বহু শতাব্দী ধরে উপনিবেশবাদ ছিল এক বাস্তব সত্য। বিভিন্ন মহাদেশগুলি ইওরোপীয় শক্তিরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল, এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকাকে ভাগ করা হয়, দখল করা হয় ও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শোষণ করা হয়। ইওরোপীয়ানরা তাদের সঙ্গে এনেছিল তাদের ধর্মকে; এক অর্থে এই ধর্ম ছিল দখলদারদের, দাস মালিকদের, শোষণকারীদের ধর্ম। একথা সত্য যে এই ধর্মের যে প্রকৃতি, আমি বলব এর যে মানবিক উপাদান, সৌভ্রাতৃত্বের যে মহান আদর্শ এর মর্মবস্তু, সে মর্মবস্তুর সঙ্গে দখলদারদের লোকদেখানো ধর্মের বিরোধিতা ছিল এবং আমি এই প্রসঙ্গে ধর্মযাজকদের কথা বলছি না - কিন্তু এই একই ধর্ম সেই প্রাচীন রোমে শেষ পর্যন্ত দাসদের ধর্মে পরিণত হয়। পৃথিবীর এই গোলার্ধে, যেখানে স্পেনীয়রা তিন শতাব্দী ধরে ছিল, কিউবায় ছিল প্রায় চার শতাব্দী, কারণ এই দেশটাই তারা সবার আগে দখল করে এবং সবশেষে মুক্তি পায় - স্বাভাবিকভাবে জয়ী পক্ষের ধর্ম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
এশিয়ার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেনি, কারণ সেখানে অন্য ধর্ম ছিল, যার শিকড় অনেক গভীরে এবং সেখানে প্রাচীন সংস্কৃতির প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল বেশি - হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও অন্যান্য স্থানীয় ধর্মের উপাদানও ছিল অনেক সমৃদ্ধ। ফলে সেখানে অন্যধর্মের সঙ্গে, অন্য দর্শনের সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের সংঘাত হয়েছে, ফলে তাদের প্রভাব ততটা ছড়ায়নি, ততটা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। আরব দুনিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে ইসলাম থেকেই গেছে, খ্রিশ্চান ধর্মযুদ্ধ ও পশ্চিমী ইউরোপীয় আধিপত্য সত্ত্বেও। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতে হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম থেকে গেছে, যদিও ওইসব দেশ ইউরোপের উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। ভারতে এবং এশিয়ার অন্য অঞ্চলে যেমন চিনে ইউরোপীয় আধিপত্য সত্ত্বেও তাদের নিজস্ব ধর্ম টিকে গেছে।
===========================================
ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে এইসব ঘটনাটাকে যদি বিশ্লেষণ করা যায় তবে একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে এই বিজেতা, শোষক এবং অত্যাচারীদের চার্চ বিজেতা, অত্যাচারী ও শোষকদের পাশেই ছিল। তারা কখনই সুনির্দিষ্টভাবে দাসত্বকে ধিক্কার জানায়নি, যে ব্যবস্থা আজ আমাদের বিবেকের কাছে ঘৃণিত। কৃষ্ণাঙ্গ ও ইন্ডিয়ানদের ক্রীতদাস বানানোকে কখনই ধিক্কার জানানো হয়নি। চার্চ কখনও আদিম অধিবাসী জনসাধারণকে নিকেশ করা ও ওইসব মানুষদের উপর অন্যান্য অপরাধকে নিন্দা করেনি - প্রকৃতপক্ষে তাদের জমি, সম্পদ, সংস্কৃতি এবং এমনকি তাদের প্রাণও লুট করা হয়েছিল। কোনো একটা চার্চ এইসব অপরাধকে ধিক্কার জানায়নি এবং এই ব্যবস্থা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চালু ছিল।
সুতরাং এইসব যুগ যুগ ধরে চলে আসা অবিচারের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে একটা ধর্মবিরোধী স্পিরিট ছিল। হ্যাঁ, একথা অবশ্যই সত্য বিপ্লবী আন্দোলনের অভ্যন্তরে এইসব আইডিয়া উদ্ভবের পিছনে কতগুলি বস্তুগত ঐতিহাসিক কারণও ছিল। এইসব আইডিয়া ছিল ফরাসি বিপ্লবে, ছিল বলশেভিক বিপ্লবেও। এই আদর্শ প্রথম উদয় হয় উদারনীতিবাদে। জাঁ জ্য়ক রুশো এবং ফরাসি বিশ্বকোষ প্রণেতাদের মধ্যে এই ধর্ম-বিরোধী স্পিরিট ছিল। এই আইডিয়া সমাজতন্ত্রের আদর্শের মধ্যে হঠাৎ এসেছে এমন নয়, ঐতিহাসিক কারণেই তা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মধ্যে এসেছে। কখনই চার্চের থেকে পুঁজিবাদকে ধিক্কার জানানো হয়নি। হয়ত আজ থেকে ১০০ কিংবা ২০০ বছর পর যখন পুঁজিবাদ সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে যাবে তখন কেউ হয় তিক্ত ভাষায় বলবে, "শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পুঁজিপতিদের চার্চ কখনও পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থাকে ধিক্কার জানায়নি"; ঠিক যেমন আজকে মানুষ বলছে যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চার্চ দাস ব্যবস্থাকে, ইন্ডিয়ানদের নিকেশ করাকে এবং ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাকে ধিক্কার জানায়নি।
বর্তমানে বিপ্লবীরা বর্তমান শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন, যা অত্যন্ত নির্দয়। অথচ সব ভুল কাজেরই একটা ব্যাখ্যা থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সেটা ভুলই। মূল কথা হল একটা আইডিয়া অথবা বিপ্লবী সামাজিক কর্মসূচিকে কী করে বাস্তবে রূপায়িত করা হবে। আপনি যদি একথা বলেন যে লাতিন আমেরিকার বর্তমান পরিস্থিতিতে খ্রিশ্চানরা হল সংখ্যাগুরু এবং তারাও বর্তমান ব্যবস্থার ভয়ানকরকম শিকার - সুতরাং তারা যখন ন্যায়বিচার চাইছে তখন তাদেরকে বুঝিয়ে একটা সাধারণ সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করার কথা আপনি বলছেন - আমি এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে একমত। আমি আরো জোরালোভাবে আপনার সঙ্গে একমত একারণে লাতিন আমেরিকার খ্রিশ্চানদের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের মধ্যে জাগরণ দেখতে পাচ্ছি। এই সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মাথায় রেখে আমরা যদি বিশ্লেষণ করি তবে একথা বলা সম্পূর্ণ সঠিক এবং যুক্তিসঙ্গত হবে এ বিষয়ে বিপ্লবী আন্দোলনের একটি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা দরকার এবং যে কোনও মূল্যে তাত্ত্বিক বাগাড়ম্বরকে এড়িয়ে যাওয়া উচিত - কারণ তা শ্রমিক, কৃষক ও মধ্যবিত্তের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে - এই ধরনের বাগাড়ম্বর শুধু শোষণ ব্যবস্থার স্বার্থকেই রাখা করে।
আমি বলব, নতুন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বামপন্থীরা এ বিষয়টি নিয়ে আগে যেভাবে ভাবত, তার বদল হওয়া দরকার। এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। এ নিয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই। ইতিহাসের এক দীর্ঘসময়ে ধর্মীয় বিশ্বাসকে ব্যবহার করা হয়েছিল আধিপত্য ও শোষণের জন্য। সুতরাং যেসব মানুষ সেই অবিচারের ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন, তাঁরা ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে, তার বিভিন্ন হাতিয়ারের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হবেন এটাই স্বাভাবিক।
আমি বলেছি যে যারা কৌশলে কার্যসিদ্ধি করতে চায় তারা কখনোই কারোর সন্মান পায় না এবং কোথাও সফল হয় না। এইসব কৌশলীরা যেন ছোট নৌকা, হাওয়া আর স্রোত যেদিকে সেদিকে চলে। এই কৌশলে কার্যসিদ্ধি হল সুবিধাবাদেরই নামান্তর। এর কোনো সারবত্তা নেই, এর কোনো শিকড় নেই, আপনার যদি মনে হয় আমি একজন সুবিধাবাদী তাহলে আমার প্রতি আপনার কোনো শ্রদ্ধা থাকবে না এবং একইভাবে কোনো বিপ্লবী যদি আপনাকে বা অন্য কাউকে মনে করে যে এই ব্যক্তি কায়দা করে কাজ হাসিল করে তাহলে সেক্ষেত্রে আপনি শ্রদ্ধা পাবেন না। আমি মনে করি সন্মান, সম্পর্ক, গভীর বিশ্লেষণ ও বোঝাপড়া তাঁদের মধ্যেই গড়ে ওঠা সম্ভব যাঁরা নিজের কাছে সৎ এবং অন্যের কাছেও। আপনার বিশ্বাসের মধ্যে যদি গভীরতা না থাকে, তাহলে আপনার আইডিয়া আমার মনের মধ্যে কোনো ছাপ ফেলবে না।
ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে আমি যে শ্রদ্ধা করি, তার কারণ ধর্মের বিষয়ে আপনার বিশ্বাস খুব গভীর। আমি নিশ্চিত চার্চের অন্যান্য সদস্যরা, যাঁরা আপনারই মতো এইসব সমস্যা নিয়ে ভাবিত, তাঁরাও আপনারই মতো। যদি বিপ্লবীরা মনে করত আপনারা সৎ নন, তাহলে আপনারা যা কিছুই বলুন না কেন তার কোনো অর্থ নেই - আপনাদের সঙ্গে যেসব আইডিয়া নিয়ে আলোচনা করেছি বা ঐক্য গড়ে তুলতে চেয়েছি সেগুলোও মূল্যহীন। একথা আমি আগেই নিকারাগুয়াতে বলেছি যে একজন খাঁটি মার্কসবাদী একজন মেকি খ্রিষ্টানকে বিশ্বাস করবে না এবং সত্যিকারের খ্রিস্টান যে সে একটি মেকি মার্কসবাদীকে বিশ্বাস করবে না। একমাত্র এই বিশ্বাসই একটি সত্যিকারের শক্তিশালী দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে।
এই প্রসঙ্গ আপাতত থাকে। কথায় বলে "খোঁড়ার চেয়ে মিথ্যাবাদীকে চেনা সহজ।" কপটতা করে কেউ নিজেকে খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী অথবা বিপ্লবী প্রমাণ করতে পারবে না, এবং মিথ্যাকে চাপা দেওয়া যায় না।
===========================================
No comments:
Post a Comment