Thursday, 20 January 2022

দর্শন ধর্ম নৈতিকতা - অরুণ চৌধুরী

পরিবর্তনশীলতার প্রক্রিয়া সম্পর্কে এই যে সমস্ত সুনির্দিষ্ট আবিষ্কার তার সবখানি কৃতিত্বই কি কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস-এর প্রাপ্য? না, তা নয়। মার্কস ও এঙ্গেলস-এর পূর্বেই এই দ্বন্দ্বমূলক প্রক্রিয়ার কথা দর্শন জগতে যিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি হচ্ছেন ভাববাদী জার্মান দার্শনিক হেগেল। কিন্তু হেগেলীয় চিন্তাধারা ছিল ত্রুটিপূর্ণ এবং তা দাঁড়িয়েছিল এক ভাববাদী ধ্যানধারণার ভিত্তির উপরে। মার্কস ও এঙ্গেলস এই ভাববাদী ধ্যানধারণার ভিত্তিকে নস্যাৎ করে দিয়ে দ্বন্দ্বমূলক প্রক্রিয়াকে এক বিজ্ঞানসম্মত বস্তুবাদের ভিত্তির উপরে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। আর তা করতে গিয়ে মার্কস ও এঙ্গেলসকে বস্তুবাদী দার্শনিক ফয়েরবাখ প্রবর্তিত এক যান্ত্রিক ধারণার কবল থেকেও বস্তুবাদকে মুক্ত করে নিয়ে আসতে হয়। এই জন্যই মার্কসীয় দর্শনকে শুধুমাত্র বস্তুবাদ না বলে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

বস্তুর স্বতন্ত্র সত্তা

ভাববাদের প্রত্যক্ষ বিপরীতটা-ই হচ্ছে বস্তুবাদ।

বস্তুর একটা চৈতন্য নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র সত্তা আছে। এই যে সব ধারণা , - 'ব্রহ্ম সত্য', 'জগৎ মিথ্যা' বা 'জগৎ পরমাত্মার প্রকটিত রূপ মাত্র' অথবা 'পার্থিব যা কিছু তা কেবলমাত্র চৈতন্য কর্তৃকই অনুভূত উপলব্ধির সমষ্টি মাত্র', - মার্কসীয় বস্তুবাদ এগুলিকে ভাববাদী ধ্যানধারণা বলে অভিহিত করে ও তাকে বর্জন করে।

এই যে বিশ্বপ্রকৃতি তা ইন্দ্রিয়াতীত কোনও পরমাত্মার প্রকটিত রূপ নয়, নয় কোন মায়া। অপর পক্ষে তা রীতিমত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও স্বভাবতই তার মর্ম একেবারেই বস্তুগত। জগৎ সংসারের যা কিছু তা কোনও পরম চৈতন্যের লীলা খেলা নয়। বরঞ্চ তা বস্তুর গতিশীলতার-ই বিচিত্র অভিব্যক্তি মাত্র।

বস্তু মুখ্য, চেতনা গৌণ

বস্তুর সত্তা স্বতন্ত্র এবং তা চৈতন্য নিরপেক্ষ। কিন্তু বস্তুর সাথে চেতনার কোনও সম্পর্ক আছে কি? হ্যাঁ, আছে। বস্তু এবং চেতনার পারস্পরিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে কার কি ধারণা সেই কষ্টি পাথর দিয়েই মার্কসীয় বস্তুবাদ বিচার করে থাকে, - কোন ধারণাটা বস্তুবাদী আর কোনটা ভাববাদী। যাঁরা মনে করে থাকেন, চেতনা নিরপেক্ষ বস্তুর স্বাধীন সত্তা আছে, চেতনা বস্তুরই প্রতিফলন মাত্র এবং বস্তু মুখ্য চেতনা গৌণ, তাঁরাই হলেন বস্তুবাদী। অপর পক্ষে যাঁরা মনে করেন চেতনা নিরপেক্ষ কোনও স্বাধীন সত্তা বস্তুর নাই, বস্তু চেতনার-ই নিছক একটা অনুভূতি মাত্র এবং চেতনা মুখ্য বস্তুই গৌণ, তাঁরা সকলেই হলেন কোন না কোন ধরণের ভাববাদী।

মনে করা যাক, চোখের সম্মুখে বাগানে একটা গোলাপ ফুল এবং তার রংটা লাল। ভাববাদীরা বলবেন, ওটাকে গোলাপ ফুল বলে মনে করা হচ্ছে ও তার রংটাকে লাল বলে অনুভূত হচ্ছে বলেই ওটা একটা লাল গোলাপ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তাঁদের মতে ঐ লাল গোলাপের চেতনা নিরপেক্ষ কোন স্বতন্ত্র সত্তা নাই। বস্তুবাদীরা বলবেন, ওটা অন্য ফুল না হয়ে গোলাপ বলেই গোলাপ ফুল মনে হচ্ছে এবং সেটা লাল বলেই সকলের অনুভূতিতে তার রক্তিমা সাড়া জাগিয়েছে। চেতনা নিরপেক্ষ ঐ লাল গোলাপটির একটা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব না থাকলে রাম, শ্যাম ও যদু - এই তিনটি সুস্থ মানুষই তাকে লাল গোলাপ বলে দেখতো না। কেউ তাকে নীল অপরাজিতা বা সাদা রজনীগন্ধা বলেও দেখতো। প্রকৃতপক্ষে বস্তুর প্রতিফলনেই অনুভূতির সঞ্চার।

মার্কসীয় বস্তুবাদের মতে, যে বস্তু চিন্তা করে তা থেকে চেতনাকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। কারণ বস্তুর স্বাধীন সত্তার প্রতিফলনে যেখানে চেতনার সঞ্চার ঘটে বা চিন্তার উদয় হয় সে মস্তিস্ক নিজেই মানব দেহের বস্তু বিশিষ্ট অতীব সুসংগঠিত একটা অংশ।

বস্তু সত্তা অজ্ঞেয় নয় 

বস্তুর গতিশীলতার বিচিত্র অভিব্যক্তিতে সমৃদ্ধ এই যে বিশ্বপ্রকৃতি তা ইন্দ্রিয়গোচর এবং অবশ্যই স্বীকার্য যে, ইন্দ্রিয়ানুভূতির মাধ্যমেই তার প্রতিফলন মানব চেতনায় সঞ্চারিত হয়। কিন্তু, এই মানব ইন্দ্রিয়গুলি তো বস্তু সত্তাবিশিষ্ট এবং অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য। সুতরাং বস্তুজগৎ 'স্বয়ং সিদ্ধ সত্তায়' রহস্যাবৃত হয়ে মানুষের কাছে চির অজ্ঞেয় হয়ে থাকতে পারে না। কোনও একটা নির্দিষ্ট সময়ে বস্তুজগতের এই সত্তা বিষয়ে মানুষের জ্ঞান হয়তো অসম্পূর্ণ বা সীমিত থাকতে পারে। কিন্তু ক্রমবর্ধিষ্ণু এই জ্ঞান ভাণ্ডারে আজ যা নাই, তা কালকের সংগ্রহের অপেক্ষায় আছে মাত্র। অতীতে এমন অনেক কিছু ছিল যার বস্তুসত্তা সেই সময়ে মানুষের কাছে দুর্জ্ঞেয় ছিল। কিন্তু কালক্রমে রসায়ন বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ তার গঠন প্রকৃতি শুধুমাত্র আবিষ্কার করেই ক্ষান্ত হয়নি, নিজ হাতে তাকে তৈরী করে তবে তৃপ্ত হয়েছে। সুতরাং বিশ্বপ্রকৃতির সত্তা অজ্ঞেয় বলে যে প্রচারিত ধারণা তাও এক রকমের ভাববাদ ছাড়া আর কিছু নয়।

  


  

No comments:

Post a Comment