Wednesday, 25 May 2016

বাল্মীকির রাম ফিরে দেখা - সুকুমারী ভট্টাচার্য

রাম উপাখ্যানে কতগুলো প্রশ্ন জাগে । প্রথমত, বালী বধ বিষয়ে । স্পষ্টতই ক্ষত্রিয় বীরের পক্ষে কাজটা গর্হিত, এক বানররাজাকে আড়ালে লুকিয়ে থেকে হত্যা করা, এটা কোনো নীতিতেই সমর্থন করা যায় না । উত্তরে যদি বলি, সীতাকে খুঁজে পাবার জন্যে সুগ্রীবের সাহায্য অত্যাবশ্যক ছিল, তাহলেও প্রশ্ন ওঠে যে এতে রামের বীরত্ব সম্বন্ধে জাগে । সম্মুখ-সমরে তাহলে বালীকে হারাবার শক্তি বা সে শক্তি সম্বন্ধে আত্মবিশ্বাস রামের ছিল না । এটা এক যশস্বী ক্ষত্রিয়বীরের পক্ষে গ্লানিকর । কাজটা কাপুরুষোচিত, সম্পূর্ণ স্বার্থ প্রনেদিত । এবং আরও কলঙ্ককর হলো, বালীকে নিজের প্রজা বলে শাসন করেছেন বলা, বানর মাংস অভক্ষ্য তবুও বালী হত্যাকে মৃগয়া বলা এবং আনুষঙ্গিক বিস্তর কুযুক্তির অবতারণা করা।

গুহকের আতিথ্য গ্রহণ না করার মধ্যেও বর্ণ-বৈষম্যের প্রশ্ন ওঠে । ফলাহারী ঋষিরাও অন্যের দেওয়া ফল খেতে পারেন, বনবাসকালে রাম কয়েকবার মুনিঋষির আতিথ্য নিয়েওছেন । গুহক চন্ডাল, তাই তার কাছে শুধু পশুর খাদ্যই গ্রহণ করলেন।

অন্ধমুনি বৈশ্য, তাঁর স্ত্রী শূদ্রা (২/৫৭/৬৩) । তিনি নিজেকে 'বানপ্রস্থী' বলছেন কী করে ? তাহলে 'শম্বুকের সাধনাও তো অশাস্ত্রীয় হয় না ? এই শম্বুককে রাম বধ করেছেন এবং ব্রাহ্মণের অকাল মৃত পুত্রকে বাঁচাতে । তাহলে প্রাণের মূল্য রাম রাজত্বে বর্ণগতভাবে আপেক্ষিক, ব্রাহ্মণ-পুত্রের প্রাণ শূদ্রের প্রাণের চেয়ে দামি ? এটা মেনে নেওয়া হয়েছে সমস্ত প্রক্ষিপ্ত অংশে । রামরাজ্যে চন্ডালের সঙ্গে বন্ধুত্ব শুধু কথায় ?যে ফল জল ব্রাহ্মণদের কাছে নেওয়া যায় তা চন্ডাল বন্ধুর কাছে নেওয়া যায় না ? শূদ্র শম্বুক তপস্বী, কৃচ্ছসাধনে রত কিন্তু সাধারণ এক ব্রাহ্মণ বালকের তুলনায় তার প্রাণের মূল্য কিছু নেই ।

বালীকে বধ করা, শম্বুককে হত্যা করা ছাড়াও যেটি আমাদের বেশি ভাবায় তা হলো সীতা প্রত্যাখ্যান । সুন্দরকান্ডে সীতাহরণের পরে রামের যে বিলাপ তার ভাব সম্পূর্ণতই বিরহার্ত প্রেমিকের, কিন্তু সে কি শুধু অলঙ্কারিক বিরহ ? শুধু সীতাসম্ভোগ-বঞ্চিতের বিলাপ ? নতুবা দীর্ঘ অদর্শনের পরে রামের 'হৃদয়ান্তর্গতভাব' এমন হলো কেন যে সীতাকে দেখা মাত্রই তাঁর দুই চক্ষু পীড়িত বোধ করল এবং রাজনন্দিনী রাজকুলবধু সীতাকে শিবিকা থেকে নেমে হেঁটে আসবার হুকুম দিলেন, সীতা আসামাত্রই বললেন, 'গচ্ছ বৈদেহি' তোমার জন্য যুদ্ধ করিনি, করেছি ইক্ষবাকু বংশের গৌরব রক্ষার জন্য ? কোথায় ছিল সে ইক্ষবাকু কুলের গর্ব যখন লঙ্কায় প্রকাশ্য সভায় অপ্রমাণিত, অসত্য আশংকায় রাজকুলবধূকে কটু কথা বলেছিলেন ? কোথায় ছিল সে কুলগর্ব যখন দেবতাদের সাক্ষ্য, ঋষি বাল্মীকির শপথ সব অগ্রাহ্য করে পুত্রদের, প্রজাদের, অতিথিদের সামনে ইক্ষবাকু কুলবধূ সীতাকে আবার অগ্নিপরীক্ষা দিতে বললেন ? কোথায় রইল সে গর্ব যখন দেবী বসুমতী বারংবার সন্দেহে পীড়িত, লাঞ্ছিত, অপমানিত কন্যাকে কোলে নিয়ে অন্তর্ধান করলেন ? কে অপরাধী প্রমাণিত হলো ? অকারণ সন্দেহ এবং তার বশে দণ্ডদানের অপরাধে কলঙ্কিত হলেন না, ইক্ষবাকু-কুলতিলক রামচন্দ্র ? সীতা লক্ষ্মণকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছিলেন। 'রামকে বোলো, আমাকে চিরদিনই সম্পূর্ণ নির্দোষ জেনে, রামের হিতব্রতিনী জেনে, শুধু লোকাপবাদের আতঙ্কে ভয় পেয়ে ত্যাগ করলেন তিনি ।' এতে কি ইক্ষবাকু কুলের গৌরব বাড়ল ? গৌরব বাড়ল অন্যায় দণ্ডদাতা রাজার ? এ-ই রাম রাজ্যের নমুনা ?

========================================================================


কলিতে শূদ্র দ্বিজাতির প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠবে একথা রামায়ণ মহাভারত উভয় মহাকাব্যের ভার্গব প্রক্ষেপে অত্যন্ত স্পষ্ট । কাজেই এমন আদর্শ রাজার আকল্প নির্মান করতে হবে যিনি কঠোর হাতে প্রতিস্পর্ধী শূদ্রকে দমন করেন, বিনা দ্বিধায়, বিনা চিন্তায় । সেই আদর্শ রাজা রামচন্দ্র, যিনি শম্বুককে হত্যা করলেও দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করে বলেন - তুমি দেবতাদের কাজ করেছ । বর্ণগুলোর ক্রম যাতে নষ্ট না হয় সেটা দেখা রাজার কর্তব্য । রাম সেই আদর্শ রাজা, যাঁর এক খড়গাঘাতে প্রতিস্পর্ধী শূদ্র মরল এবং বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণের অকালমৃত পুত্রও বাঁচল । কলির আসন্ন সংক্রমণ থেকে যিনি প্রজাকুলকে বাঁচালেন, সমাজকে আশ্বস্ত এবং সুস্থির করলেন ।

পিতৃভক্ত, বন্ধু-বৎসল, প্রজাহিতৈষী, ভ্রাতৃ-বৎসল দেবদ্বিজে ভক্তিমান, সুবিচারক, যজ্ঞকারী - অতএব আদর্শ যুগোচিত নায়ক । শূদ্র যদি ত্রিবর্ণের সেবা ছাড়া অন্য কিছুর আকাঙ্ক্ষা করে তবে বর্ণ-ধর্মরক্ষাকারী রাজা তো তাকে মেরে ফেলবেনই । স্ত্রী যদি অনিচ্ছাতেও পর-পুরুষের দ্বারা স্পৃষ্ট বা অপহৃত হয় - তবে যতই সচ্চরিত্রা হোন না তিনি, অগ্নিপরীক্ষা, নির্বাসন, পুনর্বার পরীক্ষা এইসব অবমাননা তাঁকে নির্বিকার চিত্তে মেনে নিতেই হবে । সমাজ কখনোই নারীকে ব্যক্তি বল স্বীকার করেনি, ভোগ্যবস্তু পণ্যদ্রব্য এইসব আখ্যা দিয়েছে । .... সীতার সচ্চরিত্রা নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হবার পরও তাঁর গর্ভজাত সন্তানদের ইক্ষবাকু কুলের রাজসিংহাসনে অধিকার দেওয়া গেল না । প্রজারা নিশ্চয়ই পুলকিত হলো, আদর্শ রাজা রাজকুল-মর্যাদায় এতটুকু কলুষের বা তার সন্দেহেরও স্পর্শ লাগতে দিলেন না ।

এই যে নতুন আদর্শের প্রজাপালক রাজার নির্মাণ হলো, ইনি কিন্তু মহাকাব্যের নায়ক নন । সে নায়ক ক্ষত্রিয় যোদ্ধা বীর, আদর্শ রাজা হওয়া তাঁর কাছে প্রতীক্ষিত ছিল না । ক্ষত্রিয় নায়কের অঙ্গীকার ও কর্তব্য শেষ হয়েছে যুদ্ধ-জয়ে রাবণ-বধে । তারপর শুরু হলো মহাকাব্যটি ঢেলে সাজানো, আদিকান্ডে প্রথমার্ধে ও উত্তরাকান্ডে এঁর নবকলেবর রূপায়ণ ঘটল । এখন ইনি বর্ণধর্মের পরিপালক রাজা । শূদ্র ও নারীর কোনোরকম স্বাধীনতা, স্পর্ধা বা অধিকার স্বীকার করলে পাছে কলির স্পর্শদোষ ঘটে রাজ্যে, তাই ইনি সমাজের স্থিতবস্থা রক্ষা করেছেন অতন্দ্রভাবে । এর কিছু মূল্য দিতে হয়েছে তাঁকে, এক-পত্নীক রাজা সীতাকে হারালেন । সমাজে নারীর সতীত্ব শুচিতা নিয়ে যে নতুন নিরিখ তৈরি হয়েছে তার কাছে বলি দিতে হলো আপন দাম্পত্য-সুখ । কিন্তু এর মূল্য দিতে তাঁর বিশেষ বাজেনি, কারণ সীতাকে যখন তিনি প্রথম কঠিন কথাগুলো বলেন লঙ্কায়, তখন তা তাঁর হৃদয়ান্তর্গত ভাব । অর্থাৎ, সমাজের নির্মম নির্দেশ তিনি নিজ অন্তরে স্বীকার করে নিয়েছিলেন বলেই পারলেন ওই কথাগুলি বলতে । এইখানে মহাকাব্যের পরাজয় ঘটল শাস্ত্রকারদের কাছে ।

আজ যখন 'রামরাজ্য' সম্বন্ধে একটা স্বপ্নকে পুনর্বার কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করার একটা উগ্র চেষ্টা হচ্ছে এ দেশের লোকমানসে, তখন যেন আমরা নিজেদের প্রশ্ন করি : নারী শূদ্রের ওপর অত্যাচার যে তন্ত্রে অপরিহার্যভাবে গৃহীত, যেখানে ধর্মাকাঙ্ক্ষী শূদ্র ব্রাহ্মণ-পুত্রের জন্য প্রাণ দিতে বাধ্য হয়, নিষ্পাপ অন্তঃসত্ত্বা নারী অকারণে যেতে বাধ্য হয় নির্বাসনে, দেওরালা-আড়ওয়ালের পরও আমরা কি সেই রাজতন্ত্রই চাই ? এরই নায়ক কি 'মর্যাদা পুরুষোত্তম' ? অর্থাৎ পুরুষের সর্বোত্তম আদর্শ অসহায়কে বিপন্নকে ও নারীকে রক্ষা করাই তো এতদিন আদর্শ পুরুষদের অবশ্য করণীয় ছিল, তাকে বর্জন করে যে রাজতন্ত্র, তা কি সাধারণ মানুষের পক্ষে চূড়ান্ত অভিশাপ হয়ে উঠবে না ? তাকে ঠেকানোই কি আজ আমাদের প্রধান কর্তব্য নয় ?

Sunday, 15 May 2016

বামফ্রন্ট সরকার ৩৪ বছরের ইতিহাস সংকলন

বামফ্রন্ট সাফল্যকে অনুধাবন করতে ব্যাপক তথ্যাবলীর চেয়ে জীবনের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু কোন মানুষই জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে কখনো বিচরণ করতে পারেন না, তাই কেবলমাত্র ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে ব্যাপকতম সত্যকে স্পর্শ করা সম্ভব নয় । তবে সমাজজীবনের বৃহত্তর অংশগুলির জন্য কোন ইতিবাচক কাজ হলে তার পরোক্ষ প্রভাব সমাজের সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে । পশ্চিমবাংলায় সে অনুভব এত প্রত্যক্ষ ও স্পষ্ট যে, অজস্র মিথ্যা প্রচারেও সেগুলিকে নিষ্প্রভ করা যায়নি । কেননা এখানে উন্নয়নের সুফলে উপকৃত সর্বজনীন মানুষ । তবে ভিন্ন একটু মাধ্যম ও মাত্রা রয়েছে যার নিরিখে অনেক সময়ই সত্যকে চিন্হিত করা যায় । তা হলো বিবেচ্য বিষয় প্রসঙ্গে তৃতীয় কোন নিরপেক্ষ অভিজ্ঞতা ও অভিমত । তৃতীয় পক্ষ অর্থে তেমন অংশের মানুষ বা প্রতিষ্ঠান যে বা যারা ঘটনাবলীর দাতা ও গ্রহীতা না, দূরের অবলোকনকারী বা সমীক্ষক । পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্য উপলব্ধিতে সংক্ষেপে এমন নিরিখ কিছুটা লক্ষ্য করা যাক ----

১) সাধারণ মানুষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও রাজ্যের সাফল্য সমগ্র দেশ তথা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে । বিশেষ করে দারিদ্র দূরীকরণে এ রাজ্যের অভাবনীয় সাফল্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে বহুল আলোচিত বিষয় । রাষ্ট্রসংঘের দারিদ্রতা সম্পর্কিত প্রতিবেদনে পশ্চিমবঙ্গের সাফল্য প্রশংসিত হয়েছে । রাষ্ট্রসংঘ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রশংসা করেই ক্ষান্ত হয়নি অন্যদের অনুরূপ পথে চলার পরামর্শ দিয়েছে ।

২) ২০০০ সালের ৩১শে জানুয়ারি প্রকাশিত বিশ্বব্যাঙ্কের "ভারত : দারিদ্র্য দূরীকরণ, উন্নয়ন, উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণ" রিপোর্টে ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে দ্রুততার সঙ্গে দারিদ্র প্রমশনের ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর কারণও চিন্হিত করা হয়েছে । বলা হয়েছে পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে এই সময়ে ভূমিসংস্কার ও উচ্চহারে কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । এরই পাশাপাশি রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্পর্কে রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়, "বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা রাষ্ট্রায়ত্ত স্বাস্থ্য পরিষেবার বিশ্বাসযোগ্যতা কয়েকটি রাজ্যে বাড়িয়েছে - উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা" ।

৩) একদা ভারতের যোজনা কমিশনের অন্যতম সদস্য মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়া ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাপ্লায়েড ইকনেমিক রিসার্চের সুবর্ণজয়ন্তী বক্তৃতায় দেশের প্রধান ১৪ টি রাজ্যের (যেখানে ৯৫ শতাংশ মানুষ বাস করেন) উন্নয়নের তুলনামূলক ব্যাখ্যা করেন । সেখানে তুলে ধরা হয়েছে "১৯৮০-৮১ সাল থেকে ১৯৯০-৯১ সাল (৮০-র দশক) এবং ১৯৯০-৯১ সাল থেকে ১৯৯৭-৯৮ সালের (৯০-এর দশক) মধ্যে ১৪ টি রাজ্যের উন্নয়নমূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে । ঐ রিপোর্ট থেকে দেখা গেছে ৮০-র দশকে মোট আভ্যন্তরীণ উত্পাদন বৃদ্ধির হারের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল দশম । ৯০-এর দশকে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, কর্নাটক, তামিলনাডু, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ এবং রাজস্থানকে অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গ তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে । মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের পরই পশ্চিমবঙ্গের স্থান । মাথাপিছু রাজ্যের মোট আভ্যন্তরীণ উত্পাদন বৃদ্ধির দিক থেকে ৮০-এর দশকে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল একাদশ । ৯০-এর দশকে উঠে এসেছে তৃতীয় স্থানে, মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের পরেই ।

৪) হল্যান্ডের আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জি কে লিটেন এক দীর্ঘ গবেষণামূলক প্রবন্ধে লিখেছেন "অনেক পর্যবেক্ষকের কাছে এটা বিস্ময়কর যে, পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট প্রধান বামফ্রন্ট সরকার এখন প্রায় দুই দশক হলো ক্ষমতায় রয়েছে । এই সরকার অনেকগুলি জাতীয়, প্রাদেশিক ও স্থানীয় স্তরের নির্বাচনের পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে । ভারতীয় রাজনীতির ক্রমবর্ধমান ঘূর্ণাবর্তের মধ্যেও তা অবিচল রয়েছে । অবজ্ঞামূলক অস্বীকৃতি এবং নিঃশর্ত প্রশস্তি, এই দুই চরমাবস্থা কাটিয়ে একজন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক সরাসরি স্বীকার করে নিতে পারেন যে, পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ভালই কাজ করেছে এবং সেটাই হলো তার সাফল্যের উত্সস্বরূপ"।

৫) দেশের অন্যতম বনিকসভা - অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার অব কমার্স বিভিন্ন রাজ্যের উত্পাদন বৃদ্ধির হার সম্পর্কে একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে । তাতে ৮০-র দশক এবং ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যে বিভিন্ন রাজ্যের অভ্যন্তরীণ উত্পাদন বৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে তুলে ধরা হয়েছে । তাতে দেখা গেছে আলোচ্য সময়ে গড় উত্পাদন বৃদ্ধির হার বিহারে ১.৭৯ শতাংশ, পাঞ্জাবে ০.৬৯ শতাংশ, রাজস্থানে ০.৬ শতাংশ কমেছে । এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ । ৮০-র দশকের তুলনায় ৯০-র দশকে (১৯৯১-১৯৯৮) পশ্চিমবঙ্গে উত্পাদন বৃদ্ধির হার ৪.৭১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৬.৯১ শতাংশ হয়েছে ।

৬) রাষ্ট্রসংঘের অ্যাটাকিং পর্ভাটি রিপোর্ট (২০০০-০১) পশ্চিমবঙ্গের বর্গা অপারেশন-এর প্রশংসা করা হয়েছে ।

৭) পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সারা দেশের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে । শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা পরিচালিত বিকেন্দ্রীকৃত ব্যবস্থার প্রসারের এবং কর্মসূচির সুষ্ঠ রূপায়ণের ফলে কমেছে গ্রামীণ দারিদ্রতা । বিশ্বব্যাঙ্ক পশ্চিমবঙ্গের ভূমিকাকে প্রশংসা করে পশ্চিমবঙ্গকে অভিহিত করেছিল "leader state" হিসাবে ।

৮) কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ শৌরী কর্তিক প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে, ১৯৯৩-৯৪ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক বিকাশের হার পশ্চিমবঙ্গে সর্বাধিক । আলোচ্য সময়ে অর্থনৈতিক বিকাশের হার কমেছে অন্ধ্রপ্রদেশে ৮৩ শতাংশ, দিল্লিতে ৪০.২ শতাংশ, পাঞ্জাবে ৩৫ শতাংশ এবং উত্তর প্রদেশে ৪ শতাংশ । আর বেড়েছে ওড়িশায় ১.০২ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৫.৫৮ শতাংশ,বিহারে ১৮ শতাংশ, মহারাষ্ট্রে ২২ শতাংশ, রাজস্থানে ৫০ শতাংশ, কর্নাটকে ৮৫ শতাংশ, তামিলনাড়ুতে ৮৮ শতাংশ, ত্রিপুরায় ১০১ শতাংশ, গুজরাটে ১২১ শতাংশ এবং কেরালায় ১৪০ শতাংশ বেড়েছে । পশ্চিমবঙ্গে বেড়েছে সর্বাধিক হারে ১৮০ শতাংশ ।

৯) পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সাফল্য প্রসঙ্গে ভূয়শী প্রশংসা করেছেন বিশ্ববিখ্যাত পন্ডিত, বিশেষজ্ঞ, গবেষক নোয়াম চমস্কি ।

১০) পশ্চিমবঙ্গের সাক্ষরতার কর্মসূচীর বিপুল সাফল্যের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসাবে ইউনেস্কো পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে পুরস্কৃত করেছে ।

১১) ১৯৮৯ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত পূর্বাঞ্চল ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের সমস্ত রাজ্যগুলির পঞ্চায়েতরাজ সম্মেলনের উদ্বোধন করতে এসে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত রাজীব গান্ধী বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এবং বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগকে প্রশংসা করে তাকে সমগ্র দেশের 'মডেল' হিসাবেই চিন্হিত করেছিলেন ।

১২) সামাজিক বনসৃজনের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করে বনরক্ষার সাফল্যের জন্য বামফ্রন্ট সরকার অর্জন করে আন্তর্জাতিক সন্মান 'পল গেটি পদক' ।

১৩) পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসঙ্গে প্রতীচী ট্রাস্ট ২০১০ সালে একটি সমীক্ষা করে । ঐ সমীক্ষার ভিত্তিতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন যে মন্তব্য করেছেন তাহা এখানে উল্লেখ করা হলো : প্রথমত --- "শুধু ছাত্র ভর্তির সংখ্যাই বেশী নয়, ছাত্রদের উপস্থিতির গড়ও উল্লেখযোগ্য । (প্রাথমিক স্কুলে ও শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে যথাক্রমে ৫৮ শতাংশ এবং ৬৪ শতাংশ থেকে বেড়ে উভয় ক্ষেত্রেই ৭৫ শতাংশ হয়েছে)" । দ্বিতীয়ত --- "শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অবদান সম্পর্কে অবদান সম্পর্কে পিতামাতাদের সন্তুষ্টির মাত্রা বেড়েছে । (প্রাথমিক স্কুলের ক্ষেত্রে ৫২ শতাংশ থেকে ৬৪ শতাংশ এবং শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের ক্ষেত্রে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ) । যদিও সামগ্রিক সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এখনও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে । সন্তানদের উন্নতির ক্ষেত্রেও পিতামাতারা আগের থেকে অনেক বেশী সন্তুষ্ট । (প্রাথমিক স্কুলে ৪২ শতাংশ থেকে ৭১ শতাংশ, শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের ক্ষেত্রে ৪৯ শতাংশ থেকে ৭৩ শতাংশ)" । তৃতীয়ত --- "২০০১-০২ সালে ছাত্ররা কে কতটা শিখেছে, তার উপর সমীক্ষা চালাতে গিয়ে আমরা প্রতিটি ছাত্রের আলাদা আলাদা করে পরীক্ষা নিয়েছিলাম । আমরা দেখেছিলাম এমনকি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রদের ৩০ শতাংশ নিজের নাম লিখতে পারে না ।এতে আমরা খুবই আশাহত হয়েছিলাম । কিন্তু এখন এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে । বর্তমানে এই সংখ্যা ৩০ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৫ শতাংশ । (যদিও সংখ্যাটি শূন্য হওয়াটাই কাম্য, কিন্তু এই সংখ্যাটি হ্রাস পাওয়াও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়)" । চতুর্থত --- "এখন বেশিরভাগ প্রাথমিক স্কুল ও শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে মিড ডে মিল দেওয়া হয় । স্কুলগুলিতে শিক্ষা ও ছাত্রদের পুষ্টি বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা-ও স্পষ্ট । স্কুলে মিল দেওয়ার জন্য অবশ্যই ছাত্রদের উপস্থিতির হার বৃদ্ধি পেয়েছে । আবার শিক্ষকদের সংগঠনগুলিও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনুপস্থিতি কমাতে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে । এই উদ্যোগের ফলেও বহু অঞ্চলে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে" । পঞ্চমত ---"শিক্ষকদের সঙ্গে বাবা-মায়েদের সাক্ষাত এখন অনেক বেশী বাস্তবায়িত হচ্ছে । বিশেষ করে মা ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়ে কমিটি তৈরী হচ্ছে । তা সত্ত্বেও এঁদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতির ব্যাপারে আমাদের নির্দিষ্ট কিছু পরামর্শ আছে" । "স্কুল শিক্ষার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে " ।

১৪) প্রবীণ চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন বলেছেন - "প্রায় ৩৫ বছর ধরে আমি এই বামফ্রন্টকে দেখছি, দেখে আসছি ১৯৭৭ সাল থেকে কিভাবে এই দলটি নিয়মিত পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে নিজেদের গড়ে তুলেছে । প্রত্যাবর্তন কিন্তু পরিবর্তনের ভিতর দিয়েই হয় । সহজ স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দ জীবন পেয়েছে সাধারণ মানুষ এই বামফ্রন্টের আমলেই । নতুন রাস্তাঘাট, ব্রিজ থেকে ছোট-বড় অনেক কাজই করেছে এই সরকার । সেই সঙ্গে আমি তো অবশ্যই বলব যে, শিল্পী-সাহিত্যিকতা সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছেন এই বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই । সিনেমার কর্মী হিসাবে আমি যেমন নন্দন-এর কথা উল্লেখ না করে পারছি না । আমার বিদেশী বন্ধুবান্ধবের যাঁরাই এসে দেখেছেন, বলেছেন, আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা কমপ্লেক্স । রক্ষনাবেক্ষণ নিয়ে সমস্যা তো থাকতেই পারে । নন্দন তৈরি হয়েছিল জ্যোতি বসুর আমলে, তারপর বিশেষ করে বুদ্ধদেব যথেষ্ট মাথা ঘামিয়েছেন নন্দন-এর সূত্রে সিনেমার উন্নত সংস্কৃতি এ-রাজ্যে তৈরি করতে । সব পরিকল্পনা হয়তো বাস্তবে রূপায়িত হয়নি । তা নিয়ে আমার একটু অস্বস্তি ছিল, বেশ ছিল । বলে রাখা ভাল, আমি কিন্তু কোন বামপন্থী দলের সভ্য নই । কমিউনিস্ট পার্টি যখন অবিভক্ত চিলম তখনও আমি তাদের মেম্বার বা কার্ডহোল্ডার --- কিছুই ছিলাম না । তাছাড়া এই বামফ্রন্টের দলীয় মত কোন ভাবেই আমার উপর বিস্তার করে না । আরও স্পষ্ট করে বলা ভাল, আমার ভাবনাচিন্তা কাজকর্মের ব্যাপারে আমি কখনই তাদের মতামতের অপেক্ষায় থাকি না " ।

Thursday, 12 May 2016

সিঙ্গুর - না বলা কথা ।

আজ ১২ই মে ২০১৬ "এই সময়" পত্রিকায় "সিপিএম-কে বামপন্থার পাঠ দিল সুপ্রিম কোর্ট" শীর্ষক খবরটা পড়তে পড়তে বহুদিনের না বলা কিছু কথা বলতে ইচ্ছে হলো । ইতিমধ্যেই ইচ্ছুক অনিচ্ছুক নিয়ে রাজ্য রাজনীতি তোলপাড় - ৩৫ বছর দীর্ঘ সময়কালব্যাপী বামফ্রন্ট সরকার পতন -  বামফ্রন্টের নিজস্ব মূল্যায়নেও সিঙ্গুর আন্দোলন সরকার পতনের একটা প্রধান কারণ হিসাবে উঠে এসেছে - তত্কালীন বিরোধী দল সরকারে এসেই সিঙ্গুর সমস্যার সমাধান করবে বলে কথা দিয়েও কথা রাখেনি - সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ সমস্যা নিয়ে টাটা ও বর্তমান সরকার সুপ্রিম কোর্টে - এসবই আমাদের জানা । "এই সময়" পত্রিকা বলছে  তত্কালীন বিরোধী নেত্রী এটা বলেছিলেন, ওটা বলেছিলেন - উনি কি বলেছিলেন বা কি করতে চেয়েছিলেন এটা নিয়ে এখন আর কোনো প্রশ্ন থাকারই কথা নয় - তত্কালীন বিরোধী নেত্রী ও তার দলের অবস্থান নিয়ে কোনো আলোচনা করতেও চাই না - তাদের ঐকান্তিক কৃষক প্রীতি এই ৫ বছরে আমাদের বারবার দৃষ্টিগোচর হয়েছে ।

আমার প্রশ্নটা অন্য জায়গাতে - গণতন্ত্রে একটা মানুষের অধিকার নিয়ে - টাটা একটা নির্দিষ্ট জায়গাতে কারখানা বানাতে চেয়েছিল - কিন্তু কিছু কৃষক বা ক্ষুদ্র জমির মালিক তাদের স্বল্প চাষের জমি বিক্রি করতে চাননি - জমির পরিমান ৪০০ একর নাকি ৪০ একর - সেটাও প্রশ্ন নয় । প্রশ্নটা হলো - গণতন্ত্রে কোটিপতি ব্যবসায়ী হিসাবে টাটার যেমন একটা চাহিদা আছে - মালিকপক্ষ হিসাবে তার যেমন মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, তেমনই ৫০০০ টাকার জমিতে লাঙ্গল টানা একজন প্রান্তিক কৃষকেরও তার নিজস্ব মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে - গণতান্ত্রিক কাঠামোতে সেটাও ফেলনা নয় । অনিচ্ছুক কৃষকদের সাথে বসে আলোচনার মাধ্যমে অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াটার জটিলতাটাকে কাটিয়ে ওঠা যেত না কি ? মানছি, বিরোধী দল রাজ্যের উন্নয়নের প্রশ্নটাকে সরিয়ে কতিপয় অনিচ্ছুক জমির মালিক্গুলোকে সামনে রেখে শুধুই রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন - কিন্তু বামফ্রন্ট শাসিত রাজ্যে প্রান্তিক কৃষকদের অধিকার ক্ষুন্ন হওয়া কি কোনোভাবেই সমর্থন যোগ্য ?

আমি নিজে একজন কৃষক পরিবারের সদস্য হয়ে মনে করি - আমার ছোট জমিতে আমি চাষ করবো, আমি আমার জমি কোনো কারখানার মালিককে বিক্রি করবো না - আমি আমার জমি বিক্রি করে, জীবিকার সন্ধানে একটা বেসরকারী কারখানায় দারোয়ানের কাজ করবো না - আমাদের দেশের গণতন্ত্র আমাকে আমার নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয় । আর সিঙ্গুর কোনো জনস্বার্থে অধিগ্রহণ নয় - সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ করে কোনো নতুন রাস্তা হতো না, কোনো নতুন রেলপথ গড়ে উঠত না, কোনো নতুন সামরিক বাহিনীর কেন্দ্রও গড়ে উঠত না - কোন দিক থেকে একটা কারখানার মালিকের জন্য জমি অধিগ্রহণকে জনস্বার্থে অধিগ্রহণ বলা যায় ? আমিও জানি রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থে, ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থে কল কারখানা দরকার - কল কারখানার জন্য জমিও চাই - কিন্তু কোনভাবেই কি বহুফসলি জমি অধিগ্রহণ এড়ানো যেত না ?

বর্তমান সরকারের জমি অধিগ্রহণ নীতি অনুযায়ী সরকার শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করে দেবে না - মালিকপক্ষকে নিজের জমির ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হবে । একটা এলাকাতে ২০০০ জনের জমি থাকলে, মালিকপক্ষকে ২০০০ মানুষের সাথে দরাদরি করতে হবে - এটা অবাস্তব -  প্রধানত এই জমি অধিগ্রহণ নীতির কারণেই বিগত ৫ বছরে পশ্চিমবঙ্গ একটাও বড় শিল্পের মুখ দেখেনি । যদি মালিকপক্ষ এই জমি অধিগ্রহণ নীতি মেনেও নেন - তাহলে শিল্পপতি আর ক্ষুদ্র জমির মালিকের মধ্যে ঢুকবে জমির মাফিয়া, সিন্ডিকেট - আখেরে প্রতারিত হবেন প্রান্তিক কৃষকেরা । তাই প্রান্তিক কৃষকদের স্বার্থরক্ষার প্রশ্নে রাজ্য সরকারেরই মধ্যস্থতা বাঞ্চনীয় । তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জমি অধিগ্রহণ পদ্ধতিতে ভুল থাকতে পারে - কিন্তু তাঁর ও বামফ্রন্ট সরকারের সদিচ্ছা সংশয়াতীত - কিন্তু কোথাও যেন একটা ভুল হয়ে গেল - যার মাসুল আজও দিতে হচ্ছে আমাদের সবাইকে । পড়াশোনা শেষ করেই অন্য রাজ্যে পাড়ি দাও - বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে এক নিঃসঙ্গ জীবনকে নিয়ে চলতে হচ্ছে আমাদের যুবসমাজকে - সেটা অবশ্যই কাম্য নয়  । সিঙ্গুর প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পশ্চিমবঙ্গ শিল্পায়নে একটা জোয়ার আসতো - যা সকলের মত আমারও স্বপ্ন । পশ্চিমবঙ্গের মত কৃষিনির্ভরশীল রাজ্যে যেখানে ক্ষুদ্র জমির মালিকানা বেশি - সেখানে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াটা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেকাংশেই জটিল । কিন্তু বামপন্থী শাসিত একটি রাজ্যে সামান্য একটি কৃষকেরও স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়াটা কি বাঞ্চনীয় ?

প্রক্রিয়াগতভাবে অবশ্যই ভুল হয়েছে কিন্তু সমস্যা সমাধানে বামফ্রন্ট সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল - কিছু বাধাকে সেসময় প্রতিহত করা যায়নি  - কিন্তু থেমে যাওয়া যাবে না - এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই ভবিষ্যতের দিকে এগোতে হবে । ২০১৬ বিধানসভা ভোটে জয়ী হলে বামফ্রন্ট ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক জোট অবশ্যই শিল্পের প্রতি মনোযোগী হবে - বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে এটাই জনগনের প্রত্যাশা । আশা রাখি - নতুন সরকার জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে অনেক বেশি সংবেদনশীল হবে, কোনভাবেই কৃষকের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে না আর সিঙ্গুরবাসীও  আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানে উত্সাহী হবেন ।


ধীমান