মতামত: "প্রায় ১৮ বৎসর পূর্বেকার কথা, আমি তখন প্রথম বিলাত হইতে ফিরিয়াছি। বৈজ্ঞানিক জগতে তখন আমার সামান্য কিছু সুনাম হইছে। ঢাকা শহরনিবাসী (অর্থাৎ আমার স্বদেশবাসী) কোনও লব্ধ প্রতিষ্ঠ উকিল আমি কি বৈজ্ঞানিক কাজ করিয়াছি জানিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি প্রথম জীবনের উৎসাহভরে তাহাকে আমার তদানীন্তন গবেষণা সম্বন্ধে (অর্থাৎ, সূর্য ও নক্ষত্রাদির প্রাকৃতিক অবস্থা, যাহা Theory of lonisation of Elements দিয়া সুস্পষ্টরূপে বোঝা যায়) সবিশেষ বর্ণনা দেই। তিনি দুই-এক মিনিট পর পরই বলিয়া উঠিতে লাগিলেন, “এ আর নূতন কি হইল, এ সমস্তই ব্যাদে আছে।” আমি দুইএকবার মৃদু আপত্তি করিবার পর বলিলাম, “মহাশয়, এসব তত্ত্ব বেদের কোন অংশে আছে, অনুগ্রহপূর্বক দেখাইয়া দিবেন কি ? তিনি বলিলেন, “আমি ত কখনও ‘ব্যাদ’ পড়ি নাই, কিন্তু আমার বিশ্বাস, তোমরা নূতন বিজ্ঞানে যাহা করিয়াছ বলিয়া দাবী কর সমস্তই ‘ব্যাদে’ আছে।” অথচ এই ভদ্রলোক বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন।
বলা বাহুল্য যে, বিগত কুড়ি বৎসরে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ইত্যাদি সমস্ত হিন্দুশাস্ত্র গ্রন্থ এবং হিন্দু জ্যোতিষ ও অপরাপর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রাচীন গ্রন্থাদি তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া আমি কোথাও আবিষ্কার করিতে সক্ষম হই নাই যে, এই সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থে বর্তমান বিজ্ঞানের মূলতত্ত্ব নিহিত আছে। সকল প্রাচীন সভ্যদেশের পণ্ডিতগণই বিশ্বজগতে পৃথিবীর স্থান, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহাদির গতি, রসায়ন বিদ্যা, প্রাণী বিদ্যা ইত্যাদি সম্বন্ধে নানারূপ কথা বলিয়া গিয়াছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও বাস্তবিক পক্ষে বর্তমান বিজ্ঞান গত তিনশত বৎসরের মধ্যে ইউরোপীয় পণ্ডিতগণের সমবেত গবেষণা, বিচারশক্তি ও অধ্যবসায় প্রসূত। একটা দৃষ্টান্ত দিতেছি, এদেশে অনেকে মনে করেন, ভাস্করাচার্য একাদশ শতাব্দীতে অতি অস্পষ্টভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন সুতরাং তিনি নিউটনের সমতুল্য। অর্থাৎ, নিউটন আর নূতন কি করিয়াছে ? কিন্তু এই সমস্ত “অল্পবিদ্যা-ভয়ঙ্করী” শ্রেণীর তার্কিকগণ ভুলিয়া যান যে, ভাস্করাচাৰ্য কোথাও পৃথিবী ও অপরাপর গ্রহসূর্যের চতুর্দিকে বৃত্তাভাস ( elliptical) পথে ভ্রমণ করিতেছে একথা বলেন নাই। তিনি কোথায়ও প্রমাণ করেন নাই যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও গতিবিদ্যার নিয়ম প্রয়োগ করিলে পৃথিবীর ও অপরাপর গ্রহের ভ্রমণ কক্ষ নিরূপণ করা যায়। সুতরাং ভাস্করাচার্য বা কোন হিন্দু, গ্রীক বা আরবী পণ্ডিত কেপলার-গ্যালিলিও বা নিউটনের বহুপূর্বেই মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন, এরূপ উক্তি করা পাগলের প্রলাপ বই কিছুই নয়। দুঃখের বিষয়, দেশে এইরূপ অপবিজ্ঞানপ্রচারকের অভাব নাই, তাহারা সত্যের নামে নির্জলা মিথ্যার প্রচার করিতেছেন মাত্র।" (সবই ব্যাদে আছে - লেখক স্বনামধন্য বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা)
২) "আমরা আধুনিক জ্যোতিষ হইতে জানিতে পারি যে, আমাদের এই পৃথিবী ও সূর্যের সেই অবস্থা-পরিবর্তন চলিয়াছে, শেষে এই কঠিনাকার পৃথিবী গলিয়া গিয়া তরলাকার এবং অবশেষে বাষ্পাকার ধারণ করিবে।" (পৃষ্ঠা ১০)
মতামত: ওপরের বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার যে স্বামী বিবেকানন্দ জ্যোতির্বিদ্যা আর জ্যোতিষশাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্যটা বুঝতেন না। জ্যোতিষশাস্ত্র টলেমির বিতর্কিত ভূকেন্দ্রিক (geocentric) তত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল এবং ইহা কখনই বিজ্ঞানসম্মত নয়।
৩) "চক্ষু যদি দেখিত, তবে মানুষের যখন মৃত্যু হয় তখন তো চক্ষু অবিকৃত থাকে, তবে তখনও তাহারা দেখিতে পাইত।" (পৃষ্ঠা ১২)
মতামত: মানুষের মৃত্যুর পর ৪ - ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত জীবিত থাকে কর্নিয়ার এন্ডোথেলিয়াম কোষগুলি। ফলে ওই সময়ের মধ্যে তা পুনরুদ্ধার করা গেলে তা সহজেই প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। যদিও আমাদের দেশে এই পদ্ধতি ১৯৪৮ সালে শুরু হয়েছিল (স্বামীজীর এই বক্তব্যের অনেক পরে) কিন্তু স্বামীজীর সব ইন্দ্রিয়ের পিছনে অবস্থিত নির্গুণ ব্রহ্মের বুজরুকিগুলো এবার বন্ধ হোক।
https://www.dragarwal.com/blog/general-ophthalmology/eye-donation-facts-and-myths/
৪) "কপিল-দর্শনই পৃথিবীতে যুক্তি-বিচার দ্বারা জগত্তত্ত্ব-ব্যাখ্যার সর্বপ্রথম চেষ্টা। কপিলের প্রতি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করা জগতের সকল দার্শনিকেরই উচিত। আমি আপনাদের মনে এইটি বিশেষ করিয়া মুদ্রিত করিয়া দিতে চাই যে, দর্শনশাস্ত্রের জনক বলিয়া আমরা তাঁহার উপদেশ শুনিতে বাধ্য এবং তিনি যাহা বলিয়া গিয়াছেন, তাহা শ্রদ্ধা করা আমাদের কর্তব্য। এমন কি, বেদেও এই অদ্ভুত ব্যক্তির—এই সর্বপ্রাচীন দার্শনিকের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁহার অনুভূতিসমুদয় কি অপূর্ব! যদি যোগিগণের অতীন্দ্রিয় প্রত্যক্ষশক্তির কোন প্রমাণ প্রয়োগ আবশ্যক হয়, তবে বলিতে হয়, এইরূপ ব্যক্তিগণই তাঁহার প্রমাণ।" (পৃষ্ঠা ১৯)
আবার একটু পরে স্বামীজী নিজেই বলেছেন, "এ কী কুসংস্কার! আর ইহারই ফলে মানুষ তাহার দেব-স্বভাব হইতে পশু-স্বভাবে অবনত হইতেছে। যদি আমাদিগকে সবকিছু অন্ধভাবেই বিশ্বাস করিতে হয়, তবে বিচারবুদ্ধি আমরা লাভ করিয়াছি কেন? যুক্তিবিরোধী কোন কিছু বিশ্বাস করা কি মহাপাপ নয়? ঈশ্বর যে উৎকৃষ্ট সম্পদটি আমাদিগকে দান করিয়াছেন, তাহা যথাযথ-ভাবে ব্যবহার না করিবার কী অধিকার আমাদের আছে? আমার নিশ্চিত বিশ্বাস এই যে, ঈশ্বরদত্ত শক্তির ব্যবহারে অক্ষম অন্ধবিশ্বাসী অপেক্ষা যুক্তিবাদী অবিশ্বাসীকে ভগবান্ সহজে ক্ষমা করিবেন। অন্ধবিশ্বাসী শুধু নিজের প্রকৃতিকে অবনমিত করে এবং পশুস্তরে অধঃপাতিত হয়—বুদ্ধিনাশের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। যুক্তিবিচারের আশ্রয় আমরা অবশ্য গ্রহণ করিব এবং সকল দেশের প্রাচীন শাস্ত্রে বর্ণিত এই-সকল ঈশ্বরের দূত বা মহাপুরুষের কাহিনীকে যখন যুক্তিসম্মত বলিয়া প্রমাণ করিতে পারিব, তখন আমরা তাঁহাদিগকে বিশ্বাস করিব।" (পৃষ্ঠা ২০৮)
একদিকে স্বামী বিবেকানন্দ নিজেই ফতেয়া জারি করছেন আবার অন্যদিকে বলছেন যুক্তিবিরোধী কোনোকিছু গ্রহণ না করতে - কোনটাকে অভ্রান্ত হিসেবে ধরবো, সেটাই তো বোধগম্য হল না।
৫) "যে-ব্যক্তি বলে, জগৎ রহিয়াছে, কিন্তু ঈশ্বর নাই, সে নির্বোধ; কারণ যদি জগৎ থাকে, তবে জগতের একটা কারণও থাকিবে, আর সেই কারণের নামই ঈশ্বর। কার্য থাকিলেই তাহার কারণ আছে, অবশ্য জানিতে হইবে। যখন জগৎ অন্তর্হিত হইবে, তখনই ঈশ্বরও অন্তর্হিত হইবেন।" (পৃষ্ঠা ৭২)
মতামত: ধর্ম ব্যবসায়ীরা ইচ্ছাকৃতভাবে জগৎ নির্মাণের মধ্যে "কারণ"টাকে ঢোকাতে চান যাতে এর মধ্যে তাঁদের নির্গুণ ব্রহ্মের তত্ত্বটাকে জোরজবরদস্তি ঢুকিয়ে দিতে পারেন।
https://www.shongshoy.com/%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%97-%e0%a6%ac%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%82-%e0%a6%a5%e0%a7%87%e0%a6%95%e0%a7%87-%e0%a6%ae%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%b6%e0%a7%8d%e0%a6%ac/
৬) "ধর্ম হইতে আমরা যে-সকল তথ্য ও তত্ত্ব শিক্ষা করিতে পারি, যে-সান্ত্বনা পাইতে পারি, তাহা ছাড়িয়া দিলেও ধর্ম অন্যতম বিজ্ঞান অথবা গবেষণার বস্তু হিসাবে মানব-মনের শ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক কল্যাণকর অনুশীলনের বিষয়।" (পৃষ্ঠা ৯১)
মতামত: স্বামীজীর আরেকটি ভ্রান্ত বিশ্বাস। ফিনল্যাণ্ডে প্রায় ২০%-এর ওপর মানুষ কোনো ধর্মে বিশ্বাস করেন না অথচ বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় টানা ছয় বছর ধরে শীর্ষে রয়েছে ফিনল্যাণ্ড।
মতামত: স্বামীজীর আরেকটি ভ্রান্ত বিশ্বাস। ফিনল্যাণ্ডে প্রায় ২০%-এর ওপর মানুষ কোনো ধর্মে বিশ্বাস করেন না অথচ বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় টানা ছয় বছর ধরে শীর্ষে রয়েছে ফিনল্যাণ্ড।
https://wisevoter.com/country-rankings/least-religious-countries/
https://worldpopulationreview.com/country-rankings/happiest-countries-in-the-world
৭) "মানুষের ইতিহাসে ‘যুক্তি-দেবতার উপাসনা’ ফরাসী-বিপ্লবের সময়েই প্রথম আত্মপ্রকাশ করে নাই; এই জাতীয় ঘটনা পূর্বেও ঘটিয়াছিল, ফরাসী-বিপ্লবের সময় উহার পুনরভিনয় মাত্র হইয়াছে। কিন্তু বর্তমান যুগে উহা অতিমাত্রায় বাড়িয়া উঠিয়াছে। জড়বিজ্ঞানগুলি এখন পূর্বাপেক্ষা আরও ভালভাবে প্রস্তুত হইয়াছে; আর ধর্মের প্রস্তুতি সে-তুলনায় কমিয়া গিয়াছে, ভিত্তিগুলি শিথিল হইয়া গিয়াছে। আর আধুনিক মানুষ প্রকাশ্যে যাহাই বলুক না কেন, তাহার অন্তরের গোপন প্রদেশে এ-বোধ জাগ্রত যে, সে আর ‘বিশ্বাস’ করিতে পারে না। আধুনিক যুগের মানুষ জানে যে, পুরোহিত-সম্প্রদায় তাহাকে বিশ্বাস করিতে বলিতেছে বলিয়াই, কোন শাস্ত্রে লেখা আছে বলিয়াই, কিংবা তাহার স্বজনেরা চাহিতেছে বলিয়াই কিছু বিশ্বাস করা তাহার পক্ষে অসম্ভব। অবশ্য এমন কিছু লোক আছে, যাহারা তথাকথিত জনপ্রিয় বিশ্বাসকে মানিয়া লইতে প্রস্তুত বলিয়া মনে হয়। কিন্তু এ-কথাও আমরা নিশ্চয় জানি যে, তাহারা বিষয়টি সম্বন্ধে চিন্তা করে না। তাহাদের বিশ্বাসের ভাবটিকে ‘চিন্তাহীন অনবধানতা’ আখ্যা দেওয়া চলে। এই সংগ্রাম এভাবে আর বেশীদিন চলিতে পারে না; চলিলে ধর্মের সব সৌধই ভাঙিয়া চুরমার হইয়া যাইবে।" (পৃষ্ঠা ৯৫)
"আমরা সকলেই বাল্যকাল হইতে প্রেম, শান্তি, মৈত্রী, সাম্য, সর্বজনীন ভ্রাতৃভাব প্রভৃতি অনেক কথাই শুনিয়া আসিতেছি। কিন্তু সেগুলি আমাদের কাছে কতকগুলি নিরর্থক শব্দমাত্রে পরিণত হইয়াছে। আমরা সেগুলি তোতাপাখীর মত আওড়াইয়া থাকি এবং উহাই আমাদের স্বভাব হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আমরা ঐরূপ না করিয়া পারি না। যে-সকল মহাপুরুষ প্রথমে তাঁহাদের হৃদয়ে এই মহান্ তত্ত্বগুলি উপলব্ধি করিয়াছিলেন, তাঁহারাই এই শব্দগুলি সৃষ্টি করেন। তখন অনেকেই এগুলির অর্থ বুঝিত। পরে অজ্ঞ লোকেরা এই শব্দগুলি লইয়া ছেলেখেলা করিতে থাকে, অবশেষে ধর্ম জিনিষটাকে কেবলমাত্র কথার মারপ্যাঁচে দাঁড় করান হইয়াছে—উহা যে জীবনে পরিণত করিবার জিনিষ, তাহা তাহারা ভুলিয়া গিয়াছে। ইহা এখন ‘পৈত্রিক ধর্ম’, ‘জাতীয় ধর্ম’, ‘দেশীয় ধর্ম’ ইত্যাদিতে পরিণত হইয়াছে। শেষে কোন ধর্মাবলম্বী হওয়াটা স্বদেশপ্রেমের একটা অঙ্গ হইয়া দাঁড়াইয়াছে, আর স্বদেশপ্রেম সর্বদাই একদেশী।" (পৃষ্ঠা ১০৯)
মতামত: অনেকেই স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক সত্ত্বা খুঁজে বেড়ান কিন্তু ওপরের বক্তব্যগুলি থেকে আমরা বুঝতে পারি যে উনি সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের প্রশ্নে পুরোনো সামন্ততান্ত্রিক শোষণভিত্তিক সমাজ কাঠামোর হয়েই তাঁবেদারি করছেন আর ধর্মের ঠিকাদারেরা বিভিন্নভাবে শ্রমজীবী মানুষদের ধর্মের বিধি, নির্দেশের দোহাই দিয়ে এই সামন্ততন্ত্রের কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে চিরকালই এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ স্বামীজী নিজে; নিচের বক্তব্যগুলো একটু দেখে নেওয়া যাক -
"বর্তমানে যন্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম-নির্মাণ দ্বারা অসাধারণ শক্তি সঞ্চিত হইতেছে এবং এমন সব অধিকার দাবী করা হইতেছে, যাহা পৃথিবীর ইতিহাসে পূর্বে কখনও করা হয় নাই। এই কারণেই বেদান্ত এই অধিকারবাদের বিরুদ্ধে প্রচার করিতে চায়, মানবাত্মার উপর এই উৎপীড়ন চূর্ণ-বিচূর্ণ করিতে চায়।" (পৃষ্ঠা ২৫২)
"বেদান্ত বলেন, আমাদিগকে অধিকারের ভাব ছাড়িয়া দিতে হইবে; ইহা ছাড়িলেই ধর্ম আসিবে। তৎপূর্বে কোন ধর্ম আসে না।" (পৃষ্ঠা ২৫৪)
এরকম আরো উদ্ধৃতি আছে।
৮) "তবু একমাত্র যুক্তিই এই মানব-প্রকৃতির সহিত সরাসরি সংযুক্ত; সেজন্য যতক্ষণ তাহা মানব-প্রকৃতির অনুগামী হয়, ততক্ষণ যুক্তিরই আশ্রয় লওয়া উচিত।" (পৃষ্ঠা ৯৭)
মতামত: স্বামীজীর বহু বক্তব্য এমনই দ্বিচারিতায় পরিপূর্ণ। একটু পরে আবার নিজেই বলেছেন, "বাগাড়ম্বর নয়, তত্ত্বালোচনা নয়, যুক্তিতর্ক নয়, চাই অনুভূতি। ইহাকেই আমি বলি—বাস্তব জীবনে পরিণত ধর্ম।" (পৃষ্ঠা ১৯৬)
বক্তব্য দুটি সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।
৯) "আমার মনে হয়, আধুনিক বিজ্ঞান বার বার যাহা প্রমাণ করিয়া চলিয়াছে, তাহা এইঃ আমরা এক; মানসিক, শারীরিক, আধ্যাত্মিক—সব দিক্ দিয়াই আমরা এক। শরীরের দিক্ হইতে আমরা পৃথক্, এ-কথাও বলা ভুল।" (পৃষ্ঠা ১০০)
স্বামীজীর বহু বক্তব্য এমনই দ্বিচারিতায় পরিপূর্ণ। একটু পরে আবার নিজেই বলেছেন, "আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি, আমাদের শক্তি, আমাদের শরীর কি সব সমান? এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তি অপেক্ষা বলশালী, একজনের বুদ্ধিবৃত্তি অপরের চেয়ে বেশী। যদি আমরা সকলেই সমান হই, তবে এই অসামঞ্জস্য কেন? কে ইহা করিল? আমরা নিজেরা। আমাদের পরস্পরের মধ্যে ক্ষমতার তারতম্য, বিদ্যাবুদ্ধির তারতম্য এবং শারীরিক বলের তারতম্য আছে বলিয়া আমাদের পরস্পরের মধ্যে নিশ্চয়ই পার্থক্য হইতে বাধ্য।" (পৃষ্ঠা ১১৩)
বক্তব্য দুটি সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।
১০) "যদি কলেজ হইতে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকগণ আসেন, তাঁহারা যুক্তিবিচার পছন্দ করিবেন। তাঁহারা যত পারেন বিচার করুন। শেষে তাঁহারা এমন একস্থানে পৌঁছিবেন, যেখানে তাঁহাদের মনে হইবে যে, যুক্তিবিচারের ধারা অক্ষুণ্ণ রাখিয়া তাঁহারা আর অগ্রসর হইতে পারেন না। তাঁহারা বলিয়া বসিবেন, ‘ঈশ্বর, মুক্তি প্রভৃতি ভাবগুলি কুসংস্কার মাত্র—উহাদিগকে ছাড়িয়া দাও।’ আমি বলি, ‘হে দার্শনিক প্রবর, তোমার এই পাঞ্চভৌতিক দেহ যে আরও বড় কুসংস্কার, এটিকে পরিত্যাগ কর। আহার করিবার জন্য আর গৃহে বা অধ্যাপনার জন্য তোমার দর্শনবিজ্ঞানের ক্লাসে যাইও না। শরীর ছাড়িয়া দাও এবং যদি না পার, জীবনভিক্ষা চাহিয়া চুপ করিয়া বস।’" (পৃষ্ঠা ১১৮)
আবার স্বামীজী নিজেই বলেছেন, "আমাদের দেশে যিনি বেদপাঠ করেন, তাঁহার সম্মুখে আমরা নতজানু হই। আর যে ব্যক্তি পদার্থবিদ্যা অধ্যয়ন করিতেছে, তাহাকে আমরা গ্রাহ্যের মধ্যে আনি না। এটা কুসংস্কার—মোটেই বেদান্ত মত নয়—এও জঘন্য জড়বাদ। ঈশ্বরের নিকট সকল জ্ঞানই পবিত্র; জ্ঞানই ঈশ্বর।" (পৃষ্ঠা ২৮৭)
বক্তব্য দুটি সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।
১১) "ধর্ম অনুভূতির বস্তু—উহা মুখের কথা বা মতবাদ বা যুক্তিমূলক কল্পনা মাত্র নয়—তাহা যতই সুন্দর হউক না কেন। ধর্ম—জীবনে পরিণত করিবার বস্তু, শুনিবার বা মানিয়া লইবার জিনিষ নয়; সমস্ত মনপ্রাণ বিশ্বাসের বস্তুর সহিত এক হইয়া যাইবে। ইহাই ধর্ম।" (পৃষ্ঠা ১২৬)
মতামত: স্বামীজী বোঝাতে চেয়েছেন কোনো ব্যক্তি যেন বেদান্ত, আত্মা বা নির্গুণ ব্রহ্মের বাস্তব অস্তিত্বের উপর প্রশ্ন না করে; আর প্রশ্ন করলে সে উত্তরটা পাবে উপরের বক্তব্যের মতো - কারণ সব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই পুরোপুরি বিশ্বাসের ওপর স্থাপিত, এগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
প্রতিটি ছত্রে ছত্রে স্বামীজী যতই এই বিজ্ঞান অমুক বলেছে, সেই বিজ্ঞান তমুক বলেছে বলে দিস্তা দিস্তা কু-যুক্তি তুলে ধরুন না কেন, "ব্রহ্ম"-এর বাস্তব অস্তিত্বের প্রমাণের দায়িত্ব উনি নিতে চান না।
১২) "‘যোগ্যতম ব্যক্তি বা বস্তুই বাঁচিয়া থাকিবে’—আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণের এই মত যদি সত্য হয়, তাহা হইলে এই-সকল ধর্ম যে এখনও বাঁচিয়া রহিয়াছে, ইহা হইতেই প্রমাণিত হয় যে, এখনও তাহারা কতকগুলি লোকের পক্ষে উপযোগী; তাহারা যে কেন বাঁচিয়া থাকিবে, তাহার কারণ আছে—তাহারা বহু লোকের উপকার করিতেছে।" (পৃষ্ঠা ১২৯)
মতামত: যুক্তিবাদের ভাষায় স্বামীজীর এই বক্তব্য জনপ্রিয়তার কুযুক্তি বা ফ্যালাসি (Argument from popularity/ Argumentum ad populum)।
https://www.shongshoy.com/%e0%a6%95%e0%a7%81%e0%a6%af%e0%a7%81%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%bf-%e0%a6%ac%e0%a6%be-%e0%a6%ab%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%bf/
১৩) "আর যদি আপনার ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ থাকে, তবে তাঁহাকে দেখিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করুন না কেন? কেন আপনি সংসার ত্যাগ করিয়া এই এক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সমস্ত জীবন অতিবাহিত করেন না?" (পৃষ্ঠা ১৩৮)
"যেখানে ঈশ্বর আছেন, সেখানে আর কিছু নাই। যেখানে সাংসারিকতা আছে, সেখানে ঈশ্বর নাই।" (পৃষ্ঠা ১৯৪)
মতামত: স্বামীজীর বহু বক্তব্য এমনই দ্বিচারিতায় পরিপূর্ণ। প্রথম খণ্ডে উনি নিজেই বলেছিলেন, "সংসারী অপেক্ষা সংসারত্যাগী মহত্তর, এ-কথা বলা বৃথা। সংসার হইতে স্বতন্ত্র থাকিয়া স্বাধীন সহজ জীবনযাপন অপেক্ষা সংসারে থাকিয়া ঈশ্বরের উপাসনা করা অনেক কঠিন কাজ।" (পৃষ্ঠা ৪৯)
বক্তব্য দুটি সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।
১৪) "মনে রাখিতে হইবে, মানুষ তাহার নিজ কর্মদোষে তাহার শুদ্ধ ভাব হারাইয়াছে। আমরা যে কষ্ট পাই, তাহা আমাদের নিজেদের কর্মফলে। ইহার জন্য ভগবান্ দোষী নন। এই সব ধারণার সহিত পুনর্জন্মবাদের সম্বন্ধ অচ্ছেদ্য। পাশ্চাত্যগণের হস্তে অঙ্গহানি হওয়ার পূর্বে এই মতবাদটি সর্বজনীন ছিল।" (পৃষ্ঠা ১৪৩)
"আমাদের জন্মান্তরবাদের দার্শনিক ভিত্তি এইরূপ। আমরা পূর্বজন্মের অভিজ্ঞতা লইয়া বর্তমান জীবনে প্রবেশ করিয়াছি এবং আমাদের বর্তমান জন্মের সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য সেই পূর্বজন্মের কর্মের ফল; তবে উত্তরোত্তর আমাদের উন্নতিই হইতেছে এবং অবশেষে একদিন আমরা পূর্ণত্ব লাভ করিব।" (পৃষ্ঠা ১৬৫)
"উৎপীড়কদের তুলনায় উৎপীড়িতদের জীবনে বেশী আশা আছে। উৎপীড়কদের পক্ষে মুক্তিলাভ করিতে অনেক বেশী সময় লাগিবে, অন্যের পক্ষে সময় লাগিবে কম।" (পৃষ্ঠা ২৫৪)
মতামত: বেদান্তবাদী স্বামী বিবেকানন্দ "প্রকৃতপক্ষে কেহই জন্মায় না বা মরে না; স্বর্গও নাই, নরকও নাই অথবা ইহলোকও নাই" (পৃষ্ঠা ৫১) বা "মানুষ জন্মায় না বা মরে না বা স্বর্গেও যায় না এবং আত্মার পক্ষে পুনর্জন্ম একটা নিছক কাহিনী মাত্র" (পৃষ্ঠা ২৩৩) মার্কা তত্ত্ব কথা আওড়ানোর পরে পরিশেষে তিনিও সেই জন্মান্তরবাদ আর কর্মফলেরই পক্ষ নিলেন; সাধারণ মানুষের মনে এই কুসংস্কারের বীজ বপন করতে না পারলে যে ধর্ম ব্যবসা লাটে উঠবে!
১৫) "কেনই বা লক্ষ লক্ষ লোক পদদলিত হয়? দুর্ভিক্ষ-সৃষ্টির জন্য যাহারা দায়ী নয়, তাহারা কেন অনাহারে মরে? ইহার জন্য দায়ী কে? ইহাতে মানুষের কোন হাত না থাকিলে ভগবানকেই নিশ্চিতরূপে দায়ী করিতে হয়। সুতরাং ইহার উৎকৃষ্টতর ব্যাখ্যা এই যে, কাহারও ভাগ্যে যে-সকল দুঃখভোগ হয়, তাহার জন্য সে-ই দায়ী। কোন চক্রকে যদি আমি গতিশীল করি, তাহার ফলের জন্য আমিই দায়ী এবং আমি যখন আমার দুঃখ উৎপন্ন করিতে পারি, তখন তাহার নিবৃত্তিও আমিই করিতে পারি।" (পৃষ্ঠা ১৪৩)
মতামত: স্বামীজীর এই ধরণের বহু বক্তব্যই তাঁর সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের খুশি করবার স্বার্থে, যাতে ধর্মের দোহাই দিয়ে শোষণভিত্তিক সমাজ কাঠামোটা ধরে রাখা যায়।
যদি ওঁর এই বক্তব্য যথার্থ হয় সেক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির হত্যা করা হলে, সেই ব্যক্তিই দায়ী, হত্যাকারী নয়।
১৬) "আমরা কি ঈশ্বরকে দর্শন করিতে পারি? অবশ্যই পারি না। আমরা কি ঈশ্বরকে জানিতে পারি? নিশ্চয়ই নয়। ঈশ্বর যদি জ্ঞাতই হন, তাহা হইলে তিনি আর ঈশ্বরই থাকিবেন না। জানা মানেই সীমাবদ্ধ করা। কিন্তু ‘আমি ও আমার পিতা এক।’ আত্মাতেই আমি আমার বাস্তব পরিচয় পাই।" (পৃষ্ঠা ১৪৬)
মতামত: স্বামীজীর বহু বক্তব্য এমনই দ্বিচারিতায় পরিপূর্ণ। একটু পরে আবার নিজেই বলেছেন, "আর একটি কথা আপনাদিগকে জানাইতে চাই—ধর্ম-অর্থে কোন মন-গড়া মত বা সিদ্ধান্ত নয়। আপনারা কি অধ্যয়ন করেন অথবা কি মতবাদ বিশ্বাস করেন, তাহাই প্রধান বিচার্য বিষয় নয়, বরং আপনি কি উপলব্ধি করেন, তাহাই জ্ঞাতব্য। ‘পবিত্রাত্মারাই ধন্য, কারণ তাঁহাদের ঈশ্বর-দর্শন হইবে।’—ঠিক কথা, এই জীবনেই দর্শন হইবে; আর ইহাই তো মুক্তি।" (পৃষ্ঠা ১৪৭)
১৭) "ভারতবর্ষই একমাত্র দেশ, যেখানে ধর্মের জন্য কখনই কাহারও উপর নির্যাতন হয় নাই, যেখানে কোন ব্যক্তি কখনও তাহার ধর্মবিশ্বাসের জন্য উত্যক্ত হয় নাই; সেখানে আস্তিক, নাস্তিক, অদ্বৈতবাদী, দ্বৈতবাদী এবং একেশ্বরবাদী সকলেই আছেন এবং কখনও নির্যাতিত না হইয়া বসবাস করিতেছেন।" (পৃষ্ঠা ১৫৪)
"ইহা যথার্থ গৌরবের বিষয় যে, ভারতবর্ষ এমন একটি দেশ, যেখানে কখনও ধর্মের জন্য উৎপীড়ন হয় নাই, যেখানে ধর্ম বিষয়ে মানুষকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়।" (পৃষ্ঠা ২৫১)
মতামত: সর্বৈব মিথ্যা কথা। ভারতবর্ষে সতীদাহ থেকে শুরু করে বাল্যবিবাহ, কুলিন ব্রাহ্মণদের একাধিক স্ত্রী থেকে দেবদাসী বা মহিলাদের ওপর বৈধব্যজনিত বর্বর, অমানবিক শৃঙ্খলার বেড়া হিন্দুদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল।
রামায়ণে মর্যাদাপুরুষোত্তম রাজা রাম বেদ অধ্যয়ন করার অপরাধে এক নিচু জাতের বালক, শম্বুককে হত্যা করেন। দক্ষিণ ভারতে শিব ও বিষ্ণু ভক্তদের মধ্যেও প্রচুর দ্বন্দ্ব বিদ্যমান ছিল।
https://www.deccanchronicle.com/nation/in-other-news/170416/where-shiva-vishnu-bhakts-clashed.html
১৮) "ফরাসীদেশে দীর্ঘকাল ধরে জাতির মূলমন্ত্র ছিল ‘মানুষের অধিকার’, আমেরিকায় এখনও ‘নারীর অধিকার’ জনসাধারণের কানে আবেদন জানায়; ভারতবর্ষে কিন্তু আমাদের মাথাব্যথা ঈশ্বরের বিভিন্নভাবে প্রকাশের অধিকার নিয়ে।" (পৃষ্ঠা ১৭২)
মতামত: দেশ যখন পরাধীন তখন ওপরের উক্তিটি স্বামী বিবেকানন্দের সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের প্রতি আনুগত্যেরই সাক্ষ্য দেয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের অধিকার, নারী স্বাধীনতা এইসব শব্দ মুখে আনলে তাঁর সামন্তপ্রভুরা ক্ষুব্ধ হতেন বৈকি। এরপরেও কিছু উদারপন্থী বামপন্থীদের কাছে স্বামীজী নাকি সমাজতান্ত্রিক!
১৯) "হিন্দুদের স্বাতন্ত্র্য এই যে, ধর্মের মধ্যে তারা কোন মতবাদ বা নিয়মাদি আনেনি। তাদের ধর্মের তাই সর্বোচ্চ বিকাশ হয়েছে। এই ধর্মের ক্ষেত্রেই আমরা সবচেয়ে বাস্তবদৃষ্টিসম্পন্ন—আর তোমরা সেখানেই সবচেয়ে বাস্তবদৃষ্টিহীন।" (পৃষ্ঠা ১৭৫)
মতামত: সর্বৈব মিথ্যা কথা। সতীদাহ থেকে শুরু করে বাল্যবিবাহ, কুলিন ব্রাহ্মণদের একাধিক স্ত্রী থেকে দেবদাসী বা বিধবা মহিলাদের পুনরায় বিবাহের অন্তরায় পরিস্থিতি হিন্দুরা ধর্মকে ব্যবহার করেই সৃষ্টি করেছিল।
২০) "প্রকৃতপক্ষে ধর্ম ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ইহলোকের বস্তু নয়; ইহা অতীন্দ্রিয় স্তরের বস্তু। ইহা যুক্তি-বিচারের অতীত, ইহা বুদ্ধিগ্রাহ্য স্তরের অন্তর্ভুক্ত নয়। ইহা এমন একটি প্রত্যক্ষ দর্শন, এমন একটি দৈব-প্রেরণা, অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়ের মধ্যে এমন এক আত্ম-নিমজ্জন যাহার ফলে অজ্ঞেয়কে জ্ঞাত অপেক্ষাও নিবিড়ভাবে জানা যায়; কারণ লৌকিক অর্থে ইহার জ্ঞান সম্ভব নয়।" (পৃষ্ঠা ১৭৬)
মতামত: ভক্তদের যে কোনো উপায়ে যুক্তি, বুদ্ধির পথ থেকে সরিয়ে নির্গুণ ব্রহ্মের খোঁজ নিয়ে ব্যস্ত রাখতে সর্বদা সচেষ্ট স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ।
২১) "সমগ্র জগতে যে সকল অবতারপুরুষ ও সাধক জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদের কথা স্মরণ করুন; ইহা সর্বজনবিদিত যে, তাঁহাদের জীবনে এমন সব মুহূর্ত আসিয়াছে, যখন আপাতদৃষ্টিতে তাঁহাদিগকে বাহ্যজগৎ সম্পর্কে অচেতন বলিয়া মনে হয়; অতঃপর তাঁহাদের ভিতর হইতে যে জ্ঞানরাশি উৎসারিত হয়, সে সম্বন্ধে তাঁহারা বলেন, উহা তাঁহারা অতিচেতন স্তর হইতে পাইয়াছেন।" (পৃষ্ঠা ১৮৫)
মতামত: এইসব অতিচেতন স্তরের কোনো একটি সাক্ষ্য প্রমাণ আমরা তাঁদের বা তাঁদের ভক্তকুলের বাইরে থেকে পাই না।
২২) "একটি কথা আপনাদের জানা উচিত, যে-কোন ঘটনাই সম্ভবপর হইতে পারে; এবং ইহাও সম্ভব হইতে পারে যে, লুব্ধক নক্ষত্রের সংস্পর্শে আসিয়া পৃথিবী আগামী বৎসরে বিদীর্ণ হইয়া যাইবে। আমি যদি এইরূপ সম্ভাবনা উপস্থাপিত করি, তবে আপনাদেরও অধিকার আছে যে, আপনারা আমাকে ইহা প্রমাণ করিতে বলিবেন। আইনজ্ঞেরা যাহাকে বলেন, ‘প্রমাণ করার দায়িত্ব’, সে দায়িত্ব তাহার উপরই বর্তাইবে, যে ঐ জাতীয় মতবাদ উপস্থিত করিবে।" (পৃষ্ঠা ১৮৭)
মতামত: আইন ও যুক্তিবাদের দৃষ্টিতে বাস্তব কথা; কিন্তু প্রশ্ন একটাই - স্বামী বিবেকানন্দ নিজে "ধর্ম"কে বিজ্ঞান বলে চালিয়ে দেওয়ার আগে তাঁর বক্তব্যের সপক্ষে কোনো প্রমাণ, সাক্ষ্য বা দলিলের ধার ধারলেন না কেন?
২৩) "যে বৎসরগুলি—যে শত শত বৎসর ধরিয়া আমি শুধু এই ইন্দ্রিয়ভোগে পরিতৃপ্ত মানুষ হইবার জন্য কঠোর সাধনা করিয়াছি, (ঐ দৃষ্টিতে) তাহা বৃথাই গিয়াছে!" (পৃষ্ঠা ১৯০)
মতামত: আবার সেই এক দ্বিচারিতা। দ্বিতীয় খণ্ডে স্বামীজী নিজেই বলেছেন, "এ বিষয়ে আমি নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারি যে, আমার জীবনের ভাল-মন্দ কোন ভাবই বৃথা যায় নাই—আমি সেই অতীত শুভাশুভ উভয়বিধ কর্মেরই সমষ্টি-স্বরূপ। আমি জীবনে অনেক ভুল করিয়াছি, কিন্তু ঐগুলির একটিও যদি বাদ পড়িত, তাহা হইলে আমি আজ যাহা হইয়াছি, তাহা হইতাম না। আমার জীবনে আমি বেশ সন্তুষ্ট।" (পৃষ্ঠা ২১৯)
দুটি বক্তব্য সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।
২৪) "তুমি দুই সহস্র আরোগ্য-নিকেতন নির্মাণ করিয়া থাকিবে, কিন্তু তাহাতে কি আসে যায়, যদি না তুমি আত্মানুভূতি লাভ করিয়া থাক? তুমি মরিবে সামান্য কুকুরেরই মত কুকুরের অনুভূতি লইয়া।" (পৃষ্ঠা ১৯৫)
মতামত: পুনঃপুন সেই এক দ্বিচারিতা। একটু পরে আবার স্বামীজী নিজেই বলেছেন, "লাভের বাসনা না রাখিয়া ঐ ধরনের কর্ম অনুষ্ঠান করিলে আত্মার মঙ্গল সাধিত হয় এবং এরূপ ব্যক্তিদেরই স্বর্গরাজ্য লাভ হয়।" (পৃষ্ঠা ১৯৬)
আত্মানুভূতি লাভ করার ইচ্ছাও তো একরকমের বাসনা। দুটি বক্তব্য সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।
২৫) "প্রকৃত ধর্ম—কোন মানুষের নিকট হইতে শিক্ষাদ্বারা প্রাপ্য নয়, পুস্তকপাঠের দ্বারাও লভ্য নয়; প্রকৃত ধর্ম হইল অন্তরাত্মার জাগরণ" (পৃষ্ঠা ২১৪)
মতামত: অথচ একটু আগে স্বামীজী নিজেই বললেন, "আধুনিক যুক্তির সম্মুখে যদি কোন ধর্মীয় মতবাদ দাঁড়াইতে পারে, তবে তাহা হইলে একমাত্র অদ্বৈতবাদ" (পৃষ্ঠা ১০২)
আবার অন্য স্থানে উনি নিজেই বলেছেন, "প্রকৃত ধর্মে—অন্ধবিশ্বাসবশতঃ কোন কিছু বিশ্বাস করা বা মানিয়া লওয়ার স্থান নাই। কোন ধর্মপ্রচারক মহাত্মা এরূপ প্রচার করেন নাই। অধঃপতনের সময়ে ইহা আসিয়া জোটে।" (পৃষ্ঠা ১৮৮)
কিন্তু ওপরের বক্তব্যে তো স্বামীজী স্বয়ং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সরাসরি বিরোধিতা করছেন, বিজ্ঞান-নির্ভর শিক্ষা ছাড়া তো যুক্তিবোধ গড়ে ওঠার বিকল্প রাস্তা নাই আবার অন্ধবিশ্বাস তো অশিক্ষারই নামান্তর মাত্র। বাস্তবে এটাও ওঁর আরেকটি দ্বিচারিতা মাত্র।
আসলে প্রশ্ন করা ধর্ম জগতের সবথেকে বড় পাপ। "ব্রহ্ম সত্য" এটা মেনে নিয়ে প্রশ্ন চলতে পারে। যেমন ব্রহ্ম সাকার না নিরাকার, উনি নকুল দানায় সন্তুষ্ট নাকি কাজু বরফিতে, বেলপাতায় সন্তুষ্ট নাকি ১০ ভরি সোনার হারে। এরকম গুরুগম্ভীর প্রশ্ন চলতেই পারে কিন্তু ব্রহ্মকে মেনে নিয়েই। কিন্তু পড়াশোনা শিখলে বিচার, বুদ্ধি, যুক্তিবোধ তৈরী হলে প্রশ্ন আসবেই তাই এইসব ধর্মব্যবসায়ীদের বিধান আগে ব্রহ্ম লাভ তারপর সবকিছু।
(আগ্রহী পাঠকেরা শ্রী সুনিত দে মহাশয়ের লেখা "শ্রীরামকৃষ্ণ কিছু অজানা প্রসঙ্গ" পড়ে দেখতে পারেন)।
২৬) "কাজেই পূর্ণসাম্যাবস্থা কখনই লাভ করা যায় না—এ-কথা বলিবার অধিকার আমাদের নাই। সাম্যাবস্থায় কোনরূপ বৈচিত্র্য থাকা অসম্ভব, উহাকে বৈচিত্র্যহীন হইতেই হইবে।" (পৃষ্ঠা ২১৫)
মতামত: পুনঃপুন সেই এক দ্বিচারিতা। একটু পরে স্বামীজী নিজেই বলেছেন, "জোরের সহিত এরূপও বলা হয় যে, জড়দেহে এবং সামাজিক শ্রেণী-বিভাগে সম্পূর্ণ সমতা স্বাভাবিক মৃত্যু আনে এবং সমাজের বিলোপ সাধন করে।" (পৃষ্ঠা ২৫৬)
দুটি বক্তব্য সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।
২৭) "এক জাতি বা এক যুগের পক্ষে যাহা পুরাণ, অন্য জাতি বা যুগের নিকট তাহাই ইতিহাস।" (পৃষ্ঠা ২২৩)
মতামত: বিভিন্ন রূপকথার গল্পগাঁথাকেও স্বামী বিবেকানন্দ ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন, বিজেপি আরএসএস-কে দোষ দিয়ে লাভ কী?
ইতিহাসের সঙ্গে পৌরাণিক কাহিনির বেশ কিছু পার্থক্য লক্ষ করা যায়। এই পার্থক্যগুলি হল -
চরিত্রগত পার্থক্যঃ পৌরাণিক কাহিনীতে বিভিন্ন ঈশ্বরের কর্মকাণ্ড ও তাঁদের শক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। পৌরাণিক কাহিনীগুলির নায়ক - নায়িকা হলেন দেবদেবীরা। অন্যদিকে ইতিহাসে গুরুত্ব আরোপ করা হয় মানুষের কর্মকাণ্ড ও শক্তির ওপর, সেই দিক থেকে দেখলে ইতিহাসের নায়ক - নায়িকা হল মানবমানবী, ইতিহাস হল মানুষের কাহিনি।
ভিত্তিগত পার্থক্যঃ পৌরাণিক কাহিনীগুলি ধর্মভিত্তিক হয়। পৃথিবীর সৃষ্টি, মানুষের সৃষ্টির পৌরাণিক ব্যাখ্যা দেয় কিন্তু ইতিহাসের কর্মকাণ্ড পৃথিবী ও মানুষের সৃষ্টির যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা তুলে ধরে।
লক্ষণগত পার্থক্যঃ পৌরাণিক কাহিনীর প্রধান লক্ষ্য ঈশ্বরের মাহাত্ম্য প্রচার ও মানুষকে নৈতিক জ্ঞানদান করা কিন্তু ইতিহাসের প্রধান লক্ষ্য সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা।
বাস্তবতার পার্থক্যঃ পৌরাণিক কাহিনীর কল্পনার আধিক্য বেশি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো বাস্তবতা নেই, নেই কোনো তথ্য বা প্রমাণ কিন্তু ইতিহাসের বাস্তবতা আছে। প্রতিটি ঘটনার তথ্য বা প্রমাণ থাকে। তথ্য বা প্রমাণ ছাড়া ইতিহাস হতে পারে না।
সময়গতঃ পৌরাণিক কাহিনীগুলির সময়ের ভিত্তিতে কোনো ধারাবাহিকতা বা কালপঞ্জি থাকে না কিন্তু ইতিহাসের সময়ের ভিত্তিতে ধারাবাহিকতা ও সঠিক কালপঞ্জি থাকে।
২৮) "অধিকার-বিলোপ আমরা নিশ্চয়ই ঘটাইতে পারি। সমগ্র জগতের সম্মুখে ইহাই যথার্থ কাজ। প্রত্যেক জাতি ও প্রত্যেক দেশের সামাজিক জীবনে ইহাই একমাত্র সংগ্রাম। এক শ্রেণীর লোক অপর শ্রেণীর লোক অপেক্ষা স্বভাবতই বেশী বুদ্ধিমান—ইহা আমাদের সমস্যা নয়; আমাদের সমস্যা হইল এই যে, বুদ্ধির আধিক্যের সুযোগ লইয়া এই শ্রেণীর লোক অল্পবুদ্ধি লোকেদের নিকট হইতে তাহাদের দৈহিক সুখস্বাচ্ছন্দ্যও কাড়িয়া লইবে কিনা। এই বৈষম্যকে ধ্বংস করিবার জন্যই সংগ্রাম। কেহ কেহ অন্যান্য ব্যক্তি অপেক্ষা অধিকতর দৈহিক বলশালী হইবে এরূপে স্বভাবতই দুর্বল লোকদিগকে দমন বা পরাজয় করিতে সমর্থ হইবে—ইহা তো স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার, কিন্তু এই শারীরিক শক্তির জন্য তাহারা জীবনের যাহা কিছু সুখস্বাচ্ছন্দ্য লাভ করা যায়, তাহাই নিজেদের জন্য কাড়িয়া লইবে—এই প্রকার অধিকার-বোধ তো নীতিসম্মত নয় এবং ইহার বিরুদ্ধেই সংগ্রাম চলিয়া আসিতেছে। একদল লোক স্বভাবসিদ্ধ প্রবণতাবশতঃ অন্যের অপেক্ষা বেশী ধনসঞ্চয় করিতে পারিবে—ইহা তো স্বাভাবিক। কিন্তু ধনসঞ্চয়ের এই সামর্থ্য-হেতু তাহারা অসমর্থ ব্যক্তিদের উৎপীড়ন এবং নিষ্ঠুরভাবে পদদলিত করিবে—ইহা তো নীতিসম্মত নয়; এই অধিকারের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম চলিয়া আসিতেছে। অন্যকে বঞ্চিত করিয়া নিজে সুবিধা ভোগ করার নামই অধিকারবাদ এবং যুগযুগান্ত ধরিয়া নীতিধর্মের লক্ষ্য এই অধিকারবাদকে ধ্বংস করা। বৈচিত্র্যকে নষ্ট না করিয়া সাম্য ও ঐক্যের দিকে অগ্রসর হওয়াই একমাত্র কাজ।
এই-সকল বৈচিত্র্য পার্থক্য অনন্তকাল বিরাজ করুক। এই বৈচিত্র্য জীবনের অপরিহার্য সারবস্তু। এভাবেই আমরা অনন্তকাল খেলা করিব। তুমি হইবে ধনী এবং আমি হইব দরিদ্র; তুমি হইবে বলবান্ এবং আমি হইব দুর্বল; তুমি হইবে বিদ্বান্ এবং আমি হইব মূর্খ; তুমি হইবে অত্যন্ত আধ্যাত্মিক-ভাবাপন্ন, আমি হইব অল্প আধ্যাত্মিক। তাহাতে কি আসে যায়? আমাদিগকে এরূপই থাকিতে দাও, কিন্তু তুমি আমা অপেক্ষা শারীরিক ও মানসিক শক্তিতে অধিকতর বলবান্ বলিয়া আমা অপেক্ষা বেশী অধিকার ভোগ করিবে, ইহা হইতে পারে না; আমা অপেক্ষা তোমার ধনৈশ্বর্য বেশী আছে বলিয়া তুমি আমা অপেক্ষা বড় বিবেচিত হইবে, ইহাও হইতে পারে না, কারণ অবস্থার পার্থক্য সত্ত্বেও আমাদের ভিতরে সেই একই সমতা বর্তমান।
বাহ্যজগতে পার্থক্যের বিনাশ এবং সমতার প্রতিষ্ঠা—কখনই নৈতিক আচরণের আদর্শ নয়, এবং কখনও হইবে না। ইহা অসম্ভব, ইহা মৃত্যু ও ধ্বংসের কারণ হইবে।" (পৃষ্ঠা ২৬০)
মতামত: সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের প্রতি নির্লজ্জ অনুগত্য প্রদর্শন।
যুগ যুগ ধরে ঠিক এইভাবেই ধর্মব্যবসায়ীরা সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের মনে পরজন্ম, কর্মফল, পাপ, পুণ্য নামক কুসংস্কারগুলোকে রোপন করে, সমাজের সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের শ্রমজীবী মানুষকে শোষনের ক্ষেত্রকে প্রস্তুত করেছে। স্বামী বিবেকানন্দের এই বক্তব্য সেই শোষণভিত্তিক কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই।
২৯) "ভারতের যাবতীয় মনোবিজ্ঞান একই প্রকার, উহা প্রাচীন সাংখ্য মনস্তত্ত্বের অনুরূপ।" (পৃষ্ঠা ২৬২)
মতামত: স্বামীজীর জানা ছিল না যে বিজ্ঞান কোনোদিন কোনো দেশের, ধর্মের, বর্ণের বা জাতির হতে পারে না।
৩০) "যাঁহারা উপনিষদ্ পাঠ করিয়াছেন, তাঁহারা জানেন যে, উপনিষদই বারংবার বলিতেছে, ‘শুধু পড়িয়া শুনিয়া কেহ আত্মজ্ঞান লাভ করিতে পারে না।’" (পৃষ্ঠা ২৭৭)
মতামত: স্বামীজী তাঁর ভক্তদের আধুনিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে নির্গুণ ব্রহ্মের খোঁজ নিয়ে ব্যস্ত রাখতে বিশেষ আগ্রহী।
৩১) "আমরা সকলেই ইন্দ্রিয়ের দাস, নিজেদের চেতন ও অবচেতন মনের দাস। কোন অপরাধী যে স্বেচ্ছায় কোন অপরাধ করে—তাহা নয়, শুধু নিজের মন তাহার আয়ত্তে না থাকাতেই সে ঐরূপ করিয়া থাকে, এবং এইজন্য সে তাহার চেতন ও অবচেতন মনের, এমন কি প্রত্যেকের মনেরও দাস হয়। সে নিজ মনের প্রবলতম সংস্কারবশেই চালিত হয়। সে নিরুপায়। সে নিজ মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে—বিবেকের কল্যাণকর নির্দেশ এবং নিজের সৎস্বভাবের বিরুদ্ধে চলিতে থাকে। সে তাহার মনের প্রবল নির্দেশ মানিয়া চলিতে বাধ্য হয়। বেচারী মানুষ নিতান্তই অসহায়।" (পৃষ্ঠা ২৯৫)
"দাগী চোর-ডাকাতেরা, মিথ্যাবাদীরা, অন্যায়কারী নর-নারী—সকলেই নিজ নিজ অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঐরূপ হইয়া গিয়াছে। ইহা সত্যই মনস্তত্ত্বের একটি বড় সমস্যা। মানুষের বিচার—আমাদিগকে অতি উদার সহৃদয় দৃষ্টি লইয়াই করিতে হইবে।" (পৃষ্ঠা ৩৪৭)
মতামত: ব্যাস আর কী! দেশের সব চোর, ডাকাত, খুনি, ধর্ষক, সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের জেল থেকে বের করে রামকৃষ্ণ মিশনে পাঠিয়ে দেওয়া হোক।
৩২) "তোমাদের নিকট প্রথমে আমার নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ কয়েকটি ঘটনারই উল্লেখ করিব। একবার এক ব্যক্তির কথা শুনিয়া-ছিলাম; মনে মনে কোন প্রশ্ন ভাবিয়া তাঁহার কাছে যাওয়া মাত্রই তিনি সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়া দিতেন; আরও শুনিয়াছিলাম, তিনি ভবিষ্যদ্বাণীও করেন। মনে কৌতূহল জাগিল; তাই কয়েকজন বন্ধুসঙ্গে তাঁহাকে দেখিতে গেলাম। প্রত্যেকেই মনে মনে কোন-না-কোন প্রশ্ন ঠিক করিয়া রাখিলাম এবং পাছে ভুল হয়, সেজন্য প্রশ্নগুলি এক এক খণ্ড কাগজে লিখিয়া নিজ নিজ জামার পকেটে রাখিয়া দিলাম। আমাদের এক একজনের সঙ্গে তাঁহার যেমনি দেখা হইতে লাগিল, অমনি তিনি তাঁহার প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করিয়া উত্তর বলিয়া দিতে লাগিলেন। পরে একখণ্ড কাগজে কি লিখিয়া কাগজটি ভাঁজ করিয়া আমার হাতে দিলেন, এবং তাহার অপর পিঠে আমাকে নাম স্বাক্ষর করিতে অনুরোধ করিয়া বলিলেন, ‘এটি দেখিবেন না, পকেটে রাখিয়া দিন; যখন বলিব, তখন বাহির করিবেন।’ আমাদের সকলের সঙ্গেই এই রকম করিলেন। তারপর আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনে ঘটিবে, এমন কয়েকটি ঘটনার কথাও বলিলেন। অবশেষে বলিলেন, ‘আপনাদের যে ভাষায় খুশী, কোন শব্দ বা বাক্য চিন্তা করুন।’ আমি সংস্কৃত ভাষায় একটি প্রকাণ্ড বাক্য মনে মনে আওড়াইলাম; সংস্কৃতের বিন্দু-বিসর্গও তিনি জানিতেন না। তিনি বলিলেন, ‘পকেট হইতে কাগজটি বাহির করুন তো!’ দেখি, তাহাতে সেই সংস্কৃত বাক্যটিই লেখা রহিয়াছে! এক ঘণ্টা আগে তিনি এটি লিখিয়াছিলেন, আর নীচে মন্তব্য দিয়াছিলেন, ‘যাহা লিখিয়া রাখিলাম, ইনি পরে সেই বাক্যটিই ভাবিবেন’—ঠিক তাহাই হইল। আমাদের অন্য একজন বন্ধুকেও অনুরূপ একখানি কাগজ দিয়াছিলেন, এবং তিনিও তাহা স্বাক্ষর করিয়া পকেটে রাখিয়াছিলেন। এখন বন্ধুটিকেও একটি বাক্য চিন্তা করিতে বলিলে তিনি কোরানের একাংশ হইতে আরবী ভাষায় একটি বাক্য ভাবিলেন। ঐ ব্যক্তির সে ভাষা জানিবার সম্ভাবনা ছিল আরও কম। বন্ধুটি দেখিলেন, সেই বাক্যটিই কাগজে লেখা আছে।
সঙ্গীদের মধ্যে আর একজন ছিলেন ডাক্তার। তিনি জার্মান ভাষায় লিখিত কোন ডাক্তারি পুস্তক হইতে একটি বাক্য ভাবিলেন। তাঁহার কাগজে তাহাই পাওয়া গেল।
সেদিন হয়তো কোনরূপ প্রতারিত হইয়াছি ভাবিয়া কিছুদিন পরে আমি আবার সেই ব্যক্তির নিকট গেলাম। সেদিন আমার সঙ্গে নূতন আর একদল বন্ধু ছিলেন। সেদিনও তিনি অদ্ভুত সাফল্যের পরিচয় দিয়াছিলেন।" (পৃষ্ঠা ২৯৯)
মতামত: সামন্তবাদী প্রভুদের স্বার্থে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে অন্ধবিশ্বাসের বীজ বপন করতে উদ্যত স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ। এরকম উদাহরণ আরো আছে।
যদি স্বামীজীর কথা সত্যি হয়, সেক্ষেত্রে এমন একজন সিদ্ধ পুরুষ জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমাদের দেশের মানুষকে আগেভাগে সতর্ক করলেন না কেন - সে প্রশ্ন থেকেই যায়!
৩৩) "কোন হ্রদের তলদেশ হইতে একটি বুদ্বুদ উঠিতেছে; যখন হ্রদের উপরে উঠিয়া উহা ফাটিয়া যায়, তখনই মাত্র উহা আমাদের নজরে পড়ে, তলদেশ হইতে উপরে উঠিয়া আসিবার মধ্যে কোন সময়ই সেটিকে দেখিতে পাই না।" (পৃষ্ঠা ৩০৫)
মতামত: আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে এখন বুদবুদের শুরু থেকে শেষ অবধি ক্যামেরা বন্দি করা যায়; আজকের দিনে দাঁড়িয়ে রামকৃষ্ণ মিশন স্বামীজীর এই অবৈজ্ঞানিক বক্তব্যটাকে অসার ও ভিত্তিহীন বলে স্বীকার করবে কী?
৩৪) "অর্থ ও অন্যান্য জাগতিক বস্তু দান করিয়া অপরকে সাহায্য করা বা দৈনন্দিন জীবনে কিভাবে নির্ঝঞ্ঝাটে চলা যায়, তাহা শিক্ষা দেওয়া—এ-সব নিতান্তই তুচ্ছ আনুষঙ্গিক কার্য মাত্র।" (পৃষ্ঠা ৩০৭)
মতামত: রামকৃষ্ণ মিশন তার ভক্তকুলের থেকে আর্থিক দান গ্রহণ করা বন্ধ করলে, ভক্তকুল এইসব তুচ্ছ আনুষঙ্গিক কাজগুলো থেকে মুক্ত হবে।
৩৫) "বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ অর্থে ইহাই বুঝিতে হয় যে, কতগুলি তথ্যকে এমন সাধারণ স্তরে নামাইয়া আনা হইবে যে, ঐগুলি সকল মানুষের পক্ষে সমভাবে গ্রহণীয় হইবে, ঐগুলি সকলের দ্বারা অনুভূত হইবে, তাহা হইলে কোন বিষয়ে যে এইরূপ কোন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ সম্ভব—ইহা আমি সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করি।" (পৃষ্ঠা ৩১২)
মতামত: এক মূর্খ চাষার বাড়িতেও একটা সুইচের সাহায্যে আলো জ্বলে - বিজ্ঞান সাধারণ স্তরে গ্রহণীয় ও অনুভূত হওয়া অসম্ভব কিছু নয়!
৩৬) "নিজ মস্তিষ্ক সম্পর্কে কেহই সচেতন নয়। আমি আমার মস্তিষ্ক কখনই দেখি নাই, এবং ইহার সম্পর্কে আমি কোন সময়েই সচেতন নই। তথাপি আমি জানি, মস্তিষ্ক আছে।" (পৃষ্ঠা ৩১৪)
মতামত: বর্তমানে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব আবিষ্কারের ফলে ইহাও সম্ভব হয়েছে। এগুলো ধর্ম, বেদান্ত দিয়ে সম্ভবপর হয়নি, সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানের অগ্রগতির দ্বারা।
৩৭) "ভারতে কিন্তু এমন লোকও আছে, যে বিশ্বাস করে—মন্ত্রশক্তির দ্বারা অর্থলাভ সম্ভব। তাই সেখানে দেখা যাইবে যে, ধনাকাঙ্ক্ষী হয়তো বৃক্ষতলে বসিয়া মন্ত্রের মাধ্যমে ধন কামনা করিতেছে। (চিন্তার) শক্তিতে সব-কিছু তাহার নিকট আসিতে বাধ্য।" (পৃষ্ঠা ৩২১)
মতামত: এত মন্ত্রোচ্চারণের পরেও এই ধর্মবিশ্বাসীদের দেশে জাতীয় আয়ের ৫৭ শতাংশের মালিক জনসংখ্যার উপরের দিকের ১০ শতাংশ আর সেখানে নীচের ৫০ শতাংশের উপার্জন, জাতীয় আয়ের মাত্র ১৩.১ শতাংশ। সামন্ততন্ত্রের তাঁবেদার স্বামী বিবেকানন্দ এই বৈষম্যের মূলে আঘাত করতে অপারগ।
https://bengali.abplive.com/news/world-inequality-report-2022-india-poor-very-unequal-country-851565
৩৮) "যদি তুমি তোমার দেয় অংশ উঠাইয়া লইতে সমর্থ হও, তবে জলের উপর দিয়াও তুমি হাঁটিতে পারিবে। জল আর তোমাকে ডুবাইবে কেন?" ( পৃষ্ঠা ৩৩২)
"ধ্যানাভ্যাসই জ্ঞানলাভের বিজ্ঞানসম্মত পন্থা। ধ্যানের শক্তি ব্যতীত জ্ঞান হয় না। ধ্যানশক্তির প্রয়োগে অজ্ঞান, কুসংস্কার ইত্যাদি হইতে আমরা সাময়িকভাবে মুক্ত হইতে পারি, ইহার বেশী নয়। মনে কর, এক ব্যক্তি আমাকে বলিয়াছে যে, এই বিষ পান করিলে মৃত্যু হইবে এবং আর এক ব্যক্তি রাত্রে আসিয়া বলিল, ‘যাও, বিষ পান কর!’ এবং বিষ খাইয়াও আমার মৃত্যু হইল না (যাহা ঘটিল তাহা এই)—ধ্যানের ফলে বিষ ও আমার নিজের মধ্যে একত্ববোধ হইতে সাময়িকভাবে আমার মন বিচ্ছিন্ন হইয়াছিল। অপর পক্ষে সাধারণভাবে বিষ পান করিতে গেলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী ছিল।
যদি আমি কারণ জানি এবং বৈজ্ঞানিক উপায়ে আমাকে ধ্যানের অবস্থায় উন্নীত করি, তবে যে-কোন লোককেই আমি বাঁচাইতে পারি। এই কথা (যোগ)-গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে, কিন্তু ইহা কতখানি নির্ভুল, তাহার বিচার তোমরাই করিও।" (পৃষ্ঠা ৩৩৩)
"যোগীদের মধ্যে কেহ কেহ দাবী করেন যে, এই শরীর তরল বাষ্প ইত্যাদিতে পরিণত হইবে। তুমি শরীর দ্বারা যাহা খুশী করিতে পারিবে—ইহাকে ছোট করিতে পার, এমন কি বাষ্পেও পরিণত করিতে পার, এই দেওয়ালের মধ্য দিয়া যাতায়াতও সম্ভব হইতে পারে—এই রকম তাঁহারা দাবী করেন। আমার অবশ্য তাহা জানা নাই। আমি কখনও কাহাকেও এরূপ করিতে দেখি নাই। কিন্তু যোগশাস্ত্রে এই-সব কথা আছে। যোগশাস্ত্রগুলিকে অবিশ্বাস করিবার কোন হেতু নাই।" (পৃষ্ঠা ৩৩৬)
"তোমার নিজের প্রাণকে যেমন তুমি নিয়ন্ত্রিত করিতে পার, তেমনি যথেষ্ট শক্তিমান্ হইলে এখানে বসিয়াই ভারতে অবস্থিত অপর একজনের প্রাণকেও তুমি নিয়ন্ত্রিত করিতে পারিবে। সব প্রাণই এক, মাঝখানে কোন ছেদ নাই; একত্বই সর্বত্র বিদ্যমান।" (পৃষ্ঠা ৩৪৫)
"শরীরের ভিতরে যে-সব যন্ত্রের কাজকে আমরা স্বয়ংক্রিয় বলিয়া থাকি, যেমন যকৃতের ক্রিয়া, সেগুলিকে পর্যন্ত নিজের ইচ্ছাধীন করা যায়।" (পৃষ্ঠা ৩৪৯)
মতামত: মুখে কুসংস্কার বিরোধিতার বুলি আওড়ে বাস্তবে সাধারণ জনগণের মধ্যে কুসংস্কারের প্রচার।
৩৯) "মানসিক শক্তির দ্বারা লোকের রোগ সারাইতে আমি দেখিয়াছি। উহা ‘অলৌকিক কর্মী’র কাজ। আমরা বলি, তিনি প্রার্থনা করিয়া লোককে নীরোগ করেন। (কিন্তু) কেহ বলিবেন, ‘না, মোটেই না, ইহা কেবল তাঁহার মনের শক্তির ফল। লোকটি বৈজ্ঞানিক। তিনি জানেন, তিনি কি করিতেছেন।’
ধ্যানের শক্তি আমাদিগকে সব কিছু দিতে পারে। যদি তুমি প্রকৃতির উপর আধিপত্য চাও, (ইহা ধ্যানের অনুশীলনেই সম্ভব হইবে)। আজকাল বিজ্ঞানের সকল আবিষ্ক্রিয়াও ধ্যানের দ্বারাই হইতেছে।" (পৃষ্ঠা ৩৩২)
মতামত: সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন মন্তব্য। স্বামী বিবেকানন্দের গুরু রামকৃষ্ণদেবের শরীর খারাপের সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় এমডি ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার দেখতেন, মানসিক শক্তি দিয়ে রোগীকে কিন্তু সারানো যায়নি। এইসব এইসব ধর্মের ঠিকাদাররা ভক্তদের যা জ্ঞান দেন, সেগুলো নিজেদের জীবনে তখনও মানেননি আর এখনও মানেন না।
আজকের দিনে ভারতের যোগগুরু বলে খ্যাতনামা বাবা রামদেবকেও প্রাণে বাঁচতে সেই আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপরই নির্ভর করতে হয়।
https://www.bbc.com/bengali/news/2011/06/110606_mb_ramdev_hospital
"যদি বেঁচে যাও এবারের মতো
যদি কেটে যায় মৃত্যুর ভয়
জেনো বিজ্ঞান লড়েছিলো একা
মন্দির মসজিদ নয়"
৪০) "মেয়েরাও পুরুষদের মত সমান সাহসী। নিজ নিজ ভাবে প্রত্যেকেই ভাল। নারী যে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও স্নেহ লইয়া সন্তান পালন করে, কোন্ পুরুষ সেভাবে তাহা করিতে পারে? একজন কর্মশক্তিকে বাড়াইয়া তুলিয়াছে, অপরজন বাড়াইয়াছে সহনশক্তি। যদি বল, মেয়েরা তো শারীরিক শ্রম করিতে পারে না, তবে বলিব, পুরুষরাও তো সহ্য করিতে পারে না। সমগ্র জগৎটি একটি নিখুঁত ভারসাম্যের ব্যাপার।" (পৃষ্ঠা ৩৪১)
মতামত: মনুবাদী মতের সমর্থন।
মনুসংহিতার ৯/২৬ শ্লোকে আমরা দেখতে পাই - সন্তানের হেতু স্ত্রীলোকেরা বহুকল্যাণভাজন, (বস্ত্রালংকারাদি দ্বারা) পুজনীয়া, গৃহশোভাকারিণী ; গৃহে স্ত্রীলোক ও শ্ৰী (লক্ষ্মী)তে কোন ভেদ নেই।
আর ৯/২৭ শ্লোকে আছে - সন্তানোৎপাদন, জাতসন্তানের প্রতিপালন ও প্রতিদিন (অতিথিসেবাদি) লোক-ব্যবহারের প্রত্যক্ষ কারণ স্ত্রী। (মনুসংহিতা – অনুবাদ : সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়)
৪১) "পতিতা নারীকে দেখিয়া আমাকে নাসিকা কুঞ্চিত করিতে হয়, কারণ সমাজ তাহাই চায়, যদিও সে আমার ত্রাণকর্ত্রী, যদিও তাহার পতিতাবৃত্তির ফলে অপর স্ত্রীলোকের সতীত্ব রক্ষা পাইতেছে। কথাটি ভাবিয়া দেখ।" (পৃষ্ঠা ৩৪৮)
মতামত: স্বামীজী দ্বিতীয় খণ্ডে নিজেই বলেছিলেন, " জনৈক সাধু বৃক্ষতলে বসিয়া লোককে ধর্মোপদেশ দিতেন। তিনি শুধু দুধ ও ফলমূল আহার করিয়া এবং প্রাণায়ামাদি অভ্যাস করিয়া নিজেকে খুব পবিত্র মনে করিতেন। সেই গ্রামে এক চরিত্রহীনা নারী বাস করিত। দুষ্কার্যের জন্য নরকে যাইতে হইবে—এই বলিয়া সাধু প্রত্যহই ঐ নারীর নিকট গিয়া তাহাকে সাবধান করিয়া দিতেন। হতভাগিনী তাহার জীবিকা উপার্জনের একমাত্র পথ পরিবর্তন করিতে অক্ষম হইয়া সাধু-কথিত ভয়াবহ পরিণামের চিন্তায় শঙ্কিত হইয়া থাকিত। নিরুপায় ঐ নারী কাঁদিয়া, ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিয়া ক্ষমা ভিক্ষা করিত। এই সাধু ও ভ্রষ্টা নারীর মৃত্যু হইলে দেবদূতেরা আসিয়া সেই নারীটিকে স্বর্গে লইয়া গেল, আর যমদূতেরা আসিয়া সাধুর আত্মা দাবী করিল। সাধু উচ্চৈঃস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘একি? আমি কি কঠোর সাধুজীবন যাপন করিয়া সকলের মধ্যে ধর্ম প্রচার করি নাই? আমি কেন নরকে যাইব, আর এই ভ্রষ্টা নারী স্বর্গে যাইবে?’ যমদূতগণ বলিল, ‘নারীটি দেহ দ্বারা পাপ কাজ করিতে বাধ্য হইলেও তাহার মন সর্বদা ভগবানে নিবিষ্ট ছিল এবং সে মুক্তি কামনা করিয়াছিল। সেই মুক্তি এখন সে লাভ করিয়াছে। আর তুমি বাহিরে ধর্ম-কার্য করিয়াছ, তোমার মন কিন্তু অপরের পাপের দিকেই সর্বদা নিবিষ্ট থাকিত। তুমি পাপই দেখিয়াছ, পাপই চিন্তা করিয়াছ; সুতরাং যেখানে কেবলই পাপ, তোমাকে সেই স্থানেই যাইতে হইবে।’ এই গল্পের শিক্ষণীয় বিষয়টি অতি স্পষ্টঃ বাহ্য জীবন যাপনের দ্বারা কোন ফলই হয় না। হৃদয় পবিত্র হওয়া চাই; পবিত্রহৃদয় ব্যক্তি পাপ না দেখিয়া কেবল পুণ্যই দেখে। মানবজাতির অভিভাবক অথবা পাপীতাপীর উদ্ধারকর্তা সাধুরূপে দাঁড়াইবার চেষ্টা করা আমাদের পক্ষে উচিত নয়। তাহার পরিবর্তে নিজদিগকে পবিত্র করিতে চেষ্টা করিব। ইহার ফলে আমরা অপরের ধর্মলাভেরও সহায় হইতে পারিব।" (পৃষ্ঠা ৩২২)
দুটি বক্তব্য সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।
৪১) "পতিতা নারীকে দেখিয়া আমাকে নাসিকা কুঞ্চিত করিতে হয়, কারণ সমাজ তাহাই চায়, যদিও সে আমার ত্রাণকর্ত্রী, যদিও তাহার পতিতাবৃত্তির ফলে অপর স্ত্রীলোকের সতীত্ব রক্ষা পাইতেছে। কথাটি ভাবিয়া দেখ।" (পৃষ্ঠা ৩৪৮)
দুটি বক্তব্য সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।
আবার সমাজ সম্বন্ধে স্বামীজীর বক্তব্য হলো, "যে-কোন নীতিশাস্ত্র মানুষকে তাহার নিজ সমাজের গণ্ডীর মধ্যেই আবদ্ধ রাখিতে ইচ্ছা করে, তাহা সমগ্র মানবজাতির পক্ষে প্রযোজ্য নৈতিক বিধি ব্যাখ্যা করিতে অক্ষম।" (পৃষ্ঠা ৮৯)
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বক্তব্যে অপরাধীদের জন্যও সমবেদনা প্রকাশ করতে পারেন (দেখুন - ৩১) কিন্তু গতর খাটিয়ে জীবনধারণ করা এক নারীর জন্য তাঁর কোনো সমবেদনা নেই।
৪২) "ধর্ম হইতে আমরা যে-সকল তথ্য ও তত্ত্ব শিক্ষা করিতে পারি, যে-সান্ত্বনা পাইতে পারি, তাহা ছাড়িয়া দিলেও ধর্ম অন্যতম বিজ্ঞান অথবা গবেষণার বস্তু হিসাবে মানব-মনের শ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক কল্যাণকর অনুশীলনের বিষয়।" (পৃষ্ঠা ৯১)
"বিজ্ঞানগুলির জ্ঞান যেন আমাদের জীবনের একটুখানি অংশ জুড়িয়া আছে। কিন্তু ধর্ম আমাদের কাছে যে জ্ঞান লইয়া আসে, তাহা চিরন্তন; ধর্ম যে সত্যের কথা প্রচার করে, সে সত্যের মত এ জ্ঞানও সীমাহীন।" (পৃষ্ঠা ৯৪)
"পদার্থবিদ্যা বা রসায়নের সিদ্ধান্তগুলি যতখানি বিজ্ঞানসম্মত, ধর্ম যে অন্ততঃ ততখানি বিজ্ঞানসম্মত হইবে শুধু তাহাই নয়, বরং আরও বেশী জোরালো হইবে; কারণ জড়বিজ্ঞানের সত্যগুলির পক্ষে সাক্ষ্য দিবার মত অভ্যন্তরীণ আদেশ বা নির্দেশ কিছু নাই, কিন্তু ধর্মের তাহা আছে।" (পৃষ্ঠা ৯৫)
"উচ্চতম সামান্যীকরণ এবং বিবর্তনবাদের কথা বেদান্তে আছে বলিয়া বেদান্তের ধর্ম বৈজ্ঞানিক জগতের দাবী মিটাইতে পারে।" (পৃষ্ঠা ১০১)
"সমস্ত ধর্ম যে সত্যের সন্ধানে রত, যে সত্যের তুলনায় জড়বিজ্ঞানের সব জ্ঞানই গৌণ মাত্র, আমরা সেই সত্যের সন্ধান পাইয়াছি; ইহাই একমাত্র সত্যজ্ঞান, যাহা আমাদিগকে বিশ্বের এই বিশ্বজনীন ঈশ্বরের সঙ্গে এক করিয়া দেয়।" (পৃষ্ঠা ১০৮)
"প্রত্যেক জড়বিজ্ঞান ঐক্যের সন্ধান পাইলেই শেষ হইবে, কারণ ইহার বেশী আর আমরা যাইতে পারি না। পূর্ণ ঐক্যে পৌঁছিলে তত্ত্বের দিক্ দিয়া বিজ্ঞানের আর বেশী কিছুই বলিবার থাকে না।" (পৃষ্ঠা ২০৬)
"বিভিন্ন প্রকৃতি অনুযায়ী এই রাজযোগ-বিজ্ঞানের প্রয়োগ বিভিন্নভাবে হয়।" (পৃষ্ঠা ২২১)
"জড়বিজ্ঞানের বিপরীত অধ্যাত্ম বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে আজ সারা বিশ্বে এক মহা সোরগোল পড়িয়া গিয়াছে। আমাদের ঐহিক জীবন ও এই পরিদৃশ্যমান জগৎকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য আমাদের ইন্দ্রিয়জ্ঞানের সীমার বহির্ভূত সকল ভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা অতি দ্রুত একটি ফ্যাশনে পরিণত হইতেছে, এমন কি ধর্মপ্রচারকেরাও একের পর এক এই ফ্যাশনের নিকট আত্মসমর্পণ করিতেছেন। অবশ্য চিন্তাহীন জনসাধারণ সর্বদা সুখাবহ ভাবরাশিই অনুসরণ করে, কিন্তু যাঁহাদের নিকট অধিকতর জ্ঞান আশা করা যায়, তাঁহারা যখন নিজেদের দার্শনিক বলিয়া প্রচার করেন এবংঅর্থহীন ফ্যাশন অনুসরণ করেন, তখন উহা সত্যই শোচনীয়।" (পৃষ্ঠা ২২৫)
"যদি কেহ মনে করে, মানুষের সমগ্র জ্ঞান শুধু ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি—আর কিছু নয়, তবে আমরা ঐকথা অস্বীকার করিব। যদি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বলিতে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানই বুঝায়—তার বেশী আর কিছু নয়, তবে আমরা বলিব, এরূপ বিজ্ঞান কোন দিন ছিল না, কোন দিন হইবেও না। উপরন্তু শুধু ইন্দ্রিয়জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত কোন জ্ঞান কখনও বিজ্ঞান বলিয়া গৃহীত হইতে পারিবে না।" (পৃষ্ঠা ২২৬)
"এখন জড়বস্তু, শক্তি, মন, নিয়ম, কারণ, দেশ, কাল প্রভৃতি ভাবগুলি অতি উচ্চ বিমূর্তনের ফল; কেহই কোনদিন এগুলি ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করে নাই; অথবা বলা যায়, এগুলি একেবারে অতিপ্রাকৃতিক বা অতীন্দ্রিয় অনুভূতি। অথচ এগুলি ছাড়া কোন প্রাকৃতিক তথ্য বোঝা যায় না।" (পৃষ্ঠা ২২৬)
"পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিক একমাত্র অণু বা পরমাণুর মধ্যে ঐক্যের সন্ধান করেন। যখন তিনি উহা প্রাপ্ত হন, তখন তাঁহার আর কোন কিছু আবিষ্কার করিবার থাকে না। আর আমরা যখন আত্মার বা স্ব-স্বরূপের ঐক্য দর্শন করি, তখন আর অধিক অগ্রসর হইতে পারি না। আমাদের নিকট তখন ইহা স্পষ্টই প্রতিভাত হয় যে, সেই একমাত্র সত্তাই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের যাবতীয় বস্তুরূপে প্রতীত হইতেছে। অণুর নিজস্ব দৈর্ঘ্য বা বিস্তৃতি না থাকিলেও অণুগুলির মিশ্রণের ফলে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও বিস্তৃতির উদ্ভব হয়—এইপ্রকার কথা স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে বৈজ্ঞানিকদিগকে বাধ্য হইয়া অধ্যাত্মশাস্ত্রের সত্যতাও স্বীকার করিতে হয়।" (পৃষ্ঠা ২৩৯)
"এই-সকল বিভিন্ন কেন্দ্রকে নিয়ন্ত্রণ করিতে পারে, এইরূপ কোন একটি বিশেষ কেন্দ্র শারীরবিজ্ঞানে আবিষ্কৃত হয় নাই। সুতরাং ঐ-সকল বিভিন্ন কেন্দ্রের ঐক্য কোথায়, তাহা শারীরবিজ্ঞান আমাদের বলিতে পারে না। এই-সকল কেন্দ্রের ঐক্য কোথায় সংস্থাপিত? মস্তিষ্কস্থ কেন্দ্রগুলি পরস্পর-বিচ্ছিন্ন, এবং সকল কেন্দ্রকে নিয়ন্ত্রণ করিতে পারে—এরূপ কোন কেন্দ্র সেখানে নাই। সুতরাং ভারতীয় মনস্তত্ত্ব যতটুকু তথ্য আবিষ্কার করিয়াছে, তাহার বিরুদ্ধে আপত্তি করা চলে না।" (পৃষ্ঠা ২৬২)
"আমাদের এই শরীর জড়বস্তু নামে পরিচিত কতকগুলি কণিকার সমষ্টি মাত্র। ইহা অনুভূতিহীন ও অচেতন। বৈদান্তিকগণ যাহাকে সূক্ষ্মশরীর বলেন, তাহাও ঐরূপ। তাঁহাদের মতে এই সূক্ষ্মদেহটি স্বচ্ছ হইলেও জড়; ইহা অতি ক্ষুদ্র কণিকাদ্বারা গঠিত; এই কণিকাগুলি এত সূক্ষ্ম যে, অণুবীক্ষণ যন্ত্রসহায়েও সেগুলি দেখা যায় না।" (পৃষ্ঠা ২৬৩)
"নিউটনের জন্মের হাজার বছর আগে ভারতবাসীরা মাধ্যাকর্ষণের কথা জানিত।" (পৃষ্ঠা ৩০৮)
"যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করিলে মনের অসাধ্য কিছুই নাই—এই বিষয়ে ভারতীয় মনে এতখানি দৃঢ়বিশ্বাস আসিয়াছিল যে, মনঃশক্তির গবেষণাই তাহার মহান্ লক্ষ্য হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। তাঁহাদের নিকট সম্মোহন, যাদু ও এই জাতীয় অন্যান্য শক্তিগুলির কোনটিই অলৌকিক মনে হয় নাই। ইতঃপূর্বে ভারতীয়েরা যেভাবে যথানিয়মে জড়বিজ্ঞানের শিক্ষা দিতেন, তখন তেমনি যথা নিয়মে এই বিজ্ঞানটিও শিখাইতে লাগিলেন। এ বিষয়ে জাতির এত বেশী দৃঢ়-প্রত্যয় আসিয়াছিল যে, তাহার ফলে জড়বিজ্ঞান প্রায় লুপ্ত হইয়া গেল। তাহাদের দৃষ্টি নিবন্ধ রহিল শুধু এই একটি লক্ষ্যে।" (পৃষ্ঠা ৩০৮)
"সন্দেহাতীত সত্য বলিয়া বৈজ্ঞানিকেরা কিংবা সাধারণে বিশ্বাস করিতে পারেন—এইপ্রকার তত্ত্ব মাত্র দুই-তিনটিই আছে, অবশিষ্ট সবই শূন্যগর্ভ কল্পনা।" (পৃষ্ঠা ৩১৩)
"অনেক ক্ষেত্রেই উপস্থাপিত বিষয় সত্য নাও হইতে পারে, কিন্তু আবার অনেক ক্ষেত্রে আমরা নিজেরা সেই-সব প্রমাণ অনুধাবন করিবার উপযুক্ত কিনা এবং আমরা আমাদের দেহমনকে ঐ-সব আধ্যাত্মিক সত্য আবিষ্কারের উপযুক্ত আধাররূপে প্রস্তুত করিয়াছি কিনা, তাহা বিবেচনা করিতে ভুলিয়া যাই।" (পৃষ্ঠা ৩১৪)
"মুশকিল এই যে, অনেক ক্ষেত্রে যে-সকল অসাধারণ শক্তি তাহার আয়ত্তে আসিয়াছিল, অনুসন্ধান করিলে দেখা যায়, ঐগুলি কোন নিয়মিত বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাপ্রণালীর মাধ্যমে অর্জিত হয় নাই। যাহারা যাদুবলে সর্প বশীভূত করে, তাহাদের প্রাণ যায় সর্পাঘাতেই। ... কেহ যদি কোন অলৌকিক শক্তি লাভ করিয়া থাকে তো সে পরিণামে ঐ শক্তির কবলে পড়িয়াই বিনষ্ট হইবে। ভারতবর্ষে লক্ষ লক্ষ লোক নানাবিধ উপায়ে অলৌকিক শক্তি লাভ করে। তাহাদের অধিকাংশ উন্মাদরোগগ্রস্ত হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হয়। অনেকে আবার অপ্রকৃতিস্থ হইয়া আত্মহত্যা করে।" (পৃষ্ঠা ৩১৭)
"আমরা দার্শনিক দৃষ্টিতে দেখিয়াছি যে, আত্মা মন ভূত (জড় পদার্থ) প্রভৃতি নানা বৈচিত্র্যের (বাস্তব সত্তা কিছু নাই)। ... যাহা আছে, তাহা ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’। বহু কিছু থাকিতে পারে না। জ্ঞান এবং বিজ্ঞানের অর্থ ইহাই। অজ্ঞানের জন্যই বহু দেখি। জ্ঞানে একত্বের উপলব্ধি ...। বহুকে একে পরিণত করাই বিজ্ঞান ...। সমগ্র বিশ্বের একত্ব প্রমাণিত হইয়াছে। এই বিজ্ঞানের নাম বেদান্ত-বিদ্যা। সমগ্র জগৎ এক। আপাত প্রতীয়মান বৈচিত্র্যের মধ্যে সেই ‘এক’ অনুস্যূত হইয়া রহিয়াছে।" (পৃষ্ঠা ৩৩৫)
"কিন্তু একটি কথা তোমাদের স্মরণ রাখিতেই হইবে। ধর্মবিষয়ক কুসংস্কার যেমন আছে; বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও সেইরূপ কুসংস্কার আছে। এমন অনেক পুরোহিত আছেন, যাঁহারা ধর্মানুষ্ঠানকে নিজ জীবনের বৈশিষ্ট্যরূপে গ্রহণ করেন; তেমনি বৈজ্ঞানিক নামধেয় এমন অনেক আছেন, যাঁহারা প্রাকৃতিক নিয়মের পূজারী। ডারউইন বা হাক্সলির মত বড় বড় বৈজ্ঞানিকদের নাম করা মাত্র আমরা অন্ধভাবে তাঁহাদের অনুসরণ করি। এইটি আজকালকার চলিত প্রথা। যাহাকে আমরা বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান বলি, তাহার ভিতর শতকরা নিরানব্বই ভাগই হইতেছে নিছক মতবাদ। ইহাদের অনেকগুলি আবার প্রাচীনকালের বহু-মস্তক ও বহু-হস্তবিশিষ্ট ভূতে অন্ধ বিশ্বাস অপেক্ষা কোন অংশে উৎকৃষ্ট নয়; তবে পার্থক্য এইটুকু যে, কুসংস্কার হইলেও উহাতে মানুষকে গাছপাথর প্রভৃতি অচেতন পদার্থ হইতে অন্ততঃ খানিকটা আলাদা বলিয়া ভাবা হইত। যথার্থ বিজ্ঞান আমাদের সাবধানে চলিতে বলে। পুরোহিতদের সঙ্গে ব্যবহারে যেমন সতর্ক হইয়া চলিতে হয়, বিজ্ঞানীদের বেলায়ও তেমনি সতর্কতা আবশ্যক। অবিশ্বাস লইয়া শুরু কর। বিশ্লেষণ করিয়া পরীক্ষা করিয়া, সব প্রমাণ পাইয়া তবে বিশ্বাস কর। আধুনিক বিজ্ঞানের অতিপ্রচলিত বিশ্বাস এখনও প্রমাণোত্তীর্ণ হয় নাই। অঙ্কশাস্ত্রের মত বিজ্ঞানের ভিতরেও অনেকগুলি মতবাদই শুধু কাজ চালাইয়া যাইবার উপযুক্ত সাময়িক সিদ্ধান্ত হিসাবে গৃহীত হইয়াছে। উচ্চতর জ্ঞানের উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি বাতিল হইয়া যাইবে।" (পৃষ্ঠা ৩৪৩)
মতামত: প্রতিটি অবান্তর যুক্তি-বিবর্জিত মন্তব্য। যে কোনো উপায়ে, বিভিন্নরকম কু-যুক্তির উপস্থাপনা করে বিজ্ঞানের ওপর ধর্মের জয়যাত্রা সুনিশ্চিত করতে উদ্যত স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ।
ধর্মবিশ্বাসীরা আমাদের আশেপাশের কতিপয় বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞানী বা চিকিৎসকদের স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি অনুরাগকে সম্বল করে ওঁকে অভ্রান্ত হিসেবে তুলে ধরতে চান কিন্তু বাস্তবে এই মানুষগুলোও স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে প্রচারের শিকার।
এঁরা সামাজিক বা পারিবারিক ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণেই স্বামীজীর প্রতি অনুরক্ত, তার বেশি কিছু নয় (এরকম মনে করার কোনো কারণ নেই যে এঁরা স্বামীজীর প্রতিটি লেখা খুব খুঁটিয়ে পড়ে তারপর তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়েছেন) আর স্বামীজীর এই বক্তব্যগুলো ওঁদের সামনে রাখলে ওঁরাও এইসব আজগুবি, অবান্তর, কাঁঠালের আমসত্ত্ব মার্কা কথাবার্তাগুলোকে মান্যতা দিতে পারবেন না।
No comments:
Post a Comment