Friday, 12 April 2019

কাস্ত্রোর সঙ্গে : ধর্ম প্রসঙ্গে


বহু শতাব্দী ধরে উপনিবেশবাদ ছিল এক বাস্তব সত্য। বিভিন্ন মহাদেশগুলি ইওরোপীয় শক্তিরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল, এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকাকে ভাগ করা হয়, দখল করা হয় ও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শোষণ করা হয়। ইওরোপীয়ানরা তাদের সঙ্গে এনেছিল তাদের ধর্মকে; এক অর্থে এই ধর্ম ছিল দখলদারদের, দাস মালিকদের, শোষণকারীদের ধর্ম। একথা সত্য যে এই ধর্মের যে প্রকৃতি, আমি বলব এর যে মানবিক উপাদান, সৌভ্রাতৃত্বের যে মহান আদর্শ এর মর্মবস্তু, সে মর্মবস্তুর সঙ্গে দখলদারদের লোকদেখানো ধর্মের বিরোধিতা ছিল এবং আমি এই প্রসঙ্গে ধর্মযাজকদের কথা বলছি না - কিন্তু এই একই ধর্ম সেই প্রাচীন রোমে শেষ পর্যন্ত দাসদের ধর্মে পরিণত হয়। পৃথিবীর এই গোলার্ধে, যেখানে স্পেনীয়রা তিন শতাব্দী ধরে ছিল, কিউবায় ছিল প্রায় চার শতাব্দী, কারণ এই দেশটাই তারা সবার আগে দখল করে এবং সবশেষে মুক্তি পায় - স্বাভাবিকভাবে জয়ী পক্ষের ধর্ম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

এশিয়ার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেনি, কারণ সেখানে অন্য ধর্ম ছিল, যার শিকড় অনেক গভীরে এবং সেখানে প্রাচীন সংস্কৃতির প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল বেশি - হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও অন্যান্য স্থানীয় ধর্মের উপাদানও ছিল অনেক সমৃদ্ধ। ফলে সেখানে অন্যধর্মের সঙ্গে, অন্য দর্শনের সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের সংঘাত হয়েছে, ফলে তাদের প্রভাব ততটা ছড়ায়নি, ততটা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। আরব দুনিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে ইসলাম থেকেই গেছে, খ্রিশ্চান ধর্মযুদ্ধ ও পশ্চিমী ইউরোপীয় আধিপত্য সত্ত্বেও। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতে হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম থেকে গেছে, যদিও ওইসব দেশ ইউরোপের উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। ভারতে এবং এশিয়ার অন্য অঞ্চলে যেমন চিনে ইউরোপীয় আধিপত্য সত্ত্বেও তাদের নিজস্ব ধর্ম টিকে গেছে।

===========================================

ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে এইসব ঘটনাটাকে যদি বিশ্লেষণ করা যায় তবে একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে এই বিজেতা, শোষক এবং অত্যাচারীদের চার্চ বিজেতা, অত্যাচারী ও শোষকদের পাশেই ছিল। তারা কখনই সুনির্দিষ্টভাবে দাসত্বকে ধিক্কার জানায়নি, যে ব্যবস্থা আজ আমাদের বিবেকের কাছে ঘৃণিত। কৃষ্ণাঙ্গ ও ইন্ডিয়ানদের ক্রীতদাস বানানোকে কখনই ধিক্কার জানানো হয়নি। চার্চ কখনও আদিম অধিবাসী জনসাধারণকে নিকেশ করা ও ওইসব মানুষদের উপর অন্যান্য অপরাধকে নিন্দা করেনি - প্রকৃতপক্ষে তাদের জমি, সম্পদ, সংস্কৃতি এবং এমনকি তাদের প্রাণও লুট করা হয়েছিল। কোনো একটা চার্চ এইসব অপরাধকে ধিক্কার জানায়নি এবং এই ব্যবস্থা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চালু ছিল।

সুতরাং এইসব যুগ যুগ ধরে চলে আসা অবিচারের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে একটা ধর্মবিরোধী স্পিরিট ছিল। হ্যাঁ, একথা অবশ্যই সত্য বিপ্লবী আন্দোলনের অভ্যন্তরে এইসব আইডিয়া উদ্ভবের পিছনে কতগুলি বস্তুগত ঐতিহাসিক কারণও ছিল। এইসব আইডিয়া ছিল ফরাসি বিপ্লবে, ছিল বলশেভিক বিপ্লবেও। এই আদর্শ প্রথম উদয় হয় উদারনীতিবাদে। জাঁ জ্য়ক রুশো এবং ফরাসি বিশ্বকোষ প্রণেতাদের মধ্যে এই ধর্ম-বিরোধী স্পিরিট ছিল। এই আইডিয়া সমাজতন্ত্রের আদর্শের মধ্যে হঠাৎ এসেছে এমন নয়, ঐতিহাসিক কারণেই তা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মধ্যে এসেছে। কখনই চার্চের থেকে পুঁজিবাদকে ধিক্কার জানানো হয়নি। হয়ত আজ থেকে ১০০ কিংবা ২০০ বছর পর যখন পুঁজিবাদ সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে যাবে তখন কেউ হয় তিক্ত ভাষায় বলবে, "শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পুঁজিপতিদের চার্চ কখনও পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থাকে ধিক্কার জানায়নি"; ঠিক যেমন আজকে মানুষ বলছে যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চার্চ দাস ব্যবস্থাকে, ইন্ডিয়ানদের নিকেশ করাকে এবং ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাকে ধিক্কার জানায়নি।

বর্তমানে বিপ্লবীরা বর্তমান শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন, যা অত্যন্ত নির্দয়। অথচ সব ভুল কাজেরই একটা ব্যাখ্যা থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সেটা ভুলই। মূল কথা হল একটা আইডিয়া অথবা বিপ্লবী সামাজিক কর্মসূচিকে কী করে বাস্তবে রূপায়িত করা হবে। আপনি যদি একথা বলেন যে লাতিন আমেরিকার বর্তমান পরিস্থিতিতে খ্রিশ্চানরা হল সংখ্যাগুরু এবং তারাও বর্তমান ব্যবস্থার ভয়ানকরকম শিকার - সুতরাং তারা যখন ন্যায়বিচার চাইছে তখন তাদেরকে বুঝিয়ে একটা সাধারণ সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করার কথা আপনি বলছেন - আমি এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে একমত। আমি আরো জোরালোভাবে আপনার সঙ্গে একমত একারণে লাতিন আমেরিকার খ্রিশ্চানদের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের মধ্যে জাগরণ দেখতে পাচ্ছি। এই সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মাথায় রেখে আমরা যদি বিশ্লেষণ করি তবে একথা বলা সম্পূর্ণ সঠিক এবং যুক্তিসঙ্গত হবে এ বিষয়ে বিপ্লবী আন্দোলনের একটি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা দরকার এবং যে কোনও মূল্যে তাত্ত্বিক বাগাড়ম্বরকে এড়িয়ে যাওয়া উচিত - কারণ তা শ্রমিক, কৃষক ও মধ্যবিত্তের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে - এই ধরনের বাগাড়ম্বর শুধু শোষণ ব্যবস্থার স্বার্থকেই রাখা করে।

আমি বলব, নতুন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বামপন্থীরা এ বিষয়টি নিয়ে আগে যেভাবে ভাবত, তার বদল হওয়া দরকার। এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। এ নিয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই। ইতিহাসের এক দীর্ঘসময়ে ধর্মীয় বিশ্বাসকে ব্যবহার করা হয়েছিল আধিপত্য ও শোষণের জন্য। সুতরাং যেসব মানুষ সেই অবিচারের ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন, তাঁরা ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে, তার বিভিন্ন হাতিয়ারের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হবেন এটাই স্বাভাবিক।

===========================================

আমি বলেছি যে যারা কৌশলে কার্যসিদ্ধি করতে চায় তারা কখনোই কারোর সন্মান পায় না এবং কোথাও সফল হয় না। এইসব কৌশলীরা যেন ছোট নৌকা, হাওয়া আর স্রোত যেদিকে সেদিকে চলে। এই কৌশলে কার্যসিদ্ধি হল সুবিধাবাদেরই নামান্তর। এর কোনো সারবত্তা নেই, এর কোনো শিকড় নেই, আপনার যদি মনে হয় আমি একজন সুবিধাবাদী তাহলে আমার প্রতি আপনার কোনো শ্রদ্ধা থাকবে না এবং একইভাবে কোনো বিপ্লবী যদি আপনাকে বা অন্য কাউকে মনে করে যে এই ব্যক্তি কায়দা করে কাজ হাসিল করে তাহলে সেক্ষেত্রে আপনি শ্রদ্ধা পাবেন না। আমি মনে করি সন্মান, সম্পর্ক, গভীর বিশ্লেষণ ও বোঝাপড়া তাঁদের মধ্যেই গড়ে ওঠা সম্ভব যাঁরা নিজের কাছে সৎ এবং অন্যের কাছেও। আপনার বিশ্বাসের মধ্যে যদি গভীরতা না থাকে, তাহলে আপনার আইডিয়া আমার মনের মধ্যে কোনো ছাপ ফেলবে না।

ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে আমি যে শ্রদ্ধা করি, তার কারণ ধর্মের বিষয়ে আপনার বিশ্বাস খুব গভীর। আমি নিশ্চিত চার্চের অন্যান্য সদস্যরা, যাঁরা আপনারই মতো এইসব সমস্যা নিয়ে ভাবিত, তাঁরাও আপনারই মতো। যদি বিপ্লবীরা মনে করত আপনারা সৎ নন, তাহলে আপনারা যা কিছুই বলুন না কেন তার কোনো অর্থ নেই - আপনাদের সঙ্গে যেসব আইডিয়া নিয়ে আলোচনা করেছি বা ঐক্য গড়ে তুলতে চেয়েছি সেগুলোও মূল্যহীন। একথা আমি আগেই নিকারাগুয়াতে বলেছি যে একজন খাঁটি মার্কসবাদী একজন মেকি খ্রিষ্টানকে বিশ্বাস করবে না এবং সত্যিকারের খ্রিস্টান যে সে একটি মেকি মার্কসবাদীকে বিশ্বাস করবে না। একমাত্র এই বিশ্বাসই একটি সত্যিকারের শক্তিশালী দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে।

এই প্রসঙ্গ আপাতত থাকে। কথায় বলে "খোঁড়ার চেয়ে মিথ্যাবাদীকে চেনা সহজ।" কপটতা করে কেউ নিজেকে খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী অথবা বিপ্লবী প্রমাণ করতে পারবে না, এবং মিথ্যাকে চাপা দেওয়া যায় না।

===========================================

Sunday, 7 April 2019

অপসংস্কৃতি ?

ঋগ্বেদে নারীর বিষয়ে প্রথম উল্লেখটি হল, 'স্বয়ং সা মিত্ৰং বনুতে জনেচিৎ' নারী জনসমাজের মধ্যে নিজেই নিজের বন্ধু বা সঙ্গীকে বেছে নেয়।

====================================================

এখন সমাজে বহু প্রাচীন নিষেধকে অগ্রাহ্য করার জোয়ার এসেছে। বিগত পাঁচ ছশ' বছর সমাজে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা নিয়ে কঠোর নিষেধ চাপানো ছিল; বর্তমানের ছেলেমেয়েরা সেটা অগ্রাহ্য করছে। কিন্তু এইটে কি ঐতিহ্যের বাইরে? বরং মধ্যযুগে যে নিষেধ আরোপিত হয়েছিল তাকেই এরা ভাঙছে। এবং ভাঙবার পর্বে কিছু আতিশয্য এসেই যায়; বিশেষত, রক্ষণশীল প্রতিপক্ষকে স্পর্ধার সঙ্গে তাচ্ছিল্য করার একটা মনোভাব এর মধ্যে আছে যেটা সর্বত্রই প্রতিবাদের স্বাভাবিক প্রকাশ। রক্ষণশীল অংশ সমাজে যদি একটু সহিষ্ণুতা অবলম্বন করেন তাহলে আতিশয্যটা কেটে যাবে একদিন; নারীপুরুষের যৌন এবং যে কোনো বন্ধুত্ব, ঘনিষ্ঠতা অনেক শোভন ও সহনীয় রূপে দেখা দেবে। আজ যেটাকে উচ্ছৃঙ্খলতা মনে হচ্ছে তার অনেকটাই পূর্ব প্রজন্মর প্রতি স্পর্ধিত অবজ্ঞা। ঐ প্রজন্ম এটাকে অবজ্ঞা করতে পারলে অনেক বাড়াবাড়ি ধিমিয়ে আসবে।

====================================================

বহু পূর্বে আর্যরা এ দেশে যখন আসে তখন তারা 'র' প্রধান ভাষা ব্যবহার করত। শ্রীযুক্ত অর্থে ওরা বলত 'শ্রীর' (র = যুক্ত)। কিছুদিন পরে যখন তারা দক্ষিণ দিকে এগোচ্ছিল তখন অনার্য স্থানীয় অধিবাসীদের কথ্য ভাষার প্রভাবে আর্যদের 'র' ক্রমে অনার্যদের 'ল'-য়ে পরিণত হয়। তখন শ্রীর হয় শ্রীল; আরও পরে শ্লীল, মানেটা রইল 'শ্রীযুক্ত'। এর বিপরীত অর্থ হল অশ্লীল অর্থাৎ শ্রীহীন। আমরা সচেতন নই যে আজকে যখন কিছুকে অশ্লীল বলি তখন মূল যে অর্থটি প্রকাশ করতে চাই তা হল শ্রীহীন। তাহলে মাপকাঠিটা হল সৌন্দর্য। এখন সৌন্দর্যের নিরিখ যুগে যুগে পালটেছে, থামেনি কোথাও। তবু সুপ্রাচীন গ্রীক, মিসরীয়, এশিরীয়, ব্যাবিলনীয়, মেক্সিকীয় এবং ভারতীয় স্থাপত্য ভাস্কর্যের যে নিদর্শন এখনো দেখে আমরা মুগ্ধ হই তার কারণ দীর্ঘ জগ পার করে ঐসব শিল্পকর্মে একটি শ্রী আছে যা ইতিহাস ও ভূগোলের বিপুল দূরত্বকে অতিক্রম করে মানুষের চিত্ত জয় করতে পেরেছে। প্রাচীন রাগরাগিণী, চিত্রশিল্প, সাহিত্য, অভিনয়, নৃত্যগীতের যে নিদর্শন আমাদের যুগ পর্যন্ত পৌঁছে আমাদের মুগ্ধ করে তার অন্তর্নিহিত রহস্যও ঐ শ্রী, সৌন্দর্য। এর কোনো স্থির সংজ্ঞা নেই, কিন্তু যুগে যুগে স্বীকৃত একটি সার্বজনীন গ্রাহ্যতার ভূমি আছে। যখন কোনো যুগ, বা কোনো দেশ একে লঙ্ঘন করে; তখন লঙ্ঘন করার একটা তাৎক্ষণিক উল্লাস নিশ্চয়ই থাকে। লঙ্ঘনকারীরা তাতে বেশ কিছুকাল আপ্লুত থাকতে পারে, কিন্তু একটা সম্ভাবনা থেকেই যায় যে ওরা তাৎক্ষণিক উল্লাস পেরিয়ে একদিন নিজেদের উদ্দামতার মধ্যে সৌন্দর্যের অভাব অনুভব করে অতৃপ্তি বোধ করবে। তখন ঐ শ্রীহীনতার অপূর্ণতা লক্ষ করবে এবং নিজেদের উদ্দাম আত্মপ্রকাশের মধ্যে শ্রী সঞ্চারিত করবার চেষ্টা করবে। ফলে যা দাঁড়াবে তা হয়ত আমাদের পরিচিত নয়, কিন্তু সেই অপরিচিত প্রকাশের মধ্যে আমরা হয়ত শ্রীয়ের এক নতুন প্রকাশ দেখতে পাব। এমনটা বারেবারেই ঘটেছে সভ্যতার ইতিহাসে এবং এই ধরনের বিবর্তনের মধ্যেই সভ্যতার অগ্রগতি হয়ে চলেছে। কাজেই ভবিষ্যৎকে চিরকালের মত অন্ধকার মনে করার কোনো কারণ নেই।

====================================================

পাশ্চাত্য সব কিছুকে নকল করার প্রবৃত্তি ঊনবিংশ শতকের ওপরতলার ছোট একটা সুবিধাভোগী শ্রেণীর মধ্যে খুব বেশি ছিল। কিন্তু দেশটা যেহেতু তখনও পরাধীন তাই শাসক শ্রেণীর আচার-আচরণকে পরিহার করার প্রবণতা পরিব্যাপ্ত ছিল অধিকাংশ মানুষের মধ্যে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই ঐ বাধাটা দূর হল, ফলে, বিশেষত মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে ভুল উচ্চারণে, ভুল ভাষায় যত্রতত্র ইংরিজী বলার এবং ভুল উচ্চারণে ও বেসুরে বিলিতি গান গাওয়ার অভ্যাস দ্রূত বেড়ে গেল। তেমনই পাশ্চাত্য পোষাক, গান, নাচ, চলাফেরার ভঙ্গী, উৎসব নাটক সব কিছুরই বেশি প্রচলন হল। এখন বাঙালি মধ্যবিত্ত আর 'স্বামী', 'স্ত্রী' বলে না, বলে হাজব্যান্ড ওয়াইফ। টিভির বিজ্ঞাপনে পাশ্চাত্য জামাকাপড় পরা মেয়ে কৌপীন পরা পুরুষ দেখে সাহেবদের ভাষায় বিস্ময় ও আবেগ প্রকাশ করে, 'ওয়াও' বলেও মূর্ছাও যায়। প্রায় প্রত্যেকটি পণ্যদ্রব্যের বিজ্ঞাপনে বিদেশী পোশাকে তরুণতরুণী বিদেশী কেতায় নাচগান করে এবং এদের উচ্চারণে মার্কিনি প্রভাব স্পষ্টতই লক্ষণীয়, কারণ খেলো মার্কিন সিনেমাই এদের প্রেরণার উৎস। যত্রতত্র নাচ এখন প্রায় প্রত্যেকটি বিজ্ঞাপনের অপরিহার্য অঙ্গ এবং প্রায়শই সে নাচ বিদেশী। এর কারণ নকল করার মত দেশী নাচগানের কোনো নজির নেই, জীবনে, অভিনয়ে বা সিনেমায়। যা আছে তা পাশ্চাত্য নাচগানেরই নকল। অতএব পাশ্চাত্য আধুনিক সিনেমার প্রভাবে এই যে নাচগান চলছে তা শিক্ষিত মানুষের রুচিতে বাধছে, এর মধ্যে হাত পা নেড়ে উদ্দামতা প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছু নেই। এটা অপসংস্কৃতি নয়, কিন্তু নেহাৎই রুচিগর্হিত।

====================================================

মার্ক্স বলেছিলেন স্থিতি, প্রতিস্থিতি ও সংস্থিতি এই পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে এগোয় সমাজ। প্রথমে যা থাকে তা একদিন অপ্রয়োজনীয় অবাঞ্ছিত বলে প্রতিভাত হয়, তখন মানুষ তীব্রভাবে তার বিরুদ্ধ অবস্থানটি গ্রহণ করে, এটাই স্থিতিকে নাকচ করার জন্যে প্রবর্তিত প্রতিস্থিতি। তারপর একদিন প্রতিস্থিতির উপযোগিতা ফুরোয় তার অতিশয্যকে বর্জন করে তার সঙ্গে স্থিতির সমন্বয় ঘটায় মানুষ, সেটাই সংস্থিতি। আমাদের বেশবাস, উৎসব অনুষ্ঠান, নাচগানের বিবর্তনও এই স্থিতি-প্রতিস্থিতি-সংস্থিতির পর্যায়ে ঘটতে থাকে অনিবার্যভাবেই। কোনটা কতদিনে বদলাবে, কীভাবে, কেন ও কতটা বদলাবে তা আগে থেকে বলা যায় না ; তবে বিবর্তন এই অমোঘ নীতিতেই দীর্ঘকাল ধরে চলেছে মানবসভ্যতার সব ক্ষেত্রেই। এখানেও এই রীতিতেই বিবর্তন ঘটবে, ধৈর্য হারালে চলবে না। সব পরিবর্তন সর্বত্র সকলকে সন্তুষ্ট করতে পারে না, কিন্তু ভেতরের রুচির তাগিদই একদিন আবরণে ও আচরণে পরিবর্তন আনবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

====================================================

সংস্কৃত ভাষায় 'সংস্কৃতি'র তিনটি বিরুদ্ধ ধারণা আছে (ক) প্রকৃতি, (খ) বিকৃতি এবং (গ) সংস্কৃতি। প্রকৃতি মানে কোনো বস্তুর যে সাধারণ রূপ, যেমন মাটি, সোনা। বিকৃতি এর অর্থ 'বিশেষ কৃতি', বিশেষভাবে নির্মিত; বাংলার বিকার বা বিকৃত অর্থ নয়। এই বিকৃতির উদাহরণ হল যেমন মাটির কলসী, সোনার গয়না। অর্থাৎ প্রকৃতি দিয়ে মানুষের প্রয়োজনে শিল্পবোধ দিয়ে যে নির্মাণ। সংস্কৃতি হল বিকৃতির সুস্থতর ও সুন্দরতর রূপ, গান হল কণ্ঠস্বরের সুন্দর প্রকাশ, দৈনন্দিন কণ্ঠস্বরে কথাবার্তা বলা প্রকৃতির কাছাকাছি, তার সংস্কৃত অর্থাৎ শুদ্ধ ও সুন্দর মার্জিত বাগধারার প্রকাশ হল আবৃত্তি ও গান। এখন প্রকৃতিতে যেটি যেমনভাবে পাওয়া যায় তারই মনোরম রূপ বিবর্তন ঘটানোই সংস্কার বা সংস্কৃতি। আগেই বেদের উদ্ধৃতি দিয়েছি : আত্মসংস্কৃতির্বাব শিল্পানি। এ সংস্কৃতি হল শিল্পীর নিজের চেতনা ও বোধের সংস্কার, যার দ্বারা সে শিল্পবস্তু নির্মাণ করতে পারে ও করে। এ শিল্পবস্তু প্রকৃতি থেকে সরে আসা এক নির্মিত রূপ। প্রকৃতিকে শুদ্ধতর ও সুন্দরতর করার ফলই তাহলে সংস্কৃতি। মানুষের সভ্যতার ইতিহাসই হল প্রকৃতি থেকে সংস্কৃতিতে উত্তরণ। 

====================================================

যুগে যুগে আগেকার জীবনধারা রক্ষা করবার জন্যে উগ্র চেষ্টা করেছে রক্ষণশীল গোষ্ঠী এবং তারই সঙ্গে যা কিছু প্রগতিশীল তার প্রভাবকে রুখতে চেষ্টা করেছে।

লক্ষ করলে দেখা যাবে বর্তমানে অপসংস্কৃতি নিয়ে যে শুচিবায়ুগ্রস্ত মনোভাব সমাজে প্রবল তার মধ্যে তিনটি দিক --- প্রধানত, পাশ্চাত্য প্রভাবের সম্বন্ধে বিরূপতা, দ্বিতীয়ত এবং এটাও পাশ্চাত্য প্রভাবের পরোক্ষ ফল মেয়েদের নতুন আচরণে আপত্তি, তৃতীয়ত যা কিছু দেশজ তার সম্বন্ধে অন্ধ আনুগত্য। পাশ্চাত্য প্রভাব দেশে আজ নতুন আসেনি; কিন্তু এখনকার সমাজে পাশ্চাত্য প্রভাবের যে উদগ্র অনুকরণ সেইটেকেই অপসংস্কৃতি বলছে রক্ষণশীল মানুষ।

====================================================

সাম্যবাদ আমাদের শিখিয়েছে, স্থিতির পরে আসে তার (প্রতিবাদী) প্রতিস্থিতি আর একদিন তার মধ্যেও স্ববিরোধ অবক্ষয় বা অন্যায়ের বীজ প্রকট হয়ে উঠলে উভয়ের সংঘর্ষ ও সমন্বয়ের ফলে আসে সংস্থিতি।

====================================================

... সংস্কৃতির সংজ্ঞার একটা দিক হল নারীর অবদমন, ব্যতিক্রম ঘটলে তার নাম অপসংস্কৃতি। নারীকে সর্বতোভাবে পুরুষের থেকে হীন প্রতিপন্ন করলে তাকে বশীভূত রাখা যায়। এর পিছনে রাষ্ট্রেরও একটা ভূমিকা আছে। নারীর অবদমন পুরুষতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটা আবশ্যিক শর্ত, রাষ্ট্র চায়, পুরুষসমাজকে বশংবদ রাখতে। ছলে, প্রলোভনে, প্রসাদবিতরণে। এতে পুরুষ রাষ্ট্রের স্বার্থের অনুকূল আচরণ করবে এবং নারীর স্বতন্ত্র সত্তা, স্বার্থ, অস্তিত্ব স্বীকার করার কোনো প্রয়োজন থাকবে না রাষ্ট্রের।

====================================================

অপসংস্কৃতির একটা লক্ষণ, নারীর অধীনতা না মানা। অন্য একটা প্রধান লক্ষণ হল, যা কিছু পাশ্চাত্য তাকেই অপসংস্কৃতি বলে অভিহিত করা। পাশ্চাত্য প্রভাব গত আড়াইশ' বছর ধরে কীভাবে সমস্ত সমাজ জীবনে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে তা লক্ষ করি না বলে আজকের এই উগ্র প্রতিবাদ। ঘড়ি, চেয়ার, টেবল, ট্রেন, মোটরকার, ফোন, ফ্রিজ, আধুনিক চিকিৎসা, জ্ঞানবিজ্ঞান, বিশেষত বিজ্ঞানের ও প্রযুক্তির চর্চা দেশে সমাজজীবনে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে কারণ এগুলো এমন বিষয়ে জীবনকে সহজ, গতিশীল করে, সময়সংক্ষেপ করে, নানাভাবে ব্যয়সংকোচনও করে যাতে জীবন যাপন সহজ, দ্রুত এবং আরামের হয়। কিন্তু তার বাইরে যদি জ্যাজ, বিচিত্র বেশবাস, নারীপুরুষের যৌথ বা সমবেত নৃত্য, উৎসব অনুষ্ঠানে নতুন বিদেশী আঙ্গিক দেখা দেয়, বিলিতি সুর, বিলিতি খাবার এবং নৃত্যভঙ্গীর চলন হয় তাহলে সেটা শুধু বিজাতীয় বলে পরিত্যাজ্য নয়, অপসংস্কৃতি বলেও সর্বতোভাবে পরিহরণীয়। এই হল এখনকার নতুন মনোভাব। এরা ভুলে গেছে যে, সেই ঊনবিংশ শতকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ কত বিলিতি সুরে গান রচনা করেছেন। বিলিতি বিজ্ঞান, গবেষণা, চিকিৎসাশাস্ত্র কত সমাদর পেয়েছে তখন। বাঙালি মেয়েরা দেড়শ বছর আগে বিলেতে গিয়ে ডাক্তারি পাস করে এসেছেন, বাঙালি বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র, মেঘনাথ সাহা বিলেতে গবেষণা করে এসে দেশের বিজ্ঞানচর্চাকে সমৃদ্ধ করেছেন। বিলিতি প্রভাব পরিহার করলে দেশটা মননসম্পদে দীন হয়ে থাকত। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের চর্চার পরোক্ষ প্রভাবে বিকশিত হয়েছিলেন মধুসূদন, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ। বিদেশী ভাবধারার প্রভাবে এদেশে সতীদাহ, বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়, স্ত্রীশিক্ষা প্রবর্তিত হয়, নারীর কিছু কিছু অধিকার আইনে স্বীকৃত হয়। বিদেশী প্রভাবে শিক্ষার অঙ্গন বিস্তৃত হয়, ক্রমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মেয়েরা বাড়ির বাইরে চাকরি করতে আসে এবং তাদের মানবিক মূল্যায়নে নতুন এক মাত্রা সংযোজিত হয়। ঊনবিংশ শতকে বিদেশী জামাকাপড়ের প্রভাব, নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই লক্ষ করা যায়। ক্রমে বিদেশী অর্থাৎ ফরাসী, জার্মান, স্প্যানিশ, ইটালিয়ান কাব্যনাটক উপাখ্যান পাঠে ও অনুবাদে কত না ঐশ্বর্য দেখা দেয় এবং ধীরে ধীরে একটি চর্চার ধারা গড়ে ওঠে যা প্রকারান্তরে বাংলা সাহিত্যকেই নানাভাবে সমৃদ্ধ করে। সমাজ বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব যথার্থ ইতিহাসচর্চা, নানা বিভিন্ন প্রস্থানের দর্শনচর্চাও প্রবর্তিত হয়। আজকে বাঙালি যে সংস্কৃতি তার রূপ অনেকাংশেই নির্মাণ করেছে বিদেশী প্রভাব। মধ্যযুগে মোগল স্থাপত্য, ভাস্কর্য, সঙ্গীত ও চিত্রকলার প্রচুর প্রভাব এসে পড়ে ভারতীয় সংস্কৃতিতে, অবশ্যম্ভাবী রূপে বাংলার সংস্কৃতি এর দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত হয়। এমনকী খাদ্য, বেশবাস, সৌজন্যমূলক আচরণ, সৌজন্যের বাকভঙ্গী ইত্যাদির ব্যাপারেও বিদেশী রীতিনীতির ছাপ লক্ষ করা যায়। এরপরে ইংরেজদের অধিপত্যকালে স্বভাবতই বিলিতি আদবকায়দা, জামাকাপড়, উৎসব-অনুষ্ঠান ও সামাজিক আচরণের প্রভাব পড়ল নারীপুরুষ উভয়েরই ওপরে। ঠান্ডা দেশের আপাদমস্তক আবৃত বেশবাসের প্রভাবে এখানকার নারীপুরুষও যথাসাধ্য ঐরকম সর্বাঙ্গ আবৃত করে রাখার রীতি মেনে নিল। যদিও ঐ মেমসাহেবরাই বল-নাচের আসরে অনেক স্বল্পাবরণ হয়েই নাচতে যায়। আমাদের দেশের শতকরা নব্বই জন আদিবাসী এবং চাষি ও মজুর নারীপুরুষ নিরপেক্ষভাবে স্বল্প বেশ ব্যবহার করে কাজের সুবিধার জন্যে এবং শরীরের স্বস্তি ও আরামের জন্যে। অবশ্য মধ্যবিত্তের হিসেবের মধ্যে ওদের চালচলন আসে না কেননা মানুষ হিসাবে তাদের গণ্য করাটা আমাদের চেতনায় বা অভ্যাসে নেই। কাজেই মূলত মধ্যবিত্তের কথাই বলছি। ঊনবিংশ শতকে সাহেবদের প্রভাবে বাঙালির বেশবাসে যে পরিবর্তন ঘটল তাতে স্বল্পবাস অসভ্যতার লক্ষণ বলে বিবেচিত হল।

====================================================

... শুধু লিঙ্গবৈষম্য বা নারী-পুরুষের স্বার্থের মধ্যেই আবদ্ধ রাখলে ব্যাপারটা যথেষ্ট মর্যাদা পায় না, তাই অনেক বড় পরিধির মধ্যে এনে ফেলা হল : সমাজের সংস্কৃতির মুলে কুঠারাঘাত করছে নারীর এই অশালীন আচরণ, তাই এর নাম দেওয়া হল অপসংস্কৃতি।

====================================================



====================================================

এ সমাজে নারী আছে স্বাধিকারে নয়, পুরুষের কাজে ও ভোগে লাগে তাই। না হলে তাদের অস্তিত্ব সমাজ মেনে নিতনা। কথাটা শুনতে বিস্ময়কর এবং অপ্রীতিকর, কিন্তু দুঃখের বিষয়, সমাজের শতকরা দুই তৃতীয়াংশের সম্বন্ধেই এটা সত্য। নারীর অবস্থান সমাজে বিপদসঙ্কুল। কী ঘরে কী বাইরে। দৈনিক সংবাদপত্রই একথা সাক্ষ্য বহন করে। নারীকে সমাজ সহ্য করে সমাজের নিজের প্রয়োজনে। তা সত্ত্বেও মানুষের মনে পুরুষ-প্রাধান্যের এমনই দৃঢ়মূল প্রভাব যে সমাজে কন্যা শিশুর জন্মই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে ক্রমে। আগে মনে করা হত, অ্যামনিওসেন্টেসিস পদ্ধতিতে ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ণয় ও তারপরে কন্যাভ্রূণ নষ্ট করা বুঝি রাজস্থানের বৈশিষ্ট্য, কিন্তু এখন পশ্চিমবঙ্গে বহু ডাক্তার বা হাতুড়ে যন্ত্রে অ্যামনিওসেন্টেসিস-এর দ্বারা ভ্রুণের লিঙ্গ নিরূপণ করে কন্যাভ্রূণকে বিনষ্ট করছে এমন দৃষ্টান্ত একটুও বিরল নয়। ধীরে ধীরে কন্যাসন্তানের আনুপাতিক সংখ্যা কমবে এ রাজ্যেও। নারীকে হীন অবস্থানে রাখার চেষ্টা ও তার ফলে কন্যাভ্রূণ বিনাশ দিয়েই শুরু হয়। ভারতবর্ষের অন্যত্রও কন্যাসন্তানের সংখ্যা কমে গেছে বেশ ভয়াবহ রকমে, এই কমা স্বাভাবিক নয়, ডাক্তারের সাহায্যে কন্যাভ্রূণ নষ্ট করা হয়ে চলেছে পরিকল্পিতভাবে ও নিয়মিত, এবং এ ধারা চললে ক্রমশ ভয়াবহ অনুপাত দেখা দেবে পুত্র ও কন্যার জন্মে। রাজস্থানে বহু গ্রামে কন্যা নেই, বিয়ের জন্যে যৎসামান্য দামে অন্য কোনো গ্রাম থেকে দরিদ্র পরিবারের কন্যা কেনা হয় এবং সে যতটা স্ত্রী হয় তার চেয়েও বেশি হয় সারা পরিবারের বিনা বেতনের দাসী। পশ্চিমবঙ্গে যে হারে কন্যাভ্রূণ নষ্ট করা হচ্ছে তাতে ভয়াবহ রকম লিঙ্গ-বিপর্যয়ের সম্ভাবনা দূর ভবিষ্যতে হলেও আছে। এখনই কলকাতার অনুপাত একহাজার পুরুষের তুলনায় ৮৩৩ নারী। জেলাগুলির বড় শহরেও এ প্রবণতা ছড়াচ্ছে। এ সব বিষয়ে কেন উদাসীন এ প্রজন্ম? পুত্রকন্যার মধ্যে পার্থক্য করাটাও অপসংস্কৃতির প্রকাণ্ড একটা স্তম্ভ, সেদিকে পিছন ফিরে নারীর বহিরাবরণ ও আচরণের পরিবর্তনে আতঙ্কিত হওয়া, আর যাই হোক সুস্থ চেতনার পরিচায়ক নয়। অপসংস্কৃতি কোথায় রাষ্ট্র ও সমাজের সমর্থনে বেড়ে চলেছে তার দিকে নজর দিলে তুচ্ছ বেশবাস ও নাচগান নিয়ে বাড়াবাড়ি করার সময় ও প্রবৃত্তি হত না। এ ধরণের ক্রিয়াকলাপ যেখানে প্রচলিত, সেখানে তুচ্ছ পোষাক, নেশা, মেলামেশা ও নাচগানে স্বেচ্ছাচারিতাই চিহ্নিত হবে অপসংস্কৃতি বলে? কন্যাভ্রূণ বিনাশ এমন একটা মারাত্মক অমানবিক কাণ্ড, যে তার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ হলে তবেই তাতে সংস্কৃতির পরিচয় থাকত।

Thursday, 28 March 2019

সংশোধন ও সঙ্কীর্ণতাবাদের ইতিহাস



এঙ্গেলেসের মৃত্যুর (১৮৯৫) পর থেকেই শুরু হলো বার্নস্তাইনের নতুন থিওরি রচনার ও তার প্রচারের অভিযান। তাঁর থিওরি পূর্ণরূপ গ্রহণ করলো ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত তাঁর "বিবর্তনের পথে সমাজতন্ত্র (Evolutionary Socialism) নামক গ্রন্থে। ১৮৯৯ সালে হ্যানোভারে অনুষ্ঠিত জার্মান সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি কংগ্রেসে তিনদিন ধরে তাঁর এই নতুন থিওরি আলোচিত হয়, কিন্তু কংগ্রেস এই থিওরি 'গ্রহণ' করতে অস্বীকার করে। 

১৯০০ সালে বার্নস্তাইন ফিরে আসেন জার্মানিতে এবং সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি নিজের মত প্রচার করে থাকেন। তাঁর সেই মতবাদই সংশোধনবাদ নামে খ্যাত। তিনি বললেন যে, মার্কসের সমস্ত বক্তব্য এখন প্রযোজ্য নয়, তাই কালোপযোগী করে তিনি মার্কসবাদের সংশোধন করেছেন।

১৯০০ সাল থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ প্রথম মহাযুদ্ধের আরম্ভ ও দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের পতন পর্যন্ত সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে প্রকৃত মার্কসবাদীদের প্রচন্ড সংগ্রাম করতে হয়েছিল। এই সংগ্রামের গোড়ার দিকে জার্মান সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা কার্ল কাউৎস্কি মার্কসবাদের পক্ষ সমর্থন করে সংগ্রাম চালিয়েছিলেন সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে -- লেনিনের কথায় কাউৎস্কি তখন পর্যন্তও বিপ্লবী ছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরে কাউৎস্কি সংশোধনবাদীদের দলে ভিড়ে যান এবং সংশোধনবাদের অন্যতম প্রবক্তা হয়ে দাঁড়ান। গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের নেতৃত্ব লেনিনকেই গ্রহণ করতে হয়েছিল।

ইতিহাসের গতিধারায় মার্কসবাদের সত্যতা যখন প্রমাণিত হলো, যখন ইউরোপ ও আমেরিকার প্রলেতারিয়েত "একক বাহিনীরূপে, এক পতাকার নিচে একটি উপস্থিত লক্ষ্য নিয়ে" সঙ্ঘবদ্ধ হলো, যখন তত্ত্বগতভাবে মার্কসবাদের জয়ধ্বনিই দিকে দিকে ঘোষিত হলো, তখন মার্কসবাদের শত্রুরা দেখলো যে, প্রকাশ্যে মার্কসবাদের বিরোধিতা করে বিশেষ ফল পাওয়া যাবে না, মার্কসবাদী সেজেই মার্কসবাদের বিরোধিতা করতে হবে, শ্রমিক সংগঠনের, শ্রমিকশ্রেণীর পার্টির অভ্যন্তরে থেকেই এই বিরোধিতা আত্মপ্রকাশ করলো মার্কসবাদকে সংশোধন করার রূপ নিয়ে।

লেনিনের কথায় :

"সংশোধনবাদ ও মার্কসবাদের 'সংশোধন' হচ্ছে  প্রলেতারিয়েতের উপর বুর্জোয়া প্রভাবের এবং শ্রমিকদের কলুষিত করার বুর্জোয়া পদ্ধতির প্রধান অভিব্যক্তি না হলেও অন্যতম প্রধান অভিব্যক্তি। সেজন্যই সুবিধাবাদী নেতা এডওয়ার্ড বার্নস্তাইন এতো বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছেন।" (লেনিন : হঠকারী সিদ্ধান্ত - ১৯১৪)

====================================

সংশোধনবাদের মতন একটি আর একটি মতবাদও মার্কসবাদকে বিকৃত করে। এই মতবাদ হচ্ছে সঙ্কীর্ণতাবাদ। সংশোধনবাদ মার্কসবাদকে যুগোপযোগী, কালোপযোগী করার নামে বাতিল করে দেয় মার্কসবাদের প্রাণবস্তুকে -- শ্রেণীসংগ্রাম, শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্ব আর শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বকে। অন্যদিকে সঙ্কীর্ণতাবাদ মার্কসবাদকে আপ্তবাক্য মনে করে, সুত্রানুবদ্ধ বিধি বা অন্ধবিশ্বাসের প্রতীক বলে মনে করে। যেহেতু মার্কসবাদের লক্ষ্য বিপ্লব, সেহেতু সঙ্কীর্ণতাবাদীরা মার্কসবাদের আক্ষরিক বিশুদ্ধতার কথা বলে স্থান-কাল-পাত্র বিচার না করে সর্বক্ষণই বিপ্লবের স্লোগান আউড়ে চলে -- এরা রেডিমেড বিপ্লবের ভক্ত, এরা চায় 'এক্ষুনি, এই মুহূর্তে বিপ্লব করতে হবে'; এরা মার্কসবাদকে কর্মক্ষেত্রে পথ-নির্দেশক হিসাবে গ্রহণ করা না, গ্রহণ করে আপ্তবাক্য হিসাবে। তাই সব সময়েই এরা অতি-বিপ্লবী, 'হঠাৎ ক্ষেপে-ওঠা' বিপ্লবী।

====================================

মার্কস ও এঙ্গেলেস্ সর্বদাই বলতেন : "আমাদের শিক্ষা আপ্তবাক্য নয়, আমাদের শিক্ষা কর্মক্ষেত্রে পথনির্দেশক"। লেনিন বারবার মার্কস ও এঙ্গেলেসের এই শিক্ষার কথা উল্লেখ করতেন। লেনিন আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছেন যে, "মার্কসবাদের সূত্রগুলি কেবল সাধারণভাবে কাজের মোটামুটি রূপরেখা দিতে সক্ষম, ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার প্রত্যেকটি পর্যায়ের বাস্তব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনিবার্যভাবেই এই কাজের রূপভেদ ঘটায়। এই অবিসংবাদী সত্য প্রত্যক্ষ করা একান্ত প্রয়োজন যে, মার্কসবাদীকে বাস্তব জীবনের প্রকৃত তথ্যের অনুশীলন করতে হবে। গতকালের মতবাদকে আঁকড়ে থাকলে চলবে না।" (সি পি এস ইউ'র ইতিহাস, পৃ: ৩০৪ - এনবিএ সংস্করণ; লেনিন কালেকটেড ওয়ার্কস রুশ সংস্করণ - ২০ খন্ড, পৃ: ১০০-১০১)।

লেনিনের মতে, বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণই হচ্ছে মার্কসবাদের প্রাণবস্তু। আমাদের সব সময়ে মনে রাখতে হবে যে, প্রত্যেকটি দেশের গণ-আন্দোলন অত্যন্ত জটিল রূপ ধারণ করতে পারে এবং সংগ্রামের যে যে রূপ প্রয়োজন তা বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করেই গ্রহণ করতে হবে। একটা অবস্থায় সংগ্রামের একটা রূপ গ্রহণ করা যেতে পারে। আবার যখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে তখন সংগ্রামের নতুন রূপ গ্রহণ করতে হবে এবং অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অপ্রত্যাশিতভাবে অত্যন্ত দ্রূতগতিতে সংগ্রামের রূপ পরিবর্তনের দক্ষতা মার্কসবাদীদের অর্জন করতে হবে। তাদের মার্কসবাদী তত্ত্বকে ধর্মীয় আপ্তবাক্য মনে না করে কর্মক্ষেত্রে পথ নির্দেশক বলে মনে করতে হবে।

নভেম্বর বিপ্লবের বিজয়ের পর ইউরোপের কোনো কোনো দেশের কমিউনিস্টরা খুব তাড়াতাড়ি বিপ্লব করার জন্য উৎসাহিত হয়ে বলতে আরম্ভ করেছিল যে, কারুর সঙ্গে কোনরকম আপস নয়, একেবারে সোজা পথেই তারা চলবে, তারা এ ধরণের চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল যে, বিপ্লবের পথ সিধা, মসৃন রাজপথ। এদের উদ্দেশ্যে লেনিন তাঁর 'বামপন্থী কমিউনিজম - শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা' গ্রন্থের 'কয়েকটি সিদ্ধান্ত' অধ্যায়ে যা লিখেছিলেন তা আজ আবার আমাদের স্মরণ করা প্রয়োজন।

লেনিন লিখেছিলেন : "আমরা যদি জার্মান ও ব্রিটিশ বামপন্থী কমিউনিস্টদের মতো বলি যে, আমরা শুধু একটি পথ - সোজা সড়কই মানি, ঘুরপথে চলা বা আপস মহড়ার আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আমরা স্বীকার করি না, তাহলে সেটা ভুল হবে এবং তার ফলে কমিউনিজমের গুরুতর ক্ষতি হতে পারে, স্থান বিশেষে ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছেও। দক্ষিণপন্থী গোঁড়ামী শুধু পুরনো কাঠামোকেই (ফর্ম) স্বীকার করে চলছিল নতুন বিষয়বস্তুকে (কনন্টেন্ট) উপলব্ধি করতে পারেনি। তাই তা সম্পূর্ণ দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। বামপন্থী কমিউনিজম কয়েকটি পুরনো কাঠামোকে বিনাশর্তে বর্জন করতে চায়। তারা এটা দেখে না যে, নতুন বিষয়বস্তু সবরকম কাঠামোর মধ্যেই জোর করে প্রবেশের পথ করে নিচ্ছে। তারা বোঝে না যে, কমিউনিস্ট হিসাবে কর্তব্য হলো সব কাঠামোকেই আয়ত্ত করা, শিক্ষা করা কি করে সব থেকে দ্রূত একটা কাঠামো দিয়ে আর একটাকে পরিপূর্ণ করা যায়, একটা কাঠামোর বদলে আর একটাকে ব্যবহার করা চলে, আমাদের শ্রেণী বা আমাদের প্রচেষ্টার ফলে যে পরিবর্তন আসেনি তার সঙ্গে আমাদের কৌশলকে খাপ খাইয়ে নেওয়া যায়।"

ঐ গ্রন্থেই লেনিন কমিউনিস্টদের রণকৌশল সম্পর্কে 'কোনো' আপস নয়' অধ্যায়ে যে নির্দেশ কমিউনিস্টদের দিয়েছিলেন আজও তা প্রযোজ্য।

লেনিন লিখেছিলেন:
"অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী শত্রুকে পরাজিত করতে হলে সর্বশক্তি দিয়ে প্রচেষ্টা করতে হবে। সেজন্য অবশ্য শত্রুপক্ষের প্রত্যেকটি, এমনকি সামান্যতম 'মনোমালিন্য', বিভিন্ন দেশের বুর্জোয়াদের মধ্যেকার এবং দেশগুলির ভিতরে ও নানা গোষ্ঠী ও ধরণের বুর্জোয়াদের প্রত্যেকটি স্বার্থের সংঘাত সুচতুরভাবে ব্যবহার করতে হবে। তেমনি আবার গণ-সমর্থন লাভের প্রত্যেকটি, এমনকি সামান্যতম সুযোগেরও সদ্ব্যবহার করতে হবে তা সে সমর্থন যতোই সাময়িক, দোদুল্যমান, অস্থায়ী, অনির্ভরযোগ্য বা শর্ত সাপেক্ষই হোক না কেন। যাঁরা এ কথাটা বোঝেন না, তাঁরা মার্কসবাদ বা সাধারণভাবে বৈজ্ঞানিক আধুনিক সমাজবাদের বিন্দুবিসর্গও বোঝেন না। যাঁরা বেশ দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই সত্যকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগের দক্ষতা কাজের মধ্য দিয়ে প্রমান করতে পারেননি, তাঁরা এখনও শোষকদের কবল থেকে খেটে-খাওয়া মানুষদের মুক্ত করার সংগ্রামে বিপ্লবীশ্রেণীকে সাহায্য করতে শেখেননি"।

====================================

সংশোধনবাদীরা যে মার্কসবাদকে বিকৃত করেন তা বোঝা কষ্টকর নয়, কেননা তাঁরা খোলাখুলি বলেন যে, পুরনো ধরণের মার্কসবাদ অকেজো হয়ে গিয়েছে এবং মার্কসবাদকে কালোপযোগী করতে হবে, তাই তাঁরা নতুন ধরনের মার্কসবাদ আবিষ্কার করছেন, যার মূল কথা হলো শ্রেণী-সংগ্রামের তত্ত্বের বর্জন এবং তার জায়গায় শ্রেণী-সহযোগিতার তত্ত্বের প্রাণপ্রতিষ্ঠা।

কিন্তু যাঁরা নিজেদের 'বিপ্লবী কমিউনিস্ট' বলে জাহির করে মার্কসবাদের তত্ত্বকে আপ্তবাক্য বলে মনে করেন, তাঁরা হচ্ছেন মতান্ধ, তাঁরা হচ্ছেন সঙ্কীর্ণতাবাদী। তাঁরাও ভিন্ন পথে মার্কসবাদকে বিকৃত করেন। বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে তাঁরা অসার, শূন্যগর্ভ সূত্রই রচনা করেন, তাঁরা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে অন্য দেশের বাস্তব পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য কিনা সে কথা আদৌ বিচার না করে তা জনগণের উপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেন এবং গণ-আন্দোলনের সাফল্যের পথে বাধা সৃষ্টি করেন। স্থান-কাল এবং বাস্তব অবস্থাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তাঁরা সংগ্রামের একটি রূপকে আঁকড়ে ধরে থাকেন এবং তাকেই সংগ্রামের একমাত্র রূপ বলে প্রচার করে থাকেন। তাঁরা এমনই মতান্ধ যে, তাঁরা একথা বুঝতেও চান না যে, প্রত্যেকটি দেশের গণ-আন্দোলন অত্যন্ত জটিল রূপই ধারণ করে এবং সংগ্রামের যে যে রূপ প্রয়োজন তা বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করেই গ্রহণ করতে হবে, তাঁরা একথা বুঝতে অক্ষম যে, যখন বাস্তব অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, তখন সংগ্রামের নতুন রূপ গ্রহণ করতে হয়। জনগণের চেতনার স্তরকে তাঁরা গ্রাহ্যের মধ্যেই ধরেন না, জনগণ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখেন এবং পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যেই নিজেদের আবদ্ধ রাখতে ভালোবাসেন। নিজেদের অভিলাষ দিয়ে তাঁরা জনগণের চেতনার মান বিচার করেন এবং বড়ো বড়ো বিপ্লবী বুলি আউড়ে নিজেদের বিপ্লবীপনা জাহির করেন। তাঁরা মার্কসবাদকে কর্মক্ষেত্রে পথনির্দেশক মনে করতে শেখেননি, এঁরা বিপ্লবের ক্ষতিই করে থাকেন।

Wednesday, 20 March 2019

আর এস এস ও বর্তমান ভারত

নওজোয়ান ভারতসভার পুনর্গঠনের সময়ে ভগৎ সিং দীপ্ত কণ্ঠে বলেন, 'ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় আর সাম্প্রদায়িকতা একটা শত্রু - এর বিরুদ্ধে লড়তে হবে।'

===================================================

'৪১ সালের দাঙ্গার পর গান্ধীজির সঙ্গীদের মধ্যে একদল ওয়াগা শিবিরে পাঞ্জাবের শরণার্থীদের জন্যে আরএসএস-এর কাজকর্মের কথা বললে গান্ধীজি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, 'কিন্তু ভুলে যেও না যে, হিটলারের নাৎসি এবং মুসোলিনীর ফ্যাসিস্তদেরও একই গুণ ছিল।' গান্ধীজি আরএসএসকে একনায়কতন্ত্রী দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন সাম্প্রদায়িক সংগঠন বলে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, 'জাতীয় আন্দোলনের পথ আখড়ার মধ্যে দিয়ে আসবে না ... এগুলি যদি হিন্দু মুসলমান সংঘর্ষের সময়ে আত্মরক্ষার জন্যে তৈরি হয়ে থাকে তবে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। মুসলমানরা একই খেলা খেলতে পারে। এই ধরনের উন্মুক্ত কিংবা গোপন প্রস্তুতি কেবলমাত্র সন্দেহ আর বিরক্তিরই সৃষ্টি করবে। এর দ্বারা কোনও সমাধানের পথে পৌঁছানো যাবে না।' (মহাত্মা গান্ধী : দ্য লাস্ট ফেজ, পেয়ারেলাল, আমেদাবাদ, পৃ.৪০; মহাত্মা : জি ডি তেনডুলকর, তৃতীয় খন্ড, বম্বে ১৯৪৫, পৃ.১৩০-৩৪)।

===================================================

যে 'রাম'কে কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করে আরএসএস তাদের সামাজিক আগ্রাসনের সূচনা ঘটিয়েছিল এবং যার সুযোগেই তাদের রাজনৈতিক সংগঠন ভারতীয় জনতা পার্টি আজ নানা কৌশলে ভারতের শাসনক্ষমতাকে দখল করে দেশকে একটি অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে, সেই রামচন্দ্রের জন্মস্থানকে ঘিরে যে তাত্ত্বিক ভণ্ডামি হিন্দুত্ববাদীদের মূলধন যা নানাভাবে গত ষাট/সত্তর বছর ধরে ভারতীয় রাজনীতির পরিমণ্ডলে আবর্তিত হয়ে আসছে তার সূচনা হয় আনেত সুসান বেভরিজকৃত 'বাবরনামা'র ইংরেজি অনুবাদের প্রথম খন্ড 'ফরখনাখন্ত' ১৯১২ সালে প্রকাশ হওয়ার পর; এটির দ্বিতীয় খন্ড 'কাবুল খণ্ড' নামে প্রকাশিত হয় ১৯১৪ সালে, তৃতীয় খণ্ড 'হিন্দুস্তান খণ্ড' নামে ১৯১৭ সালে এবং ১৯২১ সালে সংযোজিত খণ্ড 'ভূমিকা ও বিষয়সূচি' যেখানে কেবলমাত্র অনুমানের উপর ভিত্তি করে অনুবাদিকা লেখেন, Presumably the order for building the mosque was given during Babar’s stay in Oudh in 934 A.H. (1528 AD), at which time he would be impressed by dignity and sanctity at the ancient at the ancient Hindu shrine it (at least in purk) displaced and like the obedient follower of Muhammad he was in intolerance of another faith, would regard the substitution a temple by a mosque as dutiful and worthy। অথচ ঐ মসজিদের গায়ে উৎকীর্ণ শিলালিপিতে ছিল : 'বা ফারমুদা-ই-শাহ বাবার কি আদিলাশ/বানাইসত তা কাখ-ই গর দুন মলাকি বানা কয়দ-ই মুহবিত-ই কুদসিঁয়া/আমির-ই সাআদাত-নিশাঁ মীর বাকি বুঅদ খয়ের বাকি চৌসাল-ই-বানাইশ/ইঁয় ওদ কি গুফতম, বুঅদ খয়ের বাকি', যার অর্থ হল, ''আদিলশাহ বাবরের ইচ্ছানুসারে ফেরেশতার ন্যায় সজ্জন মীর বাকি এই কীর্তি নির্মাণ করেছে, ৯৩৫ হিজরিতে এই নির্মাণ সমাপ্ত হয়েছে, এই কীর্তি তার মাহাত্ম্যের জন্যে চিরকাল অক্ষয় থাকবে"--এখানে কোথাও-ই মন্দির ভেঙে মসজিদের কথা নেই। ব্রিটিশ সরকারের 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' নীতির প্রয়োগের উদ্দেশ্যেই অনুবাদিকা বেভারিজ এই মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণের কথাটি লিখেছিলেন, যার উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করা, সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে জিইয়ে রাখা। এটিই ছিল আরএসএসের জন্মের পিছনে ঔপনিবেশিকদের অবদান। এই অবদানকে শ্রদ্ধা জানিয়েই আরএসএস কোনোদিনই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কোনো অবস্থান নেয়নি। হেডগেওয়ার অবশ্য সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দিয়ে সামান্য কিছুদিনের জন্যে কারাবাস করেছিলেন। এটি ছিল একটি কৌশলের অঙ্গ। কারণ '৩০-'৩১ সালের আইন অমান্য আন্দোলনকে আরএসএস তাদের ইতিহাসে একটি অপ্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবেই উল্লেখ করেছে।

===================================================

'৫০ সালে এইসব প্রবল পরস্পর-বিরোধী ভাবনার মধ্যেই যে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান গৃহীত হয় তার জন্যে প্রায় সবটা কৃতিত্ব দিতে হয় নেহেরুকে। প্রবল চাপ সত্ত্বেও নেহেরুর অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বের জোরে সংবিধানে কোনও ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রধান্যকে অস্বীকার করতে পেরেছিলেন সংবিধান প্রণেতা আম্বেদকর। নেহেরু এবং আম্বেদকরের যৌথ প্রচেষ্টায় সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে লেখা হয়, 'freedom of conscience and the right freely to profess, practice and propagate religion.' - এই অনুচ্ছেদ রচনার পিছনে বামপন্থীদের অবদান কম ছিল না। ঘরে-বাইরে হিন্দুত্ববাদীদের প্রবল চাপ নেহেরু অস্বীকার করতে পেরেছিলেন আম্বেদকর এবং বামপন্থীদের ঐকান্তিক সহযোগিতার ফলে (এই বিষয়ে আরও তথ্যের জন্যে দেখুন, 'The limit of accommodation, Nehru, Religion and the State in India' নামক S.Mitra-র প্রবন্ধ, South Asian Research 9(2) 1989, Page 113)। ধর্মকে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে পরিগণিত করবার যে চিন্তাভাবনাকে আধুনিকতার দালাল আখ্যা দিতেও সেদিন হিন্দুত্ববাদী শক্তির দ্বিধা হয়নি। এরপরও ঘরে-বাইরে প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও হিন্দু কোড বিলের অনুমোদন নেহেরুর হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা এবং আরএসএস-এর বিরুদ্ধে তীব্র লড়াইয়ের একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ফলশ্রুতি।

===================================================

হিটলারের সুরে সুর মিলিয়ে গোলওয়ালকার বলেছিলেন 'জার্মানদের জাতিত্বের গর্ব আজ আমাদের মুখ্য আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের জাতীয় সংস্কৃতিকে কলুষমুক্ত করতে জার্মানি গোটা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে সেমেটিক জাতি ইহুদিদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। সেখানে সর্বোচ্চ মহিমা নিয়ে জাতিত্বের গর্বকে তারা সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। এটাও জার্মান দেশের মানুষ প্রমাণ করেছে যে, নিজস্ব ভিন্ন শিকড় রয়েছে এইরকম জাতি বা সংস্কৃতি একসঙ্গে মিশে একটা পূর্ণাঙ্গ সত্তা কোনও অবস্থাতেই তৈরি করতে পারে না। আমরা আমাদের এই শিক্ষা এই হিন্দুস্তানেও গ্রহণ করব...। প্রাচীন জাতিগুলোর অভিজ্ঞতা অনুমোদিত এই দৃষ্টিভঙ্গি হিন্দুস্তানের সমস্ত অহিন্দু মানুষ হয় হিন্দুদের ভাষা এবং হিন্দুত্বের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করবে, হিন্দু ধর্মকে শ্রদ্ধা করবে, তাকে পবিত্র হিসেবে জ্ঞান করবে, হিন্দুদের গৌরব ছাড়া অন্য কোনও ধারণাকে তারা বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেবে না। অর্থাৎ তারা কেবলমাত্র তাদের অসহিষ্ণুতার মনোভাব এবং এই সুপ্রাচীন দেশ এবং দেশের ঐতিহ্যের প্রতি অবজ্ঞার মনোভাবই ত্যাগ করবে না, এই দেশের প্রতি ভালোবাসা এবং ভক্তির মনোভাব তৈরি করবে। এককথায় হয় তারা আর বিদেশি হয়ে থাকবে না, তা না হলে সম্পূর্ণভাবে হিন্দু জাতির এই দেশে তারা থাকবে অধীনস্থ হয়ে, কোনও প্রকারেরই দাবি তাদের থাকবে না, কোনও সুযোগ-সুবিধা তারা পাবে না, কোনও প্রকারের পক্ষপাতমূলক ব্যবহারও তারা পাবে না। এমনকী নাগরিক অধিকার তাদের থাকবে না।' (উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড -এম.এস গোলওয়ালকার, নাগপুর ১৯৩৮, পৃ. ২৭,৫২)।

===================================================

আর্য-সমাজীদের শুদ্ধি আন্দোলন গোটা উত্তর ভারত জুড়ে যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সূচনা করেছিল তাকে জন্ম থেকেই নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে আরএসএস। সেই বিভাজনকে তারা আরও তীব্র থেকে তীব্রতর করে নিজেদের সাংগঠনিক আগ্রাসন বাড়িয়েছে। লালা মুনশিরাম ওরফে স্বামী শ্রদ্ধানন্দের নিহত হওয়ার পর গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'ভারতবর্ষের অধিবাসীদের দুই মোটা ভাগ, হিন্দু ও মুসলমান। যদি ভাবি, মুসলমানদের অস্বীকার করে এক পাশে সরিয়ে দিলেই দেশের সকল মঙ্গলপ্রচেষ্টা সফল হবে, তা হলে বড়োই ভুল করব। ছাদের পাঁচটা কড়িকে মানব, বাকি তিনটে কড়িকে মানবই না, এটা বিরক্তির কথা হতে পারে, কিন্তু ছাদ-রক্ষার পক্ষে সুবুদ্ধির কথা নয়।...এক দেশে পাশাপাশি থাকতে হবে, অথচ পরস্পরের সঙ্গে হৃদ্যতার সম্বন্ধ থাকবে না, হয়তো বা প্রয়োজনের থাকতে পারে-- সেইখানেই যে ছিদ্র-- ছিদ্র নয়, কলির সিংহদ্বার। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে যেখানে এতখানি ব্যবধান সেখানেই আকাশ ভেদ করে ওঠে অমঙ্গলের জয়তোরণ।' (রচনাকাল-১৯৩৩)। গুরুদেবের এই মিলন আকাঙ্ক্ষার আমরা শরিক হইনি-এটা আমাদের জাতীয় জীবনের একটা বড় লজ্জা। এই সময়ে বাংলার সাহিত্যিক পরিমণ্ডলের একাংশের পরিবেশ এখানে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে জোরদার করেছিল। 'আনন্দমঠ'কে ঘিরে তো একটা ভেদরেখা অনেককাল থেকেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কিছু লেখা এবং কেবলমাত্র হাওড়া জেলা কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গেই তাঁর সংস্রব একটা বিভাজিকার সৃষ্টি করেছিল। এই সময়ে সংবাদপত্রগুলিও কী ভূমিকা পালন করেছিল তা বোঝবার জন্যে 'কালিকলম' পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক হিসেবে প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রী কৃত্তিবাস ভদ্র ছদ্মনামে ১৯৩৩ সালের মাঘ সংখ্যা থেকে উদ্ধৃত করছি : 'দেশের নেতা উন্মাদের অস্ত্রাঘাতে শহিদের স্বর্গে গেছেন। এই ভয়ংকর হত্যার সংবাদে সারা ভারতবর্ষের গায়ে কাঁটা দিয়েছে কিন্তু খবরের কাগজে মারাত্মক ছাপার ভুল দেখে বিস্মিত হলাম। পড়লাম - মুসলমান হত্যাকারীর দ্বারা হিন্দু নেতা নিহত। তারপর মনে হল এ ছাপার ভুল নয় - এ ভুল সম্পাদকের। শেষে বুঝলাম - এ ভ্রম সর্বসাধারণের এবং এ ভুলই সমস্ত সর্বনাশের মূল। অকারণ বিশেষণের বিষে আমরা জাতিকে বিপন্ন করে তুলেছি। পুলিশ কোর্টের সংবাদ আমরা কখনও লিখি না কর্তাভজা বৈষ্ণব ও হনুমান ভক্ত দারোয়ানের সংখ্যা নগন্য বলেই বোধহয় লিখি না। অথবা সত্যই আমাদের এ জ্ঞানটুকু থাকে যে, ঘটি চুরির কাহিনিতে বৈষ্ণব ধর্ম ও হনুমান ভক্তির কোনও সংস্রব নেই। কিন্তু আমরা ফরমাসী বড় হরফে সংবাদপত্রের সমস্ত ললাট জুড়ে লিখি - মুসলমান গুন্ডার ছুরিতে হিন্দু কুলির মৃত্যু।'

এই সময়ে এক শ্রেণির সংবাদপত্র যে অসাবধানী ভূমিকা পালন করে তা হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে যথেষ্ট পরিমাণে সাহায্য করে। লালা মুনশিরাম ওরফে স্বামী শ্রদ্ধানন্দ শুদ্ধির নাম যে আন্দোলন করে গোটা সমাজজীবনকে একটা বড় স্থবিরতার দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন তার অপূর্ব সাহিত্যিক দলিল হল প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'মিছিল' নামের উপন্যাস। 'প্রবাসী' সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মতো মানুষেরও হিন্দু মহাসভা সংস্রবই আতঙ্কিত করেছিল প্রেমেন্দ্র মিত্রকে। শরৎচন্দ্র তাঁর শ্রীকান্তের প্রথমপর্বে লিখছেন, 'সেদিন বাঙালি ও মুসলমান ছেলেদের ফুটবল খেলা কেন্দ্র করে একটি অশান্তি দেখা দিয়েছিল।' এই 'বাঙালি' আর 'মুসলমান' শব্দ দুটির ব্যবহারই একটা দূরত্বের সীমারেখা নির্মাণ করে দিচ্ছে। '২১ সালে সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগেকার শরৎচন্দ্রের লেখা আর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত শরৎচন্দ্রের লেখার মধ্যে একটা বড়রকমের সীমারেখা নির্মিত হয়ে গেছে। রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার ফলে সাম্প্রদায়িকতা শরৎচন্দ্রের শিল্পী সত্তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। শরৎচন্দ্রের মতো এমনটা আরও অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটেছিল যা শেষপর্যন্ত লাভবান করে আরএসএস, হিন্দু মহাসভাকে। অনুজাচরণ সেনগুপ্ত সম্পাদিত 'হিন্দু সংঘ' সাপ্তাহিকে শরৎচন্দ্র লিখলেন 'বর্তমান হিন্দু মুসলমান সমস্যা' নামক একটি ঘোরতর সাম্প্রদায়িক নিবন্ধ (সংশ্লিষ্ট সাপ্তাহিকের ১৯ অশ্বিন ১৩৩৩, ৬ অক্টোবর ১৯২৬)। এই নিবন্ধের ফলে সাম্প্রদায়িক পরিবেশ বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় ব্রিটিশ সরকার পত্রিকার সম্পাদককে গ্রেপ্তার করে, সংশ্লিষ্ট পত্রিকাটি বাজেয়াপ্ত করে।

===================================================

সাম্প্রদায়িকতার এই বাতাবরণ আরএসএস-এর প্রসারের ক্ষেত্রটিকে গোড়া থেকেই অনেক-ই মজবুত করে রেখেছিল। গোটা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এইরকম একটা সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ সৃষ্টি করে আরএসএস শুরু করল তাদের সাংগঠনিক প্রশিক্ষণ। আরএসএস-এর সাংগঠনিক স্তরের মূল ভিত্তি 'শাখা'র কাজকর্ম আরএসএস-এর দর্শন অনুযায়ী চরিত্র গঠনের কর্মসূচির ওপরে জোর দেয়। এই প্রশিক্ষণে প্রথমে সকলের জন্যে একই ধরণের আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয় যাতে প্রশিক্ষণরত স্বয়ংসেবকদের মধ্যে একটা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ঐক্যের মনোভাব গড়ে ওঠে। সম্প্রদায়গত বিষয়টিকে কেন্দ্র করে একটা সাধারণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিতে আসা ছেলেদের মগজধোলাইয়ের প্রাথমিক কাজটা যাতে হয় তার ওপরে প্রথম থেকেই নজর দেওয়া হয়। 'শাখা'গুলো অনুষ্ঠিত হয় খোলা মাঠে। মগজধোলাইয়ের উপকরণ হিসেবে শেখানো হয়, 'মুসলমান এবং খ্রিস্টানরা এদেশে জন্মেছে ঠিকই, কিন্তু তারা কি যথার্থ এ-দেশের প্রতি অনুগত?...না। তাদের ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে জাতির প্রতি ভালোবাসা ও ভক্তি চলে গেছে।' (উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড - গোলওয়ালকার, পৃ.১২৭-১২৮)। স্বয়ংসেবকদের শেখানো হয়, মুসলমানরা এদেশের শত্রুদের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে ফেলেছে। তাদের পুণ্যভূমি বিদেশ। তারা নিজেদের শেখ ও সৈয়দ বলে...তারা এখনও মনে করে যে তারা এদেশ জয় করতে এবং রাজ্য স্থাপন করতে এসেছে। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এটা শুধু ধর্ম বিশ্বাসের পরিবর্তন নয়, এমনকী জাতীয় পরিচয়েরও পরিবর্তন। নিজেদের মাতৃভূমিকে ফেলে রেখে শত্রুশিবিরে যোগ দেওয়াকে দেশদ্রোহ ছাড়া আর কী বলা যায়? (সূত্র ওই পৃ. ১২৮)। এই ধরনের মগজধোলাই সীমান্ত সমস্যা, উত্তেজনা দেখা দিলে খুব বেশিভাবে আরএসএস নিজেদের লোকেদের মধ্যে প্রচার করে। বর্তমান সময়ে কাশ্মীরের সীমান্ত উত্তেজনাকে ঘিরে একইরকমই বীভৎস প্রচার চালাচ্ছে তারা।

===================================================


১৯৩৮ সালের শেষ দিক থেকে গোটা বিশ্ব পরিস্থিতি একটা অদ্ভুত জটিল আকার ধারণ করে। আরএসএস, হিন্দু মহাসভা, ইতালি এবং জার্মানির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখা করে চললেও, এই বছরের ৯ নভেম্বর ভয়াবহ ইহুদি মারণযজ্ঞ, যা ইতিহাসে কুখ্যাত Crystal night নাম অভিহিত, ঘটবার অল্প কয়েকদিন পরেই ১২ ডিসেম্বরের ঘোষণাপত্রে কংগ্রেস জার্মান নীতির তীব্র সমালোচনা করে। ভারতে ইহুদিদের আশ্রয়দানের বিষয়টিকেও কংগ্রেস সমর্থন জানায়। অথচ সাভারকার থানেতে আরএসএস-এর প্রশিক্ষণ শিবিরে বলেন, জার্মানিতে জার্মানরা যে আন্দোলন করছে তা নিঃসন্দেহে জাতীয় আন্দোলন, ইহুদিদের আন্দোলন হল চরম সাম্প্রদায়িক আন্দোলন (MSA, Home Special Dept, GOD (g) ptill 1938, A report on the meeting held on Dec 11, 1938)। একই বক্তব্যের পুনরুক্তি করে পুনেতে ১৯৩৯ সালের ২৯ জুলাই সাভারকার বলেন, 'ভৌগোলিক পরিসীমার ওপরে কোনও অবস্থাতেই জাতিত্ব নির্ভর করে না। সাধারণ ভৌগোলিক পরিসীমার থেকেও ভাব, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির ঐক্যের ওপরে জাতিত্ব অনেকখানিই নির্ভর করে।ঠিক এই কারণেই কোনও অবস্থাতেই জার্মান এবং ইহুদিকে এক জাতি হিসেবে পরিগণিত করতে পারা যায় না।' এই সময় থেকেই ধীরে ধীরে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভার মধ্যে হিন্দু এবং মুসলমানকে একই জাতির অংশ হিসেবে পরিগণিত না করবার চিন্তাভাবনা গড়ে উঠতে শুরু করে।


ভারতীয় জাতির যে চিন্তাচেতনার কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন তার সম্পূর্ণ বিপরীত-ধর্মী চিন্তাকে সম্বল করে ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় আগ্রাসন শুরু করে দেয় হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীশক্তি। এই চিন্তাভাবনাই পরবর্তী সময়ে পরিণতি লাভ করে গোলওয়ালকরের "সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদে"র তত্ত্বে। তিরিশের দশকের শেষ ভাগ থেকেই একযোগে আরএসএস এবং তার শাখা সংগঠনগুলি ও তার রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভা বলতে শুরু করে -ভারতবর্ষে সংখ্যালঘুদের অধিকারগুলো নির্ভরশীল থাকবে সংখ্যাগুরুদের মহানুভবতার ওপর। এই ধারণাই এখনও বহন করে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভার পরিবর্তিত সংস্করণ ভারতীয় জনতা পার্টি। এই চিন্তার জালেই তারা অক্টোপাশের মতো বেঁধে ফেলতে চাইছে গোটা ভারতবর্ষকে, গণহত্যার তান্ডব চালাচ্ছে গুজরাটে। ১৯৩৯ সালে হিন্দু মহাসভার এক অধিবেশনে সাভারকার পরিষ্কারভাবে বলেন যে, ঠিক জার্মানির ইহুদিদের মতোই ভারতবর্ষের মুসলমানরাও সামগ্রিকভাবে তাদের নিকট প্রতিবেশী হিন্দুদের থেকে ভারতবর্ষের বাইরের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থকে অভিন্ন করে দেখে (Bombay Chronicle-এ ২৯.১২.১৯৩৯-এ সাভারকারের এই বক্তৃতা প্রকাশিত হয়) এছাড়াও সাভারকার বলেন, ওদের পবিত্রভূমি সুদূর আরব দেশ অথবা প্যালেস্টাইন। ওদের পুরান শাস্ত্র এবং সাধুসন্তরা, ভাবনায়কেরা কেউই আমাদের পবিত্র দেশে জন্মগ্রহণ করেনি। তাই ওদের সব নামধামের মধ্যেও বিদেশি উৎসের পরিষ্কার ছাপ রয়েছে। (Hindutva: Who is Hindu? 4th Edition Bharat Mudranalaya, Pune, 1949, Page-94)।

===================================================

গোলওয়ালকরের 'উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড' নামক মারাত্মক প্রতিক্রিয়াশীল পুস্তকটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ সালে নাগপুর থেকে। এই পুস্তকে গোলওয়ালকর বলেন, 'আজকের দিনে সব থেকে আলোচিত বিষয় জার্মান জাত্যাভিমান। নিজেদের জাতি এবং তার সংস্কৃতির কৃত্রিমতাকে অস্বীকার করে তারা দেশ থেকে সেমেটিক জাতি ইহুদিদের বিতাড়নের পথ নিয়েছে। জাতিগত অহংকার এখানে অসাধারণভাবে শীর্ষবিন্দুতে উপনীত হয়েছে। জার্মানি এটা দেখতে সক্ষম হয়েছে যে, ভিন্ন প্রকারের জাতি এবং সংস্কৃতির পক্ষে একটা ঐক্যবদ্ধ সমগ্রের সঙ্গে মিশে যাওয়া সম্ভবপর নয়। হিন্দুস্থানের এই শিক্ষা নেওয়া উচিত এবং এই শিক্ষা অনুযায়ী চলা প্রয়োজন। (গোলওয়ালকরের পুস্তকের '৩৯ সালের সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৩৭) গোটা উত্তরভারতের সিংহভাগ জুড়ে আর্য সমাজীদের মদমত্ততা। এক সঙ্গে আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভাকে পায়ের তলায় মাটি এনে দিচ্ছে। স্বামী দয়ানন্দের মূর্তিবিরোধী ঐতিহ্যকে ম্লান করে দিয়ে আরএসএস ওইসব অঞ্চলে তখন ধীরে-ধীরে মূর্তিপূজার ব্যাপক প্রচলন শুরু করে, নানা আচার সর্বস্বতাকে একটা অন্যমাত্রায় নিয়ে আসে আরএসএস। মজার বিষয় হল, এই সময়ে আরএসএস-এর মধ্যে হনুমান পুজোর ব্যাপক প্রচলন দেখতে পাওয়া যেত। হেডগেওয়ার কিন্তু এই হনুমান পুজোর বিষয়টিকে ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেন। এখন অবশ্য সঙ্ঘ-পরিবারের সদস্য হিসেবে বজরং দল-এর উৎপত্তি এবং ভারতবর্ষের অন্যতম বড় সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ, বজরংবলী পুজোর নামে বাঁদর পুজোটাকে আবার বড় আকারে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। হেডগেওয়ার তাঁর কার্যকালের একদম শেষদিকে আরএসএস-এর উপাসনার ভাষা হিসেবে সংস্কৃত ভাষাকে উপস্থাপিত করেন। প্রভাব বিস্তার, প্রচার ইত্যাদির প্রথম পর্যায়ে আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও, বেশকিছুটা প্রভাব প্রতিপত্তি পেয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়জাত মানুষদের সংগঠন হিসেবে নিজেদের উপস্থাপিত করবার লক্ষ্যে হেডগেওয়ার আঞ্চলিক ভাষার পরিবর্তে সংস্কৃত ভাষাকে আরএসএস-এর প্রার্থনার ভাষা হিসেবে নির্ধারিত করেন। ১৯৪০ সালে নাগপুরে আরএসএস-এর এক প্রশিক্ষণ শিবিরে হেডগেওয়ার বলেন, 'আমি আমার সামনে হিন্দুরাষ্ট্রের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ দেখতে পাচ্ছি' এই প্রশিক্ষণ শিবিরে উড়িষ্যা, আসাম, কাশ্মীর ছাড়াও ভারতের প্রায় সব অঞ্চলের প্রতিনিধিরাই যোগ দিয়েছিল। সরসঙ্ঘচালক হিসেবে এটাই ছিল হেডগেওয়ারের শেষ অনুষ্ঠান। এরপর আরএসএস প্রধানের দায়িত্ব নিলেন গোলওয়ালকর, শুরু হয় আরএসএস-এর নতুন পর্যায়, আরও প্রলয়ঙ্কর এক অধ্যায়।

গোলওয়ালকর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের দায়িত্ব গ্রহণ করেই এই ধারণাটাকে প্রকট করে দিলেন যে, হিন্দু হওয়াটা কেবলমাত্র সংস্কৃতিগত বা কৃষ্টিগত কোনও বিষয় নয়, এর সঙ্গে জাতি এবং রক্তের সম্পর্কের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। গোলওয়ালকর যে সময়ে আরএসএস প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ঠিক সেই সময়েই এই সংগঠনটির রাজনৈতিক মুখ হিন্দু মহাসভার সভাপতি সাভারকার বিশ্বযুদ্ধজনিত পরিস্থিতিতে হিন্দুদের কাছে আবেদন জানান, 'ব্রিটিশ সরকারের সব রকমের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করবার জন্যে। কিছু মূর্খ এই নীতির সমালোচনা করছে, তাদের কথা কানে না তুলে, সরকারের দিকে সংবেদনশীল সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে।' সাভারকার বলেন, 'যুদ্ধের আগে কিংবা সূচনাপর্বে হিন্দু মহাসভার তোলা দাবিগুলো অনেকাংশেই সরকার পূরণ করেছে।' (হিন্দু রাষ্ট্রদর্শন -ভি.ডি.সাভারকার, পৃ. ২০৩) '৩৯ সালে অক্টোবর মাসে সাভারকার গোপনে ভাইসরয়কে বলেছিলেন, হিন্দু এবং ব্রিটিশদের পরস্পর বন্ধু হওয়া প্রয়োজন। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, কংগ্রেস মন্ত্রীসভাগুলি পদত্যাগ করলে কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে হিন্দু মহাসভার থাকা উচিত (জেটল্যান্ড টু লিনলিথগো, ৭ অক্টোবর, ১৯৩৯, জেটল্যান্ড পেপার্স, খন্ড ১৮, রীল নং ৬)। আরএসএস-এর সঙ্গে এই সময়ে ঔপনিবেশিক শাসকদের সম্পর্ক অনেক বেশি পরিমাণে জটিল এবং কৌশলী মাত্রা ধারণ করে। মধ্যশ্রেণীভুক্ত তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের টার্গেট করে আরএসএস তাদের কার্যক্রমকে পরিচালিত করছিল। একটা লোক দেখানো রেডিকাল জাতীয়তাবাদী অবস্থান গ্রহণ করলেও, আরএসএস কিংবা তার রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভার রাজনীতি মুসলিম লিগের মতোই ঔপনিবেশিক আওতার মধ্যেই লালিত-পালিত হচ্ছিল। কংগ্রেসকে পয়লা নম্বরের শত্রু হিসেবে পরিগণিত করে, ছলে-বলে-কৌশলে কংগ্রেসকে দুর্বল করা এবং ধ্বংস করে তাদের মূল লক্ষ্য ছিল। অভিন্ন শ্রেণি অবস্থানের কারণে খুব সহজেই ঔপনিবেশিক কর্তাব্যক্তিদের সাহায্য-সহযোগিতা তারা পেয়ে যাচ্ছিল। কংগ্রেস নেতাদের বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়ে গোটা জাতীয় আন্দোলনকেই তাচ্ছিল্য করে, গোলওয়ালকর সরাসরি অভিযোগ জানালেন, অদ্ভুত, ভারি অদ্ভুত, বিশ্বাসঘাতকদের জাতীয়বীর হিসেবে সিংহাসনে বসানো হয়, আর দেশপ্রেমিকদের ওপরে কলঙ্ক আরোপ করা হয়।

'৩৭-এর নির্বাচনের ফলে বিভিন্ন প্রদেশে কংগ্রেস কর্তৃক মন্ত্রিসভা গঠনের পরে ক্ষমতালোভী হিন্দু সাম্প্রদায়িক নেতৃত্ব কার্যত মাত্রাজ্ঞানহীন হয়ে পড়ে। সীমিত পরিসরে দেশীয় ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত জাতীয়তাবাদী সরকারের কার্যক্রম জনমানসে তাঁদের আরও জনপ্রিয় করে তোলে। জাতীয় আন্দোলনও নতুনভাবে সঞ্জীবিত হয়। স্বভাবতই এসবই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে বড় রকমের অপছন্দের বিষয় হয়ে দেখা দেয়। এইরকম পরিস্থিতিতে জার্মান আইনজীবী Jaham Kasper Bulntschil-র কাছ থেকে জাতি এবং জাতীয়তাবাদের ধারণা ধার করে আসরে নেমে পড়েন তথাকথিত গুরুজি গোলওয়ালকর। উগ্রতায় তিনি সাভারকারকেও ছাড়িয়ে যান। মুসলিম সম্প্রদায়জাত মানুষের সম্পর্কে গোলওয়ালকর বলেন, আমাদের পরিষ্কার কথা, ওরা বিদেশি হয়ে থাকাটা ছেড়ে দিক, তা না হলে ওরা হিন্দুজাতির অধীনস্থ হিসেবেই থাকুক। এভাবে তারা আমাদের দেশে থাকতে পারে। কোনও কিছু দাবি তাদের করা চলবে না। কোনও বিশেষ সুযোগ-সুবিধাও তারা কোনও অবস্থাতেই পাবে না। পক্ষপাতিত্বমূলক কোনও ব্যবহারের আশা ওরা যেন না করে\ মুসলমানদের নাগরিক অধিকারও থাকা উচিত নয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সাভারকর এবং তার সমমনোভাবাপন্ন চরমপন্থী হিন্দু সাম্প্রদায়িক মানুষেরা মুসলিমদের দুই ভাগে ভাগ করত, হয় তারা মোগল আক্রমণকারীদের বংশধর নতুবা ধর্মান্তরিত হিন্দু। ভারতীয় মুসলিমসমাজের প্রধান আকর্ষণ নাকি ভারতবর্ষের মূল্যবোধ, যে মূল্যবোধকে হিন্দু সাম্প্রদায়িকরা হিন্দু মূল্যবোধ হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত। মুসলিমরা তার বাইরে বলে আরএসএস নেতৃত্ব প্রথম থেকেই মনে করত। সাভারকর এবং তাঁর সহযোগীরা কেবলমাত্র এটাই মনে করত না যে, ইসলাম একটি বিদেশ থেকে আনা ধর্মমত এবং এই ধর্মমতের প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের বাইরে রয়েছে। একই সঙ্গে তারা মনে করত যে, ভারতীয় মুসলিমসমাজ একটা পৃথক জাতিসত্তা তৈরিতেই সব থেকে বেশিরকমে আগ্রহী, ভারতবর্ষকে তারা তাদের স্বদেশভূমি বলে মনে করে না। কোনও অবস্থাতেই এটা ভারতীয় মুসলিমদের স্বাধীনতার আগে বা পরবর্তী সময়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের অভিমত নয়। এগুলি উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির অতিরঞ্জিত অভিমত। ভারতীয় মুসলিমরা সব সময়েই মনে করত তারা প্রথমে ভারতীয় তার পরে মুসলিম। ভারতীয় মুসলিমসমাজের এই অভিমত সম্পর্কে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদীশক্তি অবহিত থাকলেও, তাদের দাবি ছিল ভারতীয় মুসলিমরা মেনে চলুক হিন্দু মূল্যবোধ। এটা তো স্বাভাবিক অবস্থাতে কোনওমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। 

===================================================

১৯৪০ সালের জুন মাসে সাভারকরের সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুর একটি সাক্ষাৎকারের কথাও এই সময়ে আরএসএস-এর পক্ষ থেকে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। আজও বর্বর হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীশক্তি গান্ধীজি-হেডগেওয়ারের তথাকথিত সাক্ষাৎকারের মতোই সুভাষচন্দ্র বসু এবং সাভারকরের   সাক্ষাৎকারের ঘটনাকে নগ্নভাবে প্রচার করে থাকে। আরএসএস-এর স্বেচ্ছাসেবকের স্মৃতিচারণ : 'এই সময়ে সমস্তকিছু সম্পর্কে নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি যাই হোক না কেন, যুবকেরা দলে-দলে আরএসএস-এ যোগ দিয়েছিল। এই যোগদানের সাধারণ সংগ্রামী আবহাওয়া নিয়েও তারা এই গর্ববোধ করত। স্বেচ্ছাসেবকদের আরএসএস-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, আমাদের অপেক্ষা করতে করতে হবে। সুযোগ একদিন অবশ্যই আসবে। আমাদের উচিত সেই সময়ের জন্যে শক্তি সঞ্চয় করে রাখা (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ - ডি আর গয়াল, পৃ. ৮৭)। গয়াল আরও লিখেছেন, আরএসএস-এর মূল কাজ হল যুব সমাজের মধ্যে যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব জেগে উঠেছে, সেই মনোভাবকে ভোঁতা করে দেওয়া। যুবসমাজের মধ্যেকার এই ব্রিটিশবিরোধী মনোভাবকে মুসলিমবিরোধী মনোভাবের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হল আরএসএস-এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এই নীতি গ্রহণের ফলেই ব্রিটিশ সরকার আরএসএস-এর বিরুদ্ধে কোনও প্রকারেরই বড় পদক্ষেপ কখনওই নেয়নি। কারণ, আরএসএস-এর শিক্ষাশিবিরগুলোতেও নেতাদের বক্তৃতার মূল বিষয়ই ছিল মুসলিম বিরোধিতা (ওই, পৃ. ৬৭)।

সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে সাভারকরের যে সাক্ষাৎকারের কথা আজও আরএসএস-এর পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়, সেই সাক্ষাৎকারটি কিন্তু সত্যিই ঘটেছিল। এই সাক্ষাৎকারের ঘটনা '৯৭ সালের মার্চ মাসে সাভারকরের পুত্র বিক্রম সাভারকর বম্বেতে জানিয়েছিলেন। তাছাড়াও, বিলওয়াস সাভারকরের 'Veer Savarkar-INA'S Source of inspiration' Commemoration Volume -এর ১৪৭ থেকে ১৫১ পৃষ্ঠায় এ সম্পর্কে বহু তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। বম্বের সাভারকর দর্শন প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৮৯ সালে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের 'Savarkar's Role in the British Quitting India'-তে পৃষ্ঠা ১৮০ থেকে ১৮৮-এ সম্পর্কে তথ্য রয়েছে। এই সাক্ষাৎকারের ঘটনাটি আরএসএস-এর পক্ষ থেকে বিকৃতভাবে পরিবেশন করা হয়। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই সাক্ষাৎকারের সময়ে সাভারকরই নাকি সুভাষচন্দ্রকে ইউরোপ গিয়ে একনায়কদের সাহায্য প্রার্থনা করবার জন্যে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছিলেন। সাভারকর এবং সুভাষচন্দ্রের মধ্যে সাক্ষাৎকারের যেসব তথ্যপ্রমাণ আরএসএস-এর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সেইসব তথ্যপ্রমাণের মধ্যেও সাভারকরের এই ধরনের পরামর্শ বিষয়ক কোনও তথ্যই নেই। Times of India ১৯৪০ সালের ২৪ জুন লিখছে, 'শনিবার সন্ধেবেলায় দাদারে সাভারকরের বাসভবনে সুভাষচন্দ্র বসু এবং সাভারকরের মধ্যে আলোচনা হয়। আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে মনে করা হচ্ছে যে, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং এই পরিস্থিতিতে হিন্দু মহাসভা, ফরওয়ার্ড ব্লক এবং সমমনোভাবাপন্ন রাজনৈতিক শক্তিগুলি পারস্পরিক সহযোগিতায় কী করতে পারে, তা নিয়ে উভয় নেতা কথাবার্তা বলেন। তবে যতদূর জানতে পারা গেছে, এই আলাপ-আলোচনা বিশেষ আশাপ্রদ হয়নি। লক্ষণীয়, সাভারকর এবং সুভাষচন্দ্র বসুর এই সাক্ষাৎকারটি কোনও অবস্থাতেই ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে যায়নি। গোয়েন্দা বিবরণীতে বলা হচ্ছে, সুভাষচন্দ্র বসু বম্বেতে আসেন ২২ জুন। তিনি এখানে এসে এম এ জিন্নাহ এবং সাভারকরের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন। ফরওয়ার্ড ব্লক এবং হিন্দু মহাসভার মধ্যে সম্ভাব্য সহযোগিতা নিয়ে আলাপ আলোচনা হলেও, শেষপর্যন্ত এই আলোচনা কোনও শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছতে পারেনি। ২৩ জুন বম্বেতে একটি সভার আয়োজনের পরিকল্পনা সুভাষচন্দ্র এবং তাঁর দু-একজন সহযোগীর পক্ষ থেকে চালানো হলেও, এই প্রচেষ্টাও শেষপর্যন্ত সফল হয়নি (MSA, Home Special Dept, 1023, 1939-40, SA dated June 29, 1940, FORWARD BLOCK)।

===================================================

আরএসএস-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা যখন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের মধ্যে ফাটল ধরিয়ে সাম্রাজ্যবাদকে সাহায্য করবার তাগিদ নিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন, তখন তিনি এই উদ্দেশ্য নিয়ে অনুশীলন সমিতির মধ্যে প্রবেশের চেষ্টা করেন। সেই সময়েই বিপ্লবী সংগঠনগুলি প্রশিক্ষণের কর্মকাণ্ডের আরএসএস-এর মধ্যে প্রয়োগ ঘটাতে হেডগেওয়ার প্রথম থেকেই সচেষ্ট ছিলেন। আরএসএস-এর প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে তার কিছু অন্ধ অনুকরণের চেষ্টা প্রথম থেকেই ছিল। পরবর্তী সময়ে সেই প্রচেষ্টা আরও প্রসারিত হয় এবং নিত্যনতুন কৌশল তাতে সংযুক্ত হয়। তবে স্বভাবসুলভ ভাবেই বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগের কথা বলে আরএসএস তাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ারকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে উপস্থাপিত করবার সবরকম প্রচেষ্টা চালালেও, অনুশীলন সমিতির নেতা, কর্মীরা কোনও অবস্থাতেই হেডগেওয়ারের দ্বারা বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হননি। এই সাক্ষাৎকারকে ঘিরেও যথেষ্ট মিথ্যে প্রচার চালায় চরম প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দুত্ববাদীরা। ত্রৈলোক্য মহারাজ জীবনের শেষদিকে যেভাবে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মতো ভাবধারার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন, বামপন্থীদের সঙ্গে তাঁর যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তার দ্বারাই পরিষ্কারভাবে প্রমাণ হয়ে যায় তিনি হেডগেওয়ারের দ্বারা কোনওভাবেই প্রভাবিত হননি।

===================================================

১৮৯০ সালে বিবেকানন্দ যখন পরবর্তী পর্যায়ের ভারত পরিক্রমা করছেন, আলমোড়ার পথে একদিন সহায় সম্বলহীন অবস্থায় ক্ষুধা, তৃষ্নায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েন। কাছাকাছি কোন বাড়ি নেই সেখানে আতিথ্য নেবেন। একমাত্র রয়েছে একটি পীরের মাজার। সেই মাজারে রয়েছেন এক বৃদ্ধ ফকির। বিবেকানন্দ অবলীলার সেই ফকিরের কাছে ভিক্ষা চাইলেন। ফকির সাহেবেরও যথার্থই কেবল অতিথিকে দেওয়ার মতো সম্বল বলতে মাত্র একটি শসা তাঁর কাছে রয়েছে। তিনি পরম আগ্রহভোরে সেই শশাটি বিবেকানন্দের হাতে তুলে দিলেন। বিবেকানন্দও পরম তৃপ্তিভরে শশাটি খেলেন।


প্রাণরক্ষাকারী সেই ফকির সাহেবকে কিন্তু বিবেকানন্দ কোনোদিন ভোলেননি। তখন তিনি শিকাগো জয় করে বিশ্ব বিখ্যাত। এসেছেন আবার আলমোড়ায়। গেলেন সেই ফকির সাহেবের কাছে। পরম কৃতজ্ঞতায় নিজের সম্বল থেকে কিছু অর্থও তুলে দিলেন সেই মহৎ-প্রাণ মানুষটির হাতে। সেই ফকির সাহেব প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ সেদিন বলেন, উনি বাস্তবিক সেদিন আমার প্রাণরক্ষা করেছিলেন, কারণ আমি আর কখনো ক্ষুধায় অমন কাতর হইনি। এই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন স্বামী অখণ্ডানন্দ। যাঁকে নিজের গুরু বলে দাবি করেন গোলওয়ালকর। যদিও এই দাবির পক্ষে কোনো তথ্য প্রমাণ তারা দিতে পারেনা।   

===================================================

বিবেকানন্দের অকপট স্বীকারোক্তি : "আমরা মানবজাতিকে সেখানে নিয়ে যেতে চাই যেখানে বেদও নেই, বাইবেলও নেই, কোরানও নেই।" এই ভারত পথিক বিবেকানন্দ ভারতাত্মার উন্মীলনে মাত্র ৩৯ বছরের জীবনে সর্বশক্তি নিয়োগ করে দিয়েছেন। ধর্মের নাম ধর্মান্ধতা, জাতপাতের নামে মনুষ্যত্বের অপমান, অন্ধ কুসংস্কার-এ সবের মূর্ত প্রতিবাদ ছিলেন বিবেকানন্দ। যুক্তির বাইরে জীবনে একটিও কথা বলেননি, পদক্ষেপ নেননি। সন্ন্যাসী হয়েও একদিনের তরেও অস্বীকার করেননি গর্ভধারিনী ভুবনেশ্বরীর প্রতি তাঁর সন্তানসুলভ দায়িত্ব। নিজের মৃত্যু আসন্ন বুঝতে পেরে জননীর অন্নসংস্থানের জন্যেই হাত পেতেছিলেন খেতাবি, রাজের কাছে। নিছক আচার আচরণের জালে আবদ্ধ না থেকে, কেবলমাত্র দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনে আত্মনিবেদিত যুবকদের অনুপ্রাণিত করেই নিজের কর্তব্য সমাধা করেননি। অনুরাগী দেশিয় রাজন্যদের কাছ থেকে অর্থসংগ্রহ করে, বিদেশি ভক্ত মিস ম্যাকলাউডের কাছ থেকে বিদেশ থেকে অস্ত্র আনার পরিকল্পনা করেছিলেন ব্রিটিশকে এদেশ থেকে তাড়াতে। চন্দননগরের ভিতর দিয়ে ভারতে অস্ত্র নিয়ে আসার ক্ষেত্রেও যে বিবেকানন্দের যে ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল তা জানা যায় মিস ম্যাকলাউডের কাছে থাকা বিবেকানন্দের কতকগুলি ঐতিহাসিক চিঠির মাধ্যমে। সেই চিঠিগুলি পরবর্তী সময়ে নানা ঐতিহাসিক পটভূমিকায় ম্যাকলাউড নষ্ট করে ফেলেন। এই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন মিস ম্যাকলাউড ঘনিষ্ট লিজেল রেমঁ। বিবেকানন্দ নিবেদিত প্রাণ গবেষক শঙ্করীপ্রসাদ বসুকে এই ঘটনাবলী লিজেল রেমঁ লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন।


আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে বুকের মাঝে বিশ্বলোকের যে সন্ধান বিবেকানন্দ করে গেছেন তাকে স্বার্থান্বেষীরা প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম, রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী প্রবণতায় বিকৃত করছে। এই প্রবণতাকে পরাজিত করে বিশ্বলোকের সন্ধানী বিবেকানন্দকে উদ্ভাসিত করতে হবে মানুষের কল্যাণে।

===================================================


সহিষ্ণুতা থেকে রোহিত ভেমুলা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এবং দেশের শাসক দল বিজেপি এবং তার চালিকা শক্তি আরএসএস'র ভূমিকা দেখে মনে পড়ে যায় জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সম্পাদিত 'বালা' পত্রিকায় ১২৯২ বঙ্গাব্দের আষাঢ় (১৮৮৫) সংখ্যায় 'আকবর শাহের উদাহরণা' শীর্ষক রবীন্দ্রনাথের একটি নিবন্ধ। ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, অসহিষ্ণুতা, চরম দলিত বিরোধিতায় মোদি জামানায় দীর্ণ ভারতে রবীন্দ্রনাথের ওই নিবন্ধ আজও সমান প্রাসঙ্গিক। তিনি লিখছেন :

"একজন প্রাচীন ইংরাজ ভ্রমণকারী আকবর বাদশাহের উদারতা সম্বন্ধে একটি গল্প করিয়াছেন তাহা নিম্নে লিখিতেছি।

আকবর শাহের মাতৃভক্তি অত্যন্ত প্রবল ছিল। এমন-কি, এক সময়ে যখন তাঁহার মা পালকি চড়িয়া লাহোর হইতে আগ্রায় যাইতেছিলেন, তখন আকবর এবং তাঁহার দেখাদেখি অন্যান্য বড়ো বড়ো ওমরাওগণ নিজের কাঁধে পালকি লইয়া তাঁহাকে নদী পার করিয়াছিলেন। সম্রাটের মা সম্রাটকে যাহা বলিতেন তিনি তাহাই পালন করিতেন। কেবল আকবর শা মায়ের একটি আজ্ঞা পালন করেন নাই। সম্রাটের মা সংবাদ পাইয়াছিলেন যে পর্টুগিজ নাবিকগণ একটি মুসলমান জাহাজ লুঠ করিয়া একখণ্ড কোরান গ্রন্থ পাইয়াছিল, তাহারা সেই গ্রন্থ একটি কুকুরের গলায় বাঁধিয়া বাজনা বাজাইয়া অর্মজ শহর প্রদক্ষিণ করিয়াছিল। এই সংবাদে ক্রুদ্ধ হইয়া সম্রাটমাতা আকবরকে অনুরোধ করিয়াছিলেন যে একখণ্ড বাইবেল গাধার গলায় বাঁধিয়া আগ্রা শহর ঘোরানো হউক। সম্রাট তাহার উত্তরে বলিয়াছিলেন-- "যে কার্য একদল পর্টুগালবাসীর পক্ষেই নিন্দনীয় সে কার্য একজন সম্রাটের পক্ষে অত্যন্ত গর্হিত সন্দেহ নাই। কোনো ধর্মের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করিলে ঈশ্বরের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করা হয়। অতএব আমি একখানা নিরীহ গ্রন্থের উপর দিয়া প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করিতে পারিব না।"


গোবিন্দ পানসারে থেকে কালবুর্গি বা দাদরির শেখ আখলাক থেকে রোহিত ভেমুলাসহ জানা অজানা যে সব মানুষ আজ অসভ্য বর্বর হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির অসহিষ্ণুতা নামক প্রতিহিংসার শিকার তাদের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথের এই পংক্তিগুলি মনে হয় যথার্থ শ্রদ্ধাঞ্জলি। 

===================================================