এঙ্গেলেসের মৃত্যুর (১৮৯৫) পর থেকেই শুরু হলো বার্নস্তাইনের নতুন থিওরি রচনার ও তার প্রচারের অভিযান। তাঁর থিওরি পূর্ণরূপ গ্রহণ করলো ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত তাঁর "বিবর্তনের পথে সমাজতন্ত্র (Evolutionary Socialism) নামক গ্রন্থে। ১৮৯৯ সালে হ্যানোভারে অনুষ্ঠিত জার্মান সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি কংগ্রেসে তিনদিন ধরে তাঁর এই নতুন থিওরি আলোচিত হয়, কিন্তু কংগ্রেস এই থিওরি 'গ্রহণ' করতে অস্বীকার করে।
১৯০০ সালে বার্নস্তাইন ফিরে আসেন জার্মানিতে এবং সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি নিজের মত প্রচার করে থাকেন। তাঁর সেই মতবাদই সংশোধনবাদ নামে খ্যাত। তিনি বললেন যে, মার্কসের সমস্ত বক্তব্য এখন প্রযোজ্য নয়, তাই কালোপযোগী করে তিনি মার্কসবাদের সংশোধন করেছেন।
১৯০০ সাল থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ প্রথম মহাযুদ্ধের আরম্ভ ও দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের পতন পর্যন্ত সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে প্রকৃত মার্কসবাদীদের প্রচন্ড সংগ্রাম করতে হয়েছিল। এই সংগ্রামের গোড়ার দিকে জার্মান সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা কার্ল কাউৎস্কি মার্কসবাদের পক্ষ সমর্থন করে সংগ্রাম চালিয়েছিলেন সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে -- লেনিনের কথায় কাউৎস্কি তখন পর্যন্তও বিপ্লবী ছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরে কাউৎস্কি সংশোধনবাদীদের দলে ভিড়ে যান এবং সংশোধনবাদের অন্যতম প্রবক্তা হয়ে দাঁড়ান। গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের নেতৃত্ব লেনিনকেই গ্রহণ করতে হয়েছিল।
ইতিহাসের গতিধারায় মার্কসবাদের সত্যতা যখন প্রমাণিত হলো, যখন ইউরোপ ও আমেরিকার প্রলেতারিয়েত "একক বাহিনীরূপে, এক পতাকার নিচে একটি উপস্থিত লক্ষ্য নিয়ে" সঙ্ঘবদ্ধ হলো, যখন তত্ত্বগতভাবে মার্কসবাদের জয়ধ্বনিই দিকে দিকে ঘোষিত হলো, তখন মার্কসবাদের শত্রুরা দেখলো যে, প্রকাশ্যে মার্কসবাদের বিরোধিতা করে বিশেষ ফল পাওয়া যাবে না, মার্কসবাদী সেজেই মার্কসবাদের বিরোধিতা করতে হবে, শ্রমিক সংগঠনের, শ্রমিকশ্রেণীর পার্টির অভ্যন্তরে থেকেই এই বিরোধিতা আত্মপ্রকাশ করলো মার্কসবাদকে সংশোধন করার রূপ নিয়ে।
লেনিনের কথায় :
"সংশোধনবাদ ও মার্কসবাদের 'সংশোধন' হচ্ছে প্রলেতারিয়েতের উপর বুর্জোয়া প্রভাবের এবং শ্রমিকদের কলুষিত করার বুর্জোয়া পদ্ধতির প্রধান অভিব্যক্তি না হলেও অন্যতম প্রধান অভিব্যক্তি। সেজন্যই সুবিধাবাদী নেতা এডওয়ার্ড বার্নস্তাইন এতো বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছেন।" (লেনিন : হঠকারী সিদ্ধান্ত - ১৯১৪)
====================================
সংশোধনবাদের মতন একটি আর একটি মতবাদও মার্কসবাদকে বিকৃত করে। এই মতবাদ হচ্ছে সঙ্কীর্ণতাবাদ। সংশোধনবাদ মার্কসবাদকে যুগোপযোগী, কালোপযোগী করার নামে বাতিল করে দেয় মার্কসবাদের প্রাণবস্তুকে -- শ্রেণীসংগ্রাম, শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্ব আর শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বকে। অন্যদিকে সঙ্কীর্ণতাবাদ মার্কসবাদকে আপ্তবাক্য মনে করে, সুত্রানুবদ্ধ বিধি বা অন্ধবিশ্বাসের প্রতীক বলে মনে করে। যেহেতু মার্কসবাদের লক্ষ্য বিপ্লব, সেহেতু সঙ্কীর্ণতাবাদীরা মার্কসবাদের আক্ষরিক বিশুদ্ধতার কথা বলে স্থান-কাল-পাত্র বিচার না করে সর্বক্ষণই বিপ্লবের স্লোগান আউড়ে চলে -- এরা রেডিমেড বিপ্লবের ভক্ত, এরা চায় 'এক্ষুনি, এই মুহূর্তে বিপ্লব করতে হবে'; এরা মার্কসবাদকে কর্মক্ষেত্রে পথ-নির্দেশক হিসাবে গ্রহণ করা না, গ্রহণ করে আপ্তবাক্য হিসাবে। তাই সব সময়েই এরা অতি-বিপ্লবী, 'হঠাৎ ক্ষেপে-ওঠা' বিপ্লবী।
====================================
মার্কস ও এঙ্গেলেস্ সর্বদাই বলতেন : "আমাদের শিক্ষা আপ্তবাক্য নয়, আমাদের শিক্ষা কর্মক্ষেত্রে পথনির্দেশক"। লেনিন বারবার মার্কস ও এঙ্গেলেসের এই শিক্ষার কথা উল্লেখ করতেন। লেনিন আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছেন যে, "মার্কসবাদের সূত্রগুলি কেবল সাধারণভাবে কাজের মোটামুটি রূপরেখা দিতে সক্ষম, ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার প্রত্যেকটি পর্যায়ের বাস্তব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনিবার্যভাবেই এই কাজের রূপভেদ ঘটায়। এই অবিসংবাদী সত্য প্রত্যক্ষ করা একান্ত প্রয়োজন যে, মার্কসবাদীকে বাস্তব জীবনের প্রকৃত তথ্যের অনুশীলন করতে হবে। গতকালের মতবাদকে আঁকড়ে থাকলে চলবে না।" (সি পি এস ইউ'র ইতিহাস, পৃ: ৩০৪ - এনবিএ সংস্করণ; লেনিন কালেকটেড ওয়ার্কস রুশ সংস্করণ - ২০ খন্ড, পৃ: ১০০-১০১)।
লেনিনের মতে, বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণই হচ্ছে মার্কসবাদের প্রাণবস্তু। আমাদের সব সময়ে মনে রাখতে হবে যে, প্রত্যেকটি দেশের গণ-আন্দোলন অত্যন্ত জটিল রূপ ধারণ করতে পারে এবং সংগ্রামের যে যে রূপ প্রয়োজন তা বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করেই গ্রহণ করতে হবে। একটা অবস্থায় সংগ্রামের একটা রূপ গ্রহণ করা যেতে পারে। আবার যখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে তখন সংগ্রামের নতুন রূপ গ্রহণ করতে হবে এবং অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অপ্রত্যাশিতভাবে অত্যন্ত দ্রূতগতিতে সংগ্রামের রূপ পরিবর্তনের দক্ষতা মার্কসবাদীদের অর্জন করতে হবে। তাদের মার্কসবাদী তত্ত্বকে ধর্মীয় আপ্তবাক্য মনে না করে কর্মক্ষেত্রে পথ নির্দেশক বলে মনে করতে হবে।
নভেম্বর বিপ্লবের বিজয়ের পর ইউরোপের কোনো কোনো দেশের কমিউনিস্টরা খুব তাড়াতাড়ি বিপ্লব করার জন্য উৎসাহিত হয়ে বলতে আরম্ভ করেছিল যে, কারুর সঙ্গে কোনরকম আপস নয়, একেবারে সোজা পথেই তারা চলবে, তারা এ ধরণের চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল যে, বিপ্লবের পথ সিধা, মসৃন রাজপথ। এদের উদ্দেশ্যে লেনিন তাঁর 'বামপন্থী কমিউনিজম - শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা' গ্রন্থের 'কয়েকটি সিদ্ধান্ত' অধ্যায়ে যা লিখেছিলেন তা আজ আবার আমাদের স্মরণ করা প্রয়োজন।
লেনিন লিখেছিলেন : "আমরা যদি জার্মান ও ব্রিটিশ বামপন্থী কমিউনিস্টদের মতো বলি যে, আমরা শুধু একটি পথ - সোজা সড়কই মানি, ঘুরপথে চলা বা আপস মহড়ার আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আমরা স্বীকার করি না, তাহলে সেটা ভুল হবে এবং তার ফলে কমিউনিজমের গুরুতর ক্ষতি হতে পারে, স্থান বিশেষে ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছেও। দক্ষিণপন্থী গোঁড়ামী শুধু পুরনো কাঠামোকেই (ফর্ম) স্বীকার করে চলছিল নতুন বিষয়বস্তুকে (কনন্টেন্ট) উপলব্ধি করতে পারেনি। তাই তা সম্পূর্ণ দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। বামপন্থী কমিউনিজম কয়েকটি পুরনো কাঠামোকে বিনাশর্তে বর্জন করতে চায়। তারা এটা দেখে না যে, নতুন বিষয়বস্তু সবরকম কাঠামোর মধ্যেই জোর করে প্রবেশের পথ করে নিচ্ছে। তারা বোঝে না যে, কমিউনিস্ট হিসাবে কর্তব্য হলো সব কাঠামোকেই আয়ত্ত করা, শিক্ষা করা কি করে সব থেকে দ্রূত একটা কাঠামো দিয়ে আর একটাকে পরিপূর্ণ করা যায়, একটা কাঠামোর বদলে আর একটাকে ব্যবহার করা চলে, আমাদের শ্রেণী বা আমাদের প্রচেষ্টার ফলে যে পরিবর্তন আসেনি তার সঙ্গে আমাদের কৌশলকে খাপ খাইয়ে নেওয়া যায়।"
ঐ গ্রন্থেই লেনিন কমিউনিস্টদের রণকৌশল সম্পর্কে 'কোনো' আপস নয়' অধ্যায়ে যে নির্দেশ কমিউনিস্টদের দিয়েছিলেন আজও তা প্রযোজ্য।
লেনিন লিখেছিলেন:
"অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী শত্রুকে পরাজিত করতে হলে সর্বশক্তি দিয়ে প্রচেষ্টা করতে হবে। সেজন্য অবশ্য শত্রুপক্ষের প্রত্যেকটি, এমনকি সামান্যতম 'মনোমালিন্য', বিভিন্ন দেশের বুর্জোয়াদের মধ্যেকার এবং দেশগুলির ভিতরে ও নানা গোষ্ঠী ও ধরণের বুর্জোয়াদের প্রত্যেকটি স্বার্থের সংঘাত সুচতুরভাবে ব্যবহার করতে হবে। তেমনি আবার গণ-সমর্থন লাভের প্রত্যেকটি, এমনকি সামান্যতম সুযোগেরও সদ্ব্যবহার করতে হবে তা সে সমর্থন যতোই সাময়িক, দোদুল্যমান, অস্থায়ী, অনির্ভরযোগ্য বা শর্ত সাপেক্ষই হোক না কেন। যাঁরা এ কথাটা বোঝেন না, তাঁরা মার্কসবাদ বা সাধারণভাবে বৈজ্ঞানিক আধুনিক সমাজবাদের বিন্দুবিসর্গও বোঝেন না। যাঁরা বেশ দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই সত্যকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগের দক্ষতা কাজের মধ্য দিয়ে প্রমান করতে পারেননি, তাঁরা এখনও শোষকদের কবল থেকে খেটে-খাওয়া মানুষদের মুক্ত করার সংগ্রামে বিপ্লবীশ্রেণীকে সাহায্য করতে শেখেননি"।
====================================
কিন্তু যাঁরা নিজেদের 'বিপ্লবী কমিউনিস্ট' বলে জাহির করে মার্কসবাদের তত্ত্বকে আপ্তবাক্য বলে মনে করেন, তাঁরা হচ্ছেন মতান্ধ, তাঁরা হচ্ছেন সঙ্কীর্ণতাবাদী। তাঁরাও ভিন্ন পথে মার্কসবাদকে বিকৃত করেন। বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে তাঁরা অসার, শূন্যগর্ভ সূত্রই রচনা করেন, তাঁরা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে অন্য দেশের বাস্তব পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য কিনা সে কথা আদৌ বিচার না করে তা জনগণের উপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেন এবং গণ-আন্দোলনের সাফল্যের পথে বাধা সৃষ্টি করেন। স্থান-কাল এবং বাস্তব অবস্থাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তাঁরা সংগ্রামের একটি রূপকে আঁকড়ে ধরে থাকেন এবং তাকেই সংগ্রামের একমাত্র রূপ বলে প্রচার করে থাকেন। তাঁরা এমনই মতান্ধ যে, তাঁরা একথা বুঝতেও চান না যে, প্রত্যেকটি দেশের গণ-আন্দোলন অত্যন্ত জটিল রূপই ধারণ করে এবং সংগ্রামের যে যে রূপ প্রয়োজন তা বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করেই গ্রহণ করতে হবে, তাঁরা একথা বুঝতে অক্ষম যে, যখন বাস্তব অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, তখন সংগ্রামের নতুন রূপ গ্রহণ করতে হয়। জনগণের চেতনার স্তরকে তাঁরা গ্রাহ্যের মধ্যেই ধরেন না, জনগণ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখেন এবং পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যেই নিজেদের আবদ্ধ রাখতে ভালোবাসেন। নিজেদের অভিলাষ দিয়ে তাঁরা জনগণের চেতনার মান বিচার করেন এবং বড়ো বড়ো বিপ্লবী বুলি আউড়ে নিজেদের বিপ্লবীপনা জাহির করেন। তাঁরা মার্কসবাদকে কর্মক্ষেত্রে পথনির্দেশক মনে করতে শেখেননি, এঁরা বিপ্লবের ক্ষতিই করে থাকেন।
No comments:
Post a Comment