Monday, 19 February 2024

বিজ্ঞান কল্পনা ও অহিংষ্ণু ভারত - শ্যামল চক্রবর্তী

 ১৯৪৭ সালের ৩-৮ জানুয়ারী দিল্লিতে বিজ্ঞান কংগ্রেসের চোত্রিশতম অধিবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দেশ সে বছর স্বাধীনতা পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু জনজীবনে বিজ্ঞান মানসিকতা প্রসারে আন্তরিকভাবে আগ্রহী ছিলেন। তাঁকেই সে বছর মূল সভাপতি করা হয়। একথা বলতে কোনো দ্বিধা নেই, বিজ্ঞান কংগ্রেস তার অভীষ্ট লক্ষ্য পূর্ণ করুক, প্রধানমন্ত্রী নেহরু তা সকল সময় চেয়েছেন। আর একটি বিষয়েও বিজ্ঞান কংগ্রেস নতুন চরিত্র অর্জন করেছিল। পৃথিবীর নানা দেশের বিজ্ঞান সোসাইটির কাছে আমন্ত্রণ গেল, তাঁরা যেন ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে প্রতিনিধি পাঠান। বিজ্ঞান চরিত্রে আন্তর্জাতিক। পৃথিবীর নানা দেশের নানা জল-হাওয়ায় কেমন গড়ে উঠছে বিজ্ঞান, সদ্য স্বাধীন দেশের বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান পরিকল্পনাকারদের অবহিত হওয়া প্রয়োজন বই কি।

১৯৪৭ সালে নেহরু তাঁর বক্তৃতা শুরু করেছিলেন এই বলে : '...বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ও মানবিকতা প্রসারে আমাদের বিজ্ঞানীরা কাজ করবেন ... যুদ্ধের কোনো কাজে আমরা সহযোগিতা করব না।'

নেহরু বলেছিলেন : ভারতকে আমরা 'More and more scientifically minded' করতে চাইব। কথাটা যে আজও কেমন জরুরি, বিজ্ঞান কংগ্রেসের ১০২তম অধিবেশন দেখে আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয়নি। সে কথায় আমরা পরে যাব। তাঁর ভাষণের প্রধান তিনটি উপশিরোনাম ছিল, 'বৈজ্ঞানিক বিকাশ', 'হিরোশিমায় বোমাবর্ষণ' ও 'সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা'। বিজ্ঞানের হাত না ধরলে কোনো দেশেরই অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। হিরোশিমার ক্ষত, সত্যি বলতে কী, আজও শুকোয়নি। ১৯৪৭ সালে স্বভাবতই তা ভয়ঙ্কর ছিল। 'সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা' নিয়ে তিনি সেদিন যে উদ্বেগের বার্তা দিয়েছিলেন আজ প্রতিটি সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন ভারতীয় হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছেন। তাঁর কথার মানে ছিল একটাই। বিজ্ঞান মনন সম্প্রসারিত হলে, ভারত 'More and more scientifically minded' হলে, সাম্প্রদায়িকতার ভেদবুদ্ধিকে আমরা বিনাশ করতে সমর্থ হব।

১০২ তম বিজ্ঞান কংগ্রেস আমাদের এক বৈপরীত্যের বার্তা শেখালো। এ এমন এক বৈপরীত্য যা সর্বতোপরিত্যাজ্য। রবীন্দ্রনাথের কথা মমনে পড়ে। দুরকম সংস্কৃতির কথা বলেছিলেন তিনি। মোহমুগ্ধতার সংস্কৃতি ও মোহমুক্ততার সংস্কৃতি। প্রথম সংস্কৃতি বিজ্ঞান মননকে আচ্ছন্ন করে। দ্বিতীয় সংস্কৃতি মানুষকে বিজ্ঞান মননশীলতায় উজ্জীবিত করে। এবারে বিজ্ঞান কংগ্রেস দেখে মনে হল, ভারত যেন 'less and less scientifically minded' হচ্ছে।

**************************************************
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বলেছিলেন : 'বিশ্বাস' আর যা-ই দিক, বিজ্ঞান দিতে পারে না।
**************************************************
বিজ্ঞানের ডিগ্রি থেকে বিজ্ঞান সংস্কৃতি গড়ে উঠে না। যিনি দিল্লি থেকে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতিষশাস্ত্র পড়ানোর ফতোয়া জারি করেছিলেন, তিনি তো এককালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা পড়াতেন। চারপাশে তাকালেও দেখা যায়, বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং এমনকি ডাক্তারি ডিগ্রি নিয়েও অনেকে অপবিজ্ঞানের ফুলঝুড়ি হয়ে বেঁচে আছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'তিন সঙ্গী' বইয়ের তিনটি গল্পে আমাদের কী বলতে চাইলেন? বিজ্ঞান যাদের জীবিকা তারাও অপবিজ্ঞান আর কুসংস্কারের আবর্তে নিজের ঠিকানা গড়তে পারে। বিজ্ঞান তো আর 'বিষয়' নয়, বিজ্ঞান হল 'পদ্ধতি'। 
**************************************************
ধর্মের দাপটে সর্বনাশ হয়েছে পৃথিবীর নানা সভ্যতায় অনেক বিজ্ঞানীর। এই সর্বনাশের তালিকায় রয়েছে সার্ভেটাস, আব্দুল লতিফ, চার্বাক। রয়েছেন গ্যালিলিও, ব্রাহে, ব্রুনো। গ্যালিলিওকে নিয়ে চর্চা হয়েছে অনেক। বেশ কয়েক বছর আগে পোপ বললেন, গ্যালিলিওকে শাস্তি দেওয়া অন্যায় হয়েছে আমাদের। দিনকয় আগে পোপ ফ্র্যান্সিস যা বললেন, পৃথিবী চমকে উঠেছে। তিনি ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বকে সমর্থন করলেন। স্টিফেন হকিংয়ের বিগ ব্যাং তত্ত্ব মেনে নিলেন। সব চেয়ে বড়ো কথা, বললেন ফ্র্যান্সিস, 'ঈশ্বর জাদুকর নন'। মনে পড়ে আমাদের, অনেকদিন আগে আইনস্টাইনের একটি কথা আমাদের বুকে আলোড়ন তুলেছিল। 'ঈশ্বর দাবা খেলোয়াড় নন।' তবে আইনস্টাইন আর পোপ ফ্র্যান্সিস কি একই কথা বললেন?

বছর কয় আগের কথা। ভ্যাটিকান থেকে বলা হয়, বিজ্ঞানের সত্য যাচাই করার নিয়ম বিজ্ঞানেই রয়েছে। ধর্মকে সেখানে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই। ধর্মের কাজ কি তবে? বিজ্ঞান যখন মানুষের কল্যাণের সত্য আবিষ্কার করে, সেই সত্য কেমন করে মানুষের জীবনে আরও বেশি কল্যাণে কাজে লাগানো যায়, ধর্মকে সেই পথ আবিষ্কার করতে হবে।

ডারউইনের লাঞ্ছনার কথা আমাদের অজানা নয়। বিবর্তনের কথা বলেছিলেন ডারউইন। ডারউইনের আগে বিবর্তনের কথা কি আর কেউ বলেননি? বলেছেন বই কি। ডারউইনের দাদু এরাসমাস ডারউইন বলেছেন। লামার্ক বলেছেন। আরও কেউ কেউ বলেছেন। তবে ডারউইন এমনভাবে আক্রান্ত হলেন কেন? কারণ সহজ। ডারউইনের আগে বিবর্তন নিয়ে যাঁরা বলেছেন, তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, বিবর্তন 'কেমন' করে হয়? ভ্যাটিকানের অভিমত, এতে আমাদের আপত্তি নেই। বিবর্তনের পথ আবিষ্কার করুন বিজ্ঞানীরা, আমাদের এতে ঝগড়া করার কিছু নেই। ডারউইন যে ভিন্ন কথা বলছেন। তাঁর প্রশ্ন, 'কেন' বিবর্তন হয়? কিভাবে হয়, বললে পোপের আপত্তি নেই। কেন হয়, বললে আপত্তি আছে। ঈশ্বরের ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন ডারউইন? একথা ভ্যাটিকান মানবে কেন? ঈশ্বরই তো তাঁর অভিলাষ পূরণে নানা জীব প্রজাতিকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।

একই কাণ্ড হকিং-র বেলায়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির দুটি তত্ত্ব। ফ্রেড হয়েলের 'স্টিডি স্টেট থিওরি'। স্থির দশা তত্ত্ব। হকিং-এর 'বিগ ব্যাং তত্ত্ব'। হয়েল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির মুহূর্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। সৃষ্টির পর কী ঘটছে হয়েল বুঝতে চাইছেন। ভ্যাটিকানের আপত্তি নেই। হকিং যে বেয়াড়াপনা করছেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির মুহূর্ত বুঝতে চাইছেন। এত স্পর্ধা মেনে নেওয়া যায় না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঈশ্বরের সৃষ্টি। সৃষ্টির সত্য মেনে নিয়ে যে বিজ্ঞানী যে কাজই করুন না কেন, পোপের কোনো আপত্তি নেই। হকিং যা বলছেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির মুলে ঈশ্বরের ভূমিকাকে নস্যাৎ করতে চাইছেন। এমন বেয়াদপি মানা যায় না। অথচ আজ ফ্র্যান্সিস তাই মেনে নিলেন। তিনি ডারউইন ও তাঁর বিবর্তন তত্ত্বকে মেনে নিলেন। হকিং ও তাঁর বিগ ব্যাং তত্ত্ব মেনে নিলেন। বিজ্ঞানের সত্যকে পোপ অবজ্ঞা করতে পারছেন না। বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকে একবিংশ শতাব্দীতে মানতে হচ্ছে।

আমরা যারা বিজ্ঞান সংস্কৃতির কথা বলি, আমাদের কাছে এ পরম সুখবর। তবে হালে দিল্লিতে যারা ক্ষমতায় এসেছেন তাদের কাছে সুখবর নয়। সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় ভাবনায় পরিচালিত হয় যারা, অন্য ধর্মে ঔদার্যের বিকাশ দেখলে গায়ে জ্বালা ধরে। লড়াইটা তাহলে জমবে কেমন করে? লজ্জা হয় আমাদের ভাবতে। ২০১৩ সালের ২০ আগস্ট পুনে শহরে দিনের আলোয় খুন হলেন ডাঃ নরেন্দ্র দাভোলকার। রাজনীতির কর্তারা ছুটে গেলেন। একজন তো বলেই ফেললেন, গান্ধীজীর হত্যাকান্ডের চেয়েও এই হত্যাকান্ড ভয়ঙ্কর। কিন্তু ঘটনা এই, খুনিদের কেউ আজও ধরা পড়েনি। একুশ শতকে বিজ্ঞানের কোনো সত্য আবিষ্কার হলেই কোনো কোনো মহল প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করেন, 'এ আর এমন নতুন কথা কী। ভারতে পুরানো আমলেই এই সত্য আবিষ্কার হয়েছে।' এমন উন্মাদ দর্শন কত কাল চলবে এ দেশে? কত কাল চলবে এমন উন্মাদের পাঠক্রম?
**************************************************
সুদর্শনজি, আপনি ভারতীয় ঐতিহাসিকদের মার্কসবাদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের 'অভিযোগ' করেছেন। ইতিহাস চর্চার তাই 'ভারতীয়করণ' চাইছেন। আপনার মনে পড়বে নিশ্চয়ই বার্ট্রান্ড রাসেলের কথা। 'পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস' বইয়ে কার্ল মার্কসকে নিয়ে লিখেছেন রাসেল। রাসেল কোনোকালেই মার্কসপন্থী নন। অথচ তাঁর রচনায় সেই সমালোচনার ধারা রয়েছে। শেষে তিনি কি লিখলেন? নিবন্ধ রচনায় তাঁর বিশ্লেষণভঙ্গি মার্কস অনুসৃত পথই অনুসরণ করেছে। আমরা বলি, বিজ্ঞান কোনো 'বিষয়' নয় বিজ্ঞান হলো 'পদ্ধতি'। মানতেই হবে। নইলে জ্ঞানচর্চার মণিমাণিক্য তৈরি হয় না। তৈরি হয় সভ্যতার জঞ্জাল।
**************************************************
আধুনিক ভারতের অন্যতম বিশিষ্ট বিজ্ঞানী পুষ্প ভার্গব। হায়দ্রাবাদের 'সেন্টার ফর সেলুলার অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি'-র তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা অধিকর্তা। ওরিয়েন্ট লংম্যান থেকে ২০০৩ সালে প্রকাশিত তাঁর লেখা একটি বইয়ে আমরা দেখতে পাই তিনি লিখছেন, 'বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বহু বিষয়ে আমাদের সাফল্য রয়েছে। গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন, মেডিসিন, শল্যবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, ভূবিদ্যা, ধাতুবিদ্যা, সুগন্ধিবিদ্যা-র নাম অবশ্যই করা যায়। কিন্তু অসংখ্য পৌরাণিক আখ্যান আজও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সিংহভাগ আখ্যানের কোনো যুক্তি ও সারবত্তা নেই। অথচ শুধুমাত্র বিশাল সংখ্যক সাধারণ নাগরিক নন, বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ এমন বার্তা বহন করে চলেছেন।'
**************************************************
বিজ্ঞানীরা ভারতের তেরোটি জেলা থেকে পঁচিশ রকমের মানুষ মোট একশো বত্রিশ জনকে বেঁচে নিলেন। এদের ভাষা ছ-রকমের। কেউ তথাকথিত উচ্চবর্ণের। কেউ তথাকথিত নিম্নবর্ণের। বেশ ক'রকমের আদিবাসী মানুষও ছিলেন। বাইরে থেকে দেখলে এদের ভেতর কোনো মিল নেই। বাইরের এই মিল-অমিল বিজ্ঞানের আলোয় যাচাই করব আমরা। বিজ্ঞানীরা তাই সকলের 'জিন মানচিত্র' বার করলেন। দেখা গেল ভাষা-জাতি-বর্ণ যতই আলাদা হোক, জিন মানচিত্রের বিচারে এরা সকলেই এক।

অতীত খুঁজতে গেলে দু-রকমের বংশানুক্রম জিন দেখা যায় ভারতে। উত্তর ভারতীয় বংশানুক্রম জিন আর দক্ষিণ ভারতীয় বংশানুক্রম জিন। 'সেন্টার ফর সেলুলার অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি'-র বিজ্ঞানী কুমারস্বামী থঙ্গরাজন ওই সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন: 'পঁয়ষট্টি হাজার বছর আগে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ও দক্ষিণ ভারতের কিছু এলাকায় প্রথম বসতি গড়ে উঠেছিল। তেমনি চল্লিশ হাজার বছর আগে উত্তর ভারতের কিছু এলাকায় প্রথম বসতি গড়ে উঠেছে। একটা সময়ের পর দুই বসতির মানুষের মিশ্রণ ঘটেছে। এখন তাই সারা দেশ জুড়ে আমরা যে জনবসতি দেখতে পাই, সেই মানুষদের জিন মানচিত্র উত্তর আর দক্ষিণের এক মিশ্রিত মানচিত্র হিসেবে গড়ে উঠেছে।'

... বিজ্ঞানীরা আরও কয়েকটি আকর্ষণীয় তথ্য ওই সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছিল। পশ্চিম ইয়োরেশিয়ার মানুষের সঙ্গে উত্তর ভারতের মানুষের জিনগত মিল খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। তবে বিজ্ঞানীরা এখনও বলতে পারছেন না, এই মিলের কারণ কী। উত্তর ভারত থেকে জনবসতি ইউরোপে গিয়েছিল? ইউরোপ থেকে জনবসতি উত্তর ভারতে এসেছিল? এর নির্ভুল উত্তর উদ্ধার খুব সহজ নয়। তবে বিজ্ঞানীরা থেমে নেই।

ইতিহাস আমাদের বলছে, এক লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার বছর ও পঁচাত্তর হাজার বছরের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে পূর্ব আফ্রিকায় জলাশয়ের জল শতকরা পঁচানব্বই ভাগ শুকিয়ে যায়। আফ্রিকার মানুষ দলে দলে তখন আশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। কোন পথে কোথায় এসেছে ওই মানুষ? এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা সবচেয়ে বেশি ভরসা করেন, কোষের মাইটোকনড্রিয়া ডি এন এ-র সজ্জাক্রমের উপর। কেন এই ডি এন এ? এই ডি এন এ সবচেয়ে বেশি ঝড়ঝাপটা সামনে অক্ষত থাকতে পারে। কাজেরই গোয়েন্দাগিরির কাজ এই ডি এন এ দিয়েই সবথেকে ভালো হয়। প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে, পূর্ব আফ্রিকায় অধিবাসীরা অতকাল আগে ভারতের দক্ষিণ উপকূলের পথ ধরেই এগিয়েছিল। যদি শেষ পর্যন্ত এ কথা সত্যি হয়, ইতিহাসের এক প্রচলিত আখ্যান বাতিল হয়ে যাবে। কী সেই আখ্যান? মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার পথ ধরে এককালে জনবসতি ভারতে এসেছিল। ভারতের জনবসতি উত্তরবাহী নাকি দক্ষিণবাহী - এই বিতর্ক প্রবল বিক্রমে চলেছে। সে যে 'বাহী'ই হোক না কেন, ভারতের এখনকার জনবসতি যে দুই মিশ্রণের ফসল, এ নিয়ে দ্বিধা নেই কোনো। বংশাণুক্রমিকতার বিচারে ভারতের সব মানুষ সমান, এ কথা অবশ্যই জোর গলায় বলা যায়।

২০০৯ সালের পর ২০১১ সাল। লালজি সিং ও একাধিক দেশের বিজ্ঞানীরা ২০১১ সালের ৯ ডিসেম্বর 'আমেরিকান জার্নাল অফ হিউম্যান জেনেটিকস'-এ একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। লালজি সিং তখন বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনিই বললেন, 'ভারতীয় উপমহাদেশে আর্য বা দ্রাবিড় বলে কেউ নেই। এই বিভাজনে যারা বিশ্বাস করেন তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য করেন।' এস্তোনিয়া বায়োসেন্টারের বিজ্ঞানী জ্ঞানেশ্বর চৌবে সেসময় বলেছিলেন, 'আমরা পরীক্ষা করে দেখিয়েছি যে সারা ভারতে একইরকম ডি এন এ-র গঠন রয়েছে এমন লোকেরাই বাস করে। গত ষাট হাজার বছর ধরে ভারতীয়দের ডি এন এ বিশুদ্ধ থেকে গিয়েছে। বাইরে থেকে কোনো 'জিন' বা 'ডি এন এ' যোগ হয়নি। আরও এক ধাপ এগিয়ে বিজ্ঞানীরা বললেন, 'আর্য আগ্রাসনের কোনো চিহ্নই নেই। ভারতীয়রা বরং ইউরোপে গিয়েছে।' মজা হল এই, দ্রাবিড় সংস্কৃতির প্রতিনিধিরা বিজ্ঞানীদের এই গবেষণার ফল মানতে রাজি নন। জ্ঞানী শংকরণ তামিলনাড়ুর এক পরিচিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। নিয়মিত তিনি ব্রেখট, বিজয় তেন্ডুলকার ও বাদল সরকারের নাটক করেন। নিজে তিরিশটিরও বেশি নাটক লিখেছেন। ধারালো তাঁর লেখনশৈলী। রাজনীতির কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এখনকার সব রাজনীতিই খারাপ। তুমি যদি এর থেকে দূরে থাকো তবে তা আরও খারাপ হয়ে যাবে।' বিজ্ঞানীদের কাজ দেখে তিনি বলেছিলেন, 'ওই গবেষণাপত্র যারা লিখেছেন তারা কেমন মাপের বিজ্ঞানী, সেকথা আগে জানতে হবে। তাদের কোনো গোপন অভিসন্ধি আছে কিনা দেখতে হবে। তামিলনাড়ুতে একথা সকলেই জানে যে আর্য সমাজের লোকেরা দ্রাবিড় ব্রাহ্মণদের দলিত হতে বাধ্য করেছিল।'
**************************************************
বিজ্ঞান সংস্কৃতির অবমাননার নিদর্শন এখন যেন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর কোথাও কোনো বিজ্ঞানের উদ্ভাবনা হলেই একদল ভারতীয় বলতে শুরু করেন, এর সবকিছুই তো আমাদের দেশে ছিল। তেমন উদ্ভাবনাকে এরা কখনও 'বৈদিক বিজ্ঞান', কখনও 'হিন্দু বিজ্ঞান' -এর শিরোনামে চিহ্নিত করতে শুরু করেন। জার্মানিতে হিটলারের সময় 'আর্য বিজ্ঞান'-এর শোরগোল উঠেছিল। কোথাও কোথাও আজকাল 'ইসলাম বিজ্ঞান'-এর কথাও শুনতে পাওয়া যায়। এই শব্দোচ্চারণের লোকেরা সকলেই উগ্র জাত্যাভিমানের দর্শনে বিশ্বাস করেন। বিজ্ঞানের নিজের জগতে যে ইতিহাস ও দর্শন আছে সে বিষয়ে এদের বিন্দুমাত্র আস্থা ও আগ্রহ নেই।

... ১৯২০ সালে নাগপুর শহরে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র। সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন :

'ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে প্রাণশক্তি ও সক্রিয়তা দেখায়, সেখানে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? পরিস্থিতির দিকে তাকালে লজ্জা ও বিষন্নতা আমাদের গ্রাস করে। ... অনন্তকাল ধরে ভারতীয় সংস্কৃতি এক অদ্ভুত ছাঁচে গড়া। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে হিন্দুজাতি প্রকৃতপক্ষে এক অধিবিদ্যানির্ভর জাতি। প্রাচীন ভারতে ভৌত বিজ্ঞানের চর্চা যে পুরোপুরি উপেক্ষিত হয়েছে এমনটা নয়, তবে তা অধিবিদ্যা ও ধর্মের অনুসারী বিষয় হিসেবে অগ্রসর হয়েছে। বৌদ্ধধর্মের পতনের পর ভারতের অন্ধকার যুগ শুরু হয়। গত এক হাজার বছর বা তার বেশি বছর ধরে ভৌত বিজ্ঞান চর্চার কথা বলতে গেলে আমাদের বলতে হবে, আমরা এক অভিনব চিন্তার জগতে আছি।'

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র ওই দীর্ঘ ভাষণে তিনি আরও বলেছিলেন, ইউরোপে বিজ্ঞানের এল প্যারাসেলসাসের সময় থেকেই আরম্ভ হয়েছে। তারপর গ্যালিলিও, নিউটন ও বয়েল এসেছেন। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে অনেক প্রতিভাবান বিজ্ঞানীদের দেখা গিয়েছে। 

প্রফুল্লচন্দ্রের কথায়, প্রাচ্য দেশে আমরা তখন নীরব ও ভাবালুতায় ধ্যানমগ্ন। হিন্দুজাতি বেদান্ত অনুসরণ করে চলছে। বাস্তব জগতের অস্তিত্বকেই এরা স্বীকার করে না। বেদান্ত দর্শনের প্রণেতা শঙ্করাচার্য পরমাণুবাদের সমালোচনায় মুখর। বৈশেষিক দর্শনের বার্তা তখন চরম নিন্দনীয়।

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের এই ক্ষোভ হতাশার উচ্চারণ থেকে আমরা একটা কথাই বুঝতে পারি। ভারতীয় বিজ্ঞান সংস্কৃতির প্রবাহ তখন ক্ষীণকায় এক স্রোতস্বিনীর মতো।

প্রফুল্লচন্দ্রের সাত বছর পরে ১৯২৭ সালে বিজ্ঞান কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। তিনি এক ভিন্ন বিষয়ে ভারতবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলেন। বিজ্ঞানের কোনো উদ্ভাবনা কখনও জাতি-বর্ণ-ধর্ম ও বিশেষ ভূ-খণ্ডের সম্পত্তি হতে পারে না। তাঁর কথায় :

'কোনো বিশেষ জাতির উপর জ্ঞানের অগ্রগতি নির্ভর করছে, এমন মূর্খ অভিভাষণের চেয়ে বড়ো অসত্য আর কিছু হতে পারে না। সমগ্র জগত পরস্পর নির্ভরশীল। যুগ থেকে যুগান্তরে নিরবিচ্ছিন্ন চিন্তার স্রোতধারা মানবজাতির সর্বজনীন ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে।'

জগদীশচন্দ্রের এমন অভিমত কি 'হিন্দু বিজ্ঞান', 'বৈদিক বিজ্ঞান', 'আর্য বিজ্ঞান','ইসলাম বিজ্ঞান' প্রভৃতির ধারণাকে হাস্যকর ও অর্থহীন করে তুলছে না?
**************************************************
মেঘনাদ সবে তখন বিলেত থেকে গবেষণার কাজ সেরে ফিরেছেন। ঢাকা শহরের এক খ্যাতনামা আইনজীবী মেঘনাদ বিজ্ঞানের কী কাজ করেছেন জানতে চাইলেন। উৎসাহ নিয়ে মেঘনাদ যখন বলছিলেন, সামান্য সময় অন্তর অন্তর ওই আইনজীবী বলতে থাকলেন, 'এ আর নতুন কি হইল, এ সমস্তই ব্যাদে আছে।' মেঘনাদ শেষ পর্যন্ত লিখলেন, '...বিগত কুড়ি বৎসরে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ইত্যাদি সমস্ত হিন্দুশাস্ত্রগ্রন্থ এবং হিন্দু জ্যোতিষ খুঁজিয়া আমি কোথাও আবিষ্কার করিতে সক্ষম হই নাই যে, এই সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থে বর্তমান বিজ্ঞানের মূলতত্ত্ব নিহিত আছে।'

মেঘনাদ-সত্যেন্দ্রনাথ এঁরা কয়েকজন একসঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েছেন। তখন তাঁদের পদার্থবিদ্যা পড়াতেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। রসায়নবিদ্যা পড়াতেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। 
**************************************************
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর 'রাজনীতি' নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলতেই পারে। কিন্তু তাঁর 'বিজ্ঞান মানসিকতা' নিয়ে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। ২০১৫ সালের মে মাসে ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত এক বিজ্ঞান সম্মেলনে প্রসিদ্ধ ভারতীয় বিজ্ঞানী ডি বালসুব্রামানিয়ান (তিনিও একসময় 'সেন্টার ফর সেলুলার অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি'র অধিকর্তা ছিলেন) এক বক্তৃতায় জানান, নেহরুর সময়ে তাঁর যে উপদেষ্টামন্ডলী ছিল সেখানকার পঞ্চাশ ভাগ ছিলেন বিজ্ঞানী। এলাহাবাদের 'আনন্দভবন' থেকে সংগৃহীত একটি নথি আমাদের হাতে এসেছে। সেখানে নেহরু দেশবাসীকে জানাচ্ছেন,তাঁর প্রয়াণের পর যেন কোনো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের আয়োজন না করা হয়। সুযোগ হলে গঙ্গার বুকে এক মুঠো চিতাভস্ম দিলে ভালো হয়। এ কথায় চমক জাগে। তবে যে তিনি কোনো আচার অনুষ্ঠান না করে বলেছিলেন? পরের লাইনে এ কথার উত্তর নেহরু নিজেই দিয়েছেন। একেবারে শৈশব থেকে গঙ্গার কোলেপিঠে মানুষ হয়েছেন তিনি। ক মুঠো চিতাভস্ম ছাড়া গঙ্গাকে আর কোনো কিছু দেওয়ার কথা তিনি ভাবতে পারছেন না। নিজেই বলেছেন, এ থেকে যেন কেউ তাঁর ভাবনায় ধর্মীয় আচ্ছন্নতার অনুসন্ধান না করেন। যারা মুখে সুমহান ঐতিহ্যের কথা বলেন, তারা এই রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য মানতে রাজি আছেন তো? মননে বিজ্ঞান সংস্কৃতির বীজ বপন হলে যুক্তি-কুযুক্তির ফারাক বোঝেন একজন মানুষ। যারা পরিকল্পিতভাবেই যুক্তির মুক্ত হাওয়া সরিয়ে দূষিত হাওয়া ছড়িয়ে দিতে চান, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের লড়াই হবে দীর্ঘতর। আসুন, সেই দীর্ঘতর লড়াইয়ের এক সেনানী হিসাবে আমরা সকলে সামিল হই। রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের 'মোহমুক্ত' স্বদেশ গড়ে তুলি।
**************************************************
যুক্তি বুদ্ধি বিসর্জন দিলে পৃথিবীতে কিছু বিষয় হয়তো বা চর্চিত হতে পারে। বিজ্ঞান চর্চা প্রশ্ন উঠে না। ভারতে যে মানুষদের হাতে অহঙ্কারের ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে, গভীর মনন দিয়ে তাঁদের দিকে নজর দিই কি আমরা? কতোকাল আগে চরকসংহিতা ও সুশ্রুতসংহিতা লেখা হয়েছিল। ১৮৩৬ সালে পন্ডিত মদুসূদন গুপ্ত কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজে মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ সম্পাদনের অপরাধে সনাতনী হিন্দু সমাজ থেকে বহিস্কৃত হলেন। তাঁকে তখন সুশ্রুতসংহিতার শ্লোক উদ্ধৃত করে গোঁড়া হিন্দু পন্ডিতদের বলতে হয়েছে, কতোকাল আগে সুশ্রুত শবদেহ ব্যবচ্ছেদের প্রক্রিয়া সমর্থন করেছিলেন। তাই তিনি প্রকৃত প্রস্তাবে কোনো অপরাধ করেননি। একশো বছরেরও বেশি আগে মাইকেল মধুসূদন দত্ত 'মেঘনাদ বধ' কাব্য লিখেছিলেন। রাবণের মানবিক মুখ এঁকেছিলেন তিনি। এখন প্রতিদিন চলচ্চিত্র, সাহিত্য, নাটক ও চিত্রশিল্প যে হিংস্রতার সুর ও স্বরে আক্রান্ত হচ্ছে, মেঘনাদবধ কাব্য রচনার সমকালে আমরা সেই দৃশ্য দেখতে পাইনি। ভিন্ন চিন্তারও এক ধরনের সামাজিক অনুমোদন ছিল। সেই চিন্তাকে আতুড়ঘরে গলা টিপে মেরে ফেলবার এমন অভিপ্রায় দেখা যায়নি। বাংলাদেশের বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে (প্রতিদি, ২২ মার্চ ২০১৪) জানিয়েছেন, তিনি যখন সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ-র 'লালসালু' চলচ্চিত্রায়িত করেন, মৌলবাদীদের চাপে সিলেট ও খুলনায় সে ছবি দেখানো যায়নি। তারপর বলেন, '...উপন্যাসটি ১৯৪৮ সালে লেখা। তৎকালীন মুসলমান সমাজ কিন্তু উপন্যাসটিকে মেনে নিয়েছিল। আজ পঞ্চাশ-ষাট বছর পর দেখা যাচ্ছে, 'লালসালু' চলচ্চিত্রটিকে তারা তেমন সহ্য করতে পারছে না। গত কয়েক দশকে মুসলমান সমাজে ইসলামি মৌলবাদীদের প্রভাব বৃদ্ধিই হয়তো এর কারণ। ধর্মীয় উদারতার দিক থেকে বাঙালি, মুসলমান সমাজ মনে হচ্ছে আরও পিছিয়েছে।' ভারতের ইতিহাসে একদিন সেই কলঙ্কিত পরিচ্ছেদ লিখিত হবে, সমকালের সর্বোত্তম চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হুসেইনকে স্বভূমি পরিত্যাগ করে ভিন্নভূমে জীবন যাপন করতে হয়েছে ও সে মাটিতেই তাঁর জীবনদীপ নির্বাপিত হয়েছে। কন্নড় সাহিত্যের সর্বকালের সেরা স্রষ্টাদের অন্যতম ও সাহিত্য একাডেমির ভূতপূর্ব অধ্যাপক ইউ আর অনন্তমূর্তি উগ্র ধর্মীয় আচরণের বিরুদ্ধে অভিমত দিয়েছিলেন বলে নিজের বাসগৃহেই আক্রান্ত হয়েছিলেন।

শিক্ষিত মানুষ মাত্রই জানেন, বিজ্ঞান সচেতনতা মানে বিজ্ঞানের ডিগ্রির সমাবেশ নয়। রবীন্দ্রনাথ আমাদের বলেছিলেন, বিজ্ঞানের চর্চা এই কারণে জরুরি যে বিজ্ঞান আমাদের মোহমুক্ত ও সতর্ক করে। মোহাবরণের পলেস্তারা খসে পড়বে, সেখানে নতুন প্রলেপ পড়বে মোহমুক্ততার, এই তো ছিল বিশ্বকবির চাওয়া। 'তিন সঙ্গী'-র তিনটি গল্পেই রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানজীবীদের সতর্ক করেছেন, অন্ধবিশ্বাস ও কুযুক্তির  আত্মসমর্পণ করতে পারেন বিজ্ঞানজীবীরা। কী প্রত্যক্ষভাবে আমরা কিছুকাল আগে সেই দৃশ্য অনুভব করেছি। মাথাপিছু মাত্র চারটাকার মতো খরচ করে আমাদের দেশ একবারের চেষ্টাতেই মঙ্গলের কক্ষপথে মঙ্গলযান পাঠিয়ে দিল। আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা সারা পৃথিবীর অভিনন্দন কুড়োলেন। অথচ সেই সময় দেখা গেল, ইসরোর অধিকর্তা ত্রিভুবনের সবচেয়ে ধনাঢ্য ঈশ্বর তিরুপতির কাছে গিয়ে প্রার্থণা করছেন, 'হে ঈশ্বর, আমাদের মঙ্গলযানকে মঙ্গলের কক্ষপথে বসিয়ে দাও।' মঙ্গলযানের একটি ছোটো মডেল নিয়ে ঈশ্বরের পদপ্রান্তে সমর্পিত করা হল। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত যে মানুষেরা এই দৃশ্য দেখেছেন, কী শিক্ষা গ্রহণ করেছেন তারা? প্রশ্ন তো জাগতেই পারে মনে, কার প্রতিভার জোরে মঙ্গলযান মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছুল? ঈশ্বর তিরুপতির নাকি একদল বিজ্ঞানীর দিন রাতের শ্রম আর নিষ্ঠার ফসল এই সার্থক অভিযান? স্বদেশের মাটিতে প্রবহমান জীর্ণ বিজ্ঞান সংস্কৃতিকে জীর্ণতর করে তোলা হল। বলতে দ্বিধা নেই, ভারতের বিজ্ঞানী সমাজ থেকে প্রত্যাশিত প্রতিবাদ দেখা যায়নি। কয়েকজন নিশ্চয়ই প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এই দৃশ্য থেকে আমাদের মনে পড়ছিল অনেককাল আগে লেখা অক্ষয়কুমার দত্তের একটি রচনার কথা। অক্ষয়কুমার তাঁর লেখায় একটি গাণিতিক (নাকি সামাজিক?) সমীকরণ যোগ করেছিলেন। পরিশ্রম = শস্য। পরিশ্রম + প্রার্থনা = শস্য। অতএব, প্রার্থনা = শূন্য।

শোনা যায়, হিন্দু হস্টেলের কয়েকজন ছাত্র অক্ষয়কুমারকে প্রার্থনার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন করেছিল। অক্ষয় দত্ত তখন ছাত্রদের কাছে জানতে চাইলেন, কৃষকেরা পরিশ্রম করে কী পায়? ছাত্ররাই উত্তরে বলল, শস্য। অক্ষয়কুমার তখন আবার জিজ্ঞেস করলে, পরিশ্রমের পাশাপাশি কৃষকেরা যদি প্রার্থনা করে, তবে কী পায়? এবারও ছাত্রদের একযোগে উত্তর, 'শস্য'। অক্ষয়কুমার তখন বললেন, তোমরাই তো তাহলে বুঝতে পারছ, প্রার্থনার দাম শূন্য।

একথাও শোনা যায়, এই নিয়ে সেসময় বাংলার সমাজে হই চই পড়েছিল। অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। বাবু নীলমাধব মুখোপাধ্যায় যখন অক্ষয়কুমারকে বলেছিলেন যে তিনি একথা বলে শহরে চাঞ্চল্য ঘটিয়ে দিয়েছেন, অক্ষয়কুমার উত্তরে বলেছিলেন, 'বিশুদ্ধবুদ্ধি বিজ্ঞানবিৎ লোকের পক্ষে যাহা অতি বোধ-সুলভ, তাহা এদেশীয় লোকদের নূতন বোধ হইল এইটি বড় দুঃখের বিষয়।' অক্ষয়কুমার আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একই বছরে (১৮২০) জন্ম। ব্রাহ্ম সমাজের একটি প্রার্থনা সভার বিবরণ মুদ্রণে রাজি হননি বলে 'তত্ত্ববোধিনী' পত্রিকার সম্পাদক পদ অক্ষয়কুমারকে ছাড়তে হয়েছিল। অক্ষয়কুমারের সেই প্রতিবাদী আখ্যান একুশ শতকের ভারতে নিছক 'উপহাস' বলেই মনে হয়। কোনো শিক্ষা স্বদেশ তা থেকে অর্জন করেনি।
**************************************************
ভারতের এই ত্রয়ী বিজ্ঞান ব্যক্তিত্বের (সতীশ ধাওয়ান, আবদুর রহমান ও পুষ্প এম ভার্গব) আবেদনে সেদিন ভারতে খুব বেশি বিজ্ঞানজীবী মানুষ এগিয়ে আসেননি। ওই সোসাইটির (সায়েন্টিফিক ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া) যিনি সদস্য হবেন, তাঁকে একটি অঙ্গীকার পত্রে সই করতে হত। কী ছিল সেই অঙ্গীকার পত্র?

'I believe that knowledge can be acquired only through human endeavour and not through revelation, and that all problems can and must be faced in terms of man's moral and intellectual resources without invoking supernatural powers.'

'আমি বিশ্বাস করি যে কোনো দৈববলে নয়, মানব প্রচেষ্টা থেকেই জ্ঞান অর্জিত হয়। কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তিকে আহ্বান জানিয়ে নয়, মানুষের নৈতিক ও বৌদ্ধিক সম্পদের উপর নির্ভর করেই সকল সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে।'

পুষ্প ভার্গব লিখেছেন, বিজ্ঞানীদের কাছে যখন এই অঙ্গীকার পত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে, একের পর এক অনেকেই এই অঙ্গীকার পত্রে স্বাক্ষর দিতে অস্বীকার করেন। সেসময় ভারতের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন অধ্যাপক নুরুল হাসান। তাঁর কাছে আবেদন করা হয়, সংবিধানে বিজ্ঞান সচেতনার কথা যোগ করা হোক। ১৯৭৬ সালে ৪২ তম সংবিধান সংশোধন হল। তখ '৫১ এ' ধারাটি যোগ হয়। সেই ধারায় লিখিত রয়েছে, ভারতের প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য হবে 'to develop the scientific temper, humanism and the spirit of enquiry and reform.'
**************************************************
বিজ্ঞানী পুষ্প ভার্গবের লড়াইয়ের কথা আমরা জানি। ভারতীয় জনতা দলের আগের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী (তিনি এককালে ছিলেন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক) যখন কলেজে কলেজে জ্যোতিষশাস্ত্র পড়ানোর ফতোয়া জারি করেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলেন এই বিজ্ঞানী। তাঁর যথার্থ ক্ষোভ, কোনো বিজ্ঞানী বা দেশের কোনো বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি তাঁর সপক্ষে সেদিন এগিয়ে আসেননি। যাঁরা এসেছিলেন, বেশির ভাগ-ই বিজ্ঞানজীবী নন। প্রতিবাদে তিনি ভারতের সব কয়টি বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির সদস্যপদ বর্জন করেন। সামাজিক সংকটে বিজ্ঞানীদের সংগঠন মতামত জানায়, এম উদাহরণ পশ্চিমের দেশে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। পশ্চিমের দেশে না গেলে যে বিজ্ঞানীদের 'পরিশুদ্ধি' ঘটে না, তারা সাংস্কৃতিক ভাবনায় ওই সব সংগঠনের কর্মকান্ড থেকে প্রভাবিত হন না। নিজস্ব জীবনবোধে কারও কারও হয়তো কুসংস্কার দেখা যায় না। জনসাধারণের অর্থে উচ্চশিক্ষা ও বিজ্ঞানশিক্ষা গ্রহণ করে বিজ্ঞানমনন প্রসারে জনৈক বিজ্ঞানী কি পুরোপুরি নিশ্চেষ্ট থাকবেন? অধ্যয়ন ও গবেষণা নিশ্চয়ই তার প্রধান কাজ হবে। তার 'অপ্রধান' কাজের তালিকাতে কি বিজ্ঞান মনন প্রসারের কাজ জায়গা পেতে পারে না? অপ্রধান ভাবনার অনেক মানুষ একসঙ্গে কথা বললে তার সামাজিক প্রভাব উপেক্ষা করা যায় না।
**************************************************
আমাদের  ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এখন পর্যন্ত প্রাচীনতম যে সভ্যতার সন্ধান পেয়েছেন তার নাম মহেঞ্জোদারো হরপ্পা সভ্যতা। কম বেশি এর বয়স সাড়ে চার হাজার বছর।
**************************************************
ভারতেও কি নিশ্চিত আছি আমরা? তিন বছরে খুন হলেন তিনজন। ডা. নরেন্দ্র দাভোলকার, গোবিন্দ পানসারে ও অধ্যাপক এম এম কালবুর্গি। আরও কম সময়ে বাংলাদেশে খুন হয়ে গেলেন অভিজিৎ রায়, অনন্তবিজয় দাস, ওয়াশিকুর রহমান, নিলয় চক্রবর্তী। পাকিস্তানে ফুলের কুঁড়ির মতো শিশুদের খুন করল সভ্যতার শত্রুবাহিনী।

ভারতীয় উপমহাদেশে দাপিয়ে বেড়াতে চাইছে এই শত্রুদল। জাত, ধর্ম ও বর্ণের বাইরে মিলিত হতে হবে আমাদের সবাইকে। আমাদের পরিচয় থাকবে একটাই। আমরা মানুষ। বিজ্ঞান তো মানুষকে নানা নামে ডাকে না। একটা নামেই ডাকে। হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স। প্রকৃত বিজ্ঞান ভাবনাই মানুষকে সংঘবদ্ধ করতে পারে। লড়াই হোক মানুষের সামাজিক শোষণ ও অনাচারের বিরুদ্ধে। জাত-বর্ণ-ধর্মের পরিচয় মানুষের শুভবুদ্ধিকে যেন গ্রাস না করে।
**************************************************
দেশ ও সমাজের যে সকল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাঁদের অবস্থান স্পষ্ট করেন না, ইতিহাসের আলোচনায় তাঁদের কখনও বড়ো রকমের জায়গা হয় না। আইনস্টাইনের বিজ্ঞানের কাজ বিজ্ঞানে প্রশিক্ষিত মানুষও কি সব কিছু বুঝতে পারেন? তবু বেশিরভাগ ঘরে তিনি পরিচিত কেন? দেশ ও সমাজের সংকটে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছেন।
**************************************************
১৯৭৬ সালে সংবিধান সংশোধনের সময় সংবিধানে 'Scientific temper' শব্দটি সংযোজনের ক্ষেত্রে যে চারজন মানুষের বড়ো অবদান ছিল তাঁরা হলেন মহাকাশ বিজ্ঞানী সতীশ ধাওয়ান, অধ্যাপক ও ঐতিহাসিক সৈয়দ নুরুল হাসান, বিজ্ঞান ঐতিহাসিক আবদুর রহমান ও বিজ্ঞানী পুষ্প এম ভার্গব।
**************************************************
রবীন্দ্রনাথ 'নাইটহুড' উপাধি পেয়েছিলেন ১৯১৫ সালে। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর তিনি 'নাইটহুড' পরিত্যাগ করেন। ওরা সেদিন থাকলে প্রশ্ন তুলতেন নিশ্চয়ই, ১৯১৫ থেকে ১৯১৯ সালের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ এই উপাধি ত্যাগ করেননি কেন? ওই চার বছরের ব্যবধানে ইংরেজ শাসকেরা কি কোনো রকমের নিপীড়ন রচনা করেনি?
**************************************************







Saturday, 17 February 2024

বিপ্লবের বলি - সম্পাদনা পবিত্রকুমার গুপ্ত

কবি রবীন্দ্রনাথ বড় দুঃখের সহিত লিখিয়াছিলেন "পিতামহের বিরুদ্ধে আমাদের এইটেই সব চেয়ে বড়ো অভিযোগ। সেই তো আজ তাঁহারা নাই, তবে ভালো মন্দ কোনো-একটা অবসরে তাঁহারা রীতিমত মরিলেন  না কেন। তাঁহারা যদি মরিতেন তবে উত্তরাধিকারসূত্রে আমরা নিজেদের মরিবার শক্তি সম্বন্ধে আস্থা রাখিতে পারিতাম। তাঁহারাও নিজে না খাইয়াও ছেলেদের অন্নের সংগতি রাখিয়া গেছেন, শুধু মৃত্যুর সংগতি রাখিয়া যান নাই। এত বড়ো দুর্ভাগ্য, এত বড়ো দীনতা আর কী হইতে পারে।"

কবি আবার লিখিয়াছেন "বাঙালী আজকাল লোকসমাজে বাহির হইয়াছে। মুশকিল এই যে, জগতের মৃত্যুশালা হইতে তাহার কোনো পাস নাই। সুতরাং তাহার কথাবার্তা যতই বড়ো হোক, কাহারও কাছে সে খাতির দাবি করিতে পারে না। এইজন্য তাহার আস্ফালনের কথায় অত্যন্ত বেসুর এবং নাকিসুর লাগে। না মরিলে সেটার সংশোধন হওয়া শক্ত।"
********************************************************
ক্ষাত্রবীর্য্যহীন ভীরু বলিয়া নূতন রাজা ইংরাজ তাহার সামরিক খাতায় বাঙ্গালীর নাম কাটিয়া দিয়াছিল। ইংরাজী শিক্ষিত বাবুর দল, সাহেব মুখনিঃসৃত অপবাদ নীরবে সহ্য করিয়াছে, এমন কি নির্লজ্জের মত তাহা সমর্থনও করিয়াছে। বিজয়ী ইংরাজ কখনো বাঙ্গালীর মুখে অভিনেতাসুলভ অপরিমিত স্পর্দ্ধাবাক্য শুনিয়া চিন্তিত বা চঞ্চল হয় নাই, - কার্য্যে যে বাঙ্গালী কিছুই করিতে পারে না, এই সিদ্ধান্ত সকলেরই মনে বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু বাঙ্গালী চরিত্রের মধ্যেও যে প্রচণ্ড দুঃসাহসিকতার বীজ লুক্কায়িত আছে, - যাহা সমস্ত পারিপার্শ্বিক অসহায় অবস্থাকে উপেক্ষা করিয়া অসাধ্য সাধনের জন্য তেজোদৃপ্ত মস্তক দাঁড়াইতে পারে, যাহা অত্যাচার, শাসন, পীড়নের ভয়কে তুচ্ছ করিয়া মরণরঙ্গে মাতিতে পারে, নিশ্চিত মৃত্যু বা ততোধিক ভয়ঙ্কর কঠোর শাস্তির সম্মুখে দাঁড়াইয়া যাহা ব্যাঙ্গহাস্যে আত্মগৌরব রাখিতে পারে - সেই অপ্রেমেয় সাহস ও শৌর্য্য প্রকাশ করিয়া বিংশ শতাব্দীর প্রথম প্রভাতেই যাহারা বাঙ্গালীর দীর্ঘ দুই শতাব্দীর কলঙ্ক স্খলন করিয়াছেন, এমনকি রাজপুরুষগণেরও বিস্মিত শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিয়াছিলেন, -- যতীন্দ্রনাথ তাঁহাদেরই মুকুটমণি।


Monday, 12 February 2024

জ্যোতিষশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞান - ডঃ শ্যামল চক্রবর্তী

 আমাদের যে চারটি 'বেদ' রয়েছে তার কোনটিতেই 'জ্যোতিষী'র কথা লেখা নেই। চারটে 'বেদ' বাদ দিয়ে 'বেদাঙ্গ' রয়েছে। দর্শন রয়েছে। 'ব্রাহ্মণ' ও 'সংহিতা'র কথাও আমরা জানি। এসবই খ্রিস্ট ধর্ম দু'হাজার থেকে পাঁচশো বছর আগের কথা। বেদসাহিত্যের কোথাও আপনি জ্যোতিষী, কোষ্ঠি, ঠিকুজি এসব কথা পাবেন না। সার্কুলার দাতারা বলেছেন, পুরোনো ভারত জানতে 'বৈদিক জ্যোতিষ' পড়ুন। আমরা বলছি, বেদসাহিত্যে জ্যোতিষীর ব্যাপার স্যাপার নেই বলেই ভারতীয় হিসেবে আমরা গর্বিত। আমাদের একটি বেদাঙ্গের নাম 'জ্যোতিষাম অয়নম'। পাতা খুলে দেখবেন। খ-গোলের কথা আছে। জ্যোতিষ্কদের চলাফেরার কথা আছে। খ-গোল মানে 'পৃথিবী' অনেকেই জানেন। গ্রহ, ভাগ্য, হস্তরেখা এসব কথার চিহ্নমাত্র নেই।

হ্যাঁ, ভারতীয় হিসেবে গর্ব হয় যখন দেখি চীন মিশর গ্রিস সকল সভ্যতায় 'জ্যোতিষী'র কথাবার্তা থাকলেও ভারতীয় সভ্যতায় তার ছায়া মাত্র নেই। গ্রিক সভ্যতা বাদ দিলে বাকি সব সভ্যতায় এই জ্যোতিষচর্চা রাজা রাজড়াদের বাড়ির বিষয় ছিল। সব রাজাই একজন বা একের বেশি রাজজ্যোতিষী রাখতেন। কখন যুদ্ধে যেতে পারলে জয় হবে, কখন সিংহাসনে রাজপুত্রের অভিষেক হবে, কখন রাজকন্যার বিয়ে দিলে ভালো হয় - এসব কথা রাজজ্যোতিষীদের গোনা গুনতি করে বলতে হত। সাধারণ মানুষ 'রাজাউজির'দের ব্যাপার স্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। গ্রিক সভ্যতায় এসে আমরা দেখতে পেলাম 'জ্যোতিষ' বিষয়টা একরকমের আটপৌরে চরিত্র অর্জন করেছে। সাদামাটা মানুষেরাও 'জ্যোতিষ' নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। ভালোমন্দ জানতে জ্যোতিষীদের কাছে যাচ্ছেন। নিশ্চয়ই সেই যুগে কোন কারসাজি ছিল। রাজার বাড়ির আচার বাইরে ছড়াতে পারলে ব্যবসা বাড়ে অনেক। বুদ্ধি খাটিয়ে একদল মানুষকে এই কাজ করতে হয়েছে। যেখানে মানুষের বসতি সেখানেই জ্যোতিষের আলোচনা শুরু করতে হয়েছে। বিজ্ঞানের ইতিহাস পড়লে আমরা দেখি, গ্রিস দেশের পণ্ডিতেরা একটা বিষয়ে খুব অহঙ্কার করেন। কি বিষয়? গ্রিক সভ্যতার আগে নাকি পৃথিবীর কোথাও 'বিজ্ঞান' ছিল না। কি ছিল তবে? ওঁরা বলেন, 'জ্ঞান' ছিল, 'বিজ্ঞান' ছিল না। আমরা জানি, কথা দুটোর মানে আলাদা। 'জ্ঞান' বলতে কত কি হতে পারে। 'বিজ্ঞান' বললে যা খুশি হয় না। নিয়মকানুন মেনে কথা বলতে হয়। আমরা এখানে কথাটার সত্যি-মিথ্যে যাচাই করছি না। তবে বলতে চাইছি, গ্রিক সভ্যতার শেষ দিকে ছিল ব্যাবিলন সভ্যতা। ব্যাবিলন শহরকে মাঝে রেখে গড়ে উঠেছিল। সেই সভ্যতারই একজন রাজা ছিলেন আলেকজাণ্ডার। আলেকজাণ্ডার খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ সালের কাছাকাছি আমাদের দেশ আক্রমণ করেন। তখনই ওঁদের দেশ থেকে এই দেশে 'জ্যোতিষবিদ্যা'র আমদানি ঘটে। আগে বলেছি আমরা, গ্রিক সভ্যতার আমলে জ্যোতিষচর্চা ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ে। কোষ্ঠি তৈরি শুরু হয়।

বাইরে থেকে কোন কিছু এলেই তা বেঁচে থাকে না। তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। আমরা দেখছি, প্রথম যে নামকরা মানুষ 'জ্যোতিষ' বাঁচিয়ে রাখতে উদ্যোগী হয়েছেন তিনি বরাহমিহির। ছয় শতকের চরিত্র বরাহমিহির। পণ্ডিত মানুষ। নানা বিষয়ে তাঁর বই রয়েছে। গণিত, জ্যোতিষ, ভূগোল এমনকি প্রাণিবিদ্যাতেও তাঁর খুব উঁচুমানের বই ছিল। তাঁর জীবনের কথা বলতে গেলে দুটো বইয়ের নাম করতে হয়। 'পঞ্চসিদ্ধান্তিকা' আর 'বৃহৎসংহিতা'। প্রথম বইটিতে হিন্দু জ্যোতির্বিদ্যার নানা ভাবনা চিন্তা রয়েছে। হিন্দু জ্যোতির্বিদ্যার পাঁচটি শাখা। পৌলিশা, রোমক, বশিষ্ঠ, সূর্য আর পৈতামহ। এদের এক একটিকে আমরা 'সিদ্ধান্ত' বলি। তাই একসাথে বরাহমিহির নাম দিয়েছিলেন 'পঞ্চসিদ্ধান্তিকা'। তবে একটা কথা বলা দরকার। পৌলিশা ও রোমক সিদ্ধান্তে গ্রিক ভাবনার যথেষ্ট প্রভাব দেখা যায়। এমন কথা বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাও বলেছেন। বরাহমিহির তাঁর লেখায় আমাদের দেশের আর্যভট্ট ছাড়াও লাটদের সিংহাচার্য, প্রদ্যুম্ন ও বিজয়নন্দীর কথা বলেছেন।

আমাদের দেশের বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার ১৬ই জুন ২০০১ তারিখের 'ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি' পত্রিকায় পরিষ্কার লিখেছেন, 'বৈদিক জ্যোতিষবিদ্যা 'বৈদিক' নয়, 'বিজ্ঞান'ও নয়। আমাদের বেদের কোথাও এই বিষয়ে কথা নেই। বরং বলা যায় আর্যভট্ট প্রথম (পঞ্চম শতাব্দ) থেকে শুরু করে ভাস্কর দ্বিতীয় (দ্বাদশ শতাব্দ) পর্যন্ত আমাদের জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা ঈর্ষণীয় মৌলিকত্বের সাক্ষর রেখেছে।

দ্বিতীয় যে বইটির কথা আমরা বলব, বোধ হয় বরাহমিহির সেই বই না লিখলে আরও ভালো করতেন। দুর্বলতাহীন একজন বড়ো মাপের বিজ্ঞানী হিসেবেই তাঁর নাম আলোচনা হত। যাই হোক, বইটির নাম আমরা বলেছি। 'বৃহৎসংহিতা'। ফলিত জ্যোতিষের বই। গ্রহের ফেরে মানুষের নানা রকমের ক্ষতি হয়। ক্ষতি এড়াতে গ্রহরত্ন ধারণ করতে হয়। বরাহমিহির কথাটা মানেন। তাই 'বৃহৎসংহিতা'য় নানা গ্রহরত্নের গুণাগুণের কথা ফলাও করে লিখলেন।