ্রীরামকৃষ্ণের শরীর খারাপের সময় বহু ডাক্তারকে দেখানো হয়েছিল; তার মধ্যে অন্যতম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় এমডি ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার। এছাড়াও সময়ে সময়ে হোমিয়োপ্যাথিক ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল দত্ত, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডাক্তার জে এম কোটস শ্রীরামকৃষ্ণের চিকিৎসা করেছেন।
৩১) "আমরা সারা জীবন পুস্তক পাঠ করিতে পারি, খুব একজন বুদ্ধিমান্ হইয়া উঠিতে পারি, কিন্তু শেষে দেখিব—আধ্যাত্মিক উন্নতি কিছুই হয় নাই। বুদ্ধিবৃত্তির উন্নতি হইলেই যে সঙ্গে সঙ্গে আধ্যাত্মিক উন্নতিও খুব হইবে, তাহার কোন অর্থ নাই। গ্রন্থপাঠ করিতে করিতে অনেক সময় ভ্রমবশতঃ ভাবি, আমাদের আধ্যাত্মিক উপকার হইতেছে। কিন্তু গ্রন্থপাঠে আমাদের কি ফল হইয়াছে, তাহা যদি ধীরভাবে বিশ্লেষণ করি, তবে দেখিব বড়জোর আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির উন্নতি হইয়াছে, অন্তরাত্মার কিছুই হয় নাই। আমাদের মধ্যে প্রায় সকলেরই আধ্যাত্মিক বাক্যবিন্যাসে অদ্ভুত নৈপুণ্য থাকিলেও কার্যকালে—প্রকৃত ধর্মভাবে জীবন-যাপন করিবার সময়—কেন এত ভয়াবহ ত্রুটিবিচ্যুতি লক্ষিত হয়, তাহার কারণ—আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতির পক্ষে গ্রন্থরাশি পর্যাপ্ত নয়। জীবাত্মার শক্তি জাগ্রত করিতে হইলে অপর এক আত্মা হইতে শক্তি সঞ্চারিত হওয়া আবশ্যক।" (পৃষ্ঠা ১৭)
"
বাজে পুস্তক না পড়িয়া ঈশ্বর-বিষয়ক সদ্গ্রন্থ পড়িতে হইবে।" (পৃষ্ঠা ৭৪)
"আপনারা জগতের সব গ্রন্থ পড়িতে পারেন, কিন্তু বক্তৃতাশক্তি, উচ্চতম মেধা বা নানাবিধ বিজ্ঞান অধ্যয়নের দ্বারা এই প্রেম লাভ করা যায় না। তিনি যাহাকে ইচ্ছা করেন, সেই তাঁহাকে লাভ করে। তাহার নিকটই ভগবান্ আত্মপ্রকাশ করেন।" (পৃষ্ঠা ৮৫)
"
এই-সব বই, এই-সব বিজ্ঞান—আমাদিগকে কিছুই শিখাইতে পারিবে না। বই পড়িয়া আমরা তোতাপাখি হই, বই পড়িয়া কেহ পণ্ডিত হয় না। যে ব্যক্তি প্রেমের একটি অক্ষর পাঠ করিয়াছে, সে-ই প্রকৃত পণ্ডিত।" (পৃষ্ঠা ৮৫)
"বাহির হইতে যে-শক্তি আসার কথা বলা হইল, উহা গ্রন্থ হইতে পাওয়া যায় না। এক আত্মা অপর আত্মা হইতেই শক্তি লাভ করিতে পারে, অন্য কিছু হইতে নয়। আমরা সারা জীবন বই পড়িতে পারি, খুব বুদ্ধিমান্ হইয়া উঠিতে পারি, কিন্তু পরিণামে দেখিব—আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি কিছুমাত্র হয় নাই। বুদ্ধি খুব উন্নত ও বিকশিত হইলেও যে সঙ্গে সঙ্গে তদনুযায়ী আধ্যাত্মিক উন্নতিও হইবে, তাহার কোন যুক্তি নাই; বরং আমরা প্রায় প্রত্যহই দেখিতে পাই, বুদ্ধির যতটা উন্নতি হইয়াছে, আত্মার সেই পরিমাণে অবনতি ঘটিয়াছে।
বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে গ্রন্থ হইতে অনেক সাহায্য পাওয়া যায় বটে, কিন্তু আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করিতে গেলে গ্রন্থ হইতে কোন সাহায্যই পাওয়া যায় না বলিলেই হয়। গ্রন্থ পাঠ করিতে করিতে কখনও কখনও ভ্রমবশতঃ আমরা মনে করি, উহা হইতে আধ্যাত্মিক সহায়তা পাইতেছি, কিন্তু যদি অন্তর বিশ্লেষণ করিয়া দেখি, তবে বুঝিব—উহাতে আমাদের বুদ্ধিই কিছুটা সাহায্য পাইয়াছে মাত্র, আত্মার কিছুই হয় নাই। এই জন্যই আমরা প্রায় সকলেই ধর্মসম্বন্ধে সুন্দর সুন্দর বক্তৃতা দিতে পারি, অথচ ধর্মানুযায়ী জীবন-যাপনের সময় অনুভব করি—আমাদের শোচনীয় অক্ষমতা। ইহার কারণ—আধ্যাত্মিক উদ্দীপনার জন্য বাহির হইতে যে শক্তির প্রয়োজন, পুস্তক হইতে তাহা পাওয়া যায় না। আত্মাকে জাগ্রত করিতে হইলে অপর এক আত্মা হইতেই শক্তি সঞ্চারিত হওয়া একান্ত আবশ্যক।" (পৃষ্ঠা ৮৭)
"হৃৎপদ্ম একবার প্রস্ফুটিত হইলে নদী-প্রস্তর চন্দ্র-তারকা প্রভৃতি হইতে শিক্ষা গ্রহণ করা যাইতে পারে—ইহাদের সকলের নিকট হইতেই কিছু না কিছু আধ্যাত্মিক শিক্ষা পাওয়া যাইতে পারে। কিন্তু যাহার হৃৎপদ্ম এখনও প্রস্ফুটিত হয় নাই, সে শুধু নদী ও প্রস্তরই দেখিবে।" (পৃষ্ঠা ৯২)
"জ্ঞান অপেক্ষা উচ্চতর ও পবিত্রতর আর কিছু নাই; গুরুর মাধ্যমে উহা মানবাত্মায় আবির্ভূত হইয়া থাকে। সিদ্ধ যোগী হইলে ঐ জ্ঞান আপনা-আপনি আসিয়া থাকে, গ্রন্থ হইতে উহা লাভ করা যায় না!" (পৃষ্ঠা ৯৩)
"বই পড়িলেই ধর্ম হয় না, তর্কবিচার করিতে পারিলেই ধর্ম হয় না, অথবা কতকগুলি মতবাদে সম্মতি প্রকাশ করিলেই ধর্ম হয় না।" (পৃষ্ঠা ৯৮)
"আপনারা সকলেই সম্ভবতঃ বিজ্ঞানবাদ (Idealism) সম্বন্ধে অনেক গ্রন্থ পড়িয়াছেন। এই মতবাদ অনুসারে এই জগতের অস্তিত্ব নাই, আপনাদেরও অস্তিত্ব নাই। এরূপ কথা যাহারা বলে, আপনারা তাহাদের কথা বিশ্বাস করেন না, কারণ তাহারা নিজেরাই নিজেদের কথা বিশ্বাস করে না। তাহারা জানে যে, ইন্দ্রিয়গণের সাক্ষ্য এইরূপ সহস্র সহস্র বৃথা বাগাড়ম্বর অপেক্ষা বলবান্। ধার্মিক হইতে গেলে আপনাদিগকে প্রথমেই গ্রন্থ ফেলিয়া দিতে হইবে। বই যত কম পড়েন, ততই ভাল।" (পৃষ্ঠা ৯৯)
"বয়সে বড় হইতে পারি এবং জগতের সব বই পড়িয়া ফেলিতে পারি, কিন্তু ধর্মরাজ্যে আমরা শিশুমাত্র।" (পৃষ্ঠা ১০১)
"আমার মতে গ্রন্থ দ্বারা জগতে ভাল অপেক্ষা মন্দ অধিক হইয়াছে। এই যে নানা ক্ষতিকর মতবাদ দেখা যায়, সেগুলির জন্য এই-সকল গ্রন্থই দায়ী। মতামতগুলি সব গ্রন্থ হইতেই আসিয়াছে, আর গ্রন্থগুলিই জগতে যত প্রকার অত্যাচার ও গোঁড়ামির জন্য দায়ী। বর্তমানকালে গ্রন্থসমূহই সর্বত্র মিথ্যাবাদী সৃষ্টি করিতেছে। সকল দেশেই মিথ্যাবাদীর সংখ্যা বাড়িতেছে দেখিয়া আমি আশ্চর্য হই।" (পৃষ্ঠা ১০৯)
"প্রাচীন হিন্দুরা অদ্ভুত পণ্ডিত ছিলেন—যেন জীবন্ত বিশ্বকোষ। তাঁরা বলতেন, বিদ্যা যদি পুঁথিগত হয়, আর ধন যদি পরের হাতে থাকে, কার্যকাল উপস্থিত হলে সে-বিদ্যা বিদ্যা নয়, সে-ধনও ধন নয়।" (পৃষ্ঠা ১৮৯)
"শাস্ত্র বা বই পড়ে দার্শনিক জ্ঞান বা তত্ত্বজ্ঞান হয় না; বরং যত বই পড়বে, ততই মন গুলিয়ে যাবে।" (পৃষ্ঠা ১৯৭)
"নিজের ঘরে গিয়ে বস, আর নিজের অন্তরাত্মার ভিতর থেকে উপনিষদের তত্ত্বগুলি আবিষ্কার কর। তুমি সকল বিষয়ের অনন্তখনিস্বরূপ, ভূত-ভবিষ্যৎ সকল গ্রন্থের মধ্যে তুমিই শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।" (পৃষ্ঠা ২২০)
"গ্রন্থাদিও ধাত্রীর কাজই করিয়া থাকে, কিন্তু আমাদের চেষ্টা করিয়া সেই অবস্থায় উপনীত হইতে হইবে, যেখানে মানুষ উপলব্ধি করিবে, সে তাহার শরীরের প্রভু।" (পৃষ্ঠা ২৬৪)
"এ-সকল রহস্যপূর্ণ পবিত্র শব্দরাশি আমরা জানি এবং বুঝিতে পারি, কিন্তু কেবল গ্রন্থাদিতে পড়িলেই ঐগুলি আমাদের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করিতে পারিবে না। শব্দগুলি ভাবপূর্ণ হইলে এবং সাধনা করিয়া যিনি স্বয়ং ভগবানের স্পর্শ লাভ করিয়াছেন এবং এখনও ভাগবত জীবন যাপন করেন, এরূপ ব্যক্তির স্পর্শ থাকিলে ঐগুলি ফলপ্রদ হয়।" (পৃষ্ঠা ২৬৫)
"মনে রাখিও—পাণ্ডিত্যের কোন মূল্য নাই। পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে তোমাদের সকলেরই ধারণা ভুল। মনকে বলিষ্ঠ ও সুনিয়ন্ত্রিত করার মধ্যেই জ্ঞানের একমাত্র মূল্য। আমি অবাক্ হইতেছি যে অনন্ত কাল ধরিয়া এই গলাধঃকরণের দ্বারা আমাদের বদহজম হইতেছে না কেন? আমাদের এইখানেই থাকিয়া যাবতীয় পুস্তক পুড়াইয়া ফেলা প্রয়োজন এবং নিজেদের অন্তরে চিন্তা করা কর্তব্য।" (পৃষ্ঠা ২৭৩)
"জগতে অনেক লোক-শিক্ষক আছেন, কিন্তু দেখিতে পাইবে—(তাঁহাদের অধিকাংশই) একদেশী। কাহারও দৃষ্টি বুদ্ধিবৃত্তির প্রখর মধ্যাহ্নসূর্যের উপর, অন্য কিছুই তাঁহার চোখে পড়ে না। অপর কেহ বা শুনেন প্রেমের সুমধুর গীতি এবং ইহা ছাড়া আর কিছুতে কান দিতে পারেন না। আবার আর একজন আছেন কাজে (ডুবিয়া), তাঁহার অনুভূতি বা চিন্তার সময় নাই। এরূপ একজন মহামানব কেন (চাও) না—যিনি যেমন কর্মী, তেমনি জ্ঞানী, আবার সমানভাবে প্রেমিক? ইহা কি সম্ভব?—নিশ্চয়ই নয়।" (পৃষ্ঠা ২৭৮)
"(কেবলমাত্র) গ্রন্থ-অধ্যয়নে (লোকে) শুষ্ক হইয়া যায়। কে বিদ্বান্?—যে অন্ততঃ একবিন্দু প্রেমও অনুভব করিতে পারে।" (পৃষ্ঠা ২৮৮)
"শুধু বুদ্ধির দ্বারা জানা যায় না। ... হাজার হাজার বই পড়িয়াও তুমি জানিতে সমর্থ হইবে না ... যখন আমরা ইহা বুঝিতে আরম্ভ করি, সমুদয় জগৎ-রহস্য যেন আমাদের সম্মুখে খুলিয়া যায়। ... একটি ছোট মেয়ে তাহার পুতুল লইয়া খেলিতেছে—সব সময় সে নূতন নূতন স্বামী পাইতেছে, কিন্তু যখন তাহার সত্যকারের স্বামী আসে, তখন (চিরদিনের জন্য) সে তাহার পুতুল-স্বামীগুলি দূরে ফেলিয়া দেয়। ... জগতের সবকিছু সম্বন্ধে ঐ একই কথা।" (পৃষ্ঠা ২৯১)
"আমরা বক্তৃতা শুনি, পুস্তক পড়ি, ঈশ্বর আত্মা ধর্ম ও মুক্তি সম্বন্ধে তর্কবিতর্ক করি। এগুলি আধ্যাত্মিকতা নয়, কারণ আধ্যাত্মিকতা পুস্তকে দর্শনে বা মতবাদে নাই। ইহা বিদ্যা বা বিচারে নাই, অন্তরের প্রকৃত বিকাশে নিহিত। তোতাপাখিও বুলি মনে রাখিয়া আওড়াতেই পারে। যদি আপনি বিদ্বান্ হইয়া থাকেন, তাহাতে কি আসে যায়? গর্দভেরা সমগ্র গ্রন্থাগারটি পৃষ্ঠে বহন করিয়া লইয়া যাইতে পারে। সুতরাং যখন যথার্থ আলোক আসিবে, তখন পুঁথিগত বিদ্যার আর প্রয়োজন হইবে না। নিজের নামটি পর্যন্ত সই করতে অক্ষম ব্যক্তিও ধার্মিক হইতে পারেন, আবার পৃথিবীর যাবতীয় গ্রন্থাগারের জ্ঞানরাশি যাঁহার মস্তকে পুঞ্জীভূত আছে, তিনিও পারেন না। আধ্যাত্মিক উন্নতি পুঁথিগত বিদ্যার অপেক্ষা রাখে না। পাণ্ডিত্যের উপর আধ্যাত্মিকতা নির্ভর করে না। গুরুর স্পর্শ—শক্তি-সঞ্চার দ্বারা আপনার হৃদয় জাগ্রত হইবে।" (পৃষ্ঠা ৩১২)
মতামত: স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বহু বক্তব্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সরাসরি বিরোধিতা করছেন কারণ, বিজ্ঞান নির্ভর, কুসংস্কার-মুক্ত শিক্ষাই আমাদের ধর্মের বেড়াজাল ভেঙে বের করে আনতে পারে; বিচার বুদ্ধি যুক্তিবোধ তৈরী করে, প্রশ্ন করতে শেখায়, যেটা কখনই তাঁর কাম্য ছিল না। বক্তব্যগুলো মুক্ত মনে পড়লেই বোঝা যায় যে, তিনি তাঁর ভক্তদের বিজ্ঞান নির্ভর শিক্ষা থেকে সরিয়ে বেদান্তভিত্তিক অনন্ত সর্বজ্ঞ আত্মাকে খুঁজে বেড়ানোর কাজে প্রভাবিত করতে চান; যাতে তাঁর সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের শোষণের ক্ষেত্রকে সুরক্ষিত করে রাখা যায়।
একটা প্রশ্ন থেকেই যায় - স্বামীজীর কথা অনুযায়ী বইপত্র পড়ে যখন কিছুই হয় না, তারপরেও রামকৃষ্ণ মিশন তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে চালিয়ে যাচ্ছে কেন? আর্থিক লাভের জন্য নয় নিশ্চয়ই!