ষোড়শ শতকে পৃথিবীর প্রতি প্রতিটি মানুষ বিশ্বাস করত, অসুখের কারণ পাপের ফল বা অশুভ শক্তি। ষোড়শ শতকে সুইজারল্যান্ডের বেসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নশাস্ত্র ও ভেষজবিদ্যার অধ্যাপক ডাক্তার ফিলিপ্রাস অ্যাউরেওলাস প্যারাসেলসাস ঘোষণা করলেন - মানুষের অসুস্থতার কারণ কোনও পাপের ফল বা অশুভ শক্তি নয়, রোগের কারণ জীবাণু। পরজীবী এই জীবাণুদের শেষ করতে পারলেই নিরাময় লাভ করা যাবে।
প্যারাসেলসাসের এমন উদ্ভট ও ধর্মবিরোধী তত্ত্ব শুনে তাবৎ ধর্মের ধারক-বাহকরা 'রে-রে' করে উঠলেন। এ কী কথা! রোগের কারণ হিসেবে ধর্ম আমাদের যুগ যুগ ধরে যা বলে এসেছে, তা সবই কি একজন উন্মাদ অধ্যাপকের কথায় মিথ্যে হয়ে যাবে? শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পবিত্র ধর্মনায়কেরা যা বলে এসেছেন, ধর্মগ্রন্থগুলোতে যা লেখা রয়েছে, যুগ যুগ ধরে কোটি কোটি মানুষ যা বিশ্বাস করে আসছে, সবই মিথ্যে? সত্যি শুধু প্যারাসেলসাসের কথা?
প্যারাসেলসাসকে হাজির করা হল 'বিচার' নামক এক প্রহসনের মুখোমুখি। ধর্মান্ধ বিচারকরা 'রোগের কারণ জীবাণু' বলার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিল। প্যারাসেলসাস সেদিন নিজের জীবন বাঁচাতে নিজের দেশ সুইজারল্যান্ড ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। সেদিনের জনসমর্থন পুষ্ট ধর্মীয় সত্য আজ শুধু সুইজারল্যান্ডবাসীদের মন থেকেই নয়, সারা পৃথিবীর শিক্ষার আলো দেখা মানুষদের মন থেকেই নির্বাসিত।
ইতিহাস বার বার আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছে, যুক্তি ও প্রমাণের কাছে সংখ্যাগুরুর মতামতের দাম এক কানা-কড়িও নয়।
*************************************
আর্য আগমনের পর তারা উপজাতিদের কাছ থেকে গবাদি পশু অপহরণের জন্য আক্রমণ চালাত। আর্যভাষীরা ঘোড়া ব্যবহার করার জন্য যুদ্ধে জিতত। তখন শুধু গবাদি পশু নয়, পরাজিতদের বন্দি করত। এই বন্দিরাই 'দাস' বা 'পনি' বলে সম্বোধিত হত। উপজাতির গায়ের রং ছিল কালো, নাক ভোঁতা। আর আর্যভাষীরা ছিল ফর্সা ও চোখ নাক তীক্ষ্ণ। এই দুই শ্রেণির গাত্রবর্ণ থেকেই বর্ণ প্রথার সূচনা করে আর্যভাষীরা। (ভারতবর্ষের ইতিহাস, রোমিলা থাপার, ওরিয়েন্ট লংম্যান, পৃষ্ঠা ১৮)।
এই দাসপ্রথা চালুর আগেই আর্যভাষীদের মধ্যে শ্রেণিবিভাজন ছিল। তখন ছিল তিনটি শ্রেণি। শীর্ষে ছিল রাজা। তারপর শ্রেণি অনুসারে ক্ষত্রিয় যোদ্ধারা, দ্বিতীয় স্থানে ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত। তৃতীয় স্থানে ব্যবসায়ী বা বণিক অথবা বৈশ্যরা।
দাসরা আসার পর তাদের চতুর্থ স্থান বা সর্বনিম্ন স্থান দেওয়া হল। বল হল - এরা 'শূদ্র'।
*************************************
নবি মোহাম্মদের জীবনে নারী
মোহাম্মদ ও খাদিজার বিবাহিত জীবন ২৫ বছর স্থায়ী হয়েছিল। খাদিজা যখন মারা যান তখন তাঁর বয়স ৬৫ বছর এবং মোহাম্মদের ৫০ বছর। এই দীর্ঘ ২৫ বছরের বিবাহিত জীবনে তিনি ছিলেন একগামী, এক পত্নীব্রত পতি।
খাদিজার মৃত্যুর পর নবি মোহাম্মদ ১৩ বছর বেঁচেছিলেন। এই ১৩ বছরে আরও ১০টি বিয়ে করেছিলেন।
খাদিজা মারা যাওয়ার এক মাসের মধ্যে জাময়াকে বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন বিধবা। কয়েক মাসের মধ্যে তিনি তৃতীয় বিয়ে করেন। পাত্রী নবির ঘনিষ্ঠ বন্ধু খলিফার আবুবকরের ৬ বছরের অতি সুন্দরী কন্যা। যৌন মিলন ছাড়া ইসলাম ধর্মে বিয়ে বৈধ নয়। কন্যার নাম আয়েশা। আয়েশার ৯ বছর বয়সে নবি তার সঙ্গে যৌন মিলন ঘটান এবং বিয়ে সিদ্ধ হয়। মোট ১০টি বিয়ে করেছিলেন নবি।
আবার T.P.Huges, 'Dictionary of Islam' পৃষ্ঠা ৪০০ বলা হয়েছে মোহাম্মদের ২২টি পত্নী ছিল। যাক ১০ পত্নী ধরলেও তাঁর দুজন উপপত্নীও ছিল। একজন ইহুদি। নাম রায়হানা। অন্যজন খ্রিস্টান মারিয়া।
মোহাম্মদের একটি বিয়ে নিয়ে বিতর্ক আছে। নীতিবোধ বহির্ভূত কি না - এই নিয়ে বিতর্ক।
জায়েদ ছিলেন মোহাম্মদের পালিত পুত্র। পালিত পুত্র হিসেবে গ্রহণ করার পর জায়েদ পরিচিত হন জায়েদ বিন মোহাম্মদ বলে। জায়েদের বিয়ে হয় জয়নব-এর সঙ্গে। একদিন নবী জয়নবকে দেখে অত্যন্ত কামার্ত হয়ে ওঠেন। জায়েদ পিতার ইচ্ছা পূরণ করতে জয়নবকে তালাক দেন। জয়নবকে বিয়ে করার পক্ষে বাধা ছিল আরবের সামাজিক প্রথা। পালিত পুত্রের বউকেও শ্বশুর বিয়ে করতে পারেন না।
শেষ পর্যন্ত মোহাম্মদ আল্লাহর প্রত্যাদেশ পেলেন। নবির জন্য আল্লাহর প্রত্যাদেশ, প্রাক্তন পুত্রবধূকে বিয়ে করতে পারেন। নবি এবার প্রাক্তন পুত্রবধূকে বিয়ে করে নিলেন।
*************************************
'ঈশ্বরই সব কিছুর নিয়ন্তা' - বলে যারা বিশ্বাস করেন এবং সে কথা প্রচারও করেন, তাঁরা কি সত্যি সত্যিই কথায়-কাজে একাত্ম মানুষ? তাঁরা কি অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে যান না?
ঈশ্বরকে সব কিছুর নিয়ন্তা বলে স্বীকার করলে চিকিৎসা শাস্ত্রকে অবশ্যই অস্বীকার করতে হয়! কারণ ঈশ্বরের ইচ্ছেতেই রোগ ও তার মুক্তি হলে চিকিৎসা শাস্ত্রের রোগমুক্তির ক্ষেত্রে কোনও ভূমিকাই থাকতে পারে না।
আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা অবশ্য বড়ই করুণ। বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সার্টিফিকেট পাওয়া ধর্মগুরু গৌরাঙ্গ ভারতী সবার রোগ গ্যারান্টি দিয়ে সারাবার দাবি করলেও, নিজের হেঁচকি রোগ (সব সময়ই হেঁচকি ওঠা) সারাতে তা'বড় তা'বড় কত যে ডাক্তার দেখিয়েছিলেন তার ইয়ত্তা নেই। জনসিদ্ধ বালক ব্রহ্মচারী দুনিয়ার মানুষের ক্যান্সার থেকে এইডস পর্যন্ত সরিয়ে নিজের অসুখ সারাতে হাজির হয়েছিলেন কোঠারি হসপিটালে। সাঁইবাবা সবার রোগই সারাতেন, নিজের রোগ সারাতে পাড়ি দিতেন বিদেশে। আজ পর্যন্ত যত অবতার দেখেছি, সব অবতারই রোগমুক্তির জন্য রোগীকে ঈশ্বরের ওপর ভরসা রাখতে বললেও নিজেরা ভরসা রাখেন ঈশ্বরের পরিবর্তে ডাক্তারের ওপর। কেন এই দ্বিচারিতা?
ঈশ্বর বিশ্বাসীদের প্রতি অনুরোধ, অসুখ করলে আপনারা আর ডাক্তারের কাছে না গিয়ে ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পন করে ঈশ্বরের বিশ্বাসের প্রতি সততা দেখান। তাতে আপনার সততাই শুধু প্রমাণিত হবে না, হাসপাতালগুলোতে ভিড় কমবে, সরকারও হাঁফ ছেঁড়ে বাঁচবেন।
ঈশ্বরবাদীদের প্রশ্ন - বহু বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী ঈশ্বরে বিশ্বাসী করেছিলেন। এঁদের মধ্যে সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী, আইনস্টাইন থেকে প্যালভেন-এর মতো বহু শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানীরা রয়েছেন। তাঁদের এই ঈশ্বরে বিশ্বাসকে উড়িয়ে দেবেন কোন যুক্তিতে?
এটা ঠিক, বিশ্বের বহু বরেণ্য বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রেই তাঁদের নবতম আবিষ্কারকে, তাঁদের দেওয়া নবতম তত্ত্বকে বিজ্ঞানীরাই সবচেয়ে বেশি সন্দেহের চোখে দেখেছেন। শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হয়েছে। সন্দেহ করা, প্রশ্ন তোলা বিজ্ঞানের কাজ। প্রশ্নহীন ভাবে কোনও কিছুকে মেনে নেওয়া স্পষ্টতই বিজ্ঞান-বিরোধী কাজ। সন্দিগ্ধ বিজ্ঞানীরা সন্দেহ নিরসন শেষে ওই সব বরেণ্যদের মতামতকে শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
আজ কিছু বিজ্ঞানীদের ঈশ্বরে অস্তিত্বের প্রতি সন্দেহে আদৌ প্রমাণিত হয় না যে, ঈশ্বর-বিশ্বাস ভ্রান্ত এক অন্ধবিশ্বাস। বিজ্ঞানীদের সন্দেহই যদি শেষ কথা হত, তবে নিউটন থেকে শুরু করে ফ্র্যাঙ্ক জে টিপলার পর্যন্ত বহু বিশিষ্ট বিজ্ঞানীই ঈশ্বরে বিশ্বাসী হতেন না। বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু থেকে জে. বি. এস. হ্যালডেন পর্যন্ত ঈশ্বরতত্ত্বে, আধ্যাত্মবাদে ও অলৌকিকতায় আস্থাশীল হতেন না। সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ঈশ্বরে গভীর প্রত্যয় ব্যক্ত করতেন না। এই যুক্তি দেন কিছু ঈশ্বরে বিশ্বাসী অধিক।
বিজ্ঞান যেহেতু পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়েই সিদ্ধান্তে পৌঁছয়, তাই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আসে পরীক্ষার প্রশ্ন। এসবের পরিবর্তে ব্যক্তি বিশ্বাসকে মর্যাদা দিতে গেলে, ব্যক্তি-বিশ্বাস বা ব্যক্তির দাবিকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিলে বিজ্ঞান আর বিজ্ঞান থাকত না। পরীক্ষিত সত্যকে বিজ্ঞান মর্যাদা দেয়। ঈশ্বর বিশ্বাসীরা যেদিন ঈশ্বরের সংজ্ঞা দিতে পারবেন, পারবেন সেই সংজ্ঞায় বাঁধা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রমাণ করতে, সেদিন নিশ্চয়ই বিজ্ঞান ঈশ্বরের অস্তিত্বকে মেনে নেবে।
আমরা নিশ্চয়ই এইসব ঈশ্বর-বিশ্বাসী ও আধ্যাত্মবাদে আস্থাশীল বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদদের মূলগতভাবে অশ্রদ্ধেয় মনে করি না, বা আধ্যাত্মবাদী সংস্কৃতি প্রচারের ষড়যন্ত্রের অংশীদার বলেও মনে করি না। বরঞ্চ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে তাঁদের কাজকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করি ও স্মরণ করি। আমরা জানি তাঁদের এই সীমাবদ্ধতার পেছনে রয়েছে তাঁরা যে সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছেন, সেই পরিবেশের প্রভাব।
স্বীকার করছি, শুধু এদেশের নয়, পৃথিবী জুড়েই বহু বিজ্ঞান পেশার মানুষই ঈশ্বর-বিশ্বাসী। আবার এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই, প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই সব বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের বিশ্বাসের পেছনে রয়েছে জন্ম থেকে লালিত যুক্তিহীন এক অন্ধ বিশ্বাস। ফলে তাঁরা একই সঙ্গে পেশায় বিজ্ঞানী কিন্তু মানসিকতায় বিজ্ঞান-বিরোধী। এমন স্ববিরোধিতার কারণ, আমাদের সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশ।
আপনার আশেপাশে একটু তাকান। দেখতে পাবেন প্রায় প্রতিটি পরিবারের শিশুরাই বেড়ে উঠছে ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার মধ্যে, ঈশ্বর-বিশ্বাসের মধ্যে, আত্মার অমরত্বে বিশ্বাসের মধ্যে। শিশুকে পরিবারের মানুষরা শেখান - "ঠাকুর নম কর"। শিশু দেখে 'রোজা' 'নামাজ'। শেখে ফি হপ্তায় গির্জায় যেতে। স্কুলে পড়ে ঠাকুর-দেবতা, আল্লাহ, যিশুর নানা অলৌকিক কাহিনি! সিনেমায়, টিভিতে, যাত্রায় কত না ঈশ্বর-তত্ত্বের, ভুতুড়ে কাহিনির, অলৌকিক ব্যাপার স্যাপারের ছড়াছড়ি। পরিচিত হয়, নানা ধর্মের নানা আচার-আচরণের সঙ্গে। শোনে নানা ভরের কাহিনি। কোথাও ভর করে মনসা-শীতলা-কালী বা মহাদেব, কোথাও বা ভর করে জিন কি ফেরেস্তা। ভরগ্রস্তদের প্রতি বিশ্বাস নিয়ে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমান। তাঁদের বিশ্বাস, তাঁদের মুখের কাহিনি অন্যকেও প্রভাবিত করে। প্রভাবিত করে ধর্মীয় গ্রন্থ, প্রচারমাধ্যম, ধর্মীয় উন্মাদনা। এমনই পরিবেশের মধ্যে প্রায় সকলেই বেড়ে উঠেছে, তা সে ভাল ছাত্রই হোক বা খারাপ ছাত্রই হোক। ফলে লেখাপড়ায় ভাল ছেলেমেয়েরাও যুক্তিহীন ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার মধ্যেই পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করার সুবাদে সাধারণভাবে দৌড়ায় ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশুনো শেষ করতে। আমাদের এই অনিশ্চয়তায় ভরা সমাজে ভবিষ্যতে আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা এখনও এইসব বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়াশুনো শেষ করে বেরলে বেশি বলেই, ভাল ছাত্রছাত্রীদের মা-বাবারা তাঁদের এসব লাইনে পড়তে ঠেলে দেন। ফলে এঁরা বিজ্ঞান শিক্ষা শুরু করে ধর্মবিশ্বাসে গা ডুবিয়ে রেখেই যখন সাফল্যের সঙ্গে এঁরা ছাত্রজীবন শেষ করে। কর্মজীবনে প্রবেশ করেন তখন এঁরা - বিজ্ঞানেও থাকেন, ধর্মেও থাকেন। এঁরা জীবনের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করেন না। বিজ্ঞান এঁদের অনেকের কাছেই শুধুই একটা পেশা থেকে যায়, যেমন পেশা জমির দালালি বা আলু-পটলের ব্যবসা।
এঁদের সকলেই যে বিজ্ঞানকে শুধু একটা 'পেশা' হিসাবে গ্রহণ করে সুখী থাকেন, তেমন নয়। ব্যতিক্রমী কেউ কেউ বিজ্ঞানকে 'জীবনের শ্বাস-প্রশ্বাস', 'বেঁচে থাকার আনন্দ' হিসেবেই গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁদেরও অনেকের মধ্যে থেকে যায় আজন্ম-লালিত ঈশ্বর-বিশ্বাস থেকে শুরু করে অনেক বিষয়েই অন্ধ-বিশ্বাস।
এইসব ঈশ্বর-বিশ্বাসী বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদদের কেউ যেদিন বিশ্বাসের গণ্ডি পেরিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে কোনও প্রমাণ হাজির করতে পারবেন, সেদিন তাঁদের মতকে নিশ্চয়ই আমরা মেনে নেব। কিন্তু তার আগে শুধুমাত্র 'বিখ্যাত বিজ্ঞানীর বিশ্বাস' বলে মেনে নিই কী করে? তেমন করতে হলে বহু অস্তিত্বহীন বিষয়কে এক্ষুনি-এক্ষুনি আমাদের মেনে নিতে হয়। বিজ্ঞানাচার্য অলৌকিকের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন, এই দোহাই দিয়ে কি আমরা তবে অলৌকিকের মতো অলীক, অন্ধ বিশ্বাসকে মেনে নেব? হ্যালডেন টেলিপ্যাথিতে বিশ্বাস করতেন, বিশ্বাস করতেন আত্মার অমরত্বে। তাই বলে কি আমরা তাঁর এইসব অদ্ভুত ছাই-পাঁশ চিন্তায় বিশ্বাস করব? যে কারণে তাঁদের এই অন্ধ-বিশ্বাসকে বিজ্ঞান মানে না, যুক্তি মানে না, আমরা মানি না, সেই একই কারণে তাঁদের ঈশ্বর বিশ্বাসও বিজ্ঞান মানে না, যুক্তি মানে না, আমরা মানি না।
একটি বিখ্যাত বাংলা পত্রিকায় সম্পাদকীয় কলমে ঈশ্বর বিশ্বাসের পক্ষে লেখা হয়েছিল, "চিকিৎসক অস্ত্রোপচারের আগে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানান, বিজ্ঞানী রকেটের মহাকাশ যাত্রার সাফল্য কামনায় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন এ ঘটনা বিরল নয়।"
কিন্তু এই ধরনের কিছু ঘটনা কখনই ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ নয়। বড় জোর এটুকুই প্রমাণিত হতে পারে, ওই বিজ্ঞানীরা ঈশ্বরে বিশ্বাসী। কিন্তু তাতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হচ্ছে কি?
*************************************
ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ কি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে শেখায়?
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ধারক-বাহকরা, ধর্মীয়বেত্তারা, বুদ্ধিজীবী ধর্মগুরুরা অধুনা প্রচার শুরু করেছেন - প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে শেখায়। ধনী-দরিদ্রের বিভেদ ভুলিয়ে সকলকে একই গণউপাসনায়, গণপ্রার্থনায় মেলাতে পারে এবং মিলিয়ে থাকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বা ধর্মীয় সম্প্রদায়।
কিন্তু, এ তো কোনও কাম্য মিলন হতে পারে না! এ তো ধনী-দরিদ্রের বাস্তব বিভেদ মেটানোর কোনও পথ নয়! শোষক ও শোষিতের সম্পর্ক ভেঙে সাম্য প্রতিষ্ঠার কোনও দিশা নয়? এ তো অলীক বিশ্বাসের, ভ্রান্ত চেতনার ঐক্য! অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে, শোষিতদের ক্ষোভকে বের করে দিতেই এই ঐক্য। শোষিতদের ক্ষোভকে বিস্ফোরিত হতে না দেওয়ার স্বার্থে ঐক্য। এইঐক্য, এই আবেগময় ধর্মীয় গণজমায়েত প্রায়শই গণহিস্টিরিয়া তৈরি করে। এবং এ'জাতীয় গণহিস্টিরিয়া ব্যক্তিমানুষের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা-সমাজ চেতনা-সামাজিক দায়িত্ববোধকে গুলিয়ে দেয়, ভুল পথে চালিত করে। শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় ঐক্য ধনী-দরিদ্র শ্রেণির বৈষম্য বা অনৈক্যকে বাস্তবে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে অবাস্তব এক 'ছেলে-ভোলানো ললিপপ' ছাড়া আর কিছুই হয়ে ওঠে না।
বৈষম্যের অনৈক্যকে টিকিয়ে রেখে কখনই সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব নয়। এই ধরনের অনৈক্যের মধ্যেও ঐক্যের অলীক চিন্তা অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই উঠে এসেছে।
*************************************
ঈশ্বর অবিশ্বাসী প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ইতিহাস প্রাচীন। এই ঈশ্বরবাদ দেওয়া ধর্মকেও সমষ্টিগতরূপ দেওয়া হয়েছিল, সংঘের রূপ দেওয়া হয়েছিল বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম এমনই দুই ধর্ম যারা নিরীশ্বরবাদী এবং বেদবিরোধী হিসেবে প্রাচীন ভারতে প্রসিদ্ধ ছিল।
এই প্রসঙ্গে এটুকু মনে করিয়ে দিলে বোধ হয় একটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, চার্বাক দর্শনের নিরীশ্বরবাদী নাস্তিকতাবাদের সঙ্গে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের নিরীশ্বরবাদী নাস্তিকতাবাদের মৌলিক পার্থক্য ছিল।
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম নিরীশ্বরবাদী ও বেদবিরোধী হলেও এই ধর্মের প্রবক্তা চিন্তানায়করা মানুষের পার্থিব জীবনের অনিবার্য পরিণতি দুঃখময় বলে মনে করতেন। পীড়া-জরা-মৃত্যু ইত্যাদি দুঃখময় জীবন থেকে নিজেকে বাঁচাতে জীবন বিচ্ছিন্ন এক জীবনকে খুঁজতে চেয়েছিলেন। তাঁদের এমনই ত্যাগ ও তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে জীবনের উদ্দেশ্যকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা ছিল স্পষ্টতই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক।
চার্বাকবাদ নিরীশ্বরবাদী ও বেদবিরোধী অবশ্যই কিন্তু মানুষের পার্থিব জীবনের প্রতি চার্বাক দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যথেষ্ট ইতিবাচক। তাঁদের চিন্তার মধ্যে ছিল যুক্তি ও বিজ্ঞানমনস্কতার বীজ।
এই আলোচনার পর এ'কথা নিশ্চয়ই বলতে পারি, পৃথিবীর সব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ঈশ্বর বিশ্বাস ছিল না। পরন্তু কিছু কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ঈশ্বর বিশ্বাসকে কুসংস্কার বলে মনে করত।
*************************************
টেলিভিশন, রেডিও, সিনেমা, থিয়েটার, গান, নাচ, বৃহৎ পত্র-পত্রিকাগোষ্ঠী ও প্রকাশকরা বিশালভাবে আমাদের চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আমরা টেলিভিশনে কতটা মারদাঙ্গা দেখব, কতটা যৌনতা, কতটা ভক্তিরসে আপ্লুত হবে, ধর্মগুরুদের বাণীর দ্বারা কতটা আচ্ছন্ন হব, কতটা ভাগ্য-নির্ভর হব, কতটা ঈশ্বর বিশ্বাসী হব, কতটা ভূতে, "আদর্শ-নারীর গুণ -- পতিসেবা, পতির পরিবারের সেবা, লজ্জা" -- এই ধরণের নীতিবোধ কতটা আমাদের মাথায় ঠাসব -- এ সবই ঠিক করে দিচ্ছে বিভিন্ন ধনকুবের গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রশক্তি। আমরা কী ধরণের গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস কবিতা পড়ব -- তা ব্যাপকভাবে নির্ধারিত করে দিচ্ছে বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠী ও প্রকাশকরা। প্রচারমাধ্যমগুলোর সংবাদ সরবারহের 'নিরপেক্ষ' মোড়কের আড়ালে থাকে একটি একপেশে মূল্যবোধ ও মতাদর্শগত কর্তৃত্বকে সাধারণ মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়ার দৃঢ় প্রচেষ্টা। এই একপেশে মূল্যবোধ কাদের স্বার্থ-রক্ষায় সহায়ক হবে? অর্থাৎ, কোন শ্রেণির স্বার্থরক্ষায় সহায়ক হবে? অবশ্যই প্রচারমাধ্যমের মালিক যে শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেন, সেই শ্রেণির। কারণ প্রচারমাধ্যমগুলোর নীতি মালিকের শ্রেণিচরিত্রের ওপর নির্ভর করে।
*************************************
মনুর বিধানে নারী-পুরুষ দুই মেরু
এইসব ধর্মগুলো কতটা মানবিক, কতটা মানবতার মূর্ত প্রতীক, তা জানতে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে ধর্মের বিধানগুলোর দিকে।
হিন্দু ধর্মীয় বিধানে নারী জন্ম-পরাধীন, চির-পরাধীন, মনুর বিধানে [৯:৩] আছে :
পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে।
রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি।।
অর্থাৎ নারীকে -
পিতা রক্ষা করবে কুমারিকালে, স্বামী রক্ষা করবে যৌবনে।
বার্ধক্যে রক্ষা করবে পুত্ররা, স্ত্রী স্বাধীনতায় যোগ্য নয়।।
হঠাৎ মনুর বিধান টানলাম কেন? মনুর বিধান কি হিন্দু ধর্মীয় বিধান? যেমন মুসলিম ধর্মীয় বিধান কোরআন বা হাদিস? এমন প্রশ্নের উত্তরে বলছি - হ্যাঁ, তাই। মনু কে? হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীরা মনে করেন, মনু কোনও রমণীর গর্ভজাত নন, ব্রহ্মার দেহ থেকে উদ্ভূত। এই হেতু তিনি ব্রহ্মাপুত্র বলে বিবেচিত হওয়ার পাশাপাশি 'স্বয়ম্ভূ' মনু বলেও পরিচিত। মনুর স্ত্রী শতরূপা, ছেলে প্রিয়ব্রত ও উত্তানপাদ। কন্যা - আকুতি, দেবহূতি ও প্রসূতি। এঁদের ছেলেমেয়েদের থেকেই নাকি মানুষ বা মানবজাতির বিস্তার। মনুর বংশধর বলেই নাকি এই প্রাণীদের নাম হয়েছিল 'মানুষ' বা 'মানব'।
মনু স্মৃতিশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন ব্রহ্মার কাছে। এই স্মৃতিশাস্ত্রই ধর্মশাস্ত্র বা প্রাচীন আইনের বিধান। অর্থাৎ হিন্দু আইনের বিধান ছিল সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মারই চিন্তার ফসল।
মনুর বিধানে মানুষ বিভক্ত হয়েছিল সরাসরি দুটি ভাগে - 'পুরুষ' ও 'নারী'। পুরুষকে প্রভুর ভূমিকায় এবং নারীকে ক্রীতদাসীর চেয়েও অধম, ধর্ষিতার চেয়েও অত্যাচারিতা ও গৃহপালিত পশুর চেয়েও হীন ভূমিকায় নামিয়ে এনেছিল মনুর আইন অর্থাৎ হিন্দু ধর্মীয় আইন।
মনুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলো একইভাবে নারীকে চূড়ান্তভাবে শোষণ করতে নানা উপদেশ প্রয়োগ করেছে, নানা নীতিকথার নামে দুর্নীতি ছড়াতে চেয়েছে।
শিক্ষা আনে চেতনার মুক্তি, যা দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে বিবেচনায় মনুষ্যত্বের ও মানুষের চরম শত্রু মনু বিধান দিলেন তাঁর বিখ্যাত মনুসংহিতায় [২:৬৭]:
বৈবাহিকো বিধিঃ স্ত্রীণাং সংস্কারো বৈদকঃ স্মৃতঃ।
পতিসেবা গুরৌবাসো গৃহার্থোহাগ্নি পরিক্রিয়া।।
...
অর্থাৎ:
বিয়েই নারীর বৈদিক উপনয়ন।
পতিসেবাই গুরুগৃহবাস, গৃহকর্মই হোমস্বরূপ অগ্নিপরিচর্যা।।
বিধানের এখানেই শেষ নয়। মনু আরও বলেছেন [৫:১৫৪], পতি সদাচারহীন, পরস্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কযুক্ত বা গুণহীন হলেও সতী স্ত্রী সেই পতিকে দেবতার মতোই পুজো করবে।
তাহলে হিন্দু নারীর বিনোদন কি শুধুই নানা ব্রতপালন ও উপবাস ঘিরেই আবর্তিত হবে?
না, ব্রতপালন, উপবাসের স্বাধীনতা নারীকে দেননি মনু। তাঁর বিধানে আছে [৫:১৫৫] স্ত্রী'র স্বামী ছাড়া পৃথক যজ্ঞ নেই, পতির অনুমতি ছাড়া ব্রত বা উপবাস নেই। নারী স্বর্গে যেতে পারে কেবলমাত্র স্বামী-সেবার সাহায্যেই।
হিন্দু সমাজে পুরুষরা এভাবে পুরুষরা এভাবে নিজেদের লাম্পট্য, অসদাচরণ ও অত্যাচারকে নারীদের কাছে শুধুমাত্র প্রতিবাদহীনভাবে গ্রহণীয় করেন, নিজেদের দেবতার আসনে বসিয়েছে ধর্মের বিধান খাড়া করে।
হিন্দুধর্মের বিভিন্ন বিধানে পদে পদে পুরুষের লাম্পট্যকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। পুরুষের লাম্পট্যকে নীতিগতভাবেই গ্রহণ করা হয়েছে। তৈত্তিরীয় সংহিতায় [৬/৬/৮৫] বলা হয়েছে, "যজমান, দীক্ষার দিনে গণিকাসাহচর্য বর্জন করবেন, তার পরদিন পরস্ত্রীর সাহচর্য এবং তৃতীয় দিন নিজ স্ত্রীর সাহচর্য বর্জন করবেন।" অর্থাৎ দীক্ষার দিনেও পরস্ত্রীর সাহচর্য বৈধ ছিল। দীক্ষার দিন ছাড়া অন্যান্য দিন গণিকা গমনও বৈধতার ছাড়পত্র পেয়েছিল এবং গণিকাগমন পুরুষের কাছে কখনই দোষণীয় বা লজ্জার বলে চিহ্নিত হয়নি। বরং চিহ্নিত হয়েছিল পৌরুষের প্রতীক হিসেবেই।
মনুসংহিতায়, অর্থাৎ মনুর বিধানে [৯:৪] বলা হয়েছে, নিঃসন্তান স্ত্রীকে বিয়ের দশ বছর পর ত্যাগ করা যায়, যে স্ত্রী শুধুমাত্র কন্যাসন্তানের জন্ম দেয় তাকে ত্যাগ করা যায় বারো বছর পরে, মৃত সন্তানের জন্মদানকারী স্ত্রীকে ত্যাগ করা যায় পনেরো বছর পরে।
সন্তানের জন্ম দেওয়ার অক্ষমতার কারণে স্বামীকে কিন্তু ত্যাগ করার কোনও বিধান নেই হিন্দুশাস্ত্রে।
মনু [৯:৪] ঝগড়ুটে স্ত্রীকে তক্ষুনি ত্যাগ করার অধিকার দিয়েছেন। কিন্তু ঝগড়ুটে শুধু নয়, অত্যাচারী স্বামীকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করতে বলেছেন এই মনু নামক অমানুষ এক পুরুষ। মানুষের শত্রু, মনুষ্যত্বের শত্রু এই মনুকে দেবত্ব আরোপ করেছে হিন্দু পুরুষ সমাজ। মনুকে ব্রহ্মার অংশ হিসেবে চিত্রিত করে মনুর বিধানকেই আইনের বিধান বলে মেনে নেওয়ার কথা বলেছেন হিন্দু শাস্ত্রকার, যাঁরাও মানুষ ছিলেন না অবশ্যই যাঁরা ছিলেন পুরুষ শ্রেণির প্রতিনিধি, যাদের হাতে ধর্মের আর এক নাম কখনই মনুষ্যত্ব হয়ে ওঠেনি, বরং যাঁদের হাতে মনুষ্যত্ব হয়েছে খণ্ডিত, লাঞ্ছিত, ধর্ষিত। শত সহস্র বছর পরে যখন ধর্মের নামে অধর্মের দিন শেষ হয়ে, মানুষের ধর্ম শুধু 'মনুষ্যত্ব' হওয়ার কথা, আমরা দেখতে পাচ্ছি, পৃথিবী জুড়ে ভোগবাদী তীব্র ক্ষুধা জাগিয়ে তোলার চেষ্টার পাশাপাশি ভাববাদী চিন্তাও মনুষ্যত্বের ধর্ষক ধর্মচিন্তাকে জনপ্রিয় করে তোলার সমস্ত রকম প্রচেষ্টা চলছে শাসক ও শোষক গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায়।
ইসলামের দৃষ্টিতে নারী
বৃহত্তর ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যে ইসলাম এসেছে সবচেয়ে পরে, অর্থাৎ আধুনিকতম। ইসলাম ধর্ম নারীকে দিয়েছিল কিছু অধিকার যা হিন্দু, খ্রিস্ট বা ইহুদি ধর্ম দেয়নি। তারপর শত শত বসন্ত এসেছে, বিদায় নিয়েছে। ইসলামি পুরুষতন্ত্রের ফাঁস আলগা না হয়ে আরও বেশি করে চেপে বসেছে। নারী আরও বেশি শৃঙ্খলিত হয়েছে। ইসলামি সমাজের বিবর্তনে আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রগতির পরিবর্তে সমাজ তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের আবর্তে।
ইসলাম ধর্মগ্রন্থ কোরআন-এ আছে [সুরা নিসা: ৩৪], "পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ আল্লা তাদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন ... স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও, তারপর তাদের শয্যা বর্জন কর এবং তাদের প্রহার কর।"
কেন প্রহার? স্ত্রী কি পুরুষের ক্রীতদাসী? নারী পুরুষকে সমান চোখে দেখে কোরআন নারীকে একসঙ্গে চারটি পতি গ্রহণের অনুমোদন দিতে পারেনি। অথচ পুরুষদের ক্ষেত্রে কোরআন বলছে [সুরা নিসা: ৩], "বিয়ে করবে নারীদের মধ্যে যাদের ভালো লাগে, দুই, তিন অথবা চার।"
ইসলাম ধর্ম নারীকে দেখেছে পণ্য হিসেবে। ভোগের সামগ্রী হিসেবে। মানুষ হিসেবে নয়। তারই পথ নির্দেশ রয়েছে কোরআন-এ। সেখানে বলা হয়েছে [সুরা বাকারা: ২২৩] "তোমাদের স্ত্রী তোমাদের শস্যক্ষেত্র; তাই তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে খুশি প্রবেশ করতে পার।"
মুসলিম শরীয়াত আইনে নারীকে কিছু আর্থিক ও সম্পত্তির অধিকার দিয়ে কেড়ে নিয়েছে নারীর মানুষ হয়ে ওঠার অধিকার। মুসলমান স্বামী চারটি স্ত্রীর ওপর যখন তখন যৌন অধিকার ফলাতে পারে, যার আর এক নাম অবশ্যই ধর্ষণ। মানবিকতার উপর ধর্ষণ। মুসলমান স্বামীর ধর্মীয় অধিকার রয়েছে কোনও কারণ না দেখিয়ে যে কোনও স্ত্রীকে শুধু তিনবার 'তালাক' নামক শব্দটি উচ্চারণ করে তাড়িয়ে দেওয়ার। মুসলমান স্বামী একসঙ্গে চার স্ত্রীকে নিয়ে ঘর করার অধিকারী। তাই পুরনো এক স্ত্রীকে তালাক দিয়ে নতুন স্ত্রী ঘরে এনে আইনি লাম্পট্য চালাতেই পারে। এমন তালাকের সুযোগে পুরুষ সম্ভোগ করতে পারে বহু নারী। এমন যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা ও স্বেচ্ছাচারিতা চালাবার পুরুষ সুলভ অধিকার যে ধর্ম দেয় সে ধর্ম অবশ্যই সুন্দর পৃথিবী গড়ার ধর্ম হতে পারে না।
ধর্মের সূত্র ধরে মরক্কোর সংবিধানে স্ত্রীকে স্বামীর আইনি ক্রীতদাসী করা হয়েছে। ও দেশের সংবিধানে বলা হয়েছে - স্ত্রী বাধ্য বা বিশ্বস্ত থাকবে স্বামীর কাছে, স্বামীর পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজনদের সন্মান করবে। স্ত্রী যদি তার মা-বাবাকেও দেখতে চায়, স্বামীর অনুমতি নিতে হবে। [The Sisterhood of Man' by Newland Kathleen: W.W.Norton & Co., New York: 1979, Page-24]
ইসলামে বিয়ে একটি চুক্তি। ইসলামে বিয়েতে পাত্রপাত্রী যে চুক্তিতে আসে, তা পাত্রপাত্রী ঠিক করে না। চুক্তি সম্পাদন করে পাত্রপাত্রীর অভিভাবক। এই চুক্তি একজন মালিকের সঙ্গে একজন গোলামের চুক্তি ভিন্ন যে কিছুই নয়, তা মুসলিম ধর্মীয় অনুশাসনে নারীদের অবস্থান নিয়ে সামান্য যে আলোচনা করেছি তাতেই যথেষ্টর বেশিই বোঝা গেছে। বিয়েতে নারীর সম্মতির কথা বলা হয়েছে বটে, কিন্তু বাস্তবে এই সম্মতি একটি নিয়মরক্ষা বা অভিনয় বই কিছুই নয়। অভিভাবকরা বিয়ে ঠিক করে ফেলার পর আমন্ত্রিতদের সামনে পাত্রীর সম্মতি, একটি আচারের চেয়ে বাড়তি গুরুত্ব পায়নি।
এমন চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পরও মধ্যপ্রাচ্যের ধনীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে তালাক দেওয়ার রেওয়াজ চালু রয়েছে। তালাক দিয়ে নিত্য নতুন মনপসন্দ নারীদের চুক্তি করে বিয়ে করেই চলে ধনী লম্পটরা। তারা যে স্ত্রীকে বন্ধুর পরিবর্তে ভোগপণ্য বা রক্ষিতা বই কিছু মনে করে না, এ কঠোর বাস্তব। ইসলামে বিয়ে যেহেতু চুক্তি, তাই তা যে কোনও সময় বাতিল হতে পারে। তবে বাতিল করার একমাত্র অধিকার রয়েছে পুরুষের; নারীর নয়।
আরব অঞ্চলে 'ইদ্দা' নাম একটি ধর্মীয় বিধান রয়েছে। এই বিধান মতো স্বামী তিন মাসের জন্য স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে এবং তিন মাস পরে আবার তালাক দেওয়া স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারে। এই মধ্যবর্তী সময়ে স্বামী কোনও নারীকে স্ত্রী করে তার চার স্ত্রীর রাখার ধর্মীয় অধিকার বজায় রাখতে পারে। আরবের অনেক পুরুষ 'ইদ্দা' বিধান মতো চার স্ত্রীকেই মাঝে মাঝে তিন মাসের জন্য বিদায় দিয়ে নতুন চার স্ত্রীকে নিয়ে যৌন উত্তেজনা উপভোগ করে।
মুসলমান পুরুষ যে কোনও ধর্মের নারীকেই বিয়ে করার অধিকারী। কিন্তু মুসলমান নারী বিধর্মীকে বিয়ে করার অধিকারী নয়। সত্যিই কি বিচিত্র সাম্য! যে ধর্ম মানুষকে মানুষের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, সে ধর্ম কখনই মানুষের ধর্ম হতে পারে না। প্রতিটি অলৌকিক ও অলীক বিশ্বাস নির্ভর ধর্ম নিয়ে সামান্য পড়াশুনো করলেই দেখতে পাবেন এরা কী প্রচণ্ড রকমের মানবিকতার শত্রু। এরা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে। সৃষ্টি করে ঘৃণা।
খ্রিস্ট ও ইহুদি ধর্ম একইভাবে নারীকে শয়তানের আসনে বসিয়েছে। আর তাই শোষক শ্রেণির কাছে 'ধর্ম' আজ এক শক্তিশালী অস্ত্র, যার সাহায্যে শোষিতদের ভেঙে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা যায় পরম নিশ্চিন্তে, অবহেলে, বিনা প্রতিবাদে, বিনা প্রতিরোধে।
মুসলিম দুনিয়ার বহু দেশেই 'নারী-খৎনা' নামের এক বীভৎস, বর্বরোচিত ধর্মীয় প্রথা প্রচলিত রয়েছে। এই প্রথা মানুষ্যসমাজের কলঙ্ক বই কিছু নয়। এই প্রথা পুরুষকে মানুষ থেকে শয়তানে পরিণত করেছে। আর নারীকে পরিণত করেছে পশুতর জীবে।
খৎনা প্রথা আজও প্রচলিত আছে ঘানা, গিনি, সোমালিয়া, কেনিয়া, তাঞ্জানিয়া, নাইজিরিয়া, মিশর, সুদানসহ উপসাগরীয় বিভিন্ন দেশে। এইসব দেশে নারীদের যৌন কামনাকে অবদমিত করে যৌন-আবেগহীন যৌন-যন্ত্র করে রাখতে পুরুষশাসিত সমাজ বালিকাদের ভগাঙ্কুর কেটে ফেলে। নারীর যৌন আবেগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় যোনির প্রবেশমুখে পাপড়ির মতো বিকশিত ভগাঙ্কুর। নারীদের খৎনা করা হয় ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার আগে অর্থাৎ সাধারণভাবে সাত-আট বছর বয়সে। খৎনা যারা করে তাদের বলা হয় 'হাজামী'। দু'জন নারী শক্ত করে টেনে ধরে বালিকার দুই ঊরু। দুই নারী চেপে ধরে বালিকার দুই হাত। 'হাজামী' ছুরি দিয়ে কেটে ফেলে ভগাঙ্কুর। এই সময় উপস্থিত নারীরা সুর করে গাইতে থাকেন, "আল্লা মহান, মহম্মদ তার নবী; আল্লা আমাদের দূরে রাখুক সমস্ত পাপ থেকে"।
পুরুষশাসিত সমাজ ঐসব অঞ্চলের মস্তিস্ক স্নায়ুকোষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই বিশ্বাসের বীজ রোপন করেছে, কাম নারীদের পাপ, পুরুষদের পুণ্য। খৎনার পর সেলাই করে দেওয়া হয় ঋতুস্রাবের জন্য সামান্য ফাঁক রেখে যোনিমুখ। খোলা থাকে মূত্রমুখ। খৎনার পর চল্লিশ দিন পর্যন্ত বালিকার দুই ঊরুকে একত্রিত করে বেঁধে রাখা হয়, যাতে যোনিমুখ ভালমতো জুড়ে যেতে পারে। বিয়ের পর সেলাই কেটে যোনিমুখ ফাঁক করা হয়, স্বামীর কামকে তৃপ্ত করার জন্য। আবারও বলি, স্বামীর কামকে তৃপ্ত করার জন্যই; কারণ নারীর কম তো ওরা পাপ বলে চিহ্নিত করে নারীকে করতে চেয়েছে কাম-গন্ধহীন যৌন-যন্ত্র। সন্তান পেলে বা বিধবা হলে আবার নতুন করে সেলাই পড়ে ঋতুস্রাবের সামান্য ফাঁক রেখে। আবার বিয়ে, আবার কেটে ফাঁক করা হয় যোনি। জন্তুর চেয়েও অবহেলা ও লাঞ্ছনা মানুষকে যে বিধান দেয়, সে বিধান কখনই মানুষের বিধান হতে পারে না। এ তো শুধু নারীর অপমান নয়, এ মনুষ্যত্বের অবমাননা।
ইসলামের বেহেশত শুঁড়িখানা আর বেশ্যাপল্লী বই কিছুই নয়। এখানে যৌন-সুখ ও ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার অধিকারী পুরুষ। বেহেশতের হুরেরা সৌন্দর্যে সূর্য, চন্দ্রকেও মলিন করে। পুরুষদের জন্যে বেহেশতের সুখ বিষয়ে কোরআন বলছে, "ওদের সঙ্গিনী দেব আয়তনয়না হুর।" [সুরা দুখান: ৫৪]
"সাবধানীদের জন্যে রয়েছে সাফল্য: উদ্যান, দ্রাক্ষা, সমবয়স্কা উদ্ভিন্নযৌবনা তরুণী এবং পূর্ণ পানপাত্র।" [সূরা নাবা: ৩১:৩৪] এই আয়তনয়না অসামান্য সুন্দরী হুরদের সঙ্গে বেহেশতে আসা পৃথিবীর পুরুষদের মিলন ঘটাবার লোভ দেখানো হয়েছে [সূরা তূর: ২০] কোরআনে। এইসব স্বর্গসুন্দরীরা যে হবে অনাঘ্রাত ফুল এবং বেহেশতে আসা পুরুষরাই তাদের জীবনের প্রথম পুরুষ, সে নিশ্চিন্ততার প্রতিশ্রুতিও রয়েছে কোরআনে [সূরা রহমান: ৫৬]।
কল্পিত স্বর্গ বেহেশতে নারীদের কোনও স্থান হয়নি। বরং মুসলিম নীতি নির্দেশক গ্রন্থ হাদিসে বলা হয়েছে, 'নারী শয়তানের রূপে আসে আর শয়তানের রূপে যায়।"
*************************************
'ঈশ্বরের ইচ্ছেতেই সব কিছু হচ্ছে' ধরে নিলে একদিকে সমস্ত রকম প্রচেষ্টাই যেমন নিরর্থক হয়ে যায়, তেমনই কোনও ভাল কাজ বা খারাপ কাজের দায়-দায়িত্বও মানুষের উপর বর্তায় না। এর অবস্থায় পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক, সবই অর্থহীন হয়ে যায়। ঈশ্বর তাঁরই খেয়াল খুশি মতো মানুষকে দিয়ে ভাল-খারাপ কাজ করিয়ে নেবেন এবং মৃত্যুর পর মানুষ ঈশ্বরের খেয়াল-খুশির ফল ভোগ করবে, এটা কোনও মতেই ন্যায় বিচার হতে পারে না। বরং এ বিচারের নামে প্রহসন।
*************************************
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম যদিও 'নিরীশ্বরবাদী' অর্থাৎ ঈশ্বর বা পরমাত্মায় বিশ্বাসী নয়, তবু এই দুই ধর্মকে 'নাস্তিক' বলে চিহ্নিত করলে ভুল করা হবে। কারণ, এই দুই ধর্মই আত্মায় বিশ্বাসী এবং হিন্দু ধর্মের প্রভাবে, জন্মান্তরে বিশ্বাসও প্রবল। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে বিশ্বাসীরাও তাঁদের ধর্মের বিধানকে তাঁদের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আচার বা দেশাচার বলে মান্য করে।
*************************************
নাস্তিকতাবাদে যুক্তিহীন আধ্যাত্মবাদী চিন্তাকে বাতিল করার ঝাঁঝ যতখানি উপস্থিত, ততখানিই অনুপস্থিত ভবিষ্যৎমুখী মানবতাবাদী সমাজ সচেতনতা বোধ।
*************************************
এদেশের প্রাচীন ধর্মসূত্রগুলো যেমন পরিপূর্ণভাবে রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিল, চার্বাকবাদীরাও ছিল তেমনই সেই সময়কার রাজতন্ত্রকেন্দ্রিক শোষণ কাঠামোর সমর্থক।
*************************************
এক -- দেশপ্রেম মানে দেশের মাটির প্রতি প্রেম নয়, দেশের সংখ্যাগুরু মানুষের প্রতি প্রেম। দুই -- সমাজসেবার মাধ্যমে শোষণমুক্তি ঘটেছে, এমন দৃষ্টান্ত আজ পর্যন্ত কোনও ঐতিহাসিকের জ্ঞানভাণ্ডারে নেই। হাজারটা রামকৃষ্ণ মিশন, হাজারটা ভারত সেবাশ্রম সংঘ, হাজার মাদার টেরিজার সাধ্য নেই ভারতের শোষিত-জনতার শোষণমুক্ত ঘটানোর। তিন -- ঈশ্বর, ভূত, কর্মফল, অদৃষ্টবাদ ও অলৌকিকত্বের বাস্তব কোনও অস্তিত্ব নেই। শোষক ও শাসকশ্রেণি শোষণকে কায়েম রাখতেই শোষিতদের মধ্যে এই ভ্রান্ত চিন্তাগুলোর প্রসারকামী। চার -- দাম্পত্যজীবন গড়ে তোলার প্রথম শর্ত হওয়া উচিত বন্ধুত্ব, যৌন স্বত্বাধিকার নয়...
*************************************
দেকার্তে ঈশ্বরের ও আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। গ্যালিলিও ঈশ্বরের সঙ্গে জ্যোতিষশাস্ত্রেও পরম বিশ্বাসী ছিলেন। স্পিনোজার দর্শনও ছিল ঈশ্বর অস্তিত্বকে সঙ্গী করেই। লিবনিজ তাঁর দর্শনে জানিয়েছিলেন ঈশ্বর ও আত্মা বিষয়ক ধর্মীয় মতবাদকে। কান্ট ঈশ্বর ও আত্মার সঙ্গে অতীন্দ্রিয় ব্যাপার-স্যাপারে বিশ্বাসী ছিলেন। হেগেলীয় দর্শনের বুনিয়াদও ছিল ভাববাদী বা অলীক কল্পনাবাদী। ভলতেয়ারও স্পষ্টতই ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন। এইসব বিশিষ্ট দার্শনিক ও ব্যক্তিত্বরা তাঁদের সময়ে অন্য অনেকের থেকেই চিন্তার ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিলেন; ধর্মগ্রন্থের ও ধর্মগুরুদের কিছু কিছু যুক্তি-বিরোধী বক্তব্যের বিরোধিতা করেছিলেন, এক কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেও আমরা বলতে পারি - কিন্তু তাই বলে ওঁদের ভাববাদী প্রবল চিন্তার দিকটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে 'যুক্তিবাদী' বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টাকে কোনওভাবেই সমর্থন করা যায় না।
*************************************
যে'সব সংগঠন ধর্মের ও ঈশ্বরের অস্তিত্বকে সুরক্ষিত রেখে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের জয়গান গাইছে, তাদেরকে 'যুক্তিবাদী' আন্দোলনের শরিক সংগঠন হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। অথচ নিশ্ছিদ্র নিরীশ্বরবাদিতা-বস্তুবাদিতা ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রতি একনিষ্ঠতা, আধুনিক যুক্তিবাদের লক্ষণ।
*************************************
তারিখটা ২৬ জুন। সাল ১৯৮৬। কলকাতার রাজাবাজারে অবস্থিত 'সায়েন্স কলেজ'-এ দীর্ঘ আলোচনার পর ভারতের বিশিষ্ট ১৮ জন বিজ্ঞানী একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। প্রস্তাবটি একটি অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি :
" আমাদের শরীরে রক্ত আছে। প্রয়োজনে বাহির হইতে সংগ্রহ করিয়া রক্ত দেওয়া হয়। কিন্তু কোনও ব্যক্তি যদি হঠাৎ দাবি করিয়া বসেন - পশু বা মানুষের রক্ত গায়ে মাখিয়াই শরীরের রক্ত-স্বল্পতা দূর করা সম্ভব, তাহা হইলে তাহার মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে সন্দেহ জাগে। কেহ যদি প্রশ্ন করিয়া বসেন - রক্ত-স্বল্পতার ক্ষেত্রে চিকিৎসাশাস্ত্রে আয়রন ট্যাবলেট-ক্যাপসুল ইত্যাদির প্রয়োগবিধি আছে, অতএব লৌহ-আংটি ধারণে ওই একই কার্য সমাধা হইবে না কেন? - তবে প্রশ্নকর্তার কাণ্ডজ্ঞান বিষয়ে সন্দিহান হই। এইরূপ প্রশ্নকর্তা তাঁহার নিজের রক্ত-স্বল্পতা দেখা দিলে ভারি লৌহখণ্ড শরীরের সর্বত্র বাঁধিয়া রাখিয়া পরীক্ষা করিলেই তাঁহার প্রশ্ন ও বক্তব্যের অসারতা বুঝিতে পারিবেন।"
*************************************
No comments:
Post a Comment