প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীদের নামে চালু প্রকল্প, যেমন, ইন্দিরা আবাসন যোজনা ইত্যাদির নাম মোদি ক্ষমতায় আসার পর বদলে দেওয়া হয়েছে। অথচ আর এস এস নেতা দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নামে "দীনদয়াল অন্তোদয় যোজনা" নামক সরকারী প্রকল্প চালু করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে সরকারী কোষাগারের বিপুল অর্থ খরচ করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে দীনদয়াল জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে। কে এই দীনদয়াল? আর এস এসের বাইরে কী তার সামাজিক অবদান? ১৯৩৭ সালে কানপুরের সনাতন কলেজের ছাত্র হিসেবে আর এস এসে যোগদানের আগে বা পরে এই দীনদয়ালের দেশের জন্যে কী অবদান আছে? যে শ্যামাপ্রসাদকে ঘিরে বাংলাতে আবেগ তৈরীর চেষ্টা করে হিন্দুত্ববাদীরা, খানিকটা সেই শ্যামাপ্রসাদকে হিন্দুত্ববাদী শিবিরে কোনঠাসা করতেই এই ব্যক্তি বিশেষ গুরুত্ব পেতে থাকে আর এস এস শিবিরে। শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর পর '৫৮ সালে 'দুটি পরিকল্পনা' নামক একটি তত্ত্বের অবতারণা করে দীনদয়াল। গোলওয়ালকরের "সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ" কে আরো ক্রূর করতে '৬৫ সালে সে অবতারণা করে "একাত্ম মানবতাবাদ" তত্ত্বের। সেই বছরই এই দুটি তত্ত্বকেই নিজেদের দলের আদর্শগত ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেয় বিজেপির পূর্বসূরী জনসঙ্ঘ। এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে দীনদয়াল বলে - ভারত যে মূল সমস্যার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেটি হল, সে জাতীয় অস্তিত্বকে অস্বীকার করছে (Integral Humanism - D Upadhyaya, New Delhi, Bharatiya Jana Sangh, 1965, Page 5)। এভাবেই কৌশলে নাগপুরের কেশব ভবনের হিন্দুত্বকে দীনদয়াল জুড়ে দেয় জাতীয় অস্তিত্বের মোড়কের ভিতরে। জাতীয়তাবাদকে সবথেকে প্রাচীন ও শক্তিশালী ধারণা হিসেবে তুলে ধরে দীনদয়াল (ঐ - পৃ 8)।
হিন্দু সাম্প্রদায়িকেরা তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ "সাম্প্রদায়িকতা"র প্রচার, প্রসার এবং প্রয়োগের কৌশল হিসেবে পশ্চিমী দুনিয়ার সমালোচনা করে দেশজ ভাবধারার কথা বলে। তবে লক্ষ্য পূরণের স্বার্থে পশ্চিমের সঙ্গে তাদের বোঝাপড়ার এতোটুকু অভাব নেই। দীনদয়ালের জন্মশতবর্ষ নিয়ে আর এস এস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির এতোখানি উৎসাহ, দীনদয়ালের নামে সরকারী প্রকল্পের নামকরণ - এগুলির আসল উদ্দেশ্য হলো, হিন্দু সাম্প্রদায়িকেরা যে বর্ণ ব্যবস্থার উগ্র সমর্থক, দীনদয়াল সেই বর্ণ ব্যবস্থার সময়োপযোগী মডেলটাকে তুলে ধরেছিল। বর্ণ ব্যবস্থাকে "ঐতিহাসিক ব্যবস্থা" বলে বর্ণনা করেছেন দীনদয়াল। বর্ণ ব্যবস্থার ভিতর দিয়ে কীভাবে "হিন্দুরাষ্ট্র" গঠন করা সম্ভব তার নীল নক্সাও দীনদয়াল তৈরী করে দিয়েছিলেন। তাই পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আবেগকে উসকে দিতে এ রাজ্যে এসে কেন্দ্রীয় স্তরের আর এস এস, বিজেপি নেতারা যতোই শ্যামাপ্রসাদের কথা বলুন না কেন, জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে তারা শ্যামাপ্রসাদের থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয় দীনদয়াল উপাধ্যায়কে। অতীতের ধারাবাহিকতাবাদী যেসব মানুষরা জাতীয় আন্দোলনের সময়কালে হিন্দু সমাজের একটা অংশকে সাম্প্রদায়িক অভিমুখে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন, তাদের চিন্তাধারার সঙ্গেও দীনদয়ালের ভাবনার আশ্চর্য রকমের সাদৃশ্য আছে।
জাতীয়তাবাদী চিন্তায় যাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁদের কাছে রাষ্ট্রের উৎপত্তির কারণ হিসেবে রুশোর সামাজিক চুক্তি (Social Contract) তত্ত্ব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রকে তাঁরা শ্রেণি শোষণের যন্ত্র বলে আদৌ মনে করেন না। টলস্টয়, প্রোপোটকিন, গান্ধীজী, নেহেরু যে জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন রাজনৈতিক হিন্দুদের জাতীয়তাবাদ যে সেই বোধের সম্পূর্ণ বিরোধী তা পরিষ্কার হয়ে যায় রাষ্ট্রের উৎপত্তি বিষয়ে দীনদয়ালের দেওয়া তত্ত্বের ভিতর দিয়ে। দীনদয়ালের মতে, রাষ্ট্র হলো স্বয়ম্ভূ। একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রবেশ পথেই নাকি রাষ্ট্রের উৎপত্তি (ঐ, পৃ ৩২)। দীনদয়াল লিখছেন, "In our concept of four castes, they are thought of an analogous to the different limbs of virat - purusha ... These limbs are not only complementary to one another, but even further, there is individuality, unity. There is a complete identity of interest, identity of belonging. If this idea is not kept alive, the castes, instead of being complementary, can produce conflict. But then this is distortion. This is indeed the present condition of our society." (ঐ, পৃ ৪৩)
এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে কেন দীনদয়াল উপাধ্যায় নরেন্দ্র মোদির কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ। দীনদয়াল অন্তোদয় যোজনার প্রচারে দীনদয়ালের ছবি ছেয়ে গেছে গোটা পশ্চিমবঙ্গে। সংলাপ কলকাতার নাটক "ঈশ্বরের খোঁজ" এর মুখ্য চরিত্র শান্ত মিত্রর মতো নিজের ভিতরে রপ্ত করে নিয়েছেন বিজেপি নেতারা, তা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না। তাই এখন কেন্দ্রীয় সরকারের তৎপরতা মুঘলসরাই স্টেশনকে দীনদয়ালের নামে নামাঙ্কিত করে ইতিহাসকে বদলে দিতে।
*************************************
আজ যাঁরা বলছেন শ্যামাপ্রসাদের জন্যেই নাকি বুদ্ধদেববাবু উপমুখ্যমন্ত্রী হতে পেরেছেন তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি, যে ব্যক্তি '৪৭ সালের ৫ এপ্রিল তারকেশ্বরে হিন্দু মহাসভার সম্মেলনে বলেন, "I can conceive of no other solution of the communal problem in Bengal than to divide the province in Bengal than to divide the province and let the two major communities residing herein live in peace and freedom." (Amrita Bazar Patrika, 06/04/1947, pg 3), তিনি কোনো অবস্থাতেই বুদ্ধদেববাবু সহ কোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে প্রণম্য হতে পারেন না। ২২শে এপ্রিল বাংলা ভাগের দাবিতে দিল্লিতে এক জনসভা করে শ্যামাপ্রসাদ বলেন, "This separation must not be dependent on Pakistan. Even if Pakistan is not conceded and some form of a weak and loose centre envisaged in the Cabinet Mission Scheme is accepted by the Muslim League, we shall demand the creation of a new Province composed of the Hindu Majority areas in Bengal." (Amrita Bazar Patrika, 25/04/47, pg 7)। ১লা মে সোহরাওয়ার্দির বক্তব্যের বিরোধিতা করেও বাংলা ভাগের দাবি শ্যামাপ্রসাদ জানান। ২৬শে এপ্রিল দিল্লিতে কিরণশঙ্কর রায়, ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় ও শ্যামাপ্রসাদ একসাথে মিটিং করে বাংলা ভাগে সম্মত হওয়ার জন্যে কংগ্রেসের কাছে অনুরোধ জানান। কার্যত এই সময় শ্যামাপ্রসাদ মাড়োয়ারি ব্যবসাদারদের হাতে পুতুল হয়ে গিয়েছিলেন। তৎকালীন রাজ্য কংগ্রেসের নেতাদের অবশ্য এই দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া যায় না। বাংলা ভাগের দাবিতে শ্যামাপ্রসাদ এবং হিন্দু মহাসভাকে সক্রিয় সহযোগিতা করেন যুগলকিশোর বিড়লা, শেঠ বিন্ধিশ্বর জালান, বদরিদাস গোয়েঙ্কা, রাধাকৃষ্ণাণ কানোড়িয়া, খৈতান গোষ্ঠী, বিশেষ করে দেবী প্রসাদ খৈতান [Shadows of Mahatma - a Personal Memoir, G.D.Birla, Memo dated 3 Dec.,'39, GB SB 'PH' series file no. 501/39 (iii)]
ঐতিহাসিক মহলের অনেকে বলেছেন, '৪০ সালে কলকাতার মেয়র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে লীগের সঙ্গে রফাকে সুভাষচন্দ্র আশা করেছিলেন হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের পথ আলোকিত করবে; বাস্তবে কিন্তু তা ছিল না। এই ঐক্য প্রচেষ্টা ছিল সুভাষচন্দ্রের সুবিধাবাদী রাজনৈতিক লাইনেরই একটি নিদর্শন। লালা লাজপত রায় দেশভাগের অন্যতম প্রাচীন ও প্রধান দাবিদার। হ্যাঁ, জিন্নাহ, ইকবাল প্রমুখের আগেই তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা এই দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কংগ্রেস নেতা হিসেবেও এঁদের হিন্দু সাম্প্রদায়িক চরিত্র গোপন ছিল না। ... লীগের সঙ্গে আঁতাত সুভাষের অপরিণত সুবিধাবাদী রাজনীতিরই দুঃখজনক প্রকাশ। ফরওয়ার্ড ব্লক আর হিন্দু মহাসভা '৪৬-এর দাঙ্গায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুসলমান আর কমিউনিস্ট খতমে নেমেছিল। কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী অংশও ছিল তাদের একান্ত সহযোগী।
*************************************
নেহেরু সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে ছিলেন অত্যন্ত কঠোর মনোভাবের সমর্থক। অপরপক্ষে হিন্দু স্বার্থের প্রশ্নে ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ এবং বিধানচন্দ্র রায়ের অবস্থানে খুব একটা ফারাক ছিল না। ফারাক ছিল না কংগ্রেসের সেই সময়ের প্রাদেশিক নেতৃত্বের ভাবনার ভিতরেও। শ্যামাপ্রসাদের সুরেই ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ চেয়ে সেই সময়ে বাংলার কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষ পুস্তিকা পর্যন্ত লিখেছিলেন।
*************************************
হিন্দু বলতে বোঝায় সেই মানুষজনের যাঁরা নিজেদের মনে করেন সিন্ধু থেকেই ভারতবর্ষের উৎপত্তি এবং এই দেশকে নিজেদের 'পিতৃভূমি' ও 'পবিত্র ভূমি' বলে মনে করেন। হিন্দু হিসেবে পরিগণিত হওয়ার এই যে সংজ্ঞাটি হিন্দু মহাসভার সংশ্লিষ্ট বৈঠকে গৃহীত হয়েছিল, সেই সংজ্ঞাটি মূলত সাভারকার বর্ণিত 'হিন্দু ইন হিন্দুত্ব' নামক গ্রন্থে দেওয়া সংজ্ঞার প্রায় সমার্থক।
*************************************
আজকের মতোই গান্ধী হত্যার পূর্ববর্তীকালে প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কের বিষয়টি আরএসএস কিছুতেই প্রকাশ্যে নিয়ে আসত না। অপরপক্ষে আজ যেমন বিজেপি কোনো অবস্থাতেই প্রকাশ্যে তাদের মস্তিস্ক হিসেবে আরএসএসের অবস্থানটিকে স্বীকার করে না, তেমনি কিন্তু গান্ধী হত্যার আগে বা পরে সঙ্ঘের সেই সময়ের রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভা, প্রকাশ্যে কখনোই তাদের সঙ্গে সঙ্ঘের সম্পর্কের কথা স্বীকার করত না।
এই পারস্পরিক অস্বীকৃতি সত্ত্বেও হিন্দু মহাসভার '৪৮ সালের নভেম্বর মাসের কার্যকরী সমিতির যে বৈঠকের কথা উল্লেখ করা হল, সেই বৈঠকে গান্ধী হত্যাজনিত পরিস্থিতির দায় আরএসএসের উপর এসে পড়ায়, সঙ্ঘে যে সঙ্কটজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সে জন্য সঙ্ঘের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন করা হয়েছিল।
*************************************
বস্তুত ১৯৪৯ সালের শেষ দিকে পশ্চিমবঙ্গে এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে প্রলয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, অত্যন্ত গোপনে সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠনের বিষয়ে শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকা ছিল বিশেষ রকমের সক্রিয়। এই দাঙ্গা সংগঠনের ভিতর দিয়ে রাজনৈতিক হিন্দু ভাবাবেগকে সক্রিয় করে তুলতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা শ্যামাপ্রসাদকে আবার সঙ্ঘের সুনজরে এনে দেয়।
এভাবেই নতুন রাজনৈতিক সংগঠন লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে আবার আরএসএসের সুনজরে চলে আসেন শ্যামাপ্রসাদ। এই পর্যায়ে শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে বিদেশি গবেষকরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করলেও সেই সব গবেষণা সম্পর্কে ভারতীয় গবেষকরা, বিশেষ করে বাঙালি গবেষকরা আশ্চর্যজনকভাবে নীরবতা পালন করে গেছেন। এই নীরবতার সুযোগ নিয়েই শ্যামাপ্রসাদের একটি বিশেষ ইতিবাচক ইমেজ তৈরির কাজ রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি যেমন করেছে, তেমনি প্রচারমাধ্যমের একটি বড় অংশ তাদের এই কাজ করতে সবরকমের সাহায্য করেছে (শ্যামাপ্রসাদের এই পর্যায়ের ভূমিকার জন্যে উৎসাহী পাঠক দেখুন, Shyama Prasad Mookherjee and the Communalist Alternative নামক Bruce Graham এর নিবন্ধ; সংশ্লিষ্ট নিবন্ধটি D A Low সম্পাদিত Soundings in Modern South Asian History গ্রন্থে [প্রকাশক - Weidenfeld and Nicolson, London, 1968] পৃষ্ঠা - ৩৩৮)।
*************************************
জাতীয় আন্দোলনের সময়কাল থেকেই ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যে ধারা প্রবাহিত ছিল, সেই ধারার সঙ্গে নিজেদের একটা বড় রকমের পার্থক্য বজায় রাখতে আরএসএস তাদের সব ধরণের সাংগঠনিক স্তরে এই 'জাতীয়তাবাদ' শব্দটির এবং দ্যোতনাটির একটি ভিন্নার্থক ব্যঞ্জনা ব্যবহার করত। তারা 'জাতীয়তাবাদে'র পরিবর্তে 'রাষ্ট্রবাদ' শব্দটি দেশের স্বাধীনতার আগে থেকেই ব্যবহার করত।
কংগ্রেস যে ধরণের জাতীয়তাবাদী চিন্তায় তাড়িত ছিল, সেই চিন্তার ভিতর বহু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও খাতায়-কলমে সমন্বয়ী চেতনার প্রতি আস্থা ধ্বনিত হতো এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ উচ্চারিত হতো। এই মানসিকতার বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আরএসএস, তার জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি নির্মাণে প্রথম থেকেই সমন্বয়ী চেতনাবিরোধী মানসিকতা এবং সাম্প্রদায়িকতাকেই মূল অবলম্বন করে নিজেদের সমস্ত রকমের চিন্তা ভাবনাকে পরিচালিত করবার উপরে জোর দিয়েছিল।
*************************************
ভারত সরকারের অর্থনৈতিক প্রশ্নগুলির বিষয়ে, অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে শ্যামাপ্রসাদ পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের উপর সবথেকে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। সরকার অর্থনীতির বৃহত্তর অংশ নিয়ন্ত্রণ করুক এটা যে তিনি কোনো অবস্থাতেই চান না - সেটা সেই সময়ে শ্যামাপ্রসাদ খুব পরিষ্কার করে বলে দিয়েছিলেন। মূলত নেহেরুর অর্থনীতির একজন কট্টর সমালোচক হিসেবে নিজেকে দাঁড় করিয়ে, নিজের রাজনৈতিক ভিত্তিকে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করাই ছিল শ্যামাপ্রসাদের প্রধান লক্ষ্য।
এই দিক থেকে বিচার বিশ্লেষণ করে বলতে হয় যে, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণাধীন শিল্প এবং অর্থনীতির যে সোভিয়েত ঘেঁষা অর্থনৈতিক চিন্তা জওহরলাল নেহেরু ভারতবর্ষে প্রয়োগ করেছিলেন, প্রথম থেকেই সেই চিন্তাধারার শুধু সমালোচকই নয়, ঘোরতর বিরোধী ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। এই দৃষ্টিভঙ্গির থেকে বিচার করে বলতে হয় যে, সেই সময়কালে পাবলিক প্রাইভেট এন্টারপ্রেনারশিপের যে তত্ত্বের শ্যামাপ্রসাদ অবতারণা করেছিলেন, তা থেকে এটা স্পষ্ট করে বলতে পারা যায় যে, বাজার অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক স্তরে আসবার অনেক আগেই, জাতীয় অর্থনীতিকে প্রাইভেটাইজ করবার লক্ষ্যে শ্যামাপ্রসাদ খুব স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছিলেন।
এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণাধীন অর্থনীতির পরিবর্তে বাজার অর্থনীতির ভেতর দিয়ে দেশের গোটা বাজারটাকেই ফাটকাবাজদের অবাধ বিচরণভূমি করবার ক্ষেত্রে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ছিলেন ডঃ মনমোহন সিংহের পূর্বসূরী।
*************************************
যাঁরা আজ রাজনৈতিক স্বার্থে শ্যামাপ্রসাদকে পশ্চিমবঙ্গের জনক আখ্যা দিয়ে আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন, তাঁদের কিন্তু লজ্জা পাওয়ার কথা পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দু অভিজাত, জমিদার, বিত্তবানদের সম্পত্তি এপার বাংলাতে স্থানান্তরের প্রশ্নে শ্যামাপ্রসাদ এবং তাঁর একান্ত সহযোগী নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ন্যাক্কারজনক ভূমিকা স্মরণ করে। হিন্দু মহাসভার মতোই একদিন কংগ্রেসও হিন্দুদের, বিশেষ করে বর্ণহিন্দুদের স্বার্থরক্ষা করবে - এই ধারণা থেকেই শ্যামাপ্রসাদ, নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং কংগ্রেসের অতুল্য ঘোষ, কালীপদ মুখোপাধ্যায়, বিধানচন্দ্র রায়, কিরণশঙ্কর রায়ের মতো নেতারা বর্ণহিন্দুদের শ্রেণিস্বার্থের তাগিদ থেকে বাংলা ভাগ করেন। তবে শেষ মুহূর্তে বর্ণহিন্দু জমিদার ও অভিজাত হিন্দু সম্প্রদায় হিন্দু মহাসভা অপেক্ষা বর্ণহিন্দু স্বার্থবাহী হিসেবে কংগ্রেসকেই বেশি নির্ভরযোগ্য বলে ঠাওরেছিল। এই যে চারের দশকের সংকট, শ্যামাপ্রসাদের ঘোরতর হিন্দু সাম্প্রদায়িক অবস্থান, তাঁর সাগরিদ হিসেবে নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ঘোরতর প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান, আবার এই নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই ছয়ের দশকের গোড়ার দিকে শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর পর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে তেমন একটা কলকে না পেয়ে (কারণ, মৃত্যুর আগেই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের উত্থান ঘটার ফলে স্বয়ং শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন যথেষ্ট চাপের ভিতরে) চিরশত্রু কমিউনিস্টদের শরণাপন্ন হন। হিন্দু মহাসভার সঙ্গে সংস্রব ত্যাগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১৯৬৩ সালে বর্ধমান লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থনে নির্দল প্রার্থী হন এবং জেতেন। তাঁদের আরেক সাগরিদ ভাটপাড়াতে একদা আরএসএসের সহযোগী সংগঠন রামরাজ্য পরিষদের হয়ে লোকসভা ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা শ্রীজীব ন্যায়তীর্থের ভাগ্নে জানকীবল্লভ ভট্টাচার্য হঠাৎই হিন্দু মহাসভার সংস্রব ছেড়ে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে জিতে যান বিধান পরিষদে। এই উদাহরণগুলি নিঃসন্দেহে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে কমিউনিস্টদের গায়ে এক একটি কলঙ্করেখা।
*************************************
দেশভাগের সমর্থনে বুদ্ধিজীবীদের একাংশকে সমবেত করার কাজে শ্যামাপ্রসাদের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল। তাঁর উপাচার্যের পদের প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগের পরেও তিনি ব্যবহার করেছিলেন। ধরা যাক, উনিশ শতকের নবজাগরণের পর্বের কথা। এই সময়কালের ইতিহাস লিখতে গিয়ে বিশ্ববিশ্রুত ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার ব্রিটিশ শাসনের প্রশংসার পাশাপাশি আধুনিক বাংলার ইতিহাসে মুসলমানদের অবদানকে কেবল অস্বীকারই করেননি, অনেক নেতিবাচকভাবেই আধুনিক বাংলা গঠনে মুসলমানের অবদানকে তিনি দেখিয়েছিলেন। স্যার যদুনাথ তাঁর গ্রন্থের শেষ পর্বে বলেছিলেন যে, মুসলমানদের যুগে (১২০০ থেকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) মুসলমানেরা বাংলাকে কেবলমাত্র রক্তাক্তই করেছে। নিরবিচ্ছিন্ন বর্বরতাই তারা দেশকে দিয়েছে। অত্যাচার ছাড়া আর কিছুই তারা করেনি (দি হিস্ট্রি অব বেঙ্গল - স্যার যদুনাথ সরকার; পৃ. - ৪৯৭, ৪৯৮)। স্যার যদুনাথের মতে, সংস্কৃতি আর আলোকিত আধুনিক যুগে মুসলমানের এতটুকু ঠাঁই নেই। তিনি আধুনিক বাংলাকে হিন্দু ভদ্রলোকের সৃষ্টি হিসেবেই দেখিয়েছেন। ব্রিটিশের থেকে পাওয়া দীপ্তির দ্বারাই হিন্দু ভদ্রলোকেরা আবার বাংলাকে ভারতীয় সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে - এমনটাই অভিমত স্যার যদুনাথের। তাই তাঁর মতে, অধিকার বলেই বাংলা কেবলমাত্র বাঙালি হিন্দুদের। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই নবজাগরণ কেবলমাত্র বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের সংস্কৃতিরই প্রতীকমাত্র নয়, তাঁর মতে, এটি একান্তই হিন্দু বাংলার, যার সঙ্গে মুসলমানের বিন্দুবিসর্গ সম্পর্ক নেই। এই চিন্তাধারাতে বাঙালি মুসলমানের বাঙালি জাতীয়তাকে অস্বীকার করা হয়েছিল। যদিও এই ধ্বংসাত্মক চিন্তাধারার অল্প কিছুকালের ভিতরেই বাঙালি জাতীয়তার বিজয় বৈজয়ন্তী উড়েছিল পূর্ববঙ্গে। যদুনাথের সঙ্গেই সুর মিলিয়ে শ্যামাপ্রসাদেরও অভিমত ছিল যে, মুসলিম শাসন ছিল অবৈধ। তাঁরা মনে করতেন, মুসলিম শাসন তাঁদের নিজদেশে পরবাসী করেছে। আজ আরএসএস এবং তাদের শাখা সংগঠনগুলি ও তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি এই আত্মঘাতী দর্শন ও চিন্তাধারারই প্রসার, প্রচার ও প্রয়োগ করে চলেছে (এই দৃষ্টিভঙ্গী সম্পৃক্ত একটি প্রধান সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল অমৃতবাজার পত্রিকাতে ১৯৩৯ সালের ৫ এপ্রিল। সেই সম্পাদকীয়তে লেখক বাঙালি হিন্দুদের জেগে ওঠার আহবান জানিয়েছিলেন। সেখানে 'নিজের বিবেচনায় চিন্তা-ভাবনা করার ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচির জন্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের' কথা বলা হয়েছিল)। সেখানে, মুসলমান কর্তৃক হিন্দুদের নিজ প্রদেশে ভূমিদাস করে রাখার যে কথা বলা হয়েছিল, সেটিই ছিল শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বাধীন হিন্দু মহাসভার গোটা বাংলাব্যাপী সাম্প্রদায়িক প্রচারের মূলমন্ত্র।
*************************************
একদিকে শ্যামাপ্রসাদ এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা, অপরদিকে কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক হিন্দু মানসিকতা সম্পন্ন নেতারা বাঙালি সমাজে ভদ্রলোক হিসেবে কেবলমাত্র হিন্দুদের দেখাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এই বোধের সম্প্রসারণ রাঢ় বঙ্গের সমাজজীবন নিয়ে সাহিত্য চর্চাতে অভ্যস্ত তারাশঙ্করের ভিতরেও যথেষ্টই এসে পড়েছিল। এমনিতে তারাশঙ্কর ব্যক্তিজীবনে রাজনৈতিক সখ্যতা ছিল কংগ্রেসেরই প্রতি। তাই তাঁর রাঢ় বঙ্গ কেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চাতে বাঙালি মুসলমানকে তিনি সেভাবে কোনোদিন 'ভদ্রলোকে'র মর্যাদা দিয়ে উঠতে পারেননি। বাঙালি ভদ্রলোক সমাজে হিন্দু কর্তৃত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রবণতায় শ্যামাপ্রসাদ, নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বা তাঁরও আগে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বা তাঁর সমসাময়িক ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, কিরণশঙ্কর রায়, অতুল্য ঘোষ প্রমুখ কারওর ভিতরেই খুব একটা চরিত্রগত ফারাক ছিল না।
*************************************
পুনেতে আরএসএসের একটি শিবির সম্পর্কে '৪২-এর মে মাসে পুলিশ প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে: 'স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে তিনবার বক্তৃতা দিয়েছেন ডা. পি সি সহস্রবুধে'। ৪মে তিনি ঘোষণা করেন যে, আরএসএস একনায়কতন্ত্রের নীতি অবলম্বন করে চলবে। সহস্রবুধে বলেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কার্যকারিতা শেষ হয়ে গেছে। এই প্রসঙ্গে তিনি ফ্রান্সের উদাহরণ দেন। স্বৈরতন্ত্রের ভূয়সী প্রশংসা করতে গিয়ে তিনি জার্মানীকে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরেন। ফুয়েরার হিটলারের নীতির জয়গান করেন। ২১ মে '৪২ তারিখে তিনি রাজনৈতিক প্রচারের গুরুত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাশিয়া এবং জার্মানীর উদাহরণ দেন। নেতৃত্বের গুণাবলীর তাৎপর্য বোঝাতে গিয়ে সহস্রবুধে মুসোলিনীর সাফল্যের প্রসঙ্গ অবতারণা করেন (NAI Home Political Dept. 28.2.1942, Summary of report on the officers Training Camp of RSS held in April/May, 1942 sy Poona, Copy in MSA, Home Special Dept. 822 11nd 1940-1)। এই সময়েও ফ্যাসিবাদের প্রতি আকর্ষণ আরএসএস-সহ হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির বিন্দুমাত্র শিথিল হয়নি। হিটলার, মুসোলিনীর নৃশংসতার যাবতীয় খবরাখবর তখন প্রকাশিত হয়ে গেছে, তা সত্ত্বেও হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি এইসব কুখ্যাত একনায়কদের এবং তাদের শাসন পদ্ধতির জয়গান করে চলেছে। একই সাথে ব্রিটিশের সঙ্গেও সহযোগিতার একটা অদ্ভুত নীতি তারা অবলম্বন করে চলেছে।
*************************************
সুবক্তা হিসেবে শ্যামাপ্রসাদের পরিচিতি ছিল। বাচনিক অভিব্যক্তিতে আরএসএসকে সম্পূর্ণভাবে তাঁর নিজের বিশ্বাস, কৌশল এবং কূটনীতি সম্পকে অবহিত করে তুললেন শ্যামাপ্রসাদ। 'ভারত-ছাড়ো' আওয়াজকে তিনি রূপ দিলেন 'সেটল উইথ ইন্ডিয়া' হিসেবে।
*************************************
... জীবনে একটি দিনের জন্যেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করে জেল-না-খাটা শ্যামাপ্রসাদ দেশের স্বাধীনতা আসন্ন অনুমান করে, নিজের ক্ষমতা দখলের উদগ্র বাসনায় এই ধরণের খেলায় মাতলেন।
*************************************
বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশকে সাম্প্রদায়িকতার বিপথে পরিচালিত করবার সবথেকে বড় কলঙ্কিত নায়ক হলেন শ্যামাপ্রসাদ।
*************************************
বাংলার ফজলুল হক মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী হিসেবে সমগ্র ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সঙ্গে গোপন বোঝাপড়া করে শ্যামাপ্রসাদ বাংলাকে ঠেলে দিয়েছেন করাল দুর্ভিক্ষের গ্রাসে। এইচ.দত্ত কোম্পানিকে কোনোরকম নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে চালের বরাত পাইয়ে দিয়ে বাংলার মানুষকে অনাহারে মেরেছেন। বিনিময়ে পেয়েছেন হিন্দু মহাসভার জন্যে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঢালাও অর্থ সাহায্য।
*************************************
চিত্তপ্রসাদের চোখে তেতাল্লিশের মন্বন্তরে শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকা
তেতাল্লিশের মন্বন্তর শিল্পী চিত্তপ্রসাদের (জন্ম ১৯১৫ সালের ২১ শে জুন নৈহাটিতে, মৃত্যু ১৯৭৪ সালের ১৩শে নভেম্বর) শিল্প সৃষ্টিকে যেমন সমাজ মনস্কতার এক চরম কেন্দ্রবিন্দুতে উপনীত করেছিল, তেমনি মন্বন্তরের সময়কালে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে দুর্ভিক্ষের করাল চিত্রের বাস্তব ছবি দেখার যে বিবরণ তিনি রেখে গেছেন, তার ভিতর দিয়ে মানুষের তৈরি এই ভয়াবহতাকে ঘিরে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ন্য়ক্কারজনক ভূমিকার এক জান্তব ছবি ফুটে ওঠে। পল গ্রিনো থেকে এমা রথচাইল্ড দুর্ভিক্ষের ইতিহাস রচনায় যাঁরা আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত, তাঁদের ইতিহাসমনষ্কতাকেও ছাপিয়ে যায় শিল্পী চিত্তপ্রসাদের দুর্ভিক্ষের কালে দেখা গ্রাম বাংলায় ত্রাণ বন্টন এবং কালোবাজারিদের সঙ্গে বোঝাপড়ার সম্পর্ক ঘিরে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা।
'৪৩ সালের নভেম্বর মাসে চিত্তপ্রসাদ মেদিনীপুর জেলা সফর করেছিলেন। সেই সফরের বিবরণীতে তিনি লিখছেন:
"আধঘন্টা খোঁজাখুঁজির পর সেই ঠিকানাতে পৌঁছলাম। এটি আগে কংগ্রেসের অফিস ছিল। এখন হিন্দু মহাসভার কেন্দ্র। দরজায় মহাসভার নারীসমিতি ঐরকম কিছু একটা সাইনবোর্ড ঝুলছিল। অনেকক্ষণ ধরে দরজায় ধাক্কা দিয়েও কোনো উত্তর না পেয়ে আমরা সোজা ভেতরে চলে এলাম। গিয়ে দেখি আহাররত এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক (তারাপদর কাছে জানতে পারি ভদ্রলোক আগে কংগ্রেসি ছিলেন -- কিন্তু এখন মহাসভাপন্থী হয়ে গেছেন)।"
বিবরণের এই সূচনাপর্বেই আমরা বুঝতে পারি, সেই সময়ের কংগ্রেসী এবং হিন্দু মহাসভাপন্থী রাজনীতির চাপান-উতোর এবং তাকে ঘিরে কুখ্যাত তেতাল্লিশের মন্বন্তরের আবর্তনের প্রাথমিক চিত্রটি।
এই বিবরণীতেই চিত্তপ্রসাদ লিখছেন:
"মেদিনীপুর শহরে সমস্ত পার্টি ও ত্রাণ কর্মীরা বঙ্গীয় ত্রাণ সমিতির তলায় ঐক্যবদ্ধ হলেও নভেম্বরে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ যে সস্তা চাল (সাড়ে পাঁচ টাকা দরে) পাঠিয়েছিলেন, তা পাঠানো হয়েছিল গিরিশ দাস নামক জনৈক মহাসভাপন্থী ব্যবসায়ীকে, এবং ত্রাণ সমিতিকে নয়"।
কাঁথিতে অবশ্য বঙ্গীয় ত্রাণ সমিতি শ্যামাপ্রসাদের কাছ থেকে সস্তা চাল ও অন্য কিছু সামগ্রী সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছিল। সমিতির সভাপতিদের সংখ্যা ও প্রভাবের জন্যই হয়তো তা সম্ভব হয়েছিল।
তমলুক সাব ডিভিশনের ত্রাণ সমিতিটিও গড়া হয়েছিল সর্বদলীয় প্রতিনিধি নিয়ে। ডঃ শ্যামাপ্রসাদ এখানে কোনো সাহায্যই পাঠায়নি। যত কিছু পাঠিয়েছিলেন সে সবই আর্য সমাজের মহেন্দ্র সংঘের কাছে। প্রথমটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক গোষ্ঠী। দ্বিতীয়টির উপর কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণের কথা আর অপ্রকাশিত ছিল না।
'ক্ষুধার্ত বাংলা' নামক গ্রন্থে চিত্তপ্রসাদের মন্বন্তরকালীন মেদিনীপুর শহরে শ্যামাপ্রসাদের যে ভূমিকার কথা জানা যায়, সেটিকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি অত্যন্ত কৌশলে সেই ভূমিকাকে আড়াল করে রাখতে চায়।
অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা পিপলস ওয়ারে তেতাল্লিশের মন্বন্তর সম্পর্কে চিত্তপ্রসাদ একাধিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেরকমই একটি প্রবন্ধে তিনি শ্যামাপ্রসাদ সম্পর্কে লিখছেন:
"গত দুই বছরে কোন বাঙালি যদি ন্যাশনাল ফিগার হিসেবে উঠে এসে থাকেন তাহলে তিনি হলেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। হবে নাই বা কেন? তিনি হলেন আশুতোষ মুখার্জির ছেলে। যে আশুতোষ আধুনিক বাংলার অন্যতম স্থপতি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষা সংস্কৃতির আন্তর্জাতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে গভর্নরের সাথে টক্কর দিয়েছিলেন।"
১৯৪৩ সালে বাংলার আমেরির শাসনের প্রতিবাদে পদত্যাগ করে শ্যামাপ্রসাদ রাতারাতি ন্যাশনাল ফিগার হয়ে যান। বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় গভর্নরের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো কণ্ঠ ছিল তাঁরই। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাঁর বেঙ্গল রিলিফ কমিটিতে লাখ লাখ টাকা এসেছিল। বাংলা বাঁচাতে যাঁকে লক্ষ লক্ষ টাকা দেওয়া হলো সেই লোকটি তাঁর নিজের গ্রামে জীবন শাখা জ্বালিয়ে রাখতে কী কী করেছিলেন আপনারা নিশ্চয়ই সে কথা জানতে চাইবেন।"
অত্যন্ত শ্লেষের ভিতর দিয়ে শিল্পী চিত্তপ্রসাদ বাংলার দুর্ভিক্ষ ঘিরে শ্যামাপ্রসাদের লক্ষ লক্ষ টাকা ত্রাণ সংগ্রহ এবং তাঁর পৈত্রিক গ্রাম জিরাটের সেই সময়ের পরিস্থিতির কথা লিখেছেন।
চিত্তপ্রসাদ জিরাট পৌঁছানোর স্মৃতিচারণ করে লিখছেন:
"আমি ধান ভরা মাঠের উচ্ছ্বাস দেখতে পেলাম না। কেবল পতিত জমি। রোদে পোড়া ফাটল ধরছে ইতিউতি। উঁকি মারছে ঘাস আগাছা। এখানে ওখানে কিছু পাট চাষ করেছে সম্পন্ন কৃষকেরা। কিন্তু এবারে বর্ষা দেরিতে এসেছে বলে সেগুলো ঝলসে গেছে রোদে। তাঁরা (গ্রামের লোক) আমাকে এটাও বললো যে, বিলম্ব বর্ষণের কারনে আলু পিঁয়াজ ইত্যাদি নষ্ট হয়ে গেছে।
কলকাতার বাজারের জন্য এসব চাষ করেছিলেন তাঁরা। শুধু প্রাচীন আমগাছগুলিকে বন্যা ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। সে কারণে বলাগড়ের ২৫ শতাংশ পরিবার বেঁচে আছে আমের আঁটি খেয়ে।
আম খাবার জিনিস। কিন্তু শুধুমাত্র আম তো মানুষের খাদ্য নয়। ফলতঃ যেখানেই যাই দেখি কলেরা, ম্যালেরিয়া, গুটিবসন্ত, চর্মরোগ ছেয়ে গেছে। রাজপুর গ্রামে যেমন বাহান্নটা পরিবারের মধ্যে মাত্র ছয়টি পরিবার টিঁকে আছে। তাঁরাও ধুঁকছে ম্যালেরিয়ায় আর অন্ন বস্ত্রের নিদারুণ অভাবে।
যতগুলি গ্রামে গেলাম প্রতিটি থেকে এক অবস্থা (দেখলাম)। নিজের বাড়ির পাশের এই গ্রামগুলিকে সাহায্য করার জন্য শ্যামাপ্রসাদ কী কী করেছেন আমি এদিকে ওদিকে কিছু লোকজনকে জিজ্ঞাসা করি। সত্যি কথা বলতে গ্রামগুলিতে তাঁর সম্পর্কে কাউকে একটি ভালো কথা বলতে শুনলাম না।"
এই ঘটনার আরও গভীরে পৌঁছে চিত্তপ্রসাদ দেখিয়েছেন কীভাবে সরকারের তরফ থেকে লোপসি খাওয়ানোর জন্যে লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল। তিনি লিখছেন: "দুমাস ধরে ৪০০ জনকে দুবেলা খাওয়ানো হয়েছিল সেই সব লোপসি, স্থানীয় মানুষজন বললেন সেসব কথা।"
চিত্তপ্রসাদ লিখেছেন, কীভাবে সরকার কোনো কোনো গ্রামের কিছু পরিবারকে কিছু সাহায্য করেছিল। তিনি লিখছেন, "পনেরো আনা ও মাথাপিছু দুমুঠো চাল ছেড়ে দিয়েছিল সে সব বললেন সেখানকার মানুষেরা। তারপর ইউনিয়ন বোর্ডের তরফ থেকে পুরুষদের ১৪ পয়সা করে মহিলাদের ১০ পয়সা করে ও শিশুদের ৫ পয়সা করে দেওয়া হয়।
স্টুডেন্ট ফেডারেশন ও মুসলিম স্টুডেন্ট লীগ সম্পর্কে অনেক কথা বলেন তাঁরা। বন্যার ঠিক পরেই ওরা জামাকাপড়, ১২ মণ শষ্যবীজ, প্রচুর তরিতরকারি দিয়েছিল। কোন কোন গ্রামে পরিবারপিছু ৫ টাকা করে দিয়েছিল।
কমিউনিস্ট পার্টিও দু'বার মাথাপিছু এক পোয়া করে চাল ও এক পোয়া করে আটা দিয়েছিল। 'ডুমুরদহ উত্তম আশ্রম' বাড়ি বাড়ি ২ টাকা দেয় এবং আট সের করে আটা কন্ট্রোল রেটে দিয়েছে তিন মাস। এক কথায় সকলেই কিছু না কিছু সাহায্যের চেষ্টা করেছে কেবলমাত্র জেলার সবচেয়ে বিশাল ব্যক্তিটি ও সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠনটি ডক্টর মুখার্জি ও তার হিন্দুমহাসভা ছাড়া।"
চিত্তপ্রসাদ লিখছেন: "শ্রীকান্ত গ্রামের এক গণ্যমান্য ব্যক্তির কাছে আমি সরাসরি প্রশ্নটা করে বসলাম, তাঁদের জন্য 'বেঙ্গল রিলিফ কমিটি' কী কী করেছে? তিনি 'বেঙ্গল রিলিফ কমিটি' বা শ্যামাপ্রসাদের নাম শোনেননি, কিন্তু আশুতোষের নাম বলতে সাথে সাথে বুঝলেন, বললেন না, ওঁদের কাছ থেকে আমরা কিছু পাইনি।
তারপর জিরাট পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত আমি আর শ্যামাপ্রসাদ সম্পর্কে কারো সাথে কোন কথা বলিনি। কিন্তু যতই আমি এগোতে থাকলাম ততো বেশি করে জিরাট লাগোয়া এই গ্রামগুলির অবস্থা আমি বুঝতে পারছিলাম।
এক কথায় বললে একটা গ্রামের স্বাভাবিক নেতাটিই যদি বিপদের দিনে পালিয়ে যায়, তাহলে গ্রামের কী অবস্থা হতে পারে তা দেখলাম আমি। শ্যামাপ্রসাদ ওঁদের কোনো সাহায্য করেননি এবং ওই এলাকায় আর কোনো ক্ষমতাশালী লোক ছিল না যে তাদের সাহায্য করতে পারে।
ফলতঃ খাদ্য, বস্ত্র, ঔষধপত্র ইত্যাদি যেটুকু সাহায্য বাইরে থেকে এসে পৌঁছেছিল, তার বেশিরভাগটাই চোর ছ্যাঁচড়ে লোপাট করে দেয়।
আরও উদাহরণ এরকম এক ব্যক্তির কাছ থেকে শুনেছিলাম। তিতিবিরক্ত হয়েছিল লোকটা সত্যিই। বলেছিলেন, উনি একটা গলাকাটা ইউনিয়ন বোর্ডের ত্রাণকার্যের দায়িত্বে আছেন। তিনি তার নিজের লোকজনকে সপ্তাহে দেড় সের করে খাদ্য দিচ্ছিলেন। কিন্তু কদমডাঙা গাঁয়ের কৃষাণেরা যখন তার কাছে সাহায্যের আশায় গেলেন, তখন তিনি পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিলেন যে, এমনি এমনি তো আর চাল পাওয়া যায় না। আমার জমিতে বিনা পয়সায় কাজ করে দাও। আমি কন্ট্রোলে বাড়িতে চাল পৌঁছে দেব।
সারা গ্রাম তার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল। কিন্তু তবু ইউনিয়ন বোর্ড এই লোকটাকেই ১৫টা থান কাপড় দিল ৮৩ টা পরিবারের মধ্যে ভাগ করে দিতে। সে পুরোটাই নিজের স্বজনদের মধ্যে উপহার হিসেবে বিলিয়ে দিল।
এই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই শ্যামাপ্রসাদের নিজের গ্রামে গিয়ে হাজির হলেন চিত্তপ্রসাদ। চিত্তপ্রসাদ লিখছেন: "আশুতোষের একজন দূর সম্পর্কের আত্মীয়, কোন এক গোস্বামী, প্রাচীন বাড়িটিকে 'আশুতোষ স্মৃতি' নামকরণ করেছিলেন।
কিন্তু আধুনিক বাংলার গর্বিত স্থপতি, যিনি একজন বিরাট মাপের মানুষ ছিলেন এবং বৃহৎ পরিকল্পনা নির্মাণের কাজ করতেন, সেই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের ভেঙে পড়া ধসে যাওয়া বিষন্ন এক স্মারকগৃহ দেখতে পেলাম আমি।
আমি যে স্কেচটি করেছি তা থেকেই আপনারা বুঝতে পারবেন যে, ক্লাসিক ডিজাইনের সুদৃঢ় থাম দিয়ে গঠিত সেই প্রাসাদ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে। সরাসরি অর্ধেক খসে গেছে। বাকি অর্ধেকের ইঁট বেরিয়ে আসছে, খুলে খুলে পড়ছে। শ্যাওলা আর বুনো ঝোপঝাড়ে জানলাগুলো ঢেকে দিয়েছে। আর ফাটলে গজিয়ে ওঠা আগাছা থামগুলির উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ফাটিয়ে দিয়েছে।"
চিত্তপ্রসাদ লিখছেন: "বলাগড়ের গ্রামগুলিতে এক নতুন হাটের গল্প। জিরাটে এই নতুন হাটের পত্তন করেছেন শ্যামাপ্রসাদ, মহা ধুমধামে অনুষ্ঠান করে দুর্ভিক্ষের এক বছরে মোট দু'বার তিনি গ্রামে এসেছিলেন। সব সদাশয় ব্যক্তিই ওই হাটটাকে অভিসম্পাত দেয়।
কারন, সিজেই গ্রামে বহুদিন ধরে একটি চালু হাট ছিল। জিরাট থেকে দূর নয়। একটা হাটই যথেষ্ট। বিপদের সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা যাতে গ্রামবাসীদের ঠকিয়ে মুনাফা না করে, যাতে ন্যায্যমূল্যে জিনিস পায় গ্রামের মানুষ, তার ব্যবস্থা করার কথা ছিল। কিন্তু তা না করে শ্যামাপ্রসাদ আরেকটি হাট প্রতিষ্ঠা করলেন এবং সিজেই হাট যেদিন করে বসে সেই বুধবার করে নতুন হাট বসার ব্যবস্থা করলেন। বলাই বাহুল্য যে সিজেইয়ের হাটকে ভাঙার জন্যই এই ব্যবস্থা, প্রায় সমস্ত গ্রামবাসী তাই মনে করে।"
এরপর চিত্তপ্রসাদ খুব খোলামেলাভাবেই হিন্দু মহাসভার তেতাল্লিশের মন্বন্তরে ত্রাণ বন্টন সম্পর্কে লিখেছেন:
"শ্যামাপ্রসাদের বসানো হাটে প্রকাশ্য দিবালোকে মুনাফালোভী কারবার দেখে জিরাটের হিন্দু মহাসভার ত্রাণকার্য সম্পর্কে জানার আগ্রহ ছিল না। কিন্তু তবু আমি আরও খোঁজ খবর নিলাম। কারণ, জিরাটই ছিল একমাত্র গ্রাম, যেখানে মানুষ শ্যামাপ্রসাদের ত্রাণকার্য সম্পর্কে কিছু কথা শুনেছে। এই ত্রাণকার্যকেও আমি এই হাটের মতই এক মুনাফাচক্র হিসেবে আবিষ্কার করলাম, অথবা ঠিক এই দাতব্য চিকিৎসালয়ের মতো। চারটি ত্রাণ কেন্দ্র থেকে সপ্তাহে একদিন মোট যতদূর বুঝলাম ২৮ সের আটা এবং ২৮ সের চাল বিতরণ করত হিন্দু মহাসভা।
এছাড়া শ্যামাপ্রসাদের দুই (সম্পর্কিত) ভাই একটি দোকান খুলে বসেন। সেখানে বাজার দরের অর্ধেক দামে চাল বিক্রি করে। কিন্তু তাতে কারোর উপকার হয়নি। কারন, তখন বাজার দর ছিল ৪০ টাকা মণ।
সেই কারনে গাঁয়ের গরিব কৃষক ও মৎস্যজীবীরা আমাকে বলে যে সব দানই তো বাবুদের জন্য। কুড়ি টাকা মন করে ধান কেনা ওই গুটিকয় লোক ছাড়া বাকিদের কাছে অনেক মহার্ঘ।"
মোটামুটি এগুলোই আমি জানলাম জিরাটের শ্যামাপ্রসাদের বাড়ির গ্রামে। আমি বাংলার অনেক গ্রামে গেছি। যে সব গ্রাম আমাদের অনেক মনীষীদের জন্মস্থান। কিন্তু ধনীদের বিরুদ্ধে, বিশেষত গ্রামের সবচেয়ে বড় ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের এমন তিক্ত ঘৃণা আমি আর কোথাও দেখিনি।"
চিত্তপ্রসাদ লিখছেন: "আমার ফিরতি পথে আমি আরও এমন কিছু পেলাম যার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। মনে হল মধ্যবিত্ত যুবদের এক পুরো প্রজন্ম বেহায়ার মত মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে তাদের লিডার ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির মহিমা কীর্তনে। বলাগড়, জিরাটের সবাই আমাকে বলেছে যে, গত দু'বছরে শ্যামাপ্রসাদ দু'বারের বেশি বলাগড়ে আসেননি।
একবার দুর্ভিক্ষের সময় আর একবার হাট বসাতে তিনি এসেছিলেন। তথাপি পাশের কাসালপুর বলে একটি গ্রামের এক ডাক্তার আমাকে বলল যে, শ্যামাপ্রসাদ কলকাতা থেকে যাওয়া আসা করতেই আছে। গত দুই মাসে চারবার এসেছে। মানুষটা তাঁর গ্রামকে ভালোবাসে।
বিমলেন্দু গোস্বামী যিনি জিরাট রিলিফ ক্যাম্পে ময়দা বিতরণ নিয়ন্ত্রণ করেন, আমাকে বললেন যে, তিনি কেবল রবিবার করে রিলিফের মাল দেন। অথচ হাইস্কুলের ছাত্র, যে কিনা হিন্দু মহাসভা নিয়ে গর্বিত, আমাকে বলল যে, রিলিফ ক্যাম্পে ১০০ থেকে ১৫০ জনের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য প্রতিদিন ২৪ জন স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছে।"
এরপর চিত্তপ্রসাদের কলম ঝলসে ওঠে:
"ধনীরা এভাবে নিজেদেরকে জিরাটে ঘৃণার বস্তুতে পরিণত করেছে এবং অন্য যে কারো থেকে বেশি শ্যামাপ্রসাদকে ভয় ও ঘৃণা করে সবাই কিন্তু আমার ভিজিটের শেষে আমি কিছু কথা শুনলাম যা থেকে বুঝলাম যে, শ্যামাপ্রসাদের সমস্ত অপকর্ম সত্ত্বেও বাংলার প্রাচীন সভ্যতা, আশুতোষের স্পিরিট এখনো শেষ হয়ে যায়নি"।
শিল্পী চিত্তপ্রসাদের এই দুটি বিবরণ থেকেই বুঝতে পারা যায়, তেতাল্লিশের মন্বন্তর ঘিরে সেই সময় গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং সংবাদ মাধ্যমের একটি প্রভাবশালী অংশ শ্যামাপ্রসাদের একটি ইতিবাচক চরিত্র চিত্রণে কীভাবে আত্মনিবেদন করেছিল।
(পিপলস ওয়ারে প্রকাশিত এই প্রবন্ধটি পরবর্তীতে 'সম্প্রীতি মনন' নামক একটি পত্রিকাতেও আংশিক প্রকাশিত হয়েছিল)।
*************************************
'৪৬ সালের ভোটে একটি উল্লেখযোগ্য, বর্ণহিন্দু আসনে কংগ্রেসের পরাজয় ঘটে। আসনটি হলো দার্জিলিং। এই নির্বাচনে স্থানীয় জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ডি এস গুরুং কংগ্রেস প্রার্থীকে শোচনীয়ভাবে হারিয়ে দেয়। '৩৬ সালের নির্বাচনেও গুরুং ঐ আসন থেকে জিতেছিলেন। ... তবে সব মহলকে বিস্মিত করে দিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিশ্ববিদ্যালয় আসনটি নিজের দখলেই রাখেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
*************************************
'৪৫ সালের নির্বাচনে তফসিলি সম্প্রদায়ের আসনের ভিতরে কংগ্রেস জিতেছিল শতকরা ৮০ শতাংশ আসনে। অথচ তার আগের নির্বাচনে (১৯৩৬-১৯৩৭ সালে) কংগ্রেসের ফলাফল এই তফসিলি সম্প্রদায় কেন্দ্রে যথেষ্টই খারাপ হয়েছিল। '৪৬-এর নির্বাচনে মুসলিম লিগ বাংলায় ক্ষমতায় ফিরে আসে। '৪৬ সালের এপ্রিল মাসে সোহরাওয়ার্দি সরকার গঠন করেন এবং তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন (তখন প্রাদেশিক সরকারের প্রধানকে প্রিমিয়ার বা প্রধানমন্ত্রী বলা হতো)। সোহরাওয়ার্দির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঘটনাটিকে হিন্দু বাঙালিরা চরম হতাশাজনক ঘটনা হিসেবেই দেখেন। '৪৩-এর দুর্ভিক্ষে সিভিল সাপ্লাই (তখন খাদ্য দপ্তরকে সিভিল সাপ্লাই দপ্তর বলা হতো) মন্ত্রী হিসেবে সোহরাওয়ার্দির ভূমিকাকে ঘিরে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ভিতরে একটা ভয়ঙ্কর নেতিবাচক প্রচার ছিল। এই দুর্ভিক্ষে সোহরাওয়ার্দি ব্যক্তিগতভাবে দায়ী ছিলেন বলে হিন্দু মালিকানাধীন খবরের কাগজগুলি ব্যাপক অপপ্রচার চালিয়েছিল। ...
সোহরাওয়ার্দির শাসনকালটি যথেষ্টই ঘটনাবহুল। বিশেষ করে '৪৬ সালের ১৬ই আগস্টের ঘটনাক্রম নিয়ে তাঁর পক্ষে এবং বিপক্ষে বহু কথা আছে। তবে অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে, সোহরাওয়ার্দির শাসনকাল নিয়ে প্রথম থেকেই কী নেতিবাচক অবস্থান নিয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি চলতে শুরু করেছিলেন, সে সম্পর্কে। সোহরাওয়ার্দি শাসনকাল সম্পর্কে মূল্যায়ন করে শ্যামাপ্রসাদ লিখছেন: বাঙলা যদি পাকিস্তানে পরিণত হয় ... বাঙলায় হিন্দুরা স্থায়ীভাবে মুসলমান শাসনের অধীনে চলে যাবে। হিন্দু ধর্ম এবং হিন্দু সমাজের উপর যেভাবে আঘাত আসছে তার পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করে বলতেই হয় যে, এটি হলো হিন্দু সংস্কৃতির সমাপ্তি। কিছু নিম্নশ্রেণির হিন্দু থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত ব্যক্তিকে শান্ত করতে হলে অতি প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতিকেই বিসর্জন দিতে হবে (শ্যামাপ্রসাদ পেপার্স ২-৪ নং অংশ, ফাইল নং ৭৫/১৯৪৫-৪৬)।
*************************************
'৪৬ সালের ঘটনাক্রম সম্পর্কে হিন্দুদের প্রস্তুতির বিষয়টি কিছুটা অনালোচিত থেকে গিয়েছে। গত শতকের তিনের দশকের শেষের দিকে এবং চারের দশকের প্রথম দিকে অবিভক্ত বাংলার কলকাতা এবং সংলগ্ন মফস্বল শহরগুলিতে হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর যে সাংগঠনিক দৌরাত্ম্য দেখা গিয়েছিল, সেটি এই সময়কালের ইতিহাস রচয়িতাদের অনেকেই এড়িয়ে যেতে চান। এইসব সংগঠনের নীতিই ছিল হিন্দুদের যে কোনো মূল্যে ঐক্যবদ্ধ করা। এই কাজে হিন্দু যুবকদের দৈহিক যোগ্যতার উপরে সংগঠনের কর্তাব্যক্তিরা সবথেকে বেশি জোর দিতেন। সংগঠনের কর্মীদের আধা সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে নানাভাবে উৎসাহিত করা হতো। এই হিন্দু সংগঠন তৈরির কাজে সবথেকে জোরদার এবং সুসংগঠিতভাবে কাজ করত আরএসএস'র সহযোগী সংগঠন "ভারত সেবাশ্রম সংঘ"। ছেচল্লিশের ১৬ই আগস্ট কলকাতা এবং সন্নিহিত মফস্বলকে কেন্দ্র করে মুসলিম হত্যায় সবথেকে সংগঠিতভাবে অংশগ্রহণ করেছিল আরএসএস'র সহযোগী এই ধর্মের রাজনৈতিক কারবারি সংগঠনটি। আরএসএস'র তৎকালীন রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভার স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ছেচল্লিশের দাঙ্গাতে এই ভারত সেবাশ্রম সংঘ প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক হিন্দুদের পক্ষ অবলম্বন করে মুসলমান হত্যা, লুঠতরাজে অংশগ্রহণ করে।
ভারত সেবাশ্রম সংঘ নিজেদের প্রকাশ্যে ধর্মীয়, সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান বলে দাবি করলেও ছেচল্লিশের ঐ পরিস্থিতিতে সামরিক কৌশল গ্রহণ করে হিন্দুদের আত্মরক্ষার কথা বলে সে সম্পর্কে হিন্দুদের প্রশিক্ষণে যত্নবান হয়ে ওঠে। ভারত সেবাশ্রম সংঘের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। সেই সভাতে সভাপতিত্ব করেছিলেন স্বয়ং শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। এই সভায় ২৬০০ লোক উপস্থিত হয়েছিলেন বলে সরকারি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সভা সম্পর্কে সরকারি প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে: সভাতে বক্তারা সম্প্রদায়গত ভাগ বাঁটোয়ারার কথা তোলেন। এই প্রসঙ্গে সভাতে বক্তারা বলেন, সম্প্রদায়গত রোঁয়েদাদের অর্থ হলো, বাঙালি হিন্দুদের প্রতিহত করা। সভায় বক্তারা আরো বলেন, সাবেককালের দণ্ডিত অপরাধী পুলিন দাস এবং সতীন সেনের সাহায্য নিয়ে তাঁদের আখড়া তৈরি করে দৈহিক গঠনের প্রতি মনোযোগী হওয়া উচিত, যাতে যদি হিন্দুরা আক্রান্ত হয়, তাহলে যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এক হাজার লাঠি উঁচিয়ে ধরা সম্ভবপর হয়ে ওঠে।
এই সভা উপলক্ষ্যে বাংলায় লেখা বহু পোস্টার তৈরি করা হয়েছিল। সেইসব পোস্টারে লেখা ছিল, এখনই অহিংসার চেতনা ত্যাগ করো। এখন প্রয়োজন পৌরুষ (জি বি এস বি 'পি এইচ' সিরিজ, ফাইল নম্বর ৫১০/৩৯, মেমো ০৯/০৯/১৯৩৯)।
এই ঘটনার ঠিক দু'মাসের মাথায় ভারত সেবাশ্রম সংঘ আর একটি মিটিং ডাকে। এই মিটিংয়ের প্যান্ডেলের সামনে বাংলায় তারা লেখে, "হিন্দুরা জাগ্রত হও এবং অসুরদের হত্যার শপথ গ্রহণ করো" (প্রাগুক্ত মেমো)। এর ঠিক এক বছরের মাথায় শিবের ধর্মীয় রূপ ব্যবহার করে তাঁরা বলে উগ্র সাম্প্রদায়িক কথা। এ সম্পর্কে সরকারি প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ১৯৪০ সালের ৭ই এপ্রিল ভারত সেবাশ্রম সংঘের উদ্যোগে মহেশ্বরী ভবনে একটি হিন্দু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বি সি চট্টোপাধ্যায় ঐ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। সেখানে হিন্দুদের সামরিক মানস গড়ে তোলবার লক্ষ্যে বক্তৃতা করা হয়। সেই সভাতে ত্রিশূল হাতে শিবের একটি বড়ো ছবি ছিল। স্বামী বিজনানন্দ সেখানে বলেন, অসুরকে ধ্বংস করবার জন্যে হিন্দু দেব দেবীরা সব সময়ে বিভিন্ন অস্ত্রাদিতে সজ্জিত থাকতেন। স্বামী আদিত্যনাথ বলেন, হিন্দুর শত্রুদের মুণ্ডচ্ছেদ করতে হবে। ত্রিশুলসহ শিবের ছবির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, শিবের অনুসারীদের অস্ত্র, কমপক্ষে লাঠি হাতে নিয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, স্বামী প্রণবানন্দ পাঁচ লক্ষ হিন্দুর একটি প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলতে চান। মাড়োয়ারিদের কাছে তিনি অর্থ সাহায্যের জন্যে আবেদন জানান। হরনাম দাস নামক এক ভারত সেবাশ্রম সংঘের ভক্ত প্রত্যেক হিন্দুদের সৈনিক হওয়ার কথা বলেন। পাঁচ লক্ষ হিন্দুর একটি প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলার প্রস্তাব এই সভাতে গৃহীত হয়। সেখানে বলা হয় যে, এই প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে বারো হাজার হিন্দুকে একত্রিত করা হয়েছে (সংশ্লিষ্ট মেমো, ০৯/০৪/১৯৪০)।
আরএসএস'র সেই সময়কালের রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভার সহযোগী সংগঠন হিসেবে ভারত সেবাশ্রম সংঘ এই সময়কালে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবেই কাজ করে যাচ্ছিল। চল্লিশের দশকে ভদ্রলোক হিন্দুদের ভিতরে এই ভারত সেবাশ্রম সংঘ ধীরে ধীরে অত্যন্ত ভালোভাবে শিকড় বিস্তার করতে শুরু করে দেয়। অমৃতবাজার পত্রিকার মৃণালকান্তি ঘোষ, দৈনিক বসুমতি পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গে ভারত সেবাশ্রম সংঘের শীর্ষস্তরের সাধুদের এই সময় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয় (প্রাগুক্ত মেমো, ০৯/০৯/১৯৩৯)। '৪৭ সালেও দেখা গেছে ক্ষমতার অলিন্দের কাছাকাছি মানুষজনদের সঙ্গে এই চরম মুসলিম বিদ্বেষী, হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী সংগঠনটির দারুণ সখ্য। প্রাক্তন আই সি এস এবং সেই সময়ের মন্ত্রী বিজয়প্রসাদ সিংহ রায় এই সময়কালে ভারত সেবাশ্রম সংঘ আয়োজিত একটি হিন্দু সম্মেলনের অধিবেশনের উদ্বোধন করেছিলেন। সংশ্লিষ্ট অধিবেশনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য পি এন বন্দ্যোপাধ্যায় সভাপতিত্ব করেছিলেন (অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৮/০২/১৯৪৭)।
ভারত সেবাশ্রম সংঘের সঙ্গে তখন খানিকটা হিন্দু মহাসভার সাথে প্রতিযোগিতা করেই সম্পর্ক রাখত কংগ্রেস। কংগ্রেসও কিন্তু একটি হিন্দু স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী তৈরি করেছিল। কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত এমন ১৩টি হিন্দু স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর নাম বর্তমান প্রাবন্ধিক সংশ্লিষ্ট সময়ের পুলিশের তালিকাতে দেখেছেন (মেমো নম্বর: ডি আই আর ১০১ জি বি এস বি 'পি এম' সিরিজ, ফাইল নম্বর: ৮৮২/৪৮-২)। এ প্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখ করতে হয় এই যে, '৪৬ এর ১৬ই আগস্টের ঘটনাক্রমের জের কিছুটা সোহরাওয়ার্দির প্রতি বিদ্বেষবশতই শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত ব্যোমকেশ সিরিজের "আদিম রিপু" গল্পে শহরের মানুষের জীবনের নিরাপত্তাহীনতার জন্যে সোহরাওয়ার্দিকে এবং পাঞ্জাবি পুলিশকে দায়ী করেছেন - যার সঙ্গে ইতিহাসের কোনো সামঞ্জস্য নেই।
কংগ্রেস এই সময়কালে কিছুটা হিন্দু মহাসভার রাজনীতির পাল্টা চাল দিতে গিয়ে রাজনৈতিক হিন্দুদের সঙ্গে একটা ঘনিষ্ঠতা তৈরি করে কার্যত হিন্দু সাম্প্রদায়িক অবস্থান গ্রহণ করতো। কংগ্রেস এই সময় নিজেদের ছত্রছায়ার ভিতরে কিছু রাজনৈতিক হিন্দু সংগঠন তৈরি করেছিল। সেই সংগঠনগুলি সরাসরি ভারত সেবাশ্রম সংঘের সাম্প্রদায়িক সভা সমিতিতে যোগ দিত। চন্দ্রনাথ মন্দির তথাকথিত অপবিত্র করবার ঘটনা সেই সময়কালের একটি বড়ো সাম্প্রদায়িক প্ররোচনামূলক ঘটনা। রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের পক্ষ থেকে এই ঘটনার দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের উপর। যার জেরে সমসমায়িককালে রাজনৈতিক পরিবেশ যথেষ্ট উত্তপ্ত হয়েছিল। চন্দ্রনাথ মন্দিরের ঘটনাক্রমকে কেন্দ্র করে ভারত সেবাশ্রম সংঘ '৪৬ সালের মে মাসে একটি জনসভা সংগঠিত করেছিল। সংশ্লিষ্ট সভাটিতে সভাপতিত্ব করেছিলেন সেই সময়কালের বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা শশাঙ্ক শেখর সান্যাল (জি বি এস বি 'পি এইচ' সিরিজ, ফাইল নম্বর ৫১০/৩৯, ২৫/০৪/১৯৪৬)।
ক্ষমতা হস্তান্তরের অব্যবহিত আগে নিজেদের সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী প্রণবানন্দের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ভারত সেবাশ্রম সংঘ একটি শোভাযাত্রার আয়োজন করেছিল। সেই শোভাযাত্রায় কংগ্রেস দল উল্লেখযোগ্যভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। এ সম্পর্কে সরকারি প্রতিবেদনে লেখা হচ্ছে, কংগ্রেস দলের সভ্য, সমর্থকেরা ছিল সাদা জামা, হাফ প্যান্ট এবং গান্ধী টুপি পড়ে। তাঁদের হাতে ছিল জাতীয় কংগ্রেসের পতাকা। তাছাড়াও বিভিন্ন পোস্টার, যেখানে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্ববান ছিল। তাছাড়াও শিবাজী ও রানা প্রতাপের আদর্শ অনুসরণ করে হিন্দু সমাজকে শক্তিশালী হওয়ার আহবান ছিল (প্রাগুক্ত, ১৯/০২/১৯৪৭)।
কমিউনিস্ট আন্দোলনের বাইরে থাকা অতীতের সশস্ত্র বিপ্লবীদের একত্র করে রাজনৈতিক হিন্দুদের সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই সময়ে হিন্দু মহাসভা, আরএসএস, কংগ্রেস, ভারত সেবাশ্রম সংঘ সহ রাজনৈতিক হিন্দু ভাবধারার অনুরাগী সংগঠনগুলি যথেষ্ট তৎপর হয়ে ওঠে। বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাশ এবং সতীন সেন, যাঁরা এককালে ছিলেন "যুগান্তর" দলের সদস্য, তাঁদেরকে ভারত সেবাশ্রম সংঘ নিজেদের 'মার্শাল আর্টে'র পরামর্শদাতা হিসেবে নিয়োজিত করল। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, সাবেক যুগান্তর দলের মাদারিপুর শাখা (অবিভক্ত ফরিদপুর জেলার) ১৯৪১ সালে ভারত সেবাশ্রম সংঘের স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল (ঢাকা ডিভিশনের কমিশনারের প্রতিবেদন। এল ও এফ সি আর , প্রথম অংশ, মার্চ, '৪১, জি বি এইচ সি পি বি, ১৩/৪১)। মাদারিপুরে যুগান্তর দলের বিশিষ্ট বিপ্লবী কল্যাণকুমার নাগ এই সময়ে একই সঙ্গে ভারত সেবাশ্রম সংঘ এবং হিন্দু মহাসভাতে যোগদান করেন। ভারত সেবাশ্রম সংঘে এঁর নাম ছিল স্বামী সত্যানন্দ। তিনি যুগান্তর দলে থেকেই ১৯২৬ সালে মাদারিপুর অঞ্চলে 'হিন্দু মিশন' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন (হিন্দু মিশন সম্পর্কে সরকারি প্রতিবেদনের জন্যে দেখুন - জি বি এস বি 'পি ই এইচ' সিরিজ, ফাইল নম্বর - ৫০২/৪২)।
*************************************
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতো চরম প্রতিক্রিয়াশীল মানুষটির গ্রহণযোগ্যতা তৈরিতে সংশোধনবাদী কমিউনিস্টরা যে ভূমিকা পালন করেছিলেন আজ ঢোক গিলে দু-চারটি প্রলাপ বকে সেই পাপস্খলন কি আদৌ সম্ভব? হ্যাঁ, আমি আরএসএস-এর মুখপত্রে সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে অধ্যাপক হীরেন্দ্ৰনাথ মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধের কথাই বলছি। 'পাঞ্চজন্য'-এ হীরেনবাবুর এই লেখাটি যেভাবে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মানুষদের কাছে শ্যামাপ্রসাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছে তার মূল্য আজ আমাদের দিতে হচ্ছে। আরএসএস দশটিরও বেশি ভারতীয় ভাষায় হীরেনবাবুর এই প্রবন্ধটির অনুবাদ করে প্রচার চালিয়েছে। আজ বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বাঙালিদের মধ্যে শ্যামাপ্রসাদ সম্পর্কে যে ক্রেজ তৈরি হয়েছে তা সৃষ্টির দায় থেকে কোনো অবস্থাতেই সিপিআই এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে অব্যাহতি দেওয়া যায় না।
*************************************
সঙ্কীর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা এম এ ক্লাসের ছাত্র শহিদুল্লাকে বেদ পড়াতে অস্বীকার করায় তাঁর প্রতি উপাচার্য স্যার আশুতোষের আন্তরিক ব্যবহার এবং প্রবল সহানুভূতি আমাদের দেশের চিরাচরিত শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কেরই একটি অনুবর্তন। অথচ ১৯৩৭ সালে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ দীক্ষান্ত ভাষণ মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা কেবলমাত্র উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদের সাম্প্রদায়িক এবং পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণের জন্য বয়কট করে। সমগ্র পরিস্থিতিকে উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ এতটাই জটিল করে তুলেছিলেন যে, মুসলমান সমাজের কাছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় 'যবন বর্জিত বিদ্যাপীঠ' নামে পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীক থেকে শুরু করে প্রশ্নপত্র, সিলেবাস, শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ - সব ক্ষেত্রেই ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতাবোধ থেকে শ্যামাপ্রসা চরম সাম্প্রদায়িক, প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করেছিলেন।
*************************************
শ্যামাপ্রসাদ যে হিন্দু মহাসভার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন সেই হিন্দু মহাসভা কোনদিনই আমাদের জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি। হিন্দু মহাসভা এবং আরএসএস-এর প্রথম যুগের নেতা বি এস মুঞ্চের বক্তব্য ছিল, 'আমরা কংগ্রেসের সহযোগিতা এবং অহিংসা নীতিতে বিশ্বাস করি না, আমরা তার বিরোধী। আমরা সমবেদনাপূর্ণ সহযোগিতায় বিশ্বাসী।' হিন্দু মহাসভা কোনোদিন ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোন সশস্ত্র আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেনি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভেদনীতির যে খেলা খেলেছিল সেই খেলায় তাদের প্রধান সহযোগী ছিল হিন্দু মহাসভা, যার নেতৃত্বে ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। হিন্দু মহাসভার বিশ্বাস ছিল, 'ভারতবর্ষে বসবাসকারী আমরা একটি জাতিরূপে চিহ্নিত। আমাদের যে কেবল একটিই মাতৃভূমি এবং আঞ্চলিক একতা আছে তা নয়। পৃথিবীর অন্যত্র যা নেই সেই একটি পবিত্রভূমি আমাদের আছে। এটি আমাদের মাতৃভূমির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। হিন্দুরা কোন সন্ধি-সূত্রে বাঁধা জাতি নয়, তারা একটি সুসংবদ্ধ জাতির মানুষ। আমাদের সাহসের সঙ্গে এই অপ্রীতিকর ঘটনা মেনে নিতে হবে যে ভারতবর্ষে দুটি জাতি আছে - 'হিন্দু এবং মুসলমান' - হিন্দু মহাসভার কলকাতা সম্মেলনে সাভারকরের এই বক্তব্যই (১৯৪০ সালে) পরবর্তীতে ধ্বনিত হয়েছে শ্যামাপ্রসাদের কণ্ঠে; ১৯৪৭ সালের ৫ এপ্রিল তারকেশ্বরে হিন্দু মহাসভার সম্মেলনে তিনি বলেছেন, 'I can conceive of no other solution of the communal problem in Bengal than to divide the province and let the two major communities residing herein live in peace and freedom.'
*************************************
বঙ্গভঙ্গের দাবিতে শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে প্রকাশ্য জনসভা করেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সুরেন্দ্রনাথ সেন। বঙ্গভঙ্গ চেয়ে বড়লাট লিন্টওয়েলের কাছে ১৯৪৭ সালের ৭ মে টেলিবার্তা পাঠান। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, স্যার যদুনাথ সরকার, ড. মেঘনাথ সাহা, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং ড. শিশিরকুমার মিত্র, স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং স্যার জন ওয়ান্ডার অ্যান্ডারসনকেও তারা এই দাবিতে টেলিবার্তা পাঠান। ১ জুন কলকাতার সিংহীপার্কে হিন্দু মহাসভার উদ্যোগে বাংলা ভাগের পক্ষে এক জনসভায় বক্তৃতা করেন স্যার যদুনাথ। দলিত নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল বাংলা ভাগের বিরোধিতা করলে হিন্দু মহাসভার পক্ষ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে অসম্মানজনক প্রচার চালানো শুরু হয়ে যায়।
*************************************
১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট, অর্থাৎ, ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় থেকে ১৯৫০ সালের ২৫ জানুয়ারী মধ্যরাত পর্যন্ত সময়কাল ভারত শাসিত হয়েছিল এই ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী। সেই সময় সেটিকেই ভারতবর্ষের সংবিধান হিসেবে গণ্য করা হত।
আমাদের মনে রাখার দরকার যে, দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির ক্ষেত্রে এই ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের যে পরিকাঠামো ছিল, সেই পরিকাঠামোই কিন্তু ব্যবহার করা হয়েছিল। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি দেশীয় রাজ্যবর্গকে ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করার যে কৃতিত্বের ভাগীদার করেন, মজার কথা হলো, সেই তথাকথিত কৃতিত্বের ভিত্তি কিন্তু সর্দার প্যাটেল তৈরি করেননি। স্বাধীন ভারতবর্ষের মানুষের তৈরি করা আইনের ধারাতেও দেশীয় রাজ্যগুলির অন্তর্ভুক্তি হয়নি - হয়েছিল ব্রিটিশের তৈরি করা আইনের বলে।
*************************************
ভারতীয় সংবিধানে কাশ্মীরে ৩৭০ নম্বর ধারায় যে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল সেটি যখন প্রস্তাবিত হয় এবং গৃহীত হয়, তখন ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন সর্দার প্যাটেলের মতোই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
মজার কথা হলো শ্যামাপ্রসাদ কিন্তু একবারের জন্যও এই ৩৭০ নম্বর ধারার প্রস্তাব এবং সেটি গৃহীত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগের কথা কল্পনাও করেননি। বরঞ্চ ৩৭০ ধারা নিয়ে শ্যামাপ্রসাদের অবস্থানের তীব্র সমালোচনা করে জম্মু কাশ্মীর গণপরিষদের এক ভাষণে শেখ আবদুল্লাহ যখন বক্তব্য রাখেন, হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষ থেকে তার বিরোধিতা করে উচ্চারিত হয়নি।
*************************************